ত্রিশ
এলিভেটরে করে মুর ফার্মাসিউটিকাল কর্পোরেশনের বেসমেন্ট গ্যারাজে নেমে এল আর্নল্ড মুর ফি, বরাবরের মতই সারাটা দিন হাজার দুশ্চিন্তা করে ক্লান্ত। গত ক’দিন ঘুমাতে পারেনি। মাথায় উঠেছে নাওয়া-খাওয়া। কড়া উইস্কির গ্লাসে কয়েকবার দীর্ঘ চুমুক দিয়েও শান্ত হয়নি মন।
ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার, এই বুঝি কেউ জেনে ফেলল! আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে তার। প্রিয় বুলেটপ্রুফ লিংকন টাউন কার পাশে থামতেই গাড়ির পেছনের সিটে উঠল বিলিয়নেয়ার। কয়েক সেকেণ্ড পর মুরের বডিগার্ড।
পার্কিং এরিয়া থেকে বেরিয়ে চওড়া রাস্তায় পড়ল গাড়ি। সেণ্টার কন্সোল নুক থেকে বোতল নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল মুর। মনে আশা, গ্লেনফিডিক ৪০-এর পঞ্চম পেগ ঠাণ্ডা করবে মাথা
কাউণ্ট নামের ওই ভয়ঙ্কর পশুর ইচ্ছেকে পাত্তা না দিয়ে বিপজ্জনক এক কাজ করে বসেছে সে। প্রথম সুযোগে মোনা মোবারককে চেয়েছে নিজের মুঠোর ভেতর। মেয়েটা দুবাইয়ে ফাণ্ড জোগাড় করছিল। গোলাগুলি হলেও হাতের নাগালে পাওয়া যায়নি তাকে। এই চরম ব্যর্থতা ডেকে আনতে পারে চরম · সৰ্বনাশ!
বুর্জ আল আরব হোটেলে কী হয়েছে ব্রডকাস্ট করেছে সিএনএন। নিচের রাস্তায় ছিল হেলিকপ্টার, বিধ্বস্ত। চারপাশে সিকিউরিটির লোক। খুন হয়ে গেছে মুরের পাঠানো একদল লোক। তাদের হাতে খুন হয়েছে নিরীহ একদল মানুষ।
সরাসরি গলায় নির্জলা উইস্কি ঢালল আর্নল্ড মুর ফি। দু’ হাজার ছয় শ’ ডলার দাম ওই বোতলের, ভেতরের জিনিস ফোঁটা ফোঁটা করে জিভে দিয়ে আয়েস করার জন্যে তৈরি। যেন গলে যাবে জিভে। নাকে আসবে দামি ওয়াইনের সুবাস। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বস্তি দিচ্ছে না গ্লেনফিডিক ৪০। বারবার ভাবছে সে, কী করে ওই হামলাকারী দল আর নিজের মাঝের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে। যে মধ্যস্থ করেছে, সে হামলার জন্যে জোগাড় করেছে এক লোককে। সেই লোক আবার জুটিয়েছে অন্যদেরকে। কিন্তু অন্য কারণে ভয় লাগছে মুরের। মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে কোনও মতেই যোগাযোগ করতে পারছে না সে। ফোন ধরছে না কেন লোকটা?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মুর। মনে প্রাণে চাইছে, খুন হয়ে যাক কমাণ্ডোদের ওই নেতা। সেক্ষেত্রে কোনও চিন্তা নেই। কেউ অভিযোগের আঙুল তুলতে পারবে না তার দিকে।
আরেক চুমুক গ্লেনফিডিক নিল মুর। বার কয়েক বড় করে দম নিয়ে শান্ত করতে চাইল নিজেকে। আসলে নিচের লোকগুলো দায় নিলে ওপরের লোকদেরকে আর বিপদ ছুঁতে পারে না।
বিপদের জোয়ার স্পর্শ না করলেই হলো।
জানালা দিয়ে সাগর দেখল মুর।
আরে, এ পথে তো বাড়ি ফেরে না সে!
উপকূলীয় এই রাস্তা গেছে পুবের ক্লিফগুলোর মাঝ দিয়ে।
‘ড্রাইভার!’ ধমকে উঠল মুর। ‘বোকার মত কোথায় চলেছ?’
জবাব দিল না ড্রাইভার।
মুর শুনল দুটো খুক-খুক আওয়াজ। তার পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বডিগার্ড। রক্ত ছিটকে লাগল মুরের গালে। এত ভয় পেয়েছে যে হাত থেকে ফেলে দিল দামি বোতল।
‘ক্ব-ক্বী হচ্ছে?’
লাফিয়ে গতি বাড়াল দ্রুতগামী গাড়ি। যেন পেছন থেকে টেনে নেয়া হলো মুরের ঘাড়। বেকায়দা হয়ে গেল সে। ভয়ে থরথর করে কাঁপল শরীর। খপ করে ধরল দরজার হ্যাণ্ডেল, লাফিয়ে নেমে পড়বে গাড়ি থেকে। কিন্তু গাড়ি তো চলছে ষাট মাইল বেগে! পাশেই গার্ডরেল, ওই বেড়া ভেঙে গেলে আশি ফুট নিচের পাথুরে সৈকতে পড়বে গাড়ি।
‘যাও, লাফ দাও!’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল ড্রাইভার।
সাঁই করে বাঁক নিল লিংকন, ফলে উল্টো দিকের দরজার ওপর আছড়ে পড়ল মুর। শরীরটা স্থির হলো বডিগার্ডের পিঠে। রক্তাক্ত লোকটা মরেনি, মুখ থেকে বেরোচ্ছে ঘড়ঘড় শব্দ।
তাকে ঠেলা দিয়ে নিজে সরে এল মুর।
রাস্তা সোজা হওয়ায় ফিরে পেল ভারসাম্য।
‘লাফ দে, হারামজাদা!’ ধমক দিল ড্রাইভার। ‘লাফ দে!’
ভয়ঙ্কর ওই কণ্ঠ এবার চিনল মুর। লোকটার ঘাড়ে উলকি। ‘কাউণ্ট!! পাগল হয়ে গেলে?’
‘কী বলেছিস মনে আছে তোর?’ সুইচ টিপে সাউণ্ড সিস্টেম চালু করল লোকটা। নিজের কণ্ঠ শুনল মুর।
‘…না, ওই সাইকোপ্যাথের কথা মত চললে হবে না। জোগাড় করো যোগ্য লোক, তারপর তুলে আনো মোবারকের মেয়েকে। ওকে হাতের মুঠোয় চাই!’
ভয়েস চেঞ্জিং টেকনোলজির কারণে অন্য লোকটার কণ্ঠ বিকৃত শোনাল: ‘কাজটা সহজ হবে না। ওর বাবার মতই লুকিয়ে বেড়ায়।’
‘ওকে যেতেই হবে দুবাই শহরে,’ নিজের কণ্ঠ চিনল মুর।
‘অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হবে।
‘যা করার করো! যত খুশি টাকা লাগুক! ওকে চাই!’
জানতে চাইল বিকৃত কণ্ঠ: ‘কাউণ্ট? তার কী হবে?’
‘সরিয়ে দিতে হবে। মেয়েটাকে এনেই আর দেরি করবে না তাকে শেষ করে দিতে।
গাড়ি সামনে বাঁক নিতেই ফিরে তাকাল কাউণ্ট। মুরের পাশে সিটে কী যেন ফেলল। ভয় পেয়ে ওটার দিকে ঘুরল মুর। জিনিসটা ভেজা, লাল রঙের কাপড়। সামান্য সরে গেছে বলে মুর দেখল রক্তাক্ত একটা আঙুল।
‘বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছে,’ বলল কাউণ্ট, ‘এত বড় ভুল করা উচিত হয়নি ওর।‘
বুক ঠেলে ভীষণ বমি পেল মুরের। ধাক্কা দিয়ে কাটা আঙুল ফেলে দিল সিট থেকে মেঝেতে। গতি আরও বাড়ছে গাড়ির।
‘কী চাও?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল মুর।
‘আমি চাই লাফ দিবি,’ বলল কাউণ্ট।
‘এসব কী বলছ!’
কষে ব্রেক করল কাউণ্ট। তৈরি ছিল না মুর, ধুপ করে বাড়ি খেল সামনের সিটের পেছনে। দু’ঠোঁট ফেটে যেতেই ঝরঝর করে ঝরল রক্ত। খসে পড়েছে সামনের একটা দাঁত। আবারও গতি তুলল গাড়ি। গতির কারণে হ্যাঁচকা টান খেয়ে সিটে পড়ল মুর।
‘পরেরবার সিট বেল্ট বেঁধে নিস,’ অশুভ হাসল কাউণ্ট। মেঝের সঙ্গে চেপে ধরেছে অ্যাক্সেলারেটর।
কঠিন মৃত্যুর চিন্তা মনে আসতেই একমাত্র উপায়ে বাঁচতে চাইল মুর। ‘আমি টাকা দেব! পুরো দুই মিলিয়ন! ঠিক তোমার কথা মত!’
‘অনেক দেরি করে ফেলেছিস।’
‘পাঁচ মিলিয়ন… দশ মিলিয়ন!’ প্রায় কেঁদে ফেলল মুর। ‘যা চাও!’
আবারও ব্রেক চাপল কাউণ্ট। আটকে গেল চার চাকা। পুরো এক শ’ ফুট পিছলে গাড়ি থামল উঁচু এক ক্লিফের পাশে।
এই সুযোগ! দরজার হ্যাণ্ডেল মুচড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল মুর। তখনই গুলি করা হলো তাকে।
ভীষণ ব্যথায় কাতরে উঠল মুর। ফুটো হয়ে গেছে ভুঁড়ি, ছোট্ট গর্ত থেকে তিরতির করে বেরোচ্ছে রক্ত। দু’হাতে ক্ষত চেপে ধরল সে।
পিস্তলের নলের ওপর দিয়ে তাকে দেখল কাউণ্ট। নিষ্কম্প হাতে পিস্তলের নলে আটকে নিল সাইলেন্সার। ‘ঠিক আছে, কল কর্। ট্রান্সফার কর টাকা।’
কোটের পকেট থেকে ফোন বের করল মুর। ডায়াল করল কাঁপা হাতে। কানে ঠেকিয়ে জানাল কোড।
‘কত?’
‘বিশ মিলিয়ন ডলারই যথেষ্ট।’
আরেকটা কোড উচ্চারণ করল মুর। ‘ট্রান্সফার করুন বিশ মিলিয়ন ডলার। …হ্যাঁ। বিশ মিলিয়ন ডলার। দেরি করবেন না। ‘ তৃতীয় কোড দেয়ায় মেনে নেয়া হলো অথেনটিসিটি।
নিজের ফোন দেখল কাউন্ট। অ্যাকাউন্টে এইমাত্র জমা পড়েছে বিশ মিলিয়ন। পাশের দরজা খুলে ফেলল, চোখ রেখেছে মুরের ওপর।
‘সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে কখনও কারও সঙ্গে চুক্তি করতে যাসনে,’ বলল সে। ‘কঠিন পথে এটা শিখেছি, ওই জ্ঞান তোকে দিলাম।’
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল কাউণ্ট।
সে এক পা যেতে না যেতেই ফোনে ৯১১ ডায়াল করল মুর। কিন্তু তখনই পেছনের সিটে কী যেন ফেলল কাউণ্ট। হন-হন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আবারও কারও বিচ্ছিন্ন অঙ্গ দিল কি না দেখতে ঘুরে তাকাল মুর। জিনিসটা ধূসর ক্যানের মত। ওপরে কী যেন।
ইনসেনজেরি গ্রেনেড!
দু’হাতে হ্যাণ্ডেল চেপে ধরল মুর, দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। আর তখনই বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। গাড়ির ভেতর থেকে ছিটকে বেরোল লেলিহান আগুন।
বিস্ফোরণের ধাক্কা সামনে ঠেলল মুরকে, পার করিয়ে দিল ক্লিফের কিনারা। আগুন ও ধোঁয়ার ভেতর সাঁই-সাঁই করে নেমে চলেছে সে। অবাক হয়ে দেখল, উঠে আসছে পাথুরে সৈকত!
বিশ্রী কুড়মুড় শব্দে এবড়োখেবড়ো পাথরে আছড়ে পড়ল সে। একবার গড়িয়ে থেমে গেল।
লকলকে আগুন চাটছে তার নিথর দেহ।