ত্রিশ
আর্কটিক, পোলার আইল্যাণ্ড।
সকাল এগারোটায় পৃথিবী জুড়ে প্রলয় শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু এখন দুপুর দুটো।
ছুটছে রানার অ্যান্টোনভ বিমান, উত্তর দিগন্তে দেখা দিয়েছে আবছা সাদা পোলার আইল্যাণ্ড। এগিয়ে আসছে দ্বীপের দক্ষিণের পর্বতমালা। দেখা গেল উত্তরের মালভূমি, মাথার উপর সসার নিয়ে উঁচু টাওয়ার ও প্রকাণ্ড দুই ভেণ্ট।
অ্যান্টোনভের রেডিয়ো ব্যবহার করল রানা। ‘শুনছেন, আমেরিকান লিসেনিং পোস্ট? বাংলাদেশ আর্মির মেজর মাসুদ রানা বলছি! মস্ত বিপদে পড়েছি আমরা! কেউ কি মনিটর করছেন এই ফ্রিকোয়েন্সি?
মুহূর্তে এল জবাব। রাশান ভাষায়। বোধহয় স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ায় হেরে রেগে কাঁই হয়ে আছে। অবশ্য, এক সেকেণ্ড পর তার গলা টিপে ধরল কড়কড় আওয়াজের স্ট্যাটিক। এবার এল এক আমেরিকানের কণ্ঠ: ‘মেজর মাসুদ রানা, এক সেকেণ্ড, আমরা সিকিয়োর লাইনে যাচ্ছি।’ কয়েকটা সুইচ টেপার আওয়াজের পর বলল, ‘স্যর, এটা ইউনাইটেড স্টেট্স এয়ার ফোর্স লিসেনিং পোস্ট ব্রাভো-স্মিথ-সেভেন-নাইনার, অপারেট করা হচ্ছে এলেশন দ্বীপপুঞ্জের এরেকসন এয়ার স্টেশন থেকে। আপনি যোগাযোগ করতে পারেন বলে আগেই আমাদেরকে জানানো হয়েছে। দয়া করে নিজের কোড নেম দিন, সঙ্গে ভেরিফিকেশনের কম সিকিউরিটি পাসওঅর্ড।’
নিজের নাম ও পাসওঅর্ড দিল রানা, তারপর বলল, ‘সরাসরি হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে লাইন দিন।’
‘জী, স্যর।’
এখনও হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে আছেন প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর ক্রাইসিস টিমের সবাই। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্সের বাড়তি দু’জন কর্মী: কেভিন কনলন ও রিনা গর্ডন। এ মুহূর্তে রুমে নেই সিআইএ-র রিপ্রেযেক্টেটিভ। রিনা গর্ডন ও কেভিন ব্রিফ শুরু করবার আগে তাকে অনুরোধ করেছে, যাতে ঘর ত্যাগ করে সে।
কিছুক্ষণ হলো ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে রিনা গর্ডন
কিন্তু হঠাৎ করেই প্রাক্তন এক মেরিন জেনারেল, বর্তমানে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইযার, তিনি চালু করে দিলেন স্পিকারফোন। মুখে বললেন, ‘মাসুদ রানা লাইনে আছেন।’ মাইক্রোফোনে জানালেন, ‘আমি কার্টিস উডল্যাণ্ড বলছি, মিস্টার রানা। আমার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আছেন। আপনি কোথায়, মিস্টার রানা? দয়া করে বলুন কী হয়েছে অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইসের।
‘ওই ডিভাইস বিকল করা হয়নি, স্ফেয়ার ও মিসাইল নষ্ট করে দেয়া হয়েছে,’ বলল রানা। ‘এখন জরুরি একটা কথা জানতে চাই। যখন আপলিঙ্ক সিগনাল বন্ধ হলো, সেসময়ে কি পোলার আইল্যাণ্ড লক্ষ্য করে নিউক্লিয়ার মিসাইল লঞ্চ করেছে রাশানরা?’
‘হ্যাঁ, তাই করেছে। তিন মিনিট আগে।’
‘কখন আঘাত হানবে?’
‘উনিশ মিনিট পর।’
‘আপনারা রাশানদের সঙ্গে কথা বললে মিসাইল নষ্ট করবে তারা?’
‘না। কেউ ওই মিসাইল ফেরাতে পারবে না, ওটার গাইডেন্স কন্ট্রোল সিস্টেম ডিসেবল করে দেয়া হয়েছে। রাশানরা ধ্বংস করতে পারবে না ওটা। নিশ্চিত করেছে, যাতে ওই নিউক্লিয়ার মিসাইল ঠিকভাবে পোলার আইল্যাণ্ডে আঘাত হানে।’
লাইনে চুপ হয়ে গেছে রানা।
‘মিস্টার রানা?’ বললেন উডল্যাণ্ড, ‘আপনি কোথায়?’
‘পোলার আইল্যাণ্ডের দক্ষিণে, একটা বিমানে।’
‘তা হলে বসে আছেন কেন? সরে যান ওখান থেকে। উনিশ মিনিট পর ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ধ্বংস হবে ওই দ্বীপ।’
‘দ্বীপে আমার লোক রয়ে গেছে, মিস্টার উডল্যাণ্ড,’ গম্ভীর শোনাল রানার কণ্ঠ।
স্পিকারফোনের কাছে ঝুঁকে এলেন প্রেসিডেন্ট। ‘মিস্টার রানা, আমি প্রেসিডেন্ট… ‘
‘এক্সকিউয মি, স্যর, আপনি কি জানেন হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কেভিন কনলন নামের কেউ?’
চট্ করে কেভিন কনলনের দিকে ঘুরলেন প্রেসিডেন্ট।
‘হ্যাঁ, তা করেছে। একটা গেট উড়িয়ে দিয়ে এখানে এসে ঢুকেছে। আমার পাশেই আছে। সঙ্গে ডিআইএ-র আরেকজন, ব্রিফ করছিল দু’জন মিলে। সিআইএ-র কিল-ড্রাগন নামের প্ল্যান ও উইলিয়াম থ্রাশার নামের এক লোকের বিষয়ে কথা বলছিল।’
‘সারা সকাল ওই উইলিয়াম থ্রাশারের সঙ্গে লড়েছি আমরা। ..হাই, কনলন।’
‘হাই, মিস্টার রানা, স্পিকারফোনের কাছে সরে এল কেভিন। সবার চোখ ওর উপর স্থির। ‘কী করছেন ওখানে?’
‘কিছুক্ষণের জন্য মারা পড়েছিলাম, আপাতত ভাল আছি। এত সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ, কেভিন। তোমার দেয়া নানান তথ্য না পেলে মস্ত বিপদে পড়তাম। আশা করি বিরাট কোনও বিপদে ফেলে দিইনি?
‘না, তেমন কিছুই না,’ মৃদু হাসল কেভিন।
‘ঠিক আছে। …মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আরেকটা বিষয় জানিয়ে রাখি: আমরা ঠেকিয়ে দিয়েছি অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইসের আগুন। কিন্তু একযিট প্ল্যান অনুযায়ী সঠিক সময়ে সরে গেছে উইলিয়াম থ্রাশার। আবারও দেখা দেবে ল্যাংলিতে। আমি হয়তো আর ফিরব না, কিন্তু, স্যর, আমি চাই তার শাস্তি হোক। আপনি কি তা নিশ্চিত করবেন?’
‘আমরা তাকে খুঁজে বের করব,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘কথা দিলাম।’
‘ধন্যবাদ, স্যর। এবার বিদায় নিতে হচ্ছে, পৌছে গেছি পোলার আইল্যাণ্ডের কাছে।
নামতে শুরু করেছে অ্যান্টোনভ বিমান, সামনেই পড়বে দ্বীপের এয়ারস্ট্রিপ।
হাতঘড়ি দেখল রানা।
উনিশ মিনিট পর রাশান নিউক আসছে শুনেই টাইমার চালু করেছিল। এখন দেখাচ্ছে টাইমারে:
১৪:৪৭…..
১৪:৪৬…
১৪:৪৫….
দেরি না করেই অঙ্ক কষল রানা।
অবতরণে একমিনিট, দলের জীবিত নিশাত, বুনো, পবন, ফারিয়া ও শ্যারনের কাছে পৌঁছুতে দশ মিনিট। চার মিনিট আবারও অ্যান্টোনভের উঠে মিনিমাম সেফ ডিসট্যান্স বা এমএসডি- এ পৌঁছে যাওয়া।
হিসাবের সংখ্যাগুলো ভাল ঠেকল না রানার কাছে।
হাতে সময় বা ভাল অস্ত্র নেই যে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকদের বিরুদ্ধে লড়বে। অস্ত্র বলতে বন্ধু, কিন্তু ফুরিয়ে গেছে তার গুলি বিমানে পেয়েছে কয়েকটা পিস্তল, এসব দিয়ে যুদ্ধ চলে না।
ভোরে ক্যাম্পে নিজের বলা কথা মনে পড়ল ওর, ‘আপনাদের কাউকে বিপদে ফেলে যাব না। বন্দি হতে পারেন, কিন্তু বেঁচে থাকলে ফিরে আসব সরিয়ে নিতে।’
রানওয়ের দিকে যাওয়ার সময় রানা দেখল, বেস থেকে নানাদিকে রওনা হয়েছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিক।
তারা যে শুধু সুপ্রিম লিডারকে হারিয়েছে, তা নয়, থ্রাশারের সঙ্গে উধাও হয়েছে গোটা কমাণ্ড গ্রুপ। সৈনিকরা এখন চাইছে নির্দেশ দেয়া হোক তাদেরকে। বুঝছে না কী করা উচিত।
বন্ধুর শর্ট-রেঞ্জ রেডিয়ো ব্যবহার করল রানা।
‘আপা! বুনো! পবন! ফারিয়া! শ্যারন! তোমরা শুনছ আমার কথা?’
এক লোকের কণ্ঠ শুনল রানা।
‘আরে শালা, তোমার মাকে…
‘কী বলছিস্ কুকুরের বাচ্চা!’ হিসহিস করে উঠল আরেক কণ্ঠ: ‘নিজের মাকে … কর্! আমি করেছিলাম, তোর মা খুবই খুশি হয়েছিল!’
নিশাত, ডিফেখন বা অন্য কারও সাড়া নেই।
‘মেজর, আমি,’ নরম একটা কণ্ঠ বলল।
পবন।
‘বেঁচে আছি। আমার সঙ্গে ‘এফ’।’ পবন বুঝতে পেরেছে, অন্যরাও শুনবে ওর কণ্ঠ। তাই ফারিয়ার নাম উচ্চারণ করেনি।
‘ঝটপট দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে,’ বলল রানা। ‘বুনো যে জায়গায় ডিজেল ফেলেছিল, ওখানে এসো নয় মিনিটের ভেতর।’ রানাও চাইছে না জানাতে কোথায় সাক্ষাৎ হবে ওদের।
‘ঠিক আছে। দেখা হবে।’
কয়েক সেকেণ্ড পর ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে বলল এক মেয়ে, ‘রানা, সত্যি…’ দুর্বল ভাবে কাশল, তারপর বলল, ‘সত্যিই ফিরে এলে আমাদের নিয়ে যেতে?’
‘তুমি কোথায়?’
‘যেখানে রেখে গেছ। কিন্তু সমস্যায় পড়ে গে… গুড়ুম করে উঠল পিস্তল। ‘বড় ধরনের সমস্যা!’
‘ওখানেই থাকো, আমি আসছি।’
‘ঠিক আছে!’ ‘বুম!’ করে উঠল পিস্তল।
এয়ারওয়েভে টিটকারির সুরে বলল এক লোক, ‘ওহ্-আহ্, ডার্লিং! থাকো ওখানেই, আমরাও আসছি!’
১৪:০৪…
১৪:০৩…
১৪:০২…
রানওয়ের দিকে যেতে যেতে নিশাত ও ডিফেখনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইল রানা। কিন্তু বদলে শুনল ভয়ঙ্কর বাজে কয়েকটা গালি।
নিশাত সুলতানা বা পিয়েখে ডিফেখন সাড়া দিল না।
খারাপ হয়ে গেল রানার মন।
সাঁৎ করে প্রকাণ্ড দুই ভেণ্ট পাশ কাটিয়ে এল ও, সসারের মত টাওয়ার ছুঁয়ে নামতে শুরু করেছে রানওয়ের দিকে। কখন যেন ছোট পিরিচটা খসে পড়েছে টাওয়ার থেকে, ওটা আছে এখন টাওয়ারেরই পায়ের কাছে। কয়েক সেকেণ্ড পর রানওয়ে স্পর্শ করল অ্যান্টোনভের চাকা। ভুস করে ধোঁয়া উঠল পোড়া রাবারের। কমতে শুরু করেছে গতি, রানওয়ের মাঝে পৌছে গেল। থামল বিমান পশ্চিমের ক্লিফের পঞ্চাশ গজ দূরে।
সগর্জনে বিমান এয়ারস্ট্রিপে নেমে আসতেই হ্যাঙারের সামনে জড় হয়েছে কমপক্ষে বিশজন রাফিয়ান আর্মির সৈনিক।
লাফ দিয়ে জিপে উঠল তারা, তেড়ে এল বিমানের দিকে। তাদের জানতে হবে তাদের নেতা অ্যান্টোনভে আছে কি না।
বিমান থেকে লাফিয়ে নামল রানা। চট্ করে দেখে নিল টাইমার:
১৩:১২…
১৩:১১…
১৩:১০…
তখনই জিনিসটা দেখল রানা।
রানওয়ের উত্তরদিকে পড়ে আছে মোটরসাইকেলটা। ওটার দুই আরোহীকে গুলি করে উড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধু। একটু দূরেই পড়ে আছে দুই লাশ।
এক দৌড়ে মোটরসাইকেলের পাশে পৌঁছে গেল রানা, দুই টানে সোজা করে নিল ওটাকে। চেপে বসেছে সিটে, কিকারে তিন লাথি দিতেই গর্জে উঠল শয়তানের বাহন।
মুচড়ে ধরল থ্রটল, পিছনে তুষার ছিটকে দিয়ে রওনা হয়ে গেল মোটরসাইকেল।
১২:৩১…
১২:৩০…
১২:২৯…
মনে মনে একবার কপালের দোষ দিল রানা। আবারও ফিরতেই হয়েছে অভিশপ্ত দ্বীপে, আর নেতাহীন একদল সশস্ত্র পশু সুযোগ পেলেই মেরে ফেলবে ওদেরকে!
তার চেয়েও বড় কথা: মাত্র সাড়ে বারো মিনিট সময় পাবে সঙ্গীদেরকে নিয়ে সরে যাওয়ার!
থ্রটলের কান মুচড়ে ধরেছে রানা, রানওয়ে থেকে সাঁই-সাঁই করে উঠে যাচ্ছে টিলার উপরে— সামনে পড়বে তিমি মাছ ধরা গ্রাম। মাত্র আধঘণ্টা আগে ওখান থেকেই উঠে এসেছিল ও।
১১:০৫…
১১:০৪…
১১:০৩…
একবার চট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে রানওয়ের দিকে চাইল রানা।
চার জিপ ভরা রাফিয়ান আর্মির চোরের দল পৌঁছে গেছে বিমানের কাছে। লাফ দিয়ে গিয়ে ঢুকল বিমানের ভিতরে।
কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও ফিরে চাইল রানা। এবার দেখল বিমানের পেট থেকে বেরিয়ে আসছে তস্করগুলো। হতাশ ও দ্বিধান্বিত মনে হলো তাদেরকে। হঠাৎ ছুটন্ত মোটরসাইকেলের দিকে আঙুল তুলল একজন। লাফ দিয়ে দুই জিপে উঠল
কয়েকজন, শুরু করেছে ধাওয়া।
সামনে টিলার মাথায় উঠে দু’দিকে গেছে দুই রাস্তা। বামেরটা বেছে নিল রানা। তীর গতি তুলছে, সামনেই পড়বে তিমি মাছ ধরা গ্রাম।
জানিয়ে চলেছে ওর ঘড়ির টাইমার:
০৯:৫৯…
০৯:৫৮…
০৯:৫৭…
একমিনিট পেরোতেই গ্রামের রোডব্লকে পৌঁছে গেল রানা। এখানেই ওকে বন্দি করেছিল কর্নেল সাইক্লোন।
একপাশে পার্ক করা রাফিয়ান আর্মির জিপ। কিন্তু আশপাশে জীবিত কেউ নেই। রাস্তার উপর লাশ হয়ে পড়ে আছে কয়েকজন তস্কর সৈনিক। শ্যারনের স্মোক গ্রেনেডের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে খতম করেছিল রোবট বন্ধু।
ঝড়ের গতিতে রোডব্লক পেরিয়ে গেল রানা, স্কিড করে থামল তুষার ঢাকা গ্রামের মুখে। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল মোটরসাইকেল থেকে, হাতে উদ্যত পিস্তল। ‘শ্যারন!’ গলা ছাড়ল রানা।
বামে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল ওর।
দুই ছাউনির মাঝ দিয়ে ছুটছে রোমশ এক পোলার বেয়ার।
গুড়ুম! গুড়ুম!
গুলির আওয়াজ।
গ্রামের ভিতর থেকে এসেছে শব্দ। ওদিকেই গেছে ভালুক। দেরি না করেই ছুট লাগাল রানা ওদিকে।
একটা বাঁক নিয়েছে, এমন সময় আবারও গর্জে উঠল অস্ত্র।
তখনই দেখল একটা দেয়ালের কোণে পিঠ ঠেকিয়ে বসে গুলি করছে শ্যারন। ওটা ওর শেষ অস্ত্র। ক্ষুদে রুগার এলসিপি পকেট পিস্তল। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে, গুলি করছে দানবের মত মস্ত এক ভালুক ঠেকাতে!
উপুড় হয়ে ধুপ্ করে তুষারে পড়ল ভালুক, সারাদেহে বুলেটের ক্ষত। ব্যস্ত রানা লক্ষ করল, তুষারে পড়ে আছে আরও তিন ভালুকের মৃতদেহ। ও চলে যাওয়ার পর একের পর এক মেরু ভালুক হামলা করেছে শ্যারনের উপর। এত ছোট ক্যালিবারের গুলি দিয়ে এসব দানব শেষ করা প্রায় অসম্ভব!
নতুন ভালুক বিকট গর্জন ছেড়ে শ্যারনের দিকে ধেয়ে গেল।
ওটাকে লক্ষ্য করে গুলি করল শ্যারন।
কিন্তু ওই বুলেট ছিল ম্যাগাযিনের শেষ গুলি।
আর নেই!
আতঙ্ক নিয়ে ভালুকের দিকে চাইল শ্যারন।
বিকট গর্জন ছাড়ল ভালুক। সোজা তেড়ে গেল শ্যারনকে লক্ষ্য করে। এবার কেউ ঠেকাতে পারবে না তাকে!
রানার দু’হাতের দুই পিস্তল গুড়ম করে উঠল।
শ্যারনের পায়ের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেরু ভালুক। দু’বার ফুটো হয়ে গেছে ওটার করোটি। দীর্ঘ জিভ বেরিয়ে এল, তুষারে পড়ছে গলে যাওয়া রক্তাক্ত মগজ।
মুখ তুলে রানার দিকে চাইল শ্যারন, বড় করে দম নিল।
ঝটপট ওর সামনে পৌছে গেল রানা, দু’হাতে কোলে তুলে নিল, আরেক দৌড়ে এসে নামাল মোটরবাইকের সাইডকারের আরামদায়ক সিটে।..
ওকে বয়ে আনবার সময় রানার পিঠে ঝুলন্ত বন্ধুকে দেখেছে শ্যারন।
‘হ্যালো, ম্যাম,’ ইলেকট্রনিক কণ্ঠে বলল বন্ধু।
‘অ্যালো,’ মিষ্টি করে হাসল শ্যারন। রানাকে বলল, ঠিক সময়ে এসেছ। কখনও ভাবিনি সত্যিই ফিরবে।’
‘আমি অনেকের কাছেই খারাপ লোক, কিন্তু অতটা খারাপ বোধহয় নই,’ বলল রানা। চট করে দেখে নিল টাইমার:
০৮:০২…
০৮:০১…
০৮:০০…
‘আর মাত্র আট মিনিট, তারপর বোমা পড়বে এই দ্বীপে,’ বলল রানা। ‘রওনা হয়েছে রাশান নিউক্লিয়ার মিসাইল।’
‘তার পরেও সত্যিই ফিরলে?’ অবাক স্বরে বলল শ্যারন।
‘দলের কাউকে ফেলে যাই না আমি,’ সহজ স্বরে বলল রানা।
সিটে উঠে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিল। ‘শক্ত করে বসে থাকো।’
ঝড়ের গতিতে টিলার দিকে রওনা হয়ে গেল রানা। আবারও ফিরছে রাশান স্থাপনাগুলোর দিকে।
ষাট সেকেণ্ড পর আবারও পৌঁছল টিলার মাথায় রাস্তার সঙ্গমে। ওখান থেকে পোলার আইল্যাণ্ডের বেশিরভাগ জায়গা দেখা যায়।
ওই যে এয়ারস্ট্রিপ, মেইন টাওয়ার, উত্তরদিকের উপসাগর…
০৭:০০…
০৬:৫৯…
০৬:৫৮…
বাইক দাঁড় করিয়ে ফেলল রানা। চোখ গিয়ে পড়েছে রানওয়ের উপর।
হায় হায় করে উঠল ওর মন।
ওই যে অ্যান্টোনভ বিমান। ওটাকে ঘিরে ফেলেছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা। ঠেলে নিয়ে গেছে ক্লিফের কাছে। এবার রানওয়ে থেকে ফেলে দিলেই অনেক নীচে…
একটা মস্ত হোঁচট খেয়ে ক্লিফের নীচের ধাপে গিয়ে পড়ল অ্যান্টোনভ, পরক্ষণে হুড়মুড় করে নেমে গেল অনেক নীচে। আর দেখা গেল না ওটাকে।
নাচতে শুরু করেছে তস্কররা।
মস্ত ঢোক গিলল রানা। বহু কিছুই ঘটতে পারে, কিন্তু এমন যে হবে, ভাবতেও পারেনি। লোকগুলোর খ্যাপার কারণ বুঝতে পারছে। নেতা নেই। অফিসাররা নেই। ওদেরকে ফাঁকি দেয়া হয়েছে।
ওরা জানে না থারমোনিউক্লিয়ার মিসাইল আসছে মাত্র ছয় মিনিট পর!
‘এবার, রানা?’ শুকনো স্বরে বলল শ্যারন। চোখ রানার চোখে।
‘ওই বিমান ছিল মুক্তির একমাত্র উপায়,’ নীরস কণ্ঠে বলল রানা। ‘কাজেই আপাতত আটকে গেছি আমরা এই দ্বীপে।’
রানওয়ে শেষে সাগরে গিয়ে পড়েছে অ্যান্টোনভ বিমান, পতনের ওই জায়গার দিকে চেয়ে আছে ফ্রেঞ্চ ডিজিএসই এজেণ্ট শ্যারন। আনমনে বলল, ‘নিশ্চয়ই বাঁচার কোনও উপায় আছে। কোনও বিমান, হেলিকপ্টার, বা কোনও বাঙ্কার… যেখানে আশ্রয় নিলে বাঁচব আমরা।’
স্স্স্ করে মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল কয়েকটা বুলেট। এইমাত্র রানওয়ে থেকে এদিকে পৌঁছে গেছে দুই জিপ।
কী যেন ভাবছিল রানা, হঠাৎ করেই চাইল শ্যারনের দিকে। ‘হ্যাঁ, একটা বাঙ্কার… নিউক্লিয়ার বাঙ্কার।
‘ডক্টর ম্যাক্সিম তারাসভ বলেছিলেন মেইন টাওয়ারের নীচে ল্যাবোরেটরির বাঙ্কার বিশেষভাবে তৈরি নিউক্লিয়ার স্ট্রাইকের জন্য…’ থেমে গেল শ্যারন।
‘না, ওটা নয়,’ মানা করে দিল রানা। ‘সময় মত ওখানে পৌছতে পারব না। ওটা ছাড়াও আরেকটা আছে। …..কিন্তু আছে কোথায়…
মাথার উপর দিয়ে গেল অন্তত দশটা গুলি।
সাইডকারে মাথা নিচু করে নিল শ্যারন। ‘রানা, ভাবতে ভাবতে যেতেও তো পারো? নইলে যে মরব দু’জনেই!
‘ঠিক!’ মুঠোর জোরে থ্রটল মুচড়ে দিল রানা। ছিটকে রওনা হয়েছে। পালাতে শুরু করেছে জিপ থেকে।
কয়েক সেকেণ্ড পর শ্যারনের দিকে চাইল, ‘মনে পড়েছে!’
‘কী মনে পড়েছে?’
‘কোথায় আছে বাঙ্কার।’
০৫:৫৯…
০৫:৫৮…
০৫:৫৭…
তুমুল গতিতে মোটরবাইক স্কিড করে থামল কেবল কার টার্মিনালের সামনে। শ্যারনকে কোলে নিয়ে ছুটতে শুরু করেছে রানা, এমন সময় খুলে গেল গ্যারাজের পাশের একটা দরজা। ভিতর থেকে খুলে দিয়েছে পবন ও ফারিয়া। কথামত এখানেই হাজির হয়েছে ওরা। ডিফেখন এখানেই ফেলেছিল ডিজেল।
০৫:২৩…
০৫:২২…
০৫:২১…
রানার পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল পবন, ‘কী হয়েছে, মিস্টার রানা?’
থামল না রানা, চলবার পথে বলল, ‘রাশানরা যখন দেখল আপলিঙ্ক অফ করে দেয়া হয়েছে, দেরি না করেই নিউক্লিয়ার মিসাইল লঞ্চ করেছে। আর পাঁচ মিনিট পর এই দ্বীপে ওটা আঘাত হানবে।’
ফ্যাকাসে হয়ে গেল পবন। ‘পাঁচ মিনিট? মাত্র? এত অল্প সময়ে কোথায় যাব?’
‘আমরা যাব নিউক্লিয়ার বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে,’ গ্যারাজ পেরিয়ে গেল রানা, ঢুকে পড়েছে মূল টার্মিনালে। প্রায় ছুটে পৌছল কেবল কারের সামনে। ওখান থেকে অনেক নীচের অ্যাসিড দ্বীপে গেছে পুরু সব কেবল।
ওর মনে আছে ওই দ্বীপের ল্যাবোরেটরির নীচতলায় একটা পোক্ত সীসার দরজা আছে। ওটার উপর আছে নিউক্লিয়ার সিম্বল ও সিরিলিক সাইন। তখন মনে করেছিল ওই চেম্বার নিউক্লিয়ার স্টোরেজের জন্য। কিন্তু তা নয়, ওদিকের ঘর নিউক্লিয়ার বাঙ্কার।
নিশ্চয়ই পোলার আইল্যাণ্ডে আরও কয়েকটি নিউক্লিয়ার বাঙ্কার থাকবে। কোল্ড ওয়ারের সময় এই দ্বীপ ছিল ফার্স্ট-স্ট্রাইক টার্গেট। এদিকে অ্যাসিড দ্বীপে বাঙ্কার রাখাও যুক্তিযুক্ত ছিল। তিন দিক থেকে খাড়া ক্লিফের মাধ্যমে নিরাপদ ওই দ্বীপ। পোলার আইল্যাণ্ড থেকে ওটাকে আলাদা করেছে সাগর। আর বিপুল পানিও বাফার হিসাবে কাজ করবে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন হলে।
‘কেবল কার অনেক ধীরগতি, ঠিক সময়ে নামতে পারব না আমরা,’ বলল ফারিয়া।
‘ঠিক, তাই ওভাবে যাব না,’ বলল রানা। চেয়ে আছে অনেক নীচের অ্যাসিড দ্বীপের স্টেশনের দিকে। ওটা এক হাজার ফুট দূরে। ঘুরে চাইল ও। ‘সবাই ওঠো কেবল কারের ছাতে। কেবল ব্যবহার করে যিপলাইন বেয়ে নীচে নামব আমরা।’
০৪:২১…
০৪:২০…
০৪:১৯…
অজস্র বুলেটে বিদ্ধ কেবল কারের ছাতে উঠতে লাগল ওরা। এখান থেকে নীচে গেছে কেবল। শেষ হয়েছে বহু দূরের দ্বীপের টার্মিনালে। এত উপর থেকে নীচে চাইলে ঘুরে উঠতে চায় মাথা।
সবাই কেবল কারের ছাতে উঠে পড়বার পর রানা বলল, ‘ঠিক আছে, পবন! ফারিয়া! বেল্ট ব্যবহার করবে। কেবলের উপর এভাবে লুপ করতে হবে।’
দুই কেবলের উপর দিয়ে পবনের বেল্ট ঘুরিয়ে আনল রানা। এর ফলে বেল্টের দুই অংশ তৈরি করল একটা X। ‘উঠে আসার সময় কেবলের বেশিরভাগ বরফ খসে গেছে, আশা করি খুব সমস্যা হবে না। নেমে যাওয়ার শেষ দিকে দু’হাত বাইরের দিকে ঠেলবে, সেক্ষেত্রে তোমাদের বেল্ট চেপে বসবে কেবলের ওপর। গতি কমবে। …বুঝতে পেরেছ? …গুড। এবার রওনা হও।’
দু’হাতে বেল্টের দু’প্রান্ত ধরে রওনা হয়ে গেল পবন। ওর সঙ্গে দূরে যাচ্ছে ভীত আর্তনাদ: আ-আ-আ-আ!
কয়েক মুহূর্তে অনেক নীচে এবং দূরে চলে গেল পবন।
এবার ফারিয়া, সাবধানে দাঁড়াল কেবল কারের ছাতের শেষে। বুঝতে পারছে না কী করা উচিত
‘আমাদের সময় নেই, ফারিয়া,’ বলল রানা। ‘কাজটা করতেই হবে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন,’ শেষবারের মত বড় করে দম নিল ফারিয়া, তারপর রওনা হয়ে গেল পিছলে গিয়ে।
বাকি রয়ে গেছে রানা ও শ্যারন।
নিজের বেল্ট কেবলের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল রানা।
০৩:৩১…
০৩:৩০…
০৩:২৯…
তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শ্যারনকে।
দু’জনের মুখ পরস্পরের মাত্র এক ইঞ্চি দূরে।
শক্ত করে রানার ঘাড় জাপ্টে ধরল শ্যারন।
রানার দু’হাত উপরে, লূপ করা বেল্টে।
‘শক্ত করে ধোরো,’ বলল ও।
এক সেকেণ্ডের জন্য রানার চোখে চাইল শ্যারন।
আর ওই মুহূর্তে অবাক হলো রানা।
ওর ঠোঁটে আবেগঘন চুমু দিল শ্যারন। চট্ করে বলল, ‘তোমার মত কারও সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি আমার। তুমি সত্যি অন্যরকম।’ ঠোঁট সরিয়ে নিল। ‘ঠিক আছে, চলো এবার উড়ে যাই!’
কথাটা মাত্র শেষ করেছে ও, এমন সময় টার্মিনালের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল রাফিয়ান আর্মির পাঁচ সৈনিক। গুলি করতে করতে ভিতরে ঢুকেছে।
অবশ্য কাউকে আহত করল না তাদের গুলি।
তস্কররা দেখল, এইমাত্র সুন্দরী মেয়েটাকে বুকে নিয়ে আর পিঠে রোবট নিয়ে কেবল কারের ছাত থেকে লাফিয়ে সাগরের দিকে নেমে গেল মাসুদ রানা!
একত্রিশ
পোলার আইল্যাণ্ডের ক্লিফের উপর বসে থাকা টার্মিনাল থেকে পরিষ্কার দেখা গেল, দীর্ঘ কেবলে ঝুলে নীচের অ্যাসিড দ্বীপের টার্মিনালের দিকে নেমে চলেছে মাসুদ রানা ও সুন্দরী শ্যারন ফ্যেনুয়্যা।
পিছনে উঁচু, প্রকাণ্ড ক্লিফ আর ঘোড়ার নাল সদৃশ উপসাগরের তুলনায় নিজেদেরকে অতিক্ষুদ্র মনে হলো দুই এজেন্টের। এখন চমৎকার দৃশ্য দেখবারও সময় নেই।
ঝুলন্ত কেবলে তেলমাখা বাঁশে ওঠা বাঁদরের মত পিছলে নেমে চলেছে ওরা, পুরো বিশ সেকেণ্ড পর পৌঁছে গেল গন্তব্যের কাছে। দ্বীপের কাছে আসতেই দু’হাতে শক্ত করে বেল্ট ধরল রানা, চোখের সামনে মস্ত হাঁ করেছে স্টেশনের চৌকো দরজা। বাইরের দিকে বেল্ট ঠেলে দিল রানা, ওটা চেপে বসছে কেবলে।
পতনের গতি কমতে শুরু করেছে। প্রথমে রানা ভেবেছিল দেরি করে ফেলেছে, এবার আছড়ে পড়বে স্টেশনের ভিতরের দেয়ালে। কিন্তু প্রাণপণে বেল্ট টাইট করতেই কেবলে এঁটে বসল ওটা। কমে আসছে গতি, ঢুকে পড়ল ওরা স্টেশনে, আরও কয়েক গজ যাওয়ার পর বেকায়দাভাবে দুলতে লাগল।
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেছে পবন ও ফারিয়া। শ্যারনকে নেমে পড়তে সাহায্য করল ওরা।
ডিজিএসই এজেণ্ট নিরাপদে নামবার পর প্ল্যাটফর্মে নামল রানা, চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি:
০৩:১৩…
০৩:১২…
০৩:১১…
‘আর বড়জোর তিন মিনিট,’ বলল রানা। ‘দৌড় শুরু করো সবাই!’
কেবল কার স্টেশন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল ওরা। শ্যারনকে বুকে তুলে ছুটছে রানা। ঝড়ের গতিতে সামনের রাস্তা পেরিয়ে এল ওরা, ঢুকে পড়ল প্রকাণ্ড হলরুমের মত দালানে। চারপাশে একের পর এক অ্যাসিডের ভ্যাট ও ট্যাঙ্ক।
০২:০৩…
০২:০২…
০২:০১…
চারজনের দলের সামনে ছুটছে পবন ও ফারিয়া। পিছনে শ্যারনকে পাঁজাকোলা করে রানা।
০১:৩১…
০১:৩০…
০১:২৯…
দৌড়ে কয়েকটি ক্যাটওয়াক পেরিয়ে গেল ওরা।
০১:০৪…
০১:০৩…
০১:০২…
দৌড় না থামিয়ে বলল রানা, ‘আর বড়জোর এক মিনিট!’
ছোট কয়েকটা মই বেয়ে নামছে ওরা। নামবার সময় শ্যারনকে
কাঁধে তুলে নিল রানা।
০০:৪১…
০০:৪০…
০০:৩৯…
পবন ও ফারিয়ার পর শ্যারনকে নিয়ে নীচের তলায় নামল রানা। একটু দূরেই সেই পুরু সীসার দরজা। বুকে নিউক্লিয়ার সিম্বল আঁকা। ‘ওই যে, চলো!’
০০:৩২…
০০:৩১…
০০:৩০…
লেজে আগুন ধরা পায়রার মত উড়ছে যেন ওরা।
০০:২৯…
০০:২৮…
ভারী রিইনফোর্সড্ দরজা দিয়ে ছিটকে ভিতরে ঢুকল ফারিয়া ও পবন।
সামান্য পিছনে পড়ে গেছে ক্লান্ত রানা।
০০:১৫…
০০:১৪…
শ্যারন ও বন্ধু রোবটকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকল রানা।
০০:১২…
০০:১১…
পবন ও ফারিয়া মিলে দড়াম করে বন্ধ করে দিয়েছে ভারী দরজা। বদ্ধ ঘরে কবাট আটকে যাওয়ার আওয়াজটা বুক কাঁপিয়ে দেয়ার মত হলো।
০০:০৯…
সংক্ষিপ্ত কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা।
পরপর আরও দুটো ভারী দরজা পেরিয়ে গেল।
গায়ের জোরে পিছনের কবাট বন্ধ করে দিল রানা। শ্যারনকে কোলে নিয়ে ধুপ্ করে বসে পড়ল। দৌড়ে এসে জিভ বেরিয়ে গেছে। মনে করতে পারল না, আগে কখনও এমন জোরে ছুটেছে।
০০:০৫…
০০:০৪…
০০:০৩…
০০:০২…
০০:০১…
রানা শুনল, চারপাশ থমথম করছে।
তারপর এল প্রলয়দেবতার ভয়ঙ্কর সানাই।
বিস্ফোরিত হয়েছে নিউক্লিয়ার বোমা!
.
সাদা বজ্রপাতের মত আকাশ থেকে নেমে এল পোলার আইল্যাণ্ডের উপর রাশান আইসিবিএম, গতি ছিল ঘণ্টায় এক হাজার কিলোমিটার।
মিসাইলের লেজের জ্বলজ্বলে আগুন ও ধূসর ধোঁয়া দেখবার জন্য বড়জোর পাঁচ সেকেণ্ড পেয়েছে মুগ্ধ রাফিয়ান আর্মির অবশিষ্ট তস্কর। তখনই বুঝে গেছে ওটা আসলে কী। জেনে গেছে, আর রেহাই নেই, মৃত্যু নিয়ে এসেছে ওই মিসাইল।
তখনই ডেটোনেট করল আইসিবিএম।
হাজারটা বজ্রপাতের মত আলো ঝিকিয়ে উঠল, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড এক ভয়াবহ আওয়াজ- বাইরের দিকে ছড়িয়ে গেল ব্লাস্ট ওয়েভ, গিলে ফেলল গোটা দ্বীপকে।
শকওয়েভের ধাক্কায় উপড়ে গিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হলো পোলার আইল্যাণ্ডের বিশালাকার দুই ভেণ্ট। কাত হয়ে পড়তে শুরু করেছিল সসার মাথায় নিয়ে মেইন টাওয়ার, কিন্তু মাঝপথে চুরচুর হয়ে ভয়ঙ্কর তপ্ত হাওয়া ও থারমোনিউক্লিয়ার অগ্নিশিখায় মিলিয়ে গেল। ওই প্রলয়ঙ্করী বিস্ফোরণে উপকূলের কয়েকটা ক্লিফ এবং ওগুলোর বুকের মস্ত সব পাথর নামল সাগরে। উঁচু ক্লিফের মাথা থেকে কাত হয়ে উপসাগরে পড়ল কেবল কার টার্মিনাল।
লেলিহান আগুনে পুড়তে লাগল সবকিছু। দ্বীপের সব স্থাপনা ও সমস্ত মানুষ মিলিয়ে গেল বাতাসে।
আকাশে উঠতে লাগল মস্ত এক কালো রঙের ব্যাঙের ছাতা।
আগের সেই রাশান বেস পোলার আইল্যাণ্ড আর রইল না।
উধাও হয়েছে রাফিয়ান আর্মির সবাই।
.
অ্যাসিড আইলেটের গভীরে, জমিনের তলের বাঙ্কারে বিকট এক আওয়াজ শুনল রানা ও অন্য তিনজন। বুক কেঁপে গেল ওদের।
থরথর করে কাঁপতে লাগল চারপাশের দেয়াল, তবে ভেঙে পড়ল না। দপ্ করে নিভে গিয়েও আবারও জ্বলে উঠল বাতি। এখনও কাজ করছে জেনারেটার।
কিছুক্ষণ পর থেমে গেল কম্পন ও আওয়াজ। পরস্পরের দিকে চাইল ওরা।
‘এবার, মিস্টার রানা?’ বেসুরো কণ্ঠে বলল পবন।
দেয়ালের পুরনো কমিউনিকেশন কন্সোলের উপর চোখ পড়ল রানার। ওটার কাছে চলে গেল। কন্সোলের সঙ্গে জেনারেটারের সংযোগ আছে। কাজও করছে ঠিকভাবে।
‘আমেরিকানদের রেডিয়ো করব,’ বলল রানা। ‘তারপর অপেক্ষা করতে হবে। আশা করি তারা সরিয়ে নেবে আমাদেরকে।’
ওদের প্রতীক্ষা বেশি দিনের জন্য নয়।
এরেকসন এয়ার স্টেশনের লিসেনিং পোস্ট রানার বার্তা পাওয়ার পর আবারও যোগাযোগ করেছে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে।
ওদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ঠিক তিনদিন পর হাজির হবে অ্যাটাক সাবমেরিন ইউএসএস সিল।
এই নীরব সময়ে অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করবার রইল না ওদের। সতর্কভাবে অল্প অল্প করে তৃষ্ণা মেটাল ওরা। বন্ধুর পেটে রাখা এমআরই গেল চারজনের পেটে।
বারবার নিশাত ও ডিফেখনের কথা মনে পড়ল রানার। ওরাই ঠেকিয়ে দিয়েছিল মেগাট্রেনের মিসাইল। তারপর কী হলো? আহত হয়েছিল? মারা পড়েছিল? রানার মন জানতে চাইল, আসলে কী হয়েছিল আপা ও ডিফেখনের?
যদি বেঁচেও থাকত, রাশান নিউক আসবার পর বাঁচবার আর কোনও উপায় ওদের ছিল না।
আপা সবসময় বলত, ‘আমি যেন লড়াই করতে করতে মরতে পারি।’
তাই পেয়েছে সে।
তৃতীয় দিন চুপ করে বসে আছে রানা বাঙ্কারে, বিড়বিড় করে বলল, ‘বিদায়, আপা, সত্যিকারের একজন ভাল বন্ধু। ভাল হতো শেষ সময়ে একসঙ্গে লড়তে লড়তে দু’জন বিদায় নিলে। কখনও ভুলব না আপনাকে, আপা।’
এর কিছুক্ষণ পর উপসাগরের বরফঠাণ্ডা জল-সমতলে মাথা তুলল সাবমেরিন ইউএসএস সিল।
একেবারে পুড়ে কালো হয়েছে পোলার আইল্যাণ্ড। আর্কটিকে বেখাপ্পা কোনও মরুভূমি যেন।
নিউক্লিয়ার বোমার প্রাথমিক বিস্ফোরণে কংকাল হয়েছে অ্যাসিড দ্বীপের সমস্ত স্থাপনা। একটা জানালারও কাঁচ নেই। চুরচুর হয়েছে সব ছাত। সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে কংকাশন ওয়েভ। একের পর এক ভ্যাট ও ট্যাঙ্ক এখন পড়ে আছে খোলা আকাশের নীচে।
সাবমেরিন সিল থেকে পুরো বায়োহ্যাযার্ড সুট পরে দ্বীপে নামল তিনজন ক্রু। তাদের সঙ্গে রইল চারটে প্রোটেকটিভ সুট ও একটা স্ট্রেচার।
সময় লাগল, কিন্তু শেষপর্যন্ত বায়োহ্যাযার্ড সুট পরিয়ে সবাইকে সরিয়ে নেয়া হলো সাবমেরিনে।
সবার শেষে জলযানে ঢুকেছে রানা, একহাতে ভাঙা বন্ধু। ওর সামনে হাঁটছে পবন ও ফারিয়া। দুই ক্রু স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেল শ্যারনকে। বাঙ্কারে অপেক্ষা করবার সময় নিয়মিত শ্যারনের ক্ষত ড্রেস করেছে রানা। অবশ্য এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা পাবে। মেডিকেল যন্ত্রপাতিসহ হাসপাতাল রয়েছে সাবমেরিনে, ওখানে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের রেডিয়েশন লিক হওয়া ক্রুদের চিকিৎসা দেয়া হয়।
স্বাভাবিক জীবনে যাওয়ার উপায় নেই, রানা-পবন-ফারিয়াকে যেতে হবে রেডিয়েশন-প্রুফ চেম্বারে। ভালভাবে গোসল করবার পর দেখা হবে রেসিডুয়াল রেডিয়েশন আছে কি না।
কোয়ারান্টাইন চেম্বারে যাওয়ার পথে শ্যারনকে তুলে দেয়া হয়েছে এক মেডিকেল অফিসারের হাতে। তখনই সিল করা মেডিকেল এরিয়া থেকে আবছা চিৎকার শুনতে পেয়েছে রানা। মনে হলো যেন: ‘স্যর! …ভাই!’
ওই ওয়ার্ডে উকি দিয়ে চমকে গেল রানা।
বেডে উঠে বসেছে নিশাত সুলতানা। ঘনঘন হাত নাড়ছে। ‘স্যরা বেঁচে থেকে বাঁচিয়ে দিলেন আমাকে! কী যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’
নিশাতের বেডের পাশের বেডে শুয়ে আছে পিয়েখে ডিফেখন, বাহুতে টিউব ও ড্রিল। কোমায় চলে গেছে। পাশের হার্ট রেট মনিটরে দেখা যাচ্ছে দুর্বলভাবে চলছে হৃৎপিণ্ড। মানুষটা বেঁচে আছে, তবে মৃত্যুর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করছে।
ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে রানা, তারপরও খুবই খুশি হয়ে হাসল। ওর পাশে হাঁ করে চেয়ে আছে পবন।
নিশাতকে বলল রানা, ‘বারবার রেডিয়োতে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছি। কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি। ট্রেনে কী হয়েছিল, আপা? আর আণবিক বোমা থেকে রক্ষা পেলেন কী করে?’
আন্তরিক হাসল নিশাত সুলতানা। ‘আপনি হলে যা করতেন, তা-ই করেছি, স্যর। পুরো গতি তুলে নেমে গেছি ট্রেন নিয়ে সাবমেরিন ডকের পানিতে! তুমুল লড়াই হয়েছিল তার আগে, আর তখন গুলি খেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হলো আমাদের ফ্রেঞ্চ বন্ধু। কিন্তু যথেষ্ট সময় করে দিয়েছিল, আর তারপর তো পানিতেই গিয়ে পড়ল ট্রেন। ডিফেখনকে নিয়ে নেমে পড়লাম বড় রেলগাড়ির ছাত থেকে। ওটা তো তলিয়ে গেল, কিন্তু আমরা পড়লাম প্রায় ডুবে থাকা ফ্রেইটারের বো-র কাছে। তখনই দেখলাম ওই রাশান সাবমারসিবল।
‘দু’জনই আমরা আহত, কিন্তু ডিফেখন গুরুতরভাবে— ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে উঠলাম সাবমারসিবলের পেটে। খুঁজে বের করতে চাইলাম শুকনো কিছু, যেটা দিয়ে বুনোর ক্ষতগুলো মুছব।’
নিশাতের পাশের বেডে চোখ গেল রানার। শুয়ে আছে ডিফেখন। ছয়বার গুলি লেগেছে। একটা বুকে। এ ধরনের ক্ষত মৃত্যু নিয়ে আসে, যদি না হেমোস্ট্যাটিক, ব্লাড ক্লটিং এজেন্ট সেলক্স জেল বা কুইকক্লট স্পঞ্জ ব্যবহার হয়।
রানা জানে, ওসব ছিল না নিশাত বা ডিফেখনের কাছে।
‘রক্ত পড়া থামালেন কী করে?’
আন্তরিক হাসল নিশাত। থুতনি দিয়ে পবনকে দেখিয়ে দিল। ‘এই ছোকরার গুণে। ভাগ্যিস কখনও কখনও টেকনোলজির কথা শুনি। একদিন ক্যাম্পে পবন বলছিল আমাদের নতুন এমআরই রেশনের কথা। ওয়াটার ফিলট্রেশন পিল আসলে সিটোস্যান- বেযড। আর সিটোস্যান দিয়েই তৈরি করা হয় সেলক্স জেল। আর এসব এমআরই-র ভিতর তেলাপোকার গু-র মত খেতে একটা জেল আছে, ওই জেলি আসলে জেলেটিন। ভাবলাম, আমি যদি ফিলট্রেশন পিলের সঙ্গে পানি আর জেলি গুলে নিই, তা হলে পাওয়া উচিত সেলক্সের মত কিছু। কাজেই এমআরই বের করলাম, ব্যবহারও করলাম। ভারী একটা জেল তৈরি হলো। বুনোর বড় ক্ষতগুলোতে লাগিয়ে দিলাম। সত্যিই আটকে গেল জিনিসটা, রক্ত আর বেরোতে পারল না। কাজটা নিখুঁত হলো না হয়তো, কিন্তু বুজে তো দিতে পারলাম ক্ষত। সাবমারসিবলের ভেতর ফার্স্ট-এইড কিট ছিল। ওখান থেকে ব্যাজে নিয়ে ভালভাবে বেঁধে দিলাম ক্ষত। জানি না কতদিন টিকবে ওই জেল আর ব্যাণ্ডেজ, তবে টিকেই গেল। তারপর আমাদেরকে তুলে নিল এই সাবমেরিন।’
আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা।
‘আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, আপা,’ বলল পবন। ‘রেশন প্যাক থেকে তৈরি করেছেন ক্লটিং জেল।’
‘তুমি জানো না ছোকরা, আমি ম্যাকগাইভার!’ হাসল নিশাত।
‘ওই ডক থেকে বেরোলেন কী করে?’ জানতে চাইল রানা। ‘আমি যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম রেডিয়োতে।’
‘আপনার সব কথা শুনেছি, কিন্তু গুলি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমার মাইক্রোফোন। আর ডিফেখনেরটা ছোটাছুটির ভেতর পড়ে গিয়েছিল। বোধহয় পানিতে পড়ার সময়। খুবই জোরে পানিতে পড়েছিলাম। শুনছিলাম সবই, কিন্তু ট্র্যান্সমিট করতে পারছিলাম না। বলেছিলেন: দ্বীপ ছেড়ে যেতে হবে, নইলে মরব আমরা। তখনই বুঝলাম, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে এবার। কাজেই ব্যবহার করলাম সাবমারসিবল, চলে গেলাম পানির অনেক গভীরে। সরে গেলাম পোলার আইল্যাণ্ড থেকে বহু দূরে। মির সাবমারসিবল ভালই কাজ করছিল, কিন্তু ভাঙা ছিল ওটার রেডিয়ো। বাধ্য হয়ে কয়েক দিন ধরে অ্যাকটিভ সোনার ব্যবহার করে পিং-পিং আওয়াজ করেছি। তারপর এল এই সাবমেরিন।’
‘ওর অবস্থা এখন কেমন?’ পিয়েখেকে দেখাল রানা।
‘ক্রিটিকাল অবস্থা। জোর করে কোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে ডাক্তার। আমাকে বলেছে, আবার জ্ঞান না-ও ফিরতে পারে।’
‘এবার কোয়ারান্টাইনে গিয়ে ভালভাবে গোসল করতে হবে, ‘ বলল রানা। ‘পরে দেখা হবে আপনার সঙ্গে, আপা।’
তখনই নিশাতের পাশের বেডে এনে রাখা হলো শ্যারনকে।
‘পরে দেখা হবে, শ্যারন,’ বলল রানা।
আস্তে করে মাথা দোলাল মেয়েটি। নিচু স্বরে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ… রানা… সবকিছুর জন্যে।’
বত্রিশ
ওভাল অফিস।
হোয়াইট হাউস, ওয়াশিংটন ডি.সি.। উনিশ জুলাই।
রাত আটটা।
এইমাত্র কোট পরিহিত মাসুদ রানার গলায় বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য একটি বিশেষ মেডেল পরিয়ে দিলেন ইউনাইটেড স্টেট্স্ অভ আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট।
তাঁর বামপাশে দাঁড়িয়ে আছেন নুমার চিফ অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিল্টন। ডানদিকে বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। তাঁর কথায় আমেরিকান মেডেল নিতে রাজি হয়েছে রানা। এবং প্রেসিডেন্টের অনুরোধে এবং বিমানের টিকেট ও ভিসা পাঠিয়ে দেয়ায় এ দেশে এসেছেন রাহাত খান। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হ্যামিল্টনের অনুরোধে তাঁর বাড়িতে উঠবেন ঠিক করেছেন।
রানার পাশেই নিশাত সুলতানা, তাকেও মেডেল পরিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট।
ওদের সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকজন সিভিলিয়ান: কেভিন কনলন, রিনা গর্ডন, পবন হায়দার ও ফারিয়া আহমেদ। আরও রয়েছে নীল কোট পরা একটি রুপালি রোবট। ওটা দাঁড়িয়ে আছে পবনের পাশে। ওর নীচের অংশ মেরামত করে দিয়েছে কুয়াশা।
মেডেল দেয়ার অনুষ্ঠানে সবার শেষে ছোট্ট একটা সোনার মেডেল দেয়া হলো রোবট বন্ধুকেও।
‘অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার প্রেসিডেন্ট,’ ভদ্রলোককে একদম চমকে দিল বন্ধু প্রেসিডেন্টেরই কণ্ঠে কথা বলে।
‘আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা কী করছেন?’ এক এইডের দিকে চেয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট।
অনুষ্ঠান শেষ হতেই অন্যরা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু রানাকে থাকতে বললেন প্রেসিডেন্ট।
‘একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, মিস্টার রানা।’ ইন্টারকম তুলে কার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করলেন তিনি। ‘জেনি, অ্যাম্বাসেডারকে পাঠিয়ে দাও, প্লিয।
ওভাল অফিসের একটা সাইড ডোর খুলে গেল, ভিতরে ঢুকল তিনজন। তাদের একজনকে চেনে না রানা।
এ ভদ্রলোককে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ বলে মনে হলো রানার। ব্যাকব্রাশ করেছেন রুপালি চুল। খাড়া নাকের ডগায় চশমা। পরনে দামি সুট।
অন্য দু’জন সাধারণ পোশাকে।
শ্যারন ফ্যেনুয়্যা ও পিয়েখে ডিফেখন।
শ্যারনকে সম্পূর্ণ সুস্থ লাগছে। টেইলর করা স্কার্ট-সুট পরনে। মেকআপ নিখুঁত। কাঁধে এলিয়ে আছে কালো চুল। এই অনুষ্ঠানের জন্য খাটো করেছে।
দাড়ি ছেঁটেছে ডিফেখন। চেহারায় খুবই অস্বস্তি। কোট পরতে অভ্যস্ত নয়। একটা হাত এখনও ঝুলছে স্লিঙে।
‘মিস্টার রানা,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘পরিচয় করিয়ে দিই ইউনাইটেড স্টেট্স্ অভ আমেরিকার জন্য নিযুক্ত ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসেডার মোসিউ ফ্রাঁসোয়া দো সারকোজি।’
রানা খেয়াল করল, ফর্মাল মেথড ব্যবহার করে ওদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তফাৎ করেছেন। সাধারণত দু’জনের ভিতর গুরুত্বপূর্ণ লোকটির নামই আগে বলা হয়। এখানে তা করা হয়নি। রানাকে ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসেডারের চেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ভদ্রলোক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন।
‘মোসিউ,’ আস্তে করে মাথা দোলালেন তিনি, রানার সঙ্গে করমর্দন করলেন। ‘আমার কোনও ভুল না হয়ে থাকলে মেজর শ্যাখন ফ্যেনুয়্যা আর ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন আপনার
পরিচিত।’
আস্তে করে ওদের দু’জনের উদ্দেশে মাথা দোলাল রানা। ‘হ্যাঁ, চিনি। ওদের দেখে ভাল লাগছে।’
প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘মিস্টার রানা, আপনার জন্যে জরুরি বার্তা এনেছেন অ্যাম্বাসেডার, ওটা পাঠিয়েছেন ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট।’
টানটান হয়ে দাঁড়ালেন অ্যাম্বাসেডার। ‘মিস্টার রানা,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। মেজর ফ্যেনুয়্যা এবং ক্যাপ্টেন ডিফেখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন, আপনার কারণে রক্ষা পেয়েছে কয়েকটি দেশ। তাদের ভিতর ফ্রান্সও রয়েছে। কাজেই আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে আপনাকে জানাতে: আর সব দেশের মত ফ্রান্সও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার উপর থেকে মৃত্যু-পরোয়ানা তুলে নিয়েছে দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স।’
চুপ করে আছে রানা।
ওর দিকে চেয়ে হাসছে শ্যারন। সবক’টা দাঁত বের করে ওকে দেখছে বুনো।
আর ইউনাইটেড স্টেট্স অভ আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে খুবই খুশি মনে হচ্ছে।
প্রেসিডেনশিয়াল বক্তৃতা শেষে রুযভেল্ট রুমে বুফেতে দেয়া হলো কেক ও কফি। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রেসিডেন্টকে রোবট বন্ধুর নানা সুবিধা ব্যাখ্যা করে বলল পবন, পাশে থাকল ফারিয়া। সবাই পরিষ্কার বুঝল, দু’জন দু’জনের প্রেমে পড়েছে।
নিশাতের সঙ্গে আমেরিকায় এসেছেন ওর বাবা, ঘুরে ঘুরে দেখছেন হোয়াইট হাউস। তাঁকে বগলদাবা করেছে পিয়েখে ডিফেখন।
প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে রানা, নিশাত, তার বাবা, শ্যারন, পবন, ফারিয়া ও ডিফেখন ঠিক করেছে, তিনদিনের জন্য থাকবে হোয়াইট হাউসের অতিথি কোয়ার্টারে।
কফির কাপ নিয়ে শ্যারনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রানা, ওর সামনে চলে এল নিশাত। জানতে চাইল, ‘স্যর, শেষপর্যন্ত কি পাওয়া গেল সিআইএ-র সেই উইলিয়াম থ্রাশারকে?’
আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা। ‘পরে কখনও হয়তো দেখা হবে তার সঙ্গে। কিন্তু চিনব না। শুনেছি সিআইএ-র বড়কর্তা জানিয়েছেন, লাশ পাওয়া গিয়েছিল থ্রাশারের। মারা পড়েছে।’
‘কিন্তু কথাটা আসলে মিথ্যা?’ আনমনে বলল নিশাত।
‘উইলিয়াম থ্রাশার সিআইএ-র সেরা স্টার। পঁয়ত্রিশ বছর আগে পোলার আইল্যাণ্ডের অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইসের পুরো পরিকল্পনা তৈরি করেছিল সে। সবই ঠিক ছিল, মাঝে থেকে বাধা দিয়েছি আমরা। আমার ধারণা, আবারও দেশে ফিরেছে সে। নতুন চেহারা নিয়ে কাজ করছে ওই একই অফিসে, তার বসের ছত্রছায়ায়।’
নিশাত আবারও চলে গেল ওর বাবাকে খুঁজে বের করতে। শ্যারন গেল কেক আনতে।
তখনই এসে রানার কাঁধে টোকা দিলেন প্রেসিডেন্ট। ‘মিস্টার রানা, সামান্য কথা আছে, আসুন।’
তাঁকে অনুসরণ করে মস্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এল রানা। নীচ তলায় নেমে সিচুয়েশন রুমে ঢুকলেন প্রেসিডেণ্ট।
ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইন্টেলিজেন্স সংগঠনের বড়কর্তারা। তাঁদের ভিতর রয়েছেন ডিআইএ ও সিআইএ-র দুই ডিরেক্টর।
‘মিস্টার রানা,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘এবার নিজ কানে শুনুন কী হয়েছিল।’
সিআইএ-র ডিরেক্টর রানার সামনে এসে দাঁড়ালেন। অত্যন্ত গম্ভীর। রানাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন, তারপর বললেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট। মিস্টার রানা। আমরা অনেক খুঁজে শেষে পেয়েছি উইলিয়াম থ্রাশারের লাশ। দুই সপ্তাহ আগে। ওটা পাওয়া গেছে নরওয়েজিয়ান এক ট্রলারে। লাশ ভাসছিল আর্কটিক সাগরে। পানির নীচে ডুব দেয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় তার সাবমারসিবলের অক্সিজেন সাপ্লাই। শ্বাস আটকে মারা গেছে।’
সরাসরি ভদ্রলোকের চোখে চোখ রাখল রানা। ‘শুনে খুবই খুশি হলাম, ডিরেক্টর। অনেক ধন্যবাদ।’
কেউ কিছুই বলছে না। খুকখুক করে কাশলেন প্রেসিডেন্ট।
তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারও রুযভেল্ট রুমে ফিরল রানা, চলে গেল শ্যারনের পাশে। আগেই ঠিক হয়ে আছে, ডেটিঙে যাবে ওরা পটোম্যাক নদীর তীরের এক নিরালা রেস্টুরেন্টে।
চোখে চোখে কথা হলো দু’জনের। চট্ করে একবার ঘরের দূরে দেখল রানা। অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিল্টনের সঙ্গে বসে আলাপ করছেন মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান।
কারও চোখে না পড়েই এক মিনিটের ভিতর ঘর থেকে উধাও হলো দুর্ধর্ষ বিসিআই এজেন্ট ও ডিজিএসই এজেন্ট শ্যারন।
রাত বারোটার সময় হোয়াইট হাউসে ফিরল ওরা, বিদায় নিয়ে চলে গেল যার যার ঘরে। চমৎকার কেটেছে সময়।
নীল ডিম লাইট জ্বেলে চেস্ট অভ ড্রয়ারের সামনে থামল রানা, পোশাক পাল্টে শুয়ে পড়বে এবার। কিন্তু ওর চোখ পড়ল ড্রেসারের মাথায় পুরনো একটা সানগ্লাসের উপর!
ওটার এক কাঁচে ছোরা দিয়ে খোদাই করা একটা বৃত্ত, ভিতরে
বড় অক্ষরে লেখা: R. A.
রাফিয়ান আর্মির সিম্বল!
নির্যাতনের এক পর্যায়ে ওর কাছ থেকে ওটা কেড়ে নিয়েছিল সিআইএ সিনিয়ার এজেণ্ট উইলিয়াম থ্রাশার।
সানগ্লাসের সঙ্গে কোনও নোট বা চিঠি নেই।
অস্বস্তি নিয়ে প্রায়ান্ধকার ঘরের চারপাশে চাইল রানা।
আর তখনই খুট করে খুলে গেল ঘরের দরজা!
ঝট্ করে ওয়ালথার পি.পি.কে. বের করল রানা, পরক্ষণে থেমে গেল।
নিঃশব্দে যে ঘরে ঢুকেছে, সে পিছনে বন্ধ করে দিল দরজা।
চপল পায়ে এগিয়ে আসছে।
শ্যারন!
হোলস্টারে পিস্তল ফিরল রানার।
ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অপরূপা।
অস্ফুট স্বরে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কী যেন বলল, একটু ফাঁক হলো ভেজা দুই টসটসে ঠোঁট। উঁচু করে ধরেছে নিজের চাঁদের মত মুখ। চোখে কীসের ব্যাকুলতা।
এক সেকেণ্ড পর নামল রানার নিষ্ঠুর ঠোঁট শ্যারনের তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে।
***