প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মৃন্ময়ী – ১০

দশ 

পরী কালীবাড়ি যাবার রাস্তাটায় ঢুকে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। আমরা পাশাপাশি দু’জন সাইকেল চালিয়ে এসেছি। দু’জনের মধ্যে একটা কথাও হয় নি। হবার কথাও নয়। 

শহরটা কেমন ক্রমেই ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে। শহরের ভেতর নিরিবিলি সাইকেল চালিয়ে আসা কঠিন। সরকারি খামারের পাশে এসে পড়লে দু-পাশে মাঠ দেখা যায়। রিকশা কিংবা মানুষের চলাচল কম বলে, খামারের পাশ দিয়ে আসার সময় ইচ্ছে করলে আমরা দু’জনে দু-একটা কথা যে বলতে পারতাম না তা নয়। তবু কেমন আমরা দু’জনেই নিজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। 

ডুবে ছিলাম বললে ঠিক হবে না। আসলে পরীর কথা আমি ভাবছিলাম। আমার কথা পরী ভাবছিল। 

পরী এ-ভাবে অকপটে কথাটা বলতে পারবে ভাবিনি। ও যত অকপটে বলেছিল, আমি তার চেয়ে আরও সহজে জবাব দিতে পেরেছি। এটা কী করে বুঝি না! আমার তো জ্বালা হবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য যেন এমন কোনো ঘটনাই নয় এটা। আর দশটা স্বাভাবিক ঘটনার মতোই পরীর বিয়ে হবে। এতে অবাক হবার কী আছে! 

আমার মধ্যে আসলে ঘটনার প্রতিক্রিয়া শুরু হয় অনেক পরে। এই যে সাইকেল চালিয়ে পাশাপাশি এসেছি, পরী একটা কথা বলেনি আমি একটা কথা বলিনি, দেখলে মনে হবে কেউ কাউকে আমরা চিনি না। এখন বুঝতে পারছি পরীর কথাগুলিই আমাকে এতক্ষণ ভাবিয়েছে। 

শুধু পরী কেন, তার দাদুর কথাও। 

যেন একটা সামান্য কথা জীবনে এমন মারাত্মক আলোড়ন তুলবে তখন যেন টেরই পাইনি। কত অনায়াসে বলতে পেরেছিলাম, হ্যাঁ, তা একটু হবে। 

পরী কেমন বিস্ময়ে চোখ তুলে দেখছিল। অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিল আমার মুখের দিকে। তারপর মাথা নিচু করে বলেছিল? একটু হবে? 

আমি হেসে ফেলেছিলাম। এখন ভাবছি, এমন কথা শোনার পর কেউ হাসতে পারে! আমি মানুষ! অথচ কত অনায়াসে বলেছি, বেশি হলে তোমার ভাল লাগবে? 

কালী বাড়ির রাস্তায় ঢুকেও আমরা কথা বলতে পারি নি। সাইকেল থেকে নেমে পরীর কথাও যেন আমার কানে যায় নি। কিংবা এতক্ষণে যেন মনে করতে পারছি পরী লক্ষ্মী সম্পর্কে কী একটা মন্তব্য করেছিল। কী বলেছিল পরী! আমার মাথায় কী কোন গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে! বেচারা লক্ষ্মী। এমন কিছু বলেছিল। যেন এক দূর অতীত থেকে কথা ভেসে আসছে। 

এই পথটা আমার চেনা কত কালের। এই রাস্তায় কিছু ইতস্তত বাড়িঘর উঠেছে। শহর ছাড়িয়ে রেল-লাইনের পাশে বেশ নির্জন জায়গা। সকালের রোদ গাছের মাথায় উঠে এসেছে। পরী লাল রঙের সৌখিন লেডিজ সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তার কালীবাড়িতে বাবাঠাকুরের কাছেও যাবার ইচ্ছে নেই। আমাকে তার একা পাওয়া দরকার। একা পাওয়া দরকার তাই বা মনে করছি কী করে। বললাম, কী হল! যাবে না! 

—ভাবছি। 

—ভাববার কি হল! 

—ভাবছি আমি একাই যাব। দু’জনে গেলে ভাববে, তুমি আমার গেরো। তাই বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইছি, তিনি বুঝতে পারবেন। 

—না গেলে বুঝি বুঝতে পারবেন না। 

—কী করে বুঝবেন! 

—কেন তোমাদের পরিবারে তিনি তো অন্তর্যামী। তোমার দাদু যে আমাকে নিয়ে ফ্যাসাদে পড়েছেন, নিশ্চয়ই চোখ বুজলে টের পান বাবাঠাকুর—আমি গেলেও টের পাবেন, না গেলেও টের পাবেন। 

হাওয়া দিচ্ছিল। শরৎকাল এসে গেছে, ঠান্ডা আমেজ। পরীর রেশমের মতো ববকরা চুল উড়ছিল। সাদা সিল্ক পরনে। আঁচল একটু হাওয়াতেই খসে পড়ছে। পরী শাড়ী ঠিকঠাক করতে করতে বলল, দাদুকে ঠেস দিয়ে কথা বলছ কেন? বয়স হলে হয়। বৈভব থাকলে এটা আরও বেশি হয়। আমার দাদুর দুটোই আছে। তার একজন বাবাঠাকুর না থাকলে নির্বিঘ্নে বাঁচবেন কী করে! বাবাঠাকুর যে অন্তর্যামী নন, সেটা তুমিও বোঝো আমিও বুঝি। তুমিও কম প্রিয় নও বাবাঠাকুরের। তুমি একা গেলেই হত। কত করে বলেছি, যাও নি। আসলে তুমি স্বার্থপর। পরের জন্য কিছু করার দায় তোমার থাকবে কেন! 

আমি স্বার্থপর। পরী যেন ঠিকই বলেছে, স্বার্থপর না হলে কালীবাড়ি ছাড়ার পর একদিনও যাইনি কেন! কতবার বাবা বলেছেন যা একবার বাবাঠাকুরের কাছে। তাঁর অসীম করুণা না থাকলে চাকরিটা হত? মুকুলের জামাইবাবু উপলক্ষ্য মাত্র। 

বাবাকেও দেখেছি, কালীবাড়ির সেই আধ ন্যাংটা সাধুর প্রতি একটা অসীম ভরসা আছে। বাবা একদিন বলেছিলেন, বদরিই বা কী না ভাবছে। কালীবাড়িতে বদরি থাকতে না দিলে কী করে পড়তিস। বৌমাও তোকে পুত্রস্নেহে লালন করেছে। তোর ছাত্ররাই বা কী না ভাবছে। না বলে না কয়ে সেই যে চলে এলি, আর গেলি না। লক্ষ্মী অপঘাতে মারা গেল, এটা তার নিয়তি। তোর যে কী হয়! সংসারে নিজেকে নিয়ে কেবল ভাবলে চলে না। এতে জীবনের মন্দ দিকটাই ফুটে ওঠে। 

আর পরী তো বলবেই, যে বার বার বলেছে, এ বিয়ে একমাত্র ভেঙে দিতে পারেন বাবাঠাকুর। তুমি তো জান বিলু, দাদুর শেষ ভরসা বলতে তিনি। তিনি হ্যাঁ করলে হবে, না করলে হবে না। বাবাঠাকুর কত আক্ষেপ করেছে, বিলুটা সেই যে গেল আর এল না। ওর হয়েছেটা কী! 

কী হয়েছে বোঝাই কী করে। কালীবাড়ির রাস্তাটা শহরে যেতে আসতে পড়ে। ভিতরে ঢুকে আধ মাইল খানেক রাস্তা পার হলে গভীর বনজঙ্গলের মধ্যে মন্দির, বটতলা, সেবাইত, বদরিদা’র ঘরবাড়ি। খুবই নির্জন। মন্দিরের পিছনে বিশাল ঝিল। ও-পারে যতদূর দেখা যায় শুধু বাঁশের জঙ্গ ল। মন্দিরের সামনে রেল-লাইন, দু-পাশে যতদূর দেখা যায় শুধু আমের বাগিচা। রোজ শহরে যাই আসি। অপরূপা কাগজ বের করি। ইস্কুল করি, মুকুল, নিখিল, নিরঞ্জনের সঙ্গে আড্ডা দিই। 

রাস্তায় জড়বৎ দু’জন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকের চোখে পড়ারই কথা। কেউ আমরা কথা বলছি না। যেন কালীবাড়ির রাস্তায় ঢুকে আমাদের দু’জনেরই মনে হয়েছে, পথ ভুল করেছি। 

শহরের লোকজন পরীকে চেনে না, এমন কেউ আছে আমি জানি না। এই সেই মেয়ে—এখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবকের সামনে। দু’চারজন যুবক থাকবে, এটাও তাদের কল্পনার বাইরে নয়। দঙ্গল নিয়ে পরীর ঘোরার অভ্যাস। কারো হাতে ফেস্টুন, কারো হাতে পোস্টার। পরী দাঁড়িয়ে আছে, ওরা পোস্টার মারছে। 

পরীর আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক না। অস্বাভাবিক আমার হাতে কোনো ফেস্টুন নেই, কোনো পোস্টার নেই। পরী যে আজ মাসখানেক হল বড়ই বিপাকে পড়েছে কেউ জানে না। এমন কী আমাদের অপরূপা কাগজের কবি লেখকরাও না। এজন্যে পরী আমাদের অস্থায়ী কাগজের অফিসে আসতে পারছে না কিংবা তাকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। 

আমার কিছুই ভাল লাগছে না। 

পরী বলল, এস হাঁটি। 

আমরা দু’জনে পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। মনে হয় পরী কোনো নির্জন জায়গায় আমাকে আজ নিয়ে যেতে চায়। পরীর দাদু আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল কেন জানতে চাইতে পারে। পরীর দাদু যে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছে আমার খোঁজে, সেটা শুনলে আরও হতবাক হয়ে যাবে। পরী আর শ্রীময়ী থাকবে না। ওর লাবণ্য ঝরে পড়বে সহসা, সে কঠিন রুক্ষ গলায় বলবে, বিলু তোমার আত্মসম্মান বোধটুকুও গেছে। তুমি ফাঁদে পা দিলে। তোমার কাছে চাকরিটাই বড়। অপরূপার জন্য আমার এত খাটাখাটনি তুমি এক দণ্ডে বিসর্জন দিতে পারলে। তোমার কষ্ট হল না? 

যেতে যেতে পরী বলল, কী, কথা বলছ না কেন? 

—তুমিও তো কথা বলছ না। 

—আমার আবার কথা কী। 

—তোমারই তো কথা। 

—না। আমার কোনো কথা নেই। তুমি জেনে রাখ আমি রাজি না হলে কারো ক্ষমতা নেই কিছু করে। 

—তবে তুমি এত ভেঙে পড়েছ কেন? 

ভেঙে পড়েছি তোমার কথা ভেবে। দাদুকে আমি জানি। বলেই পরী কী বলতে গিয়ে থেমে গেল।

—কী জান? 

—দাদুর আত্মসম্মানে লেগেছে। একটা রিফুজি ছেলে তার বনেদি পরিবারে ঝড় তুলে দেবে তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। পরেশচন্দ্রকে আমি সোজা বলে আসতে পারি আমাদের বাড়ি ফের গেলে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব। 

—তা তুমি পার, বিশ্বাস করি। তবে আমি তা চাই না। পরেশচন্দ্র ভাল মানুষ। তোমার রূপে সে মজেছে। অপরূপার জন্য সেও কম করছে না। 

—করছে, আমি আছি বলে। 

—কেন ওর কবিতা! 

—ও তো আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য! ওটা পরেশের ছলনা। 

—আগে লিখত না? 

—জানি না লিখত কি না। 

আমি এবারে হেসে দিলাম। বললাম, সত্যি তোমাকে সে ভালবাসে পরী। দেখতেও খারাপ না। তাছাড়া শুনেছি, বিয়ে হয়ে যাবার পর ক্লাশ করতে পারবে। পড়ায় বাধা দেবে না। ওর বাবা তোমার দাদুকে কথা দিয়ে গেছে। 

—বিলু! 

দেখলাম পরীর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ওর ভেতর এতদিন অস্থিরতা কাজ করেছে, অর্থাৎ কী করবে ঠিক করতে পারছিল না, কারণ পরী তো তার দাদুকে নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসে। তার বাবা কাকারাও কম না। সবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস যেন তার এতদিন ছিল না। আজ তাদের হলঘরে আমার হাহাকার হাসি শুনে সে ঠিক করে ফেলেছে সব। কেন যে মনে হল বাবাঠাকুরের কাছে যাবে বলে বাড়ি থেকে যে পরী বের হয়ে এল, এটা তার আর এক ছলনা। 

বললাম, পরী অবুঝ হবে না। তোমার দাদু ভাল চান তোমার। তাকে আর যাই কর, ছলনা কর না। আমি তার কষ্ট বুঝি। আমি সত্যি দেখছি তোমার মাথাটি খেয়েছি। 

পরী কিছু বলল না। আমার দিকে শুধু একবার আড়চোখে তাকাল। এই তাকানো আমাকে এত দুর্বল করে দেয় যে আমি আর নিজের মধ্যে ঠিক থাকি না। কেমন উতলা হয়ে পড়ি। পরীর চোখে এত ধার আছে, এর আগে যেন আর টের পাই নি। 

পরী সামনের খোলা একটা মাঠের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ল। পাশের একটা আমগাছে সাইকেলটা তার দাঁড় করানো! পরী আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এই রাস্তার পাশে খোলা মাঠে পরীকে নিয়ে বসে থাকতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। কারণ এই রাস্তায় রিকশার চলাচল আছে। মানুষজনেরও। দুপুর না হোক, শরতের এই না দুপুর না সকাল এমন একটা অসময়ে যে কোনো নারীকে সামনে নিয়ে বসে থাকতে অস্বস্তি হয়। পরীর না হতে পারে আমার হয়। আমি তো পার্টি করি না, যে গণসংযোগ করতে বের হয়ে পড়েছি, ক্লান্ত হয়ে পার্টির কোনো কর্মীকে নিয়ে গাছতলায় বিশ্রাম নিচ্ছি। 

রাস্তায় দাঁড়িয়েই বললাম, কালীবাড়ি তা হলে যাচ্ছ না। 

পরী জবাব দিল না। 

পরীর এই একগুঁয়েমি বড় বেশি আমাকে রূঢ় করে তোলে। কিন্তু আজ কেন যে তাকে একটাও রূঢ় কথা বলতে পারছি না। 

পরী বসে বসে ঘাসের ডগা ছিঁড়ছে। কার জেদ কত প্রবল সে যেন এখন যাচাই করতে বসে গেছে। আমার না তার। 

আমি আর পারলাম না। ওর পাশে গিয়ে সাইকেলে ভর করে দাঁড়ালাম। নিজেকে খুবই বুদ্ধ মনে হচ্ছে। কী বলব। তবু কথা না বললে, স্বাভাবিক না থাকলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠতে পারে ভেবে বললাম, তোমার দাদুকে বললেই পারতে বিলুকে নিয়ে বের হচ্ছি। কালীবাড়ি যাবে বললে কেন। কালীবাড়ি যাবে তো এখানে বসে থাকলে কেন। গাড়ি বের করতে বললেন, বললে কেন, না সাইকেলে চলে যাব। এ-সময় আমাদের দু’জনকে এভাবে দেখলে লোকেই বা কী ভাববে! তোমার দাদুর কানে উঠলে তিনিই বা আমার সম্পর্কে কী ভাববেন। ফুসলে বের করে এনেছি এমনও ভাবতে পারেন। 

পরী নির্বিকার। যেন আমি দাঁড়িয়ে যতক্ষণ কথা বলব, ততক্ষণ সে একটা কথারও জবাব দেবে না।

এবার বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বললাম, কী বলছি শুনতে পাচ্ছ। 

পরীও পাগলের মত চিৎকার করে বলল, না, শুনতে পাচ্ছি না। 

এরপর আর কী করা যায়! পরীকে ফেলে বাড়ি চলে যেতে পারি। কেন যে সকালে মরতে পরীদের বাড়ি গেছিলাম! বাবা ঠিকই বলেন গ্রহ বিরূপ হলে এসব হয়। আমার গ্রহের অবস্থান ভাল না। বাবা আমাকে প্রায়ই বলেন, যেন সাবধানে চলাফেরা করি। 

কিন্তু বাবাই তো ঠেলে পাঠালেন। রায়বাহাদুর নিজে এসেছিলেন, তোমার যাওয়া উচিত। তোমার সার্টিফিকেটগুলো নিতে ভুলো না। নারায়ণের কৃপায় রেলে কাজটা হয়ে গেলে গ্রহ শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাবা গরীব বলেই ধর্মভীরু মানুষ। মানুষের সব কিছুতেই তিনি। তাঁর কৃপা না থাকলে কিছু হয় না। তাঁর কৃপা আছে বলেই শহরের এমন প্রভাবশালী মানুষ যেচে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে পচে মরি, তিনি চান না। 

তিনি কী চান, আমার চাইতে বাবা বেশি কী বুঝবেন। এ সময় বাবার উপর ক্ষোভে দুঃখে আমার চোখে জল এসে গেল। বড় প্রলোভনে ফেলে তিনি যে আমাকে দেশছাড়া করতে চাইছেন, বাবা যদি বুঝতেন! পরী কী তবে সব টের পেয়েছে। টের পেয়ে মরীয়া হয়ে উঠেছে। আমার সব ক্ষোভ পরীর উপর নিমেষে জল হয়ে গেল। সাইকেলটা পাশে রেখে মুখোমুখি বসলাম। একজন এতবড় ঘরের নারীর যদি অসম্মান না হয় আমার মতো গরীব বামুনের অস্বস্তির কী কারণ থাকতে পারে! 

বসে একবার আমিও আড়চোখে দেখলাম পরীকে। পরীর চোখে চোখ পড়ে গেল। পরীর দু চোখ জলে ভারী। পরী শুধু বলল, বিলু, তুমি আমার অহংকার। তুমি ভেঙ্গে পড়লে আমি দাঁড়াব কোথায়। বল দাদুর সঙ্গে তোমার কী কথা হয়েছে? কেন ডেকেছিলেন। তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্য তুমি হাত পেতে নিলে, আমার কষ্টের শেষ থাকবে না। বল, চুপ করে আছ কেন! 

আমি মাথা নিচু করে বললাম, পরী, পাগলামি কর না। আবার বলছি, তিনি তোমার ভাল চান। তুমি তাঁর কাছে মানুষ! তোমার ভাল হয়, এমন করে আর কেউ চাইতে পারে না! 

—বিলু! 

আমি চুপ করে গেলাম।। পরী তার দাদুর কোনো প্রশংসাই শুনতে চাইছে না। জেদি বালিকার মতো গোঁ ধরে আছে। 

আমরা দু’জনে আবার চপচাপ। স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছে। তার শব্দ কানে আসছিল। কেমন এক দূরাতীত শব্দের মতো ট্রেনটা এগিয়ে আসছে। ও-পাশের মাঠ পার হয়ে চলেও গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, আমরা দু’জনে গভীর কোনো নৈঃশব্দের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। আমার ভারি কষ্ট হচ্ছিল পরীর অসহায় মুখ দেখে। এক আশ্চর্য সুন্দর শ্রীভূমি যেন দৃশ্যের অন্তরালে উঁকি দিল। আমি আবার নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। বললাম, আমি উঠি পরী। স্কুলে যেতে হবে। 

উঠে পড়লে দেখলাম পরী একইভাবে মাথা গোঁজ করে বসে আছে। যেন আমার কথা তার কানে যায়নি। তার দাদু আমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন, কী এমন গুরুতর খবর যে সকালবেলায় তাদের প্রাসাদতুল্য বাড়ির হলঘরে হাজির হতে বাধ্য হলাম, না জানা পর্যন্ত পরী স্বস্তি পাচ্ছে না।

কিন্তু বুড়ো মানুষটার আর্ত মুখ চোখে ভেসে উঠতেই কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেলাম। এমন অসহায় মুখ আমি জীবনেও দেখিনি। যেন আমি বিলু লম্ফের মতো এক ফুঁয়ে তার জীবনের রোশনাই নিভিয়ে দিতে পারি। এখন আমার দরকার পরীকে স্বাভাবিক করে তোলা। কারণ তার চোখ মুখ বড় অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। বললাম, পরী শুনেছ, চৈতালী কলকাতায় চলে যাচ্ছে। 

পরীর কোনো আগ্রহ নেই চৈতালী সম্পর্কে। চৈতালীর প্রতি মুকুলের দুর্বলতা আছে জানে। দু- একবার পরী নিজেও চৈতালীকে নিয়ে মুকুলের সঙ্গে ঠাট্টা তামাসা করেছে। চৈতালী চলে গেলে মুকুল এই শহরে খুব একা হয়ে যাবে, এও জানে পরী। অথচ নির্বিকার। 

আমাকেই কথা বলতে হবে। ওকে এখন অন্যমনস্ক না করতে পারলে, আমি চলে গেলে অপমান বোধ করবে। আমার সামান্য স্কুলের চাকরিটা এমনিতেই ওর পছন্দ নয়। এ-নিয়ে দু-পক্ষই আমরা লড়ালড়ি করছি। আমি অন্তত ডিগ্রিটা নিই পরী এটা চায়। যেন পরী চায়, ও যতদিন কলেজে পড়ছে, ততদিন অন্তত পড়াশোনা চালিয়ে যাই। পরীর সঙ্গে আর কোথাও না হোক কলেজে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য দু’জনের মেশার সুযোগ থাকবে। পরী আমাকে তার নিজের মতো করে বড় করে তুলতে চায়। নিজের মতো তৈরি করে কোনো নিরুপম পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চায়। 

অথচ তার ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতাই নেই আমার। পরী কেন যে এটা বোঝে না। পরেশচন্দ্র মানুষটি মার্জিত বিনীত এবং ভদ্র। আমাকে তাঁর ব্যবহার মুগ্ধ করে। তাঁর বাংলোয় গিয়ে বসলে আমার গর্ব হয়। নীল রংয়ের বেতের চেয়ারে বসলে মনে হয় আমি এক রহস্যময় সমুদ্রের বাসিন্দা। কবিতা পাঠের আসরেই দেখেছি, কেমন তিনি কিছুটা সংকোচ বোধ করেন। কবিতার বাতিক না থাকলে তিনি আমাদের বড় দূরের মানুষ। দুর্বল কবিতা লেখেন। কবিতা পাঠের আসরে তিনি যখন কবিতা পড়েন আমরা কেউ কেউ মুচকি হাসি। একদিন পরীকেও দেখেছি হাসি সামলাতে না পেরে উঠে দৌড়ে ভিতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। পরীর উপর আমার সেদিন কী ক্ষোভ! বাইরে এসে পরীকে একা পেতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বলেছি, এ কী অসভ্যতা, সবার সব হয় না। তাঁর আন্তরিকতাকে ছোট করছ কেন! 

আসলে এইসব কবিতা পাঠের আসরে আমি পরীর হিরো। আমার কবিতা সবাইকে শোনাবার জন্যই যেন, এই মাসিক কবিতা পাঠের আসর। শুধু কবিতা পাঠই হয় না। গল্প প্রবন্ধ পাঠও হয়। আমরা অপরূপা কাগজের লেখক কবিরা এই শহরে অন্য এক অহংকার নিয়ে বড় হবার মুখে পরী যে আমাকে নিয়ে কোথায় যেতে চায় বুঝি না। মাঝে মাঝে মনে হয় পরীর পার্টি বিলাসের মতো আমিও তার এক ধরনের বিলাস। কোনো শিশুর খেলনার মতো। আর তখনই মনের মধ্যে পরীর বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মনে হয় এই কবিতার জগতে জোর করে পরীই আমাকে টেনে এনেছে। কবিতার ভূত মাথায় চাপিয়ে দিয়ে সে মজা দেখছে। মজা দেখতে দেখতে কখন সে ভেবে ফেলেছে আমার উপর তার আজন্ম অধিকার। অধিকার কেউ কেড়ে নিলে তাকে সে ক্ষমা করবে না। 

আমি হেসে বললাম, পরী তোমার ছেলেমানুষী আমার ভাল লাগছে না। তুমি উঠবে কি না বল। তোমার দাদুর কাছে কেন গেছি তোমাকে বলতে পারব না। কেন হা হা করে হাসছিলাম বলতে পারব না। 

আমি তো পরীকে বলতে পারি না, তোমার দাদুর কাছে আমি অবাঞ্ছিত। এই শহরে অবাঞ্ছিত। আমাকে তিনি রেলে চাকরীর লোভ দেখিয়ে দেশান্তরী করতে চান। 

পরী বলল, তুমি যাও। আমার যখন খুশি যাব। তোমাকে কে মাথার দিব্যি দিয়েছে দাঁড়িয়ে থাকতে।

-–দিব্যি কেউ দেয় না পরী। লক্ষ্মী মেয়ে, ওঠো। চল তোমাকে এগিয়ে দিই।

–তুমি যাবে কিনা বল! 

—না। তোমাকে এভাবে ফেলে আমি যেতে পারি না। 

—কেন, ভয় করে? 

—হ্যাঁ, করে। 

—কেন এত ভয়? 

—তোমাকে চিনি বলে। 

—আমাকে তুমি চেন? 

—চিনি। হেলায় তুমি যে কোন অঘটন ঘটাতে পার। 

—বলছ কী! হেলায়। 

—তা না হলে আমার সঙ্গে মজা করতে আসতে না। 

—মজা! 

—কালীবাড়ি তো ধর্মস্থান। তোমার দাদু বাবা কাকারা এসেছিলেন দেবীদর্শন করতে, বাবাঠাকুরের আশীবাদ নিতে। তুমি এসেছিলে চিড়িয়াটিকে দেখতে। মজা করতে। 

—বেশ করেছি। তাতে তোমার কী। 

পরীকে রাগিয়ে দিতে পারছি, এটাই এখন আমার লাভ। পরীকে অন্য খাতে বইয়ে দিতে পারছি, এটাই আমার সান্ত্বনা। পুরানো কথা বলে চটিয়ে দিতে পারলে পরী হয়ত আর জানতে চাইবে না, আমি কেন সাত সকালে তার দাদুর কাছে গেছিলাম। 

পরীকে বললাম, আমার কিছুই না। তবু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। কথায় কথায় হাসি, মজা লোটা ভাল না। এটাই জীবনে তোমার কাল হয়েছে। তুমি সহজে মজা করতে পার, আবার সামান্য অভিমানে চোখ ফেটে জল বের হয়ে আসে। দুটোই ক্ষতিকর। 

—ক্ষতি তো আমার। তোমার ক্ষতি না হলেই হল। আসলে তুমি স্বার্থপর বিলু। তুমি আত্মকেন্দ্রিক। নিজের গোঁ নিয়ে আছ। 

সাইকেলে ভর দিয়েই কথা বলছি। 

পরী বসে থেকেই জবাব দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। যে কোনো মানুষের কাছে এভাবে কোন নারীর সামনে উবু হয়ে থাকা অশোভন। অস্বস্তিটা আমার বাড়ছে। এবারে না পেরে ওর হাত ধরে টানলাম। বললাম, ওঠো বলছি। লোকে দেখলে কী ভাববে। 

কারণ এই ছোট শহরে আমাকে কেউ না চিনলেও পরীকে ঠিক চিনে ফেলবে। পরীর যে কোনো অসম্মান কেন যে আমার নিজের অসম্মান মনে হয়। আমি স্থির থাকতে পারি না। 

সে হাত টেনে নিল। যেন জোর করলে ধস্তাধস্তি হবে। তবু পরীকে ওঠানো যাবে না। 

পরী বলল, তুমি সামান্য ক্ষতিও স্বীকার করতে চাও না বিলু। 

—আমার অবস্থায় পড়লে বুঝতে। 

—কী বুঝতাম! তোমার চাকরি না হলে কী হত? তুমি পড়তে না! 

—অগত্যা পড়তে হত। 

—তোমাদের সংসার চলত না! 

—খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলত। 

—সেটা আর দু-পাঁচ বছর হলে ক্ষতি কী ছিল। মাসীমা তো বলেছেন, আমরা কী করব বল! অভাব কোন সংসারে না থাকে! বিলুটা আর পড়বে না। টিউশনি ছেড়ে দিল। বাঁধা মাইনের চাকরি দরকার সংসারে বুঝি। 

—তুমি পরী মা’র দিকটা দেখছ। বাবার দিকটা দেখ। সংসারে দু-বেলা অন্নসংস্থান আমাদের কত দরকার বাবাকে দেখলে বুঝতে। তুমিই আমার কাল। তুমিই সেদিন বাবাঠাকুরের মেঘদূত পাঠের সময়- মুচকি না হাসলে এতবড় অঘটন আমার জীবনে ঘটত না। 

—আমার হাসি পেলে কী করব! আমার কী দোষ। 

—এটাই দোষ। সবাই এত আগ্রহ নিয়ে শুনছে, আর তুমি তাকে মজা ভাবলে। আসলে বাবাঠাকুর আমাকে ডেকে পাশে না বসালে তোমারও আগ্রহ থাকত। কোথাকার একটা ছোকরা কিনা বাবাঠাকুরের দোসর। সে ভুল ধরে দেবে। 

—তুমি অমন গম্ভীর মুখে বসেছিলে কেন! যেন একেবারে ছোট বাবাঠাকুর। যেন কিছু জান না বোঝ না! নবীন সন্ন্যাসী। আমার ছোট বাবাঠাকুর রে! পদ্মাসনে বসে বুড়োদের মতো মুখ করে রাখতে তোমার কষ্ট হচ্ছিল না। ইচ্ছেটাও আছে দেখার, আবার মুখ গম্ভীর করে রাখবে, হাসি পাবে না! 

—কী ইচ্ছে আছে? 

—কেন মনে নেই। চুরি করে আমাকে দেখছিলে কেন, হাসি পাবে না! ছোট বাবাঠাকুর আমার প্রেমে পড়ে গেল! 

—তাকালেই প্রেমে পড়ে! 

—পড়ে। বুঝতে পারছ না। 

—না বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না বলেই চলে যাচ্ছি। বুঝতে পারলে কে যায় বল।

–চলে যাচ্ছ মানে? কোথায়? পরী সহসা উঠে দাঁড়াল। 

—এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যেন বুঝিয়ে দিতে চাই পরীকে, আমার মতো গরীব বাবার ছেলের প্রেম হল বিলাস। 

—তুমি কোথায় যাবে? 

এবারে আর রায়বাহাদুরের মিনতির কথা মনে থাকল না। – বিলু, পরী যেন না জানে, আসলে পরী জানলে আমার আর কতটা ক্ষতি হবে। ক্ষতি হবে তার দাদুর। আমি জানি পরী আমার কোনো ক্ষতি করবে না। গেরো একটা, পরীর জেদ, না জেনে উঠবে না। এভাবে বসে থাকলে আমিই বা যাই কী করে। সব খুলে বললাম। 

পরী শুনে কেমন হতবাক হয়ে গেছে। বিস্ময় ক্ষোভ সব মিলে পরীর চোখ এখন জ্বলছে।

—তুমি যাবে ঠিক করেছ? ঠোঁট চেপে পরী কথাটা বলল। 

—এত ভাল চাকরি আমায় কে করে দেবে? 

—আমাদের জন্য কষ্ট হবে না? 

পরী আমার দিকে তাকাচ্ছিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। 

—কষ্ট হলেই কী করা। রেলের চাকরি সোজা কথা। 

—অপরূপার জন্য কষ্ট হবে না। তোমার কবিতার জন্য কষ্ট হবে না? 

এবারে বললাম, ওগুলো শখ। বেকার থাকলে হং। 

—তাহলে সবটাই বেকার ছিলে বলে! কবিতা, অপরূপা, সব। 

পরীকে বোঝাতে পারছি না আমি কত অবাঞ্ছিত পরীদের পরিবারে। আমার ভেতরে বড় অভিমান এবং জ্বালা। আমি থাকলে পরী যে করেই হোক বিয়ে ভেঙ্গে দেবে। সে পারে। ওদের পরিবারের পক্ষে কত বেমানান আমি, নিজেও বুঝি। গোটা পরিবারে ঝড় উঠে গেছে। পরীর স্বাধীনতা শেষপর্যন্ত রায়বাহাদুরের মর্যাদা রাস্তায় লোটাবে, তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। পরীর রুচি এমন নিম্নমানের হবে, তিনি চিন্তাই করতে পারেন না। এ-নিয়ে বাড়িতে বেশ লড়ালড়ি গেছে পরীর বিধ্বস্ত চেহারা দেখলেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু কী যে থাকে, আমি যেন চোরের মতো ওদের বৈভবের মধ্যে ঢুকে গেছি। বেহায়ার মতো পরীর সঙ্গে মিশছি। কিংবা পরীকে গুণটুন করেছি, যে-জন্য পরী স্পষ্টই বলে দিয়েছে বোধহয়, আমি রাজি না। সে তোমরা যাই ভেবে থাক। আমি পড়ব। 

না হলে পরীর দাদু আমার বাবার কাছে ছুটে যেতেন না। আমার ভাবনায় পরীর দাদুর ঘুম নেই, যেন আমাকে রেলে চাকরি দিয়ে আমার এবং বাবার দুজনেরই মর্যাদা রক্ষা করছেন। শত হলেও আমি তাঁর গুরুদেব বাবাঠাকুরের প্রিয়, পরীর সঙ্গে এক কলেজে পড়তাম—আমি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করলে সবার অসম্মান। 

পরী এবার সাইকেল নিয়ে হাঁটতে থাকল। পরী ভিতরে ভিতরে যে ফুঁসছে ওর চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারছি। পরী রাস্তায় উঠে বলল, চাকরি ঠিক হয়ে গেছে? 

–হয়নি। হবে। 

—কোথায়? চোখ মুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমি চুপ করে আছি দেখে ফের পরী তিক্ত গলায় বলল, কোথায় হচ্ছে? কোথায় যাবে। বলো! বলো! 

—বিলাসপুরে শুনছি। ওখানেই ট্রেনিং। সামনে নাকি আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত। 

পরী এবারে হা হা করে হেসে উঠল। ঠিক আমি যেভাবে পরীদের বাড়িতে রায়বাহাদুর হাত ধরতেই হেসে উঠেছিলাম। 

আমি এমন একজন জাঁদরেল মানুষের, যিনি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, যিনি সকাল হলে শহরের শতেক সমস্যা নিয়ে মানুষের সঙ্গে দেখা করেন, মানুষজন লাইনবন্দী হয়ে তাঁদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, বাড়িতেই এই, অফিসে না জানি কত ইজ্জত,—সেই মানুষটা এত অসহায় তাঁর নাতনীকে নিয়ে ভাবতেই ভিতর থেকে জীবনের প্রবল তামাসার মতো হাহাক্কার হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম। ওটা ছিল আমার জয়ের হাসি। বিশাল পরাজয়ে আমি যে কতটা ভেঙে পড়েছি তারও প্রকাশ। 

পরী কেন হাসছে! 

পরীকে বললাম, কী হয়েছে তোমার। এত হাসছ কেন! 

—তোমার চাকরি হবে রেলে। হাসব না, কী আনন্দ। 

—হবে বলেছেন। কাল সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে বলেছেন। এখনও হয়নি। 

—আর কিছু নিয়ে যেতে বলেন নি? 

–না। 

—ঠিক আছে। বলেই সে সাইকেলে চড়ে সোজা চলে গেল। গাছের ছায়ার এবং ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। একবারও আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আমি যে দাঁড়িয়ে আছি, আমি যে দাঁড়িয়েই আছি, আমার এ-দাঁড়িয়ে থাকা যে পরীর জন্য অনন্তকালের। পরী আমাকে ফেলে চলে গেল, এমন কেন মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এ-আবার আমার কেমন অভিমান! 

আমিই তো চাইছিলাম পরী চলে যাক। শহর ছাড়িয়ে জেলখানার মাঠ পার হয়ে রেললাইনের পাশে বসে থাকা কত অশোভন, এটাই কেবল মনে হচ্ছিল। পরী চলে যাওয়ায় কেমন একা হয়ে গেলাম। পরী চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

তখন গাছপালার ফাঁকে আমার মুখে রোদ পড়েছে। বনজঙ্গলের রাস্তাটা পার হয়ে গুমটি ঘরের দিকে হাঁটতে থাকলাম। আমার ইস্কুল আছে, বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছে। 

এ সবই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম। 

আমার সঙ্গে সাইকেল আছে ভুলে গেছি। সাইকেল নিয়ে হাঁটছি। গুমটি পার হয়ে মনে হল, কী করব! পরী কেন যে আমার এত বড় সুখবরেও খুশি হল না। থার্ড ইয়ারে ভর্তি না হয়ে প্রাইমারী ইস্কুলে চাকরি নেওয়ায় পরীর ক্ষোভ আছে বুঝি, কিন্তু হাতের কাছে এত বড় চাকরির খবরেও পরী খুশি নয়। আমি না হয় বুঝতে পারি, কেন রায়বাহাদুর চান আমি এখান থেকে চলে যাই।—কিন্তু পরী, সেও কী টের পায় দাদুর আসল উদ্দেশ্য বিলুকে ঘরছাড়া করা। শহর ছাড়া করা। 

কখন বাড়ির রাস্তায় ঢুকে গেছি টের পাই নি। পিলু দৌড়ে আসছে। এবং আমার বাবা-মাও খবরটা পাবার আশায় প্রতীক্ষা করছে বুঝতে পারছি। 

পিলু এসেই বলল, দাদারে! 

এই দাদারে বললেই বুঝি আমার জীবনে পরীর অস্তিত্ব যত ঝড়ই তুলুক, এরাও আমার কম নয়। একদিকে পরী, আর একদিকে অভাবের সংসার থেকে আমার বাবা-মার মুক্তি। ভাইবোনদের বড় করে তোলা,–কত কাজ আমার। 

পিলু আমার খবর বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য দৌড়ে গেল।—দাদা আসছে। 

এতটা রাস্তা সাইকেলে না এসে হেঁটেই চলে এসেছি টের পেতেই বুঝলাম পরী কতটা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। পিলুর ‘দাদারে’ কথায় যেন আমি জেগে গেছি। সত্যি বেলা হয়ে গেছে। নতুন চাকরি। স্কুলে না গেলে বাবা মনে মনে ক্ষুব্ধ হবেন। বলবেন, বিলু কর্তব্যকর্মে অবহেলা ঠিক না। মানুষ কাজের মধ্যেই বাঁচে। 

বাড়ি ঢুকে দেখলাম বাবা বাড়ি নেই। 

মা’র পাশে খোঁড়া বাঁদরটা রান্নাঘরে বসে আছে। খোঁড়া বাঁদরটা মা’র ভারি ন্যাওটা। মায়া মাঠ থেকে ছাগল তাড়িয়ে আনছে। আমার ফিরে আসার অপেক্ষাতে হয়তো বাবা বসে আছেন এমন মনে হয়েছিল। কিন্তু বাবাকে বাড়ি না দেখে মনে মনে খুশি হলাম। পিলু যে দাদারে বলেই চুপ মেরে গেছে, আর একটা কথাও বলেনি কেন, এখন বুঝেতে পারলাম। আমার চোখ মুখ দেখলে পিলুই আগে টের পায়, আমি ভাল নেই। দেখেই বুঝেছে, তার দাদাটির কিছু হয়েছে। চোখ মুখ ভাল ঠেকছে না। 

পিলু তার দাদার বিষণ্ণ মুখ দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে। সে মাকে এসেও খুব একটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দাদা আসছে খবরটা বোধ হয় দিতে পারেনি। অথবা কিছুই বলেনি। সে তার নিজের কাজে মন দিয়েছে। এই সংসারে সে কিছু নিজের মতো কাজ, বাবার ঘরবাড়ি বানাবার সময়ই কাঁধে তুলে নিয়েছিল। এখনও সেটা সে করে। 

সাইকেলটা বারান্দায় ঠেস দিয়ে রাখার আগে বললাম, কীরে ইস্কুলে গেলি না? 

মা টের পেয়ে আঁচলে হাত মুছে বের হয়ে এল। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মা কেমন জলে পড়ে গেছে বলে মনে হল। 

মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললাম, চাকরিটা হবে। কাল সার্টিফিকেট মার্কসিট নিয়ে যেতে বলেছে।

মা কেমন ভাল বুঝল না। শুধু বলল, এত দেরি করলি কেন? কখন রান্না করে বসে আছি। তোর বাবা বলল, এত দেরি হবার তো কথা না। চাকরিটা কী তবে হচ্ছে না? 

—না, হবে। 

এতেও মা আশ্বস্ত না হলে বললাম, চাকরির জন্য ভেবো না। চাকরিটা হবেই। পরীর দাদু খুব উঠে পড়ে লেগেছে। 

মা বলল, হলেই বাঁচি বাবা। রেলের চাকরি সোজা কথা। তোর বাবা তো বলল, চাকরিটা হলে তুই আমাদের যখন-তখন তীর্থ করাতে পারবি। রেলের পাশ পাবি। এক পয়সা ভাড়া লাগবে না। 

আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। মা’র এত আশা! 

সেই মা সহসা কেমন কাতর চোখে আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেল। বলল, কীরে মুখে তোর কালি পড়েছে কেন! এ কি চোখ মুখের চেহারা করেছিস? 

রোদে হেঁটে এসেছি, চোখে ক্লান্তির ছাপ থাকতেই পারে। না কি মা বলেই টের পায়, ভিতরে আমার চরম সংকট। আমি অস্থির। 

সাইকেল বারান্দায় তুলে স্বাভাবিক গলায় বললাম, আমি তাড়াতাড়ি ডুব দিয়ে আসছি। ভাত বাড়। বলে আর দাঁড়ালাম না। মা সঙ্গে সঙ্গে হা হা করে প্রায় তেড়ে এল। বলল, একটু ঠান্ডা হয়ে নে। এই মায়া। ছাগলগুলোকে জল দেখাস পরে। তোর দাদাকে তেল দে। গামছা বের করে দে। পিলু গেলি কোথায়। এখন ছাগলের জন্য তোমায় ঘাসপাতা কাটতে হবে না। স্কুলে যাবি না। দাদা ফিরছে না কেন! এখনও তো স্কুলের ঘন্টা পড়েনি। তুইও বসে যা। 

খেতে খেতে বললাম, বাবাকে দেখছি না। কোথায় গেলেন। যজনযাজনে যাবার কথা নয়। কোথাও শ্রাদ্ধশান্তি আছে তাও জানি না। 

মা বলল, আর বলিস না, নবমীর কাছে গেছে। 

নবমী বুড়ি বিশাল জঙ্গলের কারবলার দিকটায় পরিত্যক্ত ইটের ভাটাতে এখনও বেঁচে আছে। নবমীর কাছে আমারও অনেক দিন যাওয়া হয়নি। আমাদের দু-বেলা অন্ন সংস্থানের সঙ্গে নবমীও লেপ্টে গেছে। নবমীর দা-ঠাকুরটি আমার পাশে বসে খাচ্ছে। নবমী সম্পর্কে একটিও কথা বলছে না। সকাল বিকাল সে-ই নবমীর জন্য কলাই করা টিনে ভাত ডাল শাক নিয়ে যায়। নবমীর জন্য দানের কোরা ধুতি, —যখন যা লাগে সেই দিয়ে আসে। বাড়িতে গরুবাছুর আছে। মাঠ থেকে নিয়ে আসা, জাবনা দেওয়া তার কাজ। এই কাজগুলির মতো নবমীর কাজটাও সে নিজ থেকেই কাঁধে তুলে নিয়েছে, ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার কর আমারে’পথের পাঁচালির ইন্দির ঠাকরুণের মতো বসে আছে পারের অপেক্ষায়। তবে বনজঙ্গল সাফ করে স্রোতের মতো ছিন্নমূল মানুষ এসে যাওয়ায় বনটার সে আদি ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আর নেই। কেবল নবমী বুড়ির ওদিকটায় এখনও কেউ ঢুকতে সাহস পায়নি। কারবালার কবরখানার পরেই জঙ্গলটা। 

গভীর জঙ্গলের ভিতর থেকে নবমীর সাড়া পেতাম,—দাঠাকুর, ভয় নেই। 

সঙ্গে সঙ্গে গভীর বনের মধ্যে আমরা দু-ভাই সাহস ফিরে পেতাম। 

সেই নবমীর কাছে বাবা গেছেন। 

খেয়ে উঠে সাইকেলে উঠতে যাব, হঠাৎ পিলু কাছে এসে বলল, দাদা আমাকে স্কুলে দিয়ে যাবি?

পিলুর দেরি হয়ে গেছে বুঝতে পারি। বললাম ওঠ। 

সে রডে বসলে সাইকেলে বের হয়ে রাস্তায় পড়লাম। 

পিলু বলল, জানিস দাদা, নবমী না জঙ্গলটায় আর থাকতে চাইছে না। 

বললাম, কেন। বনটা ছেড়ে আসতে পারবে? 

—কে নাকি আজকাল রাতে এসে শিয়রে তার বসে থাকে। 

—কে বসে থাকে? 

—বলে না। কিছু বলে না। কে বসে থাকে বলে না। গেলেই বলবে, কিগো দা-ঠাকুর বাবাঠাকুরকে পাঠালেন না! বাবাঠাকুরকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে! 

বাবাঠাকুর মানে আমার বাবাকে। বাবা গেলেই নবমী গড় হবে। বনের ফল-পাকুড়, নারকেল, বেল, কয়েতবেল যখনকার যা পায়ের কাছে রাখবে। যেন বাবাকে গড় হয়ে এ-সব ফলমূল দেবার মধ্যে জীবনের অন্য এক অজ্ঞাত নক্ষত্রের খোঁজ পায়। বনটায় নবমী কতকাল ধরে পড়ে আছে। তার স্বামী ইঁটের ভাটার সর্দার ছিল। সেই কবেকার কথা। নবমী হিসেব জানে না। কেবল বলে,— এই যে যুদ্ধ হল নাগো, তখন আমার সোয়ামীটা মরে গেল। আসলে এখানে থাকতে থাকতে নবমী তার দিনকাল তিথি নক্ষত্রের হিসাব ভুলে গেছে। কখনও মনে হত স্মৃতি। তার মরদের স্মৃতি সে ভুলতে পারছে না। আমরা কতদিন বলেছি, তোমার ভয় করে না। সে কী মধুর হাসি!—ভয় পাব কেন? তেনার কথা আমি শুনতে পাই। গাছপালার ভেতর ঘুরে বেড়ালে সবাই আমার সঙ্গে কথা বলে। সবাই বলতে বুঝি, গাছপালা, বনের প্রাণীসকল এবং পাখপাখালি। 

সেই নবমী নাকি রাতে একা থাকতে ভয় পায়। বাবা কী বিধান দেবেন কে জানে।

পিলু বলতে পারে, নবমীকে বাড়ি নিয়ে এস বাবা। নবমীর জন্য পিলুর চার পাঁচ বছরে এক আশ্চর্য মায়া গড়ে উঠেছে বুঝি। 

বললাম, কে এসে বসে থাকে জিজ্ঞেস করলি না? 

আমরা আচার্য পাড়ার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। নরেশ মামা এসে মাঠের মধ্যে প্রাইমারী স্কুল খুলেছেন। এবারে সিক্স সেভেন এক সঙ্গে দুটি ক্লাশও খোলা হয়েছে। পিলু সেভেনে পড়ে। সে বলল, যাবি দাদা? 

—কোথায়? 

—নবমী বুড়ির কাছে। ও বেশিদিন আর বাঁচবে না। 

তা নাই বাঁচতে পারে। এতদিন বেঁচে আছে ভাবতেই অবাক লাগে। আমার তো এক সময় মনে হত, পিলু যখন তখন ছুটে এসে খবর দেবে, জানিস দাদা নবমী না মরে গেছে। বাবাকেও দেবে। নবমীর সদ্‌গতি হয় এমন একটা বাসনা আগেই সে বাবার কাছে পেশ করে রেখেছে। যেন এই সদগতি না হলে নবমী পিলুর উপরই মরে গিয়ে আক্রোশে ফেটে পড়বে। সে আর একা সাঁজবেলায় কিংবা রাত করে বাড়ি ফিরতে পারবে না। 

—একটা লাঠি নিয়ে দরজায় বসে থাকে নবমী। 

—লাঠি কেন? 

—লাঠি না হলে তাড়াবে কী করে! 

—কাকে তাড়াবে। 

—একটা সাপ! জানিস! আজ তো তাই বলে ফেলল। 

–সাপ? 

—হ্যাঁরে, আলিসান ভুজঙ্গ। ইন্দুরখোমা সাপ বলল, ওটা নাকি যখ। 

ইন্দোরখোমা এক ধরনের গোখরো। পদ্মনাগ বলে কেউ। ফণায় খড়মের ছাপ। ইঁদুর খেতে ভালবাসে বলে আমরা ইন্দোরখোমা বলি। অমন একটা বিষধর সাপ তাড়াবার জন্য লাঠি নিয়ে বসে থাকে,— ভাবতেই অবাক হয়ে গেলাম! নবমী তো কুঁজো হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। ভাল করে হাঁটতে পারে না। সাপখোপের মধ্যেই এতদিন বাস করে এসেছে। কিছু বললে, এক কথা, কারো অনিষ্ট না করলে আমার অনিষ্ট করবে কেন কন দাঠাকুর। 

সেই নবমী এখন সাপের আতঙ্কে মুষড়ে পড়েছে। আতঙ্ক হবারই কথা। রাতে আবার কে এসে বসে থাকে শিয়রে। বসে থাকে, না যখটা ফণা তুলে দুলতে থাকে। কেমন একটা রহস্যের গন্ধ। বাবা গিয়ে কী করবেন! একমাত্র বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেন। বাড়িটা চিড়িয়াখানা। এবারে তবে ষোলকলা পূর্ণ হবে। খোঁড়া বাঁদর, হাঁস, কবুতর, টিয়াপাখি, বিড়াল, কুকুর, গাই বাছুর সবই আছে। ছিল না বয়সে জরাগ্রস্ত কোনো রমণী। পরী এলে এবার বুঝতে পারবে, বাবার বাড়িঘরে আরও একটি বিচিত্র জীব হাজির হয়েছে। পরীর মজার শেষ থাকবে না। যা মেয়ে, এসেই না নবমীর সেবা শুশ্রষায় লেগে যায়। মানুষের সেবা বলে কথা! সে জন্য তার পার্টি, মিছিল, ভোটের সময় গলা ছেড়ে হাঁক—ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়। বাপ ঠাকুরদার প্রাসাদে, বাগানবাড়িতে সে লাল পতাকা তুলতে চায়। 

স্কুলের সামনে পিলুকে নামিয়ে দিতেই বলল, দাদারে তোর কী হয়েছে! 

এক ধমক লাগালাম, আমার কী হবে! যা দাঁড়িয়ে থাকিস না। 

আসলে আমি ভাল নেই, পিলু টের পেয়ে গেছে। বাবার পরে পিলুরই আমাকে নিয়ে অহংকার বেশি। 

বাবার অহংকার তার বাড়িতে পুত্রের সুবাদে এস ডি ও সাব পর্যন্ত ঘুরে গেছেন।

মা’র অহংকার তার পুত্রটি ভারি সুন্দর দেখতে। 

আর পরীর অহংকার আমি কবিতা লিখি। আমি কবি। কবি ভাবলেই হাসি পায়। কবিতার যা ছিরি হাসি পেতেই পারে। আসলে নারীরা পুরুষের উপর জয়লাভ করতে চায়। পরী জয়লাভ করেছে। সে জোরজার না করলে এ-রাস্তায় কস্মিনকালেও হাঁটতাম না। রিফুজি বাবার ছেলের কবিতার বাই দুরারোগ্য ব্যাধির সামিল। বাবার আক্ষেপ, বিলুটার এই মতিচ্ছন্ন কেন। কিছু বলতেও পারেন না। মুকুল নিখিল নিরঞ্জন সুধীনবাবুরা শহর থেকে আমার টানে যে কলোনিতে চলে আসে আমি কবিতা চর্চা করি বলেই। বাবা এটা ঠিক বোঝেন। মুকুলের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, মুকুলও কবিতা লেখে বলে। শহর থেকে সব কৃতী ছেলেরাই আসে এই টানে। পরী আসে। এস ডি ও আসেন। শেষ পর্যন্ত পরীর দাদু রায়বাহাদুর। 

ফলে বাবা আমার কবিতা চর্চা সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। মুখ ফুটে কিছু বলেন না। শুধু মাকে নাকি একদিন বলেছিলেন, তোমার পুত্রটি মহাব্যাধিতে আক্রান্ত। পার তো রক্ষা কর। 

মা বুঝতে না পেরে বলেছিল, মহাব্যাধি! বলছ কী। 

—ঠিকই বলছি। উনি রাত জেগে কী করেন বুঝতে পার না? 

কবিতা বিষয়াটাই মা’র মাথায় নেই। মা, কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়তে পারে। 

মা’র মুখে আতঙ্ক। মা বলেছিল, বিলুর কী হয়েছে! 

—কী আবার হবে! কবিতা লেখেন। তুই গরীব বামুনের ছেলে, তোর এ-সব সাজে। তুই তো আর জমিদার নস,—যে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং চাপিয়ে কবিতা লিখবি! 

পিলুই আমাকে এসব খবর দেয়। অসাক্ষাতে আমাকে নিয়ে মা’র সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে পিলু গোপনে সব বলে দেয়। বাবা কাকে ঠেস দিয়ে বলেন সেও বুঝি। আমার তখন নিজেরই হাসি পায়। 

পরীর সেই মহাকবি এখন যাচ্ছেন প্রাইমারী ইস্কুলে পড়াতে। ভাঙা লঝঝরে সাইকেলের ঝং ঝং শব্দে, দূর থেকেও মানুষজন টের পায়, আসছেন তিনি। আমাকে বেল বাজাতে হয় না। বেলটা খুলে রেখেছি অকেজো হয়ে যাওয়ায়। ব্রেক একদিকটা কোন রকমে ধরে, আর একদিকটা ধরেই না। কতবার যে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি শুধু কপাল গুণে। 

বাবা বলেছেন, এখন চালিয়ে নাও। দেখি শীত গেলে কিনে দিতে পারি কি না! অর্থাৎ শীত আসতে বাবার হাতে আমার মাইনের কিছুটা সঞ্চয় থেকে যেতে পারে, সেই আশায় আছেন তিনি। পুরো মাইনেটাই বাবার হাতে তুলে দি। আট আনা এক টাকা চাইলেও প্রশ্ন, কী করবে? 

আমি যে বড় হয়ে গেছি, আমার যে সামান্য হাত খরচের দরকার, আমার বাবা তা বুঝতেই পারেন না। ফলে দরকারে অদরকারে মা’র কাছেই হাত পাতি। মা গোপনে টাকাটা সিকিটা দিয়ে বলবেন, তোর বাবা যেন না জানে। 

সুতরাং নিজেকেই বললাম, তাহলে বিলু তুমি চলে যাচ্ছ? তোমার কষ্ট হবে না সব ফেলে যেতে! সব ফেলে চলে যাব। সব বলতে আমার কেন জানি এই রাস্তা, বিকেলের বাদশাহী সড়কে বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়ানো, কখনও গাছের নিচে বসে কবিতা পাঠ, কে কি নতুন কবিতা লিখল জানার আগ্রহ এবং তখনই দূরে দেখতে পাই কেমন শাদা জ্যোৎস্নায় সে দাঁড়িয়ে আছে একা। পরীর দু- চোখে জল। তুমি চলে গেলে, বিলু, আমি একা হয়ে যাব। 

ইস্কুলে কিছুতেই মন বসাতে পারলুম না। দু-পিরিয়ড করে চলে এলাম। হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরটায় ঢুকে গেলাম। আলগা ঘর, টালির চাল, বাঁশের বেড়া। একটা তক্তপোষ। মাদুর পাতা। মায়া এখন তার দাদার ঘর সাফসুতরো রাখে। একটা টেবিল। কোন ঢাকনা নেই। ঢাকনা লাগে এও মায়ার জানা নেই। দাদার এই ঘরটায় শহর থেকে ছিমছাম তরুণরা এসে বসে, এ জন্য মায়ার সব চেয়ে বেশি লক্ষ্য ঘরটার দিকে। রোজ সকালে গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে রাখে। টেবিলে আমার পিলুর বইপত্র এলোমেলোঁ হয়ে থাকলে সাজিয়ে রাখে। জানালায় ছেঁড়া শাড়ি কেটে পর্দা করে দিয়েছে। টেবিলে কাচের গ্লাসে যে দিনের যে ফুল সাজিয়ে রাখে। 

আজ ফিরে এসে কিছুই ভাল লাগছিল না। অসময়ে ফিরে আসায় বাবাও উদ্বেগে পড়ে গেছেন। আসতেই বললেন, স্কুলে কিসের ছুটি? 

বললাম, ছুটি না। 

—তাহলে, শরীর খারাপ? 

—না। 

বাবা বারান্দায় বসে কথা বলে যাচ্ছেন। জলচৌকিতে বসে আছেন। আমি আমার ঘরে। সাইকেলটা তোলার সময়ই তিনি চোখ তুলে তাকালেন। কী দেখলেন জানি না। অবেলায় বাবাও আজ তাঁর নিজের পোঁটলা-পুঁটলি কেন খুলে বসেছেন জানি না। 

আজ ঘরে ঢোকার সময় বুঝতে পারলাম, বাবার নতুন করে কিছু খোঁজার পালা শুরু হয়েছে। এক নম্বর খোঁজার বিষয় হতে পারে, আমার রেলের চাকরি শেষ পর্যন্ত হবে কিনা। কাল যে আমি সার্টিফিকেট নিয়ে রায়বাহাদুরের কাছে যাচ্ছি, তার যাত্রা নাস্তি লেখা আছে কিনা। কখন কোন্ সময়ে বাড়ি থেকে বের হলে যাত্রা শুভ এসব দেখতে পারেন। দ্বিতীয়, নবমী বুড়ির কাল সমাগত কিনা। তাকে তিনি কি আশ্বাস দিয়ে এসেছেন জানি না। তৃতীয়, পরীর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, তা রাজযোটক কিনা। এসব কাজের দায় কেউ চাপিয়ে দেয় না বাবাকে। বাবা নিজেই এসব কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ভালবাসেন। 

কিছুক্ষণ পর আবার কী যেন বললেন। আমি শুনতে পাইনি। মা রান্নাঘরে খাচ্ছে। বাবার কথাবার্তা মা-ও যে আগ্রহ নিয়ে শুনছে, এ-ঘর থেকে বুঝতে পারছি। মা কি খবরটা দিয়েছে, বিলু গোমড়া মুখে ফিরে এসেছে। ফিরে এসে তো বাবার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। 

আবার ডাক শোনা গেল, কী করছিস। শোন। 

আমার এখন কিছু ভাল লাগছে না। তক্তপোষে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাবার এই ডাকাডাকি ভাল লাগছে না। বিরক্ত। কিন্তু বাবার ঐ এক স্বভাব, সাড়া না দিলে মানুষের কর্তব্য কী, কেন জন্ম, মানুষের সঙ্গে প্রাণীজগতের কী তফাৎ, তারপর অদৃষ্ট নিয়ে পড়বেন। বলবেন, এই আমার অদৃষ্ট। ছেলের এখন পাখা গজিয়েছে। আমাকে আর মানবে কেন। 

আমার ঘরে বাবা এসে আবার হাজির না হন। এই ঘরটায় এখন যে তাঁর ছেলে নিষিদ্ধ বস্তু রাখে, বাবা জানে না। দু-একটা সিগারেট খাবার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। রাতে খাবার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, গোপনে সিগারেট ধরিয়ে কবিতা লিখি। আসলে আমার কেমন মনে হয়েছে, নির্জনতার মধ্যে ডুবে না গেলে কবিতা লেখা যায় না। টেবিলের ড্রয়ারে তালাচাবি করে নিয়েছি। মা’র কাছ থেকে দু’-এক টাকা এজন্যই নিতে হয়। পিলু জানে। তবে পিলু দাদা লায়েক হয়ে গেছে ভেবেই খুশি। সে আর পাঁচ কান করেনি। 

অগত্যা গেলাম। 

বাবা বললেন, বোস। 

তারপর তেমনি পুঁথির দিকে চোখ রেখে বললেন, শুনলাম কাল তোমাকে যেতে বলেছেন। সকাল পাঁচটার আগে রওনা হবে। 

—এত সকালে গিয়ে কী করব! 

—রাস্তায় বসে থাকবে। 

বাবার এসব কথা মাঝে মাঝে মাথায় রক্ত তুলে দেয়। বললাম, রাস্তায় বসে থাকব? 

—পঞ্চাননতলায় গিয়ে বসে থাকবে রবির দোকানে। 

বাবার বিশ্বাসের সঙ্গে আমার বিশ্বাস মেলে না। বাবাকে জানি বলেই আর প্রশ্ন করিনি, কেন এত সকালে বের হব? এত সকালে আমি উঠতে পারব না। আমি তো বাইরে কোথাও যাচ্ছি না। শুভ সময়ে যাত্রা করতেই হবে! এসব বলা বৃথা জেনে উঠে পড়ব, ভাবছি, বাবার তখন প্রশ্ন, চাকরি কবে নাগাদ হচ্ছে কিছু বলেছেন মৃন্ময়ীর দাদু? 

—না। 

—তোমার জেনে নেওয়া উচিত ছিল। তোমার আগ্রহ আছে—এটা তবে তিনি টের পেতেন। উদ্যমী হও। তোমরা মানুষের সঙ্গে দেখছি মিশতে জান না। তোমার স্বভাব দিনকে-দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। 

এ-সময়ে চুপ করে থাকাই বাঞ্ছনীয়। যখন আরম্ভ করেছেন, শেষ না করে থামবেন না। আসল কথায় তাঁর আসতে অনেকটা ভূমিকার দরকার হয়। এখন বাবার ভূমিকা পর্ব চলছে। 

—এত বেলা করে ফিরলে কেন? এত দেরি হবার তো কথা নয়। 

—কাজ ছিল। 

আমার গলায় দৃঢ়তার আভাস পেলেন। আমি যে রুষ্ট হয়ে উঠছি, তিনি বুঝতে পারছেন। আমি যে বড় হয়ে গেছি, আগেই টের পেয়ে গেছেন। কারণ, এখন আর বাবা যখন-তখন মানুষের সুখ্যাতি করতে গেলে দশবার ভাবেন। বাবার কাছে, পয়সাওয়ালা লোক মাত্রই উদ্যমী এবং উদ্যমী না হলে জীবনে বড় জায়গায় যাওয়া যায় না, এসব কথা তিনি বারবার শোনান। আমি জানি, আসলে মানুষগুলি চোর-বাটপাড়। লোককে না ঠকালে মানুষ এত বৈভবের অধিকারী হয় না। 

তিনি খালি গায়ে বসে আছেন। গলায় শাদা উপবীত এবং বাবাকে এ-সময় খুবই ধার্মিক দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, নিবারণ দাস তো বলল, এ আপনার পূর্বজন্মের পুণ্যফল। এত বড় একজন মানুষ বিলুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে, বিলুর মত ছেলে প্রাইমারী ইস্কুলে পড়ে থাকলে মানাবে কেন।

আমি আর পারছিলাম না। বললাম, আগ্রহ না দেখালেও কাজটা হবে। আপনি ভাববেন না। মুখ প্রায় ফসকে বলে ফেলেছিলাম, পরীর দাদুর গলার কাঁটা আমি। 

—পরীর দাদুর সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে না যাতে তিনি আঘাত পান। কত করে বললেন, বিলুকে আসতে বলবেন, তুমি গেলে না। বাধ্য হয়ে নিজেই এলেন। তোমার মা-তো রোজ ঠাকুরকে বলছেন, চাকরিটা যেন হয়। এতে বাড়িঘরের সম্মান বাড়ে, বুঝতে শিখো। 

সহসা কেন যেন মনে হল, এক অন্ধকার প্ল্যাটফরমে আমি লালবাতি দোলাচ্ছি। পরীর ট্রেন ছেড়ে চলে গেল। 

বাবা পোঁটলা পুঁটলি বাঁধতে থাকলেন। কেমন নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো বলে যাচ্ছেন, মানুষই মানুষের আশ্রয়, গাছের দুটো বড় পাকা পেঁপে তোমার মা রেখে দিয়েছেন। থলেয় করে ও-দুটো নিয়ে যাবে। বলবে, বাবা দিয়েছেন। আমাদের গাছের পেঁপে। এতে সম্পর্ক তৈরি হয়। 

আর সত্যি পারা গেল না। বললাম, কিছু আমি নিতে-টিতে পারব না। 

—ঠিক আছে, পিলুকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। 

—না, পাঠাবেন না। 

আমি খুবই রুষ্ট হয়ে উঠেছি। বাবা কেমন হতবাক হয়ে গেলেন। বললেন, তিনি এত করছেন, আর তাঁর জন্য দুটো গাছের পাকা পেঁপে নিয়ে যেতে পারবে না! তারপর একটু থেমে বললেন, তোমার মান-সম্মান বড় ঠুনকো। পরীর দাদু এতে বুঝতে পারবেন, বাড়ির ভালমন্দ তিনি খেলে আমরা খুশি হই। 

—তিনি তা ভাববেন না। 

—কী ভাববেন তবে। 

—ভাববেন আমার চাকরিটার জন্য ঘুষ দিচ্ছেন। কিছুতেই পাঠাবেন না। যদি পাঠান, আমি ও- চাকরি করব না। আপনার রায়বাহাদুর এলে আমি তাঁকে অপমান করব। 

—কী বললি! 

আমি যে মাথা ঠিক রাখতে পারছি না বুঝতে পারছি। আমার এই রূঢ় আচরণে বাবা কেমন বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। যেন এই অপমান রায়বাহাদুরকে নয়, বাবাকে করছি। হাতের কাছে এত বড় স্বর্গের সন্ধান যিনি এনেছেন, তাঁর প্রতি আমি এত ক্ষুব্ধ কেন বাবা তার বিন্দুমাত্র যদি আঁচ করতে পারতেন। আমার বাবার জন্য কষ্টে চোখে জল এসে গেল। 

বাবা এবার আমার দিকে তাকালেন। ভিতরে কতটা ভেঙ্গে পড়েছি বাবা টের পাবেন। বলবেন, তোমার কী হয়েছে। আমি মুখ ফিরিয়ে রেখেছি। যেন বাড়ির গাছপালা দেখছি। শরৎকাল এসে গেছে। এটা আমার বড় প্রিয় কাল। পরীর সঙ্গে শরতের জ্যোৎস্নায় আমি রেল-লাইন ধরে কবে যেন হেঁটে গেছিলাম। কবে যেন পরী বলেছিল না না বিলু, তুমি পাগলামি কর না। আমি তবে মরে যাব। পরী অতটা আসকারা না দিলে বোধহয় আজ আমাকে এত বড় সংকটের মধ্যে পড়তে হত না। 

বাবা আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। আমার রূঢ় ব্যবহারে তিনি বোধহয় ধরতে পেরেছেন, পেঁপে পাঠানো ঠিক হবে না। আমি পছন্দ করছি না। ঘুষ ভেবেছি। তিনি আমাকে শান্ত করার জন্য বললেন, ঘুষ মনে করছ কেন বুঝি না। আগেই বলেছি এতে সম্পর্ক তৈরি হয়। এই যে নবমীকে বাড়ি নিয়ে আসছি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে। ভেবে দেখ আমরা আসার আগে পৃথিবীর কেউ জানতই না, এই বনের মধ্যে নবমী বুড়ি একলা থাকে। পিলুই এসে খবর দিয়েছিল, তোমার মনে থাকতে পারে। 

আমি কথা বলছি না। বাবা অজস্র কথা বলে যাবেন, শুনে যেতে হবে। আমাদের বাড়িতে বাবা কখনও তুইতুকারি করেন স্বাভাবিক কথা বলার সময়। আবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার সময় তুমি সম্বোধন করেন। তেমনি আমরাও বাবাকে আপনি বলি আবার তুমিও বলি। সবটাই নির্ভর করে কোন কথার কতটুকু গুরুত্ব আছে তার উপর। 

—মনে রাখবে সম্পর্ক গড়ে না উঠলে মানুষ বাঁচতে পারে না। আমার মতো গরীব বামুনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে না উঠলে আসবেন কেন। পরী যে আসে, সেও কোনো সম্পর্ক থেকে। শুনেছি পরী বাড়ি এলে পর্যন্ত তুমি অখুশি হও। 

আমি বোঝাই কী করে, পরী আমাদের দারিদ্র্য উপভোগ করতে আসে। আমি চাই না, আমাদের দুরবস্থা দেখে কেউ মজা পাক! 

বাবা রামায়ণ পাঠের মতো বলে যাচ্ছেন, নবমীর স্বামী, তুমি জানো, ইঁটের ভাটায় সর্দার ছিল। পশ্চিমে কোথায় দেশ ছিল তাদের। স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। বলতে পারে না। তার স্বামী ইটের ভাটাতেই দেহরক্ষা করেছে। এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে নবমী তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিল। স্মৃতির সম্পর্ক। তারপর তাও তার হারিয়ে গেল। জঙ্গলের গাছপালা কীট-পতঙ্গের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠল। ভাটা উঠে গেল, নবমী গেল না। সে বনজঙ্গলের মধ্যে স্বামীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকল। 

ভাবলাম হতেই পারে। নবমীর যৌবন বয়সের স্মৃতি, কত রাতে, লন্ঠনের আলোর মুখোমুখি বসে, দু’জনের গভীর প্রেম, অথবা আকাশের নিচে বসে থাকতে থাকতে এক উষ্ণ জীবন দু’জনের— এবং নক্ষত্রমালার গভীরে টের পায় নবমী তার মানুষটি সেখানে কোথাও আছে। একজনের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকতেই পারে। একজনের পেট চালাবার আহার সংগ্রহের ব্যবস্থা এই বনজঙ্গলই করেছে। শহরে নিয়ে গিয়ে কাঠ বিক্রি করতে পারে, কিংবা গাছের ফলমূলই ছিল তার বেঁচে থাকার উপায়। 

বাবা বলে যাচ্ছেন—পিলুকে দা’ঠাকুর ডাকে। পিলু গেলে কী খুশি হয়, পিলুকে একটা ছাগলের বাচ্চাও দিয়েছে। এই দেওয়াটা ঘুষ ভাবলে দোষের। সম্পর্ক গড়ে তুলেছে নবমী। পিলু গেলে, নারকেল, বেল কতকিছু দিয়েছে। যেন সারাদিন সে বনজঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, কোথায় কী পড়ে আছে খোঁজার জন্য। তার দাঠাকুরের মুখে তবে হাসি ফুটে উঠবে। এই হাসিটুকু দেখার জন্য শরীরের জরাকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছে। তুমি তো দেখেছ, নবমীকে যখন পিলু আবিষ্কার করে তখনই জরা তাকে গ্রাস করেছে। নবমীর জন্য পিলু রোজ খাবার নিয়ে যায় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলেই। কোথাকার কে, এখন বায়না সে জঙ্গলে থাকবে না। একা ভয় পায়। তার ঘরে নাকি যখ ঢুকতে চায়। যে কটা দিন বাঁচবে, সে তার দা-ঠাকুরের কাছে থাকতে চায়। পিলুও দেখছি নবমীকে নিয়ে আসার জন্য পাগল। সম্পর্ক গড়ে না উঠলে এসব হয় কী করে! 

আমার বাবা এ-রকমেরই। তিনি যা বুঝবেন, তা থেকে নিবৃত্ত করা কঠিন। কেবল তিনি আমার মা’কেই সমীহ করেন, কিছুটা ভয়ও করেন। 

মা’র খাওয়া হয়ে গেছে। হাতে এঁটো থালা নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াল। খেতে খেতে পিতা- পুত্রের বিরোধ কী নিয়ে টের পেয়েছে। মা এবার আমার পক্ষ নিয়েই বলল, দরকার নেই পেঁপে পাঠাবার। চাকরিটা হয়ে যাক, তুমি নিজে গিয়েই একদিন বড় দুটো পেঁপে দিয়ে এস। তোমার গাছ লাগাবার হাত যশ তবে মৃন্ময়ীর দাদু টের পাবেন। 

কেউ এলে একটাই প্রশ্ন।—কত বড় বেল! 

একটাই প্রশ্ন, কী মিষ্টি আপনার গাছের আম! 

প্রশ্ন, কত বড় পেঁপে! কী সুস্বাদু। বীজ রাখবেন। নেব। 

বাবা হাসবেন তখন। আশ্চর্য তৃপ্তির হাসি। মুখে কিছু বলবেন না। 

আমরা বুঝি বাবা কী বলতে চান। আজ যেন সেটা আরও বেশি বুঝেছি, —সম্পর্ক। গাছের সঙ্গে মানুষের ভালবাসার সম্পর্ক। এরই খাতিরে তল্লাটের সবচেয়ে বড় পেঁপে আমাদের গাছে জন্মায়। বাবা পেঁপে পাঠিয়ে যেন বলতে চান, আপনি ধনবান, গুণবান, রাজধর্ম আপনার আয়ত্তে। আমার সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে গাছপালার প্রাণীজগতের। কোন অংশে আমি খাটো নই। 

বাবা এবার সহসা উঠে দাঁড়ালেন। সামনে এসে দেখলেন আমাকে। আমার ভেতরে কষ্ট আবার না টের পেয়ে যান।—আমার বিয়ে হলে বিলু তোমার কষ্ট হবে না। সকাল থেকে বিচ্ছেদের এই বেদনা আমাকে কাতর করে রেখেছে। সকাল থেকে আমার বনবাসের খবর পেয়ে মুখে উদ্বেগের ছায়া। সকাল থেকে পরী আমাকে ‘ঠিক আছে’ এই বলে চলে গেছে। দুশ্চিন্তা। পরী কিছু না আবার করে বসে। 

আমিও বাবার কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য এখন উঠে পালাব ভাবছি, তখনই বাবা কী বুঝে বললেন—আসক্তি, মোহ ও সুখদুঃখাদি স্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও। পরমবুদ্ধি লাভ কর। 

অগাধ জলে পড়ে না গেলে বাবা আমার এ হেন সাধুভাষার প্রয়োগ করেন না। যে জন্য বাবার কাছ থেকে সারা দুপুর পালিয়ে বেড়াবার চেষ্টা করেছি, শেষ পর্যন্ত তা আর রক্ষা করা গেল না। বোধহয় লক্ষ্মীর আত্মহত্যার পর বাবা আমার এমন থমথমে মুখ দেখেছিলেন। শুকনো মুখ দেখেছিলেন। 

আমি যে কী করি! 

কাল আমার যাবার কথা। 

বাবা মা’র স্বপ্ন এক রকমের, পরীর স্বপ্ন এক রকমের। 

রায়বাহাদুর আমাকে দুঃস্বপ্নের শরীক ভাবছেন। 

এ-হেন অবস্থায় যখন তক্তপোষে আশ্রয় নিয়েছি, তখনই টের পেলাম বাবা উঠোনে নেমে এসেছেন। গাছপালার ছায়া পড়েছে উঠোনে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলছেন, মনে রেখ মানুষের শেকড় এক জায়গায় লেগে যায় না। সে যাযাবর। আজ এখানে আছে, কাল আর এক জায়গায়। বুঝতে পারি দেশবাড়ি ছেড়ে যেতে কষ্ট। ভাই বোন ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। পরে আর তা থাকবে না। ছুটি- ছাটায় বাড়ি আসবে। এই আসার প্রতীক্ষা কত মধুর, তখন টের পাবে। জীবনে প্রতীক্ষা ছাড়া আর কি আছে। আমরা সবাই কোনো না কোনো প্রতীক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকি। এটা না থাকলে জীবনে বেঁচে থাকার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায় বিলু। 

সহসা চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল, আপনি থামবেন কিনা? কিন্তু পারলাম না। 

আসলে চিৎকার করলেই আমি আমার আবেগ সামলাতে পারব না। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলব। আমি ধরা পড়ে যাব। 

কারণ পরীর আভিজাত্য, পরীর লম্বা ঋজু অবয়ব, শরীরের সুঘ্রাণ, উলের মতো নরম উষ্ণ চুল এবং সারা শরীরের লাবণ্য আমাকে সেই কবে থেকে পাগল করে দিয়েছে। আজ এটা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করছি। অথচ পরীর সঙ্গে আমার দুর্ব্যবহারের অন্ত ছিল না। পরীর বাড়ি আসা নিয়ে আমি কথা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরীকে কতভাবে না মানসিক পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। এখন বুঝতে পারছি আমার হীনমন্যতা থেকেই পরীর প্রতি এই দুর্ব্যবহার। যত ভাবছি তত কষ্ট পাচ্ছি। কাল গিয়ে কী দেখব কে জানে। 

রাতে আমার ভাল ঘুম হল না। 

এ-পাশ ও-পাশ করলেই জানি পিলু বলবে, ও দাদা তোর কী হয়েছে রে। 

পিলুকে নিয়ে আর এক জ্বালা। শুয়ে ঘুমের অভিনয় করলাম কিছুক্ষণ। 

অন্য রাতে জেগে বসে থাকি। 

এখন বুঝতে পারি আমার এই কবিতা লেখা পৃথিবীর একজন নারীকে শুধু অবাক করে দেবার জন্য।

আজ একবারও কোন একটা শব্দ কবিতার শরীরে আশ্রয় পাবার জন্য মাথায় আগুন জ্বালায়নি। মগজে কোন রক্তক্ষরণ হয়নি। কী যে হয়েছে। 

চোখ জ্বালা করছে। দেখছি কেবল সামনে দাঁড়িয়ে আছে পরী। আর অনেক দূর দিয়ে কোনো নির্জন প্রান্তর ধরে হেঁটে যাচ্ছে লক্ষ্মী। দুই ভালবাসার পৃথিবীর মধ্যে পড়ে আমি হাঁসফাঁস করছি। 

লক্ষ্মীর কথা ভাবতেই কেমন ভয়ের সঞ্চার হল। আমার শেষ দেখার দৃশ্য চোখের উপর ভেসে উঠল। পায়ে আলতা, হাতে শাঁখা, কপালে বড় ধরনের সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে লাল দগদগে একটা রেখা। এ সব সে পেল কোথায়। রান্নাবাড়িতে পড়ে থাকত। থান পরত। কখনও কালো পাড়ের ধুতি। বিধবা সে। নিজেকে বিনাশ করার আগে নববধুর এই বেশটাই আমাকে কাতর করে রেখেছিল। এখন দেখছি লক্ষ্মী আবার আমার কাছে স্বপ্নে, সেই বেশেই দেখা দিচ্ছে। আসলে আর একটা আতঙ্ক থেকেই এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি। সারাটা রাত এভাবে কখনও লক্ষ্মী, কখনও পরী স্বপ্নে হাজির হতে থাকলে অসহায়বোধ করতে থাকলাম। 

রাত থাকতেই বাবা এসে ডেকে দিলেন। শুভ কাজে যাচ্ছি। বাবা বললেন, তুমি মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বোস। আকাশ ফর্সা হলে রওনা হবে। 

যাবার সময় বাবা ঠাকুরের ফুল বেলপাতা দিলেন সঙ্গে। যাতে কোনো কারণে ত্রুটি না থাকে, —বাবার সব দিকে নজর। ঈশ্বর না আবার তাঁর রুষ্ট হন। 

আমি কিছু বলতেও পারি না। 

কারণ বাবার ধারণা দৈবই সব। তুমি নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু দায়িত্ব পালন করে যাবে। 

বাবার এই ঈশ্বর বিশ্বাসই মাঝে মাঝে এত বিরক্তিকর, যে কখনও চটে গিয়ে রাস্তায় ফল বেলপাতা সব ফেলে দিই। পরীক্ষা দিতে যাবার সময়, ইস্কুলের চাকরিতে যোগদানের সময় এই সব অবলম্বন আমার পকেটে ভরে দেন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। 

সড়কের দু-ধারে বড় বড় সব গাছের ছায়া। সূর্য উঠে গেছে। পরীর দাদু সকাল আটটার আগে নিচে নামেন না। একবার ভাবলাম মুকুলের বাসায় চলে যাই। কিন্তু এত সকালে দেখলে সে অবাক হবে। 

আমার মনে সব হিজিবিজি ভাবনা। মাথামুণ্ডু কিছুরই ঠিক থাকছে না। পঞ্চাননতলায় এসে সাইকেল রাখলাম গাছের ছায়ায়। তারপর বাবার চেনা দোকানে গিয়ে টুলে বসলাম। বাবার সে যজমান। গেলে আদর-যত্ন সে একটু বেশিই করে। অত সকালে দেখে সে অবাকই হল। উনুনে তার আঁচ দেওয়া হয়েছে। এদিকটায় এখন লোকালয় বাড়ছে। মানুষজন দেশ ছাড়া হয়ে যে-যেখানে পারছে বসে যাচ্ছে। 

এতটা সময় কী করে কাটাই। 

কতক্ষণে বেলা বাড়বে, সেই প্রতীক্ষায় ভিতরে ছটফট করছি। এবং এক সময় যখন শহরে ঢুকে গেলাম, – দেখলাম সবই ঠিকঠাক আছে। কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে টের পেলাম না। পরী যে লক্ষ্মীর মতো ছেলেমানুষী করে বসতে পারে না, এটাও মনে হল এক সময়। সে আমার উপর বদলা নিতে পারে। সেটা কীভাবে! 

এই ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই পরীদের সদর গেটে হাজির। দারোয়ান অন্যদিন আমাকে দেখলে উঠে দাঁড়ায়। সামনের লনে কাকাতুয়া পাখীটা দুবার পাখা ঝাপটাল। আমি যে হাজির পাখিটাও টের পেয়েছে। দারোয়ান বসেই বলল, ভিতরে গিয়ে বসুন। আমি দূর থেকেই লক্ষ্য রাখছি পরী দোতলার বারান্দায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। কারণ পরী তো জানে আমি সকালে আসব। পরী শুধু বারান্দায় অপেক্ষা করে না, রাস্তায় দূর থেকে দেখলেই হাত নাড়ায় 

বারান্দায় পরী নেই। 

বুকটা ধক করে উঠল। 

দারোয়ান কেমন গম্ভীর মুখে আমাকে বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। আমি এলে এ- বাড়িতে সাড়া পড়ে যায়। আমি তো শুধু বিলু না। এই বাড়ির একমাত্র অবলম্বন বাবাঠাকুরের প্রিয়জন। আমার খাতিরই আলাদা। 

কিন্তু আজ মনে হল কোথাও কোনো বড় রকমের অঘটন ঘটেছে। খাতির করা দূরে থাকুক আমি যে এত বড় বাড়িতে এসেছি সেটাই যে বেমানান। 

এই প্রাসাদতুল্য বাড়িতে ঢুকলেই ঠাকুর-চাকরের কোলাহল শোনা যায়। লোকজন রায়বাহাদুরের অনুগ্রহের অপেক্ষায় নিচে লোহার বেঞ্চিতে কখন তাঁর দর্শন পাবে সেই আশায় বসে থাকে। আজও তারা বসে আছে। জমিদারি গেলেও প্রভাব প্রতিপত্তির খামতি নেই। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, — প্রভাব-প্রতিপত্তি বিন্দুমাত্র পরীদের ক্ষুণ্ণ হয়নি। পরীর বাবা কাকারা বড় পদে দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। রেলের বড়কর্তা পরীর পিতাঠাকুর। এত সব বৈভবের মধ্যে পরী বড় হতে হতে কেন যে ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় শিখে গেল। পরীর এটাই হয়েছে কাল। দাদু বোধহয় ভেবেছিলেন ছেলেমানুষ, বাড়িতে রাজনীতির আবহাওয়া, দলছুট হতেই পারে। অবুঝ। 

পরীদের বাড়ি ঢুকলে আমার এ সবই মনে হয়। 

বারান্দায় এখন দুটো জালালি কবুতর কার্নিসে উড়ে এসে বসেছে। বক বকম করছিল। আমাকে দেখেও কেউ বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করছে না। 

ভিতরে ঢুকতে যাব, একজন ষণ্ডামার্কা লোক বলল, কাকে চান? 

পরীর দাদুর নাম বললাম। 

বলল, বসুন। নামতে দেরি হবে। 

আজ আমারও কেন যে এত দুর্বলতা বুঝি না। এই বাড়িতে আর যে-কবার এসেছি, নিজেকে এত অনুগ্রহভাজন মনে হয়নি। ছোট মনে হয়নি। 

বললাম, মিমিকে ডেকে দিন। 

লোকটি আমার অচেনা। নতুন আমদানি হতে পারে। মিমিকে ডেকে দেবার কথায় বেয়াদপির আভাস পেয়ে লোকটা ত্যারচা চোখে আমাকে দেখতে থাকল। 

ধুস, এমন জড়তায় আমাকে পেয়ে বসল কেন। স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। আমি তো হলঘরটায় ঢুকে যেতে পারি। কোনোদিন অনুমতির দরকার হয়নি। আজ দেখছি সব অন্য রকম। আসলে কৃপাপ্রার্থী বলেই হয়তো স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি আমার আজ কাজ করছে না। মনে মনে বেপরোয়া হয়ে উঠছি। আর তখনই মনে হল কেউ নামছে। 

ভিতরে ঢুকে গেলাম। 

পরীর দাদু আমাকে দেখেও দেখলেন না। আর এই লোকটাই কাল সকালে হাত ঝাঁকিয়ে বলেছিল, দোহাই বিলু তোমার চাকরিটার কথা মিমি যেন টের না পায়। আজ সেই মানুষটা কেমন ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বারান্দায় গিয়ে বস। ডেকে পাঠাব। 

মগজে মনে হল কেউ ঠুক করে একটা পেরেক গুঁজে দিল। এক অসহ্য পীড়ন কিংবা অপমানের জ্বালা দগদগ করে ফুটে উঠছে সারা মুখে। 

আমিও পাগলের মতো বললাম, উপরে যাচ্ছি। পরীর সঙ্গে দরকার আছে। 

—পরী? সে কে? 

আমার হুঁশ ফিরে এল। মিমিকে আমি পরী বলে ডাকি। মিমি কলেজের প্রথম দিন থেকেই যে আমার কাছে পরী, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। 

হুঁশ ফিরে এলে বললাম, মিমির কাছে যাচ্ছি। 

—ও তো এখন কোথায় বের হবে। 

যাক পরী ভাল আছে। পরী শেষে লক্ষ্মীর মতো কিছু একটা না করে বসে। সেই আতঙ্কে রাতে ঘুম হয় নি। পরী বের হতেই পারে। সে পার্টি অফিসে যেতে পারে, কিংবা পার্টির হয়ে লড়ে যেতে পারে, কোনো নাটক থাকতে পারে পার্টির, তার রিহার্সেলে যেতে পারে—কিংবা প্রেসে খোঁজ নিতে যেতে পারে কভারের ব্লক হয়ে এসেছে কি না! পরী বসে থাকার মেয়ে নয়। কখন যে পড়ে আর এত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে আমরা ধরতেই পারতাম না। 

পরী তার ঘরেও আমায় নিয়ে বসিয়েছে। ঘরটা সাদামাটা। একটা তক্তপোষ। আর একটা টেবিল। পরীর বেশবাসও সাধারণ। ওর পছন্দের মতো লতাপাতা আঁকা সাদা সিল্ক। খুব সাজগোজ করলে সে লাল রঙের ব্লাউজ, লাল পাড়ের শাড়ি পরে। ঘরে লেনিনের একটা বড় ফটো। আর কিছু নেই। এমন কি একটা বড় আয়নাও না। এই কৃচ্ছ্রতা বাড়ির আর দশজন পরীর ফ্যাসন ভেবে বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। কাঠের চেয়ারে কোনো কভার পর্যন্ত নেই। একজন সাধারণ পার্টি কর্মির মতোই তার ঘরটা। আমার ভাল লাগত না। আসলে মনে হত পরীর এটাও এক ধরনের বিলাস। 

পরীর দাদু কী দেখছিলেন আমার মুখে জানি না—তিনি বেশ শান্ত গলায় বললেন, পরেশ এসেছে।

পরেশচন্দ্র! সে কেন? 

পরীর দাদু আবার বললেন, পরেশের সঙ্গে কোথায় যেন যাবে। তুমি বরং আর একদিন এসে দেখা কর। 

আমার সারা শরীরে মনে হল কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমার তো পরীর সঙ্গে দেখা করার কথা না। পরীর দাদুর সঙ্গে দেখা করার কথা। তিনিই তো অনুনয়-বিনয় করেছেন। তিনিই তো ছুটে আমাদের বাড়ি গেছেন। বাবাকে রেলের চাকরির লোভ দেখিয়ে এসেছেন। এক রাতের মধ্যে এত বড় গন্ডগোল হয়ে গেল! তিনি ভুলে গেলেন! আজ আমায় তিনি আসতে বলেছিলেন। সে কী করে হয়! পরী, পরেশচন্দ্র, তুমি আর একদিন এস-এ সবের মানে কী! 

মনে হচ্ছিল লাথি মেরে সামনের সিঁড়ির রেলিং ভেঙে দি। কিংবা দেয়ালের সব বড় তৈলচিত্রে থুথু ছেটাই। মানুষের নিষ্ঠুরতার শেষ থাকে। আমার বাবাকে এত বড় কুহকে ফেলে দেবার কী দরকার ছিল। সরল সাদাসিধে মানুষটা গেলেই বলবেন, — দিয়ে এলি। কবে আবার যেতে বললেন! বাবাকে আমি কী বলব! বাবার বিশ্বাস এত বড় মানুষেরা কখনও ঠকায় না। 

মাথা নিচু করে বের হয়ে যাবার মুখেই মনে হল সিঁড়ি ধরে কারা নামছে। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। উঁচুতে তাকিয়ে দেখলাম পরী, পাশে পরেশচন্দ্র, ওর সাদা ভুটিয়া কুকুরের চেন হাতে। পরী লাফিয়ে নামছে। উর্বশীর চেয়েও আজ বেশি সেজেছে। এমন কী দূর থেকেও মনে হল পরী আজ চোখে কাজল দিয়েছে। ঠোঁটে লিপস্টিক। পরীর এ-সাজ আমি দেখিনি। পরী কতটা আগুন হয়ে জ্বলতে পারে আজ যেন আমাকে দেখাল। লক্ষ্মীর আত্মহত্যার মতো অক্লেশে পরী আজ নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। পরী নামছে অথচ আমাকে যেন দেখতে পাচ্ছে না। দুজনেই কথায় কথায় হাসছে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে। নিচে নেমে হঠাৎ যেন পরী আমাকে আবিষ্কার করে ফেলল, আরে বিলু। কী ব্যাপার। দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। বসে কাজটা কিন্তু করিয়ে নিও। রেলের চাকরি, সোজা কথা! 

আমার কী হল জানি না। আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। ঠাস করে পরীর গালে একটা চড় কষিয়ে দিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে দুদ্দাড় করে সবাই ছুটে আসছে। ওর দাদু চিৎকার করে বলছে, গেট- আউট স্কাউন্ডেল। গেট-আউট। এত বড় আস্পর্ধা! এই কে আছিস! দাঁড়িয়ে কী তামাশা দেখছিস! সবাই ছুটে আসছে আমাকে ধরার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে পরী আমাকে আড়াল করে দাঁড়াল।

—তোমরা ওর গায়ে হাত দেবে না। পরীর চোখ জ্বলছে। 

আমার কাছে সবটাই নাটক মনে হচ্ছে। সবাই আমাকে মারুক, আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিক চাইছিলাম। নিজেকে নির্যাতন করার মধ্যে অপমানিত হবার মধ্যে পরীর উপর আক্রোশ মেটাবার এটাই যেন শেষ উপায়! 

পরী আমার হাত ধরে বলল, আমার ঘরে এস। 

আমার স্নায়ুতে তরল সিসে ঢেলে দিচ্ছে পরী। জোর করে হাত ছাড়িয়ে বললাম, আর নাটক করতে হবে না। ছাড় বলছি। তারপর এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে পাগলের মতো বের হয়ে আসার মুখে শুনতে পেলাম, এ যে তোমার কত বড় অধিকার, বিলু তুমি জান না। একবার শুধু মুখ ফিরিয়ে দেখেছিলাম। পরী সারা মুখ আঁচলে ঢেকে দিয়েছে। পরী ফুঁপিয়ে কাঁদছে। 

বাইরে বের হয়ে রাস্তায় নেমে মনে হল, ছিঃ ছিঃ, এটা আমি কী করলাম। পরীকে মেরেছি, পরীকে মারতে পারলাম? 

হাতে জ্বালা বোধ করছি। 

সাইকেলের হ্যান্ডেল পর্যন্ত তাপে যেন গলে যাবে। 

নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি, বিলু তুমি অমানুষ। 

প্রবল নিশ্বাস পড়ছে। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে পুলিশ প্যারেডের মাঠ পার হয়ে গেলাম।

চোখে কিছু যেন দেখতে পাচ্ছি না। 

হয়তো কোনো অঘটন ঘটে যাবে। 

সামনেই সেই ধোবিখালের মাঠ। শহরের নির্জনতা আরম্ভ। মানুষজন কোর্ট কাছারিতে যাচ্ছে। রিক্সা, গরুর গাড়ির ভিড়। আমি মাঠের মধ্যে সাইকেল ছুঁড়ে ফেলে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। মনেই থাকল না আমার পিলুর মতো ভাই আছে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে শুধু পরী। পরীকে আমি মেরেছি। ডান হাতটা কেমন অবশ ঠেকছে। পরীর সেই শঙ্খের মতো সাদা রঙের গালে পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ লাল হয়ে ভেসে আছে। বললাম, পরী, আমি সত্যি অমানুষ। জীবনেও আর তোমাকে মুখ দেখাতে পারব না। 

ঘাসের মধ্যে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম, বসে থাকলাম। কী করব কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা ভুলে গেছি। এখানে বসে থাকাটাও নিরাপদ নয়। লালদীঘির ধার ধরে চেনা জানা কেউ আসতেই পারে। দেখে ফেলতে পারে। চুপচাপ এখানটায় বসে থাকলে তারা বিস্মিত হতে পারে। কিছুটা সাইকেল চালিয়ে গেলে চৈতালিদের বাড়ি। ওর দিদিরা আমাকে চেনে। লালদীঘির ধারে আমরা বিকালে অনেক দিন বেড়াই। পাশের বাড়িঘরের তরুণীরাও চেনে। নাম জানে না হয়ত, কিন্তু চেনে। যেমন আমরা শহরে সব সুন্দরী তরুণীদের চিনি, তারাও যে চেনে না সেটা অবিশ্বাস করি কী করে। দু-পক্ষই খবর রাখে আমরা কারা, তারা কারা। 

এখানে বসে থাকাটা নিরাপদ ঠেকল না। উঠে পড়লাম। পরীকে আর জীবনেও মুখ দেখাতে পারব না। কে যেন ভিড়ের মধ্যে চিৎকার করে উঠেছিল, গুন্ডা বদমাসদের কে ঢুকতে দিল! পুলিশে দিন স্যার। 

এখন সব মনে পড়ছে। 

পুলিশে দিলেই ভাল হয়। আমি যেন তাই চাইছিলাম। পরী আমাকে নিয়ে তা হলে আর মজা করতে পারবে না। পরী ইচ্ছে করেই পরেশকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমাকে চূড়ান্ত অপমান করার জন্য পরী আগুনের মতো সেজেছে। পরী তার দাদুকে দিয়ে অপমান করিয়েছে, পরীর জেদ আমি জানি। আমি সত্যি বলছি এত অপমান সহ্য করতে পারিনি। পরীকে আমার সহসা বেশ্যা নারীর চেয়েও অধম মনে হয়েছিল।—পরী বিশ্বাস কর ইচ্ছে করে মারিনি। আমি তোমার হাতের খেলার পুতুল হতে চাই না। আমাকে নিয়ে তুমি যা খুশি করবে! আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। 

তারপরই মনে হল, পরী চড় খেয়ে বলছে, এ তোমার কত বড় অধিকার বিলু তুমি জান না। আর সঙ্গে সঙ্গে পরীর জন্য ভিতরটা হাহাকার করে উঠল। দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকল। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালো, শাসালো কেউ ওর গায়ে হাত দেবে না—সব মনে পড়তেই অস্থির হয়ে পড়লাম। আমি যেন এখানে থাকলে আরও ভেঙে পড়ব। যত দূরে এখন চলে যাওয়া যায়—সাইকেলে চেপে উন্মাদের মতো নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইলাম। বড় বিপন্ন বোধ করছি। 

কোথায় যাব, কার কাছে যাব। যেখানেই যাই না কেন আমি ধরা পড়ে যাব। মুকুলের কাছে গেলে আমি ভেঙ্গে পড়ব। মুকুল এত বেশি আমাকে টের পায় যে তার কাছে কিছুই গোপন করতে পারব না। মুকুল খোলা আকাশের মতো উদার। সে টের পাবে, পরীকে তবে যে আমি সহ্য করতে পারি না, এই কারণ। তুমি বিলু মরেছে। এ-মরণ ঠেকাবার যে কেউ নেই। মরণ তোমার হাতে। তুমিই গলায় নিজের অজ্ঞাতে ফাঁসের দড়ি ঝুলিয়ে দিয়েছ। শান্ত হয়ে বোস। তারপরই ডাকবে বৌদি, বিলু এয়েচে, দু-কাপ চা। বিলু মরেছে, জান? আর বৌদি সব শুনে বলবে, তুমি পরীকে মেরেছ? ছিঃ ছিঃ, পরী এত ভাবে তোমার জন্য। পরী কত দুঃখ করেছে, বিলুটা বৌদি কলেজ ছেড়ে দিল। প্রাইমারী ইস্কুলে মাষ্টারি নিল! আচ্ছা বল বৌদি, ওর মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারলে, সে পুড়বে আর পুড়বে। যত পুড়বে তত সে খাঁটি মানুষ হবে। বড় কবি হতে গেলে যে নিজেকে পোড়াতে হয় বৌদি। তারপরই মনে হল কী আজে বাজে ভাবাবেগে ভুগছি। 

আমি উদভ্রান্তের মত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। যে কোন দিকে এখন আমার চলে যাওয়া দরকার মানুষের এই বিপন্ন বিস্ময় বড় আচমকা সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেয়। 

এখন শুধু এক অন্তর্গত খেলা। 

আমার এই অন্তর্গত খেলা কোন নদীর পাড়ে নিয়ে যাবে জানি না। 

ভাঁকুড়ির রাস্তায় পড়ে আরও গভীর নির্জনতা টের পেলাম। কত বেলা হয়ে গেছে। চারপাশে ধানের মাঠ। সরু পথ ধরে কিছুটা গেলে রেশম গুটির গভীর জঙ্গল। নিজেকে আড়াল করার এর চেয়ে নিভৃত জায়গা যেন পৃথিবীর আর কোথাও নেই। 

মানুষের সাড়া শব্দ নেই। শুধু কীটপতঙ্গের শব্দ পাচ্ছি। কিছু গাংশালিখ উড়ে এল। ডালে পাখি। কিচিরমিচির করছে। ওরা দেখছে গাছের নিচে বসে আছে এক প্রাণ, নাম যার বিলু, যে নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইছে,– যেন এই পালানো, কোনো গভীর অন্ধকার থেকে উঠে আসে। গভীরতায় তার নকল রহস্য ছুঁয়ে যায়। ছুঁয়ে যায় তার তীব্র রক্তক্ষরণ। পরিণাম গলায় কোনো রজ্জুর ফাঁস, এই পর্যন্ত ভেবে মনে হল, না, ঠিক হয়নি। বুঝি এগুলো সব এলোমেলো ভাবনা—’শুয়ে থাকা আকাশ/আপন মনে উদার হয়ে/উড়ে যায় যাক পাখিরা/মেঘেরা উড়ে আসবে/কোনো ফুলের উপত্যকা পার হয়ে/ঢেকে যাক সুন্দর শ্যামল পৃথিবী/নিচে আছে সবুজ ধানের মাঠ/ গাঙ ফড়িং লাফায়, এক গিরিগিটি হাঁটে/বড় প্রত্যক্ষ দৃষ্টি, ক্ষুধা তার একমাত্র বৃত্তি/আহার তার একমাত্র অহঙ্কার / সে জানে না মেঘেরা উড়ে আসে/যায় যাক পাখিরা উড়ে/ 

আমি বিড় বিড় করে বকছিলাম। 

মনে হল, ‘নিরন্তর শুয়ে থাকি সবুজ মাঠ হয়ে/আলে পায়ের ছাপ, ছোপানো আলতার দাগ / ঘুমে দূরে সরে যায় সে/তার আঁচল ওড়ে হাওয়ায়/স্তনে ধানের সবুজ শিষ উষ্ণতা ছড়ায়/ সে হেঁটে যায়, আলে পায়ের ছাপ/ছোপানো আলতার দাগ ঠোঁটে। 

বললাম, পরী আমি চলে যাব বহুদূরে। 

আমি উবু হয়ে শুয়ে থাকলাম। মাথার মধ্যে শব্দগুলি খেলা করছে। 

পাখিরা আমার চারপাশে খেলা করে যাচ্ছে। 

পাখিরা আমাকে ভয় পাচ্ছে না। কারণ তারা জানে পাখির সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আমার সব শত্রুতা পরীর সঙ্গে। 

একটা খরগোস কোথা থেকে লাফিয়ে আমার সামনে বসল। আমি কত নিথর হয়ে আছি, টের পেলাম। নড়লেই ছুটে পালাবে। নড়ছি না। কিন্তু চোখ দেখে কী টের পায়, আমার মধ্যে কোনো আত্মহননের প্রবণতা জেগে উঠছে। এই প্রথম নিজেকে আমি ভয় পেতে শুরু করলাম। 

বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। খরগোসটা চলে যাবার সময় যেন শুধু বলে গেল— বেঁচে থাক। বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কিছু নেই। 

আমি কখনও বসে আছি, কখনও জঙ্গলে হেঁটে বেড়াচ্ছি। পলাতক আসামী। কে জানে সবাই জেনেও ফেলেছে কিনা। বাড়িতে বাবা অস্থির হয়ে পড়বেন জানি। বাবা মা পিলু সবাই। পিলু সাইকেলে যদি খুঁজতে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কত বড় আহাম্মক আমি টের পেলাম। পিলু গেলেই শুনতে পাবে— আমি ওখানে কী বিশ্রী ব্যাপার ঘটিয়ে পালিয়েছি। পিলুকে দারোয়ান, পরীর দাদু, ঠাকুর, চাকর, সবাই চেনে। 

আকাশের রং পাল্টাচ্ছে। গভীর অন্ধকার হয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছি। সাপ খোপের ভয় আছে। এখন বড় রাস্তায় উঠে যাওয়া দরকার। সারাক্ষণ জঙ্গলটার মধ্যে ঘুরে টের পেলাম প্রকৃতির এক কথা—বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কিছু নেই। মাথার মধ্যে রক্তক্ষরণ থেমে গেছে। অন্ধকারে বাড়ি ফিরলে চোখ মুখ দেখে কেউ টের পাবে না, এমন অশোভন আচরণের পর নিজের কাছেই ছোট হয়ে গেছি। পিলু খবর নিয়ে ফিরতে পারে, দাদা পরীদিকে মেরেছে। 

বাড়ি ঢুকতে সংকোচ হচ্ছিল। 

দেখছি প্রতিবেশীরা বাড়িতে এসে জড় হয়েছে। বাড়িতে না ফেরায় বাবা মা কতটা উদ্বেগের মধ্যে ছিল, টের পেলাম। কেবল পিলু কিছু বলল না। 

মা আমাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদছে। কোথায় ছিলি? কী হয়েছে তোর? 

বললাম, কী হবে আবার। 

কিছু না হলে তুই ফিরলি না কেন? সারাদিন কোথায় ছিলি। 

বাবা বললেন, সব অদৃষ্ট। 

এই প্রথম বাবা খুঁটিয়ে কিছু জানতে চাইলেন না। শুধু বললেন, তোমাকে তো বলেছি ধনবৌ, ঠিক ফিরে আসবে। বয়সটারই দোষ। 

এমন কি বাবা রায়বাহাদুর সম্পর্কেও কোনো প্রশ্ন করলেন না। পরীদের বাড়ি গেছিলাম কিনা তাও জানতে চাইলেন না। পিলু এসে সাইকেলটা ঘরে তুলে রাখল। মায়া এক বালতি জল রাখল হাত মুখ ধোয়ার জন্য। 

খেতে বসে ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লাম। 

মা বলল, কী হল, কিছুই মুখে দিলি না। 

—আমার খেতে ইচ্ছে করছে না মা। 

আমার মধ্যে পলাতক মানুষের বসবাস আছে, বাবা জানেন। এর আগেও সেটা টের পেয়েছেন বলে, আজ বাবা ঠাকুরঘরে ঢুকে যাবার সময় বললেন, যাও শুয়ে পড়গে। সবই ভবিতব্য।

আমার বাবা জীবনের সব সংকটকে সহজেই ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন। 

ছেড়ে দিতে পারেন বলেই, আমি না ফিরলেও বাবা থানা পুলিশ করতেন না। থানা-পুলিশের নামে বাবার আতঙ্ক আছে জানি। আমার পরিচিত সবার বাড়ি যেতেন, যেমন আমি জানি মুকুলের বাসায় খোঁজখবর নিতেন, আমি কোনো চিঠি দিয়েছি কিনা। সাইকেলটার খোঁজ করতেন, কার কাছে রেখে গেলাম। আমার মধ্যে নাকি একজন বিবাগী মানুষের বাস আছে। সেই যে একবার গ্যারেজে কাজ করার সময় পালিয়েছিলাম, তখনও বাবা থানা-পুলিশ করেন নি।–গেছে আবার চলে আসবে। চঞ্চল মন। 

বাবা মা-কে প্রবোধ দিতেন, অদৃষ্ট, বুঝলে ধনবৌ। তা না হলে দেশ ভাগ হবে কেন, আমরা ছিন্নমূল হব কেন! দু’বেলা খেতে দিতে পারি না, পড়াতে পারি না, ছেলের কী দোষ। বাবার আর একটা আপ্তবাক্য, আমি তো কোনো পাপ করিনি আমার কোনো সর্বনাশ হতে পারে না। 

সর্বনাশ হয়নি। 

ছোড়দি একটা চিঠি লিখেছিল, বিলু এখানে আছে। কতদিন পর আবার ছোড়দির কথা মনে হল। আমার চেয়ে বয়সে ছোটই হবে। ছোড়দি লিখেছিল, বিলু রহমানের কাছে থাকে। 

পিলু আমার পাশে শুয়ে উসখুস করছে। আমি মটকা মেরে আছি। এ-পাশ ওপাশ করলে পিলু দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। বাড়ি ফেরাতক পিলু একটা কথাও বলেনি। শুয়ে পড়লে সে দরজা বন্ধ করেছে। হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে পাশে এসে শুয়েছে। ভাদ্র মাসের গরম। আমার কষ্ট হয় ভেবে সে হাত-পাখায় হাওয়া করছে। এমনভাবে করছে যেন গরমটা তারই বেশি। গরমে ঘুমোতে পারছে না। বাঁশের বেড়ার ঝাঁপ তোলা। বাইরে থেকে এক-আধটু যা হাওয়া ঢুকছে, আমার গায়ে লাগছে। সে বোধহয় চায়, আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। সে জানে ঘুম থেকে উঠলে, মনের অনেকটা ক্লেদ কেটে যায়। সেভেনে পড়লে কী হবে, দাদাকে সে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারে। কথা বলছে না। আমারও কিছু ভাল লাগছে না। যতই ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি না কেন, ওর বুঝতে কষ্ট হয় না, অনিদ্রার শিকার আমি। আমি ভালো নেই। 

সে যখন বুঝল, তার দাদাটির সহজে ঘুম আসবে না, তখনই ডাকল, দাদারে! 

পাশ ফিরে শুলাম। 

সে আবার ডাকল, দাদারে। 

—বল। 

—তুই পরীদিকে মারতে পারলি! 

—কে বলল তোকে, পরীকে আমি মেরেছি! কে বলল! 

—তুই মেরেছিস দাদা। 

আমার কেমন ভয় ধরে গেল। বাবা জানতে পারলে আমায় অমানুষ ভাববে। বাবা এমনিতেই নারীজাতিকে শক্তিরূপেন সংস্থিতা ভাবেন। মেয়েছেলের গায়ে হাত! এ যে গো-বধের সামিল। কিন্তু বাবা যে আমাকে কোনো প্রশ্নই করেননি। পরীকে মেরেছি জানলে, বাবা স্থির থাকতে পারতেন না। তুমি আমার কুপুত্র। বংশের কুলাঙ্গার। তোমার মুখ দর্শন করলে পাপ। নারী হল’গে দেবী। পৃথিবীর বীজ বপন করার ভার তোমার, বহন করার ভার তার। পৃথিবীর সৃষ্টি স্থিতি লয় তার করতলে। তুমি পরীর গায়ে হাত তুলতে পারলে। তোমার সম্ভ্রমে বাধল না। 

আমি কিছুই পিলুকে বলছি না। মনে হচ্ছে, কথাটা পিলুর কাছে স্বীকার করতেও কষ্ট। আমি তো সত্যি পরীকে মারিনি। অপমানের জ্বালায় মাথা ঠিক ছিল না, বলি কী করে! কেবল বলতে চাইছিলাম, আমি সত্যি মারিনি পিলু। সত্যি বলছি। 

—জানিস দাদা, আমাকে না হরি সিং বেঁধে রাখবে বলে ধরে নিয়ে গেছিল। 

—তোকে? তুই গেছিলি কেন। 

—বাবা যে পাঠাল। এত বেলা হয়েছে, তুই ফিরছিস না, আমাদের চিন্তা হয় না! 

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আবার পাশ ফিরে শুলাম। যেন বাকিটা শুনলে আমার আবার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমার জের পিলুর উপর দিয়ে গেছে তবে! আমার মাথায় আবার টের পেলাম, কে পেরেক পুঁতে দিচ্ছে। 

—ভাগ্যিস পরীদি ছিল। কী চেঁচামেচি জানিস, — এসেছে। ওটা তো পালিয়েছে! একে ধরে রাখুন। আমাকে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছিল। জানিস, আমার না কী ভয় ধরে গেছিল! কী হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। তোকে ওরা কত খাতির করে। একটা লোক বলছে, এত বড় সাহস বাড়িতে ঢুকে দিদিমণির গায়ে হাত তোলে। 

—আমি তো জানি নারে দাদা, কেবল চারপাশে তাকাচ্ছি। বলছি, আমার কী দোষ! আমার দাদা মারবে কেন? 

—ওরা কেমন পাগলের মতো আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচ্ছিল। আমি আর না পেরে চিৎকার করছিলাম, পরীদি, আমাকে মেরে ফেলল। 

আমি শক্ত হয়ে আছি। শুনে যাচ্ছি। 

—আর দেখি পরীদি নেমে আসছে।—তুই! এই তোমরা ওকে কী করছ! তোর দাদা তো কখন চলে গেছে। আয়, উপরে আয়। ও বাড়ি যায়নি? 

পরীদি তার ঘরে নিয়ে গেল, দেখলাম, বাড়ির সবাই কেমন গুম মেরে গেছে। কেউ টুঁ শব্দ আর করছে না। 

বললাম, পরীদি, দাদা তোমাকে মেরেছে? 

পরীদি বলল, তোকে কে বলল। 

—সবাই। 

—ধুস, তোর দাদা মারতে যাবে কেন। অত সাহস আছে ওর! তোর দাদাটা এত ভীতু জানিস জানতাম না! আর জানিস দাদা, পরীদির এক কথা, তোর দাদা বাড়ি ফেরেনি? 

—না পরীদি। 

—কোথায় গেল তবে। মুকুলের ওখানে খোঁজ নিয়েছিস? 

—যাইনি। 

—যা একবার। কোথায় গেল খুঁজে দেখ। 

—জানিস দাদা, পরীদির মুখটা না কী কালো হয়ে গেছে বলতে বলতে। মুখে একটা দিক আঁচলে ঢেকে কেবল কথা বলছিল। বলল, বোস। তারপর ফোন করল কাকে। বলল, সুধীনদা আছে। সুধীনদাকে কী বলল। ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম, পরীদির গাল ফুলে আছে। পরীদি কেমন উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকল। 

—পরীদি বলে ডাকতেই জানিস দাদা, আমার দিকে তাকাল। আমি পরীদির মুখ দেখছি। পরীদি না তাড়াতাড়ি আবার আঁচল দিয়ে গাল ঢেকে ফেলল। তুই পরীদিকে মারতে পারলি দাদা! 

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। হ্যাঁ মেরেছি, বেশ করেছি। থামবি কিনা বল। বাড়িতে এসে সাতকাহন করে বাবা মাকে বলেছিস বুঝতে পারছি। 

—বলব কেন! পরীদি বলতে বারণ করে দিয়েছে। পরীদি আমাকে মাথায় হাত দিয়ে বলল, মাসিমা মেসোমশাইকে কিন্তু বলতে যাস না! কীরে, বলবি না তো! আমার গা ছুঁয়ে তিন সত্যি কর। পরীদির গা ছুঁয়ে আমি তিন সত্যি করে এসেছি। কাউকে বললে আমার পাপ হবে না! 

পিলু এত সরল সহজ, বাবা আমার এক ধর্মপ্রাণ মানুষ, মায়া, ছোট ভাইটা, মা সবাই পরীর ব্যবহারে এত মুগ্ধ, আর আমি এমন অমানুষ! যত শুনছি, তত চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। 

—পরীদি, ভিতরে ঢুকে পাথরের থালা গ্লাসে খেতে দিল। বলল, রোদে মুখ পুড়ে গেছে তোর দেখছি। খা। খিদে পেয়েছে। আর তারপরই নিচে নেমে সবাইকে কী হম্বিতম্বি।

—তোমাদের কাঁধে- ঢাক নিতে কে বলেছে! যে আসছে, তাকেই যা-তা বলছ! দাদুর না হয় বয়স হয়েছে। বয়স হলে মাথা ঠিক থাকে না। পরীদিকে না সবাই বাঘের মতো ভয় পায় জানিস। পরীদির দাদুকে দেখলাম না। উনি নাকি ঠাকুরদালানে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। 

হত্যে দিয়েছেন শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, কে বলল তোকে? 

—কে বলবে, পরীদির পিসি এসে উঁকি দিল। বলল, পরী তুই যা একবার। দেখ তুলতে পারিস কি না। 

পরীদের পরিবারে আমার হঠকারিতা কত বড় বিষবৃক্ষ রোপণ করেছে টের পেলাম। নিজের উপর আমার এত ক্ষোভ জন্মাল যে শুয়ে থাকতে পারলাম না। যেন শুয়ে থাকলে আমি হাঁসফাস করব। নিশ্বাস নিতে পারব না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। 

আর তখনই পিলু বলল, জানিস দাদা, পরীদি বিকেলেই এসে হাজির। সঙ্গে মুকুলদা, সুধীনদারা সবাই। পরীদি বাবাকে বলল, বিলু ফেরেনি মেসোমশাই? বাবা গুম মেরে বসে ছিলেন। বাবা পরীদিকে দেখে কী বুঝল, জানি না, শুধু বলল, ও তো মা ওরকমই। চাপা স্বভাবের ছেলে। কী যে হল বুঝি না। তবে ও ফিরে আসবে। আমার মনে হয় রেলের চাকরিটা ওর পছন্দ নয়। তা তুই যদি যেতে না চাস, আমরা জোর করব কেন! তুমিই বল মা, বুঝি তোর বাড়িঘর ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে। কিন্তু মানুষের ঠিকানা তো এক থাকে না। বদলায়। ও সেটাই বুঝতে চায় না। তুমি ভেবো না। বাড়িঘর ছেড়ে ও কোথাও গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারে না। সেই যে একবার রাগ করে বর্ধমান চলে গেল, থাকতে পারল? পারল না। কালীবাড়ি এত কাছে, সেখানেও মন টিকল না। চলে এল। গেছে রাগ করে, আবার রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। 

—জানিস দাদা, পরীদি গেল না। বলল, দেখি একটু। আমি সকালেই চলে যাব পরীদিকে খবর দিতে।

আমার অবর্তমানে বাড়িতে এত ঘটনা ঘটে গেছে। পরী আমার ফেরার জন্য ছটফট করছে। বলতে পারলাম না, না যাবি না। পরী আমাদের কে? আমি মশারির বাইরে নেমে হ্যারিকেন উসকে দিলাম। জল খেলাম। দরজা খুলে বাইরের খোলা হাওয়ায় গাছের নিচে কিছুক্ষণ বসে থাকব ভাবলাম। কিন্তু পিলু দেখছি সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়েছে।—কোথায় যাচ্ছিস দাদা। দাদারে! 

আমাদের দু’জনের স্বভাব দু’রকমের। পিলু বাবার স্বভাব পেয়েছে। সংসারের সব মানুষই তার আত্মীয়। বাবার স্বভাবও তাই। মা আমার সবাইকে বিশ্বাস করে না। মা’র এক কথা, বল বল বাহুবল! জল জল রিদ্রের (হৃদয়ের) জল। কেউ কারো না। আমি বোধ হয় মা’র স্বভাব পেয়েছি। মা আমার সহসা ক্ষেপে যায়, অভাবের সংসারে এক এক সময় মা মাথা ঠিক রাখতে পারে না। সারাদিন বাবার পেছনে টিক টিক করত। বাবার সেখানেও এক আপ্তবাক্য, আরম্ভ হয়ে গেল চন্ডীপাঠ। অভাব কোন মানুষের সংসারে না আছে। অভাব ভাবলেই অভাব। তেনার মাপ মতো সব হচ্ছে। তুমি মাপামাপি করতে বসলে মানছে কে! 

আমার আর দরজা খুলে বের হওয়া হল না। পিলু ত্রাসের মধ্যে আছে। আমি একা চুপচাপ কোথাও বসে থাকলে সে ভয় পায়। দাদাটার মাথায় কীসের পোকা ঢুকে গেছে। বাবা মা’র দুঃখ বোঝে না। সবাই যে তার দাদাটাকে নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছে, সেটা ভেবে দেখে না। বের হলে, ঠিক চিৎকার করে উঠবে, বাবা বাবা, দেখ দাদা এত রাতে কোথায় চলে যাচ্ছে। আর একটা নাটক। অগত্যা শুয়ে পড়তে হল। পিলু বলল, কাল জানিস দাদা, আমাদের আর একটা ঘর উঠবে। 

বললাম, কার জন্য। 

—নবমী বুড়ির জন্য। 

এটা বাড়াবাড়ি মনে হয়। নবমী বুড়ি তার জরা নিয়ে আমাদের বাড়িটায় এসে উঠতে চায়। ওর ঘরে যখ নাকি ঢুকতে চায়। যখের ভয়ে কাবু। আমার হাসি পেল। আসলে বুড়ির যাবার সময় হয়ে গেছে। একা থাকতে ভয় পাচ্ছে। দাদাঠাকুরকে দিয়ে বাবার কাছে খবর পাঠিয়েছে। বাবাও আজ সকালে গেছিলেন। বাবার এক কথা, বন বাদাড়ে মরে পড়ে থাকবে। শেয়ালে শকুনে খাবে—ঠিক না। নিদানকালে মানুষই মানুষের ভরসা। ছ’ ছ’টা পেট চললে, আরও একটা চলে যাবে। 

পিলু কথা শুরু করলে থামতে চায় না। বলল, জানিস দাদা, নবমীর শেষ ইচ্ছে, মরার সময় আমি যেন ওর মুখে গঙ্গাজল দিই। 

মানুষের তা হলে শেষ পর্যন্ত ঐ একটা ইচ্ছেই টিকে থাকে। আর সব ইচ্ছে উবে যায়। এ-সব ভাবতে ভাবতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।

সকালে ঘুম ভাঙলে টের পেলাম, বেলা হয়ে গেছে। আমাকে কেউ ডাকেনি। গায়ে কেউ চাদর জড়িয়ে দিয়েছে। ভোর রাতের দিকে সামান্য ঠান্ডা পড়ে। ঋতু বদলের সময়। চট করে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে, পিলু সব বোঝে। পিলুর একটাই অভিযোগ তার দাদাটি সম্পর্কে, দাদা বড় তার স্বার্থপর। কেবল নিজের কথা ছাড়া ভাবে না। 

আমি নিজেও এটা বুঝি। তা না হলে কাল আমার এত মাথা গরম হবার কথা নয়। পরীর দাদু বলতেই পারেন, বসগে, পরে ডেকে পাঠাব। একজন প্রাইমারী ইস্কুলের শিক্ষক, একজন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে এর বেশি কী আশা করতে পারে। পরী, পরেশচন্দ্রের সঙ্গে কোথাও বের হতেই পারে। কথাবার্তা চলছে, পরী রাজি হচ্ছে না, এক সঙ্গে দুজনে যদি কোথাও বের হয়—পরীদের আভিজাত্য তাতে ক্ষুণ্ণ হবার কথা নয়। পরী তো আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। অথচ কাল কেন যে সহসা রায়বাহাদুরের ব্যবহারে এত অপমান বোধ করলাম, পরীর উল্লাস দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লাম, তারপর বিশ্রি কান্ড বাধিয়ে সারাদিন নিখোঁজ হয়ে থাকলাম, বাড়ি ঘরের কথা ভাবলাম না, এর চেয়ে স্বার্থপরতা আর কী থাকতে পারে। সকালে সবাইকে মুখ দেখাতেই এখন লজ্জা করছে। দিনের আলোয় শ্রীমানকে এবারে তোমরা সবাই দেখ, বাবা হয়ত মনে মনে তাই ভাববেন। সবার সামনে দাঁড়াবার মতো আমার সাহসই যেন হারিয়ে গেছে। সংকোচে কেমন গুটিয়ে গেছি। 

অথচ শুয়ে থেকেই টের পাচ্ছিলাম, মায়া ঠাকুরঘর থেকে পূজার থালা বাসন বের করে নিয়ে যাচ্ছে। পিলু, গরু বাছুর মাঠে দিয়ে আসছে। বাবার গলা পাচ্ছি। বোধ হয় ঝিঙে, কুমড়োর ফুল, ডগা, বেগুন সবজির জমি থেকে তুলে আনতে গেছেন। মা বাসি বাসনকোসন পুকুরে ধুতে গেছে। রোদ উঠে যাওয়ার এক আশ্চর্য স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাড়িটায়। নিখোঁজ পুত্রটি ফিরে এসেছে। আর কোনো দুঃখ নেই সংসারে। 

তখনই পিলুর গলা পেলাম, দাদা শিগগির ওঠ। মুকুলদারা আসছে। 

এই রে। ওরা সবাই খবর নিতে আসছে, বিলু ফিরল কি না। সঙ্গে পরী নেই তো!

ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। জামা গায়ে দিলাম। রাস্তায় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল বেজে উঠল। নানা তার আগেই ওদের কাছে হাজির। এস, ভিতরে এস। ফিরেছে। 

—কোথায় গেছিল? 

আমি ঘরের ভিতর থেকেই শুনতে পাচ্ছি। জানালায় চুপি দিয়ে দেখছি, মকুল নিখিল নিরঞ্জন সুধীনবাবু এসেছে। পরী নেই। পরী না থাকায় অনেকটা অস্বস্তি কেটে গেল। পরীদের বাড়িতে বিলু বিশ্রী কান্ড বাধিয়ে উধাও হয়েছিল, ওরা নিশ্চয়ই জানে না। পিলুর কথা থেকেই বুঝেছি পরীদের আভিজাত্যই আমাকে এ-যাত্রা রক্ষা করেছে। ওরা পারিবারিক স্ক্যান্ডাল গোপন রাখতে হয় কী করে জানে। 

আমার ঘরেই এসে ওরা বসবে। আমার এই তক্তপোষ ওদের বসার জায়গা। বর্ষায় চারপাশে ঝোপ জঙ্গল গজিয়ে উঠছে। এখন আর গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে বসা যায় না। আমার এই ঘরের চেয়ে গাছের ছায়ায় মাদুরে বসে গল্প করতে বেশি ভালবাসে মুকুল। মুকুলের এক কথা, গ্রীষ্মের দুপুরে এমন আরামদায়ক ছায়া নাকি পৃথিবীর আর কোথাও গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। 

—বিলু কোথায়! বিলু! 

—ঘরে আছে। যাও! 

বাবা কি টের পান, তাঁর পুত্রটি এখন নিজেই বুঝতে পেরেছে, কোনো বড় গর্হিত কাজ করেছে। না হলে বাবা আজ ডাকলেন না কেন? এই বিলু ওঠ! কত বেলা হয়েছে। কত ঘুমাবি। সূর্যোদয়ের আগে বিছানা না ছাড়লে আয়ুক্ষয় হয়। বাবার এ-ধরনের অজস্র আপ্তবাক্য আছে, যা এখন আমরা শুনতে অভ্যস্ত। 

ওরা রে রে করে ভিতরে ঢুকে বলল, কী ব্যাপার। কোথায় গেছিলে না বলে না কয়ে। পরী সকালে এসে হাজির। বিলুটার তোমরা খবর নেবে না? কোথায় গেল। 

পরীই তাহলে এদের তাড়া দিয়ে পাঠিয়েছে। 

সুধীনবাবু বলল, রাতে ফোন করে জানাল সুধীনদা কাল সকালে একবার যাও। বিলুটার যা স্বভাব, আমার ভয় করে। 

পিলু এখন হাজির। সে বলল, দাদা সাইলেকটা নিয়ে যাচ্ছি। এক্ষুনি চলে আসব। 

—কোথায় যাবি? 

—এই আসব। বেশিক্ষণ লাগবে না। তারপর সে আর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেল। 

আমি কারো সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারছিলাম না। ওরাই বেশী কথা বলছিল। আমাদের কবিতার রোগ আছে। মুকুল বলল, কোথায় গেছিলে কবিতার খোঁজে। জায়গাটা কেমন। 

অবশ্য এটা আমাদের হয়। জীবনের সব রোমান্টিক দিকগুলি আমাদের ভারি কাতর করে রাখে। হোঁতার সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না রাতে বিলের জল দেখতে দেখতে প্রকৃতির কত রকমের রহস্য আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে। কোনো ধুলিওড়ির মাঠে ঝড়ে পড়ে গেলেও অবিরল জলের ধারার মতো রক্তে এক রণতরী ঢুকে যায়। হৃদয় নামক বস্তুটিতে সে বিস্ফোরণ ঘটায়। ঘন্টার পর ঘন্টা, এমন কী সারা রাত জিয়াগঞ্জের শীতের গঙ্গায় ধু ধু বালিয়াড়িতে হেঁটে যাবার সময় টের পেয়েছি, কেউ আমাদের অপেক্ষায় থাকে। বালির চড়ায় আমি মুকুল নিখিল শুয়ে থেকেছি জ্যোৎস্নায়। নদীর পাড়ে শ্মশানের সেই মানুষের দাহকার্য দেখতে দেখতে আকাশ নক্ষত্র এবং ঝিঁঝি পোকার ডাকে টের পেয়েছি,—কিছুই শেষ হয়ে যায় না, ‘এই বনজঙ্গল, কিংবা শেষ অবশেষে / যেখানে যে প্রাণ বিচরণ করে / শুধু বিচরণ করে আর ধেয়ে যায় / কারণ অমোঘ নিয়তি তার পাখা মেলে থাকে/ তবু থাকে সে অনন্ত অক্লেশে। / ভ্রূণে, গভীর গোপন কোষে/ জীবনের বার্তা বার বার বহন করে/ কিছু‍ই শেষ হয়ে যায় না/ সে থাকে অন্ধকারে নিমজ্জমান / উষ্ণতায় কোনো শীতের সকালে / সে জেগে ওঠে/ কারণ, পিন্ডদানের আগে কিংবা পরে/ গোপন কোষে নিয়ত জাহাজের সাইরেন বেজে যায়। 

মুকুল বলল, কিছু গেলে? এত চুপচাপ। কী ভাবছ? 

বললাম, পেয়েছি। 

—একলা গেলে কেন! কতদূর গেলে? আমরা তোমার এ-যাত্রার সঙ্গী হতে পারলাম না।

—অনেক দূর। অতদূর তোমাদের যেতে সাহস হত না! তাই কাউকে নিলাম না। 

মুকুল বিখ্যাত এক কবির দুটো কবিতার বই নিয়ে এসেছে। সে-ই হাল আমলের কবিতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রক্ষা করে। অনেক প্রিয় কবির কবিতা আমাদের মুখস্থ এখন। আমরা মাঝে মাঝেই প্রিয় কবিতার দু-এক লাইন কথায় কথায় উচ্চারণ করি। আর একটাই আকাঙ্ক্ষা আমরা কবে এমন কবিতা লিখতে পারব। ছন্দের প্রতি অনুরাগ আমার কম। ছন্দের ব্যাকরণও ভাল বুঝি না। কিন্তু গদ্য কবিতার, সুষমা সহজেই ধরে ফেলতে পারি। যেন নাড়ী ধরে টান দেয়। 

সুধীনবাবুর স্মৃতিশক্তি প্রবল। মুকুলেরও। ওরা সহজেই অনেক কবিতা মুখস্থ বলে যেতে পারে। আমি পারি না। দু-একটা পংক্তি মনে থাকে, সবটা মনে থাকে না। 

আমরা ক্রমেই এক সময় দেখলাম, কবিতার আলোচনাতেই মগ্ন হয়ে গেছি। 

সুধীনবাবু বললেন, কলকাতায় যাচ্ছি। সবার কবিতা নিয়ে যাব। তোমার দু-একটা কবিতা দাও তো ভাল হয়। 

—কী যে বলেন! আমার দেবার মতো কবিতাই নেই। আসলে মুখচোরা মানুষের যা হয়। আমার কবিতা পরীর দয়ায় অপরূপায় ছাপা চলে। কলকাতার কাগজে কবিতা। ভাবা যায় না। চরম আহাম্মক মনে হয় নিজেকে। কিংবা আস্পর্ধা। বললাম, না, আমার সত্যি কিছু নেই। 

মুকুল কেমন ক্ষেপে গেল।— তুমি না বিলু, শামুকের মতো স্বভাব তোমার। কবিতার প্রকাশ না হলে লিখে কী লাভ। 

—লাভ অলাভ বুঝি না। আমার লিখতে ইচ্ছে করে না। তোমরা পীড়াপীড়ি কর বলে লিখি। মুকুলও ছাড়বার পাত্র নয়। টেবিল থেকে খাতাটি খুঁজে বের করল। পর পর কটা পড়ে, নিজেই দুটো কবিতা টুকে নিল। বলল, ঠিক আছে, এবারে খাতাটা যত্ন করে রেখে দাও। 

এ-সময় মা থালায় করে মোয়া নাড়, তিলের তক্তি, দুধ কলা মুড়ি রেখে গেল। গরুর দুধ। পেঁপে কেটে একটা থালায় রেখে গেল। কৃতী সন্তানের বন্ধুরা এলে, বাবা তাঁর যথাসাধ্য সৎকার করতে ত্রুটি রাখেন না। 

বাবা তাঁর কৃতী সন্তানের বন্ধুদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখতে রাজি না। এতে তাঁর বাড়িঘরের মর্যাদা বাড়ে। মুকুল তো মাসিমা, মেসোমশাইর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এক একটা নাড়, মুখে দেবে, চেঁচিয়ে বলবে, দারুণ মাসিমা। বাবা শুনতে পান, মাও। আমি বুঝি এটা বাবার পক্ষে বড়ই সুখবর। ওরা চলে গেলে বাবা বলবেন, খাঁটি গরুর দুধ শহরে পাবে কোথায়? বাবার খুব ইচ্ছে একদিন সবাইকে খেতে বলেন। খাঁটি গাওয়া ঘি ঘরে হয়। মা সর তুলে জমিয়ে সপ্তাহে একদিন ঘি জ্বাল দেয়। সর বেটে জ্বাল দেবার সময় সত্যি সুঘ্রাণে বাড়িটা ভরে যায়। গাওয়া ঘি পাতে, খেতের বেগুন, মোচার ঘন্ট, লাউ দিয়ে মুগের ডাল এবং মাছ আর দই। মাছ বাদে প্রায় সবই এখন আমাদের বাড়িতেই মেলে। এটা একজন সংসারী মানুষের পক্ষে কত বড় সাফল্য, তাদের না খাওয়াতে পারলে সেটা যেন বোঝানো যাচ্ছে না। 

ওরা চলে গেলেই পিলু হাজির। 

সে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছে। কোথায় গেছিল জানি না। বাড়িতে বলেও যায়নি। সাইকেল থেকে নেমে দেখল তার দাদাটি ঘরের বাইরে বের হয়েছে। আমাকে পিলু চুরি করে দেখছে। কেন দেখছে বুঝতে। পারছি না। ও কী টের পায়, আমি এখনও স্বাভাবিক নয়। 

দেখলাম সাইলেকটা রেখে আমার দিকেই আসছে। 

বললাম কোথায় গেছিলি! 

সে খুব কাছে এসে বলল, পরীদিকে বলে এলাম। 

পরীদির জন্য পিলুরও একটা কষ্ট আছে। তার দাদাটিকে নিয়ে পরীদি যে বিপাকে পড়েছে, সে সেটা বুঝতে পেরেই চলে গেছে। সে জানে, দাদার ফেরার খবর সবার আগে যদি কাউকে দিতে হয় তবে সে পরীদি। সে স্থির থাকতে পারেনি। 

পিলু ফের বলল, পরীদির এক রাতে কী চেহারা হয়েছে তাকানো যায় না। 

আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। কাল পরী যথার্থই বিদ্রোহ করেছে হয়ত। এমন একটা বিশ্রী কান্ড ঘটার পর পরী আমাদের বাড়িতে না হলে আসে কী করে। বাপ-ঠাকুরদার কাছে আমরা এখনও সবাই ছেলেমানুষ। আঠারো উনিশ বয়সে কত আর আমাদের সাংসারিক বুদ্ধি হতে পারে। পরীদের পরিবারও তাই ভেবে থাকতে পারে। বয়সের দোষে হচ্ছে। জীবনকে বোঝার বয়সই আমাদের হয় নি এমন ভাবতে পারে। পরীর উপর সতর্ক পাহারা যে ছিল না কে বলবে! না পরেশচন্দ্রের সঙ্গে বের হয়ে এসেছিল বিকালে। মানুষটি যথার্থই ভাল মানুষ। পরীর কথায় ওঠে বসে। পরী যদি পরেশচন্দ্রকে ডেকে পাঠায়, যতই গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্য থাকুক, ফেলে ছুটে যাবেই। কে জানে, পরেশচন্দ্রের জিপে বের হয়ে বড় রাস্তায় নেমে বলেছিল কি না, তুমি অপেক্ষা কর, আমি আসছি। বিলুর খোঁজ নিয়ে আসছি। পরী কাল সাইকেলে এসেছিল কিনা জানি না। পরেশচন্দ্র আমাদের চেয়ে কয়েক বছর বেশি আগে পৃথিবীতে এসেছে। জীবনের অভিজ্ঞতা তার আমাদের চেয়ে বেশি। পরীর সাময়িক দুর্বলতা ভেবে লেগে রয়েছে। কোনো কারণই থাকতে পারে না—পরীর মতো মেয়ের গরীব বামুনের পুত্রের জন্য এত দুর্বলতা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। পরীর চোখে মুখে আশ্চর্য এক দেবীমহিমা আছে সে টের পেয়েছে। পরীর শরীরের সবটাই যেন মা জগদ্ধাত্রীর জীবন্ত রূপ। এত রূপ যার তার আগুনে কোন্ পতঙ্গ পুড়ে মরতে না ভালবাসে। 

পিলুকে বললাম, শোন পিলু! 

পিলু কাছে এলে দু’ভাই বাবার ফুলের বাগান পার হয়ে রাস্তার ধারে আমগাছটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। শোন বললে, পিলু বুঝতে পারে দাদার কোনো গোপন কথা আছে। সে-কথা দাদা তাকেই বলতে পারে। আর কাউকে না। 

খুব সতর্ক গলায় বললাম, পরী সাইকেলে এসেছিল? 

—না তো। 

—কার সঙ্গে এল? সুধীনবাবুদের সঙ্গে? 

—না তো। 

—তবে। 

—পরীদি একাই এসেছিল। পরে মুকুলদারা। 

আমার দুশ্চিন্তা, পরীর গালে আমার হাতের ছাপ থাকলে বাবা ঠিক টের পাবে। বাবা কেন, মা, মায়া সবাই।ওমা পরী তোমার গালে কালসিটে দাগ কেন, কী হয়েছিল? 

পরী যে এল, কালসিটে দাগ ছিল না? পিলুকে বললাম। 

পরীদি খুব সেজে এসেছিল। 

—সেজে এসেছিল? 

—হ্যাঁরে দাদা। কপালে বড় আলতার টিপ। মুখ ঝকমক করছিল। 

আসলে পরী কাল মুখোস পরেছিল। পরেশচন্দ্রের সঙ্গে এত সেজে বের হয়েছিল যে প্রসাধনের নিচে তার কালসিটে দাগ ঢাকা পড়ে গেছিল। এই দাগ আড়াল করার জন্য পরী তবে এত সেজেছে। দু-দিকই রক্ষা করেছে পরী। দাদুর দিক। দাদু দেখে বুঝেছে হয় তো, পরীর মোহ কেটে গেছে। না হলে পরেশচন্দ্রকে নিয়ে বিকেলে বের হবে কেন, এত প্রসাধন করবে কেন। আর বাবাকে ধোঁকা দেবার জন্য, গালের কালসিটে দাগ দেখলে বাবা প্রশ্ন না করে পারবেন না—মিথ্যা কথা বলতে পরীরও কেন জানি সংকোচ হয়, বাবার সঙ্গে মিছে কথা বলতে পারে না। বাবা মা মায়া কেউ টের না পায়, পরীর গালে কালসিটে দাগ পড়েছে। এমন সুন্দর মুখে সে দাগ কত বড় কলঙ্কের! কলঙ্কের না গৌরবের ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। পরী আমাকে নির্ঘাৎ ডোবাবে। কেমন ভয় ধরে গেল। এমন জেদি মেয়েকে আমি কেন, কারও যেন সামলাবার ক্ষমতা নেই। পরী কী ভাবে, আমি তার হাতের খেলনা? 

এ-সব জটিল চিন্তা ভাবনায় আমার মাথাটা কেমন ধরে গেল। পিলুকে বললাম, ঠিক আছে যা।

আর তখনই দেখি বাবা কোত্থেকে দু-জন ঘরামিকে ডেকে এনেছেন। বাবা বললেন, স্কুল থেকে ফিরে কোথাও আজ আর বের হবে না। 

তারপর যেন আমার অনুমতির জন্য বলা, নবমীর ঘরটা ঠাকুরঘরের পাশেই তুলছি। কী বলিস! কাছে হবে। এই বয়সে তো তাঁর যত কাছাকাছি থাকা যায়। 

পিলু ঘরামি দুজনের সঙ্গে ছুটে গেছে বাঁশ-ঝাড়ের দিকটায়। বড় বড় কটা বাঁশের খুঁটি লাগবে। বাঁশ কাটার শব্দ কানে আসছিল। 

আমি কিছুতেই কালকের দুর্ব্যবহার ভুলতে পারছি না। পরী আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, না পরী যাচাই করে দেখল ওর প্রতি আমার সত্যি দুর্বলতা আছে কি না। একবার দুর্বলতা প্রকাশ করতে গিয়ে যে-ভাবে পরী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল, তারপর থেকে ওকে যতটা সম্ভব পরিহার করে চলেছি। তবে আমি পরিহার করে চললেও সে বার বার বেহায়ার মতো আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ি ঘুরে গেছে। এতে আমার ক্ষোভ হত, সে টের পেত। কিন্তু পরী জানত না, তাকে আমি নিজের মনে করি কিনা! গতকালের দুর্ব্যবহারে টের পাইয়ে দিয়েছি, আমার সত্যি অধিকার জন্মে গেছে। না হলে আমি তাকে এমনভাবে অপমান করতে পারি না। কানের কাছে কে যেন একই সুরে কেবল ছড় টেনে যাচ্ছে,—এ-যে তোমার কত বড় অধিকার বিলু তুমি জান না। কিছুতেই এই কথাগুলি ভুলতে পারছি না। চোখ মুখে বিষণ্ণতা ফুটে উঠছে। বাবা বাড়িতে গাছপালা লাগাবার মতো যেন টের পান, তাঁর এই ঔরসজাত গাছটিতে পোকা লেগেছে। 

গাছপালা তার ঠিকমতো মাটিতে শেকড় চালিয়ে দেওয়া না পর্যন্ত বাবা বড় সতর্ক থাকেন। একজন মানুষের এই কাজ। তার উত্তরপুরুষকে ঠিকমতো রোপণ করে যাওয়া। না করতে পারলে অসফল মানুষ, কিংবা কোনো উদ্ভিদ রোপণে তাঁর যে মহিমা থাকে— নিজের সন্তানের বেলায় তা ব্যর্থ হয়েছে। লক্ষ্মীর অপমৃত্যুর পর আমার মুখে ঠিক এমনি হয়তো বিষণ্ণতা টের পেয়েছিলেন। না হলে বলতেন না, তোমাকে এক খন্ড জমি দিলাম, জমিতে তোমার খুশিমতো শাকসব্জি লাগাও। বলতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুই শেষ কথা নয়, জীবনে বেঁচে থাকাই বড় কথা। আসলে বাবা আমাকে জীবনের অন্য এক আকর্ষণে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। এখন সেটা বুঝি। আজও যে বললেন, স্কুল থেকে ফিরে কোথাও বের হবে না, সেই একই কারণে। 

স্কুল থেকে ফিরলে বাবা বললেন, খাওয়া হলে আমার সঙ্গে যাবে। 

সামান্য অপ্রসন্ন গলায় বললাম, আপনার সঙ্গে আমি কোথায় যাব? 

বাবা জানেন, আমি তাঁর সঙ্গে কোথাও যাওয়া আজকাল পছন্দ করি না। যজমানদের শ্রাদ্ধ শান্তিতে, বিয়ে উপলক্ষে, কখনও ন’জন, কখনও দ্বাদশ ব্রাহ্মণের দরকার হয়। বাবাই সব ঠিক করে দেন। মূল কথা বাড়িতেই আমাকে নিয়ে তিনজন সৎ ব্রাহ্মণ আছেন। এই তিনজন আমি, পিলু, বাবা। এখন আমি এ-সব নিমন্ত্রণে কিছুতেই যেতে চাই না। বাবা যেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান, তাঁর যজমানদের দেখাবার জন্য, দেখ, আমার পুত্র কেমন লায়েক। কেমন সুপুরুষ। ম্যাট্রিক পাশ করেছে। কলেজের একটা পাশ দিয়েছে। 

এ-ছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার যজন যাজন আমার আদৌ মনঃপূত নয়। আমি পিলু দাঁড়িয়ে গেলে বাবাকে আর এ-কাজ করতে দেব না, এমনও মনে মনে কতবার ভেবেছি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে, বাবার সম্ভ্রম-বোধ আর আমার সম্ভ্রম-বোধ যেন আলাদা। নিমন্ত্রণে গেলে নিজেকে পেটুক বামুন ছাড়া ভাবতে পারতাম না। কলেজে পড়ার সময়ই বাবাকে সাফ বলে দিয়েছিলাম, এবার থেকে বাড়ির একজন বামুন বাদ দিয়ে লিস্ট করবেন। আমি কারো বাড়িতে কোনো আত্মার সদ্‌গতি করতে রাজি না। 

বাবা শুনে অবাক হয়ে গেছিলেন। ছেলে কী তাঁর ম্লেচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সদ্‌গতি বলে কথা। একে তো সৎ ব্রাহ্মণ আজকাল পাওয়া কঠিন। আচার নিয়ম মানে না। গলায় পৈতা থাকলেই বামুন হয়, তিনি মানেন না। তাঁর চেনা জানা কিছু ব্রাহ্মণ শহরে আছেন, কিন্তু আজকাল এতদূর হেঁটে কোনো সৎ ব্রাহ্মণই কারো সদ্‌গতির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে না। এ-হেন অসময়ে তাঁর নিজের পুত্রটি পর্যন্ত বেঁকে বসবে, তিনি বোধহয় অনুমানও করতে পারেন নি। এবং এক সকালে বাবা যখন আমাকে তার সঙ্গে কিছুতেই নিয়ে যেতে পারলেন না, ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, তোমার আজকাল কী হয়েছে বুঝি না। মানুষের অসময় বুঝতে হয়। আমাদের শাস্ত্রে আছে, সৎ ব্রাহ্মণ ভোজনে আত্মার সদ্‌গতি হয়। মানুষের কাজে কর্মে আমি কোথায় যাব। 

বলেছিলাম, সে আপনি বুঝবেন। আমার যেতে ভাল লাগে না। আসলে ভাল না লাগারই কথা। বাবা তো সকালে প্রাতঃস্নান সেরে নামাবলী গায়ে খড়ম পায়ে ঠক ঠক শব্দ তুলে বাড়ি থেকে নিষ্ক্রান্ত হবেন। বাবার বেলায় বের হওয়া কথাটা যেন মানায় না। নিষ্ক্রান্ত হলেন, এমনই মানায়। এত বেশি আচার বিচার, যেন মনে হবে বাবা বড়ই পুণ্য কাজ করতে যাচ্ছেন। তীর্থ করার সামিল। অথবা মনে করেন তাঁর মন্ত্রপাঠে সংসারী মানুষের আপদবিপদ কেটে যায়। অশুভ আত্মার হাত থেকে মানুষ মুক্তি পায়। মানুষের এটা কত বড় দায়, জ্যেষ্ঠ পুত্রটি যদি তা বুঝত। বাবার ক্ষোভের কারণ বুঝি। আমি বাবাকে, শুধু বাবাকে কেন, পরিবারের সবার কাছ থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছি বাবাও এটা বোধ হয় খুব দোষের মনে করেন না। গাছ যখন বাড়ে, তখন সে দূরত্ব বজায় রাখতেই চায়, নইলে গাছটা তার নিজের ডালপালা মেলবার জায়গা পাবে কোথায়। বীজ-তলা থেকে গাছ তুলে সময়কালে রোপণ করতে না পারলে গাছে ফসল ফলবে কেন। আম জামের কলম কেটে রোপণ করতে হয়। গাছ থেকে গাছ আলাদা হয়ে নিজের মতো বাড়ে। আমিও বাড়ছি। আমার আলাদা অস্তিত্ব এ-সংসারে বীজতলা থেকে চারা গাছ তুলে নেবার মতো। এতে মা আমার যতটা কাতর, বাবা তত নন। 

পিলুই একদিন বলেছে, জানিস মা না কাঁদছিল! 

—কেন রে! 

—তুই নাকি কেমন হয়ে যাচ্ছিস। 

—আমি আবার কী হলাম! 

—সংসারে তোর টান নেই। মন উড়ো উড়ো। বাবা মা’র কান্না দেখে ঘাবড়ে গেছিল। বলল, বয়সের দোষ। পাখা গজাচ্ছে। উড়তে শিখেছে। জীবের ধর্মই নাকি এমন। 

আমাকে নিয়ে বাড়িতে যে অশান্তি চলছে, পিলুর কথায় ধরতে পারি। আমি নাকি বাড়িতে এক দন্ড থাকতে চাই না। বাইরে আমার এত কী রাজকার্য থাকে মা নাকি বুঝতে পারে না। বেশি রাত না হলে ফিরি না। সবাই বারান্দায় আমার অপেক্ষায় বসে থাকে— বাবা ক্ষোভ সামলাতে না পারলে আক্ষেপ করে বলবেন, খুবই কান্ডজ্ঞানের অভাব। 

কান্ডজ্ঞানের কত বড় অভাব কালকের ঘটনার পর এটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। সে জন্য বাবা যখন বললেন, নবমী বুড়ীর জঙ্গলে যাব। তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে। আমি না করতে পারলাম না। 

ঘরামি দু’জন, ছোট্ট কুঁড়েঘরটা আজই বানিয়ে ফেলেছে। মাথায় তালপাতার ছাউনি। চারপাশে পাটকাঠির বেড়া। ঝাঁপের দরজা একটা। মুগুর দিয়ে মাটি বসিয়ে ভিটে তৈরি করে ফেলেছে। বাবা নিজেও সারাদিন তাদের সঙ্গে খেটেছেন। পিলুকে স্কুলে যেতে দেন নি। ঘরটা তোলার ব্যাপারে পিলুর আগ্রহই বেশি। মা নিমরাজি হয়ে আছে। তবে সবাই চাইলে মা না করে কী করে। বিশেষ করে মেজ পুত্রটি কবে থেকে নবমীকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য বায়না ধরেছে। রাতে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে জীবন্ত একটা মানুষকে নিয়ে শেয়াল কুকুরে টানাটানি করবে ভেবেই সে অস্থির ছিল। কার জন্য কীভাবে যে মানুষের টান ধরে যায়, পরীর জন্য না হলে আমার এমন নাড়ির টান জন্মায় কী করে! দু-বছর আগেও সে জানত না পরী বলে এক নারী পৃথিবীতে বড় হচ্ছে। এখন তো সব এক দিকে, পরী একদিকে। সে পরীর ভালোর জন্য জীবনের সর্বস্ব বিসর্জন দিতে পারে। আর দিতে পারে বলেই, সে সহজে পরীর কাছে ধরা দিতে চায় না। পরী ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেই ক্ষেপে যায়। পরীকে এমন বাড়িঘরে মানাবে কেন! 

পরীর ছলনায় শেষ পর্যন্ত ধরা দিতেই হল। 

এমন যখন ভাবছিলাম, বাবা বললেন, চল। পিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি দৌড়ে যাও। খবর দাওগে আমরা যাচ্ছি। কী যে বায়না বুড়ির, সবাই গিয়ে নিয়ে আসতে হবে তাকে। আসলে নবমী তার প্রিয় বনজঙ্গল ছেড়ে চলে আসবে। আসার আগে সবাই সামনে না থাকলে যেন জোর পাবে না। দাঠাকুর, বড় দাঠাকুর, বাবাঠাকুর, সবাই তাকে নিয়ে যেতে এসেছে। যেন সেই জঙ্গলের প্রতিটি গাছপালা, কীটপতঙ্গ, প্রাণীকুলের কাছে বলতে পারবে, তোমরা আমায় এতদিন খাইয়েছ পরিয়েছ, এখন আমি ঠিকমতো হাঁটাহাঁটি করতে পারি না,—মরে থাকলে আমার আত্মার সদ্‌গতি কে করবে! তেনারা তিন বামুন ঠাকুর এসেছেন, শেষ বয়সের সম্বল তেনারা। তাঁরা আমাকে ভালই রাখবেন। দেখছ না সবাই নিতে এসেছেন। 

নবমীর এত আবদার পিলুর জন্য সহ্য করা হচ্ছে। পিলুকে আমরা জানি এ-রকমেরই।

মা বলেছিল, বুড়ি কাঁথা কাপড়ে হেগে মুতে রাখলে কে পরিষ্কার করবে! 

পিলু বলেছিল, আমি করব মা! তুমি কিচ্ছু ভেব না। আমি সব করব। 

পিলুর কী আগ্রহ বুঝতে বাবার আর কষ্ট হয়নি। বাবা বলেছিলেন, ধনবৌ, যে যার ভাগ্যে খায়। নবমী পিলুকে শেষ আশ্রয় ভেবেছে। ক’দিন আর বাঁচবে। যে ক’টা দিন বাঁচে, মানুষের কাছে থাকুক। এতে ঘরবাড়ির পুণ্যই অর্জন হবে। এর সঙ্গে তোমার ছেলেমেয়েদের শুভাশুভও জড়িয়ে আছে। যদি কুকুর-শেয়ালে খায়, তবে মানুষের কত বড় অপমান হবে বল। 

এরপর আর মা কী বলবে! 

কেবল বলেছে, যা ভাল বোঝ কর। 

সেই ভাল বোঝাটা মা’র নিমরাজি হওয়া। আসলে এ-পরিবারে কার ঠাঁই হবে না হবে, তার শেষ অনুমতি দেবার দায়িত্ব আমার মা’র 

আমি ও বাবা যাচ্ছি। সুর্য নেমে গেছে। বাবা, পাঁজি দেখে বলেছেন সাঁঝবেলার পর যাত্রা শুভ। পিলু আগেই দৌড়ে গেছে। বেশ খানিকটা দূরত্বে বনজঙ্গলের শুরু। এদিকটায় আরও বাড়িঘর উঠেছে। কেউ বারান্দায় বসে পিতা-পুত্রকে জঙ্গলের দিকে অসময়ে যেতে দেখে, প্রশ্ন করেছে, কোথায় যাচ্ছেন কর্তা। বাবা বলেছেন, এই কারবালায় যাচ্ছি। একটু কাজ আছে। নবমীকে আনতে যাচ্ছেন ঘুণাক্ষরেও বলছেন না। বললেই তিনি যেন আবার তামাসার পাত্র হয়ে যাবেন। কর্তার চিড়িয়াখানায় আর একটি জীবের আমদানি হচ্ছে, এমন ভাবতে পারে। কেউ কেউ বুড়িকে জঙ্গলের ডাইনি বলতেও দ্বিধা করে নি। অন্যের কী দোষ, যেদিন আমি নবমীকে প্রথম দেখি, সেদিন আমারও এমন মনে হয়েছিল। 

বনজঙ্গলে ঢোকার আগে কিছু খানাখন্দ পার হতে হয়। বাবার হাতে হ্যারিকেন। পকেটে দেশলাই। বর্ষাকাল বলে বনজঙ্গল গভীর ঘন। কোথাও বড় বড় গাছ কিংবা পরিত্যক্ত ইটের ভাটার গভীর গর্তে জলাশয়। কত রকমের সব পাখি ওড়াউড়ি করছে। নির্জন নীল ধুসর বর্ণের পৃথিবীর মধ্যে আমরা ক্রমে ঢুকে যাচ্ছি। কোনো মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না এদিকটায়। একটা সরু পথ বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে কারবালার লাল সড়কে গিয়ে পড়েছে। দিনের বেলাতেই আমার আর পিলুর শহর থেকে ফেরার রাস্তা শর্টকাট করতে গেলে গা ছমছম করত। কোথাও এতটুকু রোদ ঢোকে না। ডাহুক, বনমুরগি, কখনও ঘুঘুপাখির, ডাক শোনা যায়। আর সাঁঝবেলায় শেয়ালের দল কবরের গর্ত থেকে উঠে আসে। বোধহয় অন্ধকারকে তারাও ভয় পায়। যখন রাতে শেয়ালেরা চিৎকার করতে থাকে, তখন মনে হয়, এক আদিম ঘোর অরণ্যের পাশে আমরা বসবাস করি। 

বাবা বললেন, দেখে হাঁটবে। 

তাই হাঁটতে হয়। সাপখোপের উপদ্রব বড় বেশি। জঙ্গলটার একটা দিক সাফ হয়ে যাওয়ায় মানুষের তাড়া খেয়ে বিশাল সব গোখরা, চন্দ্রবোড়া, ডাঁড়াস এসে এখন এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। জঙ্গলটার মধ্যে খুঁজলে এখনও দু-একটা নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। পোড়ো বাড়ি চোখে পড়ে। এক সময় ইংরাজরা এ-তল্লাটেই তাদের ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে তুলেছিল। লাল সড়ক ধরে গেলে, বিশাল রাজবাড়ির পাঁচিল, কাশিমবাজারের নীল মাঠ, দূরে একটা খালের মতো আদি গঙ্গায় জলজ ঘাস, এবং তারপর কী আছে আমরা জানি না। আমি আর পিলু একবার গঙ্গার ধার ধরে এগোতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, ও-পার দেখা যায় না এমন মস্ত বড় ঝিল। নবাবের আসল প্রাসাদ ঝিলের তলায়। জগৎ শেঠের প্রাসাদ ঝিলের তলায়। কাশিমবাজারে ঢুকলেই মনে হত পরিত্যক্ত শহর। ইঁটের দালান, দাঁত বের করা, প্রতি বছরই কালে কাউকে না কাউকে খায়। এজন্য বাবা আমি খুবই সন্তর্পণে হাঁটছি। পিলুর এই বনজঙ্গলের ঘোরা খুব প্রিয় কাজ বলে, সে গন্ধ শুঁকে টের পায় কোথায় কী পড়ে আছে। পিলু যা টের পায়, আমরা পাই না। 

আমাদের সতর্ক থাকতেই হয়। 

বাবার সঙ্গে কোথাও যাওয়া আমার এখন আর হয় না। বাবার ভাষায় প্রবেশিকা পরীক্ষার বছর থেকেই। আজ যে যাচ্ছি, সে নিতান্ত দায়ে পড়ে। দায়টা বর্তেছে অনুতাপ থেকে বুঝি। পরীকে মেরে ভাল নেই, মনের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে, মানুষ কুকাজ করলে যা হয়, আমারও তাই হয়েছে। বাবার কথা ফেলতে পারিনি। সুবোধ বালক হয়ে গেছি। 

বাবা অনেকদিন পর তাঁর বড় পুত্রকে নিয়ে আকাশের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।

জঙ্গলটায় ঢুকে বাবা বললেন, নবমীকে নিয়ে যেতে বেশ রাত হবে দেখছি। 

বললাম, কাল সকালে গেলেই হত। রাত করে। 

—নবমী নাকি দিনের বেলায় আসতে রাজি না। তা ছাড়া সময়টা খুব শুভ। 

হতেই পারে। ওকে দিনের বেলায় হাঁটিয়ে নিয়ে এলে পাড়ার ছেলেরাই পিছু নেবে। সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে পারে। আমাদের মাথা খারাপ আছে ভাবতে পারে। পিলু পর্যন্ত তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বলেনি, জঙ্গলের বুড়িটাকে বাবা বাড়ি নিয়ে আসবে। এমনকি পিলু একাই যায় রোজ। কারণ, দু-একজন সঙ্গে গেলে সে বুঝেছে বুড়ি ক্ষেপে যায়। বুড়িরও দোষ নেই। এমন প্রেতের মতো বুড়িকে দেখলে ভয় হবার কথা। নবমী বয়সকালে খুবই রূপবতী ছিল, বিশ্বাস করা কঠিন। ছেলে-ছোকরারা জঙ্গলে ঢুকে বুড়িকে ঢিলটিলও মেরেছে। পিলু নালিশ পাবার পরই শাসিয়ে দিয়েছে সবাইকে। এক পিলু গেলেই বুড়ি শান্ত থাকে। গড় হয়। আর কেউ গেলেই এমন শাপশাপান্ত শুরু করবে যে, ছেলেছোকরাদের রাগ বেড়ে যায়। 

সাঁঝ লাগতেই আমরা নবমীর জঙ্গলে হাজির। পিলু চিৎকার করে বলছে, নবমী, বাবা আসছে। দাদা আসছে। বের হয়ে দেখ। 

নবমী বের হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। পারল না। বেঁকে গেছে নবমী। দাঁড়াতে না পেরে বসে পড়ল নবমী। অনেক দূরে আছি। দূর থেকেই দেখলাম, সে মাটিতে মাথা ঠুকে তার বাবাঠাকুরকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। 

কাছে গেলে দেখলাম, নবমী আজ কেমন চুপচাপ। পিলুই নবমীর হয়ে কথা বলছে। কি কি করতে হবে সেই কথা। নবমী শুধু বড় বড় চোখে আমাকে বাবাকে দেখছে। ভাগ্য তার এত সুপ্রসন্ন হবে জীবনেও হয়ত ভাবতে পারেনি। কেউ তাকে শেষ সময়ে বাড়ি তুলে নিয়ে যেতে পারে, কল্পনা করতে পারেনি। পিলু যে মাঝে মাঝে বলত, নবমী তুমি আমাদের বাড়ি যাবে? ছেলেমানুষের কথা, সে বলত, আমার কপালে সইবে না দাদাঠাকুর। সেই দাদাঠাকুর শেষ পর্যন্ত সবাইকে রাজি করাতে পারবে, এখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। বাবা তার জন্য আলাদা ঘর তৈরি করেছেন, খবরটাও কেমন দাদাঠাকুরের ছেলেমানুষী বলেই এতক্ষণ হয়ত ভেবেছে। বাবা গতকাল এসে কী জেনে গেছিলেন, তাও জানি না। 

কিন্তু পিলুর কথায় বারা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। 

পিলু বলল, নবমী বলছে, ওর ঘরের কোণায় একটা কাঠের বাক্স আছে। ওটা নিতে হবে। কী ভারি। দেখ। বলে সে কিছু খড়কুটো সরিয়ে বাক্সটা দেখাল। কবেকার একটা কাঠের পেটি। কিন্তু উই কিংবা অন্য কোনো পোকামাকড়ের উপদ্রবে পড়েনি। 

বাবা বললেন, ওতে কী আছে তোমার 

নবমী হাতজোড় করল শুধু। 

যেন নবমী বলতে চায়, কী আছে বাবাঠাকুর শুধাবেন না। নিয়ে যেতে হবে, এইটুকু সে শুধু বলতে পারে। 

বাবা বললেন, দেখি পেটিতে কী আছে? এত ভারি! 

আর পেটি খুলে আমরা অবাক। ক’খানা আস্ত ইঁট। ইঁটের ভাটায় কাজ করত নবমীর মরদ। তারই স্মৃতি। 

বাবা হেসে ফেললেন, ওগুলো নিয়ে কী হবে? 

নবমী ফের হাতজোড় করল। যেন এগুলি সঙ্গে না নিলে নবমী তার ইঁটের ভাটার পোড়ো বাড়ি ছেড়ে নড়বে না। ছেঁড়া কাঁথা-বালিশ, এমনকি সে তার পোঁটলা-পুঁটলি সম্পর্কেও কিছু বলছে না। 

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষটার শেষ স্মৃতি। এই নিয়ে সে বেঁচেছিল তবে। কী করবি, নিতেই হবে! 

—স্মৃতি যখন একটা-দুটো নিয়ে গেলেই হয়। সবকটা নেবার কী দরকার। আমি না বলে পারলাম না।

বাবা উবু হয়ে তখন হ্যারিকেন ধরাচ্ছেন। গাছপালার আবছা অন্ধকারে সাঁঝবেলার আঁধার ঘন হয়ে উঠছে। ঘরের সবকিছু অস্পষ্ট। ভ্যাপসা স্যাঁতসেতে ঘর। নোনায় ইট-বালি খেয়ে গেছে। একটা দিক ধসে পড়েছে। ভাটা পরিত্যক্ত হলেও, সবাই চলে গেলেও, নবমী স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে এখানটায় সেই কোন্ অতীতকাল থেকে পড়ে আছে ভাবতে অবাক লাগে। বিশ্রী গন্ধ। কাঁথা-বালিশ এত নোংরা যে, তার থেকেই ভ্যাপসা গন্ধটা উঠতে পারে। নবমীর নিজেরও ভারি জীর্ণ বাস পরনে। এককালে ত্যানাকানি পরে থাকতে দেখেছি। পিলুই বাবার কাছ থেকে চেয়ে বছরে আজকাল দুটো- একটা দানের কাপড় দিয়ে যায়। একটা ছাগল আর তার গোটা তিনেক বাচ্চা গুড়ি মেরে অন্ধকার কোণে শুয়ে আছে। ঘরেই রাম ছাগলের নাদি জমা করে রেখেছে বুড়ি। দুটি মাটির মালসা ছাড়া আর কিছু বুড়ির সম্বল নেই। 

বাবা এবার হ্যারিকেনটা তুলে কাঠের পেটিটা টেনে বললেন, পিলু তুই একটা ইঁট নে। না নিলে যখন যাবে না কী করা! 

নবমী ফের বাবার দু’পায়ে গড় হয়ে পড়ল। 

পিলু নবমীর আচরণ দেখে সব বুঝতে পারে। নবমী কৃতজ্ঞতায় এতই অধীর যে, চোখ তার জলে ভেসে যাচ্ছে। কিছু বলতে গেলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। 

পিলু বলল, ও রাজি না বাবা। 

—তোকে কে বলল? 

—নবমী। 

—দাঠাকুর। বলে নবমী পিলুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। হাড় ক’খানা সম্বল করে নবমী বেঁচে আছে। চোখ কোটরাগত। চোখের ভাষা বোঝার উপায় নেই। 

পিলু বলল, তোমার সবক’টা ইট কে নেবে। বুঝতে পারছ না, কতটা রাস্তা যেতে হবে। হেঁটে যেতে পারবে ত? 

—পারব দাঠাকুর। 

—তোমার ছাগলটাকেও নিয়ে যেতে হবে। 

— হ্যাঁ দাঠাকুর। 

—তোমাকে আমি ধরে নিয়ে যাব। 

—হ্যাঁ দাঠাকুর। 

—কেবল হ্যাঁ দাঠাকুর, হ্যাঁ দাঠাকুর। পিলু কিছুটা যেন ক্ষেপেই গেছে। তোমার এত আবদার, সবকটা ইঁট নিয়ে যেতে হবে। কে নেবে এত! 

আমি যে সবক’টা ইট পাহারা দিতেছি। আমার আর কোনো সম্বল নেই। বলে কী! এই ক’টা ইট পাহারা দিতেছি! 

বাবা বললেন, কেন? পাহারা দিতেছ কেন? তোমার যখের এত ভয় কেন? 

নবমী বোধহয় আর পারল না। কেবল কাঁদতে থাকল। 

পিলু ধমকে উঠল, আচ্ছা ফ্যাসাদ হল। দেব সবক’টা ইঁট জলে ফেলে। বাবা কত কষ্ট করে নিতে এসেছে, আর তেনার আবদারের শেষ নেই। 

বাবা বললেন, বকিস না। ওর মাথা ঠিক নেই। বনজঙ্গলে থেকে ও তো একটা গাছ হয়ে গেছে। গাছটাকে নিয়ে কোথাও লাগালেও বসবে না। যা বলছে তাই কর। কী বলছে ছাই তাও বুঝতে পারছি না। 

বাবা হ্যারিকেনটা আরও উস্কে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ছাগলটা সঙ্গে নিচ্ছি। পিলু কাল এসে তোমার কাঠের পেটি থেকে ইট ক’খানা নিয়ে যাবে। সঙ্গে বনমালী আসবে। মাথায় বয়ে নিতে ওর কষ্ট হবে না। বলে একটা ইঁট বের করে ওজন দেখলেন! যেমন ইঁটের ওজন হয় তেমনি। খুব ভারি। বহু বছর আগে তৈরি ইঁট,—অথচ এতটুকু ক্ষয়ের চিহ্ন নেই। 

বাবা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইঁটের ভেতর সাপের আস্তানা গড়ে ওঠে। ইঁটের ডাঁই যেখানে পড়ে থাকে, সাপ সেখানে লুকিয়ে থাকতে ভালবাসে। বুড়ির মনে হয়েছে, পেটির মধ্যে সাপ ঢুকে বাসা বানাবে। ওর মরদের স্মৃতি সাপের বাসা হবে, ভেবেই হয়তো আকুল। দরজায় লাঠি নিয়ে বসে থাকে, পাহারা দেয়। সত্যি দেখছি নবমীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। 

নবমী বোধহয় আর পারল না। সে দাঠাকুরের রাগ দেখেছে, দাঠাকুরকে ভয়ও পায়। দাঠাকুর মালসায় ভাত বেড়ে দেয়। তরকারি ভাজা সব। খাওয়া হলে ডোবার জল থেকে ধুয়ে রেখে যায়। ঘটি করে খাবার জল রেখে যায়। ভয় পেতেই পারে। সেই ভয় থেকেই যেন বলা, যেন দাঠাকুর রেগে গেলে রক্ষা থাকবে না, সবক’টা ইঁট ডোবার জলে ফেলে দেবে। বলবে, এবার হল। চল এবার! 

সে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যা বলল, তার কিছু থেকে বুঝতে পারলাম, ওর মরদ ছিল লুটেরা। সেই কোন্ অতীতে পুলিশের তাড়া খেয়ে বাংলা মুলুকে চলে আসে। সেই কোন্ অতীতে নবমী নামে গাঁয়ের এক স্বাস্থ্যবর্তী তরুণীকে ভালবেসে ফেলে। তারপর থেকে পুরুলিয়ায় ইঁটের ভাটায় কাজ। নবমীর এক কথা ছিল, লুটেরার কাজ করলে জলে ডুবে মরবে। মানুষটা একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল! এক রাতে চলে গেল কোথায়। হপ্তা পার করে ফিরল। কাঠের পেটি আর দুটো মুরগি সঙ্গে ফিরে এল। নবমী বলল, লুটেরার সব ইঁটের ভেতরে আছে গো বাবু। আমারে দিয়ে গেছে। আমি দাঠাকুরে দিয়ে যেতে চাই। 

আমাদের কারো মুখে রা নেই। 

পিলু বলল, ইট ক’খানায় কী আছে তোমার। ওতে আমার কোঠাবাড়ি হবে? 

—ভেঙে দেখেন না। কোঠাবাড়ি হবে না কেন দাঠাকুর! 

একটা ভাঙতেই আমাদের চক্ষু স্থির। সোনার একটি ছোট পিন্ড। পাঁচ-সাত ভরি ওজনের কম হবে না। 

পিলু কেমন ঘাবড়ে গেল, নবমী তুমি ডাকাতের বৌ ছিলে? 

—না দাঠাকুর। আমার কাছে মানুষটা সাচ্চা মানুষ। খেটে খেয়েছে। শেষ লুটের মাল বিচে খায়নি। বুলেছে, আমি না থাকলে, তুই বিচে খাবি। আমি খাইনি। পাহারা দিচ্ছি। বনজঙ্গল ছেইড়ে যেতে পারিনি। 

বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। পিলু আমি সবাই এই গভীর বনজঙ্গলের অন্ধকারে মানুষের আর এক মহিমা আবিষ্কার করে মুহ্যমান। ভালবাসলে ডাকাতও মানুষ হয়ে যায়। ভালবাসলে মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়। 

বাবা কিছুটা যেন অস্বস্তি কাটিয়ে উঠেছেন। –তোমার মরদের পাপ দাঠাকুরের মাথায় চাপাতে চাইছ! 

—না, বাবাঠাকুর। সব পাপ তেনার। বাবাঠাকুর আপনার আলয়ে বিগ্রহ সেবা হইয়ে থাকে! তার সেবায় এসব লাগলে আমার মরেও শান্তি বাবাঠাকুর। 

নবমী বাবার ইতস্তত ভাব দেখে বলল, দাঠাকুর আমার জীবন্ত বিগ্রহ। তার সেবায় লাগুক সব পাপ আমার। সব পাপ লুটেরার। আপনি বাবাঠাকুর অন্যমত করবেন না গো। 

আমিই বাবাকে সাহস দিলাম, মানুষের সেবায় লাগলে দোষের কী! 

তবু বাবা যেন কিছু ঠিক করতে পারছেন না। আসলে আমার মা শেষ পর্যন্ত যদি রাজি না হয়। পাপের ধন ছুঁতে নেই। তবে বাবা জানেন, মা বৈষয়িক বুদ্ধি বেশি ধরেন। 

বললাম, সঙ্গে নিন। মা কী বলে দেখুন। 

বাবা যেন এতক্ষণে তাঁর সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলেন। ধনবৌ কী বলে। বিষয় আশয় নিয়ে মাকে বাবা যখন কথা বলেন তখনই ধনবৌ এই সম্বোধনে ডাকেন। 

বিলু ইটগুলি ভেঙ্গে সাত আটটা স্বর্ণপিন্ডের পুঁটুলি বেঁধে ফেলেছে ততক্ষণে। সেও মা’র মতো বিষয় আশয়ে আমার কিংবা বাবার চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। সে তাড়া লাগাল, ওঠো, আমার হাত ধর। 

বাবা ছাগলের দড়িটা হাতে নিলেন। 

আমার হাতে হ্যারিকেন। আমি সবাইকে অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিচ্ছি। আমাদের দারিদ্র্য শেষ পর্যন্ত এভাবে দূর হবে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। 

বাবা বাড়ি ফিরে চুপি চুপি সব মাকে বললেন, দেখলাম মা যেন আকাশ থেকে পড়েছে।–বল কী। কৈ দেখি! দেখে বলল, এগুলি সোনা তো! এত এত! মা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, পুলিশে ধরবে না। 

বাবা বলল, তাই তো। 

পিলু বলল, ধুস তুমি যে কী না মা। 

তারপরই বাবার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল যেন। বলল, বিক্রি করে জমিজমা কিনে ফেলা ভাল। ঠাকুরের নামে সব জমিজমা কেনা হবে। পিলুকে, সেবাইত করে দিলে নবমীর আত্মা শান্তি পাবে। নবমী না হলে মরে গিয়েও শান্তি পাবে না। ওর জন্য না হয় আমরা কিছুটা পাপের ভাগী থাকলামই। সবাই স্বার্থপর হলে জীবন চলবে কেন? 

মা বলল, বিক্রিটা করবে কী করে। তোমার মতো লোক বেনের দোকানে নিয়ে গেলে সন্দেহ করবে না! 

পিলু বলল, কেন নিবারণ জ্যেঠা আছে। 

নিবারণ দাসের পাটের আড়ত আছে। বাবার যজমান। সব কাজ বাবার বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে করে। শুভ দিনক্ষণ সব। বাবার উপর নির্ভর করে ব্যবসায় বুঁদ হয়ে থাকে। নিবারণ দাসের জামাতারা এলেই বাবার কাছে আসে গড় হয়। বাবার আশীর্বাদ নেয়। নিবারণ দাস, কোনো কাজে কোথাও যাবার আগে বাবার পায়ের ধুলো নিয়ে যায়। যেন সব আপদ থেকে তবে সে রক্ষা পেয়ে যাবে। এ হেন মানুষটার নাম উঠতেই বাবা আমার স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। বললেন, তাইতো। দাসমশাই থাকতে ভয় কি। দাসমশাই আমাকে ঠকাবে না। ঠকালে তার ঘরের লক্ষ্মী উধাও হবে ভাববেন। 

অবশ্য সে রাতে আমরা কেউ ঘুমোতে পারিনি। নবমীকে মা নতুন কোরা কাপড় দিল বের করে। পরদিন পিলু নবমীকে পুকুরঘাটে টেনে নিয়ে সাবান দিয়ে শরীর রগড়ে দিলে চিৎকার করতে থাকল, ও বাবাঠাকুর আমারে মেরে ফেলছে গো! 

পিলুর এক কথা, চট্টপ। কী করে রেখেছ শরীরটা। কী দুর্গন্ধ রে বাবা। 

বাবা বারান্দায় বসে তামাক সাজতে সাজতে বলেছিলেন, একদিনে তুই অত ময়লা সাফ করবি কী করে। আজ এই পর্যন্ত থাক। পিলু ভাল করে গা মুছিয়ে আর একটা কোরা কাপড় গায়ে পেঁচিয়ে বলল, একদম চিল্লাবে না। রান্না হলেই খেতে দেওয়া হবে। 

নবমীর আজকাল খাই খাই ভাব হয়েছে। পিলু এটা জানে বোঝে। মা নবমীর জন্য একখানা কালো পাথরের থালা বের করে দিল। পাথরের গ্লাস। বাবা তক্তপোষ বানিয়ে দিল। মশারি তোষক। ঘরে হ্যারিকেন জ্বালা থাকে রাতে। বাড়িতে আর দশটা জীবের যত্ন আত্তির মতো নবমীরও যত্ন আত্তি একটু বেশিই শুরু হল। 

বাবা নবমীর শিয়রে একখানা গীতা কিনে এনে রেখে দিলেন। দুদিন চন্ডীপাঠ করলেন নবমীর ঘরে। নবমী নিচে মেঝেয় হাত জোড় করে বসে থাকে। বাবা যখন বিগ্রহের পূজা শেষ করে বের হন, দেখতে পান নবমী লাঠি ঠুকে ঠুকে ঠাকুর ঘরের দরজার সামনে বসে আছে। বাবা চরণামৃত দিলে মাথায় ঠেকিয়ে ঠোঁটে এবং বাকিটা বুকে মেখে নেয়। আমি বিকেলে নবমীকে রামায়ণ পাঠ করে শোনাই। রামের বনবাস পড়লে বুড়ির দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে। 

একদিন মুকুল এসে হাজির। নবমীকে দেখে ভেবেছিলাম অবাক হবে। সে বলল, মেসোমশাইর কান্ড। আমি বললাম, না, পিলুর। 

এ-কথা সে-কথার পর মনে হল মুকুল আমার জন্য কোনো দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। সে বলতে ইতস্তত করছে। এ-কদিন বাবা আমাকে নবমীর কিছু কাজ হাতে তুলে দিয়েছেন। বলেছেন, এই বাড়িঘরে নবমী আছে। বড় একা। তোমার মা না পারেন, তুমি অন্তত তাকে কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শুনিও। রামায়ণ মহাভারত ঘরেই ছিল। পরীকে ভুলে থাকার মতো একটা কাজ পাওয়া গেছে। নবমী তার জীবনের বিচিত্র ঘটনা বলতো, আমরা মন দিয়ে শুনতাম। 

নবমী বাড়িতে কিছুটা পিতামহীর ভূমিকা গ্রহণ করে ফেলল। সে যে কত সুন্দরী ছিল, কাপড় পেঁচিয়ে লাঠিতে ভর করে নেচে দেখাত। আমরা সবাই হাসতাম। সেই বীরপুরুষের কথা বলার সময় তার চোখ থেকে জল গড়াত। আসলে নবমীর যৌবনকাল থাকতেই মানুষটা ভেদবমি করে দু-দিনের মধ্যে চলে গেল। সেই অসহায় জীবনের কথা ভাবলে আমার কেন জানি বার বার লক্ষ্মীর কথা মনে হয়। পরীর কথা মনে হয়। যেন কতদিন পরীকে দেখি না। অপরূপার খবর রাখি না। সব বাবা নবমীকে বাড়িতে তুলে ভুলিয়ে রাখতে চাইছেন। বুঝলাম, মানুষ একসঙ্গে থাকলেই মায়া জন্মায়। নবমীর প্রতি আমাদের সবারই কেমন একটা টান জন্মে গেছে। আমি শহরে যাই না বলে মুকুল অনুযোগ করল প্রথম। তারপর বলল, কথা ছিল, বের হবে নাকি। 

মুকুলকে বললাম, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আসলে শহরে গেলেই মন খারাপ হয়ে যাবে জানি। মন একবার খারাপ হলে সহজে তা কাটাতে পারি না। 

মুকুলের সঙ্গে সেদিন সারা সন্ধ্যা নদীর ধারে ঘুরে বেড়ালাম। অথচ মুকুল কী কথা বলতে ডেকে আনল বোঝা গেল না। পরীর কী কিছু হয়েছে। বললাম, অপরূপার লেখা প্রেসে গেছে? আসলে অপরূপা ছাড়া আমি পরীর প্রসঙ্গে আসতে সাহস পাই না। পরীর প্রতি আমার কোন দুর্বলতা নেই এটাই যেন সবাইকে বোঝাতে চাই। দুর্বলতা যদি কিছু থাকে তা পরীর। পরীর প্রতি আমার দুর্বলতা যে কত হাস্যকর বাবার ঘরবাড়িতে এলেই টের পাওয়া যায়। আমার দুর্বলতা টের পেলে যে আমাদের বাড়িঘরেরই অসম্মান, সেটা বুঝি। বামন হয়ে চাঁদ ধরার বাসনা। আহাম্মক আর কাকে বলে! আমার জন্য গোটা পরিবারের মর্যাদা নষ্ট হোক, আমি চাই না। পরীকে পরিহার করে চলার এটাও একটা বড় কারণ। পরীর জন্য মনটা আবার এত উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি। ভুলতে চেষ্টা করছি। মুকুলের সঙ্গে শহরে আসাটাই যে, আমার ঠিক হয়নি। পরী সম্পর্কে মুকুল কোনো কথাই বলল না। চৈতালী কলকাতায় চলে যাবে, কবে যাবে, কোথায় থাকবে সব খবর দিল- কিন্তু পরীর সম্পর্কে কোনো কথা নেই। কেবল ফেরার সময় মুকুল বলল, কলেজে মর্নিং ক্লাস হবে। তুমি বি-কমে ভর্তি হয়ে যাও। মেসোমশাইকে বলে এসেছি। তিনি রাজি। 

আমার পড়াশোনা নিয়ে জানতাম পরীরই মাথাব্যথা ছিল। এখন দেখছি মুকুলের মধ্যেও তা সংক্রামিত হয়েছে। বাবাকে বলে এসেছে। বাবা রাজি হতেই পারেন। সকালে কলেজ, দুপুরে স্কুল, সন্ধ্যায় অপরূপা মন্দ কী। নবমীর গুপ্তধনে কী হবে না হবে, নিবারণ দাস একদিন বাড়িতে এসে হিসাব করে গেছে। সবটা দিয়ে বিঘে ত্রিশেক ধানের জমি কেনা যেতে পারে। বাবা রাজি না। বাবার এক কথা, নবমী গতায়ু হলে তার কাজ, বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করার বাসনা, বিগ্রহের জন্য ছোট্ট কোঠাঘর ঠিক হয়েছে, তারকপুরের মাঠে এক লপ্তে বিঘে দশেক ধানি জমি যদি পাওয়া যায়। বাবা নিবারণ দাসকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত এক লপ্তে না হোক, রাজার দেবোত্তর সম্পত্তি বিঘে দশেক পেয়ে গেছেন। দর দাম ঠিক করা, রেজিষ্ট্রি করা, নিয়ে বাবা ক’দিন ব্যস্ত থাকলেন। এই জমিতে মোটামুটি ভাত-কাপড়ের সুরাহা হয়ে যাবে, বাবার ধারণা। বড়টির কখন কী মর্জি বোঝা ভার। তাকে নিয়ে তিনি কম উদ্বেগের মধ্যে যে নেই, আড়ালে বাবার কথাবার্তা থেকে তা ধরতে পারি। 

বাবা নিবারণ দাসকে বলেছিলেন, দাসমশাই, আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র। তাঁরই ইচ্ছে। জমিজমা সব তাঁর নামেই কেনা হবে। বড় বিপাকে পড়েছিলাম, আমি গতায়ু হলে গৃহদেবতার কী হবে! বড়টি তো এমনিতেই ঘোর নাস্তিক। মেজটি এখন একরকমের বড় হয়ে কী হবেন জানি না। ছোটটির অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে, শেষ পর্যন্ত ডালপালা মেলবে কিনা তাই সংশয়। আমার ব্রাহ্মণীর যা জেদ,—তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কেউ করে সাধ্যি কী! কন্যার বিবাহ, কম দায় তো নয়। ঠাকুরের ভরসায় দেশ ছেড়েছি। এক সময় ভেবেছিলাম, জলে পড়ে যাব। ব্রাহ্মণীর চোপার ভয়ে কতবার নিজেই উধাও হয়েছি।—এখন দেখছি, বাপের দোষ পুত্রে বর্তেছে। ঠাকুরই সব করান, — এজন্য ভাবি না। একটাই ভয়, আমার পুত্র-কন্যার কাজে অন্যের মনে যেন আঘাত না লাগে। 

বাবার ভয়টা যে কী বুঝি। বাবা কী টের পেয়েছেন, পরীকে নিয়ে রায়বাহাদুর বিপাকে পড়েছেন। আমি যার হেতু! পরী এলে তো বাবা শুনেছি খুব খুশি হন। সারাক্ষণ মা মৃন্ময়ী বলতে অজ্ঞান। সেই পরী কী তবে বাবার মনে সংশয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। রায়বাহাদুরের নিজ থেকে আসা, আমাকে চাকরির লোভ দেখিয়ে দেশান্তরী করা,—আমি অবাঞ্ছিত, বাবা কী টের পেয়ে গেছেন! 

স্কুল থেকে ফিরে খেতে বসেছি, মা ভাতের থালা এগিয়ে দেবার সময় বলল, মৃন্ময়ীর দাদু গাড়ি পাঠিয়েছে। 

—গাড়ি? 

—হ্যাঁ, গাড়ি করে তোর বাবাকে নিয়ে গেল। 

মা’র মুখ ভারি প্রসন্ন। বাবা এক জীবনে বিনা টিকিটে আমাদের নিয়ে আস্তানার খোঁজে রেল- ভ্রমণে বের হত, সেই বাবাকে বাড়ি থেকে গাড়ি করে নিয়ে গেছে, ভাবাই যায় না। এ হেন বিস্ময় মা’র জীবনে কখনও ঘটবে মায়া ভাবতেই পারে না। মায়া লাফাতে লাফাতে কোত্থেকে ছুটে এল, জানিস বাবা না, পরীদিদের বাড়ি গেছে। পরীদির দাদু বাবাকে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে। পিলু স্কুল থেকে ফিরে খবরটা পেয়ে খুশি হল না। আমার ঘরে ঢুকে একবার চুরি করে আমাকে দেখল। তার দাদাটি এই খবর পেয়ে যে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বে যেন তার জানাই ছিল। 

সে বলল, কীরে দাদা, প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেন? 

সহসা চিৎকার করে উঠলাম, তোরা কী আমাকে শান্তিতে শুতেও দিবি না। 

পিলু বলল, না! তুই শুয়ে আছিস কেন? 

অবেলায় শুয়ে থাকাটা পিলুর পছন্দ না বুঝি। আমি গুম মেরে গেলে পিলু অস্থির হয়ে পড়ে। বাবার পরীদিদের বাড়ি যাওয়াটা যে ঠিক কাজ হয়নি, পিলু সেটা বোঝে। 

—জানিস দাদা, তারপর কাছে এসে ফিসফিস গলায় বলল, পরীদি এসেছিল। বাবাকে বলে গেছে তুই যেন মর্নিং কলেজে ভর্তি হয়ে যাস। নতুন ক্লাশ খুলেছে। বাবা দুঃখ করে বলেছেন, ওর কী মর্জি জানি না মা। কী যে ছাই ভস্ম ভাবে, খাতায় লেখে, মাথাটা না খারাপ হয়ে যায়। তার ওপর পড়াশোনা করলে, মাথা তো একটা,—এত ধরবে কেন? তবু তুমি যখন বলছ বলব। 

—আমি যে বলেছি, বলতে যাবেন না কিন্তু মেসোমশাই। 

—কী হবে বললে? 

—আমাকে ও দু চোখে দেখতে পারে না। 

—তা আচরণেই টের পাই। তুমি আমাদের বাড়িতে এলেই ক্ষেপে যায়। বল, বোঝাই কি করে, মানুষই মানুষের বাড়িতে আসে। শুধু মানুষ কেন, কীটপতঙ্গ পাখি সব মানুষের চারপাশে বড় হয়। তুমি কাউকেই উপেক্ষা করতে পার না। 

তখনই পরীদি কী ভেবে বলল, ঠিক আছে মেসোমশাই, ওকে আপনি বলতে যাবেন না। আমি দেখি কাউকে দিয়ে খবরটা দিতে পারি কিনা! 

তারপর থেমে পিলু কি যেন ভাবল। সে তার দাদার পাশে বসল। জামা খুলে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখার সময় বলল, বাবা কেন গেল জানিস? 

–কী করে বলব। 

—মা, মা! 

—ও-ঘর থেকে চেঁচাচ্ছ কেন! তোমার ভাত নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব। 

নবমী খোনা গলায় তার ঘর থেকে বলছে, দা-ঠাকুর, খেয়ে নেন গো। সেই কখন চাট্টি মুখে দিয়ে গেছেন। 

পিলু বলল, নবমী আসায় বাড়িটা কেমন ভরে গেছে, নারে দাদা। 

পিলু আবার চিৎকার করছে, মা মা, পরীদির দাদু বাবাকে নিয়ে গেল কেন জান?

রান্নাঘর থেকে মা বলল, কী করে জানব? তোমার বাবা জানে আর পরীর দাদু জানে।

আমি ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছি। কী করব কিছুই ঠিক করতে পারছি না। বাড়িতে থাকলে আরও যেন অস্থির হয়ে পড়ব। জামা গায়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। এই উধাও হয়ে যাওয়ার মধ্যে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। মাথার মধ্যে গিজগিজ করে পরীর ভালবাসার পোকা। 

পরী আমার সর্বনাশ / পরী আমার আকাশ বাতাস / গভীর রাতে নির্জনে একা হাঁটি / দেখি নক্ষত্র হয়ে সে আছে / মাথার উপরে / তার দিগন্ত প্রসারিত ডানার ঝাপটায় / ধুলো ওড়ে / ওড়ে কাঙ্গালের বসন / উলঙ্গ করে দেয় অজ্ঞাতে / —পরী আমার সর্বনাশ / জীবনে / বীজ-বপনে / বিসর্জনে। 

পরী আমার সর্বনাশ, বাড়ি এসে টের পাই। 

পিলু এসে বলল, দাদা রে ঘোর বিপদ। 

বললাম, কী হয়েছে? 

—বাবা শুয়ে পড়েছে। 

—কেন? 

—দুদিন উপবাস করবেন স্থির করেছেন। 

—উপবাস। 

—হ্যাঁ। সব জেনে গেছে। তুই পরীদিকে মেরেছিস। 

—কে বলল? 

—পরীদির দাদুর খুব অসুখ। বাবাকে ডেকে বলেছেন, শেষ জীবনে এত বড় অপমান বাড়ি বয়ে করে যাবে ভাবতে পারিনি বাঁড়ুজ্যে মশাই। আমার সব শেষ। আমার সব অহং ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। আমার একমাত্র অবলম্বন নাতনিটাকে মেরেছে। তারপর থেকেই শয্যা নিয়েছি। আর বাঁচার আকাঙক্ষা নেই। আপনি ধার্মিক মানুষ। আপনাকে না বলতে পারলে আমার মরেও শান্তি নেই। আপনার ছেলের জন্য পরীকে ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এ-সব সাময়িক দুর্বলতা। দূরে গেলেই সেরে উঠবে। 

আমি শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি না। হাত পা কাঁপছে। 

—জানিস দাদা, বাবার সে কী রুদ্রমূর্তি। আক্ষেপ, শেষে এই ছিল কপালে। নারী হল’গে শক্তিরূপিণী দেবী। সে-ই মানুষের শক্তির উৎস। যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। তার গায়ে হাত! এ যে ধনবৌ মহাপাপ! এ-পাপের যে ক্ষমা নেই। আমি কী করব। এমন নিরপরাধ মেয়েটাকে বিলু চড় মেরেছে। এ-পাপের হাত থেকে তোমার ঘরবাড়ি রক্ষা পাবে কী করে। প্রায়শ্চিত্তের বিধান কী আছে জানি না। স্থির করেছি, দু-দিন উপবাস। স্থির করেছি দু-দিন অহোরাত্র চন্ডীপাঠ। তবে দেবী যদি প্রসন্না হন। তারপরই বাবা, মা মা বলে কেঁদে উঠলেন। আমার কোন্ পাপে বিলু এত বড় সর্বনাশ করল ধনবৌ। 

গোটা বাড়িটা নিঝুম। কারো ঘরে কেউ আলো জ্বেলে দেয় নি। নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায় কান পাতলে। মা, বাবার শিয়রে বসে আছে। মায়া ছোট ভাইটা বাবার পায়ের কাছে। নবমী ঠাকুর- ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে আছে। গরুগুলো গোয়ালে তোলা হয়নি। বাবা দেশভাগের দিনও এত ভেঙ্গে পড়েন নি। কেবল ভাবছি সকালে আমার এমন ভালমানুষ বাবাকে মুখ দেখাব কী করে। রাতে আমাকে ডেকে মা সাড়া পেল না। ঘরে ঢুকে বলল, ওঠ খাবি। 

—বাবা খাবে না? 

—তোর বাবার গোঁ তো জানিস। 

আমার চোখ আবার জলে ভেসে যাচ্ছে কেন? বললাম, মা আর কেউ বিশ্বাস না করুক, তুমি বিশ্বাস কর পরীকে আমি মারিনি। আমি সত্যি মারিনি মা। পরীকে আমি কোনদিনই মারতে পারি না। তারপর বললে যেন এমন শোনাত, পরীকে কষ্ট দিলে যে আমার কষ্ট তোমরা কেউ সেটা জান না। 

বাবাকে আর যেন কোনোদিন মুখ দেখাতে পারব না। আমি পরীদের বাড়িতে অবাঞ্ছিত। আজ নিজের বাড়িতেও। গভীর রাতে উঠে একটা চিরকুট লিখলাম, বাবা আপনার কু-পুত্রের মুখ দর্শন করে কষ্ট পান, সেটা আর চাই না। আমি চলে যাচ্ছি। ভাল হয়ে ফিরব। জানবেন, এটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আপনার কোনো পাপ নেই বাবা। পিলুকে লিখলাম, দাদা ফিরবে বলে তুই স্টেশনে গিয়ে বসে থাকিস না। তোর দাদা একদিন না একদিন আবার ঠিক ফিরবে। মা বাবাকে দেখিস। তারপর পিলুকে লিখলাম, পরীকে বলিস, আমার জন্যে সে তার প্রিয় শহর ছেড়ে যেন চলে না যায়। আমিই চলে গেলাম। পরীকে বলিস সে চলে গেলে, কখনও যদি ফিরে আসি, শহরটাকে আমি আর ঠিক ঠিক চিনতে পারব না। শহরটাকে আগের মতো আর ভালবাসতে পারব না। ইতি তোর দাদা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *