মৃত্যুঘণ্টা – ৪০

চল্লিশ

অত্যাধুনিক জেনেটিক ল্যাবোরেটরির প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে মোনা। ঝকঝকে পরিষ্কার নতুন সব ইকুইপমেন্ট। এরচেয়ে বেশি কিছু কখনোই চাইনি, ভাবল ও।

কিন্তু এসব যন্ত্রপাতি দেখে মনে পড়ে গেল ওর বাবার স্মৃতি।

মোনার পিঠে রাইফেলের নলের খোঁচা দিল কাল্টের এক সদস্য। ‘সামনে এগোও!’

হোঁচট খেয়ে ল্যাবে ঢুকল মোনা।

ঘরের মাঝে চেয়ারে বসে আছে এক লোক, মুখে হাসি। ঘাড়ে উলকি। বোধহয় ওটা দিয়ে ঢেকে নেয়া হয়েছে কোনও ক্ষত। উজ্জ্বল আলোয় চোখ যেন তার কালো বরফের মত শীতল।

‘আমাদেরকে আপাতত বিরক্ত করবে না,’ গার্ডকে বলল সে।

‘কে আপনি?’ জানতে চাইল মোনা।

‘চিনলে না তোমার প্রভু বা কাউণ্টকে?’

ও, এই লোকই কাল্টের নেতা, ভাবল মোনা। ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু আগে সামনা-সামনি সাক্ষাৎ হয়নি।

‘তুমি কারও প্রভু বা কোনও কাউণ্ট নও,’ বলল মোনা। ‘তুমি উন্মাদ এক সাইকোপ্যাথ খুনি। তোমাকে বিশ্বাস করে এমন একদল বোকা লোকের জীবন নষ্ট করছ।’ চেহারা দেখে ওর মনে হলো, লাফ দিয়ে উঠে গলা টিপে ধরবে লোকটা। কিন্তু সামান্য নড়ল না চেয়ারে।

‘সবই গভীরভাবে চিন্তা করে দেখো, তা-ই না?’

জবাব দিল না মোনা।

‘তুমিই আসল বোকা,’ বিরক্তি নিয়ে বলল লোকটা। ‘তুমি বা তোমার মত মানুষই মস্তবড় ভুলের ভেতর আছ। রানা… এলেনা… রাহাত খান… জেমস ব্রায়ান … এরা সবাই। ‘

শেষ মানুষটার নাম কখনও শোনেনি মোনা। কিন্তু রানা আর এলেনার নাম শুনে কেঁপে উঠল ও। এই লোকের জানার কথা নয় যে ওই দু’জন অনেক সাহায্য করেছে ওকে। এসব কী করে জানল এই লোক?

চুপ করে থাকল মোনা।

‘তুমি ভাবছ এসব করছি শুধু নিজের জন্যে?’ বলল কাউণ্ট। ‘তা হলে ভুল ভাবছ।’

কথা বলতেও ভয় লাগছে মোনার। অন্তর বলছে, এসবের ভেতরে আরও গূঢ় কিছু আছে।

প্রসঙ্গ পাল্টাল প্রভু: ‘তোমার বাবা ছিল আমার পায়ের নিচে। ওই একই কাজ করবে তুমি। এরপর একসময় তা-ই করবে পুরো পৃথিবীর সবাই।’

এ ধরনের বিপদ হবে ভেবেই সরে যাই বাবার কাছ থেকে, ভাবল মোনা। বাবা গোপনে লুকিয়ে পড়েছিলেন, আর মার্ভেল ড্রাগ্‌স্ কর্পোরেশনে ঠাঁই করে নেয় ও। ওর ধারণা ছিল, সবার সামনে হামলা করতে পারবে না কেউ। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ওকে ধরে এনে এখন বাঁকা হাসছে এই লোক। খুন করবে যখন- তখন।

হঠাৎ রাগ হলো মোনার। চারপাশ দেখল। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশেই বেঞ্চি। ওটার ওপর পড়ে আছে হাতুড়ি।

ঝট্ করে হাতুড়ি তুলে নিল মোনা, সামনে বেড়ে লোকটার মাথার তালুর ওপর নামিয়ে আনতে গেল ওটা। কিন্তু তৈরি ছিল লোকটা, খপ্ করে ধরে ফেলল ওর কবজি, জোরে একটা মোচড় দিতেই মেঝেতে পড়ল হাতুড়ি কবজি ধরা অবস্থাতেই ওর বাহু নিয়ে গেল পিঠের ওপর।

ভীষণ ব্যথায় মোনার মনে হলো, ভেঙে যাচ্ছে হাড়। বেকায়দাভাবে বাঁকা হয়ে গেছে কনুই। কাঁধ থেকে ছিঁড়ে পড়তে চাইছে হাত!

‘উহ্!’ অস্ফুট স্বরে কাতরে উঠল মোনা। এবার কাঁধ থেকে হাত ভেঙে ফেলবে ওই লোক। কিন্তু তা না করে উঠে দাঁড়াল সে, ঠেলে পিছিয়ে দিল মোনাকে, বাধ্য করল হাঁটুতে ভর করে মেঝেতে বসে পড়তে, তারপর এক ধাক্কায় চিত করে ফেলে দিল ওকে।

ভীষণ ভয় পেল মোনা। রেপ করতে চাইছে? ধড়মড় করে উঠে বসে পিছিয়ে যেতে চাইল।

কিন্তু উপায় নেই। পেছনে টেবিলের দেয়াল।

এক পা সামনে বেড়ে মেঝে থেকে হাতুড়ি নিল কাউন্ট। অন্য হাতে টেনে তুলল মোনাকে। চাপা স্বরে বলল, ‘এসো, দেখাই হাতুড়ি দিয়ে আরও ভাল কাজ করা যায়।

মোনার হাত মুচড়ে ধরে আরেকটা টেবিলের সামনে নিল সে। টেবিলের ওপর মোনার ব্যাগ। ওটা থেকে বের করে রাখা হয়েছে মাটির ট্যাবলেটের অংশ। মোনা বুঝে গেল, কী চায় লোকটা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখ। মনে মনে প্রার্থনা করল, ওর ধারণা যেন ভুল হয়।

কিন্তু ওকে ছেড়ে দিয়ে ভাঙা ট্যাবলেটের বুকে কার্বন স্টিলের বাটালি ধরল লোকটা। বাটালির মাথার ওপর নামল হাতুড়ি। মাত্র একবার, তাতেই শোনা গেল ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষের আওয়াজ। দু’টুকরো হয়ে গেল মাটির ট্যাবলেট। লাফিয়ে উঠে টেবিলে স্থির হলো গলফ বলের অর্ধেক আকারের সোনার এক  বল। গায়ে পোড়া মাটি। তবুও দেখা গেল বলের ওপর কারুকাজ করা সোনার পাতা।

ওই বলের ভেতর রয়েছে জীবন-বৃক্ষের বীজ!

‘যা খুশি করবে আর ওরা বসে থাকবে?’ মোনা ভাবছে রানা ও এলেনার কথা। ‘তোমার মতই ওই বীজ খুঁজছে ওরা।’

‘আমার চেয়েও অনেক বেশি করে খুঁজছে,’ হাসল কাউণ্ট।

‘তোমাকে খুঁজে বের করবে,’ জোর দিয়ে বলল মোনা, ‘আমাকে মেরে ফেললেও রক্ষা পাবে না।’

‘তোমার কথা ঠিক,’ ঠাট্টার সুরে বলল লোকটা। ‘আমিও সেজন্যে অপেক্ষা করছি। বিশেষ করে রানার জন্যে।’

রানার নাম শুনে অস্বস্তির ভেতর পড়েছে মোনা। খুন করে ফেলার আগে ওকে দিয়ে কী করাবে এই লোক, সেটা ভাবতে গিয়ে কেন যেন ভীষণ ভয় লাগছে।

‘তোমার কারণে সত্যিকারের বড়লোক হব,’ মোনার চোখে তাকাল কাউণ্ট। ‘সত্যি বলতে, তোমার জন্যেই প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী রাজা হয়ে উঠব পৃথিবীর বুকে। তার চেয়েও বড় কথা, তোমার জন্যেই ছুটে আসবে মাসুদ রানা। তখন আর রক্ষা নেই তার। আমার সর্বনাশের পেছনে রয়েছে ওই বাঙালি গুপ্তচর।’

দুর্বল বোধ করছে মোনা। মন বলছে, মস্তবড় পাপ করেছে। উচিত ছিল না রানাকে ফাঁকি দিয়ে বন্দি হওয়া।

আফ্রিকা থেকে ওকে উদ্ধার করেছিল রানা। পরে ইরানের বালির ঢিবিতেও। অথচ, মানুষটার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ও। আর এই লোক, ভয়ঙ্কর কিছু চেয়ে না পেয়ে খুন করেছে বাবাকে। এখন দাবি করছে ওর কাছে। নিজেকে দাবার ঘুঁটি মনে হচ্ছে মোনার। নিচু স্বরে বলল, ‘জাহান্নামে যান!’

‘নরক বলে কিছুই নেই,’ বলল কাউণ্ট, ‘মানুষই তৈরি করে নরক।’

‘ভাববেন না যা খুশি করবেন,’ শক্ত হতে চাইল মোনা। ‘আমাকে দিয়ে কিছুই আবিষ্কার করাতে পারবেন না। পৃথিবীর ক্ষতি করার আগে নিজেকে শেষ করে দেব আমি।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল কাউন্ট। তাতে প্রকট টিটকারি। ‘তোমাকে কিছুই করব না। মরতেও দেব না। শেষ পর্যন্ত বেঁচে থেকে সব দেখবে। সেটাই তো মজা।’ বেল্টে গোঁজা রেডিয়ো নিয়ে শান্ত স্বরে বলল সে, ‘ওদের নিয়ে এসো।’

মাত্র এক মিনিট পর খুলে গেল দরজা। দু’জনকে ঠেলে নিয়ে এল দু’জন সশস্ত্র লোক। সামনের দু’জনের একজন আকারে ছোট, অন্যজন স্বাভাবিক এবং বয়স্কা।

‘হায়, আল্লা…’ মাথা ঘুরে উঠতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়তে গেল মোনা। যদিও শেষ পর্যন্ত টেবিলের কিনারা ধরে সামলে নিল নিজেকে। তাকাল কাউন্টের দিকে। এই লোকই খুন করেছে ওর বাবাকে। এখন ধরে এনেছে মিনা ফুফু আর মিনতিকে।

বাচ্চা মেয়েটাকে কাউন্টের দিকে ঠেলে দিল নিষ্ঠুর চেহারার এক লোক। এখন মিনতির চোখে চশমা নেই। মনে হলো না ভাল করে কিছু দেখতে পাচ্ছে বেচারি।

প্রায় দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরল মোনা। মিনতির চোখ থেকে দরদর করে পড়ছে অশ্রু। গালে চড়ের লাল দাগ। মচকে গেছে ছোট্ট নাক। বুক ফেটে যেতে চাইল মোনার। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘আপু, ঠিক আছে, কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি! একটু পর চলে যাব এখান থেকে!’ ফুফুর দিকে তাকাল মোনা। কপাল কেটে গেছে মিনার, রক্ত পড়ছে। ফুলে উঠেছে খ্যাতলানো ঠোঁট। কাঁদতে শুরু করে কাউন্টের দিকে ফিরল মোনা। ‘প্লিয… ওদেরকে কষ্ট দেবেন না!’

থরথর করে কাঁপছে ও, চোখ থেকে নামছে অশ্রু। ওর দু’হাতের মাঝে কাঁদছে ছোট্ট বোন মিনতিও। ফুঁপিয়ে উঠে অস্ফুট  স্বরে বলল, ‘ওরা খুব মেরেছে ফুফুকে।

‘জানি, আপু, জানি। দেখো, আর মারবে না।’ কাউন্টের দিকে তাকাল মোনা। লোকটা নিজেকে বলে প্রভু। সত্যিই এখন মনে হচ্ছে সে ভয়ঙ্কর অত্যাচারী কোনও জমিদার। বুকের ভেতর মোনা বুঝে গেল, মিনতি আর ফুফুর জন্যে সব করতে পারে ও। কখনও ক্ষতি হতে দেবে না ওদের। দুর্বল স্বরে বলল ও, ‘দয়া করে ছেড়ে দিন ওদেরকে। আপনি যা বলবেন, তা-ই করব। যা চাইবেন, তা-ই দেব।’

‘তা জানি,’ বলল কাউণ্ট। ‘আগেই বুঝিয়ে দিলাম, বাড়াবাড়ি করলে কী হবে। তবুও আরেকটু দেখিয়ে রাখি।’ বেল্ট থেকে এক টানে পিস্তল বের করেই মিনা ফুফুর বুকের দিকে নল তাক করল সে।

‘না!’ আঁৎকে উঠল মোনা। বুকে জড়িয়ে ধরেছে মিনতিকে। দেখতে দেবে না কিছুই।

কামানের মত আওয়াজ তুলল শক্তিশালী পিস্তল। চোখ বুজে ফেলেছে মোনা। শুনল মেঝেতে ধুপ্ করে পড়ল কেউ। আর কোনও আওয়াজ নেই।

‘সিরামটা তৈরি করো, গম্ভীর কণ্ঠে বলল প্রভু, ‘তোমার বাবা যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেটা পূরণ করো। সেক্ষেত্রে ছেড়ে দেব তোমাদের দু’জনকে।

অন্তরে মোনা জেনে গেল, সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছে লোকটা। কিন্তু কিছু বলবে, সে সাধ্য ওর নেই। কিশোরী বয়স থেকেই দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, আর পারছে না।

কোনও চালাকির চেষ্টা করলে ভুল করবে,’ বলল কাউণ্ট ‘সেক্ষেত্রে বাঁচবে না তোমার বোন। মনে রেখো, সবার আগে তোমার বোনকে সিরাম দেব।’

মস্ত ভুল করেছে, বুঝতে পারছে মোনা। ওর কারণেই খুন হবে রানাও। ওর উচিত ছিল না ইরানের বালির ঢিবিতে এটিভি থেকে নেমে যাওয়া। ভাল করেই জানত, ওকে গুলি করবে না লোকগুলো। ধরে নিয়ে যাবে কাল্টের নেতার কাছে। মনে একটু ভয় ছিল, কাজ শেষ হলে মেরে ফেলরে ওকে। কিন্তু তাতেই বা কী? নিজের বাবার খুনের দায় এড়াতে পারবে ও? তার চেয়ে সিরাম আবিষ্কার করতে গিয়ে মরে যাওয়াও মন্দ নয়। বোনের জন্যে গবেষণা করতে গিয়ে মরতে হচ্ছে ওকে।

বাবাকে খুন হতে দিয়ে যে ভুল করেছে, সেজন্যে এবার সঠিক কাজ করবে ভেবেছিল, ধ্বংস হতে দেবে না পৃথিবী। কিন্তু সব কেমন উল্টেপাল্টে গেল। এরা ফুফু আর মিনতিকে ধরে এনেছে, তাদের হাতে ৯৫২ টেস্টের রেযাল্ট। এদিকে ওর হাতে ভাল কোনও তাস নেই। তবুও জিজ্ঞেস করল, ‘যদি আপনার হয়ে কাজ করতে না চাই?’

‘সেক্ষেত্রে তোমাকে আর তোমার বোনকে কষ্ট দিয়ে মারব, এরপর দেরি করব না ৯৫২ ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে।’

কথাটা শুনে মোনার মনে হলো, অনেক আগেই উচিত ছিল ওর মরে যাওয়া। মানুষ অদ্ভুত, কেন যেন অভিশাপ এল মনে রানার জন্যে। দুঃসাহসী বাঙালি গুপ্তচর, বাঁচিয়ে দিলে, তাই আজ সহ্য করতে হচ্ছে এই নরক যন্ত্রণা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *