মেঘনাদ ভট্টাচার্যকে নিয়ে দু’এক কথা
গত শতকের ৯০ এর দশকের প্রথম দিকে দায়বদ্ধ দেখে আমি মেঘনাদ ভট্টাচার্য মশায়ের অনুরাগী হয়ে গিয়েছিলাম। যেমন অভিনয় তেমনি নাটক। তারপরেই বোধ হয় দুই হুজুরের গপ্পো দেখেছিলাম। কিন্তু আলাপ ছিল না। আমি নাটক দেখি, নাট্যকলার অনেক মানুষকেই পারিবারিক সূত্রে চিনতাম, কিন্তু মেঘনাদ ভট্টাচার্যকে চিনতাম না। আলাপ হয়নি। তিনি প্রতিভাবান, সুখ্যাত এবং বিখ্যাত। পরে জেনেছি তাঁর জীবনের অনেকটা অংশ কেটেছে আমার বসতির কাছে। পাইকপাড়ায় সায়ক নাট্যদলের জন্ম। মেঘনাদ নাকি এই অঞ্চলের নামী ফুটবল ক্লাব যুগের যাত্রী ফুটবল দলে খেলতেনও। পরে আমাকে বলেছেন আমার বন্ধু, অকাল প্রয়াত নাট্যপাগল অভিনেতা গৌতম লাহিড়ীকেও চিনতেন। এই মেঘনাদ ভট্টাচার্য এক রাত্তিরে ফোন করলেন। কোন বছর, ২০০৮ হবে, দিনক্ষণ মনে নেই। তিনি আমাকে বললেন আমার গল্প ‘বালিকা মঞ্জরী’ নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করবেন। আমি অবাক। বললাম, এই গল্প কি নাটক হয়, আমার গল্প তো নাটকীয় নয়, এর কোনো নাটকীয়তা নেই, নাটকীয় অন্তিম নেই। কী করে হবে? একই কথা ২০০০ সালে কিশোর সেনগুপ্তকে বলেছিলাম, তিনি ফোন করেছিলেন ‘অশ্বচরিত’ উপন্যাস মঞ্চস্থ করবেন সেই কথা নিয়ে। পরে যা ঘটেছে তাতে আমি বুঝেছি, কোন গল্প বা উপন্যাস নাটক হয়, কোনটি হয় না, তা আমি জানি না, নাটকের লোক জানেন। মেঘনাদ ভট্টাচার্য সেদিন আমাকে বলেছিলেন, নাটক হয় কি হয় না, সেইটি বুঝেই তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন। বালিকা মঞ্জরী গল্প নিয়ে নাটক লিখেছিলেন প্রয়াত ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী। তাঁর সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা হয়নি। মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। তারপর তিনি আমার বাড়ি আসতে লাগলেন কয়েকটি কয়েকটি দৃশ্য নিয়ে। পড়া হতে লাগল। আমি আমার মতামত দিতে লাগলাম। এক একদিন এমন হয়েছে মেঘনাদ ফোন করলেন ইন্দ্রাশিসকে। বললেন কোনো দৃশ্য নিয়ে আমার প্রস্তাব। এমনি করে করে নাটক লেখা এবং পাঠ চলতে থাকে। অর্ধেক হলো। মানে বিরতি অবধি। তারপর দীর্ঘ ছ-মাস মেঘনাদ নিশ্চুপ। যোগাযোগ নেই। মনে হতে লাগল শেষ অবধি পারলেন না মেঘনাদ। সেই সময়ে দেখা সল্টলেকের ই.জেড.সি.সি-তে। আমি বললাম তাহলে হচ্ছে না বালিকা মঞ্জরী। তিনি বললেন, আমার বাড়ি আসবেন, একটি জায়গায় আটকে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে। তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। এলেন। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হলো। জট ছাড়ল। তারপর বালিকা মঞ্জরী গল্প মঞ্চে এল ‘পিঙ্কি বুলি’ নামে দুই কন্যার গল্প হয়ে। এবং সফল। আমি মিনার্ভা থিয়েটারে একদিন সকালে একটি নিভৃত মঞ্চায়ন দেখতে গেলাম। জনা তিরিশ কি তার একটু বেশি নির্বাচিত দর্শক। নাটক দেখতে দেখতে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। দুই কিশোরী কন্যাকে দিয়ে যে অভিনয় করিয়েছিলেন মেঘনাদ তা যাঁরা ঐ নাটক দেখেছেন, অনুধাবন করতে পারবেন। আর বিরতির দৃশ্যটি বাংলা থিয়েটারে চিরকালীন। অমন অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আমি আর দেখিনি যেন। একা একা গ্রাম্-বালিকা বুলি ইস্কুল ড্রেস পরে মঞ্চ দাপিয়ে দর্শকাসন অধিকার করে নেয়। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম নির্দেশকের কল্পনার বিস্তার দেখে। নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়েছে। বুলিকে আমি যেভাবে লিখেছিলাম বালিকা মঞ্জরী গল্পে মেঘনাদ যেন তারও অধিক কিছু করতে পেরেছিলেন নাটকে। নাটক যৌথ শিল্প নিশ্চয়। নাটককার, নির্দেশক, অভিনেতা, আলোক সম্পাত-শিল্পী, মঞ্চ শিল্পী – আরো অনেককে নিয়ে নাটক মঞ্চে আসে। কিন্তু নির্দেশকের ভূমিকাই সবচেয়ে বড়। নির্দেশক যেমন ভাববেন, কল্পনা করতে চাইবেন, তেমন ভাবেই আলোর কথা, আবহর কথা, মঞ্চের কথা ভাবেন শিল্পীরা। মেঘনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দশ বছর। দশ বছর তাঁর সঙ্গে মিশেছি খোলামনে। আমি আমার কথা বলেছি,তিনি মন দিয়ে শুনেছেন। যদি মনে হয় আমার কথার ভিতরে কোনো মৌলিক উপাদান আছে, তিনি তা গ্রহণ করেছেন। না হলে নিজের মতে স্থিত থেকেছেন। পিঙ্কি বুলি নাটকের পর মেঘনাদ করেন ধ্রুবতারা। উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাটক। আমার খুব ভাল লেগেছিল নাটক এবং প্রযোজনা। নাটকটি মধ্যবিত্ত চেতনায় ঘা দিয়েছিল মনে হয়। দর্শক ভালভাবে নেননি। আমার এখনো মনে হয় ধ্রুবতারা নাটকটি আরো দর্শক-আনুকুল্য পেতে পারত। ধ্রুবতারার পর আবার একরাতে ফোন। আকাল গল্পটি নিয়ে নাটকের কথা ভেবেছেন। আকাল হয়েছিল দামিনী হে। দামিনী হে শুধু আকাল গল্পটি নিয়ে নির্মিত হয়নি। আমি তো বলেইছি, মেঘনাদ নাট্যকারের সঙ্গে বসে নিজের ভাবনাকে বিনিময় করে নাটক নির্মাণ করিয়ে নেন। পিঙ্কি বুলি নাটকে তাই দেখেছিলাম। আকাল থেকে দামিনী হে নাটক লিখেছেন সুখ্যাত নাটককার চন্দন সেন। চন্দন সেনকে মেঘনাদ আমার আরো গল্প দিয়েছেন। আসলে আমি জানতাম না মেঘনাদ আমার কত গল্প পড়েছেন। দামিনী হে নাটকে আমার আরো চারটি গল্পের অংশাংশ আছে। যেমন অন্ন গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে এই নাটকে। সাবলীল ভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন নাটককার আকাল গল্পের সঙ্গে। আর অষ্টম বাউরির মেলা গল্পের একটুখানি বা পীরতলার সামান্য। মেঘনাদ গল্প পড়ে নিজে বুঝে নেন কীভাবে নাটকটি হবে। ছাপার অক্ষরে যে চরিত্রদের কথা লেখা হয়েছে মঞ্চে শুধু কি তারাই আসবে অবিকল? একটি নাটক কীভাবে নির্মাণ হয়, তা মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে মিশে আমি জেনেছি। এই জানা আরো নিবিড় হয়েছে পাসিং শো গল্পটি নিয়ে নাট্য-নির্মাণে। মেঘনাদ ভট্টাচার্য বলেন আমার গল্প এবং উপন্যাসের ভিতর তিনি নিজের ভাবনাকে যুক্ত করতে পারেন। আমার সঙ্গে তাঁর রসায়ন মেলে। মেলে তো নিশ্চয়। গত পাঁচ বছরে মেঘনাদ আমার তিনটি গল্পকে মঞ্চে এনেছেন। এই ঘটনা কি আগে ঘটেছে? পাসিং শো গল্পের নাটক আর এক সুখ্যাত নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের হাতে নির্মিত। পাসিং শো গল্প এবং ওই নামের একটি নভেল মেঘনাদ নিলেন প্রথমে, তারপর কোন গল্প নিয়েছেন আমি জানতাম না। গল্পের ভিতরে গল্প মিশিয়ে দিয়ে যে নাটক তৈরি হল, মঞ্চে দেখে আমি বিস্মিত। আমার কথা মেঘনাদ ভট্টাচার্য যেমন জানেন, যেমন বোঝেন, তা আর কেউ নন। আরো দুটি গল্প তিনি উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে নিশ্চয় বলেছিলেন, মিশিয়ে দিতে। মিশে গেছে। আসলে মেঘনাদ ভট্টাচার্য নিজে যেমন চান, তেমনি নাটক লিখিয়ে নেন নাটককারকে দিয়ে। যতক্ষণ না নিজের ভাবনার সঙ্গে মেলে, তিনি থামেন না। পাসিং শো নির্মাণ পর্বে একদিন আমাকে বললেন গানটি বড় করে লিখে দিতে। টেক্সট-এ যা আছে, তার চেয়ে কিছু বেশি। মেঘনাদ বললেন, এই গান আপনি ছাড়া কেউ লিখতে পারবে না। আমি লিখেছিলাম প্রবল সংকোচে। সেই লিরিকে সুর দিলেন গুণী সুরকার জয় সরকার। জয় সরকার আবহ করেছিলেন অসামান্য। পুরনো বাংলা গানের সুর আবহে যেমন ব্যবহার করেছিলেন তা আমি ভুলব না। আর মেঘনাদের অভিনয়। সে-ও বড় পাওয়া এই নাটকে। পিংকি বুলি নাটকে সুর করে ছিলেন শ্রদ্ধেয়া স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। নাটকে আবহ নাটককে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। পিংকি বুলি নাটকে বুলির মুখের গান ভুলব না। মেঘনাদ জানেন কোন নাটক, কোন কাহিনিতে কোন সুর বসবে এবং কে তার জন্য যোগ্য। মেঘনাদের প্রেমকথা নাটক ফরাসী নাটককার মলিয়েরের নাটকের বঙ্গীকরণ। চন্দন সেনের নাটক। প্রথম শো দেখে আমার ততটা ভাল লাগেনি। জানিয়েছিলাম। পরে আবার দেখতে বললেন। বুঝলাম মেঘনাদের আত্মবিশ্বাস কত গভীরে। দেখে আবার আগের মত পরিবর্তন হয়েছে। দামিনী হে নাটকের রুদ্ধ দ্বার শো হয়েছিল মোহিত মৈত্র মঞ্চে। সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত এবং অন্যান্য অনেকেই ছিলেন। শো শেষ হলে, মেঘনাদ আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। বিরতির আগের দৃশ্যটি আমার পছন্দ হয়নি। আমি বললাম। মেঘনাদ চুপ করে শুনলেন। কোনো মন্তব্য করেননি। আমার বন্ধু নাটক-পাগল সমীর চট্টোপাধ্যায় আমাকে বললেন, তুই বলে দিলি ওই ভাবে!
আমি বললাম, মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে আমার স্পষ্ট সম্পর্ক। খোলাখুলি কথা বলার সম্পর্ক। ভালবাসার এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক। তিনদিন বাদে মেঘনাদ আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন, আমার প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভেবেছেন ক’দিন ধরে, বিরতির দৃশ্যটি নতুন করে ভেবেছেন। নাট্যকারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বদলেছেন। বললেন, লেখকই তো কাহিনির স্রষ্টা, তাঁর মতামতের গুরুত্বই প্রধান। আমাদের দুজনের বন্ধুতা আর সম্পর্কের ভিতর পারস্পরিক শ্রদ্ধা অনেক। মেঘনাদ ভট্টাচার্য আমার লেখার পাঠক। এমন পাঠক অর্জন একজন লেখকের স্থায়ী অর্জন।
দামিনী হে নাটকের রিভিউ হয়েছিল এক সুখ্যাত পত্রিকায়। সেখানে কাহিনি- কারের ভূমিকাকে খুব খাটো করা হয়েছিল। নাটকের অসম্ভব সুখ্যাতিও হয়েছিল। সমালোচক জানতেন না, ‘আকাল’ গল্পের সঙ্গে অন্য কাহিনি যা মিশেছে, সবই এক লেখকের। সেই রিভিউ পড়ে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। মেঘনাদেরও মনে হয়েছিল লেখককে খামোকা ছোট করা হয়েছে। তবু ওঁর সঙ্গে আমার বাক্য বিনিময় সুশৃঙ্খলতায় হয়নি সেদিন। আমি বোধহয় বলেছিলাম, আমার আর দরকার নেই থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার। খামোকা নিন্দিত হতে যাব কেন? এবং কথাটি অসত্য তো নয়। নাটকের সমালোচনায় কাহিনিকারের গুরুত্ব ছোট করে দেখা হবে কেন? আমি আর থিয়েটারে আমার গল্প বা উপন্যাস দেব না। ঠাণ্ডা মাথার মেঘনাদ ভট্টাচার্য চুপ করে শুনেছিলেন। প্রত্যুত্তর দেননি। আমাকে ভালবাসেন আমার লেখাকে ভালবাসেন, তাই চুপ করে ছিলেন। তারপর অবশ্য সমালোচক একটি চিঠি দিয়েছিলেন ঐ পত্রিকায়। তা ছাপা হয়েছিল। এই ঘটনা ব্যতিক্রমী বলেই চিহ্নিত মনে হয়। ওখানেই ইতি হয়েছিল মতান্তরের। কিন্তু আরো পরে তাঁর সেই সমালোচনা তিনি ছেপেছিলেন এক সংকলনে, তাতে চিঠিটি ছিল না। আমার বিরক্ত লেগেছিল। অবশ্য এর পরে বহুল প্রচারিত একই সংবাদপত্রে ঐ নাটকের দুটি রিভিউ প্রকাশিত হয়, তার একটিতে সাহিত্যের এক প্রখ্যাত প্রাক্তন অধ্যাপক-সমালোচক গলপকারের নামই উচ্চারণ করেননি। আমি আর এই নিয়ে কথা বলিনি। মনে হয়েছিল ওঁর উচ্চারণ-অনুচ্চারণে কীই বা হতে পারে? প্রতি বিজ্ঞাপনে সায়ক আমার নাম ব্যবহার করে। সায়ক আমাকে প্রতি বিজ্ঞাপনেই যেন আমাকে সম্মানিত করে। প্রতি শো আরম্ভ হয় লেখক এবং নাট্যকারের নাম উচ্চারণ করে। এ খুব বড় পাওয়া। তবে একটা কথা উচ্চারণের প্রয়োজন, গল্পের নাট্যরূপ আর নাটক লেখা এক নয়। সমালোচক এই কথা কি জানেন না? জানেন নিশ্চয়। তবু কেন…? শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে ৮০-র দশকের প্রথমে একটি নাটক হয়েছিল, বিখ্যাত এক নাট্যদল প্রথম দুয়েকটি শো-এর পর আর তাঁর নাম উচ্চারণ করত না। অদ্য শেষ রজনী নাটক এর বিজ্ঞাপন তারই বিপরীত। শ্যামল সেখানে বারংবার উচ্চারিত, বিজ্ঞাপনে এবং নাট্যারম্ভে। ব্রাত্য বসু শ্যামলদার অসম্ভব অনুরাগী। তাই সেই তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই বিষাদের অবসান ঘটেছে। আমিও যে শ্যামলের অন্ধ অনুরাগী। তখন আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। আমার একটি গল্প নিয়ে পরম শ্রদ্ধেয় এক নট ও নির্দেশক একটি নাটক করেছিলেন। ২৫-৩০টা শো হয়েছিল। এখন হয় কি না জানি না। রবীন্দ্র সদন মঞ্চে দেখতে গিয়েছিলাম এক আত্মজনকে নিয়ে। পোস্টার থেকে নাট্যারম্ভ-কোথাও আমার কথা বলা হয়নি। বিষণ্ণ হয়ে ফিরে এসেছিলাম। আমার আত্মজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কই তোমার নাম তো কোথাও নেই। কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রর অশ্বচরিত নাটকে আমি ছিলাম প্রতি শো আর বিজ্ঞাপনে উচ্চারিত। লেখকের প্রাপ্তি তো এইটুকু। মঞ্চে থাকেন অভিনেতা। লেখক পর্দার আড়ালের মানুষ, যেমন নির্দেশক, আলো ও মঞ্চ শিল্পী এবং নাটককার।
দামিনী হে নাটকে বহুদিন বাদে বাংলা থিয়েটারে নিম্নবর্গের মানুষের জীবন এসেছিল। অসম্ভব ভালো নাটক এবং প্রযোজনা। কোথাও কোথাও আমার ‘না’ ছিল বটে, কিন্তু গল্প উপন্যাস আর নাটক তো এক নয়। আলাদা মাধ্যম। সুতরাং অদল বদল হয়। শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তর পৌত্রী, সুরঞ্জনা-কন্যা কথাকলি দেব অভিনয় করেছিলেন মনে রাখার মতো। মেঘনাদ ভট্টাচার্য নিজে উঁচু দরের অভিনেতা। তিনি অভিনয় করিয়ে নিতেও জানেন। পিঙ্কি বুলির দুই কন্যা কিংবা দামিনী হে নাটকের দামিনী বা জাবালির অভিনয় আমার মনের ভিতরে স্থায়ী আসন পেতে আছে। মেঘনাদ এ পর্যন্ত আমার গল্প নিয়ে তিনটি নাটক নির্মাণ করেছেন। ভেবেছিলাম এখানেই থামবেন। গত বছর, ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শারদীয় বর্তমান পত্রিকায় একটি উপন্যাস লিখেছিলাম ‘পুনরুত্থান’। পড়তে অনুরোধ করেছিলাম। পড়ে গভীর রাতে ফোন করেছিলেন। দিন পনের বাদে আবার ফোন, পুনরুত্থান নিয়ে ভাবছেন। নাটক হবে আবার। সেই নাটক লেখা হচ্ছে চন্দন সেন মহাশয়ের হাতে। হয়তো হবে। নাটক কোন ফর্মে হবে, দৃশ্য বিন্যস্ত হবে কীভাবে, তা একদিন ফোনে আমাকে শোনালেন মেঘনাদ। ৪০ মিনিট ফোন। এই নাটক যদি ঐ ফর্মে আসে মঞ্চে, মেঘনাদের হাতে তা অন্য মাত্রায় পৌঁছবে। আমার বিশ্বাস তাই। কিন্তু শেষ অবধি পুনরুত্থান নিয়ে আমি কিছু আপত্তি জানিয়েছিলাম। মেঘনাদ সেই কথায় মান্যতা দিয়েছেন। পুনরুত্থান, আমার চার কাহিনি মঞ্চে নিয়ে এসেছেন মেঘনাদ। বিরল সম্মান। এমন কি হয়েছে আগে কারোর? থিয়েটারের আমি ছিলাম শুধুই দর্শক, এখন তার অংশ হয়েছি এই ভাবে। মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে আমার বন্ধুতা চিরজীবী হোক। সায়ক আমাকে শিশিরকুমার সম্মান দিয়েছে। নাট্য দলের কাছ থেকে একজন গল্প উপন্যাসের লেখক সম্মানিত হচ্ছেন, এও প্রায় বিরল ঘটনা। তবে সায়ক তা আগেও করেছে। বিমল কর এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এই সম্মান দিয়েছিল। সাহিত্যের কাছেই সায়ক বারবার যায় নাটকের সন্ধানে। মেঘনাদ যান। কারণ তিনি সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক। নমস্কার মেঘনাদ। বড় নট, নির্দেশক আমার বন্ধু, এও এক দুর্লভ পাওয়া।
পুনশ্চ: ক’বছর আগে একটি নাটক লিখেছিলাম ব্রাত্যজন নাট্যপত্রে। সেই নাটক মেঘনদ ভট্টাচার্যর পরামর্শে কতবার বদল করেছি যে তার হিসেব নেই। দৃশ্য ধরে তিনি আমাকে দিয়ে আবার লিখিয়েছেন। এই কাজটি বন্ধুতার স্মারক হয়ে থাকবে। নাটকের নাম “শেষ পাহাড় অশ্রুনদী”। নতুন করে দৃশ্য বিন্যাস সবই তাঁর পরামর্শে। ঐটিই আমার জীবনের প্রথম নাটক।