পনেরো
ওঁয়া-ওঁ! ওঁয়া-ওঁ! ওঁয়া-ওঁ! সাইরেনের বিকট আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে পোলার আইল্যাণ্ড জুড়ে। প্রধান পিরিচের মত টাওয়ার থেকে দুই ক্রেন ড্র-ব্রিজ তুলে নিচ্ছে দুই অপারেটার। গভীর গহ্বরের মাঝে একাকী হয়ে গেল বৃত্তাকার বিশাল উঁচু দালান। ওটার মাথায় হেলিপ্যাডে দুই অসপ্নের দিকে ছুটে গেল রাফিয়ান আর্মির এয়ারক্রাফট ক্রুরা।
সবই দেখল রোবট বন্ধুর লেন্স, সবই শুনল— তার জানা হয়ে গেল কেবল কার টার্মিনালের দিকেই আসছে পুবের বাতিঘর থেকে দুই ট্রাক ভরা সৈনিক।
বন্ধু অপেক্ষা করছে কখন অ্যাসিড দ্বীপ থেকে ফিরবে কেবল কার, ওই একই সময়ে ঝটপট ফারিয়ার পায়ের ক্ষতটা পরীক্ষা করেছে মাসুদ রানা। কাফ মাসলের এক অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে বুলেট। ও সরে যেতেই দক্ষ হাতে ব্যাণ্ডেজ করেছে নিশাত।
কাজটা শেষ করতে না করতেই পৌঁছে গেল কেবল কার। সবাই চেপে বসল কেবল কারে। বুঝে গেল, দু’মিনিট ওদের কাছে মনে হবে জনম ভর অপেক্ষা। রিস্টগার্ডের স্ক্রিনে দুই অসপ্রে এয়ারক্রাফট দেখল রানা। দুই ট্রাক ছুটে যাচ্ছে উপরের টার্মিনাল লক্ষ্য করে। চিন্তিত হয়ে পড়ল ও।
রিফিউয়েলিং করছিল দুই অসপ্রে, সাইরেন বেজে উঠতেই ভাসতে চেয়েছে আকাশে। কিন্তু ট্যাঙ্কের সঙ্গে রিফিউয়েলিং হোস সংযুক্ত থাকায় উড়তে পারেনি এখনও।
এদিকে টার্মিনালের দিকে অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে দুই রাশান ট্রাক।
রানার দল ও রাফিয়ান আর্মির ভিতর শুরু হয়েছে সময়ের প্রতিযোগিতা— কে আগে পৌঁছবে টার্মিনালে!
খুব পিছনে পড়বে না দুই অসপ্রেও!
চট্ করে দেখে নিল রানা হাতঘড়ি:
১০:৪০
‘আমরা আর বিশ মিনিট সময় পাব বড়জোর, তারপর রেডি হয়ে যাবে ইউরেনিয়াম বল,’ বলল রানা।
‘সাথে সাথেই গ্যাসের মেঘে মিসাইল ছুঁড়বে,’ নিচু স্বরে বলল বব।
‘আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় নেই,’ আপত্তির সুরে বলল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো।
‘এক সেকেণ্ড সময় থাকলেও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাব আমরা,’ দৃঢ় স্বরে বলল রানা।
পোলার আইল্যাণ্ডের প্রধান টাওয়ারের ছবি রিস্টগার্ডে নিয়ে এল ও। মস্ত টাওয়ারের চারপাশে গভীর গহ্বর।
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘দ্বীপে উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে হামলা করবে ওরা। কাজেই এক মুহূর্ত নষ্ট করা যাবে না। ডক্টর তারাসভ, আপনি বলেছেন মেইন টাওয়ারের ওপরের ছোট সসারে থাকে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার। এবার বলুন, টাওয়ারের চারপাশের কূপ কত ফুট চওড়া?’
‘অনেক চওড়া,’ বললেন ডক্টর। ‘একেকদিক আন্দাজ আড়াই শ’ ফুট।’
তিক্ততা হজম করল রানা। ‘তার মানে ম্যাগহুক দিয়ে কাজ হবে না।’ শ্যারনের ম্যাগহুকের দিকে ইশারা করল। ওটা ব্যবহার করে ভালুক ল্যাবোরেটরিতে ভেসে এসেছিল মেয়েটি ওর সামনে। ‘আগে জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি, এবার বলো ওটার কেবল কত ফুট লম্বা?’
‘এটা ফ্যামাস লিগনে মেগনেটিকুয়ে মাল্টি-পারপাস গ্র্যাপলিং গান। আমরা ওটাকে ডাকি ‘লে ম্যাগনেটিউয়েক্স’। আর্মালাইট এমএইচ-১২ ম্যাগহুকের মতই, তবে ওটার চেয়ে অনেক দিক থেকে ভাল।’
রানার দিকে ম্যাগনেটিউয়েক্স বাড়িয়ে দিল শ্যারন।
জিনিসটা ম্যাগহুকের মতই দেখতে, কিন্তু আরও ফোলা পেট, তারপরও আকর্ষণীয়, আধুনিক— দৈর্ঘ্যে খানিকটা বেশি। ফায়ারিং ব্যারেলের নীচে দুটো হাই-টেক রুপালি গ্র্যাপলিং হুক।
‘ম্যাগনেটিউয়েক্সের দুটো কেবল, প্রতিটা দুই শ’ ফুট লম্বা। এ ছাড়া আছে দুটো হুক। আলাদা দুটো ব্যারেল থেকে বেরোয়। ব্যারেল দুটো আবার নানাদিকে সরিয়ে নেয়া যায়। প্রতিটি হুকে থাকে ফোল্ড করা থাবা। চৌম্বক ক্ষমতা আছে ওগুলোর। পাথরের মত শক্ত জায়গা ড্রিল করতে পারে। কংক্রিট কিছুই না ওটার কাছে। সামনে থেকে ফায়ার করলে ইস্পাতও ফুটো করা যায়।’
ম্যাগনেটিউয়েক্সের ধারালো হুক পরখ করল রানা।
হুকের উপরের দিকে প্যাঁচানো স্ক্রু।
‘ছুটে যাওয়ার সময় ঘোরে?’ জানতে চাইল রানা। ‘আর ওটার কারণেই শক্ত পাথরে গেঁথে যায়?’-
‘ঠিক।’
‘সত্যিই প্রশংসা করার মত,’ বলল রানা।
মেরিনদের ম্যাগহুক এসব কাজ পারে না।
প্রকাণ্ডদেহী ফরাসি ক্যাপ্টেন বলল, ‘এক হাজার কেজি ওজন নেবে ম্যাগনেটিউয়েক্সের প্রতিটা কেবল। আমেরিকানদের ম্যাগহুক বড়জোর দু’শ’ কেজি নেয়।’
‘এটা কী?’ জানতে চাইল রানা। ম্যাগনেটিউয়েক্সের পাশের কালো ইউনিট খুলে নেয়া যায়। জিনিসটা রাবারের সুটকেসের গ্রিপের মত, চার জায়গায় ছোট মোটোরাইড্ ক্ল্যাম্প হুইল। ‘অ্যাসেণ্ডার?’
‘হ্যাঁ,’ আস্তে করে মাথা দোলাল শ্যারন, ‘মোটোরাইড্ অ্যাসেণ্ডার। কেবলে আটকে নিতে হয় ক্লিপ, সুইচ টিপে দিলেই উপরে নিয়ে যায়। দু’হাতে দড়ি বেয়ে ওঠার দিন শেষ।’
‘কিন্তু কেবল যখন মাত্র দু শ’ ফুট, এতে কাজ হবে না,’ বললেন ডক্টর তারাসভ। ‘মেইন টাওয়ারের চারপাশের কূপ কমপক্ষে আড়াই শ’ ফুট।’
শক্ত হাতে ম্যাগনেটিউয়েক্স ধরেছে রানা। জানতে চাইল, ‘তোমরা বললে এক হাজার কেজি ওজন নেবে কেবল?’ বুনোর দিকে চাইল রানা। ‘আপনারও এই জিনিস আছে?’
‘হ্যাঁ।’
আস্তে করে মাথা দোলাল রানা, কী যেন ভাবছে। রিস্টগার্ডে দেখল অগ্রসরমান দুই ট্রাক। ‘আমরা যদি একটা… ডক্টর তারাসভ, আপনারা কি উপরের টার্মিনালে কোনও ভেহিকেল রাখেন? কোনও জিপ? বা গাড়ি?’
‘জিপ বা গাড়ি? নাহ্!’ মাথা দোলালেন ডক্টর। ‘তবে টার্মিনালের পশ্চিমে গ্যারাজ আছে। ওখানে ছোট দুয়েকটা ফিউয়েল ট্রাক রাখা হয়। খুব পুরনো, তবে এখনও কাজ করে।’
‘তাতেই চলবে,’ বলল রানা। ‘ঠিক আছে, এবার সবাই শুনুন আমাদের প্ল্যান।‘
গোঙাতে গোঙাতে উঠছে কেবল কার।
সংক্ষেপে ওর পরিকল্পনা জানাল রানা।
ওরা গিয়ে উপরের সসার থেকে কেড়ে নেবে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।
ওর কথা শেষ হতেই বিড়বিড় করেই চুপ হয়ে গেল ফ্রেঞ্চ দুর্ধর্ষ বুনো। সামান্য হাঁ হয়ে গেছে শ্যারন। মস্ত ঢোক গিলল পবন। শুধু ফারিয়া বলল, ‘আপনি পাগল হয়ে যাননি তো, মিস্টার রানা?’
‘না, উনি পাগল হয়ে যাননি,’ নিশ্চিত স্বরে বলল নিশাত সুলতানা। ‘আমাদের স্যর এমনই!’
‘যা করার ঝটপট করতে হবে, কাজে হাত দেয়ার পর দ্বিধা চলবে না,’ বলল রানা। ‘তা হলে মরতে হবে। চট্ করে সরিয়ে নেব স্ফেয়ার। আশা করি কড়া পাহারা দেবে না সসারের ভেতরে। …এবার শেষ কথা: তোমাদের ভেতর কে লাফ দেবে আমার সঙ্গে? …আপা? …বুনো? কাজটা কঠিন নয়।’
‘আমি আছি, স্যর,’ বিনা দ্বিধায় বলল নিশাত।
ভয়ঙ্করভাবে ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল ক্যাপ্টেন ডিফেখন, তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘কেই বা চিরকাল বাঁচতে চায়! আশা করি মজা লাগবে আপনার সঙ্গে কাজ করে। বুনো কাউকে ভয় করে না, কোনও মিশনে আপত্তিও নেই তার।
‘গুড,’ বলল রানা, ‘ঠিক আছে, এবার সবাই দেখে নিন ম্যাপ। মাথায় গেঁথে নিন আপনারা কোথায় থাকবেন।’
হাতে হাতে ঘুরতে লাগল রানার রিস্টগার্ড।.
ম্যাপ দেখছে সবাই।
রানার কানে কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠ: ‘মেজর মাসুদ রানা,’ খুশি খুশি ভাব স্বরে, ‘বিসিআই এজেণ্ট তুমি, কোড নেম এমআরনাইন। আর আমি বিশৃঙ্খলার সম্রাট। রাফিয়ান আর্মির জেনারেল। যা ভেবেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে বেঁচে আছ তুমি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি পা রাখছ আমার দ্বীপে।’
এক সেকেণ্ড পর রানা টের পেয়েছে, ওই কণ্ঠ আসছে ওর দ্বিতীয় ইয়ারপিসে। ওটা জোগাড় করেছিল হাঙরের দলের মৃত এক সৈনিকের কাছ থেকে।
পরের সেকেণ্ডে রানা দেখল, কেবল কারের উপরের কোণে সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা। জ্বলছে ওটার সবুজ পাইলট বাতি।
‘তুমি ক্যামেরার দিকে চাইতেই বুঝেছি, তুমি পরিষ্কারভাবে শুনছ আমার কথা। তোমার কানে গুঁজে রেখেছ আমার একটা রেডিয়ো।’
দলের সবার উপর দিয়ে ঘুরে এল রানার চোখ।
ঝট্ করে ওর দিকে চেয়েছে নিশাত ও শ্যারন। ওদের কাছেও রাফিয়ান আর্মির ইয়ারপিস/মাইক। অন্যদের নেই। মনোযোগ দিয়ে ম্যাপ দেখছে তারা। শুনবে না রাফিয়ান আর্মির জেনারেলের কথা।
গুঙিয়ে গুঙিয়ে উপরে উঠছে কেবল কার।
আর একমিনিটও নেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ওরা।
টার্মিনালের অনেক কাছে পৌঁছে গেছে সৈনিক ভরা দুই ট্রাক।
‘তোমাদের ক্যাম্পের মিস্টার জার্ড ময়লানের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার অধীনস্থ নির্যাতনকারীদের। ঢের তথ্য দিয়েছে সে তোমার এবং অন্যদের বিষয়ে। হাসিখুশি মানুষ। করোটির দু’দিকে দুই ইলেকট্রোড লাগিয়ে দিতেই রীতিমত নাচতে লাগল।’ মৃদু হাসল জেনারেল।
‘এখন সামনে নিয়ে বসেছি তোমার ফাইল, মেজর। তুমি তো দেখি সত্যিকারের একটা হিরো! অবশ্য, ফ্রেঞ্চদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়ানোটাকে ঠিক হিরোইজম বলা যায় না। কী-ই বা করবে, ধড়ের উপর একটাই যখন কল্লা!’
চুপ করে থাকল রানা।
‘কম ধকল যায়নি তোমার ওপর দিয়ে। একের পর এক মিশনে কত মেয়েকেই না ভালবাসলে, তাদেরকে হারিয়েও বসলে। সেই সুলতা থেকে শুরু করে… আর শেষে তিশা করিমও সরে গেল! … কিন্তু এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না, সময় ফুরিয়ে এসেছে তোমার।
‘বড় বড় কথা অনেকেই বলে,’ শান্ত স্বরে বলল রানা।
‘আরেহ, এ দেখি কথাও বলে!’ হাসল জেনারেল। ‘একটা উপদেশ মনে গেঁথে নাও, মেজর। তোমার ফ্রেঞ্চ বন্ধুদের কাছ থেকে সতর্ক থাকো। তোমার পাশের ওই শ্যাখন ফ্যেনুয়্যা দক্ষ খুনি। ও ভুলবে না কী নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওকে। …যদি কখনও আমাকে হারাতেও পারো, ওর নরম হাত থেকে রক্ষা পাবে না। …আর শ্যাখন ফ্যেনুয়্যা, মাসুদ রানাকে পেয়ে ভুলে যেয়ো না তোমার মরা প্রেমিকের কথা! মনে নেই লিলি রহিমের কথা? যাকে অফিসে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছিলে? …আর মেজর রানা, খেয়াল করো শ্যাখনকে। ও আসলে ফুরিয়ে যাওয়া নায়িকা। সবই হারিয়ে ফেলেছে। তোমারও তা-ই হবে
‘টিকটিক করে পেরিয়ে যাচ্ছে সময়, মেজর। আর মাত্র এক মিনিট পেরোবার আগেই শুরু হবে সত্যিকারের লড়াই। ওই লড়াই আমাদের দু’জনের মধ্যকার। একপক্ষে আমার নেতৃত্বে আমার ডাকাত সেনাবাহিনী। অন্যদিকে ভীত কয়েকজন মানুষ। মাসুদ রানা, তোমার প্রিয় নিশাত সুলতানাও বাঁচবে না। তখন ওর আলাভোলা বাপটার কী হবে?’
চমকে গেছে রানা লোকটার তথ্য সংগ্রহের বহর দেখে।
‘অথবা ধরো মেরিন কর্পসের ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলোর কথাই— কখনও ভরসা কোরো না তার ওপর। তার পরিবার অপরাধী পরিবার। এই কিছুদিন আগেও মিলিটারির পিস্তল- রিভলভার বিক্রি করেছে খোলা বাজারে। তার পরেও তোমার ওপর চোখ রাখার জন্যে মেরিন কর্পস পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে।’
ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলোর দিকে চাইল রানা।
লোকটা দেখছে এগিয়ে আসছে টার্মিনাল। কিছুই জানে না তার বিরুদ্ধে কী বলা হচ্ছে।
‘নিজেকে জিজ্ঞেস করো: তুমুল লড়াইয়ের সময় ভরসা করা যায় ওই লোকের ওপর? …বাদ থাক্ সে, তোমার সঙ্গের কর্পোরাল বব বউলিঙের কথাই বলি। তাকে অ্যাকটিভ সার্ভিস থেকে সরিয়ে দিয়েছে মেরিন কর্পস। কারণ, বেচারা প্রায় কালা। তা ছাড়া, মানসিকভাবেও সুস্থ নয়। যে যা বলে, তা-ই মেনে চলে। এদেরকে নিয়ে লড়াই করতে চাও আমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে?’
উঠে চলেছে কেবল কার।
আর বিশ সেকেণ্ড পর পৌঁছবে টার্মিনালে।
ছুটে আসছে সৈনিক ভরা দুই ট্রাক।
রিস্টগার্ড দেখল রানা। রোবট বন্ধুর লেন্সের মাধ্যমে মেইন টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। হেলিপ্যাডে অসপ্রে দুটো নেই!
ধক্ করে উঠল রানার বুক।
তা হলে ভেসে উঠেছে দুই আকাশ দানব!
জানালা দিয়ে আকাশে চাইল রানা। ওদের মন্থর গতি কেবল কারকে অনায়াসেই উড়িয়ে দেবে দুই গানশিপ!
তখনই ভয়ঙ্কর ঝাঁকি খেল কেবল কার। কমপক্ষে কয়েক শত গুলি লাগল চারপাশে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল সব জানালা। মাথার উপর দিয়ে শোঁও করে বেরিয়ে গেল একটা অসপ্রে।
কেবল কারের মেঝেতে বসে পড়েছে ওরা। অবশ্য এক সেকেণ্ড পর উঠে দাঁড়াল প্রকাণ্ডদেহী বুনো। হাতে তুলে নিয়েছে কর্ড, পাল্টা গুলি করল গানশিপ লক্ষ্য করে। ভারী অস্ত্রের এক সারি গুলি লাগল অসপ্রের বামপাশে। গুলি খেয়ে ছিটকে গিয়ে নীচের সাগরে পড়ল এক গানার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অসপ্রের বামদিকের ইঞ্জিন, দপ্ করে জ্বলে উঠল আগুন। বেরোতে শুরু করেছে কুচকুচে কালো ঘন ধোঁয়া, ছিটকে সরে গেল গানশিপ। তার জায়গা নিল দ্বিতীয় ভি-২২, পাঠাল ঝাঁক ঝাঁক গুলি। কিন্তু তার আগেই বিক্ষত, জানালাহীন কেবল কার ঢুকে পড়ল উপরের টার্মিনালে।
ঝাঁকি খেয়ে প্ল্যাটফর্মের পাশে থেমে গেল কেবল কার।
,
উবু হয়ে মেঝেতে বসে ছিল গম্ভীর রানা, উঠে দাঁড়িয়ে রাফিয়ান আর্মির মাইকে বলল, ‘অনেক বকবক করেছ, অনেক তথ্যও সংগ্রহ করেছ, কিন্তু তোমার সম্পর্কে একটা কথা বুঝে ফেলেছি: এমনি এমনি এত কথা বলোনি, আসলে ভয় পেয়েছ তুমি। টের পেয়েছ, এই দ্বীপে এবার পা রেখেছি তোমাকে শেষ করব বলে।’
ইয়ারপিস/মাইক অফ করে দিল রানা, লাফ দিয়ে নেমে পড়ল কেবল কার থেকে।
নিজের দল নিয়ে সত্যিই পৌঁছে গেছে ও মৃত্যুদ্বীপে।
ষোলো
ওয়াশিংটন, ইউএসএ।
পেন্টাগন।
রাত ০৯:৪৩ মিনিট
আর্কটিকের নরক-রাজ্য পোলার আইল্যাণ্ডে এখন সকাল ১০:৪৩।
সতেরো মিনিট পর পৃথিবী জুড়ে শুরু হবে লঙ্কাকাণ্ড।
হামলার মুখে পোলার আইল্যাণ্ডের টার্মিনালে পা রেখেছে মাসুদ রানা, ওই একই সময়ে পেন্টাগনের বি-রিঙের এক নির্জন করিডোর ধরে হাঁটছে কেভিন কনলন।
যারা এ-রিঙে কাজ করে, তাদেরকে বিশেষ দাম দেয়া হয়।
আর যারা কাজ করে বৃত্তের বাইরের দিকে ডি-রিঙে, ধরে নেয়া হয় তারা আসলে কোনও কাজেরই নয়, ফালতু।
কেভিন কনলন ম্যাথমেটিশিয়ান, কাজ করে ডিআইএ-র সাইফার ও ক্রিপটোঅ্যানালিসিস ডিপার্টমেন্টে। ওর অফিস বেযমেণ্টে, সি-রিঙে। অর্থাৎ, গুরুত্বের দিক দিয়ে কেভিন কনলন রয়েছে মাঝামাঝি অবস্থানে।
আজও বরাবরের মতই কেভিনের পরনে জিন্স ও টি-শার্ট, পায়ে স্নিকার। ডান কব্জিতে রাবারের ‘রিস্টস্ট্রং ব্রেসলেট। ওটার কারণে ওর মনে হচ্ছে, আসলে ও শক্তিশালী এক লোক।
পেন্টাগনের কোনও কমপিউটার অপারেটারকে মোটেও পাত্তা দেন না অফিসাররা, ধমকের উপর রাখেন। অবশ্য কেন যেন কনলনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে না কেউ। বিশেষ করে মেরিন কর্পসের কর্নেলরা তো দেখা হলেই সম্মানের সঙ্গে মাথা দুলিয়ে থাকেন।
তাঁরা জানেন, কনলনের সার্ভিস ফাইলে রয়েছে অস্বাভাবিক একটি নোটিফিকেশন: ইউনাইটেড স্টেটসের শত্রুদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ওকে দেয়া হয়েছে ক্লাসিফায়েড নেভি ক্রস।
মস্ত ব্যবসায়ীদের সংগঠন এম-১২-র বিরুদ্ধে বিশ্বের বড় সব শহরকে রক্ষার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বার সময় কেভিন কনলনকে জড়িয়ে নিয়েছিল মাসুদ রানা। তখন মাথার চেয়ে দেড়গুণ বড় এক হেলমেট পরে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে টেরোরিস্ট ভরা একটি ব্যালেস্টিক মিসাইলবাহী সুপারট্যাঙ্কারে উঠেছিল কেভিন, থরথর করে কাঁপছিল ভয়ে— ওকে পাহারা দিচ্ছিল ইউনাইটেড স্টেট্স্ অভ আমেরিকার দুর্ধর্ষ বারোজন মেরিন যোদ্ধা। সেসময়, নিজের কাজ ভালভাবেই সমাধা করেছিল কেভিন, রক্ষা পেয়েছিল আমেরিকার কয়েকটি বড় শহর। অবশ্য, এসব জানেন মাত্র অল্প ক’জন হাই-র্যাঙ্কিং অফিসার।
কেভিন কনলন এতেই খুশি যে ওকে চাপের মুখে ফেলা হয়নি, এখনও অফিসে পরতে পারে প্রিয় জিন্স ও স্নিকার।
রাত নয়টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট চলছে হাতঘড়িতে। বি-রিঙের বাঁক নেয়া এক করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে কেভিন। এরই ভিতর অফিস ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে ডিআইএ-র এই রিঙের বেশিরভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
সিনিয়ার বন্ধু মাসুদ রানা কেভিনকে পোলার আইল্যাণ্ড ও রাফিয়ান আর্মির বিষয়ে খোঁজ নিতে বলবার পর, ওই দ্বীপ সম্বন্ধে কিছু তথ্য পেয়েছে ও। অবশ্য, তেমন কিছুই জানা যায়নি রাফিয়ান আর্মির ব্যাপারে। এবং সে কারণেই আনঅথোরাইড় ডেটাবেস ব্যবহার করেছে। ধরা পড়লে জেলও হতে পারে ওর।
পোলার আইল্যাণ্ড সম্বন্ধে জেনেছে জেসিআইডিডি থেকে। ওই আলট্রা-হাই সিকিউরিটি ডকুমেন্ট ডেটাবেস দেখবার ক্ষমতা রয়েছে শুধুমাত্র অত্যন্ত উচ্চপদস্থ মিলিটারি ও ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের।
যা পেয়েছে, হ্যাক করেছে কেভিন।
এখন ওর হাতে মোটা একটা ডকুমেন্ট:
এজেন্সি | ডক টাইপ | সামারি | অথোর | ইয়ার |
ইউএসএন | সোভিয়েত সাব রিপেয়ার বেসেস | লিস্ট অভ সোভিয়েত নেভি ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিন রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি | ড্র্যাপার, এ. | ১৯৮০-প্রেয়েন্ট |
এনডাব্লিউ- এস | ম্যাক্রো ওয়েদার সিস্টেম অ্যানালিসিস | অ্যানালিসিস অভ জেটস্ট্রিম উইণ্ড প্যাটার্ন | হিউবার্ট এন. | ১৯৮২ |
সিআইএ | পসিবল লোকেশন্স | জিয়োলজিকাল অপশন্স ফর অপারেশন ‘কিল-ড্রাগন’ | উইলিয়াম টি. | ১৯৮৫ |
সিআইএ | সোভিয়েত কেম অ্যাণ্ড বায়ো ওয়েপন্স ডেভলপিং সাইট্স্ | লিস্ট অভ নোউন সোভিয়েত কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স ডেভেলপমেন্ট সাইট্স্ অ্যাণ্ড ফ্যাসিলিটিয় | ডেভিড, এম. | ১৯৮৬ |
ইউএস- এএফ | হাই-ভ্যালু টার্গেট লিস্ট(ইউএস- এসআর) | লিস্ট অভ ফার্স্ট টার্গেট্স্ ইন দ্য ইউএসএস- আর ইন দ্য ইভেণ্ট অভ আ মেজর কনফ্লিক্ট | জন ডাব্লিউ. | ১৯৮৫- ১৯৯১ |
এনআরও/ ইউএস- এএফ | স্যাটালাইট লোকেশন লিস্ট | ইন্টার এজেন্সি সোয়েপ অভ জিপিএস ডেটা কনসার্নিং রাশান বেসেস | কর্পেট এন. | ২০০৯- ১৪ |
আর্মি | সোভিয়েত কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স সার্ভে | লিস্ট অভ নোউন কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স কেপ্টবাই ইউএসএসআর/রাশান স্পেশাল ওয়েপন্স ডিরেক্টোরেট | রন এফ.এল. | ১৯৮২- প্রেযেন্ট |
এখন রাফিয়ান আর্মির উপর ডিআইএ-র বর্তমানের সবচেয়ে দক্ষ অ্যানালিস্ট রিনা গর্ডনের সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে কেভিন কনলন।
বি-৯৯৯০৫ লেখা অফিসের দরজার সামনে থামল কেভিন।
সংখ্যার নীচে লেখা: রিনা গর্ডন। অ্যানালিস্ট।
দরজার নীচ দিয়ে আসছে সাদা আলো। টোকা দেয়ার জন্য হাত তুলল ও, আর তখনই খুলে গেল দরজা। সামনে থমকে গেছে সুন্দরী এক মহিলা। বয়স হবে তিরিশ। প্রায় পরে ফেলেছে ওভারকোট। ‘কী চাই, বলুন?’ জানতে চাইল মিষ্টি কণ্ঠে।
‘হাই,’ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল কনলন। ‘আমি কেভিন কনলন। সাইফার অ্যাণ্ড ক্রিপ্টোঅ্যানালাইযার। আঙুল তুলে দেখাল বুকে ঝুলন্ত সিকিউরিটি ব্যাজ। ‘আপনি রিনা গর্ডন?’
‘হ্যাঁ। তবে ব্যস্ত। অফিস ছাড়ছি।’
‘আমি মাত্র একমিনিট নেব। কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’.
‘হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?’
‘নিশ্চয়ই।’
হনহন করে হাঁটে মহিলা। তাল রাখতে গিয়ে প্রায় দৌড়াতে লাগল কেভিন।
ওরা চলেছে পেন্টাগনের রিভার এন্ট্রান্সের দিকে।
হাঁটবার ফাঁকে কেভিনকে দেখল মহিলা। ‘যে রাফিয়ান আর্মির কথা বলছেন, মাত্র কয়েক মাস ধরে তাদেরকে চোখে চোখে রাখছি। অবশ্য গতকাল পর্যন্ত ওদের বিষয়ে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু আজ? সবাই জানতে চাইছে ওদের কথা। আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুম থেকে!’ মৃদু হাসল রিনা গর্ডন। ঠিক জানতাম একদিন না একদিন ভয়ঙ্কর কিছু করবেই ওরা।’
‘আপনি এখনও জানেন না ওরা কী করেছে?’ জানতে চাইল কেভিন।
‘না। তুমি জানো?’
‘খুব বেশি কিছু না। তবে একজনকে চিনি— যা ঘটছে, তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন তিনি।’
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল রিনা। থামল কেভিনও।
বাদামি চোখে ওকে দেখল মহিলা।
‘যা ঘটছে সেটা তুমি জানো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায় কী ঘটছে, বলবে?’
বারকয়েক চোখের পলক পড়ল কেভিনের।
আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স-এ যারা কাজ করে, প্রায় সবাই নিষ্পলক চোখে তাকায় অন্যের চোখে। বুঝিয়ে দেয়: অনেক কিছুই জানি, তা হয়তো নয়- কিন্তু যা জানি, তা তোমাকে জানাব কি না তা ভাবছি। আগে আমার বুঝতে হবে জানার মত যোগ্যতা তুমি অর্জন করেছ কি না।
চোখের পরীক্ষায় ফেল মেরেছে কেভিন কনলন। তাড়াতাড়ি করে বলল, ‘আমার সোর্স আর্কটিক সার্কেলে কাজ করছেন। তাঁকে বলা হয়েছে রাফিয়ান আর্মিকে ঠেকাতে।’
কথাটা শুনেছে রিনা, একটা কথাও বলল না। আপাদমস্তক দেখল কেভিনকে। এখনও স্থির করেনি এই তরুণের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করা উচিত হবে না অনুচিত।
কিনলন, না? তা হলে তুমি সেই অ্যানালিস্ট, যে মেরিনদের সঙ্গে ব্যালেস্টিক মিসাইল ভরা নকল সুপারট্যাঙ্কারে উঠেছিলে?’
‘ওই তথ্য তো ক্লাসিফায়েড থাকার কথা…
‘পেটে খাবার দেয়ার জন্য তথ্য জোগাড় করি,’ হাসল রিনা গর্ডন। ‘তা ছাড়া, এসেছি আইসিআই থেকে।
আইসিআই মানে ইন্টারনাল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স। ওটা ডিআইএ-র মতই, তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কাজ করে।
‘হ্যাঁ, আমিই সেই,’ বলল কেভিন।
‘তোমাকে নেভি ক্রস দেয়া হয়েছে,’ বলল রিনা। ‘সাধারণ কাউকে ওটা দেয়া হয় না।’
‘আমি শুধু জানি, রাফিয়ান আর্মির বিষয়ে আপনি বর্তমানে আমেরিকার সেরা বিশেষজ্ঞ।’
‘তোমার মাথায় বোধহয় ছিট আছে, কিন্তু ওই নেভি ক্রসের কারণে বোঝা যাচ্ছে, তুমি পুরো পাগল নও। কাজেই যা জানি বলছি: এখন চলেছি হোয়াইট হাউসে। ব্রিফ করব প্রেসিডেন্টকে। সব জানাতে হবে রাফিয়ান আর্মির ব্যাপারে। আমার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে রিভার এন্ট্রান্সে। ওটা পর্যন্ত যাওয়া তক তোমাকে সময় দেব। কাজেই যা জানতে চাও, চটপট জিজ্ঞেস করো।’
‘ঠিক আছে।’
‘আমি যে ব্যাকগ্রাউণ্ড রিপোর্ট তৈরি করেছি, তাতে সবই চলিখেছি।’ আবারও হাঁটতে লাগল রিনা গর্ডন। এলিভেটারে উঠবে, নামবে রিভার এন্ট্রান্সের লবিতে। ‘গত দু’বছর আগে হঠাৎ করেই কোথা থেকে হাজির হলো ওরা। নানা সামরিক ঝামেলা করতে লাগল। রিপোর্টে লিখিনি, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে: এরা সুযোগসন্ধানী একদল ডাকাত। সশস্ত্র হামলা করছে ফাঁক বুঝে। হিসেব কষে কাজে নামে, কো-অর্ডিনেশন ভাল। তুমি কল্পনারহিত লোক না হয়ে থাকলে, আমার আরও কিছু ধারণা বলতে পারি।’
কল্পনাহীন নই আমি,’ বলল কেভিন।
এক এক করে আঙুল গুনে বলতে শুরু করল রিনা গর্ডন: ‘প্রথমে, চিলির ভ্যালপারাইসোর এক মিলিটারি প্রিযন থেকে পালিয়ে গেল এক শ’ বন্দি সৈনিক। তাদের সঙ্গে ছিল বারোজন অফিসার। আমাদের আমেরিকার ফোর্ট বেনিনের স্প্যানিশ- ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিতে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করি আমরা। উনিশ শ’ আশির দশক থেকে দুই হাজার দশ সাল পর্যন্ত ল্যাটিন খুনে শাসকরা প্রথমেই তাদের সেরা সৈনিক ও অফিসারদেরকে পাঠাত ইউএসএ-র আর্মি ট্রেনিং স্কুলে খুন শিখতে।
‘তাই?’ চমকে গেল কনলন।
‘হ্যাঁ। তারপর কী করল তারা? চুরি করল রাশান এক ফ্রেইটার। ওটা ভরা ছিল সব ধরনের অ্যাসল্ট রাইফেল ও আরপিজি দিয়ে। ডাকাতি করল এক গ্রিক বিমান। ওটা ছিল কাগজের নোটে ভরা। এরপর আফগানিস্তানের মেরিন বেস থেকে হাওয়া করে দিল অসপ্রে ও কোবরা এয়ারক্রাফট। সুদানের এক ইউএন প্রিযন থেকে ছুটিয়ে নিয়ে গেল আরও এক শ’ সৈনিক। তারা প্রত্যেকে ছিল উগ্রপন্থী। এর ফলে তারা পেয়ে গেল ছোট এক ব্যাটালিয়ন অ্যাসল্ট ফোর্স। তাদেরকে চালাল দক্ষ অফিসার। কাজেই ভয়ঙ্করভাবে হামলা করার ক্ষমতা অর্জন করল।
‘অবশ্য একটা ব্যাপার এখনও বুঝিনি,’ আস্তে করে মাথা দোলাল রিনা গর্ডন। ‘শেষের দুই হামলা কীসের জন্যে? গত মার্চে বোমা মেরে মস্কোর এক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ধসিয়ে দিয়েছে। আর তার কয়েকদিন পর ডি.সি.-তে বুড়ো এক ডিফেন্স সেক্রেটারিকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে।
‘ওই দুই হামলা অস্বাভাবিক ভাবছেন কেন?’ জানতে চাইল কেভিন। খুলে গেছে এলিভেটারের দরজা, বেরিয়ে এল ওরা লবিতে।
‘কাজগুলো ওদেরকে মানায় না,’ বলল রিনা। ‘ওদের সৈনিক ও অফিসার আছে, গত কয়েক মাসে দখল করেছে অস্ত্র ও গানশিপ… অথচ কী করল? উড়িয়ে দিল এক বাসাবাড়ি। ছোরা দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলল এক বুড়ো মানুষকে। কীসের জন্য এসব করল? হিসেব মেলে না। ভয়ঙ্কর কোনও কিছু করতে পারত। সেসব বাদ দিয়ে এসব কেন?
‘আমার মনে হয়েছে, অনেক গুরুতর কিছু করার জন্যেই প্রস্তুতি নিয়েছে ওই সেনাবাহিনী। হয়তো দখল করবে কোনও দেশ। তার আগে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদেরকে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে মস্কোর ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবন উড়িয়ে দেয়ায় হৈ-চৈ করেছে প্রেস, কিন্তু এটাও তো ঠিক, ওই বাড়ি ধসিয়ে দিতে দুই শ’ সৈনিক লাগে না। তা হলে কী কাজ করছে ওরা আসলে?’
‘আমি এভাবে ভেবে দেখিনি,’ বলল কেভিন। কোনও ভড়ং না করেই মনের কথাই বলেছে মহিলা। যুক্তিও আছে কথায়। হয়তো মস্কোর ওই বোমা ফাটানো হয়েছে সবার চোখ অন্য দিকে সরিয়ে দিতে,’ বলল কেভিন। ‘আসলে অন্যকিছু করছে। হয়তো সে-কারণেই মেরেছে অবসরপ্রাপ্ত ডিফেন্স সেক্রেটারিকে। সবার মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে অন্যদিকে। তলে তলে আজকের হামলার জন্যে কাজ করেছে আর্কটিকে।’
হাঁটবার ফাঁকে কেভিনকে দেখল রিনা গর্ডন।
‘তা হতে পারে।’
‘আসলে আপনার মত পুরো বিষয়টা জানি না,’ স্বীকার করল কেভিন। ‘কিন্তু এটা বুঝতে পারছি, যতটা জানি, সেটা আপনার কাজে আসবে। আর্কটিকে আমার যে বন্ধু আছেন, তিনি বলেছেন, আমি যেন রাফিয়ান আর্মির ওপর তথ্য সংগ্রহ করি। এ ছাড়া জানতে হবে আর্কটিকের এক সোভিয়েত আমলের ফ্যাসিলিটির বিষয়ে। ওই ফ্যাসিলিটি আসলে পোলার আইল্যাণ্ডে। ওই সেনাবাহিনী হয়তো দখল করতে চাইছে ওই ফ্যাসিলিটি।’
‘পোলার আইল্যাণ্ড…’ বিড়বিড় করল রিনা। তারপর বলল, ‘না, কখনও শুনিনি নামটা।’
‘ওই ফ্যাসিলিটি কাজ শুরু করে উনিশ শ’ পঁচাশি সালে,’ বলল কেভিন। ‘যা জেনেছি, ওটা ছিল মস্ত এক এক্সপেরিমেন্টাল- ওয়েপন্স ফ্যাসিলিটি। সে আমলে ওটা ছিল ফার্স্ট স্ট্রাইক টার্গেট। আমাদের মিলিটারির প্রতিটি ব্রাঞ্চ ওই দ্বীপের উপর চোখ রাখত- এয়ার ফোর্স থেকে সিআইএ- সবাই।’
ওরা পৌঁছে গেছে রিভার এন্ট্রান্সে।
টার্নারাউণ্ডে অপেক্ষা করছে বিশেষ নাম্বার প্লেটসহ দুই লিংকন গাড়ি। গাড়ির মাথায় জ্বলজ্বল করছে পুলিশের ফ্লাশ লাইট।
‘ভিআইপি-র মত আপনাকে নিতে এসেছে ‘দুই গাড়ি?’ জানতে চাইল কেভিন। ধাক্কা দিয়ে খুলল লবির দরজা।
‘জীবনে প্রথমবার এভাবে ডাক এল।’
‘সুপারট্যাঙ্কারের দুর্ঘটনার সময় আমাকেও ভিআইপির মত তুলে নিয়েছিল,’ বলল কেভিন, ‘ঝড়ের গতিতে চলে এসব গাড়ি। ট্রাফিক লাইটকে পাত্তাও দেয় না। আমার মনে হয়েছিল সত্যি বুঝি খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক হয়ে গেছি। আমার এস্কোর্ট বলেছিল: মিস্টার কনলন, যখনই ভিআইপি হিসাবে আপনাকে তুলে নেয়া হবে, সবসময় ওই গাড়ির চারটে দিক খেয়াল করবেন। সেসবের কারণে ওই গাড়ি কখনও আটকে দেবে না পুলিশ। প্রথম কথা ডিওডি লাইসেন্স প্লেট। ওটার অক্ষর শুরু হবে যেড দিয়ে। উইণ্ডশিল্ডে থাকবে অল-অ্যাক্সেস আইডি ট্যাগ। গাড়ির চাকা হবে মসৃণ। আর শেষ কথা, হুইল হবে অ্যালয়-এর। সত্যিই যদি হাই স্পিডে পালাতে হয়, আপনার গাড়ির থাকতেই হবে হেভি-ডিউটি রিম।’
‘গাড়ি নিয়ে ভাবে কে!’ বলল রিনা গর্ডন, ‘প্রেসিডেন্টকে ব্রিফ করতে চলেছে যে, তার জানতে হবে কেন কোন কোম্পানির গাড়িতে চড়ছে?’
লিংকন গাড়ির পাশে অপেক্ষা করছে সুট পরা দুই লোক। দু’জনই ন্যাড়া। গণ্ডারের মত গাঁট্টাগোট্টা। কেভিন ও রিনা গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই তাদের একজন সামনে বাড়ল। ‘রিনা গর্ডন? ডগলাস থর্ন, স্পেশাল ট্র্যানটি।’
আইডি উঁচু করে ধরেছে সে। নিজেরটা তুলে ধরল রিনা।
আস্তে করে মাথা দোলাল ডগলাস থর্ন, প্রথম গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিল।
থমকে গেল রিনা গর্ডন, ঘুরে দাঁড়িয়ে কেভিনকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল, মিস্টার কনলন। পরে হয়তো আবারও আলাপ হবে।’
‘হয়তো হোয়াইট হাউসে আপনার কাজ শেষ হলে…’ থেমে গেল কেভিন। পরক্ষণে নিচু স্বরে বলল, ‘এসব হুইল অ্যালোয় নয়।’ প্রথম গাড়ির চাকার রিম দেখছে। চট করে চাইল দ্বিতীয় গাড়ির রিমের দিকে। চোখ গেল নাম্বার প্লেট ও জানালার দিকে। ঠিকই আছে। যেড অক্ষর দিয়েই শুরু হয়েছে প্লেট। চাকাগুলোও মসৃণ। কিন্তু চাকার রিমগুলো অতি সাধারণ।
ঘুরে দাঁড়াল কেভিন, দেখতে পেল পিছনের অন্ধকার থেকে উদয় হয়েছে প্রকাণ্ডদেহী আরও দু’জন লোক। পথ আটকে দিয়েছে তারা। রিভার এন্ট্রান্সে ফিরতে পারবে না কেভিন ও রিনা।
‘এরা আপনাকে হোয়াইট হাউসে নিতে আসেনি, রিনা,’ নিচু স্বরে বলল কেভিন। ‘এরা এসেছে আপনাকে কিডন্যাপ করতে!’
কেভিনকে একবার দেখেই ডগলাস থর্নের দিকে চাইল রিনা গর্ডন।
মুহূর্তের জন্য চোখের পলক পড়ল লোকটার। ‘কোনও সমস্যা, ম্যাম?’
‘এবার বুঝতে পেরেছেন?’ চাপা স্বরে বলল কেভিন।
‘হ্যাঁ,’ বলল রিনা গর্ডন।
‘তা হলে চলুন লেজ তুলে দৌড় দিই!’
‘তা আর বলতে?’ ডানদিকে ঘুরেই ছুটল রিনা গর্ডন। পিছনে কেভিন কনলন। চলেছে বিশগজ দূরের মেট্রো রেলের এন্ট্রান্সের দিকে।
ধাওয়া করল দু’ গাড়ির পাশের লোকদুটো। পেন্টাগনের পথ আড়াল করা লোক দু’জনও দৌড়াতে শুরু করেছে। সবার হাতে বেরিয়ে এসেছে সাইলেন্সার ফিট করা গ্লক পিস্তল।
ঝড়ের গতিতে সাবওয়ে স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল কেভিন ও রিনা গর্ডন। ট্র্যান্সটিল পার হয়েই পৌঁছে গেল প্ল্যাটফর্মে।
এইমাত্র এসে থেমেছে এক ট্রেন, খুলছে দরজা।
বেশ রাত বলে যাত্রীদের চাপ কম।
প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রেনের বগিতে উঠল রিনা ও কেভিন। তিন সেকেণ্ড পর সস্ আওয়াজে আবারও বন্ধ হয়ে গেল দরজা। পরক্ষণে রওনা হলো ট্রেন।
তখনই প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলো চার ধাওয়াকারী। কোটের ভিতর লুকিয়ে ফেলেছে পিস্তল। রাগে গনগনে লাল হয়ে গেছে মুখ। মানতে পারছে না, হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে তাদের শিকার।
সতেরো
আর্কটিক সাগরের মাঝে মৃত্যুদ্বীপ বা পোলার আইল্যাণ্ড।
সকাল দশটা তেতাল্লিশ।
সতেরো মিনিট পর ধ্বংসের পথে রওনা হবে পৃথিবী।
দ্বীপের উপরের টার্মিনালে কেব্ল্ কার থেমে যেতেই ঝড়ের গতিতে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছে মাসুদ রানা।
টার্মিনালের প্রধান দরজায় রোবট বন্ধুর পাশে পৌঁছে দেখল, মাত্র বিশ গজ দূরে কর্কশ আওয়াজে থামল সেনা ভরা দুই ট্রাক। ওপাশে আকাশে মাথা তুলেছে সাদা মেইন টাওয়ার। যেন ভবিষ্যতের কোনও স্থাপনা- প্রকাণ্ড ও দুর্গম।
‘বন্ধু, কাভার, দাও,’ বলল রানা। ‘গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত দরজা আটকে রাখবে। কেউ যেন ঢুকতে না পারে।’
‘নিশ্চয়ই, বন্ধু।’
দুই ট্রাক থেকে হুড়মুড় করে নামছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিক। বন্ধু তাদের দিকে গুলি পাঠাতেই প্রাণভয়ে নানাদিকে ডাইভ দিল লোকগুলো। পাগল হয়ে উঠেছে কাভার পাওয়ার জন্য।
প্রধান প্রবেশ পথ আটকে দিয়েছে খুদে রোবট।
দলের অন্যদেরকে নিয়ে পশ্চিমে ছুট দিল রানা।
ডক্টর তারাসভ বলেছেন ওদিকে রয়েছে গ্যারাজ।
প্রায় উড়ে ওটার সামনে পৌঁছে গেল রানা, দড়াম করে খুলে ফেলল দরজা।
গ্যারাজের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। অবশ্য দরজা দিয়ে আসা আলোয় দেখা গেল দুটো ট্রাক। প্রথমটা মাঝারি ফিউয়েল ট্রাক, পিঠে জং-ধরা ড্রামের মত অ্যালিউমিনিয়ামের গ্যাসোলিন ট্যাঙ্ক। ওটার পিছনে ও উপরাংশে রাং ল্যাডার। ট্যাঙ্কারের পিছনে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় ট্রাক। ওটা ছোট সিমেন্ট মিক্সার, পিঠের উপর ঘুরতে পারে এমন স্টিলের ব্যারেল।
ট্রাকের দিকে পা বাড়িয়ে বলল রানা, ‘আপা, ডিফেখন, আপনারা ট্যাঙ্কারে উঠুন। ইঞ্জিন চালু করুন, আপা। …আমরা গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে গেলেই অন্যরা শত্রুদের মনোযোগ আটকে রাখবেন। আমরা সরে গেলে নিজেদের পযিশনে যাবেন।
জবাবে আস্তে করে মাথা দোলাল শ্যারন, বব, পাওলো, পবন ও ফারিয়া। ‘ঠিক আছে,’ বললেন ডক্টর তারাসভ।
সবাইকে একবার দেখে নিল রানা, তারপর বলল, ‘এতে যদি কাজ না হয়, আপা, বুনো আর আমি জান নিয়ে ফিরব না। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব নেবে মেজর শ্যারন ফ্যেনুয়্যা ও ক্যাপ্টেন পাওলো।’
ওদের পিছনে খড়-খড় শব্দে জেগে উঠেছে ট্যাঙ্কারের ইঞ্জিন।
‘মেজর,’ ট্যাঙ্কার ট্রাকের পাশের গজ দেখছে বুনো। ট্যাঙ্কে এখনও ফিউয়েল আছে। আমাদের যা প্ল্যান, উচিত বোধহয় টাঙ্কি খালি করে ফেলা। তাতে ওজন কম হবে।’
‘তা-ই করুন।’
ট্রাকের পিছনের একটা স্পিট ঘুরিয়ে দিল ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেন।
ড্রামের মত ট্যাঙ্ক থেকে ঝরঝর করে মেঝেতে পড়তে লাগল ডিজেল ফিউয়েল।
এবার ড্রাইভারের সিটে গিয়ে উঠল রানা। নিশাত ও ডিফেখন উঠল ট্রাকের পিঠের স্টিল রাং ল্যাডারে। হাতে উদ্যত অস্ত্র।
‘গ্যারাজের দরজা খুলুন, নির্দেশ দিল রানা।
পাশের দেয়ালের একটা সুইচ টিপে দিলেন ডক্টর তারাসভ। পিছলে খুলে যেতে লাগল রোলার ডোর। দিনের আলো এসে পড়ল গ্যারাজে।
মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরেছে রানা, হোঁচট খেয়ে সগর্জনে রওনা হলো ট্রাক। চলেছে ওরা লড়াই করতে।
রানার ট্রাক গ্যারাজ থেকে বেরোতেই ঘুরে দাঁড়াল পবন, চলে গেল টার্মিনালে যাওয়ার দরজার কাছে। এবার সরিয়ে নেবে বন্ধুকে।
খুদে রোবট গুলি করছে মেশিনগান দিয়ে। তার দিকে গুলি পাঠাচ্ছে শত্রুরা। ঠুংঠাং আওয়াজে বুলেট ছিটকে যাচ্ছে বন্ধুর গায়ে লেগে।
‘চলে এসো, পবন,’ কুয়াশার সহকারীকে সরিয়ে নিতে চাইল ফারিয়া। ‘সময় নেই, পযিশনে যেতে হবে। বন্ধু ঠিকই থাকবে।’
কথাটা মাত্র বলেছে ফারিয়া, এমন সময় টার্মিনালের প্রধান দরজা দিয়ে বন্ধুর সামনে পড়ল রকেট-প্রপেল্ড গ্রেনেড।
ছোট্ট রোবটের চারপাশে বিস্ফোরিত হলো আগুন। জ্বলজ্বলে কমলা শিখার ভিতর হারিয়ে গেছে বন্ধু। তারপর শক ওয়েভের কারণে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েই পড়ল পিছনে। দড়াম করে লাগল বিপরীত দেয়ালে। কয়েক ফুট দূরেই টার্মিনালে কেবল কার ঢুকবার মস্ত খোলা জায়গা। ওদিকে খাড়া তিন শ’ ফুট নীচে উপসাগর।
উপর থেকে কাত হয়ে ধুপ্ করে মেঝেতে পড়েছে বন্ধু, যেন অসহায় ও দ্বিধান্বিত। ঘুরছে রাবারের চাকা।
‘নাহ্!’ দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল পবন।
অবশ্য এক সেকেণ্ড পর নিজেকে সোজা করে নিল বন্ধু, মনে হলো ঠিকই আছে। কিন্তু এমন সময় টার্মিনালে ঢুকল রাফিয়ান আর্মির প্রথম সেনা। নিচু হয়ে ছুটে আসছে। কাঁধে তুলে নিয়েছে আরপিজি, পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার।
এবার আর কোনও সুযোগ রইল না বন্ধুর।
বিদ্যুদ্বেগে গিয়ে ওর বুকে লাগল আরপিজি, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো।
ওই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে উত্তর দেয়ালের পাশ কাটিয়ে খোলা মস্ত দরজা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল বন্ধু। তিন শ’ ফুট নীচে শীতল সাগর। সাঁই-সাঁই করে নীচে পড়তে লাগল বন্ধু, মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর ঝপাৎ করে পড়ল গিয়ে সাগরে।
শেষ হয়ে গেছে ওর লড়াই।
ওদিকে গ্যারাজ থেকে ট্রাক পশ্চিমে রওনা হতেই ওটার দিকে মনোযোগ দিয়েছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা, চমকে গেছে।
প্রকাণ্ড গহ্বরের দিকে ছুটছে রানার ট্রাক। ট্যাঙ্কের পিঠে উবু হয়ে বসেছে নিশাত ও বুনো। মোটা পাইপ থেকে পিছনে ঝরঝর করে পড়ছে ডিজেল।
সামনেই পড়বে মেইন টাওয়ার।
অস্ত্র বাগিয়ে ধরল রাফিয়ান আর্মির সদস্যরা, কিন্তু এমন সময় ব্রাশ ফায়ার করল নিশাত ও বুনো। পিছনে ছিটকে পড়ল কমপক্ষে ছয়জন সৈনিক। তাড়াতাড়ি কাভার নিল অন্যরা। ফলে দেখল না, গ্যারাজ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে রানার দলের অন্যরা।
সৈনিকদের পুরো মনোযোগ এখন ট্যাঙ্কার ট্রাকের উপর।
এর মূল কারণ: অস্বাভাবিক পথে চলেছে ওই ট্রাক।
গহ্বরের দু’দিকের দুই ক্রেন-ব্রিজের দিকে যাচ্ছে না।
সামনেই পড়বে গভীর, প্রকাণ্ড কূপ।
তীরের মত ছুটছে ট্রাক, অথচ সামনে রাস্তা নেই!
খোলা জায়গা পেরোলে শত শত ফুট নীচে কংক্রিটের চাতালে গিয়ে পড়বে!
‘শালারা করে কী?’ বলে উঠল রাফিয়ান আর্মির এক সদস্য।
মেইন টাওয়ারের কমাণ্ড সেন্টার থেকে দ্রুতগামী ট্যাঙ্কার ট্রাক লক্ষ করছে তাদের জেনারেল বা বিশৃঙ্খলার সম্রাট।
‘লোকটা কী করতে চাইছে?’ আনমনে বলল।
গতি বাড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটছে ট্রাক। সরাসরি চলেছে যেন মস্ত কূপে ঝাঁপ দিতেই।
আর মাত্র পনেরো গজ দূরেই শত শত ফুট গভীর গহ্বর।
গতি এখনও বাড়ছে ট্রাকের।
কিন্তু পিছনের আকাশে হাজির হলো অসপ্রে, বারবার গর্জে উঠছে কামান।
ট্রাকের চারপাশে এসে পড়ছে স্ আওয়াজ তোলা বুলেট। পিছনে পড়ল কয়েকটা গোলা। দপ্ করে জ্বলে উঠল মাটিতে পড়া ডিজেল। ধাওয়া করল পলায়নরত ট্রাককে!
ওই আগুন সাইড মিররে দেখেছে রানা। ‘চলছে সবার পাগলামি,’ মনে মনে বলল। গহ্বরের কিনারার দিকে ছুটছে তুমুল গতি নিয়ে। হাঁক ছাড়ল: ‘আপা! বুনো! … রেডি?’
ট্রাকের পিঠ থেকে জানাল নিশাত, ‘সামনের দিক দেখছি!’
‘পিছন দিক আমার!’ চেঁচাল ক্যাপ্টেন ডিফেখন। বিড়বিড় করে বলল, ‘আকাশে কেউ থেকে থাকলে, বাপু, সাহায্য কোরো! আর চান্স পাবে না!’
গম্ভীর মুখে মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরল রানা, আরও গতি চাই ওর। পরক্ষণে প্রকাণ্ড কূপের কিনারা পেরিয়ে গেল ট্রাক, ছিটকে ভেসে উঠল শূন্যে!
বনবন করে ঘুরছে চাকা, বৃত্তাকার গহ্বরের কিনারা পেরিয়ে গেছে ট্রাক— অনেক নীচে কংক্রিটের চাতাল!
ট্রাকের চাকা মাটি ছাড়তেই ম্যাগনেটিউয়েক্সের দুই ব্যারেলই
ফায়ার করেছে ক্যাপ্টেন ডিফেখন। কাছের কিনারার কংক্রিটে গেঁথে দিয়েছে দুই গ্র্যাপলিং হুক। পরিষ্কার ‘ঠং! ঠং!’ আওয়াজ শুনেছে। কংক্রিটের গভীরে ঢুকেছে দুই ড্রিল বিট। পিছনে ছিটকে বেরোচ্ছে কেবল। যন্ত্রটা হাতে ট্রাকের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে বুনো। চট্ করে ট্যাঙ্কার ট্রাকের স্টিলের মইয়ের নীচ দিয়ে দু’বার ঘুরিয়ে আনল ম্যাগনেটিউয়েক্স লঞ্চার।
ওই একই সময়ে ট্রাকের ছাতের সামনে উঠে দাঁড়িয়েছে নিশাত সুলতানা— ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। সময় যেন পেরোবে না। আগে গহ্বরের যতটা পারা যায় মাঝে যেতে হবে। কয়েক সেকেণ্ড পর নীচের দিকে নাক তাক করল ট্রাক। এবার শ্যারনের কাছ থেকে পাওয়া ম্যাগনেটিউয়েক্সের দুই হুক ফায়ার করল নিশাত। উড়ন্ত ট্রাকের অনেক সামনের সসারের দিকে ছুটল চৌম্বক গজাল।
ফ্রেঞ্চদের তৈরি গ্র্যাপলিং হুকের পিছনে সরসর করে চলেছে কেবল, দুই সেকেণ্ড পর কংক্রিটের পিরিচের জানালার দু’ফুট উপরে বিদ্যুদ্বেগে গেঁথে গেল বোল্ট। দুর্ধর্ষ বুনোর মতই, দেরি করল না নিশাত, স্টিলের রাং ল্যাডারের তলা দিয়ে দু’বার লঞ্চার ঘুরিয়ে আনল। ওরা দু’জনই শক্ত করে ধরেছে লঞ্চার। অপেক্ষা করছে প্রচণ্ড ঝাঁকির জন্য।
তিন সেকেণ্ড পর যখন ওই ঝাঁকি এল, ওদের মনে হলো পেটের নাড়িভুঁড়ি নেমে গেল পায়ের দিকে।
নামতে নামতে হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর হোঁচট খেয়েছে উড়ন্ত ট্রাক, বার কয়েক দু’দিকে ভীষণ দুলে থেমে এল।
দুই ফ্রেঞ্চ লঞ্চারের কাজ দেখবার মত: প্রকাণ্ড, গভীর গহ্বরে গিয়ে পড়ল না ট্রাক। পড়তে শুরু করতেই ওটার সামনে ও পিছনের চারটে কেবল টানটান হয়েছে শক্ত দড়ির মত। যেন তৈরি করেছে ঝুলন্ত এক দড়ির সেতু। চার কেবলের কারণে গহ্বরের মাঝে ঝুলছে ট্রাক!
যেন মাছির অপেক্ষায় বসে আছে মাকড়সা।
দেড় টনি ফিউয়েল ট্রাক ঝুলে আছে প্রকাণ্ড কূপের মাঝে। কংক্রিটে গেঁথে আছে পিছনের দুই কেবলের বোল্ট, সামনের দুই কেবলের বোল্ট সসারের গায়ে। দুই শ’ ফুট নীচে কংক্রিটের চাতাল। ঝুলন্ত ট্রাকের পিঠে খুদে দুই মূর্তি বুনো ও নিশাত।
ওরা থেমে যেতেই দেরি করেনি রানা, ক্যাব থেকে বেরিয়ে এসেই চট করে সামনের একটা কেবলে আটকে নিয়েছে শ্যারনের মোটোরাইড্ অ্যাসেণ্ডার।
কাজে নেমে রানা টের পেল, ওটা দারুণ জিনিস। সাঁই-সাঁই করে উঠে যেতে লাগল ও বিদ্যুদ্বেগে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পৌছে গেল পিরিচের মত আকৃতির দালানের বাইরে। একহাতে অ্যাসোর ধরে রাখল রানা, অন্যহাতে হোলস্টার থেকে বের করল ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল — তিন গুলিতে ভেঙে ফেলল জানালা।
ঝনঝন করে ভিতরে গিয়ে পড়ল কাঁচ।
বার কয়েক দোল দিয়েই পিরিচের ভিতর নেমে পড়ল রানা। চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি:
১০:৫৭
আর মাত্র তিন মিনিট বাকি!
ঝড়ের মত সামনে বাড়ল রানা। মনে মনে বলল, টাওয়ারে হামলা হতে পারে, কাজেই দুই ক্রেন-ব্রিজ তুলে নিয়েছে রাফিয়ান আর্মির জেনারেল। এবার ওই দুই ব্রিজ তারই বিরুদ্ধে যাবে।
চাইলেই টাওয়ারে আসতে পারবে না তার লোক, বেশিরভাগই রয়ে গেছে এই গহ্বরের ওদিকে।
কনভেনশনাল ডিফেন্সিভ ডিপ্লয়মেন্ট।
এখন কমপক্ষে একমিনিট লাগবে দুই সেতু নামাতে।
তার মানে, বড়জোর কয়েকজনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
এবার চট করে পৌঁছে যেতে হবে ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার রাখা ল্যাবোরেটরিতে।
ক্ষিপ্র বাজপাখির গতি নিয়ে ছুটছে রানা।
ডিস্কের মত টাওয়ারের ইন্টেরিয়ার উনিশ শ’ আশির দশকে তৈরি। অফিসের মেঝেতে ধূসর-হলদেটে কার্পেট, তার উপর নকল কাঠের একের পর এক ডেস্ক— দ্বীপের অন্য জায়গার মত নোংরা নয়, রীতিমত ঝকঝকে তকতকে। ভুতুড়ে শহরের দালানের মতই পরিত্যক্ত।
ছুটবার ফাঁকে ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল দিয়ে ডানে-বামে গুলি করছে রানা। শত্রু নেই, কিন্তু ওর লক্ষ্য সিলিঙের সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা। বিস্ফোরিত হচ্ছে সব, ছিটকে উঠছে নানারঙা ফুলকি।
দৌড়ের ভিতর পরিত্যক্ত ডেস্কগুলো পাশ কাটিয়ে গেল রানা, পৌছে গেল এলিভেটারের খোলা দ্রজার সামনে। এই সসারের উপরের এই তলায় ল্যাবোরেটরি নেই। এলিভেটারের দরজার পাশে নিচু হলো ও, কিছু একটা রাখল মেঝেতে, তারপর টিপে দিল ওটার সুইচ।
চট্ করে দেখল সময়:
১০:৫৯ হয়ে গেল ১১:০০
ব্যবহার করবার জন্য প্রস্তুত ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।
ধার করা সময়ে কাজ করছি, ভাবল রানা।
বামহাতে ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল রেখে ডানহাতে বের করল এমপি-৭। দুই অস্ত্র হাতে টিপে দিল এলিভেটারের কল বাটন।
.
প্রকাণ্ড গহ্বরের মাঝে চারটে কেবলে ঝুলন্ত ট্যাঙ্কার ট্রাকের দিকে চেয়ে আছে রাফিয়ান আর্মির জেনারেল।
‘ভাল বুদ্ধি করেছে তো!’ মন্তব্য করল।
তার পাশেই কর্নেল সাইক্লোন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না সে। রেডিয়োতে ধমকে উঠল হেঁড়ে গলায়: টাওয়ার টিম! দালানে শত্রু ঢুকেছে! তোমাদের দিকেই যাচ্ছে! শালা স্ফেয়ার চাইছে! স্ফেয়ারগুলো নিয়ে ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়ে এসো!’
জবাবে বিস্মিত এক কণ্ঠ বলল, ‘স্যর, এইমাত্র অপারেটিং টেম্পারেচারে পৌঁছেছে স্ফেয়ার। আমরা রিহিটার ইউনিট খুলছি। কমপক্ষে আরও কয়েক মিনিট লাগবে…’
ভুরু কুঁচকে ফেলল সাইক্লোন। ‘তা হলে তোমার গার্ডদের বলো এলিভেটার পাহারা দিতে। আমি আরও লোক পাঠাচ্ছি।’
কমাণ্ড সেন্টারে সর্বক্ষণ উপস্থিত ছয়জন সৈনিকের দিকে ঝট করে ঘুরল সে। ‘সোজা চলে যাও নীচের সসারে!’
রাগে থমথম করছে সাইক্লোনের মুখ।
এদিকে সিসিটিভি স্ক্রিনে নির্দিষ্ট এলিভেটারের ভিতরাংশ দেখছে বিশৃঙ্খলার সম্রাট।
সাদা-কালো স্ক্রিন, কোনও আওয়াজ পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সম্রাট পরিষ্কার দেখল, এলিভেটারে ঢুকছে মাসুদ রানা। লোকটা তারই দিকে এমপি-৭ তুলল, পরক্ষণে গুলি করল।
পর্দা থেকে হারিয়ে গেল রানার ইমেজ।
.
নীচের সসারের প্রথমতলায় বৃত্তাকার ল্যাবোরেটরি, সবদিকে জানালা। ওখান থেকে পরিষ্কার চোখে পড়ে দ্বীপের চারপাশ। অবশ্য, মূল ভিত্তির জায়গায় জায়গায় সসার ধরে রেখেছে ধূসর কংক্রিট কলাম। সামান্য পুবে আরও উপরে পরের সসার।
নীচের সসারের ল্যাবোরেটরি প্রায় স্বয়ং-সম্পূর্ণ। ওই দালানে রয়েছে কিচেন, টয়লেট, একটা ক্লটি, ছোট একটা বাঙ্ক হাউস এবং এলিভেটার। শেষের জিনিসটার মাধ্যমে ঢুকতে হবে ল্যাবোরেটরিতে, এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।
এ মুহূর্তে ল্যাবে রয়েছে রাফিয়ান আর্মির দুই টেকনিশিয়ান— ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউণ্ডের কারণে তাদেরকে এ কাজ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ল্যাবে রয়েছে রাশান এক সায়েন্টিস্ট- সেমেন ইগোরভ। এই লোকই রাফিয়ান আর্মিকে দ্বীপে পা রাখবার সুযোগ করে দিয়েছিল।
ইগোরভ বিশালদেহী লোক, পিপের মত ফোলানো পেট। ফলে কোমরের জোর হারিয়ে কুঁজো হয়ে গেছে। রাশান ভদকার কারণে লাল শিরা ওঠা দুই চোখ ঢুলু-ঢুলু। পাতলা চুল। বেশিরভাগ সময় ঘামতে থাকে, এবং এই মুহূর্তেও দরদর করে ঘামছে।
দুই টেকনিশিয়ান ও রাশান বিজ্ঞানী দাঁড়িয়ে আছে বড় একটা ইনকিউবেটার চেম্বারের সামনে।
চেম্বারে শুয়ে আছে ছয়টি ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার।
এইমাত্র বারো ঘণ্টা তাপ দিয়ে প্রাইম করা হয়েছে লাল বল।
টেকনিশিয়ানদের কাছেই রয়েছে রাফিয়ান আর্মির তিন সৈনিক। এদের মনে হয়েছিল ল্যাব পাহারার কাজ নিলে খাটনি হবে না, তাই এখানে এসেছে। গত কয়েক ঘণ্টা আরাম করে বসে তাস খেলেছে।
কিন্তু এখন কর্নেল সাইক্লোনের নির্দেশে সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠেই এলিভেটারের দিকে তাক করেছে অস্ত্র।
এক সেকেণ্ড পর এলিভেটার পৌঁছে যেতেই ‘পিং!’ আওয়াজ শুনল তারা।
.
টাওয়ারের কমাণ্ড সেন্টারে নির্দিষ্ট স্ক্রিনে আবারও মাসুদ রানার ডোশিওতে চোখ বোলাচ্ছে রাফিয়ান আর্মির জেনারেল। পাশেই সিসিটিভির ইমেজ, টানটান উত্তেজনা নিয়ে স্ফেয়ার ল্যাবে অপেক্ষা করছে সশস্ত্র বেশ কয়েকজন।
স্ক্রিনে স্থির রানার দিকে চেয়ে বলল জেনারেল: ‘মেজর, যদি স্ফেয়ার সরিয়েও নাও, টাওয়ার থেকে বেরোবে কী করে? দ্বীপ ছেড়ে যাওয়া তো ঢের দূরের কথা!’
.
এলিভেটারের দরজা খুলে যেতেই গুলি শুরু করল অপেক্ষারত রাফিয়ান আর্মির তিন সৈনিক। ঝাঁঝরা হয়ে গেল খুদে লিফটের তিন দেয়াল। ওই গুলিবর্ষণের পর কারও পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
তিন সেকেণ্ড পর গুলিবর্ষণ থামাল তিন সৈনিক।
সরে যাচ্ছে কটুগন্ধী ধোঁয়া।
দেখা গেল এলিভেটারে কেউ নেই।
পড়ে আছে খালি খাঁচা
পরক্ষণে এলিভেটারের মেঝের হ্যাচ খুলে উদ্যত এমপি-৭ হাতে লাফিয়ে উঠে এল মাসুদ রানা- বিন্দুমাত্র দেরি না করেই গুলি পাঠাল তিন সৈনিককে লক্ষ্য করে।
গোটা দশেক গুলি বুকে নিয়ে ছিটকে পড়ল তিন সৈনিক [
পরের পাঁচ সেকেণ্ডে সামনের লাশটা ডিঙিয়ে রাশান বিজ্ঞানীর সামনে পৌঁছে গেল রানা।
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সেমেন ইগোরভ ও রাফিয়ান আর্মির দুই টেকনিশিয়ান।
‘প্রাইমিং ইউনিট থেকে সরো,’ ধমক দিল রানা।
লোকগুলো হুড়মুড় করে সরে যেতেই ইনকিউবেটার চেম্বারের সামনে থামল রানা। হোলস্টারে রেখে দিল ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল কন্সোলের নির্দিষ্ট বাটন টিপে দিতেই হিস্ আওয়াজ তুলে খুলে গেল ইনকিউবেটার। ভিতরে দুই সারিতে মুরগির ডিমের মত বসে আছে পুরো গোলাকার, চকচকে ছয়টি স্পেয়ার। রং গাঢ় লাল, যেন তাজা রক্ত।
নিখুঁত।
ইনকিউবেটারের পাশেই ছোট তিনটে স্যামসোনাইট কেস।
ওগুলোতে করে স্ফেয়ার এনেছিল টেকনিশিয়ানরা।
কন্সোলের উপর কেস রেখে খুলল রানা, অন্যহাতে আঁকশি ব্যবহার করে তুলে নিল দুটো স্ফেয়ার, রেখে দিল একটা কেসের মখমলের খোপে। পরের পাঁচ সেকেণ্ডে চারটি স্ফেয়ার গেল অন্য দুই কেসের পেটে। কেসের ঢাকনি বন্ধ করে ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে নিল ওয়েপন্স বেল্টে। কঠোর চোখে চাইল ভীত টেকনিশিয়ান ও ইগোরভের দিকে। বেল্ট থেকে নিল ছোট একটি রিমোট কন্ট্রোল।
‘বসে পড়ো, নইলে আছাড় খাবে,’ রিমোটের বাটন টিপে দিল রানা।
.
ক্যাচ-কোঁচ শব্দ তুলে ক্রেন-ব্রিজ মাটি স্পর্শ করতেই হুড়মুড় করে উঠে এল রাফিয়ান আর্মির কমপক্ষে পঞ্চাশজন সৈনিক। ছুটে চলেছে টাওয়ারের উপরের সসার লক্ষ্য করে।
প্রকাণ্ড টাওয়ার ঘুরে এদিকে এসেছে একটি অসপ্রে, তেড়ে গেল ঝুলন্ত ট্যাঙ্কার ট্রাকের দিকে। হোঁচট খেতে খেতে গিয়ে উপরের হেলিপ্যাডে নামল অন্য এয়ারক্রাফট, ইঞ্জিন থেকে ভলকে ভলকে বেরোচ্ছে ঘন কালো ধোঁয়া।
ট্যাঙ্কার ট্রাক ত্যাগ করবার প্ল্যান করছে নিশাত ও বুনো। বাইরের দিকের কিনারায় পৌঁছতে একটা কেবলে অ্যাসেণ্ডার আটকে নিয়েছে বুনো, এমন সময় শিলাবৃষ্টির মত গুলি এল ভাসমান অসপ্রে থেকে।
‘আপনার কি মনে হয় মেজর রানা ওখানে উঠতে পেরেছে?’ গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে নিশাতের কাছে জানতে চাইল বুনো।
চট্ করে অপেক্ষাকৃত ছোট সসারের দিকে চাইল নিশাত। ‘কয়েক সেকেণ্ড পরে জানব! রওনা হোন!’
একহাতে অ্যাসেণ্ডার ধরে কেবল বেয়ে উপরে রওনা হয়ে গেল বুনো। অসপ্রে লক্ষ্য করে জি৩৬ দিয়ে গুলি করল নিশাত।
অসমসাহসী নিশাত গুলি করছে, কিন্তু গানশিপের গায়ে লেগে ফুলকি তুলে ছিটকে যাচ্ছে ওর বুলেট। এক মুহূর্ত পর ওর মুখের সামনে এসে ভাসতে লাগল দানবীয় এয়ারক্রাফট। ঘুরতে শুরু করেছে কামান। এবার উড়িয়ে দেবে ট্রাক।
‘মরেছি!’ বিড়বিড় করল নিশাত।
প্রকাণ্ড গহ্বরের কিনারায় পৌঁছে গেছে বুনো, ওখানে তার সঙ্গে দেখা হলো পবন ও ফারিয়ার। এইমাত্র গ্যারাজ থেকে সিমেন্ট মিক্সার ট্রাক নিয়ে হাজির হয়েছে ওরা। কয়েক মুহূর্ত পর উপস্থিত হলো শ্যারন ফ্যেনুয়্যা। নিয়ে এসেছে চোরাই এক জিপ, স্কিড করে থামল গভীর কূপের পাশে।
ওরা নীচে দেখল অসপ্রে মুখোমুখি হয়েছে নিশাত সুলতানার। ‘সবাই চোখ বুজে ফেলো, পরের দৃশ্যটা হবে খারাপ, গম্ভীর স্বরে বলল ক্যাপ্টেন ডিফেখন।
আঠারো
বিকট আওয়াজ তুলছে ভাসমান ভি-২২ অসপ্রে, এবার কামান দিয়ে উড়িয়ে দেবে নিশাতসহ ঝুলন্ত ট্রাক। এমন সময় থরথর করে চারপাশ কেঁপে উঠল ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আওয়াজে।
প্রথমে বোঝা গেল না কোথায় ঘটল ওই বিস্ফোরণ। সামান্য উপরের সসার থেকে আসেনি আওয়াজটা। অসপ্রে বা নিশাতের আশপাশ থেকেও নয়। ভেঙে পড়েনি দুই ক্রেন-ব্রিজ। গহ্বরের কিনারায় বোমা পড়েনি বা ফাটানো হয়নি।
দু’সেকেণ্ড পর বোঝা গেল কোথায় ছিল বোমা।
এলিভেটারের পাশে খাটো সসারের নীচের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ।
ওখানেই জিনিসটা রেখেছিল রানা।
আগুনের কমলা বিশাল এক বল উঠে গেল আকাশে।
চারপাশে ছিটকে উঠল গুঁড়ো হয়ে যাওয়া কংক্রিটের মেঘ।
বোমা ছিল সসারের উত্তর ভিত্তির গায়ে। অর্ধেক ভিত্তি উড়িয়ে দিয়েছে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ।
আরও দুই সেকেণ্ড পেরিয়ে গেল, তারপর পড়ন্ত বিশাল এক গাছের মত কাত হতে শুরু করল খাটো সসার।
দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য!
কাঁচ-ঢাকা ল্যাবোরেটরি নিয়ে অতি ধীর গতিতে নীচে রওনা হলো সসার উত্তরদিকে।
মাটি কাঁপিয়ে দেয়া গা রি রি করা আওয়াজ শুরু হলো। কাত হতে শুরু করা কংক্রিটের দালানের উপরাংশ আছড়ে পড়ল মেইন সসারের নীচের অংশে। ল্যাবোরেটরি নিয়ে আরও কাত হলো বৃত্তাকার দালান, নীচে পড়তে গিয়েও হঠাৎ হোঁচট খেয়ে শেষ মুহূর্তে থামল।
সামান্য দূরেই নিশাত, দাঁড়িয়ে আছে কেবলে ঝুলন্ত ট্রাকের পিঠে। পরিষ্কার দেখেছে ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে দালানের প্রতিটি জানালা। নানাদিকে ছিটকে গেছে কাঁচের টুকরো।
কংক্রিটের ধুলোয় আঁধার হয়ে গেল মস্ত গহ্বর।
অবশ্য কিছুক্ষণ পর টানা হাওয়ায় ভেসে গেল ধুলো। দেখা গেল একপাশে কাত হয়ে গেছে পিরিচের মত দালান। ওটাকে খাড়া রাখবার কলামগুলো ভেঙে পড়েছে, দাঁত খিঁচিয়ে আছে এবড়োখেবড়ো ভাঙা কংক্রিট ও মুচড়ে যাওয়া পুরু সব রড।
কখনও আর মেরামত হবে না ওই ল্যাবোরেটরি।
.
সামান্য উপরের কমাণ্ড সেন্টার থেকে নীচের ভাঙা সসার দেখছে রাফিয়ান আর্মির জেনারেল। বুঝে গেছে দালানের ওই পতনের পর বাঁচবে না কেউ। ভাবল: হয়তো প্রস্তুতি ছিল মাসুদ রানার
পরক্ষণে দেখল সে যমের অরুচি লোকটাকে।
ওই যে!
কাত হওয়া ভাঙা দালান থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসছে সে! কোমরে কালো কয়েকটা কেস। ঝেড়ে দৌড় দিল ট্রাক ঝুলিয়ে রাখা কেবল লক্ষ্য করে।
.
অবশ্য, নিরাপদে থাকা কঠিন হয়েছে রানার জন্য।
তিন স্যামসোনাইট কেসে ছয় স্ফেয়ার রেখেই দৌড়ে গেছে ল্যাবোরেটরির দক্ষিণ প্রান্তে। ওখানেই এলিভেটার। তার আগে বাঙ্ক হাউস থেকে জোগাড় করেছে দুটো কটের ম্যাট্রেস, ওগুলো নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে এলিভেটারের দরজার উপর। ঢুকে পড়েছে দুই ম্যাট্রেসের মাঝে। শক্ত হাতে ধরেছে সামনের ম্যাট্রেস। অপেক্ষা করেছে, তারপরই বিস্ফোরিত হয়েছে সসারের ভিত্তির গোড়ায় রাখা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ।
বোমা ফাটতেই উত্তরদিকে নেমে গেল পিরিচ। পিছলে গিয়ে রওনা হলো রানা। সামান্য নীচের এই পিরিচের দক্ষিণদিক মেইন সসারে আঘাত হানতেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল প্রতিটি জানালার কাঁচ। দুই ম্যাট্রেসের মাঝে স্যাণ্ডউইচের পুরের মত রানা সরসর করে নামল উত্তরদিকে। ‘বাধা পেল জানালার নীচের কংক্রিটের দেয়ালে। পিঠের ম্যাট্রেসের উপর ঝরঝর করে পড়ল অসংখ্য ভাঙা কাঁচ। সামান্য মুচড়ে গেল ডানকব্জি, এ ছাড়া আর কিছু হয়নি।
রানার মত কপাল নিয়ে আসেনি দুই টেকনিশিয়ান। পিরিচের উপরতলার মেঝের এক অংশ ভেঙে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে তারা। ভাগ্য আরও খারাপ বিশ্বাসঘাতক রাশান বিজ্ঞানী সেমেন ইগোরভের। পিছলে গিয়ে ল্যাবের উত্তরদিকের এক জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেছে সে। নীচে পড়বার সময় বিকট আর্তনাদ ছাড়ল। ওই আওয়াজ পরিষ্কার শুনল রানা। ভাল করেই জানে, দু’ শ’ ফুট নীচে ওই লোকের জন্য অপেক্ষা করছে সিমেন্টের কঠিন জমিন।
পিরিচের পতন থেমে যেতেই উঠে রওনা হয়ে গেল রানা। চারপাশে ঘন ধুলোর ধূসর মেঘ। জানালার কাঁচ নেই বলে ওকে কাঁপিয়ে দিল হিমশীতল হাওয়া।
.
ওদিকে নীচের সসারের পতনে প্রাণে বাঁচল নিশাত সুলতানা।
পিরিচের এক অংশ গুঁতো দিল ভাসমান অসপ্রের একপাশে, ভয় পেয়ে এয়ারক্রাফট নিয়ে পিছিয়ে গেল পাইলট— মাথাছেলা। অসপ্রে ও নিশাতকে ঢেকে দিল ঘন ধুলোর মেঘ। আড়াল হয়ে গেল দুই প্রতিপক্ষ।
চারপাশে অসপ্রের রোটরের বিকট ধুপ-ধুপ আওয়াজ। নিশাত জানে, যে-কোনও সময়ে আবারও ধূসর মেঘ সরবে, আর তখনই হাজির হবে যান্ত্রিক পাখি।
এক সেকেণ্ড পর পাশে ধাপ্ আওয়াজ পেল নিশাত। ঘুরেই দেখল ট্রাকের পিঠে মাসুদ রানা। গান বেল্টে দুটো স্যামসোনাইট কেস। অন্যটা ঝুলছে হাতে। কেবলে আটকে নেয়া অ্যাসেণ্ডার ব্যবহার করে এইমাত্র নেমে এসেছে।
‘বাপের জন্মে এমন ডাকাতি দেখিনি, স্যর!’ চেঁচিয়ে জানাল নিশাত।
‘ডাকাতি নয়, আপা, আমরা যেটা করেছি সেটা চোরের ওপর বাটপারি,’ ট্রাকের পিছনদিক লক্ষ্য করে রওনা হয়ে গেল রানা। ওখানে আছে দুই কেবল, উঠে গেছে গহ্বরের কিনারায়।
‘সবই কি ধ্বংস করতে হবে, স্যর?’ রানার পাশে পৌঁছে গেল নিশাত, হাসছে।
‘সব ধ্বংস করতে পারলাম কই, আপা! রেডি হন!’
ট্রাকের পিছনদিকের ম্যাগনেটিউয়েক্সের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল রানা।
‘কিন্তু সঙ্গে করে অ্যাসোর আনেননি আপনি, স্যর!’
‘এবার ওটা লাগবে না! শক্ত করে ধরুন আমার কোমর!’
তর্ক না করেই দুই হাতে পিছন থেকে রানার কোমর জড়িয়ে ধরল নিশাত। তখনই দমকা হাওয়ায় সরে গেল ধুলোর মেঘ। ওদের পিছনে দেখা দিল অসপ্রে। ভাঁসছে সামান্য দূরে, তাক করে ফেলেছে কামান ও অন্যান্য অস্ত্র।
‘স্যর!’
‘রেডি!’ একহাতে ফ্রেঞ্চ ম্যাগনেটিউয়েক্সের কেবল শক্ত হাতে ধরল রানা। দু’বার রাং ল্যাডারের তলা দিয়ে যন্ত্রটা ঘুরিয়ে আটকে রেখে গেছে বুনো। বামহাতে আনস্থুল বাটন টিপে দিল রানা।
ঠনাৎ-ঠং শব্দে ট্রাকের মইয়ের তলা দিয়ে দু’বার ঘুরল ম্যাগেনেটিউয়েক্স, পরক্ষণে ছিটকে বেরিয়ে এল।
ট্রাক থেকে খুলে গেছে কূপের বাইরের দিকের দুই কেবলসহ ম্যাগনেটিউয়েক্স। ভারী ভেহিকেলের সামনের দুই কেবল এখনও টাওয়ারে যুক্ত। রানা ও নিশাতের পায়ের নীচ থেকে রওনা হয়ে গেল ট্রাক। তার আগেই বিদ্যুদ্বেগে খপ্ করে ম্যাগনেটিউয়েক্সের দুই হ্যাণ্ডেল ধরেছে রানা। সাঁই করে গহ্বরের কিনারা লক্ষ্য করে রওনা হয়ে গেছে। রিল করে উঠে যাচ্ছে উপরে। পিছনে দেখতে পেল না দক্ষিণে ছুটছে ট্রাক, যাওয়ার পথে দড়াম করে ধাক্কা দিয়ে গেল ভাসমান অসপ্রের ডানদিকের ডানায়।
মাঝ আকাশে ভয়ঙ্কর হোঁচট খেল অসপ্রে, যেন হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর ঘুষি খেয়েছে হালকা ওজনের কেউ। ছুটন্ত ট্রাক ভেঙে দিল এয়ারক্রাফটের স্টারবোর্ড উইং। আকাশ থেকে ছিটকে পড়তে এক সেকেণ্ডও লাগল না নিয়ন্ত্রণহীন অসপ্রের। কূপের মেঝেতে নামল এয়ারক্রাফট।
দেখবার মত হলো বিস্ফোরণ।
নানাদিকে ছিটকে গেল কমলা বিপুল আগুন।
এদিকে জোর গতি নিয়ে গহ্বরের বাইরের কংক্রিট দেয়ালে নামল রানা ও নিশাত।
দু’পা বাড়িয়ে রেখেছিল রানা, প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে আবারও পিছিয়ে গেল। ফস্কে যেতে চাইল ম্যাগনেটিউয়েক্সের দুই হাতল। অবশ্য প্রাণপণে ধরে রইল।
রানার পিঠের কাছে ঝুলছে হতবাক নিশাত।
একটু পর আবারও দেয়ালে ঠেকল রানার পা। রিল করছে ও ম্যাগনেটিউয়েক্স। উঠতে শুরু করেছে উপরে।
কিনারায় সিমেন্ট মিক্সার ট্রাক ও জিপে অপেক্ষা করছে পবন, ফারিয়া, শ্যারন ও বুনো— অবাক হয়ে দেখছে সব।
কয়েক সেকেণ্ড পর নিশাতকে নিয়ে কিনারায় উঠল রানা
‘অপূর্ব!’ জোর গলায় প্রশংসা করল প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডিফেখন, ‘মিশন হলে এমনই হওয়া উচিত! আজ সত্যি হার মানলাম! ব্রাভো, মেজর মাসুদ রানা! আজ থেকে আপনি আমার ওস্তাদ!’
‘লোকটা মানুষ, না খোদ শয়তান!’ বিড়বিড় করল শ্যারন। চোখ বোলাল চারপাশের ধ্বংসস্তূপে।
কথাগুলো শুনেছে রানা, কোনও মন্তব্য না করেই বুনোর জিপের পিছনে উঠে পড়ল। ম্যাগনেটিউয়েক্স বাড়িয়ে দিল শ্যারনের দিকে। ‘সোজা উপকূলের দিকে ড্রাইভ করো! সাগরে
ফেলে দেব ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।’
‘কেবল কার টার্মিনালে গিয়ে উপসাগরে ফেললেই তো হয়?’ বলল পবন।
‘পানি ওখানে অগভীর। ডাইভ দিলেই পাবে। ফেলতে হবে গভীর পানি…’ থেমে গেল রানা।
শুরু হয়েছে গোলাগুলি।
ক্রেন-ব্রিজ পেরিয়ে আসছে চার ট্রাক ভরা রাফিয়ান আর্মির সৈন্য।
‘আপা!’ গলা উঁচু করল রানা, ‘সিমেন্ট মিক্সার ড্রাইভ করুন! সামনে থেকে কাভার দেবেন! সোজা এয়ারস্ট্রিপে! ডক্টর তারাসভ হয়তো জানেন ওখানে কোনও বিমান আছে কি না!’
কয়েক সেকেণ্ডে ঝড়ের গতি তুলে রানওয়ের দিকে রওনা হয়ে গেল ওরা।
পোলার আইল্যাণ্ডের প্রধান কমপ্লেক্সের পশ্চিমে নিচু জমিতে এয়ারস্ট্রিপ। ওখানে যেতে চাইলে ব্যবহার করতে হবে প্রায় খাড়া নেমে যাওয়া বিটুমেন রাস্তা। গহ্বর ও টাওয়ারের উত্তরদিক থেকে ওটা গেছে পশ্চিমে
চার আর্মি ট্রাক লেজে নিয়ে ছুটছে রানাদের দুই ভেহিকেল। তুমুল গতি তুলে নামছে খাড়া ঢালু পথে, পাশ কাটিয়ে পিছনে পড়ছে ছোট সব টাওয়ার, ওখান থেকে আসছে রাফিয়ান আর্মির গুলি।
রানাদের চারপাশের পথ খুবলে তুলছে বুলেট। মিক্সার ট্রাকের চাকায় লাগল দুটো। চাকা ফুটো হতেই তীক্ষ্ণ আওয়াজ উঠল- হুইশ্! সঙ্গে সঙ্গে ক্লিফের সরু রাস্তায় পিছলে গেল ট্রাক।
সামনের পথে রাফিয়ান আর্মির দুই জিপ নিয়ে ব্যস্ত কয়েকজন। আড়াআড়ি ভাবে রাখছে গাড়ি। আটকে দেবে পথ। কিন্তু কিছুই পাত্তা না দিয়ে দুই জিপের মাঝে গুঁতো দিল নিশাত সুলতানা। বেদম ধাক্কা খেয়ে দু’দিকে ছিটকে গেল দুই জিপ, উড়ে গেছে রোডব্লক। উঁচু ক্লিফের কিনারা থেকে নীচের সাগরে গিয়ে পড়ল একটা জিপ। অন্যটা চ্যাপ্টা হয়ে গেল ক্লিফের আরেক পাশের পাথুরে দেয়ালে লেগে।
ধাওয়াকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও সৈনিক এবং অফিসার। প্রথমে পাঁচটি, এরপর ছয়টি এবং শেষে দেখা গেল আসছে আসলে সাতটি ট্রাক। প্রতিটিতে সশস্ত্র সৈনিক ঠাসা।
তেড়ে আসছে সব ভেহিকেল।
ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এল রানাদের দিকে।
পাল্টা জবাব দিচ্ছে রানা ও বুনো, এদিকে ড্রাইভ করছে শ্যারন। চিইই আওয়াজ তুলে আশপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট। একটা লাগল জিপের পিছনের জেরি ক্যানে। ওটা ভরা অকটেনে। দপ্ করে ক্যানে জ্বলে উঠল আগুন।
গনগনে তাপ থেকে সরে গেল রানা, রেডিয়ো করল: ‘ডক্টর তারাসভ! ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার আমাদের কাছে, কিন্তু পিছনে শত্রু! গুলির ঝড়ে আছি! মনে করি না উপকূল পর্যন্ত যেতে পারব! আপনি কি বিমান পেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, মেজর!’ ওদিক থেকে জানালেন তারাসভ। ‘আমি প্রথম হ্যাঙারে, অ্যান্টোনভ-১২ বিমানের ককপিটে!’
‘রানওয়েতে বেরিয়ে আসুন!’
‘আর স্ট্রেলা-১? ওই জিনিস আমার বিমান ফেলে দিয়েছিল!’
‘আমাদেরকে উড়তে হবে না! শুধু রানওয়ের শেষে পৌছুলেই হবে! সাগরে স্ফেয়ার ফেলব! আর কপাল ভাল থাকলে আমাদের সবাইকে জড় করে বিমান নিয়ে ভেগেও যেতে পারি!’
‘মনের কথা বলেছেন, মেজর!’
তিরিশ সেকেণ্ড পর ক্লিফের রাস্তার উঁচু ঢাল থেকে তুমুল গতি তুলে রানওয়েতে নেমে এল সিমেন্ট মিক্সার ও আগুন ধরা জিপ। →ওই একই সময়ে গুড়-গুড় আওয়াজ তুলে প্রথম হ্যাঙার থেকে বেরিয়ে এল প্রপেলার চালিত বিশাল কার্গো বিমান। পাখা দিয়ে সাঁই-সাঁই কাটছে বাতাস।
বিমানটা অ্যান্টোনভ এএন-১২ ট্র্যান্সপোর্ট বিমান, পিছনের হোল্ডে রাখতে পারে বিশ হাজার কেজি। ভেহিকেল বা নব্বইজন সম্পূর্ণ সশস্ত্র সৈনিক আঁটে পেটে। ভরসা করবার মতই বিমান। যদিও উনিশ শ’ পঞ্চাশ সালের। কাজ করে আমেরিকান সি-১৩০ হারকিউলিসের মতই। অ্যান্টোনভ চেনা সহজ কাঁচের নাকের কারণে। ওখান থেকে চারপাশে চোখ রাখতে পারে যে-কোনও স্পটার।
বিশাল বিমান তার কাঁচের নাক তাক করেছে পশ্চিমে সামনে একমাইল দীর্ঘ, কালো রানওয়ে। দু’পাশে সামনে একের পর এক উঁচু ক্লিফ, রানওয়ের শেষে নীচে সাগর। বামপাশ দিয়ে গেছে চওড়া নদী। ওটার উৎস দ্বীপের উঁচু পাহাড়ের গলন্ত তুষার। সাগরের কয়েক শ’ গজ আগে হঠাৎ করেই কয়েক ধাপে ছোট কিছু জলপ্রপাত তৈরি করেছে নদী। তারপর ঝপাৎ করে নেমে গেছে পঞ্চাশ ফুট নীচের সাগরে।
প্রচণ্ড গতি তুলে রানওয়ের শেষমাথা লক্ষ্য করে ছুটছে দুই স্ট্রেলা-১ অ্যামফিবিয়াস অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ভেহিকেল। বিমান উড়বার আগেই পযিশন নেবে। ডক্টর তারাসভের বিমান ফেলে দিয়েছিল ওই দুই উভচর গাড়িই। ওগুলোর পিঠে পড় ভরা সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল।
রানওয়েতে পুরো বেরিয়ে এসেছে অ্যান্টোনভ। নামিয়ে দিয়েছে রিয়ার র্যাম্প। কয়েক সেকেণ্ড পর বিমানের পেটে উঠে এল রানাদের দুই ভেহিকেল— সামনে নিশাতের সিমেন্ট মিক্সার, পিছনে শ্যারনের আগুন ধরা জিপ।
‘উঠে পড়েছি!’ রেডিয়ো করল রানা। দড়াম করে এক লাথি মেরে জিপের পিছন থেকে ফেলে দিল জ্বলন্ত জেরি ক্যান। ‘রওনা হন, ডক্টর! জলদি!’
নতুন উদ্যমে গর্জে উঠল ইঞ্জিনগুলো। আগের চেয়ে অনেক জোরে ঘুরতে শুরু করেছে চার টার্বোপ্রপেলার। শুরু হলো তীক্ষ্ণ জোরালো হুঁই-হুঁই আওয়াজ। গতি বাড়তে শুরু করেছে বিমানের। লাফিয়ে জিপ থেকে নেমেই সামনে ছুটল রানা, স্টিলের কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে ঢুকে পড়ল ককপিটে।
পাইলটের সিটে বসে বিমান নিয়ন্ত্রণ করছেন ডক্টর তারাসভ।
পাশের সিটে বসল রানা। ককপিটের জানালা দিয়ে দেখল, রানওয়ের শেষে দুই স্ট্রেলা।
‘এবার শুধু ভেসে উঠতে হবে, তা হলেই ব্যস, সাগরে ফেলে দিতে পারব লাল স্কেয়ার,’ ভাবল রানা। ‘ওদের সাধ্য নেই খুঁজে বের করবে।’
রানওয়ের পুরো দৈর্ঘ্যের মাঝামাঝি পৌঁছে প্রায় টেক-অফ স্পিড পেয়ে গেছে অ্যান্টোনভ।
এদিকে মিসাইল পড় নীচে নামাতে শুরু করেছে দুই স্ট্রেলা।
‘আমরা ঠিকই উঠে পড়ব আকাশে,’ বললেন তারাসভ।
কিন্তু তখনই দেখা গেল একাকী সৈনিককে। সে আছে রানওয়ের ডানদিকে। কাঁধে প্রেডেটার আরপিজি লঞ্চার। ট্রিগার টিপে দিতেই ছিটকে এল রকেট গ্রেনেড।
হতবাক হয়ে চেয়ে রইল রানা।
ছুটন্ত বিমানের দিকেই আসছে রকেট!
এক সেকেণ্ড পর হারিয়ে গেল ওটা বিমানের নাকের নীচে।
ভীষণ ঝাঁকি খেল বিমান।
পরক্ষণে নিচু হয়ে গেল গোটা ককপিট।
সিট থেকে সামনে ছিটকে গেল রানা ও ডক্টর তারাসভ। বিটুমেনের উপর শুরু হয়েছে ধাতুর ভয়ঙ্কর কর্কশ আওয়াজ। বিশাল বিমানের নাক দড়াম করে নামল রানওয়ের বুকে। তালা লেগে গেল কানে। বিমানের পেট ও রানওয়ের বুকের সংঘর্ষে নানাদিকে ছিটকে গেল নানারঙা ফুলকি।
প্রেডেটার রকেটের হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে অ্যান্টোনভের পুরো ফরোয়ার্ড হুইল। চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের গতিপথ, বাঁক নিয়েই রওনা হয়ে গেল বামে। অবিশ্বাস্য দ্রুত কমছে স্পিড। মাত্র যেতে পেরেছে রানওয়ের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি পথ।
আরও কিছুদূর যাওয়ার পর কানে তালা লাগানো কর্কশ আওয়াজ তুলে থেমে গেল বিমান।
ককপিটে সোজা হয়ে চারপাশ দেখে নিল রানা।
আটকা পড়েছে ওরা।
পিছন থেকে তেড়ে আসছে রাফিয়ান আর্মির একের পর এক ভেহিকেল।
রানার মনে হলো, ওরা যেন আহত হরিণ, আর ওদেরকে ঘিরে ফেলছে একদল হায়েনা!
সামনে দুই স্ট্রেলা, পিছনে বেশ কয়েকটা ট্রাক।
ভীষণ তিক্ত হয়ে গেল রানার মন।
প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে দখল করেছিল ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার, কিন্তু শেষরক্ষা হলো?
করুণভাবে হেরে গেছে ও।
অস্বাভাবিক স্বল্প সময়ে হাজির হয়েছিল এ এলাকায়।
ঝড়ের মত পেরিয়ে এসেছিল ভালুক দ্বীপ।
কেবল কারের কৌশল কাজে লাগিয়ে উঠেছিল এই দ্বীপে।
মস্ত কূপ পার হয়ে দখল করেছিল আণবিক গোলক।
ধসিয়ে দিয়েছিল উঁচু ল্যাবোরেটরি।
প্রকাণ্ড গহ্বর টপকে যেতে চেয়েছিল দূরে, যেখানে গভীর সাগরে ফেলবে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।
কই, সফল হলো?
উপকূল পর্যন্ত যাওয়াই তো হলো না ওর।
হতাশায় নত হয়ে গেল রানার মাথা। মনের চোখে দেখল মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানকে। ভুরু কুঁচকে ওকেই দেখছেন তিনি। আস্তে করে মাথা নাড়লেন। গম্ভীর সুরে বললেন, ‘মাই বয়, তুমি হেরে গেলে?’
বিড়বিড় করল রানা, ‘আমি দুঃখিত, স্যর।’
উনিশ
হঠাৎ করেই জটিল হয়ে উঠল রানওয়ের পরিস্থিতি। যেন খানিকক্ষণের জন্য থমকে গেছে দাবার দুই প্রতিপক্ষ।
ভেহিকেল দিয়ে অ্যান্টোনভটাকে দূর থেকে ঘিরে ফেলেছে রাফিয়ান আর্মির অফিসার ও সৈনিকরা। রানওয়ের একপাশে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিমান, পুরো বিধ্বস্ত ফরোয়ার্ড ল্যাণ্ডিং গিয়ার। জমিনের দিকে ঝুঁকে গেছে ককপিট
‘দরজাগুলো কাভার করুন!’ গলা চড়িয়ে বলল নিশাত।
অ্যান্টোনভের দু’পাশের দুই দরজার মুখে পৌঁছে গেছে বুনো এবং ও। ঝড়ের গতিতে ওদেরকে পাশ কাটাল রানা, আটকে দিতে হবে খোলা রিয়ার র্যাম্প। বিমানের পিছনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল রানা, টিপে দিল পাশের দেয়ালের ‘ক্লোষ’ সুইচ।
একটুও নড়ল না র্যাম্প।
রানার মাথার পাশে ঠং শব্দে স্টিলের স্ট্রাটে লাগল বুলেট। চমকে সরে গেল ও।
‘র্যাম্প কাজ করছে না!’ সবাইকে জানিয়ে দিল।
ককপিট থেকে বেরিয়ে এসেছেন ডক্টর তারাসভ। ‘আমাদের দেশের বহু কিছুই কাজ করে না। র্যাম্প বা দরজা বিশেষ করে। আর বিমানটা অনেক পুরনো।’
হঠাৎ কানের ভিতর পরিচিত কণ্ঠ শুনল রানা:
‘আহহা, মেজর! প্রায় চলেই গিয়েছিলে! তা এখন কেমন লাগছে তোমার? যেখানে আছ, সেখান থেকে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছ দূর সাগর?’ হাসছে লোকটা।
‘মর্ শালা!’ বিড়বিড় করল রানা। পরক্ষণে বলল, ‘তোমার স্কেয়ার কিন্তু আমার কাছে।
‘ঠিক। কিন্তু চিন্তিত হতে পারছি না। হয়তো ভাবছ ভাল অবস্থানে আছ, কিন্তু তা নয়- এর পর হবে এক তরফা লড়াই। যথেষ্ট গুলিও নেই, আমার লোক ঘিরে ফেলেছে তোমাদেরকে। আমাদের সময়ের অভাব নেই। …আর গুলি? লাখে লাখে! না, মেজর, তুমি শালাই মরবে করুণ ভাবে! …জল্লাদ! তিন উন্মাদ পাঠাও। মাসুদ রানা বুঝুক ওরা কী!’
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। লোকটা কী বলতে…
ওদেরকে ঘিরে ফেলা লোকগুলোর মাঝ থেকে হঠাৎ করেই ছিটকে দৌড় লাগাল তিনজন। এরা আফ্রিকান। প্রত্যেকের দু’ হাতে একটা করে একে-৪৭। খ্যাপা গণ্ডারের মত আসছে, গুলি করছে দৌড়ের মাঝে। লক্ষ্য বিধ্বস্ত বিমান। ভালুক ল্যাবে তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে করতে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে লোকগুলো, ঠিক তাদের মত করেই চিল চিৎকার ছাড়ছে এরা।
ঠং-ঠং করে বুলেট লাগছে বিমানের গায়ে। স্ আওয়াজ তুলে রিয়ার র্যাম্প দিয়ে ঢুকল কয়েকটি গুলি। বাধ্য হয়ে জিপের আড়াল নিল রানা। হাতের এমপি-৭ দিয়ে পাল্টা গুলি করল।
ওর পাশে পৌঁছে গেল নিশাত ও শ্যারন।
টানা গুলি করল তিনজন।
হোঁচট খেল প্রথম দৌড়বিদ। বোধহয় কড়া কোনও ড্রাগ ব্যবহার করে। দশটা গুলি গায়ে লাগার পরেও মাটিতে পড়ল না। এবার সরাসরি তার মুখে গুলি করল নিশাত। উপর থেকে পড়া তরমুজের মত বিস্ফোরিত হলো লোকটার গোটা মাথা, নানাদিকে ছিটকে গেল তাজা রক্ত। রানওয়ের কঠিন জমিনে ধুপ্ করে পড়ল লাশ।
তাতে থামল না অন্য দুই চরমপন্থী। দৌড়ের মাঝে বৃষ্টির মত গুলি পাঠাল রানাদের দিকে।
গুলির পর গুলি করছে রানা-নিশাত-শ্যারন। বুঝতে পারছে, এভাবে অসংখ্য বুলেট খরচ করবার উপায় আসলে নেই।
কয়েক সেকেণ্ড পর রানওয়েতে পড়ল দ্বিতীয় লোকটা। তারপর তৃতীয়জন। ছ্যার-ছ্যার করে পিছলে থামল র্যাম্পের গোড়ায়। তার আগেই মারা গেছে।
চারপাশে নেমে এল থমথমে নীরবতা।
বিমানের ভিতর ভাসছে বারুদের ধূসর ধোঁয়া।
চমকে গেছে রানা।
সত্যিই যদি রাফিয়ান আর্মির জেনারেলের এমন আরও উন্মাদ থাকে, তা হলে ওরা শেষ!
‘মেজর, নিশ্চয়ই সবই বুঝছ? শুধু আমার উন্মাদ গ্রুপের লোক ‘পাঠালেই বুলেট শেষ হয়ে যাবে তোমাদের। এমন অনেক লোক আছে আমার হাতে। খুশি মনে প্রাণ দেবে তারা। …জল্লাদ! আরও তিনজন পাঠাও!’
আবারও শোনা গেল রণহুঙ্কার!
রানাদের ঘিরে রাখা দলের মাঝ থেকে ছিটকে এল আরও তিন উন্মাদ। খোলা রানওয়েতে তেড়ে আসছে অ্যান্টোনভ বিমান লক্ষ করে।
বাধ্য হয়েই লোকগুলোকে ফেলে দিল রানারা।
আস্তে করে মাথা নাড়ল নিশাত। ‘ওরা সত্যিই পাগল! আর ওদেরকে শেষ করতে গিয়ে নিজেরাই না পাগল হই! আমি আগে কাউকে এভাবে আত্মহত্যা করতে দেখিনি!’
‘তার চেয়েও বড় কথা, এদেরকে কীভাবে এমন করল ওই লোক?’ ভুরু কুঁচকে ফেলেছে শ্যারন।
‘ড্রাগ, প্রশিক্ষণ, দিনের পর দিন নির্যাতন করে সহ্যক্ষমতা বৃদ্ধি… আসলে জানি না,’ হাল ছেড়ে দেয়া সুরে বলল রানা।
‘আমরাও বেশিক্ষণ নেই,’ বলল নিশাত। ‘প্রায় ফুরিয়ে গেছে গুলি।
‘আমার কাছেও খুব বেশি নেই,’ বলল বুনো।
ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবছে রানা।
ফুরিয়ে এসেছে ওদের গুলি।
এরপর অনায়াসেই ওদেরকে খুন অথবা বন্দি করবে শত্রুরা।
আদর করবার কোনও কারণ নেই।
চরম নির্যাতন করবে মৃত্যুর আগে।
ভয়ঙ্কর মরণ এড়াতে চাইলে এখন একটা উপায়ই আছে।
শেষ গুলিটা ব্যবহার করতে হবে নিজের মাথায়।
‘কী, মেজর?’ কর্কশ হাসল রাফিয়ান আর্মি জেনারেল। ‘কমে গেছে অ্যামিউনিশন? ভাবছ কোনও চুক্তি করবে? ভাবতে পারো। চিন্তা করে দেখো, আমার লোক বিমানে উঠলেই নির্বিচারে খুন করবে তোমাদের সবাইকে। বলতে খারাপই লাগছে, আমার ছেলেরা আবার একটু উগ্র। ওদেরকে চরমপন্থীও বলতে পারো। সত্যিকারের বিশৃঙ্খল দল। আর আমি তাদের সম্রাট ও মালিক।
‘অবশ্য একটা কাজও করা যায়, নিজেরাই নিজেদেরকে খুন করতে পার। তাতে মরে বাঁচবে তোমরা। সে মৃত্যু হবে ঝট্ করে। কিন্তু যদি কোনও ভাবে বেঁচে যাও, আমার দেয়া মৃত্যু হবে অত্যন্ত কষ্টের।’
চট্ করে রানার দিকে চাইল শ্যারন। সবই শুনছে।
চিন্তিত চোখে অপরূপা মেয়েটাকে দেখছে রানা। বুঝতে পারছে, ওর মনের কথা পড়ছে বিশৃঙ্খলার সম্রাট।
এরপর কী করবে বুঝতে চারপাশে নজর বুলিয়ে নিল রানা।
না, কিছুই করবার নেই।
এখন শুধু মৃত্যু-প্রতীক্ষা।
‘মেজর, ককপিটে গিয়ে ভিডিয়ো কমিউনিকেশন স্ক্রিনের সুইচ টেপো।’
সামান্য দ্বিধা নিয়ে ককপিটে চলে এল রানা।
ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে আটকে রাখা হয়েছে ভিডিয়ো স্ক্রিন।
পুরনো বিমানে জিনিসটা নতুন। উপরাংশে ছোট ক্যামেরা।
স্ক্রিনে দেখা গেল রাফিয়ান আর্মির জেনারেলকে, হাসছে।
‘খবর কী, মেজর? ইচ্ছে ছিল মুখোমুখি হব। তা বুঝি আর হলোই না।’
‘কী চাও তুমি?’ সরাসরি জানতে চাইল রানা।
‘একটা জিনিস দেখাতে চাই।….এই যে দেখো।’
কী যেন উঁচু করে ধরল সে।
স্ক্রিনে জিনিসটা দেখে ধক্ করে উঠল রানার কলজেটা।
ওটা একটা ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার।
সপ্তম গোলক!
বুড়ো আঙুল ও তর্জনী শক্ত করে ধরে রেখেছে গোলকটা।
রানার প্রতিক্রিয়া দেখছে।
আরও চওড়া হলো তার হাসি।
‘বুঝলে, মেজর, আসলে তোমাদের স্ফেয়ার অত জরুরি নয়।’
মগজের ভিতর ঝড় বইতে শুরু করেছে রানার।
হঠাৎ করেই সব বুঝল
ডক্টর তারাসভ ওই স্ফেয়ারের কথা আগেই বলেছিলেন।
ওটা ছিল মেইন টাওয়ারের নীচে ইমার্জেন্সি বাঙ্কারে।
তারাসভ আরও বলেছিলেন, ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই সেমেন ইগোরভের।
কিন্তু যেভাবেই হোক, ওই স্ফেয়ার পেয়ে গেছে এই লোক।
যেন স্ক্রিন ভেদ করে কঠোর চোখে চেয়ে আছে রানার দিকে।
‘আমার ধারণা, মেজর, আমরা দু’জন আসলে একই জাতের লোক। যা চাই, তা পেতে সবই করতে পারি। পৃথিবী রক্ষা করতে জান দিতে পারো তুমি। আর আমিও জান দিতে পারি পৃথিবী ধ্বংস করতে। আমরা যা চাই, অন্তর থেকে চাই। সমস্যা হচ্ছে, আমরা একে অপরের উল্টো জিনিস চাইছি। কাজেই মজা লাগছে তোমাকে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার দেখিয়ে। চোখের সামনে দেখবে লেলিহান আগুনে পুড়ছে তোমার সাধের পৃথিবী। উপলব্ধি করবে নিজের ব্যর্থতা ও ক্ষুদ্রতা।’
কথা শেষ করেই ক্যামেরার সামনে থেকে সরে গেল বিশৃঙ্খলার সম্রাট। সে এখন কমাণ্ড সেন্টারে নেই, দাঁড়িয়ে আছে ষোলো চাকার এক মিসাইল লঞ্চারের সামনে।
ভেহিকেলটা ক্লাসিক, নাক বোঁচা সেমি-ট্রেইলার সাইযের ট্র্যান্সপোর্টার ইরেকটর লঞ্চার, পিঠে রাশান এসএস-৩৩ ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল।
দুই টেকনিশিয়ানের হাতে রক্তিম স্ফেয়ারটা দিল বিশৃঙ্খলার সম্রাট। ওয়ারহেডের ভিতরের ইনসারশন ক্যাপসুলে ওটা রাখল লোক দু’জন। এবার মিসাইলে আটকে দেয়া হলো ওয়ারহেড। ধীরে আকাশে মুখ তুলতে লাগল মিসাইল।
অ্যান্টোনভ বিমানের ভিতর অসহায় চোখে স্ক্রিনে চেয়ে রইল রানা। পরক্ষণে মগজে বুদ্ধি খেলল। নিজেদের রেডিয়োতে বলল, ‘সান? পাওলো? তোমরা কি মিসাইল ব্যাটারির কাছে?’
এল ববের জবাব, ‘এইমাত্র সেতুর কাছে পৌঁছেছি। কিন্তু এই সেতু ফোর্ট নক্সের চেয়েও সুরক্ষিত। পাহারা দিচ্ছে শতখানেক লোক। মিসাইল ব্যাটারি পর্যন্ত যেতে পারব না। …হঠাৎ জানতে চাইছেন কেন, মেজর?’
‘কারণ যে-কোনও সময়ে ওরা এখন মিসাইল লঞ্চ করবে, বিষণ্ণ শোনাল রানার কণ্ঠ। ‘ওদের কাছে বাড়তি স্ফেয়ার আছে। এবার আগুন জ্বেলে দেবে গ্যাসের মেঘে।
নিচু হয়ে যেতে চাইল রানার মাথা।
কিছুই করতে পারল না শু?
চোখের সামনে দেখবে নরক হয়ে উঠছে এত সুন্দর, মায়াবী সবুজ গ্রহটা!
‘ও, মেজর, আমার দলের দিকে কিন্তু মোটেও চোখ রাখছ না তুমি! স্ক্রিন জুড়ে হাসল জেনারেল।
হঠাৎ করেই বিমানের বাইরের দেয়ালে লাগল কমপক্ষে বিশটা বুলেট।
হোল্ড থেকে পাল্টা গুলি করল নিশাত ও বুনো।
এইমাত্র লাশ হয়ে গেছে তিন উগ্ৰপন্থী।
ককপিটে রানার পাশে চলে এল শ্যারন, চোখ পড়ল স্ক্রিনে। বলল, ‘এসএস-৩৩, মিডিয়াম-রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল, টার্গেটে আঘাত হানতে পারে আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ মাইল দূরে। সোভিয়েতরা বলত, উনিশ শ’ সাতাশি সালের আইএনএফ ট্রিটির কারণে কমিয়ে এনেছে ওই জিনিস।’
স্ক্রিনে দেখা গেল প্রথম লঞ্চারের পিছনে আরও চারটে ট্র্যান্সপোর্টার ইরেকটর লঞ্চার, পিঠে এসএস-৩৩ মিসাইল।
এসব পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে,’ মন্তব্য করল রানা। ‘কোল্ড ওয়ারের গোরস্তান এই দ্বীপ।’
থেমে গেল মিসাইলের উত্থান।
লঞ্চ করতে তৈরি।
এবার গোটা দুনিয়ায় জ্বেলে দেবে দাউ-দাউ আগুন, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না রানা।
ক্যামেরার দিকে ঘুরে গেল জেনারেল। ‘এবার নিজের ব্যর্থতা বুঝতে শুরু করো, মেজর। ভাল করে দেখো বিশ্বের শেষ হয়ে যাওয়া। অ্যাই, লঞ্চ করো মিসাইল!’
অন করে দেয়া হলো লঞ্চারের একটা সুইচ, সঙ্গে সঙ্গে জীবন ফিরে পেল এসএস-৩৩-এর থ্রাস্টার। মিসাইলের পিছন থেকে বেরোল বিপুল লাল আগুন ও কালো ধোঁয়ার মেঘ। পরক্ষণে বাতাস চিরে রওনা হয়ে গেল মিসাইল।
স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে দক্ষিণ আকাশ দেখল রানা।
অ্যাটমোসফিয়ার ভেদ করতে বর্শার মত রওনা হয়েছে ইউরেনিয়াম স্ফেয়ারসহ মিসাইল, পিছনে দীর্ঘ ঘন ধোঁয়া।
বিদ্যুদ্বেগে উপরে উঠছে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে হয়ে গেল বহু দূরের বিন্দু। ওই মিসাইল একেবারেই পাল্টে দেবে বর্তমানের এই গ্ৰহ।
হতবাক হয়ে ওদিকে চেয়ে রইল রানা। কানে এল বিশৃঙ্খলার সম্রাটের কণ্ঠ: ‘এবার ডেটোনেট করো!’
পরক্ষণে দপ্ করে জ্বলে উঠল দক্ষিণ আকাশে সাদা কী যেন।
ঝলসে যেতে চাইল চোখ।
এরপর যা ঘটল, জীবনে কখনও দেখেনি রানা বা শ্যারন।
এইমাত্র যেখানে ছিল এসএস-৩৩, ওখানে জ্বলে উঠেছে জ্বলজ্বলে সাদা, উত্তপ্ত বাতাস— যেন মস্ত কোনও ঢেউ। অকল্পনীয় গতিতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের শিখা। এবং ভীতিকর এক পলকের জন্য পোলার আইল্যাণ্ডের গোটা আকাশ হয়ে গেল ফ্যাকাসে নীল থেকে জ্বলন্ত হলদে-সাদা।
হাজারো কোটি চিতা যেন জ্বলছে চারপাশে। বরফ-ঢাকা মাটি লক্ষ্য করে নামল লকলকে সাদা-হলদে আগুন!
.
যখন আর্কটিকে পোলার আইল্যাণ্ডের আকাশ ভেদ করেছে রাশান মিসাইল, ওই একই সময়ে ওয়াশিংটন ডি.সি.-র হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে থমকে গেল সবাই।
স্যাটালাইট কন্সোলের স্ক্রিনে চোখ আর্মির টেকনিশিয়ানের।
ক্রাইসিস রেসপন্স টিমের আর্মি জেনারেলের দিকে ফিরল সে। ‘স্যর! এইমাত্র পোলার আইল্যাণ্ড থেকে লঞ্চ করা হয়েছে মিসাইল!’
কন্সোলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট।
পোলার আইল্যাণ্ড এবং ওদিকের আর্কটিক সাগরের স্যাটালাইট ইমেজে চোখ গেল তাঁর।
‘ওরা আগুন জ্বেলে দিচ্ছে গ্যাসের মেঘে,’ বললেন ডিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর কনি হল। ‘আমরা ব্যর্থ হয়ে…
চুপ হয়ে গেলেন তিনি।
মনিটরে দেখা গেল, হঠাৎ ধবধবে উজ্জ্বল সাদা আগুন ও বিদ্যুচ্চমকের মত আলো ঝলসে উঠেছে।
‘পোলার আইল্যাণ্ডের দক্ষিণ সাগরে মিসাইল ডেটোনেট করেছে,’ জানাল টেকনিশিয়ান।
ভীত চোখে ইমেজের দিকে চেয়ে রইলেন প্রেসিডেন্ট, বিড়বিড় করে বললেন, ‘হায় ঈশ্বর! হায় ঈশ্বর! সহায়তা করুন!’