মৃত্যুহীন পিশাচ

মৃত্যুহীন পিশাচ

মূল গল্প  Mrs Amworth (Edward Frederic Benson)

যে ঘটনাটার কথা বলতে চলেছি সেটা ঘটেছিল সাসেক্সের একটা ছোট গ্রামে৷ পাহাড়ের উপর পাইন গাছের জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম ম্যাক্সলেতে৷ হলফ করে বলতে পারি এত সুন্দর, নির্জন আর ঘন সবুজ গ্রাম গোটা ইংল্যান্ড ঢুঁড়ে ফেললেও আর একটা খুঁজে বের করা যাবে না৷ লোকজন এখানে চোখে পড়ার মতো কম, ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নির্দ্বিধায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে৷

ম্যাক্সলের রাস্তাঘাট বড়সড়৷ গ্রামের একেবারে মাঝামাঝি একটা পুরনো চার্চ আছে, সঙ্গে লাগোয়া কবরস্থান৷ এছাড়া গ্রামে অন্য বাড়ি-ঘর বলতে বেশিরভাগই ছোট-ছোট কটেজ৷ তাদের দেওয়ালগুলোতে সব লাল রং করা৷ উপর থেকে দেখলে বড় রাস্তাগুলোর উপর কদাচিৎ ছোটখাটো কয়েকটা গাড়ি কিংবা পায়ে হাঁটা লোকজন চোখে পড়ে৷ সব মিলিয়ে জায়গাটা আশ্চর্যরকম শান্ত৷

একমাত্র শনি আর রবিবার রাস্তায় একগাদা গাড়ি-ঘোড়ার যানজট দেখা যায়৷ গ্রামটা যেহেতু লন্ডন আর ব্রিজটনের মাঝামাঝি তাই ওই দুটো দিন এক শহর থেকে আরেক শহরমুখী জনতার ভিড়ে গোটা রাস্তাগুলো কানায়- কানায় ভরে ওঠে৷

ম্যাক্সলেতে ওই লাল ছোট কটেজগুলোর একটাতেই আমি থাকি৷ এখানকার একটা কলেজে অধ্যাপনা করছি কিছুদিন হল৷ তাছাড়া আমার কিছু লেখালিখির শখও আছে৷ আমার ঠিক পাশের কটেজেই থাকেন ফ্রান্সিস উরকম্ব৷ ভদ্রলোকের বেশ চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব৷ একসময় আমার মতোই কলেজের প্রোফেসর ছিলেন৷ কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াতেন৷ আপাতত অবসর নিয়ে এই গ্রামে বাসা বেঁধে প্যারাসাইকোলজি নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠেছেন৷ এছাড়াও মধ্যেমধ্যে নানারকম অকাল্ট ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আগ্রহ জন্মায় তার৷ হানাবাড়ি, পিশাচতন্ত্র, ভ্যাম্পায়ার এইসব শব্দ তার মুখে শুনতে-শুনতে একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি৷

মুশকিল হল, এই ভূতুড়ে বিষয় নিয়ে পড়াশোনার কথা অন্য কাউকে বলতে না পেরে আমাকেই চেপে ধরেন তিনি৷ মাঝেমধ্যেই কলেজ থেকে ফেরার পথে আমাকে পাকড়াও করে নিজের কটেজে নিয়ে গিয়ে তার জ্ঞানের ঝাঁপি খুলে বসেন৷ সাবজেক্টের অন্তঃসার কিছু থাক আর নাই থাক ভদ্রলোকের বলার গুণে এই ক-দিনে আমারও কিছু আগ্রহ জন্মেছে এইসব নিয়ে৷

তবে দিন কয়েক হল আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু আর আগের জায়গায় নেই৷ তার কারণ একসপ্তাহ আগে মিসেস এমওর্থ নামে এক মহিলা আমাদের এই একচিলতে গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করেছেন৷ এমনিতে ম্যাক্সলে এতই ছোট গ্রাম যে নতুন কেউ এখানে এসে থাকতে শুরু করলে অন্যদের চোখে না পড়ার উপায় নেই৷ তবে আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি মিসেস এমওর্থ যে এখানে এসে জুটেছেন তার একটা বিশেষ কারণ আছে৷

মহিলার স্বামী নাকি একসময় কোনও এক কোর্টের জাজ ছিলেন৷ পেশোয়ারে থাকতে স্বামী মারা যেতে মহিলা লন্ডনে ফিরে আসেন৷ ঠিক এই সময়ে তিনি জানতে পারেন যে একশো বছর আগে তাঁর পূর্বপুরুষ নাকি এই ম্যাক্সলে গ্রামের আদি বাসিন্দা ছিল৷ গ্রামের মাঝে যে উঁচু চার্চটা আছে সেটাও নাকি তাঁর পূর্বপুরুষের তৈরি৷ জানতে পেরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তিনি ম্যাক্সলেতে এসে পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা করেন৷

গ্রামে এসে নতুন প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচয় করতে বড়সড় একটা পার্টির আয়োজন করেন৷ সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় আমাদের৷

এরপর থেকেই গোটা গ্রামে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে৷ মহিলা ঠিক যেমন সুন্দরী তেমনি গুণী৷ কাটাকাটা ছিপছিপে চেহারা৷ একমাথা চুলের ঢল মুখের দুপাশ জুড়ে পাহাড়ি ঝর্নার মতো নেমেছে৷ টকটকে গোলাপি রং, মখমলের মতো চামড়ার শরীর ঠিক যেন ঝলমলে আলোর মতো একদিক থেকে আরেকদিক উড়ে বেড়াচ্ছেন৷ চোখের দু-দিকে টেনে কাজল পরেন মহিলা৷ সর্বদা হাসি-খুশি মুখ৷ সারাক্ষণই একটা তারুণ্যের লাবণ্য ঝরে পড়ে মুখ থেকে৷

পার্টিতেই হল ভর্তি লোকের সামনে নিজে হাতে পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে শোনান তিনি৷ মহিলার গলার স্বর সত্যি একবার শুনেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো৷ বলাই বাহুল্য আমাদের এলাকার ছেলেছোকরারা মিস এমওর্থ বলতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ত৷ একমাত্র প্রোফেসর উরকম্বের মুখটা পার্টি থেকে ফিরে থেকেই থমথমে লাগছিল আমার৷ তাঁর নাকি একেবারেই পছন্দ হয়নি মহিলাকে৷ সেটা যে ঠিক কী কারণে তা আমাকে ভেঙে বলেননি তিনি৷

যাই হোক, মিসেস এমওর্থের সঙ্গে আমার এতদিনে কিছুটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল৷ মাঝে-মাঝেই আমাকে যেচে পরে ফোন করেন তিনি৷ আমি লেখালিখির কাজে ব্যস্ত না থাকলে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তাও হয়৷ এমন করে আমাদের বন্ধুত্ব একটু ঘন হতে একদিন তাঁকে আমার বাড়িতে নেমন্তন্নই করে ফেললাম৷ মিসেস এমওর্থও রাজি হয়ে গেলেন৷

নেমন্তন্ন কিন্তু আমি স্বেচ্ছায় করিনি৷ বেশ কিছুদিন হল আমার পিছনে আদা-জল খেয়ে লেগেছেন উরকম্ব৷ তিনি নাকি মিসেস এমওর্থকে কাছ থেকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে চান৷ একবার সন্দেহ হল বুড়ো বয়সে ভীমরতি হল না তো প্রোফেসরের? পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেদের মতোতিনিও লাস্যময়ী মহিলার প্রেমের পড়ে গেছেন হয়তো৷ যাই হোক, একদিন নেমন্তন্ন বই তো নয়, আমিও খুব একটা আপত্তি করিনি৷

পরদিন মিসেস এমওর্থের আসার প্রায় আধঘণ্টা আগে প্রোফেসর আমার বাড়ির বেল বাজালেন৷ সাধারণত বয়স হয়েছে বলে তাঁর হাত-পা একটু ধীরে চলে, যখন আসার কথা তার মিনিট পনেরো পরে আসেন৷ আজ তাঁকে এত তাড়াতাড়ি আসতে দেখে কিছুটা অবাকই হলাম৷

দরজাটা খুলে দিতেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে এলেন তিনি, আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরের চারিদিকটা এক নজরে দেখে নিয়ে সোফায় বসে পড়ে দুটো হাতে মাথা চেপে ধরে কী যেন ভাবতে লাগলেন৷ আমি তার দিকে এগিয়ে এসে বললাম, ‘কী ব্যাপার প্রোফেসর, আজ এত তাড়াতাড়ি!’

হাতের ভিতর থেকে মাথা তুলে একটু শুকনো হাসি হাসলেন তিনি, তারপর বললেন, ‘অন্যদিন পড়াশোনা করতে-করতে লেট হয়ে যায়৷ আজও পড়ছিলাম, কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না৷’

‘সেকি!’ আমি তার পাশে বসে পড়লাম, ‘কী নিয়ে পড়ছিলেন?’

‘ভ্যাম্পায়ার!’ আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন প্রোফেসর, ‘এর যে কত হাজার-হাজার উদাহরণ ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে সে না জানলে তুমি বিশ্বাস করবে না৷ আমাদের মুশকিল হল আমরা পরীক্ষা না করেই সবই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছি৷ ফলে সত্যিটা আর কোনওদিনই প্রকাশ হতে পারেনি৷’

‘যাহ কী যে বলেন, আজকালকার দিনে ভ্যাম্পায়ারের কথা বলতে গেলে লোকে হাসাহাসি করে৷’ আমি পকেট থেকে সিগারেট বের করতে-করতে বললাম৷

‘তুমি ব্ল্যাক ডেথে বিশ্বাস কর?’ আমার দিকে উজ্জ্বল চোখ তুলে তাকালেন তিনি৷

‘তাতে বিশ্বাস করা বা না করার কী আছে, ব্ল্যাক ডেথ ছিল একটা মধ্যযুগীয় রোগ৷ সেকালে ভয়ানক প্রকোপ ছিল৷ ইউরোপের তিনভাগের একভাগ সাফা করে কোনও অজানা কারণে নিজেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷’

‘ধরে নাও ভ্যাম্পায়ারিজমও ঠিক তেমনই একটা রোগ৷ আজ থেকে ঠিক তিনশো বছর আগে এই ম্যাক্সলেতে সে রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল৷ তা জানো?’

‘বলেন কী!’ আমি চমকে উঠলাম, ‘ভ্যাম্পায়ার! ম্যাক্সলেতে!’

‘শুধু তাই নয়, কয়েক বছর আগে ভারতবর্ষে…’

প্রোফেসর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন৷ দরজার উপরে টোকার শব্দ হয়েছে৷ আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘দরজা খোলা আছে, ভিতরে চলে আসুন৷’

দরজা ফাঁক করে ঘরে ঢুকলেন মিসেস এমওর্থ৷ এই ক-দিনে লক্ষ করেছি মহিলার ঠোঁটের কোণে একটা অমায়িক মিষ্টি হাসি প্রায় সবসময়ই ঝুলতে থাকে৷ ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে আমাদের দু-জনকে দেখে সেটাই যেন বেড়ে উঠল একটু৷

‘বাহ, ভালো সময়ে এসেছেন৷ এবার প্রোফেসরের ভূতের গল্পের থেকে আমাকে রক্ষা করুন তো দেখি৷’ আমি হাসতে-হাসতে বললাম৷

একটা সরল উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল মহিলার মুখ থেকে, ‘আরে তাই নাকি! ভূতের গল্প তো দিব্যি লাগে আমার৷ আমিও শুনব৷’

আগন্তুককে মন দিয়ে দেখছিলেন প্রোফেসর, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘না-না, ঠিক ভূতের গল্প নয়৷ বলছিলাম যে এই বছরখানেক আগেও ভারতবর্ষের কোনও এক প্রান্তে ভ্যাম্পারিজমে মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷’

এমওর্থ প্রোফেসরের ঠিক উল্টোদিকের সোফাটায় বসতে-বসতে বললেন, ‘যাহ! এই গল্পটায় কিন্তু একেবারে ভয় পাচ্ছি না৷ একদম আষাঢ়ে গল্প৷ এখানে আসার আগে আমি বেশ কয়েকবছর ভারতে ছিলাম৷ সেখানে এরকম ভ্যাম্পায়ারের গল্প তো শুনিনি কোনওদিন৷’

প্রোফেসর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ লক্ষ করলাম, থেমে গেলেন৷ সেদিন কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে খোশগল্প করে মিসেস এমওর্থ বিদায় নিলেন৷

সে বছর গরমে ভালো করে বৃষ্টি পড়ল না৷ শুকনো আবহাওয়ার জন্যে কি না জানি না গোটা ম্যাক্সলে জুড়ে একরকম ছোট কালচে পোকার উপদ্রব শুরু হল৷ পোকাগুলো কামড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গেই ভয়ানক যন্ত্রণা শুরু হয়৷ সন্ধে হলেই ঝাঁকে-ঝাঁকে বেরিয়ে আসে তারা৷ এমন নিঃশব্দে চামড়ার উপরে এসে বসে যে বোঝাই যায় না৷ হুল ফোটানোর পরে শুরু হয় ছটফটানি৷

আমরা প্রথম-প্রথম ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিইনি৷ কিন্তু কিছুদিন পরে মিসেস এমওর্থের মালির বছর ষোলোর ছেলেটা এক অদ্ভুত রোগে ভুগতে শুরু করায় লোকে নড়েচড়ে বসল৷ কিছুদিন থেকে নাকি তার খিদে হচ্ছিল না৷ শরীর শুকিয়ে যাচ্ছিল৷ তাছাড়া ডাক্তার রস তার ঘাড়ের কাছে পাশাপাশি দুটো ফুটোও আবিষ্কার করেন৷ তিনি রায় দেন যে পোকার কামড়েই রোগটা হয়েছে ছেলেটির৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ছেলেটার ঘাড়ে ফুটো দুটোকে ঘিরে পোকা কামড়ালে যেমন লাল দাগ হয়, সেটা দেখা গেল না৷

এর দিন দুয়েকের মধ্যেই একদিন রাস্তায় ডাক্তার রসের সঙ্গে দেখা হয় আমার, মালির ছেলেটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে খানিক বিমর্ষ দেখায় তাঁকে৷ হতাশ হয়ে মাথা দুলিয়ে বলেন, ছেলেটি আর বেশিদিন বাঁচবে না৷ রোগটা নাকি গোলমেলে৷ সেদিন যখন দেখতে এসেছিলেন স্বাভাবিক অ্যানিমিয়া গোত্রের রোগ ভেবেই চিকিৎসা শুরু করেছিলেন৷ কিন্তু বাড়ি ফিরে নাকি তাঁর মন বদলাতে শুরু করে৷ ততক্ষণে ওষুধপত্র বাতলে দিয়ে চলে এসেছেন বলে আর যোগাযোগ করেননি৷

সেদিন বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়ে মিসেস এমওর্থের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার৷ আমাকে দেখে এবং আমার পাশে প্রোফেসর নেই দেখে নিজেই এগিয়ে এলেন৷ তাঁকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে এলাম৷

বাজার ছেড়ে বেশ অনেকটা দূরে হেঁটে এসেছি আমরা৷ একটু দূরেই মিসেস এমওর্থের কটেজ আর তার বাইরে সাজানো বাগান চোখে পড়ছে৷ সেটার সামনে এগিয়ে এসে আমি বললাম, ‘বাগানখানা কিন্তু দিব্যি বানিয়েছেন৷ এ এলাকায় এত সুন্দর সাজানো বাগান আমি আগে দেখিনি৷’

মহিলা হাসলেন কি না বুঝলাম না৷ কিন্তু একটা বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম, বুক ভরে শ্বাস টেনে তিনি বললেন, ‘এই রাতের হাওয়া আর ফুলের গন্ধ, এ যে আমাকে কী শান্তি দেয়…’

‘খাটতেও তো হয় প্রচুর৷’ আমি বাগানের দিকে তাকিয়ে বললাম৷

‘সে আর বলতে! বাগানের কাজ সেরে যখন উঠি, বুঝলেন, আমার হাত নখ জুতো সব মাটিতে-মাটিতে কালো হয়ে যায়৷’ মজার ছলে হেসে উঠলেন তিনি, ‘আজকাল মাটির গন্ধের যেন একটা নেশা হয়ে গেছে আমার৷ মৃত্যুর পরের সময়টা মাটির ভিতরে নেহাত খারাপ কাটবে না, কী বলেন৷’ একটা হাত দিয়ে আমার কনুই স্পর্শ করে হাসতে লাগলেন তিনি৷

‘যাহ, কী যে বলেন…’ আমি প্রসঙ্গটা বদলানোর চেষ্টা করলাম৷

‘সত্যি বলছি কিন্তু, আমি তো বলেই রেখেছি, আমার মৃত্যুর পরে যেন কফিনে ঢোকানো না হয় আমাকে৷ একেবারে সরাসরি মাটির ভিতরে শুইয়ে দেওয়া হয়৷’

প্রসঙ্গটা মোটেই ভালো লাগছিল না আমার৷ ফিরে আসতে যাচ্ছিলাম, তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভালো কথা, আপনি রাতে জানলা খুলে শোন না বন্ধ করে?’

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন বলুন তো?’

তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘ওই যে বললাম, মাটির গন্ধ৷ জানলা খুলে শোবেন৷ দেখবেন, ভালো ঘুম হবে৷’

‘আমি জানলা খুলেই শুই৷’

‘বাহ, তাহলে তো কথাই নেই৷ গুড নাইট৷’

সেদিন রাতে ঘুম আসতে একটু দেরি হল৷ একটু আগে এমওর্থের বলা কথাগুলো বারবার ফিরে আসছিল মনের ভিতরে৷ ঘর অন্ধকার৷ বাইরে ঘাসের গোড়া থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে৷ একটু দূরেই মাথার কাছের জানলাটা খোলা৷ বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল সেদিকে৷ মনে জোর এনে একরকম জোর করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷

মাঝরাতে ভেঙে গেল ঘুমটা৷ এবং ঘুম ভেঙে ঘরের জানলার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল৷ জানলার কাঠের পাল্লাগুলো এখন বন্ধ৷ আমার কটেজে আমি ছাড়া কেউ শোয় না৷ স্পষ্ট মনে আছে শোয়ার আগে জানলাগুলো খুলে শুয়েছিলাম৷ তাহলে আমি যতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলাম ততক্ষণে সেগুলো কে বন্ধ করবে?

পায়ে-পায়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ কটেজের যে ঘরে আমি শুই সেটা দোতলায়৷ নীচের জানলায় কার্নিস নেই৷ কেউ যে একতলার কার্নিসে উঠে বাইরে থেকে জানলা বন্ধ করবে তাও হতে পারে না৷

জানলার কাছে এগিয়ে গেলাম আমি৷ কাঠের পাল্লার ঠিক সামনে একটা পাতলা সাদা পর্দা ঝুলছে৷ এখন গোটা জানলা জুড়ে টানা আছে পর্দাটা৷ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিলাম পাল্লাগুলো৷ মচমচ করে একটা আওয়াজ করে সরে গেল সেগুলো৷ এখন শুধু সাদা পর্দাটা আমার চোখের সামনে ওপাশের দৃশ্যগুলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে৷ মনে হল পর্দার ওপারে কিছু একটা যেন আছে৷ ভালো করে তাকাতে বুঝতে পারলাম৷ একটা মানুষের মুখ…

হাতের এক টানে পর্দা সরিয়ে ফেললাম৷ আর সরাতেই আমার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল৷ পা দুটো কেঁপে উঠল থরথর করে, জানলার বাইরে শূন্যে ভেসে আমার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন মিসেস এমওর্থ৷ একটা মরা ছাগলের মতো চোখের দৃষ্টি তাঁর৷ মাথাটা উপরে-নীচে নড়ছে৷ ঠোঁটের কোণে আলগা একটা হাসি৷

দ্রুত সেখান থেকে পাশের জানলার কাছে সরে এলাম৷ এ জানলাটাও খোলা এখন, একটানে এর পর্দাটাও সরিয়ে ফেললাম, এখানেও সেই একইরকম ভাবে ভাসছে এমওর্থের মুখটা৷ এখনও একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি৷ পাশের, তার পাশের… একটার পর একটা জানলার পর্দা সরিয়ে সেই একই বীভৎস হিংস্র মুখ চোখে পড়ল আমার… পিছিয়ে এলাম… একটা ভয়ার্ত তীব্র চিৎকার বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে… সঙ্গে- সঙ্গে উঠে বসলাম বিছানার উপরে৷

ঘুমটা ভেঙে গেল৷ জানলাগুলো ঠিক যেভাবে খুলে শুয়েছিলাম এখনও তেমনই খোলা আছে৷ বাইরে ঘন রাতের আকাশে মিটমিট করে তারা জ্বলতে দেখা যাচ্ছে সেখানে৷ একটা খোলা হাওয়া জানলা দিয়ে ভেসে এসে স্পর্শ করে যাচ্ছে আমাকে৷

সেদিন রাতে ঘুম এল না আর৷ সারারাত খোলা জানলার দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলাম৷ হঠাৎ ওই স্বপ্নটাই দেখলাম কেন কে জানে৷

পরদিন সকালে প্রোফেসর ফোন করে জানালেন এক্ষুনি দেখা করতে চান আমার সঙ্গে৷ বললাম আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, তিনি যেন নিজেই আমার কটেজে এসে দেখা করে যান৷ ব্যাপারটায় আপত্তি জানালেন না প্রোফেসর৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই উদভ্রান্তের মতো আমার ঘরে এসে ঢুকলেন তিনি৷

আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগে নিজেই অস্থির পায়ে পায়চারি করতে-করতে বললেন, ‘তোমার সাহায্য দরকার আমার৷’

‘কীরকম সাহায্য?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷

‘বলছি, কিন্তু তার আগে শোনো কী ঘটেছে কাল রাতে…’

একটু থমকালাম আমি, ‘কী ঘটেছে?’

‘কাল সন্ধের দিকে আমি আর ডাক্তার রস মিলে মালির ছেলেটাকে আবার দেখতে যাই৷ সে বেঁচে আছে বটে, কিন্তু আধমরা হয়ে৷ তার শরীরের কিছু লক্ষণ দেখে আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা একটি ভ্যাম্পায়ারের পাল্লায় পড়েছে৷’

কথাটা বলে পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরালেন তিনি৷ আমি আর কিছু বললাম না, বুঝতে পারছি ভদ্রলোক এখনও বক্তব্য শেষ করেননি৷ সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললেন, ‘কাল রাতে আমরা দু-জন মিলে সিদ্ধান্ত নিই যে ছেলেটিকে আর ওখানে রাখা নিরাপদ নয়৷ একটু-একটু করে ওর শরীর থেকে রক্ত শুষে নিচ্ছে কেউ৷ আমি আর ডাক্তার রস মিলে ওকে স্ট্রেচারে করে তুলে আমার বাড়িতেই নিয়ে আসছিলাম, এমন সময় মিসেস এমওর্থ দেখতে পান আমাদের৷ আমাদের দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে যান…তোমার কী মনে হয়? এর কারণ কী?’

কাল রাতের স্বপ্নটার কথা কেন জানি না মনে পড়ে যায় আমার৷ কিন্তু সেটার রেশ মুখ আসতে না দিয়ে বলি, ‘আমি কী করে জানব?’

সিগারেট থেকে ছাই ফেলেন প্রোফেসর, একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘এর পরের ঘটনা শোন তাহলে৷ কাল রাতে ছেলেটিকে নিজের তিনতলার ঘরের বেডরুমে শুইয়ে দিয়েছিলাম আমি৷ ঘরের আলো নিভিয়ে গোটা রাত পাহারায়৷ বলতে পারো একরকম ফাঁদ পেতেছিলাম৷ মাঝরাতে জানলার কাছ থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পাই আমি৷ মনে হয় বাইরে থেকে যেন জানলাটা কেউ খুলতে চাইছে৷ আগন্তুক যে কে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম৷ তবে যেই হোক না কেন সে আমার কটেজের দোতলার জানলার কাছে ভাসছিল৷ আমি ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে কম্পমান পায়ে করিডোর দিয়ে হেঁটে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মুখটা দেখতে পাই৷ মিসেস এমওর্থ৷

আমার মাথা তখন কাজ করছিল না৷ তাও কোনওরকমে ঘরে ফিরে এসে জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে গায়ের সমস্ত জোর কাজে লাগিয়ে বন্ধ করে দিই জানলাটা৷ জানলার দুটো পাল্লার মাঝে সম্ভবত তার একটা আঙুল আটকে গেছিল৷’

‘কিন্তু তা কী করে হতে পারে?’ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘মিসেস এমওর্থ ওভাবে হাওয়ায় ভাসবেন কী করে? আর জানলা খুলে তিনি কী করতে চাইছিলেন?’ প্রোফেসরে উত্তর দেন না৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে বলি, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন যে মিসেস এমওর্থ…’

‘আমি যা দেখেছি শুধু সেটাই বলছি৷ সারারাত এমওর্থ বাদুড়ের মতো আমার জানলার আশপাশেই ছিলেন৷ তাহলে সব মিলিয়ে কি দাঁড়াচ্ছে?’ হাতের পাঁচটা আঙুল তুলে ধরলেন তিনি, ‘মালির ছেলেটা যে রোগে ভুগছে সেই রোগ কয়েক বছর আগে পেশোয়ারেও ছড়িয়ে পড়েছিল৷ এবং মিসেস এমওর্থের হাসবেন্ড সেই রোগেই মারা যান৷ দুই, ছেলেটাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসার কথা শুনে তিনি বাধা দেন, তিন মিসেস এমওর্থ বা যে পিশাচটি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে সে কাল রাতে বারবার ঘরে ঢুকতে চাইছিল, চার, মিসেস এমওর্থের পারিবারিক ইতিহাস খুঁজলে ভ্যাম্পায়ারিজমের গুজব শোনা যায়৷’

‘এতে কী প্রমাণ হয়?’

প্রোফেসর আর কিছু না বলে একমনে সিগারেট টানতে লাগলেন৷

‘কাল রাতে আমিও কিছু দেখেছি৷ একটা স্বপ্ন…’

স্বপ্নের কথাটা শুনতে-শুনতে প্রোফেসরকে আরও উত্তেজিত দেখাল৷ আমার বলা শেষ হতেই তিনি টেবিলের উপরে একটা চাপড় মেরে বললেন, ‘তোমার অবচেতন মন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে তোমাকে সংকেত দিতে চাইছে৷ মিসেস এমওর্থের হাত থেকে বাঁচাতে চাইছে৷ তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে…’

‘কী কাজ?’

‘না, একটা নয়, দুটো কাজ৷ প্রথমটা হল, কাল রাতে আমার ঘুম হয়নি৷ আজ সকালে যতক্ষণ আমি ঘুমাব তুমি নজর রাখবে ছেলেটার উপরে৷ আর দুই…’ একটু থেমে তিনি বললেন, ‘মিসেস এমওর্থের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ভালো, যে-কোনও ভাবে ওকে ফাঁদে ফেলবে তুমি… তবে ফাঁদে ফেলার পর যে ঠিক কী করবে তা আমিও জানি না…’

এরপর দুটো দিন এইভাবেই কাটল৷ এর মধ্যে আমি আর প্রোফেসর পালা করে পাহারা দিয়ে গেছি ছেলেটাকে৷ ছেলেটার স্বাস্থ্য এই দু-দিনে চোখে পড়ার মতো বদলে গেছে৷ এখন বিছানার উপরে উঠে বসতে পারছে সে৷

তিনদিনের দিকে সকালে আমি প্রোফেসরের কটেজ ছেড়ে বেরনোর তোড়জোড় করছিলাম, প্রোফেসর ছেলেটার পাশে বসে একটা বইতে মুখ গুঁজেছেন৷ এমন সময় নীচ থেকে বেয়ারা এসে জানাল প্রোফেসরের সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন৷ আমি জানলা দিয়ে নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম মিসেস এমওর্থ দাঁড়িয়ে আছেন নীচে৷ হাতে একটা ছোট বাক্স৷ প্রোফেসরও উঠে এসে তাকিয়েছেন নীচের দিকে৷

‘আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে৷’ আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন তিনি৷

‘কিন্তু ছেলেটা একা থাকবে?’

‘মিসেস এমওর্থ আমাদের সামনে আছেন যতক্ষণ ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই৷’

আমরা দু-জনেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম৷ মিসেস এমওর্থ একগাল অমায়িক হেসে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হাতের বাক্সটা তুলে ধরে বললেন, ‘শুনলাম আপনাদের পেশেন্টের শরীর-স্বাস্থ্যের নাকি বেশ উন্নতি হয়েছে, তাই একটু দেখতে এলাম আরকী৷’

কথাটা বলে হাতের বাক্সটা খুলে দেখালেন৷ তার ভিতরে কিছু খাবার-দাবার আর চকোলেট রাখা আছে৷

‘ক্ষমা করবেন৷ আপনাকে আমরা ভিতরে আসতে দিতে পারি না৷’

‘কেন বলুন তো?’ কথাটা বলে আমাদের দিকে কিছুটা এগিয়ে এলেন তিনি৷

‘কারণটা আপনিও জানেন, আমরাও জানি৷’ প্রোফেসরের গলার আওয়াজ পাথরের মতো শান্ত৷ কিন্তু আমাদের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস এমওর্থের মুখে এখন নতুন রং লাগতে শুরু করেছে৷ একটা খয়েরি কুয়াশায় যেন ঢেকে যাচ্ছে তার মুখ৷ একটা হাত মুখের সামনে তুলে ধরে ক্রমশ পিছু হাঁটতে শুরু করেছেন তিনি৷

ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন রাস্তার দিকে৷ সেখান থেকে মধ্যে-মধ্যে তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে দ্রুতগতির কয়েকটা গাড়ি৷ কিন্তু গাড়ির দিকে খেয়াল নেই তাঁর৷ আমাদের দিকে স্থির চোখ রেখে পিছিয়ে চলেছেন তিনি৷ একটা তীব্র হর্নের শব্দ, পরমুহূর্তেই একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার৷ আমাদের চোখের সামনে একটা ভারী গাড়ির সামনের চাকা মাটিতে ফেলে পিষে দিয়ে চলে গেল মিসেস এমওর্থকে, তারপর আর একটা চাকা৷ কিছুক্ষণ মাথা কাটা পশুর মাংসপিণ্ডের মতো মাটির উপরে পড়ে থরথর করে কাঁপল এমওর্থের দেহটা৷ তারপর রক্তক্ষরণ থেমে যেতে স্থির হয়ে গেল৷

তিনদিন পরে ম্যাক্সলের সেমেট্রিতেই সমাধিস্থ করা হয় মিসেস এমওর্থকে৷ তাঁর নিজের ইচ্ছামতোই কফিনে ঢোকানো হয়নি তাঁকে৷ এক স্বল্পজীবী কিন্তু প্রাণোচ্ছল মহিলার কথাও ম্যাক্সলের মানুষের মন থেকে ক্রমে ফিকে হয়ে আসতে লাগল৷ আমরাও মিসেস এমওর্থের প্রকৃত রূপের ব্যাপারে কাউকেই কিছু জানাইনি৷

এত কিছুর মধ্যে একমাত্র প্রোফেসরের মুখটা এখনও ভার হয়ে আছে৷ কী একটা কারণে যেন মোটেই খুশি হতে পারেননি তিনি৷ ঘটনার পরে প্রায় একমাস তাঁর সঙ্গে আমার তেমন কথাবার্তা হয়নি৷ একদিন রাতে গ্রামের একপ্রান্তে এক অনুষ্ঠান বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল আমার৷ সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে হাঁটা পথেই বাড়ি ফিরছি৷ বেশ রাত হয়েছে৷ রাস্তাঘাট সব শুনশান হয়ে গেছে৷ দূর অবধি ছড়িয়ে থাকা রাস্তাঘাট আর কটেজগুলোর উপর শুয়ে থাকা চাঁদের আলো ছাড়া অন্য আলো নেই৷ হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎই মিসেস এমওর্থের বাড়ির সামনে এসে পড়লাম৷ কিছুটা কৌতূহল হতেই ভালো করে চোখ তুলে তাকালাম বাড়িটার দিকে৷ বাইরের বড় গেটের গায়ে এখন একটা ‘অন সেল’ সাইনবোর্ড লাগানো আছে৷ বাড়িটা আর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে সামনে পা বাড়াতে যাব, এমন সময় টুং-টুং করে কটেজের লাগোয়া বাগানের দরজা খোলার শব্দ হতে আমি চমকে ফিরে তাকালাম সেদিকে৷

একটা দমবন্ধ করা ভয় আমার গলা চেপে ধরল৷ অবাক হয়ে দেখলাম কটেজের গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসছেন মিসেস এমওর্থ৷ সেই এক মুখ, এক শরীর, একই হাঁটার ছন্দ৷ সাদা কাপড়ে পা থেকে মাথা অবধি ঢেকে আছে তার৷ আমার থেকে প্রায় মিটার দশেক দূরেই রাস্তাটা পার করে উল্টোদিকের বাড়ির গেটের ভিতরে মিলিয়ে গেলেন তিনি৷ তারপর আর দেখা গেল না তাঁকে৷

সম্বিৎ ফিরে পেতেই কোনওদিকে না তাকিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম৷ মনে হল একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন তাড়া করে আসছে আমাকে পিছন থেকে৷ আমি একবারও পিছনে না তাকিয়ে সামনের বিস্তীর্ণ ফাঁকা রাস্তা ধরে দৌড়াতে লাগলাম৷

নিজের বাড়িতে ঢোকার আগে হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রোফেসরের দরজায় কড়া নাড়লাম, তিনি দরজা খুলে আমার অবস্থা দেখে দরজা থেকে সরে গিয়ে আমাকে ভিতরের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার! এত হাঁপাচ্ছ কেন? ভূত দেখেছ নাকি?’

‘আপনি ইয়ার্কি করছেন!’ আমি দম নিতে-নিতে বললাম, ‘আপনি ভাবতেও পারবেন না আমি কী দেখেছি৷’

‘তা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি৷ মিসেস এমওর্থ ফিরে এসেছেন এবং তাঁকে কোনও একটা বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখেছ তুমি৷’ তিনি শান্ত গলায় বললেন৷

‘ওনার নিজের কটেজের উল্টোদিকের কটেজটায়৷’

‘মেজর পারসালের বাড়ি… চল আমাদের বেরোতে হবে এক্ষুনি৷’

‘কিন্তু আমরা কী করতে পারি?’ আমি হাত নেড়ে বললাম৷

‘আমি জানি না৷ বলতে পারো সেটাই জানতে যাচ্ছি৷’

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পা চালিয়ে মেজর পারসালের কটেজের সামনে পৌঁছে গেলাম আমরা৷ একটু আগে যখন এখানে দাঁড়িয়েছিলাম তখন রীতিমতো অন্ধকারে ভরে ছিল জায়গাটা৷ এখন আশপাশের কয়েকটা কটেজের দোতলার আলো জ্বলে ওঠায় কিছুটা দেখা যাচ্ছে চারপাশ৷ আমরা বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই মেজর পারসালকে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখলাম৷ আমাদেরকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন তিনি৷ উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘ওহ আপনারা, আমি একটু ডাক্তার রসের কাছে যাচ্ছিলাম৷ আমার স্ত্রীর শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়েছে৷ মুখটা বড্ড ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে… আপনারা হঠাৎ…’

‘এক মিনিট মেজর…’ প্রোফেসর থামিয়ে দিলেন তাকে, ‘ওনার গলায় কি কোনও দাগ দেখতে পেয়েছেন?’

খানিকটা থতমত খেলেন মেজর পারসাল৷ অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনারা কী করে জানলেন? আমি তো ভাবলাম ওই কালো পোকাটা কামড়ানোর ফলেই… রক্তে একেবারে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা…’

‘ওনার সঙ্গে কেউ আছে?’

‘হ্যাঁ, একজন নার্স আছে…’

আমার দিকে ঘুরে তাকালেন প্রোফেসর, ‘আমি জানি কী করতে হবে, বাড়ি চল, এক্ষুনি সিমেট্রিতে যেতে হবে৷’

একটা সুচালো ফলার ছুরি, একটা শাবল, একটা স্ক্রু ডাইভার আর কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি৷ পথে যেতে-যেতে পরবর্তী এক ঘণ্টায় ঠিক কী ঘটতে চলেছে তার একটা আন্দাজ আমাকে দিলেন৷

দ্রুত পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, ‘আমি যা বলছি সেটা তোমার এই মুহূর্তে অবিশ্বাস হতে পারে৷ কিন্তু সকালের আগেই এর সত্যতা প্রমাণ করব আমি৷ একটু আগে তুমি যা দেখেছ সেটা একটা এস্ট্রাল বডি৷ মিসেস এমওর্থের শরীরের ভিতরে যে শয়তান বাসা বেঁধে ছিল সে মৃত্যুর পরেও সেই একই রূপ বহন করে চলেছে৷ আমি জানতাম এরকম কিছু একটা হবে৷ আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে মিসেস এমওর্থের কফিন খুলে আমরা তাঁর দেহ অবিকৃত অবস্থাতেই আবিষ্কার করব৷’

‘তা কী করে হয়? প্রায় দু’মাস হয়ে গেছে তিনি মারা গেছেন৷’

‘সেটা কথা নয়৷ পিশাচ ওর শরীর ছেড়ে যায়নি এখনও৷ আজ আমাকে যাই করতে দেখ না কেন, জানবে সেটা মিসেস এমওর্থের মৃতদেহের শরীরে বাসা বাঁধা পিশাচকে ধংস করার জন্যই করছি৷’

‘কী দেখব?’

সিমেট্রির প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা৷ প্রোফেসর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এইমুহূর্তে পিশাচ মিসেস এমওর্থের মৃতদেহের ভিতরে নেই৷ সে বাইরে আছে, কিন্তু যেখানেই থাক না কেন, ভোরের আগে আবার তাকে ফিরে আসতে হবে৷ আমরা ততক্ষণ অপেক্ষা করব৷ একবার ভোর হয়ে গেলে সে আর শরীর ছেড়ে বেরতে পারবে না৷ তখন তার শরীর মাটি থেকে তুলে এনে মৃতদেহের বুকে এইটা গেঁথে দিতে হবে…’ হাতে ধরা সরু ফলার ছুরিটা দেখালেন তিনি৷

সিমেট্রিতে ঢুকে মিসেস এমওর্থের সমাধিটা খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হল না৷ চাঁদের আলোয় ভরে আছে চতুর্দিক৷ সেটার সামনেটা একবার ঘুরে দেখে নিয়ে চার্চের দিকে মুখ করে একটা বড় গাছের কাণ্ডের কাছে জমাট অন্ধকারের ভিতরে জায়গা করে নিলাম আমরা৷ এখান থেকে লক্ষ রাখতে হবে৷

দূরে গির্জার দরজার উপর ঝোলানো উইন্ড চাইমগুলো টুং-টুং করে বেজে চলেছে৷ একটা নরম হাওয়া ভেসে আসছে ছড়িয়ে থাকা পাথরের গায়ে লেগে৷ ঝোপের ভিতর থেকে পোকামাকড় ডেকে চলেছে৷ মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো ডালপালা হাওয়ার ধাক্কায় মড়-মড় শব্দ তুলছে৷ হঠাৎ কানে এলে মনে হচ্ছে কেউ যেন হেঁটে আসছে এইদিকেই৷

বেশ কিছুক্ষণ হল মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে৷ তারাদের আলো অবশ্য ভেসে আসছে সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে৷ ক্রমে দূরের কোনও বাড়ির ঘড়িতে ভোর পাঁচটা বাজল৷ কয়েকটা মুহূর্ত কাটতেই হঠাৎ অনুভব করলাম আমার ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছেন প্রোফেসরে৷ বাঁ হাতটা তুলে ধরেছেন সামনে৷ আমি সেই আঙুলের সোজাসুজি তাকালাম৷ ছড়িয়ে থাকা সমাধিপাথরগুলোর মাঝে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা মূর্তি৷ ঠিক যেন হাওয়ার উপরে ভেসে আসছেন তিনি৷ কোনওদিকে মুখ না ফিরিয়ে একটা বিশেষ সমাধি লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছেন৷ আমার কপাল ঘামে ভিজে উঠল৷ মিসেস এমওর্থ৷ তাঁর ঠোঁটের কোণে পরিতৃপ্তির হাসি৷ কিছুটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কশ বেয়ে৷ একটা হাত দিয়ে সেই রক্তটা মুছে নিলেন তিনি৷ তারপর আকাশ ফাটানো উন্মাদ পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়লেন৷ হাতদুটো তুলে ধরলেন আকাশের দিকে৷ সেইভাবে হাসতে-হাসতেই একটু-একটু করে তার শরীরটা মাটির নীচে নেমে গেল৷

‘সাবধানে এসো…’

প্রোফেসরের সঙ্গে উঠে গিয়ে মিসেস এমওর্থের শরীরটা ঠিক যেখানে মাটিতে মিশেছে সেই জায়গাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা৷ মাত্র দু-মাস আগেই খোঁড়া হয়েছিল মাটিটা, ফলে এখনও মাটি খুব শক্ত হয়ে যায়নি৷ কোদালের কোপে বেশ তাড়াতাড়িই মাটি উঠে আসতে লাগল৷

একটু-একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে৷ প্রায় ছ-ফুট মাটি খোঁড়ার পর একটা কাঠের পাটাতনে শাবল আটকে গেল আমাদের৷ প্রোফেসরের সুচালো ছুরির ডগাটা দিয়ে পাটাতনের একটা দিকে চাড় দিতে সেটা কিছুটা উঠে এল মাটি থেকে৷

আমি রুদ্ধশ্বাসে দেখলাম শক্ত মাটির উপরে যেখানে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল সেইখানে একইভাবে শুয়ে আছেন মিসেস এমওর্থ৷ তাঁর মুখে এখনও মৃত্যুর ছাপ লাগেনি৷ যেন এইমাত্র জেগে উঠবেন তিনি৷ আগের থেকে বরং আরও বেশি জীবন্ত দেখাচ্ছে তার মুখ৷ একটা মৃদু হাসির ছোঁয়াও লেগে আছে ঠোঁটের কোণে৷ প্রোফেসর বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শক্ত হাতে ছুরিটা আমূলে বসিয়ে দিলেন তাঁর বুকের বাঁদিকে৷ গলগল করে রক্তের স্রোত বেরিয়ে এল সেখান থেকে৷

মুখ তুলে উঠে দাঁড়ালেন প্রোফেসর, রক্তমাখা হাতটা আমার হাতের উপরে রেখে বললেন, ‘আর ভয়ের কিছু নেই… এবারে আবার মাটি দিয়ে বুজিয়ে ফেলতে হবে…’

কোদালটা হাতে নিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম আমি৷ প্রোফেসর একবার আড়মোড়া ভাঙলেন৷ একটু দূরে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ এখন থেমে আছে৷ আকাশের বুক চিরে আবার চাঁদ উঁকি দিয়েছে৷ তার রূপালি জ্যোৎস্না বিছিয়ে আছে কাঠের পাটাতনের উপরে৷

হাতে শক্তি সঞ্চয় করে আমি আবার কোদালটা তুলে নামিয়ে আনতে গিয়েও থেমে গেলাম৷ প্রোফেসরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, একটা ব্যাপার খটকা লাগছে জানেন৷’

‘কী ব্যাপার?’

‘মেজর পারসেল বললেন উনি ঘরে একটি নার্সকে রেখে ডক্টর রসকে ডাকতে যাচ্ছিলেন৷’

‘হ্যাঁ, আমিও তো তাই শুনলাম৷’

‘এদিকে ওনার স্ত্রী আগে অসুস্থ ছিল না৷ আজ রাতেই হয়েছেন৷’

‘হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছিলেন৷’

‘না, আমার প্রশ্ন তা নয়৷’

‘তাহলে?’

‘যেখানে এখনও ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়নি সেখানে একটু আগে অবধি সুস্থ ছিল এমন মানুষের কাছে নার্স আসবে কী করে?’

প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না প্রোফেসর৷ আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে একটু উপরে তাকিয়েছেন তিনি, আমার ঠিক পিছনেই যেন দেখছেন কাউকে৷ মাটির উপরে নিজেদের তৈরি করা গর্তের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি আমরা৷ কে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে?

চকিতে পিছন ঘুরে মেজর পারসালকে দেখতে পেলাম৷ তাঁর সারা শরীর জুড়ে একটা সাদা আভা খেলে যাচ্ছে৷ মাটি থেকে কিছুটা উপরে যেন ভাসছেন তিনি৷ কয়েকটা হিসহিসে শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে—

‘কার কবর খুঁড়ছেন!’ অবিকল মিসেস এমওর্থের গলা৷ একটা চাপা হাসি খেলে যাচ্ছে তার ঠোঁটের কোণে ‘নিজেদের নয় তো?’

আমি পিছিয়ে আসতে গেলাম৷ প্রোফেসরের হাত মৃত চামড়ার মতো ঠান্ডা হয়ে আছে৷

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *