প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মৃন্ময়ী – ৯

নয় 

বৃষ্টি বাদলার দিনে বাড়িঘরের চেহারা কেমন পালটে যায়। কদিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি। মাঠ- ঘাট ভেসে গেছে। বাড়ির সামনে এক চিলতে খাল। কবে এখানকার স্থানীয় মহারাজ—এই অঞ্চলে আখের চাষ করবেন বলে এই খাল কাটিয়েছিলেন, মহারাজদের খেয়াল—কে কী বোঝায়, আর তাতেই লেগে পড়া। দু-এক বছর চাষ আবাদে বানের জলের মতো টাকা কামাবার ধান্দা। তিনি চাষবাস বন্ধ করে দিতেই জায়গাটা ঝোপ জঙ্গল, বাঁশের বন, এবং বলতে গেলে ঘোর অরণ্য—এমন একটা অঞ্চলেই আমার বাবা জলের দরে জমি পেয়ে এখন বলতে গেলে থিতু হয়ে বসেছেন। প্রাইমারী স্কুলে চাকরি হয়ে যাওয়ায় বাবার অভাব অনটনও আর সেভাবে নেই। মোটামুটি আমরা ভালই আছি। 

কেবল মা’র আপসোস আমার আর পড়াশোনা হল না। আর দুটো বছর পড়তে পারলেই গ্র্যাজুয়েট হওয়া যেত। ছিন্নমূল পরিবারের পক্ষে এটা যে কত বড় মর্যাদার প্রশ্ন বাবা বুঝলেন না। আমারও গোঁয়ার্তুমি কম নয়। পড়ার চেয়ে চাকরিটাই বেশি। মাঝে একদিন পরী এসে ক্ষোভে দুঃখে যা মুখে আসে বলে গেছে! 

পরী বলে গেছে, আসলে মাসিমা ওর জেদ। মেসোমশাইকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কত করে বোঝালাম, আর তো দুটো বছর, তর সইল না। চাকরি না হলে ওর অন্ন জুটবে না। অন্নই সার বুঝেছে। আসলে আমি বুঝি পরী মনে প্রাণে চায় না, আমি একটা প্রাইমারী ইস্কুলে মাস্টারি করি। এই নিয়ে পরীর সঙ্গে পরে আবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। দেখাশোনা বন্ধ হয়েছে। অবশ্য আমার দিক থেকে সাড়া না পেলে, সে বোধহয় স্থির থাকতে পারত না। বেহায়ার মতো সাইকেলে চলে এসেছে শহর থেকে। একটা কলোনিতে আমরা আছি। পরী এই কলোনিতে কেন বার বার আসে লোকের বুঝতে কষ্ট হয় না। অবশ্য সবাই বোঝেও বড় লোকের ঝি। কতরকমের খেয়াল — আমার মতো একটা খেলনা পেয়ে পরীর সাময়িক মতিভ্রম হয়েছে। বয়স বাড়লে কেটে যাবে। আমারও বিশ্বাস তাই। পরীকে পাত্তা না দেওয়াটা আবার কেমন একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে ইদানীং। 

সকালবেলায় বাবা পাটের জমি থেকে উঠে এসে বললেন, তুমি একবার পরীদের বাড়ি যাবে। পরীর ঠাকুরদার সঙ্গে দেখা, বললেন, বিলুকে আসতে বলবেন, বড় বিপাকে পড়েছি। 

বিপাকে পড়ারই কথা। রায়বাহাদুরের একমাত্র নাতনি, আদরে আদরে মাথাটি গেছে। একসঙ্গে কলেজে পড়ার সময় সেটা ক্রমে বুঝেছি। বিপাক থেকে আমিই এত বড় সম্ভ্রান্ত বংশকে রক্ষা করতে পারি তিনি জানেন। কিন্তু সেদিন যেভাবে পরী তাদের বিশাল বৈঠকখানা ঘরে সহসা চিৎকার করে উঠেছিল, তাতে পরীর দাদুর ঘাবড়ে যাবারই কথা! 

বাবা পাটের জমি থেকে উঠে এসেছেন তবে এই কারণে। আমাকে খবরটা দেবার জন্য। 

স্কুলে বের হব। স্নান সারা। বারান্দায় মায়া আসন পেতে দিচ্ছে। আসনে বসে গণ্ডুষ করার সময় বললাম, কোথায় দেখা হল? 

—কাদাইয়ে। মানুর বাসা থেকে বের হচ্ছি। দেখি গাড়ি থেকে তিনি নামছেন। 

—তোমাকে দেখে নামলেন! 

—তাই তো মনে হল।

—চিনলেন কী করে! 

—কেন ওদের অন্নপূর্ণা পূজায় সেবারে গেলাম না। 

আমি ভুলে গেছি। পরীই সবাইকে দাদুর হয়ে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিল। আমার বারণ ছিল, না, না যাবে না। তোমরা কিছুতেই যাবে না। 

বাবার এক কথা—দেবদেবী নিয়ে তিনি খেলা করতে পারেন না। পিলু বলেছিল, দাদাটা যে কী! পরীদি কত করে বলে গেছে! 

মা’র কথা, সংসারের মঙ্গল অমঙ্গল আছে না! 

সতুরাং সবাই গেলেও আমি যাইনি। পরী আমার বাবা-মাকে তাদের বৈভব দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। আসলে অন্নপূর্ণার পূজা একটা অজুহাত। এসব কারণে পরীর উপর আমার যত ক্ষোভ। বাবা হাঁটুর উপর কাপড় পরেন। পায়ে জুতো পরেন না। বিশাল টিকি রেখেছেন। তাতে আমাদের গৃহদেবতার পূজা শেষে লাল জবা বেঁধে দেন। সবই করা সংসারে অশুভ প্রভাব যাতে পড়তে না পারে। মা’র ভাল একখানা শাড়ি নেই। পিলুর জামা প্যান্ট ক্ষারে কাচা। সুতরাং বাবা তার লটবহর নিয়ে অন্নপূর্ণার প্রসাদ নিতে গেলে, বিলুর মান-সম্মান কতটা পরীদের বাড়ি বজায় থাকে, বাবা যদি বুঝতেন। 

কী বলল! 

মুসুরির ডাল দিয়ে ভাত মাখছি। বৃষ্টি ধরে এসেছে। দুটো গরম কুমড়ো ফুলের বড়া মা খুন্তিতে তুলে দিয়ে গেল। গ্রাস তুলব মুখে বাবা বললেন, তোমার কথা জিগ্যেস করল। 

—আমার কথা! 

—হ্যাঁ, বলল, তুমি সত্যি সত্যি প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারিটা করছ কিনা। বাবা কলকেয় টিকে গুঁজে দুবার গুড় গুড়ক টানলেন। বাবার কথা এরকমেরই। বিশেষ করে তামাক খাবার সময় বাক্য অসমাপ্ত রেখেই মনোযোগ সহকারে হুঁকায় নিমগ্ন হওয়া—দেখলে মনে হবে আর তাঁর কথা নেই, উঠে পড়া যাক— তখনই আবার কথা শুরু —বললাম, ঈশ্বরের কৃপায় বিলুর কাজটা হয়েছে। বললাম আশীর্বাদ করবেন, সুনামের সঙ্গে যেন কাজটা করতে পারে। সরকার মাইনে দিচ্ছে, একরকমের সরকারি কাজই বলতে পারেন। 

বাবার সঙ্গে কেন যে রায়বাহাদুরের দেখা হয়ে যায়। এটাও যেন একটা কাকতালীয় ব্যাপার। বলার ইচ্ছে হল, শুনে বোধহয় তিনি খুবই প্রীত হলেন। কত বড় সরকারি কাজ, প্রীত হবারই কথা। কিন্তু আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। কলেজ ছেড়েছি বলে, পরীর জ্বালা আছে। পরীর এই জ্বালাই যেন আমার মধ্যে জেদ বাড়িয়ে দিয়েছে—আমি তোমার গোলাম! তোমার পছন্দমতো আমি সব করব! আমরা কত গরিব তোমরা বোঝ না। চাকরিটা হাতছাড়া হলে আবার কবে চাকরি পাব ঠিক আছে। পড়াশোনায় আমার নম্বরও খুব ভাল নয়। পাশ করে যাচ্ছি কোনরকমে। তাই এর চেয়ে আর কী ভাল চাকরি হতে পারে। আমি যা তাই। চাকরি করব, কলেজ যাব না। দেখি তুমি কী করতে পার। তুমি অর্নাস নিয়ে পড়বে। জেলার সেরা ছাত্রী, জলপানি পেয়েছ, পড়াশোনা তোমাকে সাজে। সেদিন পরীর খোঁজ করতে গিয়ে এ-সবই ছিল দু-পক্ষের মধ্যে বিতর্কের বিষয়। এবং আরও বড় বিষয় যেটা, সেটাই বেশি আমাকে ভাবাচ্ছে। পরীর বাবা কাকারা সম্বন্ধ ঠিক করছে এস ডি ও সাহেবের সঙ্গে। পরীর চেয়ে সাত আট কি দশও হতে পারে বড়। পরী রাজি হচ্ছে না। পরীদের সংসারে এই নিয়ে অশান্তি। নিজের উপরই ক্ষোভ হয়, কেন যে ওদের অশান্তিতে আমাকে জড়াচ্ছে। 

আমি বললাম, পরীর দাদুর সঙ্গে দেখা হলে বলে দেবেন, আমার সময় হবে না! 

বাবা আমার ঔদ্ধত্যে অবাক হয়ে গেলেন! —কী বলছে বিলু। কত বড় মানী মানুষ। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ~~ সোজা কথা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, রোজই তো বিকেলে শহরে যাও। মৃন্ময়ীদের বাড়ি যেতে তোমার এত আপত্তি কেন? 

আপত্তি কেন বোঝাই কী করে! 

বাবা তো জানেন না, সেদিন পরী আমাকে কী বলেছে। জানলে বাবারও মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

আমি বাবাকে এড়িয়ে যাবার জন্য মিছে কথা বললাম, পরী পছন্দ করে না। 

বাবা হুকোটা বেড়ায় ঝুলিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, মৃন্ময়ী তো এমন স্বভাবের মেয়ে নয়। সে যা ভাল বোঝ করবে। বাবা কী বুঝলেন কে জানে। উঠোনে নেমে পাটের জমির দিকে রওনা হলেন। পাট কাটা হচ্ছে। কাছে না থাকলে জনমজুর দিয়ে কাজ করানো যায় না। কাজেই বাবা রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেলে, জামা প্যান্ট পরে সাইকেলে চেপে বসলাম। 

পরীর এখন এক কথা, দুটো তো বছর। এতদিন চলেছে, দুটো বছর চলবে না। না হয় আর একটু কষ্ট করবে সবাই। 

আমি বলেছি, না। তা হয় না কষ্টের সীমা আছে। 

—তাহলে ঠিকই করে ফেলেছ পড়া ছেড়ে দেবে। আমার কথা রাখবে না। 

—ঠিক করে ফেলেছি! 

তারপর আমরা দু’জনই চুপচাপ। অন্যদিকে আমি তাকিয়েছিলাম। পরীর এক কথা, তুমি পড়া ছেড়ে দিলে আমার কোনো সম্বল থাকবে না বিলু। আমি ভারী একা হয়ে যাব। 

আমি হাঁ! বলে কী। শুনে বলেছিলাম, প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টারি তোমার অপছন্দ বুঝি। তোমার পছন্দ নিয়ে আমার ভাবলে চলবে না পরী। আমার নিজেরও পছন্দ-অপছন্দ আছে। একা হয়ে গেলেও কিছু করার নেই। 

সহসা পরী সেদিন কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে গেল, তোমাকে দিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু হবে না। তোমার কোনো স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন না থাকলে বড় হওয়া যায় না। সব তোমার মরে যাবে। তারপরই উঠে চলে গিয়েছিল। আবার কী ভেবে ফিরে এসে বলল, স্বপ্ন না থাকলে মানুষ বড় হতে পারে না। তুমি কী সেটা বোঝ! 

আমি বলেছিলাম, বুঝে দরকার নেই। অনেক বোঝা হয়ে গেছে। মাথায় কবিতা ঢুকিয়ে জীবনটাকে আমার জগাখিচুড়ি কেন বানাতে চাও বুঝি না! ও করে কিচ্ছু হয় না। আমার তো নয়ই। 

আসলে সবই জেদের বশে বলা। ও যদি আমার চাকরিট কে এত অপছন্দ না করত আমি হয়তো, এসব বলতাম না। কবিতা লেখার মধ্যে যে আশ্চর্য মুক্তি আছে—একটা ভাল কবিতা লিখতে পারলে মনে হয় আমি রাজার মত বেঁচে আছি—পরীই আমাকে কবিতার পোকা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং আমার কবিতা নিয়ে ওর গর্বের শেষ নেই—সুতরাং বুঝতে পারি পরীকে একমাত্র মোক্ষম আঘাত হানতে পারি শুধু কবিতাকে অপমান করে। আমি তাই করেছিলাম। দেখ পরী যাকে যা সাজে। আমাকে সাজে না। কবিতা তো নয়ই। 

সাইকেলে যাচ্ছি, আর ভাবছি। 

সাইকেলে চাপলেই আমি কেমন যেন এক ঘোড়সওয়ার মানুষ। দ্রুত গাছপালা, মাঠ পার হয়ে যাওয়ার মধ্যে আশ্চর্য এক আনন্দ আছে। এখন কেমন লাগছে। কোনো আনন্দ নেই। ভিতরে ভিতরে আমিও ঠিক নেই। আড্ডায় কথাবার্তা কম। পরীদের বাড়ির সেই ঘটনার পর কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয় না। অপরূপা কাগজ বের হবে কি হবে না তা নিয়ে গরজ নেই। এবং বাড়িতে থাকলেই আমার মাথা গরম থাকে, মা’র এমন অভিযোগ। সাইকেলে উঠলে সেটা থাকে না। 

পরীর দাদু উপরে উঠে ফের পরীকে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যাবার সময় বলেছিলেন, তুমি একটু বোস বিলু। 

পরী ধীরে ধীরে নেমে এসে আমার সামনে বসেছিল। মেঝের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি পার বিলু।

—কী পারি? 

–পরেশচন্দ্র এঁটুলির মত লেগে আছে। 

পরী নিজের স্বভাবদোষেই মরেছে। তোর কী দরকার ছিল এস ডি ও সাহেবকে আশকারা দেবার। না দিলে সে এত পাগল হয় কী করে—পরেশচন্দ্র তার বাবা-মাকে কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছে- ঘন ঘন যাতায়াত। এমন সুপাত্র পরীর দাদুই বা হাতছাড়া করে কী করে। কেন জানি মনে হয় পরীর আশকারা না থাকলে পরেশচন্দ্র এত পাগল হত না। নিজের দোষে নিজে মরেছে, আমি কেন তার সঙ্গে মরতে যাব! 

বলেছিলাম, দোষ তোমার। 

—মানছি সব দোষ আমার। আচ্ছা বিলু মানুষ ভুল করে না? আমি কী জানতাম এটা এতদূর গড়াবে। বন্ধুর মতো মিশলে কী দোষের 

—দোষের-অদোষের বলছি না।

—তবে কী বলছ? 

বলেছিলাম, পরেশচন্দ্র খারাপ কী! তোমার এত অমতের কী থাকতে পারে বুঝি না। বিয়ে হলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। 

পরী ফোঁস করে উঠেছিল, আমি যা বলছি পারবে কিনা বল। অত কথা আমি শুনতে চাই না। তোমরা আমাকে জান না। আমি সব করতে পারি। বিয়ে হলে ঠিক হবে কি বেঠিক হবে সেটা আমি বুঝব। 

বলে কী। আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বলেছিলাম, আমাকে কী করতে বলছ। 

পরীকে এতদিন দেখে বুঝেছি, সে সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। পরীদের সংসারে ঝড় উঠেছে, পরীর বাইরে ঘোরাঘুরি আর বাপ -কাকারা পছন্দ করছেন না, কারণ পরেশচন্দ্রের ইচ্ছে নয়, পরী মিছিল করে, পরী ইউনিয়ন করে, পরী অপরূপা কাগজ করে। পরী এখন ঘরে থাকবে—যেমন দশটা মেয়ে বিয়ের আগে কোথাও বের হয় না, পরীও সে ভাবে থাকবে, পরেশচন্দ্র এমন চায়। 

পরেশচন্দ্রের সবই ভাল। জাঁদরেল মানুষ। অল্প বয়সে কত বড় দায়িত্বশীল কাজ করছেন সরকারের। মাথায় কবিতার পোকা না থাকলে পরেশচন্দ্রের মতো ব্যক্তি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটা জায়গায় পরেশচন্দ্র হেরে বসে আছে—সে সেটা জানে না। জানে না বলেই পরীর মতো মেয়েকেও জীবনে আর দশটা বিষয়ের মতো অর্জন করা যায় ভেবে ফেলেছে। 

আমি বলেছিলাম, আমাকে কী করতে হবে বল। যদিও আমি জানি পরী দুম করে এমন কথা বলতে পারে যাতে আমার হৃৎপিণ্ড উপড়ে আসতে পারে। কিন্তু পরীর কাতর মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, জীবনে সে এত বড় সর্বনাশের মুখোমুখি কখনও হয়নি। আমার তো ধারণা ছিল, পরী এস ডি ও সাহেবের জিপে যখন ঘুরে বেড়ায়—কোথাও কিছু একটা কিন্তু আছে। আছে বলেই পরীর প্রতি সংশয়। আমি সহজে তাকে কোনো আশকারা দিতে রাজি না। 

পরী মাথা নিচু করে বসেছিল। কিছু বলছিল না। 

—বল। 

রাখার মতো হলে রাখব। 

—তুমি একবার বাবাঠাকুরের কাছে যদি যাও। সেই এক কথা। 

কিছুটা স্বস্তিবোধ করেছিলাম। ভাগ্যিস বলেনি, আমাকে নিয়ে পালাও। কারণ পরী পারে না এমন কাজ নেই। বলেছিলাম, কেন? 

—তুমি তো জান বাবাঠাকুর পারেন- 

আরে এ যে দেখছি আমি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছি। আসলে আমি নিরুপায়। সব যাব করে যাওয়া হচ্ছে না। পরীকে কেন যে কথা দিতে গেলাম। এখন বুঝতে পারছি, বিষয়টা খুব সহজ নয়। কতদিন হয়ে গেল কালীবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। বাবার অভিযোগ, মার অভিযোগ, তুমি একবার গেলে না। তুমি পরীক্ষায় পাশ করলে, খবরটা দিতে হয়। তোমার বদরিদা, বউদি, বাবাঠাকুর কত খুশি হতেন। 

সত্যি যাওয়া দরকার। সেবাইত বদরিদা, আর বউদির মতো মানুষ হয় না। আমার পড়াশোনার খরচ তিনিই দিতেন। থাকা খাওয়া সব। এবং প্রায় বাড়ির আর একজন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মধ্যে একটা বেইমান বাস করে টের পাই। তোমার হাত ধরে বলছি, তুমি যাও। বাবাঠাকুরকে তুমি বললে বুঝবেন। বলবে, মৃন্ময়ীর ইচ্ছে নয় এখন বিয়ে করে। পড়াশোনা করছে। বাবাঠাকুর তো পড়াশোনা পছন্দ করেন। আমাকে মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন, তোর হবে। 

পরীর কাতর মুখ দেখে কথা দিয়ে এসেছিলাম, যাব। বাবাঠাকুরকে বুঝিয়ে যে করেই হোক পরীর গলার কাঁটা তুলে ফেলতে হবে। 

—কথা দিচ্ছ। 

না পরীর দিকে তাকানো যায় না। কার আশায় এই সজল চোখ। প্রাইমারী ইস্কুলের একজন মাস্টারকে নিয়ে তার কোনো স্বপ্ন থাকতে পারে না। ভাল লাগা আর ভালবাসা দুটো তো এক নয়। আমাকে তার ভাল লাগতে পারে—এ পর্যন্ত। এর বেশি নয়। কথা দিয়ে এসেছি, যাব। 

সেই যাওয়াটা আজও হয়নি। কী যে করি। 

সাইকেল থেকে নেমে ইস্কুলের মাঠে হেঁটে যাচ্ছি। পাশে মসজিদ, মসজিদ সংলগ্ন মাটির দেওয়াল ঘেরা লম্বা চালাঘর। ছোট ছোট সব বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। সামনে বড় সড়ক। দু-পাশেই বাড়িঘর। গরিব মুসলমান মানুষজন চারপাশে। স্কুলের হেড স্যার জাহির সাহেব। চালাঘরের দরজা নেই। টেবিল চেয়ার রাখার জন্য শেষ দিকটায় একটা ঘরের দরজার বন্দোবস্ত হয়েছে। স্কুল ছুটি হলে সব ঘর থেকে টেবিল বেঞ্চ ব্ল্যাকবোর্ড ও ঘরটায় নিয়ে গিয়ে তুলে রাখা হয়। ইস্কুলের খাতাপত্র জাহির সাহেবের বাড়িতে থাকে। আমাকে নিয়ে পাঁচজন শিক্ষক। জাহির সাহেব লুঙ্গি পরেন। মাথায় দেন ফেজ টুপি। লম্বা আলখাল্লার মতো পাঞ্জাবি গায়ে দেন। পায়ে জুতো পরেন না। তিনি চাবি নিয়ে না আসা পর্যন্ত মসজিদের পাশে আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। 

স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তখন মাঠে ছোটাছুটি করে। দৌড়ে বেড়ায়। তাদের নতুন মাস্টার গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরেই দু-একজন দৌড় লাগাল। জাহির সাহেবের বাড়ি কিছু জমি পার হয়ে গাছপালা ঘেরা গাঁয়ের মধ্যে। এত কাছে বাড়ি অথচ একদিনও বলেন নি, চলুন বাড়ি। একটু বসবেন। কাউকেই বলেন না। ওরা দু’একজন কেন ছুটছে বুঝতে পারছি। আমার ঘড়ি নেই, থাকার কথাও নয়। মিলের ভোঁ শুনে আমরা সময় ঠিক করি। দশটায় ভোঁ পড়ে। ওই শুনে চানে যাওয়া, খেতে বসা। তারপর সাইকেল চালিয়ে আসা। এগারটা বেজে যাবার কথা। রোজই দেখি, দেরি হয়ে গেছে ভেবে যতই দ্রুত সাইকেল চালাই না কেন, স্কুলের দরজা তখনও বন্ধ। 

যারা ছুটে গিয়েছিল, তারাই আবার ফিরে আসছে। এসেই তালা খুলছে। ওরা বুঝতে পারে তালা খুললেই, আমি সাইকেল ঘরে তুলে ফেলব। আমি দাঁড়িয়ে থাকলে ওদের দৌড়ঝাঁপ করতে অসুবিধা হয় বুঝি। সেজন্য কিনা, এটা প্রায় রোজকার ঘটনা, সময়মত ইস্কুলের দরজা খোলা হয় না। আমি বুঝতে পারি, জাহির সাহেবই হোক আর কল্যাণ, বসিরুদ্দিন যেই হোক—ইস্কুলের কাজটা ফাউ। জোতজমি ঘরবাড়ির আর দশটা কাজ সেরে, একটু সময় করে ইস্কুলে এসে কিছুক্ষণ দয়া করে থেকে যাওয়া। আমার এত তাড়াতাড়ি আসাটা জাহির সাহেবের খুব একটা পছন্দ নয়। কিছু বলতে পারেন না, খোদ একজন স্কুল ইন্সপেক্টর আমার এই চাকরির মূলে। এমনিতে সমীহ করেন। আগেকার কালের গুরু ট্রেনিং পাশ। স্কুলের গোড়ার দিক থেকে আছেন। গাঁয়ের মান্যগণ্য মানুষ। 

স্কুল করে ফিরতে তিনটে সাড়ে তিনটে বাজে। এসে ভাত খেয়ে নিজের ঘরে খানিকক্ষণ লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি। চাকরিটা হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে আমার ওজন আরও বেড়ে গেছে। আগের মত আর পিলু যখন-তখন ঘরে ঢুকে ষাঁড়ের মতো কাউকে ডাকাডাকি করে না। সে ইস্কুলে যায়। ইস্কুল থেকে ফিরে খুব সন্তর্পণে বইখাতা টেবিলে রাখে। আমি লম্বা হয়ে শুয়ে আছি দেখতে পায়। মুখের উপর হাত ফেলা। ফলে চোখ ঢাকা থাকে। আমি যে ঘুমাইনি, জেগেই আছি সে টের পায়। 

ঘুম আসার কথাও নয়। 

কেন জানি আশঙ্কা হয় যে-কোনোদিন, যে-কোনো বিকেলে পরীর দাদু গাড়ি নিয়ে বাবার বাড়িঘরে হাজির হবে। কেন যে পরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হল—এটা আমাকে ভাবায়। বড়লোকদের মর্জি আমি ঠিক বুঝতে পারি না। বাবা সকালে বলেছেন, যা ভাল বোঝ কর। অর্থাৎ বাবাও আমাকে আর ঘাঁটাতে চান না। 

কিন্তু টের পাই ভিতরে আমিও কম অস্থির হয়ে উঠিনি। যে করেই হোক বাবাঠাকুরকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু বোঝাই কী করে। একেবারে বেটা ন্যাংটা সন্ন্যাসী। গেরুয়া নেংটি পরে থাকেন। মন্দির সংলগ্ন তাঁর ঘর। মেঝের উপর কম্বল পাতা থাকে শীত-গ্রীষ্মে। মন্দিরে সকালে ঢোকেন। ঢোকেন এই পর্যন্ত। পূজা আর্চা তাঁর নিজের পছন্দ মাফিক। ইচ্ছে হলে ফুল জল দেন, ইচ্ছা না হলে দেন না। বড় জাগ্রত দেবী। পূজার সময় দেবীকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রপাঠের চেয়ে বেশি খিস্তিখাস্তা করেন। সেবাইত বদরিদা সবসময় তটস্থ থাকেন। এহেন মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোই কঠিন। 

আমার মাঝে মাঝে এসব মনে হয়—যা ভবিতব্য তাই ঘটছে। ঘটবে। কিন্তু এটা কী আমার শরশয্যা…। রাতে ভাল ঘুম হয় না। প্রাইমারি ইস্কুলে মাস্টারি নিচ্ছি শুনে পরী মহাখাপ্পা। বলেছিল, বিলু আসলে তুমি অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ! 

আমি তখন হাঁ। বলেছিলাম, আমি প্রতিশোধপরায়ণ। 

—হ্যাঁ। তুমি আমাকে খাটো করতে পারলে আর কিছু চাও না। 

আমি প্রাইমারী ইস্কুলে মাস্টারি করলে ওর খাটো হবার কী কারণ থাকতে পারে বুঝি না।

পরী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, আমিও জানি তোমাকে কী করে শায়েস্তা করতে হয়।

এস ডি ও পরেশচন্দ্রের সঙ্গে মেলামেশাটা তাপরেই বাড়িয়ে দিয়েছিল ফের। এতটা ভাল দেখায় না ভেবেই হয়তো বাড়ি থেকে হতে পারে কিংবা পরেশচন্দ্র নিজেও বাপ মাকে আনিয়ে পরীর দাদুর কাছে প্রস্তাবটা দিয়েছিল। পরেশচন্দ্র তো জানে না, আমাকে শাস্তি দিয়ে পরী নিজে জ্বলছে। আর সেই থেকে মহাফাপরে। নিজের জালে নিজে জড়িয়ে পড়েছে। 

কিছুই ভাল লাগছে না। শুয়ে থাকতে না, বসে থাকতে না–কেমন এক গুঞ্জন ভেতরে গুঞ্জন না গঞ্জনা, জামা গায় দিয়ে সেই বাদশাহি সড়কে উঠে যাব বলে বের হচ্ছি, মা বলল, সাবধানে যাস। বাবা বললেন, সকাল সকাল ফিরবি। রাস্তাঘাট ভাল না। ট্রাকগুলো যা যমদূতের মতো ছোটে। 

সাইকেল ঘর থেকে বের করার সময় বাবা বললেন, যাচ্ছ যখন, মৃন্ময়ীদের বাড়ি ঘুরে এস। বুড়ো মানুষ, বারবার বললেন, যাক ভালই হয়েছে দেখা হয়ে, বিলুকে একবার আসতে বলবেন। না হলে আমি যেতাম পরীকে নিয়ে। 

পরী আমাদের ঘরবাড়ি দেখেছে, পরী কী শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছে, তার দাদুকে আমাদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে নিয়ে যাবে! 

এসব মনে হলে আমি কেমন যেন একটা মজাও পাই—তুমি আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেই এখন জালে জড়িয়ে পড়েছ। বোঝ এবার। 

মুকুলের কাছে যাওয়া দরকার। কিন্তু মুকুলের কাছে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে। মুকুল সহজে ছাড়বে না। চৈতালি একদিন নাকি ওর কাছে নিজেই হাজির। চৈতালি প্রসঙ্গ উঠলে মুকুল আর থামতে চায় না। 

পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে বাদশাহি সড়কে উঠলেই আগে আমার মন প্রসন্ন হয়ে উঠত। এই রাস্তা যেন আমার আজন্মকালের সঙ্গী। হাজার বছর আগেও মনে হয় এমন এক সড়ক ধরে সমানে ছুটছি। আমি এক অশ্বারোহী। খটাখট আওয়াজ উঠছে ঘোড়ার ক্ষুরের। আমার উষ্ণীষ চন্দ্রালোকে ঝলমল করছে। বড় বড় গাছের ছায়া পার হয়ে দ্রুতবেগে ছুটছি। সেই আমি আজ বিলু। আমার অশ্ব নেই, উষ্ণীষ খুলে নেওয়া হয়েছে। ভাঙা তরবারি। অবশ্য বাবার ভাষায়, যেদিন যায়, তাই সুদিন। যেদিন অনাগত, তা দুঃসময় 

সত্যি কি আমার দুঃসময় উপস্থিত! আমার তো মানসিক যন্ত্রণার জন্ম হলে কবিতা মাথায় আসে- কবে যেন সেদিন এক গভীর অন্ধকারে / দেখি মাথার উপরে আকাশ, এক অলৌকিক নক্ষত্র জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যায়/নীহারিকার খবর কে আর কতটা রাখে / কে জ্বলে, কে নেভে, কোথায় দগ্ধ আত্মা করে লুকোচুরি—তুমি আমি সব তার ছাইভস্ম, উড়ে যায়/নিরন্তর মাঠ পার হয়ে ও কার অনুসন্ধান / ব্যাপ্ত বেদনা অস্থির চকমকি কাঠ— শুধু সে জানে আগুন জ্বালাতে। আমি তার আগুনে পুড়ে মরি বারবার/ যেমত অস্থির পতঙ্গ ধায় প্রজ্জ্বলিত আগুনে। 

আমিও ধেয়ে যাচ্ছি। 

রেলগুমটি পার হয়ে জেলের পাঁচিল, ঝাউগাছের বন অতিক্রম করে শহরের দিকে উঠে যাচ্ছি। 

কী মনে হল কে জানে। গেলেই পরী নেমে এসে বলবে, বিলু! দেখে আত্মাহারা হয়ে যাবে। তারপর চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকলে একসময় বলবে, গিয়েছিলে! আর কতদিন লড়ব! তোমরা কী চাও আমি মরে যাই। বিয়ে হলে কেউ মরে যায় পরীই বলতে পারে। তার স্বাধীন জীবন শেষ হয়ে যাবে। এ জীবন থেকে সে নড়তে চায় না। আর আশ্চর্য হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেবে আমি তার ভরসা। বাবাঠাকুরই একমাত্র পরীর বিয়ে রদ করতে পারেন। তিনি পরীদের পরিবারে সাক্ষাৎ মহাপুরুষ। তিনি যদি বলেন, পরীর বিয়ে এখানে দিও না, আমার মনে খটকা লাগছে, তবেই সব উল্টে যাবে। পরীকে কথা দিয়ে এসেছি যাব। যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। পরীকে পক্ষকালের উপর এড়িয়ে চলছি। 

আজও সেই এক বারবার কেন জানি অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। পরী আশায় রয়েছে, আমার যেতে সঙ্কোচ হচ্ছে, বলি কী করে! — পরীর জন্য তোর এত মাথাব্যথা কেন বিলু। পরী তোর কে? তার ভালমন্দ তুই কতটা বুঝিস? তার বাবা-মা আছে, বিনয়েন্দ্র আছে, তারা বোঝে না, তুই বুঝিস। যদি বলে ভাগ। দুর হ। 

কী যে করি! 

কখন আমি লালদীঘির পাড় ধরে যাচ্ছি, নিজেই টের পাইনি। এ পথটা পরীদের বাড়ি যাবার পথ নয়। আমি আমার অজ্ঞাত ইচ্ছের তাড়নায় পি ডবলু ডি-র কোয়ার্টারের দিকে এগুচ্ছি। সাইকেল নিয়ে ঢুকতেই মুকুল দরজা খুলে বারান্দায়। পাজামা পাঞ্জাবি পরনে। ভারী প্রসন্ন মুখে ভেতরে ঢুকে হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে। বউদি বিলু এসেছে। বউদি বউদি। 

বউদি দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, আর কি, এবারে বসে পড়। দুজনের যে এত কী কথা থাকে বুঝি না। ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না পর্যন্ত! 

সত্যি আমরা দুজনে যখন ঘরে ঢুকে যাই, পৃথিবীর অন্য জানালা আমাদের কাছে বন্ধ হয়ে যায়।

মুকুল বলল, ভিতরে গিয়ে বস। আমি সাইকেলটা তুলে রাখছি। ঘরে ঢুকে বললাম, বউদি এক গ্লাস জল। 

বউদি বলল, এত তেষ্টা পায় কেন? 

—কী গরম! 

—শুধু গরম। তা গরমই বলতে পার। আমারই খেয়াল নেই, ভাদ্র মাস এটা। শরতের আকাশ পরিষ্কার। 

বলতে ইচ্ছে হল, বউদি আকাশ পরিষ্কার নয়। বড়ই ঘোলা। আমার মুখ দেখে টের পাও না।

বউদি আমাদের জননীর মতো। কখনও দিদির মতো, রঙ্গরসিকতা করলে বউদি। 

মুকুল ঘরে ঢুকে বলল, আঃ কী মজা! আজ আমরা ঘুরব। 

—কোথায়? 

—সন্ধ্যার পর বালির ঘাটের দিকে চলে যাব। আজ পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় ঘুরে বেড়াব।

—হঠাৎ! 

—আঃ কী মজা। চৈতালি এসেছিল। 

—সে তো জানি। বলেছ। 

—চৈতালি খুব খুশি। বলল, মুকুলদা তুমি এত সুন্দর লিখতে পার? 

–কী লিখতে পার? 

—কেন কবিতা, আমার কবিতা ওর ভারী পছন্দ বলেছে। 

—ওর ওপর লেখাটার কথা কিছু বলল না। 

—না! 

—ওকে তো সঙ্গীত-সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দিয়েছ। 

—কী গায় বল! টাউন হলের ফাংশনে সেই গানটা—দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় থাকি…অপূর্ব। অসাধারণ। কী গলা। যেন এরই প্রতীক্ষায় সে অনন্তকাল বসে আছে। ও গাইবে আমি শুনব। আমাদের থাকবে ছোট্ট বাংলো প্যাটার্নের একটা বাড়ি। 

আমি বললাম, নিশ্চয়ই কোন পাহাড়ী উপত্যকায়। 

—ঠিক বলেছ। বাংলোর চারপাশে গভীর বনজঙ্গল। ফুল-ফলের গাছ। রঙিন প্রজাপতি উড়বে। আমি বললাম, পাশে একটা ঝর্ণা থাকলে ভাল হয়। 

–ঝর্ণা কেন? 

–বা অমন সুন্দর মেয়ে আর তুমি—সারা দিন সারা বেলা শুধু গাছপালা ফুলফুল দেখবে? ঝর্ণার জলের শব্দ শুনবে না? 

—শব্দ! 

—কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। 

—তুমি ঠাট্টা করছ বিলু? 

—না ঠাট্টা নয়। শুধু ভাবছি, এইটুকু প্রশংসাতেই এই। বুঝতেই পারছ, মেয়েরা একটুকুন প্রশংসাতেই মাথা ঠিক রাখতে পারে না। 

বউদি এক গ্লাস জল রেখে বলল, আমার হয়েছে জ্বালা। 

এ কথা কেন। ভাবলাম। 

বললাম, তোমার আবার জ্বালা কিসের! দাদা থাকতে তোমার জ্বালা হবার তো কথা নয়।

—এই ফাজিল ছেলে। 

—বারে ফাজলামিটা দেখলে কোথায়? জ্বালা আমাদের। 

ও সবারই হয়। বয়স হলে জ্বালা হয়, জ্বালা থেকে যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণা থেকে ঘা হয়। তারপর সংসারে সেই ঘাটা আর শুকায় না। 

বউদি আজ কোনো ক্ষোভে জ্বলছে তবে। বউদির মুখ ব্যাজার। বললাম, কী ব্যাপার! কী হয়েছে বলবে তো? 

মুকুল আগ বাড়িয়ে বলল, ব্যাপার আবার কী! আমাকে ইকনমিক্‌স-এ অনার্স নিতে বলছে। 

মুকুল ইচ্ছে করলে ইকনমিক্‌সে অনার্স নিতে পারে। ম্যাট্রিকে টেনেটুনে সেকেণ্ড ডিভিসন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ই চৈতালির প্রেমে পড়ে যায়। চৈতালির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। পরীক্ষার ভাল ফলটাও চৈতালির প্রতি গোপন প্রেম, ইমপেটাসের কাজ করেছে। এবং এসব কারণে পরীক্ষার নম্বর তার আশাতীত ভাল। সে আমাকে বলেছে, মেসোমশাই জান ঠিকই বলেন—যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। 

আমি বললাম, সে তো বাবা মা’র সঙ্গে ঝগড়ায় পেরে না উঠলে চণ্ডীপাঠ শুরু করে দেন। মা তো এতে আরও ক্ষেপে যায়। 

সে বলেছিল, চৈতালির প্রেমে না পড়লে আমি এত ভাল নম্বর পেতাম না। চৈতালির দিদিরা আমাদের বাঁদর বলেছে—এখন বুঝেছে আমরা কে? 

তারপরই থেমে বলল, বড় হবার সময় কেউ পাশে না থাকলে সাহস পাওয়া যায় না। একজন এসেই যায়। সেই একজনের জন্যই তো বিলু আমরা সব করি। ঠিক কি না বল! এই যে বড় হওয়া, কবিতা লেখা, পরীক্ষার ভাল নম্বর তোলা, শুধু সে একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে। কী বল, তাই না। 

আমি কিছু বললাম না। জল খেয়ে গ্লাসটা রাখার জন্য রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছি। দেখি বউদি বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছে। আমাকে দেখে, বলল, বিলু শোন। 

সহসা যিনি বিকেলে গা ধুতে যাবার জন্য শাড়ি সায়া পরে ঘর থেকে বের হয়ে আসছিল, সেই আমাকে কেন যে অভিভাবকের মতো ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে গেল। আমি কিছুটা হতভম্বই হয়ে গেছি। আবার কেউ কোনো নালিশ-টালিশ করেনি তো! 

বউদিকে আমরা এমনিতে খুব সমীহ করি। এক সন্তানের জননী বাপের এক মেয়ে। আদুরে। টুনি বাড়িতে নেই। বোঝাই যায়। থাকলে আমার সাড়া পেলে ছুটে আসত। লতাপাতা ফ্রক গায়ে দিয়ে টুনি আমাকে দেখলেই স্কিপিং করতে শুরু করে দেয়। সে কত ভাল স্কিপিং করতে পারে এটা দেখানোর মধ্যে ভারী আনন্দ পায়। বোধহয় ওর দাদু-দিদিমার কাছে এখন আছে। সৈদাবাদের দিকে বউদির বাপের বাড়ি। বউদির দুঃখ, এমন আংটা পরিয়ে দিয়েছে সংসার যে, এক রাত বাপের বাড়িতে থাকার সময় নেই তার। সারাটা দিন, এই বাসাবাড়িটি ছিমছাম রাখতে ব্যস্ত। একদণ্ড বসে থাকার যদি ফুরসত মেলে। আমার এসব দেখলে কেন যে মনে হয়, সংসারে এত দায় যে কে তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। কেউ তো বলেনি, সারাক্ষণ এই সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। জানালার পর্দা থেকে গ্রিল কোথাও এতটুকু ধুলোবালির চিহ্ন থাকে না। আসলে এটাই বোধহয় বউদির স্বপ্নের পৃথিবী। সেই স্বপ্নের পৃথিবীতে কে আবার নখের আঁচড় কাটল। এসব যখন ভাবছিলাম তখনই বউদি বলল, বন্ধুকে একটু বুঝিয়ে বল বিলু। আমরা জানি তুমি বললে ও কথা রাখবে। জামাইবাবু পর্যন্ত রেগে গেছেন। 

কী নিয়ে এত জটিলতা বুঝতে পারছি না। সংসারে তবে কী কেউ ভাল থাকে না। যেখানেই যাব আমাকে জড়ানো হবে। 

বললাম, কী হয়েছে? 

—আর কী হবে। সকালে তোমার দাদার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। 

মুকুল এমনিতে খুবই শান্ত স্বভাবের, কিছুটা প্রকৃতি প্রেমিক। আসলে আমরা সবাই। ভীরু প্রকৃতির না হলে কবিতা গল্প কেউ লেখে না এটাও কেন জানি আমার মনে হয়। আমরা যা চাই, স্বপ্ন দেখি— তা সোজাসুজি বলতে পারি না বলেই বোধহয় এই একটা নরম জায়গা আছে যেখানে সহজেই আশ্রয় পেতে পারি। 

বউদি বলল, বোস। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। 

ভিতরে ডবল খাট। মাথার দিকে দুটো জানালা। জানালায় পেলমেট রঙিন পর্দা, খাটের বিপরীত দিকে ড্রেসিং টেবিল – মাথা সমান আয়না। বিবাহিত জীবনে এই আয়নাটা মানুষের বড় দরকার। আমি নিজের পুরো ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। আসলে ওটা আমার বাইরের ছবি। ভেতরে আর একটা ছবি আছে—যা আয়নায় আমার কোনোদিন ভাল করে দেখা হয়নি। পরী এমন আয়নার সামনেই আমাকে নিয়ে দাঁড়াতে চায়। 

বললাম, কী হয়েছে বলবে তো! কী নিয়ে কথা কাটাকাটি। 

—আর কী নিয়ে। বাবু ঠিক করেছেন, বাংলা অনার্স নিয়ে পড়বেন। 

—ভাল তো। 

—তুমিও ভাল বলছ? বৌদি জ্বলে উঠল। 

—বাংলা অনার্স নিয়ে পড়লে ক্ষতি কি? 

—ক্ষতি নয়। বউদির মুখ ভারী গম্ভীর। 

বললাম, কী ক্ষতি? 

—এর কোনো ভবিষ্যৎ আছে? 

সত্যিই বিষয়টা আমি তলিয়ে দেখিনি। 

বউদি ফের বলল, সব ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলায় এম পড়বেন। বাংলায় ডক্টরেট করবেন। দাদারা তো শুনে হাঁ। বাংলা নিয়ে পাশ করলে কী হয় তোমরা ভালই জান। 

বউদির গম্ভীর মুখ দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই। আমরা দল বেঁধে আসি। আমাদের কাগজের অস্থায়ী ঠিকানা এই বাড়ি। অস্থায়ী অফিস, মুকুলের ঘর। কাজেই কোনো কোনো দিন বেশ রাত হয়ে যায় আমাদের আড্ডা ভাঙতে। মুকুলের দাদাকে আমরা সবাই বড়দা বলি। তাঁর তাস খেলার আড্ডা আছে সন্ধ্যায়। চেককাটা লুঙ্গি পরে ঘাড়ে গলায় পাউডার দিয়ে তাসের আড্ডায়। যাবার মুখে দরজায় উঁকি দিয়ে একবার দেখবেন, কে কে আছি আমরা। তারপর হেসে বলবেন, বউদির মেজাজ ঠিক আছে, আর এক রাউণ্ড চা মেরে দিতে পার। অর্থাৎ ইচ্ছে করলে আমরা আর এক রাউণ্ড চায়ের অর্ডার দিতে পারি। যেন উসকে দিয়ে যাওয়া। সেই মানুষের সঙ্গে সকালে মুকুলের কথা কাটাকাটি হয়েছে। ভাবতে খারাপ লাগছে। বললাম, আমি বুঝিয়ে বলব। বউদি বড় হালকা বোধ করল। 

তারপরই মনে হল, কী বুঝিয়ে বলব। 

আমি বললাম, কী বলতে হবে বল তো? ও ইকনমিকস-এ অনার্স নিয়ে পড়ুক এটা তোমরা চাও? 

বউদি বলল, আমি তোমার দাদা আমরা সবাই চাই ও ইকনমিকস-এ অনার্স নিক। এখন যাও বোঝাওগে। তুমি বোঝালে বুঝবে। 

—দেখছি। 

আমার উপর খুব নির্ভর—বিশেষ করে তার দেবরটির ব্যাপারে। 

বউদি ফের বলল, আমি তোমার দাদাকে বলেছি, রাগারাগি কর না। বিলুকে আসতে দাও! সব ঠিক হয়ে যাবে। 

আমি হুঁ-হাঁ কিছু না বলে বের হয়ে এলাম। 

বাইরের ঘরে ঢুকে দেখি মুকুল লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। সামনের জানালার পর্দা সরানো। ওর চোখ জানালা পার হয়ে রাস্তায়। ওর স্বভাব শুয়ে শুয়ে পা নাড়ানো। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, বউদির সঙ্গে নিভৃতে এত আলাপন—ভাল ঠেকছে না। চৈত্রের ঝরাপাতার বড় ওড়াওড়ি। হেমন্তের অপেক্ষায় থাকি— সোনালি ধানের গুচ্ছ, সবুজ ঘাসের মাঠ পার হয়ে যায় দেখ—উদাসী বাউল একতারা বাজায়। তারপরই ঝটকা মেরে উঠে বসে বলল, আমি আমার মতো বাঁচতে চাই। এত ব্যাগড়া দিলে চলে! 

বুঝতে পারি মুকুল আজ ভাল নেই—সে তার কবিতার দু-একটা লাইন আউড়ে মনে প্রশান্তি আনার চেষ্টা করেও পারেনি, তাই ক্ষেপে গিয়ে বলল, আমি কী নিয়ে পড়ব না পড়ব তাও বাড়ি থেকে ঠিক হবে। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাম নেই! বলে আর একটা বালিশ সে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি যাতে আয়েস করে বসতে পারি কিংবা পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে পারি সেজন্যে সে একটা বালিশ আমার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমি বিছানায় না বসে পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। কিছু বললাম না। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই জানালাটা আমারও ভারী প্রিয়। রাস্তার পর মাঠ, তারপর পুলিশ সাহেবের বড় বাংলো, বিশাল এলাকা জুড়ে পাঁচিল। কতরকমের গাছপালা- বাড়ির পাশ দিয়ে জজ কোর্টে যাবার রাস্তা—অনেক দুরের এইসব দৃশ্য এবং মানুষজনের পাশাপাশি মনে করিয়ে দেয় পরীর সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ লাল রঙের লেডিজ সাইকেল। বড় শৌখিন সাইকেলে চেপে পরী কোনো বিকেলে সহসা আমাদের আড্ডায় হাজির। কত বিকেল এমন অপেক্ষায় কেটেছে। তারপর কোনোদিন সে এলে, আমি বোবা বনে গেছি। পরী এলে আমি কিভাবে কথা বলব বুঝতে পারতাম না। পরী বড় চঞ্চল, পরিহাসপ্রিয় এবং এক অদম্য উৎসাহের ভাণ্ডার। পরী এলে কেন যে গম্ভীর হয়ে যেতাম—সবাই মিলে একশটা কথা বললে, আমার একটা দুটো কথা। তার উপরেই বেশি গুরুত্ব দিত পরী। আমি হাঁ বললে হাঁ, না বললে না। 

আমি চুপচাপ থাকলে মুকুলের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দেয়। সে জানে, স্কুলের মাস্টারি নিয়ে পরীর সঙ্গে আমার রেষারেষি চলছে। পরী একদিন মুকুলকে বলে গেছে, বন্ধুটিকে শেষ পর্যন্ত প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টার বানিয়ে ছাড়লে। এই তোমার বন্ধুকৃত্য! এটা মুকুলকেও বোধহয় ভাবিয়েছে। কাজটা শেষ পর্যন্ত ভাল কি মন্দ হল বুঝতে পারছে না। সে তার জামাইবাবুকে ধরাধরি না করলে কাজটা আমার হতই না। পরী এমনও নাকি শাসিয়ে গেছে, তোমাদের কাগজে আর আমি নেই। ফলে কাগজের ভবিষ্যৎ নিয়েও আমরা সংকটের মধ্যে আছি। 

অপরূপা কাগজ তো আর কাগজ নয়—আমাদের কিছু হবু গল্পকারদের প্রাণ। ওটা না বের হলে আমাদের মর্যাদা নিয়ে টানাটানি। পরীর যে বিয়ে ঠিক। বাড়ি থেকে পরীর বের হওয়া বন্ধ। কিন্তু পরীর এক কথা। এখন বিয়ে-ফিয়ে আমি করব না। পড়ব। এর চেয়ে পরী বেশী কিছু বলে না। 

পরেশচন্দ্র পরীর দাদুকে বলেছে, মিমি পড়তে চায়-পড়ুক না। পরেশচন্দ্রের বাবা বলেছেন, নিশ্চয় পড়বে। আমরা পড়াব। এমন ব্রিলিয়েন্ট ছাত্রী না পড়লে চলবে কেন। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়াই ভাল। 

এখন সব কিছুতেই জট পাকিয়ে যাচ্ছে। পরীর বাড়িতে যাওয়া হচ্ছে না। গেলেই পরীর এক কথা, গিয়েছিলে! 

যাই কী করে। যাওয়া হয়নি। 

আমার মাস্টারি নিয়ে রেষারেষি পরীর সঙ্গে। পরী শেষ পর্যন্ত হয়তো বিয়ের পিঁড়িতে বসে আমাকে রক্ষা করতে পারে। দেখ এবার, তুমি প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টারি করতে পার আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারি না! আমি সব পারি। মিছিলে যেতে পারি, পার্টির পোস্টার লিখতে পারি, আর ‘মাউন্টব্যাটন, সাধের ব্যাটন কারে দিয়া গ্যালা’ গাইতে পারি, নাটকে নায়িকার পার্ট করতে পারি—আর বিয়ের পিঁড়িতে টুক করে বসেও যেতে পারি। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। লক্ষ্মী ঠিকই বলেছে, তোমাকে মাস্টারি মানায় না, রাখালি করগে, যেন পরী বলতে চায়, আমি সব পারি, তুমি কিছুই পার না। 

এখানে এসে আর এক জট। মুকুলের সঙ্গে ওর বড়দার সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। 

 মুকুলকে বললাম, দাদা, বউদি, জামাইবাবুর যখন ইচ্ছে ইকনমিকস-এ অনার্স নিয়ে পড়ার, তাই পড়।

—তার মানে! 

—মানে একটাই বাংলায় অনার্স নিলে ভবিষ্যত ঝরঝরে। আমার মাস্টারির মতো।

—বাংলায় অনার্স আমার বিধিলিপি। 

—বিধিলিপি মানে? 

—বিধিলিপি বোঝ না? নিয়তি। বুঝলে নিয়তি। বাংলায় অনার্স আমাকে নিতেই হবে।

—নিতেই হবে। 

—নিতেই হবে। বলে মুকুল ফের চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, যেন বড়ই অসহায়। কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। 

—চৈতালির দিব্যি নাকি? 

আর তখনই রাস্তায় কাকে দেখে মুকুল ধড়ফড় করে উঠে বসল। বলল, এই শিগগির। তাড়াতাড়ি কর। দেখ কে আসছে? 

দেখলাম যিনি আসছেন, তিনি আর কেউ নন—চৈতালির দিদি। প্রচণ্ড মোটা, মাথার সামনের দিকটায় টাকের মতো, লাল রঙের সিল্ক পরা। রিকশা থেকে নেমে, দরজার কাছে এসে বউদির নাম ধরে ডাকছে। 

বউদি বাথরুমে। মুকুল দু-লাফে তক্তপোষ থেকে নেমে ওদিকের দরজা খুলে আড়ালে কথাটা বলে এদিকে আবার চলে এল। ভদ্রমহিলা বুঝতেই পারল না, কে দরজা খুলে দিল। এক দরজা দিয়ে তিনি ঢুকলেন, অন্য দরজা দিয়ে মুকুল আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল। তারপর দেখছি মুকুল ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটছে। আমি পিছিয়ে পড়লে বলেছে, ইস শিগগির। 

কী কারণ বুঝতে পারছি না। 

—কী হয়েছে? ছুটছ কেন! 

—চলে এস, শিগগির চলে এস। 

বাড়ির আড়ালে পড়ে যেতেই কিছুটা যেন স্বস্তিবোধ করছে মুকুল। একবার পেছন ফিরে তাকায় আবার হাঁটে। 

—আরে হলটা কী? 

—আর হল। 

এদিকটায় বড় মাঠ, ইষ্টিশনে যেতে হলে এই বড় মাঠ পার হয়ে যেতে হয়। না পেরে বললাম, আমরা কি ট্রেনে করে পালাচ্ছি? 

—প্রায় তাই বলতে পার! 

বুঝতে পারছি না চৈতালির দিদিকে দেখে মুকুল এহেন আচরণ করছে কেন! চৈতালি নিজে এসে মুকুলের কবিতার সুখ্যাতি করে গেছে। দিদির পারমিশন না পেলে চৈতালির এক পাও নড়বার উপায় নেই। সেই দিদিকে দেখে এত ভয়? ভয় হবার তো কথা নয়। বাড়ি থেকে ছাড়পত্র না পেলে মুকুলের কাছে চৈতালি আসতেই পারে না। কারণ এর আগে কম ঝক্কি যায়নি মুকুল ফাঁক পেলেই সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে দিত। মুকুল দিলে আমি না দিয়ে থাকি কী করে। মাধ্যাকর্ষণের টান। মুকুল এই টানে কোথায় যাবে জানি, আর গিয়ে কি দেখবে তাও জানি। বড়দি ছাড়পত্র না দিলে চৈতালি মুকুলের কাছে আসে কী করে। না কি গোপনে এসে দেখা করে গেছে! গোপনে এসে দেখা করেছে ভাবতেও কেমন রোমাঞ্চ বোধ করলাম। 

আমি ডাকলাম, এই মুকুল শোন। কোথায় যাচ্ছ? 

—পালাচ্ছি। 

—পালাচ্ছি মানে! চৈতালির দিদি কি ধাওয়া করবে ভাবছ? 

—করতে পারে। 

মুকুল আসলে কত ভীরু প্রকৃতির বুঝতে কষ্ট হয় না। ওকে সাহস দেবার জন্য বললাম, রাখ তো—দেখা আছে সব। তুমি কী অন্যায় করেছ যে ভয় পাবে। বলে দৌড়ে হাত ধরে ফেললাম। 

এখানে কিছু বড় গাছ আছে। মাঠে সবুজ ঘাস। জায়গাটা খুবই নিরিবিলি। দুজন উঠতি যুবকের পক্ষে মাঝে মাঝে এ-সব জায়গা খুবই মনোরম। প্রাণ খুলে কথা বলা যায়। ওকে হাত টেনে বসালাম। বললাম, ব্যাপার কী বল তো! 

মুকুল পা ছড়িয়ে বসেছে। গাছের কাণ্ডে শরীর হেলানো। পাঁচটার ট্রেন চলে যাচ্ছে। আকাশ নীল এবং স্বচ্ছ। শরতের আকাশ। আজ জ্যোৎস্না উঠবে। 

তখন মুকুল বলল, রুদ্রাক্ষ ধরা পড়ে গেছে। 

রুদ্রাক্ষ মুকুলের ছদ্মনাম। সে নিজের নামে কবিতা লেখে। শহরের অনুষ্ঠান নিয়ে যে আলোচনার পাতা বরাদ্দ করা আছে সেটাও সে লেখে। ছদ্মনামে না লিখলে চলে না। অনুষ্ঠানের সমালোচনাও থাকতে পারে—সবাই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, পথেঘাটে ধরে ধোলাই দিলে কে কাকে রক্ষা করবে ভেবেই মুকুল ছদ্মনামটি নিয়েছে। অপরূপার প্রথম সংখ্যায় শহরের বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিন-চতুর্থাংশ জায়গা চৈতালির জন্য দিয়েছে। এতে চৈতালির খুশি হবার কথা—কোনো বিপাকেই পড়ার কথা নয়, তাছাড়া চৈতালি মুকুলের সঙ্গে কথা বলেছে, এরপর আর কী হুজ্জতি হতে পারে—ভেবে পেলাম না। 

বললাম, কার কাছে? 

—আর কার কাছে! ওর দিদিরা টের পেয়েছে ওটা আমি লিখেছি। 

—খারাপ কিছু তো লেখনি। 

—খারাপ লিখব কেন? চৈতালির খারাপ হয় এমন কিছু আমি লিখতে পারি? তুমিই বল!

—না কিছু বুঝছি না! চৈতালি তো তোমার কবিতার প্রশংসা করে গেছে। তুমিই বলেছ।

–না করেনি। 

—তবে যে সেদিন বললে, চৈতালি কী খুশি! 

—ওটা আমার ধারণা। জান, বিলু আজকাল আমার যে কী হয়েছে! মনে মনে যা ভাবি, সেটা কেন জানি মনে হয় সত্যি ঘটেছে। চৈতালি আসবে; ঠিক আশা করেছিলাম সে আলোচনা পড়ে খোঁজ করতে আসবে, কে লিখেছে? 

—সমালোচনা পড়ে ও আসবে ভাবলে কী করে? না আসারই তো কথা। 

—বুঝলে না, মনের উপর তো আমার হাত নেই। আমি ভাবলাম, ব্যস হয়ে গেল। মনে হল সত্যি সে এসেছে। আমার সঙ্গে কথা বলেছে। মুকুলদা তুমি কী সুন্দর কবিতা লিখেছ বলেছে। এই ভাবনাটাই আমার কাছে সত্যের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই বলেছিলাম। জান সে আসেনি। জান বউদিকে ওর দিদিরা বলেছে, তোর বাঁদর দেওর এটা লিখছে। চৈতালিকে নিয়ে এত পাঁচ কাহন করার কী আছে। কী কারণ। কী সূত্র। বলবি আমি একদিন যাব। ধুইয়ে দিয়ে আসব। জীবনে ও আর চৈতালিকে নিয়ে যেন লিখতে সাহস না পায়। এ কী রে বাবা, নাক টিপলে দুধ গলবে, এখনই এই ভাষা—কী যাদু বাংলা গানে, চৈতালির সেই উচ্চকিত কণ্ঠ—যেন সেতারের মুর্ছনা, শেষ হয়েও শেষ হয় না। যা অনন্ত, যা অসীম, চৈতালির গান শুনলে তা টের পাওয়া যায়। যেন আকাশ মাটি গাছপালা কীটপতঙ্গ সব স্তব্ধ। ঝড়ের পর প্রকৃতির সেই নিরুপম সৌন্দর্য তার সঙ্গীতে। এত কাব্য করা হয়েছে কেন। তোর রুদ্রাক্ষকে বলবি, আর যেন চৈতালিকে নিয়ে বাঁদরামি না করে! 

—বউদি বলল। 

—হ্যাঁ সেই তো। দাদাও জেনে গেছে। 

–কী জেনে গেছে? 

—আমি চৈতিকে নিয়ে একটু ইয়েতে আছি। 

—এটাই আমাদের গেরো। যাকে ভালবাসি সেই কেমন শত্রুপক্ষ হয়ে যায়। আমার সঙ্গে পরীর সম্পর্কটা ভালবাসার পর্যায়ে পড়ে না—বরং সবাই জানে, পরীকে আমি দু চোখে দেখতে পারি না। সংসারে আমরা উভয়ে উভয়ের চরম শত্রু। পরীর কোনো কাজই আমার পছন্দ নয়। বেহায়া বলে পরী মেশে! 

ভাবলাম, সত্যি রুদ্রাক্ষ চৈতিকে নিয়ে একটু বেশি কাব্য করে ফেলেছে। 

আমি বললাম, আর কতক্ষণ বসে থাকবে? 

—গিয়ে যদি দেখি বসে আছে! 

—থাকুক বসে। বসে থাকল তো বয়ে গেল। ভালবাসা অন্যায় নয়। আমাদের ইচ্ছে আমরা ভালবাসব। ভালবাসা মানুষের ফাণ্ডামেন্টাল রাইট তুমি জান? 

—সে তো জানি। 

—আমরা তো বলছি না, চৈতিকেও এজন্য তোমাকে ভালবাসতে হবে, কী বল? তুমি কখনও জোর খাটিয়েছ? আমাদের ইচ্ছে আমরা ভালবাসব। কার কি বলার আছে? 

—কারও কিছু বলার নেই। 

—তুমি বলেছ, আমি ভালবাসি, তোমাকেও ভালবাসতে হবে? না ভালবাসলে হুজ্জতি হবে? এমন তো দাবি করনি। 

–না। 

—তা হলে মামলা দাঁড় করাবে কার ভিত্তিতে? 

—চৈতালির দিদিরা সব পারে। হেডমিসট্রেস বলে কথা। 

—ভয় পেলে চলে না। এক কাজ করব? 

—কী করতে চাও? 

—প্রণবের মারফত কাজটা করা যায় না? 

—না, না। ও করতে যেও না। হিতে বিপরীত হবে। ও করতে যাবে না। দাদা পর্যন্ত বলল। 

—কী বলল? 

—তোরা চৈতির পেছনে লেগেছিস। চৈতিকে না দেখলে আমাদের মন মানে না, সেজন্য যাওয়া। পেছনে লাগার কী হল! 

—তুমিই বল বিলু, শুধু দেখি। আমরা শিস মারি না, মাস্তানি করি না, শুধু দেখি। চৈতিকে ‘না দেখলে মনে হয় দিনটা মাঠে মারা গেল। দূর থেকে দেখলে মনে হয় দেবী চলে যাচ্ছেন। বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়ব চৈতির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে বলে। 

.

মেয়েদের কলেজে এখনও অনার্স ক্লাস খোলা হয়নি। বাংলায় অনার্স নিতে হলে চৈতালিকে আমাদের কলেজেই ভর্তি হতে হবে। বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়ার বাসনা তবে মুকুলের সেই জন্য। এক সঙ্গে ক্লাস, এক সঙ্গে বের হয়ে আসা; করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। নোট টুকে নেবার ছল করে, কথা বলার সুযোগ—এত সব ভেবে মুকুল বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়বে বলে ঠিক করেছে। আর সেই নিয়ে মুকুলের বাড়িতে ঝড় উঠে গেছে। 

ক্রমে সাঁঝ নেমে এল। ইস্টিশনে আলো জ্বলছে। শহরের রাস্তায় আলো। আজ আর তবে দু বন্ধুতে সাইকেলে বালিরঘাটে জ্যোৎস্না দেখতে যাওয়া হল না। দিগন্ত প্রসারিত মাঠে নেমে জ্যোৎস্নায় ডুবে যাওয়া আমাদের বিলাস। আমি চুপ মেরে বসে থাকি, মুকুল গলা ছেড়ে গান ধরে—দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। আমি তখন আর বিলু থাকি না, মুকুল তখন আর মুকুল থাকে না। এক রাজার পৃথিবী আমাদের সামনে। মাথায় উষ্ণীষ, এক হাতে তরবারি, অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম-পেছনে বসে আছে রাজকন্যা সংযুক্তা। পৃথ্বিরাজ জয়চন্দ্রের কন্যা হরণ করে পালাচ্ছে। 

সব যুগেই এই পৃথ্বিরাজদের কপালে দুঃখ থাকে। 

বললাম, এবারে ওঠো। আমাদের সাহসী হওয়া দরকার। 

—তুমি বলছ সাহসী হতে? 

—আলবত। 

আমার মধ্যে মুকুল নুতন কিছু যেন আবিষ্কার করে মনমরা ভাবটা কাটিয়ে ফেলল। আমি এভাবে কখনও কথা বলি না। কথা সব আমার মনের সঙ্গে। বাইরের লোক দেখলে ভাবে আমি এক বিষণ্ণ মানুষ। মুকুল নিজেও এ অনুযোগ করেছে বার বার। বিলু তুমি এত বিষণ্ণ থাক কেন? এত কম কথা বল কেন? আজ আমার মধ্যে সেই বিষণ্ণতা টের না পেয়ে সে অবাকই হয়ে গেছে। এ যেন অন্য এক বিলু তার সঙ্গে কথা বলছে। দারিদ্র্য বিলুকে তবে আর পঙ্গু করে রাখতে পারছে না। দুর্জয় সাহসের অধিকারী বিলু। বলল, বিলু পারবে ফেস করতে? 

—দেখ পারি কি না? 

মুকুল বলল, তুমি পারবে। চল। নো কম্প্রোমাইজ। যদি বলে, রুদ্রাক্ষ ছদ্মনাম তোমার? বলব, হ্যাঁ! যদি বলে তুমি চৈতিকে নিয়ে কাব্য করেছ? বলব, হ্যাঁ। যদি বলে চৈতিকে নিয়ে তোমার এত কাব্য করার বাসনা কেন? বলব হ্যাঁ, বাসনা থাকে। আপনারও ছিল। মাস্টারি করে করে সব হারিয়েছেন। বিয়ে থা করলেন না। সময়ে বিয়ে না করে পস্তালেন। চৈতির জীবন আমি নষ্ট হতে দেব না। 

আমরা ফিরছি। মুকুলের আবেগ এসে গেছে। আমার বলার ইচ্ছে ছিল, এত বলার দরকার হবে না। 

তার আগেই কাট। 

হঠাৎ মুকুল থেমে গেল। কী ব্যাপার বিলু তুমি কিছু বলছ না? যা বললাম, ঠিক বলিনি?

মনের কথা ফস করে বেরিয়ে গেল—এত বলার দরকার হবে না। তার আগেই কাট। 

—কার্ট মানে? 

—চিত্রনাট্য দেখছিলাম। তাতে কাট কথাটার খুব ব্যবহার। 

—চিত্রনাট্য দেখছিলে মানে? 

—আরে সেদিন বিমল কলকাতা থেকে নাটকের কাগজ নিয়ে এল না। 

বিমলই আমাদের মধ্যে একমাত্র নাটকের চর্চা করে। সে কলকাতায় গেলে নাটক সম্পর্কিত যত কাগজ পায় নিয়ে আসে। সেই আমার কাছে কাগজটা দেখার জন্য রেখে গিয়েছিল। কী সুন্দর ছাপা! পরিচ্ছন্ন কাগজ। আমাদের অপরূপার কোনো অঙ্গসজ্জা নেই। কাগজটার পাশে অপরূপা খুবই ম্যাড়মেড়ে। ইচ্ছে ছিল কাগজটা পরীকে দেখাব। পরী দেখলেই তার বাসনা হবে অপরূপাকেও সেভাবে সাজানো যায় কি না। কারণ কাগজটা তো আমাদের প্রাণ। কাগজের সম্পাদক আমি, কাগজের তিন- চতুর্থাংশের ইজ্জত আমার। আমার ইজ্জত বাড়লে পরী কেন জানি গর্ববোধ করে। কিন্তু একে একে এমন সব জটিলতা এসে জুটবে, কে জানত! যে-পরী কাগজের সব, তাকে নিয়েই বাড়িতে চরম অশান্তি। 

পরীর দাদু যেতে বলেছে। মুকুলকে সঙ্গে নিয়ে গেলে হয়। কিন্তু মুকুল গেলে পরীর দাদু কিছু নাও বলতে পারেন। অবশ্য উপরে নিয়ে যেতে পারেন তিনি। মুকুলকে একা নিচে রেখে উপরে যাওয়া ঠিক শোভন হবে না। মুকুল বড় সেনসিটিভ। একা যেতেও ভয় করছে। এই ভয় থেকে মুকুলের কাছে চলে আসা। অথচ বলতে পারছি না, জান পরীর বিয়ে নিয়ে অশান্তি দেখা দিয়েছে। পরীর বিয়ে শুনলে, সবাই সটকে পড়বে।—বল কী! পরীর বিয়ে! কার সঙ্গে। পরী রাজি! পড়বে না! কলেজ করবে না! আমাদের কাগজের কী হবে! 

আমার প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টারি করায় পরীর যাই ক্ষোভ থাকুক যতই ভয় দেখিয়ে যাক, তোমাদের কাগজে পরী আর নেই—কিন্তু মুকুল প্রণব সুধীনবাবুরা জানে, আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে পরীর সব ক্ষোভ জল হয়ে যাবে। ওরা বোঝে বিলুর চরিত্রে এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে যা পরীর মতো মেয়েকেও ভাবায়। কাগজের আর্থিক দিকটায় কোনো জটিলতা দেখা দিলেই পরীর সামনে ওরা আমাকে ঠেলে দেয়। 

সেই পরীর বিয়ে ঠিক, পরী রাজি নয়, পরীর চোখ বসে গেছে, যেন বড় একটা অসুখ থেকে উঠেছে দেখলে মনে হয়—আর সেই চিৎকার, দাদু জান না, তুমি জান না, ও আমার কত বড় শত্রু। সেই হাহাকারের ছবি চোখে ভেসে উঠলেই আমি স্থির থাকতে পারি না। রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। কাউকে বলতেও পারি না। 

আমার বুকের মধ্যে টনটন করতে থাকে— বলি, পরী সত্যি আমি তোমার সব চেয়ে বড় শত্রু। আমার শত্রুতার শেষ নেই। 

বাবাঠাকুরের কাছে যাইনি, এও এক ধরনের শত্রুতা। সব দায়ভার আমার উপর অর্পণ করে বসে আছ, আমার উপর তোমার প্রবল বিশ্বাস-কথা যখন দিয়েছি বাবাঠাকুরের কাছে যাব। আমি না গিয়ে থাকতে পারব না। এখন বুঝতে পারছি এ যাওয়াটা আমার পক্ষে কত কঠিন। – আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না? 

আমরা কিছুক্ষণ দুজন চুপচাপ হাঁটছিলাম। কথা বলছিলাম না। ‘কাট’ চিত্রনাট্যে ব্যবহার হয়ে থাকে। পরিচালক তার কাহিনী বিন্যাস অনেকগুলো দৃশ্যে ভাগ করে নেয়। অর্থাৎ এক একটা শট তোলার পরই কাট। আমার কাছে ‘কার্ট এই শব্দটি অনেকভাবে এখন প্রযোজ্য। মনের মধ্যে ‘কার্ট’ রয়ে গেছে। আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না—কথাগুলি পরী সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা থেকে মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। মুকুল বুঝল চৈতালি সম্পর্কে কোনো নুতন পন্থা মাথায় আমার এসেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, কী কাজ করলে হয় না বিলু? 

আমি কী বলি! 

এটা যে আমার নিজেরই সলিলকি বোঝাই কী করে! মুকুলের এমন সঙ্কট মুহূর্তে নিজের জটিলতা নিয়ে অস্থির হয়ে উঠছি তাও তো বলতে পারছি না। মুকুল তবে ভাববে বিলুটা বড় স্বার্থপর। সে নিজেকে ছাড়া কিছু ভাবে না। নিজের মান অপমান ক্ষোভ নিয়ে ব্যস্ত। 

বললাম, না। মানে আমরা যদি এখন গিয়ে বলি, দেখুন আমরা সত্যি বাজে ছেলে নই। বাঁদর নই। কারণ আমরা এখন জ্যোৎস্নায় হেঁটে যেতে চাই। জ্যোৎস্না আমাদের চারপাশে এখন খেলা করে বেড়াচ্ছে। কত রকমের প্রজাপতি উড়ছে আমাদের চারপাশে। কত রকমের গাছ আমাদের ছায়া দেয়। আমরা তারই সৌন্দর্যে বিভোর। নারী আমাদের কাছে এখন দেবী ছাড়া কিছু নয়। সব তরুণীই আরাধ্যা দেবী। এখন আমাদের কোনো বাসনা নেই। বরং চৈতালির যে কোনো অপমান আমাদের অপমান। চৈতালিকে খাটো করলে আমরাই খাটো হয়ে যাব। রুদ্রাক্ষ চৈতালির সৌন্দর্যের পূজারী। 

মুকুল অবাক হয়ে বলল, পারবে বলতে? 

—পারব না কেন? 

মুকুল সহসা যেন আলোর খোঁজ পেয়ে গেছে। ওর মধ্যে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে কেউ। সে ঘুসি পাকিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল তার দুঃখ। সে বলল, পারতে হবে। হাতের তালুতে আর এক ঘুসি মেরে বলল, সত্যের বিনাশ নেই। বিলু আমাদের পারতেই হবে। কিছুতেই হেরে যাব না। 

তারপর থেমে আমার মুখের দিকে তাকাল। কী ভাবল কে জানে! সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আমরা হেরে যাবার জন্য জন্মাইনি। আমরা হারব না। 

সে আমার হাত তুলে ইস্তাহার দেখাবার মতো অথবা শ্লোগান দেবার মতো বলল, বল, আমরা হারব না, হারব না। 

ওকে খুশি করার জন্য বললাম, আমরা হারব না, হারব না। 

আবার সে বলল, আমরা ভয় পাব না, ভয় পাব না। 

কিছুটা ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে ভেবে বললাম, ভয় পাবার কী আছে? 

—না তবু বল হাত তুলে, বজ্রমুষ্টি তুলে বল, আমরা ভয় পাব না, ভয় পাব না। 

পি ডব্লু ডি-র কোয়ার্টার্স থেকে ইস্টিশনের পথ অনেক দূরে। ক্রোশব্যাপী এই মাঠ— উত্তরে শহরের রাস্তা লালবাগের দিকে চলে গেছে। দক্ষিণে শহরের রাস্তা জেলের পাঁচিল ঘেঁসে মোহন সিনেমার পাশ দিয়ে ইস্টিশনের দিকে গেছে। ফাঁকা মাঠের মধ্যে আমরা যতই চিৎকার করি না কেন কেউ শুনতে পাবে না। জ্যোৎস্নায় কিছু জীব এখনও মাঠে চরে বেড়াচ্ছে। ওগুলো ধোপাদের গাধা। আমরা দুজন এবং কিছু গাধা বাদে, এই মাঠে অন্য কোনো প্রাণীর সাড়া নেই। 

মুকুল আবার বলল, আমরা ভালবাসব, বাসব। 

আমি চুপ করে আছি দেখে বলল, বল, একসঙ্গে বল, আমরা ভালবাসব, বাসব। 

বুঝতে পারছি মুকুল কী সাংঘাতিক নার্ভাস ফিল করছে। এখন না বলেও উপায় নেই। এমন বন্ধু না থাকলে আমার ইস্কুলের মাস্টারিটাই হত না। মিলের টিউশনি করতে গিয়ে কী অপমানের বোঝা না বইতে হত। 

ইস্কুলের মাস্টারিটা হয়ে যাওয়ায় কত বড় নিষ্কৃতি পরী যদি বুঝত। 

আমি কিছু না বলায় মুকুল বোধহয় আহত হয়েছে। আমি যে আমার মধ্যে থাকি না, মানুষের চিন্তা ভাবনার কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না, আমরা ভালবাসব শ্লোগান আমার মাথায় ঢোকেনি, ক্ষণিকের মধ্যে কত স্মৃতি ভিড় করে এসেছিল মুকুলকে বোঝাই কি করে? 

বললাম, কী বলতে বলছ? 

—বল, আমরা ভালবাসব, বাসব। 

দুজনে সমস্বরে বললাম, আমরা ভালবাসব, বাসব। 

—আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। 

—কিসের অধিকার মুকুল? 

—কেন ভালবাসার অধিকার। 

—কাকে? 

—চৈতালিকে। 

আমি আর পারলাম না। বললাম, এ তো অর্জন করতে হয়। অধিকার অর্জন করতে হয়। 

—কী করে করব বুঝতে পারছি না। 

—আমিও ঠিক জানি না। তবে নিজেকে বড় করে তোলার মধ্যেই এই অর্জনের অধিকার জন্মায়। বড় অর্থে মুকুল আমি কৃতী হতে বলছি না, একজন গরিব মানুষও খুব বড় হতে পারেন—তাঁর চরিত্রই তাঁকে বড় করে। এত অধীর হলে চলবে কেন। নারীমহিমা সব মেয়েদের মধ্যেই আছে। বুঝতে পারছি আমাদের মধ্যে হ্যাংলামিটা একটু বেশি। চৈতালিকে নিয়ে আর একটি লাইনও নয়। এবার থেকে অন্য যারা আছে, তাদের কথা থাকবে। চৈতালিকে নিয়ে অপরূপায় আর একটি লাইনও নয়। 

—তবে এত খাটাখাটনি কার জন্য? 

—কেন নিজের জন্য! 

—ধুস আমার বয়ে গেছে। 

আমি বোঝালাম, শোন মুকুল, ভেবে দেখ—শহরে লীলা রত্না কম ভাল গায় না? 

—ভাল গায়। 

—সমর অধীরও জলসায় গায়। 

— গায়। 

—এরাই শহরের সব অনুষ্ঠানের মণি। 

—চৈতালিকে বাদ দিচ্ছ কেন? 

—চৈতালিও আছে। থাক না। একবার চৈতালিকে নিয়ে লেখা গেল, এবারে রত্নাকে নিয়ে। প্রফেশনাল জেলাসি বুঝলে না? তুমি রুদ্রাক্ষ একবার দয়া করে প্রমাণ কর, সব লেখাতেই তোমার কাব্য থাকে। আমি চাই কাব্যটা রত্নার বেলায় আর একটু বেশি থাকুক। আমরা খুবই নিরপেক্ষ এটা প্রমাণ করা দরকার। 

—নিরপেক্ষ প্রমাণ করব, কাগজ কী আর বের হবে? ওর গলায় ভারী হতাশার সুর। 

—কাগজ ঠিক বের হবে। কাগজ আমরা কিছুতেই বন্ধ হতে দেব না। কাগজ আমাদের কাছে এখন মর্যাদার প্রশ্ন 

আমরা এসে গেছি। দেবদারু গাছের ছায়া পার হলেই ওদের কোয়ার্টার্সের সামনেকার বাগান। মুকুলের দাদার ফুলের শখ। জবা, জুঁই বেলফুলের গাছ। গাছগুলিতে বেলফুল ফুটেছে। জ্যোৎস্নায় গাছে খই হয়ে ফুটে আছে। বেলফুলের সুগন্ধে সারাটা বাগান ম ম করছে। মুকুল থমকে গেছে। বাগানে ঢুকছে না। আমাকে ঠেলে দিচ্ছে। 

চৈতালির প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই। তবু কেন জানি মনে হয় চৈতালি আমাদের সঙ্গে খুবই বেমানান—ঠিক যেমন পরী, সব সুন্দরী তরুণীরাই অন্য কারো জন্য যেন অপেক্ষা করে আছে। আমরা ফালতু। যত নিজেদের ফালতু মনে হয় তত কাব্যচর্চার প্রতি কেন জানি অনুরাগ জন্মায়। মাথায় এই অনুরাগের ঠেলা খেলে অনেক সাহসী কাগজ বের করে ফেলতে পারি। আর পারি বলেই লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে গেলাম। চৈতালির দিদিকে পরোয়া করি না। দেখলাম, বউদি একা বসে কী একটা বই পড়ছে। চৈতালির দিদি নেই। 

খুব সর্তক পায়ে ঢুকে বললাম, চলে গেছে? 

—কে? 

—মানে যে এসেছিল? 

বউদি হাহা করে হেসে দিল। তোমরা ওকে এত ভয় পাও কেন বল তো? 

—ভয়, না ভয় নয়। মানে- 

—মানে আর বোঝাতে হবে না। বন্ধুটি কোথায় 

—রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। 

—ডাক। 

আমি ডাকলাম, মুকুল ভয় নেই। চলে এস। 

মুকুল যেন কথাটার অর্থই ধরতে পারেনি—একেবারে তাজ্জব। সে বারান্দায় উঠে বলল, কে নেই! কার কথা বলছ! 

—যার থাকবার কথা ছিল! 

—তিনি কে? থাকলে আমার কী, না থাকলেই বা আমার কী। আমরা কারোর দাস নই। বউদি শাড়ি সামলে উঠে দাঁড়ালেন—বইয়ের ভাঁজে একটা কাগজ রেখে বললেন, তোমাদের কোকিলকণ্ঠী কলকাতায় চলে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হবে। আমার কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে গেল। বড়দার কাছে চিঠি লিখতে হল। 

শুনে মুকুল আমি হতভম্ব। 

মুকুল কখন ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেছে খেয়াল করিনি।

—চিঠি কেন? 

—সুপারিশ। 

বউদির বড়দা প্রেসিডেন্সিতে পড়ায় জানি। নিজের দাদা নয়। বউদির বড় পিসিমার ছেলে। এটা বউদি আমাদের অনেক সময়ই শুনিয়েছেন। বউদির সুপারিশ তাহলে দরকার হয়। আর বউদির দেবরটি বাঁদর! বাড়িতে বাপু সুপারিশ চাইতে আসা কেন। কীরকম রাগ এবং বিদ্বেষ জন্মাল—স্বার্থপর— আমরা যা করি তাই অপছন্দ। বললাম, তুমি চিঠি দিলে কেন? 

বউদি আমার দিকে না তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। যাবার সময় বলল, গেলে বাঁচি বাপু যা চলছে। 

তবে কী বউদিও চায় চৈতালি শহর ছেড়ে চলে যাক। চৈতালি মুকুলের মাথাটি চিবোচ্ছে। চৈতালি মুকুলের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে ছাড়বে। সব পক্ষই সমান। বউদি বুঝল না, আমাদের এই ভালবাসা বেঁচে থাকার রসদ। কবিতা লেখার রসদ। মুকুলের সব অনুপ্রেরণা এই মেয়েটি। সে চলে গেলে মুকুল ভারী ভেঙে পড়তে পারে। দিনে অন্তত একবার যাকে না দেখলে দিনটা বিফলে গেল এমন মনে করে—তার পক্ষে চৈতালির শহর ছেড়ে যাওয়া বড়ই হতাশা সৃষ্টি করবে। কাগজের জন্য মুকুলের খাটাখাটনি বৃথা মনে হবে। কাকে যে এখন চাঙ্গা করি। মুকুলকে না পরীকে। পরীকেও তো কথা দেওয়া আছে। না কোনোদিকে পথ পাচ্ছি না। 

ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। আমাদের হয়ে কেউ ভাবে না। বউদিকে রাগিয়ে দেবার জন্য বললাম, চৈতালি চলে গেলেও মুকুল যা ভেবেছে তাই করবে। 

ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বউদি আমাকে দেখল। বলল, কী বললে? 

—না মানে, ও তো বলছে বাংলায় অর্নাস নেবেই। 

—নিক না। কে বারণ করেছে। আমরা আর কতদিন! বাবুর এখন পাখা গজিয়েছে। বাবুকে বলে দিও, জীবনটা এত সহজ নয়। 

আসলে বউদি তো মুকুলকে ছোট থেকে বড় করেছে। সন্তান-স্নেহ। বুঝি সব। সবসময় ভয় জীবনটা না মাটি হয়ে যায়। দুর্ভাবনা। দুর্ভাবনা কেবল দেখছি আমার বাবারই নেই। যা কপালে লেখা আছে তা নাকি খণ্ডাবার ক্ষমতা দেবতাদেরও নেই। 

পরীর দাদুর অনুগ্রহ লাভে বাবা খুবই খুশি। শহরের এমন জাঁদরেল মানুষ বাবাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে এসেছেন, এটা বাবার ইহজীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তাঁরই ইচ্ছে সব। না হলে একজন ছিন্নমূল মানুষের শেকড় চালিয়ে দেবার সময় এতসব সৌভাগ্যলাভ হয় কী করে। শুধু কী নেমে আসা। বাড়ির সবাইকার খোঁজখবর নিয়েছেন। পিলু পড়াশোনা করছে কিনা জানতে চেয়েছেন। দু-এক বছর বাদে পিলুর যে একটা হিল্লে হয়ে যাবে বাবা পরীর দাদুর কথাবার্তায় এমনও অনুমান করে এসেছেন। তাঁর পরিবারের পক্ষে মাথার উপর এত বড় মানুষের কৃপাদৃষ্টি পড়বে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। 

ও-ঘর থেকে মুকুলের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বউদি কখন এক কাপ চা, কিছু নোনতা বিস্কুট রেখে গেছে টেরই পাইনি। চোখ বুজে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছি। আসলে মানুষ একসময় বড় হয় স্বপ্ন দেখতে দেখতে। স্বপ্নে সে রেলগাড়ি চালিয়ে দেয়। এক একটা ইস্টিশনে থামে, যাত্রী ওঠে, নেমে যায়, তারপর একসময় শেষ স্টেশনে গেলে, কেউ আর থাকে না। গাড়িটা আর সে। এখন আমি সেই রেলের চালক। বাবা-মা ভাইবোন নিয়ে রওনা হয়েছি –একটা নির্জন স্টেশনে কেউ দাঁড়িয়ে। তার আঁচল উড়ছে। নীল বাতির মতো জ্বলছে। সিগনালিং। গাড়িতে আর একজন উঠবে বলে স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছে। তাকে এবার তুলে নাও। 

বউদি ডাকল, এই বিলু চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল! কার ধ্যানে মগ্ন হলে!

তাকালাম। 

বউদি হাসল। বলল, বাবুকে ডাক। 

চেয়ে দেখি টেবিলে দু-কাপ চা। ডাকলাম, এই মুকুল, এস। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

—তুমি খাও। 

—আরে এস। বাংলায় অনার্স নিয়েই পড়বে। দাদা বউদি কিছু আর বলবে না! 

সহসা মুকুল লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বলল, আমি কী নিয়ে পড়ব না পড়ব কাউকে ভাবতে হবে না। বলে চা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। 

বসে বসে চা-টুকু শেষ করলাম। পরীর দাদুর সঙ্গে দেখা না করে গেলে বাবার অনুযোগ শুনতে হবে। বাবা বলবেন, আমি ঠিক তোমাদের বুঝতে পারি না। নামী মানুষকে সম্মান দিতে তোমরা শেখনি। সম্মান দেখালে কেউ ছোট হয়ে যায় না। নিজেকে নিজে ছোট না করলে, কেউ তাকে ছোট করতে পারে না। তোমাদের মতিগতি আমি ঠিক বুঝতে পারি না। কী ভাববে মানুষটা! ভাবতে পারে, তোমার বাবার সংসারে কোনো নিয়মশৃঙ্খলা নেই। ভাবতে পারে, খবরটা আমি তোমাকে দিইনি। তোমার বাবার দায়িত্বজ্ঞান কম। এসবও তো তিনি ভাবতে পারেন। একবার দেখা করতে দোষ কোথায়। 

চটপট উঠে পড়লাম। –না যাওয়া দরকার। আমার জন্য না হলেও বাবার সম্মানের কথা ভেবে যাওয়া দরকার। মুকুলের ঘরে ঢুকে বললাম, যাচ্ছি। নতুন কপি সব ঠিক করে রেখ। প্রেসে দিয়ে দেব। 

মুকুল শুনল কী শুনল না বুঝলাম না। সে বলল, বউদি কী বলল? চৈতালির দিদি কেন এসেছিল? প্রেসিডেন্সিতে সত্যি ভর্তি হবে। 

—সুপারিশ পত্র নিতে 

—কার জন্য সুপারিশ? 

—চৈতালি সেনের হয়ে সুপারিশ পত্র লিখে দিলেন বউদি। 

—কার কাছে? 

—প্রেসিডেন্সির তোমাদের সেই আত্মীয়ের কাছে। 

—কেন? বউদি লিখতে গেল কেন? 

—সে তুমি জিজ্ঞেস করগে। 

চৈতালি সেন চলে গেলে এই শহরের জ্যোৎস্না মরে যাবে। চৈতালি সেন চলে গেলে, এই শহরের আর ফুল ফুটবে না। চৈতালি সেন চলে গেলে, লালদীঘির ধার, শহরের সদর রাস্তা, টাউন হল, সব নির্জন পরিত্যক্ত নগরী হয়ে যাবে। অন্তত একটা মানুষের কাছে এই শহর মৃতের শহর বলে মনে হবে। কথাটা বলি কী করে। 

মুকুল চায়ের কাপ নামিয়ে বলল, তুমি তবে বলবে না! 

কী আর করি। কেমন অসহায় চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মুকুল, মনে হয় কিছুটা শুনেছে—সবটা শোনেনি। কিংবা সবটাই শুনেছে, আমার কাছে আবার জানতে চায় বউদির এটি ঠাট্টা কিনা। চৈতালি সেনকে নিয়ে বউদির ঠাট্টা-বিদ্রুপ আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। বললাম, চৈতালি সত্যি শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। 

—আমাদের জন্য? 

—কী জানি! আমরা তো শিও দিইনি, টিজও করিনি। কেন যে চলে যাচ্ছে! 

—ঠিক জান চলে যাচ্ছে? 

—তাই তো বউদি বলল। প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হবে। 

মুকুল মাথা নিচু করে কী ভাবল। তারপর বলল, আচ্ছা বিলু এক কাজ করলে হয় না? 

-কী কাজ! 

—আমি চৈতালি সেনের কাঁটা! 

—তুমি কাঁটা হবে কেন! 

—না হলে চলে যাবে কেন। ভাবছি আমিই বরং চলে যাব। এ শহরে চৈতালি না থাকলে শহরটা অর্থহীন হয়ে যাবে। 

—কী আজেবাজে বকছ? 

—আজেবাজে বকছি না। একটা শহর/বাঁচে, বেঁচে থাকে/ সেই নারী যবে হেঁটে যায় অকুস্থলে। কী কারণ জানি না/ বাঁচি না আমি/ আমার আত্মা খাঁচায় আছে জানি/ সেই আত্মার জন্য, নীল আকাশ চাই চাই ঘরবাড়ি / বাড়ি আছে গাছ নাই, ফুল আছে পাখি নাই, নদী আছে জল নাই— সব শূন্য/অন্ধকারে ডুবে আছে গভীর নক্ষত্র। 

মুকুল তার একটি প্রিয় কবিতা বলে শুয়ে পড়ল। পাশ ফিরে মুখ লুকাল। 

আমি ওর পাশে বসলাম, বললাম, মুকুল চৈতালি না থাকুক আমরা তো আছি। ছেলেমানুষী করতে যেও না। তুমি চলে গেলে বালির ঘাটে গিয়ে আমার সঙ্গে কে তবে জ্যোৎস্না দেখবে। ভেবে দেখ তো সেই জ্যোৎস্না, বালিরঘাট, বাদশাহি সড়ক, বাঁশের সাঁকো কত কবিতার জন্মই না দিয়েছে। একা চৈতালি সেন সব কবিতার জন্ম দেয় না মুকুল! আমরাও আছি। তুমি না থাকলে আমি কত একা হয়ে যাব। 

মুকুল কী ভেবে বলল, সারাটা দিন আমি ভাল ছিলাম না। দাদা বউদির সঙ্গে ঝগড়া করেছি। একটা স্বার্থপর মেয়েকে না ভালবাসাই ভাল। 

—এই তো চাই। 

মুকুল উঠে বসল। দীর্ঘকায় মনে হচ্ছে মুকুলকে। ভরাট গাল, রেশমের মত নরম দাড়ি গালে, একমাথা ঘন চুল ব্যাকব্রাশ করা, পাঞ্জাবি গায়ে গেরুয়া রঙের বাহার যাকে বলে, এমন সুপুরুষ যেন আমার চোখে কমই ঠেকেছে। মুকুলের স্বভাব, আত্মপ্রত্যয় ফিরে পাবার জন্য ঘুসি পাকিয়ে কথা বলা—সে বলল, আমাদের একটা কিছু করতেই হবে। আমরা দূরে যাবই। সেই বহুদুরে, যেখানে অচলা পার্বতী সব বিষপান করে শিবের সঙ্গিনী। সেখানে আমরা যাবই। 

—আমাদের যেতেই হবে। 

এই যেতেই হবে বলে বেরিয়ে পড়ার সময় বললাম, তাহলে বলে যাই। 

—কী বলবে? 

—বউদিকে বলে যাই তুমি ইকনমিক্স-এ অনার্স নিয়ে পড়বে। 

—আমার না হয় হল, তোমার কী হবে? 

—কেন মাস্টারি করব। প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টার। দারুণ। ভাবা যায় না। কোনো দায় নেই, শুধু পড়িয়ে খালাস। তারপর মুক্ত স্বাধীন। তারপর আমার সাইকেল, আর বাদশাহি সড়ক। তারপর, শহরে বিকেল নেমে আসবে, গাছপালার ছায়ায় আমি চলে আসব তোমার কাছে। তারপর আমরা যাব, ধোবিখানার মাঠে। সেখানে সবাই মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহিত্যচর্চা। আর অপরূপা তো থাকলই। সে আমাদের সব। আর কিছু না পারি একটা কাগজকে ভালবাসা কম কথা নয়। কাগজ তো নয়, লিটল ম্যাগাজিন। সব নতুন কথা, নতুন খবর মানুষের ঠিকানায় পৌঁছে দেব। পুরনো সব ঝেড়ে ফেলতে হবে। নতুন জেনারেশন তৈরী হচ্ছে, আমাদের কাগজটা হবে তারই মুখপত্র। কোথাও বেঁচে না থাকতে পারি, কাগজটার মধ্যে অন্তত বেঁচে থাকতে পারব। 

আসলে মুকুল বুঝতে পারছে, ওর ভেতরে যে ঝড় উঠেছিল তার প্রশমন হওয়ায় সে দারুণ খুশি। আমার আর কোনো সম্বল নেই—বাবার দীনেশবাবু আছেন, মানুকাকা আছেন, ইদানীং পরীর দাদু সম্বল হয়ে গেছে, কিন্তু আমার মতো করে আমাকে দেখার পাশে কেউ নেই—একমাত্র মুকুল, মুকুল সেটা জানে, বোঝে। বোঝে বলেই আবেগের চোটে এত কথা বলে যাচ্ছি তা ধরতে পারি। এমনিতে আমি খুব কম কথা বলি, সাহিত্যচর্চার আসরেও একমাত্র মুকুল আর আমি এক সঙ্গে থাকলে কখন প্রগলভতা দেখা দেয়। মুকুল সব সময় মেনে নেয় আমার এই প্রগলভতা। 

মুকুল বলল, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু মিমি তো মিছে বলেনি। ইস্কুলের মাস্টারি জামাইবাবুকে ধরপাকড় করে না দিলেই ভাল ছিল। সত্যি বোধহয় তোমার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দিলাম। 

হাহা করে হেসে ফেললাম—হেসে ফেললাম জোর করে। বিষয়টাকে উড়িয়ে দেবার অথবা হালকা করার আর কোনো পথ জানা ছিল না। বললাম, বাদ দাও মিমির কথা। 

—কি বলছ! মিমি তোমার জন্য কত ভাবে! আর তুমি একথা বলছ! 

—মিমি আর কদ্দিন! 

—কেন, কদ্দিন মানে! 

একটু রসিকতা করার প্রলোভনে, আসলে রসিকতা নয়, কোনো গুরুত্বই দিচ্ছি না প্রমাণ করার জন্য বলা, যদিদং হৃদয়ং মম…তারপর কী যেন আর সহসাই মনে হল এ কী ছলনা করছি নিজের সঙ্গে! 

—তার মানে! 

কোনো জবাব দিতে পারছি না। সব কেমন বিস্বাদ ঠেকছে। বললাম, ও কিছু না। যাই। 

মুকুল আমাকে এগিয়ে দেবার জন্য সাইকেল বের করছে। সে আমাকে রোজ রেল গুমটি পর্যন্ত রাতে এগিয়ে দিয়ে আসে। কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সাইকেল বের করার আগে দরজায় উঁকি মেরে বললাম, বউদি যাই। 

বউদির সেই কথা, সাবধানে যেও। 

মুকুল বারান্দার নিচে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা পথ আমরা পাশাপাশি হাঁটব। দুজনের হাতে সাইকেল। কিছুটা পথ দুজনে সাইকেলে পাশপাশি, কিছুক্ষণ আবার গাছের ছায়ায় বসে থাকা কিংবা সাহেবদের কবরখানার কালভার্টে। কিছুতেই ছেড়ে আসতে ইচ্ছা হয় না। বাড়িতে মা-বাবা চিন্তা করে, পিলুটা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে—এ সবের টান না থাকলে আমি যেন ফেরার কথা ভুলেই যেতাম। 

সাইকেল বের করার সময় মুকুলই মনে করিয়ে দিল, বউদিকে বললে না। 

—ওঃ ভুলেই গেছি। ও বউদি, বউদি শোনো। 

বউদি বোধহয় মুকুলের ঘরের বিছানার চাদর পাল্টাচ্ছিল— কিংবা বিছানার লণ্ডভণ্ড অবস্থা ঠিকঠাক করছিল-আসতে পারছে না ঘর থেকেই বলল, এত চেঁচাচ্ছ কেন। বলতে পার না। আমি কালা না কিরে বাবা! 

—বউদি, মুকুল ইকনমিক্স-এ অনার্স নেবে। দুজনে বসে অনেক আলোচনার পর এটাই ঠিক হল!

বউদির ভারী গম্ভীর গলা— সে বাবু যা ভাল বুঝবেন, করবেন। তোমরা যা ভাল বুঝবে করবে।

আসলে সংসারে যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, কী খাবে, পরবে সব ঠিক রাখে, তারই কোনো গুরুত্ব নেই। দু’বছরের মধ্যে কোথাকার এক বিলু এসে মাথার উপর বসে গেছে। 

বউদির অভিমানটা কোথায় টের পাই। বউদি কী জানে না—একটা বয়সে মা-বাবা, ভাইবোন, একটা বয়সে সমবয়সী বন্ধুবান্ধব, আর একটা বয়সে চৈতালি সেন। চৈতালি সেন এলেই জীবনের একটা মহৎ পর্ব শেষ। এই পর্বটার কথা মানুষ কোথাও গিয়ে ভুলতে পারে না—এই পর্বটা বড় রহস্যময়, এই পর্বটা আছে বলেই পৃথিবীটা মানুষের কছে চিরদিন বেঁচে থাকার কথা বলে। সে যখন সব হারায়, তার এই পর্বটা, নদীর পারে কোন দূরবর্তী খেয়ার মতো থেকে যায়। 

বউদির কোথায় লেগেছে বুঝি। বউদির ধারণা, আমি বুঝিয়ে সুজিয়ে মত পাল্টেছি। আসলে তো অন্য ব্যাপার। চৈতালি কলকাতায় চলে গেলে বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়ার আর কোনো মানে থাকছে না। আসল কারণ সেটাই। কিন্তু এসব কথা তো আর বউদিকে বলা যায় না। 

রাস্তায় নেমে আসতেই শরতের এক আকাশ নক্ষত্র আর জ্যোৎস্না ঝপ করে মাথার উপর নেমে এল। লালদীঘির ধারে নতুন নতুন বাড়ি উঠছে। কত রকম ফ্যাশানের বাড়ি। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। শৌখিন মানুষেরা এখানে থাকে। জানালায় লাল নীল রঙের পর্দা। ভিতরে নিয়ন আলো। কোনো জানালায় সদ্য যুবতী হবে বলে বসে আছে মেয়ের মেঘলা করুণ মুখ। সবই আমাদের চোখে পড়ে। বিশাল দীঘির জল নিস্তরঙ্গ। নির্জন জ্যোৎস্না সেখানে খেলা করে বেড়াচ্ছে। আমরা দুই সদ্য যুবক হয়ে ওঠা পুরুষ চারপাশে নারী অন্বেষণে থাকি। স্বপ্নে তারা আসে। কখনও কোনো ফুলের উপত্যকায় হাত ধরে নিয়ে যায়। সহবাসের হাহাকার ভেতরে। এই হাহাকার নারীকে অপার মহিমায় আমাদের কাছে সাজিয়ে তুলছেন এক অদৃশ্য শক্তি—যেতে যেতে টের পাই। আমাদের যা কিছু আমাদের বড় হওয়া তারই জন্য এমন মনে হয়। যে-পথে সে হাঁটে বড় পবিত্র মনে হয়। 

তখনই মুকুল বলল, যেখানেই যাক ছাড়া পাবে না। আমরা তাকে ছাড়ব না! তাকে ভালবাসবই।

কার সম্পর্কে মুকুলের এই ক্ষোভ বুঝি। সব কথাতেই মুকুল আমি না বলে আমরা বলে। আমরা যেন একটা কোড। আমরা অর্থাৎ এই যারা আমাদের মতো বয়সী মানুষেরা বড় হচ্ছে, তাদের কাছ থেকে চৈতালি সেনদের আত্মরক্ষার কোনো উপায়ই নেই। 

‘আমরা’ আরও নতুন অর্থ বয়ে আনে আমাদের কাছে। আমরা চৈতালি সেনকে ভালবাসব। এই ‘আমরা’ অর্থে আমি এবং মুকুল। মুকুল মাঝে মাঝেই বলবে চৈতালিকে আমরা দুজনেই ভালবাসব। কী বল! যেন চৈতালির মতো মেয়ের পক্ষে একজনের ভালবাসা যথেষ্ট নয়। তার জন্য দুজন পুরুষ দরকার। 

ঠাট্টা করে বলতাম, কিন্তু এক ঘরে দুজনে ঢুকব কী করে? 

—কেন, দ্রৌপদী যদি পঞ্চপাণ্ডব সামলাতে পারে, চৈতালি আমাদের দুজনকে সামলাতে পারবে না।

—পারবে তবে অসুবিধা আছে। 

—না কোনো অসুবিধা নেই। তোমার জুতো দেখলেই বুঝব, ঘরের ভেতর তুমি আছ। আমার দেখলে বুঝবে আমি আছি। 

—তা হলে বলছ, দু-রকমের দু জোড়া। 

—তাই। তবে আর কোনো অসুবিধা থাকবে না। কী ঠিক বলিনি। 

—ঠিক না বলে আমার উপায় থাকে না। যে মেয়ে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তার জন্য দু জোড়া কেন, পাঁচ জোড়া থাকলেও অসুবিধা হবার কথা না 

মুকুল ভারী তৃপ্তি পেত এমন সব আজগুবি চিন্তা-ভাবনা করে। পুরুষের কাছে মেয়েদের এই নারীমহিমার কথা চৈতালির দিদিরা টেরই পেল না। আইবুড়ো হয়ে থাকল -কিসের অপেক্ষাতে আমাদের মাথায় সেটা কিছুতেই আসে না। 

লালদীঘির পাড় ধরে আমরা হেঁটে যাই। কিছু মানুষজনের চলাফেরা, একটা রিকশা চলে গেল, আমরা এত অন্যমনস্ক থাকি যে রাস্তাটার ধার ধরে হাঁটতে হয়। সাইকেলে উঠি না। সাইকেলে উঠলেই রাস্তাটা কেমন খুব ছোট হয়ে যায়। যেন উঠতে না উঠতেই রাস্তা শেষ। শহর থেকে রেল-লাইনের দিকে যে রাস্তা গেছে, সেখানে এলে আমরা সাইকেলে চাপি। ধীরে ধীরে, হাওয়া খেতে খেতে এগোনো। আসলে বুঝতে পারি, বাড়ি গেলেই কেন জানি একা হয়ে যাই। কারো পাশে থাকার কথা যেন। সে না থাকায় অর্থহীন মনে হয় সব কিছু। 

বাড়ি যেতেই দেখলাম পিলু দৌড়ে আসছে। পিলু দৌড়ে এলেই বুঝি, বাড়িতে আমাদের জন্য কেউ সুখবর বয়ে এনেছে। খবরটা আগে পিলু দিতে না পারলে শাস্তি পায় না। কতক্ষণে দাদাকে বলবে, জানিস দাদা, আজ না……। 

শিলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দাদা আজ না…. 

—আজ কি? 

—আজ না, মিমিদির দাদু এসেছিল। 

বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। আমার যাবার কথা ছিল, যাইনি বলে নিজেই হাজির। পরীর কিছু হয়নি তো! শহরের এতবড় মানী মানুষ, এমন একটা জঙ্গলের মধ্যে হাজির হয়েছিল। 

বললাম, কেন এসেছিল? পরী পাঠিয়েছে? 

—পরীদি পাঠাবে কেন? পরীদি কিছু জানেই না। বাবাকে বলল, দশ কান করবেন না। চেষ্টা করছি, মনে হয় হয়ে যাবে। 

সাইকেল থেকে নামতে লণ্ঠনের আলোয় বারান্দায় বাবাকে দেখা গেল। মা পাশে বসে আছে। দুজনকে একসঙ্গে পাশাপাশি বসে পুত্রের ফেরার আশায় থাকতে কোনোদিন দেখিনি। বাবাকে মা তালপাতার পাখায় হাওয়া করছে। 

বুঝতে পারছি, আমাদের পরিবারের পক্ষে বড়ই সুখবর কেউ দিয়ে গেছে আজ। মা বাবা সবাই বড় বেশি প্রসন্ন। আমাকে দেখেই বাবা বলবেন, সাইকেলটা রেখে বিশ্রাম কর। পিলু তোর দাদার সাইকেলটা তুলে রাখ। মায়া যা, দাদাকে এক বালতি হাতমুখ ধোবার জল এনে দে। 

বারান্দায় একটা জলচৌকি, কাঠের চেয়ার। মার তাগাদাতেই এসব করা। বাড়িঘর হয়ে যাওয়ার পর আরও কত কাজ বাকি থাকে বাবাকে দেখে বুঝতে পারছি। যজন যাজনে সংসার চলে, যজমানরা কেউ কেউ বেশ সচ্ছল। শুভদিন, শুভযাত্রা, পূজা-আর্চ্চার বিধি এসব জানতে তারা আসে। বসতে দেবার কিছু না থাকলে ঘরবাড়ির সুনাম নষ্ট। মা লেগে থেকে হালে এ দুটো মূল্যবান জিনিস মিস্ত্রি লাগিয়ে করে নিয়েছে। প্রতিবেশীদের কার বাড়িতে কী নতুন জিনিস এল মার কানে পিলু তুলবেই। কিংবা বিকালে মা এর-ওর বাড়ি গেলে দেখতে পায় বালতি, পেতলের হাঁড়ি। কবে কিনলি আকাশীর মা। সের দুই চালের খিচুড়ি ধরবে। মার কাছে পেতলের ডেগ, পেতলের বালতি, পেতলের ঘটি সোনার চেয়েও দামী। বাড়ি ফিরে অপ্রসন্ন মুখে শুধু অভিযোগ, কিছু নেই, এই যে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা আসছে, একটা পেতলের ডেগ লাগে না। চেয়ে চিনতে কাহাতক আনা যায়। বাবা তখনই বুঝতে পারেন হয়ে গেল, কিনে না আনা পর্যন্ত সময়ে অসময়ে মার চণ্ডীপাঠ শুরু হয়ে যাবে। 

আজ অন্যরকম। জলচৌকিতে বসতেই বাবা বললেন, ঈশ্বরের করুণাই সব। তাঁর কী মর্জি কেউ বুঝতে পারে না। 

বাবা আমাকে কিছু বলবেন, তারই প্রস্তুতিতে এসব ভাষণ। আমি চুপচাপ আছি। পরীর দাদু কেন এসেছিল, জানার যেন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বড়লোকদের সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা নেই। মনে হয় এই অর্থ প্রতিপত্তির পেছনে বড় রকমের কোনো অনাচার কাজ করছে। এঁরা সাধু পুরুষ নন। মানুষ তার পরিশ্রমের বিনিময়ে কতটা উপার্জন করতে পারে আমি বুঝি। পরীদের যা বৈভব, তা রক্ষা করতে কোথাও কারও চোখ উপড়ে ফেলা হচ্ছে না, আমি বিশ্বাস করতে পারি না। শহরের রাস্তাঘাট ধরে যাবার সময় বিশাল বিশাল বাড়িঘর দেখলেও এটা মনে হয়। এরা কেউ সৎভাবে বেঁচে নেই। সৎভাবে একজন মানুষের উপার্জন এত প্রাচুর্য এনে দেয় না—এটা আমার বিশ্বাস। পরীদের বাড়ি গেলে এটা আমার আরও বেশি মনে হয়। দাবার কূট চালে এরা প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ঘোড়া হাতি সব কেড়ে নিয়েছেন। সেই মানুষ আমাদের কলোনিতে এলে, বাবার গর্ব বোধ হতে পারে, আমার কেন জানি হয় না। বাবার প্রচণ্ড ঈশ্বর বিশ্বাসও মাঝে মাঝে আমাকে ক্ষোভের শিকার করে তোলে। ভেতরে চটে যাই—বাবা কষ্ট পাবেন বলে কিছু প্রকাশ করি না। যতটা পারি কম কথা বলি। হাঁ হুঁ এই পর্যন্ত। 

মায়া বারান্দার নিচে এক বালতি জল রেখে ঘরে গামছা আনতে গেল। চিরদিনই কিছুটা গম্ভীর এবং কম কথার মানুষ আমি। বাবার জন্যই যেন এটা হয়েছে আমার। আমার বাবা একজন অপরিচিত মানুষের কাছে যে ভাবে ঘরবাড়ির কথা খোলাখুলি বলে দেন- আমার তা পছন্দ নয়। আমার সম্পর্কেই তাঁর বেশি গৌরব। এই যে বিলুটা আই এ পাশ করল সোজা কথা। আই এ পাশ করলে সরকারি কাজ পাবেই। পাবে না মানে– প্রাথমিক ইস্কুলের মাস্টারি বেশিদিন করবে না। ঠেকা দেওয়া, চেষ্টা- চরিত্র চলছে, মানুও চেষ্টা-চরিত্র করছে। লোকের কাছে এমন শুনলেই আমার মাথা আর ঠিক রাখতে পারতাম না।—রাখেন তো আপনার মানু! তিনি আমাকে বাসের কনডাকটার করতে পারলেন না এটাই তাঁর জ্বালা। আমি সব বুঝি বাবা। নিজের ছেলেগুলো সব চোর বাটপাড় হচ্ছে, আপনার ছেলের ভাল তিনি চাইবেন কেন! না হলে একটা গ্যারেজে আমাকে ঢোকায়! 

এ-সব কথাবার্তা রাতে খেতে বসলেই বেশি হয়। 

বাবা বলতেন, মানু কী জানত গোবিন্দ তোকে মারধর করবে। 

—গ্যারেজে কী হয় আপনি জানেন না বাবা! আর বাবাকে তো বলাও যায় না, কত রকমের কুৎসিত কথাবার্তা হয়। আমাকে যার তার বাচ্চা বলে গাল দেয়। বাবাকে এইসব খিস্তিখাস্তার কথা বলতেও পারি না, অথচ বাবার মানুপ্রীতি আমার মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। সেই জ্বালায় দেশান্তরী হয়েছিলাম। ভাগ্যিস ছোড়দি ছিল। না হলে হয়ত এ-জীবনে আর ফেরাই হত না, পড়াও হত না, পরীর সঙ্গে দেখাও হত না। 

বাবার এই এক স্বভাব, কারো কাছে এতটুকু উপকার পেলে বর্তে যান। আমরা ছিন্নমূল হবার পর নানা জায়গায় ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত বাবার খুবই নিকট আত্মীয় মানুকাকার বাসায় এসে উঠেছিলাম। চার-পাঁচ বছর আগে বাবা এই উঠতে পারার কৃতজ্ঞতায়, এখনও এক কথা, মানুটা না থাকলে কী যে হত! 

—দোষ নেই। গুণই বা কী আছে। ক্যাম্পে যান দাদা—ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে দিচ্ছি। সোনার হারটা বন্ধক ছিল, সেটা নাকি সুদেই উশুল হয়ে গেল। দু-ভরির হার। ভাগ্যিস আর তোমার ভাইয়ের বুদ্ধিতে পড়িনি। সব বিক্রি করে এই জমি। থাকলে আমাদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ত। 

বাবার তখন আপ্তবাক্য—কেউ কাউকে সর্বস্বান্ত করতে পারে না ধনবউ। নিজে সর্বস্বান্ত না হলে, কেউ কাউকে সর্বস্বান্ত করতে পারে না। 

এখন আর বাবার সেই চরম আপ্তবাক্যটি আমাদের শুনতে হয় না। নতুন নতুন আপ্তবাক্য বাবা এখন ঝোলায় সংগ্রহ করে রাখছেন। 

একদিন কী কারণে মা’র ক্ষোভ বাবার উপরে চরমে উঠলে, কেঁদে ফেলেছিল মা–তোমার মানুভাই, বুঝলে তোমার পরম আত্মীয় আমার দু-ভরির হারটি বন্ধকই দেয়নি। তুমি ফুসলালে বলে দিয়েছিলাম। তুমিই তো বললে,—মানুর বাসায় উঠেছি, একা এতগুলি পেট চালাবে কী করে। কিছু থাকলে দাও। ওর হাতে দিই। বন্ধক দিয়ে কিছু যদি মেলে। ও টাকাটা হাতে ধরে দিতে পারলে, সময় পাওয়া যাবে—ঠিক কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

আমরা জানতাম, মা’র স্বর্ণালঙ্কার নেই। ইস্টিশনে পড়ে থেকেছি, ভাঙা মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছি, দু-একটা অলঙ্কার যে মা বাবার হাতে তুলে দেয়নি অন্ন সংস্থানের জন্য তা নয়, তবে মা দিয়েই বলত, আর কিছু নেই। এই নেই নেই করেও মা তার শেষ সম্বল বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল এই জঙ্গলের মধ্যে জমি কেনার জন্য। তার আগে মা’র দু-ভরির হারটি মানুকাকা সুদের নাম করে গস্ত করেছে। মানুকাকার বাড়িতে গিয়ে মা একদিন দেখে এসেছে হারটি কাকিমার গলায় শোভা পাচ্ছে। এখন আবার পরীর দাদু হাজির। তাঁর কী মর্জি বুঝতে পারছি না। তিনি কেন এই কলোনিতে হাজির বুঝতে পারছি না। আমাকে তাঁর এত কী দরকার, যে কারণে এখানে পর্যন্ত ছুটে এসেছেন। হাতমুখ ধুয়ে একসঙ্গে খেতে বসেছি রান্নাঘরে—মা থালা সাজিয়ে দিচ্ছে, মায়া পাতে পাতে নুন-দিচ্ছে, জল দিচ্ছে, বাবা গণ্ডুষ করছেন, আমি পিলু গণ্ডুষ করছি—অথচ কেউ কোনো কথা বলছি না। বোধহয় বাবা পরীর দাদুর আগমনবার্তাটি আমাকে কীভাবে দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। 

বাবা খাচ্ছেন। গাছার উপর একটা কুপি জ্বলছে। শেয়াল ডাকছিল। কীটপতঙ্গের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। মা ভারী প্রসন্ন—বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাই বলবেন বোধহয় এমন ঠিক হয়ে আছে। পিলু যে পিলু রাস্তায় গিয়ে রায়বাহাদুরের আগমনবার্তাটি দিয়েছিল সেও চুপ। 

বাবা ভাত থেকে একটি ধান বেছে থালার বাইরে ফেলে দেবার সময় বললেন, বুঝলে মানুষই মানুষের সম্বল। 

আমি জানি, কিছু না বললেও বাবা তাঁর কথা বলে যাবেন। 

—বুঝলে, শুধু মানুষ হবে কেন, এই যে কীটপতঙ্গ, প্রাণিজগৎ, গাছপালা, মাটি জল হাওয়া সবই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য। তাঁরই অশেষ করুণা না থাকলে, রায়বাহাদুরের মতো মানুষ তোমাদের ঘরবাড়িতে আসবেন কেন! 

বাবা তাঁর ঘরবাড়ি বানাবার পর, কোনো বিশিষ্ট মানুষ এলে খুবই খুশি হন। যেন বলা, দেখ এই যে ঘরবাড়ি বানিয়েছি, ও শুধু তোমার আমার আশ্রয় নয়—ঘরবাড়ির সঙ্গে মর্যাদার প্রশ্নও থাকে। মানুষজন এলে সেটা বাড়ে। 

বাবা কাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলছেন ঠিক যেন এখন বুঝতে পারছি না। পরীর সঙ্গে একবার বাদশাহি সড়ক দিয়ে জিপে এস ডি ও পরেশচন্দ্র আমাদের বাড়ি হেঁটে এসেছিল একটা ম্যানাস্ক্রিপ্টের প্যাকেট দিয়ে পরী পাঠিয়েছে। এস ডি ও সাহেব আমাদের বাড়ি আসায় বাড়িঘরের মর্যাদা বাবার কাছে কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, টের পেয়েছিলাম পরে। নিবারণ দাসের সঙ্গে দেখা, কী বিলু, তোমাদের বাড়িতে নাকি সদরের এস ডি ও এসেছিলেন। 

বলেছিলাম, হ্যাঁ। 

জীবন পরানের সঙ্গে দেখা, তাদেরও এক কথা। 

কলোনির ঘরে ঘরে বাবা খবরটা পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন। আসলে তাঁর পুত্রগৌরব কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটাই প্রমাণ করার উদ্দেশ্য। নরেশমামা পর্যন্ত তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন শুনে। তিনি নিজে একটা মেয়েদের প্রাথমিক ইস্কুল খুলেছেন, তাঁর অনুমোদন যদি এস ডি ও সাহেবকে ধরে করিয়ে দিই—এই মানুষটির প্রতি কেন জানি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আছে। পরীকে কথাটা বলতেই, সে বলেছিল হবে। এবং হয়েও গেছে। 

বাবা ফের বললেন, তোমার তাঁর কাছে যাবার কথা, তুমি গেলে না। তোমাদের মান-সম্মান বড়ই ঠুনকো। বড়লোক কেউ এমনিতে হয় না। ভিতরে কিছু না থাকলে অত উপরে ওঠা যায় না। পূর্বজন্মের পুণ্যফল। তুমি গেলে ছোট হয়ে যেতে না। তিনি যে এলেন তাতেও তিনি ছোট হয়ে যাননি। তোমার প্রতি তাঁর কত আগ্রহ যদি বুঝতে! তোমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। 

আগ্রহ থাকারই কথা। পরীর দাদুর এখন মহাসঙ্কট। তিনি পরী ছাড়া সংসারে কিছু বোঝেন না। পরীর বাবা রেলে খুবই বড় কাজ করেন। এখন মোকামাঘাটে আছেন। পরীর মাও সেখানে। রেলে খুবই বড় কাজ করলে, এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। পরী সেজন্য দাদুর কাছেই মানুষ। পরীর মাকে একবারই দেখেছি কালীবাড়িতে। পরীর বাবাও গিয়েছিলেন। রায়বাহাদুর মানুষটি পূজা উপলক্ষে বাড়ির ছেলেরা প্রবাস থেকে ফিরলে বাবাঠাকুরের কাছে সবাইকে নিয়ে যান। সেই উপলক্ষেই দেখা।

বাবা বললেন, আই এ পাশ করে তুমি মাস্টারি করছ—এতে নাকি কোনো উন্নতি নেই।

আমি বললাম, কী বলেছে বলুন না। কারণ ধৈর্য রক্ষা করতে পারছি না।

বাবা মা’র দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। 

—খুবই সুখবর। ঠাকুর চোখ তুলে তাকিয়েছেন। 

সুখবরটা কী বুঝতে পারছি না। পিলুর দিকে তাকিয়ে আছি সে যদি সুখবর দুম করে দিয়ে দেয়।

কিন্তু পিলু এতবড় সুখবর দিতে সাহস পাচ্ছে না কেন বুঝি না। রায়বাহাদুরের সঙ্গে বাবার কথাবার্তার সময় পিলু কাছে থাকবে না, হয় না। 

বাবার দাঁতের ফাঁকে কুমড়োর ডাঁটার ছিবড়ে ঢুকে গেছে। বাবা এখন যা, দু-আঙুলে বের করার চেষ্টা করছেন। খুবই উত্তেজনার মধ্যে রয়েছেন, আবার কোথাও একটা যেন গলায় কাঁটা ফুটে আছে। সুখবর অথচ বাবার এহেন অবস্থায় আমি কিছুটা বিপাকে। ধৈর্য রাখা গেল না। পাত থেকে উঠে পড়লাম। আমার খাওয়া হয়ে গেছে, বাবার সুখবরের প্রত্যাশায় কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। 

বাবা খুব নিরুত্তাপ গলায় বললেন, বোস। 

আবার বসে পড়তে হল। 

—রায়বাহাদুর একটা চিঠি টাইপ করিয়ে রাখবেন। তুমি কাল গিয়ে সই করে দিয়ে এস।

—কী চিঠি। 

—রেলে তোমার চাকরি। বললেন, বিলু ইস্কুলের মাস্টারি কী করবে! খুবই ধীর স্থির ছেলে। বিচারবুদ্ধি আছে। ঠিক জায়গায় পড়লে চড়চড় করে উন্নতি। 

—রেলে চাকরি! 

—তাই। বললেন, দরখাস্তটা তিনি তাঁর বড় ছেলের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। রেলের হোমরাচোমরা হতে তোমার সময় লাগবে না। 

বাবার ধারণা, পরীর বাবা রেলের হোমরাচোমরা এবং আমারও সেই সম্ভাবনা যখন আছে, তাছাড়া এমন মন্তব্য পরীর দাদু যখন করে গেছেন—তখন আমরা পরীদের প্রায় সমপর্যায়ের। বাবার গৌরব রাখার দেখছি এখন জায়গা নেই। 

বাবা বললেন, সবই গ্রহরাজের কৃপা বুঝলে। গ্রহরাজ প্রসন্ন থাকলে কেউ আটকাতে পারে না।

গ্রহের ফেরে আমরা এতদিন দারিদ্র্য ভোগ করছি। গ্রহ প্রসন্ন, সুতরাং আমাদের সুদিন সমাগত। বাবা যেন পারলে এমনও বলতেন। 

খবরটা আমার খুবই সুখবর সন্দেহ নেই। এতটা আশা করতে পারিনি। পরী তবে সত্যি আমার জন্য ভাবে। পরেশচন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ ঠিক, পরীর মত নেই বলে শুভ কাজ হচ্ছে না, আমার উপর দায় ছিল, বাবাঠাকুরকে ধরে বিয়ে ভেঙে দেবার ব্যবস্থা করা—কিন্তু বাবাঠাকুরের কাছে আমার যাও- য়াই হয়নি, এসব সত্ত্বেও পরী আমার জন্য ভাবে, তার সঙ্গে আমার যত বিরোধ ইস্কুলের মাস্টারি নিয়ে, সে চায় না, চায় না বললেই তো হবে না—অন্য কিছু একটা বন্দোবস্ত না করলে বাবার সংসারই বা চলবে কী করে। পরী এত বোঝে। অথচ পরীকে অপমান করার চেয়ে বড় সুখ আর আমার কিছু নেই। 

–বিলু এ লেখাটা দেখ ছাপা যায় কি না। ভদ্রলোক বলেছেন, একটা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে দেবেন। 

—রেখে যাও। দেখব। 

—না রেখে যাব না। তোমাকে কথা দিতে হবে বিলু। 

—কথা দেওয়া যাবে না। পাঠ্য হতে হবে। অপাঠ্য হলে কী করে ছাপব? দয়া করে তোমার আমাদের কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ না করলেও চলবে। বিজ্ঞাপনের জন্যে কাগজে ছাই-পাঁশ ছাপতে আমি রাজি না। 

পরী সহসা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আর ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেই কেন জানি আমি আরও বেশি মজা পাই। 

পরীর তখন এক কথা, আমি বেহায়া বলে আসি। অন্য মেয়ে হলে তোমার মুখ দর্শন করত না। স্বার্থপর। 

–কে আসতে বলেছে! তুমি না থাকলেও কাগজ ঠিক চালাব। 

আমি জানি পরী না থাকলে কাগজ চালাবার মুরোদ আমাদের থাকবে না। কিন্তু পরীর কাছে আর সবই করতে রাজি কিন্তু খাটো হতে রাজি না। আসলে এদেশে আসার পর সচ্ছল পরিবারের প্রতি আমার কেন জানি বড় রাগ জন্মে গেছে। বড়লোক হলে তো কথাই নেই। পরী আমাদের ঠেকে ভিড়ে যেতেই, হাতের কাছে একটা চরম সুযোগ পাওয়া গেছে যেন। পরী কী বোঝে কে জানে, মাঝে মাঝে একা থাকলে, বিরোধের সময় চোখ জলে ভেসে যায়। আর পরী এটা জানে, আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু চোখে জল সহ্য করতে পারি না। তখন পরী যা বলবে, আমি গোলামের মতো সব করে যাব। পরীর কথাই শেষ কথা। 

নিজেকে বড়ই অকৃতজ্ঞ ঠেকছে। পরী এত করছে। অথচ আমি একবার বাবাঠাকুরের কাছে গেলাম না। আমি গেলে তিনি বালকের মতো চঞ্চল হয়ে পড়বেন জানি। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যাবে, ওরে বদরি, ও বউমা, দেখ বিলু এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে হয় তো বলবেন, এই ছোঁড়া না বলে না কয়ে ভেগে গেলি। বেটা লক্ষ্মীকে ভজাতে চেয়েছিলি-লক্ষ্মী ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। কিছুই মুখে আটকায় না। আর এ সময় যদি পায়ে গড় হই, বলি বাবাঠাকুর পরী আমাকে পাঠিয়েছে। অবশ্য পরী বললে তিনি চিনবেন না, সুতরাং বলতে হবে, বাবাঠাকুর মৃন্ময়ী আমাকে পাঠিয়েছে। পরীর দাদু আপনার অনুমতি নিতে আসবে বাবাঠাকুর। আপনি অনুমতি না দিলে মিমিদের সংসারে কুটোগাছটি নড়ে না, বাবাঠাকুর আপনি অনুমতি দেবেন না, বাবাঠাকুর মিমি বড়ই কাতর হয়ে পড়েছে বিয়ের কথা ভেবে। পরীর বিয়ে হয়ে গেলে, কোথায় এস. ডি ও সাহেব বদলি হয়ে যাবেন, আমরা পরীকে আর দেখতে পাব না, পরী আমাদের দেখতে পাবে না—পরীর কষ্ট, পড়া ছেড়ে দিতে হবে—পরীর কষ্ট, সে মিছিল করতে পারবে না, নাটক করতে পারবে না, পরী না থাকলে আমাদের অপরূপা কাগজ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের কবিতা ছাপবার জায়গা থাকবে না। কবিতা ছাপা না হলে আমরা কী নিয়ে থাকব। কী নিয়ে বাঁচব। এসব যে কতবার ভেবেছি, ভাবতে ভাবতে রাত কাবার করে দিয়েছি, ঘুম আসেনি। পরী আমি সমবয়সী, পরী কেন বোঝে না, আমার পক্ষে এমন কথা শোভন নয়। বাবাঠাকুর বলতেই পারেন, তুই ক্যারে, ভাগ। ওর দাদু ভাল বোঝে, না তুই ভাল বুঝিস। মিমির বিয়ে হবে কি হবে না, সে ঠিক করবে ওর বাবা কাকারা। তোর কথায় আমি বলব! আমি একটা চ্যাংড়া ভেবেছিস। বের হ। এই বদরি শোন, বিলু কী বলছে! মিমির নাকি ইচ্ছে নয় বিয়েতে বসার। মিমির ইচ্ছে অনিচ্ছে কি। বাবা-মার ইচ্ছে অনিচ্ছেই সব। এ কি অনাসৃষ্টি কথা! তুই দেখছি মিমির সর্বনাশ করতে চাস্। তুই মিমির ঘোর শত্রু। ভাগ ভাগ! পরেশচন্দ্র রত্ন বিশেষ। 

সবার কাছেই পরেশচন্দ্র রত্ন বিশেষ। আমার বাবার কাছেও। এইটুকুন ছেলে সদরের এস.ডি ও। ত্রিশও হয়নি মনে হয়। কী সৌম্য আচরণ! 

রেগে গিয়ে বলেছিলাম, কী সৌম্য আচরণ দেখলেন। আপনার সঙ্গে তো কথাই হয়নি। 

—তোমার সঙ্গে কথা বলার ধরন দেখে বুঝেছি। 

পিলু তখন বলল, বাবা, দাদা রেলে কী চাকরি করবে? 

—শিক্ষানবিসীর কাজ। ট্র্যাফিক ইনসপেক্টর হয়ে যাবে পরে—এরকমই কী যেন বলল। ইস্কুলের ডাবল মাইনে হাতে পাবে। সংসারের খাওয়াপরা নিয়ে আর আমাদের ভাবতে হবে না। আসলে বুঝতে পারছি, বাবার চোখে কৃতী পুত্রের ছবি ভেসে উঠছে। যজমানি বামুনের পুত্রটি কত লায়েক বাবা পুজাআর্চা করতে গিয়ে গর্বের সঙ্গে বলতে পারবেন। 

বাবা বারান্দায় উঠে যাবার সময় বললেন, কত দেশ তোমার ঘোরা হবে। রেলের পাশ পাবে। রেলের পাশ পেলে ভাবছি তোমার মাকে নিয়ে তীর্থ করতে যাব। 

আমার বাবা এরকমেরই। এখনও কিছু ঠিকই হয়নি—অথচ ভেবে ফেলেছেন, চাকরিটা আমার হয়ে গেছে। 

বাবা এখন জলচৌকিতে বসে তামাক খাবেন। 

মা আজ এতই প্রসন্ন যে, মায়াকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাবাকে তামাক সাজিয়ে দেবার জন্য।

রান্নাঘর থেকেই বললে— হ্যাঁগো আমরা আগে তারকেশ্বরে যাব। জাগ্রত ঠাকুর। মানত করেছিলাম, বিলুটার ভাল কাজটাজ হলে শিবের মাথায় বেলপাতা দেব। 

—শুধু তারকেশ্বর কেন ধনবউ। কামাক্ষ্যা বল, কাশীর বিশ্বনাথ বল সব তোমার পুত্রের কল্যাণে দর্শন হয়ে যাবে। গ্রহাচার্য বলেছে, আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বৃহস্পতি এখন একাদশ স্থানে যা কিছু হবার এই সময়। বড় সুসময় আমাদের। 

এই কাজটা হলে আমি সত্যি তবে বর্তে যাব। স্বপ্নের দেশে যেন চলে যাচ্ছি। এখনই কাউকে বলা যাবে না। আগে একবার যাই, দেখা করি পরীর দাদুর সঙ্গে। দরখাস্তে সইসাবুদ হয়ে গেলে তিনি তাঁর বড় পুত্রের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি চাকরির পাকা বন্দোবস্ত করছেন এমনও বলে গেছেন পরীর দাদু। কিন্তু পরীর সঙ্গে দেখা হলে কী বলব! 

মনে হল পরীকে সোজাসুজি বলে দেওয়াই ভাল হবে, না যাইনি। বাবাঠাকুরের কাছে আমার যাওয়া হয়নি। সাহসে কুলাচ্ছে না। 

কিন্তু জানি, এমন কথা শুনলে, পরীর দু চোখে তিক্ততা ফুটে উঠবে। কাতর চোখে সহসা আগুন জ্বলে উঠবে—তুমি বিলু নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝো না। তোমাকে আমার চিনতে বাকি নেই। তুমি আমার শত্রুতা করতে পার, কিন্তু কোনোদিন আমি তোমার শত্রুতা করব না। তোমার মাস্টারি আমার ভাল লাগছিল না, তোমার মতো ছেলে একটা প্রাইমারী ইস্কুলে পড়ে থাকলে, আমার কোনো আর অবলম্বন থাকে না। রেলে বড় চাকরি হলে, আমার সাহস বাড়বে। 

এই সুখস্বপ্নটা আমাকে কাতর করছিল। রেলের চাকরিটা হলে পরীর মর্যাদা নষ্ট হবে না। কিন্তু কোথায় সদরের এস ডি ও আর কোথায় রেলের একজন শিক্ষানবিসী। তার আগেই পরী চলে যাবে। নিজেকে কেন জানি বড় অসহায় লাগছিল। দূরে চাকরি নিয়ে চলে গেলে পরীকে আর দেখতে পাব না এও একটা কষ্ট। এই বাড়িঘরের প্রতিও টান ধরে গেছে, মাঠ পার হলে বাদশাহি সড়ক, দুই বন্ধুর সাইকেল আরোহীর অলৌকিক ভ্রমণ, বালিরঘাটে বসে জ্যোৎস্নায় ডুবে যাওয়া সব আমার হারিয়ে যাবে। আমি খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে যাব। 

এতগুলি বিষয় আমাকে ভাবাচ্ছে। 

পিলু দরজা বন্ধ করে মশারি টানিয়ে আমার পাশে এসে শুল। বলল, দাদা আমি তোর সঙ্গে যাব।

—যাবি। আগে কাজটা হোক। 

—কাজটা হবে। 

—কী করে বুঝলি? 

—মিমিদির বাবার হাতেই সব। মনে হয় মিমিদিরই ইচ্ছে। না হলে মিমিদির দাদু ছুটে আসতেন না।

পাশ ফিরে শুলাম। বললাম, হবে হয়ত! 

—তুই ছুটিতে আসতে পারবি। 

—তাও বলে গেছে? 

—হ্যাঁ, সবই তো বলল, অনেক ছুটি আছে। রেলের পাশ, উপরি রোজগার কত কী! —উপরি রোজগার। সে আবার কী! 

পিলু বলল, বাবাও অবাক। বললেন, উপরি রোজগার মানে? 

—এ কাজে অনেক উপরি রোজগার। সে আপনি বুঝবেন না! আপনার ছেলে কাজে ঢুকলে বুঝতে পারবে। 

উপরি রোজগারটা ঠিক ধরতে পারছি না। ঘুষের কথা বলছেন। ঘুষ না নিলে বড় হওয়া যায় না। মর্যাদা রক্ষা হয় না পরিবারের। 

কিন্তু বাবা ঘুণাক্ষরে টের পেলে, সোজা বলবেন, দরকার নেই—মানুষের অসাধু জীবন, সংসারে মঙ্গলজনক হয় না। পাপ। কত পাপে না জানি দেশছাড়া হয়েছি, পাপ বাড়িয়ে লাভ নেই। জীবন তো একটাই। পরজন্মে, কীটপতঙ্গ হয়ে কে বেঁচে থাকতে চায়। 

অর্থাৎ এই পাপ বাবার জীবনে শুধু ইহকালের দায় নয় পরকালেরও। এমন বাবার পুত্রের পক্ষে উপরি রোজগার খুবই বিপজ্জনক বিষয়। বাবা হয়তো কথাটার অর্থ ধরতে পারেননি, অথবা ভেবেছেন, অসৎ কাজে প্রবৃত্ত হবে এমন ইন্দ্রিয়াধীন তাঁর পুত্র নয়। না হলে এই একটা কথাই বাবার সব প্রসন্নতা নিমেষে হরণ করে নিত। 

শুয়ে পাশ ফিরছি। এ-পাশ ওপাশ করছি। ঘরের বেড়াতে খোপকাটা দরমার জানালা। হাওয়া একদম ঢোকে না। বাবা এই গরমে বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন। মা-ও। মাঝরাতের দিকে গরমের তাপ কমলে ঘরে উঠে যান। আমি ঘামছিলাম। শিয়রে তালপাতার পাখা থাকে। মাঝে মাঝে হাওয়া করছি। বাইরে জ্যোৎস্না। ঘুম আসছিল না। পিলু বেশ ঘুমোচ্ছে। শরীরে এত তাপ নিয়ে বাঁচা যায় না। দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলাম। বারান্দায় দেখছি মা বাবা কেউ নেই। শুধু গাছপালাগুলি বাড়িটাকে এখন পাহারা দিচ্ছে। সাপের উপদ্রব আছে। তবে জ্যোৎস্নায় প্রকৃতি ভাসমান বলে সব দেখা যায়। রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে খাল। জলে ভরে গেছে। দু একটা মাছের নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। জোনাকি উড়ছিল। বাদশাহি সড়কে গরুর গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ শব্দ। কোথাও কুকুর ডাকছে। কটা ডাহুক পাখি তারস্বরে ডেকে উঠল। সবই কেমন বিস্ময়ের সঞ্চার করছে। রেলের চাকরি হয়ে গেলে—এই জীবন থেকে প্রায় নির্বাসিত হয়ে যাব। কোন সুদূরে চলে যাব জানে। 

এই জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে কী এক অপার রহস্য মানুষের জীবনে, ভাবছিলাম—মানুষ নিরন্তর স্থানান্তরে চলে যাচ্ছে। তার শেকড় এক জায়গায় ঢুকে যায়, অন্য প্রজন্মে সেই শেকড় আবার আলগা হয়ে যায়। আমি চলে গেলে, বাবার এই ঘরবাড়িতে আমার জন্য রাতে কেউ আর অপেক্ষা করে থাকবে না। হুটহাট পরী চলে আসবে না। মুকুল নিখিল নিরঞ্জন সাঁঝবেলায় জ্যোৎস্নায় সাইকেলে এসে হাজির হবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাকবে না, বিলু আমরা। অযথা একসঙ্গে সাইকেলগুলির বেল বেজে উঠবে না। কোনো গ্রীষ্মের দুপুরে আম গাছের ছায়ায় আমি আর মুকুল শুয়ে বসে কবিতা পাঠ করব না। আমার কবিতা মাথায় উঠে যাবে। আসলে মানুষ সঙ্গদোষে বোধহয় কবি হয়, গল্পকার হয়—পরী মাথার মধ্যে কবিতা ঢুকিয়েছিল, সঙ্গদোষে তার বাড়াবাড়ি ঘটেছে। আসলে জীবনে বাহবা অর্জনই এই কবিতাচর্চার দিকে আমায় টানছে। আর এই বাহবা পরী যখন দেয়, তখন আমি রাজার মতো বেঁচে থাকি। 

অথচ সেই পরীর খোঁজ নিইনি। তার কাছে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। কাল আমাকে পরীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। পরীকে দেখার জন্য মনটা কেন এই গভীর রাতে এত আকুল হয়ে উঠল বুঝতে পারছি না। যেন পারলে এক্ষুনি সাইকেল নিয়ে ছুটে গেলে ভাল হয়। পরী কী রোজ দোতলার বারান্দায় আমার জন্য সকাল বিকাল অপেক্ষা করে থাকে। পরীর দাদু কী পরীর কোনো খবর দিয়ে যাননি! পরীর যে বিয়ে হবে—কথাবার্তা চলছে, বাবা কী তা জানেন! এ সময় নিজের উপরই কেমন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একবারও আমি পিলুকে ডেকে বলিনি, পরীর কথা কিছু বলল। পরী তো চুপ করে থাকার মেয়ে নয়। পরী খোলামেলা, বেপরোয়া, অথচ মেয়েটার মধ্যে কোনো অতি চালাকি নেই—এমন যার স্বভাব, সে কেন একবার অন্তত খোঁজ নিতে এল না, বাবাঠাকুরের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটাতে আমি কী করলাম! 

তাহলে কী পরী ভেবে ফেলেছে, বিলুটা কর্মের নয়। পরী আমার উপর বিশ্বাস হারিয়েছে। যে পরীর জন্য এতটুকু সাহস দেখাতে পারে না, তার উপর নির্ভর করা নিছক পাগলামি। পরেশচন্দ্র অনেক বেশি নির্ভরশীল। ভাবতেই বুকটা ছাঁত করে উঠল। পরী হয়ত সবই মেনে নিয়েছে। তবু আমি থাকলে পরীদের পরিবারে কাঁটা হয়ে থাকব, সেই ভেবে কী পরীর দাদু আমাকে দেশান্তরী করতে চাইছেন। ঠিক কিছুই বুঝছি না। 

যত এ-সব ভাবছিলাম, তত কেমন তলিয়ে যাচ্ছি। গাছের গুঁড়িতে চুপচাপ হেলান নিয়ে বসে আছি। দরজা ভেজিয়ে বাড়ির বাইরের রাস্তায় শা-দুল্লা আমগাছের নিচে এক অসহায় তরুণ কোনো এক রাজকন্যার স্বপ্নে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। আমার কেন জানি, পরীর জন্য চোখে জল এসে যাচ্ছিল। পরী জানেই না, তার জন্য গোপনে আমি কখনও কাঁদতে পারি। জানলে পরী না এসে থাকতে পারত না। সামনা-সামনি সব সময় পরীকে ছোট করা আমার স্বভাব। পরী সেটাই সত্য জেনে বসে আছে। 

তখনই গলা পেলাম কার!

দেখি পেছনে, পিলু, বাবা-মা। 

ওরা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। 

বাবার প্রশ্ন, এত রাতে এখানে বসে আছ? 

—গরম। ঘরে শোওয়া যাচ্ছে না। 

পিলুর কী মনে হল কে জানে—আমাকে নিয়ে মা-বাবার যেমন দুশ্চিন্তার শেষ নেই, পিলুরও তেমনি। সে আমার হাত ধরে টানতে থাকলে, বললাম, যাচ্ছি। 

মনে হল ওরা আমার আচরণে খুবই ভয় পেয়ে গেছে। আমি কখন কী করে বসব, এই ভয়ে পিলু আমার পাশে রাতে শোয়। 

পিলুকে বললাম, হাত ছাড়। যাচ্ছি। 

–যাচ্ছি না, এক্ষুনি ওঠ। 

বাবা বললেন, তোমার কী হয়েছে! ক’দিন থেকে আবার মনমরা দেখছি। বলবে তো। না বললে বুঝব কী করে? 

কী করে বোঝাই, পরীর বিয়ের কথা হচ্ছে। পরীকে কথা দিয়েছিলাম, বাবাঠাকুরের কাছে যাব- কিন্তু যেতে পারছি না। কেন যে কথা দিতে গেলাম। পরী যদি বিশ্বাস করে থাকে, কথা যখন দিয়েছি, আমি ঠিক যাবই, যদি বিশ্বাস করে থাকে বিলুর স্বভাব নয় কথা দিয়ে কথা না রাখার। কিন্তু পরী তো বুঝছে না, কী বিপাকে পড়ে বলেছিলাম, আমি যাব।—তুমি এই নিয়ে মন খারাপ করবে না। কী চেহারা করেছ? তারপরও যদি না যেতে পারি মন মানবে কেন! তারপর সব যদি ছেড়ে চলে যেতে হয়, না গিয়েও কী উপায়! যে-ভাবে ট্রেনে, রেল স্টেশনে পড়ে থেকেছি মাসের পর মাস, যে-ভাবে চেকারবাবুদের দেখলে বাবা সাক্ষাৎ ভগবান হাজির ভেবেছেন, যে-ভাবে স্বপ্নে দেখেছি, আমার হাতে সবুজ বাতি, সবুজ বাতি দোলালে ট্রেন চলবে, না দোলালে চলবে না, একটা ট্রেনের এই স্বপ্ন এখন সত্যি হতে যাচ্ছে— অথচ সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে হবে—এতসব কষ্ট আমাকে বিচলিত করে তুলছে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি আমার এখন এই অবস্থা। সেখানে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকা ছাড়া অন্য কী উপায়। 

ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লে, দেখলাম পিলু দরজা ভাল করে বন্ধ করে দিচ্ছে। মশারির নিচে ঢুকে সে পাখা তুলে এমনভাবে হাওয়া করছে, যেন সবটা হাওয়া আমার গায়েই লাগে। 

আমি হেসে বললাম, এই পিলু তোর কী হয়েছে রে? 

পিলু অবাক। ওর হাতপাখা বন্ধ। 

পিলু হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল, তুই দাদা কেন বের হয়ে গেছিলি? বল কেন বের হয়ে গেলি। 

—আরে এমনি। তুই কী রে! 

—আমার ভয় করছে। তুই কেমন হয়ে যাচ্ছিস দাদা। 

হঠাৎ মনে হল, আমি আর, পিলু কিংবা মায়ার জন্য, মা-বাবার জন্য, এমনকি সংসারের ভালমন্দের জন্য যেন খুশি অখুশি কিছুই হচ্ছি না। পিলু এটা বুঝতে পেরেই আশঙ্কা করছে, আমি কিছু করে না বসি। বাবা-মাও কি এমন আশঙ্কায় সর্বক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকে। সন্তান বড় হলে জটিলতা যে কত রকমের। আমরা তো এখন বলতে গেলে বেশ ভালভাবে খেয়েপরে বেঁচে আছি—কিন্তু ভিতরে যে আমি ভাল নেই। একসময়ে শুধু পেট ভরে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ পেয়েছি, এখন আর তা পাই না কেন। খাওয়াটাই সব নয়। এরপরও পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য বুঝি উত্তাপের দরকার হয়। আমার মধ্যে যে উত্তাপের সৃষ্টি হচ্ছে, তারই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কবিতা, পরী, প্রেম, রেলের নীল বাতি। এসব না থাকলে জীবন অর্থহীন। কিন্তু এসব কথা পিলুকে বলি কী করে, বললেই বা বুঝবে কেন? 

তখনই পিলু বলল, পরীদি আর আসে না। আমি কাল যাব। 

কী করতে যাবি? 

—পরীদি আসে না কেন? 

—পরীদির বিয়ে। আসবে কী করে? 

হঠাৎ পিলু উত্তেজনায় উঠে বসল, কবে বিয়ে রে দাদা। আমাদের খেতে বলবে না! —বলবে, বিয়ে ঠিক হলে বলবে। এখনও বোধহয় হয়নি। পরীর কথা তোলায় সুযোগ এসে গেল। বললাম, ওর দাদু পরীর কথা কিছু বলল? 

–না। 

—গাড়ি নিয়ে এসেছিল? 

—রাস্তায় গাড়ি রেখে হেঁটে এসেছে। 

—তুই কোথায় ছিলি? 

—আমি কালীর পুকুরে গরু আনতে যাচ্ছি, দেখি পরীদির দাদু আসছে। হাতে সেই রুপোর লাঠি। 

—আর কেউ ছিল? 

—সেই লোকটা! 

সেই লোকটা কে বুঝি। ওঁর খাস চাকর। উঠতে বসতে যে একটা লাঠির মতো সঙ্গে থাকে। পিলু বসেই আছে। জানিস দাদা এসেই আমাদের বাড়িটা ঘুরে-ফিরে দেখলেন। আমগাছের কোনটা কী আম বাবা বললেন। পরীদির দাদু কী খুশি। বললেন, এ তো একটা আশ্রম বানিয়ে ফেলেছেন। বাবা জানিস ঠাকুরঘর খুলে নারায়ণ শিলা দেখালেন। চরণামৃত দিলে তিনি হাত পেতে নিলেন। বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেবতা নিয়ে কথা হল। মা মায়া তো ঘর থেকে বেরই হল না। চেয়ারে বসে আমাকে ডেকে বললেন, কী খবর পিলুবাবুর? 

এমন ডাকসাইটে একজন মানুষের পক্ষে পিলুর নাম মনে রাখা সহজ নয়। কিন্তু পিলুর স্বভাবে মানুষকে আত্মীয় ভাবার এমন একটা সহজ কৌশল আছে যার জন্য একবার আলাপ জমে উঠলে তাকে ভোলবার কথা নয়। পরীদের কাকাতুয়াটি আনতে পিলু একদিন সত্যি তাদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। আমাদের বাড়িতে, খোঁড়া গরু, খোঁড়া বাঁদর, হাঁস, কবুতর, ছাগল, গোটা তিনেক বিড়াল এবং দুটো কুকুরের সঙ্গে কাকাতুয়াটি বেশ মানিয়ে যাবে মনে হয়েছিল তার। পরী সেদিন আমাদের বাড়ি, আমার অনিচ্ছাসত্ত্বে হাজির। যে যা চেয়েছে পরী সেদিন দিতে রাজি হয়েছিল। সেই বাড়ির মেয়ে যদি বলে, পিলু তুই কি নিবি? পিলুর কাকাতুয়া ছাড়া আর কী চাইবার থাকতে পারে। সে সোজা বলেছিল, পরীদি তোমাদের কাকাতুয়াটি দেবে? আমি পালব। তা পিলু পালতে পারে। ওর জীবজন্তুর প্রতি আলাদা একটা মায়া আছে। সেই কাকাতুয়াটি সত্যি পিলু আনতে যাবে পরী ভাবতে পারেনি। পরী বলেছিল, পারবি পুষতে? তোদের বাড়ির হুলো বেড়াল দুটোকে না তাড়ালে পাখিটাকে মেরে ফেলতে পারে। ওর দাদু সামনে। দাদুকে বলেছিল, বিলুর ছোটভাই। কী মিষ্টি দেখতে না দাদু! কাকাতুয়া নিতে এসেছে। 

আসলে পিলু কত সরল সহজ, এটা ভেবে দাদুটি বলেছিলেন, নিয়ে গিয়ে পুষতে পারবি তো? পিলুর সোজা জবাব, হ্যাঁ পারব। কী খায়? 

–কী যে খায় আমরা জানি না। আমাদের রঘু টের পায়। ওর সঙ্গে পাখিটার খাওয়া নিয়ে কথা হয়। রঘু সকাল থেকে লেগে পড়ে। 

—আমাকে বলবে না। 

—দ্যাখ না গিয়ে বলে কিনা! রঘুকে ছাড়া সে কাউকে বলে না জানি। 

পরী নাকি হাসছিল পিলুর কান্ড দেখে। সে পাখিটার সামনে দাঁড়িয়ে শিস দিয়েছে, হাতে তুড়ি মেরেছে। পাখিটা ওকে দু-বার তেড়ে গেছে, তাতেও ঘাবড়ায়নি। সে পাখিটার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। সুন্দর কথা বলে। পিলু বলেছিল, আমার নাম পিলু, আমার দাদার সঙ্গেই পরীদি পড়ে। এই সম্পর্কের খাতিরেই পাখিটার উচিত পিলুকে মান্য করা। কিন্তু পিলু পাখিটার কাছেই যেতে পারছিল না, দাঁড়ে ঝাপটাচ্ছিল। ধরতে গেলে ঠোকর খাচ্ছিল। পরী আর দাদু পিলুর কান্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। 

পিলুর স্বভাব বেপরোয়া, সে ছাড়বে কেন, একবার জোর করে পাখিটার দাঁড়ে হাত দিতে গেলেই এমন ঠুকরে দিল যে হাত থেকে রক্ত বের হয়ে আসছে। পরী ছুটে গেছে, পরীর দাদুও।—ইস কী ছেলে রে তুই! আয়। রক্ত বের হচ্ছে! 

পরী বলেছিল, দস্যি বটে তুই। 

পিলু হাত ছাড়িয়ে বলেছিল, কিছু হয়নি। 

—হয়নি তো হয়নি। আয় বলছি। আমরা বুঝিয়ে-সুজিয়ে দিয়ে আসব। 

তারপর হাতে ডেটল তুলো ব্যান্ডেজ বেঁধে একপেট খাইয়ে রিকশায় তুলে দিয়েছিল। কাজেই পরীর দাদু যত ডাকসাইটে হোক, এমন ছেলের নাম ভুলে যেতে পারে না। 

পিলুকে বললাম, শুয়ে পড়। আমাকে হাওয়া করতে হবে না। ফের বেহায়ার মতো বললাম, পরীর কথা কিছুই বলল না? 

—না! 

—তুই পরীর কাছে যাবি কেন? —পরীদি মনে হয় রাগ করেছে। 

—রাগ করবে কেন? আমরা পরীর কে? 

পিলু আমার এমন কথায় কেমন ঘাবড়ে গেল। পরীদির জন্যই রেলে চাকরি, পরীদি না থাকলে এতবড় চাকরি কে দিত, পরীদি আছে বলেই আমার কাগজ অপরূপা অথচ তার দাদাটা বলছে কী না পরী আমাদের কে! 

পিলু এবারে শুয়ে পড়ল। আমরা দু-জনেই দু-পাশে পাশ ফিরে শুয়ে আছি। পরী আমাদের কে, বলার পর পিলু তার পরীদির উপর সব অধিকার যেন হারিয়ে ফেলেছে। পিলুও বোঝে পরী এলে আমাদের বাড়িটা মুহূর্তে কেমন বদলে যায়। পরীর ছোটাছুটি, পিলুকে হাঁকডাক করে বাইরে নিয়ে যাওয়া, মার রান্নাঘরে বসে টুকিটাকি কাজে সাহায্য করা সবটাই পরীর আলাদা এক মহিমা যেন। পিলু পর্যন্ত সেটা টের পেয়ে বুঝেছে, তার যাওয়া দরকার। 

আমি বললাম, কাল তো যাচ্ছি। দেখা হবে। 

—কাল সত্যি যাচ্ছিস? 

—যাব না! কত বড় চাকরি। 

পিলু কেন জানি আমার এত বড় চাকরি নিয়ে এই মুহূর্তে উচ্ছাস প্রকাশ করতে পারল না। আমি আর কোনো কথা বলছি না দেখে, সে ঘুমিয়ে পড়ল। কী কথা বলব। পরী ছাড়া আমার যে আর কোনো কথা নেই। 

সকালবেলায় বাবা বললেন, যাবার আগে ঠাকুর প্রণাম করে যেও। শুভ কাজে যাচ্ছ। 

পিলু সাইকেল বের করে ন্যাকড়া দিয়ে পরিষ্কার করছিল। মুড়ি দুধ কলা খেয়ে সাইকেলে বের হয়ে পড়লাম। দরখাস্তে সই করতে যেতে হবে। সইসাবুদ সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা, চান খাওয়া সেরে স্কুল—খবরটা বন্ধুদের আগাম দিতে না পারলে স্বস্তি পাচ্ছি না। অথচ মনে হচ্ছে খবরটা দেব, শেষে যদি কাজটা না হয়—কতরকমের শঙ্কা আছে, তবে পরী যদি চায়, কাজটা আমার হবেই। পরীকেও দেখে আসা হবে। বাবাঠাকুরের কাছে যেতে পারিনি, এই সুযোগে সেই খবরটাও দেওয়া যাবে। 

আর আশ্চর্য, সদর দিয়ে ঢুকতেই দেখি পরী ওদের দোতলার বারান্দায় মাথা এলিয়ে বসে আছে। আমি যে ঢুকলাম, সে তা লক্ষ্য পর্যন্ত করেনি। অনেক দূরের আকাশে তার চোখ। যেন সে আমাকে চেনেই না। এই হল গিয়ে মানুষের গেরো। আমি ঢুকলাম, অথচ কোনো সাড়া নেই, কেমন জটিল সব চিন্তা-ভাবনায় মাথাটা আমার গুলিয়ে যাচ্ছিল। তবে কি সে আমাকে সত্যি বাড়ির আর দশজন অনুগ্রহভাজন ব্যক্তির মতো ভাবছে। দয়া চাই—এস। চাকরি চাই—এস। কাগজের বিজ্ঞাপন–এস। অনুগ্রহ করে সে কি মাথা কিনে নিয়েছে ভেবেছে। না কি সে লক্ষ্যই করেনি আমি এসেছি। কোন্‌টা। 

এতসব ভাববার আমার অবকাশই ছিল না। বিরাট সেই হলঘরে বুড়ো মানুষটি যেন আমার প্রত্যাশায় বসেই ছিলেন। দরজা পর্যন্ত যেতে পারিনি, তার আগেই তিনি প্রায় ছুটে এসেছেন। আমি যেতে পারি, এটা বোধহয় তাঁর বিশ্বাসের বাইরে ছিল। তিনি একটা বড় রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেছেন। তাঁর চোখমুখ দেখে আমার এমনই মনে হল। এই বিপর্যয় থেকে আমিই তাঁদের উদ্ধার করতে পারি—কারণ তিনি তাঁর আচরণে যেন কিছুটা বালকসুলভ, আর কেমন গোপন, খুব ধীরে এবং লঘুস্বরে কথাবার্তা-আপ্যায়ন। 

—এলে। বোস। 

বিরাট হলঘর। আর কেউ নেই। এমনকি তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী সেও না। কত রকমের মানুষজন সকাল থেকে তাঁর কাছে আসে। বাইরের বারান্দায় বসার মতো পনের-বিশজনের জায়গা করা আছে। এক একজনের ডাক পড়ে, তিনি তাদের অভিযোগ দাবিদাওয়া সম্পর্কে খবরাখবর নিয়ে ছেড়ে দেন। যতবার এসেছি, দেখেছি একজন ব্যস্ত মানুষ—অন্তত সকালের দিকটাতে তিনি শহরের মানুষজন নিয়ে ভারী ব্যস্ত থাকেন। আরও সকালে তাঁর পূজা-আর্চ্চার পাট থাকে, তখন বামুনঠাকুর এই বাড়ির সর্বত্র গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেয়। পরনে গরদ, খালি গা, গৌরবর্ণ মানুষ, ঘন চুল, মাঝখানে সিঁথি কাটা। গায়ে নামাবলী। হলঘরের বড় দেওয়ালে বাবাঠাকুরের বড় তৈলচিত্র। এবং সিঁড়ি ধরে উঠে গেলে দেখেছি লম্বা করিডোর পার হয়ে তাঁর পূজার ঘর। সেখানেও সিংহাসনে বাবাঠাকুরের ছবি। পরী আমাকে গোটা বাড়িটা একদিন ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। কার কোন মহল, তার বাবা-কাকারা কেউ কেউ চাকরিজীবী—জমিদারি চলে যাবার পর যেন এই বৈভব রক্ষার্থেই সবাই বের হয়ে পড়েছেন। 

তিনি আমাকে বসিয়ে সন্তর্পণে একটা দেওয়াল আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করলেন। এসব বের করে দেবার লোকটিকে পর্যন্ত কাছে রাখেননি। ফাইল বের করে আমার সামনে একটা টাইপ করা কাগজ বের করে বললেন, সই কর। 

আমি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সই করলাম। 

মাথার উপর ঝাড়-লণ্ঠন, হাওয়ায় তখন রিনরিন করে বেজে উঠল। ঘরে আতরবাতির সুঘ্রাণ।

তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ কেন যে তাকিয়ে থাকলেন বুঝলাম না। শেষে কী ভেবে বললেন, তোমার বাবাকে বলবে, তিনি যেন তোমার সার্টিফিকেট দুটো দেন। অ্যাটেস্টেড কপির দরকার হবে। কাল সকালে দিয়ে যাবে। 

আমি মার্কশিট পেয়েছি শেষ পরীক্ষার। সার্টিফিকেট এখনও পাইনি জানালাম। 

তিনি বললেন, মার্কশিট হলেই চলবে। 

কথা বলতে গিয়ে তিনি বেশ হাঁপাচ্ছিলেন। পায়ে তাঁর নাগরাই জুতো। তিনি পাখার হাওয়াতেও ঘামছিলেন। 

—কাল কোথায় গিয়েছিলে? আমি সব সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। না এলে আমাকে ফের যেতে হত।

আমার প্রতি এত সদয়! সবটাই পরী হেতু এমন ভাবলাম। সেই পরীর সামান্য কাজ আমি করে উঠতে পারিনি। বললাম, মিমির সঙ্গে একটু দেখা করব। 

তিনি চমকে উঠলেন। আমি এ বাড়িতে এলে রঘু বিনোদ সবাই চেঁচামেচি শুরু করে দিত— বিলু দাদাবাবু এসেছেন। বিলু দাদাবাবু শুধু পরীর সঙ্গে পড়ে না, বাবাঠাকুরের প্রিয়জন। যে মানুষটি এই বাড়ির শুভাশুভের দায় ঘাড়ে বহন করছেন, আমি সেই মানুষের বড় আপনজন। বাড়িতে এজন্য আমার আলাদা খাতির। অথচ আশ্চর্য, আজ বাড়িটা কেমন নিঝুম। 

ঠিক এইসময় সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ পেতেই উপরের দিকে তাকালাম। আমি এলে পরী ধীরে ধীরে লঘু পায়ে সেদিন নেমে এসেছিল। আজও সে আসতে পারে। কিন্তু না—দেখছি রঘু বড় রেকাবিতে ফলমূল মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে আসছে। আসলে আমার এই সমাদর আর কিছুর জন্য নয়—বাবাঠাকুর প্রসন্ন হবেন এই বোধ থেকে করা। আমাকে যে ঘাঁটাতে সাহস করছেন না, এটাও তার কারণ। আসলে বুঝতে পারি এই পরিবারে আমাকে কেন্দ্র করেই বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরীর একগুঁয়েমি এবং সেদিনের হাহাকার কান্না থেকে গোটা পরিবারটি জেনে ফেলেছে, গেরো কোথায়। সেটা খুলে ফেলার জন্য রায়বাহাদুর মাথা ঠান্ডা রেখে এগোচ্ছেন। পরীরও হয়ত সায় আছে। সে চায় না, আমার জীবন একটা প্রাথমিক ইস্কুলে আটকে থাকক। তোমরা বিলুর জন্য কিছু একটা কর। বিলুর জন্য কিছু একটা করলে, তোমরা যা বলবে, আমি তাই করব। বিলুর হয়ে সত্যিকারের কিছু করতে পারলে পরী বোধহয় বিষও খেতে রাজি। 

ক্রমেই আমি বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলাম। 

আমার সামনে রকমারি জলখাবার। রায়বাহাদুর নিজ হাতে সাজিয়ে দিচ্ছেন। তিনি পরীর কথায় চমকে উঠেছিলেন, পরী সম্পর্কে একটা কথাও বললেন না। বরং এই চাকরিতে আমি যে একদিন খুবই বড় জায়গায় চলে যাব—এটা তাঁর স্থির বিশ্বাস। তিনি আমাকে আমার চাকরির বিষয়ে নানারকমের লোভনীয় কথাবার্তা বলে পরী সম্পর্কে উদাসীন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। 

রঘু সাদা পাথরের গ্লাসে এক গ্লাস ঠান্ডা জল রেখে গেল। 

পরীর দাদু বললেন, খাও। 

আমার যে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না বুঝতে পেরে বললেন, খাও। আমি বুড়ো মানুষ। জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আসে, সহ্য করতে হয়। সবই জানবে বাবাঠাকুরের কৃপা। তুমি তো পরম সৌভাগ্যবান, বাবাঠাকুরের কৃপা লাভ করেছ। সেদিন বাবাঠাকুরের কাছে সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম—কথায় কথায় তিনি বললেন, বিলুটার কোনো খবর নেই। বদরিকে ভাবছি পাঠাব। ছোঁড়াটা কী! না বলে না কয়ে কালীবাড়ি ছেড়ে চলে গেল। মনটা জানিস মাঝে মাঝে বিলুটার জন্য বড় খারাপ লাগে। বাবা গরিব, বিলুর খুবই পড়ার আগ্রহ। দুটো বছর বিলু ছিল, দু-বছরেই কেমন আমার মধ্যে টান ধরিয়ে দিয়েছে। 

আমি মাথা নিচু করে মিষ্টি এক-আধটু খাচ্ছি আর ওঁর কথা শুনছি। 

রায়বাহাদুর কোঁচা মাটি থেকে তুলে কোলের উপর রাখার সময় বললেন, তোমার সব খবর দিয়েছি। বলেছি, বিলুর জন্য আপনি ভাববেন না। ও ভালই আছে। ওকে সমীরণ রেলের শিক্ষানবিসীতে ঢুকিয়ে দেবে। ও পাশ করেছে। ওর জীবনে অনেক উন্নতি হবে। 

আমি কিছু বলছিলাম না। কেবল একটা কথাই বার বার এখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে পরী গিয়েছিল আপনাদের সঙ্গে! পরীকে নিয়ে গিয়েছিলেন? কিংবা কেন গিয়েছিলেন! শুভকাজ, তার অনুমতি নিতে গিয়েছিলেন। তিনি কি অনুমতি দিলেন। অনুমতি দিয়ে ফেললে আমার আর কিছু করার থাকবে না জানি। আমার ইচ্ছে থাকলেও আর বলতে পারব না, বললেও তিনি শুনবেন না। তাঁর মুখ থেকে বাক্য বের করা এমনিতেই বড় কঠিন কাজ। বাক্য না, যেন আগুন। সে আগুন একবার জ্বলে উঠলে নেবানো যায় না। 

এ-সব কী করে জিজ্ঞেস করি। তবু ভেতরে এত তোলপাড় শুরু হয়েছে পরীকে দোতলার বারান্দায় দেখার পর, যে বেহায়ার মতো না বলে থাকতে পারলাম না, মিমি গিয়েছিল আপনাদের সঙ্গে? 

—গিয়েছিল। 

তারপরের প্রশ্ন যে খুবই কঠিন। বলি কী করে। পরেশচন্দ্রের সঙ্গে পরীর শুভকাজে তিনি অনুমতি দিয়েছেন—অর্থাৎ এই অনুমতি নেবার জন্যই যাওয়া কিনা! যদি বিষয়টা শেষ হয়ে গিয়ে থাকে— হয়ে যাবারই কথা, দোতলার বেতের সাদা চেয়ারে পরী যে-ভাবে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, তাতে মনে হয় বাবাঠাকুর পরীর ফাঁসির হুকুম দিয়ে দিয়েছেন। শেষ আশ্রয় বলতে পরীর ছিল, বাবাঠাকুর। নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত এমনকি তার ওপরের আদালতের রায় হয়ে গেছে। একমাত্র রাষ্ট্রপতিই পারেন ফাঁসির হুকুম বাতিল করতে। যদি সেখানেও সেই রায় বের হয়ে গিয়ে থাকে। 

ভিতরে এত জ্বালা অনুভব করছি কেন! আমি সত্যি অমানুষ। পরীদের বৈভবের প্রতি আমার ঘৃণা আছে, পরীর এই বৈভবের জন্য সে দায়ী হবে কেন! সে তো বোঝে, মানুষকে না ঠকালে, একজন মানুষ, অন্যের চেয়ে বেশি প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করতে পারে না। সে নিজে মিছিলে, ভোটের প্রচারে তার দলের হয়ে বার বার এই কথাই বলে গেছে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, এমন ডানপিটে মেয়ে, খোলামেলা বেপরোয়া মেয়ে কদিনে কী হয়ে গেল! এ জীবন তো পরীর পক্ষে আত্মহত্যার শামিল। পরী কি তার পরিবারের মর্যাদা রক্ষায় নিজে আগুনে আত্মাহুতি দিচ্ছে। 

খাওয়া আমার মাথায় উঠে গেল। বললাম, মিমিকে একবার ডেকে দেবেন। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে। জীবনেও হয়ত এমন দৃঢ়তার সঙ্গে কেউ কখনো তাঁকে হুকুম করেছে তিনি জানেন না। তার মুখচোখ কেমন সহসা রক্তবর্ণ হয়ে গেল। উত্তেজনায় তিনি থরথর করে কাঁপছিলেন। যেন এই মুহূর্তে হুঙ্কার দিয়ে উঠবেন, বের হও, বের হয়ে যাও। রাস্তার কুকুর! কিন্তু এ কি দেখছি— তিনি সহসা আমার দু-হাত চেপে ধরে অনুনয় করছেন, সব রাগ বিদ্বেষ, জ্বালা তাঁর উবে গেছে, অসহায় বালকের মতো হাত ধরে অনুরোধ করছেন, তুমি যা চাও আমি দেব, তুমি যা বলবে আমি করব। কিন্তু দোহাই মিমিকে বলবে না, রেলের চাকরি হচ্ছে তোমার। বিলাসপুর তোমাকে চলে যেতে হবে। 

কিছু বলছি না আমি। কী বলব! 

সামনাসামনি দু-জন টেবিলের দু-পাশে। শ্বেতপাথরের গোল টেবিল। সব অহঙ্কার এই একটি টেবিল এক নিমেষে উল্টে দিতে পারে। 

–বিলু তোমার দু-হাত ধরে বলছি। 

তিনি আমাকে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিতে থাকলেন। 

মাথা নিচু করে বললাম, কথা দিচ্ছি ওকে আমার কাজের কথা বলব না। রেলে কাজ পেয়েছি বলব না। এখান থেকে চলে যাচ্ছি বলব না। 

তা হলে পরী জানে না, আমার রেলে চাকরি হচ্ছে। পরী কিছুই জানে না। আমার অনুমানই ঠিক, আমাকে দূরে বনবাসে পাঠিয়ে দেবার জন্য পরীর দাদুর এই চক্রান্ত। মানুষটা কত অসহায়, কোথাকার কে এক বিলু এসে এই পরিবারে ঝড় তুলে দিয়েছে। এই প্রাচুর্যের বিরুদ্ধে বড় রকমের প্রতিশোধ নিতে পারছি ভেবে ভারী মজা অনুভব করলাম আর তারপরই আমি কেমন পাগলের মতো হা হা করে হেসে উঠলাম। 

—বিলু! বিলু। তিনি চিৎকার করছেন। 

আমি হাসছি। 

আমার সেই হাসির প্রচন্ড আওয়াজে ঝড় উঠে গেছে বাড়িটাতে। সবাই দৌড়ে নেমে আসছে। দেখতে পাচ্ছি পরীও এসে রেলিঙে ভর করে দাঁড়িয়ে। সে অবাক হয়ে দেখছে আমাকে। 

দেখলাম পরী দ্রুত দৌড়ে নেমে আসছে। 

দেখলাম পরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, এই বিলু কী হয়েছে! কী হয়েছে তোমার! বিলু বিলু, পাগলের মতো হাসছ কেন? আমার ভয় করছে! প্লিজ বিলু! 

পরী নার্ভাস হয়ে পড়ছে। এও এক মজা। এ পরিবার সম্পর্কে আমার কৌতূহলের শেষ ছিল না। এ বাড়িতে এলেই মনে হত এরা সব যেন ভিন্ন গ্রহের মানুষ। লম্বা দীর্ঘকায় সব পুরুষ, সৌম্য। এবং আভিজাত্য চলাফেরায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকলে সুঘ্রাণ। সব তকতকে ঝকঝকে। মারবেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে ভয় লাগত। পা পিছলে পড়ে যেতে পারি। পরী কত সহজে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যাবার সময় বলত, এস না ভয় কী! সেই পরিবারে আমার সামান্য হাহাকার হাসি ঝড় তুলে দিয়েছে। 

পরী নার্ভাস হয়ে পড়লেই পরীর চোখে জল চলে আসে। আসলে পরী বড় হয়েছে এক সুন্দর ফুলের উপত্যকায়—সে জানেই না, এই পৃথিবীতে বনজঙ্গল কাঁটাগাছই বেশি। সে জানে না, এ পৃথিবীতে বড় হতে গেলে পার হতে হয় অনেক উঁচু টিলা, গিরিখাত। আমি আর হাসতে পারলাম না। কতদিন পর যেন পরীর সঙ্গে দেখা। পরীকে বললাম, তোমার কোনো পাত্তা নেই। কী ব্যাপার? 

—কোনো ব্যাপার নেই। তুমি বোস। আর একদম হাসবে না। 

পরী কী আমার মধ্যে টের পায় এক ভালবাসার পাগল কাঙাল হয়ে আছে। অথচ ভীরু বলে চাইবার সাহস নেই। ভীরু বলে জোরজার করার ক্ষমতা নেই। সবসময় অহঙ্কার নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে পরীর প্রতি আমার ছলনা আছে। ওটা আমার বর্ম। পরী কি ধরতে পেরেছে, আমার সব বিরূপতা আসলে দুর্বলতা থেকে! 

পরী আমার অস্বাভাবিক আচরণে ঘাবড়ে যেতে পারে ভেবে আমি আর হাসলাম না। আসলে পরীর দাদু আমাকে কত ভয় পান, আমি তাঁর গলার কত বড় কাঁটা, সেই ভেবে হাসা। সামান্য এক বিলু, প্রাথমিক ইস্কুলের মাস্টারি পেয়ে যে বর্তে গেছে, সেই বিলু এক দোর্দন্ড প্রতাপশালী মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে—সেই ভেবে হাসা! 

পরীকে বললাম, জান আমার যাওয়া হয়নি। 

—হয়নি তো বেশ। ও নিয়ে তোমায় আর ভাবতে হবে না। সে এবার পেছনের দিকে তাকালে দেখলাম—যে যার মতো দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। ওর দাদু পর্যন্ত। পরী এতদিন নিজে মুষড়ে পড়েছিল, আজ আমার অস্বাভাবিক ব্যবহারে সে ভেবেছে, তাকে শক্ত হতে হবে। 

পরী বলল, চল বের হব। 

—কোথায়? 

—চলই না। 

পরী যেন এই কারাগার থেকে বের হয়ে মুক্তি পেতে চায়। আবেগের বশে এসব চলে, কিন্তু জীবনের বড় হওয়ার ক্ষেত্রে আমি তার অচল পয়সা। 

দাদু সিঁড়ি থেকে ফিরে এলেন, কোথায় যাবে? 

—বাবাঠাকুরের কাছে। 

তার তখনই চিৎকার, রঘু, রঘু। 

বুড়ো মানুষটার কী ভয়ঙ্কর গম্ভীর গলা। সবাই দৌড়ে আসছে।—মিমি কালীবাড়ি যাবে। গাড়ি বের করতে বল। 

মিমি বলল, দাদু গাড়ি লাগবে না। আমি বিলুর সঙ্গে সাইকেলে যাব। বাবাঠাকুর বললেন না, বিলুকে পেলে ধরে আনবি তো! 

বাবাঠাকুরের কথায় দেখলাম তিনি একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। 

পরীকে বললাম, বাবাঠাকুর সত্যি ধরে নিয়ে যেতে বলল? 

—হ্যাঁ বিলু, বলেই সে দৌড়ে উঠে গেল ওপরে। কত অস্বাভাবিক দেখেছি পরীকে কিছুক্ষণ আগে, মুহূর্তে পরী আবার কত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সে কি বুঝে ফেলেছে, আত্মহত্যা করার অধিকার তার আছে, কিন্তু বিলুকে গলা টিপে মারার অধিকার তার নেই। সে কি সেই ভেবে এত সহজ হয়ে গেল। ঠিক আগেকার পরী। সিঁড়ি ধরে নেমে এল খুব সাদামাটা পোশাকে। আমার সঙ্গে সাইকেলে বের হবার সময় দারোয়ানকে বলল, পরেশচন্দ্র এলে বলবে দিদিমণি বাড়ি নেই। কখন ফিরবে ঠিক নেই। 

আর অবাক, কিছুটা এগিয়ে টাউন হলের কাছে এসে এক পায়ে মাটিতে ভর দিয়ে সাইকেল থামিয়ে বলল, চল আগে পরেশচন্দ্রের কোয়ার্টারেই খাওয়া যাক। তারপর কেমন অসহায় গলায় বলল, দাদুর কষ্টটা বুঝি। দাদুর কাছেই আমি মানুষ। দাদু বাবা সবাই চায় আমার ভাল হোক। আমি বুঝি বিলু—কিন্তু মানুষের কী ভাল কী মন্দ কেউ বলতে পারে। কোথায় সে তার ভালমন্দ খুঁজে পায় কেউ জানে না! 

পরী আমার সঙ্গে বের হয়ে আমায় কিছুটা সঙ্কোচের মধ্যে ফেলেছিল। আমার চাকরিটা শেষ পর্যন্ত হবে কিনা কে জানে। পরীর বের হয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। যখন বিয়ে ঠিক। তাছাড়া এতবড় চাকরির খবর পরীকেও দিতে পারছি না—খুবই সুখবর। পরী বাড়ি গেলে জেনে ফেলতে পারে। বাড়ির কেউ বলে দিতেই পারে। আর কেউ না বললেও পিলু বাহবা নিতে ছাড়বে কেন! 

পরেশচন্দ্রের বাংলোর কাছে এসে পরী বলল, ধুস যত সব। চল তো! 

—কোথায়? 

—চলই না। 

ভাবলাম তবে পরী কালীবাড়ি যাবে। বললাম, পরেশচন্দ্রের সঙ্গে দরকার ছিল। 

—কিসের দরকার? 

—না মানে……এই যে এলে, এসে ফিরে যাচ্ছ। 

—কোনো দরকার নেই। ওর বোঝা উচিত, আমি কী চাই। 

—তুমি কী সত্যি চাও কেউ জানে না। 

—জানে না তো বেশ। 

তারপর পরী কেমন অকপটে বলে গেল, বিলু আমার বিয়ে হলে তোমার কষ্ট হবে না? 

—হ্যাঁ, তা একটু হবে। 

—একটু হবে? 

—বেশি হলে তোমার ভাল লাগবে? 

পরী জবাব দিল না। সে সাইকেল ঘুরিয়ে দিল—কালীবাড়ির কাছে এসে বলল, সত্যি বেচারা লক্ষ্মী! 

কালীবাড়ি এলেই আমার কাছে লক্ষ্মীর স্মৃতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে ভেবেই, কেমন ভয় ছিল, কালীবাড়ি আর আসা হয়নি। লক্ষ্মীর আত্মহত্যার পর এখান থেকে চলে গেছি—এই আত্মহত্যার মূলে আমি আর পরী। সেদিন জ্যোৎস্না রাতে পরীকে বাগানের মধ্যে আমার সঙ্গে ঘুরতে না দেখলে মেয়েটা হয়তো নিজেকে বিনাশ করত না। এসব মনে পড়লে বিষণ্ণ হয়ে যাই। মন্দিরের দরজায় লক্ষ্মীর সেই আমার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকা, কলেজ থেকে ফিরলে হাতমুখ ধোওয়ার জল, পাজামা গেঞ্জি এগিয়ে দেওয়া—এসবই ছিল তার কাজ। কথায় কথায় বলত, দেবস্থানে মিছা কথা বলতে নাই। তা’হলে মা-কালীর অভিশাপে জিব খসে পড়বে। 

লক্ষ্মীর ধারণা সে যাকে ভালবাসে, তার পরমায়ু কমে যায়। দেড়-দু বছর একজন সমবয়সী শ্যামলা মেয়ে কাছাকাছি থাকলে টান ধরেই যায়—লক্ষ্মীই প্রথম খবর দিয়েছিল, বাড়ির নতুন মাস্টারের। পরী সেই খবর পেয়ে চিড়িয়াটিকে দেখার জন্য বাইরের ঘরে হাজির সেদিন। সেই থেকে আজ আমরা সেখানেই যাচ্ছি যেখানে পরী আছে আমি আছি, বাবাঠাকুর, বদরিদা, বউদি সবাই আছেন—নেই শুধু লক্ষ্মী। লক্ষ্মী মরার আগে নিজেকে নববধূর মতো সাজিয়েছিল। কপালে সিঁদুরের টিপ, লালপেড়ে শাড়ি, পায়ে আলতা। সিঁথিতে সূর্যাস্তের শেষ আলো—এক লম্বা লাল সড়ক- আমরা দুজনে এখন তার উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *