মৃত্যু

মৃত্যু

বুড়ো হওয়াতে নাকি কোনও সুখ নেই।

আমি কিন্তু দেখলুম, একটা মস্ত সুবিধা তাতে আছে। কোনও কিছু একটা অপ্রিয় ঘটনা ঘটলে যেমন ধরুন প্রিয়-বিয়োগ–মনকে এই বলে চমৎকার সান্ত্বনা দেওয়া যায় যা এটার তিক্ত স্মৃতি আর বেশিদিন বয়ে বেড়াতে হবে না। মৃত্য তো আসন্ন। যৌবনে দাগা খেলে তার বেদনার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হয় সমস্ত জীবন ধরে। কিংবা, এই যে বললুম, প্রিয়-বিয়োগ– আমার যখন বয়স বছর চৌদ্দটা তখন আমার ছোট ভাই দু বছর বয়সে ওপারে চলে যায়। কালাজ্বরে। তার ছ মাস পরে ব্রহ্মচারীর ইনজেকশন বেরোয়। তার পর যখন গণ্ডায় গণ্ডায় লোক তারই কল্যাণে কালাজ্বরের যমদূতগুলোকে ঠাস ঠাস করে দুগালে চড় কষিয়ে ড্যাং ড্যাং করে শহরময় চষে বেড়াতে লাগল তখন আমার শোক যেন আরও উথলে উঠল। বার বার মনে পড়তে লাগল, ওই চৌদ্দ বছর বয়সেই আমি তার জন্য কত না ডাক্তার, কবরেজ, বদ্যি, হেকিমের বাড়ি ধন্না দিয়েছিলুম। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটে যেতুম মায়ের কাছে শুধাতুম, আজ জ্বর এসেছিল? মা মুখটি মলিন করে ঘাড় ফিরিয়ে নিতেন। একটু পরে বলতেন, আজ আরও বেশি।

আমি চুপ করে বারান্দায় ভাবতে বসতুম– নাহ, এ কবরেজটা কোনও কর্মের নয়। কিন্তু শহরের এই তো নামকরা শেষ কবরেজ। তবে দেখি হেকিম সায়েবকে দিয়ে কিছু হয় কি না—

আপনারা হয়তো ভাবছেন, চৌদ্দ বছরের ছেলে করবে এসব ডিসিশন! বাড়ির কর্তারা করছিলেন কী?

আসলে আমি বুঝতে পারতুম না, কর্তারা, দাদারা এমনকি মা পর্যন্ত অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন, আমার ভাইটি বাঁচবে না। তারা আমাকে সে খবরটি দিতে চাননি। আমার জনের পূর্বে আমার এক দাদা আর দিদিও ওই ব্যামোতে যায়।

ডাক্তার-কবরেজরাও আমার দিকে এমনভাবে তাকাতেন যে, তার অর্থটা আজ আমার কাছে পরিষ্কার– তখন বুঝতে পারিনি। তবু তাদের এই চৌদ্দ বছরের ছেলেটির প্রতি দরদ ছিল বলে আসতেন, নাড়ি টিপতেন, ওষুধ দিতেন।

ওই দুই বছরের ভাইটি কিন্তু আমাকে চিনত সবচেয়ে বেশি–কী করে বলতে পারব না। আমাকে দেখামাত্রই তার রোগজীর্ণ শুকনো মুখে ফুটে উঠত ম্লান হাসি।

সে হাসি একদিন আর রইল না। আমাকে সে ডরাতে আরম্ভ করল। আমাকে দেখলেই মাকে সে আঁকড়ে ধরে রইত। আমার কোলে আসতে চাইত না। আমার দোষ, আমি কবরেজের আদেশমতো তার নাক টিপে, তাকে জোর করে তেতো ওষুধ খাইয়েছিলুম।

ওই ভয় নিয়েই সে ওপারে চলে যায়।

তার সেই ভীত মুখের ছবি আমি বয়ে বেড়াচ্ছি, বাকি জীবন ধরে।

***

ঠিক এক বছর পূর্বে আমার এক প্রিয়-বিয়োগ হয়। এবারেরটা নিদারুণতর। কিন্তু ওই যে বললুম, এটা আর বেশিদিন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে না।

কিন্তু প্রশ্ন, আমি এসব করুণ কথা পাড়ছি কেন? বিশ্বসংসার না জানুক, আমার যে কটি পাঠক-পাঠিকা আছেন তারা জানেন আমি হাসাতে ভালোবাসি। কিন্তু উল্টোরথের পাঠক-পাঠিকারা নিত্য নিত্যি সিনেমা দেখতে যান সেখানে করুণ দৃশ্যের পর করুণ দৃশ্য দেখে ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলেন। ভগ্নহৃদয় নায়ক কীরকম খোঁড়াতে খোঁড়াতে দূর দিগন্তে বিলীন হয়ে যান, আর সুস্থহৃদয় নায়িকা কীরকম ড্যাং ড্যাং করে বিজয়ী সপত্বের সঙ্গে ক্যাডিলাক গাড়ি চড়ে হানিমুন করতে মন্টিকালো পানে রওনা হন। আমার করুণ-কাহিনী তো তাদের কাছে ডাল-ভাত।

তবু আমি ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে এ রচনা আরম্ভ করেছি মহত্তর আদর্শ নিয়ে।

আমাদের সবচেয়ে বড় কবি রবীন্দ্রনাথ। তিনি আর পাঁচটা রসের সঙ্গে হাস্যরসও আমাদের সামনে পরিবেশন করেছেন, অথচ কেউ কি কখনও চিন্তা করে, তার জীবনটা কীরকম বিষাদবহুল ঘটনায় পরিপূর্ণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অন্য যে কোনও সাধারণজন এরকম আঘাতের পর আঘাত পেলে কিছুতেই আর সুস্থ জীবনযাপন করতে পারত না। অথচ রবীন্দ্রনাথকে দেখলে বোঝা যেত না, কতখানি শোক তিনি বুকের ভিতর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি ভেঙে তো পড়েনইনি, এমনকি তীব্র শোকাবেগে কখনও কোনও অধর্মাচরণও করেননি– অর্থাৎ কাব্য সাহিত্য সৃষ্টি, যা তার ধর্ম সেটি থেকে বিচ্যুত হননি। তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তার ঋষিতুল্য সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলেন, আমাদের সকলেরই পা পিছলিয়েছে– রবির কিন্তু কখনও পা পিছলোয়নি।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের আদর পাননি। কিন্তু তার বয়স যখন ৭৮ তখন তার দাদা বিয়ে করে আনলেন কাদম্বরী দেবীকে। বয়সে দুজনাই প্রায় সমান। কিন্তু মেয়েদের মাতলু-বোধটি অল্প বয়সেই হয়ে যায় বলে তিনি তাঁর মায়ের অভাব পূর্ণ করে দেন। এই সমবয়সী দেবরটিকে তিনি দিয়েছিলেন সর্বপ্রকারের স্নেহ ভালোবাসা। প্রভাত মুখো-র রবীন্দ্রজীবনীতে তার সবিস্তার পরিচয় পাঠক পাবেন।

এই প্রাণাধিকা বউদিটি আত্মহত্যা করেন রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন বাইশ। কী গভীর শোক তিনি পেয়েছিলেন তা তাঁর কাব্যে বার বার প্রকাশ পেয়েছে। অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রাতা আত্মহত্যা করলে পর বৃদ্ধ কবি তাকে তখন সান্ত্বনা দিয়ে একখানি চিঠি লেখেন। সেটিও রবী-জীবনীতে উদ্ধৃত হয়েছে। পাঠক পড়ে দেখবেন। কী আশ্চর্য চরিত্রবল থাকলে মানুষ এমনতরো গভীর শোককে আপন ধ্যানলোকে শান্ত সমাহিত করে পরে রসরূপে, কাব্যরূপে নানা ছন্দে নানা গানে প্রকাশ করতে পারে, পাঠক, শ্রোতার হৃদয় অনির্বচনীয় দুঃখে-সুখে মেশানো মাধুর্যে ভরে দিতে পারে। কবির ক্ষয়ক্ষতি বাংলা কাব্যের অজরামর সম্পদে পরিবর্তিত হল। এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গত হলেন, পিতা গত হলেন- এগুলো শুধু বলার জন্যে বললুম, হিসাব নিচ্ছি না।

তার পর পুরো কুড়ি বছর কাটেনি আরম্ভ হল একটার পর একটা শোকের পালা।

প্রথমে গেলেন স্ত্রী।(১) তার বয়স তখন ত্রিশ পূর্ণ হয়নি। (বড় মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ের কয়েক মাস পরেই।} তিন কন্যা আর দুই পুত্র রেখে। সর্বজ্যেষ্ঠর বয়স পনেরো, সর্বকনিষ্ঠের সাত। মাধুরীলতা ছাড়া আর সব কটি ছেলে-মেয়ে মানুষ করার তার রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়ল। রবীন্দ্রনাথের শিষ্য অজিত চক্রবর্তীর (কাব্যপরিক্রমার লেখক) মাতা কৰিজায়ার মৃত্যুর কুড়ি বৎসর পর আমাকে বলেন, মৃণালিনী দেবী তার রোগশয্যায় এবং অসুস্থাবস্থায় তার স্বামীর কাছ থেকে যে সেবা পেয়েছিলেন তেমনটি কোনও রমণী কোনওকালে তার স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছে বলে তিনি জানেন না। তিনি বলেন, স্ত্রীর মানা অনুরোধ না শুনে তিনি নাকি রাত্রির পর রাত্রি তাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেছেন।

রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে যারা পরিচিত তারাই জানেন, স্পর্শকাতর কবিকে এই মৃত্যু কী নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তাকে জীবনের রহস্য শেখায়। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪০/৪১- দেখাত ৩০/৩১। অটুট স্বাস্থ্য। কিন্তু তিনি পুনরায় দারুগ্রহণ করেননি।

এর কয়েক মাস পরেই দ্বিতীয় মেয়ে রেণুকা বারো বছর বয়সেই পড়ল শক্ত অসুখে। যখন ধরা পড়ল ক্ষয় রোগ, তখন কবি তাঁকে বাঁচাবার জন্য যে কী আপ্রাণ পরিশ্রম আর চেষ্টা দিয়েছিলেন তার বর্ণনা দেওয়া আমার শক্তির বাইরে। কিছুটা বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দিয়েছেন– তখনও তিনি জানতেন না, মেয়েটি কিছুদিন পরে তাকে ছেড়ে যাবে। অসুস্থ অবস্থায়ও এই মেয়েটির প্রাণ ছিল আনন্দরসে চঞ্চল। পিতা-কন্যায় গাড়িতে করে স্বাস্থ্যকর জায়গায় যাবার সময় যে মধুর সময় যাপন করেন তার কিছুটা আভাস পাঠক পাবেন পলাতকার ফাঁকি কবিতাতে।

(বছর দেড়েক চিকিৎসাতে করলে যখন অস্থি জর জর

তখন বললে হাওয়া বদল করো।

পাঠক, এই তখন শব্দটির দিকে লক্ষ রাখবেন। রোগের প্রথম অবস্থায় নয়–যখন মৃত্যু আসন্ন। এ নিদারুণ অভিজ্ঞতা ক্ষয়-রুগীর অনেক আত্মীয়-স্বজনের হয়েছে।

দু বছরের ভিতরই দুইটি অকালমৃত্যু–অর্থহীন, সামঞ্জস্যহীন, যেন মানুষকে নিছক পীড়া দেবার জন্য ভগবান তাকে পীড়া দিচ্ছেন। তার পর চার বছর যেতে না যেতেই সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ তেরো বছর বয়সে এক বন্ধুর সঙ্গে ছুটিতে বেড়াতে যায় মুঙ্গেরে। সেইখানে শমীন্দ্রের কলেরা হয়; কবি টেলিগ্রাফ পাইয়া কলিকাতা হইতে মুঙ্গের চলিয়া গেলেন। রবীন্দ্রনাথই এই সময়ের এক চিঠিতে লিখছেন, যে সংবাদ শুনিয়াছেন তাহা মিথ্যা নহে। ভোলা মুঙ্গেরে তাহার মামার বাড়িতে গিয়াছিল, শমীও আগ্রহ করিয়া সেখানে বেড়াইতে গেল, তাহার পরে আর ফিরিল না।

অনেকের মুখেই শুনেছি, শমীন্দ্র তার পিতার সবচেয়ে আদরের সন্তান ছিলেন। প্রভাত মুখোপাধ্যায় বলেন, সে আকৃতিতে প্রকৃতিতে পিতার অনুরূপ ছিল।

ঠিক পাঁচ বৎসর পূর্বে ওইদিনে কলিকাতায় শমীন্দ্রের মায়ের মৃত্যু হয়। প্রভাত মুখোপাধ্যায়।

কয়েক বৎসর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই পুত্রের স্মরণে যে কবিতা লেখেন তাতে আছে,

বিজু যখন চলে গেল মরণপারের
 দেশে বাপের বাহু-বাঁধন কেটে।
মনে হল, আমার ঘরের সকাল যেন মরেছে বুক ফেটে।

আবার অকালমত্য। শুধু ভগবান জানেন তার ভূমণ্ডল ব্যবস্থায়, ত্রিলোক নিয়ন্ত্রণে ইন হিজ স্কিম অব থিংস-এর কী প্রয়োজন?(২) শমী আমাদের পুত্র নয়, কিন্তু এ কবিতাটি পড়ে কার না বুক ফাটে? এ কবিতাটি আমি জীবনে মাত্র একবার পড়েছি। দ্বিতীয়বার পড়তে পারিনি।

এর পর দশ বছর কাটেনি। সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান, বড় মেয়ে মাধুরীলতার হল ক্ষয়রোগ। প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, আমিও শুনেছি, মাধুরীর স্বামীর সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সদ্ভাব ছিল না (যদিও তাঁর পিতার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল বলেই এ বিয়ে হয়। কবি বিহারী চক্রবর্তী ছিলেন কাদম্বরী দেবীর সর্বাপেক্ষা প্রিয় কবি)। রবীন্দ্রনাথ দুপুরবেলা মেয়েকে দেখতে যেতেন বন্ধ গাড়িতে করে। জামাই তখন আদালতে। সমস্ত দুপুর মেয়েকে গল্প শোনাতেন। হয়তো-বা কবিতা পড়তেন। বোধহয় তারই দু-একটি পলাতকা (নামকরণ অবশ্য পরে হয়) বইয়ে স্থান পেয়েছে।

একদিন দুপুরে বাড়ির সামনে পৌঁছতেই বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। কবি কোচম্যানকে গাড়ি ঘোরাতে হুকুম দিলেন। বাড়িতে প্রবেশ করলেন না। আমি শুনেছি, এই মেয়ে নাকি বড় উৎসুক আগ্রহে পিতার লেখার জন্য প্রতীক্ষা করতেন। ভাগলপুরে, কলকাতায়।

বহু বহু বত্সর পর এর সখী ঔপন্যাসিকা অনুরূপা দেবী লেখেন, (উভয়ের শ্বশুরবাড়ি ভাগলপুর বোধহয় সেইসূত্রে পরিচয় ও সখ্য) মেয়ের স্মরণে কবির চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বোধহয় পলাতকার মুক্তি কবিতায় এ মেয়ের কিছুটা বর্ণনা পাওয়া যায়।

***

পূর্বেই বলেছি, মাধুরীলতার রোগশয্যায় কবি তাকে গল্প বলতেন। এবং শেষের দিকে বোধহয় বেদনার সঙ্গে অনুভব করেছিলেন যে এ মেয়েও বাঁচবে না। তখন তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন, তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, এরা সব তার মায়ার বন্ধন কেটে সময় হবার বহু পূর্বেই পালিয়ে যাচ্ছেন–এরা সব পলাতকা। তাই মাধুরীলতার মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই বেরুল পলাতকা। এই বইয়ের ওপর মাধুরী, রেণুকা, শমী তিনজনের ছাপ স্পষ্ট রয়েছে। আরও হয়তো কয়েক জনের ছাপ রয়েছে, কিন্তু তারা হয়তো তার পরিবারের কেউ নয়, তাই তাদের ঠিক চেনা যায় না।

পলাতকার সর্বশেষের কবিতাটিতে আছে,– কবিতাটির নাম শেষ প্রতিষ্ঠা–

এই কথা সদা শুনি, গেছে চলে, গেছে চলে
তবু রাখি বলে
 বোলো না সে নাই।

***

আমি চাই সেইবানে মিলাইতে প্রাণ।
যে সমুদ্রে আছে নাই পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।

এই কবিতাটি কবির সর্ব পলাতকার উদ্দেশে লেখা। কিন্তু প্রশ্ন, আছে ও নাই দুটোই একসঙ্গে অস্তিত্ব রাখে কী প্রকারে? কবি এর উত্তর দিলেন– অবশ্য সে উত্তরে সবাই সন্তুষ্ট হবেন কি না জানিনে তাঁর জীবনের শেষ শোকের সময়।

পলাতকার সব কটি পালিয়ে যাবার পর কবির রইলেন, পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও কন্যা মীরা। এই মীরাদির একটি পুত্র ও কন্যা। এ নাতিটিকে রবীন্দ্রনাথ যে কীরকম গভীর ভালোবাসা দিয়ে ডুবিয়ে রেখেছিলেন সেকথা ওই সময়ে আশ্রমবাসী সবাই জানে। একটু ব্যক্তিগত কথা বলি–নীতু যদিও আমার চেয়ে বছর নয়েকের ছোট ছিল তবু হস্টেলে সে প্রায়ই আমার ঘরে আসত। ভারি প্রিয়দর্শন ছিল সে। মাঝে মাঝে ফিনফিনে ধুতি কুর্তা পরে এলে মানাত চমৎকার– আমরা গুতুম, কে সাজিয়ে দিল রে।

সে উত্তর না দিয়ে শুধু মিট মিট করে হাসত। চট্টগ্রামের জিতেন হোড় বলত, নিশ্চয়ই দাদামশাই। আমি বললুম, মা। (আশা করি, এ লেখাটি মীরাদি বা তার মেয়ে বুড়ির চোখে পড়বে না তাদের শোক জাগাতে আমার কতখানি অনিচ্ছা সেকথা অন্তর্যামী জানেন। সেই নীতু গেল ইয়োরোপে। ক্ষয়রোগে মারা গেল ১৯/২০ বছর বয়সে। এই শেষ শোকের বর্ণনা দিতে কারওই ইচ্ছা হবে না। কবির বয়স তখন ৭১। একে নিজের শোক, তার ওপর কন্যা পুত্রহারা মাতার শোক।

শুধু একটি সামান্য ঘটনার উল্লেখ করি– শ্রীযুক্তা নির্মলকুমারী মহলানবিশের বাইশে শ্রাবণ থেকে নেওয়া।

রবীন্দ্রনাথ তখন থাকতেন বরানগরে মহলানবিশদের সঙ্গে। বন্ধু এজ সায়েবের কাছ থেকে চিঠি পেলেন, নীতুর শরীর আগের চেয়ে একটু ভালো।

পরদিন সকালবেলা খবরের কাগজে রয়টারের টেলিগ্রামে দেখলাম, ছ দিন (দু দিন?) আগে ৭ আগস্ট জার্মানিতে নীতুর মুত্যু হয়েছে।

এ খবরটা রবীন্দ্রনাথের কাছে ভাঙা যায় কী প্রকারে?

শেষে স্থির হল খড়দায় রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীকে টেলিফোন করে আনিয়ে আমরা চারজনে একসঙ্গে কবির কাছে গেলে কথাটা বলা হবে। প্রতিমাদি এলে সবাই মিলে কবির ঘরে গিয়ে বসা হল। রথীন্দ্রনাথকে কবি প্রশ্ন করলেন, নীতুর খবর পেয়েছিস, সে এখন ভালো আছে, না? রথীবাবু বললেন, না, খবর ভালো না। কবি প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। বললেন, ভালো? কাল এজও আমাকে লিখেছেন যে নীতু অনেকটা ভালো আছে। হয়তো কিছুদিন পরেই ওকে দেশে নিয়ে আসতে পারা যাবে।(৩) রথীবাবু এবার চেষ্টা করে গলা চড়িয়ে বললেন, না, খবর ভালো নয়। আজকের কাগজে বেরিয়েছে। কবি শুনেই একেবারে স্তব্ধ, রথীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। একটু পরেই শান্তভাবে সহজ গলায় বললেন, বৌমা আজই শান্তিনিকেতন চলে যান, সেখানে বুড়ি একা রয়েছে। আমি আজ না গিয়ে কাল যাব, তুই আমার সঙ্গে যাস।

নীতুর মা জর্মনি গিয়েছিলেন পুত্রের অসুস্থতার খবর পেয়ে। তিনি যেদিন বোম্বাই পৌঁছবেন, তার কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বোম্বাইয়ের ঠিকানায় চিঠি লেখেন। তাতে সেই আছে ও নাই-য়ের উত্তর আছে। তাতে এক জায়গায় তিনি লেখেন, যে রাত্রে শমী গিয়েছিল(৪), সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে যেন না টানে। তেমনি নীতুর চলে যাওয়ার কথা যখন শুনলুম তখন অনেকদিন ধরে বার বার করে বলেছি, আর তো আমার কোনও কর্তব্য নেই, কেবল কামনা করতে পারি এর পরে যে বিরাটের মধ্যে তার গতি, সেখানে তার কল্যাণ হোক। সেখানে আমাদের সেবা পৌঁছয় না, কিন্তু ভালোবাসা হয়তো-বা পৌঁছয়– নইলে ভালোবাসা এখনও টিকে থাকে কেন?

এই সেই মূল কথা। সে নেই কিন্তু আমার ভালোবাসার মধ্যে সে আছে। বার বার নমস্কার করি শুরুকে, গুরুদেবকে। বার বার দূরদৃষ্টের সঙ্গে কঠোর সংগ্রামে তিনি কাতর হয়েছেন, কিন্তু কখনও পরাজয় স্বীকার করেননি।

এবং পাঠক-পাঠিকাদের উপদেশ দিই, প্রিয়-বিয়োগ– এমনকি প্রিয়বিচ্ছেদ হলে তারা যেন উপরে বর্ণিত এই চিঠিখানা পড়েন। এ চিঠি মুক্তপুরুষের লেখা চিঠি নয়। কারণ গীতায় আছে মুক্তপুরুষ দুঃখে অনুদ্বিগ্নমন। রবীন্দ্রনাথ দুঃখে আমাদের মতোই কাতর হতেন– হয়তো-বা আরও বেশি; কারণ তার দিলের দরদ, হৃদয়ের স্পর্শকাতরতা ছিল আমাদের চেয়ে লক্ষগুণ বেশি কিন্তু তিনি পরাজয় মানতেন না। আমরা পরাজয় মেনে নিই। এ চিঠি যদি একজনকেও পরাজয়-স্বীকৃতি থেকে নিষ্কৃতি দেয় তবে অন্যলোকে রবীন্দ্রনাথ তৃপ্ত হবেন।

সহৃদয় পাঠক, তুমি সিনেমা দেখতে যাও। সেখানে যদি কোনও ছবিতে তোমার হিরোর জীবনে পরপর এতগুলো শোকাবহ ঘটনা ঘটত তবে তুমি বলতে, এ যে বড় বাড়াবাড়ি। এ যে অত্যন্ত অবাস্তব, আরিয়ালিস্টিক।

তাই বটে। যা জীবনে বাস্তব তা হয়ে যায় সিনেমায় অবাস্তব! আশ্চর্য! আমার কাছে আবার সিনেমাটা অত্যন্ত অবাস্তব ঠেকে।

তাই সিনেমাওয়ালাদের কাছেই রবীন্দ্র-জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর অধ্যায় তুলে ধরলুম। নইলে রবীন্দ্রনাথের শোক ও কাব্যে তার প্রতিচ্ছবি এ জাতীয় ডক্টরেট থিসিস লেখবার বয়স আমার গেছে। আর তাই এ রম্যরচনাটি আরম্ভ করেছি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। কারণ আমার জীবন আর তোমাদের পাঁচজনের জীবনের লেশমাত্র পার্থক্য নেই। তফাৎ যদি থাকে, তবে শুধু এইটুকু যে, তোমরা মনোবেদনা গুছিয়ে বলতে পার না বলে গুমরে গুমরে মরো বেশি। কিন্তু তোমাদের এই বলে সান্ত্বনা জানাই, যতদিন তোমার প্রিয়জন তোমার প্রতি সহৃদয় ততদিন তোমার না বলা সত্ত্বেও সে তোমার হৃদয়ের সব কথাই বোঝে। আর যেদিন তার হৃদয় বিমুখ হয়ে যায়, সেদিন যতই গুছিয়ে বল না কেন, সে শুনবে না। কাজেই না-বলতে পারাটা তোমাকে গুছিয়ে-বলতে-পারার বিড়ম্বনা থেকে অন্তত বাঁচাবে।

———

১. ইনি কী রোগে গত হন জানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, উদরের পীড়া, খুব সম্ভব এপেন্ডিসাইটিস। আমি বাল্যকালে গুরুজনদের মুখে শুনেছি সূতিকা।

২. রবীন্দ্রনাথও পুত্রহারা-মাতা তার কন্যার দিকে তাকিয়ে শুধিয়েছেন, তুমি স্থির সীমাহীন নৈরাশ্যের তীরে নির্বাক অপার নির্বাসনে। অহীন তোমার নয়নে অবিরাম প্রশ্ন জাগে যেন–কেন, ওগো কেন?– দুর্ভাগিনী, বীথিকা, পৃ, ৩০৯

৩. এর আগের দিন রথীন্দ্রনাথ শ্রীযুক্ত মহলানবিশকে বলেন, কাল এজের চিঠি পেয়ে অবধি নীতুর জন্য মনটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, যদিও তিনি লিখেছেন, ও এখন একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সাহেব লিখেছেন, নীতুকে হয়তো শিগগিরই দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তা হলে তাবছি তাকে একটা কোনও ভালো জায়গায় অনেকদিন ধরে রেখে দেব। ভাওয়ালি কি কোনও পাহাড়ে বেশ কিছুদিন থাকলেই সেরে উঠবে। পৃ. ২৮

 ৪. এর মৃত্যুর কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। এবং আরও বলেছি মাতা ও পুত্র যান একই দিনে, এবং আশ্চর্য, দাদামশাই ও নাতি যান একই দিনে। (২২ শ্রাবণ)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *