মৃত্যুঘণ্টা – ৪৩

তেতাল্লিশ

শেষ বিকেলের লালচে আলোয় পারস্য উপসাগরের বুক চিরে ছুটে চলেছে খয়েরি পাওয়ার বোট। পেছনে বসে আছে রানা, কোলে ল্যাপটপ কমপিউটার। ওটার ভেতর ডাউনলোড করা হয়েছে এনআরআই মেইনফ্রেম কমপিউটার থেকে জরুরি সব তথ্য। দ্রুতগামী নৌযান নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রাহাম। বামের সিটে এলেনা। ওদের পরনে এখন বডি আর্মার, পাশে এআর-১৫এস রাইফেল।

কমপিউটার থেকে চোখ তুলে আবছাভাবে এক মাইল দূরে ক্রুড ক্যারিয়ার শিপ দেখল রানা, ওদের দিকেই আসছে ওটা। পানির ওপরে অনেক উঁচু লাগল, তার মানে পেটের ট্যাঙ্ক খালি।

‘চ্যানেল থেকে দূরে থেকো, জন,’ বলল রানা।

‘ঠিক আছে’ বলল গ্রাহাম।

‘কী বুঝছ, রানা?’ জানতে চাইল এলেনা।

ওর দিকে ল্যাপটপ এগিয়ে দিল রানা। স্ক্রিনে এবড়োখেবড়ো এক পাথুরে দ্বীপ।

‘নাসা স্যাটালাইট ইমেজ?’ জানতে চাইল গ্রাহাম।

মাথা দোলাল রানা। ‘সকালে ওই দ্বীপের ওপর দিয়ে গেছে। ভাল ছবি নয়। যেসব তথ্য চেয়েছি, একটাও দিতে পারেনি।

দ্বীপের দিকে যুম করল এলেনা।

পাথরের ওই টুকরো দৈর্ঘ্যে ও প্রশস্তে বড়জোর আট মাইল। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাইপ ও পাম্পিং ইকুইপমেন্ট দূরে কয়েকটা কন্ট্রোল বিল্ডিং ও হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম। ছবিতে মনে হচ্ছে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে সব। দ্বীপের পশ্চিমে চার শত ফুটি এক ফ্রেইটার, নোঙর করেছে না বালি-পাথরে আটকা পড়েছে, বোঝা গেল না।

‘জুবায়েরের বলা সেই দ্বীপই,’ মন্তব্য করল এলেনা। ‘পরিত্যক্ত,’ বলল রানা।

‘জুবায়েরও তাই বলেছিল,’ বলল এলেনা, ‘কিন্তু এমন হতে পারে, মোনাকে নিয়ে ওখান থেকে সরে গেছে তারা।’

‘ইনফ্রারেড স্ক্যান করতে বলেছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘এবার সুযোগ ছিল না,’ চট্ করে হাতঘড়ি দেখল এলেনা। ‘পরেরবার যাওয়ার সময় স্ক্যান করবে। ধরো দু’ মিনিট পর। তখন কেউ আছে কি না জেনে যাব।’

তিরিশ সেকেণ্ড পর স্যাটালাইট ফোনের বাতি জ্বলে উঠতেই স্পিকার চালু করে জবাব দিল ও: ‘হ্যালো?’

হাওয়ার দমকা আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনল না। মুখ সরিয়ে নেয়ার পর কানে এল কণ্ঠ: ‘এলেনা?’

‘বলুন, চিফ।’

‘তোমরা এখন কোথায়?’

‘উপসাগরে, দক্ষিণে চলেছি। নতুন কোনও ইনফর্মেশন পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ,’ বললেন ব্রায়ান। ‘এনএসএ থেকে বলেছে, ওই আটকা পড়া জাহাজ বা আশপাশের দালানে তাপ ও বৈদ্যুতিক বাতি আছে, কেউ না কেউ আছে ওই দ্বীপে।

তাই তো থাকার কথা, ভাবল রানা। এটা দুঃসংবাদ নয়।

‘তার মানে আমরা ঠিক জায়গায় যাচ্ছি,’ বলল এলেনা।

‘তাই তো মনে হচ্ছে,’ বললেন ব্রায়ান। চুপ হয়ে গেলেন।

রানা আর এলেনা পরস্পরকে দেখল। এবার বোধহয় খারাপ কোনও সংবাদ দেবেন এনআরআই চিফ।

‘অ্যাসল্ট টিমের সঙ্গে কোথায় দেখা হবে আমাদের?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘ইয়ে… এলেনা…’ আবারও চুপ হয়ে গেলেন ব্রায়ান।

‘তারা পরে পৌঁছলেও আমাদের ক্ষতি নেই,’ বলল এলেনা, ‘নাকি একই সঙ্গে হামলা করব আমরা? তা-ই ভাল হতো না? ওদেরকে বলে দিতে পারতাম…

‘এলেনা।’ কাশলেন ব্রায়ান। ‘ওখানে কোনও অ্যাসল্ট টিম যাচ্ছে না।’

অদ্ভুত কথা! এক ঘণ্টা আগে প্রস্তুতি নিচ্ছিল অ্যাসল্ট টিম।

‘কী বলছেন, স্যর?’

‘আমরা ওখানে কোনও দলকে পাঠাব না।’

‘কেন?’ গলা চড়ে গেল এলেনার।

‘ভুলে গেলে? ওই পাথুরে দ্বীপ ইরানের জলসীমায়,’ বললেন ব্রায়ান। ‘অনেক দিন ধরেই ওটা নিয়ে বিরোধ চলছে ইরাক ও ইরানের ভেতর। ওখানে যে ক্ষতি দেখছ, সেটা হয়েছে উনিশ শত ছিয়াশি সালে। তারপর থেকে ওখানে আর পা রাখেনি কেউ।’

‘তাতে কী? আমাদের কাজ কাল্টের ওপর হামলা করা।’

‘ইরান সরকারকে জানাতে পারব না, তাদের নাগালের ভেতর আছে ম্যাস ডেস্ট্রাকশন ওয়েপন। ওটা আছে ওদের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।’

‘তা হলে কী করব?’ অসহায় সুরে জানতে চাইল এলেনা। ‘অ্যাসল্ট টিম না পাঠালে ….

‘আমেরিকান নেভি ওখানে টমাহক মিসাইল ফেলবে,’ অস্বস্তি নিয়ে বললেন ব্রায়ান। ‘এটাই প্রেসিডেন্টের নির্দেশ।’

বড় করে দম নিল এলেনা। ‘কিন্তু যারা জিম্মি? তাদের কী হবে?’

‘সরি,’ বললেন ব্রায়ান, ‘আর সব কিছুর সঙ্গে হারিয়ে যাবে তারাও। আমার কিছু করার নেই, এলেনা। সত্যিই দুঃখিত।’

থমথম করছে রানার মুখ, ওর দিকে তাকাল এলেনা। প্রতিটা কথা শুনেছে রানা। রেগে ওঠেনি, যেন এমনটাই ভেবেছিল।

মন খারাপ হয়ে গেল এলেনার।

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট মানুষের জীবনের মূল্য দিচ্ছেন না। যুক্তি সহজ, মাত্র ক’জনের জন্যে কোটি কোটি মানুষের বিপদ ডেকে আনা ঠিক নয়। ওই দ্বীপ উড়িয়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

‘চিফ, ওই কাল্টের লোক ওখানে না থাকলে?’ জানতে চাইল এলেনা। ‘যদি সাধারণ মানুষ থাকে? আমরা ধরে নেব পৃথিবী রক্ষা করেছি মিসাইল মেরে, কিন্তু কয়েক দিন পর যদি বুঝি বিরাট ভুল করেছি— তখন?

‘পরেরটা পরে দেখবেন প্রেসিডেন্ট।’

‘দ্বীপ উড়িয়ে দেয়ার পর? যখন থাকবে না কোনও প্রমাণ?’ রেগে গেল এলেনা। ‘আমরা চাইলেও পরে ইরানিয়ানদের দ্বীপে পা রাখতে পারব না!

‘ছয় মাস ধরে এখানে আছে ওই ফ্রেইটার,’ বললেন ব্রায়ান। ‘ট্র্যাক করে দেখা গেছে, বাতিল মাল হিসেবে ওটা কেনা হয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। এত দিনে গলিয়ে ফেলার কথা। হয়তো শীঘ্রিই কাজে হাত দেবে। জাহাজটা গেঁথে রয়েছে ওই দ্বীপের পাথুরে তীরে। ওখানেই আস্তানা গেড়েছে ওই কাল্ট। তাই প্রেসিডেন্ট কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি।’

একবার রানাকে দেখে নিয়ে ফোনে বলল এলেনা, ‘অনেক ভাল কাজে আসবে ডক্টর মোবারকের এই ভাইরাস। ট্রিটমেন্ট করা যাবে নানান অসুখের। অথচ থিয়োরেটিকালি সেসব এখনও সম্ভব নয়। আমরা যদি ধ্বংস করে দিই এই জাহাজ, এত গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ হারাব চিরতরে।

‘দুনিয়া জুড়ে বিশৃঙ্খলা হওয়ার চেয়ে ভাল,’ বললেন ব্রায়ান।

‘সত্যি যদি অন্য কোনও বেস থাকে কাল্টের?’ জানতে চাইল এলেনা।

চুপ করে থাকলেন এনআরআই চিফ।

‘কোনও না কোনও কারণ আছে বলেই আজও নিজেদের হাতে অ্যান্থ্রাক্স, স্মলপক্স বা এ ধরনের ভাইরাস রেখে দিয়েছে সিডিসি,’ যুক্তি দিল এলেনা, ‘সেভাবেই ওই জাহাজ থেকে সরিয়ে নেয়া উচিত ৯৫২ ভাইরাস আর জীবন-বৃক্ষের বীজ। পরে গবেষণার সুযোগ পাব আমরা। নইলে ভবিষ্যতে ওই ধরনের ভাইরাসের হামলা হলে মোটেও তৈরি থাকবে না বিজ্ঞানীরা।’

‘জানি, এলেনা,’ ক্লান্ত সুরে বললেন ব্রায়ান। ‘গত এক ঘণ্টা ধরে বোঝাতে চেয়েছি প্রেসিডেন্টকে। কিন্তু একটা কারণে তাঁকে বা তাঁর স্টাফদেরকে ফেরাতে পারিনি— কাল্টের হাতে আছে মিসাইল। শর্ট রেঞ্জ হলেও ওগুলো পড়বে কুয়েত, দক্ষিণ ইরাক বা উপসাগরের রেড যোন-এ। মাত্র একটা মিসাইল ছড়িয়ে দিতে পারে ভাইরাস।’

চুপ করে থাকল এলেনা। রানার গম্ভীর মুখ দেখে মায়া হলো ওর। আসলে কিছুই করার নেই! মিসাইলের হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারবে না ওরা।

‘মিস্টার রানা আর তুমি অনেক করলে,’ বললেন ব্রায়ান, তোমাদেরকে ধন্যবাদ দিতে বলেছেন প্রেসিডেন্ট। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমাদের কিছুই করার নেই। এবার সরে চলে এসো তোমরা নিরাপদ এলাকায়।’

‘আর কিছু বলবেন?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘মিস্টার রানাকে বলো, আমি সত্যিই দুঃখিত।’

‘জানিয়ে দেব,’ মোবাইলের সুইচ অফ করে দিল এলেনা। রানার দিকে তাকাল। ‘আমার কিছু করার নেই, রানা।’

‘আমাকে দ্বীপের কাছে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যেয়ো,’ সহজ সুরে বলল রানা।

‘তুমি যাবেই?’ মন দমে গেল এলেনার।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা।

‘তা হলে আমিও যাব,’ জানিয়ে দিল এলেনা।

‘উচিত হবে না,’ বলল রানা, ‘এবারের লড়াই তোমার নয়।’

‘তোমার লড়াই তো আমারও,’ আপত্তি তুলল এলেনা।

‘অনেক বেশি ঝুঁকি, এলেনা। গ্রাহামের দিকে ফিরল রানা। ‘তীরের কাছে আমাকে নামিয়ে দিয়ে সরে যাবে এলেনাকে নিয়ে।’

‘আমি যাচ্ছি,’ রেগে গেল এলেনা। ‘পাশে থেকে লড়ব।’

‘অর্ধেক পাকস্থলি নেই, বলতে পারো আধ পেটা লোক, তাই বলে বাদ পড়ব কেন, আমিও যাব,’ বলল গ্রাহাম, ‘বন্ধুর পাশে লড়ে মরলে নির্ঘাৎ স্বর্গ!’

মৃদু হাসল রানা। ‘লণ্ডনের অর্ধেক মেয়ের অভিশাপে তোমার কপালে নিশ্চিত নরক! তাও যদি যেতে চাও, আপত্তি তুলব না। বোটে থাকবে, আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে এলে লেজ তুলে ভাগব যত দূরে সম্ভব। ঠিক আছে?’

‘তোমরা যে লড়বে, ওরা ক’জন?’ জানতে চাইল গ্রাহাম।

‘এখনও জানি না,’ বলল রানা।

‘এক শ’জনও হতে পারে,’ মন্তব্য করল এলেনা। ‘এর চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়।

‘আহা রে, বেচারারা,’ বলল গ্রাহাম, ‘রানা একাই তো দেড় শ’জন!’

‘চাপা একটু বেশি হয়ে গেল না?’ গম্ভীর হলো রানা।

‘মাত্র অর্ধেক পাকস্থলি বলেই তো গ্যাসের মত বেরোয় এত কথা,’ নালিশ করল গ্রাহাম। ‘ভাগ্যিস দুর্গন্ধ নেই।’

‘আছে কি নেই, তুমি কি জানো?’ মনে মনে বলল এলেনা।

দূরের পাথুরে দ্বীপ লক্ষ্য করে সাগর চিরে ছুটে চলল বোট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *