মেঘমেদুর বরষায়

মেঘমেদুর বরষায়

‘নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি, নেরে ও মন নেরে, আপনপানে টানি৷’

এক একটি গানের কলি মনে এলেই সেই উদ্ভাসে আলোকিত হয়ে ওঠে অতীতের কত স্মৃতি, কত বৃষ্টিভেজা অনুষঙ্গ, কত উদাসী সিক্ত হাওয়ায় ভেসে আসা অনুভূতি৷

‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গগনে গগনে ডাকে দেয়া৷’ গা শিরশির করে ওঠে সেই সব গানের পঙ্ক্তির কথা মনে পড়লে৷

বর্ষাকালের স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে কত জায়গার বর্ষার কথাই যে মনে আসে তা কী বলব৷ কোনটাকে বাদ দিয়ে কোনটাকে মনে করি৷

আমার ছেলেবেলার রংপুরে বৃষ্টি আসত সন্ধের সময়ে৷ দিনমানের সব কাজ শেষ হয়ে গেলে ঝেঁপে বৃষ্টি আসত৷ বাড়ির টিনের চালে তার ঝমঝমানি শুনতে পেতাম৷ আবহাওয়া সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হয়ে যেত৷ চ্যাগারের ওপাশে সাপে ব্যাঙ ধরত আর কুয়োপাড়ের পাশের কচুবনের নীচ থেকে ব্যাঙেদের সম্মিলিত ডাক ভেসে আসত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে৷ বৃষ্টির সঙ্গে জোর হাওয়া বাঁশবনে আন্দোলন তুলত৷ শেষ বিকেলে কাঁটালের বীচি ভাজা বা পোড়া দিয়ে মুড়ি খেতাম আমরা৷

শুধু রংপুরেই নয়, পরে দেখেছি জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, নামনি আসামের সমস্ত অঞ্চলেই বৃষ্টিধারার ওই অলিখিত নিয়ম ছিল৷ দিনমানে তেমন বৃষ্টি হত না, বৃষ্টি নামত সন্ধের পরে পরে৷ আরামে খাওয়াদাওয়ার জন্যে এবং তারপরে আরও আরামে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমুবার জন্যে৷ আমার ছেলেবেলাতে মানে ত্রিশ-চল্লিশের দশকে সারা পৃথিবীটাই বড়ো সুখের জায়গা ছিল৷ বড়ো শান্তি, বড়ো নিভৃতি, বড়ো আরামের ছিল সেই পৃথিবী৷ গাছপালা থেকে টুপটাপ শব্দে জল ঝরত নানা গাছের গায়ের গন্ধবাহী হাওয়ার সঙ্গে৷ এই রকমই আবহ ছিল নামনি আসামের গোয়ালপাড়া জেলার তামারহাটে—যেখানে রংপুর থেকে আমরা আমার বড়ো পিসিমার বাড়িতে যেতাম ছুটিকে আরও মধুর করার জন্যে৷ গৌরীপুর শহর হয়ে ধুবড়ি থেকে যেতে হত সেখানে৷ কলকাতার এক কিশোরের কাছে সে ছিল স্বর্গরাজ্য৷ কুমারগঞ্জ থেকে তামারহাটে পৌঁছোতে হত শিলাবিছানো পথ বেয়ে, তখনকার দিনের লজঝড়ে বাসে করে৷ তামারহাটের সামনেই ছিল পাটের ব্যবসায়ী আমার পিসেমশায়ের বাড়ি৷ কত সব বিচিত্র নামের জায়গা ছিল চারপাশে৷ ডিঙ্গডিঙ্গা, ডুমডুমা, রাঙামাটি, আলোকঝারি, পর্বতচুড়োর—পাহাড়ের ওপরে৷ রাঙামাটির আগে সাহেবদের টুঙ বাগান ছিল৷ শুনেছিলাম সেই টুঙ থেকে এরোপ্লেনের গায়ের রং তৈরি হত৷ সে বয়সে সত্য-মিথ্যার বিচার করার মতো মানসিকতা ছিল না—ছিল শুধু অসীম বিস্ময় আর সেই বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া৷ বর্ষার উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে থাকত পুরো অঞ্চল৷ মেচ, রাভা, গারো, সাঁওতাল নানা আদিবাসীদের বাস ছিল সেই সব পাহাড়-জঙ্গলে৷ তামারঙা মেচদের বাড়িগুলি বড়ো সুন্দর ছিল৷ পরে ইম্ফল এবং কোহিমাতে দেখেছিলাম নাগাদের গায়ের রঙের সঙ্গে মেচদের গায়ের রঙের খুব মিল ছিল৷ আলোকঝারি পাহাড়ে আমার এক কিশোরী মেচ বান্ধবী ছিল৷ হাতে বোনা বহুবর্ণ মোটা মেখলা ও দোহর থাকত তার পরনে৷ সারা দুপুর তার মা তাঁতে খটাখট শব্দ তুলে ওই সব পরিধেয় তৈরি করতেন গুয়াপান চিবোতে চিবোতে৷ সেই মেচ কিশোরীর গায়ের গন্ধ আজও আমাকে মথিত করে৷ বর্ষাদিনের পাহাড়জঙ্গল, গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি এবং পরিদের গায়ের গন্ধ অন্যরকম হয়ে যায়৷ শিশুকাল থেকেই গন্ধ আমাকে মোহিত করে—সব গন্ধই—তাই গন্ধের কথা এমন করে মনে পড়ে৷

তামারহাট থেকে আরো এগিয়ে গেলে ডিঙ্গডিঙ্গা চা বাগান এবং জনপদ পেরিয়ে বরবাধা রেঞ্জ হয়ে রাইমানা কচুগাঁও হয়ে পৌঁছোতে হত গভীর অরণ্য মধ্যের যমদুয়ারে৷ যমদুয়ার নামের মধ্যেই তার মাহাত্ম্যের আভাস মেলে৷ সেই বনে ছিল না, এমন বন্যপ্রাণী ছিল না৷ বাঘ, চিতা, হাতি, নানারকম হরিণ, বন্যমহিষ ইত্যাদিতে ভরা ছিল সেই অরণ্য৷ আর তার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছিল ভুটান থেকে নেমে আসা খরস্রোতা সংকোশ নদী৷ মানস অভয়ারণ্যের মানাস নদীর মতো অতটা সুন্দরী না হলেও সংকোশ যথেষ্টই সুন্দরী ছিল৷ ওখানে শিকারে প্রাণীর প্রতুলতার কারণে ভুটানের মহারাজা হেলিকপ্টার নিয়ে আসতেন—থাকতেন সংকোশ নদীর পাড়ের যমদুয়ারের দোতলা বনবাংলোতে৷ জানি না, বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এ বর্ণিত বন্য-মহিষদের দেবতা ‘টাঁড়বারো’ও সেখানে ছিলেন কি না৷ বন্য-মহিষদের খুব বড়ো বড়ো দল ছিল সেখানে৷ রাঙ্গানদীর পাড়ের দিকে দেখতে পাওয়া যেত সেই সব দলকে৷

বর্ষার যমদুয়ার দেখার মতো ছিল৷ সেখানে এমন বড়ো বড়ো শালগাছ এবং সেগুনের গাছ ছিল যে বার্মার (বর্তমানের মায়ানমারের) ম্যানগুস্যালেউইন নদীর পাড়ের জঙ্গলেও কম দেখা যায়৷

বর্ষাকালে বনের রূপই আলাদা হয়ে যায়৷ শ্যাম্পু করা, শিকাকাই ঘষা মেয়েদের মতো তাদের গা থেকে এমন সুগন্ধ ওঠে যে তা বলার নয়৷

বর্ষাদিনে যেতে হয় মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল অথবা নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমাতে এবং খাসী হিলসের রাজধানী শিলং থেকে সাঙঘাতিক বিপদসঙ্কুল পথ বেয়ে চেরাপুঞ্জীতে৷ চেরাপুঞ্জী তখনও পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের জায়গা ছিল৷ চেরার কাছেই আছে অত্যন্ত সুন্দর মওসমাই প্রপাত৷ সেখান থেকে দূরের সিলেট উপত্যকা দেখা যায়—সেই জায়গা শুঁটকি মাছের জায়গা—এখন বাংলাদেশে৷

কিশোর বয়সে শিলঙের নানা শহরের ছায়া সুনিবিড় পথে পথে অবুঝের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি কোথায় শেষের কবিতার লাবণ্য আর অমিত রায়ের গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা খুঁজে বের করার জন্য৷

যামী হিলসের কাছেই আছে জান্তনীয়া হিলস৷ এখন সবই মেঘালয়ের অন্তর্গত হয়েছে৷ এ সবই মেঘের আলয় তাই মেঘালয়৷ বর্ষাকালে মেঘালয়ে শেষের কবিতা যেন প্রাণিত হয়৷

গুয়াহাটিতে নেমে এসে যেতে হয় গারো পাহাড়ে৷ আমাদের কৈশোর বয়সে গারো হিলস ছিল হাতিদের রাজত্ব৷ কত হাতি যে ছিল তার ইয়ত্তা নেই৷ গারো হিলসেও বর্ষার রূপ ছিল অত্যন্ত সুন্দর৷ নানারকম বাঁশের বনে ভরা—জুম চাষের চল ছিল পথের দু’পাশে পাহাড়ে৷ রাজধানী তুরা ছিল একটি ছোট্টো কিন্তু সুন্দর শহর৷ তার পায়ের নীচ দিয়ে বয়ে গেছিল ছিপছিপে কিন্তু অত্যন্ত গভীর জিঞ্জিরাম নদী৷ এই ভরা বর্ষাতে জিঞ্জিরাম হয়ে উঠত নানারকম কুমিরের আড্ডা৷ কুমির এবং ঘড়িয়াল৷ খুব বড়ো বড়ো কুমিরের স্থানীয় নাম ছিল ঘটওয়ালা কুমির৷ তাদের মাথার চামড়া বয়সের ভারে কুঁচকে গিয়ে ঘটের আকার নিত—তাই তাদের নাম ছিল ঘটওয়ালা কুমির৷ এই জিঞ্জিরাম নদীর দু’পাশে ছিল রাভাদের গ্রাম৷ একটি গ্রামের কথা এখনও মনে আছে, তার নাম ছিল রাভাতলা৷ জিঞ্জিরামের কুমিরেরা ছিল মানুষখেকো৷ তাই বর্ষাকালে সেই সব কুমির শিকারের জন্যে বাবার সঙ্গে যেতাম৷ ছোট্টো ছইওয়ালা নৌকোতে ধুবড়ির নেতা ধোপানি ঘাট থেকে ব্রহ্মপুত্রের বুকে নৌকো ভাসিয়ে সেই দামাল নদী পেরিয়ে শানমাড়া হয়ে জলপ্লাবিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল বেয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছোতাম জিঞ্জিরামের বুকে৷ সারা দিনরাতই বৃষ্টি পড়ত৷ নদীর গন্ধ, জলের গন্ধ, নারী শরীরের গন্ধেরই মতো ছিল আলাদা আলাদা৷ মাঝে মাঝে সামান্য সময়ের জন্য বৃষ্টি থামত৷ মেছো নৌকো থেকে ভাঙনি মাছ কিনে হলুদ, কাঁচালঙ্কা, কালোজিরে দিয়ে তার ঝোল রান্না করে লাল চালের ভাত দিয়ে নৌকোর পাটাতনের ওপর বাবা, বিখ্যাত শিকারি আবু ছাত্তার এবং ধুবড়ির বিখ্যাত টাউন স্টোরস এবং টাউন হোটেলের মালিক শচীন রায়ের সঙ্গে সেই খাবার খাওয়া হত৷ রাভাদের গ্রাম থেকে প্রায়ই কুমিরে মানুষ নিয়ে যেত—তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মেয়ে—যারা জলে নামত বাসন ও কাপড়চোপড় ধুতে এবং চান করতে৷ অনেক কুমিরের পেট থেকেই—তাদের শিকার করার পরে নানা গয়না এবং মেয়েদের ব্যবহার্য নানা জিনিস পাওয়া যেত৷ ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে দিনমানেই প্রায়ান্ধকার নদীর বুকে গাছপালার চন্দ্রাতপের নীচে নৌকো বেয়ে যেতে যেতে দেখতে পেতাম জলের ওপরে বাঁশের মাচা বানিয়ে রাভা ছেলেরা লম্বা লম্বা হাতছিপ দিয়ে মাছ ধরছে৷ তখন নৌকোর ছইয়ের ছাদে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে রাইফেল হাতে বসে কল্পনাতে মনে হত দক্ষিণ আমেরিকার কোনও নদীতে বয়ে চলেছি৷ সেইসব বৃষ্টিভেজা জলগন্ধে সুবাসিত দিনগুলির কথা মনে আসে ভিড় করে৷ ফুলবাড়ি বন্দরের আলো দেখা যেত রাতের বেলাতে আর আমাদের ছোটো নৌকোর পাশে অন্য নৌকো এসে ভিড়ত৷ ডাকাত কি না বুঝতে পারার আগেই তারা নীচু গলায় বলত, ‘আগুন আছে কর্তা?’ মানে, দেশলাই৷ হুঁকো বা বিড়ি খাবার জন্যে তারা দেশলাই চাইত৷

এই গারো পাহাড়েই একসময়ের লোকসভার স্পিকার পূর্ণ সাংমার বাড়ি ছিল৷ নব্বইয়ের দশকে কলকাতাতে তাঁর সঙ্গে আলাপিত হয়ে সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করেছিলাম৷ পূর্ণ সাংমা চমৎকার বাংলা বলেন৷ তিনি গারো৷

পুব আফ্রিকাতে সেরেঙ্গেটি, গোরোংগারা, লেকমানিয়ারা ইত্যাদি জায়গাতেও গেছিলাম এই জুন-জুলাইয়ে৷ কিন্তু বছরের এই সময়ে সেখানে শীতকাল৷ বৃষ্টির ব-ও নেই৷ ভারত মহাসাগরের বুকে মরিশাসের কাছে এবং আফ্রিকারও কাছে পৃথিবীর মানচিত্রে সর্যেদানার মতো কয়েকটি দ্বীপের একটি পুঞ্জ আছে৷ যার নাম সেশেলস্ আইল্যান্ডস৷ এখানের বর্ষাও নয়নাভিরাম৷ ছোটো ছোটো আইল্যান্ডার প্লেনে করে রাজধানী ‘মাহে’ থেকে অন্য দ্বীপগুলোয় উড়ে যাওয়ার চল আছে৷ এয়ারপোর্ট-টোর্ট নেই৷ বৃষ্টির মধ্যেই চষা খেতের মধ্যে প্লেন ল্যান্ড করে৷ একটি পুরো দিন বর্ষা উপভোগ করেছিলাম মাহে থেকে কাছেই PRASLIN দ্বীপে৷ PRASLIN-এর ফরাসি উচ্চারণ প্রালেঁ৷ এই সমস্ত দ্বীপই নানারঙা কোরাল দিয়ে ঘেরা৷ প্লেন থেকে দেখলে মনে হয় কোনও স্বপ্নের দেশে নামছি৷ সারাটা দিন প্রালেঁতে বর্ষার রূপ দেখেছিলাম৷ সমুদ্রের ওপরে বর্ষার দুরন্তপনা দেখে মন ভরে গেছিল৷

‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গগনে গগনে ডাকে দেয়া, কবে নব ঘন বরিষনে গোপনে গোপনে এলি কেয়া৷’ অথবা ‘নীলাঞ্জনছায়া প্রফুল্লকদম্ববন, জম্বুপুঞ্জ শ্যামবনান্ত বনবীথিকা ঘন সুগন্ধ’ অথবা ‘আমার প্রিয়ার ছায়া আকাশে আজ ডাকে হায় হায়৷ বৃষ্টি সজল বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে হায়৷’ বর্ষার কত গানই যে মনে আসে ভিড় করে৷

মহারাষ্ট্রের রামটেক পাহাড়ের সামনে এক দারুণ সুন্দর নীলজলের হ্রদ আছে৷ তার চারপাশে রামমন্দির—অন্য দেবতাদের মন্দিরও আছে৷ এরই কিছু দূরে মহাকবি কালিদাসের নামাঙ্কিত একটি সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় আছে৷ জানি না, ভারতের আর কোথাও এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে কি না! কালিদাস নাকি এখানে বসেই ‘মেঘদূতম্’ লিখেছিলেন৷ ভরা বর্ষাতে যাঁরা রামটেকে গেছেন তাঁরাই শুধু জানতে পারবেন এর বর্ষাবিধুর সৌন্দর্যের কথা৷

আমরা ভারতবাসী৷ পৃথিবীর কত দেশেই না ঘুরেছি কিন্তু আমাদের দেশের মতো সুন্দর, বৈচিত্র্যময় দেশ আর সম্ভবত নেই৷




Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *