মেঘনাদবধ-কাব্যের নারী-চরিত্র
মেঘনাদবধ কাব্যের নারী-চরিত্র; চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরী; প্রমীলা—প্রেমের নূতন আদর্শ; সীতা—অপর আদর্শ।
এইবার আমরা এ কাব্যের কল্পনা ও কবিশক্তির আর এক দিক লক্ষ্য করিব : কবিমানসের উচ্চাকাঙ্ক্ষা—স্বর্গ-মর্ত্য-রসাতল, দেব-দেবী ও মনুষ্যবীরের কাহিনী রচনার যে আগ্রহ—তাহারই সঙ্গে, কবিপ্রাণের অতিশয় পরিচিত ঘনিষ্ঠ বস্তুর রসরূপকে এই ঘনঘটাময়ী কাব্য-প্রদর্শনীর মধ্যে সন্নিবিষ্ট করিবার যে সফল প্রয়াস—তাহার কথা বলিব, অর্থাৎ ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র নারীচরিত্রগুলির প্রতি আমাদের বিস্ময়-দৃষ্টির কারণ আলোচনা করিব। এবার আমাদিগকে ভুলিতে হইবে যে, আমরা এক পৌরাণিক-আখ্যানঘটিত মহাকাব্য পড়িতেছি—উত্তাল সাগর-তরঙ্গে দুলিতে দুলিতে জলকল্লোল অথবা ঝটিকার ভেরী-রব শুনিতেছি। সত্যকার কবিদৃষ্টির মূলে বাস্তবের রসপ্রেরণা থাকিবেই—যদি সে প্রতিভা সৃষ্টি-প্রতিভা হয়; তাই, অতি উর্দ্ধগ কল্পনার সার্ব্বভৌমিকতার মধ্যেও কবির স্বকীয় ব্যক্তি-জীবনের অভিজ্ঞতা, জাতি ও জন্মগত ভাব-সংস্কার লুপ্ত হয় না; তাহা হইলে কবির সৃষ্টি-কৰ্ম্ম অমূলক হইয়া থাকে। ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র কল্পনায় কবি যেন আপনাকে একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছেন বলিয়া মনে হয়; যেন তিনি কল্পনার সত্য ছাড়া আর কোন সত্য মানিবেন না—রামায়ণের কাহিনীকে আপনার কবিপ্রবৃত্তির বশে আনিবার জন্য, তিনি যেন কোন সংস্কারকে মনে স্থান দিতে প্রস্তুত নহেন; যেন একমাত্র কাব্যের অধিকারকেই বিস্তৃত করিবার জন্য তিনি এক প্রশস্ত পটভূমিকার উপরে, রাজা ও রাজ-ঐশ্বর্য্য, বীরধর্ম্ম ও বীরকীর্ত্তি, বিপুল উদ্যম ও দারুণ ব্যর্থতার মহনীয় চিত্র অঙ্কিত করিবার উৎসাহে লেখনী ধারণ করিয়াছেন। কিন্তু সে কল্পনারও অন্তস্তলে—পার্বত্য মহারণ্যের দিগন্তপ্রসারী শাখা-প্রশাখার ফাঁকে ফাঁকে জলজ কুসুম—শোভার মত—–বাস্তবজীবনের সরস সহজ সুষমার প্রতি অনুরাগ উঁকি দিয়াছে; রাবণের স্বর্ণালঙ্কার মণিমাণিক্যকঠিন আস্তরণ ভেদ করিয়া বঙ্গমৃত্তিকার সরস শ্যামল কুঞ্জবিতান স্বচ্ছন্দে ও সহাস্যে আপনার কোমল তনু-লতিকা উচ্ছ্ৰিত করিয়াছে। মধুসূদন তাঁহার দুরারোহিণী কল্পনাকেও এই মৃত্তিকার মোহ ত্যাগ করাইতে পারেন নাই, বরং তাহাকে অসঙ্কোচে প্রশ্রয় দিয়াছেন। তাঁহার চক্ষে, যেন নারী মাত্রেই বঙ্গনারী—শিশুর চক্ষে যেমন সকল নারীই তাহার মা, তেমনই ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’ যেখানেই নারীর সাক্ষাৎ পাই, সেখানেই দেখি, কবির কল্পনা, চরিত্র-চিত্রণে বা রূপ-বর্ণনে, তাহার নিজের ঘরের প্রতিমাগুলিকে ছাড়িয়া এক পাও বাহিরে অগ্রসর হইবে না, সেজন্য সময়ে সময়ে আমাদেরও লজ্জা হয়। লঙ্কার পুরনারীদের বর্ণনায়, কবি বাংলাদেশেরও বাহিরে যাইতে রাজি নহেন—যদিও তিনি বহুকাল দক্ষিণ ভারতে বাস করিয়াছিলেন— নহিলে, তাহাদেরও কক্ষে কলস দেখিবেন কেন?
রাক্ষসবধূ মৃগাক্ষীগঞ্জিনী
দেখিলা লক্ষ্মণ বলী সরোবর কূলে,
সুবর্ণ কলসী কাঁখে, মধুর অধরে
সুহাসি!
সরমাও সীতাকে সিঁদুর পরাইবার আগে যাহা বলিতেছে, তাহা ভারতের আর কোন এক দেশের সধবা আর এক সধবাকে নিশ্চয় বলে না—
আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া
সিন্দূর, করিলে আজ্ঞা সুন্দর ললাটে
দিব ফোটা।—এয়ো তুমি তোমার কি সাজে
এ বেশ!
—’এয়ো তুমি’—রাক্ষসবধূ সরমার কথাই বটে। সীতাও একেবারে খাঁটি বঙ্গবধূ, পূর্ব্বকথা বলিবার সময়ে এক স্থানে সরমাকে বলিতেছেন—
আবরি বদন আমি ঘোমটায় সখি,
করপুটে কহিনু…..
—এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। কিন্তু বাহিরের এই রূপ, বেশবাস ও আচারের বর্ণনাতেই নয়, এ কাব্যের যে কয়টি প্রধান নারী চরিত্র—এমন কি, এ কাব্যের নায়িকা বীরাঙ্গনা প্রমীলাও, চরিত্রের মাধুর্য্যে ও মহিমায় খাঁটি বঙ্গনারী। মধুসূদন মাতৃভাষায় কাব্য লিখিতে বসিয়া যেন তাঁহার নিজের মাতৃজাতিরও বন্দনা করিয়াছেন; বস্তুত, এ কাব্যে যে মানবতার নিগূঢ় প্রেরণা অপর সকল বাসনাকে পরাভূত করিয়াছে, তাহারও একটা কারণ ইহাই বলিয়া মনে হয়। তাই হোমারের বীর-গাথা ও মিল্টনের অমর্ত্য-গীতরাগ তাঁহাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করিলেও তিনি সে প্রলোভন দমন করিয়াছিলেন; এবং এইজন্যই সৰ্ব্ববিধ বিজাতীয় ভাব ও আলঙ্কারিকতা সত্ত্বেও, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ খাঁটি বাংলাকাব্য হইয়াছে; ভাবে যেমন বীররসকে ছাপাইয়া করুণরসই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, ভাষাতেও তেমনই সুগম্ভীর সংস্কৃত সাধুশব্দকে কিছুমাত্র ভূক্ষেপ না করিয়া, যেখানে সেখানে খাঁটি মাতৃভাষার অসংস্কৃত বুলি তাহাদের পাশে আসিয়া বসিয়াছে, অতিশয় গম্ভীর বাক্যধ্বনির নিরবচ্ছিন্ন স্রোতে কবির প্রাণ যেন স্বস্তি পাইতেছে না। কল্পনার উত্তুঙ্গ-নির্জ্জন শিখর হইতে নামিয়া তিনি যেন নিম্নভূমির শষ্পশ্যামল তটিনীতটে—যেখানে হৃদয়-যমুনার তল-তল ছল-ছল বারিরাশিতে নরনারীর গাহন, সন্তরণ ও নিমজ্জন—লীলা চলিতেছে—সেইখানে বিচরণ করিতেই উৎসুক। কবি নিজেই তাঁহার পত্রাবলীর এক স্থানে লিখিতেছেন—
He who is beautiful, tender and pathetic with a dash of sublimity is sure to float down the stream of time in triumph.
সেই সঙ্গে মিল্টনের মহাকাব্য সম্বন্ধে বলিতেছেন—
He is full of lofty thoughts, but has little or nothing that can be called amiabe, *** His is the deep roar of the lion in the silent solitude of the forest.
মজার এই কথাগুলিতেই ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র কাব্য-প্রকৃতির সঠিক পরিচয় আছে। Beautiful, tender and pathetic— এইগুলিই আসল; কেবল, তাহার সহিত sublimity বা ভাবগাম্ভীৰ্য্য চাই; প্রথম কয়টিতেই মূল রস, শেষেরটি তাহাদিগকে উজ্জ্বল করিবার উপায় মাত্র। ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র কাহিনীর ঘনঘটা ও বর্ণনার বিপুল আয়োজন, যেন মেঘচুম্বী পৰ্ব্বতমালার মত, ভাবের একটি করুণ-কোমল স্বচ্ছ-সুন্দর কমল-হ্রদকে বেষ্টন করিয়া আছে। এ কাব্যে যাহা কিছু beautiful, tender and pathetic, তাহার আলম্বন হইয়াছে এই নারীচরিত্রগুলি—সেই মীলিত ও মুদিত কমলদলের শোভা ও সৌরভে মুগ্ধ হইয়া, কবির কল্পনা-মধুকরী স্বচ্ছন্দে ও পূর্ণতানে গুঞ্জন করিয়াছে। আমরা অতঃপর এই গুঞ্জনের গীতি-কৌশল একটু পরীক্ষা করিয়া দেখিব।
এ কাব্যের নারী-চরিত্রগুলির মধ্যে সীতা ও প্রমীলাই প্রধান, এবং সাধারণতঃ এই দুইটিই কবির কবিশক্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে। এরূপ ধারণা যথার্থ বটে; কিন্তু, রসনা-রস-বিচারে আমরা যেমন প্রচুর মশলা-সুগন্ধি ঘৃতপক মূল্যবান ভোজ্য এবং পায়স-পিষ্টককেই পাকশিল্পের পরাকাষ্ঠা বলিয়া মনে করি, এবং অতি সহজেই তাহার প্রশংসা করিয়া থাকি,—কিন্তু তাহারই সঙ্গে অপর যে দুইচারিটি অতি সুলভ তুচ্ছদর্শন বস্তুও থাকে, তাহার প্রতি তেমন মনোযোগ করি না; অথচ সেই সুলভ ও স্বল্প উপকরণে প্রস্তুত ব্যঞ্জনের মৃদু ও বিশিষ্ট স্বাদই যে প্রকৃত পাকনৈপুণ্যের পরিচায়ক, তাহা বুঝিবার অবকাশ প্রায়ই হয় না; তেমনই, কল্পনার উচ্চতা ও বিষয়বস্তুর অসাধারণত্বে মুগ্ধ আমাদের মন, সূক্ষ্মতর সৃষ্টিকে সুলভ ও সাধারণ ভাবিয়া তাহার তেমন আদর করে না। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ হইতেই আমি তাহার প্রমাণ দিব। সে কাব্যের সীতা ও প্রমীলা, এই দুই মহত্তর সৃষ্টির আলোচনা করিবার পূর্ব্বে, আমি দুইটি ক্ষুদ্রতর সৃষ্টি—রাবণের দুই মহিষী, চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরীর—চরিত্র-চিত্রণে কবির নৈপুণ্যের পরিচয় দিব।
চিত্রাঙ্গদাকে আমরা কাব্যে একবার মাত্র দেখিতে পাই, সেই একবারের যে দেখা তাহাতেই চিত্রাঙ্গদার সেই মূৰ্ত্তি আকস্মিক বিদ্যুদ্দীপ্তির মত আমাদের নেত্রপটে মুদ্রিত হইয়া যায়। রাবণের বিরাট রাজসভা মধ্যে পুত্রশোকাতুরা রোরুদ্যমানা বীরবাহু-জননী সখীগণ সঙ্গে প্রবেশ করিল। সেই অবস্থাতেও কবি তাহার যে রূপলাবণ্যের আভাস দিয়াছেন, তাহাতে বুঝি, সে রাবণের মহিষী হইলেও এখনও বিগতযৌবনা নহে।—
আলুথালু হায় এবে কবরী বন্ধন!
আভরণহীন দেহ, হিমানীতে যথা
কুসুমরতনহীন বন-সুশোভিনী
লতা! অশ্রুময় আঁখি নিশার শিশির—
পূর্ণ পদ্মপর্ণ যেন!….
এই চিত্রাঙ্গদা রাবণের একাধিক মহিষীর একজন, এবং রাবণের সহিত তাহার বয়সের ব্যবধানও অল্প নহে। বহুপত্নীক স্বামীর প্রতি এরূপ পত্নীর যেরূপ মনোভাব হইয়া থাকে, তাহা আমরা জানি। আজ রাবণের মত পুরুষের সম্মুখে এই অতিশয় অসমবয়সী স্নেহানুগ্রহধন্যা নারীর সেই অভ্যস্ত আচরণও বিচলিত হইয়াছে। স্বামী নয়—পুত্রই ছিল যাহার একমাত্র আপন বস্তু, আজ সেই পুত্রের বিয়োগে তাহার অন্তর ও বাহিরের সকল আৰু যেন খসিয়া গিয়াছে। পুত্রশোকে অধীর হইলেও রাবণ সিংহাসনে রাজমহিমায় আসীন, সেই সিংহাসনের তলে দীন প্রজার মত দাঁড়াইয়া চিত্রাঙ্গদার এই যে অভিযোগ—
একটি রতন মোরে দিয়াছিল বিধি
কৃপাময়; দীন আমি থুয়েছিনু তারে
রক্ষাহেতু তব কাছে রক্ষঃকুলমণি,
তরুর কোটরে রাখে শাবক যেমতি
পাখী! কহ কোথা রেখেছ তাহারে
লঙ্কানাথ? কোথা মম অমূল্য রতন?
দরিদ্রধন-রক্ষণ রাজধৰ্ম্ম; তুমি
রাজকুলেশ্বর, কহ কেমনে রেখেছ,
কাঙ্গালিনী আমি, রাজা, আমার সে ধনে?
—তাহাতে চিত্রাঙ্গদার শুধুই শোক নয়, তাহার সমগ্র জীবন—স্বামীর সহিত তাহার সম্পর্ক, তাহার অসহায় একক অবস্থার দুঃখ, মুহূর্ত্তে আমাদের হৃদয়গোচর হয়। রাবণের বিশাল পুরীতে এই অবহেলিতা নারীর একটি মাত্র সম্বল ছিল—তাহার সেই পুত্র। রাবণের সুখ-দুঃখ তাহার সুখ-দুঃখ নয়—পুত্রের মৃত্যুতে তাহার যাহা হইয়াছে, তাহাতে স্বামীর সহিত ব্যবধান কিছুমাত্র ঘুচে নাই। তাই, রাবণ যখন বলিয়া উঠে—
এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে।
শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবানিশি।
তখনও সে স্বামীকে সমদুঃখে দুঃখী মনে করে না, বরং ইহাই ভাবিয়া আরও অধীর হয় যে, শতপুত্র যাহার—একমাত্র পুত্রের মৃত্যুশোক সে বুঝিবে কেমন করিয়া? সে সত্যকার রাজমহিষী নয়—রাজ্যের মঙ্গল অমঙ্গল সে বোঝে না, রাবণের ভাবনার অংশভাগিনী সে নয়; তাই দেশরক্ষার্থে বীরপুত্র প্রাণ দিয়াছে, এ সান্ত্বনা তাহার সান্ত্বনা নয়। নিজের পুত্রহানির মর্মান্তিক ক্ষোভে, রাবণের উপস্থিত বিপদ তাহাকে কিছুমাত্র ব্যাকুল করে না; রাবণের শোকেও তাহার সহানুভূতি নাই। যাহার জন্য তাহার সর্ব্বস্ব গিয়াছে, সেই রাবণের কোনও সান্ত্বনা-বাক্যে সে আশ্বস্ত হইবে না; রাবণের পাপকেই সে বড় করিয়া দেখিতেছে। বিধাতার ন্যায়দণ্ডকে বুক পাতিয়া লইবার মত ধীরতা, কিম্বা তাহার আঘাতে পাপীর যে যন্ত্রণা, তাহা নিজেরও বক্ষে অনুভব করিবার মত প্রেম—কোনটাই তাহার নাই। তাই শোকে মুহ্যমানা বিবশা রাবণ-বধূর অশ্রুসিক্ত মুখমণ্ডলে যেন বিধাতার রোষানলকেই প্রদীপ্ত হইতে দেখি; যখন তাহার মুখে এই জ্বালাময় বাক্যস্রোত বহির্গত হয়—
কিন্তু ভেবে দেখ নাথ, কোথা লঙ্কা তব;
কোথা সে অযোধ্যাপুরী? কিসের কারণে,
কোন্ লোভে, কহ, রাজা, এসেছে এ দেশে
রাঘব? এ স্বর্ণলঙ্কা দেবেন্দ্রবাঞ্ছিত,
অতুল ভবমণ্ডলে; ইহার চৌদিকে
রজতপ্রাচীর-সম শোভেন জলধি।
শুনেছি সরযূতীরে বসতি তাহার—
ক্ষুদ্র নর। তব হৈম সিংহাসন আশে
যুঝিছে কি দাশরথি? বামন হইয়া
কে চাহে ধরিতে চাঁদে? তবে দেশ-রিপু
কেন তারে বল, বলি? কাকোদর সদা
নম্রশির, কিন্তু তারে প্রহারয়ে যদি
কেহ, উর্দ্ধ-ফণা ফণী দংশে প্রহারকে।
কে, কহ, এ কাল—অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে? হায়, নাথ, নিজ কর্ম্মফলে
মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলে আপনি।
—তখন জীবনের একটা মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতা, এবং নারী-পুরুষঘটিত সংসারনাট্যের একটি নিদারুণ পরিহাস-রস যেমন আমাদিগকে অভিভূত করে, তেমনই এই একটি মাত্র দৃশ্যের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে, একটি নারীর জীবন ও চরিত্র অতি গভীর রেখায় পরিস্ফুট হইয়া উঠে; রাজগৃহবন্দিনী রূপসী চিত্রাঙ্গদার দুঃখ ও অভিমান, স্বামীস্নেহবঞ্চিতা পুত্রহারা রমণীর নৈরাশ্যপীড়িত তেজস্বিনী-মূর্ত্তি—তাহার সেই অশ্রুপ্লাবিত করুণ-সুন্দর চক্ষে আহত নারী-হৃদয়ের বহ্নিবিভাস—আমাদের মানসপটে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠে।
এই চরিত্রের পাশে মন্দোদরীকে দাঁড় করাইলে, উভয় চরিত্র, মর্ম্মর-শিল্পীর মূর্তি—রচনার মত, আকারে, আয়তনে ও ডৌলে বিলক্ষণ ও সুপরিচ্ছন্ন হইয়া উঠে। মন্দোদরী রাবণের জ্যেষ্ঠা মহিষী, পাটরাণী; সে তাহার সহধর্মিণী—ধর্মসাধন ভার্য্যা। মন্দোদরী শুধুই পুত্রের জননী নয়, রাবণের গৃহিণী; সমস্ত রাক্ষস-পুরী ও রাক্ষস-পরিবারের কল্যাণ-চিন্তা, রাজ্যের শুভাশুভ, স্বামীর সম্পদ-বিপদের ভাবনা তাহাকে ভর্তিণীযোগ্য গুরুভার মহিমায় মহিমান্বিত করিয়াছে। রাবণ যেমন লঙ্কেশ্বর, সেও তেমনই লঙ্কেশ্বরী। মন্দোদরীর মূর্তিও পূর্ণ মাতৃত্বের মূর্তি, তাহার বাৎসল্য সহজ শান্ত ও আত্মতৃপ্ত। পুত্রের কল্যাণ কামনায় শিবের আরাধনা করিয়া মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতেছে—এই অবস্থায় মন্দোদরীর সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ, এবং মেঘনাদ যুদ্ধে যাইবার পূর্ব্বে মাতৃপদ বন্দনা করিয়া বিদায় লইতে আসিয়াছে, ইহাই তাহার উপলক্ষ্য। পুত্র ও পুত্রবধূর শিরশ্ছম্বন করিয়া সে যখন তাহাদিগকে আলিঙ্গন করিল, মন্দোদরীর তখনকার সেই রূপ কবি কেবল একটিমাত্র উপমায় বর্ণনা করিয়াছেন, তাহার রূপের আর কোন বর্ণনা কবি করেন নাই। সে কেমন রূপ? —
শরদিন্দু পুত্র, বধূ শারদ কৌমুদী,
তারাকিরীটিনী-নিশিসদৃশী আপনি
রাক্ষসকুল-ঈশ্বরী!
—এ উপমার আলঙ্কারিক মৌলিকতা যেমনই হউক, এ চিত্রে তাহার যে ধ্বনিব্যঞ্জনা ঘটিয়াছে, মাতৃত্বের যে বিশাল গম্ভীর মহনীয়তা—সেই স্নেহের যে উদার মধুর রহস্যময়তা ইহাতে সূচিত হইয়াছে, তাহাতে বোধ হয় এই উপমার এমন সার্থক প্রয়োগ আর কোথায়ও হইতে পারিত না। চিত্রাঙ্গদা শোকার্তা জননী হইলেও তাহার রূপে নায়িকার লক্ষণ আছে। এ রূপ ‘তারাকিরীটিনীনিশিসদৃশী’—কালিদাসের ‘স্ফুটচন্দ্রতারকা বিভাবরী’ নয়; কারণ, ইহার যৌবন—ইহার চন্দ্র ও জ্যোৎস্না-এক্ষণে পুত্র ও পুত্রবধূতে বৰ্ত্তিয়াছে। মন্দোদরীর এখন সেই বয়স, যে বয়সে জননীরূপিণী নারী কেবল মাতৃত্বের সুখে ও গৌরবে সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত—যেন তাহার পাইবার আর কিছুই নাই, এখন কেবল দিবার পালা আসিয়াছে, স্বামীর নিকটেও আর কোন স্বার্থের দাবি নাই। এই মন্দোদরী—চরিত্রে কবি সেকালের খাঁটি বাঙালী-মায়ের ছবি আঁকিয়াছেন—একেবারে বাঙালীর মা। স্নেহের নির্বুদ্ধিতায়, বয়স্ক পুত্রের বুদ্ধি ও শক্তির উপরে নিরতিশয় শ্রদ্ধায়, তাহার দুঃসাহসের জন্য একই কালে গর্ববোধ ও আশঙ্কায়, পুত্রের বিপদ ঘটাইয়াছে বলিয়া জগৎসুদ্ধ সকলের উপর দোষারোপে, এবং ব্রত উপবাস দ্বারা সেই বিপদ কাটাইবার জন্য আহারনিদ্রাত্যাগে—এ চরিত্র মধুসূদনের প্রত্যক্ষ-দৃষ্ট বলিয়া মনে হয়। মন্দোদরী মেঘনাদকে বলিতেছে—
দুরন্ত লক্ষ্মণ শূর, কালসর্প সম
দয়াশূন্য বিভীষণ।**
কুক্ষণে, বাছা, নিকষা-শাশুড়ী
ধরেছিলা গর্ভে দুষ্টে, কহিনু রে তোরে!
এ কনক-লঙ্কা মোর মজালে দুম্মতি।
হায় বিধি, কেন না মরিল
কুলক্ষণা শূর্পনখা মায়ের উদরে?
—’এ কনক-লঙ্কা মোর’— এখানে মন্দোদরীর মুখে এই একটি কথা ‘মোর’ সমগ্র লঙ্কাপুরীর সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ—শুধুই কর্তৃত্বের নয়, তাহার মমত্বের অধিকার ব্যক্ত করিয়াছে; এমন কথা চিত্রাঙ্গদার মুখে কখনও আসিত না। চিত্রাঙ্গদার মাতৃস্নেহও এমন অবুঝ নয়, সে প্রখরবুদ্ধিমতী; অথবা, সে স্বামীস্নেহে এত অন্ধ নয় যে, লঙ্কার সর্ব্বনাশের জন্য রাবণ ছাড়া আর কাহাকেও দায়ী করিবে। একজন সংসারকে বুকে জড়াইয়া এবং আপনাকেও সেই সংসারে বিলাইয়া দিয়া, স্নেহ ও প্রেমের দাবি ছাড়া আর কিছুই জানে না। আর এক জনের আত্মসচেতনতা এখনও অটুট; বিবেক ও বুদ্ধির স্বাতন্ত্র্যে সে চরিত্র আপনাকে হারায় না–প্রেম বা স্নেহের আত্মবিগলিত অবস্থার গদগদ ভাষা বা প্রলাপ-বাণী তাহার পক্ষে অসম্ভব। এমন মাকে ভয় পাওয়ানো বা আশ্বস্ত করা দুই সহজ, তাই মায়ের প্রাণ যখন আসন্ন পুত্ৰবিয়োগ-ঘটনা যেন অজ্ঞাতে জানিয়াই অধীর হইয়াছে মেঘনাদ যাহা লক্ষ্য করিয়া বলিতেছে—
কি হেতু
সভয় হইলা আজি, কহ মা আমারে?
এবং মন্দোদরী তাহার আর কোন কারণ দেখাইতে না পারিয়া বলিতেছে— মায়াবী মানব, বাছা, এ বৈদেহী-পতি,
নতুবা সহায় তার দেবকুল যত!
নাগপাশে যবে তুই বাঁধিলি দুজনে
কে খুলিল সে বন্ধন? কে বা বাঁচাইল
হয়া এবং নিশা-রণে যবে তুই বধিলি রাঘবে
সসৈন্যে? এ সব আমি পারি না বুঝিতে!
—তখন মেঘনাদ তাহার ভয় দূর করিতে না পারিয়া শেষে বড় বুদ্ধি করিয়া বলিল—
বিখ্যাত রাক্ষসকুল, দেবদৈত্য নর—
ত্রাস ত্রিভুবনে দেবি! হেন কুলে কালি
দিব কি রাঘবে দিতে, আমি, মা, রাবণি
আশার বার ইন্দ্রজিৎ? কি কহিবে, শুনিলে এ কথা
মাতামহ দনুজেন্দ্র ময়? রথী যত
মাতুল?
মেঘনাদ জানে—রাবণি ইন্দ্রজিৎ’ এবং ‘মাতামহ দনুজেন্দ্র ময়, রথী যত মাতুল’ এক সঙ্গে এই দুই বাক্য এ ক্ষেত্রে কত অমোঘ। পতিগতপ্রাণা নারীর পক্ষে পতিকুলমর্য্যাদা পিতৃকুলমর্য্যাদার চেয়ে অধিক; আবার, পিতার নিকটে কন্যার বীরপুত্রবতী হওয়ার গৰ্ব্বও কম নয়। তাহা ছাড়া, ‘রাবণি ইন্দ্রজিতে’র প্রতি কটাক্ষ করিবে তাঁহার পিতৃকুল! মন্দোদরীর মাতৃত্ব ও পত্নীত্ব এই দুইয়েরই সম্পূর্ণ চিত্র এখানে কত সংক্ষেপে অঙ্কিত হইয়াছে! কিন্তু এই দৃশ্যের সর্ব্বশেষে কবি মন্দোদরীর মুখে যে কথাটি দিয়াছেন, তাহাতেই এই মাতৃচরিত্রের—মাতৃ-হৃদয়ের চিত্র যেন শেষ রেখায় সম্পূর্ণ হইয়াছে। পুত্র যখন যাইবেই, তখন—
“কাঁদিয়া মহিষী
কহিলা চাহিয়া তবে প্রমীলার পানে,–
“থাক, মা, আমার সঙ্গে তুমি; জুড়াইব
ও বিধবদন হেরি এ পোড়া পরাণ!
বহুলে তারার করে উজ্জ্বল ধরণী।”
—কবি এখানে পুত্রস্নেহাতুরা জননীর মর্ম্মস্থল উদ্ঘাটিত করিয়াছেন।
পরবর্তী সর্গে মন্দোদরীর এই মাতৃত্বের সহিত পত্নীত্বের যে অপূর্ব্ব মিলন দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতেও বর্ণনা নাই, বক্তৃতা নাই। পুত্র মেঘনাদের মৃত্যুতে তাহার যে শোক, তাহা স্বামী রাবণের শোকের সহিত মিলিয়া যেন স্তম্ভিত হইয়া আছে। সে শোক চিত্রাঙ্গদার শোকের মত একার শোক নয়, তাই তাহা একেবারে সান্ত্বনাতীত নহে; এবং তাহাতে কাহারও প্রতি অভিযোগের মর্ম্মদাহ নাই বলিয়া তাহা নিৰ্ব্বাক। যখন শোকে অধীর হইয়া রণমদে মত্ত সাজে রক্ষকুলপতি’, তখন সভাতলে উত্তরিলা রাণী মন্দোদরী * * * রাজপদে পড়িলা মহিষী’। মন্দোদরী আর কিছুই করিল না—এ যেন সেই দারুণ শোকে হৃদয়ের আশ্রয় প্রার্থনা। তারপরেও আর কিছুই নয়; রাবণের মুখে তাহার হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক কথা শুনিয়া রাণী যেন একটু আশ্বস্ত হইলেন, সখীরা ধরাধরি করিয়া দেবীকে অবরোধে লইয়া গেল। প্রথম সর্গের চিত্রাঙ্গদা ও রাবণ-সংবাদ ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে পুত্রই যেন পতি-পত্নীর মিলিত হৃদয়বৃন্তের ফুল; সে ফুল বৃন্তচ্যুত হইলে কে কাহাকে সান্ত্বনা দিবে? অথবা, পুত্রশোকের বজ্রালোকে দম্পতি যেন আজ আর একবার নূতন করিয়া, আরও গভীর স্নেহে, পরস্পরের মুখাবলোকন করিল—দুর্যোগঝটিকার দারুণ উচ্ছ্বাসে দুই হৃদয়-স্রোতে উতল তলদেশ পৰ্য্যন্ত যুক্ত হইয়া অকূলপ্রসারী মোহানার সৃষ্টি করিল। চিত্রাঙ্গদা এত বড় ভাগ্যবতী নয়—সে কিছুই পায় নাই, যাহা পাইয়াছিল তাহাও হারাইয়াছে; মন্দোদরী সকলই পাইয়াছিল, এবং হারাইয়াও যেন সব হারায় না। মধুসূদন তাঁহার কাব্যের কল্পনাকাশে ঝড়ঝঞ্ঝার যে ঘনঘোর সমারোহ আমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহারই মধ্যে, নিম্নে ধরণীতলে আমাদের অতি সন্নিকটে—গৃহস্থের গৃহবাতায়নে যে দুই একটি দীপশিখাকে অনির্ব্বাণ রাখিয়াছেন, তাহার দিকে চাহিয়া আমাদের দৃষ্টি পিপাসা কম চরিতার্থ হয় না। সীতা ও প্রমীলার পার্শ্বে এই দুইটি নারীচরিত্র নিতান্ত অপ্রধান বলিয়া মনে হইলেও কবি-কল্পনার সমগ্রতার পরিচয় ইহাতেই আছে। কবির সৃষ্টি যে জগৎ, তাহার মূলে আছে এক দৃষ্টি—একটি বীজ হইতেই কাব্যের পূর্ণাঙ্গবিকাশ হইয়া থাকে। কাব্যের বিকাশমুখে চিত্রাঙ্গদা এবং প্রায় শেষে মন্দোদরীর আবির্ভাব; কিন্তু কবির দৃষ্টি এমনই যে, এ দুই চরিত্র, তাহাদের ব্যক্তিত্বে ও বৈশিষ্ট্যে, যেন সেই বীজের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল—কবির দৃষ্টি যখনই যাহার উপরে পড়িয়াছে, তখনই সে স্বরূপে প্রকাশ পাইয়াছে। কাব্যসৃষ্টি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে, সম্মুখ হইতে পিছনে, এবং পিছন হইতে সম্মুখে, যেমন করিয়াই আমরা পর্যবেক্ষণ করি না কেন, দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, কাব্যের সর্ব্বাঙ্গের যেমন সামঞ্জস্য রহিয়াছে, তেমনই প্রত্যেক অঙ্গও আপনার বৈশিষ্ট্যে ও বৈলক্ষণ্যে অপর অঙ্গগুলিকে উজ্জ্বল করিয়াছে। বড় কাব্যে ও ছোট কাব্যে প্রভেদ এই যে, ছোট কাব্যে বা কবিতায় উপকরণ-বাহুল্যের অভাবে, বিচিত্র ও জটিলকে ঐক্যবন্ধনে বাঁধিবার প্রয়োজন হয় না; সেখানে বিষয় বস্তু অতিশয় সামান্য ও সরল—জীবনের বহিঃপ্রকাশের যে বিস্তৃতি এবং জগতের স্থান-কাল-পাত্রভেদের যে অশেষ দ্বন্দ্ব, তাহার প্রতিরূপ সে কবিতায় নাই; সেখানে শেষ পর্যন্ত—বস্তু নয়—ভাবই প্রধান। এ জন্য যে-শক্তি—বৈচিত্র্য, বিরোধ ও বিভেদের মধ্যেই একটি রসরূপের স্থাপনা করে, সেই উৎকৃষ্ট সৃষ্টি-শক্তির পরিচয় তাহাতে নাই। যাঁহারা সকল কাব্যকেই—রূপ নয়, কেবল রসের নিকষে যাচাই করিয়া থাকেন, তাঁহারা কাব্যের লিরিক-নির্য্যাসটুকুতেই পরিতৃপ্ত, এপিক বা কাহিনীকাব্যের পৃথক মাহাত্ম্য স্বীকার করেন না। বিশেষ অপেক্ষা নির্বিশেষের প্রতিই তাঁহাদের পক্ষপাত, এজন্য কাব্য-বিচারে, কবির বিশেষ সৃষ্টির যে ক্ষমতা, তাঁহাদের রস-পিপাসা তাহার সম্যক পরিচয় গ্রহণে উৎসুক নহে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যের মত কাহিনী-কাব্যে এই শক্তিই উৎকৃষ্ট সৃষ্টিশক্তির নিদর্শন, তাই আমি প্রথমেই এ কাব্যের এই দুইটি অপ্রধান নারীচরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও সৃষ্টিচাতুর্য্যের আলোচনা করিলাম।
চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরী মধুসূদনের যে-কল্পনার সৃষ্টি, তাহাকে objective বা বস্তুনিষ্ঠ বলা যাইতে পারে। যাহা প্রত্যক্ষ-পরিচিত, যাহার আদর্শ ও ভাব-রূপ স্থির, যাহা ব্যক্তির বাসনা-কামনায় রঞ্জিত নহে; সামাজিক ও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে যাহার রস-রহস্য সর্বজন-হৃদয়বেদ্য, যাহার প্রকাশে ও বিকাশে, মানুষের স্বাধীন কল্পনার বিরোধী এক নিত্যস্বীকৃত নিয়তি-লীলা প্রকটিত হইতেছে, এবং তাহাই মানুষের হাসি—কান্নার—তাহার বাস্তব হৃদয়ানুভূতির কারণরূপে, কাব্যে একটি অপরূপ সৌন্দর্য্য সঞ্চার করে—কবিচিত্তের সেই ক্ল্যাসিক্যাল প্রবৃত্তির কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি; এই দুই চরিত্রসৃষ্টিতে মধুসূদন তাহারই বশ্যতা স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু প্রমীলা ও সীতা যে-কল্পনার সৃষ্টি তাহাতে কবির নিজ স্বাধীন প্রবৃত্তির ক্রিয়া রহিয়াছে—এই দুইটিতে কবির মানস-আদর্শ দুই রূপে প্রতিফলিত হইয়াছে। এই দুইয়েরই মূল উপাদান সেই এক বস্তু—যাহা কাব্যে ও জীবনে মানুষের প্রবলতম ও শ্রেষ্ঠতম প্রাণধর্ম্মরূপে পূজিত হইয়া থাকে। মধুসূদন সেই প্রেমকে, এই দুইটি চরিত্রের কল্পনায়, আপন কবিহৃদয়ের সর্ব্বস্ব উজাড় করিয়া অর্ঘ্য নিবেদন করিয়াছেন; তাই এখানে কবির কবি-প্রবৃত্তি অন্যরূপ-একটিতে প্রেমের রতি এবং অপরটিতে তাহারই আরতি রোমান্টিক লিরিক আবেগে উচ্ছ্বসিত হইয়াছে। তথাপি প্রমীলার সৃষ্টিই নবসৃষ্টি, ইহার মধ্যে কবির প্রাণের অভিনব উৎকণ্ঠা একটি দুরূহ সৃষ্টিসাফল্যে মণ্ডিত হইয়াছে। সীতার আদর্শ নূতন নহে, সেখানে কবি পুরাতনকেই, নূতন মন্ত্রে আবাহন করিয়া নবতন কিরণ-কিরীট পরাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু প্রমীলায় তিনি পুরাতনকেই গ্রহণ করিয়া, তাহাকে ভাঙিয়া, তাহার সেই চূর্ণ-মুষ্টি হইতেই আপনার মনের মানসী গড়িয়া লইয়াছেন। এ কাজ সহজ নহে—দেশী ও বিলাতী দাম্পত্যের দুই বিভিন্ন আদর্শকে, তিনি যেন এক আশ্চর্য্য রাসায়নিক যাদুশক্তিতে একাধারে মিলাইয়াছেন। প্রমীলার চরিত্রে স্বাধীন ভর্তৃকা নায়িকার সঙ্গে বাঙালী কুলবধূ, এবং ভারতীয় আদর্শের শক্তিরূপা নারীর সঙ্গে অভারতীয় বীরাঙ্গনা-মূর্ত্তির এই যে সংযোজন, ইহারই প্রতিভা সে যুগের বাংলা সাহিত্যকে উদ্ধার করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে যে-প্রতিভা য়ুরোপীয় ভাববস্তুকে দেশীয় বিগ্রহরূপে এমন রূপান্তরিত করিয়াছিল, এখানেও সেই প্রতিভার কীর্তিকুশলতা লক্ষ্য করা যায়। এমনই করিয়া সে যুগে কবিপ্রতিভার এই আত্মসাৎ বা স্বীকরণ-শক্তির গুণে আমাদের সাহিত্য প্রাণ পাইয়াছিল। কিন্তু প্রমীলার চরিত্রসৃষ্টিতে মধুসূদনের দুঃসাহস বিস্ময়কর; দুই সম্পূর্ণ—বিরোধী সংস্কারকে তিনি এই চরিত্রে যুক্ত করিয়াছেন—যে বিরোধ এতই অসংশয় যে, কবির সৃষ্টিতে এইরূপ চাক্ষুষ জীবন্ত দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কোন প্রকারে, তাহাকে মন হইতে দূর করা যায় না। ইহাই প্রতিভার যাদুশক্তি; অথবা হয়তো যাদুশক্তি নয়, ইহাই সত্য। আমাদের ধারণায় যাহা অবাস্তব, কবির কল্পনা তাহাকে শুধুই একটা বাস্তবের ভানমাত্র ধারণ করাইয়া দেয় না—বরং তাহার স্বরূপ আবিষ্কার করিয়া আমাদের মিথ্যাকে তাহার স্বকীয় সত্যে প্রতিষ্ঠিত করে। নারীচরিত্র পুরুষের কাছে রহস্যময়, তাহার মধ্যে আমরা আমাদের ধারণাকে পদে পদে খণ্ডিত হইতে দেখিয়া মনে করি, সে বুঝি সকল নিয়মের বহির্ভূত; সে যে আমাদেরই আত্মসংস্কারের দোষ তাহা আমরা কখনও ভাবিয়া দেখি না। একই নারীর পক্ষে বীরাঙ্গনা ও কুলবধূর আচরণ যে বিসদৃশ, এমন কি, অপ্রাকৃত—ইহাই আমাদের অভ্যস্ত ধারণা। সে ধারণা আমাদের বুদ্ধি অনুসারে যুক্তিযুক্তও বটে; কিন্তু এ কাব্যের প্রমীলা চরিত্র—তাহার সকল আচরণে সকল অবস্থায়—এমনই স্বাভাবিক ও জীবন্ত যে, আমাদের সে ধারণাও অন্ততঃ সাময়িকভাবে নিরস্ত হইয়া থাকে। তাহার একমাত্র কারণ, কবি আমাদিগকে, কোন অবস্থাতেই তাহার নারীত্বকে বিস্মৃত হইবার অবকাশ দেন নাই। প্রমীলার বীর ভূষণ ও নারী-ভূষণ যতই বিপরীত হউক, মূলে একের সহিত অপরের বৈসাদৃশ্য নাই—কবি তাহা কিছুতেই ঘটিতে দিবেন না। ইহার একটি দৃষ্টান্ত দিব। অশ্বপৃষ্ঠে রণসজ্জায় সজ্জিত তাহার যে-রূপ বর্ণনা করিয়া কবি বলিতেছেন—
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে টঙ্কারিছে বামা
হুঙ্কারে বিকট ঠাট কাঁপিছে চৌদিকে!
দেখ লো নাচিছে চূড়া কবরীবন্ধনে;
তুরঙ্গম-আস্কন্দিতে উঠিছে পড়িছে
গৌরাঙ্গী হায় রে, মরি, তরঙ্গ-হিল্লোলে
কনক-কমল যেন মানস সরসে!
সেই রূপের সঙ্গে—যখন সে
ত্যজিলা বীরভূষণে; পরিলা দুকূলে
রতনময় আঁচল, আঁটিয়া কাঁচলি
পীনস্তনী; শ্রোণিদেশে ভাতিল মেখলা।
দুলিল হীরার হার, মুকুতা-আবলী
উরসে; জ্বলিল ভালে তারা-গাঁথা সিঁথি,
অলকে মণির আভা, কুণ্ডল শ্রবণে।
—তখনকার সেই রূপের কিছুমাত্র বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হয় না। আবার, একদা যে প্রমীলাকে বলিতে শুনিয়াছিলাম—
“পৰ্ব্বতগৃহ ছাড়ি’
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?…..
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজবলে
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমণি!”
তাহারই সম্বন্ধে যখন অন্যত্র পড়ি-—
“হায় নাথ,” কহিলা সুন্দরী—
“ভেবেছিনু যজ্ঞগৃহে যাব তব সাথে,
সাজাইব বীরসাজে তোমায়। কি করি?
বন্দী করি স্বমন্দিরে রাখিলা শাশুড়ী।”
—তখনই চমৎকৃত হই, বিস্মিত হই না। ইহার কারণ কি? কারণ, প্রমীলা বীরাঙ্গনাও নয়, লজ্জাশীলা কুলবধূও নয়—সে পতিগতপ্রাণা প্রেমিকা নারী। সেই একই প্রেমের দায়ে সে কখনও বীরাঙ্গনা, কখনও কুলবধূ; নতুবা, তাহার আসল রূপ একই। সে রূপের আভাস কবি চকিতে একবার দিয়াছেন। রজনী প্রভাতে ইন্দ্ৰজিৎ যখন বড় আদরে, মধুর মৃদুভাষে, তাহাকে ডাকিয়া জাগাইল, তখন—
চমকি রামা উঠিলা সত্বরে—
গোপিনী কামিনী যথা বেণুর সুরবে!
আবরিলা অবয়ব সুচারুহাসিনী
সরমে।
—এ আচরণ কুলবধূর পক্ষেও যেমন, বীরাঙ্গনার পক্ষেও তেমনই স্বাভাবিক। এমনই করিয়া সর্ব্বত্র প্রমীলার ভিতরকার এই নারীরূপকে এক মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন হইতে না দিয়া, কবি এই চরিত্রে, আপাতদৃষ্টিতে যাহা একান্ত বিরোধী, সেই আদিরস ও বীররসকে একাধারে মিলাইয়াও রসাভাস বা অসঙ্গতি-দোষ নিবারণ করিয়াছেন।
তথাপি প্রমীলা-চরিত্রে কবি নারীর প্রেমকে এক নূতন আদর্শে উদ্বোধন করিয়াছেন—সেই আদর্শকেই বুঝিয়া লইতে হইবে, নতুবা এ চরিত্র-সৃষ্টির রহস্য হৃদয়ঙ্গম হইবে না। প্রমীলার নারীত্বে কবি প্রেমকেই একাধিপত্য দিয়াছেন; সে বিষয়ে আর এক কবির নজীর আছে, যথা—
Man’s love is of man’s life a thing apart,
‘Tis woman’s whole existence,
কবি এই তত্ত্বটিকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করিয়া তাহাকেই তাঁহার নায়িকার একমাত্র ধর্ম্ম করিয়া তুলিয়াছেন। কিন্তু এই তত্ত্বের সহিত তিনি তাঁহার নিজের কামনাগত আদর্শকেও যুক্ত করিয়াছেন, কারণ, কেবলমাত্র ঐ তত্ত্বটিই তাঁহার কাছে সত্য নয়-প্রেম কেবল নারীজীবনের সর্ব্বস্বই নয়, তাহা নারীকে দুর্জয় শক্তির অধিকারিণীও করে; এবং সে শক্তি কেবল আত্মদমন বা অসীম ধৈর্য্যের শক্তি নয়, সে শক্তি তাহার কামনা—বাসনাকে মুক্ত করিয়া দেয়; সে প্রেম কোন বাধা মানে না, সে আপনার মধ্যে আপন বাসনাকে রুদ্ধ করিয়া একটা আত্মিক আনন্দেই চরিতার্থ হয় না। প্রমীলা যেন আর এক বাংলা কাব্যের নায়িকার মতই বলিতে পারিত—
এ প্রেম আমার শুধু ক্রন্দনের নহে;
যে নারী নির্ব্বাক্ ধৈর্য্যে চিরমর্ম্মব্যথা
নিশীথ-নয়নজলে করয়ে পালন,
দিবালোকে ঢেকে রাখে ম্লান হাসিতলে,-—
আজন্মবিধবা, আমি সে-রমণী নহি;
আমার কামনা কভু নিষ্ফল না হবে!
—কিন্তু সে ভিন্ন অর্থে; কারণ, তাহার প্রেম এমন আত্মনিষ্ঠ, আত্মসচেতন নয় বলিয়া—মধুসূদনের আদর্শ, খাঁটি নারী-প্রেমের আদর্শ বলিয়া—তাঁহার আদর্শনারী পুরুষের সহিত প্রতিযোগিতায় এমন করিয়া আত্মশক্তির ঘোষণা করে না; তাহার প্রেম আত্মদানের আকাঙ্ক্ষায় অধীর—সেই কামনার মুখেই সে কোন বাধা মানে না। মধুসূদন নারী-প্রেমের সেই কামনা-বলিষ্ঠ আদর্শকেই বরণ করিয়াছেন—সে প্রেমের সেই রাজসিক মহিমার ধ্যান করিয়াছেন, যদিও সেই প্রেম—
Oft to agony distrest,
And though his favourite seat be feeble woman’s breast.
প্রেমের ‘calm pleasures, majestic pains’ তাঁহাকে ততটা মুগ্ধ করে না—যতটা করে সেই প্রেম বাসনার প্রখরতা।
এই প্রসঙ্গে আমাদের একালের শ্রেষ্ঠ কবির আর একটি কবিতা মনে পড়িতেছে, তাহাতেও প্রেমকে যে-রূপে কবি উদ্বোধন করিয়াছেন তাহার সহিত তুলনা করিলে, মধুসূদনের এই আদর্শ আরও স্পষ্ট হইয়া উঠিবে।—
ভস্ম-অপমান-শয্যা ছাড়, পুষ্প-ধনু,
রুদ্র-অগ্নি হ’তে লহ জ্বলদর্চি তনু!
* *
সেই দিব্য দীপ্যমান দাহ
অন্তরে করুক ক্ষুব্ধ দুঃখের প্রবাহ।
মিলনেরে করুক প্রখর,
বিচ্ছেদেরে ক’রে দিক্ দুঃসহ-সুন্দর।
মৃত্যু হ’তে ওঠো, পুষ্পধনু,
হে অতনু, বীরের তনুতে লহ তনু।
—এ প্রেমও দুর্ব্বলতাকে পরিহার করার প্রেম, ইহাও কামনার দীপ্যমান দাহে—ভোগে—ত্যাগে, মিলনে-বিরহে—রুদ্রের উপাসক। এ কবিতার পরের পংক্তিগুলির প্রায় প্রত্যেকটি, লঙ্কাপ্রবেশের দুঃসাহসিক অভিযানে উদ্যত, যোদ্ধৃবেশিনী প্রমীলার মুখে কিছুমাত্র অপ্রযুক্ত হয় না—
সঙ্কটবন্ধুর তব দীর্ঘ রাজপথ—
সে-দুর্গমে চলুক প্রেমের জয়রথ।
তিমির-তোরণ রজনীর
স্পন্দিবে আহ্বানে মোর নির্ঘোষ-গম্ভীর।
যাক দূরে দ্বিধা লজ্জা ত্রাস—
আয় বক্ষে সর্বনাশা প্রচণ্ড উল্লাস
মৃত্যু হ’তে ওঠো, পুষ্পধনু,
হে অতনু, বীরের তনুতে লহ তনু।
—গীতিকবিতার এই আবেগই মহাকাব্যের নায়িকা চরিত্রে রূপপরিগ্রহ করিয়াছে। ইহাতেও প্রেমের সেই আর-এক রূপ নাই যাহাকে স্মরণ করিয়া কবির ভাষাতেই বলা যাইতে পারে—
*the Gods approve
The depth and not the tumult of the soul;
–সে প্রেম সাত্ত্বিক, এ প্রেম রাজসিক। তাই বলিয়া, এ প্রেম কেবল আদিরসের প্রেম নয়; মধুসূদন তাঁহার ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ সেই আদিরসের প্রেম লইয়া কয়েকটি কবিতা রচনা করিয়াছেন। সে প্রেম কাব্যরসের প্রেম—জীবনের প্রেম নয়; তাহারই ভস্ম-অপমান-শয্যা হইতে আর এক কবি পুষ্পধনুকে জাগাইয়া ‘বীরের তনুতে তনু লইতে’ আহ্বান করিয়াছেন। ইহারই বশে প্রমীলা বীরাঙ্গনা সাজিয়াছে। প্রমীলার বিরহ দুঃসহ বলিয়াই সুন্দর, এবং সেই দুঃসহতাই মিলনকে প্রখর করিয়াছে। অতএব যুদ্ধযাত্রার বীরবেশিনী প্রমীলা ও সহমরণ-যাত্রার বধূবেশিনী প্রমীলায় কোন পার্থক্য নাই। প্রখরমিলনের এই তত্ত্ব কবির কল্পনাকে উজ্জীবিত করিয়াছে বলিয়াই, প্রমীলাচরিত্রে বাহ্যতঃ অসঙ্গতি থাকিলেও, ভিতরে সৃষ্টি-সত্যের সঙ্গতি রহিয়াছে।
অতএব দেখা যাইতেছে, ওই প্রখর মিলনের অর্থই এ কাব্যের প্রমীলাঘটিত কাহিনীর আদ্যোপান্ত অর্থবান করিয়াছে। এ প্রেম বড় অধীর, বড় অসহিষ্ণু—ক্ষণমাত্র বিচ্ছেদও সহ্য করিবে না। মেঘনাদের প্রেয়সীর পক্ষে প্রেমের এই প্রচণ্ডতা যেমন শোভন হইয়াছে, তেমনই, প্রাচীন কাব্যের আদিরস—–সেই মদন-যে রুদ্রের নয়নবহ্নি সহ্য করিতে পারে না, তাহাকে ভস্ম না করিয়া—এইরূপ বহ্নিদীপ্ত করিয়া তোলা—নব্য বাংলা কবিতার প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা এই কবির প্রেরণাকে সার্থক করিয়াছে। তাঁহার এই নূতন প্রেমের কল্পনাকে উদ্দেশ করিয়া বলা যাইতে পারে—
বন্ধু তব দৈত্যজয়ী দেব বজ্রপাণি,
পুষ্পচ্ছলে তাঁরি অগ্নি দাও তুমি আনি’।
—কারণ, সে কল্পনারও বন্ধু ছিল য়ুরোপীয় কাব্য, এবং তাহাতে দৈত্যজয়ী দেব বজ্রপাণির বজ্র-ঘোষণাও ছিল।
কিন্তু কবি এই প্রেমকে, নারীর এমন প্রকৃতিগত করিয়া দেখিয়াছেন যে খাঁটি বাঙালী ঘরের বধূও রাক্ষস-বধূ প্রমীলার রূপ ধারণ করিয়াছে। প্রমীলা যখন বলে—
লঙ্কাপুরে, শুন লো দানবি!
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ বন্দীসম এবে! * * *
যাইব তাঁহার পাশে; পশিব নগরে
বিকট কটক কাটি’, জিনি ভুজবলে
রঘুশ্রেষ্ঠে—এ প্রতিজ্ঞা, বীরাঙ্গনা, মম;
নতুবা মরিব রণে; যা থাকে কপালে!
—তখনও সে যাহা, আবার যখন স্বামীর অনুগমন করিয়া মৃত্যুর দুর্গমতর পথে যাত্রা করিবার কালে সে বলে—
—লো সহচরি, এতদিনে আজি
ফুরাইল জীবলীলা জীবলীলাস্থলে
আমার, ফিরিয়া সবে যাও দৈত্যদেশে।….
কহিও মায়েরে মোর, এ দাসীর ভালে
লিখিলা বিধাতা যাহা, তাই লো ঘটিল
এতদিনে। যাঁর হাতে সঁপিলা দাসীরে
পিতামাতা, চলিনু গো আজি তাঁর সাথে;
—তখনও সেই একই নারী। অতএব, মধুসূদন এ চরিত্রের আদর্শ কোথা হইতে পাইয়াছিলেন—কোন্ বিদেশী বা স্বদেশী কাব্যের, অথবা দেশের অতীত বা সমসাময়িক ইতিহাসের—কোন্ নারী-চরিত্র তাঁহার কল্পনার সহায় হইয়াছিল, সে বিচার নিতান্তই গৌণ। কারণ প্রমীলার বীরাঙ্গনা-মূর্ত্তি এ চিত্রের আধখানা মাত্র—সেই আধখানাকে পৃথক করিয়া দেখিলে, এ চরিত্রের কিছুই দেখা হয় না; বাকি আধখানা যখন যোগ করিয়া দেখি, তখন সে এমন একটি চরিত্র যাহা কোন কাব্যে বা ইতিহাসে নাই। তাই সেরূপ আলোচনা শুধু বৃথা নয়, তাহা ভ্রমাত্মক; তাহাতে প্রমাণ হয় যে রসসৃষ্টির যে মূল রহস্য, কাব্য সমালোচনায় তাহারই সন্ধান লওয়া হয় না। প্রমীলার চরিত্রে কবি আমাদের দেশের মূক দাম্পত্য-প্রেমকে যে মুখরতা দান করিয়াছেন, এবং তাহারই যে দুঃসাহস, তাহাতেই নবযুগের নব্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছে; এই মুখরতাই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-কাব্যে দাম্পত্য-প্রেমকে নূতন করিয়া উদ্বুদ্ধ করিয়াছে—সে মুখরতাও অল্প নহে, যদিও উপন্যাসের অপেক্ষাকৃত বস্তুনিষ্ঠ কল্পনায় তাহাকে এমন করিয়া প্রকাশ করিবার প্রয়োজন ঘটে নাই। এ প্রসঙ্গে ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, যে-প্রেমে আমাদের দেশের সেকালের সীমন্তিনীরা স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপাইয়া পড়িতেন তাহাও কম প্রখর—কম উদ্বেল ছিল না; তাহাতে depth অপেক্ষা tumult of the soul-ই অধিক থাকিত; কেবল শাস্ত্র-সংস্কার ও লোকাচারের কঠিন গুণ্ঠনে আবৃত থাকায় সে মুখের সে চোখের দীপ্তি তেমন ধরা পড়িত না।
‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র মূল ঘটনাবস্তুর সঙ্গে সীতা-চরিত্রের কোন সাক্ষাৎ সম্পর্ক নাই; যে-কল্পনা এ কাব্যের আখ্যান গড়িয়াছে ও তাহার উপযোগী চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে—সীতা-চরিত্র যেন সে কল্পনার বাহিরে। এজন্য কবি যেন সীতা-চরিত্র অঙ্কনে একটি স্বতন্ত্র তুলিকা ব্যবহার করিয়াছেন—সে যেন তাঁহার বিশ্রাম-মুহূর্ত্তের স্বপ্ন-রচনা! পুরীর মধ্যে ও পুর-প্রাচীরের বাহিরে সমবেত অগণিত বীরবাহিনীর তূর্য্য ও পটহ—নিনাদ হইতে দূরে, স্নিগ্ধ শীতল পল্লবঘন প্রচ্ছায় কাননতলে বসিয়া, কবি যেন কিয়ৎকালের জন্য একখানি বাঁশি লইয়া প্রাণের নিভৃত রাগিণী আলাপ করিয়াছেন—নিদাঘ—দিবার দীপ্ত দ্বিপ্রহর যাপনের পর, গোধূলি-সন্ধ্যার একটিমাত্র তারার পানে চাহিয়া, জননান্তর-সৌহৃদ-স্মৃতির মত, আর এক পিপাসা অনুভব করিয়াছেন। ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র সমগ্র চতুর্থ সর্গটি আর সকল হইতে পৃথক; সে যেন তরঙ্গিত ক্ষুব্ধ সাগরের মধ্যস্থলে একটি স্তব শ্যমল প্রবাল দ্বীপ—মহাকাব্যের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত একটি গীতি-কবিতা। কবি নিজেও এ-কাব্যের সহিত এরূপ শাখা-কাহিনীর (episode) সঙ্গতি সম্বন্ধে নিঃসংশয় ছিলেন না। বন্ধু রাজনারায়ণকে লিখিত একখানি পত্রে তিনি ইহার জন্য একটু কৈফিয়ৎ দিয়াছেন।—
I think I have constructed the Poem on the most rigid principles, and even a French critic would not find fault with me. Perhaps the episode of Sita’s abduction (Fourth Book) should not have been admitted, since it is scarcely connected with the progress of the Fable. But would you willingly part with it?
কৈফিয়ৎ দিবার কথাই বটে। সমগ্র ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র কল্পনায় আমরা কবিমানসের যে পরিচয় পাই—সে কাব্যের নায়ক-নায়িকা যে আদর্শে গঠিত, তাহা যখন স্মরণ করি, তখন কবির এই স্বধর্ম্ম-চ্যুতির জন্য কৈফিয়ৎ দাবী করিতে পারি। কবি তাহার কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারিয়া, শেষে বলিয়া উঠেন— ‘But would you willingly part with it?” কিন্তু, সত্যই কাব্যের রচনা কৌশলের দিক দিয়া কৈফিয়ৎ দিবার কোন প্রয়োজন নাই—রীতিমত মহাকাব্যের গঠনে এইরূপ শাখা—কাহিনীর স্থান আছে; সে সম্বন্ধে শাস্ত্রের নির্দেশ এইরূপ। মূল কাহিনীর প্রসাধন—স্বরূপ—তাহার বৈচিত্র্যবিধানের জন্য—শাখা-কাহিনী থাকাই আবশ্যক; তাহাতে দীর্ঘ একটানা আখ্যানের ক্লান্তি-বিনোদন হইয়া থাকে; পাঠকের চিত্ত প্রসঙ্গান্তরে আকৃষ্ট হইয়া, শেষে নবীভূত কৌতূহলে মূল কাহিনীতে ফিরিয়া আসে। কেবল, ইহাই দেখিতে হইবে যে, এরূপ প্রসঙ্গ যেন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, অথবা মূল কাহিনী অপেক্ষা দীর্ঘ বা অধিকতর চমকপ্রদ না হয়। সীতার কাহিনীতে এ অভিপ্রায় সম্পূর্ণ সিদ্ধ হইয়াছে—শুধুই বিষয়ের বৈচিত্র্যে নহে, কবি এই শাখা-কাহিনীর সুযোগে মূল কাহিনীর পূর্ব্ব-পর বৃত্তান্ত সংক্ষেপে পাঠকের গোচর করিয়াছেন—সীতার হরণ-কাহিনী ও তাহার উদ্ধারের কাহিনী সুকৌশলে ইহার মধ্যে বলিয়া লইয়াছেন। এতভিন্ন, তিনি যেভাবে ও যে সুরে, এই খণ্ড-কাহিনী রচনা করিয়াছেন—নূতন ছন্দের সর্ব্বভাব-বহন-ক্ষমতার নিদর্শন স্বরূপ, তাহাও একটা বড় উদ্দেশ্য সাধন করিয়াছে। যে ছন্দে প্রমীলা ও মেঘনাদের মূর্ত্তি গঠন করা যায়, সেই ছন্দেই যে সীতার মত একটি লিরিক-প্রতিমা নির্ম্মাণ করা যাইতে পারে—সে দৃষ্টান্ত কম মূল্যবান নহে। তাই নিছক কাব্য-কলার দিক দিয়া এ সর্গ আগন্তুক বা অবান্তর নয়।
কিন্তু কবি-মানসের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে সীতা-চরিত্র তাহার পক্ষে অভাবনীয়, বলিয়া মনে হইতে পারে। মনে হয়, এ যেন কবির নিজেরও অজ্ঞাত কোন সুপ্ত হৃদয়তন্ত্রীর আকস্মিক ঝঙ্কার—ইহা যেন কোন্ দূর-দূরান্তর হইতে তাঁহার কানে বাজিতেছে, ইহাকে ভুলিয়াও ভুলিতে পারা যায় না! তাই এই সুরের প্রতিমাকে অশোক কাননে, বসাইয়া, নিজে সরমা সাজিয়া, কবি ইহার ললাটে সিন্দূর দিয়া পদধূলি লইয়াছেন। বিস্ময়ের কথাই বটে—‘মেঘনাদবধ-কাব্যের কবির মানসে সরস্বতীর এ-রূপ কেমন করিয়া ধরা দিল! এ যেন—
কপোল সুধাংশু ভাস,
অধরে অরুণ-হাস,
নয়ন করুণাসিন্ধু—প্রভাতের তারা জ্বলে।
ইহাকে দেখিয়া সেই আর এক কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা হয়—
এস মা করুণা-রাণী
ও বিধবদনখানি
হেরি’ হেরি’ আঁখি ভরি’ হেরি গো আবার।
শুনে সে উদার কথা,
জুড়াক মনের ব্যথা,
এস আদরিণী বাণী সম্মুখে আমার!
—বিহারীলালের সেই প্রভাতের শুকতারাই এ কাব্যের সীতা; এখানে সে গোধূলি—ললাটের তারারত্ন হইয়া জ্বলিতেছে। এ সরস্বতীও তেমনই ‘করুণা-মেয়ে’, কেবল বিষাদের অস্ত-কিরণে সেই তরল মুকুতা-বিম্ব সুবর্ণের দীপবিন্দুতে পরিণত হইয়াছে। বিহারীলাল যাহার ধ্যান করিতে বাল্মীকিকে স্মরণ করিয়াছেন, মধুসূদন তাহার চরিত্র কীর্ত্তন করিয়াছেন যে-সর্গে তাহার আরম্ভে তিনিও বাল্মীকি-বন্দনা করিয়াছেন। এ যেন একটি পূজা-গৃহ, এখানে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে কবিকে কায়মনোবাক্যে শুচি হইতে হইবে; তাই সে বন্দনা কেবল একটা মঙ্গলাচরণ নয়—কবির একান্ত ব্যক্তিগত ও আন্তরিক স্তুতি—
নমি আমি, কবিগুরু, তব পদাম্বুজে,
বাল্মীকি! হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি,
তব অনুগামী দাস, রাজেন্দ্রসঙ্গমে
দীন যথা যায় দূর তীর্থ-দরশনে!
‘তব অনুগামী দাস’—কবি ঠিকই বলিয়াছেন, সীতাচরিত রচনায় তিনি আপন পথের পথিক নহেন; যে পথে বাল্মীকি ও বাল্মীকির অনুগামী রামায়ণ-কথা-কোবিদগণ গিয়াছেন, এখানে তিনিও সেই পথে চলিয়াছেন। কিন্তু সে পথে চলিবার পাথেয় তাঁহার আছে কিনা সন্দেহ—সে তীর্থে যাইবার মত ধন-বল কোথায়? তাই তিনি চলিয়াছেন—‘রাজেন্দ্রসঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থ-দরশনে।’ যেন তিনি জানেন যে, তাঁহার মত কবির পক্ষে সীতাচরিত-কীর্তন—বিষয়মদমত্ত গৃহীর তীর্থদর্শনের মত। কিন্তু এ অভিলাষ তাঁহার কেন হইল? সে প্রশ্নের উত্তরে বলিতে হয়, মধুসূদন, পুরুষের পৌরুষ ও মানুষের মনুষ্যত্ব-গৌরব সম্বন্ধে যে-ভাবের ভাবুক হউন—মাতৃস্তন্যরসের মোহ ত্যাগ করিতে পারেন নাই; আমাদের ঘরের সেই নারীমূর্তি, সেই সৰ্ব্বংসহা ধরিত্রী-কন্যা—সেই আত্মমুগ্ধা, পরগতপ্রাণা, স্বার্থে দুৰ্ব্বলা, ত্যাগে মহাবীৰ্য্যবতী মানবী—রূপিণী দেবীর মহিমা কিছুতেই মন হইতে দূর করিতে পারেন নাই। এজন্য প্রমীলা চরিত্রও সেই নারীরই এক নূতন সংস্করণ হইয়াছে মাত্র—নারী-চরিত্রের কল্পনায় তাঁহাকে সকল আত্মাভিমান ত্যাগ করিতে হইয়াছে। এই নারীই তাঁহার সেই নবযুগের বিদ্রোহী কবিচিত্তকে—তাঁহার কল্পনার বিপরীতমুখী আবর্ত্তকে—একটি স্থির কেন্দ্রবিন্দুর শাসনে রাখিয়া, এ কাব্যকে খাঁটি বাংলা কাব্য করিয়া তুলিয়াছে। তাঁহার মন যত ঊর্দ্ধে, এবং যত দূরেই বিচরণ করুক—আমাদের গৃহ-সংসারের যজ্ঞবেদিকায় নিত্যসেবার হোমানল জ্বালিয়া, যে নারী-ঋত্বিক দুই করপুটে নিজের তনুমনঃপ্রাণ আহুতি দিয়া থাকে, কবির হৃদয় বার বার ফিরিয়া আসিয়া তাহারই চতুর্দ্দিকে প্রদক্ষিণ করিয়াছে। বাঙালী কবির অন্তরের সেই অবশ আকর্ষণের ফলে ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’ সীতাচরিত—গাথা আপনি আসিয়া পড়িয়াছে। কবির জাগ্রত চেতনায় এ কাব্যের পক্ষে যে কাহিনী অবাস্তব বলিয়া মনে হইয়াছে, অন্তরের গভীরতর প্রেরণার বশে সে কাহিনীকে তিনি বর্জ্জন করিতে পারেন নাই।
তথাপি সীতা মধুসূদনের মানস-দুহিতা নয় সে দাবি প্রমীলার, তাহা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। এ কথাও বলিয়াছি যে, নারীপ্রেমের যে দুই মূর্ত্তি কবি এ কাব্যের বহিরঙ্গনে ও অন্তঃপুরে স্থাপন করিয়াছেন; তাহার একটিতে আছে, –কবিচিত্তের রতি, অপরটিতে আছে আরতি। প্রমীলাই তাঁহার মানসী; মধুসূদন, পাশ্চাত্ত্য জীবনে ও কাব্যে, প্রেমের যে প্রোজ্জ্বল দাহন-দীপ্তি দেখিয়া নিজের জীবনেও প্রভাবিত হইয়াছিলেন, তাহাকেই, কাব্যে কল্পনার উচ্চ-আদর্শে মণ্ডিত করিয়া তিনি প্রমীলা চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছিলেন। এ চরিত্রে—সাত্ত্বিক আত্মস্থতা নয়, আধ্যাত্মিক অমৃতও নয়—আধিভোতিক দেহ-চেতনার বিক্ষোভ, হৃদয়বৃত্তির প্রবল আক্ষেপ, এবং তাহার মহনীয় পরিণাম যে মৃত্যু, তাহাই তাঁহার রোমান্টিক কবি-প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের পূর্ব্বোক্ত কবিতায় যে আছে—‘যাহা মরণীয় যাক মরে’, সে মরণীয় অর্থে বাসনা-কামনার বিক্ষোভ নয়—সেই কামনা-বাসনার মধ্যেই যাহা কিছু দুৰ্ব্বল, তাহাই মরণীয়। মধুসূদনও তাঁহার আদর্শ—নায়িকার মধ্যে কামের সেই দুর্ব্বলতার ভস্ম নয়—তাহার রুদ্র বহ্নিশিখাই দেখিতে চান। প্রমীলার প্রেমে কবি যেমন দেখিয়াছেন মিলনকে—প্রথম হইতে শেষ পৰ্য্যন্ত তাহার কাহিনী প্রখর-মিলনের কাহিনী, তেমনি সীতার প্রেমে কবি দেখিয়াছেন—প্রশান্ত বিরহকে। সীতার আদর্শ প্রমীলার ঠিক বিপরীত; ইহাতে নাটক বা মহাকাব্যের স্বর্গমর্ত্যগ্রাসী, অথচ আত্মঘাতী, প্রেমের বিজয়-গৌরব নাই। এ প্রেম মৃত্যুতেই মহনীয় নয়।—ইহা আত্মার তপশ্চরণ; ধ্যানে ও স্বপ্নে, সংযমে ও ধৈর্য্যে, ইহার বিচ্ছেদ সুসহ বলিয়াই মহিমাময়—’দুঃসহ-সুন্দর’ নয়। যে প্রেম অচ্ছোদ-সরসী-তীরে, প্রিয়তমের মৃতদেহ সম্মুখে রাখিয়া, বিরহ-রজনীর যুগান্ত যাপন করে, অন্তরে ভাব-সম্মিলনের অমৃত-নিষেকে ভাবী মিলনের আশাকে সঞ্জীবিত রাখে— অশোককাননে সেই সাত্ত্বিক প্রেমের লিরিক-মূর্ছনা শরীরী হইয়া, নিয়মক্ষামমুখী একবেণীধরা বিরহিণীর বেশে, বিরহকে তারাকুন্তলা তমস্বিনীর মত জ্যোতির্ম্ময় করিয়াছে। এ প্রেমের বেদনাও যেমন—majestic pains’, ইহার সুখও তেমনই—’calm pleasures’। ইহার বেদনাও যেমন গভীর, স্তব্ধ, উদার; সুখও তেমনই সহজ শান্ত, সরল। সীতার মুখে আমরা প্রিয়-মিলনের যে সুখস্মৃতি-কাহিনী শুনিতে পাই, তাহা প্রখর মিলনের মত নয়; সে সুখে উন্মাদনা নাই, প্রাণের পরিতৃপ্তি আছে।—
কভু বা প্রভুর সহ ভ্রমিতাম সুখে
নদীতটে, দেখিতাম তরল সলিলে
নূতন গগন যেন, নব তারাবলী,
নব নিশাকান্ত-কান্তি! কভু বা উঠিয়া
পৰ্ব্বত-উপরে, সখি, বসিতাম আমি
নাথের চরণতলে, ব্রততী যেমতি
বিশাল রসাল-মূলে। কত যে আদরে
তুষিতেন প্রভু মোরে, বরষি বচন—
সুধা, হায়, কব কারে? কব বা কেমনে?
শুনেছি কৈলাসপুরে কৈলাসনিবাসী
ব্যোমকেশ, স্বর্ণাসনে বসি গৌরীসনে
আগম, পুরাণ, বেদ, পঞ্চতন্ত্রকথা
পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে,
শুনিতাম সেইরূপে আমিও, রূপসি,
নানা কথা! এখনও এ বিজন বনে
কেজী। ভাবি আমি, শুনি যেন সে মধুর বাণী!
কিন্তু সীতা-চরিত্রে কবি যে-প্রেমের ধ্যান করিয়াছেন তাহা শুধুই দাম্পত্যপ্রেম নয়—সেইখানেই তাহার শেষ নয়। ইহা সেই প্রেম যাহা নরনারীর যুগল-হৃদয়ে জন্মলাভ করিয়া, শেষে করুণা বা মৈত্রীর মধ্যে চরম সার্থকতা লাভ করে। বিহারীলালের সারদা—প্রেমে আমরা যে-প্রীতির সাধনায় বিশ্বাত্মীয়তাবোধের আভাস পাই, মধুসূদনের সীতা—চরিত্রে আমরা সেই করুণাকেই প্রেমের পরিণতি-রূপে দেখিতে পাই। সীতাও যেন মূর্তিমতী করুণা—সেই করুণার মূলে আছে এই পতি-প্রেম। মনে হয়, ইহাই স্বাভাবিক; যে-প্রেম ব্যক্তির সমগ্র সত্তায় পুষ্পিত হইয়া উঠে, তাহা বিশ্বাত্মীয়তায় পর্যবসিত না হইয়া পারে না; যাহাতে আত্মার আনন্দ, তাহার অনুকম্পার সীমা নাই। বিহারীলাল ঘুমন্ত প্রেয়সীর মুখপানে চাহিয়া ভাবঘোরে গাহিয়াছেন—
বিমল আননে তোর
জাগিছে মূরতি মোর,
ঘুমন্ত নয়ন দুটি যেন ধ্যানে নিমগন।
—প্রেয়সীর মুখে কবি নিজ-মুখের প্রতিবিম্ব দেখিতেছেন, ইহাও এক প্রকার মিষ্টিক অনুভূতির কথা। এই আত্মপর-ভেদ ঘুচিয়া যাওয়া যে অবস্থায় সম্ভব হয়, তাহাতেই এমন কথা বলা আশ্চর্য্য নয় যে—
তোমার পবিত্র কায়া
প্রাণেতে ফেলেছে ছায়া,
মনেতে জন্মেছে মায়া, ভালবেসে সুখী হই!
ভালবাসি নারী-নরে,
ভালবাসি চরাচরে,
সদাই আনন্দে আমি চাঁদের কিরণে রই।
সীতার ভালবাসাও এই ভালবাসা, কেবল বিরহের অন্ধকারে চাঁদের কিরণ এক্ষণে ঢাকা পড়িয়াছে। ‘ভালবাসি নারী-নরে, ভালবাসি চরাচরে’ এ কথা সীতার পক্ষে আরও সত্য। সীতা কাহারও দুঃখ সহ্য করিতে পারে না, এমন কি, মহাশত্রুরও নয়। তাহার নিজ হৃদয়ের অনির্বচনীয় দুঃখ তাহাকে সংসারের উপরে বিরক্ত বা বিদ্বিষ্ট করে নাই; সকল দুঃখীর দুঃখ সে আপনার দুঃখ দিয়া বুঝিয়াছে—পরকে দুঃখ দিয়া সে নিজের সুখ চায় না। তাহারই উপরে পাপাচরণ করিয়া যাহারা সেই পাপের শাস্তি ভোগ করিতেছে, তাহাদের দুঃখ দেখিয়া, তাহাদের সেই পাপের জন্যও আপনাকেই দায়ী করে। যে ইন্দ্রজিৎ না মরিলে সীতার উদ্ধার নাই, সেই ইন্দ্রজিতের মৃত্যুসংবাদ দিয়া, সরমা যখন তাহাকে এ সংবাদও শুনাইল—
দৈত্যবালা প্রমীলাসুন্দরী—
সানি বিদরে হৃদয়, সাধ্বি, স্মরিলে সে কথা—
প্রমীলাসুন্দরী ত্যজি দেহ দাহস্থলে
পতির উদ্দেশে সতী, পতিপরায়ণা।
যাবে স্বর্গপুরে আজি!
তখন—
ভবতলে মূৰ্ত্তিমতী দয়া
দারা সীতা-রূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা—সজল—আঁখি, সম্ভাষি সখীরে;—
“কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
সুখের প্রদীপ, সখি, নিবাই লো সদা
প্রবেশি যে গৃহে, হায়, অমঙ্গলা-রূপী
আমি! পোড়া ভাগ্যে এই লিখিলা বিধাতা!
নরোত্তম পতি মম, দেখ, বনবাসী!
বনবাসী সুলক্ষণে, দেবর সুমতি
লক্ষ্মণ! ত্যজিলা প্রাণ পুত্রশোকে, সখি,
শ্বশুর! অযোধ্যাপুরী আঁধার লো এবে,
শূন্য রাজ-সিংহাসন! মরিলা জটায়ু,
বিকট বিপক্ষ-পক্ষে ভীম-ভুজ বলে
রক্ষিতে দাসীর মান! হ্যাদে দেখ হেথা—
মরিল বাসবজিৎ অভাগীর দোষে,
আর রক্ষোরথী যত, কে পারে গণিতে?
মরিবে দানব-বালা অতুলা এ ভবে
সৌন্দর্য্যে! বসন্তারম্ভে, হায় লো, শুকাল
হেন ফুল!”
—এই যে ‘মূৰ্ত্তিমতী দয়া’, ইহারও আদি-মূর্ত্তি—প্রেম; ইহাকেই বলে প্রেমের রূপান্তর। নারীর সকল সাধনাই প্রেমে আরম্ভ; ইহা পুরুষের অধ্যাত্ম সাধনা নহে। করুণা বা মৈত্রীর সাধনায় পুরুষের পন্থা অন্যরূপ—সেখানে জ্ঞান আছে, বিবেক আছে, বৈরাগ্য আছে; এখানে আছে কেবলমাত্র হৃদয়।
মধুসূদন তাঁহার কাব্যে পুরুষের পৌরুষের সঙ্গে নারীর নারীত্বকেও তাহার শ্রেষ্ঠ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন—ইহাতে প্রমাণ হয়, ‘মেঘনাদবধ কাব্যের কল্পনায় কবির সমগ্র কবি-সত্তা সাড়া দিয়াছে। এই কাহিনীর অনতিপ্রসর পটভূমিকার মধ্যেই কবির অতিক্ষিপ্র তুলিকা, জীবনের বর্ণভাণ্ড হইতে অনেকগুলি রং লইয়া, তাহাদের সন্নিবেশে চিত্রের সম্পূর্ণতা সাধন করিয়াছে। সীতা-চরিত্র এ কাব্যের কাহিনী-অংশের বহির্ভাগে থাকিয়াও কবির কল্পনাকে কতখানি সার্থক করিয়াছে, সে ধারণা কবিরও ছিল না; প্রেমের যে আদর্শ তাঁহাকে সজ্ঞানে আকৃষ্ট করিয়াছিল, নিজ্ঞানে তাহার বিপরীতই যে তাঁহাকে উন্মনা করিয়াছে— তাঁহার কল্পনা যখন রণবাদ্যমুখরিত নারীসেনার শোভাযাত্রায় নিশীথ-আকাশে মশাল জ্বালাইয়া প্রেমের গৌরব কীৰ্ত্তন করিতে ব্যাপৃত ছিল, তখন প্রাণের গভীরতর নিশীথে, সেই কল্পনাই যে, তুলসীর মূলে সেই প্রেমের সুবর্ণ-দেউটি জ্বালাইতে অধীর হইয়াছে, তাহা কবিরও অগোচর ছিল। বাংলার এই কবি-শিশুর দুরন্ত হৃদয় এমনই করিয়া সেই দুরন্তপনার মধ্যেই, নিজের জাতি-ধৰ্ম্ম বজায় রাখিয়াছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র কাব্যবস্তু যেমনই হউক—বিজাতীয় আদর্শের সঞ্জীবনী প্রেরণা তাহার প্রাণ-প্রতিষ্ঠায় যতই সহায়তা করুক, কবি যে তৎসত্ত্বেও তাঁহার কবিতাকে কুলত্যাগিনী হইতে দেন নাই, ইহাই মধুসূদনের কবিশক্তির সবচেয়ে বড় নিদর্শন : এবং এইজন্যই সেকালের শিক্ষিত বাঙালীমাত্রেই এ কাব্যের রস আকণ্ঠ পান করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছিল।