মৃত্যুঘণ্টা – ৪১

একচল্লিশ

কঠোর চেহারার লোকটাকে আসতে দেখছে জুবায়ের।

ঝড়ের বেগে ওর সামনে পৌঁছে গেল মাসুদ রানা, ঘাড় ধরে একটানে তুলে নিল চেয়ার থেকে। ছিটকে ফেলে দিল দেয়ালে। ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ল জুবায়ের। পরের সেকেণ্ডে ওর পাশে বসে মুখ থেকে চড়াৎ শব্দে টেপ খুলল রানা। সিংহের গর্জনের মত গুড়গুড় করে উঠল ওর কণ্ঠ: ‘হারামজাদা, বল মেয়েটাকে কোথায় নিয়েছে!’ হ্যাঁচকা টানে জুবায়েরকে বসিয়ে দিল, পরক্ষণে তরুণের পেটে গেঁথে গেল ডানহাঁটু। বামহাতের ঘুষি ফাটিয়ে দিল ওপরের ঠোঁট। ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে রক্ত।

‘রানা! এসব বন্ধ করো!’ দরজা থেকে ধমকে উঠল এলেনা। ‘ঠিক হচ্ছে না এসব!’

মনে হলো না কিছু শুনতে পেয়েছে রানা। ঘাড় ধরে তরুণকে ফেলে দিল মেঝের ওপর। উঠে দাঁড়িয়েই কষে লাথি দিল পেটে। এক পায়ে ভর করে দাঁড়াল বুকের ওপর

‘রানা!’ চেঁচিয়ে উঠল এলেনা। ‘সরে এসো!’

‘তুমি এখান থেকে যাও!’ ধমক দিল রানা। দেয়ালের তাক থেকে প্লায়ার্স নিয়ে বসে পড়ল জুবায়েরের পাশে। এবার বুঝি এক এক করে ছিঁড়ে নেবে হাতের আঙুলগুলো।

ভয়ে পিরিচের আকার ধারণ করেছে জুবায়েরের চোখ।

না, পাশের দেয়ালের প্লাস্টিকের বোর্ডে প্লায়ার্স নামাল রানা। ভাঙা বোর্ড খসে পড়তেই সকেট থেকে এক টানে ছিঁড়ল মোটা দুটো বৈদ্যুতিক তার।

‘রানা! তোমার ফোনে মেসেজ এসেছে! ওটা দেয়া হয়েছে আমার ফোন থেকে! কিন্তু আমি ওটা পাঠাইনি!’

শুনছে না রানা। গর্জে উঠল, ‘তুই খুন করেছিস ওই মেয়ের বাবাকে!’

প্রথমবারের মত ইংরেজিতে জবাব দিল জুবায়ের। চোখে ভীষণ ভয়। ‘আমি খুন করিনি!’

‘মিথ্যা বলছিস!’ গর্জে উঠল রানা। টান দিয়ে আরও বের করে নিল বৈদ্যুতিক তার।

‘মিথ্যা বলিনি!’ ভেঙে গেল জুবায়েরের কণ্ঠ: ‘খুন করিনি, আমি তাকে দেখিইনি!’

উঠে দাঁড়াল রানা, বেল্ট থেকে পিস্তল নিয়ে রাখল পেছনের টেবিলে। চাপা স্বরে বলল, ‘ওকে কোথায় নিচ্ছে তারা?’

চুপ করে থাকল জুবায়ের।

কোথায়!’

জবাব দিচ্ছে না আরব তরুণ। কয়েক ইঞ্চি সামনে বেড়ে তামার তার দুটো ছোঁয়াল রানা তার দেহে। ফুলকি জ্বলে উঠতেই নিভু নিভু হলো ঘরের বাতি, আবারও জ্বলে উঠল। বিকট আর্তনাদ ছাড়ছে জুবায়ের।

নির্যাতনের ভয়ানক দৃশ্যটা দেখে গলার কাছে হৃৎপিণ্ড উঠে এসেছে এলেনার। বুঝে গেছে, এরপর কী করবে রানা। কোনওভাবেই ওকে ঠেকাতে পারবে না।

‘বল, কোথায় নিয়েছে, শুয়োরের বাচ্চা!’

‘এসব বন্ধ করো, রানা!’ চিৎকার করে উঠল এলেনা।

‘বল্, হারামজাদা!’

চুপ করে থাকল জুবায়ের। তখনই নতুন করে শক দিল রানা।

নিভু নিভু হয়ে আবারও জ্বলল ঘরের বাতি। করুণ আর্তনাদ বেরোল জুবায়েরের মুখ থেকে। বিদ্যুতের কারণে পুড়ে যাচ্ছে তার ত্বক। রোম ও চামড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।

‘খবরদার, রানা! এসব বন্ধ করো!’ ধমক দিল এলেনা। ‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে!’ পাল্টা চেঁচাল রানা।

‘রানা! প্লিয!’ অনুরোধের সুরে বলল এলেনা।

পাত্তাও দিল না রানা, নতুন করে শক দিল জুবায়েরকে। থরথর করে কাঁপছে তরুণ।

কয়েক পা সামনে বেড়ে টেবিল থেকে পিস্তল তুলে নিল এলেনা, হ্যামার কক করেই তাক করল রানার দিকে।

ধাতব ক্লিক আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল রানা।

ওর মতই এলেনার দিকে চেয়ে আছে জুবায়ের।

এলেনার দু’চোখ থেকে নামছে অশ্রু। চাপা স্বরে বলল, ‘ওর কাছ থেকে সরে যাও, রানা!’

হতভম্ব হয়ে গেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘পাগল হলে, এলেনা?’

‘রানা, এভাবে কাউকে খুন করতে দেব না আমি,’ বলল এলেনা। ‘এভাবে কিছুই সম্ভব নয়!’

‘তুমি জানো না এই ছোকরা…’

‘কাউকে নির্যাতন করতে দেব না, ব্যস! নিষ্কম্প হাতে রানার বুকে পিস্তল তাক করেছে এলেনা।

কালো হয়ে গেল রানার মুখ। বুঝে গেছে, এই মেয়েও গাদ্দারি করেছে। ‘পারলে ঠেকাও আমাকে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ঘুরেই নতুন করে শক দিল জুবায়েরকে। ব্যথায় ছটফট করছে আরব তরুণ। মাথা ঠুকছে দেয়ালে।

‘রানা!’

‘যা জানিস বল্, হারামজাদা!’ উন্মাদের মত চিৎকার করল রানা।

‘রানা! খবরদার!’

আবারও জুবায়েরকে বৈদ্যুতিক শক দিল রানা। কিন্তু তখনই বদ্ধ ঘরের ভেতর তরুণের আর্তনাদকে চাপা দিল পিস্তলের বিকট আওয়াজ। ঝটকা খেয়ে কয়েক পা সামনে বেড়ে ধাতব চেয়ারে পড়ল রানা। হাত থেকে খসে গেছে দুই তার।

চেয়ার ভেঙে ধাতব আওয়াজ তুলে হুড়মুড় করে মেঝেতে চিত্ত হলো রানা। চোখে গভীর বিস্ময়, চেপে ধরেছে বুক। শার্ট ভিজে গেল লাল রক্তে। ‘পাগল হলে, এলেনা?’ ফিসফিস করে বলল মারাত্মক আহত রানা।

ওদিকে তাকাল না এলেনা, ইশারা করল জুবায়েরকে। ‘উঠে বসো। আমার সঙ্গে না গেলে খুন হয়ে যাবে। যখন-তখন ফিরে আসবে ওর বন্ধু।’

রানার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয়েছে জুবায়ের।

‘জলদি!’

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল জুবায়ের। পায়ের শেকলের জন্যে চট করে হাঁটতে পারবে না। এখনও বৈদ্যুতিক শকের কারণে বুকের ত্বক থেকে উঠছে কটু গন্ধী ধোঁয়া।

ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে রানার চেহারা। কনুইয়ে ভর করে উঠে বসতে গিয়েও আবার পড়ে গেল মেঝেতে। গলা থেকে বেরোল ঘড়ঘড়ে শব্দ। ‘তুমি আমাকে গুলি করলে, এলেনা…’

দরজার দিকে পিছিয়ে গেল এলেনা। হাতের ইশারায় ডাকল জুবায়েরকে। তরুণ ঘর থেকে বেরোতেই দড়াম করে দরজা আটকে লক করে দিল এনআরআই এজেণ্ট। গম্ভীর চেহারায় বলল, ‘এসো।’ ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার দরজার পাশ থেকে কোট নিল, চাপিয়ে দিল জুবায়েরের হ্যাণ্ডকাফ পরা হাতের ওপর। ওরা চলে এল ল্যাণ্ডিঙে। ‘এবার নামতে শুরু করো!’

আপত্তি তুলল না জুবায়ের, ধীর পায়ে নামছে। একবার শুনল, ভেতরের দরজায় আছড়ে পড়ল আহত গুপ্তচর।

‘জলদি! ওর বন্ধু এলে খুন হয়ে যাব!’ তাড়া দিল এলেনা। পা টেনে নামতে লাগল জুবায়ের, পিছনে এলেনা। এখন রানার কথা ভাবার সময় নেই ওর। সামনে জরুরি অনেক কাজ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *