মেঘে ঢাকা তারা – ৩

মাধববাবুর সংসার কদিনেই শ্রী-হীন হয়ে গেছে। পঙ্গু বৃদ্ধ, ঝড়ে ভাঙা শুকনো বটগাছের মতো কাণ্ডসার হয়ে কোনো রকম জীবস্মৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। 

আগে বাইরের ঘরখানায় ছাত্র ধরত না—এখন দু-একজন মাত্র টিকে আছে। টিউশানি করে বেশই রোজগার হতো, এখন ছাত্ররাও চালাক হয়ে গেছে। নবীন মুদির ছেলে আজ টাকা ক-টা দিয়ে বলে গেল—কাল থেকে আর আসব না মাস্টারমশাই। 

—অ্যাঁ! মাধববাবু ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। অক্ষম-পা-খানাকে টেনে সোজা করবার চেষ্টা করেন। 

নবীন ব্যবসাদার লোক, তাক বুঝে পয়সা ছাড়ে। প্রথমত স্কুলে থেকে ছেড়ে এসেছেন মাধববাবু, অন্যান্য স্কুলের মাস্টাররা ছাত্রদের পরীক্ষার আগে ইমপর্ট্যান্ট কোশ্চেন বলে দেন এবং সেগুলি পরীক্ষা পাশের বীজমন্ত্র। প্রত্যেক মাস্টার কোশ্চেন করবার সময় সহকর্মীদের বলে দেন, ইংরাজি মাস্টার বলেন অঙ্ক টিচারকে, অঙ্ক টিচারও সাজেশন দেন ইংরাজির মাস্টারকে। তাছাড়া ছেলে পাশ করুক ফেল করুক, ক্লাস টেন অবধি গড়িয়ে উঠবেই তাঁদের হেপাজতে থাকলে। নবীনপুত্র ওটা বেশ বুঝেছে। 

তাই বলে ওঠে—হেড পণ্ডিতমশায় বলছিলেন… 

মাধবমাস্টারও ভিতরের এই চক্রান্তের ব্যাপারে জানতেন। আজ অসহায় বৃদ্ধের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার জন্য ওরা উঠে পড়ে লেগেছে। চুপ করে থেকে সম্মতি দেন—বেশ তো। যাও। নবীনপুত্র চলে গেল। একা বসে আছেন মাধববাবু, জীর্ণ-স্থবির দেহ, মনটা তাই চঞ্চল হয়ে ওঠে অকারণে। চোখের সামনে দেখেছেন সমাজের ছবি। 

পীরগঞ্জের সেই শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা কোথায় হারিয়ে গেছে, মুছে গেছে সেই প্রীতি ভালোবাসার চিহ্ন, শুধুমাত্র দুমুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সমস্যাই আজ মনের সব কমনীয়তা, শুচিতাকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন। 

নীতার রোজগারেই সংসার চলছে। অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করেও এম-এ ক্লাসে পৌঁছতে পারেনি। চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছে। চাকরি আর টিউশানি। মাধববাবু দেশের ছেলেকে মানুষ করেছেন; তাঁর মেয়ে এম-এ পাশ করবে—ডক্টরেট হবে এ আশাও আকাশকুসুম রয়ে গেল। একটা আশ্রয়, একটু নির্ভরও জোটেনি তার, শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে সামান্য কেরানিগিরি করেই দিন কাটাচ্ছে। বুক দীর্ণ করে দীর্ঘশ্বাস বের হয় বৃদ্ধের। 

কোণ থেকে হাতড়ে ছড়িটা নিয়ে ভর দিয়ে কোনো রকমে বাইরের দাওয়াতে এসে বসবার চেষ্টা করেন। ঘরে মাঝে বদ্ধ হাওয়া আর সন্ধ্যার আগত অন্ধকার; রুদ্ধজীবনের পথেও সব আলো তাঁর নিভে গেছে অমনি। 

সামনে সাপ দেখলেও হঠাৎ সনৎ অমনি চমকে উঠত না। 

অতীতের বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহী তেজস্বী লোকটি আজ বৃদ্ধ-পঙ্গু-অসহায়। জীর্ণ দেহের বোঝা টেনে বাইরে বসবার চেষ্টা করছেন। হাড়গুলো ঠেলে উঠেছে, কোটরাগত চোখ থেকে বের হয় নীলাভ ছলছল চাহনি! 

—মাস্টারমশাই! শিউরে ওঠে সনৎ। 

কোনোরকমে পঙ্গুদেহখানাকে টেনেটুনে ভাঙা চেয়ারখানায় বসে হাসলেন মাধববাবু। সনৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। সংসারে অবস্থাও কিছুটা অনুমান করে নেয়। মাধববাবুর এই দুর্ঘটনার জন্য নীতার অবস্থা সে বেশ অনুমান করতে পারে। তাকে চাপ দিতে পারে না, তার বিবেকে বাধে। অন্যদিকে মেসের অবস্থা মনে পড়ে, শীতল নায়েকের চিমটিকাটা কথা, মেম্বারদের নীরব হাসির কথা স্মরণ হতেই শিউরে ওঠে সে। সামনে তার কঠিন সমস্যা। 

মাধববাবু হাসছেন—এতদিন খাটুনির পর, শরীরটা যদি বিদ্রোহ ঘোষণা করে, প্রতিবাদ করবার কিছুই নেই। তবে দুঃখ হয় নীতার জন্য। খেটে খেটে গেল মেয়েটা। 

সনতের মন সমবেদনায় ভরে ওঠে। সে যেমন করেই হোক নীতাকে রাজি করাবে। নীতাকে নিষ্কৃতি দেবে এই কঠিন বন্ধন থেকে। ঘর বাঁধবে তারা। 

সনৎ পথ ঠিক করে নেয়, শান্তির পথ; সামান্য নিয়েই তৃপ্ত হবার চেষ্টা করবে সে। বলে ওঠে—একটা ভালো চাকরি পাচ্ছি, ভাবছিলাম— 

মাধববাবুকে কথাটা বলতে গিয়ে ইতস্তত করে সনৎ। মাধববাবুর মুখ-চোখে একটা অসহায় ভাব, হতাশা ফুটে ওঠে—নিবিড় হতাশা। বিড়বিড় করছেন মাধববাবু – চাকরি! ভালো চাকরি!

ওরা জীবনকে দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচাই করে নিতে চায় না। নিশ্চিন্ত আরামে বাঁচবার জন্য কাঙাল। তাই দুঃখ ওদের পরাজিত বিপর্যস্ত করেছে পদে পদে। 

বুকভরা আশা নয়—আশাহীন ব্যর্থতার পুঞ্জীভূত কালো ছায়া দু’চোখের চাহনিতে। দিন বদলেছে—বদলেছে জীবনদর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি। 

মাধবমাস্টার কাদম্বিনীকে আসতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন। কাদম্বিনীর দু’চোখে হাসির আভা। কথাটা ঘরের ভিতর থেকে শুনে এগিয়ে এসেছে কাদম্বিনী। বলে ওঠে—বেশ, খুব খুশি হলাম বাবা। এই তো চাই, লেখাপড়া শেখো, চাকরি করো, ঘরসংসার পাতো, আমাদের দেখেই আনন্দ। ওরে ও গীতু! 

গীতা মাথায় একরাশ চুল খুলে বিনুনি বাঁধছিল, গায়ের কাপড়চোপড়ও ঠিক নেই, মায়ের ডাকে দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। এভাবে আদুর গায়ে সে সনতের সামনে বের হয়ে লজ্জাবোধ করে। লাল হয়ে যায় কপোল, আয়ত দু’চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে কি এক রঙিন আবেশের গাঢ়-ছায়া। 

সনৎ পড়ন্ত বেলার আলো-আঁধারিতে ওকে দেখে চমকে ওঠে। সরে গেল গীতা! দু’চোখে কি যেন একটু মধুর লজ্জাজড়ানো আবেশ। 

কাদম্বিনী হাসছে— বড় লজ্জা ওর। চলো বাবা, ভেতরে চলো। তাহলে চাকরিতে জয়েন করছ করে? কি রকম মাইনে? 

মাধববাবু সনতের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কাদম্বিনী যেন তার কাছ থেকে সনতকে সরিয়ে নিয়ে গেল জোর করেই। 

মাধববাবুর মনে হয় যেন জোরে চিৎকার করে উঠবেন। ওদের সকলের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিবাদের চিৎকার। কিন্তু অসহায় একটি মানুষ, তার কণ্ঠস্বরও যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে। নির্বাক স্তব্ধ মানুষটি শুধু তাকিয়ে থাকে। 

সনৎ চায়ে চুমুক দিচ্ছে। গীতার ডাকে চমক ভাঙে— কী এত ভাবছেন? 

সনৎ ওর দিকে তাকাল, গীতা হারমোনিয়মটা নামাচ্ছে। কাদম্বিনী বলে ওঠে—গান আর গান। দিনরাত ওই নিয়েই পড়া কামাই করে বাবা। তবে হ্যাঁ, গায় ভালোই! ওই দেখ না আমাদের ধর্মের ষাঁড়টি—কি যে দিনরাত হাঁ-হাঁ করে। উঃ, হাড়মাস খেলে বাবা। 

শঙ্করের কথা বলে কাদম্বিনী বিরক্তভাবে। 

সনতের কানে অর্ধেক কথা ঢোকে না। কী ভাবছে সে। 

গীতাকে ঘিরে একটা তৃপ্তির জগৎ—শান্তির সন্ধান। নীতা ঠিক তার বিপরীত। কঠিন সংগ্রামমুখর জীবনের একটা বাহ্যিক রূপ মাত্র। অন্তরের সন্ধান যার পাওয়া যায় না—কঠিন চাপে সব রূপ-রস শুকিয়ে গেছে নিঃশেষে। গীতা তার তুলনায় অফুরান প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর 

রাত নেমে আসে। সনৎ মাধববাবুর সামনে যেতে কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করে। কাদম্বিনীই বলে। যা না গীতা, স্টেশনের দিকে সোজা পথটা দেখিয়ে আয় সনৎকে। 

গীতা একপায়ে খাড়া—জুতোটা পরে নিই।

.

বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে আকাশে বাতাসে। ঘাসবনে ওড়ে গঙ্গাফড়িং, জোনাকজ্বলা অন্ধকার; আমের বোলের মিষ্টি গন্ধে-ভরা বাতাস স্বপ্ন আনে। আঁধারের পরশে গীতা বদলে যায়—সম্পূৰ্ণ অন্য সত্তা। সনতের সঙ্গে আজ এই পরিবেশে বের হয়ে সে খুশিই হয়েছে। 

বসতি পেরিয়ে একটা ছোট মাঠ—নির্জন, চাঁদের আলোঢালা গাছগাছালি। গুন গুন করে গাইছে গীতা। 

সনৎ এমন মধুর জগতের সন্ধান জীবনে পায়নি। 

কঠোর কর্মমুখর জীবনের ফাঁকেও এমনি অমৃতসঞ্চয় আছে জানত না—বাঁচবার নেশা আজ মধুর আবেশ আনে তার মনে। 

নীতা অফিস থেকে বের হয়ে টিউশানি সেরে রাত্রির ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহটাকে টেনে আনে কোনমতে। স্যান্ডেলটাও ততোধিক জীর্ণ। কোনোমতে ওই জীর্ণ দেহটাকে টেনে চলেছে সেও। ইস্টিশান থেকে বের হয়ে আসছে বাড়ির দিকে, মাঠের মধ্য থেকে গীতার সুরটা উঠছে। একবার থমকে দাঁড়াল নীতা। কি ভাবে ওদিকে না গিয়ে বাড়ির দিকেই এগোয় আনমনে। 

নীতা বাড়িতে ঢুকে দেখে মাধববাবু চুপ করে অন্ধকারেই বসে আছেন। বাড়তি হ্যারিকেন ও নেই তাঁর ঘরে একটা জ্বলবে, কেরোসিন তেল কেনার পয়সা তো পরের কথা 

মাধববাবু সংসারের খাতে আজ যেন একটা বাজে খরচ। 

—বাবা! 

নীতা ডিম লাইটটা জ্বেলে আনে—এটা কিনে আনলাম বাবা, বেশ লেখাপড়া চলবে এতে।

মাধববাবুর মুখে একটু হাসির আভা—হ্যাঁ মা। 

কাদম্বিনীও এসে ঢুকেছে। কথাটা বলে নীতা—বাবার জন্য একপোয়া করে দুধ আর ওষুধ-পত্ৰ— 

কাদম্বিনী ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না, নীতা অকারণেই খুশিতে উপচে পড়ে। গলগল করে বকে চলেছে—বুঝলে বাবা, পুজোর ছুটিতে বোনাস পেলে তোমাকে নিয়ে দার্জিলিং যাব, পাহাড়ের দেশে। সেরে উঠবে। নোট-বইগুলো ছাপবার ব্যবস্থা করবো এইবার। 

—কিরে? মাধববাবু খুশি হতে পারেনি। 

নীতা বলে ওঠে—মন্টুর চাকরি রয়েছে। একশো টাকা মাইনে। সত্তর টাকা দিল। এই নাও।

কাদম্বিনী অবাক হয়ে যায়, খুশিভরা কণ্ঠে টাকাটা নিয়ে কপালে ছোঁয়ায়। 

—মা কালীর মানসিক শোধ করতে হবে বাছা। 

মাধববাবু প্রশ্ন করেন—কি চাকরি? 

—খেলার জন্য গ্যালি কোম্পানির কারখানায় চাকরি পেয়েছে। 

মাধববাবু ওর দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন—কারখানায়? লেবার? 

নীতা বলে ওঠে—তাতে কি বাবা? আজকাল এ কাজেও উন্নতি আছে। কেরানিগিরি মাস্টারি এসবের থেকে– 

হঠাৎ বাবার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল নীতা, দাঁড়াতে গিয়ে বাবার হাত থেকে ছড়িটা পড়ে গেছে। অসহায় বৃদ্ধ দরজাটা চেপে ধরে পঙ্গুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন। 

নিদারুণ আঘাতে শিউরে উঠেছেন বৃদ্ধ। ছেলে আজ কারখানার দিনমজুর মাত্র। সামান্য লেবার, মেয়েকে আজ পাত্রস্থ করতে পারেননি, তারই হাড়ভাঙা ব্যর্থ জীবনের পরিশ্রমের অন্নে তাঁর মুখে গ্রাস ওঠে। এই কথাগুলো যেন তাঁর সারা দেহমনের চাবুকের মতো তীব্র বেগে কেটে বসেছে। 

—বাবা! নীতা বাবাকে ধরে ফেলে। 

সামলে নেন মাধববাবু। মুখে সেই মলিন হাসি। বলে ওঠেন—হয়তো তাই সত্যি নীতা দিন বদলেছে। সনৎও তাই বলছিল। সেও নাকি পড়াশোনা আর করবে না, চাকরি নেবে কোনখানে। বোধহয় তাই-ই ভালো, আলেয়ার পিছনে দৌড়ে লাভ কি বল? ভালোই করেছে ওরা, জীবনে দুমুঠো শুধু খেয়ে চোখ-বুজে বেঁচে থাকার মতে সায় দিয়ে। এ ছাড়া পথ কি বল? 

নীতা স্তব্ধ দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত খুশি-আনন্দ এক নিমেষেই মুছে যায় তার মন থেকে এই কথাটা শুনে। 

সনৎ চাকরি নিচ্ছে—কেরানিগিরি! তার উপর অনেক আশা ছিল নীতার। কথাটা ঠিক যেন বিশ্বাসই করতে পারে না সে। 

কাদম্বিনী স্বপ্ন দেখছে। মন্টুর চাকরি হয়েছে—সনতেরও। গীতার দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে সে।

নীতা চুপ করে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

কাদম্বিনীর ওদিকে দেখবার সময় নেই, মাধববাবু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে কোথায় একটা বেসুরো বাজে সারা মনে। কাদম্বিনী স্বামীর ডাকে ফিরে তাকাল। মাধববাবু প্রশ্ন করেন—সনৎকে তুমি কথাটা বলেছ? 

কাদম্বিনী দেখেছে গীতার সঙ্গে ওর কথাবার্তা, ব্যবহার। সনতের চোখমুখের পরিবর্তন। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। 

বলে ওঠে কাদম্বিনী – হ্যাঁ গো হ্যাঁ! 

—অ। 

মাধববাবু একটু অবাক হন। এতদিন ওদের দুজনকেই মিশতে দেখেছেন—নীতা আর সনৎ। হঠাৎ কেমন যেন সনতের এই পরিবর্তন তাঁর চোখেও ভালো ঠেকে না। সবকিছু বদলাচ্ছে। মানুষের মনও। নইলে কাঞ্চন ফেলে কাঁচ কুড়োবার এত ধুমধাম চলবে কেন চারিদিকে! 

সনতও চাকরির নিশ্চিন্ততা খুঁজতে চলেছে। জীবনকে এড়িয়ে যেতে চায় সে। 

রাতের অন্ধকার নেমে আসে। জোনাকজ্বলা রাত্রি। সান্ত্বনাবিহীন এই নির্জনতা নীতার মনে নীরবে বেদনা এনেছে। 

নীতাও পড়ে আছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সে। সনতের খবরটা বিশ্বাস করতে পারে না। তবু মনে হয় সত্যিই হতে পারে। তার সব স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে গেল। হাজারো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল সনৎ; সাধারণ—অতিসাধারণ একটি মানুষ। একক—নিঃসঙ্গ ঋজু ব্যক্তিটির জাগর অস্তিত্ব তার মন থেকে মুছে গেল। 

এ যেন তার নিজেরই পরাজয়। 

সুরটা শোনা যায়। নিঃসঙ্গ একটা পাখি অন্ধকারে ডানা ঝাপটে ঘুরে মরছে বাসার সন্ধানে। অসীম গহনা আঁধারে কোথায় হারিয়ে ফেলেছে তার বাসার ঠিকানা। 

শঙ্কর তবু বদলায়নি। বাড়ির পরিবেশ বদলেছে; সে থাকে, বাইরে একটা চালায়। চারিপাশে কলাগাছ চালকুমড়ো আর রাংচিত্তিরের ঘনসবুজ আবেষ্টনী; সরু পথটা দুর্বাদলে ঢাকা। নিজের চারিদিকে এমনি অগোছালো সবুজ বেষ্টনী দিয়ে সমাজ, জগৎ থেকে পৃথক হয়ে রয়েছে। কিছুদিন থেকে দেখছে সংসারের অবস্থা। নীতার কাছে বিশেষ কিছু চাইতে পারেনি। আর বুঝেছে সে, গান ছাড়া তার আর কোনো পথ খোলা নেই; তাই তন্ময় হয়ে পড়েছে সে সাধনা নিয়েই। মাঝে মাঝে আঘাত পায়, কিন্তু অন্তরের সেই শিল্পীসত্তার এদিকে খেয়াল নেই। বিড়ি সিগারেটের জন্য বাকি পড়েছে কিছু। নবীন মুদি তাগাদা দেয়। 

—কই গো শঙ্কর, মিটিয়ে দাও টাকা কটা! 

—টাকা! শঙ্কর কি ভাবছে। 

গুপি মিত্তির কোন সিনেমা সঙ্গীত-পরিচালকের সহকারী হতে চলেছে। গায়ে ছক্কর-বক্কর ছাপমারা হাওয়াই শার্ট, পরনে কর্ডের প্যান্ট, মুখে সিগারেট, সর্বদাই আশপাশে দু-চারজন চেলা-চামুণ্ডা ঘোরে। শঙ্করকে দেখে এগিয়ে আসে।-হ্যাল্লো শঙ্করদা? রেওয়াজ চলছে কেমন! বলছি এই লাইনে চলে এসো। তা নয়, ওই বমিই করবে দিনরাত-হ্যা হ্যা হ্যা। ছোঃ। 

শঙ্কর কথা বলে না। নবীন মুদি বলে ওঠে—ওদিকে শঙ্কর ভায়ার পোশাক তো বেশ ফিটফাট, নতুন জামা, কাপড়, জুতো! আমাদের পয়সাডার কথা তো স্মরণ থাহে নাহি। এটা ভালো নয় শঙ্কর ভাই; হুঁশ করাইয়া দিতিছি। 

শঙ্কর মুখ নিচু করে বলে—দু-চার দিনের মধ্যেই দিয়ে দোব। 

কোনো রকমে ওখান থেকে চলে আসতে পারলে বাঁচে। শুনতে পায় পিছনে গুপি মিত্তির সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে ওঠে—ও দিয়েছে তোমার টাকা! কোত্থেকে দেবে? 

নবীন মুদিও শাসায়—অর পায়জামা খুইলা নিমু না? 

একটা হাসির বান ডাকে। 

চুপ করে বাড়ি ঢোকে শঙ্কর। এ বাড়িতে অবাঞ্ছিত অনাহূত সে, আসা-যাওয়ার খবর, কেউ রাখে না—রাখবার দরকার করে না। একমাত্র নীতা-ই দেখে তাকে অবসর সময়ে। মন্টুর জন্য কাদম্বিনী বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, বলে—দুধের ছেলে, চাকরি করছে, হাড়ভাঙা খাটনি, খাওয়া না হলে শরীর টিকবে কেন? 

দুধ-মাছের বরাদ্দ হয়েছে, মা টিফিন নিয়ে তৈরি। মন্টু ফোমসোলের চটিটা পাচ্ছে না, পাঞ্জাবিও নেই। কাজে বের হবার মুখেই মন্টুর মেজাজ বিগড়ে যায়। 

গজগজ করতে থাকে মন্টু। 

শঙ্করকে ঢুকতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসে। শঙ্কর পরেছে তারই পাঞ্জাবি ও চটিটা। 

ফোঁস করে ওঠে মন্টু—কেন পরবে ওসব? 

শঙ্কর আমতা আমতা করে—একটু কাজে যেতে হয়েছিল, আমারটা ছিঁড়ে গেছে, ভাবলাম তোমারটাই— 

—না! যদি না থাকে তোমার, খালি গায়ে খালি পায়ে যাবে। পরেরটা পরতে লজ্জা লাগে না? পরতে হয় নিজে রোজগার করে পরবে। 

শঙ্কর চুপ করে চটিটা ছেড়ে দিল। 

কাদম্বিনী বলে ওঠে—আহা, পরের নিয়ে পোদ্দারি—তবু যদি নিজের মুরোদ থাকত।

পাঞ্জাবি আর চটিটা খুলে দিল শঙ্কর। এতক্ষণ ছিমছামই দেখাচ্ছিল—পাঞ্জাবি খুলতে ছেঁড়া ফর্দাফাঁই ময়লা গেঞ্জিটা বেরিয়ে পরে, শঙ্করের মুখেও একটা কালো ছায়া। নীতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে শিউরে ওঠে বেদনায়। ধমক দেয়। 

—মন্টু! জিভের ডগে তোদের কিছুই আটকায় না? ছিঃ ছিঃ। সুর নামিয়ে বলে ওঠে—আর তোমাকে বলি দাদা—তুমি আস্ত বোকা, ঘটে একটুও বুদ্ধি নেই। 

শঙ্কর চুপ করে চলে গেল, মন্টুই বলে ওঠে—নেই আবার! মাইরি! 

নীতা কি বলতে গিয়ে থামল গীতাকে ঢুকতে দেখে। চোখে-মুখে ওর খুশির আভা; কোথায় যেন বেরোচ্ছে সে। কাদম্বিনী তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। 

গীতা হাসছে–একটু সন্ধ্যা হবে মা ফিরতে। 

—সকাল সকাল ফিরিস বাছা! 

গীতা আর কাদম্বিনীর মাঝে কি যেন নীরব ইশারা হয়ে গেল। রূপের ঢেউ তুলে বের হয়ে গেল গীতা। 

নীতা বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। 

—কোথায় যাচ্ছে ও? নীতা প্রশ্ন করে মাকে। 

কাদম্বিনী বলে ওঠে—কোন বন্ধুর জন্মদিনের নেমতন্নে। 

কী যেন চেপে যাচ্ছে তার কাছে মা; নীতাও জানতে চাইল না। সারা বাড়িতে তার অন্তরালে কি যেন একটা ঘটতে চলেছে। ঠিক অনুমান করতে পারে না নীতা 

বাড়ির এই বদ্ধ পরিবেশ, তাকেও ওদের ওই এড়িয়ে যাওয়া ভাব দেখে মন বিষিয়ে ওঠে নীতার। বাইরে এসে দাঁড়াল। 

গাইছে শঙ্কর। একটু আগে যে ছিল একান্ত অসহায়-সুরের জগতে সে প্রবেশ করেছে বিজয়ীর মতো। সেখানে সে শিল্পী—সত্যকার স্রষ্টা। 

মিষ্টি সুরেলা গলায় ফুলঝুরি ফুটছে। সবুজ পত্রাবরণের মধ্যে থেকে এক ঝাঁক মৌমাছি গুনগুন করে—কোথায় পাখি ডাকে ক্লান্ত-করুণ সুরে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় নীতা ওর দিকে। 

তন্ময় হয়েছিল শঙ্কর, নীতাকে দেখে সুর থামাল। নীতা শঙ্করের দিকে তাকিয়ে রয়েছে; বিন্দুমাত্র অপমান ওর শিল্পীসত্তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। নীতা এগিয়ে এসে খুঁট থেকে টাকা বের করে দেয়। 

—নাও, দরকার হয় আমাকে বলো, এ নিয়ে হাঁড়ির অপমান হয়ো না যার-তার কাছে। 

শঙ্কর বেমালুম ভুলেই গেছে সবকিছু। হঠাৎ যেন স্মরণ হয়—ওঃ ওই মন্টুর কথা বলছিস? যাঃ, ছোট ভাই বই তো নয়; বলুক না—ছেলেমানুষ। তা এ যে দুপাত্তি কড়কড়ে – হ্যাঁরে? 

—জামা, কাপড়, জুতো করাও। 

শঙ্কর রীতিমতো অবাক হয়। তানপুরাটা নামিয়ে বলে ওঠে—নাঃ, জীবনে তুই কষ্ট পাবি নির্ঘাত। একদম পয়সা রাখতে পারবি না। তাছাড়া জানিস? পরের দুঃখে যারা কষ্ট পায় তাদের দুঃখ কোনোদিনই ঘোচে না—ঘুচতে পারে না। 

—কি যে বলিস বড়দা? 

—হ্যাঁরে, খুব সত্যি কথা। পরে হাড়ে হাড়ে বুঝবি। তুই একটা আস্ত ইডিয়েট। নইলে আমার মতো অকর্মা লোকও তোকে ঠকায়! দেখবি তোর ঘাড়ে পা-দিয়ে অনেকেই উঠে যাবে উপরে, পড়ে থাকবি তুই। দোতলায় উঠলে নীচের সিঁড়িটার খবর কে রাখে বল? সবাই যেদিন এমনি একটি ঘাড়ের খোঁজ পাবে সেদিন দেখবি তোকে ঠকাতে আর কেউ বাকি রাখবে না। এন্তার ঠকছিসও। 

আনমনে তানপুরাটায় সুর তুলতে তুলতে বলে—হ্যাঁরে ওই সনৎ ছেলেটা কেমন?

চমকে ওঠে নীতা। কেমন একটা সলজ্জ শিহরণ খেলে যায় তার শরীরে। জবাব দেয়—যতটুকু দেখেছি তাতে মন্দ কি? ভালোই। 

আর কিছু বলে না শঙ্কর। নীরবে তানপুরায় সুর তুলতে থাকে, রিনিরিনি একটা করুণ সুরের মূর্ছনা। চুপ করে বেরিয়ে এল নীতা। 

কেমন যেন মনটা হু হু করে। স্তব্ধ মধ্যাহ্নে একটা অসীম শূন্যতা ঘিরে রয়েছে বাড়িটাকে। কলোনির পথেও লোকচলাচল কমে গেছে। খালের ধারে ঝিম হয়ে বসে আছে একটা বক-সর-বনের সঙ্গে গায়ের রঙ মিশে গেছে তার। স্তব্ধ জীবনযাত্রার কোথাও কোন পরিবর্তন নেই। 

.

মেসের বাবুদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। ঝিমধরা পুকুরের স্থির জলে কে যেন ঢিল মেরে তার আলোড়ন তুলছে; ঢেউটা ক্রমশ এগিয়ে এগিয়ে পাড়ে গিয়ে আঘাত করে, জল ছিটকে তোলে। 

শীতল নায়েক, জলধর বর্মন টেকোমাথা নটেশ্বর আরও কে কে জীর্ণ শতরঞ্চি পেতে পাশার আসর বসিয়েছে। জমাটি দানপাশার দান পড়ছে হু হু করে। পাশে চাকর গেলাসে করে চা নামিয়ে রেখে গেছে, চুমুক দেবার অবসর নেই! 

হঠাৎ সনতকে ঢুকতে দেখে কেউ বিশেষ খেয়াল করে না। সনৎ বলে ওঠে,—টাকাটা মিটিয়ে নিন ‘শীতলবাবু! 

—টাকা? কিসের টাকা? কার টাকা? বারো পাঁচ সতেরো!…হু হু বাবাঃ। এইবার কচে বারো! —শীতলবাবু! সনতের ডাকে শীতল নায়েক ধমকে ওঠে। 

—অ্যাঁ…আরে মশাই, বড় জ্বালাতন করেন আপনি। নাইবা দিলেন টাকা। গেলো তো কেঁচে গুঁটিটা! অ! তা হঠাৎ টাকা? 

—চাকরি পেলাম কিনা? 

—চাকরি! খেলার নেশা ছুটে যায় ওদের। 

—এই দুর্দিনের বাজারে চাকরি? 

কে যেন প্রশ্ন করে—তা কত গ্রেড মশায়? কত বল্লেন চারশো! 

—সরকারি চাকরি না মার্কেন্টাইল ফার্মে মশাই? 

জলধরবাবু বলে ওঠেন—সরকারি চাকরি? নেবেন না মশাই, না টিফিন না বোনাস। ওদিকে যাবেন না মশাই। চাকরি যদি করতে হয় তবে তেল কোম্পানিতে, বছরে পাঁচমাসের বোনাস! মারের চেয়ে ধাক্কার জোর বেশি। 

সনৎ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে, একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের জবাব দেওয়া অসম্ভব। শীতল নায়েক হাঁক পাড়ে। অ্যাই রামা, ব্যাটাচ্ছেলে, চা দিয়ে যা সনৎবাবুকে। সিগ্রেট চলে তো? 

—না! সনৎ হঠাৎ এত খাতির দেখে অবাক হয়ে যায়। একদিনেই তার দাম বেড়ে গেছে অনেক! 

—একদিন খাইয়ে দিন সনৎবাবু। 

সনৎ অন্য কথা ভাবছে। টাকাগুলো মিটিয়ে দিয়ে নেমে আসছে। হঠাৎ শীতলবাবুর ডাকে থামল সিঁড়ির কোণে। 

গলা খাটো করে বলে ওঠে শীতল—বেশ পজিশনের চাকরিই তো পেয়েছেন মশাই, গুণী লোক এতদিন চিনতে পারিনি। আমরা তো মুখ্যুসুখ্যু মানুষ! আমার ছেলেটা বসে আছে, দেন না অফিসারকে বলে করে একটা যাহোক কিছুতে লাগিয়ে। 

সনৎ আমতা আমতা করে—সবে নতুন চাকরি! 

—আহা আজই কি বলছি। একটু খেয়াল রাখবেন গরিবের কথাটা। চলে গেলেও যেন ভুলে যাবেন না। হাজার হোক কটা বছর এক হাঁড়িতে ভাত খেয়েছি মশায়; এ কি ভোলা যায়? বলুন? 

সনৎ সায় দেয়, এ কথা সে ভুলবে না কোনদিনই। 

মেসের সকলেই আলোচনা তুলেছে। সনৎ বেশ ভালো বাগিয়েছে। সুতরাং আর গরিবদের মনে রাখবে কেন? চলে গেল তাই আজ মেস ছেড়ে। 

শীতল নায়েক আর পাশায় মন বসাতে পারে না। কেমন যেন খালি হয়ে গেছে ঘরখানা, মেসটা। এতদিনের সঙ্গী—ওদের দয়ায় পাত্র, হঠাৎ যেন কঠোর জবাব দিয়ে চলে গেল সে। পড়ে রইল তার। সেই নীচেই। 

—আরে ছেড়ে দাও ওসব। ঢের চাকরি দেখছি। চাকরি ইজ চাকরি। সেই গোলামি। করতো স্বাধীন ব্যবস্থা, বুঝতাম, হ্যাঁ বাপের ব্যাটা। 

কাত্যায়নী দাঁতের মাজনের আবিষ্কর্তা ভূতনাথ জোর গলায় বলে ওঠে কথাগুলো সিট থেকে। চারিপাশে ছড়ানো খালি কৌটো লেবেল। ব্যবসা সম্বন্ধে তার জ্ঞান প্রচুর। 

জলধর বলে ওঠে—তা সত্যি, নিদেন দময়ন্তী কেশ তৈল, কাত্যায়নী দাঁতের মাজন আবিষ্কার করত, তাও চলত। কি বল ভূতো? 

—অ্যাও! শাট আপ। গর্জন করে ওঠে ভূতনাথ। 

গলির পড়ে গলি। দুপুরের রোদ হলদে হয়ে আসছে। নীতা চেনা পথটা ধরে এগিয়ে আসে। রাস্তায় জমেছে ছেলেদের খেলার আসর। টেনিসবলের ফুটবলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আলুকাবলি-ওয়ালাকে ঘিরে জমেছে বাচ্চা ছেলে মেয়েদের জটলা। 

বউ-ঝিদের সামনে ঠেলাগাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে নিলামবালা দরদস্তুর করে চলেছে। দুপুরের অলস শহর। মাঠে রোদপিঠ করে মেসের ঠাকুর চাকররা তাস খেলতে বসেছে। কে যেন জোর গলায় হাঁক পাড়ে—নোনা, সে রং ডিক্ করি মারিবা। 

ওরা ফিরেও চায় না। নীতা চলেছে আনমনে সনতের মেসের দিকে। একবার মুখোমুখি সে আলোচনা করতে চায়। সনতকে এড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাপারটা যে কিছুটা সত্য তা অনুমান করতে পেরেছে নীতা। চাকরির কথাটা সে তার কাছ থেকেই শুনতে চায়। 

হলদে রঙের তেতলা মেস বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। রেলিংঙে কাপড় ঝুলছে, বাবুদের কে একজন নীতাকে দেখে নেমে আসে। 

—সনবাবু আছেন? 

হলধর বর্মা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আপাদমস্তক দেখছে তাকে! নীতা ওর দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করে। হলধর জবাব দেয়—শোনেননি বুঝি? সনৎবাবু তো এখানে আর থাকেন না। 

—থাকেন না? 

—উঁহু। কোথায় যেন বাসা করেছেন। 

চমকে ওঠে নীতা। এতদূর এগিয়ে গেছে সনৎ! নীতাকে একটিবার জানায়নি পর্যন্ত। রাগে- অভিমানে সারা মন ভারী হয়ে ওঠে। সরে আসছে, হলধর শর্মা চিরকুটে লিখে দেয় ঠিকানাটা। 

—এই ঠিকানায় আছেন। 

নীতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাগজখানা কি ভেবে হাত নিয়ে দাঁড়াল না আর। 

বারান্দায় ক-জন কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। সনতের অতীত ইতিহাসের সাক্ষী ওরা, নীতাকেও দেখেছে এখানে আসতে বহুবার। ওরা বোধহয় মনে মনে হাসছে নীতার এই বেহায়াপনা দেখে। 

লজ্জায় মাটির সঙ্গে নুইয়ে আসে ওর মাথা। সরে গেল সে বড় রাস্তার দিকে। 

গলির জীবনযাত্রা তেমনিই স্বাভাবিক গতিতে চলেছে। সনৎ নেই এখানে। তবু নীতার সারা মনে একটা দুঃসহ ঝড় ঘনিয়ে ওঠে। কী এমন অপরাধ সে করেছে ওর কাছে বুঝতে পারে না। যাকে নিঃশেষে আত্মনিবেদন করতে গিয়েছিল, নিজের পরিশ্রম দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে যাকে সার্থক করে তুলতে তাকিয়েছিল, সেই সনতের কাছ থেকে এমনি নিদারুণ অবজ্ঞা-অবহেলা জুটবে এ স্বপ্নেও ভাবেনি নীতা। রাস্তায় গিয়ে ট্রামে উঠে বসে স্বপ্নাবিষ্টের মতো, হাতের মুঠোয় আবিষ্কার করে তার নতুন ঠিকানাটা। 

.

সনৎ বাড়িটা হঠাৎ পেয়েই নিয়েছে। ছোট বাড়ি; এত সস্তায় পাবে তা কল্পনা করেনি। এক বন্ধুর হেপাজতে ছিল বাড়িটা। চাকরির ব্যাপারে সে কানপুর বদলি হয়ে যাচ্ছে, সনৎকেই বসিয়ে গেল সেখানে। 

বারবার মনে হয়েছে সনতের নীতার কথা। বহু দিনের কল্পনা আর স্বপ্ন ছিল তার একটা ছোট বাড়ি; সামনে একটু বাগান হবে। বাধা দিয়ে উঠত নীতা সনতের কথায়—পুঁইশাক আর কুমড়ো গাছ থাকবে না, থাকবে কয়েকটা বেল আর রজনিগন্ধার ঝাড়, দু-চারটে গোলাপ গাছ। কলেজ থেকে ফিরে এসে বসবে, পড়াশোনা করবে সন্ধেবেলায় বাগানেই। 

হাসতো সনৎ ওর কথায়। 

—সে তো কলকাতায় জোটা সম্ভব নয় গরিব প্রফেসারের পক্ষে। 

নীতা তবু স্বপ্ন দেখত, জবাব দিত—কলকাতার বাইরে আশপাশে তো জুটবে। 

আজ নীতার কথা মনে পড়ে বারবার। একবার তাকে জানাতেও পারেনি। বারবার। ইচ্ছে হয়, তবু বাধা দেয় গীতাই। 

—নীতার সময় কোথায়? চাকরি টিউশানি। তা ছাড়া সে তো চটে আগুন হয়ে আছে। যা বদমেজাজি! 

গীতা এর মধ্যে নিপুণ গৃহিণীর মতো কাজকর্ম শুরু করেছে, এ বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে উদয় হয়। 

জানলার কোথায় পরদা বসবে, কোন্ রঙ কোন্ কাপড়ের তা গীতাই পছন্দমতো কিনে এনেছে, টেবিলক্লথ তৈরি করেছে দুটো। সামনে মাসের মাইনে পেলে কী কী কিনতে হবে তারই ফর্স দেখে বলে ওঠে— একটা খাট! কিছু জিনিসপত্রও চাই। 

হিসেব-নিকেশ করে বলে—একটা কম্বাইন্ডহ্যান্ড রাখলেই চলবে। 

সনৎ গীতার কথায় মুখ তুলে তাকাল, নীতার প্রসঙ্গ উঠতে প্রশ্ন করে—কী বলছিল সে?

গীতা একরাশ চুল বাঁধতে বাঁধতে বলে—কি আর বলবে? হিংসে আর কি! অ্যাই ধরো না ভালো চাকরি করছ—ভেবেছিল তেমনি পথে পথেই ঘুরবে, তাহলেই খুশি হতো। তা তো হল না, তাই সে বলে, ও আর কি করবে? গবেটমার্কা ছিল কিনা, রিসার্চ করতে পিছিয়ে গেল। চাকরি ছাড়া আর পথ কই? 

সনৎ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গীতাই গলগল করে বলে চলেছে। 

—আরে বাপু, সবাই কি তোর কথামতো চলবে? তুই নিজে আগে কিছু কর দেখি, তা নয় কেবল বাক্তাল্লা। সব পুরুষই বোকা—আর ওই তো রূপ! যেন কালপেঁচা; হিংসেতে ফেটে পড়বে এইবার, দেখে নিও। 

সনৎ উঠে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে, কথাগুলো শুনতে চায় না। এগিয়ে আসে গীতা।

—শুনছ? ও মশাই। 

সনতের হাতটা ধরে একটা টান দেয়, হঠাৎ খোলা দরজার কাছে কাকে দেখে চমকে ওঠে সনৎ, গীতাও! 

একটি মুহূর্ত। সনতের হাতখানা গীতার হাতে। বিস্ময়ের ঘোরে সনতও হাতটা সরিয়ে নিতে ভুলে যায়। 

নীতা খুঁজে খুঁজে বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে নেমপ্লেট দেখে সোজাই উঠে এসেছে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখবে কল্পনা করেনি। গীতা কোন্ বন্ধুর জন্মদিনে নেমতন্ন খেতে আসবে, কিন্তু এইখানেই আসবে তা জানত না নীতা। চকিতের মধ্যে ভিতরে সরে গেল গীতা, যেন ওকে দেখতেই পায়নি। 

ভিতরে যাবে কি না ভাবছে। 

—এসো? 

সনৎ সামলে উঠেছে। নীতা ভিতরে ঢুকল না। 

রোদে-ঘেমে নিয়ে উঠেছে, হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে সে। 

জবাব দেয় নীতা—না; একটু কাজ সেরে ফিরব। 

দাঁড়াল না; ভীত-চকিত জন্তুর মতো দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। 

সনতের মুখে একটা ম্লান-ছায়া ফুটে ওঠে। ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে, তা ভাবতে পারেনি। গীতা বের হয়ে আসে। 

বলে ওঠেন সনৎ—কী ভাববে বল দিকি ও? 

গীতা নিম্নকণ্ঠে জবাব দেয়—কী আবার ভাববে! এতে ভাববার কিছুই নেই। 

সনতের নিজের মনের কাছে জবাব দেবার মতো তবু কোনো কৈফিয়তও নেই। নিজেকে অপরাধী মনে করে সে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *