চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

মৃত্যুর বয়স

মৃত্যুর বয়স

আজ আমি আমার স্ত্রীকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাব। ডাক্তারবাবু কালই বলে দিয়েছেন ছোটখাটো মেরামত করার ছিল, করে দিয়েছি। তবে হার্টের অবস্থা খুবই খারাপ। একটা পেসসমকার বসাতে পারলে ভালো হত। ভালো তো হত! আমার যে আর কিছু নেই। কিছুই নেই। একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করতুম আমি। রিটায়ার করার পর যা পেয়েছি, সব জমা করে দিয়েছি ব্যাঙ্কে। মাসে সুদ পাই এগারোশো টাকা। সেই টাকার তিনশো যায় বাড়ি ভাড়ায়। থাকে আটশো। সেই আটশোয় আমার সংসার চলে। এই ভীষণ বাজার, ডাল-ভাত ছাড়া বিশেষ কিছু জোটে না। একটা পেসমেকারের জন্যে টাকাটা যদি ভেঙে ফেলি, তাহলে উপোস। আমি কী করি! অনেক চেষ্টা করলাম, কোথাও কিছু একটা যদি পাই। কী পাব! শিক্ষিত যুবক ছেলেদেরই কিছু জুটছে না। আমার মতো অথর্ব বুড়োর কী জুটবে।

আমার জীবনটাই একটা জগাখিচুড়ি। ছেলেটার পেছনে জীবনের সমস্ত উপার্জন খরচ করে মানুষ করলুম, সে করলে কী, সব ছেড়ে দৌড়ল প্রেম করতে। প্রেম গেল ফেঁসে। বোকা ছেলে, দুম করে আত্মহত্যা করে বসল। একটা মেয়ের জন্যে অমন সোনার চাঁদ ছেলেটা চলে গেল। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলুম। ভালো ঘর, ভালো মেয়ে। সুখের সংসারের সব আয়োজনই করা ছিল। ছেলেটা ঘোড়া টপকে ঘাস খেতে গিয়ে মরে গেল। ছেলে মরে গেলে মানুষের দু:খ হয়, আমার খুব রাগ হয়েছিল। নিকৃষ্ট একটা গাধা। পৃথিবীতে প্রেম কি শুধু একটা মেয়েতেই আছে! আর কোথাও নেই! আমার ছেলে হয়ে একটা ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ারে ছেদ টেনে দিল! তারপর যত দিন যেতে লাগল রাগ ঘুরে গেল দুলালীর দিকে। হিরে চিনতে পারল না। এখন আমার দু:খ হয়। ফাঁকা লাগে। হালকা লাগে। আর ছেলের শোকে আমার স্ত্রী হয়ে গেল আধপাগলী। নিজের ওপর অত্যাচার করে করে শরীরটা চুরমার। কোনও ব্যাপারেই তার কোনও আগ্রহ নেই। ফ্যালফ্যালে, উদাস চোখ। করতে হয় করে। খেতে হয় খায়। পাগলামির সবচেয়ে বড় লক্ষণ হল—চিঠি লেখে। অজস্র চিঠি। কাকে লেখে? অদৃশ্য কোনও চরিত্রকে। মৃত পুত্রকে। সে-সব চিঠি কখনও পোস্ট করা হয় না। লেখাই হয়। লিখে লিখে ফেলে দেয় এখানে-ওখানে। একটা চিঠি আমি পুড়েছিলুম। লিখেছে তার বাবাকে। আমার শ্বশুরমশাই ছিলেন নামি পণ্ডিত। আর এ তো জানা কথাই সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মীর চির-বিবাদ। অর্থের তেমন জোর থাকলে, আমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন কেন?

সেই পরলোকগত পিতাকে আমার স্ত্রী লিখছে, তোমার নাতিটাকে ঠিক কেষ্ট ঠাকুরের মতো দেখতে হয়েছে। কী দুরন্ত! কী চঞ্চল! সারাটা দিন, দেখত, না দেখো। তেমনি দু:সাহস। সেদিন একটা কুকুরের লেজ ধরে টানছে। আশ্চর্য! অত বড় একটা বাঘা কুকুর কিচ্ছু বলল না। কুকুরটার মুখ দেখে মনে হল খুব আনন্দ পেয়েছে। লেজ নেড়ে তার কী খেলা! হাঁটতে তো শিখেইছে, আবার জানলার গরাদ ধরে হনুমানের মতো ঝুলতে শিখেছে। সেদিন দুম করে পড়েছে। কত আর চোখে চোখে রাখব বলো। সেদিন কোমরে দড়ি বেঁধে জানালার গরাদে বেঁধে রেখেছিলুম। এসে দেখি ছেলে আমার মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঠোঁটের কোণে এক গাছা সুড়সুড়ি পিঁপড়ে। সেই দৃশ্যটা বাবা, তুমি ভুলতে পারবে না। একেবারে গোপাল ঠাকুরটি। সব কথা ফুটেছে। মা বলে সে কি হাঁকডাক। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে যখন গালে গাল রাখে—মিষ্টি, ঠান্ডা মুখে একটা ক্ষীর ক্ষীর গন্ধ। রাতে উঠে দেখি—ঘুমিয়ে আছে চিত হয়ে। যেন খুদে দেবতা। চোখ দুটো কাঁপে। মাঝেমাঝে হাসে। বোধহয় ভগবানের সঙ্গে কথা বলে।

শিশুপুত্রের কথা লেখে। একের পর এক চিঠিতে। আমাদের পুত্রের বাললীলা। অতীত ভুলতে পারছে না। জীবনের অতীত অধ্যায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও বর্তমানে বের করে আনতে পারছি না। এত দু:খের ছেঁকাতেও কিছু হল না।

অনেক কসরত করে একটা ট্যাক্সি ধরলুম। আমারই মতো এক প্রবীণ মানুষ। চোখে সুতো জড়ানো চশমা। ট্যাক্সিটা যেন ঈশ্বরই পাঠিয়ে দিলেন। ঝরঝরে, নড়বড়ে। যেমন তার চালক, তেমনই তার আরোহী। ভদ্রলোকের কটকটে কথা। প্রথমেই বললেন, ‘মিটারে যা উঠবে তার ওপর কিছু বেশি দিতে হবে।’

‘কত বেশি?’

‘পাঁচ-দশ দিয়ে দেবেন যা হয়।’

‘বেশ ভাই, তাই হবে।’

‘প্রতিবাদ করলেন না তো!’

‘শক্তি নেই ভাই।’

‘কারণটা জেনে রাখুন, শান্তি পাবেন। আপনার যে এলাকা, সেখান থেকে ফেরার সময় প্যাসেঞ্জার পাব না। আমাকে খালি ফিরে আসতে হবে।’

‘বুঝেছি ভাই।’

‘বুঝলেই ভালো।’

গাড়ি চলছে। আমার যেমন দুর্মতি। হঠাৎ বলে বসলুম, ‘গাড়িটা শেষ পর্যন্ত যাবে তো!’

‘সন্দেহ থাকলে নেমে যান।’

আমি তাঁর মেজাজ দেখে নীরব হয়ে গেলুম। ভদ্রলোক তখন নিজেই বললেন, ‘এই যে আপনি আর আমি, ভাবছেন সহজে ভেঙে পড়ব? না! জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের ঘানি ঘুরিয়ে যেতে হবে। যেদিন কাত হব, সেদিন একেবারেই কুপোকাত।’

‘আপনি এই এত বয়েস পর্যন্ত গাড়ি চালাচ্ছেন কী করে?’

‘কী করব? কে খাওয়াবে আমাকে? পেটের দাসত্ব বড় দাসত্ব। উপায় থাকলে কেউ এই কাজ করে! আমার যেমন বরাত! মানুষ তো ভাগ্য নিয়ে আসে! প্যানপ্যান করে তো লাভ নেই।’ রাস্তার যা ছিরি। গাড়ি একবার ডানদিকে কাত মারে একবার বাঁদিকে। কখনও গর্তে, কখনও জলে। ভদ্রলোক বললেন, ‘বাপের জন্মে এমন রাস্তা দেখেছেন? এর নাম না কি রাস্তা।’

হাসপাতালের ভেতরে গাড়ি ঢুকল। হাসপাতালে ঢুকলেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। জঘন্য পরিবেশ। উপায় নেই। করতেই হবে। কেউ তো নেই আমার হয়ে করার। গত এক মাস, রোজ আমি সকাল, বিকেল এসেছি। যাওয়ার সময় সুরমা আমার হাত দুটো ধরে বলত, ‘এরই মধ্যে চলে যাবে?’ বোঝে না যে, হাসপাতালে আর কিছু না থাকুক যাওয়ার ঘণ্টাটা ঠিকই আছে। আসলে ওইরকম একটা হট্টরোলে সুরমা হাঁপিয়ে উঠত। আমাদের বাড়িটা তো বেশ নির্জন, নিরিবিলি। কতকালের ভাড়াটে আমরা। ছেড়ে দিলেই হাজার বারশো টাকা ভাড়া অক্লেশে পাবে। আমাদের বাড়িঅলা বেশ বুঝতে পারি—দিন গুনছেন, কবে বুড়ো আর বুড়ি ছুটি পাবে এই পৃথিবী থেকে!

সুরমার জিনিসপত্র ভরতি ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিলুম। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে সুরমার মাথায় কোনও গোলযোগ আছে! বেশ একটা অভিজাত চেহারা। বরং সেই তুলনায় আমি এক খেঁকুরে ভৃত্য। কারণটা আবিষ্কার করেছি। আমি আছি বর্তমানে। আমার কত জ্বালা-যন্ত্রণা দু:খ নিয়ে। সুরমা আছে অতীতে। জীবনের প্রথম দিনে।

সুরমা সকলের কাছে বিদায় নিয়ে এল। একমাসে সকলের সঙ্গেই বেশ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ‘আবার আসবেন’ একথা কেউ বলতে পারছেন না। সবাই বলছেন, ‘আসুন, আসুন, সাবধানে থাকবেন। অত্যাচার করবেন না।’

আমার কাঁধে হাত রেখে সুরমা ধীর গতিতে সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত বেশ গেল। তারপর হঠাৎ থেমে পড়ে বলল, ‘সেই ঘরটা একবার দেখে যাই, যে ঘরে খোকা হয়েছিল।’

‘সে তো এখানে নয়। খোকা তো চন্দননগরের হাসপাতালে হয়েছিল।’

‘তুমি আজকাল সব ভুলে যাও। এই তো সেই সিঁড়ি!’

অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুরমাকে ট্যাক্সিতে তুললুম। ট্যাক্সির চালক সুরমাকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেলেন। দরজা ধরে রেখে, হাত ধরে, ধীরে ধীরে বসতে সাহায্য করলেন। হাতজোড় করে নিজের কপালে ঠেকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আহা! সাক্ষাৎ জগজ্জননী।’ পুরোনো আমলের মানুষ তো, কিছু কিছু বোধ এখনও বেঁচে আছে। মায়ের মূর্তি চিনতে ভুল হয় না। আর সুরমা শতভাগ মা। ছেলেটা মারা গেছে সেই কবে! সেই থেকেই তো সুরমা দিনরাত তাকে নিয়েই আছে। একটার পর একটা সোয়েটার বুনে চলেছে। ট্রাউজারের কাপড় কিনছে সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে। পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে দাগ মারছে। সবই করছে নীরবে। সব সময়ে তাকে অসংলগ্ন মনে হয় না। মাঝেমাঝে একটু অদ্ভুত মনে হয়। বসে থাকতে, থাকতে হঠাৎ সাড়া দেয়, ‘যাই বাবা।’ আমি তখন বোকার মতো বলি, ‘কাকে সাড়া দিলে?’ একটু যেন রেগে যায়, ‘তুমি শুনতে পেলে না! খোকা ডাকল।’

গাড়ি যেই মিউজিয়ামের সামনে এসেছে সুরমা বললে, ‘এই তো সেই বাড়ি। মিউজিয়াম না!’

চালক বললেন, ‘হ্যাঁ মা।’

‘থামাবেন একটু।’

‘এখানে তো গাড়ি রাখা যাবে না। পুলিশ ফাইন করে দেবে।’

আমি বললুম, ‘তুমি মিউজিয়ামে কী করবে?’ ‘তোমার মনে নেই, খোকাকে নিয়ে শীতকালে একবার বেড়াতে এসেছিলুম। সেই ঘরগুলো একবার দেখে যেতুম।’

‘বেশ তো, এই শীতে একবার আসব। তখন তোমার শরীরটাও একটু ভালো হয়ে যাবে।’

সুরমা গুম মেরে গেল। গাড়ি তখন সেই বিশাল বাড়িটাকে পেছনে ফেলে চলে এসেছে। সুরমা হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করছে। এইরকম করলেই বুঝতে পারি, সুরমা অতীতে ফিরে চলেছে। যখন আমার যৌবন ছিল। যখন সুরমা সুন্দরী এক বধূ। সুরমার কোলে খোকা। খরগোশের মতো চোখ। ফরসা গোল গোল হাত। সেই হাতে লোহার একটা ছোট্ট বালা। মায়ের কোলে শুয়ে নিজের হাত-পা নিয়ে খেলা করছে আপন মনে। মুখে অদ্ভুত একটা শব্দ। মাঝেমাঝে অলৌকিক কোনও আনন্দে ঝিকি মেরে উঠছে। অকারণ হাসির কপচানি। একটানা একটা যে যে শব্দ। গোল পুতুলের মতো মুখ। টকটকে লাল ঠোঁট। মুখের ভেতরটা লাল টুকটুকে। নিজের বুড়ো আঙুল চুষছে। নালঝোল মাখামাখি।

গাড়ি হাতিবাগানের কাছে এসে গেছে। দুপাশে জামাকাপড়ের দোকান। সুরমা বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। হঠাৎ করুণ গলায় বললে, ‘গাড়িটা একবার দাঁড় করানো যাবে?’

ভদ্রলাক বললেন, ‘হ্যাঁ, এখানে যাবে।’

আমি বললুম, ‘এখানে তুমি কী করবে?’

‘একটা দোকানে খুব সুন্দর একটা লাল জামা ঝুলছে। ওই জামাটা আমি খোকার জন্যে কিনব।’

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘খোকার জন্যে?’

‘হ্যাঁ, খোকার জন্যে। খোকার জন্যে একটা কিছু নিয়ে যেতে হবে তো।’

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, ‘তোমার আর নামার দরকার নেই। কোন জামাটা বলো, আমি নিয়ে আসি।’

‘তুমি পারবে না। তুমি খোকার মাপই জানো না।’ কথাটা ঠিক, তার মনের খোকা এখন কত বড়, আমার তো জানা নেই। সেই সুরমা নামল। মনের আবেগে হেঁটে চলল গটগট করে। টলছে। চালক ভদ্রলোক আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘ধরুন, ধরুন। মাকে ধরুন।’ এক মাসের হাসপাতাল বাসে বাইরের চেহারায় অসম্ভব এক উজ্জ্বলতা এসেছে। মনে হচ্ছে যেন কোনও মহারানি যাচ্ছেন।

দোকানের মালিক জিগ্যেস করলেন, ‘ছেলের বয়স কত মা?’

‘এই ধরুন সাত, সাড়ে সাত। আটে পা দেবে আর কি।’

দেখলুম, যা ভেবেছি তাই। সুরমার মনে খোকার মৃত্যুর দিনটাই জন্মদিন হয়ে উঠেছে। খোকা চলে গেছে আজ প্রায় আট বছর হল। মৃত্যুর বয়স হল আট। গাড়িতে ফিরে এসে সুরমা যেন এলিয়ে পড়ল। হার্টের অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়। ডাক্তার বলেই দিয়েছেন। কতদিন আর ফেলে রাখবেন হাসপাতালে! এর তো তেমন কোনও চিকিৎসা নেই। একমাত্র চিকিৎসা টাকা। টাকার তেলে জীবনদীপ জ্বলবে। চালক ভদ্রলোক কিছতেই বাড়তি টাকা নিলেন না। শেষে একরকম রেগেই গেলেন, ‘আচ্ছা আজব লোক! আমি নেব না, তবু আপনি আমাকে জোর করে দেবেন।’

সুরমাকে দেখে মানুষটার হঠাৎ কীরকম পরিবর্তন হয়ে গেল!

তিন-চার দিন ভাবলুম। কীভাবে একটা পেসমেকার জোগাড় করা যায়। হঠাৎ মনে হল, আমার বাড়িঅলা তো আমাকে তুলতে চান। কিছুদিন আগে বলেছিলেন, বিশ, তিরিশ হাজার দিচ্ছি, আপনার তো মাত্র দুজন, একটা ছোটখাটো, এক কামরার বাড়ি দেখে নিন না। একটা ঘর, বাথরুম, রান্নার জায়গা, এর বেশি আর কী প্রয়োজন। শুধু, শুধু এত বড় একটা বাড়ি আটকে রেখেছেন!

ঠিকই। ওই টাকাটা পেলে সুরমার বুকে সহজেই একটা পেসমেকার বসানো যায়। বাড়িঅলার বিশাল দোকানে গেলুম। তিনি তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আজ বললে কালই সব ব্যবস্থা হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ভদ্রলোক আমাকে একটা ছোট বাড়ির সন্ধান দিলেন। বাড়িটাও দেখে এলুম। এখানে একটা বাড়ি। বাড়িটার বয়স হয়েছে। বয়স হলেও মন্দ নয়। ছোট একটা কৌটোর মতো। হালকা ভাবে থাকা যাবে। কিছু মালপত্র ফেলে দিলেই হল। খোকার হাজার চারেক বইই একটা সমস্যা। বইগুলো কোনও লাইব্রেরিতে দিয়ে দিলেই হল। বইয়ের আর কি প্রয়োজন! আমার চোখ গেছে, সুরমার মাথা গেছে। যাক, অভ্যাসটা একটু পালটাতে পারলে, একটু কষ্ট করতে পারলে, সুরমা হয় তো আরও কিছুদিন বাঁচবে।

সে সময়টায় সুরমা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে, সেই সময় তাকে পরিকল্পনাটা জানালুম। জীবনে যখন যা করেছি, দু’জনে পরামর্শ করে করেছি। এখনই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? সুরমা কোনও কথা না বলে গম্ভীর হয়ে বলে রইল।

তোমার আপত্তিটা কীসের? আমরা তো দুটো প্রাণী। এত বড় বাড়ি, পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখাও তো এক সমস্যা!’

সুরমা উঠে চলে গেল। মাঝেমাঝে আমার রাগ হয়। রাগ এখন খুব কমিয়ে ফেলেছি, তবু হয়। নিজের অক্ষমতার ওপর রাগ। অবুঝ মানুষের ওপর রাগ। সামাজিক অব্যবস্থার ওপর রাগ। সুরমা পাগল হতে চায় তো পুরোপুরি পাগল হয়ে যাক। তখন আমার আর কোনও ক্ষোভ থাকবে না। আর তা না হলে, আমার অবস্থাটা বুঝুক! একটু বুঝদার হোক।

আমি একটু জোর গলাতেই বললুম, ‘তোমার কতকগুলো জিনিস আমার মাথায় আসে না। অভিনয় করো, না সত্যি সত্যিই করো বুঝতে পারি না। আমার সমস্যাটা তুমি না বুঝলে কে বুঝবে? তোমার শরীর আগে না বাড়ি আগে?

আমি রাগ করে শুয়ে পড়লুম। যা হয় হোক। ফিকসড ডিপোজিট আমি ভাঙতে পারব না। সেটা হবে আত্মহত্যার সামিল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। গভীর রাত। সুরমা বিছানায় নেই। ঘুম ভেঙেছিল একটা শব্দে। ভারী একটা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। সব অন্ধকার। কোথাও কোনও আলো নেই। এই ঘোর অন্ধকারে সে গেল কোথায়! বুকটা কেমন করে উঠল। আমারই বা হৃদয়ের জোর কোথায়। হাতড়ে, হাতড়ে গিয়ে ঘরের আলোটা জ্বাললুম। ঘরের বাইরে এলুম। দূরে বাথরুম। বাথরুমের সামনে সুরমা পড়ে আছে একপাশে কাত হয়ে।

বাথরুমের আলোটা জ্বেলে দিলুম। এক ঝলক আলো মুখে পড়েছে। পাশে বসে সবার আগে হাতটা টেনে নিলুম। নেই। কবজির কাছে জীবনের কল থেমে গেছে। কনুইতেও নেই। সব স্থির। মুখে যে যন্ত্রণাটা ছিল, সেটা ধীরে ধীরে হাসি হয়ে ফুটছে। আমাকে অপরাধী করে তাহলে তুমি গেলে! ‘কী করব! আমিও খোকাকে ভালোবাসতুম, কিন্তু তোমাকে ভালোবেসেই তো খোকাকে পেয়েছিলুম। লোক আগে গাছকে ভালোবাসে, যত্ন করে, পরিচর্যা করে, তবেই না আসে ফল। তুমি আমার তিক্ত কথাটুকুই নিয়ে গেলে! সেটা যে আমার ভালোবাসা, তা কি বুঝেছিলে!

আমাকে লেখা তার জীবনের প্রথম চিঠিটা সে ওই রাতেই লিখেছিল, আমি যখন ঘুমিয়েছিলুম—

‘তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ, এই বাড়িটা ছেড়ো না। এখানে আমার খোকা আছে। এর ঘরে ঘরে সে ঘুরে বেড়ায়। জানালার ধারে বসে। টেবিলে বসে লেখাপড়া করে। খাটে শুয়ে গান গায়। বাথরুমে চান করে। সব সময় সে আছে। সে যায়নি। তোমার ওপর অভিমান করে সে লুকিয়ে আছে। তুমি দেখতে পাও না, আমি পাই। বাড়িটা ছেড় না। খোকাকে আশ্রয়হীন কোরো না।’

চিঠিটা টেবিল থেকে বেরোল। কী করব আমি!

আর তো কিছ করার নেই এত দিনে খোকার মৃত্যু হল। বাড়িঅলা ভদ্রলোক এলেন, ‘ক্যাশ টাকা এনেছি। সোজা ব্যাঙ্কে জমা করে দিন।’

‘মশাই! এতই যখন করলেন আর ক’টা দিন অপেক্ষা করুন। বিনা টাকাতেই পেয়ে যাবেন। আর ক’টা দিন। সবুরে মৃত্যু ফলে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *