প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মৃন্ময়ী – ৭

সাত 

কদিন থেকে জোর বর্ষা শুরু হয়েছে। আমাদের বাড়ির সামনের নালাটা জলে ভেসে গেছে। সামনের মাঠ ঘাট সব। রাস্তায় এসে দাঁড়ালে, দূরের বাদশাহী সড়ক আম জাম গাছের ফাঁকে দেখতে পাই। বর্ষার সময়টা বাড়িতে আটকা পড়ে যেতে হয়। সারাক্ষণ বাড়ি থাকতে এখন কেন জানি আর ভাল লাগে না। বৃষ্টিটা কবে যে ধরবে। রাস্তাটা আমাকে টানে। 

সেদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ একেবারে ফর্সা। আশ্বিন-কার্তিকের আকাশের মতো। ভিতরটা কেমন আনন্দে রে রে করে উঠল। মা বলল, ওঠ বাবা ওঠ। একেবারে পচে গেলাম। 

আমাদের এই বাড়িঘরে কাঠকুটোর বড় দরকার। বর্ষার সময়টায় মা’র খুবই কষ্ট। পাটকাঠি, না হয় শুকনো ডালপালা, খড়, এ-সব দু-বেলা খাবার ফুটিয়ে খেতে বড় দরকার। আমাদের উঠোনটা কচ্ছপের পিঠের মতো। জল দাঁড়ায় না। একটু রোদ পেতেই শুকনো খটখটে। যে ঘরটায় আমি আর পিলু থাকি, বৃষ্টির সময়, সব খড়কুটো ডালপালা সেখানে তুলে রাখা হয়। 

এ-নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার মতান্তর চলছে। বাবাকে বলে বুঝেছি, লাভ নেই। মা’র সায় না থাকলে বাবা কিছুতেই মত দেবেন না। 

বারান্দায় জলচৌকিতে বসে মনে হল, এ-সময়েই কথাটা তোলা দরকার। 

পিলু, মায়া, মা সব খড়কুটো, শুকনো পাতা বাইরের উঠোনে মেলে দিচ্ছে। বাবা একটা লম্বা বাঁশ টেনে আনছেন। বাঁশটা দু-গাছের ডালে বেঁধে ঝুলিয়ে দিলেন। পিলু একবার আমার দিকে তাকাল। আমার বসে থাকাটা বোধ হয় তার পছন্দ হচ্ছে না। তবে পিলু জানে, আমার মেজাজ খারাপ। পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য রোজই শহরে যাই। মুকুল, নিখিল, নিরঞ্জন আমার সঙ্গে পড়ে। পত্রিকায় যদি খবর বের হয়, ওরা বাড়িতে কাগজ রাখে। পরী অবশ্য অনেক আগেই আগাম খবর দিয়েছে আমাদের, রেজাল্ট বের হতে এ-মাসের শেষাশেষি, কেন যে এত হেদিয়ে মরছি বুঝি না। 

ক’দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ায় শহরে যাওয়া হয়নি। রাস্তাটা যেমন টানে, শহরে যাওয়ার টানটাও আমার কম নয়। আমাদের ত্রৈমাসিক কাগজের অফিসটা মুকুলের বাড়িতে। ওর দাদার পি ডবলু ডির কোয়ার্টারের বসার ঘরটা ‘অপরূপা’ কাগজের অফিস। সামনে লম্বা বারান্দা, পরে লন, লোহার রেলিং দেওয়া পাঁচিল, পরে লাল ইঁট সুরকির পথ। দুটো বড় দেবদারু গাছ পার হলে, শহরের বিশাল মাঠ। মাঠ পার হয়ে সোজা স্টেশনে যাবার রাস্তা। 

আমার একটাই ভয়, পরী আবার যে কোনোদিন চলে আসতে পারে। কিছু একটা উপলক্ষ খুঁজে চলে আসবে। পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে আমার যত না মাথাব্যথা, পরীর তার চেয়ে বেশি। মেয়েটা সত্যি আশ্চর্য। নিজের কথা ভাবে না। পাশ করলে, ফেল করলে কিছুতেই না। অবশ্য পরীকে আমরা ভালই জানি। ওর রেজাল্ট মিনিমাম ফার্স্ট ডিভিসন—আমরা ধরেই নিয়েছি। আমার দুশ্চিন্তা, আমার কী না জানি হবে, পরীর দুশ্চিন্তা বিলুটা যা স্বভাবের পরীক্ষার এদিক ওদিক হলে আবার না বাড়ি থেকে ভেগে পড়ে। সে জেনে গেছে, বাড়ি থেকে একবার উধাও হয়েছিলাম, আবার উধাও হওয়াটা বিচিত্র নয়। 

বাবা দেখছি পাটকাঠির আঁটিগুলি গুনে বাঁশে হেলান দিয়ে রাখছেন। আমার ঘর থেকে ভেজা পাট তুলে নিয়ে রোদে শুকোতে দিচ্ছেন। আর বসে থাকা যায় না। বাড়িতে আমি বাবার কলেজ পড়ুয়া ছেলে বলে, এ-সব কাজে হাত লাগাই এখন বাবারও পছন্দ না। মা অবশ্য গজগজ করে। মাকে খুশি রাখতে পারলে কাজটা উদ্ধার হয়ে যেতে পারে। মা’র সঙ্গে কাজে লেগে পড়লাম। ঘর সাফ করে সব বের করে দিলাম। মা হঠাৎ বললে, তোর কী হয়েছে রে? 

এ-সব কাজে হাত লাগিয়েছি দেখেই মা অবাক। বললাম, কৈ কিছু হয় নি তো। 

মা এখন একটা চাটাইয়ে ধান ছড়িয়ে পা দিয়ে নেড়ে দিচ্ছে। বড় পুত্রটির সুমতিতে বোধ হয় কিছুটা হতভম্ব। বললাম, মা আমার ঘরটায় পার্ট-ফাট রাখতে বাবাকে বারণ কর। কী পাটপচা গন্ধ! লোক এলে ভাববে কী! 

—তোমাদের বাড়িতে আসেটা কে? এত যে ভাবনা! 

বাবা বাড়ির বাইরের দিকে কাজ করলেও কথাটা বোধ হয় কানে গেছে। বাবার ইজ্জতে লেগেছে। বাবা সোজাসুজি উঠোনে এসে বললেন, এটা কেন বলছ ধনবৌ? আসে না কে? 

—সেই তো। আমি বাবার কথায় সায় দিলাম। 

মা’র হাতে অনেক কাজ। মায়া বলল, মা আজ ধান সেদ্ধ হবে? 

—দেখি। আকাশের যা অবস্থা। বরুণ দেবের কি কৃপা হবে কে জানে। 

বাবার কথার কোনো জবাবই দিচ্ছে না মা। 

বাবা বারান্দায় উঠে এলেন। এত কষ্ট করে ঘরবাড়ি করা, গাছপালা লাগান, সবই তো মানুষের জন্য। ধনবৌ বলছে কিনা, কে আসে! 

—আরে আসে না কে? সকাল থেকেই তো আসতে শুরু করে। বাবা বেশ ঝাঁঝের গলায় কথাটা বললেন। 

মা ধানের পাতি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে যাবার সময় শুধু বলল, আসে ভজাতে। 

বাবা ঠিক বুঝতে পারলেন না, মা’র মাথা সকাল বেলাতেই এত গরম কেন! চুপচাপ থাকাই বাঞ্ছনীয়। কয়েক মণ ধান বাবা মা’র পরামর্শ মতোই কিনেছেন। চাল এতে অনেক সস্তা হয়। তাছাড়া ধানের তুষ, চালের কুঁড়া সংসারে লাগে না হেন জিনিস নেই, কিন্তু এবারে এত বর্ষণ হবে, মার বোধ হয় ধারণা ছিল না। আমাদের পাঁচ বিঘা জমির বিঘাখানেক শুধু ঘরবাড়ি, গাছপালা, গোয়াল ঘর, ঠাকুর ঘর, রান্নার ঘর, আমার পিলুর জন্য থাকার আলাদা ঘর, তক্তপোষ। বাঁশের একটা জঙ্গল আছে জমির শেষ দিকটায়। সেখানটায় কিছু আবাদ হয় না। কিন্তু ঘরবাড়িতে বাঁশের কত দরকার আমরা এখন বুঝতে পারি। পাটকাঠির বেড়া পাটকাঠির চাল, তার কোণায় চারটে মজবুত বাঁশ। মাঝে তিন খানা করে পলকা বাঁশ, চাল দুটো উপরে তুলে বেড়া লাগিয়ে দিলেই ঘর। বাবা যজন-যাজনের কাজ সেরে, বাড়িটা নিয়েই পড়ে থাকেন। 

সেই বাড়ি নিয়ে খোঁটা! 

বাবাও কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। 

মা’র গজ গজ তখনও চলছে। কে করে অত! আর ডাকলেই হল, কর্তা আমার বাড়ি শনি পূজা! তা জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে—তোমার দাম বাড়ে না! এ কি রে বাবা, এক পয়সা দু-পয়সা দক্ষিণা! ছটা পেট ওতে চলে। সেই এক কথা। 

তাহলে গতকালের জের চলছে। মা’র আবার শুরু হয়েছে। 

বাবা প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় করে এক ক্রোশ হেঁটে পূজা করতে গেছিলেন। কী দুর্যোগ! বার বার মা’র এক কথা, যেতে হবে না। অন্ধকারে কিসে কোথায় পা দেবে, তখন দেখবেটা কে? 

বাবা বলেছিলেন, ধনবৌ, ও-কথা বলতে নেই। রাখে কৃষ্ণ মারে কে! বাবা অন্ধকারেই দুর্যোগের মধ্যে মার কথা না শুনে বের হয়ে গেছিলেন। যাবার সময় শুধু বলেছিলেন, বারের পূজা। আমার জন্য বিঘ্ন ঘটলে সংসারে অমঙ্গল হতে কতক্ষণ। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি। 

মাও আর কিছু বলতে সাহস পায়নি। সত্যি তো—বারের পূজা, শনির কোপে শ্রীবৎস রাজার কথা কে না জানে। মা আর উচ্চবাচ্য করে নি। বেশ রাত করে বাবা একেবারে বৃষ্টির জলে নেয়ে ঘরে ফিরলেন খালি হাতে। দরজা বন্ধ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সোঁসোঁ বাতাসের গর্জনে কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বাবা বাড়িতে ঢোকার আগেই মা কি করে যেন সব টের পায়। দরজা খুলে দিল। বাবা, শুধু বলেছিলেন, কুণ্ডু মশাইর আক্কেল ভারি কম। খবর দিলেই পারতিস। দুর্যোগের জন্য বাজার হাট করা যায় নি। 

মা একটা কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, আগে সব ছেড়ে ফেল। পরে কুণ্ডুমশাইকে নিয়ে পড়বে। যেমন তুমি, তেমন তোমার যজমান। দু-জনেই সমান। 

বাবার মুখে একটা কথা নেই তখন। আমরাও বাবার ফিরে আসার জন্য জেগে আছি। এমন দুর্যোগের রাতে বাবা শনিপূজা করে ফিরে না আসা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। সেই বাবা ফিরে আসায় ঘরবাড়ির সব ঠিকঠাক আছে এমন ভেবে শুয়ে পড়তে চলে গেছিলাম। রাতে দু’জনের মধ্যে আক্কেল নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে পারে। সকাল বেলায় তারই সম্ভবত জের চলছে। 

মাথায় রাগ পুষে রাখা সংসারের পক্ষে অকল্যাণকর বাবা বোধহয় এটা বোঝেন। বোঝেন বলেই ক্রোধ নিবারণ করতে বাবা তাঁর জানা বিচিত্র সব ধন্বন্তরির আশ্রয় নেন। তার একটি বসে বসে নিবিষ্ট মনে তামাক সাজানো, কলকেয় আগুন দেওয়া, তারপর চোখ বুজে টেনে যাওয়া। তখন বাবার চোখ মুখ দেখলে কে বুঝবে মানুষটা এ জগতে আছে। মা’র এ-হেন দৃশ্য সহ্য হয় না। একেবারে শিব ঠাকুর সেজে সংসারে কালাতিপাত, একটু যদি জ্ঞানগম্যি থাকে। হেন দৃশ্য চোখের সামনে কে দেখে! মা সোজা রান্নাঘরে। 

বাবা টিপে টিপে কলকেয় তামাক ভরছিলেন। মা রান্নাঘরে উঠে গেছে। একবার রান্নাঘরের দিকে তাকালেন বাবা, পরে আমার দিকে। বললেন, এই তো সেদিন এস ডি ও সাহেব ঘুরে গেলেন। তা তোমার মা জানে, এস ডি ও সাহেব বস্তুটি কি! 

মা রান্নাঘরে ঠিক কান খাড়া করে রেখেছে—এবং আমরা বুঝতে পারি, এই কথা কাটাকাটির সময়, দু-পক্ষেরই কান বড় সজাগ। যে যেখানেই থাকুক না কেন সব শুনতে পায়। 

—বিলু তোর বাবা কি সাহেব বলল – আমি বুঝি না! 

আমি বললাম, এস ডি ও সাহেব। 

—পরীর সঙ্গের লোকটার কথা বলছে! 

বাবা বললেন, হ্যাঁ। লোকটা বল না, ভদ্রলোক বল। তিনি হলেন সদরের এস ডি ও। ধুতি শার্ট পরে এসেছিলেন বলে তুমি তার মূল্য বোঝ না। এই ঘরবাড়িতেই এসেছিলেন। 

—তোমার খোঁজে? 

—আমার খোঁজে হবে কেন! বিলুর খোঁজে। 

মা রান্নাঘর থেকেই কথা চালাচালি করছে। বলছে—আমি ভাবছিলাম তোমার খোঁজে বোধ হয়। ভারি অপমানবোধে বাবার মুখ কেমন পীড়িত দেখাল। মা’র এই খোঁচা দেওয়া কথা কি কঠিন বাবার দিকে তাকিয়ে টের পাচ্ছিলাম। বাবাকে প্রবোধ দেবার জন্য বললাম, আমার খোঁজে আসা বাবার খোঁজে আসা একই কথা। তুমি মা না, কি যে সব বল! 

বাবা এতে বোধহয় ভারি আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন। বললেন, তোমার মাকে বল, এই কলোনিতে কার ঘরবাড়িতে কবে সাক্ষাৎ এস ডি ও সাহেব এসেছিলেন। বোঝাও। আমি তো চোখ বুজে থাকি। সংসারের কিছু দেখি না। আমার বাড়িতে কেউ আসে না। 

এই সুযোগ। এস ডি ও সাহেবের আসার বদান্যতায় বাবা যদি আমার ঘরটায় আর কাঁচা পাট, খড়কুটো সব না রাখেন। বন্ধু-বান্ধবরা আসে, আবার এস ডি ও সাহেব আসতে পারে—বললাম, ভাগ্যিস বাড়ির ভিতর ঢুকাই নি। 

—এটা তোমার অন্যায় কাজ হয়েছে। কেউ এলেই মনে রাখবে বাড়ির অতিথি। তার আদর- আপ্যায়নে ত্রুটি রাখতে নেই। তুমি তার সঙ্গে রাস্তাতেই কথা সেরে ছেড়ে দিলে। 

–ও তো পরীর দেওয়া একটা খাম দিতে এসেছিল। ওর জিপ রাস্তায়। পরী ওর সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিল—যাবার পথে দিয়ে গেছে। বাবা পরী কথাটাতে একটু বিভ্রান্তিতে পড়লেন, তবে কিছু বললেন না। 

—তবু এই বাড়িঘরে তিনি এসেছিলেন। তুমি এখানে আছ বলেই না এসেছিলেন। অন্যথায় আসতেন! বাড়িঘরের মাহাত্ম্য ভুললে চলবে কেন? 

—এনে বসাবটা কোথায়! আমার ঘরটাতে পা ফেলা যায় না। ঢুকলেই পচা পাটের গন্ধ। এতে আপনার বাড়িঘরের সুনাম রক্ষা হত না। 

বাবা কি বুঝলেন কে জানে। বাড়িতে আজকাল বড় পুত্রের বন্ধু-বান্ধবরা আসে। তারা সবাই সম্পন্ন ঘরের ছেলে। পুত্রের মর্যাদা বলে কথা। বললেন, দেখি পাট বিক্রি হলে, মুনিষ নিয়ে আর একটা ঘর করা যায় কি না! সবই তো আছে— শুধু মুনিষের খরচটা। 

মা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত। বাবার সঙ্গে এত কথা আমার, তা ছাড়া বৃষ্টি বাদলার দিনে খড়কুটো, কাঁচা পাট রাখার জন্য একটা ঘর উঠবে, মা’র পরামর্শ নেওয়া হবে না—মা সহ্য করবে কেন, ঘর থেকেই স্বর ভেসে এল, আজও তুই বিলু টিউশনি কামাই করলি। 

অর্থাৎ মা’র আর ইচ্ছে নয় বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলি। বললাম, যাব। কাল থেকে যাব। তুমিই তো যেতে দিলে না। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরজ্বালা হলে কে দেখবে। 

—আজ তো বৃষ্টিও নেই। দুর্যোগও নেই। ওরা কি ভাববে। কুড়িটা টাকা সোজা কথা! 

আসলে আমি বারান্দায় বসে থাকি মা চায় না। বাবা আজকাল সব বিষয়েই আমার মতামতের গুরুত্ব দেন। মা যে আমার কত অবুঝ সেটা ধরিয়ে দেবার জন্যও আমি। বাবা এখন মাকে আমার মারফতে কি-ভাবে খোঁচা দেবেন, সেই ভয়ে বলা। 

বাবা তখন হুঁকোয় টান দিয়ে খানিকটা বোধহয় স্বস্তি বোধ করছেন। বললেন, তোমার মা তো এস ডি ও সাহেব কি, কেন, তাঁর ক্ষমতা কত কিছুই জানে না। আমাদের মহকুমার এস ডি ও ছিলেন বরদাবাবুর ছেলে। বরদাবাবু হল গে দীনেশবাবুর মাসতুতো ভাই। সোজা এস ডি ও হয়ে এল। মহকুমার মালিক। আর একটা সিঁড়ি ভাঙলেই ডি এম। তা কি তোমার মা বোঝে! ডি এম, এস ডি ও’র কত ক্ষমতা জানে! কি তফাৎ বোঝে! 

মা’র পক্ষে অবশ্য এ সব জানার কথা না। বাবার পক্ষে জানার কথা। মামলা-মোকদ্দমায় নারায়ণগঞ্জ ঢাকা গেছেন। তিনি বুঝতেই পারেন। বাবাদের আমলে নাকি বাঙালী ডি এম হাতে গোনা যেত। এ-সবও বললেন। 

মা হঠাৎ বোধহয় ক্ষেপে গিয়ে বলল, তা পরীর সঙ্গে কী সম্পর্ক! পরী তো কলেজে পড়ে। বাড়িতে ওর মা বাবা নেই! এমন একটা সোমত্ত মেয়েকে একলা ছেড়ে দেওয়া। বলি, আক্কেল কি বাড়ির। 

মা ঠিক বোঝে না পরীকে সবই মানায়। পরী এখানকার এক বিপ্লবী পার্টির ক্যাডার। মিছিল করে মিটিং করে সরকারের বিরুদ্ধে। আবার এস ডি ও সাহেবের জিপেও চড়ে বেড়ায়। মার বোধ হয় আপত্তিটা সেখানে। 

মা বলল, কী গেছো মেয়ে রে বাবা! 

বাবা বললেন, গেছো মেয়ে বলছ কেন। ও তো সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। একেবারে দেবীর মতো চোখ মুখ। কত বড় সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে। সেও এই বাড়িঘরে আসে। আসে না কে? এবারে তোমার মাকে বোঝাও। 

আমার বাবাকে ইতিমধ্যে একবার এসে পরী তার ভাল নামটাও জানিয়ে গেছে। 

বাবা হঠাৎ কেমন ক্ষেপে গিয়ে বললেন, পরী পরী করছ কেন তোমরা বুঝি না! ওর নাম মৃন্ময়ী। বাড়ির লোকেরা মিমি বলে ডাকে। তা রায়বাহাদুরের এমন আদরের নাতনির নাম মিমি না হলে মানাবে কেন? আমার দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, তুমিও দেখছি ওকে পরী বলেই ডাক। 

বাবাকে তো আর বলতে পারি না, পরী নামটা আমিই কলেজে দিয়েছি। কালীবাড়িতে আলাপ হবার পর পরীকে কথাটা বলতেই সে কি হাসি। শরীর থেকে আঁচল খসে পড়েছিল। আঁচল সামলে বলেছিল, তুমি বিলু আমাকে কিন্তু পরী বলেই ডাকবে। না হলে ভীষণ রাগ করব। 

নাও এবারে ঝামেলা পোহাও। বাবাকে বলি কী করে আমি ওর নাম দিয়েছি পরী। পরী নামে না ডাকলে ও রাগ করে। বাবা তখন বলতেই পারে, ওর নাম থাকতে আবার একটা নাম দেবার দায় কে তোমাকে দিল! 

আমি চুপ করে আছি। নিজের এই দুর্বলতা পরিহার করা শ্রেয়। কিন্তু কি যে হয়েছে, পরী এখন আমার এত কাছের যে তাকে পরিহার করে চলাই কঠিন। আমাদের কাগজের সব সে। কাগজের সম্পাদক পরীর ইচ্ছেতেই আমাকে হতে হয়েছে। যত ভাবি বিদ্রোহ করব তত পরী যেন নানা ভাবে আমাকে কাবু করে ফেলছে। কাগজটাও যে বের হচ্ছে পরীর চেষ্টাতে, সে-ই বিজ্ঞাপন আদায়ের ভার নিয়েছে, সে-ই টাকা পয়সা সংগ্রহ থেকে প্রেস ঠিক করা সব তার। 

বাবা ফের বললেন, মুকুল তো ওকে রাণী বলে ডাকে। 

বাবা তাহলে সবই শুনতে পান। নিখিল, নিরঞ্জন, মুকুল সাইকেল চালিয়ে শহর থেকে কোনো বিকেলে চলে এলে আমার ঘরে জম্পেশ করে আড্ডা। পরীক্ষা হয়ে গেলে কি আর করার থাকে—তরে আমরা বসে নেই। অপরূপা নিয়ে মেতে আছি। আসলে পরী বোধ হয় আমার মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিতে চায়। দেখ, যাকে তুমি হেলা ফেলা কর—তারই আজ্ঞাবহ দাস একজন এস ডি ও। – 

বাবাকে বললাম, পরীকে আমি ও নামেই ডাকি। 

—নামটা খারাপ না। তা দেখতে তো পরীই। ও রাগ করে না? 

বললাম, না। 

বাবা কথাটা শুনে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। মুখে কিছুটা দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল দেখলাম।

বাবাকে বড় অসহায় দেখাচ্ছে। পরীর কথা আবার তুলবে ভেবেই সাইকেলটা বের করে জামা গলিয়ে বের হয়ে পড়লাম। মন ভাল না। রেজাল্টের দুঃশ্চিন্তায় ঘুমও আসে না। 

মা বলল, কোথায় বের হচ্ছিস। 

পিলু বলল, আজ দাদা তুই ঠাকুরপুজা করবি। আমি পারব না। 

আমার কেন জানি সহসা মাথাটা গরম হয়ে গেল—বললাম, পারব না। 

বাবার মুখে এমন দুশ্চিন্তার রেখা কখনও ফুটে উঠতে দেখি নি। বের হবার সময় শুধু বললেন, 

কোথায় যাচ্ছ বলে যাবে না। 

মাও বের হয়ে এল। বলল, এখন বের হবার সময়? 

—একটু ঘুরে আসছি। মাকে প্রবোধ দিলাম। 

কিন্তু বাবা কেমন নাছোড়বান্দা। বললেন, শোন। 

বাবার গলা এত গম্ভীর যে সাইকেল থেকে নেমে পড়তেই হল। 

—কোথায় যাচ্ছ বলে যাও। 

বাবা এ-ভাবে কখনও কথা বলেন না। বাবার স্বভাবও রাশভারি নয়। তবু না বলে পারলাম না, মানুকাকার কাছে যাচ্ছি। 

—কেন! 

—যদি রেজাল্টের খবর পাই। 

—মানু দিতে পারবে? 

—দেখি, না হয় বাজারের দিক থেকে ঘুরে আসি। 

ক’বছরে এখানে একটা বাজারও হয়ে গেছে। চায়ের দোকান, মুদির দোকান, মাছ, কাঁচা আনাজ সবই পাওয়া যায়। চায়ের দোকানে কাগজ আসে। কলোনির লোকেরা চাও খায়, কাগজও পড়ে ওদিকটায় আরও দু-একজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে আছে। কাগজ বের হচ্ছে শুনে, তাদের সঙ্গে আমার এই কলোনিতে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তাদের একজন পালিয়ে কবিতাও লেখে। দুটো কবিতা রেখেও গেছে। ভাবলাম, ওখানেই তবে যাই। আসলে বাড়িতে একদন্ড থাকতে কেন জানি ইচ্ছে হচ্ছে না। 

সাইকেলে চড়ে বসলেই কেমন নিজের এক অন্য জগৎ ফিরে পাই। রাস্তায় নেমে গেলে গাছপালার ছায়ায় কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কেন এটা হয়। বাড়িঘর এত প্রিয়, সেই বাড়িঘরেই মন বসে না। কেমন উড়ো উড়ো একটা ভাব মনের মধ্যে কাজ করে। কিছুটা এসেই বুঝতে পারলাম বাজারের দিকে যাওয়া যাবে না। কাঁচা রাস্তায় সাইকেল চালান মুশকিল। সাইকেলের মাডগার্ডের মধ্যে কাদা ঢুকে যাচ্ছে। কিছুটা হেঁটে সাইকেল নিয়ে পাকা সড়কে উঠে গেলাম। কোথায় যে যাব বুঝতে পারছি না। কালীবাড়ি গেলে কেমন হয়। কতদিন বৌদিকে দেখি না। বাবাঠাকুর কেমন আছেন খবর রাখি না। বাবা একদিন বলেওছিলেন, এতদিন সেখানে কাটালে, অথচ বাড়ি এসে সেখানে আর গেলে না। 

আর যা হয়, মনের মধ্যে গভীর এক বেদনার জন্ম নেয়। লক্ষ্মী আমার উপর অভিমান করে চলে গেল। এসব মনে হলে আমার পীড়ন বাড়ে। কিছুই মনে থাকে না, আমার ঘরবাড়ি আছে বাবা মা আছে মনে থাকে না। কেমন উদাস হয়ে যাই এখনও। বাবার মুখে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। বাবা কি টের পেয়েছেন, আমি একটা ভাঙা লক্‌ঝরে সাইকেল নিয়ে, নতুন মার্সিডিজ গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে নেমেছি! আমাকে নির্ঘাত পেছনে ফেলে, গাড়িটা পলকে যে উধাও হয়ে যেতে পারে, আমার অপরিণত বুদ্ধির পরিণামে বাবা কি শংকিত? 

দুটো কারণে পরীকে আমি অপছন্দ করি। 

এক, পরীর রাজনীতি আমার বিলাস মনে হয়। 

দুই, পরী লক্ষ্মীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। সে জোরজার করে সব কিছু আদায় করে নিতে চায়। বড়লোকের অহংকার নেই এমন একটা ছদ্মবেশকেও পরীর আমি ঘৃণা করি। চট করে সে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে, চট করে সে বলতেও পারে, বিলু তোমাদের বাড়ি আমি যাব। 

আমি বলেছিলাম, না। 

না বলেছিলাম এ-জন্য, আমরা কত গরীব, পরী আমাদের বাড়ি এলে টের পাবে।

পরী শোনে নি। 

পরী সেই কালীবাড়ি থেকেই বায়না জুড়েছিল, বিলু আমরা ঠিক যাব। তোমার বাবা মাকে দেখে আসব। 

পরীদের প্রাসাদতুল্য বাড়িতে কে আর শখ করে যায়। নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কে যায়। আমার সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য পরী শেষ পর্যন্ত ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়েছিল বলেই যাওয়া। পরী আমাকে সেদিন একা পেয়ে হল ঘর থেকে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়েছিল। আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছি পরীর ব্যবহারে। আমাকে একা পেলেই পরী এটা করে। 

–এই পরী কি হচ্ছে। ছিঃ তুমি কী— 

—আমি কিছু না। কেউ আসবে না। 

—না আসুক, এমন করলে কোনোদিন আসছি না। 

—না এলে আমার বয়েই গেল। আমার কচু, বলে ছেড়ে দিলে। দেখলাম সত্যি, বাড়ির এমন নির্জন এক এলাকায় নিয়ে এসেছে যে পরী যা কিছু করলেও দেখার নেই। তাই পরীর এত সাহস। 

আমার ভিতরে কেমন একটি অপমানবোধ গর্জে উঠেছিল। পরীকে শিক্ষা দিতে হবে। কতটা পরী যেতে পারে দেখব। নেমে যাচ্ছিলাম সিঁড়ি ধরে। পরী সহসা পেছন থেকে নেমে হাত জড়িয়ে বলেছিল, আমাকে ক্ষমা কর বিলু। যাবে না। দাদুকে বলেছি, বিলুকে মন্দিরের পুরোহিত করা ঠিক হবে না। ও একবার কুড়িটা টাকা চুরি করেছিল। গ্যারেজে কাজ করত। ওখানকার গোবিন্দ কৌটোয় কুড়িটা টাকা রেখেছিল, তাই নিয়ে উধাও। আর যাই কর একজন চোর-ছ্যাঁচোড়কে মন্দিরের পুরোহিত করতে যেও না। 

বুদ্ধিটা আমারই দেওয়া। অবশ্য পরী বানিয়েও বলে নি। এসব কারণে আমি পরীর প্রতি আবার খুবই কৃতজ্ঞ 

পরী তার লাল সাইকেলে ভর দিয়ে সেদিন কথা বলছিল, আমি যে খুবই ক্ষেপে আছি বুঝতে পেরে বলল, ঠিক আছে আমি আর যাচ্ছি না। শোনো, লেখাগুলো প্রেসে দিতে হবে। দিলীপকে দিয়ে দিলেই হবে। 

আমি উঠে পড়ার সময় বললাম, মুকুলের কাছে আছে। দিলীপকে নিয়ে যেতে বলবে। 

—কেন দিয়ে আসতে পারবে না? 

—না। 

মুকুল বলল, তোমরা একেবারে দেখছি সাপে-নেউলে—অ্যাঁ, এ কিরে বাবা! ঠিক আছে মিমি, আমি দিয়ে আসব। আমার দিকে তাকিয়ে মুকুল বলল, পরী তোমাদের বাড়ি গেছে তো কী হয়েছে! এতে এত রাগেরই বা কী আছে! 

আমি বলেছিলাম, না আর যাবে না। এ-সব বিলাস আমার পছন্দ নয়। সেই সব কথাও বার বার মনে হয়। 

পরী সাপের মতো ফণা তুলে বলেছিল, বিলাস। বিলাস বলছ! ঠিক আছে, আমি যাব, আমি যাব। দেখি তুমি কী করতে পার। 

পঞ্চাননতলা পার হয়ে ভাঁকুড়ির দিকে কখন এসে একটা বড় গাছের নিচে বসে পড়েছি খেয়াল নেই। সাইকেলটা গাছের নিচে, সামনে আদিগন্ত মাঠ। শস্যক্ষেত্র। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। মাথায় হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। সারাটাক্ষণ মাথায় পরী। কতবার ভেবেছি পরীকে নিয়ে মাথা গরম করব না, সে তো আমার কেউ না, আমাকে জড়িয়ে পরীর চুমো খাওয়াটাও বিলাস। বিলাস কথাটা ভাবলেই মাথা স্থির থাকে না। পরীর কথা ভাবলে আমার পরীক্ষার দুঃশ্চিন্তাও মাথায় থাকে না। 

এ-সব মনে পড়লেই পরীর উপর আমি আরও কেন যে খাপ্পা হয়ে যাই। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। ডাগর চোখের অনাথা মেয়ে লক্ষ্মী আমাকে নিয়ে নিভৃতে গোপন একটা স্বপ্নের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সেদিনের ঘটনায় লক্ষ্মী এতই ভেঙে পড়েছিল, যে তার বেঁচে থাকার চেষ্টা বড় অর্থহীন—সে এ-জন্য মরে গেল। পরী এবং আমি দুজনে মিলে লক্ষ্মীকে আত্মঘাতী করেছি। 

এ-সবই ভাবছিলাম শুয়ে শুয়ে। মানুকাকার কাছেও যাওয়া হয়নি, বাজারের দিকেও যাইনি— পরীর কথা ভাবতে ভাবতে পরীক্ষার দুঃশ্চিন্তা একেবারে উধাও। কখন বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। কতটা বেলা হয়েছে খেয়াল নেই। গাছের নিচে ঘাসের ভিতর শুয়ে জীবনের বিচিত্র ঘটনায় যখন মুহ্যমান, তখনই পিলুর গলা, এই দাদা, তুই কিরে। এখানে একা শুয়ে আছিস। মা বাবা বসে আছে। খায় নি। 

ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। 

পিলুর চোখে বিস্ময়। দাদাটি তার দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। এই চল। বসে থাকলি কেন! 

—তুই যা। আমি যাচ্ছি। 

—না আমার সঙ্গে যেতে হবে। তুই কিরে, মা বাবার কষ্ট বুঝিস না! 

তবু বসে আছি। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি তো আমি এমন হয়ে যাচ্ছি কেন। পিলুর চোখ মুখ শুকনো। দাদাকে নিয়ে তার ভারি চিন্তা। কম কথা বলে। কখন আবার ফেরার হয়, এই ভয়ে সে সব সময় দাদার সম্পর্কে বড় সতর্ক থাকে। আমি সঙ্গে না গেলে সে যে যাবে না বোঝাই যাচ্ছে। সাইকেলে উঠে বললাম, চল। 

পিলু পাড়ার কারো সাইকেল নিয়ে আমাকে খুঁজতে বের হয়েছে। সে মুকুলের বাড়িতে গেছে, পরীদের বাড়ী গেছে, কালীবাড়ি গেছে সবাইকে ঠিক খবর দিয়েছে, দাদা সকালে কিছু না খেয়ে কোথায় যে বের হয়ে গেল। পিলু পেছনে আসছে। যেন আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। 

বাড়ি ফিরে দেখলাম, বাবা তামাক সাজছেন। বাবার এটা স্বভাব। সংসারে বড় রকমের গরমিলের আঁচ পেলে, খেপে খেপে ঘন্টায় তিন চারবার তামাক খান। আমার ফিরতে দেরি হওয়ায় তাঁর এখন সেই তামাক খাবার পর্ব চলছে। 

পিলু বলল, জান বাবা, দাদা না… 

ওকে আর বলতে দিলাম না।–এই থামবি! দাদা না…! দাদা কী করেছে! 

–করেছিস তো। 

—করেছি ভাল করেছি। তুই বলে দ্যাখ না। 

পিলু কী ভাবল কে জানে। সে বোধ হয় বুঝতে পারে গাছতলায় শুয়ে থাকাটা মানুষের স্বাভাবিক লক্ষণ নয়। বাবাকে বললে, আমার রাগ হতে পারে। আমি আবার কোন এক বিচিত্র কান্ড বাধিয়ে বসব ভয়েই পিলু আর কিছু বলল না। 

মায়া গামছা তেলের বাটি এনে সামনে রাখল। 

বাবা বললেন, বিশ্রাম করে স্নানটান সেরে নাও। তুমি স্নান করলে আমরা একসঙ্গে খেতে বসব।

তাহলে বাবা পিলু মা মায়া এখনও খায়নি। আমার ফেরার অপেক্ষাতে বসে আছে। নিজের উপরই তখন কেমন ক্ষেপে যাই। আমার হয়েছেটা কি! আমার তো এখন দরকার অভাব অনটন থেকে গোটা সংসারটাকে বাঁচানো। আমি একটা কাজ পেলে বাবা হাতে স্বর্গ পাবেন। বাবার চাল-চলনে, কথাবার্তায় এমন একটা আভাস আমি সেই কবে থেকে পেয়ে আসছি। মানুকাকা বাবাকে সাফ বলে দিয়েছে, আমাকে বিলুর কাজ সম্পর্কে কিছু বলবেন না। শ্যামাপদর কাছে আমার মাথা হেঁট। বছর দুই আগে শ্যামাপদবাবুর গ্যারেজ থেকেই আমি যে পালিয়ে গেছিলাম তাতে তিনি রুষ্ট। ফের কাজের ব্যবস্থা করে বিশ্বাস-ভঙ্গের দায়ে তিনি আর পড়তে চান না। ভাবলাম, খেয়ে দেয়ে একবার মুকুলের জামাইবাবুর কাছে যাব। 

আসলে পাশের খবরের চেয়ে আমার কাছে কাজের খবরের গুরুত্ব বেশি। বেকার যুবকের মতো ভিতরে হাহাকার জেগে উঠছে। মার ইচ্ছে নয়, আমি পড়া ছেড়ে কাজে যোগ দিই। পিলুও চায় না। মায়ারও ইচ্ছে দাদা বি কম পাশ করবে। দাদা এম কম পাশ করবে। দাদার গৌরবে এই বাড়ি ঘর সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। 

কিন্তু আমি জানি, যা সময়কাল বি এ এম এ পাশ করাটা সহজ। কাজ পাওয়াটা কঠিন। যাদের ধরা করার কেউ নেই, তাদের জন্য কাজও নেই। 

বাবার গলা পেলাম। যাও স্নানে যাও। 

মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে, যা দাদা। বসে থাকলি কেন! 

পিলু এখন এত বাধ্যের যে সে এসে বলল, দাদা, তোর সাইকেলটা তুলে রাখি? 

—রাখ। 

–দাদা, পরীদি না বাড়ি নেই। 

—কোথায় গেছে? 

—’জাগরণ’ নাটক হবে। নাটকের রিহারসেলে গেছে। 

আসলে পরী আমাদের বাড়ি এলে যে আমি খুশি হই না, পিলু বোঝে। পরীদের বাড়িতে আমাকে খোঁজ করতে যাওয়ায় খুবই যে আমি অপ্রসন্ন পিলু তাও বোঝে। কারণ পরী এই অজুহাতে ঠিক আমাদের বাড়ি চলে আসতে পারে।—বিলুকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি ভাববেন না মেসোমশাই—আমরা দেখছি। কোথায় যায় দেখব। পরীর আশ্বাস পেলে বাবা হাতে স্বর্গ পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমি বিরক্ত হব, পিলু এটা বোঝে বলেই বলা, পরীর সঙ্গে তার দেখা হয় নি। বাড়ির দারোয়নই খবরটা দিয়েছে। সুতরাং দাদার খবর সে জানে না। দাদার খোঁজেও সে আসবে না। 

আমি স্নান করতে বের হয়ে যাচ্ছি। মা আমার সঙ্গে এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। কেমন বোকার মতো মা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার এই আচরণ মা’র কাছে খুব অস্বাভাবিক ঠেকে। মা কি গোপনে এখন চোখের জল ফেলে আমার জন্য। পৃথিবীতে সব মায়েরাই কি সন্তান-সন্ততির এই বয়সটা নিয়ে বিমর্ষ থাকে। মাকে খুশি করার জন্য বললাম, মা আমি দৌড়ে ডুব দিয়ে আসছি। খুব খিদে পেয়েছে। ভাত বেড়ে ফেল। 

সামান্য এই আশ্বাসে মা’র চোখে মুখে প্রসন্ন হাসি খেলে গেল। সারা বাড়িটায় যে এতক্ষণ এক অপার বিষণ্ণতা বিরাজ করছিল, স্নানে যাবার আগে টের পেলাম সব কেটে গেছে। 

স্নান সেরে ফিরে এলাম তাড়াতাড়ি। মায়া ছুটে এসে আমার ভেজা গেঞ্জি এবং কাপড় হাত থেকে নিয়ে নিল। রোদে মেলে দিল। ঘরে ঢুকে দেখি পিলু আয়না চিরুনি এগিয়ে দিয়ে বলছে, চুলটা আঁচড়ে নে দাদা। 

আমাদের এই ঘরটায় শুধু কাঠের দরজা হয়েছে। বাবা আমার টিউশনির টাকাটা মাকেই দিয়ে দেন। মা টাকাটা বড় যত্ন করে তুলে রাখে। টাকাটা মা চায় বাড়ির আসবাবপত্র তৈরিতে খরচ করা হবে। শেষ পর্যন্ত আর তা হয়ে ওঠে না। সংসারে দু-বেলা আহার জোটাতে যখন বাবার প্রাণান্ত তখনই টাকাটা মা বের না করে দিয়ে পারে না। মা-র আশা ছিল আমার টাকাটা দিয়ে একটা তক্তপোষ বানানো যায় কি না, সেটা আর হয়ে উঠছে না। এবারে ধান কিনতে গিয়ে আমার উপার্জিত টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে বাবার উপর মা’র বিশেষ ক্ষোভ আছে। এই ক্ষোভ থেকেই বাবার সঙ্গে কত অকারণে যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায় যা আমার মা-বাবাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। এ- ঘরের কাঠের দরজাটা হয়েছে মা খুব হিসেবী বলে। পূজার দানের কাপড় মা তুলে রাখে। চার পাঁচটা কাপড় একসঙ্গে বিক্রী করে মা কাঠের দরজা বানাবার টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। এতে বাবা বোঝেন মা’র প্রয়োজনটা এই সংসারে কত বেশি। 

খেতে বসলে মা পিলুর দিকে তাকিয়ে বলল, মিমি কোথায় গেছে যেন বললি। 

—রিহারসেলে গেছে। 

—রিহারসেল জায়গাটা আবার কোথায়? 

পিলু খবু বিরক্ত গলায় বলল, ওফ্, মা তুমি না কিচ্ছু বোঝ না। 

—না আমি বুঝব কেন, সব তোমরা বোঝ। এই ‘বোঝ’ কথাতে বাবার প্রতি যে কিছুটা কটাক্ষ আছে তা বাবা বুঝতে পারেন। একবার শুধু মা’র দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তারপর গন্ডুষ করে আহারে প্রবৃত্ত হলেন। কিছু বললেন না। 

এখানে বাড়িঘর করার পর মা বছরে একবার যাত্রা দেখার সুযোগ পায়। মিলে ধুমধাম করে কালীপূজা হয়। তখন যাত্রা হয়। সেদিন মিলের দরজা সবার জন্য খোলা থাকে। পাড়ার সমবয়সীদের সঙ্গে মা যাত্রা দেখতে যায়। পিলু মায়া সঙ্গে থাকে। আমি যাই না। বাবাও না। মা যাত্রা দেখেছে। নাটক দেখে নি। এখানে আসার পর মানুকাকার দৌলতে দু-বার মা মায়া পিলু সিনেমাও দেখেছে। রামের সুমতি বই দেখে এসে মা’র সে কি আনন্দ। – বুঝলি বিলু একেবারে সত্যি ঘটনা রে! আহা মাছ দুটোর জন্য জানিস আমারও মায়া হয়। মায়া তো ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলেছে। 

এত সব জানা সত্ত্বেও রিহারসেল বস্তুটি মার জানা নেই এতে পিলু বিরক্ত। তার মা’টা যদি এ-সব না বোঝে তবে যেন তার দাদাটিরও আত্মসম্মান থাকে না। পরীদি এলে কথাটা উঠলে, মা’র এমন কথায় দাদার ইজ্জত যেতে পারে বলেই বুঝিয়ে বলা, রিহারসেল দিতে হয়। নাটক করার আগে রিহারসেল দিতে হয়। পার্ট মুখস্থ করতে হয় না। প্রম্পটার থাকে না। রিহারসেল দিয়ে ঠিক করে নিতে হয়, কোথায় রাগ করতে হবে, কোথায় শান্ত থাকতে হবে, কোথায় কাঁদতে হবে। রিহারসেল দিয়ে দিয়ে সব মুখস্থ করতে হয়। পরীক্ষার আগে পড়া মুখস্থ করার মতো। বুঝলে। মিমিদি নাটকের সেই রিহারসেল দিতে গেছে। 

—মিমি নাটক করে? 

–বারে মিমিদি নাটক করে শুধু। মিটিং মিছিল করে। আমি ওদের অফিসে গেছি। পুরানো ভাঙা বাড়ি। দোতলায় ওদের পার্টির অফিস ঘর। মিমিদি পোস্টারে ছবি আঁকে কী সুন্দর। 

—তাই বলে মেয়েমানুষ নাটক করবে সে কেমন কথা। 

আমার এ-সব সময়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয়। আমারও পছন্দ নয়, পরী নাটক করে। ভিতরে কোথায় যেন একটা কূট মানুষ আছে আমার যে সব কিছু সংশয়ের চোখে দেখে। পরীর এত স্বাধীনতা আমার পছন্দ নয়। এই স্বাধীনতা না থাকলে কাগজে তাকে এ-ভাবে পেতামও না। যেন কাগজটা বের করা আমাদের চেয়ে পরীর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। তার মূল কারণ কি তাও বুঝি ভায়া দাদু টিউশনিতে আমার প্রতি মিলের ম্যানেজার ভূপাল চৌধুরী এবং তার বাবা অবহেলা দেখিয়েছে, আমাকে কাগজের সম্পাদক করে, এবং আমার কবিতা দেখিয়ে পরী তার যেন প্রতিশোধ নিতে চায়। 

মিলের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ভূপাল চৌধুরী একজোড়া কবিতাও পরীকে ধরিয়ে দিয়েছিল। শহরের খোদ চেয়ারম্যানের নাতনি কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন চাইতে গেলে না দিয়ে থাকে কি করে। এই সঙ্গে তিনিও যে কাব্যচর্চা করেন, তার নমুনা হিসাবে এক জোড়া কবিতা দিয়েছিলেন মিমির হাতে। বিজ্ঞাপনের অর্ডার ফর্মে সই হয়ে যাবার পর মিমি বলে এসেছে, কবিতা নির্বাচনের ভার সম্পাদকের। তিনিই বলতে পারবেন ছাপা হবে কি হবে না। 

দুটোই বাতিলের খাতায় পড়েছে। আমি যে কাগজের সম্পাদক, ম্যানেজার সাহেব এখনও জানেন কিনা জানি না। কবিতা দুটো ফেরত দেওয়া হয়ে গেছে। ফোনে বলেও দিতে পারে। বাবার কানে কি করে কথাটা উঠেছিল, পিলু বলতে পারে, মাও খবরটা জেনে খুব দুঃখ পেয়েছে। বাবা বলেছেন, ভূপালের দুই মেয়েকে তুমি পড়াওঁ। নরেশ চৌধুরীমশাই তোমাকে ভালবাসেন বলে, টিউশনিটা ঠিক করে দিয়েছেন। মাস গেলে সংসারে কুড়িটা টাকা আসে। তারই লেখা তুমি ছাপছো না, ভূপাল জানলে রাগ করতে পারে। 

খাওয়া হয়ে গেলে উঠে পড়লাম। মা দুটো ডালের বড়া বেশি দিয়ে বলেছে, এ-কটা ভাত খেলি। তোর খিদে পায় না। কিছুই তো খেলি না। 

আমি একটু কম খেলেও মা-বাবার মনে শংকা। বললাম, খেলাম তো। আর কত খাব 

—কি খেলি? শালগমের ডালনা দিই। আর দুটো ভাত খা। 

বাবা বললেন, তোমাদের বয়সে আমাদের কি রাক্ষুসে খিদে ছিল। তুমি তো দেখছি, কিছুই খেতে চাও না। তোমার মা কত যত্ন করে রান্না করে, তোমরা দুটো তৃপ্তি করে খাবে বলে। আর তাই যদি না খাও, তোমার মা’র কত কষ্ট বোঝ না। 

আসলে বাবা তো জানেন না, তাঁর বয়সকালে পরী বলে কোনো মেয়ে তাঁকে ধাওয়া করে নি। পরী নাটক করতে যাবে। রিহারসেল দিতে যায়। পরী কি খুব পুরুষ ঘেঁষা নারী? পুরুষ ছাড়া থাকতে পারে না? ‘জাগরণ’ নাটক হবে পার্টির তরফে। ভোট আসছে। ‘জাগরণ’ এবং ‘মহেশ’ নাটক মঞ্চস্থ করা হবে পার্টি থেকে। তবে নাটকে পরী থাকবে সে-কথা আমাকে বলে নি। কেন গোপনে করে গেল! 

.

এই নিয়েই আমার মাথায় একটা কেমন জ্বালা ধরে গেল। বিকেল বেলায় সাইকেলে চড়ে শহরে চলে গেলাম। একবার ইচ্ছে হয়েছিল পরীর কাছে যাই। কিন্তু আমার যা মেজাজ তাতে পরীর সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা হলে তিক্ততা বাড়বে। আমার কথা সে গ্রাহ্য করবে কেন। আমি তার কে! পরীর পুরুষ ঘেঁষা স্বভাব আমার মধ্যে যে আজকাল জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে বুঝতে পারলে সে আরও বেশি মজা পাবে। অগত্যা টাউন হলের মোড় থেকে ফিরে এলাম। লালদীঘির ধারে মুকুলের কাছে ঘুরে গেলে হয়। কাগজের প্রুফ আসতে পারে। একবার খবর নিলে হয়। তাছাড়া, মাথায় যখন জ্বালা ধরে যায়, তখন মুকুলের সঙ্গে বসে কথা বললে, মনটা হাল্কা হয়ে যায়। 

কারণ আমরা একই অসুখে ভুগছি। মুকুল চৈতালি পাগল। তবে সে এবারে ভেবেছে বি এ পড়ার সময় চৈতালির কাছ থেকে বাংলা অনার্সের নোট নেবার অজুহাতে আলাপ করবে। চৈতালি বাংলা অনার্স নিয়ে পড়বে, এটা শোনার পরই মুকুল ঠিক করে ফেলেছে সেও বাংলা অনার্স নিয়ে পড়বে। চৈতালি আমাদের কলেজে পড়ে না। মেয়েদের একটা কলেজ আছে ওটাতে পড়ে। আমাদের কলেজে পড়লেও একটা সুযোগ তৈরি করে নেওয়া যেত— আর চৈতালির জন্য মুকুল তো মেয়েদের কলেজে ভর্তি হতে পারে না। সে এত মরিয়া যে সুযোগ থাকলে বুঝি তাও করত। 

আসলে, চৈতালিদের বাড়ি থেকে টের পেয়েছে, ছোঁড়া দুটো এদিক দিয়ে যে সাইকেলে যায়— সে একটাই কারণ। ওর দিদিরা বোধহয় টের পেয়েই সাবধান করে দিয়েছে। ওকে আজকাল বাড়ির জানালায়ও দেখা যায় না। এমন কতদিন হয়েছে, রাশি রাশি রিকশা আরোহীর মধ্যে কখন যেন দূর থেকে মনে হয়েছে, ঐ ওখানে আছে। আমরা দ্রুত সেদিকে ছুটে গিয়ে দু-একবার হতাশও হয়েছি। আবার কখনও ধোবিখানার মাঠে বসে, চোখ আমাদের চৈতালিদের বাড়ির দিকে। কে বের হল। সে যদি আসে মুকুলের চোখ মুখ উন্মুখ হয়ে থাকে তখন। কখনও সত্যি দেবী দর্শন হয়ে যায়। দেবী দর্শন হয়ে গেলেই মুকুল যেন কি এক মুক্তির আনন্দে গান গেয়ে ওঠে। তবু আমরা বুঝি, একটা বড় রকমের অবহেলা আছে—ওর দিদিরা টের পায়, তখন একটা কিছু করতেই হয়। যেন দেখিয়ে দেওয়া, তুই গাইয়ে, আমরা কবি, লেখক। তোমার চেয়ে কোনো অংশে কম না। 

সাইকেল থেকে নেমে পড়ি। মুকুল দরজা খুলে প্রাণখোলা হাসিটি নিয়ে দাঁড়িয়ে। জানালা থেকেই দেখা যায়। সাইকেলটা বারান্দায় তুলে ফেললে, মুকুল বলল, আরও একটা বিজ্ঞাপন এসেছে। মিমি লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। 

তক্তপোষে বসে বললাম, কেন মিমি দিয়ে যেতে পারল না। 

প্রশান্তও উঠে পড়েছে। সে ও-কথায় গেল না। বলল, দেখ ডামিটা। প্রথমে সম্পাদকীয়। তুমি তো লিখলে না। আমাকে লিখতে হল। শোন, সুধীনবাবুরা যদি বলে কে লিখেছে, তুমি কিন্তু বলবে, তুমি লিখেছ। 

—আমি লিখি নি, অথচ বলতে হবে আমি লিখেছি। 

—বললে ক্ষতি কি! পরীরও ইচ্ছে তাই। 

–পরী কি আমার গার্জিয়ান। তোমরা সব কথায় পরীর দোহাই দাও কেন বুঝি না। 

—পরী যে বলল, আমার কথা বললে ও ফেলতে পারবে না। 

এত অধিকার জন্মায় কী করে! পরীর কি ধারণা বাড়িতে তার জেদের কাছে সবাই হার মেনেছে বলে আমিও হার মানব। তা না হলে, পরী যে বাড়ির মেয়ে তাকে তো রাস্তাতেই দেখার কথা না। তবে পরীদের বংশে রাজনীতির রক্ত সবার গায়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামে পরীর দাদু থেকে বাবা কাকারা অনেকেই জেল খেটেছে। পরী অন্য ধাতের হয়ে গেল। সে কংগ্রেসকে বুর্জোয়াদের পার্টি মনে করে। এত বড় গরীব দেশে, পরীর ধারণা, দাদু বাবা কাকারা রাজনীতি করেছেন নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য। বাড়িতে নাকি সবার মুখের উপরই আজকাল তর্ক করে। 

আমি বললাম, সম্পাদকীয় খুব জম্পেশ করে লিখেছ। ওটার কৃতিত্ব আমার নাই থাকল।

—তুমি সম্পাদক, এটা কিন্তু ঠিক হবে না। 

—আরে আমি নাম কা ওয়াস্তে। 

—তোমার কবিতা প্রথমে থাকছে। মুকুল প্রুফ তুলে বলল, কবিতার ফর্মাটা চোখ বুলিয়ে নাও। সুধীনবাবু প্রবন্ধ দেখছে। ‘সাহিত্যের প্রতিশ্রুতি’-পর্ব দারুণ লেখা। এটা পরের সংখ্যায় দেব। বলে আর একটা প্রবন্ধ টেনে বের করে দেখাল। ওপরে নাম লেখা, ‘হালফিলের গদ্য কবিতা’। নামটা বেশ, না! 

তারপরই মুকুল, র‍্যাক থেকে আর একটা লেখার বান্ডিল বরে করে বলল, এটা দিতে চাই। দেখলাম, শহরের গত তিনমাসের অনুষ্ঠান সূচী। কে কে গান গেয়েছে, কবিতা আবৃত্তি করেছে, নাটক হয়েছে কোথায়—তার সমালোচনা সহ বিবরণ। 

আমি বললাম, নিখিল নিরঞ্জন সুধীনবাবু দেখেছে? 

—ওদের বলি নি। 

—সবাইকে বলে নেওয়া ভাল। 

কারণ আমি চাই না, এটা করতে গিয়ে চৈতালির প্রশংসা কাগজের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠুক। এতে সুধীনবাবুরা চৈতালি সম্পর্কে মুকুলের যে দুর্বলতা আছে টের পেতে পারে। ভালবাসলে বোধ হয় মানুষ কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মুকুল প্রথমে কাগজটারই তো নাম চৈতালি দিতে চেয়েছিল। এখনও মুকুলের মাথায় শুধু একটা বিষয়ই বেশি নড়ানড়ি করে। এত বড় কর্মযজ্ঞের মধ্যে চৈতালি থাকবে না কী করে হয়। সে এটা মানতে পারছে না। এ জন্য প্রায় এক ফর্মা জুড়ে শহরের তিনমাসের অনুষ্ঠান সূচী এবং তার আলোচনা রেখেছে। আমি রাজী হলে, অন্যরা আপত্তি করবে না মুকুল জানে। আমার রাজী হওয়া মানেই পরীকে আমাদের দিকে পাওয়া। মুকুল আমার দিকে এমন প্রত্যাশার চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে যে আর না বলতে পারলাম না। বললাম ঠিক আছে থাকবে। 

মুকুল উজ্জ্বল প্রাণবন্ত যুবক—সে মুখ গোমড়া করে রাখতে জানে না। দু হাতে জড়িয়ে ধরল আমাকে। 

বললাম, চৈতালি কিছু মনে করবে না তো। 

—কেন করবে। ওর তো প্রশংসাই আছে। প্রশংসা কে না চায়। তা ছাড়া কি জান, যারা শহরের সাহিত্য শিল্প নাটক নিয়ে আছে তারা সবাই কাগজটা কিনতে রাজী হবে। আর একটা বড় আকর্ষণ, এই শহরে কে কে আগে গল্প কবিতা লিখে নাম করেছেন, তাদেরও একটা পরিচয় লিপি থাকবে। ভাল হবে না! 

আমি বললাম, দারুণ। কাগজ আমাদের হট-কেকের মতো বিক্রি হয়ে যাবে। 

কাগজ বিক্রি নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলেই, মুকুলের হাঁক, বৌদি চা। বিলু এসেছে। 

ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল, এখন হবে না। করে খাওগে। 

— বৌদি বিলু কি বলছে শোনো! 

—কী বলবে জানি। বৌদি দেখতে পারে না। বৌদি খারাপ। 

—না বৌদি এমন আমি কখনও ভাবি না। 

ভেতর থেকেই কথা ভেসে আসছে। 

—না ভাবে না। সেদিন এত করে বললাম দুপুরে আর নাই গেলে। এখানেই দুটো খেয়ে বসে যাও, না মা ভাববে! আমাদের আর বাবা-মা ছিল না। 

আমি হেসে ফেললাম। 

—না হাসার কথা নয়। খুব খারাপ বলেছি! আমরা তো তোমার কেউ না। কেন মাসিমাকে বলে আসতে পার না, দুপুরে ফিরতে পারবে না। রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হয়েছে বৌদির বাড়িতে— ফেরা মুশকিল। 

সত্যি রাজসূয় যজ্ঞ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সুধীনবাবুরা এসে যাবে। পত্রিকার লেখা পাঠ করা হবে। মতামত দেওয়া হবে। পত্রিকার দ্বিতীয় ইসু থেকে ঠিক হয়েছে, সবাই মিলে মিশে পড়া হবে। তারপর বিতর্ক, তারপর লেখা ছাপা যেতে পারে, রায়, আর তারপর শেষ কথা বলার আমি। পরী তখনই নাকি বলে দিয়েছে। পরী বলে দিতেই পারে। প্রথম সংখ্যার সব লেখা আমাকে দেখতে পাঠালে বলে পাঠিয়েছিলাম—অত আমার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। একটা প্রাথমিক নির্বাচন থাকা দরকার। যে- ভাবে গাদা গাদা লেখা আসছে—পাগল হয়ে যাবার যোগাড়। 

.

আমরা ত্রৈমাসিক কাগজ বের করছি। এটা শহরে এত প্রচার হলো কী ভাবে বুঝি না। এমনিতে গল্প কবিতা যারা লেখে তারা যে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে ধরেই নেওয়া হয়। চৈতালিদের বাড়ি থেকেও আমাদের প্রতি ভাল ধারণা নেই। আমরা নষ্ট চরিত্রের এমনও ধারণা হয়েছে। পরীকে সবাই এমনিতেই নষ্ট চরিত্রের ভেবে থাকে। অন্ততঃ চৈতালির দিদিরা তো বটেই। এত সব জানার পরও আমাদের কেন জানি মনে হয় আমরা অন্য সবার থেকে আলাদা। রাস্তায় দল বেঁধে বের হলে আজকাল কেউ কেউ লক্ষ্যও করে দেখছি। আমরা এমন গাম্ভীর্য নিয়ে থাকি যে দেখলে মনে হবে, আমাদের মতো চিন্তাশীল লোক হয় না। আসলে, মেয়েরা দল বেঁধে যখন যায় তখন সেটা একটু বেশি বেশি। ছোট শহর বলে, কে কোন বাড়ির কার ভাই, কোন পাড়ায় থাকে ভিতরে ভিতরে সব মহলেই মোটামুটি খবর জানা থাকে। আমরা যেমন সুন্দরী মেয়েদের খবর রাখি, তারাও আমাদের অনেকের খবর রাখে। কেবল চৈতালি এবং তার দিদিরা আমাদের দেখলে প্রসন্ন হয় না। চৈতালি এমন ভাবে পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, যেন সে আমাদের চেনেই না। চৈতালির দিদিরা বৌদির ক্লাশফ্রেন্ড বলে—দিদিরা বেড়াতে আসত—কিন্তু চৈতালির নামে কাগজ বের হচ্ছে শুনেই ওরা সেই যে খাপ্পা হয়ে গেল, তা আর মিটল না। এখন চৈতালির দিদিরা আসে না। 

মাঝে মাঝে মুকুল একা থাকলে আমাকে ভারি করুণ গলায় বলে, কী করি বলত। 

আমি সান্ত্বনা দিই, কাগজটা বের করি আগে তখন দেখবে চৈতালি নিজের গরজেই হাজির হবে। 

—না না। যা অহংকারী, কখনও আসবে না। 

আমি বলি, আসবে। 

মুকুলের এক কথা, আসবে না। 

—আলবাৎ আসবে। 

—কি করে? 

—প্রথম সংখ্যায় প্রশংসা। 

—বেশ। 

—দ্বিতীয় সংখ্যায় গানের সমঝদার দিয়ে আলোচনা। 

—বেশ। 

—তৃতীয় সংখ্যায় ছবি। 

—বেশ। 

—চতুর্থ সংখ্যায় হাজির। 

মুকুল ছেলেমানুষের মতো বলে ফেলল, দেখ একদিন সুচিত্রা মিত্রের মতো বড় গাইয়ে হবে। কী সুন্দর গলার কাজ। আমরা ওর এত ভক্ত আর আমাদের ও এমন অবহেলা করে। 

আমি বললাম, অবহেলা আমাদের প্রাপ্য। 

—কেন বলত। 

—আসলে আমরা ভালবাসার কাণ্ডাল। মেয়েরা খুব সেয়ানা হয় বুঝলে। ওরা দেখলেই বুঝতে পারে।—কি বলে তখন জান? 

—কী বলে। 

—দেখছিস কেমন হ্যাংলার মতো দেখছে। 

—ওরা বুঝি দেখে না। 

—কই কাছে এলে তো মনে হয় ওরা রাস্তার নুড়ি পাথর দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে। 

—দেখতে দেখতে না, শুঁকতে শুঁকতে। 

—ওই হল আর কি। 

মুকুল যেতে যেতেই তখন কত কথা বলে যায়। সে মেয়েদের মনস্তত্ত্বও ব্যাখ্যা করতে ভালবাসে।

—জান বিলু, মেয়েরা অনেক দূর থেকে আগেই দেখে নেয়। 

—কী করে বুঝলে। 

—ওদের চোখের পাওয়ার বেশি। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় মনে হবে, ওরা এতে নেই। কিছুই বোঝে না যেন। জান সবটাই কিন্তু ছলনা। আমি তো মেয়েরা পাশ দিয়ে গেলে ওদের ঘ্রাণ পর্যন্ত নিতে ভালবাসি। আহা, এক নারী তোমার পাশে শুয়ে রয়েছে। সে তোমার। তার সব কিছু তোমার। ভাবতে ভাল লাগে না। 

আমি মুকুলের এমন কথায় কি বলব বুঝতে পারি না। পরীকে নিয়ে যে এভাবে ভাবি না, তা নয়। মন তখন ভারি উতলা হয়ে ওঠে। কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে যাই। যেন পরী, আমার সব অস্তিত্ব হরণ করে নিয়ে গেছে। আর ঠিক এ-সময়ই ও বলল, পরীকে বোঝা যায় না। 

—কেন! 

–ক’দিন দেখা নেই। একেবারে ডুব। ভাবলাম, আমাদের কাগজ সম্পর্কে ওর কোনো ভাবনা নেই। সকালে দিলীপদার কাছে গিয়ে শুনি, পরী কাগজ কে দেবে, কভার কোন কাগজে ছাপা হবে, সব দিলীপকে বলে এসেছে। প্রুফ উঠে গেলেই, দিলীপ একসঙ্গে ছেপে দেবে। ছ’ ফর্মার তো কাগজ শুধু দুটো আরও বিজ্ঞাপনের জন্য কভার ছাপার অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে না। 

—কভার কেমন হল দেখেছ? 

—পরী বলেছে, ও কভার করবে। 

—ও করবে কেন! 

—করুক না। পরী তো সুন্দর ছবি আঁকে। এত করছে, এই সুযোগটা তাকে না হয় দিলেই।

—আমি রাজি না। 

—তার মানে। 

—না। পরী কী ছবি আঁকবে আমি জানি। পরীর জীবনযাপনের সঙ্গে ছবির কোনো মিল থাকবে না। পোস্টার মার্কা ছবি করবে। সে তার দলের হয়ে এই কাগজে ছবি আঁকলে, সে ছবি যাবে না। 

মুকুল আমাকে জানে। পরীর অনেক কিছুই আমার পছন্দ নয়। সে খবরটা পরদিন দিয়েও এল। পরী জবাবে বলেছে, ওকে বল, আমি কভার এঁকে ফেলেছি। পরে না হয় ওর পছন্দমতো কভার হবে। 

মুকুল আমার বাড়ি এসে খবরটা দিলে আমি গুম হয়ে থাকলাম। 

মুকুল কেমন ক্ষেপেই গেল—আচ্ছা বিলু, যে সব করছে, এমন কি কাগজের দাম, ছাপার খরচ সব দিচ্ছে, কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে সে টাকাটা নেবে বলেছে—তার একটা কভার যাবে এতেও তোমার আপত্তি। 

.

সেদিন আমি তক্তপোষে শুয়ে আছি। মুকুল আমার পাশে। কথা বলছি না দেখে বলল, এত কি ভাবছ। 

সহসা আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। উঠে বসলাম। বললাম, ও কী ছবি আঁকবে তুমি জান না। আমি জানি। 

—কী ছবি আঁকবে। 

ঐ কোনো চাষীর উদ্যত হাত। কিংবা শ্রমিকের। 

—বেশ ভাল তো। ক্ষতি কী। 

—এটা সাহিত্যের কাগজ, রাজনীতির নয়। পরী কিন্তু আমাদের সেদিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আমি চাই না অমন ছবি থাকুক। পরীর জীবনের সঙ্গে একজন শ্রমিকের কী সম্পর্ক বল। কোনো সম্পর্কই নেই। বই পড়ে সব জেনে ফেলেছে ভাব। বই পড়ে সব জানা যায় না। পরীর এ-সব আমার ছলনা মনে হয়। 

—আমার মনে হয় না ও রকম ছবি আঁকবে। 

—আঁকলেই বা ঠেকায় কে! ওর তো মন্ত্রগুপ্তি পাঠ করা আছে। সেখান থেকে বের করে আনা সহজ হবে না। সুহাসদা ওর মাথাটি খেয়েছে। 

মুকুল বোঝে আমার কষ্টটা কেন এত গভীর। ঘরের ভিতর বসে থাকলে সেটা আরও ভারি হয়ে ওঠে। পিলু এসে বলল, মুকুলদা বাবা তোমাকে ডেকেছেন। 

মুকুল বলল, যাচ্ছি। বলেই উঠে গেল। বাবা বারান্দায় বসে। মা চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ঘরটা উঠোনের শেষ প্রান্তে। বারান্দার কোনো কথাবার্তাই কানে আসবে না। হঠাৎ মুকুলকে ডেকে বাবা কী জানতে চান। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই মুকুল ফিরে এল। বাবা মুকুলকে ডেকেছিলেন কেন, এ-সম্পর্কে আমার যেন কোনো কৌতূহলই নেই। আমি শুধু বললাম, জামাইবাবু ট্যুর থেকে ফিরেছে? 

মুকুল জানে আমি তাকে কেন এমন প্রশ্ন করছি। সে বসে কি দেখল আমার চোখে মুখে। তারপর বলল, ওটা তোমার হয়ে যাবে। সার্কুলার এলেই হবে। তুমি একটা দরখাস্ত ছোড়দির হাতে দিয়ে আসতে পার। আমাকেও দিতে পার। টাইপ করে দিলে ভাল হয়। রিফিউজি কথাটার কিন্তু উল্লেখ করবে। 

–কেন রিফিউজি না হলে হবে না! 

—হবে না কেন! হবে। তবে রিফিউজি হলে জামাইবাবু সহজেই ডি আইকে দিয়ে এপ্রুভ করিয়ে নিতে পারবে। রিফিউজিদের জন্য আলাদা কোটা আছে। 

টাইপ করে দেবার কথা বলছে। কোথায় করাব জানি না। হাতে লিখে দিলে অসুবিধা হবে কিনা জানতে চাইলে, মুকুল বলল, ঠিক আছে ও নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমি জামাইবাবুকে দিয়ে ড্রাফট করিয়ে নেব। টাইপ করে রাখব। সইটা করে দিও। তুমি নাকি সেদিন ভাকুরির কাছে কোন গাছতলায় শুয়েছিলে? 

—বাবা বুঝি বললেন। 

মুকুল বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসল। পাজামা সামান্য তুলে পায়ে কি দেখতে দেখতে বলল, জান আমার পায়ের চামড়া কি খসখসে। দেখ হাত দিয়ে! শীত আসার আগেই গোড়ালি ফাটতে শুরু করে। তোমার পা দুটো কী সুন্দর! 

মুকুল এ-রকমেরই। হাত পা এবং চোখ মুখ সব মিলে মুকুলের মধ্যে একটা শান্তশ্রী আছে। উঁচু লম্বা। কালো রঙটা যেন এই চোহারার সঙ্গে ভারি খাপ খেয়ে গেছে। তার এক কথা, ভগবানই যাকে মেরে রেখেছেন, তার আর কিছু হবার নয় বিলু। চৈতালিকে আমার পাশে মানাবে কেন। ঘুরে ফিরে কী করে যে আমরা হয় চৈতালি না হয় পরীতে চলে আসি। 

আমি উঠে বসলাম। মায়া দুধ রেখে গেছে দু-গ্লাস। মুকুলকে মা বাড়ির ছেলের মতোই ভেবে থাকে। মা বুঝতে পারে, মুকুল তার পুত্রের একজন প্রকৃত হিতৈষী। বাবাও এমন বোধহয় ভাবতে শুরু করেছেন। কত অসহায় হলে বাবা তার পুত্রের মতিগতি নিয়ে মুকুলের শরণাপন্ন হতে পারেন এই প্রথম আমি যেন টের পেলাম। বাবার জন্য কষ্টবোধ থেকেই যেন বলা, বাবা আর কিছু বললেন? 

—বলেছেন। 

–কী!

—ও-সব তোমাকে বলা যাবে না। 

—ও-রকম বাবা বলতেই পারেন না। পুত্রের কোনো অগৌরবের কথাই বাবা কাউকে আজ পর্যন্ত বলেন নি। বলতে চান না। তুমি জান বাবাকে। বাবার এখন একটা চিন্তা, পরীক্ষায় আমি ফেল টেল করলে আবার না বাড়ি থেকে উধাও হই। দু-বছর আগের বিলু দু-বছরের পরের বিলুতে কত তফাৎ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তখন জীবনে পরী ছিল না। লক্ষ্মী ছিল না। পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করেছি বলতে গিয়ে চোখে জল এসে গেছিল। বাবা কত সহজে বলেছিলেন, জীবনে দশটা বিষয়ের মধ্যে নটাতে পাশ করেছ—সোজা কথা! জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাশ করে। সব দুঃখ এক পলকে মুছে গেছিল। কিন্তু এখন, পরীক্ষায় ফেল করলে, গুম মেরে থাকব। বাবা কোনো সান্ত্বনার কথা বললে হয়তো রেগে যাব। দু-বছর আগে যে বিশ্বাস নিয়ে বাবার সব কিছু মাথা পেতে নিয়েছি, এখন আর তা নিতে পারব না। বুঝতে পারছি, কেউ আমার শেকড় আলগা করে দেবার চেষ্টা করছে। 

দুধের গ্লাসটা ওকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, খাও। বাড়িতে গরু আছে, দুধটা এখনও পাবে। বাবা পরীকেও তাঁর গরুর দুধ খাইয়েছেন। বাবা আমার অদ্ভুত মানুষ। তুমি চলে গেলেই বলবেন, মুকুল কিছু বলল, মানে দুধটা যে শহরের জল মেশান দুধ নয় খাঁটি দুধ, তাই তিনি জানতে চান। কিন্তু আজ এমন কি বললেন, যা বলতে পারছ না। 

অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে বকছি দেখে মুকুল উঠে দাঁড়াল। বলল, চল বের হই। বলে চুমুক মেরে দুধটা শেষ করে সাইকেলে ওঠার আগে বাবাকে বলল, দারুণ খেতে। আমাদের দুধ—সে আর বলবেন না। খাঁটি দুধের স্বাদই ভুলে গেছি। এতে বাবা ভারি আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। মুকুল বলায় আমি ক্ষুব্ধ হই নি। কিন্তু পরী বললে, আমার রাগ হত। মনে হত সব তাতেই পরীর ছলনা। বাবাকে ভালমানুষ পেয়ে খুব চাল মেরে গেল। 

বের হবার সময় বললাম, ফিরতে রাত হবে। ভেব না। টিউশনি সেরে ফিরব। 

আমি আর মুকুল আর সেই চিরপরিচিত বাদশাহী সড়ক। আমরা দু’জনই এখন বড় হবার স্বপ্ন দেখছি। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু সেটা কি, দু’জনেই ভাল জানি না। আমার তো যা অবস্থা, তাতে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হওয়া ছাড়া অন্য কি আর অবলম্বন থাকতে পারে। বাদশাহী সড়কে উঠে দু’জনে পাশাপাশি যাচ্ছি। বাবা মুকুলকে ডেকে কী বললেন, জানার কৌতূহল আছে, অথচ আমি নিজে আর কথাটা যেচে জানতে চাই না এমন এক ভাব দেখাচ্ছি। অন্য প্রসঙ্গ এসে গেল। পরীক্ষার রেজাল্ট কি হবে, ফেল করলেও যা এখন, পাশ করলেও তাই। কারণ প্রাথমিক স্কুলের চাকরির জন্য যে পড়াশুনা থাকা দরকার সেটা আমার আছে। কাজেই কাজটা হয়ে গেলে এমনিতেই কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং এ-কারণেই পরীর সঙ্গে আর আমার কোনো সংযোগ থাকবে না। কষ্টটা যত বড়, তার চেয়েও বড় বাবাকে নিদারুণ অভাব থেকে রক্ষা করা। মা’র সঙ্গে বাবার আজকাল একদম বনাবনি হচ্ছে না। যেন দু’জনেই ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আর্থিক অনটন এর মূলে বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। 

মুকুল এক সময় গলা ছেড়ে গান ধরেছিল। মুকুল ভারি সুন্দর গায়। গানের চর্চা করলে সেও চৈতালির চেয়ে কম নাম করতে পারত না এমন আমার মনে হয়। আসলে লেগে থাকা, সেটাই আমাদের মধ্যে নেই। কবিতা লিখি, মুকুল কিংবা সুধীনবাবুরা শোনে। আমি জানি কিচ্ছু হয় না, অথচ সবাই অসাধারণ বলে এক সঙ্গে হল্লা করতে থাকে। বুঝি না, এটা আমাকে খুশি করবার জন্য, না পরীকে। পরী আমার কবিতার অনুরাগী। পরী অখুশি হলে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমটাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কাগজ নিয়ে পরীর উৎসাহ কমে গেলে ওটা বের করা আমাদের পক্ষে কত শক্ত কাজ বুঝি। তখনই যেন আরও ক্ষোভ বাড়ে। 

আমরা ভাকুরি পার হয়ে সারগাছির দিকে যাচ্ছি। হু হু করে হাওয়া বইছে। চার পাঁচ দিন বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় পুকুর নালা ডোবা জলে ভর্তি। কোথাও জমিতে জল জমে আছে। সেখানে চাষ-আবাদের কাজ চলছে। প্রকৃতি সবুজ সমারোহ নিয়ে যেন এখন আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা চারপাশের গাছপালা মাঠ দেখতে দেখতে কোথায় যেন উধাও হয়ে যেতে চাইছি। 

সামনে কালভার্ট একটা। মুকুল বলল, এস বসি। পাশে চায়ের দোকান। সে সাইকেলটা কালভার্টে দাঁড় করিয়ে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে এল। এসেই বলল মেসোমশাই খুব ঘাবড়ে গেছেন। 

আমি বললাম কেন? 

—তুমি নাকি গাছতলায় শুয়েছিলে। পিলু তোমাকে খুঁজে এনেছে। 

—বললেন! 

—হ্যাঁ। বললেন, এখন কি করি বলতো মুকুল! তুমি কিছু জান?

—তুমি কি বললে? 

—কি বলব! আমি বললাম, ও কিছু না। আপনি ভাববেন না। 

—কিছু না। কী করে বুঝলে? 

—ওটা এ-বয়সে হয়। আমারও হয়। তবে কী জান, আমার মা বাবা কেউ বেঁচে নেই। থাকলে টের পেতেন। বৌদি বোঝে। বুঝে মজা পায়। বৌদির এক কথা। বি এ পাশ করলেই কাজে ঢুকিয়ে দেবে দাদা। তারপর কাঁধে জোয়াল তুলে দেবে। সব রোগ নাকি তখন আমার সেরে যাবে। কবিতা কবিতা সব মাথায়। কাগজ নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞ বন্ধ। বৌদি ঠাট্টা করে বলেন, তখন একটাই হোম। তাতে দু-পাশে দু-জন। মাঝে হোমের কাঠ প্রজ্বলিত। আমাদের মধ্যে তখন একটাই কথা—ওম অগ্নয়ে স্বাহা—হে অগ্নি তুমি সব গ্রহণ কর। তিনি হলেন অগ্নি, সর্বভুক—ঘি হবি যা ঢালবে সবই তিনি হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করবেন এবং হজম করে ফেলবেন। বলেই মুকুল একটু বেশি সাধু ভাষায় কথা বলে হা হা করে হেসে উঠল। বৌদিটা বড্ড ফাজিল। আমার মুখ চোখ দেখে এখন বৌদি আরও মজা পায়। 

—তুমি কি বল বৌদিকে। 

—বলি ও-সব বিয়ে-ফিয়েতে আমি নেই। কবিতা-আহা — সুচারু সব সপ্নের সাধ / কখন কী যে বনভূমি হয়ে যায় / আমার তোমার মাঝখানে এক সুবিশাল প্রাচীর / গন্ধরাজ লেবুর ঘ্রাণের মতো আমার বাসনা / ক্রমে বিস্তারিত মাঠ পার হয়ে সাদা জ্যোৎস্নায় দেখি / তুমি আছ নগ্ন হয়ে নতজানু আমি। 

—বা সুন্দর তো! তোমার মুখে শুনলে মনেই হয় না আমার লেখা। 

মুকুল চা খেতে খেতে হাসছে। বলল, জান, চৈতালীকে দেখলে আমি কেন জানি তোমার এই কবিতাটাই আওড়াই। 

—দারুণ মানিয়ে গেছে। 

মুকুল বলল, একটা কবিতা লিখতে পারলে মনে হয় না—সবই বড় অকিঞ্চন, আশা কুহকিনী, সব শেষে দু-লাইন কবিতার আর্শিতে পৃথিবী অতীব মায়াবী, মনে হয় না তোমার! আমার কি মনে হয় কি বলব। চুপ করে গেলাম। 

হেসে বলল, তখন চৈতালিকে আমার জান ভিখারিণী মনে হয়। আমি সম্রাটের মতো সেই ভিখারিণীর পাশে দাঁড়িয়ে বলছি, ওঠো জাগো, হাত ধর। চল কোনো সাদা জ্যোৎস্নায় আলস্যের নদী অথবা সাগরে ডুব দিতে যাই। 

আমি চা শেষ করে বললাম, এটাকে আলস্যের সাগর বলছ কেন? কী মিন করতে চাইছ। 

—না মানে… 

মুকুলের আবার সেই গলা ছেড়ে হাসি। কী এক রহস্য গোপন করে রেখেছ নারী / আমার গভীর ঘুম পাতলা হয়ে আসে / নক্ষত্রের মতো বিন্দু বিন্দু ক্যাশার জল টলটল করে রক্তে / এবং এই আমি তুমি গভীর সহবাসে লিপ্ত / যদি কোনো দিন কোন জন্মের ইশারা / কেউ হেঁকে যায় / আছ নাকি বেঁচে স্বপ্নের ভিতর। 

আমি বললাম, শুধু তিক্ততা তার রক্তে / বিলাস তার স্বপ্ন, আধো ঘুমে আধো জাগরণে / কবিতা পাঠ করে কোনো এক নারী — যার দু-হাতে বিশাল থাবা / মরণ কামড়ে আমায় ছিন্নভিন্ন করে দিতে ভালবাসে / তার বিলাস প্রেমে, বিলাস আগমনে / বিলাস শুধু নিঃসঙ্গ কোনো যুবকের চুম্বনে / তার হাড় মাসে মজ্জায় রক্ত তুফান / আমি ছিন্নভিন্ন ছেঁড়া পালে গলিত এক শব / পড়ে থাকি নদীর চড়ায় / 

—দারুণ, দারুণ। 

আমি বললাম, বয়েস আমার যন্ত্রণা / বয়েস আমার উধাও করা মাঠ / চাষ-আবাদ শেষে চাষীর প্রত্যাগমন হয় / বাড়ি ফেরে / জলে জলে নেয়ে তার হৃদয় শেষ বেলায় হতাশায় ডুবে থাকে / তাকে আমি চিনি সেও আমায় চেনে / হেসে বলে কেমন আছ / বলি, ভাল নেই / জীবনের শুভাশুভ সব খড়ের মাঠ— খরায় জলে / চিতার আগুনে পুড়ে সে শেষ হয়ে গেছে / তাকে আর জাগাতে যেও না—নাভিমূলে তোমার সোনালী রেশম / উষ্ণতায় ডুবে আছে জেনেও সে শুয়ে থাকে চিতার আগুনে। 

মুকুল সহসা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। ভালমন্দ কিছু বলল না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে ভাকুরির মাঠে। গাছপালার ছায়া দীর্ঘ হয়। আমরা দুই সাইকেল আরোহী বাড়ি ফিরি। আমরা কেউ আর কিছু বলছি না। উভয়ে কেমন ফেরারী আসামীর মতো নিজেদের গোপন করে রাখছি। 

মুকুল এক সময় বলল, মেসোমশাই খুব ঘাবড়ে গেছেন বিলু। পরীকে নিয়ে তাঁর ভাবনা দেখা দিয়েছে। বললেন …। বলেই চুপ করে গেল। 

—কি বললেন? 

—না, মানে তুমি পরীকে নিয়ে কোনো ফ্যাসাদে পড়ে গেছ তিনি ঠিক টের পেয়ে গেছেন।

—বাবা কি পরীর কথা কিছু বললেন? 

–না। 

—তবে? 

—দ্বিধা দেখা দিয়েছে। 

—কিসের দ্বিধা? 

—পরীকে নিয়ে তুমি খুব যন্ত্রার মধ্যে অ’ছ। 

—মোটেই না। 

–পরী বাড়ি গেলে তবে রাগ কর কেন। আমরাও তো যাই। তুমি তো রাগ কর না!

-–আমি রাগ করতে যাব কেন! 

—কিন্তু পরী পালিয়ে যায় জান? 

–দু-একবার গেছে। 

—এখনও যায়। -কবে গেছিল? 

—কালও গেছে। 

—কখন? 

—তুমি কখন বাড়ি থাক না পরী ঠিক জানে। সকাল বেলায় টিউশনিতে যাও পরী সব খবর রাখে।

আমি সকাল বেলাতেই মিলে পড়াতে যাই। আজ সকালে যাওয়া হয় নি। সন্ধ্যায় যাব। কিন্তু পরী আসে, অথচ কোনো খবরই পাই না। পিলু পর্যন্ত বলে না। পরী কি বাড়িতে আমার চেয়েও বেশি তাদের নিজের হয়ে গেছে। পরীর জেদের কাছে এ-ভাবে পরাজিত হতে আমি রাজী না। আমার ভেতরটা সবার উপর কেমন ক্ষোভে হতাশায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মায়া মা, বাবা পিলুকে পরী হাত করে ফেলেছে। ভাবতেই কেন জানি মনে হল, পরীর ছলনা ভাঙতেই হবে। পরীকে আবার অপমান করতে হবে। কিন্তু মুশকিল, অপমানে পরীর চোখ যেমন জলে ভার হয়ে ওঠে, শুকিয়ে যেতেও তা সময় লাগে না। না হলে, গোপনে সে কিছুতেই আমার অবর্তমানে আমাদের বাড়ি ফের যেতে সাহস পেত না। আজই গিয়ে তুলতে হবে কথাটা। কেন আসে? আমার যা কিছু অপছন্দ তাই করে বেড়ায় পরী। আমরা গরীব বলে সে ভেবেছেটা কী! 

কিন্তু মুকুল তখন বলছে, এই নিয়ে তুমি মেসোমশাইকে কিন্তু কিছু বলবে না। কথা দাও।

আমরা পঞ্চাননতলার কালীমন্দিরের কাছে এসে গেছি। এখান থেকে মুকুল রেল-লাইন পার হয়ে শহরে চলে যাবে। আমি যাব কলোনিতে। বেড়াতে বের হলে আমাদের এই জায়গাটাতে থামতে হয়। সাইকেল থেকে নেমে মন্দিরের চাতালে বসে কোনোদিন গল্প করতে করতে রাত হয়ে যায়। জায়গাটা বড় নির্জন। কোনো দোকান পাট নেই। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অফিস রাস্তা পার হলে জঙ্গলের মধ্যে। পুরানো আমলের বাড়ি। কোনোকালে, রাজরাজড়ার প্রাসাদ ছিল। সরকার থেকে ইজারা নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অফিস। সন্ধ্যা হলেই পরিত্যক্ত বাসভূমির মতো লাগে। শহর থেকে সাইকেলে কেউ ফিরে যায় রাস্তা ধরে। সাইকেল, রিকশা এবং গরুর গাড়ির শব্দ পাওয়া যায়। আর দু-পাশে গভীর জঙ্গল আর বিশাল সব আমবাগান। রাত হলে জোনাকি জ্বলে। দূরে দেখতে পাই লণ্ঠনের আলো। বাড়িটার দারোয়ানের কুঁড়েঘরে তখন একমাত্র আলো জ্বলে। মুকুলের বোধ হয় এখানটায় আরও কিছু সময় কাটিয়ে যাবার ইচ্ছা। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বস। 

আমার টিউশনি আছে। মনটাও ভাল নেই। পরীর জেদের কাছে বার বার হেরে যেতে আমি আর রাজী না। বললাম, আজ আর বসব না। চলি। 

—মেসোমশাইকে কিছু কিন্তু বলবে না। 

—ঠিক আছে বলব না। 

—মেসোমশাইর অগাধ বিশ্বাস আমার উপর। 

—জানি। 

—বললে খুব দুঃখ পাবেন। 

—বললাম তো কিছু বলব না। 

—জান সেদিন পরী গঙ্গার ধারে কী সুন্দর গাইল! 

আমি জানি ভোট আসছে বলে এখন শহরে গাঁয়ে গঞ্জে শুধু প্রচার চলছে। পরীর পার্টি এখানে সেখানে জনসভা করছে। পরী সে-সব সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়। যেন এক একটা কথা আগুনের ফুলকি হয়ে ওড়ে। তারপরই আমি কেন যে অবাক হয়ে যাই—শুনি পরী এস ডি ও সাহেবের জিপে কোথায় গেছে। হাওয়া খেতে বের হয়। একবার সাহেবটি নিজের বাড়িতেই কবিতার আসর বসিয়েছিল। সঙ্গে রকমারি খাবারের ব্যবস্থা। সাহেবটির চেয়ে পরীরই যেন বাংলো বাড়িটাতে বেশি আধিপত্য। সে সেদিন, আমার কবিতা পর পর আবৃত্তি করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি সবার চেয়ে আলাদা তার কাছে। একপাশে আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম। পরীর দিকে ভাল করে তাকাতেও পারি নি সেদিন। 

আমি বললাম, কি গাইল! 

—কোরাস। 

পরী গান গায় জানতাম না। বললাম, কোরাস মানে? 

—পরীর সঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে গাইল। মাইকের সামনে পরী। পাশে সব পার্টির ছেলেরা। নদীর বিশাল চরে মঞ্চ। মানুষজনে ভর্তি। পরী অবলীলায় সংগ্রামী গান গেয়ে গেল। হাত তুলে যখন ওর সেই সুন্দর গান মাইকে ভেসে আসছিল, তখন আমার যে কি গর্ব। পরী আমাদের। আমাদের পরী গাইছে—মাউন্টব্যাটেন সাহেবও, তুমি সাধের ব্যাটন কারে দিয়া যাও। জহর কান্দে, প্যাটেল কান্দে, কান্দে মৌলানায় মাউন্টব্যাটেন সাহেবও, তুমি সাধের ব্যাটন কারে দিয়া যাও। জারিগানের সুর। সভার মানুষজন স্তব্ধ হয়ে শুনছে। লাল পাড়ের শাড়ি পরনে। নদীর ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে— সে এক বিশাল ব্যাপার। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। তারপর যখন গাইল, এস মুক্ত কর, মুক্ত কর অন্ধকারের এই দ্বার, তখন কি মনে হয়েছিল জান, পরী আমাদের নয়, পরী অন্য জগতের বাসিন্দা। যেন অলৌকিক মহিমা তার সারা গানে বিরাজ করছে। 

মুকুল থামতে চাইছে না। পরীর প্রশংসা করতে পারলে সে আর কিছু চায় না। 

সহসা আমি কেন যে চিৎকার করে উঠলাম, থাম থাম। রাবিশ, আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। পরী একটা বাজে মেয়ে। খারাপ মেয়ে। জেদী, অহংকারী—আমি পরীকে তোমার চেয়ে ভাল চিনি। একদম আর কোনো প্রশংসা না। আমাকে যেতে দাও। বলেই সাইকেলে উঠে পাগলের মতো কেমন দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চললাম। আমার কোনো হুঁশ ছিল না। 

হুঁশ এল মিলের গেটে এসে। 

এত দ্রুত সাইকেল আমি চালাই না। অন্ধকার রাস্তায় আমি কেমন পাগলের মতো ছুটে এসেছি। হাঁপাচ্ছি। সাইকেল থেকে নেমে কিছুক্ষণ রডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি কেমন নির্বিষ নিরুপায় এক মানুষ 

হুঁশ ফিরে এলে যেন মিলের ঘণ্টা পড়ল। সাতটার ঘণ্টা। আমি অসহায় মানুষের মতো কুড়ি টাকা মিলবে বলে টিউশনি করতে যাচ্ছি। নিজের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতেই মনে হল, শরীর থেকে এই সব পোকামাকড়ের বিষ ঝেড়ে ফেলা দরকার। 

পরী আমার কেড না। মুক্ত হতে চাইলাম। রুমালে মুখ মুছলাম। ঘামে জবজব করছে জামা প্যান্ট। সাইকেল ঠেলে ভিতরে ঢুকতে যাব, দেখি খোদ ম্যানেজার দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই বিগলিত হাসি, এই মাত্র মিমির সঙ্গে ফোনে কথা হল। 

এখানেও মিমি! আর ম্যানেজার সাহেব তো আমার সঙ্গে আজ পর্যন্ত একটা কথা বলেন নি। এ-ভাবে আমাকে দেখে বিগলিত হাসিও দেখি নি। আমার সম্পর্কে কাকা হয়। বাবা তো প্রথমে যখন টিউশনিতে আসি, বলে দিয়েছিলেন, ভূপাল সম্পর্কে তোমার কাকা হয়। প্রণাম করবে! 

আমি ভূপাল কেন তাঁর বাবাকেও প্রণাম করি নি। আমরা যে তাঁদের আত্মীয় হই বিষয়টাই যেন বড় হাস্যকর। আমার সম্পর্কে তাঁরা কোনো খবর নেন নি। নরেশ মামা ভূপালের বাবার কাছের মানুষ, সেই সুবাদে আমার পড়াবার অনুমতি মিলেছে। আসলে একটা উদ্বাস্তু পরিবারকে কিছুটা যেন সাহায্য করার মতো। কিন্তু আজ নীলরঙের বেতের চেয়ার দেখিয়ে আমার কাকাবাবুটি বললেন, বোস, তুমি আমাদের দেশের ছেলে জানতামই না। তোমরা আমাদের আত্মীয় হও। 

দেখি তখন তাঁর বাবাও হাজির। 

যেন কত আপনার মানুষ, তুমি তো আচ্ছা ছেলে বিলু। তোমার বাবা আমার ভাইপো সম্পর্কে —অথচ এ-সব কিছুই তো বল নি। 

বলে কি! নরেশমামা তো জানে, আমাদের সঙ্গে লতায় পাতায় আত্মীয়তা আছে। 

আমি তখনও দাঁড়িয়ে আছি। কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেলে যা হয়। মিমির ফোন! আমার আত্মীয়! বসার ঘরে নিয়ে হাজির! এত কেন হচ্ছে! 

ভূপালের বাবাটি বগল, বোস। তোমার ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে কত গেছি। তা তোমার ঠাকুরদার বড় টোল ছিল—মহামহোপাধ্যায় তিনি। তোমার ঠাকুরদার নামডাক ছিল—এক ডাকে সবাই চিনত।

আমার বাবার নাম করে বলল, তোমার বাবা তো সেদিকে মাড়ালই না হাফ-ব্যাক খেলতে গিয়ে একবার মজুমপুরের স্কুলের মাঠে পা ভাঙল। এই ভূপাল, আরও সবাই মিলে তোমার বাবাকে বাড়ি দিয়ে এল। 

আমার বাবা ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন জানতাম না। বাবার কাছে কোনোদিন শুনিও নি। মাও বলে নি, বাবা ফুটবল খেলতেন। তবে বাবা এখন যে-ভাবে ফুটবল খেলছেন তাতে আমার চাকরির খুবই দরকার। 

ম্যানেজার সাহেবের বাবা আমার বাবার কাকা হন এটুকু শুধু জানতাম। টিউশনি ঠিক হলে বাবা বলেছিলেন, ভূপাল মিলের ম্যানেজার। আমাদের আত্মীয়। মার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আরে মনে নেই, একবার এত বড় একটা ঢাইন মাছ নিয়ে এসেছিলেন, তুমি মনে করতে পারছ না! কারো বিয়ে কি অন্নপ্রাশন এমনই কিছু বলেছিলেন, তবে আমার ঠিকঠাক মনে নেই। দেশের কথা কোনোদিন ওঠে নি। আজ শুধু দেশের কথা না, আমি তাঁদের আত্মীয়, আমার ঠাকুরদা মহামহোপাধ্যায়, অনেক শিষ্য, বাড়িতে টোল ছিল, আরও কত খবর দিয়ে নিমেষে নিজের মানুষ করে ফেলতে চাইছেন। তাহলে কি মিমি ফোনে বলেছে সব? সাহেবের কবিতা দুটো যাচ্ছে না। সম্পাদক রাজী না। 

আজ পড়াশোনার পাট উঠে গিয়ে বাড়ির অন্য চেহারা। সাহেবের পত্নী হাজির। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তুমি বিলু বড় মুখচোরা স্বভাবের মানুষ। মিমি তো বলল, ও এ-রকমেরই। 

মিমি আর কি বলেছে জানার ইচ্ছে। কিন্তু আমি চুপচাপ বসে আছি। 

—একদিন আমরা যাব। 

বললাম, যাবেন। 

—তোমার বাবাকে বলবে, আমরা খুব রাগ করেছি। এতদিন আছি দিদি একবার বেড়িয়ে গেলেন না!

বললাম, বলব। 

আমি জানি তিন মাসের মাথায় আমার এত আদর আপ্যায়নের মূলে মিমি। এখানেও মিমির প্রভাব। মিমি ভেবেছে কি? 

ম্যানেজার সাহেব বললেন, চা খাও তো! 

—খাই। 

তারপর বললেন, মিমির সঙ্গে কি করে আলাপ? 

—এক সঙ্গে পড়ি। 

—ওদের বাড়ি গেছ? 

মনে হল বলি, না গেলে কী চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে আমার মধ্যে একটা ভীতু মানুষ আছে—সে এ-সব কথায় সংকোচের মধ্যে পড়ে যায়। বললাম, গেছি। 

—ওর দাদু মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। 

— জানি। 

—খুব সম্ভ্রান্ত পরিবার! 

—শুনেছি। 

এ-সময় দুই ছাত্রী আমার হাজির। একজনের হাতে চায়ের কাপ। অন্যজন মিষ্টির প্লেট নিয়ে হাজির। আমার সামনে রাখছে। 

বড় ছাত্রীটি আজ আবার শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরলে কত সুন্দর লাগে দেখতে। কেন যে পরে না। ফ্রক গায়ে আমার সামনে বসলে আমি ঠিক মুখ তুলে তাকাতে পারি না। আমি যে একজন তরুণ যুবক, আমার মধ্যে বড় হবার স্বপ্ন আছে এতদিন এ-বাড়িতে এমন বিশ্বাস কারো ছিল না। মানুষ বলে গণ্য না করলে যা হয়। নরেশমামার কথা ফেলতে পারে না বলেই যেন রাখা। 

চা, খাবার একটা টিপয়ে রাখলে তাদের পিতৃদেবের হুকুম—প্রণাম কর। কত বড় বংশের ছেলে জান না। ওর ঠাকুরদাকে দেশে সবাই এক ডাকে চিনত। 

আমার ঠাকুরদা যে এত নামী মানুষ আমি এই প্রথম শুনলাম। আমার জন্মের আগেই ঠাকুরদা গত হয়েছেন। দুটো খবরই আমাকে আজ কেমন বিভ্রমের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এক বাবা বড় ফুটবল খেলোয়াড়, দুই, আমার ঠাকুরদা মহামহোপাধ্যায়। বাবা তো এ-দেশে এসে কোথাও ঠেকে গেলে একমাত্র দীনেশবাবুর দোহাই দিতেন। বাবা কেন যে ঠাকুরদার নাম বলতেন না বুঝতে পারি না। 

ওরা প্রণাম করে উঠে পাশের সোফায় বসে পড়ল। প্রণামে আমার কোনোদিন আপত্তি নেই। ছোট বয়েস থেকেই ওটা পেয়ে আসছি বামুন ঠাকুর বলে। পাশের সোফায় পায়ের উপর পা রেখে দাম্ভিক এবং গুরুগম্ভীর ম্যানেজার পাইপ নামিয়ে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, মিমি তো দেখছি এখানে এলে তোমার কথা ছাড়া কিছু বলে না। তুমি নাকি ছাইচাপা আগুন। তুমি বলছি বলে মনে কিছু কর না কিন্তু। 

আমি প্রায় আর্তনাদ করতে যাচ্ছিলাম—না না, তাতে কী হয়েছে। 

তারপর বলার ইচ্ছে হয়েছিল, আমি তো আপনার ভাইপো। সেটা বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে বলে চুপ করে গেলাম। 

—খাও। কাকীমার গলায় স্নেহ ঝরে পড়ছে। 

মিমি ভেবেছেটা কী! আমি ছাইচাপা আগুন! ও এখন ফু দিয়ে তা জ্বালাবার চেষ্টা করছে।

এ-ঘরের দেয়াল যেন নতুন করে ফের দেখছি—কাকীমার কিছু সুচীশিল্পের নিদর্শন আছে। সূচীশিল্পে মহামান্য ম্যানেজারের পদ্য লেখা। পদ্যের নিচে নাম, ভূপাল চৌধুরী। পতীর পুণ্যে সতীর পুণ্য গোছের সব পদ্য। তার স্বামীটি শুধু এত বড় মিলের ম্যানেজারই নয়, একজন কবিও। তার সঙ্গে তিনি যে শিকারী সে ছবিও এই ঘরে! বসার ঘরটা জীবনের প্রশংসাপত্রে ভরে ফেলেছে। কোথাও কোনো বিদায় সম্বর্ধনার প্রশংসাবাক্য, কোথাও সাহেব মালিকের পাশে দণ্ডায়মান ছবি, কোথাও সভাপতির আসন অলংকৃত করেছেন তার ছবি। এই প্রথম বুঝতে পারলাম গোটা পরিবারটাই ভূপাল চৌধুরী নামক একজন কৃতী মানুষের অহঙ্কারে ভুগছে। সারা পরিবার এবং আগামী বংশধররাও এই মহান কৃতী পুরুষের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে। তাই সব কিছুই বাঁধিয়ে রাখা! 

—কিছু খাচ্ছ না যে! 

—এত খাব না। 

—আরে খাও। ছেলেমানুষ। তোমাদের বয়সে আমরা সব গোগ্রাসে খেতাম। 

দাদুটি বললেন, তোমার ঠাকুরদা খুব খাইয়ে মানুষ ছিলেন। আস্ত পাঁঠা খেতে পারতেন। কী বিশাল চেহারা। আর তেমনি সুপুরুষ। সাদা কদমছাঁট চুল লম্বা টিকিতে লাল জবা। গায়ে শুধু রেশমের উত্তরীয়। পায়ে খড়ম। 

ভূপাল চৌধুরী মশাই বললেন, ব্যাপার কি জান, আমিও একসময়ে কাব্যচর্চা করতাম। আমার কবিতা বাণী, রূপা, চম্পা কাগজে প্রকাশিত হত। নানা ঝামেলায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বুঝলে না একজন মানুষের পক্ষে সব দিক বজায় রাখা কত কঠিন। 

আমি বললাম, তা ঠিক। বলার ইচ্ছা ছিল বুড়ো বয়সে ঘোড়া রোগ কেন। ছাত্রী দুজন আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। এতদিন তারা শুনে আসছে—ওরে তোরা কোথায়। মাস্টার এসে বসে আছে। এখন তারা ভাবছে, মিমিদি এই মানুষটিকে বড় সমীহ করে। মিমিদি ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করা মেয়ে। মিমিদি নাটক করে। শহরে এমন লোক কমই আছে মিমিদের নাম জানে না। মিমিদির দাদুকে চেনে না। মিমিদিদের গাড়ি আছে। সেটাই এখন লেটেস্ট মডেলের। মিমিদিরা গাড়িতে এলে এই বাংলোর বাসিন্দাদের ইজ্জত বেড়ে যায়। সে-ই যখন বলে গেছে, ছাইচাপা আগুন, বিলুকে এমনিতে বোঝা যায় না, জেদী অহংকারী, মাথা নিচু করে কথা বলে কিন্তু যা ভাবে তা করবেই। ওর মধ্যে দারুণ তেজস্বিতা আছে। কবিতা দারুণ লেখে। কুঁড়ের হদ্দ। লেগে আছি। হয়তো মিমি তার দু-একটি কবিতাও এখানে আবৃত্তি করে যেতে পারে। এত বড় বংশের এমন সুন্দর তরুণীর সার্টিফিকেটের কত দাম মিষ্টি মুখে দিতে টের পেলাম। কিন্তু আমি কেন যে ভিতরে ভিতরে ক্ষোভে মরছি বুঝতে পারছি না। মিমির পরিচয়ে আমার পরিচয়। মিমি বললে, আমি রাজা, না বললে আমি ভিখারী। কখনও না। এ হতে দেওয়া যায় না। 

ঢোক গিলে বললাম, মিমি মিছে কথা বলেছে। 

সহসা কেমন সম্বিত ফিরে আসার মতো ভূপাল চৌধুরী মশাই মানে আমার এখনকার কাকাবাবুটি প্রায় অনেকটা নড়ে বসলেন। বললেন, না না, মিমি কখনও বাজে কথা বলে না। 

আমারও মাথা গরম। বললাম, খুব বলে। 

—তাহলে বলল যে অপরূপার সম্পাদক তুমি।—তুমি এর মধ্যে নেই? 

মিমি যে বলল, বিলুর ইচ্ছে নয়। ও অপরূপার সম্পাদক। ও রাজী না হলে কিছু করা যাবে না।

—ঠিক বলে নি। 

দাদুটি বললেন, আজকালকার মেয়েরা যা হয়েছে। আর অত ছেড়ে দিলে হবেই বা না কেন! এর ওর বাগানে মুখ তো দেবেই। 

এই এক ফ্যাসাদ আমার। ওর প্রশংসা সহ্য হয় না। অপ্রশংসাও না। দাদুটির কথায় আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। মিমি খারাপ মেয়ে। এর বাগানে ওর বাগানে মুখ দেয়। 

কাকাবাবুটির পাইপ টানা বন্ধ হয়ে গেছে। ইজ্জতে লেগেছে। তবু খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, মিমির উৎসাহে আমি আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছি। 

তাহলে মিমির দিব্যি আছে মাথায়। আমার হাসি পাচ্ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে বসে আছি। হাসলেই গেল। এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, হাসা ঠিক না। অনেকদিনের সাধ লোকটাকে অপমান করার। কবিতা অমনোনীত— ব্যাস—তারপরই মিমির বাকি কাজ। এটা মিমি করবে আমি জানতাম। কারণ মিমি জানত আমার হেনস্থার কথা। 

বললাম, মিমির এটা স্বভাব। ও সবাইকে উৎসাহ দেয়। 

—মিমি না বললে, এ বয়সে কে আর সাধ করে কবিতা লেখে। দেয়ালের বাঁধানো কবিতা দেখেই বলল, বা কী সুন্দর হাত আপনার। ওটা ছেড়ে দিলেন কেন! 

মিমি এমন বলতেই পারে না। সৌজন্যের খাতিরে বলতে হয়তো পারে। কাকাবাবুটি জীবনের সব প্রশংসাপত্র এই ঘরে লটকে রেখেছেন। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার স্বভাব। হয়তো মিমিরা এলে সব দেখিয়েছেন। কোন ছবি কবে কোথায় তাও বলতে পারেন। কোন্ প্রশংসাপত্র কোন মিল থেকে বিদায় সম্বর্ধনায় পাওয়া। কোন বনে কোন হরিণ শিকার করেছেন। বাঘের চামড়াটি আছে। ওটাও তাঁর শিকার করা। এত সব কৃতিত্বের সঙ্গে পদ্যের প্রশংসা না করলে অশোভন। মিমি তাই বলতে পারে, ছেড়ে দিলেন কেন! আসলে মিমি হয়তো বলতে চেয়েছিল, ছেড়ে দিয়ে ভাল করেছেন। নাহলে নিজেও ডুবতেন, অনেক সম্পাদককেও ডোবাতেন। তবে মিমি দেখেছি আমাকে ছাড়া রূঢ় কথা আর কাউকে বলে না। সবার সঙ্গেই মধুর ব্যবহার। আমি ছাড়া দেখছি ওর আর কোনো বড় প্রতিপক্ষ নেই। মিমিও আমার সঙ্গে ঝগড়া করার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। বাড়িতে গোপনে আসাটাও আমার কাছে কেন জানি এক রকমের শত্রুতা। 

কাকাবাবুটি সোজাসুজি বললেন, তাহলে মিমি আমাকে ব্লাফ দিল! যেন স্বগতোক্তির মতো। কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না। ছাত্রী দু’জন পিতৃদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে বিমর্ষ কিংবা পিতৃদেবের এমন করুণ মুখ হয়তো জীবনেও তারা দেখে নি, দাপটে যে মানুষ এত বড় মিল চালায়, সেই মানুষকে এতটা কাহিল দেখালে পরিবারের লোকজনদের কষ্ট হবারই কথা। 

দাদুটি মুখে দোক্তা পাতার গুঁড়ো দু-আঙুলে ফেলে বললেন, এক্ষুনি ফোন কর।

এসব কি ফাজলামি। আর তক্ষুনি মনে হল, এই রে খেয়েছে। আমাকে বসিয়ে রেখে কথা বলতে চান। বলুক না। যেন মিমিকেও জব্দ করা যাবে এই ভেবে মজা পাচ্ছিলাম। স্রেফ অস্বীকার করব। বলব, না না আমি সম্পাদক নই। আমার টাকা কোথায়! আমাকে কে বিজ্ঞাপন দেবে! মিমির ইন্টারেস্ট কি আমাকে সম্পাদক করার। আমার এমন যুক্তির কাছে মিমি হেরে যেতে বাধ্য। কাজেই আদৌ ঘাবড়ে গেলাম না। 

বললাম, দেখুন না ফোনে পান কি না! সত্যি তো এ-ভাবে ব্লাফ দেওয়া ঠিক না। 

দাদুটি বলে উঠলেন, অসভ্য মেয়েছেলে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার কী হয়ে যায়! আমি নিজেও জানি না। সব মিষ্টি যেন ভেতর থেকে উঠে আসছে। আমি জানি, এই টিউশনির আজ এখানেই ইতি। সব জেনেও চেপে আর যেতে পারলাম না। 

বললাম, ওকে অসভ্য মেয়েছেলে বলবেন না। ও অমন মেয়ে নয়! 

—কী বলছ তুমি। ভূপালের মতো মানুষের কাছে সরাসরি মিছে কথা বলে গেল! 

—ও মিছে কথা বলে নি। আপনার পুত্রগৌরবের সামান্য হানিতেই এত ক্ষেপে গেলেন। দুটি পদ্য ছাপা হল কি হল না এই ভেবে ওকে অসভ্য মেয়েছেলে বলা ঠিক হয়নি। 

—আলবাৎ হয়েছে। ওর দাদু ওর মাথা খেয়েছে। ও অসভ্য মেয়েছেলে ছাড়া কিছু না। যারা নাটক করে, পার্টি করে, সব পুরুষদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। স্বভাব ঠিক থাকে তাদের? 

—একদম এ-রকম বলবেন না। ভূপালবাবুর পদ্য আমি বাতিল করেছি। কবিতা আর পদ্য আলাদা- আমার ‘অপরূপায় কবিতা ছাপা হয়। পদ্য ছাপা হয় না। জীবনে সবার সব হয় না দাদুমশাই। মানুষকে ইজ্জত দিতে হয়। আগে মানুষকে ইজ্জত দিতে শিখুন, পরে অসভ্য মেয়েছেলে বলবেন। মিমি মানুষকে ইজ্জত দিতে জানে। সে কখনও ব্লাফ দেয় না। অপরূপার সম্পাদক আমি। হ্যাঁ আমি। মিমির কোনো রাইট নেই, আমি না বললে, সে ছাপতে পারে না! মিমিকে অসভ্য বলার আগে আপনারা কতটা অসভ্য ভেবে দেখবেন। উঠি। 

আর এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। বাইরে বের হয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কুড়িটা টাকা। বাবা শুধু বলবেন, কুড়িটা টাকা সোজা কথা। দেড় মণ ধান হয়। 

মা বলবে, কুড়ি টাকা টিউশনিতে কে দেয়। দশ টাকা পাঁচ টাকা দেয়। তুই এ-ভাবে সবাইকে অপমান করে চলে এলি! তোর কাণ্ডজ্ঞান নেই। সংসারের কী হাল বুঝতে পারিস না। মায়াটার একটা জামা নেই, পিলু ছেঁড়া প্যান্ট পরে স্কুলে যায়। আমার পরবার একটা ভাল শাড়ি নেই। তোর বাবা তো ন্যাংটা বাউণ্ডুলে। তার কিছুতেই কিছু আসে যায় না। 

তবু যেন অনেক দিনের অপমানের জ্বালা আজ শেষবারের মতো উগরে দিয়ে আশ্চর্য এক মুক্তির স্বাদ পেলাম। বাড়ি এসে খেলাম, নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম। 

.

দু-দিন বাদে মুকুল এল। হাতে টাইপ করা খাম। সেই সব করে এনেছে। শুধু সই করে দিতে বলল। 

বাড়িতে এ দু-দিন কারো সঙ্গে বড়ো একটা কথা বলছি না। মা সকাল হলেই তাড়া দিচ্ছে, কিরে টিউশনিতে গেলি না! 

—যাব। 

সব কথা বলতেও সাহস পাচ্ছি না। কুড়িটা টাকা মাসান্তে সংসারে কত দাম বুঝি। বললেই মা ভেঙে পড়বে। বাবা হয়ত বলবেন, সব ভবিতব্য। 

এই ভবিতব্য কথাটা নিয়ে ঝড় উঠবে। মা’র গলা পাওয়া যাবে, ভবিতব্য ধুয়েই এখন জল খাও। সারাটা জীবন আমাকে তুমি জ্বালিয়েছ। এমন নিষ্কর্মা মানুষের হাতে পড়ে আমার হাড় মাস জ্বলে গেল। কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই কিছুতে। কাল কি খাবে, তার চিন্তা নেই। গাছপালা আর যজমান নিয়ে পড়ে থাকলেন। ঠাকুরপো এত করে বলল, দ্বারকা দাসের আড়তে খাতা লেখার কাজ নিতে। তাতে ওনার অপমান। ছয়কে নয় করতে পারবেন না। এখন বোঝ, ছেলের কি, সে তো বোঝে না কোথা দিয়ে কী হয়! 

কিন্তু এ-সব ঘটনা চাপা থাকে না। নরেশ মামাই এসে খবরটা দিলেন। নরেশ মামা অবশ্য সব বলে শেষে বলেছেন, বিলু ঠিক করেছে। ওরা ভাবে কি? আরে বাবা দেশে থাকতে তোর মা তো মুড়ি ভাজত। স্কুলে কে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। মানুষের দিন সমান যায় না। বিলুটাকে শুনেছি মানুষ বলে গণ্যি করত না। আমি নিজেই ভাবছিলাম বলব, আর যেয়ে দরকার নেই। 

সুতরাং এ-সব শোনার পর বাড়িতে যে ঝড়ের আশংকা করেছিলাম সেটা সহজেই কেটে গেল। এখন শুধু আমার জামাইবাবুর পেছনে লেগে থাকা। জামাইবাবুকে বলে স্পেশাল কেডারে যদি শিক্ষকতা পাওয়া যায়। এই আশাই এখন পরিবারের সবার কাছে বেঁচে থাকার উৎসাহ যোগাচ্ছে। মুকুল টাইপ করা দরখাস্ত নিয়ে যাবার পর, সংসারে সামান্য অভাব অনটন নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হলেই, বাবার এখন একটাই আপ্তবাক্য, আরে কটা দিন সবুর করতে তোমার কি হয় বুঝি না ধনবৌ! 

আমার পড়া হবে না জেনে পিলু খুবই দমে গেছে। দাদাটার কত বড় হবার কথা। সে এখন প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টার হয়ে যাবে। মাও মনের দিক থেকে ভাল নেই, সংসারে একজন নীলবাতি জ্বালাবার যাও চেষ্টা করে যাচ্ছিল, ইস্কুলের চাকরি হলে সেটাও যান। মানুষের ঘরবাড়িই তো সব নয়। সঙ্গে পুত্র কন্যার যশ খ্যাতি সবই দরকার। 

বাবা ছাতা বগলে নিবারণ দাসের আড়তে গিয়ে একদিন খবরও দিয়ে এল, বিলু দরখাস্ত করেছে দাস মশাই। মনে হয় চাকরিটা হয়ে যাবে। চাকরিটা হলে সংসারে স্থিতি আসবে। আমার ব্রাহ্মণীকে তো জানেন। বিন্দুমাত্র সহ্য ক্ষমতা নেই। অভাব অনটন কার নেই। যার লাখ টাকা আছে তারও আছে, যার কিছু নেই তারও আছে। মাথা গরম করলে চলে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *