মৃত্যু সংকেত
অতিপ্রাকৃত ঘটনার মধ্যে উপরের সারিতে থাকবে মৃত্যু সংকেতের ব্যাপারটা। কখনও মৃত্যু সংকেত আসে যিনি মারা যাবেন তাঁর কাছে। আবার অনেক সময় মৃত্যুর আভাস পান অন্য কেউ। অনেক সময়ই কোনো নারী মূর্তি হাজির হন সংকেত দেওয়ার জন্য। স্বপ্নেও পাওয়া যায় কখনও কখনও মৃত্যুর বার্তা। এসব কিছু নিয়েই ‘মৃত্যু সংকেত’।
বানশি (প্রথম পর্ব)
আয়ারল্যাণ্ডের সব ধরনের ভূত, প্রেত, পেত্নীর মধ্যে সাধারণ লোকেদের কাছ সবচেয়ে পরিচিত বানশি। কখনও কখনও একে বহিস্থা কিংবা বানকিস্থা নামেও ডাকা হয়। বানশি এখানকার লোকদের দেখা দিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। তবে তার ইতিহাস কতটা প্রাচীন এটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
বানশির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো সে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে। তবে তার এই মৃত্যুসংকেত দেওয়ার রীতি আগের জমানা থেকে এখন বদলেছে। পুরানো দিনে আইরিশ গল্পে মানুষের মাথাঅঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা রক্তরঞ্জিত পোশাক ধুতে দেখা যেত বানশিকে। যতক্ষণ না পানি পুরোপুরি রক্তে লাল হয়ে যেত ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধোয়াধুয়ি চলত। তবে ইদানিং কালে সাধারণত চিল্কার করতে করতে হাত আঁকিয়ে বা তালি দিয়ে মৃত্যুর বার্তা দেয় বানশি।
এদিকে তার পোশাক-আশাক আর চেহারার নানান ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনও কখনও সে তরুণী, সুন্দরী। কখনও আবার বুড়ো, কদাকার। একজন লেখক যেমন তার বর্ণনা দিয়েছেন, লম্বা, কৃশ এক নারী। যার মাথার খোলা লম্বা চুল নেমে এসেছে কাঁধের চরপাশে। পরনে সাদা আলখেল্লা। সেই সঙ্গে আছে কাপা, টানা চিৎকার। আবার এক কোচোয়ান তাকে এক সন্ধ্যায় একটা বাড়ির আঙিনায় বসে থাকতে দেখেছে। তরে তখন সে নীল চোখের ছোটখাট এক মহিলা। ঘাড় বেয়ে নেমে এসেছে লম্বা পাতলা চুল। আর পরনে লাল আলখেল্লা। তবে এখন যে কাহিনিগুলো আমরা পাঠকদের শোনাব তাতে মিলবে তার আরও নানান ধরনের বর্ণনা।
পুরানো আর বিখ্যাত বানশি কাহিনিগুলোর একটি পাওয়া যায় লেডি ফানশর স্মৃতিকথায়। ১৬৪২ সালে স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে এক ব্যারন বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান তিনি। পরিখা ঘেরা পুরানো ধরনের একটা দুর্গবাড়িতে থাকেন ভদ্রলোক। রাতে কলজে চরা, অতিপ্রাকৃত একটা চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল লেডি ফানশর। বিছানা থেকে তাকাতেই জানালার ওপাশে একটি নারীর মুখ আর শরীরের কিছু অংশ ভাসতে দেখলেন, চাঁদের আলোয়। মাটি থেকে জায়গাটার উচ্চতা আর পরিখার উপস্থিতি বলে দিল, তাঁর দেখা এই চেহারাটা মোটেই এই পৃথিবীর কারও নয়। মুখটা তরুণী, সুন্দর চেহারার এক নারীর। তবে বড় ফ্যাকাসে, লালচে চুলগুলো আলুথালু। আতংকে ফানশ ওটার পরনের পোশাক খুঁটিয়ে খেয়াল করলেন না। তবে পুরানো, আইরিশ পোশাক মনে হলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই ঝুলে থাকল নারীমূর্তিটা। তারপর শুরুতে যেমন চিৎকারে লেডি ফানশর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সেরকম দুটো তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে অদৃশ্য হল।
সকালে আতংকে প্রায় কাঁপতে-কাঁপতে গৃহকর্তাকে কী দেখেছেন তা খুলে বললেন। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক তাঁর কথা পুরোপুরি মেনে নিলেন। শুধু তাই না, এর ব্যাখ্যা হিসাবে নিজের পরিবারের অবিশ্বাস্য এক কাহিনি শোনালেন।
আমার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় গত রাতে এই দুর্গে মারা গেছেন, বললেন তিনি। এমনটা ঘটতে পারে এটা জানা সত্ত্বেও আপনার কাছে এটা গোপন করেছিলাম। কারণ মনে হয়েছে আপনি যে হাসি-আনন্দে মেতে থাকার জন্য এখানে এসেছেন, তাতে এটা কালো ছায়া ফেলতে পারে। আমাদের পরিবারে কিংবা দুর্গে কারও মৃত্যুর আগে সবসময়ই আপনি যাকে দেখেছেন সেই নারী মূর্তিটি দেখা দেয়। ধারণা করা হয় নিম্নগোত্রের একজন মহিলার আত্মা সে। আমার এক পূর্বপুরুষ জাত-পাতের বাইরে গিয়ে তাকে বিয়ে করেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। আর পরিবারের প্রতি যে অসম্মান করেছেন তা ঢাকতে স্ত্রীকে পরিখায় ফেলে মারেন। এর পর থেকেই এই মহিলা বানশি হয়ে দেখা দেওয়া শুরু করেন।
বানশির পরের যে কাহিনিটি বলব সেটি পাঠিয়েছেন টি.জে.ওয়েস্ট্রপ। চলুন, তবে সরাসরি গল্পতে চলে যাওয়া যাক।
আমার নানী এটা শোনেন তাঁর মা রস-লিউইনের কাছ থেকে, যিনি নিজেই ছিলেন ঘটনাটির সাক্ষী। তাদের বাবা মি. হ্যারিসন রস-লিউইন আইন ব্যবসার কাজে তখন ডাবলিনের বাইরে গিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে বাড়ির ছেলে-মেয়েরা কয়েক মাইল দূরে বাস করা এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান।
সেটি ছিল চমৎকার একটি রাত। চঁদের আলোও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। তবে কিলক্রিস্টের পুরানো গির্জাটার পশ্চিমে গাছপালা আর ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যখন এগিয়েছে তখন রাস্তাটার বেশ একটা অংশে অন্ধকারের রাজত্ব। গির্জাটা পুরানো দিনের ধবংসপ্রাপ্ত অন্য অট্টালিকাগুলোর মতই আয়তাকার একটা অট্টালিকা। চারপাশে লম্বা পাঁচিল। তবে এই মুহূর্তে পাঁচিল ভেঙে-চুরে যাওয়ায় গির্জা আর এর ধারের সমাধি দুটোই উন্মুক্ত। লম্বা, অন্ধকার পথটা ধরে যাবার সময় দূর থেকে তীক্ষ্ণ কান্না আর হাততালির শব্দ শুনতে পেলেন তারা। সাধারণত মৃত্যুর সময় আয়ারল্যাণ্ডবাসীরা এভাবে শোক করে। দ্রুত এগিয়ে গির্জার কাছে চলে এলেন তাঁরা। এখানে এসেই চমকে উঠলেন। গির্জার পাঁচিলের ওপর ধূসর চুলের ছোট্ট একজন মহিলা, যার পরনে গাঢ় একটা আলখেল্লা, দৌড়াদৌড়ি করছে। আর চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে হাত ছুঁড়ছে। মেয়েরা ভয় পেয়ে গেলেন। তবে ছেলেরা সামনে এগিয়ে গেলেন, তাদের দুজন গির্জার সীমানায় ঢুকে পড়লেন। তবে তখনই নারীমূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারও হদিস পেলেন না তাঁরা। ইতোমধ্যে অজানা একটা ভয় চেপে ধরেছে সবাইকে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ির দিকে ছুটলেন। বাড়িতে পৌঁছতেই তাদের মা দরজা খুললেন। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার চেহারা। আতংকিত কণ্ঠে বললেন স্বামীর জন্য ভয় পাচ্ছেন তিনি। কারণ চাঁদের আলোয় জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছেন এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে। আগুনে চোখের বিশাল একটা কাক এসে জানালার চৌকাঠের ওপর বসে পর পর তিনবার কাঁচে ঠকঠক শব্দে টোকা দিয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতাটা মাকে বললে ভদ্রমহিলা আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এসময়ই আবার কাছের জানালাটায় ট্যাপ ট্যাপ শব্দ হলো। তাকাতেই তাঁরা দেখলেন পাখিটা ফিরে এসেছে। কয়েক দিন পরে তাঁরা খবর পেলেন, মি. রস-লিউইন ডাবলিনে মারা গিয়েছেন। এটা ছিল ১৭৭৬ সাল।
.
এবারের অভিজ্ঞতাটি একজন রোমান ক্যাথলিক বিশপের বোনের। তাঁর কিশোরী বয়সের ঘটনা এটি। এক সন্ধ্যায় আরও কিছু ছেলে-মেয়ের সঙ্গে হাঁটতে বের হন তিনি। রাস্তা ধরে হাঁটতে-হাঁটতে একটা বাড়ির গেট অতিক্রম করে গেলেন। রাস্তার ধারেই বিশাল একটা পাথর আছে এই জায়গাটায়। পাথরটার ওপর কিছু একটাকে বসে থাকতে দেখলেন তারা। কাছাকাছি হতেই ছোট্ট, গাঢ় পোশাকের একজন বুড়ো মহিলা বলে চিনতে পারলেন ওটাকে। হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করল সে, আর হাততালি দিচ্ছে। সাহসী দু-একজন মহিলাটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে উল্টো ঘাবড়ে গেলেন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ওখান থেকে কেটে পড়লেন সবাই। পরদিন জানা গেল যে বাড়ির সামনে নারী মূর্তিটিকে কাঁদতে দেখা গেছে সেই বাড়ির কর্তা মারা গিয়েছেন। শুধু তাই না তিনি মারা গেছেন ওই সময় যখন মহিলাটিকে দেখেছে ছেলে-মেয়েরা।
ভয়ঙ্কর মুখ
ফ্রান্সে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ভবিষ্যৎ এক দুর্ঘটনার সংকেত পেয়েছিলেন। যদিও কেবল একটা ইংগিত ছিল ওটা, তবে আসলে এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতের একটি মর্মান্তিক ঘটনার কাহিনি। অশুভ সংকেত দেওয়া চেহারাটা এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে তা ভুলতে পারেননি রাষ্ট্রদূত। আর এটাই জীবন বাঁচিয়ে দেয় তার।
১৮৭৯ সাল। ফ্রান্সে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড ডাফেরিন এক বন্ধুর সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছেন। তাঁর বন্ধু থাকেন আয়ারল্যাণ্ডে।
এক রাতে হঠাৎ গভীর ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন ডাফেরিন। স্বপ্নে অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখেছেন। তবে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অন্য কোনো একটা কারণ আছে। অস্বস্তি নিয়ে কিছুটা সময় বিছানায় বসে রইলেন। তারপর বিছানা থেকে উঠে লন আর ফুল বাগনের দিকে মুখ-করা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলেন একজন লোক পিঠে একটা কফিন নিয়ে হেঁটে চলেছে।
লর্ড ডাফেরিন দুঃসাহসী মানুষ। বেরিয়ে এসে লোকটাকে থামিয়ে জানতে চাইলেন, কফিনের ভিতরে কী?
মুখ তুলে তাঁকে দেখল লোকটা। গা কাঁটা দিয়ে উঠল ডাফেরিনের। ভয়ঙ্কর একটা চেহারা। চোখের নীচের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মুখ আর শরীরের চামড়া মনে হচ্ছে বহু পুরানো আর শুকনো, খসখসে। যেন একটা কংকালের শরীরে চামড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রথমে আতংকে জমে গেলেন লর্ড ডাফেরিন। তবে সাহস সঞ্চয় করে আবার লোকটার কাছে জানতে চাইলেন, এত রাতে কফিনটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তুমি?
জবাবে লোকটা তার দিকে এগিয়ে এল। তারপরই ডাফেরিনের ভিতর দিয়েই যেন গলে বেরিয়ে গেল এবং অদৃশ্য হলো।
সকালে এখানকার বন্ধুদের ঘটনাটি খুলে বললেন ডাফেরিন। ভুতুড়ে বিয়য়ে ভাল জানাশোনা আছে এমন কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বললেন। তবে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের এই রাতের অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না কেউই। ধীরে-ধীরে ঘটনাটি মুছে গেল সবার মন থেকে।
চার বছর পরের ঘটনা। লর্ড ডাফেরিনের নিজের মনেও সেই রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্মৃতি ফিকে হতে শুরু করেছে। প্যারিসের গ্র্যাণ্ড হোটেলে এক আমন্ত্রণে গিয়েছেন লর্ড।
তাঁর সেক্রেটারি, সহকারি আর ব্যক্তিগত পরিচারকও সঙ্গে গিয়েছেন। লিফটে ঢোকার মুহূর্তে স্থির হয়ে গেলেন লর্ড। হঠাৎই তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল চার বছর আগের এক রাতে আয়ারল্যাণ্ডে দেখা লর্ড ডাফেরিন সেই অশুভ মুখটার কথা। লিফটম্যান ওই একই ব্যক্তি। কোনো সন্দেহ নেই তাঁর।
সেক্রেটারি আর সহকারীকে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে লিফটটা তাদের রেখেই চলে গেছে। লর্ড তখনও ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা বলা শেষ করেননি। এমন সময় চড়া একটা শব্দ হলো। পুরো হোটেলে হৈচৈ পড়ে গেল। লিফটটা যখন পঁচতলায় পৌঁছে তখন দড়ি ছিঁড়ে যায় ওটার, আর নীচে পড়ে ধপাস করে। লিফটে যে কয়েকজন লোক ছিলেন মারা গিয়েছেন সবাই। লর্ড ডাফেরিন দেখলেন হোটেলের কর্মচারীরা মৃত লোকদের সরিয়ে নিচ্ছে লিফটের ধ্বংস্তুপ থেকে। তবে যার কারণে তার লিফটে ওঠা হয় নি, সেই লোকটাকে দেখা গেল না লিফটে।
পরে লর্ড জনতে পারলেন সেদিন হোটেলের লিফটম্যান ডিউটিতেই আসেনি। তবে এই লোকটা এল কোথা থেকে? তার পরিচয়ই বা কী? এই কাহিনিটি লিপিবদ্ধ আছে ব্রিটিশ সোসাইটি অভ সাইকিক রিসার্চ বইয়ে। তবে সেখানে একে দেখানো হয়েছে অমীমাংসিত এক রহস্য হিসাবে। এমনকী এর কোনো সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি।
কফিনে কে?
এবারের ঘটনাটিতে আগের ঘটনাটির সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। এটি বর্ণনা করেছেন ইংল্যাণ্ডের ক্ল্যাপটনের ব্লারটন রোডের মিসেস ক্রফটস।
তাঁর স্বামীর মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা এটি। মিসেস ক্রফটস, আর তাঁর স্বামী ঘুমাতে গিয়েছেন বিছানায়। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুম এল না ভদ্রমহিলার। কিছুক্ষণ এপাশওপাশ করে উঠে বসলেন। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই অদ্ভুত একটি বিষয় নজর কাড়ল তাঁর। হঠাত্র সদর দরজাটা খুলে গেল। এখান থেকে ওটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। কারণ তাঁদের শোবার ঘরের দরজা খোলাই থাকে সবসময়। দরজা খোলার একটু পরই দুজন লোক ঢুকল বাড়িতে। তবে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো একটা কফিন বয়ে আনছে তারা। অবাক হলেও কেন যেন সেরকম ভয় হলো না মিসেস ক্রফটসের। তারপরই কফিনটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল লোক দুজন। মি. আর মিসেস ক্রফটস যে কামরায় আছেন সেখানে চলে এল তারা। ফ্লায়ারপ্লেসের মেঝেতে নামিয়ে রাখল ওটা। তারপর নীচে নেমে সামনের দরজা ভেজিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। পুরো সময়টায় একটা কথাও বেরোল না মিসেস ক্রফটসের মুখ থেকে। তারপরই যেন একটা ঘোর থেকে বের হয়ে এলেন মিসেস ক্রফটস। কফিনটারও কোনো নাম-নিশানা পেলেন না।
রাতে আর ঘুমাতে পারলেন না। সকালে নাস্তার টেবিলে স্বামীকে খুলে বললেন গোটা ঘটনাটা। মি. ক্রফটস হেসে স্ত্রীকে বললেন, স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। ভদ্রমহিলাও মন থেকে ঝেড়ে ফেললেন ওটাকে। এক সপ্তাহ পর হঠাৎ মারা গেলেন তার স্বামী। সন্ধ্যার পর ওপর তলার একটা কামরায় কাজ করছিলেন মিসেস ক্রফটস। এসময় দরজায় টোকা পড়ল। তিনি ওপরে কাজ করতে থাকায় তার মা দরজা খুলে দিলেন। তারপরই দরজায় পদশব্দ শুনলেন। মুখ তুলে চাইতেই শিউরে উঠলেন। কফিন হাতে দুজন লোক, আর তিনি এক সপ্তাহ আগে যে লোকদুজনকে দেখেছেন তারাই। তারপর এগিয়ে এসে যেখানে আগেরবার রাখতে দেখেছিলেন মিসেস ক্রফটস সেখানেই নামিয়ে রাখল কফিনটা। মিসেস ক্রফটস শুধু আতংক আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কফিনটার দিকে।
মৃত্যু পরোয়ানা
টমাস, লর্ড লিটলটনের কাছে রাতে যে এসেছিল, আর ভয়ঙ্কর সতর্কসংকেত দিয়েছিল, সে কি ভূত ছিল নাকি স্বপ্নের কোনো চরিত্র, তা কখনও জানতে পারব না আমরা। এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে বিস্তর। কিছু লোক ভূতে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে করেন না। এমনকি যখন ভবিষ্যদ্বাণীটা এল তারপরও মনে হয়েছিল ওটা আসলে কিছুই না। এমনকী মৃত্যুর আধ ঘণ্টা আগে লর্ড লিটলটন নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন ভুতুড়ে অতিথি স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নন। আসলেই কি তাই?
১৭৭৯ সালের নভেম্বরের এক সন্ধ্যা। লর্ড লিটলটন তাঁর খাস ভৃত্যকে ডেকে বললেন তিনি ঘুমাতে যাবেন। ভুরু কুঁচকে উঠল ভৃত্যের। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস নেই তার মালিকের। সাধারণত বিছানায় যান মধ্যরাতের পরে, কখনও কখনও বাড়িতে অতিথি থাকলে তো ভোর পর্যন্ত আড্ডা চলে। কাজেই কামরা ছাড়ার আগে একটু দ্বিধা করল সে।
আশা করি, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েননি? বলল সে।
না, উইলিয়াম। সেরকম কিছু না। আমি বেশ ভাল আছি। তবে আমার মনে হয় এখন ঘুমাতে যাওয়া উচিত। ক্লান্তি লাগছে, তাছাড়া আবহাওয়াটা কেমন দেখেছ তো। ভারি আর স্যাঁতস্যাঁতে। মনে হচ্ছে যেন একটা ঝড় আসতে চলেছে।
স্নায়ুগুলোকে শান্ত করার জন্য একটা ওষুধ খেলেন লর্ড লিটলটন। তারপর বিশাল খাটটায় শুয়ে পড়লেন। উইলিয়াম খাটের চারধারের পর্দা টেনে দিল। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। একটার পর একটা মিনিট পেরিয়ে যেতে লাগল। বাইরের গুমোট আবহাওয়ায় হঠাৎ করেই দমকা বাতাস বইল। বাগানের গাছগুলোতে খস খস শব্দ তুলে বয়ে গেল, আর জানালায় ডালপালা বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো। আর এই শব্দ নিরুদব একটা ঘুমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন লর্ড লিটলটন। মাথায় নানান চিন্তা এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। এর সঙ্গে তাকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে প্যারিস চার্চের ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ।
এভাবে মনে হয় কয়েকটা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আস্তে-আস্তে ঘুমে জড়িয়ে আসছে লিটলটনের চোখ। এসময়ই একটা অন্যরকম শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে গেল। মনে হয় যেন দড়িতে টার্ন পড়েছে এভাবে বিছানায় উঠে বসলেন, আর অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলেন। শব্দটাকে বিশাল কোনো পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজের মত লাগল। তবে এটা আসছে কামরার ভিতর থেকে। কিন্তু কোনো পাখি ঘরের ভিতর ঢুকবে কীভাবে, ভাবলেন তিনি। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হলো তাঁর। ওটা কী? সাহস করে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখবেন? নাকি উইলিয়ামকে ডাকবেন?
এসময়ই ডানা ঝাপটানোর শব্দ থেমে গেল। নীরব হয়ে গেল চারপাশ। এটা আরও ভয়াবহ। কামরায় তিনি ছাড়া আরও একটা অশুভ উপস্থিতির আভাস পাচ্ছেন লর্ড। সাহায্যের জন্য জোরে চিৎকার করার তাগিদ অনুভব করলেন। চেষ্টা চালালেন, কিন্তু মুখ ফুটে কোনো আওয়াজ বেরোল না।
খাড়া হয়ে বসা লিটলটনের দৃষ্টি চলে গেল বিছানার কিনারার পর্দার দিকে। তারপরই তাঁর আতঙ্কিত চোখের সামনে ওটা নড়তে শুরু করল। একসময় সরে গেল। দেখা গেল সেখানে অপার্থিব একটা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। তাঁর সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী, মোহনীয় এক নারী সে। আবার কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো বোল বেরোল না। তিনি কেবল জায়গাতেই স্থির হয়ে বসে, তাকিয়ে থাকলেন দীঘল শরীরের রহস্যময় নারীটির দিকে।
তারপরই কথা বলে উঠল নারীটি, টমাস, লর্ড লিটলটন, আমার কথাগুলো মনে গেঁথে নাও। মিষ্টি একটা কণ্ঠ, তবে অবশ্যই মানুষের গলার শব্দ না। কণ্ঠটা শুনলে বাতাস আর ঢেউয়ের কথা মনে পড়ে। আবার হালকা একটা প্রতিধ্বনি হয় এর, মনে হয় একই সঙ্গে সব দিক থেকে আসছে। শব্দটা যেন শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভবও করছেন তিনি।
আমার কথাটা মনে রাখো আর নিজে নিজে প্রস্তুত হও। তিন দিন সময়, তৃতীয় দিন রাত ঠিক বারোটার সময় তুমি মারা যাবে।
প্রস্তুত হও…
আতংকে শিউরে উঠলেন লিটলটন। মুখ বেয়ে ঘাম নামছে টপটপ করে, যখন তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এই ভবিষ্যত্বক্তাকে প্রশ্ন করার। কিন্তু দুর্বোধ্য একটা কর্কশ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোল না তাঁর মুখ থেকে।
প্রস্তুত হও…প্রস্তুত হও… আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেল রহস্যময় নারীর কণ্ঠস্বর, সেই সঙ্গে গায়েব হয়ে যেতে শুরু করল সে-ও। পর্দাটা ফিরে এল আগের জায়গায়। আবার নীরব হয়ে গেল চারধার। ভয়ে, যন্ত্রণায় বিহ্বল লিটলটন শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিলেন, তারপর নিস্তেজ ভাবে পড়ে রইলেন সেখানে।
সকালে উইলিয়াম এল লর্ডকে ঘুম থেকে জাগাতে। বিছানায় মড়ার মত পড়ে থাকা কাঠামোটাকে দেখে তার মনে হলো, মালিকের নিশ্চয়ই রাতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত লর্ডকে জাগিয়ে তুলতে পারল উইলয়াম। কিন্তু তাকে মোটেই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। উইলিয়াম বুঝে উঠতে পারল না কী করবে। সে কি এখনই একজন ডাক্তারের কাছে যাবে? কিন্তু তাহলে বিধ্বস্ত এই মানুষটাকে একা রেখে যেতে হবে। বিছানায় পড়ে আছেন এখন তিনি, চোখ বড় বড়, শরীর এমনভাবে কাঁপছে যেন জ্বর এসেছে। উদ্বিগ্ন উইলিয়ামের প্রশ্নেরও কোনো ভাল উত্তর দিতে পারলেন না। না, তিনি অসুস্থ নন, তবে ভাল নেই। নানান ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলতে লাগলেন। একবার বলেন পুরো কামরাটা খুঁজে দেখতে, একবার জানালা বন্ধ করতে বলেন তো আবার তার পরেই জানালা খোলার আদেশ দেন। এই বলেন ডাক্তর ডাকো, পরমুহূর্তেই ডেকো না।
তবে ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করলেন লিটলটন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উইলিয়াম বলল সে বরং মালিকের জন্য এক বাটি গরুর মাংসের স্যুপ নিয়ে আসছে। তার মনে হয় এখন এটাই লর্ডের জন্য সবচেয়ে দরকারি। ফ্যাকাসে আর বিধ্বস্ত চেহারার লিটলটন সম্মতি জানালেন, হ্যাঁ, মনে হয় স্যুপটা ভাল লাগবে আমার। তাঁর কণ্ঠটা এখন বেশ স্বাভাবিক।
আর মালিক, একজন ডাক্তার ডাকব. কি?
না, এখন আমি ঠিক আছি। খুব সম্ভব আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। এর কোনো ওষুধ ডাক্তারের জানা আছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। তবে আমার কিছু বন্ধুকে আমি দেখতে চাই। মি.এজ, মি. এইসকফ, মি পিগউ-এদের খবর পাঠাতে হবে। যেসব বন্ধুদের পাশে পেতে চাই তাদের সবার নাম আমি তোমাকে পরে বলছি। এখন স্যুপটা নিয়ে এসো। তারপর আমি বিছানা ছাড়ব।
একা হয়ে যেতেই বার-বার রাতের ঘটনাটা নিয়ে ভাবলেন। এটা কি একটা স্বপ্ন? ঘটনাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু এটাও ঠিক-স্বপ্ন সত্যিই মনে হয়। বিছানা থেকে নেমে সাবধানে পর্দাগুলো পরীক্ষা করলেন। গত রাতের রহস্যময় মহিলাটি এখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কোনো প্রমাণই নজরে এল না। তবে এখনও মনের ভিতর জ্বলজ্বল করছে সে। তার চেহারা, কণ্ঠ এমনকী তার বলা কথাগুলো-সব কিছু।
আর স্মৃতিটা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন। তিনি মরতে চান। এখনও বয়স বেশি হয়নি তার। জীবনটা উপভোগ করছেন। এখন একটা কাজই করার আছে তা হলো বন্ধুদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা।
সকাল হতেই লিটলটনের ডাকে একজনের পর একজন বন্ধু হাজির হতে লাগলেন হিল স্ট্রীটের বাড়িটায়। তাদের প্রত্যেককে গত রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন লিটলটন। মনেমনে আশা করেছিলেন হেসে উড়িয়ে দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করবেন তাঁরা। ঘটলও তাই। সবাইই গল্পটায় দারুণ মজা পেলো।
সে কি সুশ্রী ছিল, টমাস? জানতে চাইলেন মাইলস এণ্ড্রুজ।
সুশ্রী নয়, সুন্দরী। জবাব দিলেন লিটলটন।
হেসে গড়িয়ে পড়লেন বন্ধুরা। সুন্দরী? সুন্দরী নারীর স্বপ্ন দেখেছ? যতদূর বোঝা যাচ্ছে তিন দিনের মধ্যে তোমার বিয়ে হবে, মরবে না। সন্দেহ নেই এটা একটা স্বপ্নই। আশা করব কুসংস্কার তোমাকে পেয়ে বসবে না।
আর বন্ধুদের কথা-বার্তা আর যুক্তি শেষ পর্যন্ত লিটলটনকে আশ্বস্ত করল তাঁদের কথাই ঠিক। মন মরা ভাব কেটে যেতে লাগল তার। যদিও যখনই একা হন মহিলার চেহারা আর কথাগুলো হামলে পড়ে স্মৃতিতে। তাই ঠিক করলেন দুশ্চিন্তাটা ঝেটিয়ে মাথা থেকে দূর করে দেবেন, অন্তত তিন দিন পার না হওয়া পর্যন্ত। বাড়িটা তাই লোকজনে ভরপুর করে রাখলেন। সকালের নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ আর রাতের খাবার খেলেন বন্ধুবান্ধবদের নিয়েই।
পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল। ধন্যবাদ অবশ্য পাবেন লিটলটনের চমৎকার বন্ধুরা। তারা এমন হাসি-ঠাট্টায় লর্ডকে মাতিয়ে রাখলেন যে, আবার আগের সেই লিটলটন হয়ে উঠেছেন তিনি। হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত।
তৃতীয় দিন সকালে খুব ধীরে হেঁটে ডাইনিংয়ে ঢুকলেন লিটলটন। ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা। খুব শান্তভাবে ইতোমধ্যে এখানে উপস্থিত হওয়া বন্ধুদের স্বাগত জানালেন। তার শরীর কেমন জিজ্ঞেস করা হলে কেবল মাথা ঝাকলেন। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত আছেন জনাথন গ্রেভস নামের এক জাদুকর এবং চার্চের অর্গান বাজিয়ে। লর্ডকে নিয়ে আবার দুশ্চিন্তাটা পেয়ে বসেছে তাঁকে। কারণ তাঁর জাদু কিংবা অর্গান বাজানো লিটলটনের ওপর কোনো প্রভাবই ফেলছে না। আবার মন মরা হয়ে গেছেন লর্ড।
তবে রাতের খাবারের সময় মেঘ কেটে গেল লিটলটনের চেহারা থেকে। খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অতিথিদের তাকিয়ে হেসে বললেন, বন্ধুরা, আমি আবার আগের আমি হয়ে গেছি। তোমাদের ধন্যবাদ।
কিন্তু একটু পরেই আবার বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন লর্ড। তিনি যখন কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তখন গ্রেভস বললেন, কথা বলে আর ঠাট্টা-মস্করা করে তাকে আর খুশি রাখতে পারব না আমরা। বরং আমার মনে হয় এখন একটা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রতারণা? বললেন মি.এইসকফ, তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ?
একবার দরজার দিকে তাকালেন গ্রেভস, তাঁদের আমন্ত্রণদাতা কথাগুলো শুনতে পাবেন না এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এটা তেমন কিছু না, খুব নিচু কণ্ঠে বলে চললেন, টমাস মনমরা হয়ে আছে, কারণ সে ভাবছে মাঝরাতে মারা যাবে সে। তার মনে হবে বাড়ির প্রতিটি ঘড়ি তার দিকে তাকিয়ে আছে, বলছে রাত বারোটায় তোমার বারোটা বাজাব আমরা। চার ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা এভাবে সময় গুণতে গুণতে তার অবস্থা আরও কেরোসিন হয়ে যাবে। মাঝরাত যখন আসবে তখন দেখা যাবে হতভাগা লিটলটন দুশ্চিন্তাতেই মরেই গেছে। কিন্তু যদি এমন হয় যখন মাঝরাত আসবে, তখন সে যদি শান্তিতে বিছানায় ঘুমায়, তখন বিপদ কেটে যাবে।
কিন্তু কীভাবে মধ্যরাতের আগেই দুশ্চিন্তামুক্ত করতে পারব তাঁকে? জানতে চাইলেন মি. এইসকফ।
অন্যদের দিকে ঝুঁকে পড়ে গ্রেভস বললেন, বাড়ির প্রতিটি ঘড়িকে আমরা আধ ঘণ্টা এগিয়ে দেব। এই বলে নিজের ঘড়িটা পকেট থেকে বের করে সাবধানে ওটার সময় আধ ঘণ্টা এগিয়ে দিলেন। কিছু সময় তর্ক-বিতর্কের পর সবাই মেনে নিলেন বুদ্ধিটা ভালই কেঁদেছেন গ্রেভস। তা ছাড়া এতে তাদের বন্ধুকে চূড়ান্ত সময়ে আধ ঘণ্টা কম দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে। তারপর সবাইই নিজেদের ঘড়ি আধ ঘণ্টা করে এগিয়ে দিলেন। এবার জনাথন গ্রেভস বেল টিপে উইলিয়ামকে ডেকে আনলেন। তারপর তাকে পুরো পরিকল্পনাটা খুলে বলে জানতে চাইলেন সে কি বাড়ির সবগুলো ঘড়ির সময় পাল্টে দিতে পারবে কিনা।
হ্যাঁ, স্যর। চিন্তা করবেন না একটুও। এমনকী ড্রেসিং টেবিলের ওপর মালিকের নিজের যে ঘড়িটা আছে, ওটার সময়ও কেমন সুন্দর পাল্টে দিই দেখুন। বলল উচ্ছ্বসিত পরিচারক।
তারপরই লর্ড লিটলটন ফিরে এলেন। আলাপ চলতে লাগল। সাড়ে এগারোটার দিকে লর্ড লিটলটন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন এখন ঘুমাতে যাবেন তিনি। সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে শান্তভাবে কামরা ছাড়লেন।
তিনি চলে যাওয়াতে হাঁফ ছাড়লেন বন্ধুরা। এবার মনের ভিতরের কথাগুলো খোলাখুলি আলাপ করতে পারলেন তাঁরা। একটা প্রেতাত্মা লর্ড লিটলটনকে সতর্ক করে দিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে বাধছে সবারই। এটা স্বপ্ন ছিল, এর চেয়ে ভাল ব্যাখ্যাও কেউ দিতে পারলেন না।
আমার মনে হয় আমাদের ঘড়ির সময় এবার ঠিক করে নিতে পারি। মন্তব্য করলেন জনাথন গ্রেভস। ও, ঈশ্বর, এখন বাড়ি ফিরব আমি। বুঝতে পারলেন এখন প্রায় মধ্যরাত +
আমিও, বললেন মি. এইসরুফ। আর আমার বন্ধু শান্তিতে ঘুমাচ্ছে এটা জেনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছি।
তাই যেন হয়, বললেন আরেকজন অতিথি। তাঁরা সবাই চললেন তাদের কোট যেখানে রাখা হয়েছে সেই ক্লোকরুমের দিকে।
এসময়ই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একটা ঘণ্টা পড়ার শব্দ হলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন তাঁরা, আতংক নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। আরেকটা ঘণ্টা পড়ল।
এই একটা ঘড়ির সময় বদলাতে পারিনি আমরা, ফিসফিস করে বললেন গ্রেভস। প্যারিস চার্চের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম…
একটার পর একটা ঘণ্টা বেজেই চলল, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত…আর ঠিক তখনই ওপর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল।
তাড়াতাড়ি আসুন, মালিক মারা যাচ্ছেন…।
আট, নয়, ঘণ্টা বেজেই চলেছে। সিঁড়ি বেয়ে পড়িমরি করে ছুটলেন তারা, দেখলেন লর্ড লিটলটনের বেডরুমের দরজার সামনে ফ্যাকাসে চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম। দশ, এগারো… ঘরের ভিতর ঢুকে গ্রেভস, এইসকাফ আর অন্যরা দেখলেন যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে লিটলটনের দেহ। বারো, মধ্যরাতের শেষ ঘণ্টা বাজল। আর তাদের চোখের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন লর্ড।
পরে লাইব্রেরিতে জড় হওয়া অতিথিদের পুরো ঘটনাটা খুলে বলল উইলিয়াম।
মালিক তার কামরায় ঢুকে ঘুমানোর জন্য তৈরি হতে শুরু করলেন। তার কাপড় সরাবার সময় দেখলাম বার-বার নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। আমি চাচ্ছিলাম যতক্ষণ সম্ভব এখানে থাকতে। কারণ খুব আস্তে-ধীরে সব কিছু করছিলেন। বিছানায় গিয়ে বললেন লাগোয়া পর্দাগুলো টেনে দিতে। তারপর আবার নিজের ঘড়ির দিকে তাকালেন, বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। এবার আমার ঘড়িটা দেখতে বললেন, যখন সময়টা মিলে গেল তখন আশ্বস্ত হলেন। এবার দুটো ঘড়িই কানের কাছে নিয়ে নিশ্চিত হলেন দুটোই চলছে। ওগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, মাঝরাত পার হওয়া পর্যন্ত। এবার আমার ঘড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর ওষুধ তৈরি করতে বললেন। যখন গ্লাস নিয়ে ফিরে এলাম তখন সোয়া বারোটা ( আসলে পৌনে বারোটা)। জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, রহস্যময় নারী মোটেই ভাল ভবিষ্যত্বক্তা নন। আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। আমার ওষুধ দাও। ওটা খেয়ে ঘুমানোর তদ্বির করব।
ধীরে-সুস্থে ওষুধটা পান করে আমাকে শুভরাত্রি জানালেন। কিন্তু যখনই ঘুমাতে যাবেন গির্জার ঘড়ি বাজতে শুরু করল। এসময়ই মালিকের দমবন্ধ হয়ে এল। আমাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। কী বলতে চেয়েছিলেন তা বলতে পারব না, দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম আপনাদের, তাঁর বন্ধুদের ডাকতে।
ওহ! রহস্যময় নারী আসলেই ভবিষ্যতে জানত, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন জনাথন গ্রেভস, আর সে তার কথা রেখেছে…
ফলকে কার নাম?
এবারে একটা স্বপ্নের বর্ণনা দেব। তরে সাধারণ কোনো স্বপ্ন নয়, আর এর পর যে কাকতালীয় ঘটনাটি ঘটে তা চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্য যথেষ্ট। এটি পাঠিয়েছেন আইরিশ একটি প্রকাশনীর প্রতিনিধি। তবে নাম গোপন করার শর্ত ছিল তাঁর। আর যেখান থেকে এটি সংগ্রহ করেছি আমরা সেখানেও তার নাম ছিল না। যাক সরাসরি মূল কাহিনিতে চলে যাওয়া যাক।
এই গল্পের নায়িকা আমার এক দাদী। আর সাক্ষীদের একজন আমার বাবা। যখনকার ঘটনা তখন বাবা তার ফুপু (আমার সেই দাদী) এবং আরও কিছু আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকেন।
একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দাদী ঘোষণা করলেন কাল রাতে আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখেছেন। বাবার সবসময়ই অদ্ভুত বিষয়ের প্রতি একটা মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল। তাই পুরো ঘটনাটি তাঁর নোট বইয়ে লিখে রাখেন। সেখান থেকেই এটা বলছি।
দাদী স্বপ্ন দেখেছেন তিনি একটা গোরস্থানে আছেন। ওটাকে গ্লাসনেভিনের কবরস্থানটা বলে চিনতে পারেন তিনি। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মৃতদের নাম, পরিচয় লেখা অনেক ফলক চোখে পড়ল তাঁর। কিন্তু ওগুলোর একটা দৃষ্টি কেড়ে নিল। কী আশ্চর্য! সাদা মার্বেল পাথরে পরিষ্কারভাবে খোদাই করা তার নিজেরই নাম।
ক্লেয়ার এস.ডি.
মৃত্যু ১৪ মার্চ, ১৮৭৩।
সবার ভালবাসার পাত্রী, সবসময় তাকে মনে রাখব আমরা।
আরও আশ্চর্য ব্যাপার, পাথরে খোদাই করা তারিখটা তাঁর স্বপ্ন দেখার দিন থেকে ঠিক একবছর সামনের। তবে আমার দাদী বেশ সাহসী মহিলা। এটাকে খুব একটা পাত্তা দিলেন না। একসময় স্বপ্নটা পুরোপুরি মুছে গেল তাঁর মন থেকে। সময় গড়াতে লাগল। একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে তাঁকে দেখা গেল না। সবাই ধরে নিল দাদী গির্জায় গেছেন। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আসতে না দেখে বাবা একজনকে তাঁর কামরায় খোঁজ করতে পাঠালেন, যদি ভিতরে থেকে থাকেন এই মনে করে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে দরজাটা খোলা হলো। বিছানার পাশেই নতজানু হয়ে পড়ে আছেন দাদী। মারা গেছেন আগেই। আর তারিখটা ১৮৭৩ সালের ১৪ মার্চ। ঠিক এক বছর আগে স্বপ্নে যে তারিখটা দেখেছিলেন। দাদীকে কবর দেওয়া হলো গ্লাসনেভিনে। সাদা পাথরের সমাধিফলকে লিখে দেওয়া হলো সেই কথাগুলো, স্বপ্নে দেখা ফলকে যা পড়েছিলেন।