মৃত্যুক্ষুধা – ১০
সেদিন রবিবার। ছুটি।
প্যাঁকলের গোটা দুয়েকের সময় স্নান করতে বেরুল।
বেরুবার আগে তেলের শূন্য শিশিরটা অনেকক্ষণ ধরে উলটে রাখলে হাতের তালুর উপর। মিনিট পাঁচেকে ফোঁটা পাঁচেক তেল পড়ল। তেল ঠিক নয়, তেলের কাই। শিশিটার পিছন দিকে গোটা দুত্তিন থাপ্পড় মেরেও যখন আর এক ফোঁটার বেশি তেল গড়াল না, তখন তাই কোনোরকমে মুখে হাতে মাখতে মাখতে সে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।
ওই তেলটুকু মাথায় সে দিলে না, – নিজের মাথাকে তেলামাথা মনে করেই কিনা – বিশ্ব-সংসারে তেলামাথায় তেল দেওয়ার সবচেয়ে বড়ো মালিক যিনি তিনিই জানেন।
গামছা তাকে বলা যায় না – একটা তেলচিটে ন্যাকড়া, তাই সে মাথায় জড়িয়ে নিলে শৌখিন বাবুদের মাথায় রুমাল বাঁধার মতো করে। তাতে তার কপালে দুঃখটুকু ছাড়া মাথার বাকি সবটুকুই কোনোরকমে ঢাকা পড়ল!
এই সৌভাগ্যের জয়ধ্বজা মাথায় বেঁধে প্যাঁকালে স্নান করতে চলল ক্রিশ্চান পাড়ার ভিতর দিয়ে। মোংলা পুকুরই তার কাছে হয়, কিন্তু কেন যে সে অতটা ঘুরে গোলপুকুরে নাইতে যায়, তা আর লুকা-ছাপা নেই – ও পুকুরে নাইতে যারা যায় তাদের কাছে। প্রেমের পথ সোজা নয় বলেই হয়তো সোজা পথে যায় না।
লোকে বলে মাথার জয়ধ্বজা তার মধু ঘরামির অর্ধেক রাজত্বের ওপর দাবি বসাবার জন্য নয়, তার ‘রাজকন্যা’কুর্শিকে জয় করার জন্যই। কিন্তু ওই জয়ধ্বজার অসম্মানে সে নিজেই ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে – যখন কুর্শির সামনেই ওই জয়ধ্বজা দিয়ে গা রগড়াতে হয়।
নাইতে গেলে সে কুর্শিদের ঘরের সামনে দিয়েই যায়। আজও যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে ঘরে আগড়-দেওয়া দেখে বসে পড়ল – রাস্তায় নয়-রোতো কামারের দোকানে।
রোতো তার হাপর ঠেলতে ঠেলতে তাকে একবার আড় নয়নে দেখে নিলে। মনে হল, লোহা পেটার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন হাসি গোপন করছে।
প্যাঁকালে রোতোর চেয়েও বেশি ঘামতে লাগল, আগুন হতে অনেক দূরে থেকেও।
রোতো নেহাই-এর উপর একটা জ্বলন্ত লোহার ফাল রেখে প্যাঁকালের দিকে চেয়ে বললে, “দেখেছিস মাইরি, আগুন নিয়ে খেলার ঠেলা! হাতের কতটা পুড়ে গিয়েছে দ্যাখ!” বলেই প্রাণপণে হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটায় আর হাসে। প্যাঁকালে বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
রোতো ফলাটা আবার আগুনে সেঁদিয়ে হাপর ঠেলতে ঠেলতে বলে, “মেয়েমানুষ আর আগুন – এই দু-ই সমান বুঝলি, দু-টাতেই হাত পোড়ে।”
এতক্ষণ কুর্শি কোথায় দাঁড়িয়েছিল, সে-ই জানে; হঠাৎ তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “মুখও পোড়ে রে মুখপোড়া।”
প্যাঁকালে তাড়াতাড়ি উঠে পুকুরের দিকে চলে গেল। তখনও রোতার স্বর শোনা যাচ্ছিল, “উ–ই প্যাঁকালে রে! তুই একটু আমার হাপরটা ঠেল ভাই, আমি একটু জলে ডুবে ঠাণ্ডা হসে আসি!”
কুর্শি কতকগুলো সাজি-মাটি-সেদ্ধ কাপড়ের বোঝা নিয়ে পুকুরের দিকে যেতে যেতে একবার টেরা চাউনি দিয়ে অভ্যর্থনা করে গেল রোতোকে। যাবার সময় বলেও গেল, “যাসনে মিনসে, এক্কেবারে ঠাণ্ডা মেরে যাবি। জলে ডুবলে আর উঠতে হবে না।”
রোতো হয়তো তখন মনে মনে বলছিল, এ আগুনের তাতে মরার চেয়েও শীতল জলে ডুবে মরায় ঢের আরাম।
রোতোর কিন্তু হাতই পুড়েছে, কপাল পোড়েনি। কুর্শি তাকে দেখতে না পারলেও ঘেন্না করে না।
গোলপুকুরে অন্য যারা চান করে, তাদের কেউই এ অসময়ে – বেলা দুটোয় চান করতে আসে না। কাজেই এই সময়টাই তাদের পক্ষে প্রশস্ত, যারা শুধু গা ধুতেই আসে না, প্রাণ জুড়াতেও আসে।
কুর্শি এসে দেখে, প্যাঁকালে তখন ঘাটের বটগাছটার শিকড়ের উপর বসে সিগারেট টানছে। প্যাঁকালে মাঝে মাঝে থিয়েটারে ইয়ার বাবুদের কাছে দু-একটা সিগারেট চেয়ে রাখে এবং সেটা কুর্শির কাছ ছাড়া আর কারুর কাছেই খায় না। আজও স্নান করতে আসার সময় কালকে চাওয়া সিগারেটটা কোঁচড়ে গুঁজে আনতে ভোলেনি।
কুর্শি প্যাঁকালের দিকে না চেয়েই ঘাটে ধপাস করে কাপড়ের রাশ আর পিঁড়িটা ফেলে বেশ করে কোমরে আঁচলটা জড়িয়ে নিলে। তারপর কারুর দিকে না চেয়ে জোরে জোরেই বলতে লাগল, “ঘাটের মড়া! রোজ রোজ আমার পেছনে লাগবে! দেব একদিন মুখে বাসি চুলোর ছাই ঢেলে, তখন বুঝবে মজাটা!”
প্যাঁকাল আর চুপ করে থাকতে পারলে না। এ উত্তরে হাওয়া তার দিকে না রোতোর দিকে বইছে, তাও সে বুঝতে পারল না। সে ফস করে নেমে এসে পাশের ঘাটের পচা খেজুর গুঁড়িটাতে বসে একটা খোলামকুঁচি নিয়ে পায়ের মরা মাস ঘষতে ঘষতে বললে, “তুই আজ রাগ করেছিস না কি কুর্শি? দেখছিসই তো শালারা কীরকম চোখ লাগাতে শুরু করেছে!”
কুর্শি একটা কাপড় একটু ভিজিয়ে কাচবার জন্য দাঁড়িয়ে বলে, “বয়ে গেছে আমার! এখন তোর কুর্শিকে না হলেও চলবে। তোর ওই মেজোভাবি তো আমার মতন কালো নয়। তা হোক না ছেলের মা।”
এইবার প্যাঁকালে হাওয়ার কতকটা দিক নির্ণয় করতে পারলে। সে পা ঘষা থামিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আল্লার কিরে কুর্শি, খোদার কসম, আমি ও নিকে করছিনে। আমাকে কয়েছিলো মা, তা আমি আচ্ছা করে শুনিয়ে দিয়েছি মুখের মতন। আমি বলেছি, এ শালার গোয়াড়িতেই থাকব না। রানাঘাট চলে যাব কাজ করতে।”
কুর্শির হাতের কাপড় জলে পড়ে গেল। সে ম্লান করে বললে, “সত্যি চলে যাবি নাকি?”
ওষুধ ধরেছে দেখে প্যাঁকালে খুশি হয়ে বলে উঠল, “যাবই তো! তা না হলে যদি মেজোভাবির সঙ্গে নিকে দিয়ে দেয় ধরে?”
কুর্শি কাপড়টা তুলে অনেকক্ষণ ধরে কাচে। প্যাঁকালে তার কাপড় কাচার বিচিত্র গতিভঙ্গি চোখ পুরে দেখে। চোখে তার ক্ষুধা আর মোহ নেশার মতো করে জমাট বেধেঁ ওঠে! বুকের স্পদন দ্রুত হতে দ্রুততর হতে থাকে।তার যেন নিজেরই নিজেকে ভয় করে। অকারণে পুকুরের চারপাশে ভীত-ত্রস্ত দৃষ্টি দিয়ে দেখে –সে যেন কী চুরি করছে। মাথায় তার খুন চড়ে যায়। সে উঠে গিয়ে কুর্শির হাত চেপে ধরে। পা তার ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। চোখে কীসের শিখা লকলক করে ওঠে। সে শুষ্ককণ্ঠে ডাকে, ‘কুর্শি!’
কুর্শি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “যা মাইরি, এখুনি কেউ দেখে ফেলবে। একটু হুঁশ নেই! – আগে বল, তুই রানাঘাটে চলে যাবিনে।”
প্যাঁকালে সাহস পেয়ে বলে, “এই দেখ মজিদের দিকে মুখ করে বলছি, আল্লার কিরে কুর্শি, আমি যাব না কোথাও তুই না বললে।”
কুর্শি খুশি হয়ে বলে, “উহু! আমার গা ছুঁয়ে বল!”
প্যাঁকালে গা ছুঁয়ে বলে, “মজিদের চেয়েও বুঝি তুই বড়ো হলি?”
কুর্শি খুব মিষ্টি করে হাসে। বলে, “হলুমই তো।” সে হাসিতে রাজাবাদশা বিকিয়ে যায়। প্যাঁকালে থাকতে না পেরে একটা অতি বড়ো দুঃসাহসের কাজ করে বসে।
কুর্শি খুশি হয়, রাগও করে। মুখটা সরিয়ে দিয়ে বলে, “যা, ভালো লাগে না, কেউ দেখে ফেলবে এখনই।”
প্যাঁকালেও জানে, যে কোনো লোক যে কোনো সময়ে দেখে ফেলতে পারে। কিন্তু ওই হাসি! ওই চোখ! ওই ঠোঁট! ওই দেহের দোলান। দেখুকই না লোকেরা ! প্যাঁকালে যেন মাতাল হয়ে পড়ে। হুঁশ থাকে না।
স্নান করে সে বাড়ি ফেরে। সারা শরীর তার ঝিম ঝিম করতে থাকে। যেন তাড়ি খেয়েছে। মাথার দু পাশের রগ টিপটিপ করে। বিশ্ব-সংসার মুছে যায় তার চোখের সামনে থেকে। সে কেবল ভীত মিষ্টি কণ্ঠের আকুলতা শোনে আর শোনে, “কেউ দেখে ফেলবে, দেখে ফেলবে!” –তার তাকে লজ্জা নাই, লজ্জা শুধু দেখে ফেলার লোককে।
ওদের লজ্জা যেন ওদের জন্য নয়, অন্যের জন্য।
তারা দুজনে চলে – চির-চলা রক্ত-রাঙা পথে। যে-পথ ফরহাদ-মজনুঁ, লায়লি-শিরি, গোলে-বকৌলি, মহাশ্বেতা-পুণ্ডরীক, আরও কতজনের বুকের রক্তে রাঙা হয়ে আছে। চির-যৌবনের চির-কণ্টকাকীর্ণ পথ। চিরকালের রোমিও-জুলিয়েট দুষ্মন্ত-শকুন্তলা যেন ওরা!