প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মৃন্ময়ী – ২

দুই 

আসলে বুঝতে পারছি আমি অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করছি। ছিমছাম বাংলো বাড়ির দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা সবুজ লন। বড় একটা নীল রঙের নেট টাঙানো। দু’পাশে নীল রঙের বেতের চেয়ার সাজানো। ওটা পার হলেই সুন্দর একটা গোল ছাতার মতো গাছ। দেশী গাছ নয়। বিলিতি গাছ না হলে তার এমন পরিচর্যা হতে পারে আমার ধারণায় আসে না। সব যেন জ্যামিতিক মাপে তৈরি করা। এমন কি একটা বোগেনভেলিয়া গাছেরও যে এত ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া লাল সাদা ফুল হতে পারে এখানে না এলে যেন বিশ্বাস করা যায় না। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গলা কিছুটা শুকিয়ে উঠেছে। তবে রক্ষা, এই বাংলো বাড়ির মালিক বাবার দেশ, বাড়ির মানুষ। বাবা বলেছেন, কাজে কর্মে ম্যানেজারের বাবা মা আমাদের বাড়িতে এসেছেনও দু-একবার। বাবা না হোক আমার ঠাকুরদার কল্যাণে খুব একটা এখানে জলে পড়ে যাব না। 

বিশাল বারান্দা। এখানেও সেই নানা কারুকাজ করা চেয়ার টেবিল। সিলিংয়ে ফ্যান। অজস্র ছবি দেয়ালে। সবই ম্যানেজার সাহেবের বোধহয়। কখনও শিকারীর বেশে, কখনও সভাপতির বেশে। হরেক রকম বেশভূষায় নিজেকে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছেন। যেন বারান্দায় উঠেই মানুষজন সতর্ক হয়ে যায় কত বড় মাপের মানুষ তিনি। একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল দারোয়ান। তারপর ফ্যান চালিয়ে দিলে কেমন স্বস্তি বোধ করলাম। মুশকিল হল, টিউশনি সেরে বাড়ি গেলে, মা এবং বাবার এমন কি পিলুরও কত রকমের খবর জানবার যে আগ্রহ জন্মাবে। একজন ম্যানেজারের বাড়িতে কি কি থাকে, কি ভাবে কথাবার্তা হয়, কেমন তার আচরণ সব জানার জন্য বাবা মা নানা প্রকারের প্রশ্ন করে ঠিক ব্যতিব্যস্ত করে তুলবেন। মেঝেটাও কী মসৃণ। টাইল বসানো। লাল হলুদ ফুলের কঙ্কা আঁকা। আমি যে বসে আছি তারও প্রতিবিম্ব ভাসছে মেঝেতে। চক্‌চকে, যেন আর একখানা বিশাল আর্শি। যতবার খুশি এবার নিজেকে দেখে নাও। পায়ে স্যাণ্ডেল। খুব চক্‌চকে নয়। দু-চার জায়গায় সেলাই খেয়েছে। মেঝের পক্ষে আমি এবং আমার স্যাণ্ডেল দুই বেমানান। ততক্ষণে চিরকুটটি ভিতর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ধুতি পরা, ফতুয়া গায়, টাক মাথা, বেঁটে একজন বৃদ্ধ আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, নরেশ পাঠিয়েছে? 

—আজ্ঞে হ্যাঁ। 

—আমার সঙ্গে এস। 

একটা ঘর পার হয়ে পাশের ঘরে ঢুকে গেলাম। এই ঘরটায়ও বড় বড় সব ছবি। সবই ম্যানেজারের। ছবিতে তিনি বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোথাও টেনিস হাতে কোথাও কোন সাহেবের পাশে তিনি দাঁড়ানো। সাহেবের সঙ্গে তাঁর করমর্দনের ছবিটা ধরে রাখা হয়েছে বেশ গর্বের সঙ্গে। অর্থাৎ এ বাড়ির মানুষজন যে সে ঘরানার নয় ছবিগুলি টাঙিয়ে রেখে তার প্রমাণ রাখার চেষ্টা চলছে। 

—তুমি এবারে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছ? 

আজ্ঞে হ্যাঁ। অবশ্য বলতে ইচ্ছে হল, নরেশ মামা আপনাকে বলেনি কিছু? কিন্তু কুড়ি টাকার টিউশনি সোজা কথা না! কোন বাঁকা কথাই চলবে না কুড়ি টাকার টিউশনি রাখতে হলে। একজন ম্যানজারের পক্ষেই সম্ভব কুড়ি টাকা দিয়ে একজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ করা। বাবা হাবে-ভাবে এসব অনেক আগেই আমাকে শুনিয়ে রেখেছেন। শুধু আমাকে কেন, বাড়ির সবাইকে। বাবার সবটাই সর্বজনীন ব্যাপার। বিষয়টা, বাড়িতে যে এসেছে তাকেই কদিন ধরে বোঝানোর কাজ চলছে বাবার। আমার শুনে শুনে এর গুরুত্ব উপলব্ধি ঘটেছে। ফলে বাড়তি কথা না বলে, শুধু আজ্ঞে আজ্ঞে করে যাচ্ছি। 

—কলেজে হেঁটে যাও? 

—আজ্ঞে না। 

—কিসে যাও তবে?

—সাইকেলে। 

তিনি বললেন, ভাল। 

সাইকেলে যাই না, হেঁটে যাই এমন বেয়াড়া প্রশ্ন কেন বুঝলাম না। হেঁটে গেলে কি পত্রপাঠ বিদায় করে দিতেন। তা দিতেই পারেন। বাড়ি থেকে চার মাইল হেঁটে কলেজ ঠেঙিয়ে ফিরে এসে আবার এক ক্রোশ পথ হেঁটে ম্যানেজারের মেয়েদের পড়ানো চলে না। কুড়ি টাকা যে দেয় সব জেনে শুনে নেবার তার হক থাকতেই পারে। 

আমাকে বসতে বলে বললেন, কোন্ ডিভিসনে পাশ করেছ। 

আজ্ঞে এখনও পাশ করিনি। 

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছো বলছ, পাশ করনি মানে। 

আজ্ঞে ম্যাট্রিকের কথা বলছেন? ঢোক গিললাম। 

আর এ সময়েই হৈ হৈ করে দুই বালিকার প্রবেশ। দাদু তুমি জান, বাবা না, এত বড় দুটো পাখি শিকার করে এনেছে! ওরে বাবা, কত বড় চকা পাখি। মুরগির মতো দেখতে। পেটটা না সাদা। এস না, এস দেখবে। তারপর আমাকে দেখেই কিঞ্চিৎ চোখ উপরে তুলে দুজনেরই সহসা প্রস্থান। 

মনমোহন চৌধুরী বিগলিত হাসলেন এবার—এই আমার দুই নাতনি। ভূপাল ভোর রাতে গঙ্গার চরে গেছিল পাখি শিকার করতে। অব্যর্থ হাত। পাখির মাংস বড় নরম। সুস্বাদু খেতে। তুমি কখনও পাখির মাংস খেয়েছ? 

—আজ্ঞে না। খরগোশের খেয়েছি। তা একবারই। আর খাওয়া হয়নি। বাবা বলেন, সজারুর মাংস নাকি খুব খেতে ভাল। তবে আমরা খাই নি। 

তিনি বোধহয় আমার এত কথা শুনতে আগ্রহী নন। আসলে আমিই চাইছি ফের তিনি ডিভিসনের কথায় না এসে পড়েন। কারণ তিনি কৃতী পুত্রের জনক। দেশ বাড়ি ছেড়ে তিনিও এ দেশে এসেছেন। তবে আমার বাবার মতো লোটাকম্বল সার করে নয়। তাঁর পুত্র যে কত কৃতী এবং তার জন্য তাঁর কত গর্ব পাখি শিকার দিয়েই সেটা শুরু করেছেন। অব্যর্থ হাত বলে শেষ করলে বাঁচতাম। কিন্তু তিনি এখানেই বোধহয় থামবার পাত্র নন। বললেন, দুই নাতনির ইচ্ছা ডাক্তারী পড়বে। ইংরাজির উপর একটু বেশি জোর দেবে। ছোটটির মাথা খুবই পরিষ্কার। বড়টি পড়তে চায় না। তা এ বয়সে সবাই এক-আধটু ফাঁকি দেয়। দেবেই। ভূপালেরও ইচ্ছে মেয়েরা ডাক্তার হোক। এখানে ভাল ডাক্তারের অভাব। নরেশ বলল, তার হাতে ভাল ছেলে আছে। পড়াশোনায় খুব ভাল। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। এতেই আমার মনে ধরে গেল। তোমার বাবা কি করেন? 

বাবা কি করেন এমন প্রশ্ন আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। বাবার কাজটা আমার কাছে খুব সম্মানজনক মনে হয় না। যজন যাজন বললে, শুধু যে বাবাকেই তাঁরা খাটো চোখে দেখবেন না, সঙ্গে আমাকেও তার দায় বহন করতে হবে—অভাবী পিতার সন্তান এমন কেউ ভাবুক বিশেষ করে দুই বালিকা, ঠিক বালিকা একজনকে বললেও অন্যজনকে বলা চলে না, শ্যামলা রঙ, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, লম্বা ফ্রক হাঁটুর নিচে নামানো এবং এ বয়সে ফ্রক পরা অবস্থায় একজন তরুণী এমন তরুণ অর্বাচীন গৃহশিক্ষকের কাছে বসে থাকলে অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে, বলি কি করে। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। না বলে দেখছি পার পাওয়া যাবে না। সমস্ত রাগ নরেশ মামার উপরে গিয়ে পড়ছে। কোথায় বলবেন, তোমার বাবা কেমন আছেন, তোমরাও ত আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হও, তোমাদের বাড়ির আম কাঁঠাল যে না খেয়েছে সে জানেই না, পৃথিবীতে এত রকমারি আম কাঁঠাল থাকতে পারে-সে সবের মধ্যে না গিয়ে বাবা কি করেন জানতে চাইছেন। একবার বলতে ইচ্ছে হল বাবা হাতি বেচাকেনা করেন। আসলে বাবা কি কাজ করলে মর্যাদা রক্ষা হবে এটাই এখন মাথায় আসছে না। একজন পিতৃদেব তাঁর সন্তানকে এ হেন বিপদের মধ্যে ফেলে দিতে পারেন আমার দুরবস্থা না দেখলে কারো মাথায় আসবে না। 

—আজ্ঞে কিছু করেন না। 

–কিছু না করলে চলে কি করে? 

—আজ্ঞে চলে যায়। 

আর তখনই আবার ছোট নাতনি হাজির।—দাদু এস না। দেখবে না! 

তিনি ওঠার সময় হাতের তাগাতে রুদ্রাক্ষটি স্বস্থানে আছে কিনা যেন পরখ করে দেখলেন। অর্থাৎ পাখি শিকার করে পুত্র ফিরে এসেছে এটা তাঁর কাছে বড় একটা স্বস্তি। রুদ্রাক্ষটি বোধহয় তাঁকে সাফল্যের চূড়ায় তুলে দিয়েছে। এটি ঠিকঠাক আছে কি না অভ্যাসবশত দেখা। ঠিক থাকলে, সংসারের চাকা ঠিক মতো গড়াবে। খানাখন্দে পড়ে হোঁচট খাবে না। 

মুশকিল হল, একজন গৃহশিক্ষক বাড়িতে উপস্থিত হলে ছাত্রছাত্রীর মনে চাঞ্চল্য কিংবা ভয় ভীতি যাই হোক অথবা কৌতূহল অন্তত একটা কিছু থাকা দরকার। এদের দুজনের দেখছি কিছুই নেই। আমরা কলোনিতে থাকি এমন খবর ওরা নিশ্চয়ই পেয়েছে। কলোনিতে তাদের গৃহশিক্ষক থাকে কিনা এই প্রশ্নে ঘোর আপত্তিও উঠতে পারে তাদের মধ্যে। তবু যখন আমার নিতান্ত পুণ্যফলে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে তখন আমার প্রতি কিঞ্চিৎ হলেও সম্ভ্রম দেখান দরকার। ওদের চোখে মুখে তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। ঘরটাতে কেউ নেই। ম্যানেজার মানুষটি একবার উঁকি দিয়ে দেখলেও না কে বসে আছে, কেন বসে আছে। আমরা ত অন্যরকমের। কেউ বাড়ি এলে ঘিরে ধরার স্বভাব। উকি দেবার স্বভাব। মা মায়া পুনু পিলু কেউ বাদ যাবে না। 

দেয়াল-ঘড়িতে পেণ্ডুলাম দুলছে। সব বড় বেশি ঝকঝকে। দেয়ালে একটা দাগ নেই। সংসারে কোন দাগ লেগে থাকুক এরা বোধহয় পছন্দ করে না। এমন কি মেঝেতে সুন্দর কারুকাজ করা কার্পেট পাতা। একটা ছোট গোল টেবিলের উপর রজনীগন্ধার ঝাড়। ঘরে ভারি সুগন্ধ। আমি কি করি আর— খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছি। মেঝের কিউবিকগুলি, কখনও চৌকোনো, কখনও পাশা খেলার ঘুঁটি হয়ে যাচ্ছে। সামনে জানলা, পরে পুকুর, – তারপর টিনের লম্বা প্ল্যাটফরমের মতো সারি সারি ঘর। কেমন ঝমঝম শব্দ হচ্ছে অদুরে। তাঁত চলছে। 

কিছুক্ষণ এ ভাবে একা বসে থাকার পর ভিতরটা কেমন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল, উঠতেও পারছি না। চলে যেতেও পারছি না। যদিও এ অবস্থায় যে কোন সুস্থ মানুষের উঠে পড়া স্বাভাবিক। ভেতরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কে যেন বলল, কলোনির লোক। দাদু আর লোক পেল না। তবে নারী কণ্ঠস্বর নয়। তাহলে সবই যেত। যাদের পতার কথা তারাই যদি কলোনির লোক বলে, তবে আর ইজ্জত থাকে কি করে! খুবই অবজ্ঞার সামিল। 

যাবার সময় দাদুর বলে যাওয়া উচিত ছিল, বোস। ওরা আসছে। আর পছন্দ না হলেও বলা উচিত ছিল, পরে কথা বলব নরেশের সঙ্গে। বেকুফের মতো এ ভাবে কেউ কাউকে বসিয়ে যবনিকার অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে যায়। লোকটা একা মঞ্চে চুপচাপ বসে থাকলে দর্শকরা হাসাহাসি করবে না! এমন কি ঢিলও ছুঁড়তে পারে। একটা সূত্র থাকবে তো, পরের ঘটনা কি ঘটবে না জানলে চলে। কেন জানি মনে হল, আমি বসে থাকলেও খুব অরক্ষিত অবস্থায় বসে নেই। অন্তরালে এমন গোপন কোন স্থান আছে যেখান থেকে আমি কি করছি না করছি সব দেখা যায়। নিরাপত্তার খাতিরে তারা নিশ্চয়ই ব্যবস্থাটা পাকাপোক্ত করে রেখেছে। টেবিলের কলম দানিতে বেশ দামী কলম। নেড়ে চেড়ে দেখার শখ হলেও হাত দিতে সাহস পাচ্ছি না। একেবারে অতীব সজ্জন সাধুর মতো মুখ করে বসে আছি। আর ভিতরে দাঁত কটমট করছি। 

এ সময় সেই মহামান্য বৃদ্ধ মানুষটি ফের এসে বললেন, ওরা খাচ্ছে। তুমি বরং কাগজটা দেখ।

 যাক, কিঞ্চিৎ সম্ভ্রম বোধ তবে জন্মেছে। 

—শ্যামাপ্রসাদ শুনছি কলোনিতে আসবেন।

–তাই নাকি? 

আমার অবাক হওয়া দেখে বুড়ো মানুষটি ঘাবড়ে গেলেন। তারপর বললেন, শ্যামাপ্রসাদ কে জান? 

—আজ্ঞে জানি। স্যার আশুতোষের ছেলে। 

—বেশ তবে খবর রাখ দেখছি। হিন্দু মহাসভার মিটিং হবে কলোনিতে। আমরা তাড়া খেয়ে এসেছি। এ দেশ থেকেও তাড়া দিয়ে ওদের খেদাতে হবে। 

কেন এ কথা বলছেন, বলতে ইচ্ছে হল। ওদের বলতে রহমানদা-দের কথা হচ্ছে। খেদাতে হবে। খেদানোর ইঙ্গিতটি বেশ তিক্ত শোনাল আমার কাছে। কোন কথা বললাম না। 

এবার তিনি টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। গুরুজন, তাছাড়া আমার পিতৃদেবের আবদার, এঁরা তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সুতরাং সম্মান দেখাতে হয়। নিজেও উঠে দাঁড়ালাম। তিনি প্রথমে দশম শ্রেণীর ইংরাজি বইটা আমার সামনে খুলে ধরে বললেন, লুসি কবিতার সহজ ইংরাজিতে একটা সাবস্ট্যান্স লিখে রাখ-এই খাতায়। বেশ ভাল করে। আমার নাতনি যেন দশে অন্তত আট পায়। নোট তো আর দশ রকমের পাওয়া যায় না। এম. সেন না হয় জে. এল. ব্যানার্জী। সবাই ঐ মুখস্থ করে লেখে। আমি চাই আমার নাতনির সারমর্ম একেবারে নাতনির মতোই হবে। কেউ আর তার মতো লিখতে পারবে না। 

লুসি কবিতা আমার পড়া আছে। এম. সেনের নোট সর্বস্ব আমার পড়াশোনা অবশ্য এখন কিছুই মনে পড়ছে না। বড়ই গোলমেলে ঠেকছে সব কিছু। সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে দশম শ্রেণীর লুসি কবিতার সারমর্ম বিদেশী ভাষায় লেখা সম্ভব কি না একবার বুড়োমানুষটিকেই প্রশ্ন করে জানতে ইচ্ছে হল। এবং আমি বেশ ঘামছি। কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠছে, কিন্তু কুড়ি টাকা—মার হিসেবে এক মণ চাল হয়ে যায়। বাবার সংসারে এটা কত বড় সুরাহা এরা তা বুঝবে না। পাতা উল্টে অন্য কি আর কবিতা এবং গদ্য আছে দেখছি। আসলে ভান করছি—এই লেখা শুরু হল বলে। তিনি ততক্ষণে ফের আরও দুটি বই টেনে, তার প্রশ্নোত্তর লিখে দিতে বলে আজকের মতো নিষ্ক্রান্ত হলেন। পরের প্রশ্নগুলি আমার পক্ষে খুবই সহজ। বিষয় বাংলা এবং ভূগোল। খাতায় যত্ন করে উত্তর লিখে, অন্য একটি কাগজে লুসি কবিতা টুকে পকেটে গোপনে পুরে ফেললাম। এবং দেখলাম ঘড়িতে নটা বাজে। ছাত্রীদের দেখা নেই। মুখ তুলতেই দেখি আবার রুদ্রাক্ষ জড়িত মহামান্য সফলকাম ম্যানেজারের পিতৃদেব হাজির। মনে মনে মহামান্য সফলকামই মনে হল দাদুকে। টেবিলের কাছে কোঁচা দুলিয়ে এলে, খাতা দুটো এগিয়ে দিয়ে বললাম, হয়েছে। লুসি কবিতা সম্পর্কে বললাম, বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে আসব। 

—ঠিক আছে তাই নিয়ে এস। অর্থাৎ এবার আমি যেতে পারি। ছাত্রীরা এ মুখো হলই না। ঠিক বুঝলাম না, পড়াশোনা ওদের সরাসরি না, বুড়োর মাধ্যমে। এর আগেও দুজন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল— তারা তিষ্ঠোতে পারে নি। আমি তিন মাসের মধ্যে তৃতীয়। তৃতীয় গৃহশিক্ষক ঘর থেকে বের হলে মহামান্য সফলকাম দরজাটি অতি সযত্নে বন্ধ করে ফেললেন। আমি একা, কেমন এক নির্জন ভূখণ্ডের মানুষ, বাইরে এসে হাওয়া লাগতেই ঘাম শুকিয়ে গেল। কলার টেনে নিজেকে সাইকেলে করে নরেশ মামার কাছে। বললাম, মামা হবে না। 

—হবে না কেন রে! 

সব শুনে বললেন, মনমোহনদা কি ভাবে নিজেকে বুঝি না! আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে এই হয়। কি করবি। টাকাটা তো দরকার। কবিতাটা রেখে যা, আমি সারমর্ম লিখে রাখব। এই করে চালিয়ে যা, দ্যাখ কি হয়। 

বাড়ি এলে মা বলল, ম্যানেজার তোর সঙ্গে কথা বলল, প্রণাম করলি। 

আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল মা’র কথায়। কিছু বললাম না। 

মেজাজ আমার খুবই অপ্রসন্ন। মানুষ এমন হয় এর আগে আমি জানতাম না, ব্যবহার এমন হয় জানতাম না। কেমন যেন বলতে গেলে অপমানিত হয়েই ফিরে এসেছি। সফলকাম মহামান্য আমাদের কলোনির লোক ভেবে বড় বেশি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। মা’র প্রশ্নে আরও বেশি রুষ্ট হয়ে উঠেছি। আমি কথা বলছি না দেখে উঠে এল। বলল, কিরে ম্যানেজার তোর সঙ্গে কি কথা বলল! 

—কথা বললে কি হাতি-ঘোড়াটা হবে মা! 

আমার এমন তিক্ত জবাবে মা হতভম্ব হয়ে গেল। 

মা কেমন কাঁচুমাচু গলায় বলল, না ভেবেছিলাম দেশের লোক। তোদের লতায় পাতায় আত্মীয়ও হয়। তোর বাবার কথা যদি কিছু বলে। 

কেন জানি মা’র অসহায় মুখ দেখে আমার আর রাগ থাকল না। মা যাতে খুশি হয় সে ভেবেই জবাব দিলাম—বলেছেন বাবা কেমন আছে। কতদিন দেখা হয় নি। একবার যেতে বলেছেন। পরেই ভাবলাম, না যেতে বলেছেন বলা ঠিক হবে না। কারণ বাবা জানতে পারলে, সপরিবারে বেরিয়ে পড়বেন মিলের উদ্দেশে। একটু ঘুরিয়ে বললাম, যেতে বলেন নি ঠিক, গেলে খুশি হবেন এমন বলতে চেয়েছেন। আরে এ তো বাবার পক্ষে আরও মারাত্মক খবর। গেলে খুশি হবেন যখন, তখন মানুষের আশা আকাঙক্ষা রক্ষা করতেই হয়। শেষে না পেরে বললাম, ওরা বড়লোক মা। আমরা কারা, বাবা কে, কোন খোঁজ-খবরই আর ওদের দরকার নেই। পড়ানো নিয়ে কথা, বাবা বাজার করে তখন হাজির বাড়িতে। বারান্দায় থলে রেখে বললেন, মনোমোহন কাকাকে বললি না বেড়িয়ে যেতে। সবাইকে প্রণাম করেছিস তো? 

—তুমি থাম তো বাবা। তোমার মনোমোহন কাকা আর কাকা নেই—এমন বলার ইচ্ছে। হলে কি হবে, বাবাকেও এসব আর বলা যায় না। বললাম, আসবেন বেড়াতে। বৌমা সহ। নাতনিদের সহ। 

আসবেন না মানে! আমাদের বাড়ি এলে তো যাবার নাম করত না। না এসে পারে। তোকে কি খেতে দিল। 

—লুচি সন্দেশ বেগুনভাজা পরোটা রসগোল্লা। 

—লুচি পরোটা দু’রকমেরই দিল। 

—আরও কয়েক রকমের দিতে চেয়েছিল, আমি নিইনি। পেটে না ধরলে খাই কি করে! 

মায়া বলল, দাদা আমি তোর সঙ্গে যাব একদিন। 

—যাস। বলে আর দাঁড়ালাম না। সাইকেলটা নিয়ে জীবনের সব অপমান থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত বাদশাহী সড়কে উঠে গেলাম। রোদে ঘুরলাম। মাথাটা দিয়ে আগুন ছুটছে। ছুটুক। তবু আজ যত খুশি রোদে টো টো করে ঘুরব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *