মৃত্যুর আলোকে রবীন্দ্রনাথ

মৃত্যুর আলোকে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ অবশেষে এই মর্ত্যের মলিনতামুক্ত হইয়া সেই লোকে প্রস্থান করিলেন—’বাচো যতো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ; যেখানে চন্দ্রতারকার ভাতিও ম্লান, বিদ্যুৎ দ্যুতিহীন, অগ্নির তো কথাই নাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে মর্ত্য-মমতার কথা আমরা জানি, তাঁহার উদয়কালের সেই ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ হইতে অস্তকালের—

একদা কোন্ বেলাশেষে মলিন রবি করুণ হেসে
শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে-—

—পর্য্যন্ত, প্রাণের আকুতি ও দীর্ঘশ্বাসের গীতি স্মরণ করিলে, আমরাও যেমন সেই জ্যোতির্ম্ময় পরপারের দিব্যস্বপ্নে আশ্বস্ত বোধ করি না, তেমনই খেয়াপারের সেই ক্ষণটিতে রবীন্দ্রনাথও কেমন বোধ করিয়াছিলেন, তাহাই ভাবিতে ইচ্ছা হয়। এ ভাবনা দুর্বল মানবচিত্তের ভাবনা; মানুষ আমরা, এবং এতকাল রবীন্দ্রনাথের অতি গভীর মানবতার কাব্যদুগ্ধধারে আমাদের প্রাণ পুষ্ট হইয়াছে, তাই, আজ মৃত্যুর আলোকে সেই মহামানবের মূর্ত্তি একবার আমাদের চোখ দিয়া দেখিতে চাই। আমরা জানি, মৃত্যুর দ্বারপথে রবীন্দ্রনাথ কোন নূতন পথে প্রবেশ করিলেন না—চিররাত্রির সেই তিমিরাবরণ তিনি অনেক আগেই ছিন্ন করিয়াছিলেন, তিনি এই পারে থাকিতেই তমসার ওপার পর্য্যন্ত সেতু রচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু জানার ভিতর দিয়া তিনি যে অজানাকে জানিয়া ছিলেন, মৃত্যুর আবির্ভাবে যখন সেই অজানাকে তাহার সাক্ষাৎরূপে জানিলেন, তখন তাঁহার প্রাণ কি একটুও চমকিত হয় নাই? তিনি অরূপ-অসীমকে রূপের সীমায় দেখিবার সাধনা করিয়াছিলেন, তাঁহার সকল দেখাই রূপরঞ্জিত ছিল; এক্ষণে তিনি সেই অরূপকে সৰ্ব্বেন্দ্রিয়বর্জ্জিত অবস্থায় কিরূপ দেখিলেন? মৃত্যুর সে রূপ কি একটুও ভিন্ন নহে? রবীন্দ্র-কাব্যে, জীবন ও মৃত্যুর সারূপ্য-সাধনার যে অপূর্ব্ব গীতিসুর বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিঃশ্বসিত হইয়াছে, আজ সেই সুর আমাদের প্রাণে নূতন করিয়া আরও গভীরভাবে বাজিয়া উঠিতেছে; আজ রবীন্দ্রনাথ যে-মৃত্যুকে বরণ করিলেন, সে-মৃত্যু কি সেই জীবনের দাবীও স্বীকার করিয়াছে—রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রাণ কি সেই ভাবের শরীরে শরীরী হইয়াই দিব্যধামে পৌঁছিয়াছে? এ প্রশ্ন হয়তো অন্য সময়ে অবান্তর, এমন কি অশোভন,—তাঁহার একান্ত নিজস্ব আত্মিক উপলব্ধির সম্বন্ধে আমাদের কোনও কৌতূহল যেমন অনাবশ্যক, তেমনই নিরর্থক; রবীন্দ্রনাথের মত বিরাট ব্যক্তির ব্যক্তিচেতনার সেই অপর পৃষ্ঠে—তাহার গূঢ়তম সত্তায়—কোন্ বিশ্বাস, কোন্ ধ্রুব—জ্ঞান কি ভাবে বিদ্যমান ও বিকাশমান ছিল, সেই অপ্রকাশকে জানিবার শক্তি আমাদের নাই—অধিকারও নাই। কিন্তু আমরা তাঁহার জীবনের যে প্রকাশের দিকটি দেখিয়াছি, যাহা আমাদের এই মর্ত্যসংস্কারমলিন প্রাণকেই আশ্বস্ত ও উজ্জীবিত করিয়াছে, তাহার অবসান ও পরপারের সেই জ্যোতিৰ্ম্ময় লোকে প্রবেশ, এই দুইয়ের মধ্যে—লোকান্তরের মত—ব্যক্তিত্বেরও একটা রূপান্তর কল্পনা করিয়া, মর্ত্যের সহিত অমর্ত্যের ব্যবধান বিস্মৃত হইতে পারিতেছি না; সেই মৃত্যুর ছায়া, রবীন্দ্র-কাব্যের আলোকে আলোকিত আমাদের চিত্তপ্রাঙ্গণে পড়িয়া, যে ভাবের উদ্রেক করিতেছে—আজ তাহারই কিঞ্চিৎ ব্যক্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি।

সেদিন কবির শ্রাদ্ধবাসরে যখন সেই ঋষিমন্ত্র পাঠ হইতেছিল— ‘মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ’—তখন কবির নিজের রচিত আর একটি মন্ত্র আমাদের প্রাণে আর এক ভাবের উদ্রেক করিতেছিল—

ভেঙ্গেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতিৰ্ম্ময়,
তোমারি হউক জয়।
তিমির-বিদায় হউক অভ্যুদয়,
তোমারি হউক জয়।
হে বিজয়ী বীর নব জীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে,
বন্ধন হোক ক্ষয়,
তোমারি হউক জয়।।

—এখানে, পৃথিবীর মলিন আলোক অপসারিত করিয়া, অপ্রকাশের তিমির-তোরণ ভেদ করিয়া যাহার প্রকাশকে কবি বন্দনা করিতেছেন, তাহা যে এই বায়ু, জল, ওষধি ও পার্থিব রজঃ প্রভৃতিকে মধুমৎ করিয়া তুলিবার সেই একই অমৃত-আলোক—ধারা—এ আশ্বাস আমাদের প্রাণে জাগে না। এ গান শুনিয়া মনে হয়, জীবনের কক্ষে শতদীপ জ্বালিয়া আমরা বাহিরের অন্ধকার রাত্রিকে যতই ভুলিয়া থাকিতে চেষ্টা করি না কেন, জীবনের সেই কক্ষ হইতে নিষ্ক্রমণের পথে, সেই মৃত্যুই দুয়ে রহস্যপুরীর প্রাকারতলে, নক্ষত্রশলাকাখচিত বিরাট তোরণদ্বার রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তখন যে তিমির-বিদার উদার অভ্যুদয়ের প্রার্থনা আত্মার আর্ভরবের মতই উত্থিত হয়—’মৃত্যুর হোক লয়’ বলিয়া মৃত্যুর যে রূপকে স্বীকার করিতে হয়—মনে হয়, তাহা হইতে ঋষি অথবা কবি কাহারও নিষ্কৃতি নাই। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রস্থান—গীতিও চিরযুগের মৃত্যুভয়-পীড়িত মানুষের অস্তিম আকুতি-স্বরে ভরিয়া উঠিয়াছে। জীবনের যে উৎসবশালায় তিনি স্বহস্তে অসংখ্য দীপ জ্বালিয়াছেন, স্বরচিত বিচিত্র কুসুমমাল্যে আমাদের ললাট ভূষিত করিয়াছেন, সেই উৎসবশালা হইতে নিষ্প্রান্ত হইয়া যখন তিনি বাহিরের অন্ধকারে পদক্ষেপ করিলেন, তখন তাঁহার দূরাগত কণ্ঠের আর এক গীত আমরা এখানে বসিয়া শুনিলাম—

ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথী
লও লও ক্রোড় পাতি
অসীমের পথে জ্বালিবে জ্যোতি
ধ্রুবতারকার।।
হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয়
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
মহা অজানার।।

—তাহাতে আমাদের উৎসবশালার এই দীপাবলী আর তেমন উজ্জ্বল বোধ হয় না। তখন আমাদের সেই উৎসব-নায়ক রবীন্দ্রনাথকে সেই মহা-অজানার সম্মুখে যে—মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া অন্তরের অভয় কামনা করিতে শুনি, তাহাতে মনে হয়, জীবনেই মৃত্যুকে জয় করিবার যে সাধনাই করি না কেন, জীবিতের চক্ষে মৃত্যুর আবরণ ঘোচে না—মৃত্যুর সেই জ্বলজ্জটাকলাপ জীবনের আলোককে উপহাস করিয়া, আমাদের চক্ষু ধাঁধিয়া দিয়া, অন্ধকারকেই অন্ধতর করিয়া তোলে; মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয় না হইলে, অসীমের পথে সেই অন্ধকার পার হইবার ধ্রুবতারাটির সন্ধান মেলে না। কবি যে ‘বন্ধন-ক্ষয়ে’র কামনা করিলেন, তাহাতে কি ইহাই বুঝিতে হইবে না যে, দেহের ইন্দ্রিয়-বেষ্টনীর মধ্যে তাঁহার মনের সেই মণিপদ্ম, রূপ-রস—স্পর্শের—বর্ণ, গন্ধ ও মধুর যে অশেষ আনন্দে দলে দলে বিকশিত হইয়াছিল, তাহার সকল সংস্কার, মৃত্যুর সহিত মুখামুখী হইবার কালে, তিনি মোচন করিতেই চাহিয়াছিলেন? একদিন যে গাহিয়াছিলেন—

তার      অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ,
তার      অণু পরমাণু পেলো কত আলোর সঙ্গ।
আছে     কত সুরের সোহাগ তার স্তরে স্তরে লগ্ন,
সে যে    কত রঙের রসধারায় কতোই হ’ল মগ্ন।
সে যে    সঙ্গিনী মোর আমারে যে দিয়েছে বরমাল্য,
আমি     ধন্য সে মোর অঙ্গনে যে কত প্রদীপ জ্বাললো।

—আজ এই মুহূর্তে সে কথা কি তিনি বিস্মৃত হইতে পারিলেন! কবির প্রাণ কি তখন ‘কান্নাহাসির দোল-দোলানো পৌষ ফাগুনে’র সকল মোহ দূর করিয়া—নিজের সেই অপরিমেয় প্রাণ-বহ্নির নির্ব্বাণ কামনা করিয়া—স্নিগ্ধ শীতল শান্তি-পারাবারে তরী ভাসাইবার জন্য, মুক্তিদাতা কর্ণধারকে ডাক দিল—তাহারই ক্ষমা ও দয়া ভিক্ষা করিল! এত সাধ ও সাধের জীবন পিছনে পড়িয়া রহিল; যে কণ্ঠ অন্ধকারের বক্ষ চিরিয়া গানে গানে আলোকের উৎস অবারিত করিয়াছিল, সে কন্ঠ শুধুই নীরব হইল না–গানের সেই সুরও ভুলিয়া গেল!

রবীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধবাসরে গম্ভীর বেদগাথার মতই উদ্‌গীত তাঁহার সেই স্বরচিত গানগুলির মধ্যে, অনন্তের পথে সেই দেহমুক্ত আত্মার যে যাত্রী বেশ মানস-চক্ষে দেখিতে পাইলাম, তাহা জীবনের নিকট বিদায় লওয়ার বেশ; মহাভারতকার যুধিষ্ঠিরাদির যে মহাপ্রস্থান-বেশ বর্ণনা করিয়াছেন, ইহাও সেই বেশ। এই মহাযাত্রার পথে পশ্চাতের আকর্ষণ এতটুকুও থাকিবার যো নাই—সকল স্মৃতি মুছিয়া ফেলিতে হয়; সকল মমতা, সকল মোহ জয় করিতে হয়। কবি এইখানে থকিতে যে আলো দুই চক্ষে ভরিয়া লইয়াছিলেন, সে আলোকে মৃত্যুর পথ আলোকিত হইল না; গানের সহস্র ফুলে যে মালা গাঁথিয়াছিলেন, সেই মালার কথাও মনে রহিল না; পৃথিবীর আর কোন কবির জীবনে যে আনন্দ এমন নিরবচ্ছিন্ন গীতময় উঠে নাই, সেই আনন্দের অফুরন্ত ভান্ডারও খেয়াপারের কড়ি যোগাইল না। যখন সেই চরম মুহূর্ত্তে, কবির মুখ হইতে, সকল যুগের সকল মানবের সেই এক আৰ্ত্ত আবেদন, কম্পিত কণ্ঠে, নিরাভরণা বাণীর বেশে, বাহির হইয়া আসিল—

মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া
হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।

তখন, শোকস্তব্ধ হৃদয়কে বারবার কেবল এই কথাই বলিলাম—

সকল অভ্যাসহারা     সর্ব্ব আবরণ ছাড়া
সদ্য শিশুসম
নগ্ন মূর্ত্তি মরণের     নিষ্কলঙ্ক চরণের
সম্মুখে প্রণম’।

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ তাঁহার জীবন-সাধনায় মৃত্যুকে কখনও ভোলেন নাই, বরং জীবন ও মৃত্যুর যে দ্বন্দ্ব সে দ্বন্দ্ব উত্তীর্ণ হইবার সাধনাই তাঁহার কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা। মানুষ যাহার কথা চিন্তা করিতে ভয় পায়, আমাদের যাবতীয় মর্ত্যসংস্কার যাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে,—যাহার বর্ণনায় সকল কালের কবির কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ, এবং গান রোদন হইয়া উঠিয়াছে,—রবীন্দ্রনাথ সেই মৃত্যুকে বারংবার যে সঙ্গীতে অর্চ্চনা করিয়াছেন, তাহাতে ব্যথাও সুখ হইয়া উঠে, হর্ষ ও বিষাদ একই অশ্রুজলে বিগলিত হয়। কবি জীবনকে ভালবাসিতেন বলিয়াই—যে-মৃত্যুকে সেই জীবনেরই পরিণাম, তাহাকে একটা সর্ব্বনাশ বা মহাশূন্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারেন নাই, করিলে জীবন অর্থহীন হইয়া পড়ে। জীবনকে শুধুই ভোগ করা যায় না—সেই ভোগ যে একটা মোহ, তাহার মূলে যে কেবল অন্ধ ইন্দ্রিয়-চেতনাই আছে, ইহা বিশ্বাস করিতে বাধিত বলিয়াই তিনি জীবনের সহিত মৃত্যুর সঙ্গতি-সাধনে এমন উৎসুক ছিলেন। এই ভাব-সাধনায় তিনি জীবন ও মৃত্যুর অভেদ উপলব্ধি করিতেই প্রয়াস পাইতেন; কখনও বা, জীবন হইতে জীবনে আত্মার প্রয়াণ-লীলায় মৃত্যু একটা ক্ষণচ্ছেদ মাত্র, ইহাই মনে করিয়া আশ্বস্ত হইতেন। জীবনের দেবতা যিনি, মরণের দেবতাও তিনি—ইহা না হইয়া পারে না; অতএব জীবনে যিনি এত স্নেহময়, এত সুন্দর, মরণে তিনি অন্যরূপ হইবেন কেমন করিয়া?—

যবে      মরণ আসে নিশীথে গৃহদ্বারে
যবে     পরিচিতের কোল হ’তে সে কাড়ে
যেন     জানি গো সেই অজানা পারাবারে
এক তরীতে তুমিও ভেসেছ।

কিংবা—

বিচ্ছেদেরি ছন্দে লয়ে
মিলন ওঠে নবীন হয়ে।
আলো অন্ধকারের তীরে,
হারায়ে পাই ফিরে ফিরে,
দেখা আমার তোমার সাথে
নূতন ক’রে নূতন প্রাতে

অথবা—

জীবনে ফুল-ফোটা হ’লে মরণে ফল ফলবে

এবং—

মুদিত আলোর কমল-কলিকাটিরে
রেখেছে সন্ধ্যা আঁধার পর্ণ-পুটে,
উতরিবে যবে নব প্রভাতের তীরে—
তরুণ কমল আপনি উঠিবে ফুটে।

—এত বড় আশ্বাস ও বিশ্বাস যাহার, মৃত্যু তাহাকে বিচলিত করিবে কেমন করিয়া? যদি বা তাহার সেই আঘাত, দেহ-বিচ্ছেদের সেই যাতনাও স্বীকার করিতে হয়, তাহাও ক্ষণিক—

স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে

কিন্তু মৃত্যু সম্বন্ধে কবির এই যে মনোভাব, ইহার কারণও খুব স্পষ্ট। অতি গূঢ় ও গভীর জীবন-রস-পিপাসাই এই মনোভাবের কারণ। কবির নিকটে মৃত্যুর কোন পৃথক সত্তা নাই এইজন্য যে, আত্মার অমরত্ব—জীবনের বাহিরে, মৃত্যু নামক কোন সীমানার অপর পারেই—আরম্ভ হয় না। যে-চেতনা অমরত্বের অনুষঙ্গী তাহা কোন নির্বিকল্প কৈবল্যের অবস্থা নয়, সীমা ও অসীমার মিলনভূমি—এই অপরূপের নাট্যশালায় সেই অমরত্বের নিত্য-আস্বাদন হইয়া থাকে; আত্মা অমর এই অর্থে যে, সে—রূপ হইতে রূপান্তরে-সেই রস সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইবে না। সেইজন্যই জীবনের শেষ নাই; এই রূপের খেলাও যেমন অনন্তকাল চলিতে থাকিবে তেমনই, সেই খেলার সঙ্গী বা চেতন-সহচররূপেই আত্মার আত্ম-চেতনার কখনও লয় হইবে না। ইহার কোন দার্শনিক ব্যাখ্যা না করিয়া, একটা স্থূল অর্থ করিলেই চলিবে—এবং সহজ মানবতার দিক দিয়া তাহা সত্যও বটে। সে অর্থ এই যে, কবি এই জগৎ দৃশ্যের বাহিরে কোন অস্তিত্বের কামনা করিতেন না—সেইজন্য, সেই কামনারই রঙে রঙিন হইয়া মৃত্যুও তাঁহার নিকটে মনোহর হইয়াছিল। জগতের রস-রূপ এতই মনোহর যে, এ রূপের সঙ্গ ত্যাগ করিতে কখনও তাঁহার মন সরে নাই। যে ব্যক্তিত্বের বৃত্তবন্ধনে রূপের এই মধুসৌরভময় সহস্রদল ফুটিয়া উঠিয়াছে, সেই ব্যক্তিত্বের লয় যদিও বা মনে উদিত হইত—মহানির্ব্বাণের বর্ণহীন তাপহীন জ্যোতিঃ সমুদ্রে ডুবিয়া যাইবার ইচ্ছা হইত, তথাপি, তখনও সেই অকূল পারাপার অপেক্ষা জীবনের এই তটভূমি, এই জগৎ, সুন্দরতম বলিয়া বোধ হইত, এবং মৃত্যুকেও জীবনের সুহৃদ বলিয়া মনে করিতে বাধিত না। যখন—

আমি বলে, মিলাই আমি
আর কিছু না চাই,

তখন—

ভুবন বলে তোমার তরে
আছে বরণ-মালা,
গগন বলে, তোমার তরে
লক্ষ প্রদীপ জ্বালা।
প্রেম বলে যে, যুগে যুগে
তোমার লাগি আছি জেগে,
মরণ বলে, আমি তোমার
জীবন-তরী বাই।

এই কামনাকে, এই প্রেমকেও, তিনি শোধন করিয়া লইয়াছেন—পরমার্থ-লাভের সহায়রূপে; এই রূপরসচর্য্যাকেই আত্মার সহিত মিলন বা আত্মোপলব্ধির একমাত্র পন্থা বলিয়া বার বার নিজেকে আশ্বস্ত করিয়াছেন—

তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
যুগে যুগে বিশ্বভুবন-তলে
পরাণ আমার বধূর বেশে চলে
চির-স্বয়ম্বরা।

অতএব, যে প্রবল কামনা মৃত্যুকেও জয় করিতে চাহিয়াছে— সে কামনা জগতেরই এই রূপরস সম্ভোগের কামনা। মৃত্যুও সেই কামনার জোরে অমৃত হইয়া উঠিয়াছে। আর একটি গানে কবির সেই কামনা, ব্যর্থতার করুণ সুরকে চাপিয়া রাখিবার চেষ্টায়, যে স্বপ্ন দেখিতেছে, তাহাতে প্রাণ যেন মৃত্যুকে স্বীকার করিয়াও করিবে না। পৃথিবী হইতে বিদায় লওয়ার—একেবারে গত হওয়ার যে বেদনা, তাহাই আকাশ ও পৃথিবীর শোভাকে যেমন মমতায় মেদুর করিয়া তুলিয়াছে, তেমনই, সেই বেদনাই শান্তিলাভ করিতে চায় এক অপূৰ্ব্ব স্বপ্ন-কল্পনায়;—

যখন পড়বে না মোর চরণ-চিহ্ন এই বাটে,
বাইবো না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
* * * *
ঘাটে ঘাটে খেয়াতরী
এমনি সেদিন উঠবে ভরি
চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ঐ মাঠে।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে।

—এই গানের ঐ শেষ তিনটি পংক্তিতে যে দীর্ঘনিশ্বাস জমাট হইয়া আছে, তাহাই ইহার মূল সুর; ঐ তিনটি পংক্তিই ফিরিয়া ফিরিয়া আমাদেরও হৃদয়ের তন্ত্রীতে যেরূপ আঘাত করে, তাহাতে বিদায়ের ব্যথাই তীব্রতর হইয়া ওঠে; উহার মধ্যে সেই ব্যথাকে অগ্রাহ্য করিবার যে ভাব আছে, তাহা নিতান্তই গৌণ বলিয়া মনে হয়। কবি যখন সান্ত্বনার ছলে বলেন—

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি,
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে,
বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসবো যাবো চিরদিনের সেই আমি।

—তখন সে আশ্বাস, সেই ব্যথার তুলনায় অতিশয় অবাস্তব বলিয়া মনে হয়। কারণ, যে-প্রাণ পৃথিবী ছাড়িয়া যাইবার সময়ে এমন বিদায়-বিধুর হয়, সে প্রাণের পক্ষে এ আশ্বাস সত্য নয়। মৃত্যুতে যদি ব্যক্তিত্বের লোপ হয়—তাহাই যদি স্বীকার করিতে হয়, তবে সেই সঙ্গে এই প্রাণও মরিয়া যাইবে; তখন ‘কান্না-হাসির এই দোল-দোলানি’—এই “pleasing anxious being”-ও যে আর থাকিবে না! সেই ভয়ই যে সব চেয়ে বড় ভয়—সেই ক্ষতিই যে সব চেয়ে বড় ক্ষতি! তাহার বদলে, ঐ যে ব্যক্তিত্বহীন অস্তিত্বের চেতনা—সর্ব্বভূতে নির্বিশেষে ব্যাপ্ত হওয়ার আনন্দ-তাহা কি সত্যই একটা সান্ত্বনা! কবি এখানে এই যে ‘চিরদিনের আমি’র অমরত্বের জয় ঘোষণা করিয়াছেন, ইহাতে একটা তত্ত্বজ্ঞানের আনন্দ হয়তো আছে, কিন্তু প্রাণের আশ্রয় ইহাতে কোথায়? যে আমি সকল খেলায় খেলা করে-সে আমি একটি সুন্দর কল্পনা মাত্র; তাহাতে একটা ভাবের সৌন্দর্য্যই আছে, প্রাণের ক্ষুধার বস্তু সে নয়—সে একটা মনের বিলাসের সামগ্রী। এইরূপ কল্পনা রবীন্দ্রনাথের আর একটি কবিতায় আছে, তাঁহার ‘শিশু’ বিদায় লইবার কালে তাহার মাকে বলিতেছে—

বাদলা যখন পড়বে ঝরে’
রাতে শুয়ে ভাববি মোরে,
ঝরঝরানি গান গা’ব ঐ বনে।
জানলা দিয়ে মেঘের থেকে
চমক দিয়ে যাব দেখে,
আমার হাসি পড়বে কি তোর মনে?
খোকার লাগি’ তুমি মাগো,
অনেক রাতে যদি জাগো
তারা হ’য়ে বলব তোমায় ‘ঘুমো’,
তুই ঘুমিয়ে পড়লে পরে
জ্যোৎস্না হয়ে ঢুকু ঘরে,
চোখে তোমার খেয়ে যাব চুমো।

—ইহাও কবিতা-হিসাবেই উপভোগ্য, কিন্তু পূর্ব্বোক্ত গানটির মধ্যে এই কল্পনাই একটি তত্ত্বরূপে উঁকি দিয়াছে। কবি, মৃত্যু হইতে মুক্তি, বা ব্যক্তির অমরত্বের যে আশ্বাস সেখানে ঘোষণা করিতেছেন, তাহা একটা তত্ত্বগত আশ্বাস মাত্র; অথচ সেই তত্ত্বজ্ঞান ও প্রাণের কামনার মধ্যে একটা বিরোধ রহিয়াছে। তাহাতে ব্যক্তি—চেতনাও যেন লোপ পাইতেছে না, বিশ্ব-চেতনার মধ্যেই তাহা জাগিয়া থাকিতে চায়; যে রূপরস সম্ভোগ ব্যক্তি-দেহে ব্যক্তির চেতনাতেই সম্ভব, তাহাকেই দেহহীন নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় ভোগ করিতে চায়। জীবনের প্রতি এই অতি-গভীর ও দুশ্ছেদ্য মমতার বশে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে কখনই একেবারে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতে দেন নাই, তাহাকে বার বার দূরে রাখিতে চাহিয়াছেন। যৌবনে একদা তিনি মৃত্যুকে সম্বোধন করিয়া এই যে বলিয়াছিলেন—

এ যদি সত্যই হয় মৃত্তিকার পৃথ্বী ‘পরে
মুহূর্ত্তের খেলা,
রাই এই সব মুখোমুখী, এই সব দেখা-শোনা
ক্ষণিকের মেলা;
* * * *
তুমি শুধু চিরস্থায়ী, তুমি শুধু সীমাশূন্য
মহা পরিণাম,
যত আশা যত প্রেম তোমার তিমিরে লভে
অনন্ত বিশ্রাম;
তবে মৃত্যু দূরে যাও, এখনি দিয়ো না ভেঙে’
এ খেলার পুরী,
ক্ষণেক বিলম্ব কর, আমার দু’দিন হ’তে
করিয়ো না চুরি।

—ইহাই তাঁহার প্রাণের অকপট উক্তি, এই মনোভাবই মৃত্যুসম্বন্ধে তাঁহার প্রকৃত মনোভাব। ইহারই বশে, মৃত্যুকে দূরে রাখিবার আকুল আগ্রহে তিনি কত ভাবেই না জীবনের অমৃত-রূপ ধ্যান করিয়াছেন!

তথাপি মনে হয়, আমরা তাঁহার যে-জীবন কাব্যের চলচ্চিত্র-পটে নানা বর্ণে বিলসিত হইতে দেখিয়াছি, তাহার অন্তরালে আত্মার যে নিশ্চল নিষ্কম্প জ্যোতিঃ-শিখা ‘ঘূর্ণির মাঝখানে একটি বিন্দু’র মত স্থির হইয়া বিরাজ করিতেছিল—তাহার সন্ধান কখনও পাই নাই। যে-পুরুষ জীবনের এই নাট্যশালায় অজস্র ফুল ও অফুরন্ত আলোর আয়োজন আপনিই করিয়া লইয়াছিলেন—তিনি যে অন্ধকারকে কখনও ভোলেন নাই, তাহা আমরা দেখিয়াছি; কিন্তু এত মমতা, এত মোহের মধ্যেও, যে বিশ্বাস তাঁহার অন্তরের অন্তস্থলে চিরদিন অটুট ছিল, যাহার বলে তিনি সকলই জানিয়া শুনিয়া এই অনিত্যের সঙ্গে নিত্যের খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছিলেন—সে কথা তিনিই জানিতেন, আমরা জানিতাম না। তাই মৃত্যুর তরণীতে পা দিবার সময়ে তিনি যখন সেই অনিত্য-লীলার নটবেশ ত্যাগ করিয়া নিত্যের আশ্রয় প্রার্থনা করিলেন, তখন আমাদের চমকিত হইবার কারণ থাকিলেও, কবির আত্মা চমকিত হয় নাই তিনি তখন অতি ধীর গম্ভীর দৃঢ় কণ্ঠেই তাঁহার আত্মার সেই অভয়মন্ত্র ঘোষণা করিলেন। মৃত্যুর বিভীষিকা যেমন তাঁহাকে জীবনের প্রতি বিমুখ করিতে পারে নাই, তেমনই জীবনের হাসি-কান্নায় নিজের প্রাণকে নিঃশেষে সমর্পণ করিয়াও, তিনি মৃত্যুকে কখনও বিস্মৃত হন নাই, যথাসময়ে তাহার দাবী মিটাইয়া দিতে প্রস্তুত ছিলেন। মৃত্যুর উৎসঙ্গে বসিয়াই তিনি নিজের অফুরন্ত প্রাণ-শক্তির বলে জীবনকে একটি উৎসবশালায় পরিণত করিয়াছিলেন—মৃত্যুকে জয় করিবার ভাবনাই যেন তাঁহার ছিল না। আমরা কবির সেই প্রাণের লীলাকে তাঁহার কবিতার মধ্যে যে রূপে প্রকাশ পাইতে দেখিয়াছি—কবি হয়তো নিজে কখনও তাহাকে সেইরূপে দেখেন নাই; আমাদের নিকটে তাহা যেমন ছিল, কবির নিকটে তেমন ছিল না। সেই একান্ত একক আত্মসাক্ষাৎকারের দিককে কবি তাঁহার কাব্য সাধনাতেও পৃথক রাখিয়াছিলেন—সেই দিকটি আমাদের চোখে পড়িবার নয় বলিয়াই কখনও পড়ে নাই। এই জীবন-রঙ্গভূমির নেপথ্য-অন্তঃপুরে—যেখানে কোন দর্শক নাই, শ্রোতা নাই, যেখানে-রূপ-রস-শব্দ-স্পর্শের বিচিত্র বেশ-বিলাস, আলো-ছায়ার অপূর্ব্ব ইন্দ্রজাল সরিয়া মুছিয়া যায়, সেখানে রূপশিল্পী নিজেকে নিজের সৃষ্টি হইতে পৃথক করিয়া দেখে, সেখানে যে আত্মসাক্ষাৎকার অনিবার্য্য—রবীন্দ্রনাথ, রূপের ভাষাতেই অপরূপের সুর যোজনা করিয়া, তাঁহার গানগুলিতে, নিজের সেই ব্যক্তি-চেতনার শেষ স্বাক্ষর দিয়া তাহা ব্যক্ত করিয়াছিলেন; কারণ, প্রাণের সেই গভীরতম আকুতি ও আশ্বাস—সেই অতিশয় আত্মগত অনুভূতি—জাগ্রত ব্যক্তি-চেতনাকেও অতিক্রম করে, তাহা অনির্ব্বচনীয়; তাই তাহাকে গানের সুরেই কথঞ্চিৎ ব্যক্ত করা যায়। সে সুরও যেন নিজের সঙ্গে নিজেরই আলাপন —অন্যের নিকট তাহা স্পষ্ট হইবার নয়,—

আমার একটা কথা বাঁশী জানে,
বাঁশীই জানে।
লা ভরে রৈল বুকের তলা,
কারে কাছে হয় নি বলা,
কেবল ব’লে গেলেম বাঁশীর
কানে কানে।

কিংবা—

মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-পরে—
প্রিয়তম হে জাগো, জাগো, জাগো!
জীবনে আমার সঙ্গীত দাও আনি’
নীরব রেখো না তোমার বীণার বাণী—
হৃদয়পাত্র সুধায় পূর্ণ হবে,
তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে—
প্রিয়তম হে, জাগো, জাগো, জাগো।’

অথবা-

নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,
শূন্য হিয়ার বাঁশীতে বাজিবে গান,
পাষাণ তখন গলিবে নয়ন-জলে ॥

ইহা হইতেই, তাঁহার গান যে কি বস্তু তাহা বুঝিতে পারা যাইবে। এই গানের ভিতর দিয়াই কবি নিজের গভীরতম বেদনা, কামনা, বাসনা, আশা ও বিশ্বাস—প্রাণের অতিশয় নিভৃত নির্জ্জনে যেন সকলের অগোচরে যে-দেবতার নিকটে নিবেদন করিয়াছিলেন, সে-দেবতা কি শুধুই জীবনের দেবতা, না শুধুই মৃত্যুর? যখন শুনি—

শতদল-দল খুলে যাবে থরে থরে
লুকানো রবে না মধু চিরদিন তরে।
আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,
ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি’,
কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি,
পরম মরণ লভিব চরণ তলে।

—তখন কোন প্রশ্ন আর থাকে না।

এই যে আর এক প্রকার পরম আশ্বাসের অনুভূতি, ইহা আপনাকে নিঃশেষে হারাইয়া ফেলার—একটি চরম পূর্ণতার মধ্যে আপনাকে পূর্ণ করিয়া দেওয়ার—যে ‘অকূল শান্তি ও বিপুল বিরতি’, তাহারই পূর্ব্বাস্বাদ। এই যে মৃত্যু—এ মৃত্যু রূপপিপাসার গুঞ্জরণ-শেষে মধুপানে নীরব হওয়ার মৃত্যু। এ অবস্থা মানুষের সাধারণ অনুভূতির অতীত, ইহাকে বাক্যের দ্বারা বোধগম্য করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ এখানে কবি নন—মিস্টিক রসের সাধক। এ অবস্থায় জীবনের প্রতি মমতা, এবং তাহারই ফলে মৃত্যুকে আড়ালে রাখিবার কোন প্রয়োজনই আর নাই; এমনও বলা যাইতে পারে যে, এ অবস্থায় পৌঁছিলে জীবন ও মৃত্যু দুইয়েরই কোন সাক্ষাৎ চেতনা আর থাকে না। অতএব, রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনের সেই অপর ও প্রায় সৰ্ব্বকালীন যে ভাব-কল্পনা— যাহাতে মৃত্যুর সঙ্গে লুকাচুরি খেলার একটি নূতন রসে তিনি আমাদের মনকে আকুল, এবং জীবনেরই পূজায় উন্মুখ করিয়া দেন, তাহাই কবির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ের নিদান।

জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা
ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা,
পূর্ণের পদ-পরশ তাদের পরে।

—এই যে আশ্বাস, ইহাই মানব-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দান। এক দিকে জীবন-বিরহ, ও অপরদিকে মৃত্যু-মিলন—এই উভয়েরই গান তিনি কত ছন্দে কত সুরে গাহিয়াছেন, কিন্তু তথাপি, মৃত্যুর সহিত মিলনের সুখ নয়—জীবনের বিরহ—ভয়ই তাঁহার কাব্যে জীবনকে যে দুর্লভতার গৌরব দান করিয়াছে, তাহাই আমাদিগকে চরিতার্থ করে। কবি রবীন্দ্রনাথের সাধনায় নানা স্তর আছে, সোপান-পরম্পরাও হয়তো আছে,—একই মন্ত্রের সাধনায় তিনি হয়তো আসন পরিবর্ত্তন করিয়াছেন, কিংবা যেখানে পৌঁছিয়াছেন সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন; তাহাতে কখনও প্রেমের অতৃপ্তি-সুখ, কখনও ভক্তির আত্মসমর্পণ, কখনও জ্ঞানের দৃঢ় প্রত্যয় আছে—কিন্তু কোন অবস্থাতেই তিনি জীবনকে লেশমাত্র অশ্রদ্ধা বা অবিশ্বাস করেন নাই। এই জগৎ ও জীবনের প্রতি যে আসক্তি তাহা যদি একটা মোহমাত্রই হয়, তথাপি সেই মোহই মুক্তিরূপে জ্বলিয়া উঠিবে—একদা তাঁহার কবিচিত্তে এই যে প্রত্যয় জাগিয়াছিল, তাহার পশ্চাতে এক সুগভীর উপলব্ধি ছিল; সেই উপলব্ধিও অতি উৎকৃষ্ট বাণীতে প্রকাশ পাইয়াছিল, তেমন আশ্বাসবাণী তাঁহার কাব্যে আর কোথাও তেমন ভাবে ফুটিয়া উঠে নাই। সে বাণী যেন একটি প্রকাশ—একটি Revelation; তাহাতে ভাব-কল্পনার সম্পূর্ণ প্রভাব থাকিলেও, সে বাণী যেন এক অপৌরুষেয় প্রজ্ঞার আলোকে সমুজ্জল। আমি এখানে কবির সেই উক্তিগুলি উদ্ধৃত করিতেছি—

প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি,
ভাব হ’তে রূপে অবিরাম যাওয়া আসা;
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা!

এবং

চিরকাল একি লীলা গো—
অনন্ত কলরোল
অশ্রুত কোন্ গানের ছন্দে
অদ্ভুত এই দোল।
দুলিছ গো, দোলা দিতেছ,
পলকে আলোকে তুলিছ, পলকে
আঁধারে টানিয়া নিতেছ।
****
ডান হাত হ’তে বাম হাতে লও,
বাম হাত হ’তে ডানে।
নিজ ধন তুমি নিজেই হরিয়া
কী যে করো কে বা জানে!
****
এই মত চলে চিরকাল গো,
শুধু যাওয়া, শুধু আসা।
চিরদিনরাত আপনার সাথ
আপনি খেলিছ পাশা।
আছে ত’ যেমন যা’ ছিল,
হারায় নি কিছু, ফুরায় নি কিছু—
যে মরিল যে বা বাঁচিল। …….
আছে সেই আলো, আছে সেই গান
আছে সেই ভালবাসা।
এইমত চলে চিরকাল গো
শুধু যাওয়া, শুধু আসা।

—মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের বাণী ইহার পরে আর কোথাও পূর্ণতর বা স্ফুটতর হইয়া উঠে নাই, ইহার নিকটে—

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি,
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি।

—এক প্রকার তত্ত্বরসের কুহক-সৃষ্টি বলিয়াই মনে হয়।

কিন্তু কোথা হইতে কোথায় আসিয়া পড়িয়াছি! এ প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছিলাম এই বলিয়া, যে রবীন্দ্রনাথের জীবনকে ও সেই জীবনের সাধনাকে আমরা এতকাল যে ভাবে যেরূপে বুঝিয়াছিলাম, আজ তাঁহার মৃত্যুসংক্রান্ত কতকগুলি ব্যাপারে সেই জীবন ও সেই সাধনার সম্পর্কে আমাদের মনে একটা সংশয় ব্যকুলতার সৃষ্টি হইয়াছে। জীবনকে নূতন করিয়া দেখিবার জন্য যে আলোক তিনি জ্বলিয়াছিলেন—উপনিষদের সেই ঋষিমন্ত্র, সেই “মধুবাতা ঋতায়তে”-মন্ত্রের যে কবি-ভাষ্য তিনি রচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে, আমাদের বহুকালের অভ্যস্ত সংস্কার—জীবনের বহিঃপ্রাঙ্গণে যে পরলোক ও মৃত্যুর অন্ধকার যুগ যুগ ধরিয়া ঘনাইয়া উঠিয়াছিল—তাহার ঘোর কাটিয়া যাইতেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধবাসরে তাঁহার স্বরচিত ও অভিপ্রেত যে মন্ত্রগান সহকারে তাঁহার আভ্যুদয়িক সম্পন্ন হইয়াছিল, তাহাতে-মৃত্যুর সেই রহস্যান্ধকার জীবনের উপরে আবার তেমনই ভাবে নামিয়া আসিয়াছে, জীবন যেন নিতান্তই ক্ষুদ্র তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। আমার চিত্তে এই যে ভাবান্তর ঘটিয়াছে, ইহার আরও প্রকৃষ্ট কারণ আছে। মৃত্যু যখন আসন্ন, এবং আরও পরে যখন কবি তাহার প্রায় সাক্ষাৎ-মূৰ্ত্তি দেখিলেন, তখন তিনি যে দুই কবিতায় তাহার চরম বাণী লিপিবদ্ধ করিলেন, তাহাও কম অর্থপূর্ণ নয়; আমি তাহাই স্মরণ করিয়া প্রসঙ্গের আরম্ভে, কবির আজন্ম সাধনায় মৃত্যুকে জয় করিবার সেই প্রয়াসকে আর এক চক্ষে দেখিয়াছি। হয়তো সে দেখাও ঠিক নহে, –গূঢ়তর তত্ত্বদৃষ্টির সাহায্যে কবির সেই সাধনাকে একটি নির্দ্বন্দ্ব্বধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত করা খুব সহজ অথবা সম্ভব। কিন্তু আজ কোনরূপ তত্ত্বের গহনে প্রবেশ করিবার মত প্রাণের অবস্থা নয়; তাহার উপর, কবির সেই চরম বাণী প্রাণ-মন বিকল করিয়াছে। এক্ষণে আমি সেই কবিতা দুইটি হইতে কয়েকটি বিশেষ পংক্তি উদ্ধৃত করিয়া, তাহাদের অর্থ যেমন বুঝিয়াছি, তাহাই বলিব।—

তোমার সৃষ্টির পথ রেখছ আকীর্ণ করি’
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছে নিপুণ হাতে
সরল জীবনে…..
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার’।।

এবং-

দুঃখের আঁধার রাত্রি বার বার
এসেছে আমার দ্বারে।….
যতবার ভয়ের মুখোস তার করেছি বিশ্বাস,
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
এই হার-জিত খেলা, জীবনের এ মিথ্যা কুহক,
… দুঃখের পরিহাসে ভরা
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি—
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।

—এখানে জীবন ও মৃত্যু দুইয়ের এক মূর্তি; জীবন সরল-বিশ্বাসীকে মিথ্যার ফাঁদে ফেলিবার জন্য সৃষ্টির পথ বিচিত্র ছলনাজালে আকীর্ণ করিয়াছে, এবং মৃত্যুও আঁধারে তাহার নিপুণ শিল্প— ‘ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি’—ছড়াইয়া রাখিয়াছি, ইহাও জীবনের মিথ্যা কুহক—’দুঃখের পরিহাসে ভরা’। একদিকে ছলনা, আর একদিকে ভয়—জীবন ও মৃত্যু কেহই সত্য, শিব, বা সুন্দর নয়। কিন্তু কবি এই প্রবঞ্চনাকেও মূল্যহীন মনে করেন নাই, কারণ, যে মহৎ—যে আপনার অন্তরের চিরস্বচ্ছ, ঋজু, বিশ্বাস সমুজ্জ্বল পথে এই কুটিলকে জয় করে, ইহাকে সহ্য করিয়াই—

সত্যের সে পায় আপন আলোকে ধৌত
অন্তর-অন্তরে,

—অর্থাৎ, যে ইহাকে অস্বীকার করিবার প্রয়োজন অনুভব করে নাই—’লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত’; কিন্তু এই ছলনাকেই অনায়াসে সহিয়া—

সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।

এই উক্তি আরও গভীর গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে ইহার শিথিল বাক্যযোজনায়; ভাষা যেন সেই মৰ্ম্মান্তবিদারী চরম অভিজ্ঞতার অর্থ বহন করিতে না পরিয়া, এক প্রকার মন্ত্রচ্ছন্দের বাণীরূপ ধারণ করিয়াছে। ইহাই স্বাভাবিক; কারণ, ইহা সেই সময়ের উক্তি—যখন এক অতি তীক্ষ্ণ দেহচেতনা-কাতর আত্মার শেষ মৰ্ত্তবন্ধন খসিয়া যাইতেছে; ইহাতে কেবল এক প্রাণান্তিক বিশ্বাসের ঘোষণাই আছে—যাহাকে সম্বল করিয়া সেই জীবন-ক্লান্ত পথিক অবশেষে অনন্তের পথে যাত্রা করিলেন।

তথাপি, ইহাতেও—জীবনের ছলনা, মৃত্যুর নিপুণ শিল্প, প্রভৃতির—অর্থ খুব স্পষ্ট। সে অর্থ এই যে, শেষ পর্য্যন্ত আত্মাই আত্মার পরম নির্ভর; আত্মার বাহিরে যাহা কিছু, তাহার একটা নেতি-মূলক (negative) মূল্যই আছে; জীবন ও মৃত্যু—দুইয়েরই বন্ধনপাশ এই হিসাবে তুচ্ছ নয় যে, তাহাকে কাটিয়া বাহির হইবার শক্তিই আত্মার মহত্ত্ব প্রমাণ করে। এই মিথ্যা-সুন্দর কিম্বা ভয়ঙ্কর হইয়াও আত্মার কোন ক্ষতি করিতে পারে না; কারণ আত্মার অন্তরের আলোকে সত্যই ধৌত হইয়া উঠে।

ইহাই কবির শেষ বাণী। এ বাণী একদিকে যেমন সত্য স্বীকারের বাণী-আত্মার অভয় ঘোষণার বাণী, তেমনই, আর একদিকে ইহা জীবনকে বিদায় দেওয়ার—জীবনের সহিত সকল সম্বন্ধ মুছিয়া ফেলার-বাণী। কবির আত্মা যেন জীবনের সকল দেনা শোধ করিয়া মৃত্যুস্নানে নিৰ্ম্মল ও শুচি হইয়া উঠিয়াছে। কবি এতদিনে জীবনের যে পরিমাণকে বরণ করিলেন, সে পরিণাম পূর্ব্বেও তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না, কারণ, তাঁহাকেই আমরা গাহিতে শুনিয়াছি—

চোখের আলোয় দেখেছিলাম
চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন
আলোক নাহি রে।
ধরায় যখন দাও না ধরা
হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয়
তোমায় চাহি রে।
তোমায় নিয়ে খেলেছিলাম
খেলার ঘরেতে,
খেলার পুতুল ভেঙে গেছে
প্রলয় ঝড়েতে,…

অতএব, এই মনোভাব—এই বৈরাগ্যের সুর—অনেক পূর্ব্ব হইতেই আরম্ভ হইয়াছিল, প্রাণের মোহের উপরে এই আধ্যাত্মিক মুক্তি-পিপাসা জয়ী হইয়া উঠিতেছিল। আজ তাঁহার এই শেষের বাণী শুনিয়া আমরা চমকিত হইয়াছি বটে, মনে হইতেছে, রবীন্দ্রনাথের সেই দুর্দ্ধর্ষ মানবতাও অবশেষে আধ্যাত্মিকতার নিকটে পরাজয় স্বীকার করিয়াছে; তিনি জীবনের মধ্যেই, ‘সহস্র বন্ধনমাঝে মুক্তির স্বাদ’ লাভ করিতে পারিলেন না; শেষ পর্যন্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়াই তাঁহাকে আত্মার মুক্তি বা অভয় প্রার্থনা করিতে হইল। কিন্তু হয়তো আমরাই ভুল বুঝিয়াছিলাম; এতদিন জীবনের বহিরাবরণে বিচ্ছুরিত কবি-শিল্পীর সেই অসাধারণ শিল্প-প্রতিভার রশ্মিচ্ছটাই আমরা দেখিয়াছি, সেই শিখার অন্তস্থলের স্থিররশ্মি দেখি নাই। জীবনকে যে বাহিরের দৃষ্টিতে তিনি দেখিয়াছিলেন, সে দৃষ্টি তিনি আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন; যাহা শুধু বাণীতেই ধরা যায়, শুধু তাহাই নয়, যাহাকে বাণীতেও ধরা যায় না, তাহাকেও তিনি সুরে ধরিয়া দিয়াছেন; কিন্তু যাহা বাণী ও সুর দুইয়েরই অতীত, তাহাকে তিনি সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন—তাঁহার মৃত্যুকালীন মুখ—জ্যোতি তাহার আভাস মাত্র দিয়াছে। সেই আভাসের সাহায্যেই রবীন্দ্র-জীবন ও রবীন্দ্র-কাব্য আর একবার ভাল করিয়া আদ্যোপান্ত বুঝিয়া লইতে হইবে।

আশ্বিন, ১৩৪৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *