মৃত্যুর কবলে নূরী
বনহুর নূরীর রক্তমাখা দেহটার দিকে একবার তাকিয়ে ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো, দক্ষিণ হস্তে তার উদ্যত রিভলভার। পকেটে এখনও যথেষ্ট গুলী মজুত রয়েছে।
ভোলানাথ দলবল সহ এগিয়ে আসতেই বনহুরের হস্তস্থিত রিভলভার গর্জন করে উঠলো। অব্যর্থ গুলী বনহুরের সঙ্গে সঙ্গে ভোলানাথের একজন প্রিয় অনুচর আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ভূতলে।
ভোলানাথ বা তার দলবলের তখন কোনো দিকে ফিরে তাকাবার সময় নেই। শিকারের লালসায় রক্তলোভী জানোয়ার যেমন উগ্র হয়ে উঠে, তেমনি দ্রুত ছুটে চললো ওরা বনহুরের দিকে।
বনহুর মুহর্তে বিলম্ব না করে পরপর গুলী ছুঁড়তে লাগলো। প্রত্যেকটা গুলীর আঘাতে ভোলানাথের সঙ্গীগণ ধরাশায়ী হতে লাগলো। সুচতুর ভোলানাথ কৌশলে তার দলবলের মধ্যে আত্মগোপন করে নিজকে বাঁচিয়ে নিতে লাগলো।
নিজেও ভোলানাথ ও তার সঙ্গীগণ বনহুরকে লক্ষ্য করে তীর এবং ছোরা নিক্ষেপ করতে লাগলো।
বনহুর গাছের গুঁড়ির আড়ালে কখনও বা টিলার পাশে নিজকে আড়াল করে শত্রুপক্ষের অস্ত্র থেকে নিজকে রক্ষা করছিলো। মুহূর্তে মুহূর্তে বনহুরের রিভলভার গর্জন করে উঠছিলো।
ওদিকে ভোলানাথের দলের অস্ত্র-নিক্ষেপের বিরাম ছিলোনা।
বনহুর একা আর ভোলানাথের দলে প্রায় বিশ জনেরও বেশি হবে। তবু ভোলানাথের দল বনহুরের রিভলভারের কাছে টিকে উঠতে পারছিলোনা। বনহুর আজ ভয়ঙ্করের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, সিংহের চেয়েও হিংস্র।
নূরীর মৃত্যু তাকে উম্মাদ করে তুলেছে!
বনহুর শত্রুর সঙ্গে লড়াই এর জন্য প্রস্তুত হয়েই কান্দাই থেকে রওয়ানা দিয়েছিলো, কাজেই রিভলভার এবং অফুরন্ত গুলী সে সঙ্গে নিয়েই এসেছিলো। এই মুহূর্তে বনহুরের সম্বল তার রিভলভারখানা।
ভোলানাথের দল যতই দুর্দান্ত হোক বনহুরের রিভলভারের কাছে নাজেহাল হয়ে পড়লো, এক এক করে অনেকগুলি ধরাশায়ী হলো ভূতলে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো আরাকান জঙ্গলের মাটি!
সেকি ভীষণ যুদ্ধ।
বনহুর টিলার পাশে আত্মগোপন করে অবিরাম গুলী চালাচ্ছে। কখনও বা গাছের গুঁড়ির আড়ালে, কখনও বা ঝোপ-ঝাড় আর আগাছার অন্তরালে।
মুহূর্তে মুহূর্তে প্রকম্পিত হয় উঠছে বনভূমি বনহুরের রিভলভারের গুলীতে।
আর বেশিক্ষণ টিকে উঠতে পারলো না ভোলানাথের দল, তারা জীবনে বহুজনকে যুদ্ধে পরাজিত করে আরাকানের মাটি লালে লাল করে দিয়েছে, আজ হলো তাদের পরাজয়।
প্রায় তিন ভাগ দুশমন নিপাত করে বনহুর হাঁপাতে লাগলো। রিভলভারের গুলীর সংখ্যাও কমে এসেছে অনেক। বনহুর এখন অনেক সাবধানে গুলী চালাচ্ছে। একটি গুলী যেন তার নষ্ট না হয়।
ইতিমধ্যে ভোলানাথের এক অনুচরের গুলীতে বনহুরের বাম স্কন্ধের খানিকটা মাংস কেটে রক্ত ঝরছিলো।
বনহুর ললাটের ঘাম বাম হস্তের পিঠে মুছে নিয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগলো। কাঁধের মাংস কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। গুলীর পর গুলী নিক্ষেপ করে চলেছে সে। বনহুরের সুন্দর মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে, দাঁতে অধর চেপে গুলী ছুড়ছে।
ভোলানাথের দলের অস্ত্র নিক্ষেপেরও বিরাম নেই। তারা সংখ্যায় যত কমে আসছে ততই যেন আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠছে। ক্রুদ্ধ জানোয়ারের মতো বনহুরকে হত্যা করবার জন্য ক্ষেপে উঠেছে।
ভোলানাথ স্বয়ং তীর নিক্ষেপ করছে, চোখ দিয়ে যেন অগ্নি শিখা নির্গত হচ্ছে তার। বিরাট দেহটা দুলে দুলে উঠছে ভয়ঙ্কর রাক্ষসের মত। মাথায় একরাশ চুল সজারুর কাটার মত হয়ে উঠেছে, সেকি ভীষণ চেহারা তার!
বনহুর মরিয়া হয়ে গুলী ছুড়ছে, কিন্তু আশ্চর্য–এতো লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়েও ভোলানাথের শরীরে একটি গুলীও বিদ্ধ করতে পারছে না সে।
ভোলানাথের সঙ্গীরা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, মাত্র কয়েকজন এখনও বিপুল উদ্যমে লড়াই করছে। কিন্তু আর বেশিক্ষণ তারা বনহুরের রিভলভারের মুখে টিকতে পারবে বলে মনে হয় না। ভোলানাথের দলের অস্ত্র নিঃশেষ হয়ে এসেছে। এবার ভোলানাথ তার দলবলের মনোভাব বুঝতে পারলো, অস্ত্রশূন্য হয়ে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে আত্মগোপন করাই শ্রেয় মনে করলো বুঝি ভোলানাথ।
বনহুরের রিভলভার থেকে তখনও অবিরাম গুলী বর্ষণ হচ্ছে; তবে তার পকেটেও আর গুলীর সংখ্যা বেশি নেই। বনহুর এখন অত্যন্ত সাবধানের সঙ্গে গুলী নিক্ষেপ করছে। একটি গুলীও যেন ব্যর্থ না হয়।
হঠাৎ বনহুর এবার লক্ষ্য করলো, ভোলানাথ তার দলবল ত্যাগ করে কোথায় উধাও হয়েছে। সামান্য কয়েকজন লোক তখনও তীর-ধনু আর ছোরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। বনহুরকেই যে তারা অনুসন্ধান করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে বনহুর সব কটাকে এক এক করে যমালয়ে পাঠাতে পারে কিন্তু ওদের হত্যা করে কোনো লাভ হবে না, আসল শিকার অন্তর্ধান রয়েছে। তবু ওদের না সরানো পর্যন্ত বনহুর নূরীর মৃতদেহের পাশে যেতে পারছে না। বনহুর পরপর আরও দুজনাকে ধরাশায়ী করে ফেললো।
সঙ্গীদের এই পরিণতি দেখে অন্যান্য কয়েকজন আরাকান গুণ্ডা এবার ঝোপ-ঝাড় অতিক্রম করে পালাতে শুরু করলো।
বনহুর আর একদণ্ড বিলম্ব না করে ছুটে চললো যেখানে পড়ে আছে নূরীর তীরবিদ্ধ দেহটা।
কিন্তু কি আশ্চর্য! যেখানে নরীর লাশটা পড়ছিলো সেখানে কিছু নেই, শুধু জমাট বেঁধে আছে। নূরীর বুকের তাজা রক্ত।
বনহুর ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে, জমাট বাধা রক্ত মুঠোয় চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো, ঠিক ছোট্ট বালকের মতো। জীবনে বুঝি সে এমনভাবে কোনোদিন রোদন করে নি।
আজ বনহুর নূরীর অভাব অন্তর দিয়ে অনুভব করলো। বুকের মধ্যে অসহ্য একটা হাহাকার গুমড়ে উঠলো তার। কিছুক্ষণ আগের নূরীর সেই হাসোজ্জ্বল সুন্দর মুখখানা ভেসে উঠতে লাগলো তার মানসপটে। কাজল কালো দুটি চোখে অপূর্ব ভাবময় চাহনী। সরু গোলাপ পাপড়ীর মত দুটি ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি মধুর হাসি। বনহুর আজ সমস্ত অন্তর দিয়ে নূরীর অপরূপ সৌন্দর্য অনুভব করেছিলো, উপলব্ধি করেছিলো তাকে। নূরীকে আজ বনহুর পেয়েছিলো একান্ত আপন করে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে তাকে হারাতে হবে ভাবতেও পারেনি বনহুর কোনো সময়ের জন্য।
অবুঝ বালকের মতো কাঁদতে লাগলো বনহুর, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার গণ্ড বেয়ে। কেউ নেই আজ তাকে সান্তনা দেবার কেউ নেই তার পাশে এসে দাঁড়াবার।
কতক্ষণ বনহুর স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো খেয়াল নেই, হঠাৎ একটা হিংস্র গর্জনে ফিরে তাকালো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার উদ্যত করে ধরলো সে।
বনহুরের নিকট হতে কয়েক গজ দূরে একটা বিরাট সিংহ ভয়ঙ্কর মুখ-গহ্বর বিস্ফারিত করে দাঁড়িয়ে আছে, আর এক মুহূর্ত– তাহলেই পশুরাজ তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বনহুর দ্রুত হস্তে রিভলভারখানা বের করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো; সঙ্গে সঙ্গে একটি গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো পশুরাজের বুকে।
ভীম গর্জন করে সিংহটা লাফিয়ে পড়লো বনহুরের পাশে। বনহুর অতি কৌশলে নিজেকে সরিয়ে নিলো দূরে।
সিংহরাজ আর দাঁড়াতে পারলো না, মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো।
বনহুর এগিয়ে এলো পশুরাজের মৃতদেহের পাশে। একটি মাত্র গুলীই বনহুরের রিভলভারে শেষ সম্বল হিসাবে ছিলো; তাই আজ এই মুহূর্তে বনহুরকে বাঁচিয়ে নিলো। কিন্তু এ বাঁচায় তার আনন্দ হলোনা, বিপদ কেটে যাওয়ায় আবার নতুন করে নুরীর শোক তার হৃদয়ে দগ্ধীভূত করে চললো। বনহুরের দৃষ্টি নূরীর মৃতদেহের সন্ধানে চারদিকে ঘুরে ফিরতে লাগলো। কিন্তু কোথায় নূরী! হঠাৎ বনহুর লক্ষ্য করলো– সিংহরাজের মুখ-গহ্বর তাজা রক্তে রাঙা হয়ে রয়েছে। তবে কি নূরীর মৃতদেহটা পশুরাজের উদরে স্থান লাভ করেছে? হয়তো তাই হবে, নূরীর মৃতদেহটা তো আর পচে যায়নি– সম্পূর্ণ টাকা লাশ ছিলো ওটা, কাজেই পশুরাজের ভক্ষণে কোন অসুবিধাই হয়নি। নূরীর শেষ পরিণতি চিন্তা করে বনহুরের হৃদয় বিদীর্ণ হলো।
সেদিনের পর থেকে বনহুরের হৃদয় মধ্যে এলে একটা পরিবর্তন। যে নূরীকে সে কয়েকমাস আগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলো আজ সেই নূরীর জন্য সর্বহারা রিক্তের মত বনে বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। আজ বনহুর যেন তার সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছে, সব যেন লুট হয়ে গেছে তার। উষ্ক-শুষ্ক চুল, মলিন মুখমণ্ডল, অবশ শিথিল দেহ, মন্থর পদক্ষেপে চলছিলো– কোথায় যাচ্ছে, কেনো যাচ্ছে, সে নিজেই জানে না। দৃষ্টি উদাস-করুণ বেদনা ভরা।
বনহুর আজ সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করছে নূরী তার হৃদয়ের কতখানি অধিকার করে নিয়েছিলো। নূরীর প্রেম-ভালবাসাকে সে চিরদিন উপেক্ষাই করে এসেছে, কোনোদিন তার প্রতি এতোটুকু সহানুভূতি পর্যন্ত দেখায় নি বনহুর। কেন, নূরী কি তাকে কিছু দিয়েছিলো না? নূরীই তো তার জীবনের প্রথম কল্পনার রাণী। নূরীর ভালবাসাই তার জীবনে এনেছিলো প্রথম প্রেম। তাকেই তো প্রথম হৃদয় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করেছিলো সে। নূরীর মৃত্যুর পর থেকে সেই হয়েছে। তার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন-সাধনা। সেদিনের পর থেকে বনহুর সব সময়ের জন্য এই বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি বারের জন্য ত্যাগ করতে পারে নি সে এই আরাকান জঙ্গল। সারাটা দিন বনে বনে ঘুরে বেড়ায় উদভ্রান্তের মতো, চারিদিকে কি যেন খুঁজে ফেরে, কাকে যেন অন্বেষণ করে সে।
ক্ষুধা-পিপাসা সব যেন উবে গেছে ভুলে গেছে বনহুর সমস্ত দুনিয়াটাকে। যেখানে বসে সেখানে বসেই থাকে প্রাণহীন অসাড়ের মতো।
নূরীকে সে এতোখানি ভালবেসেছিলো নিজেই বুঝতে পারেনি কোনোদিন। নূরীকে হারিয়ে ভুলে গেছে বনহুর তার নিজের অস্তিত্ব।
বনহুর সমস্ত আরাকান জঙ্গলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। ঝোপ-ঝাড় বন সব নিপুণ দৃষ্টি মেলে দেখেছে কিন্তু কোথাও নূরীর সন্ধান পায় নি।
একটা গাছের তলায় এসে বসলো বনহুর। আজ ক’দিন সম্পূর্ণ উপবাসী সে। ক্ষুধা- পিপাসা তার হয়েছে কিন্তু উপলব্ধি করতে পারে নি। সম্মুখে বৃক্ষ ভরা কত সুস্বাদু ফল, ঝরণা ভরা স্বচ্ছ জল, বনহুর ইচ্ছা করলে এ সবে ক্ষুধা নিবারণ করতে সক্ষম হতো, কিন্তু তার মনে কোন সময় এ সব চিন্তা আশ্রয় পায়নি।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো আবার ফিরে এলো সে যে স্থানে নূরী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে, যেখানে নূরীর মৃতদেহটা পড়েছিলো বনহুর সেই স্থানে এসে দাঁড়ালো, নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো নিস্পলক নয়নে… হঠাৎ বনহুরের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো একখানা মুখ, সে মুখখানা আর কারো নয়– নূরীর।… ঐ তো নূরী বসে আছে। সেও তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুন্দর মুখমণ্ডলে বিষণ্ণতার ছাপ, চোখে করুণ চাহনী। ঠোঁট দু’খানা শুকিয়ে গেছে কেমন যেন রক্তশূন্যতার মতো। চুলগুলো এলোমেলো বিক্ষিপ্ত-কপালে-ঘাটে পিঠে ছড়িয়ে আছে। বনহুর ওর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো– নূরী–নূরী– দু’হাত প্রসারিত করে ছুটে গেলো ওকে জাপটে ধরতে, কিন্তু কোথায় নূরী– সব শূন্য, সব ফাঁকা।
বনহুর ধপ্ করে বসে পড়লো ভূতলে, দু’হাতে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে লাগলো, ডুকরে কেঁদে উঠলো– নূরী–নূরী তুমি কোথায়… কোথায়…
এমনি শুধু আজ নয়, আরও কতদিন বনহুর ছুটে এসেছে এইখানে, দেখতে পেয়েছে সে। নূরীকে ধরতে গেছে সে, কিন্তু ধরতে পারেনি, কোথায় হারিয়ে গেছে আলেয়ার আলোর মত বাতাসের বুকে।
বনহুর মাথার চুল টেনে ছিঁড়ছিলো, অধর দংশন করছিলো। নূরীর অন্তর্ধান তাকে যেন পাগল করে দিয়েছে।
*
মনি রহমানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে– কাক্কু, আমার বাপ্পি তো আর এলোনা?
বনহুরের আগমন প্রতিক্ষায় রহমান প্রহর গুণছিলো মনির মনেই শুধু চিন্তা জাগেনি, বনহুরের জন্য রহমানের মনটাও কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। সেইদিনের পর রহমান আর আরাকান জঙ্গলে যায়নি। বনহুর আর নূরীর মিলন তার মনে যেমন আনন্দ বয়ে এনেছিলো, তেমনি তার হৃদয় ভরে উঠেছিলো শূন্যতার হাহাকারে।
নূরীকে রহমান অন্তর দিয়ে ভালবেসেছিলো, সমস্ত প্রাণ ভরে সে কামনা করতো ওকে। কিন্তু নূরীর দিক থেকে কোনোদিন সে পায়নি এতোটুকু আশ্বাস। রহমান নূরীকে ভালোবেসে শুধু। দীর্ঘনিশ্বাসই বহন করেছে, কোনোদিন তাকে একান্ত আপন করে পায়নি। ওকে না পাবার বেদনা রহমানের মনে দাহ সৃষ্টি করেছে কিন্তু সান্ত্বনার প্রলেপ সে পায়নি। তাই রহমান সেদিন নূরীকে তার অন্তর থেকে বিদায় দিয়েছিলো, যদিও হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো তবু সে নূরীকে তুলে দিয়েছিলো তার প্রিয় সর্দারের হাতে।
রহমানের চোখ দুটি তখন শুষ্ক ছিলোনা, বনহুর বা নূরী কেউ লক্ষ্য করলে দেখতো সে আঁখি দুটিতে কি অসহ্য বেদনা ফুটে উঠেছিলো। সেদিন নূরীকে শেষ বারের মতো বিদায় দিয়েছিলো রহমান তার মনের গহন থেকে।
আজ মনি না বললেও রহমানের মনে সব সময় সর্দার আর নূরীর কথা জেগেছিলো– মুখে ব্যক্ত না করলেও অন্তরে সদা-সর্বদা একটা তুষের আগুনের মতো কুণ্ডলি গুমড়ে জুলছিলো।
সেদিন রহমান আরাকান জঙ্গল থেকে শহরে ফিরে এসে কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলোনা। প্রাণ-প্রতিমাকে বিসর্জন দিয়ে পূজারী যেমন শূন্য কুটিরে ফিরে আসে তেমনি অবস্থা হয়েছিলো রহমানের। নূরীকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে রহমান কাতর হলেও ভেঙে পড়েনি। আজ যদি নূরীকে সর্দারের হাতে সমর্পণ না করে অন্য কেউ গ্রহণ করতো, তাহলে রহমান তাকে কিছুতেই ক্ষমা করতো না।
রহমানকে গভীরভাবে চিন্তা করতে দেখে বলে মনি– কি ভাবছো কাকু? আমার বাপি আর আসবেনা?
রহমানের সম্বিৎ ফিরে আসে, বলে সে আসবে। আসবে মনি। কিন্তু…
কিন্তু কি কাক্কু?
এতোদিন এলোনা কেন তাই ভাবছি।
হয়তো কোনো কাজে আটকা পড়ে গেছে। কাক্কু তুমি যাও, আমার বাপিকে নিয়ে এসো।
কিন্তু,
আবার কিন্তু কেনো?
যদি না আসে? আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। কাক্কু, তুমি না বলেছিলে মাম্মিও আছে বাপির সঙ্গে?
হাঁ? মনি, সেও আছে তার সঙ্গে।
যাওনা, কাকু, আমার বাপি আর মাম্মিকে নিয়ে এসোগে।
যেতে হবেনা, তাদের সময় হলে এমনিই চলে আসবে।
তুমিতো আরও কতো দিন বলেছে, তারা চলে আসবে কিন্তু আজও তো এলোনা? আজ আমি কিছুতেই শুনবোনা, কাকু তোমাকে যেতেই হবে।
বেশ, আমি তাদের আনতে যাবো, তুমি স্কুলে যাও।
যাবো, এসে যেন বাপি আর মাম্মিকে দেখতে পাই।
পাগল ছেলে, যেখানে তোমার বাপি আর মাম্মি আছে সে স্থান যে অনেক দূরে, তুমি স্কুল থেকে ফিরেও বাড়ির বুড়িমার কাছে থাকবে। বুড়ি-মা ওরফে খালার কথাই বললো রহমান মনির কাছে।
খালা পাশের বাড়ির একটি বিধবা প্রৌঢ়া মহিলা। শুধু রহমানই নয়, এ পাড়ার অনেকেই তাকে ‘খালা’ বলে ডাকে। মহিলাটি অতি মহৎ এবং পরোপকারী। সংসারে তার আপনজন বলতে কেউ নেই, কিন্তু বিষয়-আসয় আছে অনেক, নিজে খেয়ে-পরে প্রচুর বেঁচে যায়। তাই খালা যতটুকু তার সামর্থ পরের কাজে নিজের ঐশ্বর্য বিলিয়ে দেয়, এতোটুকু কার্পণ্যতা নেই তার মধ্যে।
খালার ঐশ্বর্যের মধ্যে তার বেশ কয়টা বাড়ি ছিলো আরাকান শহরে। এ বাড়িগুলি তার কোনটা অতিথি শালা, কোনটা দাঁতব্য চিকিৎসালয়, আর কোনটা ছিলো ভিখারীদের আস্তানা। এই বাড়ীগুলির একটাতেই ভাড়াটে হিসাবে বাস করতো রহমান আর নূরীমনিও তাদের সঙ্গে ছিলো।
খালার সঙ্গে রহমান আলাপ জমিয়ে নিয়েছিলো অত্যন্ত আপন জনের মতো। খালাও ভালোবেসে ফেলেছিলো ওদের তিন জনকে একান্ত নিজের সন্তান-সন্ততির ন্যায়। মনি ছিলো বৃদ্ধার যেন নয়নের মনি। মনিকে তার বড় ভাল লাগতো, মনির নাওয়া-খাওয়া সব দায়িত্বভার নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলো তুলে, বিশেষ করে নূরীর অন্তর্ধানের পর রহমান যখন ক্ষিপ্তের মত এখানে সেখানে ছুটোছুটি করে ফিরেছিলো তখন এই বৃদ্ধা মনিকে বুকে আঁকড়ে ধরেছিলো, সান্ত্বনা দিয়েছিলো আমি তোমার বুড়ি-মা।
তখন থেকে মনি বৃদ্ধাকে বুড়ি-মা বলে ডাকতো। বুড়িমার কথায় মনি উঠতে-বসতো– সব করতো। কাজেই বুড়ি-মা বা খালার কথায় মনি রাজি হয়ে গেলো, বললো– আচ্ছা তুমি যাও কাকু, আমার বাপি আর মাম্মিকে নিয়ে এসো।
এতোদিন সর্দার নূরীকে নিয়ে ফিরে না আসায় মনে মনে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো রহমান। তবে সন্দেহ হচ্ছিলো তার সর্দার হয়তো নূরীকে নিয়ে ফিরে গেছে কান্দাই জঙ্গলে নিজের আস্তানায়। অবশ্য এই চিন্তার উপরেই বেশি জোর দিয়েছিলো বলেই রহমান আজও নিশ্চুপ ছিলো তার টাঙ্গী চালানায়।
নূরীকে হারানো বেদনা রহমান মন থেকে মুছে ফেলবার জন্যই সব সময় কাজে লিপ্ত। থাকতো। নিজকে ব্যতিব্যস্ত রাখতো টাঙ্গী আর দুলকীর মধ্যে। মনিকে বুকে জাপটে ধরেও মাঝে মাঝে সান্ত্বনা খুঁজতো, কিন্তু কিসের যেন একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে অহঃরহ দগ্ধীভূত করে চলতো। রহমান তখন সব ত্যাগ করে নির্জনে গিয়ে বসতো, যাকে সে কোনো দিন পাবেনা, যাকে সে জনমের মত হারিয়েছে, তাকেই স্মরণ হতো বার বার করে।
রহমান শুধু নূরীকে ভালই বাসতোনা, নূরীর মঙ্গল কামনাই ছিলো তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য এবং সেই কারণেই নূরীকে সে এতো সহজে ত্যাগ করতে পেরেছিলো, নূরী যাকে চায় তাকেই সে সমর্পণ করেছিলো তার হৃদয়ের রাণীকে।
সেদিন সর্দারের হাতে নূরীকে সঁপে দিয়ে হাসিমুখে ফিরে এসেছিলো রহমান তার নিজের কুটিরে। অন্তর তার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলেও সান্ত্বনা ছিলো– নূরী তার কামনার জনকে আজ একান্ত আপন করে পেয়েছে। নূরীর নারী জীবন আজ ধন্য হয়েছে, সার্থক হয়েছে তার বাসনা।
রহমান ঈর্ষা করেনা সে চায় সর্দার এবং নূরীর মঙ্গল।
কিন্তু হৃদয়ের কোথায় যেন একটা কাটার খোঁচা অবিরত খচ খচ করে বিঁধছিলো, কোন কিছুতেই সে বেদনার উপশম হতো না।
রহমান যখন তার ক্লান্ত দেহটা শয্যায় মেলে দিতো, হাজার চেষ্টা করেও নরীর প্রতিচ্ছবিটিকে মন থেকে সরাতে পারতোনা। কিন্তু কেনো তার বার বার মনে পড়েছে ওর কথা, রহমান তো জানে– নূরী তাকে কোনো দিন ধরা দেয়নি দেবেও না। তবু–তবু ওর স্মৃতি কেনো তার জীবনের প্রতি ধাপে ধাপে আঁকা হয়ে রয়েছে। নূরী তাকে সব সময় উপেক্ষাই করে এসেছে, কোনোদিন এতোটুকু সহানুভূতি সে পায়নি ওর কাছে। তবু নূরীকে কেননা ভুলতে পারেনা–
রহমান সমস্ত চিন্তাকে মুছে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। যাবে সে আবার সেই আরাকান জঙ্গলে, যেখানে তার কল্পনার রাণী আর রাজা বিচরণ করে ফিরছে।
মনিকে বুড়ি-মার নিকটে পৌঁছে দিয়ে দুলকীর পাশে এসে দাঁড়ালো, ঠিক সেই মুহূর্তে তাজের উপর নজর পড়তেই চমকে উঠলো তাজ এলো কখন! আশ্চর্য হয়ে তাকালো রহমান তাজের দিকে। কিন্তু একি! তাজের চেহারা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে, কেমন যেন বিষণ্ণ মনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। দেহটা কেমন যেন ক্ষীণ-দুর্বল হয়ে গেছে ওর। তাজের দেহের দিকে তাকিয়ে রহমানের মন আশঙ্কায় দুলে উঠলো।
রহমান ক্ষিপ্র পদক্ষেপে তাজের পাশে এগিয়ে গেলো। তাজের পিঠে মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে বললো- তাজ, সর্দার কোথায়? কেমন আছে সে?
তাজ যেন রহমানের কথা বুঝতে পেরেছে, কিছু বলবার জন্য মাথাটা নীচু করে দোলালো। বাকশক্তিহীন জীব সে, রহমান তাজের কথা বুঝতে পারলোনা। কি করে বুঝবে তাজ কি বলতে চায় বা বলছে।
রহমান তাজের অবস্থা দেখে ভীষণ চিন্তিত হলো, তার সর্দার আর নূরী কোনো বিপদে পড়েনি তো! নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, না হলে তাজ এভাবে তার কাছে এসে দাঁড়াতো না। রহমান আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দুলকীর পিঠে উঠে বসলো।
তাজ বুঝতে পারলো, দুলকী ছুটতে শুরু করবার পূর্বে সে ছোটা আরম্ভ করলো।
তাজ উল্কা বেগে ছুটছে।
দুলকী অনুসরণ করছে তাকে।
তাজ সোজা আরাকান জঙ্গলে প্রবেশ করলো।
দুলকীর পিঠে রহমানও প্রবেশ করলো জঙ্গলে। তাজ গহন বন ভেদ করে অগ্রসর হচ্ছে। তাজ যেন দুলকীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।
কত ঝোপ-ঝাড় আর বন পেরিয়ে তাজ এসে দাঁড়ালো জঙ্গলের মধ্যে এক স্থানে।
একে গহন বন তার পর সন্ধ্যা চলে গেছে তখন, কাজেই বনভূমি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছেনা। রহমান দুলকীর পিঠে বসে তাকালো চারিদিকে। ঝাপসা অন্ধকারে দৃষ্টি তার বেশি দূর এগুলোনা। কিন্তু একটা উৎকট গন্ধে তার নাড়িভূড়ি বেরিয়ে আসতে চাইলো। মাংস পঁচা ভ্যাপসা গন্ধ।
তাজ আর দুলকীর পদশব্দে আশ-পাশ থেকে কতগুলি শিয়াল হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া করে ছুটে পালালো।
রহমান দুলকীর পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো এবার। অজানিত একটা আশঙ্কা তার বুকের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। গন্ধটা যেনো কোনো জীবের পঁচা দেহের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাজ কেমন যেন ছটফট করছে এই স্থানে এসে। রহমান নেমে আলগোছে অগ্রসর হলো, সন্ধ্যার অন্ধকার তখন বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।
খানিকটা অগ্রসর হতেই রহমান হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো। নরম কোনো বস্তুর সঙ্গে তার পা দু’খানা লেগে গিয়েছে।
রহমান এবার নাকে রুমাল চাপা না দিয়ে পারলো না। সে কি ভীষণ দুর্গন্ধ। উবু হয়ে রহমান বসে হাত দিয়ে অনুভব করতেই চমকে উঠলো, শিউরে উঠলো সে, একটা গলিত মৃতদেহ তার। পায়ের কাছে পড়ে আছে।
এতোক্ষণে রহমান বুঝতে পারলো যে উকট বিশ্রী গন্ধটাকে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সে গন্ধ অন্য কিছুর নয়, এই মৃতদেহের। রহমানের বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়লো, শিউরে উঠলো তার পা থেকে মাথা অবধি, তবে কি তার সর্দারের লাশ এটা?
রহমান দ্রুত হস্তে পকেট থেকে ম্যাচ বাক্স বের করে আলো জ্বালালো। ম্যাচের কাঠিটা তুলে ধরলো মৃতদেহের মুখে। যদিও মৃত দেহটা পচে ফুলে উঠেছে, তবুও রহমান আস্বস্ত হলো কারণ সর্দারের মৃতদেহ এটা নয়। সর্দারের সুন্দর চেহারা পঁচে গলে গেলেও এতো কুৎসিৎ হতে পারেনা।
রহমান ম্যাচের কাঠি পর পর জ্বালিয়ে লাশটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো, যখন তার মন থেকে সব সন্দেহ দূর হলো তখন উঠে দাঁড়ালো সে। অন্ধকারে ভালো করে লক্ষ্য করতেই রহমান। দেখলো আশে-পাশে আরও কয়েকটা লাশ ছড়িয়ে পড়ে আছে।
আবার রহমানের বুকের মধ্যে একটা আশঙ্কায় দোলা নাড়া দিয়ে গেলো তবে কি এখানেই তার সর্দারের– না, সে কথা ভাবতে পারেনা রহমান। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা করতে লাগলো তার সমস্ত অন্তর জুড়ে।
রহমান সাহসী যুবক ভয় কাকে বলে জানেনা, তবু আজ তার মনে একটা দুর্বলতা কম্পন জাগালো। হায় আজ তাকে সর্দারের শেষ পরিণতি স্বচক্ষে দেখতে হবে। কিন্তু দেখেও উপায় নেই, দেখতেই হবে কোথায় তার সর্দার।
ম্যাচের কাঠি জ্বেলে প্রত্যেকটা লাশ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো রহমান। সে বেশ বুঝতে পারলো, সম্ভবতঃ তার সর্দারের সঙ্গে এই নরপিশাচদের তুমুল যুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যেক লাশের দেহগুলির ক্ষত যদিও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা, তবু লাশগুলি দেখে ঐ রকমই মনে হচ্ছে। কোনো কোনো লাশের দেহ শিয়াল ভক্ষণ করে বিকৃত করে ফেলেছে। কোনোটার মুখ নেই, কারোটার বুকের মাংস, কোনো লাশের নাড়িভুড়ি ছড়িয়ে পড়ে আছে চারিদিকে।
এতো উৎকট বিশ্রী গন্ধে বেশিক্ষণ রহমান টিকতে পারলোনা। লাশগুলি বেশ দূরে এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে। রহমানের ম্যাচের কাঠিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রাতের মত তাকে কোথাও অপেক্ষা করতেই হবে, তারপর সন্ধান করতে হবে সর্দার আর নূরীর। কিন্তু এখানে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠেছে। পঁচা ভ্যাপসা গন্ধে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। রহমান তাজ আর দুলকীকে ডাকলো, তারপর বেশ কিছু দূরে একটা গাছের। নিকটে এসে দাঁড়ালো। এখানে গন্ধ লাগছেনা, বেশ সচ্ছ বাতাস অনুভব করলো রহমান। ভালভাবে লক্ষ্য করতেই দেখলো গাছটার অদূরে বয়ে চলেছে একটা ছোট্ট নদী বা ঝরনা হবে। ঝরনার ধারেই ছোট-বড় পাথরের টিলা। রহমান এতোক্ষণে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো। কারণ পঁচা উৎকট গন্ধে তার নাড়িভুড়ি যেন বেরিয়ে আসছিলো।
মনে দুর্ভাবনা নিয়ে রহমান রাত কাটানোর জন্য স্থান অন্বেষণ করতে লাগলো। গহন বন, চারিদিকে হিংস্র জন্তুর গর্জন, রক্তপিপাসু জানোয়ারের লোলুপ থাবা থেকে জীবনে বেঁচে থাকতে হলে তাকে গাছে উঠতে হবে।
অগ্যতা রহমান সামনে বৃক্ষে আরোহণ করাই সাব্যস্ত করে নিলো। তাজ আর দুলকী রইলো। নীচে। গাছের একটা চওড়া ডালে রহমান বসে পড়লো রাতের মত।
গাছটা খুব উঁচু হলেও বেশ ঝাকড়া ধরনের কাজেই কোন অসুবিধা হলোনা রহমানের। ডালের এমন এক স্থানে এসে বসলো রহমান যেখানে তার হেলান দিয়ে বসবার মতো জায়গা ছিলো।
গাছের ডালে বসে রহমান আশ্বস্ত হলেও চিন্তাশূন্য হলোনা, কারণ এখনও জানেনা সে তার সর্দার আর নূরী সুস্থ আছে কিনা। একটা উদ্ভব চিন্তাধারা তাকে অস্থির করে তুললো।
রাত যতই বেড়ে আসছে ততই গহন জঙ্গল বন্য জীবজন্তুর কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে। পঁচা লাশগুলো নিয়ে শিয়াল কুকুরের দল তীব্র মারামারি আর কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে। সে কি ভয়ঙ্কর হুলস্থুল কাণ্ড!
দুঃসাহসী রহমানের বুকটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর একটা দুর্বলতা তার মনকে বিচলিত করে তুলছিলো সেটা সর্দারের শেষ পরিণতি চিন্তা করে। না জানি এই সব মৃতদেহের মধ্যে দস্যু বনহুরের লাশও আছে কিনা।
রহমান দু’হাতে মাথার রগ টিপে ধরে, সর্দারের অমঙ্গল চিন্তা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলোনা। শুধু সর্দারের মৃত্যু চিন্তাই নয়, তার সঙ্গে ছিলো নূরী। না জানি নুরীর পরিণতি কি হয়েছে, সর্দারকে নিহত করে নূরীকে নিয়ে শয়তানের দল পালিয়ে যায়নি তো?
কে জানে, কে জবাব দেবে তার প্রশ্নের।
রহমান চিন্তা সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলো। তারপর কখন যে একটু তন্দ্রা এসেছে চোখে খেয়াল নেই তার। হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে গেলো রহমানের, কান পেতে শুনলো একটা কেমন যেন শব্দ ভেসে আসছে। কেউ যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বলে মনে হলো।
এখন বনটা বেশ নীরব বলে মনে হচ্ছে। পচা লাশগুলি নিয়ে এতোক্ষণ শিয়াল কুকুরের যে তীব্র কাড়াকাড়ি মারামারি চলছিলো এখন তারা সরে গেছে। মনে হয় ওদের ক্ষুধা নিবৃত্ত হওয়ায় অলস দেহটা নিয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করছে। কিন্তু এ কিসের শব্দ! রহমান কান পেতে শুনতে লাগলো, এযে কোন পুরুষ মানুষ ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ। তবে কি তার মনের ভ্রম? হয়তো তাই হবে এই নির্জন গহন বনে মানুষ এলো কোথা হতে।
রহমান অন্ধকারে ভাল করে তাকালো, কিন্তু কিছুই তার দৃষ্টি গোচর হলোনা। আকাশে অসংখ্য তারা জেগে থাকা সত্বেও গহন বনে এতোটুকু আলো প্রবেশে সক্ষম হচ্ছিলোনা। জমাট অন্ধকারে নিজের হাতখানাই রহমান দেখতে পাচ্ছিলো না। তবু সে মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলো।
বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কোনো পুরুষ হৃদয়ের তাপিত দীর্ঘশ্বাস।
কিছুক্ষণ শব্দটা শোনা গেলো তারপর মনে হলো সমস্ত বনভূমি নীরব হয়ে গেছে। শব্দটা। আর শোনা যাচ্ছে না।
*
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে রহমান, খেয়াল নেই বুঝতেও পারেনি সে। তাজের চি হি চি হি শব্দে নিদ্রা ছুটে গেলো তার। দড়বড় উঠে সোজা হয়ে বসতে গেলো, কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলো নিজকে, আর একটু হলেই হয়ছিলো আর কি। একেবারে গাছের নীচে পড়ে মাথাটা থেতলে চ্যাপটা হয়ে যেতো।
কোনো রকমে নিজকে বাঁচিয়ে নিয়ে তাকালো রহমান গাছটার নীচের দিকে। দিনের আলোয় চারিদিক ঝকমক করছে। রহমান সব দেখতে পেলো এবার। প্রথমেই রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তাজ। তাজ গাছের দিকে মাথা উঁচু করে উদ্ভূত শব্দ করছে- চি হি চি হি..
রহমান বুঝতে পারলো তাজ কিছু বলতে চায় বা বলছে। আর বিলম্ব না করে নীচে নেমে এলো সে তাজের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাজ রহমানের কাপড় কামড়ে ধরলো।
রহমান বললো– কি বলছিস তাজ?
তাজ মাথা নাড়লো এবং তাকে সামনের দিকে টানতে লাগলো।
রহমান লক্ষ্য করলো দুলকী অদূরে দাঁড়িয়ে আছে।
তাজের সঙ্গে রহমান এগিয়ে চললো, ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল পেরিয়ে তাজ চলেছে রহমান তাকে অনুসরণ করছে।
বেশ কিছুদূর অগ্রসর হতেই রহমান দেখলো বনটা এখানে অনেক পাতলা হয়ে এসেছে। সূর্যের আলো বনভূমি উজ্জ্বল করে তুলেছে। [ রহমান নিপুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চারিদিকে দেখতে লাগলো। সব দেখতে পাচ্ছে সে, কোথাও অন্ধকার নেই।
হঠাৎ রহমান বিস্ময়ে চমকে উঠলো, অদূরে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে তার সর্দার। রহমানের দৃষ্টি প্রথম নজরেই চিনতে পারলো, যদিও মাথাটা হাটুর মধ্যে খুঁজে বসেছিলো তবু চিনতে ভুল হলো না তার।
রহমান ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গেলো বনহুরের পাশে। অস্ফুট কণ্ঠে ডেকে উঠলো– সর্দার!
রহমানের কণ্ঠস্বর বনহুরের কানে পৌঁছলো কিনা কে জানে, যেমন বসেছিলো সে তেমনি হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে রইলো নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মত।
রহমান ব্যাকুল কণ্ঠে আবার ডাকলো- সর্দার–সর্দার– সর্দার…
ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালো বনহুর।
রহমানের দৃষ্টি বনহুরের মুখে পড়তেই তার বুকের মধ্যে ঝড়ের তান্ডব শুরু হলো, একি চেহারা হয়ে গেছে তার সর্দারের মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোখে উদাস চাহনি, চুলগুলো রুক্ষ। তৈলবিহীন। গায়ের জামা-কাপড়ের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে গেছে, মলিন ধূলোবালি মাখা। রহমানের দিকে তাকিয়ে বনহুর কোনো কথা বললোনা, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কেমন। যেন উদভ্রান্তের মতো।
রহমান আর নিজকে প্রকৃতিস্থ রাখতে সক্ষম হলোনা, আকুল কণ্ঠে বলে উঠলো–সর্দার, আপনার এ অবস্থা কেনো? নূরী কোথায় তাকে তো দেখছিনা?
বনহুর রহমানের মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, উদাস ব্যথা করুণ নয়নে তাকালো সম্মুখের দিকে। কিছু বলবার জন্য ঠোঁট দু’খানা যেন নড়ে উঠলো কিন্তু একটা শব্দও তার গলা দিয়ে বের হলোনা।
সর্দারের এ অবস্থা রহমানের হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছিলো। প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে আবার রহমান সর্দার, কি হয়েছে বলুন? বলুন সর্দার? আর নূরীই বা কোথায়?
বনহুর আবার নিজের চোখ দুটো রহমানের মুখে তুলে ধরলো। তারপর বললো সে — রহমান, যাকে তুমি আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলে তাকে আমি হারিয়েছি।
সর্দার নূরী…
হা! নূরী আর জীবিত নেই।
নূরী জীবিত নেই!
না।
সর্দার নূরীর কি হয়েছিলো? কি করে তার মৃত্যু হলো?
তাকে নর-পিশাচের দল তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে।
রহমান দুই হাতে বুকটা চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো
–উঃ
কিছুক্ষণ উভয়েই নীরব।
রহমানের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো তপ্ত অশ্রু।
নূরীকে সর্দারের হাতে সঁপে দিয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলো সে। যাক, নূরী যে সুখী হয়েছে তাতেই তার সান্ত্বনা। নূরীকে হারানোর ব্যথা তার হৃদয়ে আঘাত করলেও এমন নিদারুণভাবে দগ্ধীভূত হয়নি!
রহমান ডুকরে কেঁদে উঠলো- সর্দার নূরী নেই! তার মৃত্যু হয়েছে!
হাঁ, রহমান, তোমার গচ্ছিত ধন আমি হেফাযতে রাখতে পারিনি–বনহুর দুই হাতে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে লাগলো। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে উঠলো তার চোখে-মুখে।
রহমান এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না, মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো সে। মর্মে মর্মে অনুভব করলো– সর্দারের এ অবস্থা কেননা, কেননা আজ সে উদ্ভ্রান্তের মতো উদাস হয়েছে। নূরীকে কতখানি ভালোবাসতো সর্দার আজ তা সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করলো।
বেশ কিছু সময় নীরবতার মধ্যে কেটে গেলো বনহুর আর রহমানের।
রহমান ভেবে দেখলো এখন যদি সে নূরীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে তাহলে নূরী তো গেছেই, সর্দারকেও হারাবে। রহমান এবার ধৈর্যের বুক বেঁধে নিলো, নিজেকে শক্ত এবং সংযত করে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
এগিয়ে এলো সে বনহুরের পাশে অতি মিনতি ভরা করুণ কণ্ঠে বললো– সর্দার, সর্দার আপনার একি চেহারা হয়ে গেছে সর্দার?
বনহুর নীরব।
রহমান বলে চলে– খোদার ইংগিৎ ছাড়া কিছু হয় না। সর্দার নূরীকে আমরা হারিয়েছি সে তো তারই ইচ্ছা। তিনি যদি নূরীকে গ্রহণ করে সুখী হয়ে থাকেন তাতে আমাদের দুঃখ করে কোনো লাভ হবে না। তাকে ফিরে পাবার আর কোনো উপায় নেই।
এতোক্ষণে কথা বলে বনহুর রহমান, কিন্তু আমি যে নূরীর শেষ স্মৃতিগুলো কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। রহমান, কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না তাকে….।
সর্দার, তাই বলে আপনি জ্ঞানবান হয়ে এতো অবুঝ হলে চলবে কেমন করে। ধৈর্য ছাড়া কোনো উপায় নেই। সর্দার, এখন আপনি যদি এমনভাবে ভেঙে পড়েন তাহলে যারা হাজার হাজার অনাথ-আঁতুড়- দুঃস্থ পরিবার আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহর গুণছে, তাদের কি অবস্থা হবে, একবার ভেবে দেখুন দেখি! সর্দার, আপনার যে চেহারা দেখতে পাচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি এ ক’দিন কিছু মুখে দেননি।
বনহুর শুকনো ঠোঁট দু’খানা জিভ দিয়ে একবার চেটে নিলো। সত্যি সে ক্ষুধার্ত; আজ কদিন সম্পূর্ণ অনাহারে একমাত্র ঝরণার পানি পান করা ছাড়া কিছু মুখে দেয়নি।
রহমান আর একদণ্ড বিলম্ব না করে ছুটে চললো। জঙ্গলে বহু সুস্বাদু ফলের গাছ ছিলো। রহমান কিছু ফল সংগ্রহ করে ফিরে এলো বনহুরের পাশে।
বনহুরকে জোর করে কয়েকটা ফল খাইয়ে দিলো। তারপর বললো রহমান সর্দার, চলুন আরাকান শহরে, মনি তার বাপি আর মাম্মির জন্য ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে প্রতিক্ষা করছে।
বনহুর বললো– না, পারবোনা রহমান, মনির সম্মুখে আর ফিরে যেতে পারবোনা।
মনি যে আপনার জন্য কেঁদে কেটে আকুল হচ্ছে। সর্দার, মনির মুখের দিকে তাকিয়ে চলুন, চলুন সর্দার।
রহমান, কোন মুখে আমি ফিরে যাবো, মনি যখন তার মাম্মির জন্য আমাকে প্রশ্ন করবে কি জবাব দেবো আমি তার? বলো, বলো রহমান, কি জবাব দেবো আমি তার? বনহুরের কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।
রহমান অস্কুট ধ্বনি করে উঠলো– সর্দার?
আমি পারবোনা আর মনির সামনে যেতে। তুমি আমাকে অনুরোধ করোনা বন্ধু।
সর্দার। সর্দার….।
জানি তুমি আমার অন্তরের ব্যথা নিজের অন্তর দিয়ে অনুভব করছো। রহমান, তুমি শুধু আমার সহকারী নও তুমি আমার বন্ধু। তোমার কাছে বলতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি ছোট বেলায় নূরীকে পেয়েছিলাম, যখন আমি জানতাম না জীবন কি জিনিস। প্রথম নূরীকে আমি দেখেছিলাম খেলার সাথী হিসেবে, তারপর ওর মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার পুরুষ জীবনের প্রথম আশ্বাস-ভালবাসা। আমি ওকে ভালবেসেছিলাম শুধু সাথী হিসেবে নয়–সঙ্গিনী হিসেবে। নূরীই আমার জীবনে বপন করেছিলো প্রথম ভালবাসার বীজ। আমি অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলাম তার সেই পবিত্র ভালবাসা। কিন্তু কি বলবো তোমাকে রহমান, আমি শুধু তার কাছে গ্রহণই করে গেছি প্রতিদানে তাকে কিছুই দেইনি। তবু সে কোনোদিন আমার উপর রাগ অভিমান করেনি…. আবার কণ্ঠ ধরে আসে বনহুরের, চোখ দুটো অশ্রু ছল ছল হয়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজকে প্রকৃতিস্থ করে নেয়, তারপর আবার বলে সে–রহমান, তুমি সবই জানো, তোমাকে নতুন করে আমার বলতে হবেনা। নূরীকে আমি কোনোদিন সুখী করতে পারিনি, আমি। বড় পিশাচ, বড় নরাধম।
রহমান বলে উঠে এবার–সর্দার, নূরী যা চেয়েছিলো–পেয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তার বাসনা পূর্ণ হয়েছে। নূরী জীবনে চেয়েছিলো তার বনহুরকে স্বামীরূপে পাবে, সে আশা তার বিফল হয়নি। নূরী অসুখী হয়ে মৃত্যুবরণ করেনি সর্দার।
রহমান!
হাঁ সর্দার!
কিছুক্ষণ আবার নীরবে কাটে তাদের।
রহমান বলে– সর্দার, ভেবে আর কি হবে, মনির কাছে না যেতে চান আমি আরাকানে ভিন্ন একটি বাড়ি আপনার জন্য ব্যবস্থা করবো।
তা হয় না।
তাহলে কি করবেন সর্দার?
দূরে অনেক দূরে কোনো দেশে চলে যাবো।
আর আমাদের আস্তানা আর দলবল?
তুমি ফিরে গিয়ে সব দায়িত্বভার গ্রহণ করো রহমান।
সর্দার, আমাকে মাফ করবেন।
তাহলে তুমিও যেওনা, যেখানে নূরী নেই সেখানে গিয়ে আর কি হবে।
সর্দার, আপনি পাগল হয়ে যাবেন।
হাঁ, নূরী আমাকে পাগল করে দিয়ে গেছে। আমি ভাবতে পারছি না নূরীর মৃত্যু হয়েছে। রহমান, সত্যিই কি নূরীকে আমি জন্মের মত হারিয়েছি?
রহমান কোনো জবাব দেয় না, দিতে পারেনা।
রহমান তখন জবাব দিতে না পারলেও বনহুরকে আর বনে ছেড়ে আসতে পারলোনা, তাকে নিয়ে এলো সঙ্গে আরাকান শহরে।
রহমান বোঝালো বনহুরকে আপনার আরাকানে বহু কাজ আছে, আপনি যদি এ ভাবে উদভ্রান্তের মতো হয়ে পড়েন তাহলে নূরীর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। সর্দার, যেমন করে হোক নূরীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতেই হবে।
বনহুর নূরীর শোকে এতো মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলো যে নূরীর হত্যাকারীকে সায়েস্তা করার কথা কোনো সময় তার মনে উদয়ই হয়নি। রহমানের কথায় বনহুরের চোখ দু’টো ধক ধক্ করে জ্বলে উঠে। একটা প্রতিহিংসার বহ্নিজ্বালা ফুটে উঠে তার মুখে।
রহমান একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বনহুরকে সেই বাড়িতে এনে রাখলো। তার খাওয়া দাওয়া বা অন্যান্য কোনো অসুবিধা যাতে না হয় সে জন্য রহমান সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিলো।
বাড়িখানা শহরের নির্জন প্রান্তে, মস্ত বড় বাড়ি অথচ বাড়ী খানায় কোন লোকজন নেই। উপরের তলাটাই রহমান তার সর্দারের জন্য ভাড়া নিয়েছে, আর নীচে থাকে বাড়ির মালিক আর তার কন্যা।
বাড়ির মালিক আরাকানবাসী ধনি ব্যবসায়ী মিঃ লারলং যৌথ, প্রচুর ঐশ্বর্যের অধিকারী তিনি। তার কন্যার নাম মিস এলিনা যৌথ। মিস এলিনা আলটা-মডার্ণ সুন্দরী যুবতী। সব সময়। ক্লাব-ফাংশান আর পার্টি নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। পিতা বয়স্ক হলেও বৃদ্ধ নয়, যৌবন ছাড়ি-ছাড়ি করলেও সম্পূর্ণ ছেড়ে যায়নি এখনও। সারাদিন বাড়ির মধ্যেই কাটান মিঃ লারলং যৌথ, বিশেষ দরকার ছাড়া বাইরে যান না। তেমন করে কারো সঙ্গে মেশেন না ভদ্রলোক।
বনহুর এহেন বাড়িওয়ালার ভাড়াটে হিসাবে আশ্রয় পেলো সেই বাড়িতে।
রহমানের পরিচয় প্রথম মি: লারলং যৌথের সঙ্গে নয়, মিস এলিনার সঙ্গেই তার প্রথম পরিচয় ঘটে। একদিন দুর্যোগপূর্ণ রাতে মিস এলিনা কোনো এক পার্টি থেকে বাড়ি ফিরবার পথে গাড়ির অম্বেষণে অস্থির হয়ে উঠেছিলো। পথে কোনো যানবাহনই ছিলোনা সেদিন। একা একা মিস এলিনা বিপদে পড়ে গিয়েছিলো প্রায় এমন সময় রহমান তার টাঙ্গীখানা নিয়ে বাড়ী ফিরছিলো।
দূরে কোনো আরোহীকে পৌঁছে দিয়ে ফিরতে তার বিলম্ব হয়ে গিয়েছিলো অনেক।
হঠাৎ রহমান পথের ধারে একটি যুবতীকে দেখে গাড়ি রেখে বলেছিলো–আপনি এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবেন? যদি মনে কিছু না করেন তবে আসুন আপনাকে গন্তব্যস্থানে পৌঁছেদি।
যুবতী রহমানের কথায় যেন অন্ধকারে আলোর সন্ধান পেলো। রহমান তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিয়েছিলো সেদিন তাকে তার বাড়িতে।
সেদিনের পর থেকেই পরিচয় রহমানের সঙ্গে মিস এলিনার। শুধু তাই নয় মিঃ যৌথও রহমানকে স্নেহের চোখে দেখেন। রহমান প্রায়ই এ বাড়িতে টাঙ্গী নিয়ে বেড়াতে আসতো, বিশেষ করে মিস এলিনার অনুরোধেই আসতো সে। রহমানের টাঙ্গীতে বৈকালিক ভ্রমণটা সেরে নিতো মিস এলিনা।
রহমান এই বিদেশ-বিভুয়ে এমন একটা সহৃদয় সঙ্গী পেয়ে আনন্দ বোধ করতো। মিস এলিনার চাল-চলন ওকে মুগ্ধ করতো, ভাল লাগতো ওর কাছে। শুধু তাই নয় মিঃ যৌথের আচার ব্যবহারও রহমানের মনকে আকৃষ্ট করেছিলো। রহমান টাঙ্গী চালক হলেও তাকে মিঃ যৌথ পরম আত্নীয়ের মতোই মনে করতেন। কারণ তার একমাত্র কন্যা মিস এলিনাকে দুর্যোগপূর্ণ রাতে গাড়িতে করে নির্বিঘ্নে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া কম কথা নয়।
রহমানকে সেদিন মিঃ যৌথ বহু অর্থ দিতে গিয়েছিলেন-কন্যার জীবন রক্ষার বিনিময়ে। কিন্তু রহমান একটি পয়সাও নেয় নি।
এক টাঙ্গীচালকের মহৎ হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে মিঃ লারলং যৌথ চমৎকৃত হয়েছিলেন। তাকে আবার আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
সেই পরিচয়ে রহমান আজ এতো সুন্দর বাড়িখানা তার সর্দারের জন্য ভাড়ায় পেয়েছে। বাড়িখানা সত্যি সুন্দর এবং মনোরম। যদিও শহরের একপ্রান্তে এ বাড়িটা তবু অত্যন্ত মডার্ণ ধরনের তৈরী।
রহমান সর্দারের সুখ-সুবিধার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব ব্যবস্থাই করে দিয়েছিলো এখানে। যাতে করে সর্দারের মনে আবার শান্তি ফিরে আসে, আবার সে স্বাভাবিক হতে পারে।
কিন্তু রহমানের এতো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো।
বনহুর কিছুতেই এ বাড়িতে এসেও স্বস্তি পাচ্ছিলো না। একটা বিষণ্ণতা ভাব তাকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। সব সময় কক্ষমধ্যে নীরবে বসে বসে ভাবতো। রহমানের অনুরোধে অবশ্য নিজের বেশ-ভূষা পাল্টে পরিচ্ছন্ন হতে বাধ্য হয়েছিলো সে।
রহমান মিঃ লারলং যৌথের কাছে বনহুরের পরিচয় দিয়েছিলো কান্দাই এর রাজকুমার বলে। কাজেই বনহুরকে রাজকুমারের মতো করেই সাজিয়ে নিয়েছিলো রহমান।
রাজকুমারের বেশে বনহুরকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো। যদিও ক’দিনের অনিয়মে তার শরীর আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তবুও মূল্যবান বেশ-ভূষায় অপূর্ব মানিয়েছিলো তাকে।
মিঃ যৌথ এবং তার কন্যা মিস এলিনা বনহুরের সৌন্দর্যে প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে গেলো। যদিও বনহুর তাদের সঙ্গে তেমন কোনো কথা-বার্তা বা আলাপ-আলোচনা করলোনা তবুও মিস এলিনার বড় ভাল লাগলো তাকে।
মিঃ যৌথ এবং মিস এলিনা রাজকুমার বেশি দস্যু বনহুরকে অত্যন্ত ভালভাবে আদর আপ্যায়ন করলো।
কিন্তু এতো করেও রহমান নিশ্চিন্ত হলো না। কিছুতেই সর্দারকে সচ্ছমনা করতে পারলো না সে। যখনই রহমান এ বাড়িতে আসতো তখনই দেখতো, বনহুর তার হলঘরে বসে আপন মনে গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করছে। কোনো সময় এসে দেখতো, বিছানায় বালিশটা আঁকড়ে ধরে উবু হয়ে পড়ে আছে, চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠেছে বালিশটা।
সর্দারের এ অবস্থা রহমানের হৃদয়ে আঘাত করতো। কেমন করে তার মনে আনন্দ আনবে, কেমন করে আবার তার সর্দার পূর্বের মত স্বাভাবিক হবে–এই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছিলো রহমান।
নিজের কুঠিরে ফিরে গেলে মনির করুণ মুখ আর এখানে এলে সর্দারের ব্যথা কাতর চাহনী, রহমান যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। নূরীর শোকে সে নিজেই কাতর কিন্তু শোক করবার মতো অবসর কই তার। মনের সব ব্যথা পাথর চাপা দিয়ে রহমান দু’দিক রক্ষা করার চেষ্টা করে। বাড়ি ফিরে আসতেই ছুটে আসে মনি, জাপটে ধরে রহমানকে আমার মাম্মি এলোনা কাকু? আমার বাপি কখন আসবে?
রহমান অতিকষ্টে নিজকে সংযত রেখে বলে–বাবা তুমি কিচ্ছু ভেবোনা। তোমার বাপি আর মাম্মি খুব ভালো জায়গায় আছে। সময় হলেই চলে আসবে তারা।
তবে আমাকে নিয়ে চলো কাকু, আমার মাম্মির কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কত দিন আমার মাম্মিকে দেখিনা।
হাঁ যেও, যেও মনি, কিন্তু সে যে অনেক অনেক দূরের পথ।
আমি সেখানেই যাবো। আমার মাম্মিকে ছাড়া আমি যে আর থাকতে পারছি না কাকু। কত দিন আমি মাম্মিকে দেখিনি।
রহমান অতিকষ্টে এতোক্ষণ নিজকে সংযত রেখেছিলো, কিন্তু পারেনা, মনিকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় সে; যাবার সময় বলে যায়–মনি তুমি থাকো, আমাকে এক্ষুনি টাঙ্গী নিয়ে বাইরে যেতে হচ্ছে।
মনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
রহমান ততোক্ষণে বেরিয়ে গেছে বাইরে।
মনি ছুটে যায় বারেন্দায়, কিন্তু রহমান তখন টাঙ্গী নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে।
*
সোজা রহমান তার সর্দারের বাড়ী গিয়ে হাজির হলো। টাঙ্গী গাড়ি বারেন্দায় রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে।
বনহুর তখন রেলিং এ ভর দিয়ে তাকিয়ে আছে নির্জন প্রান্তরের দিকে। বাড়িখানার পিছনে আর কোনো লোকালয় ছিলো না, শুধু বিস্তৃত প্রান্তর।
বনহুর আজকাল প্রায়ই এই রেলিং এর পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো। সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলতো সে, কখন দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতো খেয়াল থাকতো না তার।
আজও বনহুর এই রেলিং এর পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটের পর সিগারেট পান করছিলো। সম্মুখস্থ ধুম্রকুন্ডলির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো কত কথা। আজ বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি মুখ, সে মুখখানা আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা, চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে কোনো অতল গহবরে।
সর্দার…
রহমানের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে বনহুর।
কিন্তু ফিরে তাকায় না সে, যেমন দাঁড়িয়েছিলো তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে।
রহমান আবার ডাকে–সর্দার!
বনহুর ফিরে তাকিয়েই জবাব দেয়–বলো?
রহমান ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে, বলে সে–সর্দার, মনিকে যে আর রাখতে পারছি না।
এবার বনহুর তাকালো রহমানের মুখের দিকে, হাতের অর্ধদগ্ধ সিগারেটখানা দূরে নিক্ষেপ করে বললো-কি হয়েছে রহমান?
মনি বাপি আর মাম্মি মাম্মি করে অস্থির হয়ে পড়েছে। সব সময় আমাকে সে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। কি করি বলুন, বলুন সর্দার?
বনহুর গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করলো, তারপর বললো–রহমান, মনিকে কান্দাই নিয়ে ওর। মায়ের কাছে পৌঁছে দাও।
কিন্তু মনি কি এখন তার মাকে চিনতে পারবে?
রহমান, রক্তের যেখানে সম্বন্ধ সেখানে চেনা-অচেনার প্রশ্ন উঠে না। মা সন্তানকে চিনে নিতে অসুবিধা হবেনা। একদিন যাকে খুশি করার জন্য ওকে চুরি করে এনেছিলাম সে আজ নেই কাজেই তাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো।
সর্দার! আর আপনি?
আমি আর ফিরে যাবো না রহমান। এ মন নিয়ে আমি মনিরার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবোনা।
সর্দার, বৌ-রাণী যদি আপনার কথা জিজ্ঞাসা করেন?
তাকে বলো–আমি ভালো আছি।
তাতেই কি বৌ-রাণী খুশী হবেন?
তুমি যা ভালো বোঝো তাকে বুঝিয়ে বলো। যাও যাও রহমান, আমি আর ভাবতে পারছি না কিছু।
সর্দার, আপনাকে এ অবস্থায় ফেলে আমি কান্দাই এ ফিরে যাবো কি করে? আমি এসে আপনাকে জোর করে খাইয়ে দি তবে খান, আমি এসে আপনাকে গোসলের জন্য তাগাদা করি, তবে গোসল করেন। সর্দার, আপনাকে এ অবস্থায় ফেলে আমি যেতে পারবোনা।
তাহলে মনিকে হারাবে। মনির মনের অবস্থা সচ্ছ নয়, তাকে শীঘ্র তার মায়ের কাছে পৌঁছে না দিলে হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
বেশ, আমি যাবো, মনিকে নিয়ে যাবো বৌ-রাণীর কাছে। কিন্তু কয়েক দিনের জন্য আমাকে এখানে থেকে যেতে হবে।
বেশি বিলম্বে খারাপ হতে পারে।
আমি মনিকে ক’দিনের জন্য সামলে নেবো।
যা ভাল মনে করো।
বনহুর নিজের কক্ষে চলে যায়।
রহমান বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসতেই দূরে বাগান মধ্যে দেখতে পায়, মিস এলিনা ফুল গাছে পানি দিচ্ছে।
এলিনার ছোটবেলা হতেই এ অভ্যাস, ফুল গাছের যত্ন করা তার বড় সখ। বাগানে যথেষ্ট মালি থাকা সত্বেও এলিনা এ কাজ নিজ হাতে করতো।
আজও এলিনা প্রতিদিনের মতো বাগানে পানি দিচ্ছিলো।
রহমান সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো এলিনার দিকে। রহমান তাকে দেখতে পেলেও এলিনা রহমানকে দেখতে পায়নি। সে আপন মনে পানি দিচ্ছিলো।
রহমান নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকালো এলিনার দিকে, সত্যি এলিনা অপূর্ব সুন্দরী। নারী-দেহে যতটুকু সৌন্দর্যের প্রয়োজন সব আছে এলিনার মধ্যে। আজ রহমান এলিনার রূপ লাবণ্য আবিষ্কার করলো নতুন দৃষ্টি নিয়ে। রহমান ধীর পদক্ষেপে এলিনার পিছনে এসে দাঁড়ালো দিদিমনি!
ফিরে তাকালো কে, রহমান মিয়া!
জ্বি হা।
রহমান এলিনাকে দিদিমনি বলে ডাকতো। এলিনা, ওকে নাম ধরে বলতো। এলিনা রহমানকে ভালো নজরে দেখতো।
রহমানকে দেখে হেসে বললো এলিনা খবর কি রহমান মিয়া, তোমার রাজকুমার কেমন আছেন?
রহমান মুখ গম্ভীর করে বললো–রাজকুমারের খবর ভালো নয় দিদিমনি।
কেনো? কিসের অভাব তোমার রাজকুমারের?
একটা কথা আপনাকে বলবো দিদিমনি, যদি আপনি আমাকে ভরসা দেন?
রহমানের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হাসে এলিনা, বলে সে এমন কি কথা রহমান মিয়া যা বলতে তোমার ভরসার দরকার?
একটু চিন্তা করে বলে আবার রহমান আমার রাজকুমারের জীবন নিয়ে কথা দিদিমনি। আপনি যদি আমাকে ভরসা দেন তাহলে আপনাকে বলবো কথাটা।
রহমানের কথায় এলিনা চিন্তা করলো, তারপর বললো–বেশ, তোমাকে ভরসা দিচ্ছি, আমাকে বললে তোমার রাজকুমারের যদি কোনো উপকার হয় তা হলে বলো।
আপনাকে নিভৃতে বলবো।
বেশ চলো।
এলিনা এগিয়ে যায় বাগানের নির্জন স্থানে। রহমানের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে এবার, হাসিভরা মুখে বলে–বল রহমান মিয়া, কি বলতে চাও তুমি?
রহমান যত সহজে বলবে ভেবেছিলো তত সহজে বলা তার হলোনা। যার সম্বন্ধে বলবে তার বিষয়ে ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সর্দারের স্বভাব তার অজ্ঞাত নয়। তবু সে পুরুষ মানুষ এখন তার যে মনের অবস্থা তাতে একমাত্র নারীই পারবে তার মনের পরিবর্তন আনতে। তাছাড়া সর্দারকে আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কেউ পারবেনা।
রহমানকে নত মস্তকে ভাবতে দেখে মিস এলিনা বললো–কি ভাবছো রহমান মিয়া?
কথা দেন দিদিমনি, আমার কথা আপনি রাখবেন?
বলো, রাখবো!
আমার রাজকুমারের মনে একটা দারুণ ক্ষত হয়েছে। সে ক্ষতের কোনো ঔষধ আমি আবিষ্কার করতে পারছি না, যে ঔষধে তিনি আরোগ্যলাভ করতে পারেন।
এলিনা অবাক হয়ে বললো–তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না রহমান মিয়া? আমি সব বুঝিয়ে বলছি দিদিমনি। বেশ বলো?
দিদিমনি, যদিও আপনার সঙ্গে আমার বেশি দিনের পরিচয় নয়, তবু আপনার অন্তরের যে পরিচয় আমি পেয়েছি তা আমার মনে এনেছে একটি আশার বাণী। আমার রাজকুমার তার প্রিয়জনকে হারিয়েছে। তাকে হারিয়ে সে আজ উদ্ভ্রান্ত উদাসীন এমনকি নিজের নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন। দিদিমনি, আপনি নারী দয়া-মায়া-মমতায় আপনার হৃদয় পরিপূর্ণ। আমার মালিককে আপনি সুস্থ করে দিন দিদিমনি, আপনিই পারবেন তার মনকে সচ্ছ-স্বাভাবিক করতে। তার বিনিময়ে যা চান তাই আমি দেবো আপনাকে।
হঠাৎ এলিনার মুখভাব ভাবাপন্ন হয়ে পড়লো। মনে পড়লো পর পর কয়েকটা ঘটনার কথা। প্রথম যেদিন রাজকুমারের সঙ্গে তার পরিচয় হলো সেদিন সে লক্ষ্য করেছে রাজকুমার একটি বারের জন্যও তার মুখের দিকে তাকায়নি। রাজকুমারের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হয়েছিলো বটে কিন্তু খুশি হয়নি তার ব্যবহারে। এরপর আরও কয়েকদিন এলিনা রাজকুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ আশায় উনুখ হয়ে এগিয়ে গেছে সিঁড়ি বেয়ে উপরে, কিন্তু বিফল হয়ে ফিরে এসেছে। দারওয়ান বলেছে, কুমার বাহাদুর এখন দেখা করতে পারবেন না! কোনোদিন বা বলেছে, তার শরীর ভাল নেই। আবার গেছে এলিনা তবু মনের আকর্ষণে, কিন্তু কোনোদিন তার সাক্ষাৎ লাভ ঘটেনি তার ভাগ্যে। আজ মিস এলিনা বুঝতে পারলো কেনো রাজকুমার তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে। রাজকুমারের মনের অবস্থা তাহলে স্বাভাবিক নেই এবং সেই কারণেই সে সাক্ষাৎ আশায় গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। এলিনা মডার্ণ যুবতী কেমন করে পুরুষ মানুষকে মুগ্ধ করতে হয় জানে সে। তবে এলিনা সত্যিকারের কুৎসিত্মনা বা অসৎচরিত্র মেয়ে নয়। সে ক্লাব, ফাংশন বা পার্টিতে নিয়মিত যোগ দিলেও নিজের ইজ্জৎ সম্বন্ধে সব সময় সচেতন ছিলো। বয়স এলিনার। কম নয়, নিজের ভালোমন্দ বুঝবার মতো জ্ঞানও তার হয়েছিলো। কাজেই বহু পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে মিলামিশা করলেও এলিনা আজও কাউকে মন দিয়ে গ্রহণ করেনি বা করতে পারেনি। সেদিন রহমান মিয়া যখন রাজকুমারের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলো তখন কেননা যেন এলিনা নিজকে হারিয়ে ফেলেছিলো, বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে।
এলিনার বড় ভালো লেগেছিলো রাজকুমারকে, এতো দিনে মনের মতো একটি পুরুষ যেন সে খুঁজে পেলো। একটা অভূতপূর্ব আনন্দে হৃদয়মন নেচে উঠেছিলো তার। কিন্তু অল্পক্ষণেই মনের ভ্রম ভেঙে গিয়েছিলো; রাজকুমার তার অপরূপ সৌন্দর্যে, আলটা মডার্ণ সাজসজ্জায় এতোটুকু আকর্ষিত হয়নি। একবার তার দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি সে!
সেদিনের কথা মনে হতেই এলিনার হৃদয় ক্রোধান্ধ হয়ে উঠে। আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ তাকে উপেক্ষা করতে পারেনি, সবাই তার এতোটুকু আন্তরিকতা লাভের জন্য সর্বদা লালায়িত। থাকতো। আর এই রাজকুমার তার সৌন্দর্যের অবমাননা করলো। ঐ রাতে একটি বারের জন্য ঘুমাতে পারেনি এলিনা, সর্বদা রাজকুমারের ঔদাসিন্যতা মনকে উদভ্রান্ত করে তুলেছিলো। আজ এলিনা বুঝতে পারলো রাজকুমারের সে অপরাধ ইচ্ছাকৃত নয়, তার মনের দাহ তাকে চেতনালুপ্ত করে ফেলেছে। রহমানের কথায় আজ তার মন সচ্ছ হয়ে এলো। বললো এলিনা রহমান মিয়া, তোমার রাজকুমার সম্বন্ধে আমি ভেবে দেখবো। ‘
হাত দুখানা জোর করে রহমান দিদিমনি, দয়া করে এই উপকারটুকু করুন, করুন দিদিমনি। আমি আপনার কাছে চির উপকৃত থাকবো…
বেশ, কথা দিলাম আমি চেষ্টা করে দেখবো, কিন্তু রহমান মিয়া, তোমার রাজকুমার অদ্ভুত মানুষ।
দিদিমনি, তিনি অদ্ভুত মানুষ বলেই তো আপনার শরণাপন্ন হচ্ছি। আমি পারলামনা তাকে সামলে নিতে। পারলামনা স্বাভাবিক করে আনতে। আপনি নারী, আপনাদের মধ্যে এমন একটা গুণ আছে যা মরু হৃদয়ে বারিবর্ষণ করে। তাপিত হৃদয়ে আনে অনাবিল শান্তিধারা। দিদিমনি, আমি কাল আরাকান ছেড়ে চলে যাচ্ছি, ফিরতে কিছুদিন বিলম্ব হবে।
ওঃ এই কথা! এবার বুঝতে পেরেছি রাজকুমারকে একা ফেলে মন তোমার যেতে চাইছেনা। বলো সত্যি কি না?
হাঁ দিদিমনি, আপনি যা বলেছেন। রহমান এলিনার সঙ্গে ঠিক টাঙ্গীচালক বা একটি সাধারণ চাকরের মতো কথাবার্তা বলছিলো। সে যে একজন বিশ্ববিখ্যাত দস্যুর বিশ্বস্ত অনুচর এরকম কোনো নিদর্শনই ছিলোনা তার মধ্যে। নিজকে নিপুণভাবে টাঙ্গীচালক হিসেবে বানিয়ে নিয়েছিলো রহমান।
এলিনা বুঝতে পারে, ভৃত্য হলেও রহমান মিয়া রাজকুমারের একজন অনুগত হিতাকাঙ্খী। রাজকুমারের প্রতি তার অত্যন্ত হৃদ্যতা লক্ষ্য করে এলিনা খুশি হলো, বললো সে তোমার কথামতো আমি…
কথামতো নয় দিদিমনি, কথা দিন, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে দেশে যেতে পারি।
এতোবড় দায়িত্বভার আমি গ্রহণ করতে পারবো তো?
দিদিমনি, আপনিই এখন আমার ভরসা। কথাটা বলে রহমান নিজেই যেন আতঙ্কে শিউরে উঠলো। সর্দার সম্বন্ধে সে কি করে এতো বড় একটা অবান্তর ভাবধারা কল্পনায় আনতে পারলো! কিন্তু পরক্ষণেই মনকে সুস্থ করে নিলো রহমান, কারণ এখন যে অবস্থায় তার সর্দার উপনীত হয়েছে তাতে সূক্ষ্ণ বিবেচনা করে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। যেমন করে হোক, যেমন ভাবে হোক। সর্দারকে স্বাভাবিক করে নিতে হবে। যে ঔষধে কাজ করে তাই প্রয়োগ করতে হবে তার উপর। বললো রহমান পারবেন আপনি। আপনারা নারী জাতি, মায়ের জাত। আপনারাই পারবেন পথহারাকে পথ দেখাতে…একটু থেমে বললো রহমান আবার ফিরে এসে যেন মালিককে তার স্বাভাবিক জীবনে দেখতে পাই।
রহমান কথা শেষ করে যেমন এসেছিলো তেমনি সরে যায় সতর্কতার সঙ্গে।
মিস এলিনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করে। টাঙ্গীচালক রহমান মিয়া যা বলে গেলো তা অতি আনন্দপূর্ণ বাক্য। রাজকুমার তা হলে তার প্রিয়জন মানে তার স্ত্রীকে হারিয়েছে। একটা খুশি দোলা দিয়ে গেলো এলিনার হৃদয়ে। তবু যা হোক রাজকুমার আজ একা। ওকে আপন করে নিতে কতক্ষণ!
মিস এলিনা বাগান থেকে এক থোকা গন্ধরাজ ফুল হাতে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এগিয়ে চললো।
সিঁড়ির মুখে পৌঁছতেই দারওয়ান জানালো–রাজা বাহাদুর এখন তাঁর বিশ্রামকক্ষে আছেন।
এলিনা তার কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে গেলো রাজ বাহাদুরের সঙ্গে আমার জরুরী দরকার আছে।
আরও কয়েকজন আপত্তি জানালো, এখন রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হবে না।
কিন্তু আজ এলিনা কারো কথা মানলো না।
গন্ধরাজের থোকাটা হাতে নিয়ে সোজা এগিয়ে গেলো এলিনা বনহুরের বিশ্রাম কক্ষে।
বনহুর তার দারোয়ান-বয়-বাবুচী সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছিলো, কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তারা যেন রাজি না হয়, কারণ তার শরীর অসুস্থ!
একমাত্র রহমানই এখানে আসতো যেতো নিজ ইচ্ছামত, তাছাড়া একটি প্রাণী এ বাড়িতে প্রবেশে সক্ষম হতোনা। বনহুর তাই আপন মনে শুধু নূরীর কথাই ভাবতো, আর যেন কোনো চিন্তাই ছিলোনা তার।
মিস এলিনা আজ কারো বাধা না মেনে সোজা বনহুরের বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করলো।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থমকে দাঁড়ালো এলিনা।
বনহুর তখন একা একা মেঝেতে পায়চারী করছে। পদশব্দে ফিরে তাকালো বনহুর, এলিনাকে তার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে অবাক হয়ে তাকালো।
এলিনা হাস্য উজ্জ্বল মুখে বললো–বড় একা একা লাগছিলো তাই একটু গল্পসল্প করতে এলাম। নিশ্চয়ই আপনি অসন্তুষ্ট হননি?
বনহুর ভূকুঞ্চিত করে বললো–না। বসুন।
এলিনা গন্ধরাজের থোকাটা হাতের মুঠায় নাড়াচাড়া করতে করতে বসে পড়লো সোফায়, তারপর একটু হেসে বললো–তবু যা হোক কথা বলতে পারেন। আমি কিন্তু আপনাকে বোবা মনে করেছিলাম।
এলিনার বিদ্রূপ ভরা কথা বনহুরের কাছে অসহ্য মনে হলো। আজ তার মনের অবস্থা পূর্বের ন্যায় থাকলে এ কথাগুলো তাকে একটুও বিরক্ত করতো না। আজ এলিনার কথায় চট করে কোনো জবাব দিতে পারলো না বনহুর। যেমন নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলো তেমনি রইলো।
এলিনা গন্ধরাজের থোকাটা টেবিলে রেখে বললো–আপনি বিরক্তি বোধ করলে, চলে যাই। কেমন?
এবার বনহুর চোখ তুললো।
এলিনার সঙ্গে চোখাচোখি হলো বনহুরের।
এলিনা সে দৃষ্টির কাছের একমুহূর্ত আর টিকতে পারলো না, ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। তারপর দ্রুত পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো, নিজের ঘরে গিয়ে মুক্ত জানালার পাশে। দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। রাজকুমারের কক্ষে কেননা গিয়েছিলো, কিসের লোভে গিয়েছিলো সে ওখানে। পরপর কয়েকদিন রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বিফল হয়েও কি তার শিক্ষা হয়নি? এতো অপমানের পর আবার কেনো গেলো সে তার সম্মুখে? জীবনে এলিনা বহু পুরুষের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু তাকে কেউ এমনভাবে উপেক্ষা করেনি কোনোদিন। রাজকুমার যত ঐশ্বর্যের মালিকই হন না কেনো, তাদেরই বা কম কোথায়? তার বাবা মিঃ লারলং কোটিপতি, আরাকান শহরে বাড়ি-গাড়ি-ঐশ্বর্যের অভাব নেই। আর তার নিজের নারী জীবনেরই কোনোদিকে কম আছে! তার যৌবন-সৌন্দর্য যে কোনো পুরুষের কামনার বস্তু। কত পুরুষ তার সৌন্দর্যের ভিখারী হয়ে পিছনে পিছনে ছায়ার মত ঘুরে বেড়ায়, আর কোথাকার কে রাজকুমার। কত রাজা মহারাজা পর্যন্ত তার পাণিপ্রার্থী হয়ে তার পিতার নিকটে এসেছে। এলিনা কাউকে স্বামীত্বের অধিকার দেয়নি।
এলিনার মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হলো, রহমান মিয়ার কথাতেই তো সে গিয়েছিলো। সেখানে। না হলে সে কিছুতেই যেতোনা। রাজকুমার তাকে তাড়িয়ে না দিলেও তার চোখেমুখে দেখতে পেয়েছিলো এলিনা একটা উপেক্ষার ভাব। সে সহ্য করতে পারেনি রাজকুমারের সে চাহনী।
*
এলিনা তখন যতই রাগান্বিত বা ক্রোধান্ধ হয়ে চলে আসুক কিন্তু সে কিছুতেই রাজকুমারের উপর অভিমান করে থাকতে পারলো না। রাজকুমারের সৌন্দর্যে তার হৃদয় বাধা পড়ে গিয়েছিলো, কিছুতেই সে তাকে ভুলতে পারছিলো না। কোথাকার কে রাজকুমার, কোনোদিন যার সঙ্গে ছিলোনা তার পরিচয়, কি হবে তার কথা ভেবে…এমন নানা ভাবনা ভেবে মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো সে রাজকুমারকে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে এলিনা নিজের মনের। কাছে।
কয়েকদিন অবিরত ভেবেছে, রহমানের কথাগুলোই তার বার বার মনে হয়েছে “দিদিমনি, আপনি নারী মায়া-মমতায় আপনার হৃদয় পরিপূর্ণ। আমার রাজকুমারকে ফিরিয়ে আনতে। আপনিই পারবেন। আমার রাজকুমারকে সুস্থ করতে আপনিই পারবেন…এলিনা যতই ভাবে। ততই রাজকুমার তার সমস্ত অন্তর জুড়ে দাগ কেটে বসে, কেমন যেন ভালো লাগে ওর কথা ভাবতে। এলিনা সুযোগ খোঁজে আবার কেমন করে যাবে সে উপরে।
এলিনা একদিন উপরে গিয়ে বনহুরের বাবুর্চির সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিলো, বাবুর্চির হাতের রান্না সে নিজের হাতে করলো, আলটা মডার্ণ মেয়ে হয়ে আজ সে নিপুণ গৃহিনীর মতোই রান্না করলো। সুন্দর করে খাবার টেবিলে নিজের হাতে সাজিয়ে আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো, বাবুর্চিকে বলে দিলো কিছুতেই যেন তার কথা রাজকুমারকে না বলে।
বাবুর্চী তার কাজে সহায়তা পেয়েছে, বলবে কি খুশীতে সে ডগমগ হয়ে উঠেছে।
এলিনা টেবিলে সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে আড়ালে সরে যেতেই বাবুর্চি রাজকুমারকে খাবার টেবিলে আসার জন্য জানালো।
বনহুর প্রতিদিনের মত আজও খাবার টেবিলে এসে বসলো। কিন্তু অবাক হলো সে আজ খাবার টেবিলে বসে। সুন্দর করে সাজানো খাবারগুলি, মুখে দিয়ে আরও বিস্মিত হলো। তার আরাকানী বাবুর্চি আজ হঠাৎ এমন সুন্দর পাক করতে শিখলো কি করে। আরাকানের আসার পর তার মুখ কোনোদিন এমন রান্না খায়নি। বনহুরের সুস্বাদু পাক খাওয়া অভ্যাস নয়, তবে ভাল। রুচিকর জিনিস সকলেরই প্রিয়। তাই বনহুরের কাছে আজ খাবারগুলি অত্যন্ত সুস্বাদু লাগলো, অনেকদিন পর আজ পেটপুরে খেলো বনহুর।
খেতে খেতে বললো বনহুর–বাবুর্চি, আজ কে রান্না করেছে?
বাবুর্চির দৃষ্টি নিজের অজ্ঞাতে চলে গেলো ওদিকের দরজায়। সেখানে দাঁড়িয়ে এলিনা চোখের ইশারায় বারণ করে দিলো যেন না বলে সে।
তারপর থেকে প্রায়ই বনহুর লক্ষ্য করলো তার জন্য খাবারগুলো কে যেন সুন্দর করে রান্না করে দেয়। টেবিলে সাজিয়ে দেয় অতি নিপুণ হস্তে। এর আগে বনহুর খেতে বসে দু’এক বার খেয়ে আর মুখে করতে পারেনি, কেমন বিস্বাদ লেগেছে বাবুর্চির হাতের রান্নাগুলো। টেবিলে খাবারগুলো এমনভাবে সাজানো থাকতো যেন কে এসব অৰ্দ্ধভক্ষণ করে রেখে গেছে।
বনহুর কোনোদিন তৃপ্তিসহকারে খেতে পারেনি। না খেলে নয়, তাই এসে বসতো খাবার টেবিলে।
বনহুর আরও লক্ষ্য করেছে আজকাল তার কক্ষের বিছানাপত্র, আলনা, বইএর সেলফ কে যেন নিপুণ হস্তে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে যায়। কই, আগে তো এমন করে তার বিশ্রামকক্ষ কেউ গুছিয়ে রাখতো না। রহমান যখন আসতো তখন যতটুক পারতো তার নাওয়া-খাওয়া, ঘর গোছানো সব করে যেতো, কিন্তু এখন কে তার এমন করে যত্ন নিচ্ছে। নিশ্চয়ই এ চাকর-বাকর আর বাবুর্চির কাজ নয়।
প্রথম প্রথম বনহুর এ সব লক্ষ্য করেনি তেমন করে। কারণ এ সব খেয়াল করবার মতো তার মনের অবস্থা ছিলোনা। কিন্তু পর পর যখন কয়েক দিন খেতে বসে দেখলো কেউ যেন তার। খাবারগুলি পরিপাটিরূপে রান্না করে সাজিয়ে রেখে যায় খাবার টেবিলে। বিছানার চাদরখানা আর। নীচে ঝুলে থাকেনা, টেবিলে বই-পত্র বা এ্যাসট্রে ছড়িয়ে থাকেনা। তবে কে কে সেই মায়াময়ী? বনহুরের মনে পড়ে…আর একজন তার সেবা-যত্ন এমনি করে আড়াল থেকে করতো। এমন কি সে যখন ঘুমাতো, চাদরখানা তুলে দিয়ে যেতো অদৃশ্যকারিনী তার শরীরে। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতো, তার নিশ্বাসের শব্দ আজও লেগে রয়েছে বনহুরের কর্ণকুহরে। সে আর কেহ নয় তার নূরী। কতদিন বনহুর নূরীকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছে, নূরী লজ্জায় মরিয়া হয়ে উঠেনি, হাসিতে মুখর হয়ে বলেছে–তুমি যে আমার, তাই তোমার সেবা করা আমার কর্তব্য। আজ আবার নূরীর কথাই স্মরণ হয় বনহুরের মনে।
তবে কি নূরীর আত্না তার সেবায় ছুটে আসে সুদূর পরপার থেকে। কে তার মুখে এমন করে সুস্বাদু খাবার তুলে দিচ্ছে। কে তার শয্যা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে, কে তার জামা-কাপড় পরিপাটি করে দিয়ে যাচ্ছে, সে তার নূরী না অন্য কেউ?
বনহুর সেদিন চুপটি করে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলের পাশে নজর পড়তেই চমকে উঠলো বনহুর। একটি নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে টেবিলে তার খাবারগুলি সাজিয়ে রাখছে।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো। নারীমূর্তি মুখ কালো। আবরণে ঢাকা ছিলো, পদশব্দে দ্রুত বেরিয়ে গেলো ডাইনিং রুম থেকে।
বনহুর থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন কত হাবা মানুষ সে। কে বলবে সে দস্যু বনহুর।
কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন বনহুর অন্যমনস্কভাবে শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। সমস্ত শরীরে আবরণ ঢাকা একটি নারী-মূর্তি তার শয্যায় বালিশগুলি সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে।
বনহুর অতি সন্তর্পণে এগুতে লাগলো, ঠিক তার পাশে এসে খপ করে ধরে ফেললো নারী মূর্তির হাতখানা। পরক্ষণেই তার মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেললো, সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো বনহুর মিস্ এলিনা, আপনি!
এলিনার মুখ বিবর্ণ হলো, কোনো কথা বলতে পারলো না সে।
বনহুর এলিনার হাতখানা মুক্ত করে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো–আমি ভাবতে পারিনি আপনিই সেই অদৃশ্য নারী। কিন্তু কেনো মিস এলিনা, কেন আপনি এসব করতে এসেছেন?
কুমার বাহাদুর আমাকে ক্ষমা করবেন, কেন এসব করতে এসেছি তা বলতে পারবো না।
মিস্ এলিনা, আপনাকে বলতে হবে?
আমি যদি না বলি তাহলে আপনি কি করবেন!
আপনার পিতাকে সব জানিয়ে দেবো।
মুহূর্তে মিস্ এলিনার মুখ কালো হয়ে উঠলো, কিছু বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো সে।
বনহুর দৃঢ় কণ্ঠে বললো–আপনি আধুনিক তরুণী। আপনার দাস-দাসীর সীমা নেই। আমি আশ্চর্য হচ্ছি আপনি এতো নীচ কাজে কি করে…
না, যে কাজ আমি করেছি বা করছি এ কাজ নীচ নয়। এ কাজ নারীদের জন্য। আমাকে আপনি আজও চিনতে পারেননি। যে রূপ আমার দেখছেন সে রূপ আমার আসল রূপ নয়, আমি ভালোবাসি সুন্দর একটি সংসার আর…না না, আর বলতে পারবোনা।
মিস এলিনা, আপনি ভুল করছেন, এখানে সুন্দর সংসার বা অন্য কিছুর আশা নেই…
চুপ করুন রাজকুমার। চুপ করুন। আমাকে আপনার সেবা করবার একটু অধিকার দিন। আমাকে বঞ্চিত করবেন না।
মিস এলিনা!
কুমার বাহাদুর, আপনি রাজপুত্র আপনার সেবা করার অধিকার আমার নেই, তবু অনুগ্রহ করে আমাকে অনুমতি দিন….
বনহুর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো এলিনার মুখের দিকে। আলটা-মডার্ণ তরুণী এলিনার মুখে আজ একি ভাবময় প্রতিচ্ছবি!
বনহুর দৃষ্টি নত করে নিলো, তারপর ধীর কণ্ঠে বললো–তাতে যদি শান্তি পান, বেশ।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মিস্ এলিনার মুখমন্ডল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো–কুমার বাহাদুর!
বনহুর গিয়ে দাঁড়ালো ওপাশের মুক্ত জানালার কাছে। তাকালো সীমাহীন আকাশের দিকে, একি সমস্যায় পড়লো সে আবার। বিব্রত বোধ করতে লাগলো, আরাকানে কিছুদিন থাকবে বলে এ বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলো কিন্তু তা আর হলো না। রহমান এলেই তাকে আরাকান ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে! যেখানেই যাক্ বনহুর আর শান্তি পাবে না, নূরীকে হারানোর ব্যথা তার অন্তরকে নিস্পেষিত করে ফেলেছে। আগে সে জানতো না তার হৃদয়ের এতোখানি অধিকার করে নিয়েছিলো নূরী।
নূরীর কথা ভাবতে গিয়ে বনহুর আবার বিমর্ষ হয়ে পড়লো, চোখ দুটো অশ্রু ছল ছল হয়ে উঠলো তার।
মিস এলিনা লক্ষ্য করলো তার মুখভাব। এগিয়ে গেলো এলিনা বনহুরের পাশে কুমার বাহাদুর!
ফিরে না তাকিয়ে বললো বনহুর–আমাকে একটু একা থাকতে দিন মিস এলিনা।
আমি যদি না যাই আমাকে আপনি তাড়িয়ে দেবেন?
বনহুর কোনো জবাব দেয় না।
মিস্ এলিনা বললো আবার–আজ আপনাকে আমার সঙ্গে বেড়াতে যেতে হবে।
বনহুর বিরক্ত ভরা চোখে তাকালো এলিনার দিকে।
এলিনা আজ অন্যদিনের মতো ছুটে পালিয়ে গেলোনা। রহমানের মুখে শুনেছে তার। রাজকুমারে মনে দারুন একটা ক্ষত আছে, সেই ক্ষতে ঔষধ দিয়ে আরোগ্য করতে হবে তাকে। এলিনা রহমানকে কথা দিয়েছে যেমন করে হোক তার মালিককে শুধরে নেবে, পারবে সে একাজ করতে। কাজেই এতো সহজে অভিমান বা রাগ করলে চলবেনা তার।
এলিনা বললো–আজ আপনাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে। কথাটা বলে আলনা থেকে কোট নিয়ে বনহুরের দিকে বাড়িয়ে ধরে–নিন পরুন।..
বনহুর কোনো কথা বলতে পারলোনা।
মোহগ্রস্তর মতো কোটটা এলিনার হাত থেকে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গায়ে পরে নিলো।
এলিনা হেসে বললো–বাড়ীতে আর কেউ নেই কিনা, তাই আপনাকে বিরক্ত করছি। চলুন।
কোথায় যাবেন? বললো বনহুর।
এলিনা একমুখ হাসি হেসে বললো–ক্লাবে।
ক্লাবে তো আমি যাইনা মিস্ এলিনা।
আজ না হয় একটু আমার সঙ্গে গেলেন। আসুন।
বনহুর অনুসরণ করে এলিনাকে।
এলিনা আর বনহুর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। বনহুরের মুখে তখন বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।
এলিনা আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিলো বনহুরের দিকে, একটু দুষ্টামির হাসি তার ঠোঁটের ফাঁকে দেখা দিলো। নীচে গাড়ি তাদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলো, এলিনা আর বনহুর গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ড্রাইভার নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো।
এলিনা বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–কুমার বাহাদুর, উঠুন।
বনহুর তার অনুগত ছাত্রের মত আদেশ পালন করলো।
এলিনা বসলো তার পাশে।
এলিনার শরীরে যে আবরণ ঢাকা ছিলো খুলে রেখে দিলো পাশে।
বনহুর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিলো ভাল করে। কারণ এতোক্ষণ এলিনার মুখমন্ডল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলোনা।
এলিনা আজ আধুনিক ড্রেসে সজ্জিত হয়নি, তার দেহে সাধারণ সাজসজ্জা শোভা পাচ্ছিলো। বড় সুন্দর লাগছিলো আজ এলিনাকে। বনহুর ক্ষণিকের জন্য বিস্মৃত হলো তার নূরীকে।
এলিনা তার পাশে এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে যে ওর দেহের উষ্ণ তাপ বনহুরের ধমনিতে একটা অনুভূতি জাগিয়ে তুলছিলো। বনহুর সরে বসলো আর একটু।
হাসলো এলিনা–ওঃ আপনি রাজকুমার আর আমি সামান্য মহিলা, মাফ করবেন, ভুল হয়ে গেছে।
না না…বনহুর নিজকে সামলে নেয়।
এরপর থেকে এলিনার আব্দার রক্ষার জন্য বনহুরকে রোজ যেতে হয় তার সঙ্গে। কোনো দিন বা লেকের ধারে, কোনোদিন ফাংশানে। এলিনার জ্বালায় বনহুর যেন অস্থির হয়ে উঠে। কিন্তু যতই সে ওকে পরিহার করে চলতে চায় ততই ও যেন আরও বেশি করে উপদ্রব শুরু করে।
বনহুর হয়তো রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে, ভাবছে হয়তো তার নূরীর কথা, ঠিক এমন সময় এলিনা এসে পিছন থেকে চোখ দুটো টিপে ধরে ফেলে।
বিরক্ত হলেও মুখভাব হাসি টেনে বলে–একি হচ্ছে মিস এলিনা?
এলিনা বনহুরের চোখ মুক্ত করে দিয়ে বলে–সত্যি করে বলুন দেখি কি ভাবছেন আপনি?
বনহুর গম্ভীর হয়ে যায়, দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে দূরে অসীম আকাশের দিকে।
এলিনা বলে আবার–কুমার বাহাদুর, আপনি বড় চাপা মানুষ আপনার কাছে আমি তো কোনো কথা গোপন করিনা, আর আপনি আমার কাছে কোনোদিন মনের কথা বললেন না। দুঃখ আমাকে আপনি বিশ্বাস করেননা আজও।
বনহুর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে–মিস এলিনা, আপনি অযথা দুঃখ করছেন। আমার মনের কথ শুনে আপনার কোনো লাভ হবেনা।
তবে লোকসানটাই বা কোথায়। কুমার বাহাদুর, আমি জানি আপনার হৃদয়ে অনেক ব্যথা। জেনেও আপনাকে বিরক্ত করি জানিনা কেননা আপনাকে আমার বড় ভাল লাগে।
বনহুর তাকায় এলিনার মুখের দিকে।
এলিনা বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে বলে এবার আমাকে আপনি ভালবাসতে পারেন না কি?
এলিনা।
কুমার বাহাদুর!
না, আমি কুমার বাহাদুর নই। আমি কুমার বাহাদুর নই…
আপনি নিজকে কেনো এমনভাবে বিসর্জন দিচ্ছেন বলুন তো?আজ আমাকে বলতে হবে সব কথা?
এলিনা বনহুরের জামার অংশ মুঠায় চেপে ধরে রইলো।
বনহুর বিব্রত বোধ করতে লাগলো, হঠাৎ যদি কেউ দেখে ফেলে তখন কি ভাববে।
বললো বনহুর–বেশ ঘরে চলুন, সব বলছি।
এলিনা আর দস্যু বনহুর এসে বসলো পাশপাশি দুটো সোফায়।
এলিনা বললো–যদি বলতে অপনার খুব কষ্ট হয় তবে থাক।
কষ্ট! না হবেনা।
তবে বলুন? প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকায় এলিনা বনহুরের মুখের দিকে। বনহুর একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে নেয়, তারপর বলতে শুরু করে ছোট বেলায় মা বাবাকে হারিয়ে জীবনে স্নেহ মায়া মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কাজেই নিজকে ঠিক মানুষের মত স্বাভাবিক করে তৈরী করে নিতে পারিনি। মানুষের মত আমার চেহারাটা হলেও আসলে অন্তরটা আমার মানুষের মত নয়। যে কোনদিন স্নেহ মায়া মমতা পায়নি, সে কি করে জানবে মায়া মমতা কি জিনিষ। তাই ওসব কাউকে দিতেও জানিনা।
এ সব কি আমি শুনতে চাইছি কুমার বাহাদুর?
শুনতে যখন চাইছেন তখন সব শুনতে হবে।
তাহলে বলুন?
মানুষ হয়েছি জঙ্গলে জীব জন্তু পশু পাখিদের মধ্যে। ছোট বেলায় ওরাই ছিলো আমার খেলার সাথী।
এলিনার দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়, অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে–আশ্চর্য!
– হাঁ, আশ্চর্য বটে। বাঘের সঙ্গে লড়াই করা, সিংহের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাই শিখলাম। দুর্বলতা পেলোনা আমার কাছে কোনো স্থান। তাহলে ভেবে দেখুন আমার চেহারার সঙ্গে মনের কোনো মিল নেই।
অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!
তার চেয়েও অদ্ভুত আমার মন! আরও শুনতে চান?
হাঁ আমি শুনবো আপনার জীবন-কাহিনী।
আচ্ছা বলছি সব, কিন্তু সব শোনার পর আর এক মুহূর্ত আপনি আমার কক্ষে থাকবেন না। ঘৃণার অন্তর আপনার বিষিয়ে উঠবে, আপনি আমাকে–
আপনি বলুন, বলুন রাজকুমার?
হাঁ কি বলছিলাম মিস এলিনা? হাঁ আমার চেহারার সঙ্গে আমার মনের মিল নেই এতোটুকু। আমার সেই কঠিন ইস্পাতের মত অন্তরের পাশে আর একটি কোমল প্রাণ অন্তরের সন্ধান পেলাম, যে হৃদয় স্নেহ-মায়া-মমতা প্রেম-ভালবাসায় পরিপূর্ণ। সে আমাকে তার সব কিছু উজাড় করে। দিয়েছে, আর আমি তাকে দিয়েছি কঠোর শাস্তি। নির্মম কষাঘাতে তাকে জর্জরিত করেছি। এতোটুকু করুণা সে পায়নি কোনোদিন আমার কাছে–কণ্ঠ ধরে আসে বনহুরের।
এলিনা অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে–উঃ কি নিষ্ঠুর আপনি!
নিষ্ঠুর শুধু নই, কঠিন হৃদয়হীন পিশাচ আমি। নিতেই শুধু জানি, কাউকে দিতে জানিনা। তার কাছেও শুধু নিয়েই গেছি কিন্তু প্রতি দানে তাকে দেইনি কিছু।
দেবার তো এখনও আপনার অনেক আছে! কেন আপনি মিছামিছি হতাশ হচ্ছেন?
তাকে আর কোথায় পাব মিস এলিনা? সে আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। আর ফিরে আসবেনা কোনদিন–
কুমার বাহাদুর, আপনি তাকে বিয়ে করেছিলেন?
হাঁ।
তবু তাকে আপনি ভালবাসতে পারেননি?
কই আর পারলাম। ভালবাসা কি জিনিস আমি তো জানিনা মিস এলিনা।
আশ্চর্য কথা বললেন আপনি।
আপনাকে আমি তো সব বলেছি, আমার হৃদয়ে মায়া-মমতা-প্রেম ভালবাসা কিছু নেই, থাকলে আমি এতো পাষাণ হতে পারতাম না।
আপনি কি মানুষ!
না, আমি মানুষ নই মিস এলিনা। আমি অদ্ভুত জীব—
কুমার বাহাদুর, আপনি সুস্থ নন তাই–
না না, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, কিন্তু এখনও আপনি আমার সব কথা শোনেননি। সব শুনলে আর কোনো সময় এখানে আসবেন না, ভয়ে শিউরে উঠবেন আঁতঙ্কে পালিয়ে যাবেন–
হঠাৎ বনহুর হেসে উঠলো অদ্ভুতভাবে–হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—
মিস এলিনার চোখ দুটো ভয়ে কেমন যেন গোলকার হয়ে উঠলো, বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে।
হাসি থামিয়ে বলে উঠে বনহুর–আমার আসল পরিচয় জানলে আর কোনদিন আমার ছায়াও মাড়াতে চাইবেন না মিস এলিনা। আমার আসল পরিচয়—
ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করে রহমান কুমার বাহাদুর।
রহমানকে দেখেই বনহুর চুপ করে গেলো, তাকালো তার দিকে। যা বলতে যাচ্ছিলো বলা। আর হলো না।
রহমান আর মিস এলিনার মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো।
রহমান বললো–দিদিমনি, আপনাকে নীচে ডাকছেন।
এলিনা বুঝতে পারলো, রহমান মিয়া তাকে নীচে যাবার জন্য ইংগিত করলো।
এলিনা আর বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেলো।
বনহুর বললো–রহমান, মনিকে পৌঁছে দিয়েছো ওর মায়ের কাছে?
হাঁ সর্দার।
বেশ করেছে। বনহুর যেন অনেকটা আস্বস্ত হলো।
রহমান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো “সর্দার বৌ-রাণী কেমন আছেন, তাতো জানতে চাইলেন না। তা ছাড়া বেগম সাহেবা তিনিও–
আমাকে একটু নিরিবিলি থাকতে দাও রহমান। তুমি এসেছো ভালই হলো। এখানে থাকা আর চলবেনা।
কেন, কেন সর্দার?
প্রশ্ন করোনা। আমি তোমাকে কোনো কথা বলতে রাজি নই।
তাহলে?
হাঁ, আমি আরাকান ত্যাগ করে চলে যাবো।
আচ্ছা, আমিই ব্যবস্থা করবো।
বেশ, এখন যেতে পারো।
রহমান তবু দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে।
বনহুর বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বললো আবার তবু দাঁড়িয়ে রইলে কেনো? কথা শেষ হয়নি বুঝি?
সর্দার, আমি বলছিলাম কি—
বলো দ্রুত বলে ফেলো?
এখন আপনার কান্দাই ফিরে যাওয়াই শ্রেয়।
তোমার চেয়ে আমি ভাল জানি, কোটা আমার জন্য শ্রেয়।
সর্দার বৌ-রাণী বার বার আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। তার শরীরের অবস্থাও খুব ভাল নয়। বেগম সাহেবা বললেন, সব সময় নাকি কাঁদাকাটা করেন উনি।
আমি জানি মেয়েরা শুধু কাঁদতেই জানে, মনিরাও কাঁদে কাঁদতে দাও।
সর্দার!
এখানে থাকা আমার আর সম্ভব নয়। আমি চলে যেতে চাই এখান থেকে।
সর্দার, আপনার আদেশ শিরোধার্য। আমি ব্যবস্থা করবো।
রহমান আর দাঁড়ায় না চলে যায় নীচে।
সিঁড়ির মুখে রহমানের জন্য অপেক্ষা করছিলো মিস্ এলিনা। রহমান গম্ভীর মুখে নেমে আসতেই এলিনা তাকে ডাকলো–রহমান মিয়া?
রহমান থমকে দাঁড়ালো ডাকছেন দিদিমনি?
রহমান তুমি যা বলেছিলে, চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারলাম না। তোমার রাজকুমার অদ্ভুত মানুষ।
হতাশ ভরা গলায় বললো রহমান–আমি আপনাকে কি বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাবো ভেবে পাচ্ছি না দিদিমণি। কুমার বাহাদুরের জন্য আপনি যা করেছেন সব আমি শুনেছি বাবুর্চি আর চাকর বাকরের মুখে। কিন্তু দুঃখ কুমার বাহাদুর আপনাকে কোনো দিন আন্তরিকতা জানান নি।
তাতে আফসোস নেই, তোমার কুমার বাহাদুর যদি সুস্থ হয়ে উঠতো তাহলেও আমি ধন্য। হতাম রহমান মিয়া। কিন্তু জানি না, তার মনে কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি কিনা।
রহমান কোনো কথা বললো না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো এলিনার মুখের দিকে।
*
রহমানের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বনহুর আবার পালিয়ে গেলো আরাকান জঙ্গলে। যেখানে সে হারিয়েছে তার শিশু বেলার সাথী-সঙ্গিনী নূরীকে।
আবার সেই গহন বন।
চারিদিকে নানারকম হিংস্র জীবজন্তুর হুঙ্কার!
বনহুর এসে দাঁড়ালো যে স্থানে নূরীর মৃত্যু ঘটেছে। তাকিয়ে রইলো নির্বাক আঁখি মেলে। সেইদিকে। একটি সুন্দর জীবন-প্রদীপ শিখা নিভে গেছে চিরতরে। বনহুরের অন্তর হু হু করে। কেঁদে উঠে, গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা।
নূরীর স্মৃতি তার সমস্ত অন্তরে অগ্নি শিখার মত দাউ দাউ করে জ্বলছে। বুকের মধ্যে যেন একটা শূন্যতা হাহাকার করে কেঁদে ফিরছে। বনহুর নিজেই ভেবে পায় না নূরীকে সে কখন এতোখানি ভালোবেসে ফেলেছিলো।
নূরীর স্মৃতি আজ বনহুরকে বিস্মৃতির পথে টেনে নিয়ে চলেছে, বনহুর ভুলে গেছে সে একজন বিশ্ববিখ্যাত দস্যু। তার নাম স্মরণে দেশবাসীর হৃদকম্প শুরু হয়, তার দর্শনে ভুলে যায় মানুষ তার অস্তিত্ব। এ হেন দস্যু-সম্রাট আজ উদ্ভ্রান্তের মত উদাসীন। নূরীর স্মৃতি তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। মনিরার কথা। যে মনিরার জন্য বনহুর কোনোদিন নূরীকে স্থান দেয়নি নিজের হৃদয়ে। মনিরার ভালোবাসার মধ্যে বনহুর হারিয়ে ফেলেছিলো নিজেকে, নূরী সরে পড়েছিলো দূরে। কিন্তু আজ নূরীকে হারিয়ে সে ভুলতে বসেছে সবকিছু।
*
বনহুর যখন আরাকান জঙ্গলের নূরীর মৃত্যুশোকে মূহ্যমান তখন রহমান তার সর্দারের সন্ধানে এসে চিন্তিত হয়ে কক্ষমধ্যে পায়চারী করে চলেছে। কোথায় গেলো তার সর্দার, কক্ষমধ্যে সব পড়ে আছে এমন কি বনহুরের বাইরে যাবার জামা-কাপড় পোষাক-পরিচ্ছদ সব যেমন যেখানে তেমনি রয়েছে। নাইট ড্রেস পরেই সর্দার চলে গেছে; রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে সে। আরাকান জঙ্গলে।
শুধু তাজ তার সঙ্গী হিসেবে গিয়েছে।
রহমান আর বিলম্ব না করে দুলকী নিয়ে ছুটলো, আরাকান জঙ্গলে তাকে পৌঁছতে হবে। যেমন করে হোক সর্দারকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু কি করে বেঁধে রাখবে রহমান তাকে ভেবে পায় না। রহমান দুলকীর পিঠে ছুটে চলে আর ভাবে সর্দারকে কি করে রক্ষা করা যায়। যে কোনো মানুষ হলে তাকে স্বাভাবিক করে আনতে এতো বেগ পেতে হতো না কিন্তু অস্বাভাবিক মানুষ তার সর্দার।
বনহুর যে আবার আরাকানের জঙ্গলে গেছে এ সন্দেহ তার মনে দানা বেঁধেছিলো, কারণ বনহুরের রিভলভারখানাও বালিশের তলায় তেমনি পড়েছিলো। একমাত্র নূরীর কথা স্মরণ হওয়া ছাড়া, তার সর্দার কোনো সময় অস্ত্র না নিয়ে বাইরে যায় না বা যেতে পারে না। রহমান যখন দেখলো সর্দারের রিভলভারখানা বালিশের তলায় রয়েছে গেছে, তখনই সে বুঝতে পেরেছে। কোথায় গেছে তার সর্দার।
রহমানের সন্দেহ সত্যে পরিণত হলো যখন সে পৌঁছলো আরাকান জঙ্গলে।
অনেক সন্ধানের পর রহমান এসে হাজির হলো সেই স্থানে যেখানে এক রাত্রিতে সে কোনো অজ্ঞাত জনের ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ পেয়েছিলো গাছের ডালে বসে।
আশ্চর্য হলো রহমান, ঝরণার পাশে একটা টিলার উপরে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তার সর্দার।
কিছুক্ষণ রহমান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, অদূরে তাজ দাঁড়িয়ে আছে প্রভুর দিকে মুখ করে।
রহমান এগিয়ে গেলো, বনহুরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সর্দার।
সর্দার…
চোখ তুলে তাকালো বনহুর, গম্ভীর গলায় বললো– আবার কেনো এলে তুমি?
সর্দার, আপনি অবুঝ নন! আপনি জ্ঞানী-বুদ্ধিমান। সামান্য একটি নারীর জন্য আপনি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেন?
রহমান, নূরী সামান্যা নয়, জানোনা সে আমার কত বড় একজন।
জানি সর্দার, তাই বলে আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন? হাজার হাজার জনগণ আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কত নর-নারী আপনার প্রতিক্ষায় প্রহর গুণছে। সর্দার, আপনি…
রহমান।
হা সর্দার, আপনি শুধু আমাদের রক্ষকই নন, আপনি আমাদের সর্দার। আপনার অভাবে সমস্ত কান্দাই নগরী খাঁ খাঁ করছে। বেগম সাহেবার চোখের অশ্রুর বন্যা, বৌ-রাণীর দীর্ঘশ্বাস, মনির আকুল আহ্বান কেমন করে আপনি উপেক্ষা করবেন, আমাদের জন্য আপনি ফিরে না তাকালেও তাদের জন্য আপনাকে ফিরে যেতে হবে কান্দাই এ।
রহমান, বার বার কেনো তুমি আমাকে একই কথার প্রতিধ্বনি শোনাচ্ছো। আমি সত্যই কি। উন্মাদ হয়ে গেছি? না, আমি পাগল হইনি রহমান, আমি পাগল হইনি।
সর্দার।
নূরীর স্মৃতি সব সময় আমাকে এখানে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই আমি ছুটে আসি এই। আরাকান জঙ্গলে। থাকতে পারিনা রহমান, আমি থাকতে পারি না কোথাও।
সর্দার চলুন, উঠুন আপনি।
চলো রহমান। চলো একটু দাঁড়াও, তুমি দেখনি সেই দৃশ্য। উঃ কি মর্মান্তিক ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্তটি– ঐ পাথরখন্ডটার উপর বসেছিলাম আমি। ও তখন রাজহংসীর মত সাঁতার কাটছিলো ঝরণার পানিতে। সচ্ছ সাবলীল পানির মধ্যে জলপরীর মত সুন্দর অপূর্ব লাগছিলো তখন ওকে। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, ভুলে গিয়েছিলাম আমার অস্তিত্ব। তারপর জানো রহমান…
বলুন সর্দার?
হঠাৎ নূরী ঝরনা থেকে ঝড়ের বেগে উঠে এসে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালো। আমি কিছু বুঝবার পূর্বেই নূরী তীব্র আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো ভূতলে। উঃ কি রক্ত। রহমান, আমি নূরীর দিকে একবার মাত্র তাকিয়ে দেখেছি, তারপর…
সর্দার আপনি বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ছেন, যে গেছে তার কথা আর ভেবে কোনো লাভ হবে না। আপনি চলুন সর্দার।
রহমান বনহুরের হাত ধরে তাজের পাশে নিয়ে এলো। তাজের পিঠে বনহুরকে চাপিয়ে দিয়ে নিজে চেপে বসলো দুলকীর পিঠে।
*
বনহুর আর রহমান যখন ফিরে এলো আরাকান শহরে তার ভাড়াটিয়া বাড়িতে তখন মিঃ লারলং তার বন্ধুকে নিয়ে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে কোনো গোপন আলোচনা করছিলেন। মিঃ লারলং এর প্রধান বন্ধু ভোলানাথ যে নূরীকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো রহমানের কুঠির থেকে ভিখারীর বেশে।
বনহুর আর রহমান যখন অশ্বপৃষ্ঠে গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছিলো ঠিক তখন ভোলানাথের দৃষ্টি চলে যায় তাদের উপর। চমকে উঠে সে, দু’চোখে যেন অগ্নি বর্ষণ করে সে।
মিঃ লারলং বলেন– ওরা আমার উপরের ভাড়াটে; তুমি ওদের চেনো ভোলা?
আমার শত্রু ওরা।
বলো কি?
লারলং, এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম এবং কয়েকদিন আগেও আরাকান জঙ্গলের মধ্যে এর সন্ধানে আমি উল্কার মত ঘুরে ফিরেছি, তবুও পাইনি। আজ দেখছি সাপের গর্তে ব্যাঙ আস্তানা গেড়েছে।
হেসে বললো লারলং –তোমার মুখের গ্রাস এরাই কেড়ে নিয়েছিলো তা হলে?
হাঁ, তুমি জানোনা, লারলং, সেই অপূর্ব সুন্দরী যুবতীটিকে হারিয়ে আমি কতখানি ভেঙে পড়েছি। সত্য বলতে কি এমন চেহারার মেয়ে আমার চোখে আজ অবধি একটিও পড়েনি।
লারলং বললো আবার বয়স তো তোমার কম হলো না, তবু এখনও নারী লালসা..
চুপ, ওরা এদিকে আসছে।
ভয় নেই, ওরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাবে। প্রথম ব্যক্তি কে জানো ভোলা?
পরিচয় জানিনা তবে এটুকু জানি, লোকটা মস্ত বড় বীর যোদ্ধা বললেও ভুল হয়না। আর ওর সঙ্গীটি একজন টাঙ্গীচালক। হাঁ, যুবতীটিকে টাঙ্গীচালকের বাড়ি থেকেই হরণ করা। হয়েছিলো।
লারলং বললেন– প্রথম যুবক কান্দাই এর রাজকুমার আর ওর সঙ্গীটিকে ঠিক চিনতে পেরেছো, সে রাজকুমারের টাঙ্গী চালক। কিন্তু যে যুবতীটিকে তোমরা হরণ করেছিলে সে ওদের কে হয় তাতো শুনিনি!
আচ্ছা, আজ আমি ওদের সব জেনে নেবো। সাপের গর্তে যখন প্রবেশ করেছে তখন ভোলানাথের ছোবল থেকে মুক্তি পাবে না।
বনহুর আর রহমান তখন ঘোড়াশালে ঘোড়া রেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
ভোলানাথ দাতে দাঁত পিষলো।
মিঃ লারলং শুধু ব্যবসায়ী নন, তার ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য শহরের সমস্ত শয়তান লোকদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা। প্রচুর অর্থের অধিকারী লারলং যৌথ। আরাকান শহরের দুষ্ট লোকগণ কুকর্মের জন্য অর্থের প্রয়োজন মনে করলে লারলং এর অর্থে সুদে আসলে তার প্রাপ্য পরিশোধ করে দেয়। দূষিত আবর্জনার মত পাপকার্যে সঞ্চিত অর্থ স্থূপাকার হতে থাকে মিঃ লারলং এর লৌহসিন্দুকে। অর্থ পিপাসু লারলং তাই শহরের শেষ প্রান্তে গড়ে নিয়েছিলো তার ইমার।
শহরের যত দুষ্ট লোকজনের আনাগোনা ছিলো মিঃ লারলং যৌথের বাড়িতে; কিন্তু প্রকাশ্যে নয় অতি গোপনে। শহরের মানুষ জানতো মিঃ যৌথ সদাশয় এবং মহৎ ব্যক্তি। তার উপরের খোলস ছিলো অতি ভদ্র ও সাধু বেশি, কিন্তু ভিতরটা ছিলো অত্যন্ত মারাত্মক বিষাক্ত সর্পের চেয়েও সাংঘাতিক।
রাজকুমারকে তার বাড়িতে ভাড়াটে হিসাবে আশ্রয় দেবার পর মিঃ লারলং এর মনে নানা রকম কুৎসিৎ অভিসন্ধি উঁকি দিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এলিনার জন্য সহসা কিছু করে উঠতে পারছিলো না। লারলং যতই দুষ্ট প্রকৃতির লোক হোক না কেনো এলিনা ছিলো ভাল মেয়ে, অন্তরটা ছিলো তার স্বচ্ছ। পিতার মত কলুষিত ছিলোনা তার ভিতরটা।
রহমান যেদিন এলিনাকে দুর্যোগময় রাত্রিতে তার টাঙ্গীতে করে এ বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলো সেদিন সে বুঝতে পারেনি মিঃ লারলং কত বড় সাংঘাতিক মানুষ। এবং সেদিন মিঃ লারলংকে চিনতে পারেনি বলেই রহমান তার রাজকুমারের জন্য বেছে নিয়েছিলো শহরের এক প্রান্তে নির্জন এ বাড়িটা। ভেবেছিলো এই নিরিবিলি পরিচ্ছন্ন জায়গাটা তার সর্দারের বিদগ্ধ অন্তরে আনবে একটা শান্তিধারা।
কিন্তু রহমান সেদিন বুঝতে পারেনি কত বড় সাংঘাতিক ফাঁদে তারা পা দিলো।
আজ ভোলানাথ স্বচক্ষে দর্শন করলো রাজকুমার ও তার সঙ্গীটিকে। ভোলানাথের অন্তরে বিষের আগুন জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। এই রাজকুমার শুধু তার মুখের গ্রাসই কেড়ে নেয়নি। তার বহু অনুচরের জীবন বিনষ্ট করে দিয়েছে।
দাঁতে দাঁত পিষে বললো ভোলানাথ রাজকুমার! দাঁড়াও বন্ধু আমি তোমার রাজকুমার জীবন প্রদীপ কেমন করে নিভিয়ে দেই, একবার দেখো।
মিঃ লারলং চারিদিকে তাকিয়ে বললো– আস্তে, বন্ধু আস্তে। এলিনা যদিতে জানতে পারে তাহলে তোমার সব অভিসন্ধি মাঠে মারা যাবে।
পিতা আর ভোলানাথ যখন রাজকুমারকে নিয়ে গোপন আলোচনা চালাচ্ছিলো তখন এলিনা দেয়ালের ওপাশ থেকে সব শুনছিলো কান পেতে।
এলিনাকে রাজকুমার উপেক্ষা করুক না কেনো, সে তবু তার অমঙ্গল চিন্তা করতে পারেনা। এলিনার হৃদয় জুড়ে রাজকুমার বিরাজ করছে। ওকে ওর ভাল লাগে। আপনভোলা মানুষটি!
পিতার কথায় ভোলানাথ বললো– যৌথ, তোমার কন্যাটি বড় বেয়াড়া।
শুধু বেয়াড়াই নয় বন্ধু আমার প্রত্যেকটা কাজে সে আজকাল বাধার সৃষ্টি করে চলেছে কিন্তু কি করবো, মা-মরা মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারিনি।
ভোলানাথ হাসলো।
শয়তান ভোলানাথের হাসির শব্দ এলিনার শরীরে যেন আগুন ধরিয়ে দিলো।
ভোলানাথ হাসি থামিয়ে বললো– যৌথ, তুমি জানোনা রাজকুমারের দেহে অসীম বল। আমার পঞ্চসবুজ অনুচরদের তিন জনকে সে একা হত্যা করছে। শুধু তাই নয়, আমার দলের আরও বিশজন নিহত হয়েছে ঐ রাজকুমারের রিভলভারের গুলীতে।
বলো কি?
হাঁ, অব্যর্থ লক্ষ্য তোমার ঐ ভাড়াটে যুবকের। যৌথ, আমি ওর বুকের রক্ত শুষে নেবো। আমি ওর বুকের রক্ত শুষে নেবো..
এলিনা আড়ালে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠলো। নীচের ঠোঁটখানা উপরের দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো, সেও দেখে নেবে কেমন করে রাজকুমারের বুকের রক্ত ভোলানাথ শুষে নেয়।
আবার শোনা গেলো ভোলানাথের কণ্ঠ বন্ধু তোমাকে সহায়তা করতে হবে। আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে তোমাকে সাহায্য করবো। কথাগুলো মিঃ লারলং যৌথ বললেন।
ভোলানাথ গলার স্বর খাটো করে নিয়ে কি যেন সব ফিসফিস করে বললো।
এলিনা অনেক চেষ্টা করেও শুনতে পেলোনা ভোলানাথের শেষ উক্তি গুলি।
পিতার সঙ্গে ভোলানাথের পরামর্শ শুনা পর্যন্ত এলিনার মনে একটা গভীর চিন্তা আলোড়ন সৃষ্টি করলো। এতোকাল সে তার পিতাকে নানা রকম কুকর্মে লিপ্ত হতে দেখেও কোনো প্রতিবাদ করেনি। আজ তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। একজন নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন বিনষ্ট করবার জন্য এতো আগ্রহশীল কেননা তার বাবা! কি অন্যায় সে করেছে তার? ভোলানাথের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে, তাতে তার পিতার কি লাভ লোকসান?
কিন্তু সে বেঁচে থাকতে রাজকুমারের কোনো অমঙ্গল করতে পারবেনা।
এলিনা লক্ষ্য করলো, সিঁড়ি বেয়ে রহমান মিয়া নেমে আসছে। হয়তো রাজকুমারকে তার কক্ষে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে সে।
এলিনা চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর দ্রুত সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালো।
রহমান নেমে আসতেই এলিনা বললো– রহমান মিয়া, আজ আমাকে তোমার টাঙ্গী করে বেড়াতে নিয়ে যাবে?
রহমান ব্যস্তভাবে নেমে আসছিলো, বললো এবার আজ নয় দিদিমনি, আর একদিন নিয়ে যাবো।
না, তা হবেনা, আজকেই আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে।
একটু চিন্তা করে বললো রহমান– বেশ সন্ধ্যার আগে যাবেন। আমার একটু জরুরী কাজ আছে কিনা।
বেশ, মনে থাকে যেন।
নিশ্চয়ই মনে থাকবে দিদিমনি।
রহমান চলে যায়।
এলিনা তাড়াতাড়ি কক্ষমধ্যে চলে যায়।
সন্ধ্যায় এলিনার কথামত এলো রহমান, টাঙ্গী রেখে নেমে দাঁড়ালো।
এলিনা রহমানের প্রতিক্ষায় ছিলো, এগিয়ে গেলো টাঙ্গীর দিকে।
অমনি পিছন থেকে মিঃ লারলং ডাকলেন– এলিনা, কোথায় যাচ্ছো মা?
একটু বেড়াতে।
বেশ তো, আমিও যাবো তোমার সঙ্গে, আজ সারাটা দিন বাইরে বের হইনি কিনা।
এলিনার মুখ বিষণ্ণ হলো, কারণ দ্বিপ্রহরে তার পিতার আর ভোলানাথের মুখে শোনা কথাগুলো শোনার পর থেকে স্বস্তি ছিলোনা তার মনে। এখানে থাকলে রাজকুমারের জীবন যে কোনো মুহূর্তে বিনষ্ট হতে পারে। সেই জন্য এলিনা রহমানকে গোপনে বলবে তার রাজকুমারকে। নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু তার বাবা সঙ্গে গেলে কিছু বলা হবে না। বরং রাজকুমার বাড়িতে একা থাকবে সেই সময় ভোলানাথ কোনো চক্রান্ত করতে পারে।
এলিনা বললো– তা তুমি গেলে ভালই হতো বাবা। কিন্তু আমার এক বান্ধবী আজ বেড়াতে আসার কথা আছে, একটুও মনে ছিলোনা। তারপর রহমানের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো– তোমাকে কষ্ট দিলাম মনে কিছু করোনা, কেমন?
না না দিদিমনি, আমরা গরীব মানুষ, আমাদের আবার কষ্ট কি?
এলিনা কথার মধ্যে ফিস ফিস করে বললো তোমার সঙ্গে কথা আছে, কাল এসো।
রহমান আশ্চর্য হলোনা, সে প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলো দিদি কোনো গোপন কথা বলবার জন্য তাকে নিভৃতে নিয়ে যেতে চায়। রহমান বললো- আসবো।
বনহুর নিজের শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় বসে চিন্তা করছিলো। আঙ্গুলের ফাঁকে অগ্নিদগ্ধ সিগারেট। দৃষ্টি তার সম্মুখের দেয়ালে সীমাবদ্ধ।
গভীর রাত।
সমস্ত আরাকান শহর নিস্তব্ধ।
শহরের শেষ প্রান্তে মিঃ লারলং এর বাড়িও ঘুমিয়ে পড়েছে অন্ধকারের কোলে।
গেটে রাইফেলধারী পাহারাদার ঝিমাচ্ছে।
বনহুর শুধু জেগে আছে তার কক্ষে।
টেবিলে লণ্ঠন জ্বলছে।
হঠাৎ দেয়ালে একটা ছায়া পড়লো।
বনহুর চমকে উঠলোনা, কিন্তু তার মনের চিন্তাধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সজাগ দৃষ্টি মেলে তাকালো ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বনহুরের হাতখানা বালিশের তলায় চলে গেলো, দ্রুত হস্তে রিভলভার খানা টেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো কে?
একি! মিস এলিনা আপনি এতো রাতে!
এলিনা গম্ভীর গলায় বললো– তবু যা হোক আপনি সজাগ ছিলেন।
মিস এলিনা আপনি কি মনে করেছিলেন আমি একেবারে অচেতন?
না, ঠিক তা নয়। কুমার বাহাদুর, এতো রাতে এখানে কেনো এসেছি জানেন?
জানার বাসনা আমার নেই মিস এলিনা। আপনি এখানে এসে ভাল করেন নি। কারণ আপনার বাবা যদি জানতে পারেন তাহলে কি হবে জানেন নিশ্চয়ই?
কুমার বাহাদুর, আমি একটা কথা বলতে এসেছি…
ঠিক সেই সময় শোনা গেলো মিঃ লারলং এর কণ্ঠস্বর এলিনা! এলিনা! এলিনা…
বনহুর বললো- মিস এলিনা, আপনার কথা শোনার সময় হলোনা। এখন যেতে পারেন আপনি।
এলিনা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যেতেই মিঃ লারলং কঠিন কণ্ঠে বললেন– এলিনা, আমি ভাবতে পারিনি তুমি এতো অধঃপতনে গেলে কি করে! ছিঃ ছিঃ তোমার চরিত্র সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত। বিশ্বাসী ছিলাম কিন্তু তুমি আমার চোখে ধূলো দিয়ে…
বাবা, আমি চরিত্রহীনা মেয়ে নই।
আগে তাই জানতাম, কিন্তু রাজকুমারের রূপে তুমি পাগল হয়ে গেছো।
বাবা!
তুমি মুখে না বললেও আমি সব বুঝতে পেরেছি। যাও, নিজের ঘরে যাও। ঘুমাওগে।
এলিনা আর কোন কথা বলতে পারলোনা, চলে গেলো।
সেদিন এলিনা তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারেন্দা দিয়ে সোজা বাগানে চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ শুনতে পেলো পিতার কক্ষে ভোলা নাথের কণ্ঠস্বর।
থমকে দাঁড়ালো এলিনা। কান পেতে শুনতে লাগলো সে।
ভোলানাথ বলছে তার পিতাকে অতি সাবধানে কাজ শেষ করতে হবে যৌথ। তোমার মেয়ে যেন এর বিন্দুমাত্র জানতে না পারে।
কথাগুলো এলিনার শিরায় শিরায় আলোড়ন জাগালো। কি এমন কাজ করবে যা সে জানলে ভয়ানক ক্ষতি হবে তাদের? এলিনা আরও সরে দরজার পর্দা ঘেষে দাঁড়ালো।
মিঃ লারলং এর গলার আওয়াজ এলিনা জানবেনা, ওকে আমি জানতে দেবোনা ভোলা, তুমি নিঃসন্দেহ থাকো।
তাহলে কবে ফাংশন করবে মনস্থ করছো? ভোলার কণ্ঠ।
লারলং বললেন– আগামী পরশু রাত্রি আমার মেয়ে এলিনার জন্মদিন। ঐ দিনটাই আমি বেছে নিয়েছি। হা রাজকুমারকে ঐদিন আমি আমন্ত্রণ জানাবো। আমরা এক সঙ্গেই খাবো বুঝলে, কিন্তু রাজকুমারের খাদ্যের সঙ্গে থাকবে বিষ মিশানো। অতি ভয়ঙ্কর মারাত্মক বিষ, বুঝলে? কিন্তু মৃত্যুর পর তার লাশটা…
হাঃ হাঃ হাঃ তুমি না একজন এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ লোক? তোমার মুখে এ কথা শোভা পায়না লারলং। রাজকুমারের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ সৎকারের ভার আমার উপর ছেড়ে দিতে পারো।
নিশ্চিন্ত করলে বন্ধু। কিন্তু এজন্য আমাকে কি বখসী দেবে তাতো বললেনা?
তুমি বন্ধু লোক, জানোতো রাজকুমারের মৃত্যুতে আমার লাভ লোকসান কিছুই নেই। শুধু প্রতিশোধ আমি নিতে চাই। রাজকুমার আমার মুখের গ্রাসই শুধু বিনষ্ট করেনি। আমার বিশ্বস্ত অনুচরদের নিহত করে সে আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমি চাই প্রতিশোধ …… হাঃ হাঃ হা?
তুমি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ছে ভোলানাথ, কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে হবে।
যদি আমি মনের ঝাল মিটাতে পারি তাহলে তুমি আমার কাছে মোটা অঙ্ক পাবে। অবশ্য এতে আমার ক্ষতি ছাড়া লাভ হবেনা।
প্রতিহিংসার জ্বালা মিটাতে হলে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হবে বৈকি।
আচ্ছা, তোমার কথাই ঠিক রইলো যৌথ।
কক্ষমধ্যে ভোলানাথ বোধ হয় উঠে দাঁড়ালো। আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে এলিনা সরে গেলো সেখান থেকে।
এলিনার মনে ঝড় শুরু হলো, আজ রাত ও কালকের দিন পর রাত্রিতে তার জন্মদিনের উৎসব উদযাপিত করবে এ ক’দিন এলিনা জন্মদিনের উৎসব আনন্দ কিভাবে উদযাপিত করবে এ নিয়ে নানাভাবে জল্পনা-কল্পনা করেছে মনের মধ্যে। ঐদিন আসবে তার কত বন্ধু-বান্ধব আর বান্ধবী। তাদের নিয়ে নানা রকম হাসি গান বাজনা চলবে। আর চলবে খানাপিনা। কত রকম গল্পের ফুলঝুরি।
আজ এলিনার মন থেকে তার জন্মদিনের উৎসবের আনন্দ খেয়াল নিমিষে মুছে গেলো। জন্মদিন তার কাছে যেন বিষাক্তময় ক্ষণ বলে মনে হতে লাগলো। একটি নিরপরাধ জীবনের হবে পরিসমাপ্তি ঐ দিন।
এলিনা নানাভাবে চিন্তা করে চলে, কি করে রাজকুমারকে বাঁচানো যায়।
রাজকুমার যদিও তার প্রতি কোনো সময় সদয় ব্যবহার করেননি, তবু এলিনা পারেনা তার মৃত্যু চিন্তা করতে। নিজের অজ্ঞাতে সে ভালোবেসে ফেলেছিলো রাজকুমারকে।
সময় কারো মুখাপেক্ষী নয়।
এলিনার জন্ম দিন এসে পড়ে।
মিঃ লারলং এর বাড়ি আলোয় আলোকময়। নানারকম ফুল আর পাতা দিয়ে গোটা বাড়িটা সুন্দর করে সাজানো রয়েছে।
মিঃ লারলং নিজে গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে উপর তলায় রাজকুমারকে। বনহুর প্রথমে অমত করেছিলো, কিন্তু মিঃ লারলং এর অনুরোধে কথা দিয়েছিলো যাবো বলে।
এলিনা কথাটা শুনে শিউরে উঠেছিলো। রাজকুমার যদি না আসতো তবু খুশি হতো সে।
এলিনা সুযোগ খুঁজতে লাগলো, এক ফাঁকে হাজির হলো সে উপর তলায়।
কিন্তু রাজকুমারকে কোনো কথার বলার মত সুবিধা করে উঠতে পারলোনা। অন্যান্য লোকজন থাকায় কিছু বলতে পারলোনা সে তাকে।
বনহুর তখন ভেবেছিলো, এলিনা তাকে নিজে এসেছে দাওয়াৎ করবে। কাজেই হেসে বলেছিলো সে মিস এলিনা, আপনার জন্মদিনে আমন্ত্রিত হয়ে নিজকে ধন্য মনে করছি।
এলিনা কোনো জবাব দিতে পারেনি সেই মুহূর্তে। বিবর্ণ মলিন হয়েছিলো তার মুখমণ্ডল।
বনহুর বলেছিলো আবার মিস এলিনা, আপনার জন্মদিনে কি উপহার দেবো ভেবে পাচ্ছিনা।
এলিনা হাসবার চেষ্টা করে বলেছিলো তখন আপনার আশীর্বাদ আমার পরম সম্পদ কুমার বাহাদুর।
এরপর এলিনা ফিরে গিয়েছিলো।
সন্ধ্যার পর থেকে নানা রকম লোকজনে ভরে উঠলো মিঃ লারলং এর বাড়িখানা।
ঝকঝকে গাড়ি আর গাড়ি বাড়ির সম্মুখ-পথে ভীড় জমে গেলো এলিনা নিজে সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। আনন্দ আর খুশি ভরা দিনেও এলিনার মুখে হাসি নেই। কেমন যেন একটা বিমর্ষ ভাব এলিনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
বন্ধু-বান্ধব আর বান্ধবী এলিনার কম নেই, সবাই এসেছে তাকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানাতে।
এলিনাকে সকলের সঙ্গে হাতে হাত মিলাচ্ছে।
অনেকেই এলিনার বিমর্ষ মুখোভাব লক্ষ্য করে বলছে হ্যালো মিস এলিনা, তোমাকে আজ বড় ভাবাপন্ন লাগছে, ব্যাপার কি বলতো তো?
এলিনা হেসে বলেছে– শরীরটা আজ বড় কেমন লাগছে।
সেকি এলিনা, শরীর খারাপ? হয়তো প্রশ্ন করেছে তার ক্লাবের কোনো বন্ধু কিংবা বান্ধবী।
এলিনাও প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলেছে।
এমন সময় এলো বনহুর, রাজকুমারের ড্রেস তার শরীরে। অদ্ভুত অপূর্ব সুন্দর লাগছে আজ বনহুরকে।
এলিনা অভিনন্দন জানালো রাজকুমারকে।
কিন্তু এলিনার চোখ দু’টো ছল্ ছল্ করে উঠলো যেন। দৃষ্টি তুলে ভালো করে তাকাতে পারলো না সে রাজকুমারের মুখে।
বান্ধবীরা টিপ্পনী কাটলো এবং বললো–বুঝতে পেরেছি রাজকুমার শুধু তোমার অতিথি নয়, তোমার হৃদয় সিংহাসনের রাজা।
এলিনা সে কথায় কোনো জবাব দিতে পারেনি।
অন্যান্য আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে বনহুর এসে বসলো।
অদূরে ভোলানাথ আজ মুখে একমুখ দাড়ি লাগিয়ে একপাশে চুপটি করে বসেছে।
আর মিঃ লারলং অতিথিদের সমাদর করে বসাচ্ছিলেন।
টেবিলে এখনও খাবার দেওয়া হয়নি।
এলিনার মনের মধ্যে ঝড় বইছে। আর অল্পক্ষণ পরেই রাজকুমারের ঐ সুন্দর মুখখানা বিষাক্ত খাবার ভক্ষণে কালো হয়ে উঠবে। মৃত্যুর করাল ছায়া নেমে আসবে তার সমস্ত দেহে। উঃ! কি সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে আর একটু পরে।
এলিনার মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা দেয়।
বন্ধু-বান্ধবীরা ধরেছে তাকে একটা গান গেয়ে শোনাতে হবে। কিন্তু এলিনার গলা দিয়ে কোনো সুর আজ বের হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও একটা গান গাইতে পারলো না এলিনা।
বনহুর এলিনার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান একটি লকেট এনেছিলেন লকেটটি সে হাতে দিলো এলিনার।
এলিনা লকেটখানা হাতে নিয়ে খুশি হলো অত্যন্ত। কিন্তু পরক্ষণেই লকেট খানা ছুঁড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে এ লকেটখানা নকল। আমাকে নকল লকেট দিয়ে আপনি অপমান করলেন।
শুধু বনহুরই নয় কমথ্যে সকলে এলিনার এই অসৎ ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে গেলো।
মিঃ লারলং লকেটখানা হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে বললেন এ লকেট আসল হীরা দিয়ে তৈরী। কে বলেছে নকল?
এলিনা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–আমি চাইনা ঐ লকেট আপনি চলে যান। চলে যান এখান থেকে।
বনহুর অন্যদিন হলে এলিনার কথায় রাগ করতোনা এখন তার ব্যাপারটা তলিয়ে ভাববার মতো মনের অবস্থা ছিলোনা। বনহুর দারুন অপমানে লজ্জিত হলো, কারণ তার লকেটটা নকল হীরার নয়। সে বহু অর্থ ব্যয় করে এ লকেট সংগ্রহ করে এনেছে।
এলিনার তীব্র কণ্ঠস্বরে বনহুর যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো। মিঃ লারলং এর হাত থেকে লকেটখানা নিয়ে বেরিয়ে গেলো দ্রুত কক্ষ থেকে।
মুহূর্তে কক্ষমধ্যে একটা গুঞ্জনধ্বনি স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
ভোলানাথ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এলো মিঃ লারলং এবং এলিনার পাশে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো সে একি করলে এলিনা ভদ্রলোককে তুমি অপমান করলে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা।
মিঃ লারলং এর মুখে কোনো কথা নেই, সে যেন কাষ্ঠ পুতুলের মত নির্বাক হয়ে গেছে।
এলিনা আর দাঁড়াতে পারে না, ছুটে চলে যায় নিজের কক্ষে। সশব্দে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদে। ফুলে ফুলে কাঁদে এলিনা। রাজকুমারকে কেনো সে এভাবে অপমান করলো আর কেউ না বুঝুক সে জানে। তাকে এ ভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কত বড় সাংঘাতিক একটা কারণ রয়েছে। মূল্যবান লকেটখানাকে কেন সে নকল বলে। উপেক্ষা করলো। কেন কেন সে আজ রাজকুমারের প্রতি এমন কুৎসিৎ আচরণ করলো। কেউ না জানুক তার মন জানে, রাজকুমারকে সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার আর যে কোনো। পথ সে খুঁজে পাচ্ছিলোনা।
কিন্তু রাজকুমার কি মনে করলো! ছিঃ ছিঃ তার আচরণে সে মনে কত বড় আঘাত পেয়েছে কি করে বোঝাবে তখন সে যা বলেছে তা সত্য নয়। মিথ্যা মিথ্যা অভিনয় করেছে সে। তার সঙ্গে। অতোগুলি গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে যা বললো যা সে করলো, সেটা কি কোনো মানুষের কাজ হয়েছে। লোকজনই বা কি মনে করলো, রাজকুমার তখন তাদের সম্মুখ মাটিতে মিশে যাচ্ছিলো যেন।
এলিনা যতই ভাবে ততই তার অশ্রু বাধা মানেনা, কেমন করে রাজকুমারকে বুঝিয়ে বলবে ব্যাপারটা। আর বলবেই বা কি করে সে সুযোগ কই।
আজকের এই আয়োজন এভাবে পন্ড হয়ে যাওয়ায় ভোলানাথ ও মিঃ লারলং অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লো। রাজকুমারের জীবন নাশ করতে না পারায় ক্ষেপে উঠলো যেন তারা।
সেদিন উৎসব শেষ হলো বটে কিন্তু উৎসবে কোনো জৌলুস বা আনন্দ ছিলোনা।
বনহুর কক্ষে ফিরে এসে ক্ষিপ্তের ন্যায় পায়চারী শুরু করলো। এলিনার অসৎ ব্যবহার তাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করে দিয়েছে। আসল হীরক লকেট এলিনা ওভাবে নকল বলে ছুঁড়ে ফেলে দেবার কারণ কি? তবে কি লোকজনের মধ্যে তাকে এইভাবে অপমান করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো? কিন্তু তাকে এভাবে অপমান করে এলিনার লাভ কি?
বনহুর সেদিন কিছুতেই ঘুমাতে পারলোনা। গোটা রাত তার কেটে গেলো অনিদ্রায়।
গভীর রাতে রেলিং এর পাশে এসে দাঁড়ালো বনহুর।
সমস্ত শহর সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে।
আকাশে অসংখ্য তারার মেলা।
বাতাস বইছে এলোমেলো, কোনো সূদূর জঙ্গল থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ।
বনহুর রেলিংএ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে।
হঠাৎ অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে। অন্যমনস্কভাবে সে চিন্তা করছিলো পাশে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে চমকে ফিরে তাকালো গম্ভীর কণ্ঠে বললো–কে?
আমি।
মিস এলিনা আপনি!
হাঁ। আমাকে আপনি ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন কুমার বাহাদুর আমি আপনাকে ইচ্ছা করে অপমান করিনি।
বনহুর তার হাতের অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা দূরে নিক্ষেপ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
এলিনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অন্ধকার হলেও বনহুর অনুভব করতে পারছে তার চোখের পানি অঝোরে ঝরে পড়ছে।
বনহুর কোনো কথা বলেনা সে বুঝতে পেরেছিলো এলিনা নিজের ভুল স্মরণ করে এসেছে তার কাছে ক্ষমা চাইতে। বনহুর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো এবার মিস এলিনা আমি আপনাদের ভাড়াটিয়া। আমার সঙ্গে আপনাদের কোনো সম্বন্ধ নেই। অযথা আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে–
কুমার বাহাদুর সে কথা বলতেই আমি আজ এসেছি। আমাকে আপনি ক্ষমা করুন বা না করুন আপনি চলে যান, চলে যান কুমার বাহাদুর। আর একটি দিন আপনি এখানে থাকবেন না। চলে যান এ শহর ছেড়ে–
বনহুর এমনি একটা সন্দেহ করেছিলো এলিনার সেই ক্ষণটির আচরণের পিছনে কোন ইংগিৎ ছিলো। এবার বনহুর তীক্ষ্ণ-দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এলিনার মুখের দিকে। অন্ধকারে চচ করে উঠে বনহুরের গভীর নীল চোখ দুটি।
এলিনা বলে চলেছে কুমার বাহাদুর, আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে; আপনি পালিয়ে যান। আপনি পালিয়ে যান এ শহর থেকে–
এলিনার মাথাটা নুয়ে আসে বনহুরের বুকে।
বনহুর পারেনা এলিনাকে দূরে সরিয়ে দিতে। হাত দিয়ে এলিনার চোখের পানির মুছিয়ে দিয়ে বলে আবার বনহুর মিস এলিনা আমি চলে যাবো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনি–
কুমার বাহাদুর, আমাকে আপনি নিয়ে যেতে পারেন না? এ পাপ পুরিতে আমি আর থাকতে পারছি না! অসহ্য কুমার বাহাদুর কি অসহ্য যাতনা বুকে নিয়ে আমি বেঁচে আছি, কি বলবো আপনাকে।
মিস এলিনা আপনি বেশি উত্তেজিত হচ্ছেন।
না, আমি যা বলছি সব সত্য। আমার বাবা হয়ে আমাকে কুৎসিৎ পথ অবলম্বন করাবার জন্য আগ্রহশীল। আপনি জানেন না কুমার বাহাদুর আমি কত সাবধানে নিজকে রক্ষা করে চলেছি। কিন্তু আর পিরবো না, আর পারবো না আমি নিজকে বাঁচাতে। অর্থের লালসায় আমার বাবা আমাকে আলটা মডার্ণ মেয়ে করে গড়ে তুলেছে কিন্তু আমার অন্তরটা সত্যি সত্যি আলটা মডার্ণ নয়। আমি চাই সাধারণ মেয়েদের মত সুন্দর সুষ্ঠু একটি জীবন। স্বামী সংসার সন্তান–
মিস এলিনা আপনি—
আমাকে বলতে দিন কুমার বাহাদুর। বলে যদি একটু শান্তি পাই। জানি আপনি আমার চেয়ে অনেক উঁচুতে, তবু এইটুকু আমার অনুরোধ আমাকে আপনি দয়া করে দূরে কোনো দেশে নিয়ে যান। যেখানে আমি একটু নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটাতে পারবো।
বনহুর এলিনার কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না।
এলিনা বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কেঁদে উঠে।
পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বনহুর। এলিনার চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠে বনহুরের জামার আস্তিন।
*
ভোরে ঘুম ভাঙতেই বাবুর্চি ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এলো বনহুরের কক্ষে হুজুর, হুজুর, খুন–খুন–
বনহুরের কানে খু শব্দটা প্রবেশ করতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো বিছানায় খুন!
হাঁ, হুজুর,দিদিমণি খুন হয়েছে।
মিস এলিনা খুন হয়েছে! বলো কি?
বনহুর দ্রুত শয্যা ত্যাগ করে স্লিপিং গাউনের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নীচে।
মিস এলিনার কক্ষের দরজায় চাকর-বাকরদের ভীড় জমে গেছে।
মিঃ লারলং যৌথ মাথায় আঘাত করে বিলাপ করছেন। তার চুল গুলো এলোমেলো টেনে ছিঁড়ছেন ভদ্রলোক তাঁর নিজের মাথার চুল।
বনহুর ভীড় ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করলো।
বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখলো বনহুর শয্যায় ছিন্ন লতার মত এলিয়ে পড়ে আছে। এলিনা। সাদা ধপধপে বিছানার চাদরে জমাট বেঁধে আছে চাপ চাপ রক্ত।
বনহুর স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার কানের কাছে যেন শুনতে পেলো এলিনার কণ্ঠস্বর–কুমার বাহাদুর আপনি আর একটি দিন এখানে থাকবেন না। চলে যান, চলে যান, এখান থেকে চলে যান–আপনার হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। আপনি পালিয়ে যান, দূরে অনেক দূরে–আমাকে আপনি নিয়ে যেতে পারেন না সঙ্গে করে– এ পাপ পুরিতে আমি আর থাকতে পারছি না। অসহ্য কুমার বাহাদুর কি অসহ্য যাতনা বুকে নিয়ে আমি বেঁচে আছি কি বলবো আপনাকে–
নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় বনহুর নিজের কানে মিস এলিনা আপনি বেশি উত্তেজিত হচ্ছেন–
এলিনার কন্ঠ–না আমি যা বলছি সব সত্য। আমার বাবা হয়ে আমাকে কুৎসিৎ পথ অবলম্বন করাবার জন্য আগ্রহশীল। আপনি জানেন না কুমার বাহাদুর আমি কত সাবধানে নিজেকে রক্ষা করে চলেছি–বনহুর এবার অস্ফুট কণ্ঠে বললো মিস এলিনা আর নিজকে রক্ষা করতে পারলো না।
বনহুরের কাঁধে হাত রাখলো এক ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন কুমার বাহাদুর এলিন শেষ। পর্যন্ত নিজকে রক্ষা করতে পারলো না।
বনহুর অবাক হয়ে তাকালো ভদ্রলোকের মুখের দিকে। ইতিপূর্বে বনহুর তাকে আর একবার মাত্র দেখেছিলো এলিনার জন্ম উৎসবে। মুখে চাপ দাড়ি চোখে কালো চশমা মাথায় ক্যাপ ঠোঁটের ফাঁকে মোটা চুরুট।
বনহুর লোকটার আপাদমস্তক নিপুণ দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করে নিলো। তারপর বেরিয়ে যাচ্ছিলো কক্ষ থেকে।
ভদ্রলোক বনহুরের পথ রোধ করে দাঁড়ালো এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন কেনো। আর একটু দাঁড়ান।
বনহুর কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো লোকটার পাশ কেটে।
বনহুরের কানে ভেসে এলো একটা হাসির শব্দ পিছন থেকে।
নিজ কক্ষে প্রবেশ করতেই বনহুর দেখতে পেলো রহমান তার জন্য অপেক্ষা করছে।
বনহুরকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে বললো সে –সর্দার মিস এলিনা নাকি খুন হয়েছে?
হাঁ রহমান। তুমি কার কাছে শুনলে খবরটা?
বাবুর্চির কাছে। কিন্তু মিস এলিনা হঠাৎ খুন হবার কারণ বুঝতে পারছি না সর্দার?
বনহুর একটা সোফায় বসে পড়লো, তারপর ব্যথিত কণ্ঠে বললো–রহমান আমিই। এলিনার মৃত্যুর কারণ।
সর্দার।
হাঁ রহমান। নূরী নিজের জীবন দিয়ে আমাকে রক্ষা করে গেছে। এলিনাও বাঁচাতে চেয়েছে আমাকে। আমাকে বাঁচাতে চেয়েই সে নিজকে হারালো।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার কথা?
সব শুনলেই বুঝতে পারবে। শোন তবে–বনহুর গত রাতের সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করলো রহমানের কাছে।
সব শুনে রহমানের মুখমন্ডল বিবর্ণ হলো, ভীত কণ্ঠে বললো রহমান–সর্দার, আর একটি দিনও আমি আপনাকে এখানে থাকতে দিতে পারিনা।
কিন্তু এলিনার হত্যাকারীর সন্ধান না নিয়ে তো আমি যেতে পারিনা রহমান। এলিনা আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিলো দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠে বনহুর এলিনার বুকে যে ছোরা বসিয়ে দিয়েছে আমি তার বুকের রক্ত নিতে চাই–
রহমান বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। কতদিন পর আজ সর্দারকে তার স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসাতে দেখে মনে মনে খুশিই হলো সে। নূরীর মৃত্যু সর্দারকে উন্মাদ উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিলো। নূরীর শোকে এতোই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলো যে নূরীর হত্যাকারীর প্রতিশোধ নেওয়ার কথাও তার অন্তরে দানা বাঁধেনি। আজ এলিনার মৃত্যু তাকে পুনঃ সম্বিৎ দানে সক্ষম হলো।
বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হলো রহমান, আমি এলিনার হত্যাকারীর টুটি ছিঁড়ে ফেলবো, তারপর আমার স্বস্তি।
সর্দার, আপনি এখন স্বাভাবিক নন, এমত অবস্থায় কি করে আপনি এলিনার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবেন?
আমাকে করতেই হবে–বনহুরের দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
সেদিন রহমান কিছুতেই বনহুরকে ছেড়ে তার বাড়িতে ফিরে গেলোনা। রয়ে গেলো সে এ বাড়িতে।
কিন্তু বনহুর ক্রুদ্ধ হলো যখন সে জানতে পারলো রহমান এ বাড়িতে রয়ে গেছে। রহমানকে ডেকে বললো এক সময় রহমান তোমার কাজে তুমি চলে যাও। আমার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।
সর্দার, আজকের দিনটা আমাকে এখানে থাকতে অনুমতি দিন।
সম্ভব নয়, তুমি যাও।
রহমান এরপর আর কোনো কথা বলতে পারলো না, চলে গেলো সে।
রহমান আর বনহুর যখন কথা হচ্ছিলো ঠিক তখন ওদিকের জানালার পাশ থেকে সরে গেলো একটি মুখ। সে মুখে হিংস্র পৈশাচিক নরহত্যাকারীর কঠিন ভাব ফুটে আছে। চোখ দুটিতে প্রতিহিংসার আগুন যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
বনহুর না দেখলেও রহমান চলে যাওয়ার সময় অনুমান করলো, কেউ যেন সন্তর্পণে সরে গেলো পাশ থেকে। রহমান সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে। পরক্ষণেই শোনা গেলো তার টাঙ্গী চালানোর শব্দ।
এলিনার মৃতদেহ মরগে পাঠানোর ব্যবস্থা করে পুলিশ চলে গেলো। ধীরে ধীরে দিনের আলো নিভে রাতের অন্ধকার নেমে এলো পৃথিবীর বুকে।
বনহুর নিজের ঘরে পায়চারী করছে। গভীর চিন্তারেখা ফুটে উঠেছে তার ললাটে। দক্ষিণ হস্তের আঙ্গুলে ধুমায়িত সিগারেট।
সমস্ত বাড়ি খানা নিস্তব্ধতায় ভরে উঠেছে।
রাত দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়েছে।
বনহুর কার যেন প্রতিক্ষা করছে বলে মনে হলো।
বার বার তাকাচ্ছে সে দরজার দিকে।
সন্ধ্যায় বনহুর যখন চা পান করছিলো তখন একটি বালক এসে তার হাতে একখানা চিঠি দিয়ে যায়। চিঠিখানা এখনও পকেটে অবস্থান করছে।
বনহুর পায়চারী বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্পের পাশে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যায় পাওয়া চিঠিখানা বের করে মেলে ধরলো আলোর সামনে “রাত্রি আড়াই ঘটিকায় আসবো মোলাকাত হবে।
–অজ্ঞাত বন্ধু”।
বনহুর তাই দরজা খুলে প্রতিক্ষা করছিলো তার অজ্ঞাত বন্ধুর। চিঠিখানা পড়ে নিয়ে পকেটে রাখতেই বনহুর নিজের পিঠে শক্ত ঠান্ডা হিম শীতল একটা কোনো বস্তুর অস্তিত্ব অনুভব করলো।
ফিরে তাকাতেই দেখলো উদ্যত রিভলভার হস্তে মুখোস-পরা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে।
বনহুর একটুও ভড়কালো না বা চমকালো না, স্বাভাবিক সচ্ছ কণ্ঠে বললো তুমি ঠিক তোমার কথা অনুযায়ী আসতে পারোনি অজ্ঞাত বন্ধু। কয়েক মিনিট বিলম্ব হয়ে গেছে।
অজ্ঞাত বন্ধু এবার কথা বললো–কয়েক মিনিট বেশি বাঁচতে পারলে। একটা তোমার ভাগ্য।
সেজন্য আমি নিজকে গৌরবান্বিত মনে করছি অজ্ঞাত বন্ধু। কিন্তু আগমণের কারণ জানতে পারি কি?
নিশ্চয়ই পারো।
তবে বলো বন্ধু?
বনহুরের কথায় মুখোসের মধ্যে অজ্ঞাত বন্ধুর চোখ দুটো চক চক্ করে উঠলো, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে সে বোঝা গেলো তার নিশ্বাসের শব্দে।
বনহুর আবার বললো কি চাও বন্ধু বলো জীবন না অর্থ?
জীবন।
হাঃ হাঃ হাঃ লক্ষ টাকার বিনিময়ে আমার জীবন নিতে এসেছো তুমি, কিন্তু আমি যদি তোমাকে লক্ষ টাকা দেই?
মুখোস-পরা লোকটা বনহুরের হাসির শব্দে বোধ হয় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলো, বনহুর দরজার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো–রহমান তুমি অসময়ে?
মুহূর্তের জন্য মুখোস-পরা লোকটা ফিরে তাকালো।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর তার হাত থেকে রিভলভারখানা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে চেপে ধরলো। ওর বুকে–খবরদার একটুও নড়বেনা।
মুখোস-পরা লোকটা ধীরে ধীরে হাত তুলে দাঁড়ালো, বনহুর দক্ষিণ হাতে লোকটার মুখের আবরণ টেনে খুলে ফেললো।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো–মিঃ লারলং আপনি!
লারলং এর চোখ দুটো ধক ধক্ করে জ্বলে উঠলো কোনো কথা বললো না।
বনহুর বললো–আমি ভেবেছিলাম আর একজনকে কিন্তু আপনি? বলুন মিঃ লারলং যৌথ নিশ্চয়ই আপনি ভাড়ার জন্য এসেছিলেন, তাই নয় কি? কিন্তু এতো রাতে ভাড়ার তাগাদায় আপনার নিজের আসা উচিৎ হয়নি। কারণ গত রাতেই আপনার কন্যার মৃত্যু ঘটেছে সে মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। কাজেই আপনার কন্যার অশরীরি আত্মা আপনার বাড়ির আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে তাকে হত্যা করেছে, তার টুটি ছিঁড়ে নেবে সে।
বনহুরের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলি উচ্চারণ করলো সে। পর মুহূর্তেই বনহুরের দক্ষিণ হস্তের রিভলভার মিঃ লারলং এর বুকে এসে ঠেকলো, কঠিন কণ্ঠে বললো সেমিঃ যৌথ, আপনার কন্যার হত্যাকারী কে নিশ্চয়ই আপনি জানেন, এবং বলতে হবে কে সে?
আমি জানি না।
আপনার কন্যার হত্যাকারী তা হলে আপনি নিজে?
বলবো না।
বলতে হবে মিঃ লারলং?
যদি না বলি?
হত্যা করবো।
আপনি হত্যা করবেন আমাকে? আমার বাড়িতে বসে আপনি আমাকে হত্যার হুমকি দেখাচ্ছেন কুমার বাহাদুর।
হুমকি নয় সত্যিই আপনাকে আমি হত্যা করবো এবং এই দন্ডে আমি তিনবার আপনাকে অনুরোধ করবো। তার পরই আপনার প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়বে ধুলায়। বলুন, কে আপনার কন্যাকে হত্যা করেছে বলুন? বলুন?
দাঁড়ান দাঁড়ান বলছি–বলছি আমি–কিন্তু–
বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠবার পূর্বেই মিঃ লারলং এর রক্তাক্ত দেহ মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো বনহুরের পায়ের কাছে।
বিস্মিত বনহুর ফিরে তাকাবার পূর্বেই কয়েকজন মুখোস পরা লোক উদ্যত পিস্তল হস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো।
প্রায় বিশ-পঁচিশ জন পিস্তলধারী লোক একসঙ্গে বনহুরের দেহ লক্ষ করে তাদের অস্ত্র বাগিয়ে ধরেছে।
বনহুর এভাবে কোনো দিন বিপদে পড়ে নাই।
বাধ্যহলো সে নিজ হস্তের রিভলভার ফেলে দিতে। মুখোস পরা লোকগুলির মধ্যে হতে এগিয়ে এলো একজন বনহুরের সম্মুখে। দাঁতে দাঁত পিষে বললো লোকটা আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে তুমি বাঁচবে মনে করেছো? আমি তোমার বুকের হাড়গুলি টেনে ছিঁড়ে বের করে নেবো।
বনহুর অবাক কণ্ঠে বললো–তোমার মুখের গ্রাস আমি কেড়ে নিয়েছি?
হাঁ, মনে নেই আরাকান জঙ্গলের কথা?
বনহুরের মনের আকাশে ভেসে উঠলো নূরীর মুখখানা তবে কি এই সেই ব্যক্তি যে তার নূরীকে হত্যা করেছে!
বনহুরকে চিন্তা করতে দেখে বলে উঠে মুখোস-পরা লোকটা মনে পড়েছে আমার শিকার তুমি ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলে?
হাঁ মনে পড়েছে। কিন্তু তাকে আমি তোমার কাছ হতে কেড়ে নেই নি। তুমি তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। বনহুর হারিয়ে ফেলে তার স্বাভাবিক জ্ঞান, ভুলে যায় তার চার পাশে অসংখ্য পিস্তলধারী উদ্যত পিস্তল হস্তে দাঁড়িয়ে। চেপে ধরে বনহুর মুখোসধারীর গলা বলো শয়তান কে তুমি? প্রচন্ড এক ঘুষি লাগিয়ে দেয় ওর মুখে।
লোকটার মুখের মুখোস খসে পড়ে বনহুর অবাক হয়ে দেখে এই সেই লোক যাকে এলিনার জন্মদিনে মিঃ লারলং যৌথের পাশে বসে গল্প করতে দেখেছিলো আর দেখেছিলো এলিনার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো—“ঠিকই বলেছেন কুমার বাহাদুর এলিনা শেষ পর্যন্ত নিজকে রক্ষা করতে পারলোনা।” বনহুর বুঝতে পারলো এ যে হোক তার নূরীকে হত্যা করেছে। নূরীকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেছিলো এই শয়তান। বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো তার দিকে।
বন্দী সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলো নরপিশাচ তুমি শুধু নূরীর হত্যাকারীই নও, তুমি মিস এলিনাকেও হত্যা করেছে।
হাঁ, আমিই তোমার অজ্ঞাত বন্ধু কিন্তু আমি মিঃ যৌথকে দিয়ে তোমার মন পরীক্ষা করে দেখছিলাম। তুমি কম সুচতুর নও কিন্তু তোমার চেয়ে আমি অনেক বেশি বুদ্ধি রাখি।
তা তো তোমার কার্যকলাপে বুঝতে পারছি। তুমি আমার পূজনীয়। আমার নূরীর জীবন প্রদীপ তোমার হস্তে নিভে গেছে। তোমাকে আমি অতিকষ্টে নিজকে সামলে নিলো বনহুর।
মুখোসধারী নিজের দাড়ি-গোফ জোড়া খুলে ফেললো আমার নাম তুমি জানোনা কুমার বাহাদুর আমিই আরাকান সর্বশ্রেষ্ঠ ডাকু ভোলানাথ।
শুধু ভোলানাথ নই, আমি তোমার নূরীকে হত্যা করেছি; এলিনার বুকে ছোরা বসিয়ে দিয়েছি, যৌথের বুকে গুলী বিদ্ধ করে তার কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছি, এবার তোমার বুকের রক্ত শুষে নেবো কুমার
ভোলানাথের কথা শেষ হয় না, আরাকানের পুলিশবাহিনী সহ কক্ষে প্রবেশ করে রহমান।
ইন্সপেক্টার কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেন–হ্যান্ডস্ আপ।
মুহূর্তে কক্ষমধ্যে যেন একটা বজ্রপাত হয়, ভোলানাথ ও তার সঙ্গীগণের মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে উঠে। একটি শব্দ কারো মুখ দিয়ে বের হয়না।
বনহুরের মুখমন্ডলহাস্য-উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ইন্সপেক্টারের আদেশে পুলিশবাহিনী ভোলানাথ ও তার দলবলের হাতে হাত কড়া পরিয়ে দিলো।
দুজন পুলিশ ভোলানাথের দলের হাতের পিস্তলগুলি নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে রাখলো।
ইন্সপেক্টার রহমানকে রক্ষা করে বললেন রহমান, তোমার বুদ্ধি বলে আজ আমরা ডাকু ভোলানাথ ও তার দলবলকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলাম। এই শয়তানদের জন্য আরাকান শহরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। পথেঘাটে সদা-সর্বদা রাহাজানি নারী-হরণ, চুরি ডাকাতি লেগেই থাকতো। আজ শয়তান ভোলানাথের মুখে নিজ কানে শুনেছি সে শুধু ডাকুই নয়, পর পর কয়েকটা নরহত্যা সে করেছে। কাজেই বিচারে মৃত্যুদন্ড তার সুনিশ্চিত। তারপর বনহুরের দিকে হাত বাড়ালেন ইন্সপেক্টার কুমার বাহাদুর, আপনাকে ঠিক সময় উদ্ধার করতে পেরেছি সে জন্য আনন্দ বোধ করছি।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–ইন্সপেক্টার, আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ রইলাম।
হেসে বললেন ইন্সপেক্টার–আপনার ভত্য রহমান মিয়াই প্রথমে ধন্যবাদের পাত্র। আমি সরকারের তরফ থেকে তার মোটা বখশীসের ব্যবস্থা করে দেবো।
বনহুর আর রহমান একবার দৃষ্টি বিনিময় করলো।
রহমান বিনীত কণ্ঠে বললো –শুকরিয়া ইন্সপেক্টার সাহেব।
পুলিশবাহিনী মিঃ লারলং যৌথের লাশ পোষ্টমর্টেমের জন্য মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে বিদায় গ্রহণ করলেন।
সবাই বিদায় গ্রহণ করার পর বনহুর রহমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে। উঠে আজ তোমার কাছে আমার পরাজয়। রহমান।
সর্দার, এ আপনি কি বলছেন।
হাঁ রহমান। তোমার কাছে আজ আমি নতি স্বীকার করছি।
দস্যু বনহুর এই প্রথম কোনো ব্যক্তির কাছে নিজ মুখে কথাটা উচ্চারণ করলো।
রহমানের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো ফোঁটা ফোঁটা আনন্দ অশ্রু।
*
মুখ ভার করে বসেছিলো মনি।
সম্মুখে ছড়ানো নানা রকম খেলনা। পুতুল, ঘোড়া, মোটর গাড়ি, চাবি দেওয়া রেলগাড়ি, ফুলঝাড়, বাঁশি, আরও কত রকম খেলনায় ভরে উঠেছে টেবিলটা। শুধু খেলনাই নয়, নানা রকমের খাবার –বিস্কুট, লজেন্স, চকলেট, সন্দেশ আরও কত কি। কিন্তু মনি কিছুই হাতে ধরছে না বা মুখে দিচ্ছে না।
চোখ দুটো ছলছল করছে ওর।
মনিরা আঁচলে মনির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো–একটু দুধ খাও বাবা।
না, আমি কিছু খাবো না। আগে আমার বাপি আর মাম্মিকে এনে দাও।
মরিয়ম বেগম হেসে বললেন–দাদু, এইতো মাম্মি। তোমার মাম্মিকে চিনতে পারছো না?
না, আমার মাম্মি নয়। আমার বাপি মাম্মিকে নিয়ে গেছে। আমাকে আমার বাপি আর মাম্মির কাছে নিয়ে চলো।
মনিরা দুধের গেলাস টেবিলে রেখে দু’হাতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে উঃ আমি আমি পারবো না মামীমা, আমি পারবো না আর সহ্য করতে। ওকে পাঠিয়ে দাও ওকে পাঠিয়ে দাও ওর বাপি আর মাম্মির কাছে। আমি ওর কেউ নই, আমি ওর কেউ নই।
মরিয়ম বেগম মনিকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলেন–দাদু তুই জানি না কে তোর মাম্মি? দেখছিস না তোর জন্য মা কাঁদছে?
মরিয়ম বেগমের কথায় মনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো মনিরার দিকে। আবার বললেন মরিয়ম বেগম নূর–লক্ষ্মী ছেলে–
মনি গম্ভীর গলায় বলে উঠলো–আমার নাম নূর নয়। আমি মনি।
বেশ, তুমি মনি। তোমাকে মনি বলেই ডাকবো। তাহলে দুধটুকু খেয়ে নাও? লক্ষী দাদু আমার। তারপর মনিরাকে লক্ষ্য করে বললেন মরিয়ম বেগম–দাও মা, তোমার মনিকে দুধ দাও।
মনিরা আঁচলে অশ্রু মুছে টেবিল থেকে দুধের গেলাসটা তুলে নিয়ে মনির দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
মনি লক্ষ্মী ছেলের মতো এবার দুধটুকু এক নিশ্বাসে খেয়ে গেলাসটা মায়ের হাতে ফিরিয়ে দিলো।
মরিয়ম বেগম বললেন–মনি বলো তো দাদু তোমার মাম্মি কে?
আমার মাম্মি এখানে নেই।
ঐতো তোমার মাম্মি, বলো বলো মাম্মি?
না, ও আমার মাম্মি নয়। আমার মাম্মি খুব ভাল।
মনিরা বললো এবার আর আমি বুঝি ভাল নই?
ছিঃ ও কথা বলতে নেই দাদু! তুমি তো এই মায়ের পেটে ছিলে। ওর কাছেই বড় হয়েছে?
না, আমি মাম্মির কাছে বড় হয়েছি। আমার মাম্মির কাছে আমি যাবো।
মনিরা রাগত কণ্ঠে বললো–দেখলে, দেখলে মামীমা। আমার নূরকে সেই রাক্ষসী কেমন করে পর করে দিয়েছে।
সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে মা।
মনিকে বুকে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলেন মরিয়ম বেগম–তোমার মাম্মি আছে, আবার আসবে। এখন মার কাছে যাও। ও তোমার মা।
মনি তাকিয়ে থাকে, কোনো কথা বলেনা।
মনিরার বুক ফেটে কান্না আসে, দ্রুত বেরিয়ে যায় সে কক্ষ থেকে।
মরিয়ম বেগম নানাভাবে মনিকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। এখন মনি আগের মতো ছোট্টটি নেই, সবাইকে চিনবার মতো তার শক্তি হয়েছে। আর একবার যখন মনিকে খুঁজে পেয়েছিলো মনিরা তখন সে ছিলো ছোট্ট কচি বাচ্চা। তাই সে কোনো দিন মনিরাকে মা বলতে ভুল করেনি।
এবার মনি কিছুতেই মনিরাকে মা বা মাম্মি বলতে পারছিলো না। একটা সংঙ্কোচ তার কচি মনে বাধার সৃষ্টি করছিলো।
মা ও ছেলের মধ্যে এসেছিলো একটা বিরাটা ব্যবধান। মনিরা মনিকে যতই বুকে আঁকড়ে ধরতে যায় ততই মনি নিজকে সরিয়ে নেয় দূরে।
কিন্তু মরিয়ম বেগমকে মনি ভালবাসেন সেই অপরিচিত জায়গায় পরিচিত কাউকে না পেয়ে তাকেই সে অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করেছে। মরিয়ম বেগমের কাছে থাকে সে। মরিয়ম বেগমের পাশে ঘুমায়।
মনিরা ব্যথা ভরা বুকে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে। দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মরিয়ম বেগম মনিরাকে নির্জনে নিয়ে বুঝান মা, সন্তানকে ফিরে পেয়েছিস সেইতো তোর ভাগ্য। একদিন ওর মনের ভ্রম ভেঙে যাবে। তুই মা–বুঝতে পারবে সে।
কিন্তু আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না মামীমা।
দুঃখ করিসনে। তুই তবু ফিরে পেলি তোর নয়নের মনিকে। আর আমি–আমার দিকে তাকিয়ে দেখতে এই বুকটা আমার জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কি আগুন আমি পেটে ধরেছিলাম যার জ্বালায় আমি জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলাম–
মা! মাগো।
হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বরে এক সঙ্গে চমকে উঠলো মরিময় বেগম আর মনিরা। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মুহূর্তে তাদের মুখমন্ডল।
দরজায় দাঁড়িয়ে বনহুর।
মরিয়ম বেগম অস্কুট ধ্বনি করে উঠলেন মনির! বাবা তুই এসেছিস!
মা! বনহুর ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো–তুমি ভাল আছো মা? তারপর মনিরার দিকে। ফিরে তাকিয়ে বললো–তুমি কেমন আছো মনিরা?
মনিরার চোখ দুটো অশ্রু ছল ছল হলো, অভিমানে মুখ ভার করে বললো–ভালো আছি।
বনহুর শয্যায় বসে বললো–মা, তোমার হাতে আমাকে এক গেলাস পানি খেতে দাও মা।
বাছা, একি চেহারা হয়েছে তোর? অসুখ করেনি তো?
না মা, অসুখ আমার করেনি।
তবে এমন চেহারা? মরিয়ম বেগম পুত্রের মাথায় মুখে-বুকে হাত বুলিয়ে দেন। তারপর বলেন–আমি তোর জন্য পানি আনছি আবার যেন পালিয়ে যাস নে।
আর পালাবো না মা। এখন থেকে আমি সব সময় তোমাদের কাছে থাকবো।
সত্যি বলছিস বাবা?
হাঁ, দেখো আর আমি যাবোনা।
মরিয়ম বেগমের অন্তরে একটা শান্তির ধারা বয়ে গেলো। তিনি খুশি মনে বেরিয়ে গেলেন তার মনিরের জন্য পানি আনতে। শুধু পানি নিয়েই ফিরবেন না, খাবারও আনবেন নিজ হাতে তৈরী করে।
স্বামীর সাদর সম্ভাষণের প্রতিক্ষা করছিলো মনিরা। ক্ষুব্ধ অন্তর তার লালায়িত হয়ে উঠেছিলো স্বামীর আবেগ-ভরা বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্য। কিন্তু আজ মনিরাকে বিফল হতে হলো।
বনহুর অন্যমনস্কভাবে কি যেন ভাবছে।
মনিরা ব্যথা পেলো, এমন তো কোনোদিন হয়নি। মনিরা ভেবেছিলো তার স্বামী মাকে পানি আনবার কথা বলে সুযোগ খুঁজছিলো হয়তো মনিরাকে কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সে কিন্তু মা চলে যাবার পর স্বামীর মধ্যে যখন একটা আনমনা ভাব লক্ষ্য করলো, তখন তো কোনো দিন তাকে দেখে নি মনিরা।
মনিরা আর দাঁড়াতে পারলো না, বেরিয়ে গেলো কক্ষ হতে। পুত্র মনির ব্যবহারেই মনিরা সর্বান্তকরণে মুষড়ে পড়েছিলো। আবার স্বামীর এই দারুণ উপক্ষোয় ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা হলো তার। মনিরা বেরিয়ে গেলো নিজের কক্ষে–বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মনিরা যখন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় তখন বনহুর একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলো, পরক্ষণেই ডাকে–মনিরা। মনিরা–
কিন্তু মনিরা তখন কোথায়–নিজের ঘরে বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে ফুপে ফুপে কাঁদছে।
মরিয়ম বেগম নাস্তার থালা আর গেলাস ভরা ঠান্ডা পানি নিয়ে আসেন। কক্ষে প্রবেশ করে মনিরাকে না দেখে বলেন–মা মনিরা মনিরা। কথার ফাঁকে টেবিলে খাবার প্লেট রেখে বলেন –মনিরা গেলো কোথায় একটু খাওয়াবে।
বনহুর কোনো কথা না বলে পানির গেলাসটা হাতে তুলে এক নিশ্বাসে ঠান্ডা পানি পান করে গেলাস নামিয়ে রাখলো।
মরিয়ম বেগম বললেন–সেকি বাবা,শুধু পানি খেলি?
হাঁ মা, বড় পিপাসা। বড় পিপাসা—
মনিরা গেলো কোথায়?
চলে গেছে।
মনিরা চলে গেছে–কোথায় গেলো? বাবা তুই খা, একটু মুখে দে।
বনহুর মায়ের কথায় খাবার না খেয়েই বললো–মনি, কোথায় মা? কেমন আছে?
মনি ভালই আছে। সরকার সাহেবের সঙ্গে একটু বাইরে গেছে। তুই খেয়ে নে বাবা।
ক্ষুধা নেই মা, এখন কিছু খাবো না।
*
আচ্ছা, তোমার কি হয়েছে বলো তো? কোনো দিন তো অমন ছিলে না? স্বামীর ভাবাপন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
বনহুর আনমনে বসেছিলো জানালার পাশে। মনিরার কথায় চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। কোনো কথা বললো না সে।
মনিরা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো আবার –মনি আমাকে চিনতে পারো না। তুমিও কেমন হয়ে গেছো! আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো–অমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো বলো?
মনিরার গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত অশ্রু।
বনহুর আবার মুক্ত জানালা দিয়ে তাকায় দূরে–অনেক দূরে বেলা শেষের সূর্য যেখানে অস্তমিত হচ্ছে।
স্বামীর এই উদাসীন ভাব মনিরার অন্তরে শেল বিদ্ধ করে চলেছে। আজ কদিন হলো এসেছে বনহুর কিন্তু একটিবার সে প্রাণ খুলে হাসে নি। সচ্ছ মনে কথা বলেনি মনিরার সঙ্গে। মনিরা লক্ষ্য করেছে তার স্বামী নির্জনে বসে সব সময় কি যেন ভাবে। কারো পদশব্দে যেন চমকে উঠে, মনিরা পাশে থাকলে মুখভাব গম্ভীর হয়।
মনিরা সব সহ্য করে এসেছে–শুধু তার স্বামীর হাস্য-উজ্জ্বল মুখ স্মরণ করে আজও বেঁচে আছে সে।
পুত্রের এই আনমনা ভাব মরিয়ম বেগমকেও ভাবিয়ে তোলে আগে তো সে কোনো দিন অমন ছিলো না। সদা চঞ্চল-উচ্ছল স্বভাব ছিলো তার মনিরের। মা পুত্রের চিন্তিত ভাব লক্ষ্য করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন।
সেদিন দ্বিপ্রহরে মরিয়ম বেগম নিজের ঘরে বসে বসে পত্রিকা দেখছিলেন, এমন সময়। কক্ষে প্রবেশ করে মনিরা। চোখে-মুখে একটা বিষণ্ণতার ছাপ।
কক্ষে প্রবেশ করে বলে মনিরা–মামীমা।
কে মনিরা আয় মা আয় কিছু বলবি?
মামীমা, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না, ওর এই উদাসীনতা আমাকে পাগল করে তুলেছে। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না মামীমা–
কি জানি মনিরের কি হয়েছে, আমি নিজেও যে ভেবে উঠতে পারছি না ও তো অমন ছিলো না কোনো দিন–মরিয়ম বেগম কথাগুলো অত্যন্ত ব্যথাপূর্ণভাবে বললেন।
মনিরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
এমন সময় বনহুর মনিকে কোলে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। ডাকলো বনহুর মাকে –মা।
মনিরা তাড়াতাড়ি আঁচলে অশ্রু মুছে নিয়ে সরে বসলো।
বনহুর মনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো–মা, দেখো মনি কি সুন্দর গল্প বলতে শিখেছে।
গল্প? কই দাদু এসোতো শুনি?
মরিয়ম বেগম মনিকে টেনে নিলেন কোলের কাছে। আদর করে বললেন–কই কি শোনাবে এসো।
বনহুর চলে যাচ্ছিলো।
মরিয়ম বেগম পিছু ডাকলেন–বোস তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। আচ্ছা দাদু তোমার গল্প পরে শুনবো, এখন মায়ের সঙ্গে ও ঘরে গিয়ে গল্প করো গে কেমন?
মনি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো।
মনিরা বুঝতে পারলো মামীমা তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ইংগিত করলেন।
মনি এগিয়ে গেলো তার মায়ের পাশে। মনিরা ওকে সঙ্গে করে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।
মরিয়ম বেগম বললেন –বোস আমার কাছে।
বনহুর লক্ষী ছেলের মতো বসে পড়লো মায়ের শয্যায়।
মরিয়ম বেগম এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–মনির তুমি কচি খোকা নও। সব তুমি বোঝ। ছোট বেলায় তোমাকে হারিয়ে আমার অন্তর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন যদি আমাকে সেই আগুন পোহাতে হয়–
ঐ তো পুরোন কথা মা।
কি হয়েছে মনির, আমি তোর মা আমার কাছে লুকোবি না। বল্ কি হয়েছে তোর?
আমার। কই কিছু তো হয়নি?
হয়নি বললেই আমি বিশ্বাস করব? আমি তোর মা আমাকে ছুঁয়ে বল্ তোর কিছু হয়নি?
মা!
মনির তোর উদাসীন ভাব শুধু আমাকেই ভাবিয়ে তোলে নি মনিরার মনে দাহ শুরু করেছে। কত দিন পর বাড়ি ফিরে এসেছিস কই প্রাণ খুলে কোনো দিন তো মনিরার সঙ্গে কথা বললি না? সে তোর স্ত্রী-স্বামীর ভাবাপন্ন ভাব নারীর কি যে যাতনাকর সে তুই বুঝবিনে।
মা আমি সব জানি, সব বুঝি। কিন্তু আমি পারি না প্রাণ খুলে হাসতে কথা বলতে।
কেন! কি হয়েছে তোর?
আমি সব হারিয়েছি মা।
সব হারিয়েছিস তাতে দুঃখ কি। আমার তো কোনো অভাব নেই বাবা। তোর মতো এক গাদা সন্তান যদি আমার বসে বসে খায় তবু কারো কাছে হাত পাততে হবে না।
মা, তুমি বুঝবে না।
তুই কি চাস আমাকে বল আমি তাই দেবো তোকে।
পারবে না মা, পারবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বনহুর।
মরিয়ম বেগম বুঝতে পারে তার সন্তান এমন কিছু হারিয়েছে যা সে আর পাবে না।
বনহুর উঠে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।
মরিয়ম বেগমের কক্ষ থেকে বনহুর বেরিয়ে আসতেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে মনি–বাপি!
আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে দেখছিলো মনিরা।
বনহুর মনিকে কোলে তুলে নেয়।
মবি বলে উঠে–বাপি মা তোমাকে ডাকছে।
মা?
হাঁ, বাপি চলোনা মার কাছে।
বনহুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে মনি মনিরার কক্ষে।
মনিরা গম্ভীর মুখে খাটের পাশে গিয়ে বসেছিলো।
বনহুর আর মনি এসে দাঁড়ায়, মনির হাতের মুঠোয় বনহুরের হাত খানা।
মনি বলে–দেখো মা, আমি বাপিকে ধরে এনেছি।
আজ মনিরার বুক ভরে যায় মনির মুখে মা সম্বোধন তার অন্তরে সুধা বর্ষণ করে।
কদিন থেকে মরিয়ম বেগম মনিকে বুঝিয়ে দিয়েছে মনিরাই তার জননী। ছোট বেলায় তাকে লোকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো, তাই সে জননীর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যাকে সে মাম্মি বলে ডেকেছে সে মা নয় সে মাম্মি তার পালিত মা।
কথাটা মনির অন্তরে রেখাপাত করেছিলো, বাপিকে পেয়ে খুশী হয়েছিলো সে– বলেছিলো তার দাদীমার কথাগুলো সত্যি কি না।
বনহুর বলেছিলো–সব সত্যি। তোমার দাদীমা কি কোনো দিন মিথ্যা বলতে পারেন? আরাকানে যাকে তুমি হারিয়েছো সে তোমার মা নয় মাম্মি। তোমার পালিতা মা।
মনি দাদীমার কথায় যতটা আস্বস্ত হতে পারেনি, বাপির কথায় সে বিশ্বাস করেছিলো মনিরাই তার মা।
শেষ পর্যন্ত মনিরাকে বলেছিলো মনি–তুমি সত্যিই আমার মা?
মনিরা নিজকে প্রকৃতিস্থ রাখতে পরেনি তখন, মনিকে বুকে চেপে ধরে বলেছিলো-বাপ আমার, আমি সত্যিই তোমার মা।
তারপর থেকে মনি’র মন আকৃষ্ট হয়েছিলো মায়ের দিকে।
মনিরা বলেছিলো–আমি তোমায় নূর বলে ডাকবো বাপ। আমার ডাকে সাড়া দেবে তো?
ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানিয়েছিলো মনি।
বনহুরের হাত ধরে মনি টেনে নিয়ে গেলো মায়ের পাশে–মা, দেখো বাপিকে ধরে এনেছি।
মা, সত্যি তুমি রাগ করেছো? বলো বলো, তাহলে আমাকে নূর বলে ডাকলে আমি কথা বলবোনা। মনি মুখ গম্ভীর করে রইলো।
মনিরা এবার কথা না বলে পারলোনা, বললো–আমি তোমার বাপির উপর রাগ করিনি নূর।
বাপি, মা তোমার উপর একটুও রাগ করেনি, দেখছোনা মা কেমন সুন্দর হাসছে।
বনহুর এবার বললো–আমিও তোমাকে নূর বলবো কেমন রাগ করবেনা তো?
না-না-না, আমি নূর–আমি নূর–যাই দাদীমা আমাকে ডাকছে নূর বেরিয়ে যায়।
বনহুর বসে পড়ে মনিরার পাশে দক্ষিণ হস্তে মনিরার চিবুক উঁচু করে ধরে বলে লক্ষীটি আমার উপর রাগ করেছো?
মনিরা হঠাৎ স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠে। কোনো কথা বলতে পারেনা সে।
পাশের ঘরে তখন মরিয়ম বেগম আর নূরের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। নূর বলছে–দাদীমা আমাকে এখন থেকে নূর বলে ডেকো মা বলেছে নূর নাকি খুব সুন্দর নাম।
আচ্ছা দাদু, আমিও তোমাকে নূর বলে ডাকবো। কিন্তু তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে, বলো করবে?
নিশ্চয়ই করবো, বলো দাদীমা?
বলছি, কাজ মানে সোজা কাজ–পড়াশোনা করা।
ওঃ এই কথা। তুমি বুঝি জানোনা দাদী মা, আমি কত পড়তে পারি।
তাই নাকি? আচ্ছা, আজকেই আমি সরকার সাহেবকে বলবো তোমার জন্য বই কিনে আনতে।
আমি স্কুলে ভর্তি হবো দাদীমা।
বেশতো, কালকেই তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো। লেখাপড়া শিখে মস্ত-বড় নামকরা মানুষ হবে, কেমন?
নূর তখনই পাশের টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে দাদীমার বিছানায় উঠে বসে, এই দেখো আমি সব অক্ষর চিনি।
চমৎকার আমার দাদু, আমি তো কিছু চিনিনা, তুমি আমাকেও শেখাবে বুঝলে?
শেখাবো, নিশ্চয়ই শেখাবো। জানো দাদীমা আমি লেখাপড়া শিখে কি করবো?
কি করবি দাদু?
পাশের ঘরে সব শুনতে পাচ্ছিলো বনহুর আর মনিরা।
স্বামীর বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে ছিলো সে।
বনহুর ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো মনিরার মাথায়।
মরিয়ম বেগমের কথায় বললো নুর–আমি লেখাপড়া শিখে মস্ত বড় পুলিশ অফিসার। হবো। মস্ত মস্ত দস্যুকে আমি গ্রেপ্তার করবো–
মনিরা শিউরে উঠলো, তাকালো স্বামীর মুখের দিকে।
মরিয়ম বেগমের অন্তরটাও কেঁপে উঠলো শিশু নূরের কথায়। তার কোনো কথা আর শোনা গেলো না।
*
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় মনিরার। পাশ ফিরতেই চমকে উঠে, শিউরে উঠে তার অন্তর। শুন্য বিছানা, স্বামী তার পাশে নেই। আশঙ্কা ভরা আকুল হৃদয় নিয়ে উঠে বসে ব্যাকুল। আঁখি মেলে তাকায় কক্ষমধ্যে চারিদিকে।
একটা বেদনা মোচড় দিয়ে উঠে মনিরার হৃদয়ে।
মনিতো এখন তার দাদীমার কাছে শোয়, তার বিছানায় একমাত্র তার স্বামী ছিলো। এই গভীর রাতে কোথায় গেলো তবে সে! তবে কি পালিয়ে গেছেমনিরা চিন্তিতভাবে উঠে দাঁড়ালো শয্যা ত্যাগ করে। দরজায় দৃষ্টি পড়তেই বিস্মিত হলো দরজা অর্ধ ভেড়ানো রয়েছে।
মনিরা ছুটে গেলো দরজার পাশে, দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে মামীমা, মামীমা
মরিয়ম বেগমের ঘুম ভেঙে গেলো, দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে মনিরার আকুল ভরা কণ্ঠস্বরে ভয়াতুরভাবে বলে উঠলেন কি হয়েছে মনিরা? কি হয়েছে?
মামীমা, সে চলে গেছে।
মরিয়ম বেগম স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন–জানতাম ওকে ধরে রাখা যাবে না।
মনিরা ডুকরে কেঁদে উঠলো।
মরিয়ম বেগম মনিরার পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
মরিয়ম বেগম উঠে আসতেই নূরের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। নূরও এসে দাঁড়ালো সেখানে,বললো সে দাদীমা, মা মণি কাঁদে কেনো?
মরিয়ম বেগম নূরকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন–তোমার বাপি চলে গেছে।
বাপি চলে গেছে? তাই মা-মনি কাঁদছে বুঝি?
হাঁ নূর, তোমার বাপি চলে গেছে তাই তোমার মা-মণি কাঁদছে।
নূর এবার মনিরার পাশে গিয়ে নিজের হাত দিয়ে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো–কেঁদোনা মা-মণি বাপি চলে গেছে আমি তো আছি। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
মনিরা নূরকে বুকে চেপে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে বললো–বাপ আমার।
মরিয়ম বেগম একটা শান্তির নিশ্বাস ফেললেন।
*
এখানে যখন মনিরা শিশু নূরকে বুকে আঁকড়ে ধরে সান্তনা খুঁজছিলো তখন তাজের পিঠে বনহুর ছুটে চলেছে। বন-প্রান্তর পেরিয়ে উল্কা বেগে ছুটছে রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে এগুচ্ছে তাজ।
তাজের জমকালো দেহটা যেন মিশে গেছে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে। বনহুরের শরীরে নাইট ড্রেস। কারণ সে ঘুম থেকে জেগেই পালিয়েছে, নাইট ড্রেসটা পাল্টে নেবার সময়ও তার হয়নি।
বনহুর যেদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলো, তাজের পিঠেই গিয়েছিলো সে। তাজ সেদিন হতে চৌধুরী-বাড়ির বাগান মধ্যে অবস্থান করছিলো।
মনিরাও তাজকে আদর করতো, স্বামীর সঙ্গে তাজের পাশে দাঁড়িয়ে ওর গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতো। কখনও বা নিজের হাতে ছোলা-ঘাস খাইয়ে দিতো। শুধু মনিরাই নয় মাঝে মাঝে তাজের কাছে যেতেন মরিয়ম বেগম। কিন্তু নিকটে যেতে সাহসী হতেন না। তাজের বিরাট উচ্চতা আর তার চর্চকে জমকালো চেহারা মরিয়ম বেগমের মনে একটা ভীতির সৃষ্টি করতো।
তাজকে মরিয়ম বেগম ভয়ও করতেন, যেমন তেমনি তাজের বলিষ্ঠ সুন্দর দেহটা দেখে মনে মনে আনন্দ বোধ করতেন গর্বে ভরে উঠতো তার বুক দস্যু বনহুরের অশ্বই বটে।
নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকতেন তিনি তাজের দিকে। জীবনে তিনি কত অশ্ব দেখেছেন কিন্তু এমন অশ্ব তিনি কখনও দেখেননি। তাজকে দেখলে লোকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে তাই মরিয়ম বেগম সরকার সাহেবকে বলে দিয়েছিলেন, তাজকে বাগানবাড়িতে হেফাজতে লুকিয়ে রাখতে।
প্রতিদিন ফজরের নামাজান্তে মরিয়ম বেগম বাগানবাড়ীতে যেতেন, দূর থেকে তাজকে তিনি দেখতেন। খুশিতে মন তার ভরে উঠতো।
এটা মরিয়ম বেগমের কতকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। অন্যান্য দিনের মতো আজও মরিয়ম বেগম এসে দাঁড়ালেন বাগান বাড়িতে। যেখানে তাজ বাঁধা থাকতো সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন নিষ্পলক নয়নে। শূন্য জায়গাটা খাঁ খাঁ করছে। মরিয়ম বেগমের মুখমন্ডল বিষণ্ণ-মলিন হয়ে উঠলো, একটা ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠলো তাঁর মনের মধ্যে। গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।
এমন সময় নূর এসে দাঁড়ালো তার পাশে বললো–দাদীমা, তাজ কোথায় গেলো? ওকে তো দেখছিনা!
চলে গেছে দাদু।
কেনো গেলো? আমার বাপির সঙ্গে গেছে বুঝি!
হাঁ তোমার বাপির সঙ্গে তাজও চলে গেছে।
আবার কবে আসবে?
নূরের কথায় কোনো জবাব দিতে পারলেন না মরিয়ম বেগম। আঁচলে অশ্রু মুছে নিয়ে। বললেন–চলো দাদু, সরকার দাদার সঙ্গে আজ স্কুলে যাবে।
স্কুলের কথায় খুশি হলো নূর, পড়াশোনায় নূরের অত্যন্ত আগ্রহ। আরাকান স্কুলে সে তার সঙ্গীদের মধ্যে পড়াশোনা বা খেলাধুলায় ছিলো সেরা ছাত্র। নূরের সুন্দর চেহারা আর তার সর্বদিকে গুণাগুণ দেখে স্কুলের মাষ্টার গণ মুগ্ধ হয়ে যেতেন।
মরিয়ম বেগম নূরকে নিয়ে ফিরে গেলেন অন্দর বাড়িতে।
তারপর সরকার সাহেবকে বলে কান্দাই স্কুলে ভর্তি করে দিলেন মরিয়ম বেগম তার একমাত্র সন্তানের স্মৃতিচিহ্ন নূরকে।
নূরকে নিয়ে মরিয়ম বেগম আর মনিরা গড়তে লাগলো কতো আশার স্বপ্নে। নূর লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, একদিন তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে গোটা শহরে।
মরিয়ম বেগম ভাবলেন পুত্রকে নিয়ে তার বাসনা পূর্ণ হয়নি। পুত্রের সন্তানকে নিয়ে রচনা। করবেন এক কল্পনার রাজ্যে।
মনিরাও নূরকে পেয়ে উপস্থিত স্বামীর কথা ভুলে থাকতে চেষ্টা করতে লাগলো। মনকে ভরসা দিলো এমন তো আরও কতদিন চলে গেছে আবার ফিরে এসেছে তার পথে।
কিন্তু মনিরা এবার অন্যান্য বারের মত আশ্বস্ত হতে পারলো না কারণ এবার সে স্বামীকে যেন সর্বান্তকরণে পায়নি, কোথায় যেন একটা বাধা তাদের উভয়ের মধ্যে প্রাচীর সৃষ্টি করেছিলো। স্বামীর আনমনা উদাসীন ভাব মনিরার অন্তরে শুধু ব্যথাই দেয়নি, একটা অসহ্য জ্বালা অনুভব করেছে সে মনে।
স্বামীর পূর্বের আচরণ স্মরণ করে হাহাকার করে উঠেছে মনিরার হৃদয়। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তার স্বামী। পাশে পেয়েও যেন না পাওয়ার শূন্যতা তাকে অস্থির করে তুলেছে। কত কথা কত হাসি গান ছিলো মনিরার মনের গহনে কিন্তু স্বামীর ব্যবহারে সব নিঃশেষ হয়ে শুকিয়ে গিয়েছিলো এতোটুকু প্রকাশ করতে পারেনি সে।
মনিরার পাশ থেকে যখন তার স্বামী চলে গেলো তখন সে শুধু অশ্রু বিসর্জনই করে নি, স্বামীকে সে যেন আজ নুতন করে হারালো।
*
চোরের মত চুপি চুপি পা টিপে টিপে রহমানের কাছে এসে দাঁড়ালো নাসরিন। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিয়ে বললো সে–রহমান ভাই, একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো ঠিক জবাব দেবে?
রহমান তার রাইফেলটা পরিস্কার করছিলো, নাসরিনের কথায় মুখ না তুলেই বললো– দেবার মত হলে নিশ্চয়ই দেবো।
নাসরিন তার একবার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললো–আচ্ছা রহমান ভাই, সর্দারের কি হয়েছে বলতে পারো?
এবার রহমান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকালো নাসরিনের মুখে। রহমানের মুখমন্ডল গম্ভীর হয়ে উঠেছে বললো ধীর শান্ত গলায় সর্দারের মনের অবস্থা ভাল নেই নাসরিন।
তাতো দেখতেই পাচ্ছি। সব সময় নির্জনে বসে কি যেন ভাবনে, যেখানে বসে থাকেন আর যেন উঠতে চান না। কই আগে তো তিনি কোনোদিন এমন ছিলেন না? এবার তাকে সব সময় ভাবাপন্ন দেখছি। কি হয়েছে তার বলোনা রহমান ভাই?
একটা অভাব তাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে নাসরিন, যে অভাব তার কোনদিন পূরণ হবে না।
কি এমন অভাব বলোনা রহমান ভাই?
একটা দীর্ঘশ্বাস রহমান চেপে গেলো যেন!
নাসরিন বললো–শুধু সর্দারকেই নয়, এবার তোমরা ফিরে আসার পর তোমাদের দু’জনাকেই কেমন যেন সদা সর্বদা উদাসীন লাগে তোমারও যেন কিছু হয়েছে। তবে কি তুমিও কিছু হারিয়েছো?
সর্দারের অভাবটা আমার বুকেও শেল বিদ্ধ করেছে নাসরিন। আমি নিজকেও সর্দারের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছি।
নাঃ তোমার হেয়ালী ভরা কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে তোমাদের দুজনার বলবে তো?
শুনলে তুমিও ভেঙে পড়বে নাসরিন তাই কথাটা তোমাকে বলা হয়নি। শুধু তোমাকেই নয় আস্তানার কেউ জানেনা ও কথা।
কি এমন কথা যা বলতে তোমাদের এতো আপত্তি? অথচ তোমরা উভয়ে হৃদয়ে হৃদয়ে গুমড়ে মরছো সেই গোপন কথাটার জন্য। সর্দার কি কোনো মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছেন?
সর্দার নতুন করে কাউকে ভালবাসেননি তবে ভালবাসার জনকে হারিয়েছেন।
সেকি! সর্দার কি তবে বৌ-রাণীকে–
না।
তবে?
নাসরিন, নূরীর মৃত্যু ঘটেছে।
নূরীর মৃত্যু ঘটেছে। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো যেন নাসরিন।
রহমান অতিকষ্টে নিজকে সামলে নিয়ে বললো–তোমরা জানো আমি নূরীকে দূরে কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখেছি। কিন্তু আসলে নূরী ইহজগতে আর বেঁচে নেই।
উঃ এ সব তুমি কি বলছো রহমান ভাই?
নাসরিনের চোখ দুটো দিয়ে পানির ধারা নামলে কাঁদতে লাগলো নাসরিন। নূরীকে সে শুধু ভালই বাসতো না নূরী তার ছোট বেলার সঙ্গী সাথী। এক সঙ্গে খেলা-ধুলা করে এতো বড় হয়েছিলো ওরা। আজ সেই নূরীকে হারিয়ে নাসরিন যেন ভেঙে পড়লো কান্নায়!
কিছুক্ষণ পর নাসরিন অনেকটা প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেলো।
রহমান বললো–নূরীর শোকে সর্দার মুষড়ে পড়েছেন নাসরিন। একটু থেমে পুনরায় বললো সে–আগে জানতাম না তাকে এতো ভালবাসতেন সর্দার।
হাঁ সত্যি বলছো রহমান ভাই-নূরীকে সর্দার এতো ভালবেসেছিলো আগে বুঝতে পারিনি।
রহমান আর নূরী নিশ্চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
রহমানই বললো আবার নূরীর মৃত্যু-সংবাদ আস্তানায় কাউকে বলো না তুমি। দাইমা কথাটা শুনলে সব সময় কান্নাকাটি করবে। এতে সর্দারের মনের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
বেশ আমি কাউকে বলবো না। কিন্তু সর্দার নূরীর জন্য যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে আমাদের আস্তানা কেমন করে টিকবে রহমান ভাই?
আমিও সেই চিন্তায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছি। সর্দার যদি এভাবে মুষড়ে পড়েন। তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। শুধু আমাদের আস্তানা আর দলবলই ভেঙে যাবে না সমস্ত দেশে আবার শুরু হবে ভদ্র নামি ভন্ড শয়তানদের পৈশাচিক নৃত্য। যারা দেশের জনগণের মঙ্গলের নামে তাদের বুকের রক্ত শুষে শুষে খায় আবার তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।
তাহলে কি করবে রহমান ভাই?
সেই কথা আমাকেও ভয়ানকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। কি করে সর্দারের মনের অবস্থা ফেরানো যায়? আমি সর্দারকে অনেকভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার মা এবং বৌ-রাণীর কাছে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানেও তিনি টিকতে পারেননি। আমি সব জানি–বৌ-রাণীর সঙ্গে সর্দার এবার বড় উদাসীনভাবে কথাবার্তা বলেননি। তাই ভাবছি একি হলো নাসরিন একি হলো?
অত্যন্ত দুশ্চিন্তার কথা রহমান ভাই বৌ-রাণী আর তার মাও সর্দারকে স্বাভাবিক করতে পারেননি।
নাসরিন আর একটা কথা তোমাকে বলবো জীবন গেলেও তুমি কাউকে বলবে না।
বলো, বলবো না।
নাসরিন তোমাকেও বলতাম না কথাটা কিন্তু না বলে যে আমি পারছি না সহ্য করতে।
তুমি বলো রহমান ভাই আমি জীবন গেলেও কাউকে বলবো না।
যা অসম্ভব তাই আমি করেছিলাম। সে অপরাধের জন্য আমিই দায়ী। দোষ নেই কোনো সর্দারের–
কি হয়েছে বলো না?
নূরীকে আমি ভালবাসতাম জানো?
জানি তুমি তাকে গভীরভাবে ভালবাসতে।
কিন্তু নূরী আমাকে কোনোদিন ভালবাসতে পারেনি।
হাঁ, আমাকে সে অনেকদিন বলেছিলো এ কথা। বলতো নূরী–নাসরিন, জানিস আমি কত বড় হৃদয়হীন। রহমান আমাকে কত ভালবাসে কিন্তু আমি ওকে একটুও ভালবাসতে পারি না। সত্যিই ওর জন্য আমার বড় করুণা হয়। কিন্তু কি করবো মনের সঙ্গে তো যুদ্ধ চলে না।
তোমাকেও সে বলেছিলো তাহলে কথাটা?
হাঁ বলেছিলো–আরও বলেছিলো–হুঁরকে আমি ভালবেসেছি। ওকে মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছি। কি করে আমি আর একজনকে ভালবাসবো। আর কাউকে ভালবাসবার পূর্বে আমার যেন মৃত্যু হয়।
নাসরিনের কথায় রহমানের চোখ দুটো হঠাৎ অদ্ভুতভাবে দপ দপ করে উঠলো। বললো রহমান-নাসরিন নূরীর বাসনা সফল হয়েছে। যা সে চেয়েছিলো প্রাণভরে পেয়েছে। তার কামনার জনকে একান্ত আপন করে পেয়েছিলো–
সর্দার তাকে–
হাঁ নাসরিন আমিই তাকে সর্দারের হাতে সঁপে দিয়েছিলাম খোদাকে স্বাক্ষী করে। আর স্বাক্ষী ছিলো আরাকান জঙ্গলের বৃক্ষ লতা পাতা জীবজন্তু।
নাসরিনের দু’চোখে বিস্ময় ঝরে পড়তে লাগলো। কোনো কথা তার মুখ দিয়ে উচ্চারণ হলো না।
রহমান বলে চললো সেই আরাকানে সর্দার আর নূরী রচনা করলো সোনার স্বর্গ। কিন্তু সে স্বর্গ আজরাইলের এক ফুকারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। সর্দারের বুক থেকে আরাকান বাসি ডাকু ভোলানাথ ছিনিয়ে নিলো নূরীকে। তীর বিদ্ধ করে হত্যা করলো তাকে।
উঃ কি নিদারুন সংবাদ। উঃ আমিই সহ্য করতে পারছি না। আমিই সহ্য করতে পারছি না রহমান ভাই। নূরীর স্মৃতি আমাকে পাগল করে তুলেছে।
রহমান এবার স্থির কণ্ঠে বললো–কিন্তু ভেঙে পড়লে তো চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে, যে গেছে সে আর ফিরে আসবেনা কিন্তু রক্ষা করতে হবে আমাদের সর্দারকে।
সত্যি রহমান ভাই, সর্দারের মনোভাব সচ্ছ না হলে আমাদের সবকাজ পন্ড হয়ে যাবে।
কিন্তু কি করা যায় কি করে সর্দারের মনকে স্বাভাবিক করে তোলা যায়? এক কাজ করতে পারবে নাসরিন?।
বলো কি করতে হবে?
সর্দারের সেবা-যত্নের ভার তুমিই গ্রহণ করবে। যাতে তার মনোভাব ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয় সেই চেষ্টা করবে তুমি। কেমন পারবে তো?
পারবো।
নাসরিন এখন তুমিই ভরসা আমি জানি বৌ-রাণী যা পারেনি তুমি তা পারবে।
নাসরিন কোনো কথা বললো না।
রহমান বললো–যাও নাসরিন, সর্দার তার কক্ষে আছেন। তিনি এখনও কিছু মুখে দেননি। তারজন্য খাবার নিয়ে যাও।
আচ্ছা যাচ্ছি।
নাসরিন চলে যায়।
কিন্তু অল্পক্ষণ পরে ফিরে আসে নাসরিন মুখে চোখে তার উদ্বিগ্নতার ছাপ রহমান ভাই, সর্দার তার কক্ষে নেই।
সর্দার তার কক্ষে নেই! বলো কি? একটু পূর্বেই তাকে তার কক্ষে দেখে এসেছি। চলো দেখি কোথায় গেলেন তিনি।
রহমান আর নাসরিন মিলে সমস্ত আস্তানা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো কিন্তু কোথাও তারা সর্দারকে খুঁজে পেলোনা।
রহমান ছুটে গেলো ঘোড়াশালে। আরও অবাক হলো সে–সর্দার নেই তাজও নেই। এবার বুঝতে পারলো রহমান সর্দার তাজকে নিয়ে উধাও হয়েছে। কোথায় গেছে কে জানে।
সর্দারের অন্তর্ধানে সমস্ত আস্তানায় একটা গভীর অশান্তির ছায়া ঘনিয়ে এলো, বিশেষ করে রহমান মুষড়ে পড়লো দুশ্চিন্তায়।
*
বনহুর আজ তার নিজের ড্রেসে সজ্জিত হলো। শরীরে জমকালো ড্রেস, মাথায় কালো পাগড়ি মুখে গালপাট্টা বাঁধা। কোমরের বেল্টে রিভলভার। পায়ে কালো বুট।
তাজের পাশে এসে দাঁড়ালো বনহুর।
তাজ প্রভুকে দেখতে পেয়ে আনন্দে সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো।
বনহুর উঠে বসলো তাজের পিঠে।
আবার সেই পথ সেই মাঠ-প্রান্তর–বনানী ঢাকা কত পল্লী। সব ছাড়িয়ে বনহুর তাজের পিঠে উল্কাবেগে ছুটে চলেছে। বনহুরের গন্তব্য স্থান সেই আরাকান জঙ্গল।
যে জঙ্গলে নূরী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে।
বনহুর একটা অজ্ঞাত। আকর্ষণে ছুটে চলেছে কে যেন তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। কিছুতেই সে নিজকে ধরে রাখতে পারছে না।
মাথার উপরে প্রখর সূর্য অগ্নিবর্ষণ করছে যেন।
নীচে মৃত্তিকা গণগণে সীসার মতো তীব্র জ্বালাময় হয়ে উঠেছে। বনহুরের সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে চুপসে উঠেছে। বারবার হাতের পিঠে ললাটের ঘাম মুছে নিচ্ছিলো সে।
পিপাসায় কণ্ঠ শুকিয়ে উঠছিলো, ক্ষুধায় নাড়ী হজম হবার জোগাড় কিন্তু কোনোদিকে খেয়াল নেই বনহুরের।
পথে কোন বৃক্ষলতা না থাকায় এতোটুকু ছায়ার চিহ্ন ছিলো না যেখানে বনহুর তার অশ্ব নিয়ে একটু বিশ্রাম করে নেবে।
তাজ প্রভুর কষ্ট বেশ উপলব্ধি করতে পারছিলো তাই সে দ্রুত আরও দ্রুত ছুটছিলো।
তাজও হাঁপিয়ে পড়েছিলো অত্যন্ত। আজ ক’দিন সে অবিরত ছুটেছে। পথে দু’দিন কেটে গেছে আজ তৃতীয় দিন।
বেলা গড়িয়ে আসতেই বনহুর এক পর্বতের পাদমূলে এসে পৌঁছলো।
এটাই আরাকানের প্রথম সীমানা, আরাকান পর্বত।
অদূরে পর্বতটার পাদমূলে অসংখ্য নাম-না-জানা বৃক্ষলতা গুল্ম। মাঝে মাঝে উঁচুনীচু টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা বিরাট অশথ বৃক্ষের নিচে এসে বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো।
বনহুর বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে তাকালো চারিদিকে। অত্যন্ত পিপাসা বোধ করলো সে। কিন্তু কোথায় পানি শুকনো মাটির বুক যেন খাঁ খাঁ করছে।
বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো। একটা শীতল বাতাস তার সমস্ত শরীর জুডিয়ে দিয়ে গেলো। বনহুর অনেকটা শান্তিবোধ করলো এবার। তাজকে পাশে বেঁধে বৃক্ষতলে বসে পড়লো। অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো সে। হাতের উপর মাথা রেখে চীৎ হয়ে শুয়ে পড়লো বনহুর, অল্পক্ষণেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই হঠাৎ একটা সুমিষ্ট গানের সুরের আবেশে ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের। চোখ মেলে তাকালো কোন দিক থেকে সুরটা ভেসে আসছে শুনতে চেষ্টা করলো।
উঠে বসলো বনহুর। অস্পষ্ট একটা গানের সুর দূরে–বহু দূরে থেকে যেন ভেসে আসছে।
তন্দ্রাচ্ছন্নের মত বনহুর কান পেতে শুনতে লাগলো। সুরটা এখনও সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। বনহুরের হৃদয়ে এ সুরের রেশ এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি করে চললো। বনহুর এবার উঠে দাঁড়ালো, সুরের টানে এগিয়ে চললো সে আরাকান পর্বতের দিকে।
পিছনে গাছের ডালের সঙ্গে তাজের লাগাম বাঁধা রয়েছে। বনহুরকে মন্থর গতিতে তন্দ্রাচ্ছন্নের মত পর্বতের দিকে এগুতে দেখে তাজ চঞ্চল হয়ে উঠলো। পশু-প্রাণ হলেও সে যেন বুঝতে পারলো তার প্রভু কোনো অজানার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
তাজ সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো।
কিন্তু বনহুর ফিরেও তাকালো না সে যেন কোনো যাদুমন্ত্রে এগুচ্ছে।
ঝোপ-ঝাড় আগাছা জঙ্গল পেরিয়ে বনহুর অগ্রসর হলো। ছোট ছোট টিলাগুলি পড়ে রইলো পিছনে। পর্বতের গা বেয়ে উঠতে লাগলো বনহুর উপরের দিকে।
গানের সুর আরও স্পষ্ট হয়ে ভেসে আসছে।
বনহুরের মুখমন্ডল দীপ্তময় হয়ে উঠেছে এ যেন তার অতি পরিচিত সুর। কত দিন যেন সে এ সুর শুনেছে যে সুর গাথা হয়ে রয়েছে তার অন্তরের অন্তরে।
বনহুর তন্দ্রাচ্ছন্নের মত এগুচ্ছে।
ললাটে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ দুটো উজ্জ্বল দীপ্তময়, সুরের রেশ স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে।
পর্বতের কন্দরে কন্দরে সেই সুরের প্রতিধ্বনি করুণ কান্নার মতো ঝরে পড়ছে।
অপূর্ব অভূত সে সুর।
কোনোদিকে খেয়াল নেই বনহুরের, শুধু সুরের টানে সে অগ্রসর হচ্ছে।
ঘনজঙ্গলে পর্বতের গা আচ্ছন।
তেমনি ঝাপসা অন্ধকার চারিদিক ঘোলাটে করে তুলেছে। বনহুরের শরীরে কাঁটার আঁচড় লেগে রক্ত ঝড়ে পড়তে লাগলো। জামা ছিঁড়ে গেলো, পাগড়ির কোনো কোনো অংশ কাঁটায় বিধে রইলো। তবু চলেছে সে, অতি মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বনহুর সামনের দিকে।
এমন সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসে।
কখন যে আকাশে ঘন মেঘ জমে উঠেছিলো সেদিকে খেয়াল করতে পারেনি বা খেয়াল হয়নি বনহুরের।
দমকা বাতাস প্রচন্ড বেগে এগিয়ে আসছে। যেন শত শত রাক্ষস হুঙ্কার দিয়ে ছুটে আসছে তার দিকে।
ভীষণ ঝড় শুরু হলো।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
এতোক্ষণ যে সুর বনহুরকে আকৃষ্ট করে টেনে নিয়ে চলেছিলো সে সুরের রেশ থেমে গেছে, হারিয়ে গেছে যেন প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে।
বনহুরের কানে এখনও যে সুরের প্রতিধ্বনি জেগে রয়েছে। উদ্ভ্রান্তের মতো এগুচ্ছে সে। সম্মুখের দিকে।
মস্ত মস্ত গাছ পালাগুলো মড় মড় শব্দে ভেঙে পড়ছে।
কোনো কোনো গাছ সমূলে উপড়ে পড়ে যাচ্ছে বিরাট দৈত্যের নিহত দেহের মতো।
কোনোদিকে খেয়াল নেই বনহুরের।
তখনও সে এগিয়ে যাচ্ছে, দেখতে চায় বনহুর–কে সেই সুরের অধিকারিণী কে সেই মায়াময়ী।
ঝড়ের বেগ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বনহুর কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, কখনও উঠেছে আবার এগুচ্ছে সম্মুখ দিকে। পর্বতটার গা বেয়ে অনেকখানি উপরে উঠে এসেছে সে।
বনহুর এখন এমন একস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে থেকে পর্বতের পাদমূল অনেক নিচে। ওপাশেই পর্বতের গা বেয়ে মস্ত বড় একটা ফাটল। ফাটলের তলদেশে খরস্রোতা এক নদী।
এতো জোরে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে কিছু দেখতে পাচ্ছেনা বনহুর। শুকনো পাতা আর ধূলো রাশিরাশি তার দৃষ্টিশক্তিকে অন্ধ করে দিচ্ছে। সম্মুখে দু’হাত প্রসারিত করে এগুচ্ছে সে।
জীবনে কোনোদিন বনহুর এমন ঝড়ের কবলে পড়ে নি। পর্বতের গায়ে সেকি ভয়ঙ্কর তুফান।
এখানে বনহুর ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছিলো।
ওদিকে তাজ গাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা লাগামটা প্রাণপণ চেষ্টায় ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো।
তাজের দেহে অসীম বল। দস্যু বনহুরের অশ্ব সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজ লাগাম ছিঁড়ে ফেললো।
ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে সে ছুটতে শুরু করলো যেদিকে তার প্রভু চলে গেছে। পশু হলেও তাজের বুদ্ধিবল ছিলো অদ্ভুত। তাজ এতো বিপদেও নিজকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে প্রভুর সন্ধানে অগ্রসর হলো। কিন্তু এলোমেলো দমকা ঝড় তাজ বেশি দূর এগুতে সক্ষম হলোনা। তাছাড়াও পর্বতটা বেশ খাড়া তাজ পর্বত বেয়ে উপরে উঠতে পারছিলো না।
তাজ বার বার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো।
বনহুর তখন তাজের নিকট হতে অনেক দূরে উপরে উঠে গেছে। ঝড়ের মধ্যে বনহুরের একবার মনে পড়লো তাজের কথা। কিন্তু বেশিক্ষণ কিছু চিন্তা করবার মতো এখন পরিবেশ নয়।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে প্রবল, বৃষ্টিপাত শুরু হলো।
পর্বতের গায়ে কিছুতেই বনহুর নিজকে ধরে রাখতে পারছিলোনা এদিকে ঝড় আর একদিকে বৃষ্টি, বনহুরের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন হয়ে উঠেছিলো।
হঠাৎ বনহুর তাকালো সম্মুখে, বিদ্যুতের আলোতে যেন অস্পষ্ট দেখতে পেলো দূরে একটি গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার নূরী, শুভ্রবসন এলোচুল আঁচলখানা ঝড়ের বেগে উড়ছে।
বনহুর ভুলে গেলো ঝড়বৃষ্টি আর প্রচন্ড জলস্রোতের কথা। দু’হাত প্রসারিত করে ছুটে গেলো–নূরী–নূরী— সঙ্গে সঙ্গে বনহুর পড়ে গেলো সম্মুখস্থ ফাটলের মধ্যে। প্রচন্ড জলরাশি গর্জন করে নিচের দিকে ছুটে চলেছে, সেই জলস্রোতের মধ্যে বনহুর তলিয়ে গেলো কোন্ অতলে।