মেঘে ঢাকা তারা – ৬

সনৎ কিছুদিন ছুটি নিয়েছে আপিস থেকে। একটা প্রফেসারি পাবার আশা করছে। মাঝারি কলেজ হোক, তবুও সেই কাজই নেবে সে। কেরানিগিরির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। আপিসের সেই পরিবেশ—বড়বাবু, গজেন সামন্তের বেহায়া কথাবার্তাগুলো মনে পড়লেই শিউরে ওঠে। 

কতকগুলো দৈত্য যেন তাকে বেঁধে পিষে মেরে ফেলতে চায়। 

অলস দুপুর। গীতা ঘুমোচ্ছে খেয়ে দেয়ে। কদিন থেকে ক্রমশ পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ তার মনে ফেটে পড়েছে ধীরে ধীরে। সনতের এই নিশ্চিন্ত জীবন থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে পাড়ি জমানোটা কিছুতেই ভালো চোখে দেখতে পারে না গীতা। 

সনৎ মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে জেগে ওঠে বিক্ষোভের একটা ব্যবধান। 

হঠাৎ এই রোদের মধ্যেই নীতাকে আসতে দেখে বিস্মিত হয় সনৎ। উঠে এসে অভ্যর্থনা জানায়—এসো এসো ভেতরে, ঘেমে, নেয়ে উঠেছ যে! 

সনৎ ফ্যানের রেগুলেটারটা পুরো পয়েন্টে বাড়িয়ে দেয়। নীতা বলে ওঠে—উঃ যা, রোদ!

ছাতা কোলে রেখে চেয়ারটা টেনে নেয়—জল দাও একগ্লাস! গীতা কোথায়? 

নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব দেয় সনৎ—খেয়ে ঘুমোচ্ছে। 

নীতা একবার ওর দিকে তাকাল। কেমন শান্তি আর নিশ্চিন্ততার মাঝে নিজেকে মেলে দিয়েছে। আর সে! উল্কার বুকপোড়া জ্বালা নিয়ে ছুটে চলেছে অসীম আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। মন থেকে সেই ভাবনা মুছে ফেলে নীতা। 

কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিজে এক-নিশ্বাসে শেষ করে বসল নীতা। তখনও হাঁপাচ্ছে। ঠাণ্ডা জল খেয়ে একটু দম ফিরে পায়। সনৎ ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে—ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চেহারা। ওর দেহ-মনের উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। আরও শীর্ণ হয়ে উঠেছে, চোখ দু’টোতে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি। 

নীতা বলে চলেছে—মন্টু অ্যাকসিডেন্ট করে নীলরতন সরকার হাসপাতালে রয়েছে। ডান-পা খানাই হয়তো অ্যামপুট করতে হবে। বেঁচে হয়তো যাবে—কিন্তু টিকে থাকবে পঙ্গু হয়ে 

সহজ ভাবে কথাটা বলে নীতা। কোথাও এতটুকু দ্বিধা নেই! কঠিন বাস্তবকে মেনে নিয়েছে সে। 

চমকে ওঠে সনৎ—কী বলছ তুমি? 

নীতা কথা বলল না! চোখের উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সনতের মন নীরব সমবেদনায় ভরে ওঠে। সবাই, এমনকি সেও তাকে বঞ্চনা করেছে। আঘাত দিয়েছে তাকে অদৃষ্টও। তার তুলনায় গীতা অনেক শান্তিতে আছে। তবু জ্বলছে অহরহ নীতা! 

সে স্বাভাবিকভাবে সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো মুখ-বুজে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছে।

—নীতা! সনৎ ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। 

হঠাৎ পর্দাটা ঠেলে গীতাকে ঢুকতে দেখে সরে এসে বসল সনৎ। উত্তেজনায় তখনও তার মুখ-চোখ থমথমে। 

গীতা দুজনের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি মেলে কি যেন খুঁজছে। অসময়ে—এই নির্জন দুপুরে নীতাকে এখানে আসতে দেখে সে অবাক হয়েছে। একটু রাগও হয় গীতার নীতার এই অস্বাভাবিক দৃষ্টিকটু ব্যবহারে। 

সনৎ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে ওঠে—নীতা এসেছে, স্নানটানের ব্যবস্থা করে দাও। 

মন্টুর দুঃসংবাদটা প্রকাশ করতে সাহস পায় না সনৎ। এখুনি হয়তো কেঁদে-কেটে একটা বিশ্রী কাণ্ড বাধিয়ে বসবে গীতা। সামান্যতেই অধৈর্য হয়ে ওঠা গীতার স্বভাব। তাই ও প্রসঙ্গ আপাতত চেপে যাবার চেষ্টা করে সে। 

নীতা একটু অবাক হয়েছে গীতার এই উদাসীন বিরক্তিজনক ব্যবহারে। নিজে অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। গীতার সেদিকে নজর নেই। 

সনতের প্রশ্নে জবাব দেয় গীতা, বেশ একটু ব্যঙ্গের সুরে—তা-তো দেখছি! নীতাকে প্রশ্ন করে—কতক্ষণ এসেছিস? অনেকক্ষণ মনে হচ্ছে। 

নীতার সম্বন্ধে সব ভাবনাগুলো ভিড় করে এসেছে তার মনে। 

গীতার মনের জ্বালা ফুটে ওঠে। সনতকে সেই মন্ত্রণা দিয়েছে। সেইই তাকে চাকরি ছেড়ে আরো কম-মাইনেতে কোনো ছোট কলেজের অস্থায়ী অধ্যাপকের পদ নিতে অনুরোধ জানিয়েছে!

গীতার কথাগুলোর পিছনে কি কদর্য ইঙ্গিত আছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে নীতা। সারাদিন তার কেটেছে দুশ্চিন্তায়; স্নান-খাওয়া নেই, তারপর এই হীন-অপমান সহ্য করার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না। সারামন জ্বালা করে ওঠে। 

কি যেন বলতে গিয়ে উঠে পড়ল নীতা চেয়ার থেকে। এর চেয়ে বাকি সময়টুকু না হয় স্টেশনে কাটিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে যাবে। তবু ওর সামনে থেকে সরে যেতে চায় নীতা। এ ঘর থেকেই চলে যাবে—এখানে নীতার জন্য নেই কোনো সান্ত্বনা—কোনো আশ্রয়। ছাতাটা নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। 

চমকে ওঠে সনৎ—ও কি! উঠলে যে? 

নীতা জবাব দেয়—হ্যাঁ, এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা চলি! 

সনৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। 

নীতা তার সামনেই অস্নাত অভুক্ত অবস্থায় চরম বিপদের দিনে অপমানিত হয়ে ফিরে গেল তারই বাড়ি থেকে। অথচ সেইই বছরের পর বছর নিজের পরিশ্রম ও কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তার পড়ার খরচ ও মেস চার্জ জুগিয়েছে। 

নীতা কোনোদিনই প্রতিবাদও করবে না; এতবড় অবিচার অপ-যশ বঞ্চনার কোনো প্রতিবাদই সে করেনি। বজ্রাহতের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সনৎ। 

দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে—সনৎ আর গীতা। গীতার বুকে সন্দেহের বিষজ্বালা।

মনছাপানো ঝড় গর্জাচ্ছে সনতের মনে। বলে ওঠে সনৎ-ওকে যেতে দিলে?

সনতের কথায় বলে ওঠে গীতা—আমার কাছে তো আসেনি, যার কাছে এসেছিল আতিথ্য দেখানো উচিত ছিল তারই। 

কণ্ঠে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের জ্বালা ফুটিয়ে গীতা বলে ওঠে—যাও, পায়ে ধরে ফিরিয়ে আনোগে। দেহি পদপল্লবমুদারম্ 

সনৎ রাগ চেপে ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে—অনেক কিছুই ভেবে নিয়েছ, কিন্তু ওকে আজও চেনোনি। কেন এসেছিল তাও জানো না। 

—থাক। আর জেনে দরকার নেই। যা জেনেছি তাই ঢের। 

গীতার সব জানা হয়ে গেছে। জ্বলছে সে মনে মনে। ওদের দীর্ঘদিনের গভীর পরিচয়—একটা পরিণামে পরিণত হবার আগেই গীতা এসেছিল তার জীবনে। ভেবেছিল গীতা বদলে ফেলবে সনতকে, পাঁচজনের মতো শান্তির ঘর-সংসার করবে। 

কিন্তু আজ বুঝছে পদে পদে নীতা ওর মনের কত গভীরে আসন পেতেছে, সেখান থেকে গীতার সাধ্য নেই নীতাকে ফিরিয়ে দিতে! তবুও সামাজিক দাবিতে গীতা আজ নিজের অধিকার জানায়, কঠিন কণ্ঠে প্রতিবাদ করে। বলে ওঠে—মায়ের পেটের বোনকে চিনি না আমি! শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করো না। ছিঃ ছিঃ, লজ্জা হওয়া উচিত তোমার। ওই বেহায়া ঢলানি— 

বাধা দিয়ে ওঠে সনৎ বজ্রকণ্ঠে—গীতা। 

—মারবে নাকি? তাও হয়তো আজ পারো। আচ্ছা! 

গীতা ভিতরের দিকে চলে গেল। 

একা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সনৎ। ওই পলাশফুলের মতো বর্ণসার মেয়েটির মনের তীব্র বিষের জ্বালায় তখনও জ্বলছে সে। নিজের জন্য নয়, নীতাকে এই অবস্থায় এমনি কুৎসিতভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে তারই বাড়ি থেকে, এই কথাটা বহু চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারে না। ওকে থামিয়ে দিতে পারে সনৎ, কিন্তু প্রতিবাদ করলেই এখুনি কেঁদেকেটে গীতা পাড়া মাথায় করবে। আশপাশের ছাদে বউ-ঝিরা উঁকিঝুঁকি পাড়বে কৌতূহলী দৃষ্টিতে। একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি বাধাতেও গীতার বিন্দুমাত্র আটকাবে না। সেই কেলেঙ্কারির হাত থেকে বাঁচবার জন্যই সনৎ চুপ করে গেল আপাতত। 

—কোথা যাচ্ছ? 

গীতা সাজগোজ করে বের হয়ে গেল কোনো জবাব না দিয়েই। 

.

দুপুরের জনহীন হাসপাতালের রূপ বদলে গেছে বৈকালের জনারণ্যে। কাতারে কাতারে লোকজন, রোগীদের আত্মীয়স্বজন দেখতে আসছে। কারো হাতে ডাব ফল, কেউ ফ্লাস্কে করে আনছে দুধ, অভাবে হরলিকস-এর বোতলেও কেউ এনেছে দুধবার্লি। কোনো বস্তিবাসী বউ-ঝি কমদামি ফ্রকপরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে শুধু হাতেই দেখতে আসছে স্বামীকে, সারা মুখে-চোখে হতাশা আর দারিদ্র্যের নগ্ন ছাপ। কেউ পাশ দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল কটেজের দিকে। 

দু-একটা বাচ্চা ছুটোছুটি করছে সামনের লনে। 

হাসিকান্নার মেলা। বহুবিচিত্র জীবনযাত্রা এদের। 

এই নীরব গাছগুলোর পত্রমর্মরে ফুটে ওঠে দীর্ঘশ্বাস—হতাশার সুর। 

মলিন-ক্লান্ত মুখে নীতাও ঢুকল গেটে। ঘামে ভিজে গেছে তার ব্লাউজটা, সস্তা শাড়িখানা পথের ধুলোয় ময়লা হয়ে উঠেছে। মুখ-চোখ বসে গেছে। রাস্তার কল থেকে খানিকটা জল আঁজলা করে ঘাড়ে মাথায় মুখে দিয়ে একটু ঠাণ্ডা হবার চেষ্টা করেছে। সারি সারি খাট পাতা, লাল কম্বলে ঢাকা বেড। সব মুখই ওখানে এক রকম। কোনো নাম নেই—সব যেন এক-একটা নম্বর। নামের তাকিয়ে ওদের খাতায় নম্বরের হিসাবই বেশি চালু। 

একটু এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে থমকে দাঁড়াল নীতা। ডাক্তারবাবু এগিয়ে আসেন ওকে দেখে, সত্যই যে এতবড় সর্বনাশ ঘটবে ভাবেনি সে। কোনোরকমে সরে এল নীতা। 

মন্টু অজ্ঞান হয়ে রয়েছে মর্ফিয়ার ঘোরে। ডান পা-টা হাঁটুর উপর অবধি নেই। নার্সও পাশেই ছিল। ওকে দেখে আশ্বাস দেবার সুরেই বলে ওঠে—আপনার পেশেন্ট ভালোই আছে। 

ডাক্তারবাবু বলে ওঠে—চেষ্টা করে দেখলাম অনেক, কিন্তু পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে উঠেছিল। তাই বাদ দিতেই হল। আর ও তো সাধারণ ব্যাপার। দু-চারদিন পরই ঠিক হয়ে যাবে। 

কথা বলে না নীতা, চোখ ঠেলে হু-হু কান্না নামে। নার্সও যেন দয়া পরবশ হয়েই ওকে ওদিকের বারান্দায় ধরে নিয়ে গিয়ে একটা টুলে বসায়। 

–হলে গিয়ে কাঁদবেন না, পেশেন্টরা নার্ভাস হয়ে যাবে। এ সময় ধৈর্য হারাবেন না।

নীতা কথা কইল না, ওর দিকে অশ্রুভেজা চোখ তুলে তাকাল। ও জানবে কি করে নীতার ধৈর্যের সীমা! এমনি করে পদে পদে অপমানিত জীবনযুদ্ধ বঞ্চিত ক্ষতবিক্ষত হয়েও বুক বেঁধে ছিল, কিন্তু আজ সব আগল টুটে গেছে। অসহায় সে। 

ভেঙে পড়ে নীরব কান্নায়। কল্পনা করতে পারে না নীতা, মন্টু জ্ঞান ফিরে যখন দেখবে তার ডান পা নেই, সে কি সহ্য করতে পারবে? 

ছেলেবেলা থেকে ফুটবল খেলা মন্টুর রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেই তার প্রাণ। জীবনের একমাত্র অবলম্বন। সেই জীবন থেকে সে নির্বাসিত-বাতিলের দলে। একটা কাঠের ক্রাচের উপর ভর দিয়ে জীবন কাটাতে হবে—পরের গলগ্রহ হয়ে সারাজীবন। 

চোখের উপর ভেসে ওঠে মন্টুর সুশ্রী সুঠাম দেহ, ব্লেজারের কোট পরে কত খেলা জয়ের ছবি, আলমারি-ভর্তি কাপ মেডেল। সেই মন্টু আজ পঙ্গু। জীবনযুদ্ধে আহত বিকৃত একটি সত্তা। 

হু-হু কান্না কমে না নীতার। নিজের জন্য দুঃখবোধ তার নেই কিন্তু অন্যের জন্য তার অফুরান স্নেহ—দুঃখবোধ। নিতান্ত অসহায় সে। আশপাশে সান্ত্বনা দেবার কেউই নেই তার। বাইরে গিয়ে অবধি শঙ্করও একটি চিঠি পর্যন্ত দেয়নি। সবই তাকে বইতে হবে, এইসব বোঝা আর বইতে পারে না সে। 

কান্নাভেজা মুখ-চোখ নিয়ে বের হয়ে আসছে নীতা, হঠাৎ সামনে সনতকে এগিয়ে আসতে দেখে থমকে দাঁড়াল। 

—কেমন আছে মন্টু? 

কথা কইল না নীতা, আঙুল দিয়ে হলের মধ্যে লাল কম্বলটাকা মূর্তিটার দিকে দেখাল।

চমকে ওঠে সনৎ। এই সর্বনাশা দৃশ্য দেখবে কল্পনা করেনি সে। 

কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে নীতা—ওর না বাঁচাই ছিল ভালো সনৎ, বড় কষ্টের জীবন ওর। ও সহ্য করতে পারবে না। 

সনৎ চুপ করে থাকে, সেও স্তব্ধ হয়ে গেছে। 

সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলেছে নীতা, হতাশায় ভেঙে পড়া ক্লান্ত একটি মূর্তি; সারাদিন পরিশ্রম আর উত্তেজনার পর এই শোচনীয় পরিণতিতে ভেঙে মুষড়ে পড়েছে সে। 

সনৎ ওকে একা ছেড়ে দিয়ে ভরসা পায় না। শুকনো অস্নাত চেহারা বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।

—কিছু মুখে দিয়ে বাড়ি ফিরবে। অন্তত কিছু খাবার আর চা। 

—না; বাবা মা ভাবছে, এখনি বাড়ি ফিরতে হবে। 

নীতা কেমন বদলে গেছে। চোখের জল তখনও শুকোয়নি। মন্টুর সেই অসহায় মূর্তিটা চোখে পড়তেই কান্না আসে চোখ ঠেলে। সনৎ বলে ওঠে—চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। 

সনতের কথায় আজ প্রতিবাদ করে না নীতা। অত্যন্ত অসহায় বোধ করে নিজেকে। দু’জনে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে এগিয়ে যায় ভিড় ঠেলে। আপিসের বাবুরা দৌড়াচ্ছে তখন বাঁধাকপি হাতে ঝুলিয়ে; কেউ র‍্যাশন থলিতে তরকারি কিনে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছে বকের মতো পা ফেলে—ঠেলেঠুকে ধাক্কা দিয়ে। জীবনের আপাতত পরমগতি তাদের ছটা তেত্রিশের লোকাল। 

.

গীতা বাড়িতেই এসেছে দুপুরের পর। মাকে নীতার সব কীর্তি-কাহিনিই জানাবে। দরকার হয় মায়ের সামনেই নীতার সঙ্গে বোঝাপড়া করবে আজ। তার সুখের সংসারে অভিশাপের মতো ওর কালো ছায়া আর পড়তে দেবে না। অনেক সহ্য করেছে নীতাকে, আর কখনই নয়। 

মা গীতাকে অসময়ে আসতে দেখে অবাক হয়। গীতার মুখে-চোখে করুণ একটা ভাব। বাড়িতে পা-দিয়েই মায়ের মনের অবস্থার খোঁজ নেবারও দরকার বোধ করে না। নিজের কাহিনিটাই বলে যায় নানা ডালপালা দিয়ে রঙ ফলিয়ে। নীতা যে তার কতখানি সর্বনাশ করবার জন্য ঘুরছে এ কথাটা জানিয়ে দেয় মাকে। 

কাদম্বিনী নিজের মনের দুঃখে অস্থির। সারাদিন মন্টুর কোনো খোঁজ পায়নি। নীতা সেই সকালে বের হয় গেছে—এখনও দেখা নেই। ভাবছে মা। কিন্তু এমনি সময়ে গীতার দুঃখে নীতার সম্বন্ধে ওইসব বিশ্রী কথাগুলো শুনে সারা মন জ্বলে ওঠে তার। 

ফেটে পড়ে রাগে; গীতার কথাগুলো শুনে নিজের কপালই চাপড়াতে থাকে। 

—দেখ কেমন মেয়ে ও! গীতা বলে ওঠে। 

কাদম্বিনী কান্নাভেজা স্বরে বলে চলেছে—সবই আমার বরাত। নইলে ওই মেয়ের রোজগারে আমাকে বাঁচতে হয়। আর তার শোধও খুব নিচ্ছে যাহোক। তোর সংসারেও শান্তি নষ্ট করেছে সে। মেয়ের বিয়ে দিলাম, তার পিছনেও লাগল। 

গীতা বলে ওঠে—ওই তো মা, ওকে পরামর্শ দিয়েছে চাকরি ছাড়বার। বলে মাস্টারি করো!

চমকে ওঠে কাদম্বিনী—মাস্টারি। 

মাস্টারি করার সুখ টের পেয়েছে হাড়ে হাড়ে। দীর্ঘ এতগুলো বছরের একটি দিনও সচ্ছলতার মধ্যে কাটেনি—শান্তির মুখ দেখেনি কোনোদিন। গীতার কথা শুনে তাই আঁতকে ওঠে। 

—না না, ও কথা বলিস না গীতা; সারা জীবন জ্বলে-পুড়ে মরবি আমার মতো।

—নীতা তো তাই চায় মা। 

মা-মেয়ের দুজনেই চমকে উঠেছে। নীতা যেন তাদের জীবনে একটি দুষ্টগ্রহ। 

সন্ধ্যা নেমে আসছে। গাছগাছালির বুকঢাকা জোনাকজ্বলা আঁধার নামে। পাখি ডাকাও থেমে গেছে। মাধববাবু উতলা হয়ে ঘর বার করেন। ওদের দেখে প্রশ্ন করেন। 

—নীতা ফিরল? 

কাদম্বিনীর মনে গীতার কথাগুলো তখনও গজগজ করছে। আজ দুপুরের ঘটনাটিও।

তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে—ঢলানি গেছেন কোথায় কে জানে। ভাজে উচ্ছে বলে পটল! মাধববাবু ওর কথায় কান দেন না। আপনার চিন্তাতেই মশগুল। 

অসহায়ের মতো তিনি বলে ওঠেন গীতাকে—আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবি? একবার দেখে আসতাম মন্টুকে, হ্যাঁরে? 

গীতা জবাব দেয়—কিন্তু আমাকে যে আজই ফিরতে হবে। 

মাধববাবু নিরাশ হন—ওঃ! কিন্তু কেমন রইল সে খবরটাও তো পেলাম না। 

একাই ছটফট করেন তিনি অসহায়ের মতো। আঁধার নামছে চারিদিকে, সন্ধ্যার অন্ধকারে সব কেমন যেন হারিয়ে যায়। 

হঠাৎ সনতের সঙ্গে নীতাকে ঢুকতে দেখে মাধববাবু এগিয়ে আসেন। গীতার চোখে সন্দেহের গাঢ়-ছায়া। তার সন্দেহ অমূলক নয়। সনতের দিকে সে তাকিয়ে থাকে তীক্ষ্ণ- সন্ধানী দৃষ্টি মেলে। 

কাদম্বিনী বলে ওঠে নীতাকে—কোথায় ছিলি সারা দিন? 

নীতা জবাব দিতে পারে না। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে হু-হু কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবার পায়ের কাছেই। চমকে ওঠেন মাধবমাস্টার। তবে কি সত্যই কোনো অঘটন ঘটে গেছে। 

কাদম্বিনী ব্যাকুল কণ্ঠে চিৎকার করছে—কি হয়েছে বল। শুনি তুই কি বলবি—কোন সর্বনাশের খবর। 

মাধববাবুর চোখ দুটো জ্বলছে অসহ্য বেদনাভরা আর্তিতে। 

—মন্টু! আমার মন্টু কেমন আছে রে? তার কোনো খবর? 

নীতার সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। কাঁপছে সে, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে— বেঁচে আছে মাত্র, তার ডান-পাখানা বাদ দিতে হয়েছে। 

—অ্যাঁ। চমকে ওঠেন মাধববাবু। 

বড়ো একটা প্রকাণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়তে গিয়ে সামলে নেন নিজেকে। থরথর কাঁপছে তাঁর সমস্ত শরীর। জীর্ণ শিরাগুলো ফেটে পড়বে রক্তের অসহ্য চাপে। খরস্রোত নদীর বুকে নোঙর-জড়ানো রশিটা যেন জোয়ারের গতিবেগের সঙ্গে যুদ্ধ করে আটকে রেখেছে নৌকাটাকে জড়ের মতো। নীরবে সেই অতর্কিত আঘাত সহ্য-করার জন্য লড়াই করছে সে। 

কাদম্বিনী ডুকরে কেঁদে ওঠে। অসহায় আতকান্না। 

গীতা এই দৃশ্য দেখতে পারে না, চায় না। নগ্ন দুঃখের দৃশ্যটাকে এড়িয়ে যেতে চায় সে। সকলের অলক্ষ্যে চোরের মতো বাড়ি থেকে পা-টিপে পালায়। 

সুখের পায়রা সুখের দিনে বাসা বাঁধে, সুর তোলে। দুঃখের সময় তার চিহ্নমাত্র থাকবে না, নীরব হয়ে যাবে তার সুর। জগতের এই নিয়ম। 

গীতা তাদেরই দলে। তাই সরে গেল এ বাড়ি থেকে আজও ওদের অলক্ষ্যে 

সনৎ তখন দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে দেখছে কতকগুলো অসহায় মানুষের নিষ্ফল ব্যর্থতার জ্বালা। 

—নীতা! সনৎ ওকে ডাকে সান্ত্বনার কণ্ঠে। 

—সারাদিন স্নান-খাওয়া নেই, পথে পথে ঘুরছ। যাও স্নান সারগে। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না এ সময়, ওঠো! 

কাদম্বিনী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাক ছেড়ে কাঁদছে—এ কি হল রে! কোন পাপে আমার সব ছারখার হয়ে গেল গো! 

স্তব্ধতা নেমে এসেছে আঁধারঢাকা আলোনেভা বাড়িতে, শোকের একটা কালো মেঘ নেমেছে নীরবতার আবরণে। তারাগুলো হারিয়ে গেছে আঁধারে। 

সনৎ বের হয়ে আসছে। সিঁড়ির কাছে নীতার ডাকে থমকে দাঁড়ায়। তার দিকে তাকিয়ে আছে। সহজ কণ্ঠেই বলে ওঠে নীতা—কিছু টাকা দিতে পারো? মাসকাবারেই দিয়ে দোব। এখন বড় দরকার। আমার কাছে যা ছিল সবই খরচ হয়ে গেছে। 

সাধারণ অধিকারেই চাইছে। সনৎ তারার আলোয় ওর আবছা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে—কাল যখন হাসপাতালে আসব তখন নিয়ো! শ দেড়েকে হবে? 

চুপ করে ঘাড় নাড়ল নীতা। 

সনৎ হালকা পায়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলে। গীতাকে খুঁজে পায় না এ বাড়িতে। স্টেশনে গিয়ে দেখে, গীতা আগেই পৌঁছে অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। সনৎ এগিয়ে আসে—কই, দাঁড়ালে না যে? 

আমার সঙ্গে আসোনি তো। ভাবলাম থেকেই যাবে রাত্রিটা। হাজার হোক শ্বশুরবাড়ি।

চমকে ওঠে সনৎ! গীতা হাসছে বিদ্রূপের হাসি। 

সনৎ কথা কইল না। কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে ওর অমানুষিক এই স্বার্থপরতা দেখে। গীতার মনের যত পরিচয় পাচ্ছে ততই শিউরে উঠছে সে ঘৃণায়। এই বিপদেও মানুষকে আপন জনকে যারা ভালোবাসতে পারে না, তারা কোন শ্রেণির জীব তা জানে না সনৎ। তার চরম দুর্ভাগ্য তেমনি একজনের সঙ্গে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। 

ট্রেন আসছে। সার্চলাইটের আলোয় দেখা যায় একঝাঁক ফড়িং পোকামাকড় উড়ছে আলোর চারিপাশে। আলোকরশ্মিকে বাধা দেবার ওদের নিষ্ফল প্রয়াস। 

.

নীতার দেহমনের সমস্ত সুপ্ত শক্তি সাহস, কোন গোপন তল থেকে অফুরান প্রবাহ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। মায়ের মতো অসহায় কান্নায় সে ভেঙে পড়ে না। বাবার মতো নীরবে সহ্য করবার চেষ্টাও করে না। দুঃখ-বিপদের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই দুঃখ জয়ের সাধনাই করে। 

তবু কোথায় যেন ফুরিয়ে আসছে সেই শক্তি। কিছুদিন থেকে অনুভব করছে একটা অপরিসীম ক্লান্তি বিকালের দিকে তার সারা শরীর জড়িয়ে আসে। গা-মাথা ভার ভার ঠেকে। কেমন যেন চুপ করে একটু বিশ্রাম চায় তার দেহমন। 

কিন্তু সে উপায় তার নেই। কয়েকদিন পর-থেকেই আবার আপিসে গেছে যথারীতি। সেখান থেকে আসে হাসপাতালে। মেয়েদের অনেকেই আপিসের কড়াকড়িটাকে অনেক শিথিল করে এনেছে। দশটার জায়গায় এগারোটায় এসে হাজির হয়। ডেসপ্যাঁচ সেকশনের প্রতিভা আসে আরো দেরিতে। মুখে পাউডারের সযত্নে প্রসাধন, আর পিছে থাকে হাসির রঙ লাগানো চাহনি। আগে কথা কয় অজানা ভাষায় দুটো চোখ, তারপর অন্য কথা কয় মুখে।

রিটায়ারিং রুমে এই নিয়ে মেয়েদের আলোচনা হয় খুবই। 

—তুই যেন ঘড়ির কাঁটার মতো আসিস নীতা। 

নীতা হাসে—তোর মতো আমার দেরি করিয়ে দেবার কেউ যে নেই রে। 

প্রতিভার নিত্য নতুন অজুহাত; বিয়ে করবেও নাকি শিগগির একটি অধ্যাপককে। সব প্রায় ঠিকঠাক। 

নীতার কথায় অনেকেই মুখ টিপে হাসে। 

প্রতিভা বলে—না, তা তো নেই জানলাম। তবে এত আপিস-আপিস কেন রে বাবা একটু হেসে বলে ওঠে প্রতিভা। কাজ এড়ানোর তথ্যটা এদের জানিয়ে দিতে চায়। 

—ছেলেদের সঙ্গে একটু হেসে কথা বলবি, অর্ধেক কাজ তাহলেই হয়ে যাবে। 

প্রতিভা কেন, আরও অনেকেই হয়তো তাই করে। নীতা পারে না। নিজের মনের কাছেই এই অভিনয় অসহ্য ঠেকে। কাজে ফাঁকি দেবার ওই পথটা নিতে বিবেকে বাধে তার। তাই ভূতের খাটুনি খেটে মরে। 

ছোটবাবু সেদিন তাকে আপিসে আসতে দেখে নিজের থেকেই বলে ওঠেন—শুনলাম তোমার ভাইয়ের এই অ্যাক্সিডেন্ট, হাসপাতাল-বাড়ি করতে হচ্ছে আরও দিনকতক ছুটি নিলেই পারো। 

নীতা জবাব দেয়—জরুরি কাজ পড়ে আছে অনেক। 

—সরকারের কাজ পড়ে থাকবে না, ঠিকই হবে। এত খাটুনির পর রেস্ট না নিলে তোমার শরীর ভেঙে পড়বে যে। 

প্রৌঢ় ভদ্রলোক নীতাকে একটু স্নেহ করেন। অবশ্য আড়ালে অনেকেই এই নিয়ে গুঞ্জন তোলে!

নীতা কাজ করতে বসেছে। একমনে নোটগুলো পড়ে চলেছে। চিঠিখানার জবাব দিতে হবে, টাইপ হয়ে সাহেবের সই হয়ে যাবে। লিখতে শুরু করেছে। 

হঠাৎ কেমন যেন চোখের সামনে ঘর-খানা টেবিল-চেয়ার লোকজন সব মুছে যায়। একটা কালো অস্পষ্ট যবনিকার উপর ফুটে ওঠে কতগুলো সাদা-কালো ঘূর্ণায়মান ফুটকি, পায়ের নীচেকার মাটি কাঁপছে—কানে জাগে একটা দূরাগত শনশন শব্দ!… কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে সেটা, যেন প্রবল ঘূর্ণিপাকে তাকে জড়িয়ে নিয়ে কোন শূন্যে উধাও করে দেয়। সারা দেহমনে একটা হিম-জড়ানো স্তব্ধতা জাগে। একটা শব্দ!… আর কিছু মনে পড়ে না। 

বসন্তবাবু চিৎকার করে ওঠেন। পাশে টাইপিস্ট মিনা বোস নীতাকে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে দেখে ধরে ফেলে। অনেকেই উঠে আসেন। 

সারা অফিসে একটা হইচই পড়ে যায়। অন্য সেকশন থেকে মেয়েরাও এসে পড়ে। ছেলেদের দল আড়ালে আবডালে মন্তব্য করে : 

—দেখ, আবার কি! 

একটা রহস্যপূর্ণ ইঙ্গিতের সুর তাদের কথায় ফুঠে ওঠে। 

নীতার জ্ঞান ফিরতে অপ্রস্তুত হয়ে সে-ই। কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ গড়ে উঠেছে। তার জন্যই খুব লজ্জা লাগে। 

—উঠবেন না! মিনা বাধা দেয়। 

নীতা বলে ওঠে—ও কিছু নয়। মাঝে মাঝে অমন হয়। 

ছোটবাবু বলেন—ডাক্তারের কাছে যাও না কেন! 

নীতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এতজনের এত চিন্তার সমবেদনার কারণ হয়ে পড়েছে সে।

মিনাই বাধা দেয়—একটু বিশ্রাম নিয়ে বাড়ি চলে যান। 

নীতা ম্লান-মুখে জবাব দেয়-ও কিছু নয়। শুধু শুধু তোমাকে বিব্রত করলাম। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জার কথা বল দেখি! 

উড়িয়ে দিতে চায় ঘটনাটা। আবার কাগজ-কলম টেনে নিয়ে বসে জোর করে ওদের কথা না শুনেই। যেন কিছুই ঘটেনি। স্বাভাবিক করে তোলে পরিবেশটাকে। 

.

চুপ করে শুয়ে আছে মন্টু। বিকালের পড়ন্ত আলোয় দেওদার গাছের পাতাগুলো রেঙে উঠেছে। আবিষ্কার করেছে একটা পা তার বাদ দিতে হয়েছে। খেলা! এত সম্মান হাততালি আর প্রশংসার জগৎ থেকে চির-নির্বাসিত সে। 

চমকে উঠেছিল প্রথমে এতবড় সর্বনাশে। কিন্তু মন ক্রমশ কেমন যেন জড়বৎ হয়ে আসে। এই ভালো—এত কর্মব্যস্ত চঞ্চল জীবন থেকে সে যেন নিষ্কৃতি পেয়েছে। এই চরম আঘাতটাকে নীরবে মেনে নেবার চেষ্টা করে মন্টু। 

বিকালের গিনিগলা রোদমাখা আকাশ আর গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। দিদিকে আসতে দেখে তাকাল। আজ প্রথম সব হারিয়ে মন্টু দিদিকে দেখে নতুন চোখে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চেহারা। চোখের তারায় তবু হাসির আভা। 

—কেমন আছিস রে? 

মন্টু হঠাৎ যেন দুর্বল হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে সহজ ভাবেই দিদির দিকে তাকাল। দিদি কি এনেছে প্যাকেটে করে সেগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে তার প্রশ্নে জবাব দেয়—ভালোই আছি। আয়। 

আজ বসবার মতো সামর্থ্য যেন নেই নীতার। অফিসে মাথা ঘুরে যাবার পর থেকেই কেমন দুর্বল বোধ করছে। এতদিন সেই ক্লান্তি আর দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়নি, ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল নীতা। সব কাজকর্ম চলাফেরা করেছে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু আর পারছে না। নিঃশেষিত জীবনীশক্তিকে জয় করেছে সেই দুর্বলতা, বলে ওঠে নীতা—বেশিক্ষণ বসব না, একটু কাজ আছে। সনৎদা আসতে পারে। ওকে বলিস কাল যেন হাসপাতালে আসে বিকালে। 

ঘাড় নাড়ে মন্টু। দিদি পাশে বসে কি কথাবার্তা বলছে। মন্টুর মনটা উধাও হয়েছে জানলার বাইরের একফালি মুক্ত নীল আকাশে। দু-একটা চিল পাক দেয় কালো বিন্দুর মতো। দেওদার পাতা কাঁপছে। কেমন নিস্পৃহ উদাসীন চিন্তা। 

দিদির কথায় ঘাড় নাড়ে—বলব। 

—কাল মাকে আনব। 

—বেশ! আবার কাঁদাকাটা করবে না তো? 

হাসে নীতা—না, না। 

মন্টুর অফিসের দু-চারজন বন্ধুবান্ধবও আসছে। নীতা উঠে পড়ল একটু তাড়াতাড়ি। 

কেমন যেন রুটিন বদলে যাচ্ছে। কোনোদিন বিশেষ কোনো জরুরি কারণ ছাড়া নীতা আপিস ও কামাই করে না। টিউশানিও। আজ কেমন শরীর বইছে না। টিউশানিতেও যেতে ইচ্ছে করে না। 

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আজ বের হল না, আলো নিভিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকে বিছানায় কাপড়-চোপড় ছাড়বার মতো উৎসাহটুকুও যেন নীতার নেই। একটা নীরব আতঙ্ক জমাট বেঁধে আছে সারা মনে। 

হয়তো এই দুর্বলতা মাথাঘোরা তেমন কিছুই নয়, কদিন খাটাখাটুনি চলেছে, তাই বোধহয় ঘটেছে এটা। আবার আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। হঠাৎ আবার একরাশ চিন্তা কালো মেঘের মতো মনের নির্মল আনন্দাকুল আশাটুকুকে ঢেকে দেয়। কেমন ভয় করে নীতার। মনের মধ্যে একটা জমাট আতঙ্ক মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠে। 

যদি ডাক্তার পরীক্ষা করে অন্য কোনো কঠিন অসুখের কথা বলে বসে? ব্লাডপ্রেসার না হয় টি.বি! বিকালে গা-জ্বর জ্বর, বেদনা, মানে মাঝে কাশি! 

একটা দমচাপা কাশির আবেগ প্রাণপণে চাপবার চেষ্টা করে নীতা। মাধববাবুর কান খুব খাড়া। বাবা পাছে শুনতে পায় সেই ভয়েই নীতা সাবধান হয়ে ওঠে। 

কোনোমতে কাশির বেগ সামলে নেয়। একটা জমাট আতঙ্ক মনে বাসা বাঁধা। নিজের জন্য নয়, বাবা–মা—মন্টু! অসহায়—পঙ্গু মন্টু। এদের জন্যই তাকে বাঁচতে হবে। কাজ করতে হবে।

না, ও কিছু নয়! শরীরটা অনেক সুস্থ–সনতের কথা মনে পড়ে। তারাজ্বলা আবছা আকাশের দিকে তাকিয়ে। কি যেন স্বপ্ন দেখত তারা। 

দূরে, বহু দূরে বেড়াতে যাবার স্বপ্ন। নতুন করে ঘর-বাঁধা-ভালোবাসার আয়োজন। অনুভূতির স্বাদস্পর্শ নিয়ে তারা বাঁচবে। এঁকেবেঁকে উঠেছে পাহাড়ি পথ। সবুজ বন— পাহাড় ঢেকে রয়েছে বাঁশবন আর বুনো কলা গাছে। বাতাসে কমলালেবু ফুলের উদগ্র সৌরভ। উপরে উঠে চলেছে গাড়িটা—নীচে, বহু নীচে ফেলে আসা পথ দেখা যায় অন্য পাহাড়ে। সরু এক ফালি পথটা এঁকেবেঁকে বন আর পাহাড়ের মধ্যে কোথায় গেছে নিচের দিকে। 

চলেছে সে আর সনৎ। একটা হাওয়া-শনশন পাইন বনের সুর জাগে বাতাসে। হাসছে নিজের মনেই নীতা! 

বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শোনা যায়, গাড়িখানা এসে থেমেছে তাদের বাড়ির দরজায়। মাধবমাস্টার চমকে ওঠেন। নীতাও বের হয়ে আসছে। তবে কি মন্টুর কোন খারাপ খবর দিতে এসেছে হাসপাতাল থেকে পুলিশ! 

জীবনে ওদের শুধু ভয়। ক্ষয় আর ক্ষতির জমাট কালো আতঙ্ক সব আলো ঢেকে রেখেছে। তাই সকলেই যেন চমকে ওঠে। 

মাধববাবুও উঠে আসছেন। কাদম্বিনীর মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, কাঁদতেই বাকি। মা বলে ওঠে—কি হল রে নীতা? আজ তুই দেখে এসেছিলি না মন্টুকে? এসে চুপ করে শুলি মুখ-ভার করে। সত্যি কথা বলতে নেই! ওদিকে কি হাসপাতাল থেকে লোক এসেছে নাকি? 

—চুপ কর মা, ব্যাপারটা কি দেখে আসি। 

নীতা শশব্যস্ত বের হয়ে গেল। 

বাইরে এসেই অবাক হয়ে যায়। শঙ্কর নামছে গাড়ি থেকে। ট্যাক্সি নয় মস্ত ঝকঝকে একটা গাড়ি! কোনো গুণমুগ্ধ ভদ্রলোক নিজের গাড়িতে তাকে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। দুটো নতুন দামি তানপুরো, হোল্ডঅল, সুটকেশ, একটুকরি ফল নিয়ে নেমেছে শঙ্কর, নীতার দিয়ে তাকিয়ে আছে—নীতাও দেখছে ওকে অবাক হয়ে। 

ক’মাসেই ওর চেহারায় এসেছে একটা সুন্দর ব্যক্তিত্বের ছাপ। শ্রীহীন চেহারায় এসেছে সৌন্দর্য। মুখে-চোখে ফুটে উঠেছে মিষ্টি হাসির আভা। 

—হাঁ করে দেখছিস কি রে! 

শঙ্করই নীতার দিকে এগিয়ে আসে। 

কাদম্বিনী ভিতর থেকে বের হয়ে এসেছিল ভাতের ফেনগালার কাজ বন্ধ রেখে। কি সর্বনাশের খবর শুনবে। কিন্তু বাইরে এসে শঙ্করকে দেখে সেও অবাক হয়ে গেছে। গীতার বিয়ের পর থেকে শঙ্কর এ বাড়ির বাইরেই রয়েছে। কয়েক মাস বোম্বে, মাদ্রাজ—ওই দিকের বিভিন্ন শহর ঘুরে অনুষ্ঠান করে এসেছে। 

ও যেন এখন অন্য জগতের লোক, অনেক দূরের মানুষ। কয়েকটা মাসের মধ্যেই অনেক কিছু বদলে গেছে। এ বাড়ির আবহাওয়াটুকু। 

নীতার দিকে তাকিয়ে সেটা বেশ বুঝতে পারছে শঙ্কর। বাড়িতে কেমন এটা শ্রীহীন ভাব ফুটে উঠেছে, সবুজ পাতাগুলো পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে, ফুলের গাছেও কেমন একটা নিস্তেজ ভাব। নীতার রঙ আরও ময়লা হয়ে গেছে। চোয়ালের হাড় দুটো ঠেলে উঠেছে—চোখের পাতা ম্লান-করুণ! 

শঙ্কর পরম স্নেহ-মমতা-ভরা দৃষ্টিতে নীতার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

—হ্যাঁরে শরীর খারাপ! 

—কই না তো! 

কাদম্বিনী জানে শঙ্করের দ্বারা কিছু উপকার হওয়া সম্ভব নয়, তার কাছে কিছু প্রত্যাশাও করে না সে। তবুও এই সময় কিসের আবেদন জানাতে শুরু করে কাদম্বিনী। 

নীতা বাধা দিয়ে ওঠে—দূর পথ এসেছে মা, একটু জিরোতে দাও। চলো দাদা, পরে সব কথাই শুনবে। 

নীতা যেন ওকে জোর করেই সরিয়ে নিয়ে গেল এখান থেকে কাদম্বিনী থ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনি করেই চিরকাল যেন নীতা শঙ্করকে মায়ের আঘাত থেকে রক্ষা করে চলেছে। মাধববাবুর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কাদম্বিনী। বলে ওঠে তিক্ত সুরে—দেখলে তোমার মেয়ের কাণ্ড। শুনলে কথাগুলো? 

মাধববাবু কথা বললেন না। তিনিও ঘরের ভিতর চলে গিয়ে পাণ্ডুলিপিটার পাতা ওলটাতে থাকেন। 

কাদম্বিনীর ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যায়—এ বাড়ির সবই আলাদা। ভাঙবে তবু মচকাবে না। 

শুনেছে কাগজে সেদিন নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে শঙ্করের। অনেক নাম-যশ কুড়িয়েছে সে বিদেশে। তার সঙ্গে কিছু টাকাও কি না আছে? কাদম্বিনী সেই কথাই বলতে তাকিয়েছিল—এ সময় টাকা তার দরকার। কিন্তু নীতা তাকে সে সুযোগই দেয়নি। 

রাত্রি হয়ে আসছে। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে উপনিবেশের আবহাওয়া। জোনাক জ্বলা অন্ধকার ঝিঁঝিপোকার সুরে মুখর। বাতাসে ফুটেছে হাসনুহানার উদগ্র সৌরভ। রাতজাগা পাখি একবার অতর্কিত ডেকেই থেমে গেল। দূরে ইটখোলার মাঠ থেকে দেহাতি কুলির বেতালা সুরের চিৎকার ভেসে আসে। 

জোনাকির দল আকাশে ওঠানামা করছে—এলোমেলো, মুঠোমুঠো তারাফুল কে যেন আশমানে ছিটিয়ে দিয়েছে। 

এ যেন নীতার জীবন-সংগ্রামের করুণ কাহিনি। এ বাড়ির এই মানুষগুলোর কথা নয়, নীতারই জীবনের কথা। সয়ে সয়ে ও যেন আজ পাথর হয়ে গেছে। 

শঙ্কর চুপ করে নীতার কান্নাভেজা কথাগুলো শুনে চলেছে। আবছা আলোয় নাক-চোখের ধারালো তির্যক রেখাগুলো পরিস্ফুট। নীতা বলে চলেছে। 

মন্টুর এই অ্যাকসিডেন্ট! বাবার রোজগার নেই। এ সময় ওদের তুমি দেখবে না?

শঙ্কর পায়চারি করছে। কথাগুলো তার মনেও ঝড় তুলেছে। কিন্তু ঝেড়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করে সে। 

বলে ওঠে—তা, কী করতে পারি বল তুই। তুই তো দেখছিস, কিন্তু কী করতে পেরেছিস এতবড় দুর্যোগের মাঝে? 

ওর নিষ্ফল প্রয়াস দেখে নিজেই চমকে ওঠে শঙ্কর। বলে চলেছে সে—একা তোর চেষ্টায় সংসারের সব বিপদ বাধা টপকে যাবি? 

দৃঢ়কণ্ঠে নীতা বলে— চেষ্টা করে তো দেখতে হবে! 

শঙ্কর অনেক ভেবেছে এসব কিন্তু পথ পায়নি। জবাব দেয় নীতার কথায় 

—পাগলামি! এ তো নিছক পাগলামি। নিজেকে মেরে ফেলে এই দুর্বার ধ্বংসের জোয়ার ঠেলে এগিয়ে যাবার বৃথা চেষ্টা করবি? তুই এ সংসারের রূপ বদলাতে পারবি না। ওরে, ঘুণ ধরে গেছে এই কাঠামোর মজ্জায়-মজ্জায়। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের সংসার টিকবে না আর। ওরা সবাই মরবে—আজ না হোক, দুদিন পরে। তুইও যদি এই আত্মঘাতী চেষ্টা করিস, তুইও বাদ যাবি না। 

শঙ্কর নিষ্ঠুরের মতো কথাগুলো বলে চলেছে। চমকে ওঠে নীতা ওর মন্তব্যে 

—তাহলে ওদের ফেলে নিজেকে বাঁচাবার জন্য স্বার্থপরের মতো দূরে সরে যাব! 

হাসে শঙ্কর—তাও পারবি না! সুতরাং তোর দুঃখ কোনোকালেই ঘুচবে না। গীতাকে দেখে ও শিখলি না? 

—দাদা! নীতা একটু অবাক হয় ওর কথায় 

নিজের পথ যারা চিনতে পারে তাদের মনে বোধহয় জমাট হৃদয়হীনতা স্বার্থপরতা একটা কোথায় থাকে। বারবার এইটাই যেন দেখছে নীতা। 

চুপ করে থাকে। 

—রাগ করলি? শঙ্কর প্রশ্ন করে। 

শঙ্করের কথায় চটে উঠেছে নীতা মনে মনে। ওরা সবাই স্বার্থপর। আজ শঙ্কর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে, নাম-যশও হয়েছে, উপরে উঠে আজ অতীতের কথাও ভুলতে বসেছে। হয়তো ভুলেছে তার সাধনার সিদ্ধির মূলে নীতারই ত্যাগটুকুকেও। গীতার কথা তুলে তাকে হয়তো পরিহাস করবারও চেষ্টা করে। আগাগোড়া ভুল বুঝেছে নীতাকে সে। প্রতিবাদ করে ওঠে নীতা। 

—নিজের স্বার্থের জন্য কিছু করিনি দাদা। যদি সেদিন তোমার ওই দর্শন, ওই নীতিতে কাজ করতাম আজ শঙ্কর মুখুজ্যে কোথায় থাকত সেটা ভেবে দেখেছ? 

শঙ্কর ওর সোজা কথায় একটু বিব্রত হয়ে পড়ে। সামলে নিয়েই বলে ওঠে—আমি তোকে এক্সপ্লয়েট করেছি। ঠকিয়েছি। 

নীতা আজ কঠিন হয়ে উঠেছে শঙ্করের এই ব্যবহারে। প্রীতি-শ্রদ্ধার বন্ধন-এর কি কোনো দামই নেই? ওর দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা—মনের কোণে জমে ওঠে ঘৃণার একটা ভাব। তাকে ঠকিয়েছে সনৎ, ঠকিয়েছে ওই সাদাসিধে আত্মভোলা লোকটিও। সনতের উপর তার লোভ নেই। তার দুর্বল-চিত্ত সে চেনে-হাওয়ার ভর করে চলে তারা, যখন যেদিকে থাকে—তারাও যায় সেইদিকে। 

কিন্তু শিল্পী—মানবদরদী যারা, তাদের কাছে এই আত্মত্যাগের এমনি দাম পাবে—কল্পনাও করেনি নীতা। 

শঙ্কর বলে ওঠে—টাকা কিছু পেয়েছি। তা তোকেই দিয়ে দিচ্ছি নীতা। আরও যদি দরকার হয় বলবি। 

নীতা তিক্তকণ্ঠে বলে ওঠে—দাম দিচ্ছ? না দয়া করছ? 

শঙ্কর কথা বলল না; জিনিসপত্রগুলো গুছাতে থাকে। নীতা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শঙ্কর এ বাড়িতে থাকতে আর রাজি নয়। 

নীতা বলে ওঠে—তুমি কি অন্য কোথাও থাকবে? 

—এ বাড়িতে কোনোদিনই থাকতে চাই নি নীতা, আজও বাইরে থাকব। 

আবছা আলোয় কখানা নোট এগিয়ে দেয় নীতার দিকে। গুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীতা—টাকাগুলো নেবার জন্য কিছুমাত্র আগ্রহও দেখাল না, হাতও বাড়াল না। নীতার চোখে-মুখে একটা নীরব কাঠিন্য ফুঠে ওঠে। শঙ্কর তার মনে একটা কঠিন আঘাত দিয়েছে। সব ধারণা বদলাচ্ছে নীতার। 

কঠিন স্বরে বলে ওঠে—তোমার ও ভিক্ষা না নিয়েই চালাবার চেষ্টা করব, দাদা। এতদিন করেছি—এখনও করব। ও টাকা তোমারই থাক। ওতে কর্তব্যপ্রীতির কোনো ছোঁয়াই নেই—দয়া করে ভিক্ষা দিচ্ছ, আর নাইবা নিলাম। 

কাদম্বিনী তক্কে তক্কেই ছিল। পায়ে পায়ে কখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা দুজনের কেউই লক্ষ্য করেনি। নীতাকে ওর টাকা ফিরিয়ে দিতে দেখে অবাক হয়ে যায় কাদম্বিনী। এতগুলো টাকা! কাদম্বিনীর সারা মনে একটা লালসার ছায়া ফুটে ওঠে। দারিদ্র্য আর অভাব পদে পদে। এই সময় এতগুলো টাকা বেহাত করা নির্বুদ্ধিতার কাজ। তাই এগিয়ে গিয়ে শঙ্করের হাত থেকে ছোঁ-মেরে টাকাগুলো তুলে নেয় কাদম্বিনী 

—দে, আমিই রাখছি। টাকা বলে কথা, ফেলে রাখতে নেই। 

শাড়ির খুঁটে পাক দিয়ে বেশ মজবুত করে গিঁট মারতে থাকে। নীতা মায়ের এই ব্যবহারে চমকে ওঠে। বেশ কঠিন স্বরেই ধমক দেয়—মা! 

কাদম্বিনী ততক্ষণে চৌকাঠ পার হয়ে গেছে। পিছন ফিরে তাকালও না। নীতা যেন সুযোগ পেলেই তার থেকে ওই টাকাগুলো কেড়ে নিয়ে শঙ্করকে ফিরিয়ে দেবে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে বলে ওঠে কাদম্বিনী—তা বাছা, দিচ্ছে মা বলে, নোব না? হাজার হোক ছেলে। যোগ্য ছেলে। তুই বস বাবা। আমি আবার রান্নাঘরে মাছটা চাপিয়ে এসেছি। অনেকদিন মাছপাতুরি খাস নি—একটু চাপাই গে। 

দাঁড়াল না কাদম্বিনী। 

শঙ্কর নীতার দিকে তাকিয়ে থাকে–স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে নীতা। শঙ্কর যাবার আয়োজন করছে—একটি কথাও আর বলল না নীতা, বাধাও দিল না তাকে। 

ওরা যাক। গীতা গেছে। সনৎও চলে গেছে তার জীবন থেকে। দাদাও চলে যাক। ভিন্ন জগতের লোক ওরা; ফিরে যাক যে যার জগতে। পাখি ডাকা সুবর্ণ আভাময় ওদের জগৎ। নীতার জীবনের পথ তার থেকে অনেক দূরে। একাই চলেছে সে। ঝড়-দুর্যোগের মাঝে তারই বুকে দুর্গম বন্ধুর পথ চিরে চিরে। 

যতক্ষণ পারে চলবে। তারপর? তারপর আর জানে না। 

চুপ করে আছে নীতা। দাদার ডাকে মুখ তুলে তাকাল। দরদভরা কণ্ঠে শঙ্কর যেন অনুনয় করছে—অজান্তেই নীতার মনের সবচেয়ে কোমল জায়গাটুকুতেই আঘাত দিয়েছে সে। দুঃখ পায় নিজেই। বলে ওঠে শঙ্কর—আমাকে ভুল বুঝিস না নীতা, তোর ভালোর জন্যই বলছিলাম কথাগুলো। 

এত দুঃখেও হেসে ফেলে নীতা। 

—ভালো! আমার ভালো আর কি হবে দাদা? যমকাকের মতো রূপ, নিজে যাকে তিনবেলা খেটে একমুঠো ভাতকাপড়ের জোগাড় করতে হয়, তার আবার ভালো-মন্দ কি? 

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে নীতা অসহায় কান্নায়। জীবনের এই কঠিন বাস্তব রূপ তাকে নিদারুণভাবে আঘাত করেছে, ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই বেদনায় সারা মন গুমরে ওঠে। এ তো সে চায়নি। সেও বাঁচতে চেয়েছিল—ভালোবেসে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। নারীর সব চাওয়া-পাওয়ার আশাই ছিল তার মন-জুড়ে। 

কিন্তু! সব মুকুল অকালে ঝরে গেছে। ফুল-ফলের সব স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে গেছে কঠিন ঊষর এই বন্ধ্যা মৃত্তিকায়। তাই এই ঝরঝর অশ্রুবন্যা। 

শঙ্কর এগিয়ে আসে। ওকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই। জীবনে ওর নারীত্ব লাঞ্ছিত হয়েছে নিদারুণভাবে। সেই ব্যথা ভোলবার জন্যই নিজেকে অহরহ কাজে ডুবিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তবুও ভুলতে পারেনি নীতা 

শঙ্কর ওর জন্য দুঃখ পায়। কিন্তু নিরুপায় সে। এই জটিলতার আবর্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে চায় না বলেই হয়তো সে সরে থাকতে চায়। নতুন করে নতুন জগতে বাঁচতে চায়। শঙ্কর বলে ওঠে—রাত্রির ট্রেনেই ফিরতে হবে আমাকে। কাল গাড়ি আসবে। ওগুলো পাঠিয়ে দিবি ভবানীপুরে। 

কোনো ছাত্রের বাড়িতে উঠবার ব্যবস্থা করছে। 

বের হয়ে গেল শঙ্কর। রাতের বাতাস বইছে হু-হু শব্দে। গাছগাছালির মাথায় হাহাকার জাগে।

নীতা বাধা দিল না তাকে। জীবনে কাউকে বাধা দেয়নি নিজে। কোনো মতবাদের সপক্ষে বিপক্ষে কোনো কথাও জানায়নি। সহ্য-করাই তার ধর্ম। 

তাই শঙ্করও চলে গেল। দাদাও আজ আঘাত দিয়েছে তাকে। 

চারিদিকে জমাট অন্ধকার। মাধববাবু বোধহয় এখনও লিখছেন। তাই মাধববাবুর ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। নীতা জানে সেই প্রকাশকের কাছে তাকে যেতে হবে কাল! 

নিজের দুঃখটা ভুলে গেছে। মনে মনে স্বপ্ন দেখছে। বাবার বইখানা ছাপা হয়েছে, সমাদর পেয়েছে। সেই আনন্দে বৃদ্ধ মাধববাবুর শীর্ণমুখ ভরে উঠেছে। 

বাবা ওকে যেন বলে চলেছে—বুঝলি নীতা; এ আমি জানতাম। এমন বই চলবে না?

বৃদ্ধ আবার বাঁচবার স্বপ্ন দেখছেন। সুন্দর জীবনের আশা তাঁর জীর্ণ চোখে। নীতা সেই হাসির ছোঁয়ায়-হাসছে বাবার দিকে তাকিয়ে। 

নীতার মনে খুশির জোয়ার। 

হঠাৎ একটা কাশির আবেগ আসে, সারা শরীরের উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে যায়! গা-টা কেমন জ্বর-জ্বর করে। ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পায়ের নিচের থেকে চাদরটা চাপা দেয় তুলে। রাত কত জানে না। অন্ধকার তমসাচ্ছন্ন রাত্রি, কোথাও কোনো আলোর নিশানা নেই। দিনের আলোতে আবার জেগে ওঠে সুপ্ত উপনিবেশ। 

কাদম্বিনী সংসারের চাকায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে নিজেকে, কোথাও আসা যাওয়া বিশেষ করে না—করবার সুযোগও তার নেই। সেকেলে মানুষ যাতায়াত করতে ভয় পায়। তবু আজ সে জেদ করেই হাসপাতালে এসেছে মন্টুকে দেখতে। 

শঙ্করও বলেছে হাসপাতালে আসবে। তবু একবার দেখা করে আসবে তার সঙ্গে। তাই কাদম্বিনী নীতাকে অনুনয় করে—আমাকেও নিয়ে চল, বাছাকে একবার দেখে আসি। 

মায়ের প্রাণ কাঁদে; নীতা মাকে সাবধান করে দেয়। 

—দেখো, যেন কাঁদাকাটা কোরো না মা হাসপাতালে। 

—না! কাদম্বিনীর মুখ শক্ত হয়ে ওঠে; ছেলের এই বিপদে মুহ্যমান হলেও কেমন অসাড় হয়ে গেছে সারা মন। 

বিরাট বাড়িগুলো—বাইরে এদিকে-ওদিকে কত লোকজন! রাস্তায় গাড়ির ভিড়, তাই দেখে কাদম্বিনী অবাক হয়ে গেছে, কেমন যেন ভয় ভয় করে। নীতার হাত ধরে হাসপাতালের সীমানায় ঢুকে এগিয়ে যায় দুরু-দুরু বুকে। 

এত লোকজনের যাতায়াতে কলরব ওঠে। সারি সারি রোগীর দলের মাঝে কর্মব্যস্ত নার্সদের দেখে কেমন ঘাবড়ে যায় কাদম্বিনী। মন্টুও অনেকখানিও সামলে নিয়েছে এখন। মা, আর দিদিকে, সেইই যেন সান্ত্বনা দেয়। 

—ডাক্তারবাবু বলছিলেন আমাকে, সার্জারিতে আজকাল অনেক উন্নতি হয়েছে। এমন জুতো বানিয়ে দেবে, পায়ে দিলে তুই বুঝতেই পারবি না দিদি। আর কোম্পানির ডেনিস সাহেবও এসেছিলেন। 

কি বললেন রে সাহেব? কাদম্বিনী যেন ভয় পেয়েছে। বেশ কিছু টাকার চাকরি, পঙ্গু হয়ে গেলে কি আর তাকে চাকরি দেবে। অসহায় বেকার পোষ্য হয়েই থাকতে হবে মন্টুকে। 

মন্টুও তাই ভাবছিল। নিজের জীবনের এই বোঝা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল সারা মনে। কিন্তু সেই চিন্তার কালো মেঘ সরে গেছে। 

বলে ওঠে, আপনি থেকে ছ’মাস ছুটি মঞ্জুর করেছে। তারপর চাকরি থাকবে। অন্য ডিপার্টমেন্টে বসে বসে কাজ করতে দেবে। ডাক্তারবাবুরাও বললেন, তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। ওসব ঠিক পারব। 

—আচ্ছা। মা যেন তাই করেন বাছা! মা জোড় হাতে নমস্কার করে একটু নিশ্চিন্ত মনে। কাদম্বিনীর মুখের কালিমা খানিকটা মুছে যায়। 

নীতা কথা কইল না। মাসে মাসে এই পঙ্গু অভিশাপগ্রস্ত দেহটা টানবার জন্য কিছু মজুরিই একমাত্র কাম্য তার। সেই আনন্দে পায়ের দুঃখও ভুলেছে মন্টু। শুধু বেঁচে থাকার আনন্দে ওরা সব ভুলতে চায়। বাঁচাটাই যেন পরম সত্য। 

দোষ দিতে পারে না নীতা, সেও বাঁচতে চায়। জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চায়, চারিদিকে আনন্দমুখর পরিবেশে সে গড়তে চায় তার সংসার—আনন্দময় একটি নীড়। কিন্তু! কোথায় যেন বুকের মাঝে একটা কাঁটার মতো ব্যথা বাজে। একটি ব্যর্থ স্বপ্নবীণা! 

ওপাশে সনৎকে দেখে এগিয়ে যায়। এ যেন অন্য নীতা। এক মুহূর্তেই সে বদলে গেছে। সনৎ বলে ওঠে—কাল হাসপাতালে এসে ফিরে গেলাম। 

নীতা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। 

কাদম্বিনী সনতকে এখানে আসতে দেখে একটু অবাক হয়। ঠিক মন্টুকে দেখতে নয় অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসে বোধহয়। 

কাদম্বিনী এগিয়ে আসে ওদের দিকে। নীতা মায়ের দিকে তাকাল। 

সনৎও কাদম্বিনীকে দেখে একটু যেন দমে গেল। কাদম্বিনীর সন্ধানী চোখে সনতের মুখের এই পরিবর্তনটা দৃষ্টি এড়ায় না। নীতা বলে ওঠে—কাল শরীরটা ভালো ছিল না। সকাল সকাল বাড়ি ফিরেছি। 

—কী হয়েছে? সনতের কণ্ঠে ব্যাকুলতার সুর। এগিয়ে আসে ওর কাছে। এত বলি, দিন কতক ছুটি নিয়ে একবার ডাক্তারকে দেখাও। অনেক খারাপ হয়ে গেছে তোমার শরীর। 

কাদম্বিনী মন্টুকে কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ ওদের দিকে তাকিয়ে একটু বিস্মিত হয়। নীতার হাতে সনৎ কিছু টাকা দিচ্ছে। ঘটনাটা তার কাছে বিচিত্র ঠেকে। নীতা মাকে যেন কৈফিয়ত দেয়—টাকার কিছু দরকার কিনা। আবার মাসকাবারেই দিয়ে দোব। ধার নিলাম কিছু টাকা ওর কাছ থেকে। ওষুধের দোকানে লাগবে। 

কাদম্বিনী কথা বলে না। নিজের কাছে শঙ্করের কিছু টাকা আছে, তা নিতেও সাধে না। কাল শঙ্করের টাকা ফেরত দিল, কিন্তু সনতের কাছে টাকা নিতে এতটুকু বাধে না তার। এটাকে বিশেষ ভালো চোখে দেখে না সে। চুপ করে থাকে কাদম্বিনী। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *