মৃত্যুঘণ্টা – ৬

ছয়

ডুবরোভ্নিক শহর থেকে বত্রিশ মাইল দূরে নির্জন, ছোট এক এয়ারপোর্টের র‍্যাম্পে অলস ইঞ্জিন নিয়ে অপেক্ষা করছে সাইটেশন এক্স বিযনেস জেট বিমান। ওটার ভেতর চুপ করে বসে আছে এলেনা রবার্টসন। দরজা খোলা। একটু আগে লাগানো হয়েছে বিমানের সিঁড়ি। স্ট্যাণ্ডস্টিল-এ যে যার কাজ সারছে কর্তৃপক্ষের লোক।

এনআরআই-এর চিফের অনুমতি নিয়ে এই দেশে এসেছে এলেনা। দেরি না করে সরিয়ে নেবে মাসুদ রানাকে।

এই বিমানের ওপর কারও নজর থাকলে, তার জানা হয়ে গেছে, এটার মালিক মাল্টার রহস্যময় এক কর্পোরেশন। আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ওই সংগঠন। আমেরিকার সঙ্গে কোনোই সম্পর্ক নেই। যদিও কবর খুঁড়লে জানা যাবে, এলেনা রবার্টসন আসলে এনআরআই এজেন্ট। এ কারণেই বিমান থেকে বেরোয়নি সে। র‍্যাম্পের ক্লোভ্ সার্কিট ক্যামেরা ফিড আসছে কেবিনের সামনের ফ্ল্যাট-স্ক্রিনের মনিটরে। ওদিকে চোখ রেখেছে ও।

বিশ মিনিট আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল রানার। কিন্তু কোনও কারণে দেরি হচ্ছে। ক্রমেই চিন্তিত হয়ে উঠছে এলেনা। মুখে কখনও স্বীকার করবে না, কিন্তু মাসুদ রানার জন্যে নিজের জান দিতেও আপত্তি নেই ওর। মানুষটার সঙ্গে যত মিশেছে, ততই বদলে গেছে সে। আগে এত দৃঢ় ছিল না ওর ব্যক্তিত্ব। রানাকে অনুকরণ করেই ছেঁটে ফেলেছে সে নিজের অনেক অভ্যাস। ফলে সংগঠনে উঠে এসেছে সম্মানজনক অবস্থানে। এনআরআই-এর সবাই জানে, যা করা উচিত, ঠিক তা-ই করবে এলেনা, থামবে না কোনও বাধা পড়লেও।

আবারও ভুরু কুঁচকে গেল এলেনার।

দেরি হচ্ছে কেন রানার?

মস্ত কোনও বিপদে পড়ে গেল না তো?

এমনিতেই খচ-খচ করছে ওর মন।

রানাকে জানাতে হবে দুঃসংবাদ।

মনিটরে দামি এক সাদা সেডানকে আসতে দেখল এলেনা।

বিমানের পাশে এসে থামল ওটা।

গাড়ি থেকে রানাকে নামতে দেখে চাপা শ্বাস ছাড়ল এলেনা। পাঁচ সেকেণ্ড পর সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠল তার মনের মানুষ দুর্দান্ত ওই বাঙালি যুবক। সরাসরি এলেনার নীল চোখে স্থির হলো ওর কুচকুচে কালো দুই মণি।

‘দেরি দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জাগুয়ার গাড়িতে করে দিয়ে গেল কে?’

‘বন্ধু।’ এলেনার মুখোমুখি সিটে বসল রানা। ‘রাস্তায় জ্যাম ছিল।’

বিমানের গা থেকে সরিয়ে নেয়া হলো সিঁড়ি।

বাইরের দরজা বন্ধ করে ককপিটে ফিরল কো-পাইলট। আর্মরেস্টের ইন্টারকম বাটন টিপে বলল এলেনা, ‘আমরা তৈরি।’

ওদিক থেকে এল পাইলটের কণ্ঠ: ‘আমরা হ্যামবুর্গের জন্যে ফ্লাইট প্ল্যান করেছি। আমরা কি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেব?’

‘আকাশে ওঠার পর বলছি কোথায় যাব,’ বলে রানার দিকে ফিরল এলেনা। ‘ঠিক আছে?’

‘বেশ।’ মাথা ঝাঁকিয়ে জরুরি কথায় এল রানা, ‘সায়েন্টিস্ট মোবারকের ব্যাপারে কিছু জানলে তোমরা?’

কেবিনের বাইরে গর্জন করছে জেট ইঞ্জিন।

এলেনার চোখে চোখ রেখে রানা বুঝে গেল, যে-কোনও কারণেই হোক, আপাতত অন্য প্রসঙ্গে সরতে চাইছে মেয়েটা।

‘হ্যাঁ, খবর নিয়েছি,’ কয়েক সেকেণ্ড পর বলল এলেনা।

‘ভদ্রলোকের ব্যাপারটা বেশ জটিল।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘জানতাম জটিলই হবে। তোমাদের কারও সাহায্য চাই, তা-ও নয়। তাঁর খোঁজ পেলে পরের কাজ করব।’

বড় করে দম নিল এলেনা। ‘আমাদের জন্যে তোমাকে সময় দিতে হয়েছে, কাজেই তোমার হয়ে বিজ্ঞানীকে খুঁজে বের করা হয়ে উঠেছিল আমাদের কর্তব্য।’

চুপ হয়ে গেল এলেনা।

মস্তবড় বিপদে আছেন মোবারক, টের পেল রানা। পেশাগত দক্ষতার কারণে তাঁকে কাজে লাগাতে চাইবে অনেকেই। আর এ-ও স্বাভাবিক, তাদের বেশিরভাগই হবে মন্দ লোক। প্রথম থেকেই অত্যন্ত বিপজ্জনক বিষয় জেনেটিক টেকনোলজি। হাজার হাজার নিউক্লিয়ার ওয়েপন লাগে না, সাধারণ সব জিনিস দিয়েই তৈরি করা যায় মারাত্মক সব বায়োলজিকাল ওয়েপন। আর সেগুলো ব্যবহার করলে স্রেফ নরক হয়ে উঠবে পৃথিবী।

গোপনে রাখা সম্ভব বায়োলজিকাল ওয়েপন বা জীবিত অস্ত্র। ওসব বদলাতে থাকে, মিউটেট করে, বড় হয় অথবা ছড়িয়ে পড়ে। শত্রু কখন ব্যবহার করবে, আগে থেকে বলতে পারবে না কেউ। কারও জানার উপায় নেই, নিজেদের অস্ত্রেই শেষে ঘায়েল হবে কি না। এমন কী আস্ত সাগর পেরিয়ে যেতেও সময় নেবে না ভয়ঙ্কর প্লেগ। যাওয়ার পথেই হয়তো পাল্টে নেবে নিজেকে। ফলে নিরাপত্তার বোধ বাতাসে মিলিয়ে যেতে বাধ্য। নিজেদের তৈরি ভ্যাকসিন হয়তো কোনও কাজেই এল না। ব্যাপারটা শুকনো ঘাস জমিতে বাড়ি বানিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়ার মত।

যৌক্তিক মনের মানুষ বুঝবে, ব্যবহার করা উচিত নয় এত বিপজ্জনক অস্ত্র। কিন্তু ফ্যানাটিক, আত্মঘাতী জঙ্গি বা ডুম্‌স্‌ডে কাল্টের লোক ভাববে, খুবই দরকার এসব অস্ত্র। একবার হাতে পেলেই দেরি করবে না ব্যবহার করতে। হয়তো সামান্য কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে রোগটা, তারপর কিছু দিনের ভেতর মরতে শুরু করবে শত শত মানুষ।

রানা এখনও জানে না, ঠিক তেমনই কিছু ঘটেছে নিউ ইয়র্কে ইউএন অফিসে। চিঠি দেয়া হয়েছিল ইউ.এস. অ্যাম্বাসেডর ডেবি ম্যাকেঞ্জিকে। সেদিনই অসুস্থ হয়ে গেছেন মহিলা। পশ্চিমা সিকিউরিটি সার্ভিস ধারণা করছে, ওই ভাইরাসের স্রষ্টা ডক্টর আহসান মোবারক।

‘আসলে গত আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর দুটো কারণে খুব জটিল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি,’ মুখ খুলল এলেনা। রানার চোখে তাকাল। ‘প্রথম কথা, তোমার কথামত ডক্টর মোবারকের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করি আমরা। প্যারিসে তাঁকে পাই, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। রানা, খুন হয়ে গেছেন তিনি।’

গম্ভীর হয়ে গেল রানা। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে?’ সিটের পাশে ডক্টর আহসান মোবারকের ফাইল রেখেছে এলেনা। এগিয়ে দিল না। মুখে বলল, ‘আটাশ ঘণ্টা আগে আইফেল টাওয়ারের দ্বিতীয় অবযার্ভেশন ডেকে গুলি করা হয় তাঁকে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, বিষয়টা টেরোরিস্ট হামলা। তখন ওখানে ছিল ইরান থেকে পালিয়ে আসা এক আর্কিওলজিস্ট। কিন্তু পরে অন্য তথ্য পাই। তখনই জানতে পারি, ওই ডেকে গোপনে মিটিং করতে চেয়েছিলেন মোবারক আর ওই ইরানিয়ান।

‘কোনও কারণে খুন করা হয়েছে ওই দু’জনকে?’

আস্তে করে মাথা দোলাল এলেনা। ‘চাক্ষুষ সাক্ষী আর ভিডিয়ো থেকে জানা গেছে, তাদের দু’জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। হামলাকারীদের পরনে ছিল প্যারিসের পুলিশের ইউনিফর্ম। কিন্তু পুলিশ থেকে জানিয়ে দিয়েছে, এদের কাউকে কাস্টোডিতে  নেয়নি তারা।’

‘তা হলে?’

‘গতকাল শহরতলীর পরিত্যক্ত এক বাড়ির ভেতর পাওয়া গেছে চারজন পুলিশের লাশ। একদিন আগে গলা টিপে খুন করা হয়েছে। সঙ্গে ইউনিফর্ম ছিল না। এদের দায়িত্ব ছিল আইফেল টাওয়ার এলাকায় চোখ রাখা।’

‘তার মানে, আইফেল টাওয়ার এলাকায় ঢুকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে চেয়েছে ওরা।’

আবারও মাথা দোলাল এলেনা। ‘তা-ই। পুলিশ সদস্যদের ইউনিফর্ম, আইডি এমন কী তাদের গাড়িও ব্যবহার করেছে।’

‘আঁচ করা গেছে কাজটা কাদের?’

মাথা নাড়ল এলেনা। ‘ওই হামলার দায় নেয়নি কেউ।’

‘বিজ্ঞানী মোবারক কীভাবে খুন হন?’ জানতে চাইল রানা। ‘আজ সকালে পাওয়া গেছে লাশ। দুঃখিত। প্রচণ্ড অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে দেহটা।’ এলেনা টের পেল, রেগে গেছে রানা। ‘এখনও সব তথ্য পাইনি। কিন্তু যে বর্ণনা শুনেছি, তা ভয়াবহ। শহরের বাইরে খালি এক জমিতে লাশটা পেয়েছে পুলিশ।’

হাত বাড়িয়ে দিল রানা। চুপ করে আছে।

ওর হাতে ফাইলটা ধরিয়ে দিল এলেনা।

পড়তে গিয়ে রানা জানল, ডক্টর মোবারকের সঙ্গের ইরানিয়ান ছিল গ্রিন রেভ্যুলেশনের সঙ্গে জড়িত। চোৱাই অ্যান্টিকিউটি বিক্রি করত। তাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আইফেল টাওয়ার সাইটে একটা কমপিউটার কেসে ছিল বিপুল অর্থ। ডেক থেকে ফেলে দেয়া হয় শুকনো মাটির কিছু। অনেক ওপর থেকে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেছে জিনিসটা।

ফাইল দেখাল এলেনা। ‘ওখানে পাবে মিস্টার মোবারকের ব্যাকগ্রাউণ্ড ইনফর্মেশন।

আবারও পড়তে লাগল রানা।

ওর মুখের দিকে চেয়ে এলেনা বুঝল, কেন যেন নিজের ওপর রাগ ও বিরক্তি বোধ করছে মানুষটা। ‘আরও একটা খবর দিইনি,’ বলল ও। ‘ওটা আরও খারাপ।’

ফাইল থেকে মুখ তুলল রানা।

‘যেদিন উধাও হলেন মিস্টার মোবারক, সেদিনই ইউএন-এ হুমকি দিয়ে এল চিঠি। ওটার ভেতর ছিল অদ্ভুত এক ভাইরাস। ইউএস অ্যাম্বাসেডর ডেবি ম্যাকেঞ্জি আক্রান্ত হন তাতে।’

‘শুনেছি ইউএন অফিসে অ্যানথ্রাক্সের হামলা হবে,’ বলল রানা। ‘সেটাই বলছ?’

‘সাধারণ মানুষকে শান্ত করতে তা প্রচার করা হয়েছে, বলল এলেনা।

‘আসল খবর আরও খারাপ?’ জানতে চাইল রানা, ‘সেটা কী?’

‘ওই ভাইরাস আগে কখনও হামলা করেনি কোথাও,’ বলল এলেনা। ‘পুরো এক শ’ পার্সেন্ট ইনফেকশিয়াস। ওটার কারণে যে-কোনও সময়ে শুরু হবে প্লেগ।’

‘আর ওটার সোর্স আসলে সায়েন্টিস্ট আহসান মোবারক?’

‘তা-ই ধারণা করা হচ্ছে। কেউ দাবি করেনি যে সে বা তারা পাঠিয়ে দিয়েছে ওই চিঠি। খামে ছিল হাতের ছাপ। ওগুলো মিস্টার মোবারকের।

বড় করে দম ফেলল রানা। আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে মন। মরে গেলেন মোবারক, কিন্তু তার আগে কী করে গেছেন, বোঝা মুশকিল। তাঁর কারণে মস্ত বিপদে পড়তে পারে তাঁর মেয়ে মোনা। নিচু স্বরে বলল, ‘মাফ করা যায় না এমন কিছু করেছিলেন মোবারক। এটা শুনেছি।’

‘তোমার দেশের কৃতী নাগরিক, তাঁর নিষ্ঠুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছ না,’ নরম সুরে বলল এলেনা। ‘তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু কী জানো, যেটা পরে আমাদের কাজে আসবে?’

‘আমার চেয়ে তোমরাই বেশি জানো,’ ফাইল দেখাল রানা।

‘আমরা কিন্তু জানি না আফ্রিকায় কী হয়েছিল। তোলা হয়েছিল কিছু ছবি। এ ছাড়া, কোনও তথ্য আমাদের হাতে নেই। তুমি তাঁর সঙ্গেই ছিলে তখন।’

ফাইল বন্ধ করেও ফেরত দিল না রানা। কী যেন ভাবছে। কিছুক্ষণ পর সব গুছিয়ে নিয়ে বলতে লাগল: ‘আমার সঙ্গে ডক্টর আহসান মোবারক এবং তাঁর মেয়ের পরিচয় হয়েছিল আফ্রিকার রিপাবলিক অভ দ্য কঙ্গোয়। বিসিআই থেকে ওখানে পাঠানো হয় আমাকে। ওই দেশের সরকার থেকে দু’বিজ্ঞানীকে বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন বছরে দু’বার ফসল হবে এমন বীজ তৈরি করেন।’

এলেনার হাতে ফাইল দিয়ে দিল রানা।

‘কিন্তু কিছু দিনের ভেতর চাপ দিতে শুরু করল আর্মি। অন্য জিনিস চাই তাদের। রাজি হলেন না মোবারক। শুরু হলো হুমকি। সেসময় এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইণ্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন তিনি। বিসিআই থেকে আমাকে পাঠানো হয়, আমার কাজ ছিল মিস্টার মোবারক ও মোনাকে সরিয়ে আনা।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। ট্যাক্সিং শুরু করেছে সাইটেশন এক্স বিযনেস জেট বিমান।

‘আর্মির জেনারেলদের সাধ্যমত সবই দেবেন বলার পর কিছু দিনের জন্যে শান্ত হলো তারা। তখন প্রথম সুযোগে ওই দেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি দুই বিজ্ঞানীকে।’

‘শুনেছি কোনও কাজ শুরু করলে থামতেন না মিস্টার মোবারক,’ বলল এলেনা।

মাথা দোলাল রানা। ‘কাজে ডুবে যেতে ভালবাসতেন।’

‘কাজ থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে এসব মানুষ খেপে যান। হয়ে ওঠেন প্রতিশোধপরায়ণ। তাঁর ব্যাপারে তেমন কিছু হয়েছিল?’

মাথা নাড়ল রানা।

‘কখনও বলেছেন যে কী বিষয়ে কাজ করছেন? বা কোনও ইঙ্গিত দিয়েছেন?’

সিটে হেলান দিয়ে মনের সাগরে ডুব দিল রানা। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘সবসময় কথা তুলতেন স্রষ্টা ও জেনেটিকস বিষয়ে বারবার বলতেন, সত্যি স্রষ্টা থাকলে এভাবে নরক হয়ে উঠত না পৃথিবী। আসলে নিরীশ্বরবাদ ও ঈশ্বরবাদের মাঝে দ্বিধায়

থাকতেন। কখনও বলতেন, অনেক খারাপ কাজ করেছেন বলে তাঁকে চরম শাস্তি দিচ্ছে স্রষ্টা। মরে গেলেও মাফ পাবেন না।’

‘তোমার কি মনে হয়, সত্যি ভয়ঙ্কর কোনও ভাইরাস তৈরি করার মত মানুষ ছিলেন মিস্টার মোবারক? বা ধরলাম তৈরি করলেন, কিন্তু ব্যবহার করার জন্যে তুলে দিতেন খারাপ লোকের হাতে?’

সময় নিয়ে ভাবছে রানা। দু’মিনিট পর বলল, ‘ইন্টারপোল মনে করে তিনি সাধারণ মানুষের শত্রু। উন্মাদ বিজ্ঞানী। কিন্তু যতটুকু দেখেছি তাঁকে, আমার মনে হয়নি যে উনি ম্যাস মার্ডার করার মত মানুষ। কঙ্গো থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চেয়েছিলাম। রাজি হননি। বলে দিয়েছিলেন, কখনও কাউকে গুলি করতে পারবেন না।’

‘মানুষ তো সময়ে বদলে যায়,’ বলল এলেনা।

‘তুমি জানতে চেয়েছ তাঁর বিষয়ে আমার মনোভাব। তাই জানালাম।’

‘হুঁ।’ মাথা দোলাল এলেনা।

‘জরুরি কোনও কারণে আমার সাহায্য চেয়েছিলেন,’ বলল রানা। ‘তাঁকে দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নিতে চাইছিল কেউ। আমার ধারণা, মিস্টার মোবারককে পেয়ে গেছে সেই লোক। বাধ্য করেছে ভাইরাস তৈরি করতে। ভবিষ্যতে ব্যবহার করবে প্লেগের মত করে। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দেবে রোগ। আর সেই লোকই প্রেরকের নামহীন চিঠির মাধ্যমে হামলা করেছে ইউএন অফিসের ওই মহিলার ওপর। মনে করি না মিস্টার মোবারক এত বোকা ছিলেন যে খামের ওপর নিজের হাতের ছাপ রাখবেন।’

গুড পয়েন্ট, ভাবল এলেনা। আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ইউএন লেটার এসেছে ইণ্টারনাল সোর্স থেকে। অথচ সে-সময় মিস্টার মোবারক ছিলেন ওই অফিস থেকে কমপক্ষে তিন হাজার মাইল দূরে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ওই চিঠি দিল কে?

কপাল খারাপ, ইউএন সিকিউরিটি প্রথম থেকেই মনোযোগ দিয়েছে বাইরের বেড়ার দিকে। খুব কম ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে দালানের ভেতর। এটা করেছে, যাতে নির্ভয়ে নিজেদের ভেতর গোপনে আলাপ করতে পারেন কূটনীতিকরা। কখনও রেকর্ড করা হয় না সেসব।

চুপ করে বসে আছে রানা, সামান্য সামনে ঝুঁকে চোখ রাখল এলেনার নীল চোখে। ‘আমার জানা নেই কী করছিলেন মিস্টার মোবারক। কিন্তু অন্তর থেকে বলতে পারি, মানুষ হিসেবে ভাল ছিলেন তিনি। নইলে অনেক আগেই কঙ্গোর ওই নরপশুগুলোকে প্রয়োজনীয় বায়োলজিকাল ওয়েপন দিতেন। বা এভাবে বলতে পারি, যারা মেরে ফেলল তাঁকে, তাদেরকেও দিতে চাননি বায়োলজিকাল অস্ত্র।’

কথাটা মনের ভেতর নেড়েচেড়ে দেখল এলেনা। খুব জোর দিয়ে বলেছে রানা। এ-ও বুঝল, মৃত বিজ্ঞানীর হত্যাকারীদের ছাড়বে না বলেই মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছে খ্যাতিমান বাঙালি গুপ্তচর।

‘তুমি ওদেরকে ছাড়বে না,’ নিচু স্বরে বলল এলেনা।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘এই বিমান হ্যামবুর্গে নেমে গেলেই খুঁজব দরকারী তথ্য। খুন করা হয়েছে এক বাঙালি বৈজ্ঞানিককে। কাজেই সুস্থ মস্তিষ্কের যে-কোনও বাঙালির উচিত এর বিচার দাবি করা। ‘

‘বুঝতে পারছি কেমন লাগছে তোমার,’ বলল এলেনা, ‘অবাক হইনি। কিন্তু এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেক বড় কিছু।’

‘তুমি চাও আমার সঙ্গে যোগ দিতে?’

‘বিষয়টা এদিকে গড়াবে, আগেই ভেবেছি,’ বলল এলেনা, ‘তাই বসের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছি। তিনি তা দিয়েছেন অন্য কারণেও। আগে ডেবি ম্যাকেঞ্জি ছিলেন সিআইএ ও এনআরআই এজেণ্ট। নানান সাহায্য করেছেন আমাদেরকে। তাঁর কারণেই অন্য এজেন্সি থেকে জরুরি কাজ সরিয়ে দেয়া হয়েছে এনআরআই-এ, তাতে বেড়েছে আমাদের সংগঠনের সম্মান। আপাতত সিডিসির সঙ্গে মিশে ওই ভাইরাসের ব্যাপারে তদন্ত করছি আমরা। উঁচু মহল থেকে বলা হয়েছে, আমরা যেন খুঁজে বের করি ভাইরাস হামলাকারীকে। আর, রানা, ওরাই খুন করেছে মিস্টার মোবারককে। এ-ও মনে করি না যে সঙ্গে গেলে ধীর করে দেব তোমাকে।’

কিছুই বলল না রানা।

‘যা করার একা করতে চাও?’ আপত্তির সুরে জানতে চাইল এলেনা।

‘না, তা নয়,’ বলল রানা।

‘ভাবছ এনআরআই সাহায্য করতে পারবে না?’

‘তা-ও নয়,’ বলল রানা, ‘আসলে কো-ইনসিডেন্স বিশ্বাস করি না। অথচ গত দু’দিনের ভেতর দুটো ঘটনা ঘটেছে।’

মাথা দোলাল এলেনা। নিজেও ‘ মনে করে না, কো- ইনসিডেন্স বলে কিছু আছে। সিআইএ থেকে সরে এসে এনআরআই-এর পাবলিক ডিভিশনে চাকরি করতেন ডেবি ম্যাকেঞ্জি। তাঁর মত অনেকেই ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন পৌঁছে গেছেন উঁচু পর্যায়ে। কেউ পেয়েছেন কর্পোরেট আমেরিকায় ভাল ক্যারিয়ার, গেছেন পলিটিক্সে বা অন্যান্য সরকারি এজেন্সিতে। তাঁদের কিছু হলো না, কিন্তু বেছে নেয়া হলো অ্যাম্বাসেডর ডেবি ম্যাকেঞ্জিকে। নতুন অপারেশন ডিভিশনের সঙ্গে কোনও সম্পর্কও ছিল না তাঁর। আসলে জানতেনও না এনআরআই এখন কী ধরনের কাজ করে।

তাঁকে টার্গেট করা অবশ্যই অদ্ভুত কো-ইনসিডেন্স।

‘আমাকে পাশে রাখতে আপত্তি নেই তো?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘না, নেই,’ বলল রানা, ‘আলাপ করেছি আমার চিফের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, এই মিশনে তুমি এলে আপত্তি থাকা উচিত নয় আমার। সেক্ষেত্রে চারপাশে চোখ রাখতে পারব দু’জন।’

আস্তে করে মাথা দোলাল এলেনা। ‘এদিকে আমার বস্ বলেছেন, তুমি এসবে জড়িয়ে গেলে যেন চেষ্টা করি তোমার সঙ্গে থাকতে। নানান ধরনের সুবিধে পাব।’

চুপ করে থাকল রানা।

ইণ্টারকম বাটন টিপল এলেনা।

ককপিট থেকে বলল পাইলট, ‘আমরা টেকঅফের জন্যে তৈরি।’

‘গুড,’ বলল এলেনা, ‘আন্তর্জাতিক জলসীমায় গেলেই ফ্লাইট প্ল্যান জমা দেবেন কর্তৃপক্ষের কাছে।’

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘প্যারিস?’ রানার দিকে তাকাল এলেনা।

মাথা দোলাল রানা।

‘সোজা প্যারিসে,’ পাইলটকে জানাল মেয়েটা।

সিটে হেলান দিল রানা। ‘আবারও কোনও বিপজ্জনক মিশনে জড়িয়ে গেলাম দু’জন।’

‘শিখে নেব নতুন আরও বহু কিছু,’ খুশি মনে হাসল এলেনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *