মেঘে ঢাকা তারা – ৮

মাথা উঁচু করে টিকে আছে শঙ্কর। সংসার থেকে সরে দূরে গিয়ে যেন আত্মরক্ষা করেছে সে। বাংলা কেন-ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক হতে চলেছে শঙ্কর। কাগজে কাগজে তার ছবি ছাপা হয়। তার গানের সমালোচনা বোদ্ধাজনের মুখে। নতুন রাগরাগিণীর উপর গবেষণা করে বহু কিছু লুপ্ত সুর উদ্ধার করে তাই পরিবেশন করে বিভিন্ন আসরে, গুণিজন মুগ্ধ চিত্তে তাই শোনেন, স্বীকৃতি দেন ওকে। 

বিভিন্ন সম্মেলন থেকে ডাক আসে, প্লেনে পাড়ি জমায় ভারতের প্রধান প্রধান শহরে। আজ সে দুহাতে খ্যাতি-প্রতিপত্তি কুড়িয়েছে। পেয়েছে অর্থও। এতদিন পর আলোর মুখ দেখেছে শঙ্কর 

বাড়ি ফিরছে কয়েকদিনের জন্য। 

কিন্তু ওই বাড়ির পরিবেশে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। রেললাইন থেকে দেখা যায় বাড়িটা— টিনগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে, অন্যদিকে তাদের নতুন বাড়ি তোলবার আয়োজন চলেছে, ইট এসে জমা হচ্ছে। ভিত খোঁড়া হয়ে গেছে। 

শঙ্করকে আসতে দেখে অনেকেই যেচে কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করে। নবীন মুদি দোকান থেকে বের হয়ে আসে, অভ্যর্থনা জানায়—আইলা নাকি শঙ্কর বাই! সব খবর ভালো তো? শোনলাম হওয়াই জাহাজে চাপি দিল্লি, বোম্বাই পাড়ি মারতিছ। হঃ, গলা বটে! শোনলাম সেদিন রেডিওতে, যেন মধু ঝরতিছে। 

আরও কারা ভিড় করেছে তাকে দেখে। শঙ্কর ওদের এড়িয়ে আসে কোনোরকমে। ওই নবীন মুদির দোকানেই গুপি মিত্তিরের দল তাকে যা-তা ভাবে অপমান করছে ছাড়েনি। ওই নবীন মুদিও যোগ দিয়েছিল তাদের সঙ্গে ব্লেডের জন্য চার আনা বাকি পড়ায় সেও অপমান করতে ছাড়েনি। 

দুনিয়ার রূপ যেন বদলে গেছে। সেদিন মাথা নিচু করে চোরের মতো এড়িয়ে বেড়িয়েছে সকলকে। আজ মাথা উঁচু করে চলবার যোগ্যতা অর্জন করেছে সে। দাম বেড়েছে! নিজেকে চিনতে পেরেছে এত দিনে শঙ্কর। 

অনিল ডাক্তার সেই সাবেকি সাইকেলে চড়ে ডাকে যাচ্ছিল। কেরিয়ারে কালো ডাক্তারি ব্যাগটা বাঁধা। মাধববাবুর চিকিৎসার ব্যাপারে নগদ টাকা না পাওয়ায় ওই অনিল ডাক্তার ইনজেকশনের সিরিঞ্জে ওষুধ পুরে—আবার না দিয়েই ফিরে এসেছিল। 

শঙ্কর সেদিন দাঁড়িয়ে দেখেছিল মাত্র, নীতা হাতের চুড়ি বাঁধা দিয়ে ওর দাম মিটিয়ে দিতে তবে চিকিৎসা করেছিল সে। শঙ্কর সেইদিন থেকে দেখতে পারত না লোকটাকে। সেই অনিল ডাক্তার ওকে দেখতে পেয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে আসে। আবেগভাবে জড়িয়ে ধরে ওকে। বলে ওঠে—আমাদের গৌরব তুমি। দেখাই দাও শঙ্কর হালার খাঁ সাহেবগার—বাংলাতেও বাঘের বাচ্চা আছে গিয়া! 

শঙ্কর ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনিল ডাক্তার আপশোস করে—বেশ আছে শঙ্কর, একখান গান গাইয়া পাঁচশো টাকা লও। আমাগোর? ওষুধ পাইয়াও পয়সা দিবার নাম করে না লোকে। হালার দ্যাশ!… তোমারে দেইখা খুব খুশি হইচি শঙ্কর। তা কলোনির ক্লাবে একদিন ফাংশান কইরা দাও; ধর গিয়া আলপনা শ্যামল— তোমাগোর সতীনাথ—ইসে উৎপলা—ধনঞ্জয়— 

হাসে শঙ্কর, অনিলের মতলব বুঝে। বলে ওঠে—ও গান তো আমি গাই না দাদা, ক্লাসিক গাই—খেয়াল, ঠুংরি। 

—ও! অনিল ডাক্তার হতাশ হয়েছে। 

কাগজে ছবি দেখেই খানিকটা অনুমান করেছিল মাত্র। হতাশ হয়ে সাইকেলে উঠে পড়ে চলে গেল ডাক্তার। হাসতে থাকে শঙ্কর। 

.

থুবড়ে-পড়া বাড়িটায় চাঞ্চল্য ফিরে আসে শঙ্করের আসার সঙ্গে সঙ্গেই। কাদম্বিনী ছেলেকে দেখে খুশি হয়। অনেক আশা আজ ওই শঙ্করের উপর তার, বাড়ির হাল বদলাবে—টাকার অভাব নেই আজ শঙ্করের। এ বাড়ির বাতিল মানুষটারও আজ দাম বেড়ে গেছে সব তাকিয়ে বেশি। 

গীতা বাড়িতেই এসেছে, একা সনতের ওখানে ওকে রাখতে চায়নি কাদম্বিনী। প্রথমবার, তাই নিজের কাছেই এনেছে। মন্টু বাড়ি নেই—একটু একটু হাঁটতে শুরু করেছে। পাড়ায় কোথায় গেছে বেড়াতে। কাদম্বিনীও চায়—বাছা বাইরে বাইরে একটু ঘুরে যদি মনে শান্তি পায় পাক মাধবমাস্টার তেমনি স্তব্ধ হয়ে রোদপীঠ করে বসে আছেন—সামনে বই-এর প্রুফশিট। কাটছেন আর লিখছেন। বাবাকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল শঙ্কর। মাধববাবুর দেহ-মনে এসেছে তৃপ্তির আভা—আবার কাজ করবার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। শঙ্করকে প্রণাম করতে দেখে বলে ওঠেন তিনি—এসো। ভালো আছ? 

মাধববাবু আজ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন মধুর চাহনি মেলে। ওর সাধনায় আজ বিশ্বাস করেন তিনি। শঙ্কর ফাঁকি দেয়নি। দুঃখ-অভাবের মধ্যেও নিজেকে গড়ে তুলেছে অক্লান্ত পরিশ্রম আর ধৈর্যে। দুস্তর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে সে। 

মাধববাবু আশীর্বাদ করেন—জয়ী হও। জীবনে সুখী হও। 

শঙ্কর আজ মানুষটিকে দেখে একটু খুশি হয়। বৃদ্ধ বলে ওঠেন—এখনও অনেক বাকি, প্রুফটা কালই পাঠাতে হবে, শেষ করে কথা কইব। 

—কিসের প্রুফ বাবা! শঙ্কর প্রশ্ন করে। – 

—নতুন বই ছাপছে আমার। ‘রচনা-প্রকাশ’। উচ্চ বাংলা ব্যাকরণও লিখতে বলেছে। ভাবছি হাত দোব এইবার। ক্লাস নাইন-টেনের বই, খেটে লিখতে হবে। নীতাই যোগাযোগ করেছে। 

—তাই নাকি! শঙ্করও খুশি হয়। 

কাজের মানুষকে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে দেখে সে খুশি হয়েছে। কাদম্বিনী শঙ্করকে দেখে বের হয়ে আসে। 

খুশিতে ফেটে পড়ে কাদম্বিনী। বলে—ওরে গীতু, তোর বড়দা এসেছে। চল বাবা, ভিতরে চল। ইস, ঘেমে নেয়ে উঠেছিস। এই বিকালে, সন্ধ্যার মুখে আসবার সময় হলো! ওরে, পাখাটা নিয়ে আয় গীতু! 

গীতা মায়ের হাঁক ডাকে বের হয়ে আসে। বারান্দায় বসেছিল শঙ্কর—গীতার দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়। ক’ মাসেই দেহ-মনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। যৌবনচঞ্চল মেয়েটা পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে। সন্তানবতী গীতা আজ সার্থক হয়ে উেেছ। 

বেশ বলে চলেছে গীতা গলগল করে—খুব তো নাম ডাক, পাঁচশো টাকার গাইয়ে হয়েছ। ভাগ্নে হলে নেকলেস দিতে হবে কিন্তু। মামা হওয়া এমনি নয়। 

গীতার স্বভাব এতটুকু বদলায়নি। এতকাল নিজেকে কেন্দ্র করেই, তার স্বার্থকে ঘিরেই বেঁচে থাকবার চেষ্টা করেছে সে। বাইরে অপরের দিকে তাকাবার অবকাশ তার সেদিন ছিল না। আজও ঠিক তেমনি রয়ে গেছে, পরিধি সামান্য বেড়েছে মাত্র। মূলত সে একই রয়ে গেছে। 

এ বাড়ির একপাশে ভিত উঠছে, ইট-কাঠ জমা করা। কাদম্বিনী দেখায় শঙ্করকে—একতলা উঠে যাবে, তুই যদি একটু চেষ্টা করিস বাবা দোতলা উঠতেও দেরি হবে না। পাঁচজনে আসে—বলে, গাইয়ে শঙ্করবাবুর বাড়ি। তোরই তো এমন নাম-ডাক, বাড়িটার ছিরিও বদলাক। মন্টুর টাকাও পাব কিছু। বাকি তুই দে! 

হাসে শঙ্কর—হবে মা সবই হবে।

দু’চোখ দিয়ে কাকে খুঁজছে শঙ্কর। 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে নীতার এখনও দেখা নেই। এতক্ষণে ফেরা উচিত। এ বাড়িতে সেই সবচেয়ে মূল্যবান। অথচ দেখছে শঙ্কর, তার নাম পর্যন্ত যেন করে না মা! ইচ্ছে করে কথাটা এড়িয়ে যায়। শঙ্করই তোলে কথাটা নীতাকে দেখছি না! 

কাদম্বিনীর সহজ-সরল-ভাব এক নিমিষেই কেমন বদলে যায়। মুখ হাঁড়ি হয়ে ওঠে তার। জবাব দেয়— কে জানে, কদিন থেকে মেয়ের মেজাজ যেন বিগড়েছে। এদিকে আসে না—ওই বাইরের ঘরেই পড়ে থাকে। বলে, আপিস থেকে ছুটি নিয়ে পরীক্ষার পড়া করছি। গলা নামিয়ে বলে মা—বুঝলি শঙ্কর, মতির গুণেই গতি। হিংসাতেই গেল। গীতার উপরেই যত আক্রোশ। ঘরে পর্যন্ত ঢুকতে দেয় না গীতুকে। ও ঘরে গেলে দরজা থেকেই বিদায় করে নীতা। জ্বলে-পুড়ে তেমনি দশা হয়েছে! 

শঙ্কর কথা বলে না, মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগেকার অভাবের দিনের সেই নারীমূর্তি এই অতীতের যবনিকা ঠেলে জেগে উঠেছে অতর্কিতে। 

কাদম্বিনী মেয়ের উপর ঝাল ঝাড়তে থাকে। শঙ্কর অবাক হয়। চিরকালই নীতাকে কাদম্বিনী যেন অন্য চোখে দেখে। আজও সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। 

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নেমেছে। কুমড়োলতার ডগে গাঢ় হলুদ ফুলের হাসিফুটে ওঠে, নীরব পথটা ধরে এগিয়ে চলেছে চালাটার দিকে শঙ্কর। ঘাসে ঘাসে ছেয়ে গেছে পথটা—যাতায়াত বিশেষ নেই। পরিত্যক্ত ঘরের কোণে আশ্রয় নিয়েছে নীতা—সংসারের বাইরে। 

কাশির শব্দ শোনা যায়। নীতা বাইরে দাদার গলার স্বর শুনেছিল। ভেবেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। কিন্তু এলো না। জ্বরটা চেপে এসেছে—চুপ করে নীতা পড়ে আছে একা শূন্য ঘরে। কাশির দমকে জীর্ণ পাঁজরাগুলো সাঁই সাঁই করে নড়ছে। 

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে শঙ্কর। একফালি আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘদেহ মূর্তিটা। হ্যারিকেনটা উসকে দিতেই উঠে বসে নীতা। বালিশের তলায় কি একটা বস্তু শশব্যস্তে লুকোতে থাকে ওকে দেখে। 

—দাদা! 

নীতা ওকে এখানে দেখবে ঠিক ভাবতে পারেনি। একটু বিস্মিত হয়েছে। 

হাসছে শঙ্কর, দুষ্টুমির হাসি। পিঠোপিঠি ভাই-বোন—সহজভাবেই মিশে এসেছে। নীতাকে কি বলে ওঠে কৌতুকভরে। একটা কি লুকোতে দেখে এগিয়ে আসে শঙ্কর। বলে—ওটা কি রে নীতা? দেখি, দেখি? 

খপ করে ধরবার চেষ্টা করে ওর হাতটা। বালিশের নিচের থেকে জিনিসটাকে বের করবার চেষ্টা করে শঙ্কর। নীতা বাধা দেয় আর্তকণ্ঠে। 

—না-না, দোহাই তোমার বড়দা! অ্যাই বড়দা– 

কৌতূহল বেড়ে যায় শঙ্করের, আগেকার মতো চাঞ্চল্য ছেলেমানুষি ফিরে আসে। বলে ওঠে শঙ্কর–লক্ষণ যা দেখছি মোটেই সুবিধার নয়। 

চমকে ওঠে নীতা, মুখ চোখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে—না—না। অ্যাই! 

—কি রে, বুড়ো বয়সে প্রেমপত্র-ট্রেমপত্র নয় তো? দেখি, দেখি! 

—দাদা! আর্তনাদ করে ওঠে নীতা। 

মুখের তোয়ালেটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে, বালিশের নিচে গোঁজা প্রান্তটুকু সমেত। শঙ্কর চমকে ওঠে, যেন আর্তনাদ করে বেদনায়। 

—এ কি করেছিস নীতা! রক্ত! রক্ত উঠছে তোর কাশির সঙ্গে। গায়ে জ্বর! 

ব্যাকুলকণ্ঠে বলে নীতা—চুপ করো তুমি! ওরা জানে না, দূরেই সরে এসেছি। 

শঙ্করের মুখ থেকে হাসির আভা নিঃশেষ হয়ে গেছে। স্থির দৃষ্টিতে নীতার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসছে নীতা—মলিন কান্নাভেজা হাসি। বাতাসে-ঝরা বকুলের কান্না—পাখি ডেকে থেমে গেল। 

নীতা হাসছে, বলে চলেছে—এবার বোধহয় সব কাজ থেকে ছুটি পাব রে বড়দা! আমার কাজও ফুরিয়েছে—সেই সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনও। 

অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে শঙ্কর। সব দিক থেকে নীতা আজ নিঃস্ব। তার যা- কিছু ছিল সবই দিয়েছে সংসারকে। কটি হতভাগ্য মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে নিজের জীবনীশক্তিটুকু পর্যন্ত নিঃশেষ করেছে। আজ দিন ফিরেছে, এ বাড়ির মরা গাছে আবার এসেছে পত্রশোভা—ফুলের ইশারা। 

কিন্তু নীতার যাবার ডাক পড়েছে অন্য একে জগতে। 

সব দিক থেকে নিঃস্ব হয়েও নীতা আজ বিজয়ী হয়েছে। মুখে কোথাও ওর বেদনা নেই, যেন মুক্তির স্বাদ পেয়েছে সে অসীম আকাশের দিগন্তে। 

শঙ্কর বলে ওঠে—খুব খুশি হয়েছিস তুই? না? 

হাসছে নীতা, শঙ্করের কাছে তার গোপন কিছুই নেই। জবাব দেয় নীতা—কেন হব না! তোমার কণ্ঠ থেকে যে সুর বের হয়ে লোকের মনে হাসির-কান্নার ঢেউ আনে—তাতে তুমি কি খুশি হও না? আমার চেষ্টা সফল হয়েছে! ওরা বাঁচবার আশা পেয়েছে—নাই বা আর রইলাম সেখানে আমি। 

ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারে না শঙ্কর। নীতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে—সস্তা ভাবপ্রবণতায় বেশ মন ভরানো যায়। তুই একটা ইডিয়ট! কোনদিন জানিস না কি তুই চাস, বেদনা-দুঃখ তোর কোনখানে! কোথাও নিজের দাবি জানাতে পারিসনি। তাই একজনকে না পেয়েই—ঘরের ঠিকানা হারিয়ে তুই এই পথে আনন্দের সন্ধান করে নিজেকে জ্বালিয়ে খাক করেছিস। আর সান্ত্বনা দিয়েছিস ওই বলে মনকে। কাওয়ার্ড তুই! ভীরু! 

—দাদা! নীতা চমকে উঠেছে শঙ্করের নিষ্ঠুর এই আক্রমণে। 

আজ সব মুখোশ তার খুলে পড়েছে—অসহায় দুর্বল সে। এতদিন ধরে একটা প্রতিবাদের শক্ত বোঝাই বয়ে কাটিয়েছে নীতা। এক ধাক্কাতেই খুলে পড়েছে সব আবরণ। সহজ স্বাভাবিক বঞ্চিত নারীর রূপটাই প্রকট হয়ে উঠেছে। নিজের এই রূপ দেখে চমকে উঠেছে নীতা। 

শঙ্কর বলে চলেছে—তোকে বাঁচতে হবে নীতা। আমি অন্তত সেই চেষ্টা করব। আজ সে ভরসা আমার আছে। 

নীতার কাছে এগিয়ে আসে শঙ্কর। মাথায় হাত বোলাতে থাকে। নীতার দু’চোখে অশ্রু। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে নীতা—ভিক্ষে দেবে দয়া করে? 

হাসে শঙ্কর—তোর ভিক্ষাও তো আমি নিয়েছি তাহলে? 

—ছিঃ বড়দা! ও কথা শোনাও যে আমার মহাপাপ! 

—তবে আমার উপর ছেড়ে দে সব কিছু। এতদিন শুধু নিয়েছি দুহাতে, আজ দেবার জন্য আমারও মন চায় রে! 

রাত্রি নেমেছে। তারায় ভরা রাত্রি। নিবিড় তমসার মাঝে জীবনের অস্তিত্বের বিজয়কাহিনি ফুটে উঠেছে মহাকালের বুকে; একটা স্তব্ধ-প্রশান্তির মাঝে নীতা আজ নিজেকে সঁপে দেয়। শঙ্কর ওর চুলে বিলি কাটছে। বলে চলেছে—সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে নীতা। স্যানাটোরিয়ামের সুপার আমার বিশেষ পরিচিত। একটা ব্যবস্থা হবেই। 

—পাহাড়ের উপরে? 

—হ্যাঁ! দেখবি কি সুন্দর জায়গা! কালই আমি চলে যাব প্লেনে। ওখানে হোক—অন্যত্র হোক, একটা ব্যবস্থা করে আসবই। ততদিন ডাক্তারে যা বলবে তাই চুপ করে শুনে যাবি, কেমন? 

নীতা মাথা নাড়ে—আচ্ছা! 

পরক্ষণেই প্রশ্ন করে নীতা—হ্যাঁরে বড়দা, ছেলেবেলার সেই যাদব বাউলকে মনে পড়ে? ইয়া আলখাল্লা—গান গাইত, পথে পথে ঘুরত! আমারও মনে হয় তেমনি করে ঘুরি—কেবল ঘুরি। ঘর ছেড়ে পথে পথে— 

—ধ্যাৎ পাগলি! শঙ্কর ধমকে ওঠে। 

.

শঙ্করকে ওঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখে মা একটু অবাক হয়। শঙ্করের মুখ-চোখ কেমন থমথমে। 

রাত্রি নেমেছে। পুজো-পাঠ চুকে গেছে। শঙ্কর কথাটা জানায়। নীতার অসুখের কথা। সারা বাড়িতে আঁধার নেমেছে। 

কাদম্বিনী শঙ্করের মুখে কথাটা শুনে চমকে ওঠে, গীতার মুখও এতটুকু হয়ে যায়। 

—কি হবে বাবা! দুঃসাধ্য রোগ! শেষকালে কিনা নীতাকেই ধরল? 

শঙ্কর সাহস দেয়—আজকাল সেরে যায়; ব্যবস্থা করব আমি কোনো স্যানাটোরিয়ামে পাঠাবার। সে কদিন একটু সেবাযত্ন করো। অন্তত বকাঝকা কোরো না। ওকে শান্তিতে থাকতে দাও। ওর টাকা সংসারে আমিই দেব। 

মাধববাবু কথাটা শোনেন স্তব্ধ হয়ে। সামনে প্রুফ-শিটগুলো তুলে দেখবার উৎসাহ নেই। সারা বাড়িতে একটা স্তব্ধতা নামে,—রাতের আঁধার জড়ানো স্তব্ধতা। আকাশের তারাগুলো কাঁপছে। 

শঙ্কর বের হয়ে আসছে,—এতদিন পরে দায়িত্ব নিয়েছে সে। কঠিন দায়িত্ব-কর্তব্য করতে আজ সেও এগিয়ে আসে। হঠাৎ রান্নাঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। 

মা কাঁদছে। কুপির ম্লান আলোয় দেখে মায়ের চোখে জল। শঙ্করকে দেখে সামলাবার চেষ্টা করে সে। শঙ্কর এগিয়ে যায়, শত অভাব-অভিযোগের মাঝে বাঁচবার জন্য সংগ্রামক্লিষ্ট যে নারীকে এতদিন দেখেছিল এ সে নয়। স্নেহ প্রীতি আর ভালোবাসায় গড়া একটি মাতৃমূর্তি—যে সন্তানের বেদনায় কাঁদে বুকফাটা কান্নায়। 

কাদম্বিনী মুখে তুলে তাকাল। শঙ্কর মাকে বেশ কড়া কথাই বলেছিল একটু আগে। কাদম্বিনী বলে ওঠে—সত্যিই ওকে সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছি শঙ্কর। 

শঙ্কর চুপ করে থাকে। তার গুণমুগ্ধ অনেক প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন লোক আছে—আজ দরকার হয় নীতার জন্য তাদের প্রত্যেককেই আবেদন জানাবে, সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে ওকে বাঁচিয়ে তোলার। 

.

ছুটি! কাজ ফুরানো—প্রয়োজন ফুরানোর ডাক। সকাল বেলাতেই মাকে চা-খাবার নিয়ে ঢুকতে দেখে অবাক হয় নীতা। হঠাৎ যেন পৃথিবীর রঙ বদলে গেছে। আকাশে বাতাসে প্রথম দিনের সোনারোদ ফুটেছে। পাখি ডাকা আকাশ। সবুজ পৃথিবী তাকে প্রগাঢ় শান্তির সন্ধান দেয়। 

বাইরের দিকে তাকিয়েছিল নীতা, মেহেদি বেড়ার গায়ে এসেছে হালকা বেগুনি রং-এর ফুল—একটা ভ্রমর অকারণেই গুন-গুনিয়ে ফেরে ওর চারিপাশে। 

কাদম্বিনী ওর কাছে এগিয়ে যায়। গায়ে মাথায় হাত দিয়ে উত্তাপ পরীক্ষা করছে। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসে। 

—খেয়ে নে বাছাঁ। আজ শরীরটা কেমন? ডিম দুটো খেতেই হবে তোকে শঙ্কর বলে গেছে, আর ওই আপেলটা। 

—মা!

কাদম্বিনী ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ডাগর আয়ত দু’চোখ মেলে। ছলছল জলভরা সেই দৃষ্টি। কাঁদছে যেন মা! 

আজ আবার বাঁচতে ইচ্ছা করে এদের মাঝে নতুন করে। গীতাকে বলে ওঠে—চুলগুলো বেঁধে দে দিকি! ও কি লা? 

গীতা বেণী ঝুলিয়ে দিয়েছে, কলেজ যাবার সময় যেভাবে সাজত নীতা তেমনি করে। আয়নায় সেই হারানো অতীতের ছবি ভেসে ওঠে। 

সুন্দর জগৎ। মধুময় পরিবেশ! 

নীতা সহজভাবে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে—তোমার প্রুফ ঠিক আসছে বাবা? নতুন বইটা কতদূর করলে? 

মাধববাবুর সঙ্গে সহজভাবেই কথা বলে, যেন কিছুই হয়নি। মাধববাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন অবাক হয়ে, ও যেন এ বাড়ির আর কেউ নেই। সেই ভাবক্লিষ্ট মেয়েটি আর নয়, হালকা খুশিভরা ভরা একটি মেয়ে—জীবনে সব বিপদ-দুঃখকে সে সহজ করে নিয়েছে—জয় করেছে দুঃখকে। জীবনের একটা দর্শন একটা অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। 

ওর কথায় জবাব দেন মাধববাবু—এই ধরেছি মা। এই বইটাও ছাপা শেষ হয়ে এল! সেদিন গিয়েছিলাম প্রকাশকের দোকানে! তোর কথাও শুধেছিলেন। 

নীতা চুপ করে থাকে, সবার সব কাজই বুঝিয়ে দিয়ে ছুটির আশায় বসে আছে সে।

—বড়দি! 

গীতা গরম দুধ নিয়ে এসেছে। নীতা বই পড়ছিল। ওর ডাকে চমকে ওঠে।

—দুধটা খেয়ে নে। 

গীতাও আজ ওর সঙ্গে সহজভাবেই কথা বলে। 

সবাই যেন তার জন্য আজ ব্যস্ত। তাকে ছোট্ট ছেলের মতো মানুষ করে তুলতে চায় প্রীতি দিয়ে, স্নেহ দিয়ে। বলে ওঠে নীতা—তোদের জন্য কি শান্তি পাব না গীতা? চিরকালটা জ্বালাবি মুখপুড়ি! ওরে এ যে কালরোগ—তাই কেন সব তাতেই আগবাড়িয়ে আসিস? 

গীতা কথা বলে না, নীতা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। 

তার জীবনের শূন্যতা একজনের পূর্ণতার স্বাদে ভরে ওঠে, তাই নিয়েই তৃপ্ত হতে চায় সে। আজ সত্যই সে মুক্ত—তৃপ্ত। 

বাতাস জাগে—শন-শন শব্দ ভরা সেই বাতাস। কোন সুদূরে যেন মন চলে যায়। উদাস শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে মুক্ত আকাশের পানে। পাখির গান ভেসে আসে—কণ্ঠে সুর নিয়ে অসীম নীলিমায় পাখিটা উধাও হয়ে গেল—মিলিয়ে গেল। ফেরারি হয়ে গেল। 

.

সনৎ আপস করেছে জীবনের সঙ্গে। বারবার চেষ্টা করেছে ছকবাঁধা জীবন থেকে ছিটকে বের হয়ে যেতে অন্য পথে। কিন্তু বারবারই প্রতিহত হয়ে ফিরে গেছে নিজের সেই মাপবন্দি জগতে। যেন খাঁচায় বদ্ধ বাজপাখি—পিঙ্গল চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে—মুক্তির ব্যর্থ আশায় ডানা-ঝাপটায় খাঁচায়। ঠোঁট ডানা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে আঘাতে মুক্তির নিষ্ফল প্রচেষ্টায়। তবু মুক্তি পায় না। 

শেষ অবধি আপসই করেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের চিরন্তন স্বাভাবিক জীবনকে মেনে নিয়েছে সে। সামনে তার নতুন দায়িত্ব। নতুন অতিথির আগমনবার্তা তাকেও বদলে দিয়েছে। 

আবার কাজেই যোগ দিয়েছে। ফিরে গেছে আপিসের সেই পরিবেশে, সহজভাবেই মেনে নিয়েছে সব কিছু। 

আজ রক্তে আর প্রতিবাদের আগুন জ্বলে না। সেকশনে ঢুকতে কানে আসে প্রবোধবাবুর টিপ্পনি। দেওয়ালেরও কান আছে। ইতিমধ্যে কি জানি কেমন করে কথাটা রটে গেছে যে, সনৎ এ চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি খুঁজছে—না হয় প্রফেসারি করবে। 

অনেকে আবার রটিয়ে দিয়েছে চাকরি নাকি সে পেয়েও গেছে। তাই সেদিন আপিসে ফিরে গিয়ে ওকে সহজভাবে কাজ করতে দেখে অনেকেই মুখ তুলে চায়। 

নিজেদের মধ্যে দু-একটা ফুসফাস কথাও হয়। 

সনৎ কোনোদিকে কান দেয় না। 

বড়বাবু মাথা নাড়ে—এরই জন্য ছেলেরা আজকাল এত বেশি ফেল করে হে! এইতো দু-লাইন করেক্ট করে ড্রাফট লিখতে পারে না, সে কিনা করবে প্রফেসারি! যত্তো সব! 

ইতিমধ্যে কালনেমির লঙ্কাভাগ পর্বও শুরু হয়ে গেছে। একটা পোস্ট খালি হবে, তার জন্য বড়বাবু সাহেবের কাছে দরবার শুরু করেছে। প্রবোধবাবুর ভাইপোর জন্য প্রবোধবাবুও চেষ্টা করেছে। এ হেন সময়ে সনৎ আবার ফিরে এল চাকরিতে। দুজনেই মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ হয়।

কানে আসে প্রবোধবাবুর মন্তব্য—ঢেঁকি যতই মাথা নাড়ুক না কেন, হে হে বাবা, গর্তেই পড়বে শেষমেশ 

বড়বাবু বিরক্তিভরে বলে—তাই তো দেখছি হে! 

প্রবোধবাবু গজরায়—অনার্স গ্র্যাজুয়েট হয়ে টিকে রইলাম, আর উনি কি না সেকেন্ড ক্লাস এম-এ হয়ে যাবেন অন্য লাইনে! হাতি-ঘোড়া গেল তল ভেড়া বলে কত জল। 

সনতের কানে আসে কথাগুলো, কিন্তু আজ সে প্রতিবাদ করে না। অনাগত ভবিষ্যৎ আর গীতার কথা মনে পড়ে। ছোট্ট ঘরে আসছে নতুন অতিথি, তাকে বরণ করে নেবে। 

নীতার কথা মনে পড়ে—দুঃখের মাঝেই দুঃখকে সয়ে তাকে সহজ করে নেবার সাধনাই সবচেয়ে বড় সাধনা। 

নীতা সব হারিয়েও বাঁচবার স্বপ্ন দেখে। সনৎ এতদিনে সেই কথাটার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করেছে। জীবনকে সহজ করে নেবার চেষ্টাই করেছে সে। এ হয়তো তার পরাজয় — মাথা নিচু করে হার মানা, তাই কোথায় এটা সত্য বলে মানতে পারে না—সংগ্রামই করেছে সে, প্রতি পদেপদে বাঁচবার জন্য এই সংগ্রাম—এবং জয় করবে সে। 

শঙ্কর কিছুদিনের মধ্যেই ছুটোছুটি শুরু করে একটা ব্যবস্থা করে এনেছে। এতদিন নিজের ক্ষমতার উপর তার নিজেরই বিশ্বাস ছিল না। আজ সেই লুপ্ত শক্তিসামর্থ্য জেগে উঠেছে। আজ সে অনুভব করেছে নিঃশেষ সাধনায় যে সমাজের মানুষকে সুখী করতে পারে— সমাজের মানুষও তাকে ভোলে না। তার জন্য তারাও দুঃখবোধ করে, সাহায্য করে সর্বতোভাবে। 

একজনের প্রতি নিঃশেষ প্রীতি আর ভালোবাসা তাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অর্থ! আজ আর টাকার অভাব নেই। প্রতিপত্তি! তাও পেয়েছে সে। কয়েকজন পদস্থ ডাক্তার তার গুণমুগ্ধ। তাদের সাহায্যে তিনদিনের মধ্যে সে সিট জোগাড় করে ফেলে। 

শঙ্কর বলে ওঠে—গান শোনাব ডাক্তার সেন, কিন্তু আমার বোনের টি. বি. তার একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। তাকে দেখেননি ডাক্তারবাবু, দেখলে বুঝতেন যাদের কখনও ভোলা যায় না—নীতা তাদেরই দলের। 

ডাক্তার সেন শঙ্করের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সদাহাস্যময় ছেলেটির উজ্জ্বল চোখ-মুখে একটা চিন্তার কালোছায়া। কারণে-অকারণে যে হাসি আর গানের সুরে ভরিয়ে রাখে চারিদিকে—প্রাণের উচ্ছল আনন্দ যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলে পাহাড়ি ঝরনার মতো—সেই শঙ্কর সম্পূর্ণ বদলে গেছে তার বোনের ভাবনায়। 

ডাক্তার সেন প্রশ্ন করেন—বাইরে কোথাও যাবে? 

—বাইরে? 

—কোনো স্যানাটোরিয়ামে? 

শঙ্কর তাই খুঁজছে। বাড়িতে নীতার ঠিক চিকিৎসা হবে না। ওই পরিবেশ থেকে তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায় সে। ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে—গেলে সারবে তো? 

—নিশ্চয়ই, আজকাল প্রথম স্টেজে ধরা পড়লে এটা সারানো কষ্টকর কিছুই নয়।

—তাহলে একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করুন যত তাড়াতাড়ি হয়। শঙ্কর অধৈর্য হয়ে পড়েছে। এলোমেলো বকে চলেছে সে। 

—ওকে সারানো দরকার ডাঃ সেন। এ যে আমারই কর্তব্য। 

ডাঃ সেনও কি ভাবছেন ওর দিকে তাকিয়ে, বলে ওঠেন—লেট আস ট্রাই। আশা করি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইমিডিয়েটলি। 

ডাঃ সেন ট্রাঙ্ক টেলিফোনে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেন। শঙ্কর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে দূরের সেই খবরের। 

.

একক নির্বাসিত জীবন। একফালি রোদ জানলা দিয়ে এসে লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। গাছে পাতায় সবুজ আভা। পাখি ডাকা কলোনির খোয়া ঢাকা পথ দিয়ে বিকাল বেলায়, দলে দলে ছেলেমেয়েরা ফিরছে স্কুল থেকে, তাদের কলরবের শব্দ কানে আসে। বৈচিত্র্যময় জগৎ—পাখি ডাকে, ফুল ফোটে——ওরা বেঁচে আছে। দুঃখ-সুখ আনন্দ-বেদনা সবকিছুর মাঝে বেঁচে থাকে ওরা। 

আজ নীতার মনেও বাঁচবার দুর্বার আগ্রহ। একটি সংসার—তেমনি কাকলিভরা কার আধো আধো কণ্ঠস্বর মনে পড়ে। সন্ধ্যার আবছা আলোয় লতায় লতায় ফুটেছে গাঢ় হলুদ ঝিঙে ফুল-সন্ধ্যামালতীর লাল আভা প্রতিবিম্ব তোলে শেষ রশ্মির গাঢ় লালিমায়। 

কার পথ তাকিয়ে বসে থাকা! একটি শান্ত-গৃহের স্বপ্নসাধ। নীতা মাঝে মাঝে কেমন স্বপ্ন দেখে। 

হঠাৎ কাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে যায়। 

সনৎ এসেছে বেশ কিছুদিন পরে। সেই বিকালের ঘটনাটা মনে পড়ে। সেই বিচিত্র ডাক শোনা আনমনা লোকটি কোথায় হারিয়ে গেছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে বিস্মিত বেদনাভরা নির্বাক দৃষ্টিতে। 

নীতার চোহরায় এসেছে ম্লান একটা আভা, চুলগুলো উশকো-খুশকো, চোখের ঔজ্জ্বল্যই বেড়েছে মাত্র। ওকে দেখে সহজ-স্বাভাবিক সুরে অভ্যর্থনা জানায় নীতা—এসো! দাঁড়িয়ে রইলে যে? 

সনৎ অপরাধীর মতো ঘরে ঢুকল! পাশেই টিনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে প্রশ্ন করে— কেমন আছ? 

নীতা হাসিমুখে জবাব দেয়—ভালোই। 

তাকিয়ে থাকে ওর দিকে নীতা। যে সনৎ একদিন নিঃশেষে তাকে কাছে পেতে তাকিয়েছিল এ সেই মানুষটি কিনা তাই ভাবে। তার জীবনের সব আশার মুকুল যাকে কেন্দ্র করে ফুটেছিল আজ সে কাছে এসেছে, কিন্তু নিঃশেষে হারিয়ে গেছে সেই সৌরভ। আজ আর সনৎকে এড়াবার চেষ্টা করতে হবে না, তার জীর্ণ পোকাধরা’ এই অকেজো দেহ আর পঙ্গু মনের কোনো দামই নেই কারও কাছে। 

সনৎ বলে ওঠে—সেদিনের ওইসব কথার জন্য লজ্জার শেষ নেই। 

নীতা চমকে ওঠে। 

বহু দূরে পাখি ডাকছে, বাতাসে ঝরা ফুলের গন্ধ। এক ফালি মেঘ পড়ন্ত সূর্যের শেষ আভায় রঙের তুফান তুলে কোন অসীমে উধাও হয়ে গেল। দূর থেকে কে ডেকে ফিরে গেল। 

মুখ তুলে তাকাল নীতা ওর দিকে। দু’চাখে তার কামনাব্যাকুল দৃষ্টি, নির্বাণোম্মুখ প্রদীপের শেষ আভা আঁধারতল উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। আজ জীবনের কোনো সত্যকেই লুকিয়ে রাখতে চায় না সে। 

—কেন? 

সনৎ জবাব দিতে পারে না। একবার মুখ তুলে ওর আয়ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। নীতা বলে ওঠে—লজ্জার কিছু নেই সনৎ, লজ্জা নয়, দুঃখ আর ব্যর্থতা রয়ে গেল আমারই। ক্ষণিকের জন্যও আজ মনের সব গোপনীয়তা প্রকাশ করেছে নীতা। যাবার বেলা পিছন ফিরে তার জীবনের সবুজ দিনগুলোকে শেষবারের মতো দেখতে চায়, এতটুকু চাওয়া যদি অপরাধ হয়, হোক। নীতা চুপ করে তাকিয়ে রয়েছে। 

সনতের মনে আসে দূরাগত একটা শব্দ—সুর। 

—নীতা। 

নীতা আজ কোনো কিছুই লুকোতে চায় না। বলে ওঠে ভারী গলায়—আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম সনৎ! মেয়েরা সকলেই যা চায় আমিও তাই চেয়েছিলাম। কিন্তু 

কণ্ঠস্বর যেন ভারী হয়ে আসে। নীতার সব দুঃখ বা ব্যর্থতা নীরব চোখের পাতায় কান্না হয়ে ভাসে। পাখির ডাক থেমে গেছে, নেমেছে রাত্রির অন্তহীন তমসা। নিকোনো আকাশে ফুটে ওঠে দু-একটা তারাফুল। কথা কইল নীতাই। ওসব চিন্তা আজ আঁধারে হারিয়ে গেছে। নীতা বলে চলেছে।

—আগামী সোমবারই চলে যাচ্ছি শিলং! সেইখানে স্যানেটোরিয়ামে সিট পেয়েছি। 

—শিলং পাহাড়ে! 

হাসে নীতা—হ্যাঁ! 

খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে যেম অন্য কোনো নীতা। কথার সুরে সব গ্লানি মুছে গেছে। চোখের সামনে ওর নতুন দেশের স্বপ্ন। পাহাড়—সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তাটা গেছে, ছোট ছোট মেঘ জমে কালো সবুজ পাহাড়ের কোলে ঝরনার ঝরঝর শব্দ আর পাইন বনের ঝড়ের সুরে মিশে আকাশ বাতাস ভরে ওঠে! তারই স্বপ্ন দেখছে নীতা 

—চমৎকার জায়গা শিলং! 

হঠাৎ থেমে যায় সে। সনতের দিকে তাকাল। সনতের চোখের সামনে অতীতে কর্মব্যস্ত একটি মেয়ের ছবি ভেসে ওঠে, শত কাজের ফাঁকে যে বাঁচবার স্বপ্ন দেখেছিল। সে আর সনৎ যাবে সেই দেশে কাজ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে! কথাটা মনে পড়ে নীতার। 

—তুমি আর আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম সনৎ, আজ একা চলেছি সেখানে। হয়তো আর কোনোদিনই— 

চুপ করল নীতা। জমাট হতাশা আর ব্যর্থতা তার সব সুর যেন রুদ্ধ করে তুলেছে। নীতা এই দুর্বলতা চেপেই রাখতে চায় সকলের কাছে। হঠাৎ ওর দিকে ফিরে বলে ওঠে—রাত্রি হয়ে গেছে তোমাকে আবার ফিরতে হবে। তুমি যাও। 

মনের সব চিন্তাধারাকে কঠিন নিষ্পেষণে স্তব্ধ করে দিল নীতা। সনৎ দাঁড়ায়, কি ভেবে বলে—যাবার আগে একদিন আসব? 

যেন অনুরোধ জানাচ্ছে সে। বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নিজ্বালা। হু-হু শব্দে বইছে বাতাস। আনমনে জবাব দেয় নীতা—আর না আসাই ভালো সনৎ! 

মনের মধ্যে যেন একটা ঝড়ের সুর; এলোমেলো কেমন চিন্তা ভাবনাগুলো ভিড় করে আসে! তাদের দাবিয়ে দিয়ে জোরের সঙ্গে বলে নীতা—তুমি আর এসো না সনৎ! এসো না! 

চুপ করে বের হয়ে এলো সনৎ। নীতা এড়িয়ে চলতে চায় জীবনের না পাওয়ার ওই করুণ স্মৃতিটুকুকে। 

সনৎ আবার মন দিয়েই সেই চাকরি করছে। অধ্যাপকগিরির চাকরিতে, পড়াশোনায় আর প্রবৃত্তি নেই, সব. কেমন শান্ত-স্থির হয়ে গেছে। প্রাণের স্রোত নেই—দমবন্ধ জলার মতো, ক্লান্তি আর প্রাণহীন। নিস্তব্ধতার থিকথিকে শেওলা জমেছে খাদ-খন্দে জীবনের প্রবাহে। 

একা বসে আছে নীতা। অনুভব করে দু’চোখ দিয়ে তার চোখের জল নেমেছে, বুকভরা ব্যর্থতার কান্না চেপে অতীতের ব্যর্থ বসন্তকে বিদায় জানায় সে—শেষ বিদায় 

মন কেমন করে—এতদিন যাকে জেনেশুনেও মনের গোপন থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি নিঃশেষে, আজ অতি সহজ স্বাভাবিক ভাবেই সে সরে গেল। 

ফুল ফোটে—ঝরে। বৃত্তে রেখে যায় ফলের সঙ্কেত। কিন্তু তার জীবন বৃত্তে কীটদষ্ট ফুলের ব্যর্থ পরিণতি। নিঃশেষিত সৌরভ, লুপ্ত হয়ে গেছে তার সব বর্ণ আর গৌরব, এখন শুধু পথপানে  তাকিয়ে থাকা, আর ঝরে যাবার জন্যই এই নীরব প্রতীক্ষা করা। 

কান্না আসে! আসুক—চোখ ছেয়ে নামুক ব্যর্থকান্না, বন্ধুর ঊষর মৃত্তিকার বুক তবু ভুলেও শ্যামল হবে না কোনোদিন। পরেশ ফেরিওয়ালা থেকে নিজের চেষ্টায় পরিশ্রমে কিছু মূলধন জোগাড় করে ট্যাক্সি কিনেছিল ইনস্টলমেন্টে, এখন একটা থেকে দুটো ট্যাক্সির মালিক হয়েছে। কঠিন পরিশ্রমী ছোকরা, গুপি মিত্তিরের মতো মিনমিনে হয়ে যায়নি কেরানিগিরি শুরু করে, এখনও সে সজীব সতেজ। মনের কোণে একটা স্মৃতি বারবার সবুজ হয়ে জাগে—সেই স্মৃতি, একটা মুখ—একটু হাসির আভা যেন পথ দেখায়। তাই হয়তো ট্যাক্সি ড্রাইভারের মতো জীবনে থেকেও সেসব কিছু নোংরামির ঊর্ধ্বে রয়েছে আজও। 

স্ট্যান্ডে আরো দিলদোস্তী ড্রাইভাররা মাঝে মাঝে রসিকতা করে—আজ তো বহুত কামাই করছ দাদা, হোক না— 

কে এগিয়ে এসে বোতলটা বাড়িয়ে দেয়। 

—এক আধটু চললে আউর? কি একটা ইশারা করে দেখায়, কদর্য ভঙ্গিতে পরেশকে।

ওপাশে ওরা হাসছে। এই পরিবেশে পরেশের তবু পা-পিছলায়নি। পরেশ জবাব দেয় ও সব চলে না ভাই। 

হতাশ হয় বন্ধুর দল, বলে—বুদ্ধু তুমি। স্রেফ বুদ্ধু সাদা চোখে যে ট্যাক্সি খেপ মারে সে শালা হয় দেবতা নয়তো পাক্কা শয়তান। 

ওদের কথায় হাসে পরেশ। কেন জানে না। বারবার একজনের কথা মনে পড়ে। একটি বিয়ের রাত্রি, আলো-ঝলমল পরিবেশ, শাঁখের শব্দ উলুধ্বনির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে, সামনে তার নীতা। এত কাছে সে কাউকে দেখেনি। 

বলেছিল নীতা—মানুষ হবার চেষ্টা করো পরেশ। ঘর হারিয়ে সব কিছু হারিয়েছি আমরা। ওইটুকু পরিচয় তবু কেন থাকবে না। 

—ট্যাক্সি? 

কোনো বাবু ডাকছে। নিমেষে নিপুণ হাতের এক মোচড়ে গাড়িখানাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওদিকে ছুটল পরেশ। মাপমতো পায়ের চাপে একটু শব্দ করে গাড়িখানাকে দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে দেয়। পিছনে ফিরে যাত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়। বলে—শঙ্করদা! 

শঙ্কর গাড়ির জন্য দাঁড়িয়েছিল! ওর গাড়িতেই উঠে পড়ে। 

—বাড়ি-ঘুরে একবার হাওড়া স্টেশনে আসতে হবে। 

একটি চলতি গাড়িকে ওভারটেক করে রাস্তার দিকে নজর রেখে বলে ওঠে পরেশ—কি দাদা, আবার দিল্লি বোম্বে যাচ্ছ? খুব আচ্ছা গাইছ শুনলাম। 

শঙ্কর কি ভাবছে। স্যানাটোরিয়ামে সিট বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। এবার নীতাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারলে হয়তো চিকিৎসার একটা সুরাহা হবে, বেঁচে উঠবে নীতা। পরেশের কথাটা কানে আসতে আনমনে জবাব দেয়-দেখি কতদূর যেতে পারি! 

.

কাদম্বিনীর চোখ ছলছল, মাধববাবু দাঁড়িয়ে আছেন চুপ করে। মন্টুও। গীতার দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা। 

ওরা সবাই রইল; মনে ওদের আশার আলো। বাড়ির দোতলা উঠছে, গীতার হাতে আগামী অতিথির জন্য একটা ছোট জামার ডিজাইন। মাধববাবু ধরা গলায় বলেন—বইটা সামনের মাসে বের হবে নীতা! 

নীতা যাবার আয়োজন করছে। আজ বাড়ির সবাইকে কেমন ভালো লাগে। এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চোখে জল আসে। বাবার কথায় সহজভাবে বলবার চেষ্টা করে—এক কপি পাঠিয়ে দিও কিন্তু! কিরে গীতা, খোকা হলে মিষ্টিটা ডাকেই পাঠাবি? ফাঁকি দিবি না কিন্তু! ছোটবাবু তোমার জন্য আনব একটা সোয়েটার। কি রে, এতবড় ছেলে চোখের জল ফেলে? আরে? 

এবাড়ির মায়া কাটিয়ে আজ যেন যাচ্ছে সে। 

বাইরে গাড়িতে এসে উঠল। পরেশ ওকে দেখে চমকে ওঠে। সেই যৌবনোচ্ছল সদাহাস্যময়ী মেয়েটির চোখে আবছা জলধারা। 

শঙ্করের সঙ্গে নীতাকে উঠতে দেখে একটু অবাক হয় পরেশ। 

—তুমি কোথায় যাবে? 

নীতা হাসবার চেষ্টা করে—স্যানাটোরিয়ামে। রোগটা রাজ-রোগ কিনা! 

চমকে ওঠে পরেশ। তার মুখে এক পোঁচ কালি কে বুলিয়ে দেয়। একটা কল্পনার চরম অপমৃত্যু। জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলবার যে দিয়েছিল নীরব অনুপ্রেরণা—সেই কল্পনা আজ পিছন থেকে মুছে গেল নিঃশেষে, কোনো অতি আপনজন আজ চলে গেল দূর-বিদেশে, ফিরবে না আর কোনোদিন। 

পরেশ মুখ বুজে গাড়ি চালাচ্ছে। নীতা শঙ্কর চুপ করে বসে আছে, নীতা সার্সিটা তুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। 

শঙ্কর বলে—হাওয়া আসছে, ঠাণ্ডা হাওয়া। 

—খোলা থাকবে না? 

—না? শঙ্কর ওর দিকের সার্সিটা বন্ধ করে দেয়। কোনো কথাই বলে না নীতা, আজ বিনা প্রতিবাদে ওদের হাতে নিজেকে তুলে দিয়েছে। 

—বেশ ভালো লাগে নারে বড়দা, এমনি করে বেড়াতে? 

খুশির আবেগে যেন উছলে পড়ছে নীতা। শঙ্কর চুপ করে বসে আছে, পরেশও। নীতা ওদের এই স্তব্ধতায় বিস্মিত হয়। নীতাই বলে ওঠে—বাঃ রে, তোর মুখে কি তালা-চাবি পড়ে গেল, অ্যাই পরেশ? কথাই বলছিস না যে? ও বড়দা– 

অন্ধকার আর আলো ভরা রাস্তায় মসৃণ গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িটা। সামনের পথের দিকে নজর রেখে পরেশ সাড়া দেয়—এমনিই! 

হাসে নীতা—তোরা ভাবছিস এই বুঝি শেষ যাওয়া! মোটেই নয় রে! দেখবি সেরে উঠে ফিরে আসব তখন চিনতেই পারবি না, টকটকে রঙ এইসা মোটা হবো, হাঁ করে তাকিয়ে থাকবি। লোকজন, গাড়ির ভিড় ঠেলে গাড়ি এসে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেছে। মালপত্র নামিয়ে নিয়ে চলছে শঙ্কর কুলি ডেকে। 

নীতা নেমে দাঁড়াল, পরেশ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা; আজ সবকিছুই ভাল লাগে—পরেশকেও। 

—চুপ করে আছ যে? 

পরেশ যেন সবকিছু ভুলে যায়, লোকজন—কোলাহল। একটি শান্ত-সবুজ পরিবেশের ছবি ভেসে ওঠে; অনেকদিনের চেনা-জানা ওই নীতাকে আজ নতুন করে দেখে পরেশ। পরেশ বলে—তুমি চলে যাচ্ছ? 

হাসছে নীতা—আবার ফিরে আসব পরেশ। আবার ভালো হয়ে আসব। 

তাই এসো। ফিরে এসো তুমি। 

ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল নীতা। 

পরেশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় পরেশের, কি যেন আপনজনকে আজ হারিয়ে ফেলেছে সে। এত উদ্যম-পরিশ্রম যার জন্য সেই যেন হঠাৎ আনমনে তাকে ডাক দিয়ে দূরে চলে গেল। 

এ-এক বিচিত্র অনুভূতি, সারা মনটা শূন্য উদাস হয়ে গেছে। এত প্রচেষ্টা যেন অর্থহীন হয়ে ওঠে। 

—ট্যাক্সি! এই ট্যাক্সি! 

কারা ডাকছে তাকে। অন্যসময় প্যাসেঞ্জার কোনোদিনই ফেরায়নি পরেশ, একটু বিশ্রাম না নিয়েই গাড়ি চালিয়েছে। আজ! …আজ যেন মন চায় না আর; ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সে। জবাব দেয়,—যাবে না এ গাড়ি! 

—কেন? 

বিরক্ত হয়ে ওঠে পরেশ। যেন নিজের মন বলতে কিছু নেই। একদণ্ডও তার কথা শোনবার অবকাশ মিলবে না। কড়া-স্বরেই জবাব দেয়। এই প্রথম এড়িয়ে যায় পরেশ প্যাসেঞ্জারকে, – গাড়ি খারাপ! প্যাসেঞ্জার নেব না। 

চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। ওদের ট্রেন ছাড়ার শব্দ কানে আসে। নীতা চলে গেল। শূন্য গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পরেশ মহানগরীর পথে লক্ষ্যভ্রষ্টের মতো। 

একজনকে ছেড়েও ঠিকমতো চলছে মাধববাবুর সংসার। নীতার জন্য কাদম্বিনীর মনের শূন্যস্থান পূর্ণ করেছে গীতাই। বাড়িটার রূপ বদলাচ্ছে, দোতলা উঠেছে। 

বাড়িতে উঠেছে কলরব কোলাহল, নতুন অতিথির আবির্ভাব ঘটেছে, মাধববাবুর নতুন ব‍ই বের হয়েছে, ভালোই চলছে বই। প্রকাশক তাগাদা দেয় নতুন বই-এর জন্য। 

ছোট্ট বাচ্চাটার কলরবে সব ভরে যায়, গীতা হাসে, মন্টুও আপিস যাতায়াত করে কাঠের জুতো পরে। আবার অনেকটা সুস্থ কর্মক্ষম হয়ে উঠেছে সে। 

বাড়ির কাজে বাধা দেয় শঙ্করই। বাইরের ঘরখানা ভেঙে ঘর তোলবার আয়োজন করেছে কাদম্বিনী, টিনের বেড়ার ধারে সবুজ কুমড়োলতা আর কলাগাছের প্রহরা। এই ঘরে প্রথমে থাকত শঙ্কর—তারপর নীতাই থাকত, কত স্মৃতি-জড়ানো ওই ঘরটুকু, নীতার চিহ্ন আজও ওর সর্বাঙ্গে মাখানো। ওটা ভাঙতে চায় না শঙ্কর। বাধা দেয় শঙ্কর—ও ফিরে এলে তবে ওটা ভেঙো মা। 

–সে কিরে? বিশ্রী লাগবে যে. নতুন দোতলা বাড়ির পাশে।

-–তোমার অতীতের পরিচয় একটা জায়গাতেও থাকুক মা। কাদম্বিনী চুপ করে থাকে। 

মাধববাবুও বলেন—তাই থাকুক বড়বউ! নইলে নীতা এসে চিনতে পারবে কেন? আজকের চিঠিতেও লিখব! ওর ঘর তেমনই আছে। ও ফিরে এলে ওর মনোমতো করে করবো। 

শঙ্কর কথা বলে না–বাবার দিকে তাকাল। বৃদ্ধ মাধববাবুর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে। বলে ওঠেন—তুই ওদিকে যাবি বলছিলি না? 

শঙ্কর আসামে যাবে অনুষ্ঠান করতে, ইচ্ছে আছে গৌহাটি থেকে উঠে যাবে শিলং-এ, দেখে আসবে নীতাকে। মাধববাবুর কথায় সায় দেয়—ভাবছি যাব। 

—নতুন বইখানা নিয়ে যাবি, কত আশা ছিল ওর। আর ওই গীতার বাচ্চাটার ফটো একখানা প্রতি চিঠিতেই লেখে সে। 

শঙ্কর বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

.

সন্ধ্যা নেমে আসছে! আবছা মেঘগুলো ক্লান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ের গায়ে গায়ে, যেন এক বুনো হাতি নেমেছে মন থেকে, আনমনে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় এদিক-ওদিক, সাদা একটা পাতলা মেঘ ঢেকে ফেলে সব কিছু, পাইন বনে জাগে মত্ত হাওয়া, লম্বা লম্বা গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, টিলার এখানে-ওখানে বাতি জ্বলে—আকাশের দিকে উঠে গেছে দু-একটা আলো। 

কি যেন স্বপ্ন দেখছে সে! …খালের ওপরে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের সবুজ পাতা বাতাসে দুলছে; ডাকছে দু-একটা পাখি 

চমকে ওঠে নীতা! কি এক স্বপ্ন দেখছে সে! কোথায় ফেলে আসা উপনিবেশের সঙ্গীরা, স্কুলের বহু চেনা—অচেনা মুখ—আপিসের সেই দিনগুলো—সনৎ পরেশ কলকাতার কর্মব্যস্ত জীবন সবকিছু যেন মিশিয়ে আছে ওই সুরের পরতে পরতে। 

সামনে চিঠি দু’খানা খোলা পড়ে আছে। সনৎ লিখেছে— 

—মরুতীর হতে সুধাশ্যামল কোনো জীবনের স্বপ্ন। 

দেখা করতে আসছে শঙ্কর। 

বাবা লিখেছেন বাড়ির সংবাদ, দোতলা উঠেছে—গীতার ছেলেটা ভয়ানক দুষ্টু হয়েছে, যেন মাধববাবুর সবকাজ পণ্ড করার জন্যই দিন-রাত মতলব খোঁজে—নতুন বই নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত, মন্টু সেরে উঠেছে, সবাই তারই পথ তাকিয়ে আছে, কবে ফিরবে সে। 

আবার ফিরে যাবে নীতা তাদের মধ্যে। কেমন মিষ্টি একটা সবুজ স্বপ্ন দেখে নীতা সনতের চিঠিখানা তুলে ধরে, সারা মনে মুখে-চোখে ফুটে ওঠে খুশির আভা—জীবনের. ইশারা। 

জানলার বাইরে পাহাড়ের ঢেউ একটার পর একটা স্তরে স্তরে উঠে গেছে আকাশের দিকে মাথা তুলে। জিরি জিরি পাইন বনে হাঁকে শোঁ-শোঁ হাওয়া। 

সুরটা কেঁপে উঠছে। স্যানাটোরিয়ামে বসে শুনছে নীতা, শঙ্কর গাইছে, গৌহাটি স্টেশন থেকে; খাসিয়া পাহাড়ের দূর ছায়াঘন বনে লেগেছে রাতের অন্ধকার, অতীতের কত স্মৃতি সৌরভ জড়ানো সুর। বাড়ির কথা মনে পড়ে, মনে হয় শঙ্কর তার সামনেই বসে রয়েছে, জানলার ফাঁক দিয়ে লুটিয়ে পড়েছে একফালি আলো; কলাগাছের পাতাগুলো বাতাসে দোল খায়। সেই পরিবেশে ওর সুর উঠেছে। আজকের শঙ্করের সুরে মিশে যাচ্ছে অতীতের সেই দিনগুলো। 

কিন্তু সে বহুদূরের ঠিকানা। সামনে বাবার চিঠিখানা বহু দূরের স্বপ্ন বয়ে আনে। নীতা হাতে নিয়ে অনুভব করে তারই নিজের হাতে লাগানো গন্ধরাজ ফুলের সৌরভ স্পর্শ। 

কে জানে গাছটা কতবড় হয়ে উঠেছে—কত ফুল ফুটেছে। 

কেমন যেন ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় আবার সেই জীবনে। সেও বাঁচবে, সনতের চোখে—এক নজরে পরেশের চোখে দেখছে জীবনের সঙ্কেত। তারই অনুরণন এই শঙ্করের অসীমস্পর্শী সুরের মায়ায়। 

নার্স টেম্পারেচার নিতে এসেছে, মাথার সামনে টেম্পারেচার চার্টটার দিকে তাকিয়ে থাকে, লাল গ্রাফটা ওঠা-নামা করেছে একটা বিচিত্র ভঙ্গিতে। 

—কবে এখান থেকে যেতে হবে নার্স? 

—সেরে উঠেছেন তো, কিছুদিন পরই ফিরে যাবেন। 

—ফিরে যাব? 

নীতা স্বপ্ন দেখছে, সুরটা তখনও নীরব আকাশে জেগে রয়েছে! ঠুংরির করুণ মূর্ছনা—পিয়া সনে মিলন কি আশ সখিরে! 

সুরটা মনের সব কাঠিন্যকে দূর করে দিয়েছে। গৌহাটি থেকে প্রোগ্রাম শেষ করে কালই এসে পড়বে শঙ্কর। 

বলে ওঠে নীতা—কালই দাদা আসছে নার্স, ওর সঙ্গে এইবারেই যেতে পারব না? ব্যাকুল কন্ঠে যেন আবেদন জানায় নীতা। 

নার্স আশ্বাস দেয়—সেরে উঠলে আর কেউ এখানে থাকে না। 

রাত্রি কাটে প্রহর গুনে, ঘড়িটা চলেছে যেন ধীর একতালে। কাল সকালে আসছে শঙ্কর, বাড়ির খবর দিয়ে আসবে, কত কথা যেন জমে আছে নীতার মনে। এখানের অনেক খবর। 

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর মনের চাঞ্চল্যের বিন্দুমাত্র স্পর্শ ওতে লাগেনি। ভোরের আলো জেগে ওঠে পাহাড়ের মাথায়, পাইন বনের ফাঁক দিয়ে লুটিয়ে পড়েছে এক ঝলক আলো। 

দরজার পাশ দিয়ে জুতোর শব্দ শুনে ডাক দেয়—নার্স! 

নার্স এগিয়ে আসে—এত ঠাণ্ডায় উঠবেন না। 

—সকালের গাড়ি আসতে দেরি কত? 

—সবে তো ভোর হয়েছে, অনেক দেরি।

একটু যেন হতাশ হয়েছে নীতা। 

—অনেক দেরি, না? 

নার্স কম্বলটা ভালো করে মুড়ে দেয় পায়ের দিকে; নীতা ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের পানে, মনের ভিতর কি যেন চাঞ্চল্য জেগেছে। আজ মনে হয় আকাশে বাতাসে কিসের সুর—বাড়ির কথা মনে পড়ে,…ব্যাকুল হয়ে সে পথ তাকিয়ে আছে শঙ্করের। 

কর্মব্যস্ত শিলং শহরের বুকে সবে জাগরণ শুরু হয়েছে। ইয়ার্ডলি লেকের জলের ধারে দু-চারজন ভ্রমণকারী পায়চারি করছে—সবুজ পাহাড়ের মাথায় দেখা যায় আলোর প্রথম রেখা, শঙ্কর এগিয়ে চলেছে স্যানাটোরিয়ামের দিকে। যেতে দেরি হচ্ছে, চড়াই-এর পথ, একটা ট্যাক্সিকে ধরে উঠে পড়ে। 

কতদিনের দেখা, শঙ্কর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নীতার দিকে। 

—কি দেখছিস বড়দা? 

স্যানাটোরিয়ামের সামনে একটা পাইন গাছের দিকে এগিয়ে যায় তারা, ডালিয়াফুলের ঝাড়গুলো এখানে বারোমাসই রঙের মেলা বসায়, জেগে থাকে ওদের বুকে হাজারো ফুলের হাসি। পাইনবনে উঠেছে শনশন হাওয়া, রৌদ্রস্নাত নীল আকাশ আর ছায়াঘন পাহাড়ে শুরু হয়েছে মেঘের আনাগোনা, বাতাসে ভেসে ওঠে ঝরণার সুর, শঙ্কর নীতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে- 

—অনেক সেরে উঠেছিস নীতা। ডাঃ সেনও বললেন, আর দু-একমাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবি। 

নীতা গাছের নীচে ঘাসের ধারে বসেছে শঙ্করের বর্ষাতির উপর। মুখে ওর হাসির আভা। বলে ওঠে নীতা—সত্যি বড়দা আর থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে, কবে বাড়ি ফিরে যাব। হঠাৎ যেন ফেলে আসা জগতে মন ছুটে আবার ফিরে যায়; একসঙ্গে একগাদা প্রশ্ন করে বসে নীতা। 

—হ্যাঁরে, গীতার সেই বাঁদরটা কেমন হয়েছে রে? কার মতন দেখতে? খুব দুরন্ত বুঝি! দেখবি বাবার কাজকম্মো সব মাটি করে দেবে ওটা। হ্যাঁরে, বই কি হল বাবার? দেখবি বড়দা–বাবার পরের বইখানাও ভালো চলবে? আমার স্পেকিউলেশন—যাতে হাত দেব তাকে ঠিক গড়ে তুলবই। আর বাড়িটা? 

শঙ্কর ওর কথাগুলো শুনছে একমনে। 

নীতা পথের ধার থেকে একটা ডালিয়া ফুল তুলে নিয়েছে, ছিঁড়ে ফেলেছে তার মলিন বিবর্ণ দলগুলো। 

শঙ্কর জবাব দেয়—বাড়িটা দোতলা উঠেছে কেবল তোর বাইরের ঘরটা আমিই তুলতে দিইনি।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা—কেন রে? 

শঙ্কর জবাব দেয়—তোর ঘর, তুই গেলে দেখে-শুনে তোর মনের মতো তোলা হবে।

নীতা বলে ওঠে—সত্যি! এখানের ঘরগুলো কি সুন্দর, ছোট্ট ঘর হবে পূর্বদিকে থাকবে কাঠের জানলা, প্রথম রোদের আলো পড়বে ঘরের মেঝেতে- 

হঠাৎ থেমে যায় নীতার কন্ঠস্বর। 

শঙ্কর চমকে ওঠে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। একি! বুঝতে পারে না ব্যাপারটা। 

নীতা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে; কোথায় দূর বনে যেন ঝড় উঠেছে, এগিয়ে আসছে বহু চেনা সেই শব্দটা। ঘূর্ণিপাকে যেন তাকে তুলে নিয়ে কোন অসীম শূন্যে উধাও করে দিতে চায়। এতদিন ধরে এড়িয়ে গেছে সেই দুর্বার আহ্বান, ব্যর্থ হয়ে গেছে তার অন্বেষণ; আজ এগিয়ে আসছে অতীতের হারানো সেই শব্দটা, বিপুল আলিঙ্গনে তাকে যেন পিষে ফেলতে চায়; সামনে এসে পড়েছে সেই প্রবল আলোড়নের বেগ। থরথর করে কাঁপছে পাহাড় বনানী। 

দম বন্ধ হয়ে আসে—উঠে চলেছে সে, মাঠ সবুজ মাটি—রোদের আলোর অনেক ঊর্ধ্বে। তারই ভালোলাগা পৃথিবী ও ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে যেন জোর করে তুলে নিয়ে যায় তাকে। অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে নীতা—বড়দা। হাঁপাচ্ছে প্রাণপণে সে, প্রতিরোধ করতে চায় ওই দুর্বার ঝড়ের বেগকে। 

—না, না। কিন্তু ক্ষীণ সেই প্রতিবাদ! দূরে—বহু দূরে পাহাড় সীমা পার হয়ে দূর ক্রন্দসীর অসীমে উধাও হয়ে যায় সে। সূর্যের রশ্মিরেখার পথ বেয়ে চলেছে নীতা। হালকা হয়ে আসে, স্তব্ধ হয়ে আসে সব কলরব। চোখের পাতায় নামে তন্দ্রা। 

শঙ্কর চিৎকার করে ওঠে—নীতা! নীতা! 

দূর থেকে একবার যেন চোখ মেলে কোন অপরিচিতের দিকে তাকাবার চেষ্টা করে নীতা।

শঙ্কর ছুটে যায় হাসপাতালের দিকে—ডক্টর! নার্স! নার্স! 

হু-হু বইছে পাইনের হাওয়া-ঝরনার সুরে মিশে গেছে! পর্বত রাজ্যের কোন শান্তি ভঙ্গ হয়নি। বাতাসে ঝরে পাইন পাতা। ঝড়ো হাওয়ার ঘূর্ণিতে কাঁপতে কাঁপতে পড়ছে পাতাগুলো ঝরনার জলে—একটা—একটার পর একটা। 

যেন মহাজীবনের স্রোতে পড়েছে এসে ক্ষুদ্র জীবনের একটি ধারা, সাগ্রহে তাকে বুকে বরণ করে নিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতধারা, উত্তাল-ছন্দে দূর অসীমের দিকে। 

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শঙ্কর। সব শেষ হয়ে গেল। 

একটি জীবনের ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়া—কলরব; বেঁচে থাকার জন্য আশার আলোর সংগ্রাম, সব অতল স্তব্ধতায় ডুবে গেল। 

পাহাড় ছেয়ে আসে অতর্কিত মেঘে, দিনের খেয়ালি আলো কোনো অতলে হারিয়ে গেছে, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নামে পাহাড়ের বুকে—সাদা হালকা জলকণার ঘন যবনিকার আড়ালে পাইন গাছের গুড়িগুলো কালের প্রহরীর মতো জেগে থাকে। 

শনশন শব্দে নামে বৃষ্টিধারা। একটি সত্তার নিঃশেষ অবলুপ্তি ঘটে অসীম পাহাড়ঘেরা মেঘলোকে। 

বৃষ্টি নেমেছে। অঝোর বৃষ্টি! 

কয়েকমাস কেটে গেছে। সবুজ স্বাভাবিক গতিতেই চলেছে কলোনির জীবনযাত্রা, মাধববাবুর দোতলা বাড়ি উঠেছে। নীতার ঘরখানার চিহ্নমাত্রও নেই। সেখানে জমেছে ঘন সবুজ গাছগাছালি, পাখি ডাকে পত্রাবরণ থেকে। সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে আবার এ বাড়ির দিনগুলো। মাধববাবু আবার কাজে মন দিয়েছেন, কিন্তু বাধা তার গীতার ছেলেটা। চশমা-কলম থাকে না ঠিক জায়গায়। হাঁকডাক শুরু করেন তিনি। 

বাড়িতে হইচই, লোকজনের সমাগম। গীতার ছেলের অন্নপ্রাশন। শঙ্কর এত করেও এ বাড়িতে থাকতে পারে না। এই পরিবেশ তার বিষিয়ে উঠেছে। মন কেমন করে এখানে এলেই। 

কাদম্বিনী দুঃখ করেন—তুই ঘরবাসী হবি না শঙ্কর? 

হাসে শঙ্কর—বেশ তো আছি! যাযাবর জীবন, আজ দিল্লি, কাল বোম্বাই, সময় পাই কই বলো। 

আনন্দে কোলাহলে বাড়ি ভরে উঠেছে। গীতা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আসে–যাক, এসেছ তাহলে! মামা যাহোক একখানা। 

আজকের এই পূর্ণতার দিনে শঙ্করের একজনকে মনে পড়ে, সে নীতা। 

শঙ্করকে চলে যেতে দেখে বাধা দেয়—একি! চলে যাচ্ছ যে? 

—একটু কাজ আছে। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেল শঙ্কর! 

একজনকে নিঃশেষে ভুলে গেছে এরা। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। পায়ে পায়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে আসে শঙ্কর। কলোনির রাস্তায় দু-একজন লোক চলেছে। 

একজনকে মনে পড়ে—সে নীতা। কালো ডাগর চোখ, জীর্ণ-মলিন রঙ, আধ-ময়লা শাড়ি পরে একটি মেয়ে দু’বেলা যাতায়াত করত কলোনির পথ দিয়ে আপিস আর টিউশানিতে। 

আনমনে পথ চলেছে, হঠাৎ দূরে কাকে দেখে চমকে ওঠে—হ্যাঁ ঠিকই! তেমনি কে যেন চলেছে। নীতার মতোই দেহ-মনে কি এক হতাশ-বেদনা। মলিন-বিবর্ণ চাহনি রোদে-ঘেমে নেয়ে উঠেছে। 

এগিয়ে যায় শঙ্কর, না—নীতা নয়। 

তবে ওদের শ্রেণিরই ও একজন। পথে-ঘাটে-আপিসে স্কুলে ওদের দেখা মেলে।

জীবনে ওরা স্নেহ-প্রেম-প্রীতি কিছুই পায়নি—সবাই ঠকিয়েছে ওদের এতটুকু ভালোবাসা থেকেও পৃথিবী ওদের বঞ্চিত করেছে। বুক-ভরা প্রেম ব্যর্থ জ্বালায় জ্বালিয়ে খাক করে দেয় ওদের। 

নীরবে এগিয়ে চলল শঙ্কর স্টেশনের দিকে। 

স্ট্রাপছেঁড়া স্যান্ডেলটা টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে মেয়েটি ব্যস্তসমস্ত ভাবে। ট্রেনের ঘন্টা হয়ে গেছে তার। এ ট্রেন ফেল করলে আপিসে লেট হয়ে যাবে। 

নীতার কথা মনে হয় শঙ্করের। সেও ব্যর্থ হয়ে কেঁদে-ফিরে গেছে শূন্য হাতে। 

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *