মেঘে ঢাকা তারা – ৪

বের হয়ে এসে পার্কে বসলো নীতা। বিকালটা তাড়া খাওয়া কুকুরে মতো বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে সে কিসের সন্ধানে; একটু স্বস্তি, একটু শান্তির আশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে জ্বালা-পোড়া-ধরা মন।

 সারা জীবনের গ্লানি আর আত্মসমর্পণ তার নিজের কাছে দুরপনেয় কলঙ্কের মতো কালো হয়ে উঠেছে। মিথ্যা আশার পিছনে ছুটেছিল সে। 

সনতকে ভালোবাসতে গিয়েছিল নিজের স্বার্থসিদ্ধির নেশাতেই। সেই আশা ব্যর্থ হতেই ভেঙে মুষড়ে পড়েছে সে। 

আজ খোঁজ করে নিজের চারিপাশ; তার নিজের ঘর-বাঁধবার কোনো উপায় নেই। অসহায় মা, বৃদ্ধ-পঙ্গু বাবা, আত্ম-ভোলা দাদা—সবাই তার উপরই নির্ভরশীল। সে যদি বাইরে চলে আসে, নিজের ঘর-বাঁধে—তাহলে? 

ক্রমশ সব পরিষ্কার হয়ে আসছে। অন্য কোনো পথ তার নেই, একটা নিবিড় আঁধার যেন ঘিরে রয়েছে তার চারিপাশে; নিবিড় মেঘে ঢেকে আছে তারার সন্ধান; সেই মেঘমুক্তি তার চাই—এই হোক তার সাধনা। 

সনতের কথা যেন ভুলতে পেরেছে নীতা। সংসারের জন্য তার অর্থ পরিশ্রম সব দিয়েছে, বোনের জন্য আরও কিছু ত্যাগ না হয় করবে সে। চরম ত্যাগ! 

পথচলা অনেকখানি সোজা হয়ে আসে। বৈকালের সোনারোদ আভা আনে গাছগাছালির মাথায়। পাখিডাকা অপরাহ্ণ। 

বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে নীতা। শূন্য পৃথিবী—উদাস দিগন্ত, তার মাঝে তার ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়ার কথা কোথায় নিঃশেষে হারিয়ে গেছে। 

.

মন্টু কেমন বদলে যাচ্ছে। গ্যালি অ্যান্ড গ্যালি কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে খেলার জন্যই চাকরি পেয়েছে সে। খেলোয়াড় হিসাবে সেখানে তার নাম-ডাকও প্রচুর। অফিসাররা সবাই তাকে চেনে, ভালোবাসে। অফিসের গাড়িতে করে মাঠে যায়—সাহেবসুবোর সঙ্গে খেলে। কিন্তু ওই পর্যন্তই; মাইনে যা পায় সম্মান ভালোবাসাটুকুই সেই পদের তুলনায় বেশি। আর এইটাই তার কাছে বেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। ফোরম্যান, মেশিন শপ ইন্‌চার্জ—আর সকলের পরনে দামি সুট, একসঙ্গে বাইরে খেলতে গিয়ে নিজের এই অবস্থার কথা ভেবে কেমন বেশ অস্বস্তি বোধ করে সে। 

মাঝে মাঝে বাড়িতে টাকা না দেবার কথা ভাবে—কিন্তু সংসারের অভাব, বড়দির হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার কথা ভেবে কিছু বলতে পারেনি প্রথম প্রথম। 

ক্রমশ মনের সেই সহজ স্বাভাবিক চেতনাবোধটুকু ম্লান হয়ে আসে। পোশাক-আশাক তার চাই-ই। এভাবে থাকতে পারে না সে। 

নীতা বাড়িতে পা-দিয়েই স্বাভাবিক হয়ে আসে। রাজ্যিসুদ্ধ কাজ পড়ে—বাবার ঘর গোছানো হয়নি। একটু বেড়াতে বের হন মাধববাবু এখন। নীতাও কাজ নিয়ে পড়ে। কাজের ভিড়ে হারিয়ে যায় নীতা। 

মন্টু টাকা কটা দিদির হাতে তুলে দেয়। অবাক হয় নীতা। 

—মাত্র পঞ্চাশ টাকা? তোর না মাইনে বেড়েছে? 

কাদম্বিনী বলে ওঠে—তেমনি খরচও তো আছে বাছা। পোশাক-টোশাকও চাই। সাহেবসুবোর সঙ্গে ওঠা বসা, তারপর দুধ-ডিমও চাই। 

নীতা তাকিয়ে থাকে মন্টুর দিকে, সংসারে খরচের ভিড়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। বাবার চিকিৎসা খরচ, পথ্য, গীতার শাড়ি, কিছুদিন থেকে কান বালার জন্য বাতিক ধরেছে সে, মাও বলেছে কবার কিন্তু নীতা যেন দিশে পায় না। 

নীতা বলে ওঠে—তোর তো ওই দিলেই খালাস, কিন্তু আমি এতে চালাই কী করে বল। আমি কার কাছে চাইব? 

মন্টু জবাব দেয়—সমাজে ওঠা-বসা করতে হয় দিদি, সকলের মতো না চললে খারাপ দেখায়।

কাদম্বিনী মাঝে মাঝে নীতাকে সন্দেহ করে, আজ মুখ ফুটে বলে ওঠে।—এত টাকাই বা কোথায় যায় বাছা? তোর মাইনে টিউশানির টাকা। তার উপর মন্টুর মাইনে? 

নীতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, বলে ওঠে—নিজেই চালাও না মা! 

কাদম্বিনী মেয়ের ঝাঁঝালো কথায় দমে না। জবাব দেয় তখুনিই—বলতে গেলে রাগ তো হবেই বাছা। সংসার আমরা করিনি তো! কথায় আছে, অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর। ঘর তাই তোর কোনো দিনই হল না। 

আজ দুপুরের ঘটনাটা নীতার চোখের উপর ভেসে ওঠে, নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত-মন অসহ্য-যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে—মা! 

কাদম্বিনী রুটি বেলছিল, মেয়ের কথায় ওর দিকে তাকাল। বেশ কঠিন স্বরেই বলে ওঠে কাদম্বিনী—অন্যায় কিছু বলিনি বাছা। এ বাড়িতে বসে খাচ্ছে একটা দামড়া মরদ। আর দুধের ছেলেকে রোজগার করতে পাঠিয়েছি। তার কোনো সাধ-আহ্লাদও মিটবে না? 

শঙ্করকে ওরা বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না। 

চুপ করে গেল নীতা। মন্টু চা খেতে খেতে বলে—আজ সনতদাকে দেখলাম আমাদের হেড অপিসে। স্টোর ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়েছে। 

নীতা কথা বলল না, কথাটা যেন তার কানেই যায়নি। কাদম্বিনী বলে ওঠে—বলছিল বটে, তাই মাইনে কি রকম? 

রুটি চিবোতে চিবোতে বলে মন্টু—মন্দ কি, শ তিনেকের উপর। 

কাদম্বিনীর মুখে হাসির আভা ফুটে ওঠে। 

নীতা উঠে ভিতরে চলে গেল। এ প্রসঙ্গে তার কোনো ঔৎসুক্যই নেই। আঁধার ঘরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। আজ মনে হয় তার জীবন থেকে কী একটা মস্ত অংশ খসে গেছে, অসীম শূন্য হয়ে গেছে আশপাশ। নীল আকাশের তারাঢাকা বুক থেকে একটা উল্কা খসে পড়ল জ্বলন্ত তির্যকরেখায়। 

মাধববাবু চুপ করে বসে আছেন। নীতার আনা ডিমলাইটের ম্লান-আভা পড়েছে মুখে, বইপত্তরগুলো পড়বার ইচ্ছে নেই, বাতাসে পাতাগুলো উলটে চলেছে একটার পর একটা, স্মৃতির জীর্ণ কীটদষ্ট পুঁথির পাতা উড়ছে এক একখানা। 

সুখমুখর পীরগঞ্জের সেই দিনগুলো মনে পড়ে, নীতা তখন এতটুকু, সাজানো সংসার। খেলাপাতির ঘরকন্না পাতা মেয়েটি, শঙ্কর আর নীতা! প্রাচুর্য আর প্রীতিতে ভরা ছিল সেই জীবন কত চেনা-অচেনা মুখ, পুজোয় সানাই বাজত—নদীর জলে ভেসে যেত পালতোলা নৌকা বাতাসে শিউলির সুবাস। 

—শুনছ? 

স্ত্রীর ডাকে ফিরে তাকালেন মাধববাবু। 

—গীতার বিয়ের কথাবার্তা ভেবেছ কিছু? 

—নীতারই দিতে পারলাম না, আগে ওর হোক। বড় থাকতে ছোট বোনের বিয়ে? 

কাদম্বিনীর মনে মনে এতদিনের চিন্তা এতটুকুও টের পাননি মাধববাবু। নিজের চিন্তাতেই তিনি মত্ত। কাদম্বিনী বলে ওঠে বিকৃত কণ্ঠে—হয়,—আজকাল সবই হয়। বলি, কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছ মেয়েকে দুটো পয়সা রোজগার করছে, আর অমনি বিয়ে দেবার সাধ। এদিকে নেই ওদিকে আছে। 

জীর্ণকণ্ঠে মাধববাবু বলেন—চাকুরে-মেয়েকে বিয়ে করবার পাত্র আজকাল মেলে।

—রূপ? ওই তো চেহারা? কি দেখে নেবে কেউ? 

—মায়ের আমার গুণের সীমা নেই বড়বউ! যার ঘরে যাবে তাকে ভাবতে হবে না।

মাধববাবুর কথায় ফোঁস করে ওঠে কাদম্বিনী—তারপর নিজেরা কি আঙুল চুষবো? ওই তো তোমার ছেলে! একজন হাত পা নাড়ছেন আর হা-হা করছেন, ছোটটি নিজের নিয়েই অস্থির। তারপর এই আগুনের খাপরার মতো রূপ-জ্বালানো মেয়ে, নীতার বিয়ে দিলে সংসারের কি হাল হবে ভেবেছ? 

মাধববাবু এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন কিছু। চিন্তিত মনে বলেন—সবই বুঝি বড়বউ। আমি যে পঙ্গু-অথর্ব। যেটা অন্যায় বলে জানি তাকেও চুপ করে মেনে নেওয়া ছাড়া যে গতি আমার নেই। তবু ভাবি কি জানো? এককালে ছিল কৌলিন্যপ্রথা; বংশ-মর্যাদার জন্য ষাট বছরের বুড়োর’ গলায় ষোলো বছরের মেয়েকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো, দশ বছরের বিধবা মেয়েকে ধর্মের নামে জীবনের সবকিছু উপভোগ আশা-আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হতো, আজও সেইদিন বদলায়নি। সংসার আর আমাদের স্বার্থের জন্যই নীতাকে বঞ্চিত করে রেখেছি সবকিছু থেকে। ও সারাজীবন জ্বলে-পুড়ে মরবে? 

—এছাড়া আর উপায় কি বলো? 

কাদম্বিনীর দু’চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। নিজের এই ক্ষণিকের স্বরূপকেই চেনে না সে। অসহায়-নিপীড়িত একটি মাতৃসত্তা বাঁচবার জন্য যে অহরহ নখদন্তে শান দিয়ে টিকে রয়েছে এ সেই নারী নয়। শাশ্বত মাতৃত্বের ব্যর্থ জ্বালা নিয়ে গুমরে ওঠে এই মন। 

কাদম্বিনী জলভরা অসহায় কণ্ঠে বলে–আমিও ভাবি, কিন্তু কোনোদিকে কোনো পথই পেলাম না। চারিদিকে যে শুধু জমাট অন্ধকার। নইলে মা হয়ে কি আমার অন্যদিকে চোখ নেই? 

মাধববাবু ওর কণ্ঠস্বরে অবাক হয়ে যান। 

আবছা-অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন তারার সন্ধানে। কোথাও কোনো আলোর নিশানা নেই। মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। বাতাসের ক্রুদ্ধগর্জনে ভেসে আসে ঝড়ের আভাস, অন্ধকারে সার্চলাইটের চাবুক মেরে বিরাট আর্তনাদে আকাশ ভরিয়ে তুলে ট্রেনখানা ছুটে গেল স্টেশনের দিকে। 

.

—বাবা! নীতার ডাকে বৃদ্ধ উঠে বসলেন। কাদম্বিনী কখন চলে গেছে। মাধববাবু কি যেন দেখছেন ওর দিকে তাকিয়ে। 

—খেতে যাবে না? 

গীতাও ফিরেছে এতক্ষণে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল একবার, গুনগুন করছে গানের একটা কলি। একথোকা রজনীগন্ধা এনেছে বাবার জন্য। ঘরের একটা জীর্ণ ফুলদানিতে রেখে চলে গেল। নীতা চুপ করে দেখছে ওকে। 

হাসছেন মাধববাবু। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে—বুঝলি নীতা, ছেলেবেলায় আমাদের বল খেলার সময় অনেক খেলুড়ে জুটত, কাকে দলে নেবে কাকে বাদ দেবে? শেষকালে টস করে নেওয়া হতো খেলোয়াড়দের। রোজই সব প্লেয়ার বদল হতো—হতো না কেবল সেন্টার ফরোয়ার্ড। 

নীতা প্রশ্ন করে—কেন? 

—বলটা যে তারই। বল যার—এ দুনিয়ায় সেন্টার ফরোয়ার্ড হতে বাধে না তার। খেলবার কোনো যোগ্যতা তার থাক আর নাই থাক। 

হাসে না নীতা, মাধবপুর উঠে দাঁড়ালেন—চল মা, অনেক কষ্টের খাওয়া, সেটায় যেন বাদ না পড়ে। 

রাত্রি নেমে আসে। গীতা নীতার একঘরে শোবার ব্যবস্থা। নীতা ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়ে যায়। গীতার দিকে এতক্ষণ লক্ষ্য করে চায়নি। তাকাতেই দেখে ওর পোশাক আশাক সব কিছুই বদলে গেছে। দামি শাড়ি ব্রকেডের ব্লাউজে যৌবনপুষ্ট দেহ সুঠাম-সুন্দর আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। খোঁপায় তাজা রজনীগন্ধার বেড়, হাতে স্যাময় লেদারের রঙিন ব্যাগ। শাড়িখানার রঙও ম্যাচ করেছে চমৎকার। চোখে-মুখে গীতার কি অনাস্বাদিত আনন্দের দীপ্তি। গা থেকে দামি সেন্টের সৌরভ ফুটে উঠেছে ভুর ভুর করে। নীতা ওর পাশে নেহাত বেমানান। 

চোখ নামিয়ে খাটে গিয়ে উঠল; গীতা বেশবাস ছেড়ে একটু হালকা হচ্ছে। নীতা খাতা টেনে রসে। ডিপার্টমেন্টের আপার ডিভিশনের জন্য পরীক্ষা দেবে, তাই তৈরি হচ্ছে। 

গীতা বলে ওঠে—কি এত দিনরাত পড়িস বল দিকি? আমার আর বাপু পড়া-টড়া হবে না। ছেড়ে দিলাম, ব্যস! 

নীতা কথা বলে না; গীতা ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে। ওর মুখচোখে বিজয়িনীর আনন্দ-আভা। 

গীতা বলে চলে—তা ছাড়া মেয়েদের পড়াশোনা কেবল বিয়ের জন্যই। একটা ভালো ছেলে পাওয়া গেলেই সব ফুল স্টপ। 

 নীতার তরফ থেকে কোনো সাড়া নেই। গীতা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করল। বেশ ধীরভাবেই ওজন করে।

—বিয়ে করছি আমরা। 

নীতা তবুও কথা বলে না, বই থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে মাত্র! 

এতক্ষণ ধরে মেঘ জমেছিল আকাশে আকাশে; বিদ্যুতের ঝলক জাগে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি; গাছগাছালির মাথায় বৃষ্টি নেমেছে, উথালপাথাল ঝড়ের সঙ্গে মাটিতে ঝরছে বৃষ্টিধারা। 

নীতা জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছে, জলের ছাট আসছে। উড়ছে এলোমেলা চুল, আঁচলের প্রান্ত। বিদ্যুতের জোরালো আলোয় তার মুখ ও গালের একাংশ দেখা যায়—দৃঢ়তার ছাপ তাতে পরিস্ফুট। ঘৃণা আর দৃঢ়তা মিশে বদলে গেছে তার কমনীয় মুখখানা। 

বাতাসে ভেসে আসে সুরটা। শঙ্কর গাইছে। মেঘের মাদলের তালে তালে জেগে ওঠে মল্লারের রূপ—নীতার মনের সব কালো যেন ওই সুরের আলোয় ভরে ওঠে। আকাশজোড়া মাতনে সৃষ্টির আনন্দ! 

তৃষিত ধরিত্রী শ্যাম সজীব সুধাঝরা হয়ে ওঠে শান্তির নির্মল ধারায়। মাথা পেতে শান্তিজল নিচ্ছে দিগন্তসীমা বিস্তৃত জীবলোক। শান্তি নামুক সারা মনে। 

নীতা জানলাটা বন্ধ করে গীতার দিকে ফিরে তাকাল। বলে ওঠে সহজভাবে—বেশ তো! 

গীতা ওর দিকে সন্ধানী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে! হিংসা-দ্বেষের কোনো ছাপ নীতার মুখচোখে নেই, প্রশান্ত তার দৃষ্টি। 

আবার বই টেনে নিয়ে বসে। 

গীতা হাই-তুলে বলে ওঠে—আলোটা আড়াল কর বাপু। সারারাত পড়বি তুই, আলোতে আমার ঘুম আসে না। একটা আলাদা ঘরও নেই! বাব্বা, কটাদিন কাটলে বাঁচি। এ বাড়িতে মানুষ থাকে কখনও? 

অন্য জগতের স্বপ্ন দেখছে সে। অন্যঘর অন্যমনের স্বপ্ন। 

নীতা কথা কইল না। 

.

কলোনির অনেকেই জেনেছে সংবাদটা। দূরদূরান্তের বিভিন্ন জেলার আত্মীয়রা দেশত্যাগের কল্যাণে সবাই কাছাকাছি এসে বাসা বেঁধেছে। লতায়-পাতায় সম্বন্ধের অনেকের মধ্যেও আলোচনা হয়। একটু রসালো আলোচনাই। কেমন করে অমন ভালো পাত্র বাগাল গীতা, এইটাই আলোচনার বিষয়। 

.

গুপিমিত্তির ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে। সিনেমায় চান্স জোটেনি; গানের স্কুল খোলার মতলবে এইবার ক্লাব ফেঁদেছে। 

আপশোস করে চায়ের দোকানে বলে—ভালো গাইত মেয়েটা। সব যাবে এইবার। 

দত্তজা গিন্নি মল্লিকামাসি আরও কারা এসেছে বাড়িতে; কাদম্বিনী মেয়ের বিয়েতে ঘটাপটা করবে। প্রথম কাজ। তা ছাড়া এমন পাত্রকে দিতে-থুতে কিছু লাগবে না। গর্ব করার মতো ছেলে এমনিই পেয়ে গেল। রাতারাতি গীতার দাম বেড়ে ওঠে। 

ও পাড়ার মিত্তির গিন্নিও খবরটা শুনে এসেছে। বলে ওঠে—মেয়ে তোমাদের লক্ষ্মী বড়বউ, যার ঘরে যাবে তার কত বরাত। 

কাদম্বিনী পানদোক্তার জোগান দিচ্ছে কদিন থেকে; দত্তজা গিন্নি পানটা মুখে পুরে প্রশংসা করে—তা আবার বলতে, যেমন রূপ তেমনি গুণ। 

—আর বাছা ছেলেও তেমনি। 

কাদম্বিনী বলে ওঠে—নীতার সঙ্গেই ঠিক করেছিলাম দিদি; কত সাধ্য-সাধনা করলাম মেয়েকে, তা ও মেয়ের ধনুকভাঙা পণ, এম-এ পাশ না করে বিয়ে করবে না। কি করি—এদিকে এমন ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাবে, গীতার সঙ্গেই ঠিক করলাম বাধ্য হয়ে। কর্তা তো মতই দেবে না—বড় থাকতে ছোটর বিয়ে; তা শেষমেষ নিমরাজি করালাম। 

নীতা ঘরে বসে পড়ছিল; মায়ের কথাগুলো কানে আসে। সারা শরীরে জ্বালা ধরায়—মনে হয় এখুনি চিৎকার করে ওর স্বরূপ জানিয়ে দেয় সকলকে। সব মিথ্যা বলছে ওই মেয়েটি; যাকে নীতা ঠিক চেনে না। 

কিন্তু কাকে জানাবে এ কথা! নিজের এতবড় অপমান, দীনতার কথা জানাবার ভাষা তার নেই। এই দুঃসহ দুস্তর লজ্জার ভার একাই তাকে নীরবে বইতে হবে। 

আনন্দ উৎসবের আড়ালে একটা করুণ নগ্ন-অভাবের ছায়া মধ্যবিত্ত সংসারের আকাশে ফুটে ওঠে; এ বাড়িতে তার সংক্রমণ এসে লেগেছে। মন্টু ধাপে ধাপে উঠে চলেছে। খেলার দিকে নাম যশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আয়ের অনুপাতে আনুষঙ্গিক খরচও বেড়েছে। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও মাত্রা ছাড়িয়েছে; ডিভিশনে খেলবার আশায় হোটেলেও আমন্ত্রণ করতে হয় দু’চার জনকে। তাদের আপ্যায়ন করতে হয় নানা চোব্য-চোষ্য পেয় পদার্থ দিয়ে। ওদের খুশি না রাখলে তার নামও কেউ জানবে না। ডিভিশনে খেলতে যাবে এই জন্যই এসব খরচও বেড়েছে। বাস-ট্রাম ছেড়ে মাঝে মাঝে ট্যাক্সিতে ওঠে। ট্যাক্সির মিটারের মতো খরচের অঙ্কও উঠে চলেছে ধাপে ধাপে। 

নিজের কুলোয় না—বাড়িতে দেবে কোত্থেকে? সোজাভাবে কথাটা বলতে বাধে। কাদম্বিনী ছেলের গর্বে উৎফুল্ল। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হচ্ছে—নাম বের হয় খেলার জন্য 

দামি লিনেনের হাওয়াই শার্ট কর্ডের প্যান্ট আর দামি জুতো পরে মন্টুকে মানিয়েছে চমৎকার। ব্লেজার কোটটা পরে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। 

মন্টু মাকে শোনায়—বুঝলে মা, আগামী সপ্তাহে দিল্লি যেতে হবে। প্লেনে যাব, একদিন থেকে খেলেই ফিরব প্লেনে। দম নিয়ে বলে সে—গীতার বিয়েতে আসবই। দিল্লির হাতির দাঁতের বালা চুড়ি যা হয়, দেখবে আনব গীতার জন্য। সেদিন খেলা দেখে বড় সাহেব ড্যামগ্লাড। বলে—ইয়ং ম্যান তোমার ফিউচার আছে। 

কাদম্বিনী খুশিতে ফেটে পড়ে—বেঁচে থাক বাবা 

এরই মাঝে কথাটা পাড়ে নীতা—হ্যাঁরে, এ মাসে অনেক খরচা, গীতার বিয়ে, নগদ টাকা কিছু বেশি করে দে! 

মন্টু ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে—প্লিজ দিদি, এনি হাউ ম্যানেজ করে নাও। একেবারে এটি পকেট। খরচা বেড়ে গেছে—দেখি ফিরে এসে ছোড়দির বিয়েতে যদি কিছু পারি দোব 

নীতা কঠিন হয়ে ওঠে—যদি পারি? দয়া করে দিবি! তা সারা মাস চলবে কী করে?

—চালিয়ে নিও এনি হাউ। 

নীতা বলে ওঠে তিক্ত কণ্ঠে—আমি কি টাকার গাছ, যে ভেবেছিস নাড়া দিলেই পড়বে। নীতার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তিক্ত হয়ে ওঠে মন। ইচ্ছে করেই ওরা সকলেই যে তাকে এমনি করে নিঙড়ে নিচ্ছে, নিদারুণ ভাবে ঠকাচ্ছে তিলে তিলে, এই সত্যটা বুঝতে তার দেরি হয় না। মন্টু কথা বাড়াল না, পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াতে থাকে। 

—কোথা পাই আমি! নীতা অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে। 

কাদম্বিনী চুপ করে কি করছিল, হাতের কাজ ফেলে উঠে আসে। কদিন আগে কথাটা সে শুনেছিল তারপর বলি বলি করেও বলা হয়নি। তবু একটু বেশি খাটলে আরও কিছু টাকা আসবে সংসারে, এই ভেবেই আজ বলে ওঠে কাদম্বিনী—হ্যাঁরে, রেলপারের দত্তমশাই একটা টিউশানির কথা বলেছিলেন ওঁর মেয়ের জন্য; তিরিশ টাকা দেবেন বলছিলেন। 

টাকার সমস্যা মন্টুর সামনে তখনই মিটে যায়। 

—ব্যস সলভড! মন্টু বলে ওঠে নিশ্চিন্ত কণ্ঠে। 

নীতা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কঠিন দৃষ্টিতে; টাকা রোজগার করবার জন্যই যেন পুষে রেখেছে তাকে, বিনিময়ে এতটুকু স্নেহ-মায়া-মমতাবোধ নেই ওদের। নীতার ওই কঠিন চাহনি অর্থ যেন বুঝেছে কাদম্বিনী 

তাই কাদম্বিনী মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুখে একটু হাসি এনে বলে—এত খাটুনির পর আর পারবে না ও বলেছিলাম বাছা। সত্যি তো কত আর বয় শরীর! আমারও কি সাধ নয় বাছা, তোরও ঘর-বর হোক। কিন্তু পোড়া ভগবানকে কি বলব—সবাই খোঁজে রূপ না হয় টাকা।

কথাটা হয়তো নিদারুণ ভাবে সত্যি, নইলে সনতের মত ছেলেও তাকে এড়িয়ে যাবে এই ভাবে! এটা কল্পনাও করতে পারে না সে। 

কি ভেবে নীতা বলে ওঠে—জানিয়ে দিও দত্তমশাইকে, সামনের মাস থেকে পড়াব ওর মেয়েকে। কাদম্বিনী খুশিই হয় মনে মনে, তবু বলে ওঠে—দেখ বাছা! শরীর আগে!..তা বলছিলাম, এখন চারদিকে টানাটানি। বৃত্তি পাবার টাকায় যে কঙ্কন জোড়াটা গড়িয়েছিলি—পরিস নাতো, নতুনই রয়েছে; ওটাই দিয়েই দিই—কি বল? 

—কঙ্কন! 

খবরটা নীতা ভুলেই গিয়েছিল। সে এক বেদনাদায়ক স্মৃতি, ভুলতে চায় নীতা। সনতের সঙ্গে গিয়ে কিনেছিল ওই কঙ্কণ জোড়াটা। সেই-ই পছন্দ করে দিয়েছিল নিজে। 

—এই জোড়াটা মানাবে ভালো। 

নির্জন মাঠের ধারে ঝকঝকে বাক্স থেকে বের করে সনৎ তার হাতে প্রথম পরিয়ে দেয় ওই কঙ্কন জোড়া। নরম নিটোল পূর্ণযৌবনা একটি মেয়ে; প্রথম স্পর্শে আত্মহারা হয়ে যায় সে—মনে জেগেছিল বিচিত্র একটি সুরের অনুরণন। সনতের দিকে স্বপ্ন ভরা মন নিয়ে তাকিয়েছিল প্রথম ফোটা সজীব কুড়ির মত বর্ণ গন্ধ নিয়ে। 

সেই স্মৃতি নিঃশেষে মুছে ফেলতে চায় নীতা—সেই সঞ্চয়ের আজ কোনই দাম নেই, মূল্যহীন। মূল্যহীন সে সবকিছু। 

মায়ের কথায় নিস্পৃহ কণ্ঠে জবার দেয় নীতা—নিয়ে নিও, নীচেকার বাক্সে আছে ওগুলো, কৌটোসমেত। ওরই কাজে লাগবে। 

নীতা বাইরের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। 

কাদম্বিনী আমতা করে—তবু কিছু খরচা বাঁচল। যা দাম এখন! 

নীতা দাঁড়াল না। মনের অতলে কী একটা বিদ্রোহ গুমরে ওঠে, মাঝে মাঝে বুক ঠেলে বের হয়ে আসতে চায় সেটা কিন্তু চেপে রেখেছে নীতা বহু চেষ্টায়। অন্তরে একটা অসহ্য জ্বালা-বিষপোকার মত কুরে কুরে খাচ্ছে অহরহ। 

অভিমান রাগ—সবকিছু করতে ভুলে গেছে সে! করবে কার উপর? 

এ বাড়ির মধ্যে একজন আছে যে ওর সমদুঃখের দুঃখী। কিন্তু একান্ত অসহায় সে। এ বাড়ির পরিত্যক্ত একটি প্রাণী। বাইরের গাছগাছালির ঘন সবুজ আবেষ্টনী ঘেরা একটি টিনের ঘরে তক্তাপোশে বসে দিনরাত রেওয়াজ নিয়েই ব্যস্ত। দুস্তর সাধনার মধ্যে নিজেকে নিঃশেষে ডুবিয়ে দিয়ে আনন্দ পেয়েছে সে। সব দুঃখ আঘাত জয় করবার অনুপ্রেরণা পেয়েছে ওরই মধ্যে। কিন্তু কী এমন সাধনা আছে নীতার যার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দুঃখ জয় করবার অনুপ্রেরণা পেতে পারে। 

জানলার ফাঁক দিয়ে সবুজ কলাপাতায় পিছলে ঘরের ভিতর এসে পড়েছে একফালি চাঁদের আলো। শঙ্কর তন্ময় হয়ে আছে সুরের রাজ্য। এ বাড়ির ওই যেন একটি স্বতন্ত্র প্রাণকেন্দ্র। এই পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সুরময় একটি জগৎ গড়ে তুলেছে। 

নীতা এইখানে এসে শান্তি পায়। আলাপ করে চলেছে শঙ্কর। 

নীতাকে ঢুকতে দেখে থামল। তানপুরাটা পাশে নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে স্থির দৃষ্টিতে। বাড়িতে সবকথাই শুনেছে সে। গীতার বিয়ের খবরটাও কানে এসেছে। 

নীরবে সে বেদনাবোধ করেছে নীতার জন্যই। 

নীতার দিকে তাকিয়ে স্থির কণ্ঠে বলে ওঠে শঙ্কর–ঠকে গেলি নীতা! আমি লোক চিনি রে। বলেছিলাম না ওই সনৎ একটা ঠগ। ভুষিমাল! তুই ভাবতিস ও বিরাট একটা কিছু হবে, পি-আর-এস্, পি-এইচ-ডি, নাম করা কোনো অধ্যাপক, গবেষক যাহোক একটা কিছু না? কিন্তু মাটি কখনও সোনা হয় না রে! রূপ দেখেই মজে গেল নেশায়। ননসেন্স! 

নীতা শঙ্করের মুখে ওই কথা শুনে একটু ধমকের সুরেই বলে ওঠে—কি বলছিস যা তা। ছিঃ! 

শঙ্কর বলে চলেছে—কোনো দিন কোনো কথা বলি নি নীতা। বলতে চাইনি। তবে, ও ঠকবে নীতা। দেখে নিস জীবনে শান্তি কোনো দিনই পাবে না ও। ধর্ম মনুষ্যত্ব বলে যদি কিছু থাকে ও জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে। আমার কথা ফলবেই। 

একটু থেমে বলে ওঠে শঙ্কর–তোকে ঠকিয়েছে নীতা, তোর মনে ব্যথা দিয়েছে ও। এই কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। 

নীতা দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে, শঙ্করকে আজ নতুন করে চিনতে পারে। আত্মভোলা মানুষটির এক জায়গায় কোমল হৃদয় একটি রয়েছে। তার দুঃখে সেও কাঁদে। 

হাসে নীতা—খোশামুদি হচ্ছে? টাকাকড়ি এ মাসে কিন্তু দিতে পারব না। উলটে আর একটা টিউশানি নিতে হবে, মন্টু হাত গুটোল এইবার। সুতরাং টাকাকড়ি নেই। 

শঙ্কর হাসছে—তানপুরাটা সরিয়ে রেখে পাঞ্জাবির বুক পকেট থেকে তাড়া-পাকানো দশটাকার নোট কখানা বের করে দেয় ওর হাতে। বেশ গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে শঙ্কর—হিয়ার ইট ইজ! 

অবাক হয় নীতা—এত টাকা! 

হো হো করে হাসছে শঙ্কর, হাসি থামিয়ে বলে ওঠে—কেন, টাকা কি আমার থাকতে নেই? একটা গানের স্কুলে চাকরি নিলাম। সপ্তাহ একদিন করে যেতে হবে। মাসে আপাতত একশো টাকা করে দেবে। 

—সত্যি! নীতা প্রশ্ন করে, তখনও যেন বিশ্বাস করতে পারে না কথাটা। 

শঙ্কর বলে চলেছে—মাকে বলিস না। টিউশানি ফুইশানি ছেড়ে প্রাইভেট এম. এম-টা দিয়ে দে। ফার্স্টক্লাশ তুই পাবি নিশ্চয়। ওটা কি পেয়েছে—ওই সনৎ? সেকেন্ড ক্লাস না? ইডিয়ট! 

হাসছে নীতা নাঃ, বেজায় রেগে উঠেছ তুমি। 

শঙ্কর তানপুরার তারে হাত বুলোয়। মৃদু সুর উঠছে। আবার সেই সুরের রাজ্যে ফের হারিয়ে গেছে সে। নীতা সেই মানুষটিকে আর খুঁজে পায় না। 

তবু মনে হয় বেঁচে থাকার একটা আনন্দ আছে। সংসার একেবারে নিষ্করুণ নয়। চারিদিকে থেকে আঁধার ঘনিয়ে আসে না একসঙ্গে। কালোমেঘের পাশেই রুপোলি আলোর নিশানা জাগে। আঁধারের মাঝে জেগে আকাশভরা তারা—আর চাঁদ। দিনের সবহারানো আলোয় তারা হারিয়ে যায়, আবার অন্ধকারে অতলে ক্ষীণ ম্লান দীপ্তিতে জেগে ওঠে তারকার দল—আশার আলোয় মন ভরে তোলে। 

…রাতজাগা পাখি ডাকছে দীর্ঘ ক্লান্ত সুরে, বকুলের গন্ধস্নাত বাতাস আমন্থর হয়ে উঠছে। 

.

সনৎ কি এক নেশায় ডুবে রয়েছে। কাঙালের কাছে এ আনন্দের ভোজের নিমন্ত্রণ। চিরজীবন দুঃখ অভাব আর কষ্টের মধ্যে কাটিয়ে হঠাৎ প্রাচুর্য আর আনন্দের সন্ধান পেয়ে সনৎ পিছনের জীবনকে ভুলতে চায়। 

হয়তো এ তার দুর্বলতাই। কঠিন বাস্তব সত্যকে এড়িয়ে যেতে চায় মন। তবু জীবনের পথে ক্ষণিকের জন্যও ক্লান্তি আসে, চলতে চলতে থমকে দাঁড়ায় পথিক। 

সেদিন কলেজ স্ট্রিটেই দেখা হয়ে যায় সন্ধ্যাবেলা। কখানা পুরনো বই কিনছিল নীতা। মনের কোণে গোপন আশা জেগে ওঠে—শঙ্করের কথায় এগিয়ে গেছে। প্রাইভেটে এম. এ-টা দেবে। অনার্স পেপার ছিল—আরও কিছু পড়াশোনা করলে উতরে যাবে নীতা। ফুটপাথে বইওয়ালার সঙ্গে দরদস্তুর করে বইখানা তুলে নেয়। 

—তুমি? কার কথায় চমকে উঠল নীতা। 

সনৎ ফিরছে। বগলে একটা শাড়ির বাক্স, সিল্কের শাড়িই হবে বোধ হয়। বিখ্যাত সিল্ক ব্যবসায়ীর দোকানের নাম আঁটা ছবি রয়েছে তাতে। আবছা আলোয় নীতার দিকে তাকিয়ে থাকে সনৎ। 

নীতাও। 

একটি মুহূর্ত। ক-দিনেই নীতার কালো দেহটায় এসেছে ক্লান্তি আর হতাশায় ছায়া; চুলগুলো আলগা খোপার ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের উপর, সনৎ তাকিয়ে দেখে ওর হাতে জ্যাথারবেরির ইকনমিক্স 

বছরখানেক আগে নীতাই তাকে ওই বই কিনে দিয়েছিল দাসগুপ্ত কোম্পানির দোকান থেকে—ঝকঝকে নতুন বই। আজ তার নিজের দরকারের সনতের কাছে মুখ ফুটে চায় নি—বলে নি কোন কথা। নতুন বই কিনতে পারে নি, কোত্থেকে পুরনো বই কিনে নিয়ে চলেছে। তবু নীরব অবজ্ঞা ফুটে ওঠে নীতার চোখে। 

—দাম না হয় আমিই দিই, সনৎ বলে ওঠে। 

বাধা দেয় নীতা—না! 

সে-ই দাম মিটিয়ে দিয়ে চলেছে। সনৎ আছে সঙ্গে। নীতার সে দিকে খেয়ালই নেই। নিঃশেষে এড়িয়ে যেতে চায় আজ তাকে। 

—নীতা! অতীতের তীর হতে ডাকছে কোন সুদূরের পথিক। নীতা ক্ষণিকের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে। 

—আমার যে বলবার অনেক কিছুই ছিল। সনৎ বলে ওঠে নীতাকে ব্যাকুল কণ্ঠে। 

আজ তার অপরাধী মন নিজের ভুলের জন্য বোধ করে অপরিসীম লজ্জা। কলেজ স্কোয়ারের অপেক্ষাকৃত নির্জন একটু জায়গায় দাঁড়িয়েছে তারা। এর আগেও অনেক সন্ধ্যায় দুজনে এখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছে, অনাগত কোনো মধুর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। 

সনতের মনে সেই স্মৃতির অনুরণন। নীতা সে সব আগেই ভুলতে চেয়েছে। ওসব তার কাছে অর্থহীন অবান্তর। তাই উদাসীনের মত জবাব দেয় নীতা—নাই বা বললে। না শোনাই ভালো। 

—ভুল বুঝে যাবে আমায়? 

নীতা কথা বলল না, জনহীন মাঠটা—চারিপাশে থমথমে বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কলেজ স্কোয়ারের গা থেকে হকারদের গলা শোনা যায়, ভেসে আসে আলোর রেখা। 

নীতা সনতের দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে। হাসছে নীতা সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে। 

—ভাল যাহোক তুমি। সন্ধ্যাবেলায় এই নির্জনে ডেকে এনে ভালবাসার উপাখ্যান শোনাচ্ছ! মস্ত ভুল করেছিলেন সনৎ। ভালবাসা, ভুলে যাওয়া—এসব কথা শোনবার বয়স ঢের পিছনে নিছক ফেলে এসেছি। তুমি কি ভাবো যে আমি তোমায় ভালবেসেছিলাম?… ওটা একটা খেয়াল, ছেলেখেলাও বলতে পারো। 

সনৎ চমকে ওঠে। আগাগোড়াই যেন একটা ভুলের মধ্যে পাক খাচ্ছে সনৎ, কথাটা নীতার না গীতার পক্ষে প্রযোজ্য তা ঠিক বুঝতে পারে না। রহস্যময়ী ওই নারীর দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায় দৃষ্টিতে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে নীতা। 

—যাই চলি, টিউশানি আছে আবার! 

—নীতা?…নীতা যেন ওই হালকা হাসির আবরণে সবকিছুই ঢেকে ফেলতে চায়। এড়িয়ে যাচ্ছে সে। 

নীতা বলে ওঠে—দিনকতক একটু খেলেছিলাম তোমায় নিয়ে। 

—ঠকাবার জন্যই কি? সনৎ প্রশ্ন করে। 

হাসছে নীতা—বোধ হয়; আজকে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কবিতাটা শুনেছ সনৎ? 

প্রয়োজনে নেই কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, 
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়;
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। 

হঠাৎ কবিতা থামিয়ে নীতা বলে ওঠে স্থির কণ্ঠে—না, এরপর দেরি হলে ছাত্রীর দাদু কালই বিল্বপত্র শোঁকাবার ব্যবস্থা করবেন। অনেকগুলো টাকা মাসে—তা আর হারাতে চাই না! 

বের হয়ে গেল নীতা ছায়াঘন দেওদার গাছের নীচে দিয়ে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার জগতে—আকাশের বুকে ফুটে ওঠে ভীরু শঙ্কিত তারার চাহনি। 

ক্ষুণ্ণ অসহায়ের মত বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সনৎ। মনে মনে রাগই হয় আজ। নীতা তাকে অপমান করে গেল; নিষ্ঠুর খেলার জন্য সনৎই কষ্ট পায়। কই নীতার মনে তো বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে নি। সহজ সাবলীল গতিতে হাসে চলাফেরা করে; কাজও করে চলেছে। মনে হয় নীতার যোগ্য সে নয়। 

নীতা বোধ হয় তার চেয়ে অনেক উপরে! তাকে পাবার জন্য নিজেকেও তৈরি করতে হয়, দুস্তর পুরশ্চরণের প্রয়োজন। সে সাধনা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে সনৎ। 

.

বাড়িতে পা দিয়ে অবাক হয়ে যায় সনৎ। গীতা গুনগুন করে গান গাইছে। গাছকোমর করে ঘর গোছায়। রোজই আসে গীতা, নিজের ঘর-সংসার তার মনোমত করে সাজাতে চায় এখন থেকেই। 

সনৎকে দেখে এগিয়ে আসে। কাপড়টা সামলাতে সামলাতে বলে—এত দেরি? 

যেন এরই মধ্যে কৈফিয়ত চাইছে সে। 

সনৎ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দেহের দিকে তাকিয়ে আছে। নীতার বঞ্চনা আর তীব্র বিদ্রূপ মনে জ্বালা ধরিয়েছে, গীতা সেই জ্বালা স্নিগ্ধ করবার আমন্ত্রণ আনে। 

—কী হল? 

গীতা ওর পাশে এসে বসে একখানা হাতে তুলে নেয়। আপনমনেই বলে চলেছে গীতা— একটা ভাল দেখে রেডিও কিনতে হবে কিন্তু। জি.ই সি নয়তো এইচ, এম. ভি। 

—অনেক দাম যে। তা বাবা, মেয়েকে কিছু দেবেন তো? কি বল! 

হাসি ফুটে ওঠে সনতের গম্ভীর মুখে, হালকা হচ্ছে সে। গীতা হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে—বাবার থাকলে নিশ্চয়ই দিতেন। মায়ের হাতেও নেই। 

একটু দম নিয়ে কচি খুকির মত আবদারের সুরে বলে চলেছে গীতা—সংসারের টাকাকড়ি সব নীতার হাতে, হাড়কেপ্পন। যেমনি রূপ তেমনি গুণ। তা ছাড়া ওর বাইরের টানও আছে। কাকে যেন ভালবাসে, সাহায্যও করে বাপু মাসে মাসে। এই তো মাঝে মাঝে বাইরে কাকে টাকাকড়ি দেওয়া নিয়ে বেশ বচসা হয়ে যায় মায়ের সঙ্গে। কেন রে বাপু–একটা অমনি কিছু বারটান না থাকলে তোর এত টাকার দরকার কেন? ছি ছি! উপর উপর অমনি ঢলানি করার চেয়ে তাকে বিয়ে করলেই তো পারিস! 

সনৎ শিউরে ওঠে। সে জানে নীতা গড়ে তুলেছে নিজের পরিশ্রম দিয়ে, আজ নিঃশেষে সব অধিকার মুছে দিয়ে গেল। এই নিয়ে লাঞ্ছনা গঞ্জনা কুৎসিৎ ইঙ্গিতও সয়েছে বাড়িতে তবু তার কাছে কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলে নি; তবু টের পেয়েছে সনৎ, আজ আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারে বাড়িতে নীতার অবস্থা 

ঘৃণা নয়—ঘৃণা করতে পারে না নীতাকে। নীরব বেদনা জেগে ওঠে সারা মন জুড়ে। 

ওর বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিসের যেন সন্ধান করছে গীতা সনতের দৃষ্টিতে। গীতার মনে কী যেন সন্দেহের নিবিড় ছায়া। এককালে সনতের কাছে পড়ত নীতা, পীরগঞ্জে থাকতে দেখেছে দু’জনের মাঝে মধুর একটু সম্পর্ক! আজও তার বেশ মনে জাগে! 

গীতা বিদ্রূপের সুরে বলে ওঠে—ছাত্রীর কথা শুনে দুঃখ হল নাকি? 

সামলে নেয় সনৎ—না না! রেডিওর কথা ভাবছিলাম। 

ব্যাপারটাকে সহজ করে নেবার চেষ্টা করে। গীতা বলে ওঠে—কিনতে যদি হয় নিজেরাই কিনব। কারো দানের আশায় থাকব না। দাঁড়াও তো চা খাবার নিয়ে আসি। বসবার ঘরটা গুছিয়ে যেতে হবে আবার। 

সনৎ আবহাওয়াটাকে হালকা করবার চেষ্টা করে—বিয়ের আগে কেউ এসে নিজেদের ঘর গুছিয়ে যাচ্ছে। এমন কথা তো শুনি নি। 

গীতা কি ভেবে ফস করে বলে ওঠে—আর তোমার ছাত্রী যে বিয়ে না হলেও অন্য কোনো ছেলের পকেট খরচা জুটিয়ে যাচ্ছে এমন কথাও শুনি নি বাপু! কই তার নিন্দা তো করা হয় না মশাইয়ের। 

গীতা ইচ্ছা করেই নীতাকে আঘাত করছে বার বার। কোথাও ওর মনে সন্দেহের একটা কালো টুকরো মঘে ঘনিয়ে আসছে। সব বাধা জয় করে আজ বিজয়ী সে। মেয়েদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিটাকে চিনে ফেলেছে সনৎ। 

প্রথমে সনতের মনে ঝড় তোলবার জন্যই এগিয়ে এসেছিল সে। নিজেকে তুলে দিয়েছিল ওর হাতে নিঃশেষে। সনৎ তার হাতের মধ্যেই এগিয়ে এসেছে। তাই বোধহয় রহস্যময়ী নারী নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলে নিজের চারিপাশে একটা কঠোর কঠিন আবরণ রচনা করেছে পুরুষের মনে ঝড় তোলবার জন্যই। 

সনৎ দেখেছে পিছনের পরিচয় আজ অর্থহীন। নীতা তাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। আজ গীতাকে কেন্দ্র করেই সে নতুন জীবন গড়ে তুলতে চায়; বাঁচার স্বপ্ন দেখে যা পেয়েছে তাই নিয়েই। 

—গীতা! সনৎ এগিয়ে আসে। 

আবছা আলোয় গীতাকে মনে হয় কোনো রূপবতী কন্যা। সবুজের স্পর্শ মেশানো পাখি ডাকা দিগন্তসীমা; যার অসীমে নিজেকে অবাধে মুক্ত করে দিয়ে সব ভুলতে চায়—নিজেকে হারাতে চায় সে। 

হাতটা ছাড়াবার কৃত্রিম চেষ্টা করে গীতা—ছাড়ো, আর সোহাগ করতে হবে না। আমি তো বেহায়া। 

—বেহায়া! কই বললাম সে কথা? সনৎ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। 

গীতার রাগ তখনও পড়ে নি। বলে ওঠে—বা রে! ওই তো বললে বিয়ের আগে বউ এসেছে ঘর সাজাতে! 

—দূর! সনৎ প্রশ্নটা আপাতত চাপা দেবার চেষ্টা করে ওকে নিবিড় করে কাছে টেনে নিয়ে। গীতার খোঁপাটা খুলে গেছে। লাল টকটকে হয়ে উঠেছে মুখের বর্ণ। হাঁফাচ্ছে অসহ্য উত্তেজনায়–আঃ, ছাড়ো লক্ষ্মীটি! 

চোখের তারায় হাসির দীপ্তি! 

হঠাৎ চমকে ওঠে সনৎ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে—হ্যাঁ ঠিক একই! একই চাউনি—নীতা আর গীতার মধ্যে পার্থক্য অনেক। কিন্তু নিবিষ্ট মনে চাইলে দেখা যায় এক চোখ—এক চাউনি। হয়তো ভাষা আলাদা। বহু তারাজ্বালা সন্ধ্যায় সনৎ নীতার চোখে অমনি আমন্ত্ৰণ দেখেছে। 

কিন্তু আজ? 

আজকের সন্ধ্যায় হাসির সুর মন থেকে মুছে যায়নি। বহু চেষ্টা করেছে—বার বার। তবু ভুলতে পারেনি তাকে সনৎ। 

ভোলা যায় না। গীতা তার মনের এই ঝড়ের সংবাদ জানে না। 

.

ছোট বাড়িখানা ভরে উঠেছে লোকজনের কোলাহলে। বিক্রমপুরের মাসি, সোনারঙের কাকিমা, কাসুন্দির দিদিমা, লতাপাতায় জড়ানো অনেক সম্বন্ধের আত্মীয়বর্গ এসে পড়েছে। বাড়ি ভর্তি হয়ে উঠেছে ওদের কলরবে। 

মাধববাবুও জানতেন না যে তাঁর সামনে পিছনে এত স্বজন আছে; কিন্তু দেখে শুনে ভরসা পাবার চেয়ে ভয়ই পেয়েছেন বেশি। কিন্তু তার কথা বলার উপায় নেই। 

কাদম্বিনী বলে—একটি মাত্র শুভকাজে আত্মীয়দের খোঁজ নোব না? 

—কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে, মাধবাবু আমতা আমতা করেন। 

তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে পীরগঞ্জের প্রাচুর্যের ছবি। শঙ্করের অন্নপ্রাশনের সময় দেশ জুড়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। সেদিন সামর্থ ছিল—আজ, ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। তাই ভয় পেয়েছেন। 

কাদম্বিনী স্বামীর কথায় একটু উষ্ণস্বরেই জবাব দেয়—তাই বলে গুটিয়ে বসে থাকব? বিয়ে বলে কথা, শুভকাজে পাঁচজনকে ডাকব না? 

এরপর মাধববাবু আর কথা বলেননি। চুপ করে বসে থাকেন বাইরের ঘরে। বাড়ির ভিতরে হাসির ধুম পড়ে, কারণে-অকারণে, গায়ে হলুদের সময় জোকারের শব্দ ওঠে; আর সব ছাপিয়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের কান্না আর মায়েদের নির্মম পিটুনির শব্দ। 

—মরবার পারস না? অকে ধরতি কইলাম না, অ বাসন্তী? 

নীতা এই আনন্দের মাঝে নিজের কর্তব্য স্থির করে নিয়েছে। মনের গভীর দুঃখকে হাসি দিয়ে ঢেকে রাখতে চায়। সনতের সঙ্গে সব সম্বন্ধ সে সেদিন বিকালেই চুকিয়ে দিয়ে এসেছে। এরপর যা অতীত তা নিয়ে কোন কথাই আর ভাববে না সে। সব ভাবনার শেষ পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বুক বেঁধেছে আবার নীতা মনের সেই জোরেই। 

বাড়িতে পা দিয়ে বাবাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়। বৃদ্ধ স্থবির লোকটিকে এক নজর দেখেই কেমন যেন বেদনা ছেয়ে ওঠে ওর সারা মনে। একা বসে আছেন মাধববাবু। চেহারা ক-মাসেই বদলে গেছে, মাথায় একগাছি চুলও কালো নেই, চোখের কোলে গভীর কালো দাগ। কেউ তাঁর দিকে আসেনি, খোঁজ খবরও নেয়নি। নীতা এগিয়ে যায়! 

—বাবা? 

অসহায় দৃষ্টি মেলে চাইলেন মাধববাবু। শিশুর মত বলে ওঠেন—এক কাপ চা দিবি নীতা, ওরা বোধ হয় ভুলে গেছে আমার কথা। 

নীতা ঘরের ভিতর থেকে ওদের কলরব শুনতে পায়, আনন্দের উচ্ছল ভোজে ওই লোকটির কোনো আমন্ত্রণ নেই। একটু রাগও হয়—দুঃখও আসে। নিজের তুচ্ছ চাওয়া-পাওয়ার কথা ভুলে যায় ওকে দেখে। বলে ওঠে—এখুনি আনছি বাবা! 

—হ্যাঁরে! 

নীতা দাঁড়াল বাবার ডাক শুনে, কী যেন জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে ইতস্তত করছেন তিনি। বলে ওঠেন—তোকে সনৎ কিছু বলেছিল! আর পড়াশোনা করবে? না- 

নীতা জবাব দেয়—কই, দেখা করতে পারি নি। 

মিথ্যা কথাই বললো বাবাকে সে। একটা স্তব্ধ গুমোট আবহাওয়া যেন দম বন্ধ করে আনছে। হালকা হতে চায় সে। 

বাবার সামনে থেকে সরে এল, ওর দৃষ্টির সামনে এখুনি নীতার সব দুর্বলতা ধরা পড়ে যাবে সেই ভয়ে। 

বাড়ির ভিতরে সরে এসে ওদের ভিড়ে মিশে যায় সে। 

মন থেকে সব কিছু ঝেড়ে নিশ্চিন্ত হতে চায় নীতা। বাড়িতে পা দিয়ে হইচই করে ওঠে সে—কে কে চা খাবে-এ-এ? 

কাদম্বিনী মেয়েকে এই পরিবেশেও হালকা হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। বিয়েবাড়ির সব আয়োজন, সব কাজের ভার নীতাই তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। বাড়িময় হস্তদন্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। 

—অ্যাই মন্টু, বাড়তি গোড়ের মালা গাছি কয়েক আনবি? 

—কেন? মন্টু প্রশ্ন করে। 

—গীতার বন্ধুদের দিতে হবে। তা ছাড়া বাসরঘর সাজাতে হবে না? কি হাবা রে তুই। তা জানবিই বা কি করে বল? হ্যাঁ, নিয়ে আসবি কিন্তু! 

কেমন সহজ সাবলীল করে তোলে পরিবেশ—তার হাসি চিৎকার আর কর্মব্যস্ততা দিয়ে!

বিক্রমপুরের মাসি আড়ালে বলেন— মেয়ের যেন নিজেরই বিয়ে লেগেছে। 

এদিকে ওদিকে তাকিয়ে সোনারঙের পিসি ফোড়ন কাটে—তার লাগবো না। বাজারে এতো গরুর দুধ মিলবো, তো গরু পোষবার ঝামেলা ক্যান সইবো কও। তাই এত খুশি বোঝ না? আজকালকার মাইয়া! 

· 

শুধু একজনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না নীতা। 

সে শঙ্কর। বাড়ির হইচই এর বাইরে রয়েছে সে। দিনরাত এই চিৎকারে হাঁপিয়ে উঠেছে। অসহ্য হয়ে উঠেছে এই পরিবেশ। জানালার বাইরে সবুজ ঘন দিগন্তসীমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে শঙ্কর, হঠাৎ নীতার কথায় ফিরে চাইল। 

দিন শেষ হয়ে আসছে। রাস্তায় দেখা যায় আশপাশের বাড়িতে আলো, আকাশে সন্ধ্যাদীপ জ্বালে তারার দল। পাখি ডেকে ফিরে গেল দিনের সঙ্গীকে। 

শঙ্কর অনেক ভেবেছে, ভেবে এ-ছাড়া পথ নায়নি। এই স্বার্থপর পরিবেশ তার দম বন্ধ করে এনেছে, চোখের সামনে দেখেছে নীতার জীবনে এই নিদারুণ যন্ত্রণা। তবু অবাক হয় ওর সহ্যশক্তিতে। 

নীতা ঢুকেছে ঘরে, হ্যারিকেনটা ওদিকে রেখে এগিয়ে এসে চৌকিতে বসে কথাটা বলে নীতা—গান দু’খানা একটু তুলে দে না বড়দা, আগে গাইতিস তো তুই রবীন্দ্রসঙ্গীত। 

—গান! তুই গাইবি! অবিশ্বাস ফুটে ওঠে ওর দু’চোখের চাহনিতে। 

নীতা বুঝতে পেরেছে। বলে—বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? 

হাসছে নীতা। একটু ম্লান আলোর আভা পড়ছে ওর মুখে, চুলের উপর। সহজ সুরে বলে নীতা-বাঃ রে দোষ কি? 

শঙ্করের কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালির মত বোধ হয়, প্রশ্ন করে—গান গাইবার মত মত এত খুশি হলি কিসে? 

এই বিয়ের বাসরে নীতা গাইবে—এ যেন স্বপ্ন দেখেছে সে। নীতাকে চেনে—তবুও মনে হয়, কোথায় এক জাগয়ায় ও যেন অচেনা রহস্যময়ী। 

নীতাই বলে ওঠে—কেন, আগে গাইতাম না? প্রাইজও পেয়েছিলাম। তারপর না হয় কাজকর্ম আর পড়ার চাপে ও কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। তবু তালিম নিলে এখনও হবে—বুঝলি! সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা তুলে দে না। জানিস তুই। 

শঙ্কর কি ভেবে বলে ওঠে—দোব, কিন্তু একটি শর্তে! 

—কী! প্রশ্ন করে নীতা। 

শঙ্কর মন স্থির করে ফেলেছে। 

—আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব নীতা। এত বড় অন্যায়টা তুই মেনে নিতে পারিস, আমি সহ্য করব না। এ বাড়ির আমি তো ফালতু—এলে গেলেও কেউ টের পাবে না। তবু আমি এর প্রতিবাদ জানিয়ে গেলাম। 

চুপ করে যায় নীতা। মুখের হাসির আভা মিলিয়ে গেছে। অন্তত একটি লোকের সামনে এসে সে দাঁড়িয়েছে যার সাধনা শুদ্ধ চিত্তের সামনে ফাঁকি দেবার সামর্থ তার নেই। 

কি ভেবে নীতা বেদনাহত কণ্ঠে বলে ওঠে এ ছাড়া আর পথ কি বল? মুখ ভার করে থাকলে লোকের মনে অহেতুক প্রশ্ন উঠবে। তাই। 

শঙ্কর বলে ওঠে—ঠিক তা নয় নীতা। দুঃখকে ভয় করিস বলেই এতটুকু আনন্দকে কাঙালের মতো আঁকড়ে ধরে তার হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে চার্স। কিন্তু দুঃখকে জয় করবার এ পথ নয় রে! নিজের কাছে পদে পদে যে হার মানবি—দুঃখ তাতে বাড়বে বই কমবে না। 

রাতের শনশন বাতাসে কাঁদছে ধরিত্রী, তারায় তারায় সেই বেদনার প্রতিধ্বনি। পৃথিবী কাঁদে বুকজোড়া দুঃখে। 

নীতা হালকা হবার চেষ্টা করে– ধ্যাৎ, তোর যত সব বাজে কথা। 

শঙ্কর তানপুরায় সুর তুলে গলা মেলায়- 

যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে। 
জানি নাইতো তুমি এলে আমার ঘরে। 

—দুঃখের মধ্যে যে মঙ্গল আসে—সেই প্রকৃত আশীর্বাদ নীতা। তারই মাঝে পাবি সান্ত্বনা—পথ খুঁজে পাবি মুক্তির। দুঃখকে এড়িয়ে নয়—তাকে জয় করেই খুঁজে নিতে হবে সেই পথ। 

অনুভব করে নীতার দু’চোখ দিয়ে নেমেছে তার বাঁধনহারা অশ্রু। টপটপ অশ্রু ঝরে হাতের ওপর। বাধা দেয় না। সুরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে করুণ মূর্ছনায়— 

অন্ধকারে রইনু পড়ে—স্বপন মানি। 
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তা কি জানি। 
সকাল বেলায় তাকিয়ে দেখি—দাঁড়িয়ে আছ তুমি একি!
ঘরভরা মোর শূন্যতারই বুকের পরে। 

সুরটা থেমে গেছে। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে শঙ্কর। 

নীতার কান্নায় বাধা দেয় না সে। চোখের জলে ওর বুকের ব্যথা কমুক। শান্তি পাক সে।

নীতা যেন স্বপ্ন দেখছে—আকাশছোঁয়া সেই পর্বতসীমা। দূরে মেঘ রোদ ছায়া—পাইনের সবুজ বনে ঝড় উঠেছে—আকাশমাতানো ঝড়; তারই মাঝে কি যেন একটা সুর এগিয়ে আসে। সারা দেহে জাগে রোমাঞ্চ, প্রতি লোপকূপ সজাগ হয়ে ওঠে। 

সুরটা আবার সরে গেল দূরে, তার পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল সেই ঝড়ের তাণ্ডব।..স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে একা। 

শঙ্কর কখন বের হয়ে গেছে খেয়াল করেনি! ঝড়! কোথায় ঝড়! 

আকাশে কোথাও এতটুকু মেঘ নেই, ঝড়ের এতটুকু চিহ্ন নেই। চাঁদ উঠেছে। নীতা কি যেন স্বপ্ন দেখছিল। কোন নিভৃত সত্তা মাঝে যেন জেগে ওঠে দুর্বার অদম্য আগ্রহে—বিরাটকে ধরতে চায় সে। অসীমকে স্পর্শ করতে চায় দেহ-মন দিয়ে।…এই অনুভূতিটা মাঝে মাঝে কেমন যেন পাগল করে দেয় নীতার সারা মন। 

শাঁখ বাজছে—উলুধ্বনি ওঠে। ছেলেমেয়েদের ছুটোছুটি পড়ে যায়। বর এসেছে—বর। কাদম্বিনী পুরনো জবড়জং একখানা বেনারসী শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে—খই ছিটোতে হয় রে। খইগুলো কোথায়? 

—সাবধানে নামাবি গাড়ি থেকে। 

চারিপাশে ভিড় জমে যায়; কলরব কোলাহল উঠেছে। মাধববাবু বাইরে ঘরে নিরাসক্তের মত বসে আছেন—পরনে ধোপদুরস্ত পোশাক। কোনোদিকেই খেয়াল নেই তাঁর! 

পাড়ার ছেলেরা সবাই এসেছে, তারাই তদারক করছে সব কিছু। এসব ব্যাপারে নিষ্কর্মা ছেলের দল একটা করণীয় মহৎ কার্য পেয়ে মেতে ওঠে। গুপি মিত্তির ব্যস্তসমস্ত হয়ে তদারক করছে। হাতে ক্যাপস্টানের টিন, পরনে ছক্করবক্কর-মার্কা জামা। চিৎকার করে— 

—ভিয়েনের ওখান থেকে সব জিনিস আইটেম বাই আইটেম আসবে। 

দলবলকে ডিরেকশন দিচ্ছে সে নাটকীয় ভঙ্গিতে। ট্যাক্সি থেকে বর নামাতে এসেছে নীতা; বর আসনে গিয়ে বসতেই ট্যাক্সিওয়ালার আর দাম কি। সে যেন নেহাৎ অবাঞ্ছিত এখানে।

নীতা ফিরে আসছে বাড়ির দিকে। হঠাৎ কার ডাক শুনে দাঁড়াল। ট্যাক্সিওয়ালা আর কেউ নয়। পরেশ। অবাক হয়ে যায় নীতা। 

— তুমি? 

পরেশকে চেনা যায় না। সেই ট্রেনের ফেরিওয়ালার পোশাক নেই। পরনে খাকি প্যান্ট আর হাফ শার্ট। বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে চেহারা। বেশ অবাক হয়েছে সে। নীতাকেই আজ অন্য পোশাকে দেখবার কল্পনা করেছিল সে। কিন্তু সেটা না হতে পরেশ বেশ চমকে উঠেছে। 

পরেশ বলে ওঠে—তা, সনৎবাবুর বিয়ে! গীতার সঙ্গে! 

হাসে নীতা—কেন এখনও সন্দেহ হচ্ছে নাকি? তা তুমি ফেরিওয়ালাগিরি থেকে ড্রাইভারিতে পেশা বদল করতে পারো—কনে বদলই বা হবে না কেন, বল? 

কথা বলল না পরেশ। এই পেশা বদলের পিছনে দীর্ঘ ইতিহাস আর পরিশ্রম জমা হয়ে আছে। কত কষ্টে সে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে। 

কিন্তু যাদের সুখ দেখলে আনন্দ হয়—আশেপাশে তাদের অধিকাংশকেই দেখেছে কষ্ট পেতে, তেমন ধাপে ধাপে নেমে চলেছে তারা। নীতাকে এভাবে দেখবে আজ কল্পনা করে নি সে। সামলে নেয়! একটু ক্ষুব্ধস্বর ফুটে ওঠে তবু ওর গলায়—না, এমনিই বলছিলাম। 

ওদিকে বিয়ের কাজ শুরু হয়েছে। নীতা বলে ওঠে—এসে পড়েছ যখন না খেয়ে যাবে না। এসো। 

পরেশ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে; বেশ একটু দৃঢ়স্বরেই বলে ওঠে—না; ও বিয়ে দেখার অভ্যাস নেই। বাহক আমরা, আমাদের শুধু বয়ে দেওয়াই কাজ। আচ্ছা চলি। ড্রাইভার মানুষ, ওসব শখটখের দরকার নেই। 

পরেশ এড়িয়ে গেল! নীতা চুপ করে কি ভাবেছে। 

ভীরু ছেলেটি, ট্রেনে ফিরি করত। ক্রমশ কঠিন নগ্ন জীবনের সংস্পর্শে এসে সেও ঋজু কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখে মুখ ওর বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর সংগ্রামের ছাপ। 

সনতের সঙ্গে কোথায় পরেশের একটা বেশ পার্থক্য আছে। 

সনৎ দুখঃকষ্টকে ভয় করে—ক্লান্ত হয়ে আজ একটা আপোস রফা করতে চলেছে। ভীরু সে। পরেশ তার ঠিক বিপরীত। দুঃখ কষ্ট অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে জয় করতে চলেছে জীবনকে। 

ফেরিওয়ালা পরেশ। হাতকাটা তেল, আশ্চর্য মলমের ফেরিওয়ালা। সেও তো এ জীবনে পিছিয়ে যায় নি। হার মানেনি। 

কোথায় যেন একটা আশার আলো সেও দেখে। জীবন তত কঠোর বা কঠিন নয়; তাকে জয় করার সাধনায় সার্থকতা আছে—আছে নিবিড় আনন্দের সুর। 

নীতা আনমনে কথাটা ভাবছে, ওদিকে উলুধ্বনি শাঁখের শব্দ ওঠে। এগিয়ে যায় ভিতরে। কি সব ভাবছিল অকারণে সে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *