মৃত্যুক্ষুধা – ২২
সেই মাটির পুতুলের কৃষ্ণনগর! সেই ধুলা-কাদার চাঁদ-সড়ক! শুধু সড়কই আছে, চাঁদ নেই! সবাই বলে, দুদিনের জন্য চাঁদ উঠেছিল, রাহুতে গ্রাস করেছে! বলেই আশেপাশে তাকায়। “বিশ্বাসং নৈব কর্তব্য রাজকুলেষু!”
সেই ‘ওমানকাৎলি’পাড়া, সেই বাগান, পুকুর, পথ-ঘাট, কোঁদল-কাজিয়া সব আছে আগেকার মতোই। শুধু যারা কিছুতেই ভুলতে পারে না তারা ছাড়া আর সকলেই মেজোবউ, কুর্শি, প্যাঁকালে, আনসার – সবাইকে, সব কিছুকে ভুলে গেছে। স্মরণ রাখার অবকাশ কোথায় এই নিরবচ্ছিন্ন দুঃখের মাঝে!
অগাধ স্রোতের বিপুল আবর্তে পড়ে যে হাবুডুবু খেয়েছে, সে-ই জানে কেমন করে আবর্তের মানুষ এক মিনিট আগে হারিয়ে-যাওয়া তারই কোলের শিশু-সন্তানের মৃত্যু-কথা ভুলে আত্মরক্ষা চেষ্টা করে!
নিত্যকার একটানা দুঃখ-অভাব-বেদনা-মৃত্যুপীড়া-অপমানের পঙ্কিল স্রোতে, মরণাবর্তে যারা ডুবে মরছে, তাদের অবকাশ কোথায় ক্ষণপূর্বের দুঃখ মনে করে রাখার? ওরা কেবলই হাত-পা ছুঁড়ে অসহায়ের মতো আত্মরক্ষা করতেই ব্যস্ত।
কিন্তু জীবনের সকল আশা-ভরসায় জলাঞ্জলি দিয়ে যে মৃত্যুর মুখে নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পন করে, এই শেষ নির্ভরতার চরম মুহূর্তে বুঝি-বা তারও স্মরণ-পথে ভিড় করে আসে – সেই চলে-যাওয়ার দল –যারা সারা জীবন তারই আগোপিছে তার প্রিয়তম সহযাত্রী ছিল।
শোকে জরায়-অনাহারে দুঃখে প্যাঁকালের মা শয্যা নিয়েছে। সে কেবল বলে, “দেখ বড়োবউ, জন্মে অবধি এমন শুয়ে থাকার সুযোগ আর আরাম পাইনি … কাল থেকে এই একপাশেই শুয়ে আছি, মনে হচ্ছে এ ধারটা পাথর হয়ে গিয়েছে, তবু কী আরামই না লাগছে! … আর কারুর জন্যই ভাবি না, তোদের জন্যেও না, আমার জন্যেও না, কারুর জন্যেও না! … খোদা যা করবার করবেন! পানিতে লাঠি মেরে তাকে কেউ ফিরাতে পারে না! যা হওয়ার, তা হবেই!” – বলেই সে নিশ্চিন্ত-নির্বিকার চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে! হঠাৎ সে দার্শনিক হয়ে ওঠে, দুঃখ ভোলার বড়ো বড়ো কথা তার মুখ দিয়ে বেরোয় – যা জীবনে তার মুখ দিয়ে বেরোয়নি। বলেই সে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যায়। প্রশান্ত হাসিতে মুখ-চোখ ছলছল করে ওঠে। ও যেন সারা রাত্রি ঝিমিয়ে-ঝিমিয়ে পোড়া তৈলহীন প্রদীপের সলতের মতো নিববার আগে হঠাৎ জ্বলে ওঠা!
বড়োবউ চোখ মোছে। জল এলেও মোছে, না এলে লজ্জায় চোখ ঢাকার ছলনায় মোছে।
ওইটুকু তো দুটো চোখ, কত জলই বা ওতে ধরে! যে রক্ত চুঁয়ে ওই চোখের জল ঝরে, সেই রক্তই যে ফুরিয়ে গেছে।
মেজোবউয়ের পরিত্যক্ত সন্তান দুটি আঙিনায় খেলা করে; কেমন যেন নির্লিপ্তভাব ওদের কথায়-বার্তায় চলাফেরায় চোখে মুখে ফুটে ওঠে।
মাতৃহারা বিহগ-শাবক যেমন অন্য পাখিদের সঙ্গে থেকেও দলছাড়া হয়ে ঘুরে ফেরে, কী যেন চায়, কাকে যেন খোঁজে – তেমনই!
খানিক খেলা করে, খানিকক্ষণ কাঠ কুড়োয়, খানিক অলস ভাবে গাছের তলায় পড়ে ঘুমোয়, ঘুমিয়ে উঠে, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে, তারপর বুকফাটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘরে ফিরে। ঘরে এসেই কাকে যেন খোঁজে, কী যেন প্রত্যাশা করে, পায় না। বড়োবউয়ের ছেলেমেয়েরা ভাব করতে আসে, ভালো লাগে না। বড়োবউ আদর করতে আসে, কেঁদে ওরা হাত ছাড়িয়ে নেয়। অকারণ আখোট করে।
সন্ধ্যার সঙ্গে-সঙ্গে ওরা আস্তে আস্তে রুগ্ণা শয্যাশায়ী দাদির কাছে এসে বসে। ছেলেটি গম্ভীরভাবে বলে, “দাদিমা, আজ ভালো আছিস?” বৃদ্ধা হেসে বলে, “আর দাদু, ভালো! এখন চোখ দুটো বুজলেই সব ভালো মন্দ যায়।” তারপর দার্শনিকের মতো শান্তস্বরে বলে, “দেখ দাদু, আমি চলে গেলে তোরা কেউ কাঁদিস না যেন। মানুষ জন্মালেই মরে। ছেলেমেয়ে, মা-বাপ কারুর কি চিরদিন থাকে?”
শ্রীমান দাদু এ-সবের এক বর্ণও বোঝে না, হাঁ করে চেয়ে থাকে।
মা-বাপের নাম শুনতেই ঢুলতে ঢুলতে খুকি বলে ওঠে, “দাদি, তুই আব্বার কাছে যাবি? আচ্ছা দাদি, আব্বা যেখানে তাকে সেইখেন বেশিদূর, না, মা যেখানে থাকে সেই বরিশাল বেশি দূর?”
শান্ত বৃদ্ধা ছটফট করে ওঠে। একটা ভীষণ যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে পাশ ফিরে শুয়ে বলে, “ওই বরিশালই বেশি দূর, ওই বরিশালিই বেশি দূর!”
খুকি বুঝতে পারে না। তবু ক্লান্ত-কণ্ঠে বলে, “তাহলে আমি আব্বার কাছে যাব। আচ্ছা দাদি, আব্বার কাছে যেতে হলে কয়দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়! তুই তো বিছানায় শুয়ে অসুখ করেছিস, তারপর সেখানে যাচ্ছিস! আমারও এইবার অসুখ করবে, তারপর আব্বার কাছে চলে যাব! মা ভালোবাসে না, খেরেস্তান হয়ে গিয়েছে! হারাম খায়! থুঃ! ওর কাছে আর যাচ্ছি না, হুঁ হুঁ!”
বৃদ্ধা শুয়ে শুয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। মনে হয়, কামারশালে বুঝি পোড়া কয়লা জ্বালাতে হাপরের শব্দ হচ্ছে!
দাওয়ার মাটিতে শুয়ে পড়ে জড়িতকণ্ঠে খুকি আবার জিজ্ঞাসা করে, “হেঁ দাদি, আব্বা যেখানে থাকে সেখানে সন্ধ্যাবেলায় কী খেতে দেয়। আমি বলি দুধ-ভাত, হান্পে বলে গোশ্ত-রুটি!”…কিন্তু দাদির উত্তর শোনার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়ে!
ছেলেটি জেগেই থাকে। কী সব ভাবে, মাঝে মাঝে রান্নাঘরের দিকে চায়। সেখানে অন্ধকার দেখে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস করে না।
কিন্তু থাকতেও পারে না। আস্তে আস্তে উঠে বেরিয়ে যায়! দাদি চেঁচিয়ে ওঠে, “অ হান্পে, কোথায় যাচ্ছিস রে এই অন্ধকারে?” অন্ধকারের ওপার থেকে আসে, “মসজিদে শিন্নি আছে, আনতে যাচ্ছি।”
বড়োবউ মসজিদের দ্বার থেকে কোলে করে আনতে চায়, সে ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে। বলে, “যাব না, আমি শিন্নি খাব, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে গো! আমি যাব না।”
মসজিদের ভিতর থেকে মউলবি সাহেবের কণ্ঠ ভেসে আসে। কোরানের সেই অংশ – যার মানে – “আমি তাহাদের নামাজ কবুল করি না, যাহারা পিতৃহীনকে হাঁকাইয়া দেয়!” মউলবি সাহেব জোরে জোরে পাঠ করেন, ভক্তরা চক্ষু বুজিয়া শোনে!
অন্ধকার ঘরে ক্ষুধাতুর শিশুর মাথার ওপর দিয়ে বাদুড় উড়ে যায় – আসন্ন মৃত্যুর ছায়ার মতো!
ঘুমের মাঝে খুকি কেঁদে ওঠে, “মাগো আমি আব্বার যাব না! আমি তোর কাছে যাব, বরিশাল যাব!”
খন্ড অন্ধকারের মতো বাদুর দল তেমনই পাখা ঝাপটে উড়ে যায় মাথার ওপর। – রাত্রি শিউরে ওঠে!