প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মৃন্ময়ী – ৫

পাঁচ 

আশ্চর্য, চার-পাঁচ দিন হয়ে গেল মিমির আর কোনো পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। নিখিল বলল, মিমি পার্টি অফিসেও যাচ্ছে না। আমরা রাউণ্ড মারতে বের হলে শুধু দেখি, চৈতালীর ন্যালা ক্ষ্যাপা দিদিটা বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা ম্যাকসি গায়ে। মুখ দিয়ে সেই লালা ঝরছে। দু’ হাত ঝুলে আছে দু’দিকে। আর ঘাড় কাত করে একবার বাঁয়ে একবার ডাইনে দুলছে। আড্ডায় পত্রিকা নিয়ে যা শেষে গড়াল তাতে কিছু করা যাচ্ছে না। মিমির বাড়ি গিয়ে যে খোঁজ করব তারও জোর নেই। আমি যখন বলতে পারি তুমি যাবে না, গেলে আমি অপমানিত হব, তখন মিমিও মনে করতে পারে তার বাড়ি গেলে সে অপমানিত হবে। আসলে মিমিদের বাড়ি যাবার জোরটাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। 

হঠাৎ একদিন সকালে মুকুল বাড়ি এসে হাজির। খুব হস্তদন্ত অবস্থা। সে আমার ঘরে ঢুকেই তক্তপোষে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, খবর ভাল না। 

—কিসের খবর? 

—কাগজের নাম চৈতালী রাখা চলবে না। 

—কেন, কি হল? 

—চৈতালী ক্ষেপে গেছে। দিদিদের নালিশ দিয়েছে। তাকে ছোট করার জন্যই নাকি আমরা কাগজটার নাম চৈতালি রাখছি। 

আমি টেবিলে পা গুটিয়ে বসি। বললাম, এদের তুমি কিছুতেই মহান করে তুলতে পার না। নারী জাতির কি যে ভাব বুঝি না ভাই। বাবা ঠিকই বলেন-যা দেবী সর্বভূতেষু দেবীরূপেন সংস্থিতা। কি নাম রাখবে তবে? এদিকে মিমির পাত্তা নেই। মিমি এ বাড়িতে এসে মাসিমা মেসোমশাই করে গেছে। সে এ বাড়িতে পরী নয়, মিমিও নয়, একেবারে মৃন্ময়ী। কখন উদয় হবে ভয়ে মরছি, আর এখন একেবারে বেপাত্তা। বল, ভাল্লাগে। 

মুকুল চিৎকার করে বলল, মাসিমা জল। এক গ্লাস জল। 

মায়া জল রেখে গেলে বলল, কিরে তুইও দেখছি বড় হয়ে গেলি। মায়া শাড়ি পরে এসেছিল, মুকুলের কথায় দৌড়ে পালাল। 

—তা’লে পরী এখন তোমাদের বাড়িতে মৃন্ময়ী। 

—বোঝ তবে! বাবা তো মৃন্ময়ী বলতে অজ্ঞান। মৃন্ময়ী বড় ভক্তিমতী। কী লক্ষ্মী মেয়ে! হাঁটু গেড়ে ঠাকুর প্রণাম। চরণামৃত পান। বল কত সহ্য করা যায়। 

—খুব বিপদ। বলে মুকুল হাই তুলল একটা। জলটা খেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তা’লে কি হবে? 

এমন প্রশ্ন করলে আমাদের দুজনেরই চুপ করে থাকার কথা। এমন অবসর বেলায় এখন আমাদের দুই বন্ধুতে সাইকেল চেপে উধাও হওয়ার কথা। কারণ চার পাশে রাস্তাঘাট শহর, বাড়ি, গাছপালা সব আমাদের টানে। আর এ সময়ই প্রশ্ন, তাহলে কি হবে! পরী কি আমাদের সঙ্গে নেই! না থাকুক, ভারি বয়ে গেল। নাম ‘চৈতালী’ হবে না। না হোক, অন্য নাম রাখব। ভয়ের কি আছে। সুধীন বাবুরা তো লিখেই খালাস। লেখা সংগ্রহ করা থেকে সব কিছু আমাদের। সবাই না হয় চাঁদা তুলে করব। একমাসের টিউশনির টাকা না হয় আমি দেব। আর কাজটা হয়ে গেলে তো কথাই নেই। কাজের টাকা বাবার। টিউশনির টাকা কাগজের। বললাম, একবার যখন নামা গেছে পিছিয়ে আসা যায় না। আমরা কাউকে অপমান করব বলে কাগজের নাম চৈতালী রাখিনি। নারীদের আমরা শ্রদ্ধা করি। 

আমার মুখে রীতিমতো বক্তৃতা শুনে মুকুল ঘাবড়ে গেল। আগে আমিই কাগজ সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিলাম, এখন আমিই কাগজ নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ছি দেখে মুকুল মনে মনে খানিক আত্মপ্রসাদ লাভ করল। সে-ই আমাকে টেনে নামিয়েছে কাজে—আমার যা স্বভাব কিংবা গোঁ, কে জানে, কখন একেবারে হিতে বিপরীত করে বসতাম। ফলে সে আমার কাছে সাহস পেয়ে বলল, চৈতালী ছাড়া আর কি নাম রাখা যায় বল তো! 

—প্রাংশু! 

—ধুস! তুমি কি না।

—করালী! 

—তুমি ঠাট্টা করছ কেন বিলু। এখন থেকে কাজের গুরুত্ব যদি আমরা বুঝতে না শিখি তবে কবে থেকে শিখব। জামাইবাবুর কানে কথাটা উঠেছে। তিনি ডেকে বলেছেন, কাগজ নিয়ে বেশি মাতামাতি করবে না। ওতে আখের নষ্ট। রেজাল্ট বের হলে, মন দিয়ে লেগে যাও। চাকরি-বাকরি পাওয়া খুব কঠিন। কাগজে পেট ভরবে না। 

—ছোড়দি কিছু বলল না? 

ছোড়দিই তো রক্ষা করল।—রাখ তোমার চাকরি-বাকরি। ছেলেমানুষ, এ বয়সে কত শখ থাকে। এরা তো ভারি নিষ্পাপ ছেলে। কোনো খারাপ স্বভাব আজ পর্যন্ত দেখিনি। আজকাল দেখি তো সব স্যাম্পেল। 

—আচ্ছা মুকুল, ছোড়দির কাছে কিছু টাকা বাগানো যায় না। তা’লে পত্রিকাটা একেবারে মৃন্ময়ী- নির্ভর হয়ে থাকত না। 

—যায়। মুসকিল কি জান, ছোড়দি লুকিয়ে দেবে। বললেই দেবে। কিন্তু জান তো জামাইবাবুটিকে। কি কঠিন প্রকৃতির। ধরা পড়লে অশান্তি হবে। 

—কি যে করি! সত্যি আমাদের ছোড়দি এত সুন্দর আর আমাদের জন্য যদি কটু কথা শুনতে হয়, না, ঠিক হবে না। বললাম, থাক তবে- 

—কিন্তু নামটা ঠিক করে ফেল। মুকুল উঠে বসল। 

—তোমার মাথায় আসছে না? 

—না। চৈতালী ছাড়া আমার মগজে কোনো নাম নেই। 

আচ্ছা যদি ‘অপরূপা’ রাখি। দুই কুলই সামলে দেওয়া গেল! আমরা তো চৈতালী নামটা রেখে তোমার অপরূপাকে মহৎ করতে চেয়েছিলাম। যাকে বলে চিরস্মরণীয় চৈতালী বদলে অপরূপা। কারও কিছু বলার থাকবে না। তুমি আমি জানলাম আমাদের অপরূপাটি কে! 

গ্র্যাণ্ড। ভাবা যায় না। একটা ডামি করে ফেলতে হবে। চল বের হয়ে পড়ি। সোজা দিলীপের কাছে। প্রেসে সব কথাবার্তা হবে। সে একটা মোটামুটি চার পাঁচ ফর্মার কাগজ বের করতে কত লাগবে বলতে পারবে। ত্রৈমাসিক না ষাণ্মাসিক। 

ষাণ্মাসিক খুব লং গ্যাপ। অত বড় গ্যাপ রাখা ঠিক হবে না। 

তা’লে ত্রৈমাসিক! আর মনে হয় এর মধ্যে তোমার কাজটা হয়ে যাবে। আমারও ইচ্ছে ছিল কাজ নিই, দাদা একেবারে রাজি না। দু-দিক সামলানো নাকি আমার কম্ম নয়। আমি নাকি নিজে কি পরে বের হব তারও খবর রাখি না। আত্মনির্ভরশীলতার বড় অভাব। বৌদি-সর্বস্ব হয়ে আছি। কি জ্বালা বল, নিজে করতে গেলে বৌদি বলবে, আমি কি মরে গেছি। কিছু করারও উপায় নেই, অথচ হরদম খোঁচা সহ্য করতে হবে। পরীক্ষায় পাস করার পর ভাবা যাবে—দাদার এক কথা। 

মুকুলের এটা সত্যি বড় সৌভাগ্য। বৌদির এমন মিষ্টি স্বভাব যে আমার মতো লাজুক ছেলেকেও হার মানিয়েছে। আড্ডা মারতে গিয়ে বেলা হয়ে গেল, বৌদি দাদার একখানা কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলবেন, চান করে এখানেই বাবুর দুটো খেয়ে নেওয়া হোক। রোদে আর বাড়ি ফিরতে হবে না। কতদিন এ ভাবে আর বাড়ি না ফিরে সারাটা দিন শুয়ে বসে, ঘুরে ফিরে এক মুক্ত জীবনের স্বাদ বয়ে বেড়াচ্ছি। টিউশনি আর মিমি বাদে গলায় কোনো কাঁটা বিঁধে নেই। 

বের হতে যাচ্ছি, দেখি রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে। বেশ সুপুরুষ মানুষটি। বিলুবাবু এখানে কোন্ বাড়িটায় থাকেন? 

—আমিই, বলুন। 

—মিমি পাঠিয়েছে। 

একটা প্যাকেট। যুবকটি বোধহয় রিকশায় কিংবা গাড়িতে এসেছে। আমাদের বাড়িতে সাইকেলে আসা যায়। তারপর আর কোনো যানের পক্ষেই অগম্য আমাদের রাস্তা। গরুর গাড়ি অবশ্য আসতে পারে। তাই বলে আমার বাড়ি আসার জন্য যুবকটির পক্ষে গাড়ি ভাড়া করা সমীচীন হবে না ভেবেই, পাকা সড়কে গাড়ি কিংবা রিকশা রেখে এসেছেন। আমি মুকুলের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোককে, ঠিক ভদ্রলোক বলা যায় না, আমাদের চেয়ে পাঁচ সাত বছরের বড়, কি আরও কিছু—কিন্তু তিনি যে মৃন্ময়ীর কে বুঝতে পারলাম না। 

আমার নাম পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। 

ও আপনি, মানে আমার মুখে কথা সরছিল না। এখানকার স্থানীয় এস ডি ও সাহেব। একবার যেন এঁকে মিলের ম্যানেজারের বাড়িতে দেখেওছি। গলায় টাই, একেবারে সুটেড বুটেড মানুষ। পাজামা পাঞ্জাবি পরে থাকলে চিনি কি করে! আর তখনই দেখি বাবা গরু বাছুর ছেড়ে দিয়ে মাঠের উপর দিয়ে আসছেন। সর্বনাশ! কাছে এলেই হাজার প্রশ্ন, মহোদয় আপনার নিবাস। কি করা হয়। তাড়াতাড়ি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। পরেশচন্দ্রকে এগিয়ে দেওয়া দরকার। বাবা এসে পড়লে রক্ষা থাকবে না। বললাম, চলুন, আমরা বের হচ্ছিলাম। 

সুপুরুষ মানুষটি চারপাশটা এখন খুব লক্ষ্য করে দেখছেন। কি ভেবে বললেন, প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে মিমি বলল, তুমি এটা দিয়ে এস। ট্রেনিং ক্যাম্প পার হলেই ওদের বাড়ি। নাম বললেই দেখিয়ে দেবে। কী যে এত জরুরী বুঝলাম না। 

—মিমির তো পাত্তা নেই। ওকে বলবেন, ও না থাকলেও কাগজ আমরা ঠিক বের করব। মুকুল বলল, না না ওসব বলতে যাবেন না। মিমির কি কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে। বাড়ি থেকে কোথাও যাচ্ছে না? 

ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, না ভালই আছে। বাড়ি থেকে কিছুদিন বোধহয় ওর বের হওয়া বারণ। 

আমি খুব করুণ গলায় বললাম, কেন, কি হয়েছে? 

—ও এমনি। বলে ভদ্রলোক মজার হাসি হাসলেন। 

আমাদের বাড়িতে খোদ এস ডি ও সাহেব, খুবই অভাবিত ব্যাপার। এবার যেন বিষয়টা অনুধাবন করতে পারছি। যত অনুধাবন করছি তত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছি। কি ভাবে একজন এস ডি ও সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হয় তাও জানি না। বাড়িতে বসতে বলা দরকার ছিল—এটা ভদ্রতা। জানি বসতে দেবার মতো জায়গায়ও আমাদের নেই। যত সঙ্গে যাচ্ছি এগিয়ে দিতে তত ঘাবড়ে যাচ্ছি। প্যাকেটটা খুলে দেখাও হয়নি ভিতরে কি আছে। 

বললাম, প্যাকেটে কি আছে? 

—কি যেন বলল, কিসের একটা ডামি। 

সে যাই হোক— রাস্তায় খুলে আর এস ডি ও সাহেবের প্রতি অমনোযোগী হতে পারি না। বাবা বাড়ি ফিরলে ঠিক জিজ্ঞেস করবেন, কে? বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে। বসতে বললে না। এটা তো পরিবারের নিয়ম না। 

সুতরাং এখন আমি আর মুকুল, দুজনেই ক্রমে বিষয়টা অনুধাবন করে, আপনি আজ্ঞে শুরু করেছি। বলছি, মিমিটা যে কি। ও নিজেই দিয়ে গেলে পারত। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেও পারত। আপনাকে অহেতুক….. 

আরে না না। ও কিছু ভাববেন না বিলুবাবু। 

খুব সম্মান দিয়ে কথা বলছেন। স্বাভাবিকভাবেই সাহেবটিকে বড় বিনয়ী মনে হল। আমরা উঠতি যুবা, ফাংশান টাংশানে যাই, রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি। আরও কত অনুষ্ঠান সুচী—ঠিক এক মুহূর্তেই মনে হল, এস ডি ও সাহেবের নামটি মিমি বলেছিল। কলেজ সোস্যালে মিমি, ডি এম, এস ডি ও এবং কলকাতা থেকে একজন বড় সাহিত্যিককেও নিয়ে এসেছিল। মিমির পক্ষে কোন কাজই অসম্ভব নয়। 

ট্রেনিং ক্যাম্প পার হতেই আমগাছের ফাঁকে দেখলাম সড়কে একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। শহরের গাড়ি বলতে মিমি এবং দুই রাজবাড়ির দুটো গাড়ি আছে। ছোট রাজার বুইক, আর বড় রাজার মার্সিডিজ। মিমিদের গাড়িটা খুবই চকচকে, নতুন। মিমি সাধারণত গাড়িতে কোথাও যায় না। একমাত্র কালীবাড়ীতে পূজা দিতে গেলে পরিবারের লোকেদের সঙ্গে মিমিকে দেখা যেত। অবশ্য বিপ্লবী মেয়ের পক্ষে বোধহয় গাড়ি চড়া শোভাও পায় না। কাছে গিয়ে অবাক! দেখি সেই বিপ্লবী মেয়েটি দারুণ সেজে জিপ গাড়িতে বসে আছে। আমাকে দেখেও দেখল না। বুকটা সহসা ছ্যাঁৎ করে উঠল। মিমি আমার পাশে মুকুলকে দেখে যেন কিছুটা স্বাভাবিক। বলল, সব ঠিক হয়ে গেছে। দয়া করে সম্পাদক মশাইকে বলবেন, কার লেখা কোথায় যাবে তার যেন একটা লে-আউট করে দেন। আর নিজের কবিতাটি যেন দয়া করে সঙ্গে পাঠান। গোটা দশেক বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। 

একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারত। কিন্তু খোদ এস ডি ও সাহেবের গাড়িতে যিনি বসে আছেন তাঁর সঙ্গে মতান্তর আছে ভাবাটাই যেন আমার অপরাধ। 

পরেশচন্দ্র বললেন, চলি বিলুবাবু। 

গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে আমাদের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। মিমি একবার চোখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত। অনেকক্ষণ স্তব্ধ আমরা দুজনেই। মুকুল বলল, আর দেখতে হবে না। চল। আগুন নিয়ে খেলছিলে। বোঝ মজা! 

—আমি খেলতে যাব কেন। আমার সে দুঃসাহস নেই। খারাপ লাগছে মিমি একটা কথা বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *