মেক্সিকোতে রবীন্দ্র-সাহিত্য
১৯৫২ সালে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসে আমার মেক্সিকো দেশ দেখে আসবার একটু সুযোগ ঘটেছিল। ছ-মাসের জন্য আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় পেনসিলভেনিয়া ইউনিভারসিটির দ্বারা অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হই। ছ-মাস ফিলাডেলফিয়াতে কাটবার পরে মেক্সিকো দেশে ঘুরে আসবার সুযোগ পাই। মেক্সিকো নানা বিষয়ে আমেরিকার সংযুক্ত রাষ্ট্রের থেকে একেবারে আলাদা, এবং আর কতকগুলি বিষয়ে ভারতবর্ষের সঙ্গে মেক্সিকোর খুব মিল আছে। দেশটি ভারতবর্ষের প্রায় antipodes-এ অবস্থিত—অর্থাৎ ভূগোলকে ভারতবর্ষের ঠিক বিপরীত দিকে মেক্সিকো অবস্থিত। দেশটিতে প্রাচীন আর আধুনিকের এক অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। কলম্বস-কতৃক আমেরিকা আবিষ্কারের বহু পূর্বে, ইউরোপ থেকে স্প্যানিশ জাতির মানুষের আমেরিকা মহাদেশে পদার্পণ ঘটবার বহু শতাব্দীর পূর্ব থেকেই, মেক্সিকোর অধিবাসীরা একটি বড়ো-দরের সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। নাহুয়া, জাপোতেক, মিস্তেক, মায়া প্রভৃতি নানা উপজাতির লোকেরা, যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্ব থেকেই একটা উঁচুদরের সভ্যতা গড়ে তোলে। এই সভ্যতার একটা অদ্ভুত কথা এই যে, এরা লোহার ব্যবহার জানত না—ধাতুর মধ্যে এরা তামা সোনা আর রূপো এই ক-টি জানত। এদের কাটবার, কঠিন বস্তু ছেদন করবার একমাত্র অস্ত্র ছিল পাথর। পাথরেরই ছেনি দিয়ে বড়ো বড়ো পাথর কেটে যে এরা বিরাট বিরাট মন্দির আর অন্য প্রাসাদ আর ভাস্কর্য প্রভৃতি তৈরি করে গিয়েছে, তা দেখে এখন আমাদের বিস্ময় লাগে। এদের নিজেদের ধর্ম আর দেবতা, নানা শিল্পকলা, সুসংবদ্ধ সমাজ, বড়ো বড়ো সাম্রাজ্য, এসব ছিল। কিন্তু স্পেন থেকে ইউরোপীয়েরা গিয়ে এদের মধ্যে এক উৎপাতের মতো দেখা দিল; আর এদের প্রাচীন সভ্যতা এই আক্রমণকারী স্পেনীয়দের হাতে ধ্বংস হল। এখন মেক্সিকোর লোকেরা হচ্ছে, প্রাচীন মেক্সিকোর নানা উপজাতির মানুষ আর তাদের উপরে যারা দোর্দন্ডপ্রতাপে এই সাড়ে-চারশো বছর ধরে শাসন করে আসছে, সেই স্পেনীয় জাতির মানুষ, এদের মিশ্রণের ফল। প্রাচীন ধর্ম এদের আর নেই, জোর করে স্পেনীয়রা এদের রোমান-ক্যাথলিক করে দিয়েছে। প্রাচীন মন্দির প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ এখন প্রত্নতত্ত্বের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ আদিম অধিবাসীরা এখনও শতকরা প্রায় চল্লিশ হবে। আর বাকি ষাট হচ্ছে, স্পেনীয় আর আমেরিকার সুসভ্য আদিম জাতির মিশ্রণ-জাত। যারা বিশুদ্ধ স্প্যানিশ ছিল তারা এখন এই মিশ্র জাতির মধ্যেই মিশে গিয়েছে বা যাচ্ছে। ভাষায় এরা এখন স্পেনীয় হয়ে যাচ্ছে। নাহুয়া, মায়া, মিস্তেক, জাপোতেক, ওতোমি প্রভৃতি নানা ভাষা জনসাধারণ ঘরে ব্যবহার করলেও, এসব ভাষার সাহিত্য নেই, সকলেই ইস্কুলে কলেজে স্প্যানিশ শেখে, আর স্প্যানিশই এদের সাধারণ ভাষা হয়ে যাচ্ছে। স্প্যানিশ ভাষার মাধ্যমেই বাইরের জগতের সঙ্গে এদের যোগাযোগ হয়ে থাকে। এক হিসাবে ধরতে গেলে, এরা এখন স্পেনীয় জাতেরই যেন একটি শাখা, যদিও এদের জীবনযাত্রার পদ্ধতিতে, রীতি-নীতিতে, মনোভাবে আর চিন্তাপ্রণালীতে আদিম আমেরিকার বৈশিষ্ট্য অনেকটাই দেখতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে যেমন আর্য আর অনার্য মিশে ভারতীয় হিন্দু জাতির সৃষ্টি, মেক্সিকোতেও তেমনি সুসভ্য আদিম আমেরিকান জাতি আর স্পেনীয় জাতি, এই দুটি মিলে আধুনিক মেক্সিকান জাতি। মেক্সিকোতে যাবার আগ্রহ এইজন্য ছিল যে, সেখানে গিয়ে, এই অভিনব মেক্সিকান জাতি কীভাবে গড়ে উঠেছে আর উঠছে, তার একটু চাক্ষুষ পরিচয় লাভ করা।
মেক্সিকো দেশের রাজধানীর নাম হচ্ছে ‘মেক্সিকো নগর’। স্পেনীয়রা ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকো জয় করে। তার কয়েক শত বৎসর পূর্বেই এই মেক্সিকো শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। মেক্সিকো নগরটি এখন আমেরিকান মহাদেশের এক প্রধান নগর। এই নগরের স্বকীয় একটা রূপ আর বৈশিষ্ট্য আছে। প্রাচীন আমেরিকাযুগের অনেক ভগ্নাংশ আর স্পেনীয়দের দান অনেক নতুন জিনিসের মিশ্রণে শহরটি অপূর্ব।
আমি মেক্সিকো শহর আর মেক্সিকান জাতির পর্যালোচনা করবার জন্যই ওদেশে যাই। এখনকার মেক্সিকান শিক্ষিত ব্যক্তিরা রক্তে কোথাও শুদ্ধ আমেরিকান, কোথাও বা মিশ্র, আর কোথাও বা শুদ্ধ স্প্যানিশ হলেও, একটি উন্নত মনোভাবের জাতি। মেক্সিকোতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। জনশিক্ষার প্রচারও খুব বেশি। মেক্সিকোর আধুনিক শিল্পকলা ও যুগের শিল্পে কতকগুলি নতুন ধারা এনে দিয়েছে। বাইরের জগতের হাওয়া এদের মনে খুব-ই খেলছে।
এহেন মেক্সিকোতে গিয়ে একটি অপ্রত্যাশিত ব্যাপার দেখে যেমন বিস্মিত তেমনি প্রীতও হলুম। সেটি হচ্ছে—আধুনিক মেক্সিকোর শিক্ষিত আর বিদগ্ধ সমাজের মনে ভারতবর্ষের প্রভাব, আর সেই প্রভাব এসেছে স্বামী বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথের রচনাকে অবলম্বন করে। মেক্সিকো শহরে পৌঁছোবার দু-দিন পরেই আমাদের ভারতবর্ষের রাজদূত মেক্সিকো দেশে পদার্পণ করলেন। সংযুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকো—আমেরিকার এই দুই দেশের জন্য একজন রাজদূতই নিযুক্ত আছেন। ১৯৫১-৫২ সালে আমাদের রাজদূত ছিলেন শ্রীযুক্ত বিনয়রঞ্জন সেন। ইনি যোগ্যতার সঙ্গে নিজের কর্তব্য পরিচালনা করেন, আর ওয়াশিংটন থেকে মেক্সিকোতে আসেন ভারত সরকারের পরিচয়পত্র মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করবার জন্য। শ্রীযুক্ত সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্র ছিলেন। মেক্সিকোতে তাঁর সাহচর্য করবার আমার খুবই সুযোগ মেলে, আর তাঁর সঙ্গে আমি কয়েকটি জায়গায় ঘুরি। দু-একটি বিষয়ে স্বদেশের জন্য তাঁর সঙ্গে মিলে একটু কাজ করবার সুযোগও আমি পাই।
ভারতবর্ষের রাজদূত মেক্সিকোতে এসেছেন—মেক্সিকোর অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের কতকগুলি ছাত্র আর কয়েকজন অধ্যাপক। এঁরা সকলেই চান—ভারতবর্ষের সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছু জানতে, আর ভারতবর্ষ আর মেক্সিকো এই দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগ কী করে পাকা করা যায়, আর ছাত্রেরা বিশেষভাবে জানতে চায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে। ভারতের রাজদূত অল্প কয়দিনের জন্য মেক্সিকোয় গিয়েছিলেন, তাঁকে তখন নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। এই সাংস্কৃতিক ব্যাপারে জিজ্ঞাসু মেক্সিকান অধ্যাপক আর ছাত্রদের কাছে তিনি আমার কথা বলেন—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার অধ্যাপক এসেছেন, তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আপনারা আলাপ করুন, তিনিই আপনাদের নানা খবর দিতে পারবেন; আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল, রবীন্দ্রনাথের কথাও তিনি অনেক বলতে পারবেন। আমাকেও তিনি খবর পাঠিয়ে দিলেন, আর আমার হোটেলে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে এদের বলে দিলেন।
এইভাবে মেক্সিকো শহরের প্রাচীন ও আধুনিকের উত্তরাধিকারী এই নবীন মেক্সিকান জাতির কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কারপূত ছাত্র ও অধ্যাপকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ মিত্রতা ঘটল। এর পূর্বে মেক্সিকো শহরের রাস্তায় চলাফেরা করবার সময়ে একটি জিনিস দেখে আমি চমকে যাই। আমাদের দেশের মতোই বড়ো রাস্তার ধারে ফুটপাথের উপর যেখানেই একটু খোলা জায়গা পেয়েছে, সেখানেই নানারকম জিনিসের ফেরিওয়ালারা পসার সাজিয়ে পথ-চলতি লোকের কাছে নিজেদের জিনিস বিক্রি করছে—কোথাও ফল, কোথাও বা চকোলেট বা নানা রকমের মিষ্টি, কোথাও নানা মণিহারি জিনিস, আর কোথাও বই। এই রকম ফুটপাথের ধারে ছোটো-খাটো সাজানো বইয়ের দোকান দেখলে দাঁড়িয়ে পড়তুম। এ-বই ও-বই সে-বই হাঁটকে একটু দেখতুম, আর কখনো অল্প দামে দু-একখানা কিনতুমও। সব বই স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। বই আছে, ক্যালেণ্ডার আছে, খাতা-পেনসিলও আছে। বেশির ভাগ বই-ই বাজে উপন্যাসের—প্রেম আর খুনোখুনির ব্যাপার নিয়েই। আবার স্প্যানিশ ভাষার পুরাতন আর আধুনিক শ্রেষ্ঠ লেখকদেরও বই বেশ পাওয়া যায়। এই রকম একটি ছোটো দোকানে হঠাৎ দেখি স্প্যানিশ ভাষায় স্বামী বিবেকানন্দের বই—যেমন রাজযোগ, মদীয় আচার্যদেব, শিকাগো বক্তৃতা ইত্যাদি। দেখে তো অদ্ভুত লাগল। তারপরে আরও দেখলুম রবীন্দ্রনাথের বইয়েরও স্প্যানিশ অনুবাদ। এগুলি বাজে ডিটেকটিভ নভেল আর রোমান-কাথলিক ধর্মের বই আর যৌন-আবেদনের নানা ছাইপাঁশ বই এসবের পাশে এই বইও বিক্রি হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, মেক্সিকোর পথ-চলতি মানুষ সকলেই বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথের লেখা কিনে পড়ে। তবে এটা নিশ্চয় যে, দু-চারজন লোক অবশ্যই আছেন যাঁদের কাছে এইসব বইয়ের চাহিদা আছে, আর তাঁদের জন্যই ফেরিওয়ালারা এইসব বই এনে রাখে। সুদূর মেক্সিকোর সাধারণ মানুষের অন্ততঃ একটি শ্রেণীর কাছে ভারতীয় চিন্তা ও দর্শন আর ভারতীয় কবিতা ও উপন্যাস-এর একটা আবেদন নিশ্চয়ই পৌঁছেছে, এবং সেখানে এর কিছুটা আদরও হয়েছে।
ইউনিভারসিটির এই ছাত্র আর অধ্যাপকদের পেয়ে আমি খুবই খুশি হলুম। বিশেষতঃ এই সব তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের পেয়ে। অধ্যাপকেরা চান যাতে ভারতবর্ষের সঙ্গে মেক্সিকোর একটা ভাবগত আদান-প্রদানের কায়েমী বন্দোবস্ত আমাদের রাজদূত করে দিয়ে যান, এই বন্দোবস্ত অনুসারে যাতে করে ভারতবর্ষের অধ্যাপক আর ছাত্র মেক্সিকোয় আসতে পারেন, আর মেক্সিকোর ছাত্র আর অধ্যাপক ভারতবর্ষে যেতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা চায়, আমি যখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত আর তাঁরই নগর-কলকাতার অধিবাসী, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রদের কাছে আমি যেন একদিন রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ করি। এ বিষয়ে দেখলুম জন দশ-বারো ছাত্রের উৎসাহ বেশি। এদের মধ্যে তিন-চারটি মেয়েও ছিল। এরা সকলেই কলেজে পড়ে—কেউ বিজ্ঞান, কেউ সাহিত্য, কেউ দর্শন আর কেউ আইন। এই ছাত্রদের সঙ্গে আমার বেশ সদ্ভাব হয়ে গেল, যদিও এদের সঙ্গে মেলামেশা করবার জন্য আমি তিনটি কি চারটি দিনের বেশি পাই নি। এরা আমাকে বললে যে, এদের মধ্যে একটা ছোটো পাঠচক্র গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে—এরা তার নাম দিয়েছে ‘Grupo Rabindranath Tagore’ (গ্রূপো রাবিন্দ্রানাৎ তাগোরে)। এই পাঠচক্রে এরা নিয়মিতভাবে রবীন্দ্রনাথের আলোচনা করে থাকে। ইংরিজিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা যা বেরিয়েছে, সে-সবেরই স্প্যানিশ অনুবাদ হয়েছে—কতকগুলি বই স্পেন দেশে, কতকগুলি আমেরিকার আর্জেন্টিনায় আর অন্যত্র। আবার এইসব অনুবাদকে অবলম্বন করে একটি নাতিক্ষুদ্র রবীন্দ্র-রচনার চয়নিকাও স্প্যানিশ ভাষায় বেরিয়েছে। ছাত্রেরা এই বই আমাকে দেখালে—এদের হাতে তিন-চার খন্ড এই বই ছিল। আর আমি এই বই দুই-একখানি ওদের কাছ থেকে নিয়ে পাতা উলটে দেখলুম—অনেক জায়গাতেই পাঠকেরা লাল, নীল বা কালো পেনসিলে বা কালিতে দাগ দিয়ে রেখেছে—রবীন্দ্রনাথের যেসব রচনার অংশ তাদের ভালো লেগেছে।
এটা দেখে একজন ভারতবাসী বা বাঙালির মনে একটা আনন্দ হবারই কথা। অপর গোলার্ধের একেবারে উলটো দিকে এতগুলি তরুণ-তরুণীর সঙ্গে, প্রবীণ অধ্যাপকের সঙ্গে একটা ভারসাম্য পাওয়া গেল—এটা কি কম কথা! এদের সঙ্গে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে আলোচনা করতে আমি সানন্দে সম্মত হলুম। এদের সঙ্গে আরও দু-একটি বিষয়ে আমার আলোচনা হল। একদিন এরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল একটি দামী মেক্সিকান হোটেলে আমাকে খাওয়াবে বলে। সেখানে বিশুদ্ধ মেক্সিকান ভোজ্য আমাকে খাওয়ালে। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলুম, বলো তো, তোমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এমন কী পেয়েছ যার জন্যে তাঁর বই এইভাবে যত্ন করে পড়ছ আর তাঁর কথা শুনতে চাইছ? তাতে দু-তিনটি ছেলে বললে, দেখুন, উনি জীবনের সম্বন্ধে, প্রেমের সম্বন্ধে, মানুষের কর্তব্য সম্বন্ধে এত খাঁটি কথা এমন মিষ্টি করে বলেছেন, তেমনটি আমরা সাধারণত পাই না। এইজন্যে এঁর বই পড়ে আনন্দ পাই, এঁকে ছাড়তে পারি না। আমি বললুম, এহ বাহ্য, ভিতরের কথা কী বলো। জীবন, প্রেম, মানুষের পুরুষার্থ এসব নিয়ে ইউরোপেও বড়ো বড়ো কবি খুব ভালো ভালো কথা অনেক বলে গিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ হয়তো খুব মিষ্টি করে বলেছেন, কিন্তু তাতে তাঁর বৈশিষ্ট্য কোথায়? তখন এরা একটু ভেবে বললে, এঁর মধ্যে আমরা পাই একটা বিশ্বমানবিকতার বাণী, সব মানুষ যে এক আর সকলের মধ্যেই যে নিজেকে আমরা পেতে পারি সেই কথা। আমি বললুম, এও তো নতুন কথা নয়, প্রাচীন আধুনিক সব দেশেরই বিশ্বকবিদের মধ্যে এ ধরনের বিশ্বমানবিকতা তো দুর্লভ বস্তু নয়। তখন এদের মধ্যে দু-একজন একটু ভেবে বললে, দেখুন, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অতীন্দ্রিয় জগতের একটা আভাস পাই, এমন একটা আধ্যাত্মিকতার সুর তাঁর লেখার মধ্যে আছে যেটা মানুষকে উঁচুতে তুলে নিয়ে যায়, আর মানুষকে আকুল করে,—এটা তো আর সব কবির মধ্যে পাই না। আমি বললুম, আমাদেরও তাই মনে হয়, আর সেইজন্যেই রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের মনের আর হৃদয়ের বস্তু হয়ে আছে—জীবন, মানব আর শাশ্বত সত্তা, এই তিনই তাঁর প্রতিভার ঝলকে অদ্ভুত সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
আমি এদের ব্যবস্থামতো মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-কলেজে আহূত ছাত্রদের একটি সভাতে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে এলুম। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বললুম। শ্রোতার সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হবে—ইংরিজি সকলে বোঝে না, তবে অনেকেই বোঝে, সেইজন্য চট করে পঞ্চাশের বেশি শ্রোতা সংগ্রহ করা বোধহয় কঠিন হয়। বক্তৃতার পর এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন করলে—কতকগুলি প্রশ্ন বোকার মতন, ছেলেমানুষের মতন, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অজ্ঞতারই পরিচায়ক; আবার দু-চারটি প্রশ্ন বেশ বুদ্ধিমানের মতো, তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টিও মেলানো ছিল। বক্তৃতা সাঙ্গ হবার পরে, চমৎকার ইংরিজিতে একজন অধ্যাপক আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। ইনি বললেন, যখন আমরা ভারতবর্ষের কথা চিন্তা করি, তখন ভারতবর্ষের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর আর তার সমন্বয় প্রবৃত্তির কাছে আমাদের মন সম্ভ্রমে নত হয়ে যায়, আমাদের নিজেদের যেন অনেকটা খর্ব বলে মনে হয়। এর জবাবেও আমাকে বলতে হল, আমাদের এখন যা অবস্থা তাতে প্রাচীন ভারতের কতকগুলি আদর্শ—যার একটা আবেদন এখনও বিশ্বমানবের কাছে আছে—তা থেকে আমরা কতটা ভ্রষ্ট হয়ে পড়ছি, সেকথা যখন ভাবি তখন আমরা নিজেদের লজ্জা রাখবার স্থান পাই না।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার বিশ্বব্যাপী আবেদন আর প্রভাব আমরা এইভাবে পৃথিবীর সর্বত্রই দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ এমন জিনিস সব দেশের সব জাতির সব কালের মানুষকে দিয়ে গিয়েছেন যে, সে-জিনিস কেউ ছাড়তে পারবে না, তা সর্বত্র সকলের হৃদয়ের ধন হয়ে থাকবে।
শনিবারের চিঠি, রবীন্দ্র-সংখ্যা, বৈশাখ ১৩৬৭