মৃত্যুক্ষুধা – ০৯

মৃত্যুক্ষুধা – ০৯

সেদিন বড়োবউ, প্যাঁকালে, তার মা আর পাঁচিতে মিলে একটা গোপন পরামর্শসভা বসেছিল।

প্যাঁকালের অতিমাত্রায উত্তেজিত হয়ে বললে, “আমি তা কখনও পারব না। আমি কালই চললাম রানাঘাট। সেখেনে রোজ চোদ্দো আনা করে পয়সা পাব।”

তার মা অনুনয়ের স্বরে বললে, “রাগ করিস কেন বাবা? এমন তো সব গরিব ঘরেই হচ্ছে আমাদের। তা ছাড়া ওর চাঁদপনা মুখ যে কিছুতেই ভুলতে পারিনে। অমন বউ পর হয়ে যাবে। আমার কপালই যদি না পুড়বে তাহলে সোভানই বা মরবে কেন, আর তোকেই বা এ উপরোধ করতে যাব কেন?”

পাঁচি মায়ের কথায় সায় দিয়ে বলে উঠল, “তা ভাই, তোমার এক আশ্চয্যি লজ্জা! অমন তো কতই হচ্ছে! একদিন ভাবি বলেছ বলে বুঝি আর ইয়ে করতে নেই! দুদিন বাধবে, তা-পর আপনি সরগড় হয়ে যাবে বলে বুঝি আর ইয়ে করতে নেই! দুদিন বাধবে, তা-পর আপনি সরগড় হয়ে যাবে, দেখে নিয়ো।”

প্যাঁকালে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, “তুই থাম পাঁচি। যা লয় তাই! তুই তবে কেনে নিকে করলিনে তোর ভাসুরকে?”

পাঁচি ছেলের মা হলেও তার ছেলেমানুষি করার বয়স আজও যায়নি। তার ভাসুরকে নিকে করার ইঙ্গিত শুনে সে একেবারে তেলে-বেগুনে হয়ে বলে উঠল, “তা ইখেনে নিকে করবে কেনে, কুর্শিকে যে বিয়ে করবে খেরেস্তান হয়ে!”

প্যাঁকালে রেগে উঠে যেতে যেতে বললে, “রইল তোর নিকে, আমি চললুম‌!” বলেই বেড়িয়ে গেল!

বড়োবউ বললে, “তখনই বলেছিলাম মা, যে, এ হয় না। তা ছাড়া, তোমার ছেলে রাজি হলেও সে যা মেয়ে – সে কিছুতেই রাজি হত না।”

শাশুড়ি মস্ত বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, “কপাল মা, কপাল! কী করবি বল! ওই বুড়ো মিনসেই ছিল ছুঁড়ির কপালে। বলেই সোভানকে উদ্দেশ করে কান্না জুড়ে দিল।

বড়োবউ একটু রেগেই বললে, “তোমারই মা বাড়াবাড়ি! জান যে মেজোবউ ও নিকেতে রাজি নয়, তবু ওই নিয়ে দিনরাত কান্নাকাটি। তুমিই তাড়াবে এমনি করে মেজোবউকে!”

এমন সময় মেজোবউ তার বাপের বাড়ি থেকে এসে পৌঁছল। বড়োবউ হেসে বললে, “কি লো, জোড়ে ফিরলি, না বিজোড়ে?”

মেজোবউ বড়োবউয়ের রহস্যের উত্তর না দিয়ে তিক্তকণ্ঠে বলে উঠল, “তা তোমরা যে-রকম করে তুলছ অবস্থা, তাতে জোড়াই খুঁজে নিতে হবে দেখছি আমায়।” বলেই শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললে, “মাগো মা! পাড়ায় ঢি-ঢিক্কার পড়ে গেল এই নিয়ে! কেলেঙ্কারির আর বাকি রইল না! আচ্ছা মা, এমনি করে তুমি আমায় দেশ-ছাড়া করতে চাও নাকি? তুমি জান, আমার বোন বেঁচে রয়েছে আজও। এক বোন বেঁচে থাকতে আর এক বোনকে নিকে করা যায় কি-না, যাও মউলবি সায়েবকে জিজ্ঞেস করে এসো?” বলেই দাওয়ায় বসে পড়ে পা দুলোতে লাগল। ছোটো মেয়ে রাগলে যেমন করে।

বড়োবউ খুশি হয়ে বলে উঠল, “ঠিক বলেছিস মেজোবউ। দেখ ও কথাটা আমাদের কারুর মনেই ছিল না যে, এক বোন থাকতে আর এক বোনকে নিকে করা যায় না। সত্যিই মেজোবউ, তোর-না জানা কিছু নেই দেখছি। আমাদের হাফেজ সাহেব হার মেনে যায় তোর কাছে।” বলেই মেজোবউ কোন দিন কোন বিষয়ে কী ফতোয়া দিয়েছিল, তারই সালংকার বর্ণনা শুরু করে দিলে।

তার শাশুড়ির কিন্তু সন্দেহ আর ঘোচে না। সে কান্না থামিয়ে বলে উঠল, “তুই থাম বড়োবউ, অমন এনেক দেখেছি। কত জনা আমাদের চোখের সামনে এক বোনকে তালাক দিয়ে আর এক বোন কে নিকে করল। ও মুখপোড়া মিনসের মেজোবউয়ের বড়ো বোনকে তালাক দিতে কতক্ষণ?” বলেই কান্নার জের চালায়।

মেজোবউয়ের খোকাটি রোজকার মতো কান্না থামাতে যায়, “দাদি গো, চুপ কর।” মেজোবউ ছেলেকে হাত ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যায়। বলে, “তোর বাবা-কেলে দাদি! পোড়ামুখো! সব তাতেই ফফর দালালি।”

খোকা ছেলেবেলা ঝেকেই দাদি-ন্যাওটা! যত খায়, তত বলে, “ও দাদি গো, আমায় মেরে ফেললে।”

বৃদ্ধা বউয়ের কাছ থেকে ছেলে ছিনিয়ে নিয়ে মেজোবউয়ের বাপ-মাকে গাল দিতে থাকে! তারপর আঁচল দিয়ে খোকার চোখ মুঝিয়ে দিতে দিতে বলে, “দেখ বড়োবউ, সোভান ঠিক এমনটি দেখতে ছিল, ছেলেবেলায় ঠিক এমনি করে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদত! ঠিক তেমনি আওয়াজ।”

বড়োবউ বলে, “ওর কপালের ওইখেনটা কিন্তু ওর বড়ো চাচার মতো, লয় মেজোবউ?”

মেজোবউ কথা কয় না। দাওয়ায় বসে আনমনে পা দোলায় আর চাপাসুরে গান করে।

সেজোবউ পাশ ফিরে কাশতে থাকে। মনে হয়, ওর প্রাণ গলায় ঠেকেছে এসে। কবর দেবার জন্য বাঁশ কাটার শব্দটা যেমন ভীষণ করুণ শোনায়, তেমনই তার কাশির শব্দ।

তার পাশে শিশু আর কাঁদতেও পারে না, কেবল ধুঁকতে থাকে। যেন মৃত্যুর পাখার শব্দ।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন একপাল ছেলেমেয়ে চিৎকার করতে করতে ঘরে এসে বললে, “ওগো, তোমাদের বাড়িতে পাদ‍‌রি সায়েব আর মেম আসছে!” বাড়িসুদ্ধ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল! সত্যি-সত্যিই একজন পাদরি সায়েব, সঙ্গে একজন নার্স নিয়ে ঘরে ঢুকল এসে। বউ-ঝিরা ঘরে ঢুকে পড়ল। শুধু প্যাঁকালের মা হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সায়েবের মুখের দিকে।

সায়েব বাংলা ভালোই বলতে পারে। বললে, “টোমরা ভয় করবে না। হামি টোমাদিগের কষ্ট শুনিয়া আসিয়াছে। টোমাডের কে পীরিট আছে, টাহাকে ঔষড ডিবে!”

প্যাঁকালের মা একটু মুশকিলেই পড়ল প্রথমে। পরে আমতা আমতা করে বললে, “খোদা তোমার ভালো করবেন সায়েব। ওই আমার বউ আর তার খোকা শুয়ে । দেখো, যদি ভালো করতে পার । কেনা হয়ে থাকব তাহলে?”

সায়েব খুশি হয়ে বললে, “কোনো চিনটা নাই। জিশু বালো করিয়ে ডেবে। জিশুকে প্রারঠনা করো।” তারপর এগিয়ে মাটিতেইতে বসে পড়ে শিশুকে পরীক্ষা করতে লাগল। সাহেব একজন ভালো ডাক্তার।

নার্সকে ইংরেজিতে কী ইঙ্গিত করে সায়েব বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। মুখ তার বিষণ্ণ গম্ভীর।

নার্স সেজোবউকে পরীক্ষা করতে লাগল। নার্সের পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর দুজনে বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ বলা-কওয়া করলে কীসব। তারপর প্যাঁকালের মাকে ডেকে কতকগুলো ওষুধ দিয়ে খাওয়াবার সময় ইত্যাদি সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে চলে গেল। বলে গেল, আবার এসে দেখে যাবে বিকালে।

প্যাঁকালের মা খুশিতে প্রায় কেঁদে ফেললে। বললে, “ছুঁড়ির কপাল ভালো মেজোবউ, এত ওষুধ খেয়েও কি আর মরে? হেদে দেখ, কতকগুলোন ওষুধ দিয়েছে।”

মেজোবউ বললে, “মেম সায়েব যাওয়ার বেলায় একটা টাকা দিয়ে গেছে সেজোবউয়ের পথ্যি কিনতে। বলেছে, বেদানার রস খাওয়াতে। বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগল। মেজোবউ কাঁদতে লাগল, “কপালে এত দুখ্যুও লিখেছিলেন আল্লা। সেজোবউয়ের যাওয়ার সময়ও ঘরের পয়সায় কিনে দুটো আঙুর কি একটা বেদনা দিতে পারলুম না! শুকিয়ে মরলেও কেউ শুধোয় না এসে। ঝ্যাঁটা মার নিজের জাতের মুখে, গেঁয়াতকুটুমের মুখে। সাধে সব খেরেস্তান হয়ে যায়!”

শাশুড়ি জেঁদে বলে, “যা বলেছিস মা!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *