মেঘ-বৃষ্টি
১
হঠাৎ ঢুকলে অস্বস্তি হয়।
মনে হয়, সবকটা আলো ঠিকমতো জ্বালানো হয়নি। এত বড় ঘরে নিশ্চয় আরও আলো আছে। সময় হলে সেগুলো জ্বালানো হবে। একটু পরে বোঝা যায়, ব্যবস্থাই এরকম। ঘরে সবসময় একটা আলো-ছায়া ভাব করে রাখা আছে। মনে হয়, ঘরের ভেতর মানুষ, আসবাব কোনওটাই খুব স্পষ্ট নয়। আবার খুব অস্পষ্টও নয়। খানিকটা সময় থাকার পর ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসে।
‘কাননবালা কনস্ট্রাকশন’ কোম্পানির কর্ণধার আদ্যনাথ বসু এই আলো-ছায়া ঘরের এক কোণে নিজের টেবিলের সামনে বসে আছেন। তাকিয়ে আছেন কম্পিউটারের দিকে। দেখলে মনে হবে, কয়েক কোটি টাকার মালিক এই আটান্ন বছরের মানুষটি গভীর মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারের পরদায় জরুরি কিছু দেখছেন। গত তিন বছরের ব্যালান্স শিট অথবা আগামী কোনও প্রকল্পের জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং।
ঘটনা কিন্তু তা নয়। আদ্যনাথবাবু এখন তাকিয়ে আছেন তাঁর কম্পিউটারের স্ক্রিন-সেভার ছবিটার দিকে। কম্পিউটারে যখন কোনও কাজ হয় না তখন এই ছবি পরদায় ভেসে থাকে। আদ্যনাথবাবুর ঠোঁটের কোণে ছেলেমানুবি ধরনের একটা সামান্য হাসি। চোখে মুগ্ধ ভাব। যখনই তিনি এই ছবিটা দেখেন চোখে এই মুগ্ধ ভাবটা ফুটে ওঠে। ঠিকমতো খেয়াল করলে ঘরের কম আলোতেও সেই ভাব বোঝা যায়। আজও বোঝা যাচ্ছে।
ছবিটা সন্দীপের তৈরি। ভাবনা, গল্প, ছবি, কম্পিউটার প্রোগ্রাম সবটাই তার নিজের হাতে করা। এটাই ছিল তার চাকরির পরীক্ষা। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, প্রার্থীদের একটা করে কম্পিউটার স্ক্রিন সেভার তৈরি করে সিড়ি জমা দিতে হবে। সময় দশ দিন। সঙ্গে দিতে হবে বায়োডাটা আর পাসপোর্ট ছবি।
মণিদীপা এসে বলল, ‘সারাদিন কম্পিউটারে বসে কী খটর খটর করছ? বললাম না, ওসব পাগলামিতে নেচো না।’
সন্দীপ মুখ তুলে বলে, ‘পাগলামি বলছ কেন?’
মণিদীপা চাপা গলায় বলে, ‘পাগলামি বলব না তো কী বলব? পরীক্ষা নেই, ইন্টারভিউ নেই, এ আবার কেমন চাকরি! শুধু কম্পিউটারের স্ক্রিন সেভার বানাও! নিশ্চয় এর ভেতরে কোনও ফোর টোয়েন্টি ব্যাপার আছে।’
‘স্ক্রিন সেভার তৈরির ব্যাপারটা আমার বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, মণি। তুমি জানো না, আজকাল চাকরির পরীক্ষাগুলো একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। ফর্মটাই উলটেপালটে গেছে। আগের মতো জেনারেল নলেজ মুখস্থ করে, কপালে দইয়ের ফোটা লাগিয়ে যেতে হয় না।’
মণিদীপা মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘তা হলে কী করতে হয়? নাচগান করতে হয়?’
সন্দীপ উৎসাহ নিয়ে বলল, হতে পারে। অসম্ভব নয়। এই তো অঞ্জন কোথায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল। গিয়ে তো একেবারে থ! কোথায় ইন্টারভিউঃ কলকাতা থেকে অনেক দূরে বাগানবাড়িতে বিরাট পিকনিকের আয়োজন! ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্তারা বড় বড় হাঁড়িতে মাংস রান্না করছে! সারাদিন খাওয়া-দাওয়া হইচই। পিকনিকে যেমন হয় আর কী! পরে জানা গেল, ওটাই নাকি পরীক্ষা ছিল। যা দেখার দেখে নেওয়া হয়েছে। বোঝে একবার।’
মণিদীপা এবার ধমকে ওঠে, ‘থামো দেখি। উনি একেবারে বিরাট বুঝে বসে আছেন। যত্তসব গল্পকথা। এই কারণেই তোমার মতো ছেলেরা বেকার বসে থাকে। এসব পাগলামিতে সময় নষ্ট না করে ঠিকঠাক রাস্তায় চাকরির চেষ্টা করো এবার। আমি কিন্তু আর অপেক্ষা করতে পারব না বলে দিলাম।’
সন্দীপ সে কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘জিনিসটা একবার দেখবে মণি? অনেকটা করে ফেলেছি। মনে হচ্ছে, মজার হয়েছে। মাঝখানে একটা মোচড় আছে। দেখবে একবার?’
মণিদীপা কড়া গলায় বলল, ‘না, দেখব না। একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে মজা বা মোচড় কোনওটাই দেখার ইচ্ছে আমার নেই। তুমি নিজে দেখো। আমি চললাম।’
এরপর নিজেকে থামানো উচিত ছিল। সন্দীপ থামেনি। সে দশ দিনের মাথায় জিনিসটা বানিয়ে ফেলে এবং বিজ্ঞাপনের ঠিকানায় জমা দিয়ে আসে।
জিনিসটা এরকম—
একটা পুকুর। পুকুরের চারপাশে সবুজ গাছ। হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ছে। পুকুরের জালে মেঘের হালকা নীল ছায়া। তাতে মাঝে মাঝে শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ছে। সামান্য কেঁপে উঠছে জল। গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার স্থির হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। ছবির ডানদিকে বাঁধানো পুকুরঘাট। সেই ঘাটের রং টকটকে লাল। ছবি এই পর্যন্ত স্বাভাবিক। একটা নরম সরম পুকুরঘাটের ছবি যেন। মোচড়টা দেওয়া আছে এর পরে। সেই মোছড়ে দেখা যাচ্ছে, পুকুরঘাটে প্রমাণ সাইজের একটা পেট মোটা কাতলা মাছ বসে আছে পিড়ি পেতে। তার কানকো হাতে লম্বা একটা ছিপ। চোখে গোল চশমা। মুখ গম্ভীর। মাথার পিছনে লাঠিতে ছাতা বাঁধা। সেই ছাতা একপাশে কাত হয়ে আছে। পাশে টিফিন বাক্স, জলের বোতল। পেট মোটা চকচকে মাছ একটু পরপরই ছিপ তুলে দেখছে। কিছু নেই। হতাশ ভঙ্গিতে দু’পাশে মাথা নাড়ছে। বোঝা যাচ্ছে, বারবার তার টোপ খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বেচারি বঁড়শিতে ফের টোপ গেঁথে জলে ফেলছে। গোল চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকছে জলে। আবার একটু পরে ছিপ তুলে দেখছে কিছু নেই। ছবিটা এভাবেই চলতে থাকছে।
ঠিক সাত দিনের মাথায় চিঠি এল! সন্দীপ আবার সেদিন কলকাতায় ছিল না। রাতে বাড়ি ফিরে দেখল। চিঠিতে বেতন, পার্কস, ছুটি সব বিস্তারিত লেখা।
আদ্যনাথবাবু কি সেই স্ট্রিন সেভারটাই এখন দেখছেন? মনে হচ্ছে, দেখছেন। সন্দীপ এদিকে বসে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে চাকরিতে যোগ দিয়েছে তিন মাস হতে চলল। এখনও মানুষটার বেশিটাই সন্দীপ বুঝতে পারেনি। এই ঘরটার মতো। স্পষ্ট নয়, আবার অস্পষ্টও নয়। শুধু এইটুকু বুঝতে পারে, মানুষটা ইন্টারেস্টিং।
আদ্যনাথবাবু মুখ না ঘুরিয়েই সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘কেমন আছ, সন্দীপ?’
‘ভাল আছি, স্যার। আপনি কেমন আছেন?’ আদ্যনাথবাবু এবার মুখ ফেরালেন। কথায় বলে, মানুষ সবকিছু লুকোতে পারে, কিন্তু বুদ্ধি লুকোতে পারে না। ধারালো মুখ, টিকালো নাক, ঝকঝকে চোখে বুদ্ধি নিজে থেকেই ফুটে ওঠে। এই মানুষটার ক্ষেত্রে ঘটনা অন্যরকম। কালো, মোটা এবং অপেক্ষাকৃত বেঁটে এই প্রখর বুদ্ধিমান মানুষটার মুখটা যেন একটু বেশিরকমের গোল। নাকটা বড়। চোখ দুটো ছোট ছোট। অফিসে কেউ কেউ বলে, নিজের বদখত চেহারাটা ঢেকে রাখতেই উনি নাকি ঘরে কম আলোর ব্যবস্থা করেছেন।
‘আমি খুব একটা ভাল নেই, সন্দীপ।’
সন্দীপ খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘কেন স্যার, কী হয়েছে? শরীর খারাপ?’
আদ্যনাথবাবু আবার একটু হাসলেন। বললেন, ‘না, শরীর খারাপ নয়। মন খারাপ। কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। তারপর থেকেই মনটা খারাপ।’
এত বয়স্ক একটা মানুষের স্বপ্ন দেখে মন খারাপ হয়েছে শুনে হেসে ফেলা উচিত। সন্দীপের সেরকম কিছু হল না। উলটে তার খুব ইচ্ছে করল, স্বপ্নটা কী সেটা জানতে। মালিকের স্বপ্ন জানতে চাওয়া কি ঠিক হবে?
‘এখানে তোমার চাকরির ঠিক কতদিন হল, সন্দীপ?’
‘তিন মাস স্যার। আজকে নিয়ে তিন মাস দু’দিন। আমি জয়েন করেছিলাম…’
আদ্যনাথবাবু হাত তুলে থামিয়ে দিলেন। টেবিলের একপাশে রাখা ইন্টারকম তুলে চাপা গলায় বললেন, ‘চা।’ তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, ’সন্দীপ, এই সময়ের মধ্যে তুমি কি কোম্পানির কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছ?’
সন্দীপ একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘না, স্যার, এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও অ্যাসাইনমেন্ট পাইনি। শুধু গোসাবার কাছে একটা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট…’
‘আমি জানি। তুমি ওখানে একটা গেস্ট হাউসের প্রোপোজাল দিয়েছিলে। একেবারে নদীর গায়ে গেস্ট হাউস। আমার মনে পড়ছে। ওরা আমাকে ফাইলটা দেখিয়েছিল। একতলায় কিছু থাকবে না। শুধু বাগান। দোতলার ওপর বড় দুটো কাচের ঘর। সামনের ছাদটা নদী পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। তাই তো?’
সন্দীপ উৎসাহী হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, স্যার। একটা লঞ্চ রাখার কথাও বলেছিলাম। প্রোপোজালটা কি খারাপ ছিল স্যার?’
‘না, খারাপ ছিল না। বেশ ভালই ছিল। তবু আমি বাতিল করে দিই। কারণ জিনিসটার মূলে একটা গোলমাল আছে। আমরা ওখানে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরির অর্ডার পেয়েছি। গেস্ট হাউস বানানোর নয়। যা করার কথা নয়, সেটা করলে ফোকাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।’
সন্দীপ খানিকটা লজ্জিত হয়ে বলে, ‘সরি, স্যার।’
আদ্যনাথবাবু অল্প হাত তুললেন। বললেন, ‘ইটস ওকে মাই বয়। ইটস ওকে।’
সন্দীপ লক্ষ করে দেখেছে, মানুষটার গলার আওয়াজটাও ঘরের আলোর মতো চাপা। প্রথমে একটু অস্বস্তি হয় ঠিকই, তবে পরে কেটে যায়।
‘সন্দীপ, আজ তোমাকে একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে ডেকেছি। খুব বড় প্রজেক্ট। এত বড় প্রজেক্ট কাননবালা কনস্ট্রাকশন আগে কখনও করেনি। পরে আর কখনও করতে পারবে কি না ঠিক নেই। তুমি বোধহয় জানো না, নতুন কোনও প্রজেক্টের আলোচনায় আমি সাধারণত কোম্পানির ওপরের দিকের সকলকে ডেকে নিই। কিন্তু এটার ক্ষেত্রে আমি তা করছি না। আমি চাইছি, প্রাথমিকভাবে জিনিসটা গোপন থাকুক। যতক্ষণ না ভাবনাটা ফাইনাল হচ্ছে। শুধু তুমি আর আমি জানব। এটাই হবে তোমার এখানে প্রথম কাজ।’
এই পর্যন্ত বলে আদ্যনাথবাবু থামলেন। চোখ তুলে বললেন, ‘কেমন লাগছে সন্দীপ? তুমি কি উত্তেজনা বোধ করছ?’
সন্দীপ কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। টানা তিন মাস কাজ ছাড়া বসে থাকার পর এত বড় একটা দায়িত্ব, অবিশ্বাস্য তো লাগবেই। কাজ ছাড়া বসে থাকার কথা শুনে মনে হবে সন্দীপ এই অফিসের কোনও হেঁজিপেঁজি কর্মচারী। ঘটনা কিন্তু একেবারেই উলটো। সে একজন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ লোক। তার পদের নামটাও রাশভারী। আইডিয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট। ভাবনার সহকারী কোম্পানির মালিক নিজে এই পদ তৈরি করেছেন। নামটাও তাঁর দেওয়া। সন্দীপের কাজ হল, প্রয়োজন মতো কোম্পানিকে বিভিন্ন ধরনের ভাবনা জোগান দেওয়া।
গোড়াতে অফিসে অনেকেই গুজগুজ, ফুসফুস শুরু করে। কেউ বলল, পাগলামি ছাড়া কিস্যু নয়। কবিতা লেখার জন্য মালিক তোক রেখেছে। কেউ বলল, পয়সার অপচয়। এইভাবেই বড় কোম্পানি ডোবে। ইতিহাস বই খুললে অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে। দু’-একজন আর একটু এগিয়ে গেল। তাদের মতে, এসব হল আত্মীয় ঢোকানোর ফিকির। লোকটা নিশ্চয় মালিকের মামাবাড়ির দিকের কেউ হবে। খোঁজ নাও। ভাল করে খোঁজ নিলেই সব জানতে পারবে।
কথাটা কানে গেল আদ্যনাথবাবুর। তারপরই সন্দীপ সাততলার ওপর আলাদা ঘর পেল। বাড়ি থেকে অফিস আসার জন্য আলাদা গাড়ি পেল। সেই গাড়ি সকাল ন’টায় বাড়ির সামনে হর্ন বাজায়।
সন্দীপের মুখে শুনে বিশ্বাস হয়নি। মণিদীপা একদিন সকালে নিজের চোখে গাড়ি দেখতে এল। হর্ন শুনে নাক কুঁচকাল। বলল, ‘ছি, গাড়ির হর্নটা কী বিচ্ছিরি। বিয়ের পর কিন্তু এরকম বিচ্ছিরি হর্ন একদম অ্যালাউ করব না। সকালবেলা এরকম হর্ন শুনে ঘুম ভাঙবে, ইস আমি ভাবতেও পারছি না।’
সন্দীপের দেরি হয়ে গেছে। সে গালে দাড়ি কামানোের সাবান ঘষতে ঘষতে অবাক হয়ে বলল, ‘ন’টায় ঘুম ভাঙবে! সে কী? বিয়ের পর অত বেলা পর্যন্ত ঘুমোবে নাকি তুমি?’
মণিদীপা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘ঘুমোবই তো। কত রাত পর্যন্ত দু’জনে জাগব না বুঝি?’
বেয়ারা এসে টেবিলে ট্রে বসিয়ে দিয়ে গেল। ট্রে-তে কাপ ডিশ, চায়ের পট, দুধ, চিনি সব আলাদা আলাদা সাজানো।
আদ্যনাথবাবুর এটাই অভ্যেস। তিনি নিজের হাতে চা বানিয়ে খান।
সন্দীপ কাঁপা গলায় বলল, ‘স্যার, প্রজেক্টটা কী জানতে পারি?’
আদ্যনাথবাবু কথার উত্তর দিলেন না। মন দিয়ে চা বানাতে লাগলেন। শুধু একবার মুখ তুলে বললেন, ‘চিনি?’
সন্দীপ চায়ে বেশি চিনি খায়। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কম স্যার।’
সন্দীপকে চা এগিয়ে দিয়ে আদ্যনাথবাবু নিজের কাপে চুমুক দিলেন।
‘সন্দীপ, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে না আমি কাল কী স্বপ্ন দেখেছি? কেন আমার মন খারাপ?’
সন্দীপ মাথা চুলকে বলল, ‘ইচ্ছে করছে স্যার। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছি না।’
আদ্যনাথবাবু তাঁর চাকা লাগানো দামি চেয়ারটা ঠেলে একটু পিছনে সরিয়ে নিলেন।
‘সন্দীপ, আমি ব্যক্তিগত কথা বলতে পছন্দ করি না। বলিও না। কিন্তু এই নতুন প্রজেক্টের সঙ্গে বিষয়টা জড়িত। সেই কারণেই তোমার জানা প্রয়োজন। আমার এই মন খারাপের গল্পটা না শুনলে তুমি কাজটা ঠিকমতো করতে পারবে না। যে ভাবনা তোমার কাছে চাইছি সেটা হয়তো পাব না।’
সন্দীপ লক্ষ করল কোথা থেকে যেন আলোর হালকা একটা রেশ মানুষটার মুখের একদিকে এসে পড়েছে। মানুষটাকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছে।
‘তুমি কি জানো কাননবালা কে?’
সন্দীপ কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। কাননবালা যে মালিকের স্ত্রীর নাম তা এ অফিসের সকলেরই জানা। সেই মহিলা সম্পর্কে নানা ধরনের গল্পও রয়েছে। বেশিটাই কেচ্ছা কেলেঙ্কারির গল্প। বয়স অল্প আর ভয়ংকর রকম সুন্দরী ছিলেন। বিয়ের খুব অল্প দিনের মধ্যেই মারা যান। সে মৃত্যু নিয়েও নাকি গোলমাল রয়েছে। এসব সত্যি না মিথ্যে সন্দীপ জানে না। জানার ইচ্ছেও নেই। সে ঠিক বুঝতে পারছে না, নতুন প্রজেক্টের সঙ্গে ওই মৃত মহিলার কী সম্পর্ক।
সন্দীপ মাথা নামিয়ে বলল, ‘স্যার জানি। উনি আপনার স্ত্রী মারা গেছেন।’
‘মারা যায়নি, আত্মহত্যা করেছে। গোপন রাখার যতই চেষ্টা হোক না কেন, সাধারণত পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারগুলো বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে ধরা পড়ে যায়। আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে ধরা পড়তে বেশি সময় লাগে। কাননবালা আমাকে ছেড়ে তার পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে চলে যায় বিয়ের ঠিক এক বছরের মাথায়। চলে যায় না বলে, পালিয়ে যায় বলাটাই ঠিক হবে। প্রথমে যায় দিল্লি। সেখান থেকে অন্য আর একজন তাকে নিয়ে চলে আসে বেনারস। বেনারসেই কাননবালা আত্মহত্যা করে। গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। মৃত্যুর তিন দিন বাদে দরজা ভেঙে পোড়া পচা গলা দেহ বের করতে হয়েছিল। আমি মর্গে গিয়ে বড়ি আইডেন্টিফাই করেছিলাম কানের দুল দেখে। দুলটা আমার মায়ের ছিল। তুমি আর এক কাপ চা খাবে সন্দীপ? দার্জিলিং-এর সব চা ভাল হয় না। এই চা-টা ভাল। আমি আবার মকাইবাড়ির চা বেশি পছন্দ করি। অনেকে বলে কার্শিয়াং-এর দিকের চা বেস্ট। সাউথ থেকেও ভাল জিনিস আসছে। লিকার অনেক সফট হয়।
সন্দীপের মনে হয়েছিল, সে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবে না। কথা বলতে গেলে তার গলা বুজে আসবে। তা হল না। কোনওরকমে বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ স্যার। আমি আর চা খাব না।’
‘ঠিক আছে। তা হলে আমি নিজের জন্য আর এক কাপ বানিয়ে নিই।’
আদ্যনাথবাবু চেয়ারটা আবার টেবিলের কাছে টেনে আনলেন। টি পটের ওপর ঢেকে রাখা টি কোজিটা যত্ন করে তুলে কাপে চা ঢাললেন। চিনির একটা কিউব ফেললেন। চামচ দিয়ে সামান্য নেড়ে, কাপে চুমুক দিয়ে মুখে আরামের একটা ভঙ্গি করলেন। তারপর কাপের দিকেই তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন আবার।
‘কাল রাতে স্বপ্নে কাননবালা এসেছিল। অনেকদিন পর। আফটার আ লং লং টাইম। সম্ভবত শেষ রাতের দিকে এল। সেটা নাও হতে পারে। অন্য কোনও সময়েও হতে পারে। স্বপ্ন তো, সময়টা গুলিয়ে যায়। দেখার সময় একরকম মনে হয়, আসলে হয়তো অন্যরকম। যাই হোক, আমি দেখলাম, সে একটা নীল রঙের বেনারসি শাড়ি পরেছে। ঘন নীল। এটা একটা আশ্চর্যের ঘটনা। স্বপ্নে সাধারণত সে সব পোশাক আশাকই দেখা যায় যেগুলো বাস্তবে ব্যবহার হয়েছে। কাননবালাকে আমি কখনও নীল বেনারসি পরতে দেখিনি। বিয়ের রাতে সে যেটা পরেছিল সেটা ছিল মেরুন। ডার্ক মেরুন। ভুল করেছি কি না জানার জন্য আজ সকালে আমি বিয়ের অ্যালবাম খুলেছিলাম। দেখলাম, না, ভুল করিনি। শাড়ি মেরুনই। তা হলে নীল বেনারসি দেখলাম কেন? তা ছাড়া স্বপ্নে রং দেখাটাও অসম্ভব। যাই হোক, দেখলাম কাননবালার গায়ের নীল শাড়ি ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে আছে। সেই জলে আমার ঘরের মেঝে ভেসে যাচ্ছে।’
আবার থামলেন আদ্যনাথ। হাতের কাপ মুখ পর্যন্ত তুলে নামিয়ে রাখলেন। সম্ভবত খেতে দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
‘বুঝলে সন্দীপ, মেয়েটার দুটো ছেলেমানুষি ছিল। তার মধ্যে একটা হল মার্কেটিং। কেনাকাটা করা। দোকান বাজারের শখ সব মেয়েদের কম বেশি থাকে। আমার স্ত্রীর বয়স কম ছিল, ফলে এই শখ তার যে একটু বেশিই হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কখনও তাকে বাধা দিইনি। একটা কিছু নিয়ে তো থাকবে। টাকা আর গাড়ি নিয়ে যখন খুশি বাজারে বেরিয়ে যেত। আমি ওকে মার্কেটিং করতে একবার সিঙ্গাপুর পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। দ্যাট ওয়াজ হার ফার্স্ট টাইম প্লেন জার্নি। গোটা পথটা চোখ বুজে আমার হাত ধরে থাকল। আমি তো খানিকটা লজ্জাতেই পড়লাম। প্লেনসুদ্ধু সবাই দেখছে। বোঝো কী কাণ্ড! কিন্তু দ্বিতীয় ছেলেমানুষিটা খুব সমস্যা করত। মেয়েটা ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসত। কিছুতেই সামলানো যেত না। একটা সুযোগ পেলেই হল, ফাঁকতালে খানিকটা ভিজে নিত। কত বকাবকি করেছি। নতুন বউ, ছাদে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওরকমভাবে ভেজে? লুকস অড। তা ছাড়া সর্দি কাশি লেগেই থাকত। প্রথমে ভাবতাম ছোটবেলাটা গ্রামে কেটেছে। ভেজার হ্যাবিটটা রয়ে গেছে। ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হল না। কাল স্বপ্নেও দেখি এক ব্যাপার! আমি বললাম, এ কী, কানন! নিশ্চয় আবার বৃষ্টিতে ভিজেছ! উফ, তোমার ছেলেমানুষি এখনও যায়নি দেখছি! ছি ছি। দেখো তো ঘরটাকে কী করে ফেললে। যাও, কাপড় বদলে এসো। ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। কাননবালা হাত দিয়ে কপাল থেকে ভেজা চুল সরাল। তারপর হেসে মাথা নাড়ল। চুল থেকে জল পড়ল মুক্তো দানার মতো। সেই জল এসে পড়ল আমার বিছানার ওপর। আমার গায়ের ওপর। তারপর হেসে বলল…
আদ্যনাথবাবু থামলেন। মুখ তুলে সন্দীপের চোখের দিকে তাকালেন সরাসরি। বললেন, ‘তুমি কি পার্সোনাল কথা শুনতে বিরক্ত হচ্ছ?’
সন্দীপ যেন সে কথা শুনতে পেল না। সে আপনমনে ফিসফিস করে বলল, ‘কী বলল?’
আদ্যনাথবাবু চোখ না সরিয়ে বলেন, ‘কী বলল? বলল, দূর, জল কোথায়? এ তো কেরোসিন। গন্ধ পাচ্ছ না?’
‘কেরোসিন!’
‘হ্যাঁ, কেরোসিন। সুইসাইডের সময় কাননবালা…’
কথা থামিয়ে আদ্যনাথবাবু মুখ নামিয়ে নিজের মনেই হাসলেন। মুখ নামানো অবস্থাতেই ইন্টারকম তুলে বললেন, ‘গাড়ি রেড়ি করতে বলুন। আমি বাড়ি চলে যাব। হ্যাঁ, সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল।’ তারপর মুখ তুলে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইয়েস মাই বয়। বুড়ো মানুষের প্রেমকাহিনি কেমন লাগল? হাসি পেল? যাক, সন্দীপ, আমি ঠিক করেছি, কাননবালার নামে একটা বাজার বানাব। এখন যা বলে, এই শপিং মল। এমন শপিং মল যা কেউ কখনও দেখা তো দূরের কথা, ভাবতেও পারেনি। তুমি ভাববে। সেই ভাবনা দেখে সবাই চমকে যাবে। ইয়েস তুমি। টাকা নিয়ে ভাববে না। আমি ইচ্ছে করলে পৃথিবীর বড় বড় শপিং মলের ভিডিও সিডি তোমাকে দিতে পারতাম। ঘুরিয়েও আনতে পারতাম। কিন্তু সেটা চাইছি না। আমার আশঙ্কা, তাতে তোমার নিজের ভাবটা নষ্ট হয়ে যাবে। টেক সেভেন ডেজ। সাত দিন সময় নাও। ঠিক সাত দিন পরে প্রজেক্ট রিপোর্ট নিয়ে তুমি আমার কাছে আসবে। বেস্ট অফ লাক।’
একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সন্দীপের মনে পড়ল, আজ কাকে যেন সে অপেক্ষা করতে বলেছিল? কাকে বলেছিল? কোথায় সে তাপেক্ষা করছে? মনে পড়ছে না। কিছুই মনে পড়ছে না।
২
মণিদীপার রাগের ব্যাপারটা অদ্ভুত।
কোনও একটা বিষয় নিয়ে সে টানা রেগে থাকতে পারে না। প্রথমে তিনদিন রাগবে, তারপর একটা বিরতি দিয়ে আবার একদিন রাগবে। এই বিরতিটাও অদ্ভুত। হঠাৎ এবং চমকে দেওয়া বিরতি। সেই সময়টা তাকে দেখলে মনে হবে, কিছুই যেন হয়নি। পরেও কিছু হবে না।
এবার কিন্তু তা হচ্ছে না। বিরতি বা চমকে দেওয়া তো দূরের কথা, পাঁচ দিন হতে চলল সে কোনওরকম যোগাযোগই করছে না। মোবাইল বন্ধ, বাড়িতেও সে ফোন ধরছে না। ধরছে নমিতার মা। কাল রাতে নমিতার মা ফোনে সন্দীপকে ধমক দিয়েছে, ‘দেখেন, আপনি কিন্তু বড় জ্বালাতন করেন। দিদিমণি আপনারে ফোন করতে না করেছে, তবু আপনি বারবার ফোন করেন কেন? এইডা করবেন না। আপনার একটা পেস্টিজ নাই? যখন বেকার ছিলেন তখন না হয় একড়া কথা ছিল। এখন তো আর বেকার নন। তবে?’
নমিতার মা মণিদীপাদের রান্নার লোক। সন্দীপ তাকে চেনে না এমন নয়। গত সাত বছর যে বাড়ির মেয়ের সঙ্গে সে প্রেম করছে, সে বাড়ির রান্নার লোককে না চেনার কোনও কারণ নেই। সে তাড়াতাড়ি বলে, ‘নমিতার মা, একটা খুব জরুরি কথা…’ নমিতার মা ফোন কেটে দেয়।
মণিদীপার অবশ্য কোনও দোষ নেই। একটা সুন্দরী মেয়েকে পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনের সামনে যদি ঠায় দু’ঘণ্টা পনেরো মিনিট দাড়িয়ে থাকতে হয় এবং যার জন্য দাড়িয়ে আছে তার মোবাইল ফোন যদি সেই সময় বন্ধ থাকে, তা হলে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে।
সন্দীপ সেদিন কফি শপে বসে মণিদীপাকে সবটা খুলে বলতে যায়। পুরোটা পারে না। মালিকের সঙ্গে মিটিং, স্বপ্ন, গোপন প্রজেক্ট পর্যন্ত বলার পরই মণিদীপা আরও রেগে যায়। চাপা গলায় ধমকে বলে, ‘অ্যাঁ! একজন তোমাকে তার স্বপ্নের কথা বলবে, আর সেটা শোনার জন্য তুমি তোমার প্রেমিকাকে এক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখবে? কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করছে না?’
‘আহা, ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ না মণি। স্বপ্নটা সিরিয়াস। সেটা তুমি শোনো। শুনলে চমকে যাবে। ভীষণ ইন্টারেস্টিং।’
‘চুপ করো, একদম চুপ। স্বপ্ন সিরিয়াস না স্বপ্ন হাসির সেটা জানার কোনও দরকার নেই। অনেক হয়েছে, আর নয়। এটাই তোমার সঙ্গে আমার শেষ কফি খাওয়া।’
সন্দীপ পরিস্থিতি সামলাতে যায়। কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘তোমাকে তো বলেছি, আদ্যনাথবাবু মানুষটা কয়েক কোটি টাকার মালিক, অত বড় ব্যাবসা, তবু কোথায় যেন একটা ছেলেমানুষি আছে। বলিনি তোমাকে?’
মণিদীপা কফির মগে চুমুক দেয়। তার ঠোঁটের পাশে ক্রিম লাগে। ন্যাপকিন তুলে সেই ক্রিম মুছে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘বলেছ তো কী হয়েছে? তুমি তোমার ছেলেমানুষকে কোলে নিয়ে বড়মানুষ করো। আমি তো আপত্তি করছি না। করছি কি? কিন্তু আমাকে ছাড়ো৷’
‘মণি, এটা আমার প্রথম বড় কাজ। তিন মাস বসে বসে মাইনে নেওয়ার পর এটাই আমার ফার্স্ট চান্স। আমার প্রজেক্ট যদি ওঁর পছন্দ হয়…’
মণিদীপা টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে। বিলের ওপর টাকা রাখে। তারপর মোবাইলটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে বলে, ‘তোমার উন্মাদ মালিকের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে ভাবার সময় যা হচ্ছে কোনওটাই আমার নেই। আমার ধারণা এই লোকের সঙ্গে তুমি যদি বেশিদিন কাজ করো তা হলে তুমি দ্রুত উন্মাদে পরিণত হবে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি রাখবে। দুঃখিত, আমি তোমার সেই অবস্থা দেখতে চাই না, সুতরাং বিদায়। দয়া করে তুমি আমাকে আর বিরক্ত করবে না।’ সন্দীপ একটু আগে পর্যন্ত খাটে বেডকভার মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। এখন পিঠ টান করে বসে আছে। তার দুটো চোখই বোজা। মুখ ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তিন দিন হল সে অফিসে যাচ্ছে না। প্রথম দু’দিন অফিসেই প্রজেক্টটা তৈরির চেষ্টা করেছিল। হুড়মুড় করে খান কয়েক বাড়ির ছবি এঁকে ফেলেছিল কিন্তু তাতে কাজ কিছু হয়নি। তখন ভাবল, বাড়িতে বসলে কাজ হবে। তাই অফিস না গিয়ে বাড়িতে বসে রাত দিন কাজ করেছে। তার খাটের পাশ পর্যন্ত টেবিলটা টানা। সেখানে কম্পিউটারের পাশে তাড়া তাড়া কাগজ। টেবিলের তলাতেও তাই। তবে সে কাগজগুলো দুমড়ানো মুচড়ানো এবং ছেঁড়া। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, সন্দীপ ধ্যান বা যোগব্যায়াম ধরনের কিছু করছে।
দুটোর একটাও ঠিক নয়। আসলে এই মুহূর্তে সে চেষ্টা করছে একটা বইয়ের কথা মনে করতে। একেবারে ফালতু বই। পাতলা ফিনফিনে। এক বছর আগে বেকার থাকার সময় চৌরঙ্গির বাস গুমটি থেকে কিনেছিল। বইয়ের নাম— ‘পুরুষমানুষের রাগ কমানোর সহজ উপায়। তাতে একশো ধরনের রাগ এবং সেগুলো কমানোর পদ্ধতি বলা ছিল। বউয়ের ওপর রাগ, চোরের ওপর রাগ, প্রেমিকার ওপর রাগ, পুলিশের ওপর রাগ থেকে শুরু করে মালিকের ওপর রাগ, কেরানির ওপর রাগ, এমনকী নিজের ওপর রাগ কমানোর পদ্ধতিও ছিল সেখানে। একেবারে এক, দুই, তিন পয়েন্ট করে।
এখন সেই নিজের ওপর রাগের অংশটাই মনে করার চেষ্টা করছে সন্দীপ। সমস্যা হল, আবছা আবছা মনে পড়ছে। সবটা পড়ছে না। পদ্ধতির নাম— ক্রোধ তাপ বিতাড়ন। এই পদ্ধতিতে প্রথমেই ঘরের সব জানলা দরজা খুলে দিতে হবে। তারপর খাটের ওপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন, ক্রোধের তাপকে তাড়াতে হলে আগে তাকে চেপে ধরতে হবে। তাই একটা চাদর নিয়ে পুরো শরীর ঢাকা দিন। খানিকটা পরে চাদর সরিয়ে ফেলুন। এবার খোলা দরজার দিকে মুখ করে, পিঠ সোজা করে, চোখ বুজে বসুন। এর পরেরটাই আসল। সেটা হল…
ব্যস, সন্দীপের আর মনে নেই। আসলটাই মনে নেই। থাকবেই বা কী করে? কতদিন আগে হেলাফেলা করে পড়া। সে জিনিস কি এখন মনে থাকে? অথচ থাকার দরকার ছিল। কারণ এই মুহূর্তে সন্দীপের নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এই রাগের পরিণতি কী হতে পারে সন্দীপ জানে না এমন নয়। ভাল করেই জানে। শো কজ, সাসপেনশন, চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো যে-কোনও ধরনের ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকটা আত্মহত্যার মতো। তবু করতে ইচ্ছে করছে। সম্ভবত এরকমটাই হয়। ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাবনা জানা থাকলে মারাত্মক কাজের জন্য মন ছটফট করে। মানুষ সামান্য দড়ি হাতে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যায়। পলকা ছিপ নৌকো নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তাল সমুদ্রে।
সন্দীপের ইচ্ছে করছে টেবিলের ওপর রাখা কাগজগুলো বগলদাবা করে এখনই সোজা অফিসে পৌঁছে যেতে। পৌছে সোজা উঠে যাবে সাততলায় নিজের ঘরে। তারপর কাগজগুলো কুচি কুচি করে ছিড়ে জানলা খুলে ভাসিয়ে দেবে বাইরে। এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। সন্দীপ এরপর ইন্টারকমে মালিককে ধরতে যায়।
‘স্যার, আপনি কি খুব ব্যস্ত? মিটিং করছেন? স্যার, এক মিনিটের জন্য মিটিং ছেড়ে উঠে আসতে হবে। একবারটি আপনি আপনার ঘরের পিছনের লম্বা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়ান প্লিজ। এবার পরদা সরালেই চমৎকার একটা দৃশ্য দেখতে পাবেন। দেখুন, অজস্র কাগজের টুকরো ভাসছে। শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। ভাল করে দেখুন স্যার। এক-একটা টুকরো এক-এক রকম। কোনওটা নৌকোর মতো পাল তুলে সামনের দিকে ছুটছে। কোনওটা পালকের মতো ফুরফুরিয়ে ভেসে নামছে নীচে। কোনওটা আবার কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে মাঝপথে। অপূর্ব না স্যার? স্যার, নিজের কথা নিজের মুখে বলতে লজ্জা লাগে। তবু না বলে পারছি না। এই কাজটা স্যার আমার। আমি করেছি। গত তিন দিন ধরে সাতখানা প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করেছি। সাতটা শপিং মল। আজ সেগুলোই যত্ন করে ছিঁড়লাম। তারপর জানলা খুলে ছেঁড়া কাগজগুলো… কেন এমন করলাম জানেন স্যার? আমি বুঝতে পারছি, এগুলো কিছুই হয়নি। একেবারে সাদামাটা সাধারণ। আপনি যা চেয়েছেন তার ধারেকাছেও যেতে পারিনি। এই কারণেই নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে স্যার।’
প্রায় মিনিট পনেরো এভাবে চোখ বুজে বসে থাকার পর সন্দীপের কেমন ভয় করে উঠল। পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো? আশ্চর্য কিছু নয়। তিন দিনে সাত রকমের শপিং মলের কথা ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। মণিদীপা তো এরকম আশঙ্কার কথা বলেই ছিল।
ধড়ফড় করে চোখ খুলল সন্দীপ। চোখ খুলেই চমকে উঠল। একটু দূরেই জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসে আছে মণিদীপা! বসে নির্লিপ্ত মুখে পা দোলাচ্ছে। সন্দীপ লাফিয়ে উঠল।
‘তুমি! তুমি কখন এলে?’
মণিদীপা কথার উত্তর না দিয়ে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘এমন চেহারা হয়েছে কেন? দাড়ি-টাড়ি কামাওনি। পাজামা, গেঞ্জি পরে বাড়িতে বসে আছ যে! অফিসে যাও না কেন? অসুখ হয়েছে না তাড়িয়ে দিয়েছে?’
সন্দীপ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে একটা পাঞ্জাবি গলাতে গলাতে শুকননা গলায় বলল, ‘অসুখ টসুখ কিছু নয়। বিপদে পড়ে ক’টা দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলাম মণি। ছুটি নিয়ে এবার মহাবিপদের মধ্যে পড়েছি। মনে হচ্ছে, ছুটি একেবারে পাকাপাকি নিয়ে নিতে হবে। তার মধ্যে তুমি আবার ঝামেলা পাকিয়েছ। বিপদের সময় পাশে না থাকলে… তুমি কি আমার বিপদের কথাটা শুনবে?’
মণিদীপা মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘বাঃ, বাইরেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে নাকি?’
সন্দীপ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘রাখো, তোমার মেঘ-বৃষ্টি। মণি, তুমি শুনলে হাসবে আমি এজেন্টটা বানাতেই পারলাম না। অথচ হাতে মাত্র দুটো দিন। উনি এত ভরসা করে আমাকে কাজটা দিলেন। চাকরিটা থাকবে না।’
মণিদীপা চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। বলল, ‘সে কী, এতদিনেও হল না? সামান্য একটা শপিং মলের ডিজাইন ভাবতে পারলে না? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই পারতে। আচ্ছা, বলছি চট করে শুনে নাও। একতলায় জামাকাপড়। দোতলায় ক্রকারিজ। তিনতলাটা শুধু অর্নামেন্টসের জন্য রাখো। চারতলার একদিকে কসমেটিক্স আর একদিকে বিউটি পার্লার, স্পা, জিম। চলবে?’
সন্দীপ অস্থিরভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘না, না, এরকম নয়। এরকম তো আমি অনেকগুলো করেছি। অন্য কিছু, অন্যরকম।’
‘সেটা কীরকম?’ চোখ বড় করে বলল মণিদীপা।
সন্দীপ হতাশ হয়ে ফের খাটের ওপর গিয়ে বসল। বিড়বিড় করে খানিকটা আপনমনেই বলল, ‘কীরকম সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ভাবছি, অনেক ভাবছি। তবু মাথায় আসছে না। জিনিসটা হবে আদ্যনাথ বসুর স্বপ্নের মতো। তাঁর পালিয়ে যাওয়া মৃত স্ত্রী কাননবালার শখের মতো। পালিয়ে যাওয়া মরা বউয়ের জন্য বুড়ো মানুষটার ভালবাসার একটা ছোঁয়া থাকবে তাতে। সেই ছোঁয়া হবে সুন্দর অথচ মনখারাপ করা।’
মণিদীপা খাটের পাশে এগিয়ে এল। সন্দীপের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘গোড়াতেই বলেছিলাম, এটা একটা পাগলামির চাকরি। এখানে বেশিদিন থাকলে নিজেও পাগল হয়ে যাবে। সেটাই হয়েছে। পাগল হয়ে যেতে শুরু করেছ। নইলে কেউ শপিং মলের ডিজাইন করতে গিয়ে স্বপ্ন, সুন্দর, মনখারাপ এসব ভাবে? একটা পেতনি মার্কেটিং করবে বলে যা করছ, সেটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। শহরে অনেক শপিং মল রয়েছে। তোমার পেতনিকে বলো, বেশি রাতে সেগুলোর একটায় ঢুকে পড়তে। নিশ্চিন্তে ব্যাগ ভরতি বাজার সেরে কফি টফি খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। কেউ বিরক্ত করবে না।’
সন্দীপ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘জিনিসটা ঠাট্টার নয়, মণি।’
‘ছি, ঠাট্টার হবে কেন? পেতনির জন্য বাজার বানানো কি একটা ঠাট্টার জিনিস হল? খুবই সিরিয়াস জিনিস। তবে আপাতত ওইসব হাবিজাবি চিন্তা ছেড়ে আমার সঙ্গে তুমি বেরোবে। এই মেঘলা দুপুরে আমরা দু’জনে খানিকক্ষণ রাস্তায় হাঁটব। তারপর বৃষ্টি নামলে কোনও একটা চায়ের দোকানে ঢুকে ভাঁড়ে করে চা খাব। মনে হয়, এতে পুরো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আগে তুমি খানিকটা সময় পাবে। যাও, তৈরি হয়ে নাও | দাড়িটা কামাতে হবে না। বেশ একটা পাগল পাগল দেখাচ্ছে। মেঘলা দিনে পাগলের পাশে হাঁটতে কেমন লাগে দেখি।’
সন্দীপের বেরোতে একেবারেই ইচ্ছে নেই। তার ইচ্ছে আবার ডিজাইনটা নিয়ে বসার। শেষ চেষ্টা। কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে বলতে সাহস হল না। পাঁচ দিন রাগের পর মণিদীপা এসেছে। এইসময় তার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার ফল মারাত্মক হতে পারে। এত চাপ একসঙ্গে নেওয়া কঠিন হবে।
চুপ করে সন্দীপ তৈরি হয়ে নিল। বেশিক্ষণ হাঁটতে হল না। মিনিট পনেরোর মধ্যে বৃষ্টি নামল। প্রথমে বড় বড় ফোঁটায়। তারপর মুহূর্তে চারপাশে সাদা করে। মণিদীপা সন্দীপের কনুইয়ের কাছটা ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘ইস কী মজা! অ্যাই ভিজবে?’ সারা শরীর কেঁপে উঠল সন্দীপের। সামনের দোকানটায় এক ছুটে ঢুকে যাবে ভেবেছিল সে। পারল না। থমকে দাঁড়াল।
কে কথাটা বলল? মণিদীপা? নাকি কাননবালা? কে বলল?
৩
‘তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে সন্দীপ? আমি কি এসিটা কমিয়ে দিতে বলব?’
আদ্যনাথ বসুর ঘরের আলোগুলো যেন আজ আরও একটু চাপা। আরও একটু নরম। ছ’দিনে মানুষটা কি একটু রোগা হয়ে গেছে? নাও হতে পারে। আলো-ছায়ার নানা ধরনের বিভ্রান্তি হয়।
‘ঠান্ডা লেগেছে স্যার। তবে এসি কমাতে হবে না। অতটা কিছু নয়।’
‘গুড। কিছু না হলেই ভাল। সন্দীপ, তুমি কিন্তু ইচ্ছে করলে আরও একটা দিন সময় নিতে পারো। তোমাকে সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সেভেন ডেজ। তুমি একদিন আগেই চলে এসেছ।’
সন্দীপ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর হেসে বলল, ‘স্যার, আমার আর সময় দরকার নেই। আমার কাজ হয়ে গেছে।’
‘কাজ হয়ে গেছে?’ আদ্যনাথবাবুর গলায় যেন সামান্য অবাক হওয়ার সুর। তিনি চেয়ারটা ঠেলে একটু এগিয়ে আনলেন। বললেন, ‘তুমি শিয়োর যে তোমার কাজ হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, স্যার। আমার কাজ হয়ে গেছে। তবে সেই ভাবনা আপনার পছন্দ হবে কি না জানি না।’
হাত দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলতে তুলতে আদ্যনাথবাবু বললেন, ‘তুমি ক’টা প্রজেক্ট এনেছ, সন্দীপ? মানে আমি বলতে চাইছি, হাউ মেনি অপশনস?’ তারপর রিসিভারে মুখ রেখে বললেন, ‘এখন ঘরে কোনও লাইন দেবেন না।’
সন্দীপ একটু থামল। তারপর গলায় জোর এনে বলল, ‘কোনও অপশনস নেই। নো অপশনস। একটাই প্রজেক্ট।’
‘একটা! ওনলি ওয়ান!’ আদ্যনাথবাবু পা দিয়ে চেয়ারটাকে ফের একটু পিছিয়ে নিলেন। এইসময় তাঁর মুখের একপাশে একটা আলোর রেখা এসে পড়বার কথা। অন্য দিন অন্তত পড়ে। আজ পড়ল না।
‘হ্যাঁ স্যার, একটা।’
‘আশ্চর্য। এত বড় একটা কাজের জন্য একটা মাত্র প্রোপোজাল! তোমাকে কোয়াইট কনফিডেন্ট মনে হচ্ছে, সন্দীপ। আচ্ছা, ফাইলটা দাও।’
‘ফাইল তো আনিনি স্যার। সত্যি কথা বলতে কী, আমি লিখিনি কিছুই। পুরোটাই শুধু ভেবেছি।’
আদ্যনাথবাবু সোজা হয়ে বসলেন। ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসলেন। এত কম আলোতে সেই হাসি দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তবু সন্দীপ দেখতে পেল।
‘ইন্টারেস্টিং। অনেক বছর পর আমি কোনও প্রজেক্ট মুখে মুখে শুনব। জিনিসটা বলতে তোমার কতক্ষণ লাগবে? আধ ঘণ্টা? এক ঘণ্টা? আমরা কি তার আগে এক কাপ চা খেয়ে নেব?’
‘স্যার, আমার মনে হচ্ছে, খুব বেশি হলে আট থেকে দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে বলে ফেলতে পারব।’
মাত্র দশ! ওনলি টেন? আর ইউ শিয়োর ওনলি টেন?
‘হ্যাঁ, স্যার। দশ মিনিটই যথেষ্ট। আমি কি শুরু করতে পারি?’
‘তুমি শুরু করো।’
আদ্যনাথবাবু চশমা খুলে মাথা চেয়ারে ঠেকালেন। সন্দীপ শান্ত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল।
দশ নয়। লাগল বারো মিনিট। একটা সময় পর্যন্ত আদ্যনাথবাবু সন্দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। তারপর তিনি মুখ নিচু করে ফেলেন। সন্দীপ থামার পর স্থির হয়ে বসে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। একইভাবে, মুখ নামিয়ে। তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘তুমি কি আর একবার ওই জায়গাটা থেকে বলতে পারবে সন্দীপ? বলবে?’
সন্দীপ টেবিলের ওপর অনেকটা বেশি ঝুঁকে পড়ে। মালিকের টেবিলে এতটা ঝুঁকে পড়া যায় না। সন্দীপ উত্তেজনায় সে সব ভুলে গেছে।
‘কোন জায়গাটা থেকে স্যার আপনার ভাল লেগেছে?’
আদ্যনাথবাবু যেন সন্দীপের পুরো কথা শুনতেই পেলেন না। বললেন, ‘এই যে যেখানে মেঘ আরও কালো হয়ে এল।’
সন্দীপ উৎসাহের সঙ্গে প্রায় উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, দোতলা স্যার। দোতলা। একতলায় যে হালকা মেঘলা ভাবটা ছিল সেটা দোতলায় আরও কালো করে আনা হবে। করিডরে আলোটা এমন করা হবে যাতে মনে হয় মেঘে মেঘে আকাশ সত্যি কালো হয়ে গেছে। একতলার প্যাসেজগুলোতে আমরা হালকা একটা ঠান্ডা হাওয়া রাখব। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হলে যেমন হাওয়া দেয় সেরকম। দোলায় সেটা বাড়বে। বিনতুলায় উঠলে এটাকেই স্যার একটা ঝড়ের চেহারা দিতে হবে।’
‘ঝড়!’ বিড়বিড় করে বললেন আদ্যনাথ।
‘হ্যাঁ স্যার, ঝড়। আমাদের শপিং মলের তিনতলার করিড়ারে সবসময় মেঘ আর ঝড় পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, সঙ্গে বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি ফেলতে শুরু করব। জিনিসটা করা কোনও সমস্যা হবে না। সিলিং থেকে শাওয়ার দিয়ে সহজেই করা যাবে। শুধু ড্রেনেজটা স্যার খেয়াল থাকে যেন। অতটা জল সারাক্ষণ পাম্প আউট করে ফেলতে হবে তো। আমাদের এঞ্জিনিয়াররা নিশ্চয় সেটা পারবে। এরপর চারতলায় আমরা ভালভাবে বৃষ্টি নামাব। আপনাকে তো একটু আগে বললামই, যাঁরা চারতলায় উঠবেন এমন প্রতিটা কাস্টমারের জন্য আমরা ছাতা এবং ওয়াটারপ্রুফের ব্যবস্থা রাখছি। শপিং মলের নীচেই সব পাওয়া যাবে। সেই ছাতা নিয়ে আর ওয়াটার প্রুফ পরে দোকানে দোকানে ঘুরে কেনাকাটা করাটাই হবে মেঘ-বৃষ্টির আসল মজা।’
আদ্যনাথবাবু চেয়ারটা ঠেলে যেন আরও একটু অন্ধকার দিকে সরে গেলেন। তিনি যেন চাইছেন উলটোদিকে বসে থাকা সন্দীপ তার মুখ দেখতে না পায়।
‘মেঘ-বৃষ্টি! মেঘ-বৃষ্টিটা ঠিক কী?’
সন্দীপ এবার লজ্জা পেল। নিচু গলায় বলল, ‘আমাদের শপিং মলের নাম স্যার। আমি ভেবেছি। খারাপ হয়েছে?’
আদ্যনাথবাবু উত্তর দিলেন না। সন্দীপ বলতে লাগল, ‘একদম ছাদে একটা রেস্তরাঁর কথাও ভেবেছি। বড় রেস্তরাঁ। সিন্থেটিক ছাদ। ছাদের ওপর সারাটা সময় ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়বে। সময় বুঝে আলোটাও অ্যাডজাস্ট করা যাবে। এখানে সার জলের থেকে আমরা বৃষ্টির শব্দের দিকে বেশি মন দেব। অল্প অল্প ছাঁট আসবে। এখানে মূল মেনুটাই হবে খিচুড়ি। নানা ধরনের খিচুড়ি। সঙ্গে ইলিশ মাছ। আমার ধারণা, ঠিকমতো করা গেলে, এটা স্যার, খুবই আকর্ষণীয় হবে।’
‘মেঘ-বৃষ্টিতে কোনও ভেজার জায়গা নেই, সন্দীপ?’
আদ্যনাথবাবুর গলাটা একটু অন্যরকম শোনাল কি? একটু ভারী?
‘স্যার, আলাদা করে ভেজার জায়গা না রাখলেও ইচ্ছে করলে যে কেউ ভিজতে পারবে। পুরো ব্যবস্থাটাই সেরকম রাখা যেতে পারে। কাঁচা সবজি, আনাজপাতি আর ফলের দিকটা তো স্যার আমি ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই রাখতে চাই।’
’তোমার কি বলা শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, স্যার শেষ হয়েছে। আপনার কেমন লাগল। পছন্দ হয়েছে?’
‘এবার তা হলে চা দিতে বলি?’
‘বলুন স্যার।’
আদ্যনাথ বসু এতক্ষণ পরে মুখ তুললেন। কম আলোর কারণে সন্দীপ দেখতে পেল না, এই বয়স্ক, কুৎসিত দর্শন মানুষটার দু’চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে।
বড় সুন্দর দেখাচ্ছে।
সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি, ২০০৬