মেকানিক
ষাট বছর বয়সে হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছি আমি। দুরারোগ্য ক্যান্সার গ্রাস করেছে আমায়। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। তার ভারি নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার সময় হয়ে গেছে। আমার পরিবার আর পরিচিতজনদের আক্ষেপ, বড্ড অকালেই চলে যাচ্ছি আমি, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, আমার কোনো আফসোস হচ্ছে না। এ জীবনে যা পেয়েছি, যতোটুকু হয়েছি, তাতে সন্তুষ্টচিত্তেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারবো।
খুবই তুচ্ছ আর সাধারণ এক ছেলে ছিলাম আমি। তারপরও যে জীবন আমি পেয়েছি সেটা পাবার কথা ছিল না। অনেক কিছু আমি পেয়েছি-জীবনের শুরুতে যা আমি সাহস করেও কল্পনা করতে পারতাম না। তবে একজন মানুষ না থাকলে এসবের কিছুই পেতাম কি না সন্দেহ। সেই মানুষটার কাছে চিরঋণী আমি। এ কথা আমার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিচিত অনেকেই জানে। আমি কখনও তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার কথা ভুলিনি। ঐ মানুষটা না থাকলে আমি যে ভাগাড়ে ছিলাম সেখানেই পড়ে থাকতাম হয়তো। সেই মানুষটিকে নিয়ে অসংখ্য গল্প আছে আমার স্মৃতিভাণ্ডারে। আজ থেকে প্রায় আটচল্লিশ বছর আগে, এমনই এক গল্প আপনাদেরকে বলবো আজ। সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা অসাধারণ মানুষদের গল্প এটি। যদি না বলি তাহলে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে গল্পটা বিলীন হয়ে যাবে-আমি ছাড়া আজ আর এই গল্পের কোনো পাত্র-পাত্রিই বেঁচে নেই।
আমি ছিলাম খুবই দরিদ্র পরিবারের এক নমশূদ্র হিন্দুর ছেলে। জন্মের পর বাবাকে পাইনি। শুনেছি আমার বয়স যখন দেড় বছর তখনই আমার মাকে পরিত্যাগ করে সে। আমি আমার চিরদুঃখিনী মায়ের স্নেহেই বড় হয়েছি। বাবা নামের লোকটা যে কী কারণে আমাকে আর মাকে ছেড়ে চলে গেছিল জানি না। শুরুর দিকে কেউ কেউ ভাবতো সে নিখোঁজ হয়েছে, কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে করুণ পরিণতি বরণ করেছে। আদতে সে রকম কিছু ঘটেনি। আমার বয়স যখন আট, তখনই কলকাতাফেরত এক আত্মীয়ের কাছ থেকে মা জানতে পারে, তার স্বামী দিব্যি বেঁচে আছে, বিয়ে-থা করে নতুন সংসার পেতেছে ওখানে। সেই আট বছর বয়স থেকেই লোকটার প্রতি আমার ঘেন্নার জন্ম, এর শেষ হবে চিতার আগুনে কেবল আমার দেহ ভষ্ম হবার সাথে সাথে!
মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে আমার মা আমার মুখে অন্ন তুলে দিতো। অনেক চেষ্টা করেও তিন ক্লাসের বেশি পড়াতে পারেনি আমাকে। পুরনো ঢাকার শাঁখারীবাজারের এক সরু গলির ভেতরে, শত বছরের পুরনো নড়বড়ে দালানের ছোট্ট এক কামরায় থাকতাম আমরা। ঘরের ভাড়া আরা দু দুটো মুখের অন্ন জোগাতে এগারো বছর বয়সে আমাকে কাজে লাগিয়ে দিতে বাধ্য হয় আমার মা, বাড়ির পাশে ধোলাইখালে এক গ্যারাজে ঠাঁই হয় আমার। গ্যারাজের মালিকের নাম ছিল আবু ওস্তাদ-তবে তাকে আমরা ‘ওস্তাদ’ বলেই ডাকতাম। ওস্তাদ শুনলেই ভারিক্কি কোনো মানুষের ছবি ভেসে ওঠে, কিন্তু আমার সেই ওস্তাদ তখন টগবগে এক যুবক, বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ। খুবই আমুদে স্বভাবের ছিলেন তিনি। ওস্তাদের এক বন্ধুর বাসায় আমার মা কাজ করতো বলে তিনি তাকে আগে থেকেই চিনতেন।
এভাবে এগারো বছর বয়সে আমি হয়ে গেলাম আবু ওস্তাদের সাগরেদ!
ওস্তাদ ছিল একজন অটোমোবাইল মেকানিক। আমার সাথে তার দুটো মিল ছিল-জন্মের পর তিনিও তার বাবাকে পাননি। অবশ্য, তার বাবা তাদেরকে রেখে পালিয়ে যাননি কোথাও, অকালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর আমার মতোই অল্প বয়সে অভাবের সংসারে মানুষ হয়েছেন তিনি। একদিন তার মা-ও শরণাপন্ন হয়েছিলেন আরেক ওস্তাদের কাছে। সেই ওস্তাদের কাছেই তিনি শিখেছিলেন মোটরগাড়ির কলকজা মেরামতের কাজ। তবে এতো বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে শিখেছিলেন যে, একদিন তার ওস্তাদ তাকে ডেকে সস্নেহে বলেছিলেন, এক ঘরে দুই পীর থাকতে নেই! ওস্তাদ যেন এখন থেকে নিজের পথ নিজেই দেখে। তার হাত ভালো, খুব দ্রুতই মেকানিক হিসেবে নাম করে ফেলবে সে।
আর সেটাই হয়েছিল। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে ওস্তাদ ছোট্ট একটা গ্যারাজ দিয়ে নিজের পথচলা শুরু করেন। খুব দ্রুতই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। যে কাজ অন্য মেকানিকেরা করতে ব্যর্থ হতো সেগুলো তারা পাঠিয়ে দিতো আবু ওস্তাদের কাছে। তিনি কখনওই ব্যর্থ হতেন না। গাড়ির কলকজা তিনি যেন দৈবশক্তিবলে পড়ে ফেলতে পারতেন। তার দক্ষতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছিল যে, অন্যদের মতো ইঞ্জিন নেড়েচেড়ে দেখারও দরকার মনে করতেন না। কীভাবে তিনি গাড়ির ‘অসুখ’ ধরতেন সেটা একটু পরেই বলবো। একবিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, এক বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন আমার ওস্তাদ। তিনিও এক সময় আমার পিঠে হাত রেখে কিছু কথা বলেছিলেন, আমাকে অন্য পথ দেখতে বলেছিলেন, তবে সেটা আমার কাজের দক্ষতার জন্য নয়-তিনি বলেছিলেন, এরকম ভাগাড়ে পড়ে থাকলে নাকি আমার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে! মিথ্যে বলেননি ওস্তাদ। অল্প বয়সেই তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই ধোঁয়া, মরচে পড়া লোহা আর পোড়া তেলের ভাগাড়!
তো, আবু ওস্তাদের গ্যারাজে কোনো গাড়ি আসলে সবার আগে আমরা ছুটে যেতাম। ওস্তাদ চোখে সানগ্লাস পরে বসে থাকতেন গ্যারাজের সামনে এক চিলতে খালি জায়গায়, ওখানে প্রাইভেটকারের একটি সিট ছিল, সেটাই ছিল ওস্তাদের আসন। তাকে চলচ্চিত্রের নায়কদের মতোই দেখাতো। দেখতে ছিলেন অসম্ভব সুদর্শন। টকটকে ফর্সা রঙের জন্য নয়, তার একহারা গড়ন আর তীক্ষ্ণ চেহারা, অন্তর্ভেদি চোখ, সাইড-সিঁথি করা ছোটো ছোটো চুল, হাঁটার ভঙ্গি-সবই ছিল রূপালি পর্দার নায়কের মতো। প্রতি রোববার ইংলিশ সিনেমা দেখা আর বাইক চালানো ছিল তার শখ। মজার মজার কথা বলে মানুষকে হাসিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়াতেও পারতেন তিনি। তার উপস্থিত বুদ্ধির কোনো তুলনাই ছিল না।
ওস্তাদের ছিল জলপাই রঙের চমৎকার একটি বাইক। আমরা ওটাকে ভটভটি বলে ডাকতাম। ভটভট শব্দ করে ছুটতো ওটা। কাজ-কর্ম না থাকলে এই বাইকটা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ওস্তাদ। অন্যান্য জেলা থেকে গাড়ি মেরামতের জন্য ডাক আসলে প্রিয় এই বাইকটা নিয়েই ছুটে যেতেন তিনি যশোর কিংবা সিলেটে, ময়মনসিংহ কিংবা খুলনায়। কয়েকবার আমিও তার সঙ্গি হয়েছিলাম।
টারজান আর হেনরি নামে ওস্তাদের গ্যারাজে আরও দুজন ছিল, কিন্তু তারা সবাই ছিল বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। টকটকে ফর্সা হেনরির ছিল অদ্ভুত নীলচে রঙের চোখ। পরে জেনেছি, সে ছিল অ্যাংলো- ইংরেজ আর বাঙালির মিশ্রণ! আর টারজানের ছিল পেশিবহুল পেটানো শরীর। সম্ভবত এ কারণে কি না জানি না, তাকে টারজান বলে ডাকতো সবাই। তবে সত্যিটা কখনও জানা হয়নি আমার।
হেনরি আর টারজানও আমাকে খুব স্নেহ করতো। কোনো ভারি আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দিতো না। আগলে রাখতো সব সময়। মনে আছে, প্রথম দিন গ্যারাজে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল আমাকে নিয়ে। খুবই শরমিন্দা হয়েছিলাম আমি। কিছুই জানি না তখন, ওস্তাদও আমাকে হাতেখড়ি দেননি তখনও। চুপচাপ গ্যারাজের সামনে খোলা জায়গায় একটা বাতিল টায়ারের উপর বসে ছিলাম আমি, আর আবু ওস্তাদ একটা গাড়ির বনেট খুলে ইঞ্জিনের দিকে ঝুঁকে কী যেন দেখছিলেন। এমন সময় হাঁক ছাড়লেন : “বড় ডালিটা দে তো।”
হেনরি আর টারজান গ্যারাজের টিনশেড দেয়া ঘরের ভেতরে কী নিয়ে যেন ব্যস্ত, তারা ওস্তাদের কথাটা শুনতে পায়নি। তো, আমি এগিয়ে গেলাম ওস্তাদের সাহায্যে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি একটা গাছের ডাল পড়ে আছে, সেটা বড় কি না বুঝতে পারলাম না। তবে দ্রুত সেটা কুড়িয়ে ওস্তাদের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি ইঞ্জিনের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে চেয়েছিলেন, হাত বাড়িয়ে ডালটা নিতেই চমকে তাকালেন আমার দিকে, তারপরই প্রাণখোলা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
“ওই দেখ…বাবুল কী করছে!” নিজের কালিলাগা নোংরা প্যান্টের পায়ে ডালটা দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে হেসে বললেন তিনি। “গাছের ডালি দিছে আমারে! হা-হা-হা।” ওস্তাদের প্রাণখোলা হাসির সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়। ওস্তাদের অট্টহাসি শুনে গ্যারাজের ভেতর থেকে টারজান আর হেনরি ছুটে এলো, ডালিকাণ্ডের কথা শুনে তারাও হাসতে হাসতে খুন। সেদিনই আমি শিখেছিলাম, ডালি মানে এক ধরণের টুল-ডলি কিন্তু দোলাইখালের সব মেকানিক ওটাকে ডালি বলতো।
যাইহোক, আবু ওস্তাদ আমাকে খুব আগ্রহ নিয়ে সব কিছু শেখাতেন, অনেক স্নেহ করতেন। তবে সেটা তিনি কখনও উকটভাবে প্রকাশ করতেন না। পিতারহে পাইনি, কিন্তু ওস্তাদ আমাকে সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে থেকে আমি খুব দ্রুতই শিখে গেলাম, মানুষের মতো গাড়িরও নাম আছে, আছে মডেল নাম্বার। কোনো গাড়ির নাম ডজ, কোনোটার নাম বেডফোর্ড। অস্টিন, ক্যাডিলাক, ফোর্ড, ভক্সওয়াগন, টয়োটা, আলফা রোমিও, অ্যাম্বাসেডর, মরিস, মার্সিডিজ-কতো নামের যে গাড়ি আছে এ দুনিয়ায় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর সেইসব গাড়ির প্রতিটাতে থাকে হাজার হাজার ছোটোবড় যন্ত্র, যন্ত্রাংশ। মানুষের যেমন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম আছে ঠিক সেরকম গাড়িরও আছে। মানুষের শরীর তো গাড়ির বডি; মানুষের থাকে হৃদপিণ্ড, গাড়ির থাকে পাম্প; পায়ের জায়গায় চাকা, কঙ্কালের বদলে চেসিস। এছাড়াও গিয়ারবক্স, ডিফেন্সল, ক্র্যাংশ্যাফট, পিস্টন, পিনিয়াম, ইনজেক্টর, রেডিয়েটর, ব্রেক-কতো কী। তবে গাড়ির মাথা নেই! যদিও ইঞ্জিনে ‘হেড’ নামে একটা জিনিস আছে। তো, ওস্তাদকে একদনি আমি এটা বলেওছিলাম-গাড়ির তো হেড আছে, ওস্তাদ! হেড মানে তো মাথাই!
মুচকি হেসেছিলেন ওস্তাদ। বলেছিলেন, মানুষের মতো গাড়ির আসলে কোনো মাথা নেই। যেটাকে হেড বলি সেটা আসলে ইঞ্জিনের উপরিভাগ, তাই হেড বলে।
গাড়ির মাথা নেই কেন?
প্রশ্নটা শুনে ওস্তাদ বলেছিলেন, গাড়ি চালায় মানুষ, তাই গাড়ির কোনো মাথা থাকার দরকার নেই। যদি থাকতো, গাড়ি নিজেই নিজেকে চালাতে পারতো! মানুষই গাড়ির মাথা! ওস্তাদ আরও বলতেন, যন্ত্র হলেও গাড়ি নাকি আসলে একটা জন্তু!
মানুষের মতো?
আমার বালসুলভ প্রশ্ন শুনে মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন ওস্তাদ, মানুষের মতো কিছু নেই এই জগত-সংসারে। মানুষও যন্ত্র, তবে অনেক জটিল আর দুর্বোধ্য।
মাঝেমধ্যে ওস্তাদ উদাস হয়ে দার্শনিকের মতো কথা বলতেন। আমি সেসব বুঝে-না-বুঝে শুনে যেতাম শুধু। ওস্তাদ আমাকে প্রতিটি যন্ত্রাংশের কী কাজ তা শিখিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আগে জানতে হবে কোনটার কী কাজ। যদি এটা জানতে পারি তাহলে নাকি আমি যন্ত্রের অসুখ ধরতে পারবো খুব সহজে।
তখন রোববার ছিল ছুটির দিন। ওস্তাদের ওখানে আমরা যারা কাজ করতাম তারা হপ্তা পেতাম প্রত্যেক শনিবারে। মাস হিসেবে বেতন দেয়া হতো না দোলাইখালে। এখন হয় কি না আমার জানা নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমি সেই জগত থেকে বিচ্ছিন্ন।
ওস্তাদের ওখানে আমার কাজের বয়স যখন এক কি দেড় বছর তখনই দেশটা অস্থির হয়ে উঠল। পাকিস্তানিদের হাত থেকে আমরা নাকি স্বাধীন হয়ে যাবো-এরকম কথা শোনা যেতো বড়দের মুখে। ছোটোরাও যে পিছিয়ে ছিল তা নয়। দোলাইখালে আমার মতো অনেক পিচ্চি মেকানিকও বলতো এসব কথা। ব্যাপারটা ভালোই লাগতো আমার কাছে। ওস্তাদ অবশ্য রাজনীতি নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না, মাথাও ঘামাতেন না। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল গাড়ি আর তার ইঞ্জিন নিয়ে। তারপরও কার প্ররোচনায় কে জানে, সত্তরের নির্বাচনের সময় নিজের গ্যারাজের সামনে বাঁশ আর কাগজে বানানো একটা নৌকা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নৌকাই জয়ি হয়েছিল সেই নির্বাচনে, কিন্তু সেই জয়ের খুশিতে পানি ঢেলে দিলো পাকিস্তানিরা। দেশটা অস্থির হতে শুরু করলো। বড়রা আলাপ করতো এসব নিয়ে, তাদের সবার কথার মধ্যে একটা মিল ছিল বেশ : ওদের সঙ্গে আর থাকা যাবে না!
যাইহোক, ১৯৭১ চলে এলো এরপর। ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি নির্বিচারে বাঙালি নিধন শুরু করে দিলো। যেসব নিরন্ন মানুষ রাস্তায় ঘুমাতো তারাও রেহাই পেলো না। হিন্দু অধ্যুষিত শাঁখারীবাজারেও হামলা করলো তারা। সেই কালো রাতেই আমার চিরদুঃখি মা নিহত হলেন মিলিটারির আক্রমনে। একটা আম কাঠের খাটের নিচে লুকিয়ে জীবন বাঁচাই আমি। হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে মৃত্যুর ভয়ে ভীত আমি আশ্রয় নেই ওস্তাদের বাড়িতে। শাঁখারীবাজার থেকে ওস্তাদের মহল্লায় যাবার সময় আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা কেমন করে লাফাচ্ছিল সেটা আজো মনে আছে।
ঐ কালো রাতের পর থেকে বন্ধ হয়ে গেল দোলাইখাল। দ্রুত বদলে যেতে লাগলো সব কিছু। অনিশ্চয়তায় কাটতে শুরু করলো প্রতিটা দিন।
এক মাস পর, এপ্রিলে অবরুদ্ধ ঢাকার পরিস্থিতি যেমন গুমোট তেমনি গুজবে পরিপূর্ণ। বাতাসে ভেসে বেড়াতো, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে দেশে। কিন্তু আমরা দেখতাম পাকিস্তানি মিলিটারি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরজুড়ে। পথেঘাটে প্রায়শই নিহত মানুষের লাশ পড়ে থাকতো।
ওস্তাদ থাকতেন লক্ষ্মীবাজারের ছোট্ট একটা একতলা বাড়িতে। ওটাই ছিল তার বাপ-দাদার বাড়ি। উনার বয়স্ক মা ছিলেন প্রায় অন্ধ। সারাটা দিন নিজের ঘরের জানালার কাছে বসে বিড়বিড় করতেন। মহিলার ধারণা ছিল, যতো বেশি ওষুধ খাবেন ততো বেশিদিন বাঁচবেন তিনি। রোজ রোজ সিরাপ আর ওষুধের বায়না ধরতেন নিজের একমাত্র সন্তানের কাছে। আমাকেও মাঝেমধ্যে বলতেন, আমি যেন ওস্তাদকে মনে করিয়ে দেই তার ওষুধের কথা। বুড়ি আমাকে সব সময় ‘বাবুইল্যা’ বলে ডাকতেন। যতোটুকু দেখেছি, দুনিয়ার প্রায় সবাইকেই তিনি এভাবেই ডাকতেন।
প্রায় এক মাস কর্মহীন থাকার পর ওস্তাদের জমানো টাকা যখন নিঃশেষ হবার পথে তখনই এলাকার মুসলিমলীগ নেতা ময়েজ উদ্দিন ওস্তাদকে ডেকে বলল, আগামিকাল থেকে তার গ্যারাজ ভোলা রাখতে হবে-মিলিটারির কিছু গাড়ি মেরামত করে দিতে হবে। মিলিটারির নিজস্ব মেকানিক ছিল কিন্তু তারা নাকি কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাদের ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির সমস্যাও বেড়ে গেছে। আর কিছু কিছু গাড়ির সমস্যা এতটাই জটিল যে, সেসব গাড়ি মেরামত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মিলিটারির অল্প কিছু মেকানিক। এরকম অবস্থায়
যাইহোক, পরদিন আমাকে নিয়ে ওস্তাদ গেলেন গ্যারাজে। টারজান আর হেনরির খবর তখনও জানি না। অনেকেই তখন পালিয়ে গেছে নয়তো বেঘোরে মরেছে মিলিটারির হাতে। কেউ কেউ যুদ্ধেও গেছে শুনতাম। কিন্তু হেনরি আর টারজানের ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেটা কোনো দিনও জানতে পারিনি আর।
সকালে গ্যারাজ ভোলা হলেও কোনো মানুষজন এলো না। গ্যারাজের সামনের খালি জায়গায় আমি আর ওস্তাদ বসে রইলাম চুপচাপ। ওস্তাদ যথারীতি সেই প্রাইভেটকারের সিটে, চোখে সানগ্লাস নিয়ে, আর আমি তার পাশে একটা বাতিল টায়ারের উপরে। অন্য কোনো দিন হলে ওস্তাদ মজার মজার সব গল্প করতেন, কিন্তু সেদিন তিনি ছিলেন ভীষণ রকম নিশ্চুপ। চারপাশটাও কেমন স্তব্ধ ছিল।
দুপুরের আগে দিয়ে একটা মিলিটারি জিপে করে ময়েজ উদ্দিন এলো, সঙ্গে করে নিয়ে এলো আরেকটা জিপ আর ট্রাক। ওস্তাদ সঙ্গে সঙ্গে সানগ্লাসটা খুলে ফেলেছিলেন। যেন মিলিটারির সামনে ওসব পরা অন্যায়। তো বদর-কমান্ডার ময়েজ উদ্দিন চোস্ত উর্দুতে মিলিটারিকে জানালো, আমার ওস্তাদ দুনিয়ার সেরা মেকানিক। সে ঠিক করতে পারে না এমন কোনো সমস্যা নাকি নেই। লোকটা পাকিস্তানিদের দালাল হলেও এ কথাটা কিন্তু মিথ্যে বলেনি!
স্পষ্ট মনে আছে, মিলিটারির সেই অফিসার ওস্তাদকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল। সে হয়তো মেকানিক হিসেবে এমন সুদর্শন কাউকে আশা করেনি। কিংবা একজন বাঙালি দুনিয়ার সেরা মেকানিক হতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার!
ময়েজ উদ্দিন ওস্তাদকে মিলিটারির গাড়ি দুটো ঠিক করে দিতে বললে তিনি আমাকে এক গ্লাস পানি আনার জন্য বললেন। মিলিটারি দেখে তখন ভয়ে জমে আছি আমি। এরাই তো ২৫শে মার্চের রাত থেকে শাঁখারীবাজারসহ ঢাকা শহরে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। আমার মাকেও খুন করেছে! এরা তখন আমার কাছে একেকটা যম।
ওস্তাদ তাগাদা দিলে ভয়ে জরোসরো আমি গ্যারাজের ভেতরে থাকা মাটির কলস থেকে এক গ্লাস পানি এনে ওস্তাদের হাতে না দিয়ে মিলিটারির জিপের বনেটের উপরে রেখে দিলাম। মিলিটারির লোকটা বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। এরপর ড্রাইভারকে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে বললেন ওস্তাদ। পাকিস্তানি ড্রাইভার যারপরনাই অবাক। তার বিস্মিত চোখ বনেটের উপরে রাখা পানির গ্লাসের দিকে। যাইহোক, ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার পর ওস্তাদ গ্লাসে পানির আলোড়ন দেখে গেলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে, কিছুক্ষণ পর হাত তুলে ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন তিনি।
এসব কী হচ্ছে?! বুঝতে না পেরে মিলিটারির অফিসার বিস্ময়ে জানতে চাইলো।
হাত তুলে ময়েজ উদ্দিন তাকে আশ্বস্ত করে ওস্তাদকে বলল, “টেরাবলটা ধরবার পারছোস, আবু?”
“হ।” আর কিছু না বলে বনেটের উপর থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেয়ে চুপচাপ কাজে নেমে পড়লেন ওস্তাদ।
পাকিস্তানি মিলিটারি অবাক হলেও আমি হইনি। আমার ওস্তাদ এরকম আরও অদ্ভুত পন্থায় গাড়ির অসুখ’ ধরতেন!
ঐদিনের পর থেকে ক-দিন পর পরই গ্যারাজে মিলিটারির ট্রাক-জিপ আসতে শুরু করলো, ওস্তাদও সেগুলো ঠিক করে দিতেন। আমার ছোটো মাথায় অনেক কিছু না ঢুকলেও এটা ঠিকই বুঝতাম, ওস্তাদ বাধ্য হয়েই এই যমগুলোর গাড়ি মেরামতের কাজ করে দিচ্ছিলেন।
এক দিন এক অফিসারের একটি জিপ এলো, ওস্তাদ এবার পানির গ্লাস, বরং জিপের পেছনে গিয়ে ড্রাইভারকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে বললেন। ইঞ্জিন স্টার্ট দিতেই গাড়ির ধোঁয়া শুঁকলেন তিনি!
“এইটার পেট খারাপ,” আমাকে আস্তে করে বলেছিলেন তিনি।
তার কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম। আরও বুঝে গেছিলাম গাড়ির কোন অংশটা চেক করতে হবে। ঐ জিপটা ঠিক করতে সময় লেগেছিল বেশি। মিলিটারির লোকটা বলে গেল, পরদিন যেন গাড়িটা ঠিক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দিয়ে আসা হয়। একটা কাগজে কী সব লিখে দিলো সেই লোক। ওটা থাকলে তাকে কোনো মিলিটারি পথে আটকাবে না। পরদিন দুপুরের পর জিপটা ঠিক করে ওস্তাদ আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সানগ্লাস পরা ওস্তাদকে জিপ চালাতে দেখে অনেক মিলিটারি ভুল করে স্যালুটও দিলো! তার পাশের সিটে বসে ছিলাম আমি। অবাক হয়ে আমাকে দেখেছিল তারা। কী ভেবেছিল কে জানে!
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সময় অবশ্য কাগজটা দেখাতে হলো। মিলিটারি পুলিশ ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল ওস্তাদের দিকে। আমাদেরকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেবার পর ওস্তাদ জিপটা নিয়ে ঢুকে পড়লেন ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু প্যারেড গ্রাউন্ড পেরিয়ে যাবার সময় এক মিলিটারি হুইসেল বাজিয়ে জিপটা থামাতে বাধ্য করে। সে নাকি হাত তুলে জিপটা থামার ইশারা করেছিল, ওস্তাদ সেটা অমান্য করেছেন! ওস্তাদ তাকে বললেন, তিনি তাকে দেখতে পাননি।
“শালে বাহেনচোদ্দ বাঙ্গাল!” ওস্তাদের পরিচয় জানার পর গালি দিলো সেই মিলিটারি, তার আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে প্যারেড গ্রাউন্ডে জিপ নিয়ে দশ চক্কর দিতে হুকুম করলো!
তার কথার কোনো প্রতিবাদ না করে চুপচাপ চারটা চক্কর দেবার পরই জিপ থামিয়ে দিলেন আমার ওস্তাদ। দৌড়ে এলো সেই লোক। জানতে চাইলো, কী হয়েছে। ওস্তাদ জানালেন, গাড়িতে অনেক কম তেল ছিল, অতিরিক্ত চক্কর দেবার কারণে শেষ হয়ে গেছে এখন। সেই লোক পড়ল মহা ঝামেলায় প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে গাড়িটা কীভাবে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে এখন?
ওস্তাদই উপায় বাতলে দিলো : দু-তিনজন সিপাহীকে ডেকে গাড়িটা ধাক্কা দিতে বললেন। উপায় না দেখে সেই লোক আরেকজন মিলিটারিকে ডেকে নিজেও যোগ দিলো ধাক্কা দেবার কাজে। বেচারা ভর দুপুরের গরমে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে ঘেমেটেমে একাকার হয়ে গেছিল।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার সময় ওস্তাদ আর আমি হাসতে হাসতে শেষ!
ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ি সেনাক্যাম্পে ডাক পড়তো ওস্তাদের। তিনিও সেখানে গিয়ে গাড়ি মেরামত করে আসতেন। এভাবে মাসের পর মাস গড়িয়ে সেপ্টেম্বর চলে এলো। চারপাশে ভেসে বেড়াতে লাগলো মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার কথা। এক রাতে তিন-চারজন অপরিচিত লোক এলো ওস্তাদের বাড়িতে। তারা আমাকে ঘরের বাইরে যেতে বলে কী সব শলাপরামর্শ করলো। কিন্তু কৌতূহলি আমি কিছু কিছু কথা ঠিকই শুনেছিলাম জানালার বাইরে নীচু হয়ে বসে থেকে।
অক্টোবরের দিকেও লোকগুলো আবার এলো। আমি তাদের কথাও শুনলাম একইভাবে।
নভেম্বরে ঢাকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেল। এখানে ওখানে মুক্তিবাহিনীর চোরাগুপ্তা হামলা, বোমা ফাটানো চলছে। এরকমই এক সময় মিলিটারির একটা ট্রাক এলো মেরামতের জন্য, ওস্তাদ সেটার পেছনে যেতেই থমকে গেলেন। আমি উৎসুক হয়ে দেখলাম, ট্রাকের পাটাতনে রক্তের দাগ! যেন বড়সর ব্রাশ দিয়ে কেউ রক্তের পোচ দিয়েছে!
ওস্তাদ আর আমি কিছুই বললাম না, কারণ আমরা সবাই সব কিছু জানতাম!
“ওস্তাদ, মানুষ যুদ্ধ করে, ক্যান?” একদিন আমি এ কথা বলেছিলাম। ওস্তাদ হেসে আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে উদাস হয়ে গেছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন : মানুষ নাকি এখন পুরোপুরি মানুষ হতে পারেনি! যেদিন হবে সেদিন থেকে সে আর যুদ্ধ করবে না।
“মানুষ কবে মানুষ হবে, ওস্তাদ?”
আমার দিকে প্রসন্নভাবে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, “যেইদিন থিকা যুদ্ধ কইরা মানুষ কোনো লাভ করবার পারবো না সেইদিন থিকা!”
কথাটার মানে বহুদিন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি।
নভেম্বরের শুরুতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিমান হামলা শুরু করলে ঢাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দু-দিন ধরে সারা রাত নিজের গ্যারাজে কাজ করে গেলেন তিনি, আমাকে সঙ্গে রাখলেন না। মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো যন্ত্রাংশ লেদ মেশিন আর ভাইস ব্যবহার করে টারজান আর হেনরিকে দিয়ে বানিয়ে নিতেন ওস্তাদ। আমি বুঝতে পেরেছিলম, এবার তিনি সেই কাজ নিজেই করছেন।
এর কদিন পর টের পেলাম ওস্তাদ একটু চিন্তিত। বিকেলের দিকে তার বুড়ো মাকে রেখে এলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। বুড়ি কোনোভাবেই তার প্রয়াত স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। ওস্তাদ তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে পেরেছিলেন। সেই রাতেই তিনি জানালেন, কাল সকালে কয়েকটা দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাবেন। আমার থাকার ব্যবস্থা করেছেন তার এক বন্ধুর বাসায়। কাল থেকে আমি যেন ভুলেও গ্যারাজে না যাই। পরিস্থিতি ভালো না হবার আগপর্যন্ত রাস্তাঘাটে বের হবারও দরকার নেই।
পরদিন সকালে নিজের প্রিয় বাইকটায় করে আমাকে নাজিরাবাজারে তার সেই বন্ধুর কাছে সোপর্দ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ওস্তাদ। স্বাধীনের আগে তাকে আর দেখিনি। ডিসেম্বরের শুরুতে আমাদের গ্যারাজটা আগুনে পুড়িয়ে দিলো মিলিটারি, সেই সাথে বদরবাহিনীর কমান্ডার ময়েজ উদ্দিনের যমলিস্টে উঠে গেল আবু ওস্তাদের নামটাও!
পরে জেনেছি, ওস্তাদ যেসব মিলিটারি ক্যাম্পে গাড়ি মেরামতের কাজ করতে যেতেন সেগুলোর ভেতরে কোথায় কী আছে সব বলে দিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদেরকে। গেরিলাদের একজন মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার পরই ওস্তাদ পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তা-ই না, পালিয়ে যাবার আগে যে-কটা মিলিটারি গাড়ি মেরামত করেছিলেন তার সবগুলো এমনভাবে মেরামত করেছিলেন, যেন কিছুদিন চলার পরই ব্রেক ফেইল করে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে নাকি বেশ কয়েকজন মিলিটারি মারাও গেছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিনটি ছিল ১৭ই ডিসেম্বর। দৃশ্যটা আমি কখনও ভুলবো না: নাজিরাবাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওস্তাদের পুড়ে খাঁক হওয়া গ্যারাজের সামনে এসে গালে হাত দিয়ে বসে আছি আমি। আমাদের গ্যারাজটা মাটিতে মিশে গেছে। ওটা তখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই না। আমার মন ভীষন খারাপ। যে পুরনো টায়ারের উপরে বসতাম সেটা কালচে পাউডার হয়ে মাটিতে মিশে আছে! ওস্তাদের সিটটার কঙ্কাল তখনও বসে আছে সেখানে! গ্যারাজের ছাদের টিন দুমড়েমুচড়ে একাকার। দেয়ালগুলো কালো ধোঁয়ার কালিতে লেপ্টে আছে।
কিছুক্ষণ পরই শুনি সেই পরিচিত ভটভট শব্দটা। দেখি, দোলাইখালের পুবদিক থেকে জলপাই রঙের বাইকটা এগিয়ে আসছে! ওটায় বসে আছে আমার ওস্তাদ, তার চোখে সানগ্লাস! একদম নায়কের মতো লাগছিল তাকে। একেবারে সত্যিকারের নায়ক!