মৃত্যুক্ষুধা – ০১

মৃত্যুক্ষুধা (উপন্যাস)
কাজী নজরুল ইসলাম

মৃত্যুক্ষুধা – ০১

পুতুল-খেলার কৃষ্ণনগর।

যেন কোন খেয়ালি খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর।

খোকার চলে-যাওয়া পথের পানে জননির মতো চেয়ে আছে – খোকার খেলার পুতুল সামনে নিয়ে।

এরই একটেরে চাঁদ-সড়ক। একটা গোপন ব্যথার মতো করে গাছ-পালার আড়াল টেনে রাখা।

তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মুসলমান আর ‘ওমান কাত‍্‍লি’ (রোমান ক্যাথলিক) সম্প্রদায়ের দেশি কনভার্ট ক্রিশ্চানে মিলে গা-ঘেঁঘাঘেঁষি করে থাকে এই পাড়ায়।

এরা যে খুব সদ্ভাবে বসবাস করে এমন নয়। হিন্দুও দু-চার ঘর আছে – চানাচুর ভাজায় ঝালছিটের মতো। তবে তাদেরও আভিজাত্য-গৌরব ওখানকার মুসলমান-ক্রিশ্চান – কারুর চাইতে কম নয়।

একই-প্রভুর-পোষা বেড়াল আর কুকুর যেমন দায়ে পড়ে এ ওকে সহ্য করে – এরাও যেন তেমনই । পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে গোমরায় যথেষ্ট, অথচ বেশ মোটা রকমের ঝগড়া করার মতো উৎসাহ বা অবসর নেই বেচারাদের জীবনে।

জাতিধর্মনির্বিশেষে এদের পুরুষেরা জনমজুর খাটে – অর্থাৎ রাজমিস্ত্রি, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ওই রকমের কোনো-একটা-কিছু করে। আর, মেয়েরা ধান বাড়িতে ভানে, ঘর-গেরস্তালির কাজকর্ম করে, রাঁধে, কাঁদে এবং নানান দুঃখধান্দা করে পুরুষদের দুঃখ লাঘব করবার চেষ্টা করে।

বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনে দুঃখকে বড়ো করে দেখবার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়তো মস্ত বড়ো একটা অঘটন ঘটত।

এরা যেন মৃত্যুর মাল-গুদাম! অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গেই সাপ্লাই! আমদানি হতে যতক্ষণ, রপ্তানি হতেও ততক্ষণ!

মাথার ওপরে তেড়ির মতো এদের মাঝে দু-চারজন ‘ভদ্দর-নুক’ও আছেন। কিন্তু এতে তাদের সৌষ্ঠব বাড়লেও গৌরব বাড়েনি। ওইটেই যেন ওদের দুঃখকে বেশি উপহাস করে।

বিধাতার দেওয়া ছেলেমেয়ে এরা বিধাতার হাতেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিত মনে পান্তা-ভাত খেয়ে মজুরিতে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে এসে বড়ো ছেলেটাকে বেশ করে দু-ঘা ঠেঙায়, মেজেটাকে সম্বন্ধের বাচবিচার না রেখে গালি দেয়, সেজোটাকে দেয় লজঞ্চুস, ছোটোটাকে খায় চুমো, তারপর ভাত খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।

ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে – রোদে-পোড়া, ধূলিমলিন, ক্ষুধার্ত, গায়ে জামা নেই। অকারণ ঘুরে বেড়ায়, কাঠ কুড়োয়, সুতোকাটা ঘুড়ির পেছনে ছোটে এবং সেই সঙ্গে খাঁটি বাংলা ভাষার চর্চা করে।

এরাই থাকে চাঁদসড়কের চাঁদবাজার আলো করে।… এই চাঁদসড়কেরই একটা কলতলায় জল-নেওয়া নিয়ে সেদিন মেয়েদের মধ্যে একটা ধুমখাত্তর ঝগড়া বেধে গেল।

কে একজন ক্রিশ্চান মেয়ে জল নিতে গিয়ে কোন এক মুসলমান মেয়ের কলসি ছুঁয়ে দিয়েছে। এদের দুই জাতই হয়তো একদিন এক জাতিই ছিল – কেউ হয়েছে মুসলমান, কেউ ক্রিশ্চান। আর এক কালে এক জাতি ছিল বলেই এরা আজ এ ওকে ঘৃণা করে। এই দুই জাতের দুইটি মেয়েই কম-বয়সি এবং তাদের বন্ধুত্বও পাকা রকমের। কাজেই ঝগড়া ওই মেয়ে দুটি করেনি। করছে তারা – যারা এই অনাছিষ্টি দেখছে।

গজালের মা-র পাড়াতে কুঁদুলি বলে বেশ নামডাক আছে। সে-ই ‘অপোজিশন লিড’করছে মুসলমান-তরফ থেকে।

অপরপক্ষে হিড়িম্বাও হটবার পাত্রী নয়। তার ভাষা গজালের মা-র মতো ক্ষুরধার না হলেও তার শরীর এবং স্বর এ দুটোর তুলনা মেলে না! –একেবারে সেকালের ভীম-কান্তা হিড়িম্বা দেবীর মতোই!

গজালের মা গজালের মতোই সরু – হাড্ডি-চামড়া,সার কিন্তু তার কথাগুলো বুকে বেঁধে গজালের মতোই নির্মম হয়ে। গজাল উঠিয়ে ফেললেও দেয়ালে তার দাগ যেমন অক্ষয় হয়ে যায়, ঝগড়া থেমে গেলেও গজালের মা-র কটূক্তির জ্বালা তেমনই কিছুতেই আর মিটতে চায় না।

ঝগড়া তখন অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং গজালের মা বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, “হারাম-খোর, খেরেস্তান কোথাকার! হারাম খেয়ে খেয়ে তোদের গায়ে বন-শুয়োরের মতো চর্বি হয়েছে, না লা?”

‍গজালের মাকে আর বলবার অবসর না দিয়ে হিড়িম্বা তার পেতলের কলসিটা খং করে বাঁধানো কলতলায় সজোরে ঠুকে, অঙ্গ দুলিয়ে, থ্যাবড়ানো গোবরের মতো মুখ বিকৃত করে হুংকার দিয়ে উঠল, “তা বলবি বইকী লা সুঁটকি! ছেলের তোর খেরেস্তানের বাড়ির হারাম-রাঁধা পয়সা খেয়ে চেকনাই বেড়েছে কিনা!’”

গজালের মা রাগের চোটে তার ভরা কলসির সব জলটা মাটিতে ঢেলে ফেলে আরও কিছুটা এগিয়ে খিঁচিয়ে উঠল, “ওলো আগ-ধুমসি (রাগধুমসি)! ওগো ভাগলপুরে গাই! ওলো, আমার ছেলে খেরেস্তানের ভাত রাঁধে নাই লো, আমার ছেলে জজ সায়েবের খানসাহেব ছিল – জজ সাহেবের লো, ইংরেজের!”

পুঁটের মাও খেরেস্তান, তার আর সইল না। সে তার ম্যালেরিয়া-জীর্ণ কণ্ঠটাকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণকরে বলে উঠল, “আ-সইরন সইতে নারি, শিকেয় ইয়ে দিয়ে ঝুলে মরি! বলি, অ-গজলের মা! ওই জজ সাহেবও আমাদেরই জাত। আমরা ‘আজার’ (রাজার) জাত, জানিস?”

দু-তিনটি ক্রিশ্চান মেয়ে পুঁটের মার এই মোক্ষম যুক্তিপূর্ণ জবাব শুনে খুশি হয়ে বলে উঠল, “আচ্ছা বলেছিস মাসি‌!”

খাতুনের মা কাঁখে কলসি, পেটে পিলে আর কাঁধে ছেলে নিয়ে এতক্ষণ শোনার দলে দাঁড়িয়েছিল এবং মাঝে মাঝে মূলগায়েনের দোয়ারকি করার মতো গজালের মার সুরে সুর মিলিয়ে দু-একটা টিপ্পনি কাটছিল। কিন্তু এইবার আর তার সইল না। ছেলে, পিলে আর কলসি-সমেত সে একেবারে মূলগায়েনের গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল, এবং ক্রিশ্চানদের বউদের লক্ষ করে যে ভাষা প্রয়োগ করল, তা লেখা তো যায়ই না, শোনাও যায় না।

এইবার হিড়িম্বা ফস করে তার চুল খুলে দিয়ে একেবারে ‘এলোকেশী বামা’হয়ে দাঁড়াল, এবং কোমরে আঁচল জড়াতে জড়াতে খাতুনের মার মুখের সামনে হাত দুটো বারকয়েক বিচিত্র-ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে দিয়ে বলে উঠল,“তুই আবার কে লো উঝড়োখাগি! তবু যদি ভাতারের ধুমসুনি না খেতিস দুবেলা!”তারপর তার অপ-ভাষাটার উত্তর তার চেয়েও অপ-ভাষায় দিয়ে সে গজালের মা-র পানে চেয়ে বললে, “হ্যাঁ লা ভাতার-পুতখাগি! তিন বেটাখাগি। তোর ছেলে না হয় জজ সাহেবের বাবুর্চিগির করত, আর সে ছেলেকেও তো দিয়েছিস কবরে। আর তুই নিজে যে সেদিন আমফেসাদ বাবু (রামপ্রসাদ বাবুর) হাঁড়ি ঠেলে রুনুন (উনুন) কেড়ে এলি! ওই আমফেসাদ বাবু তোদের মউলবি সাহেব নাকি লা? হাত শোঁক এখনও খেরেস্তানের গন্ধ পাবি!”

এর চরম উত্তর দিল গজালের মা, বেশ একটু ছুরির মতো ধারালো হাসি হেসে, “বলি ওলো হুতমোচোখি, ওই ‘আমফেসাদ’ বাবু তো আমার তলপেটে চালের পোটলা পেয়ে মাথায় চটি ঝাড়েনি! ছেলের বেয়ারাম হয়েলো (হয়েছিল), তাই ওর বাড়ি চাকরি করতে গিয়েলাম (গিয়েছিলাম), তাই বলে এক গেলাস পানি খেয়েছি ও বাড়িতে? বলুক দেখি কোন কড়ুই-রাঁড়ি বলবে!”

শেষের কথাগুলো হিড়িম্বার কানে যায়নি। সে ‘ছিটেন পাড়ার’ (প্রোটেস্টান্ট পাড়ার) পাদরি সাহেব মিস্টার রামপ্রসাদ হাতির বাড়ি চাকরি করতে গিয়ে সত্যিই একবার চাল চুরির জন্য মার খেয়েছিল। কিন্তু সে কেলেঙ্কারির কথাটা এতগুলো মেয়ের মধ্যে ঘোষণা করে দেওয়াতে সে এইবার যা কাণ্ড করতে লাগল – তা অনির্বচনীয়! চুল ছিঁড়ে, আঙুল মটকে, চেঁচিয়ে, কেঁদে, কুঁদে সে যেন একটা বিরাট ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে ফেললে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে গালির বিগলিত ধারা – অনর্গল গৈরিকস্রাব!

যত গালি তার জানা ছিল,ছব্য, অভব্য, শ্লীল, অশ্লীল, সবগুলো একবার, দুবার, বারবার আবৃত্তি করেও তার যেন আর খেদ মেটে না!

‘লুইস-গানার’যেন মিনিটে সাতশো করে গুলি ছুঁড়ছে!

ছেলেমেয়ের ভিড় জমে গেল! ঝগড়া তো নয়, মোরোগ-লড়াই!

ওরই মধ্যে একটা গয়লাদের ছেলে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,“ওরে পচা রে, উই শালা পচা! ছুটে আয় রে ছুটে আয়! তোর দিদিমা ‘মা-কালি’হয়ে গিয়েছে!”

এই কুড়ুম-তাল ঝগড়ার মধ্যেও কয়েকটা বউ-ঝি হেসে ফেললে!

মুসলমান তরফের একটা বউ আর থাকতে না পেরে ঘোমটার ভিতর থেকেই বলে উঠল, “হাতে একখানা খাঁড়া দিলেই হয়!”

তার চেয়েও সুরসিকা একটি আধ-বয়েসি মেয়ে পিছনে থেকে বলে উঠল, “কাপড়টাও খুলে পড়তে আর বাকি নেই লো!”

মুসুলমান ছেলেমেয়েরা যত না হাসে, তত চেঁচায়!

ক্রিশ্চান ছেলেরা ছোঁড়ে ধুলো।

বেধে যায় একটা কুরুক্ষেত্তর!..

কিন্তু দুঃখের ইন্দ্রপ্রস্থ নিয়ে এ কুরুক্ষেত্র ওকানকার নিত্যঘটনা –একেবারে ‘মাছভাত!’

ঝগড়া হতেও যতক্ষণ – ভুলেতেও ততক্ষণ।

দুঃখ অভাব হয়তো এদের মঙ্গলই করেছে। এত দুঃখ যদি এদের না থাকত তাহলে এমন প্রচণ্ড ঝগড়ার পরের দিনই আবার ‘দিদি’‘বুবু’‘মাসি’‘খালা’বলে হেসে কথা কইতে ওদের বাধত!

এরা সব ভোলে – না কেবল তাদের অনন্ত দুঃখ, অনন্ত অভাব!

এই না-ভোলা দুঃখের পাথারের এরা যেন চর-ভাঙা গাছের শাখা ধরে ভেসে চলেছে। দুঃখের যন্ত্রণায় মন থাকে এদের তিক্ত হয়ে, ভাষাও বেরোয় তাই কটু হয়েই, কিন্তু পরক্ষণেই যখন দেখে – সে একা অসহায়, ভাসছে অকূলপাথারে, তখন সে তারই দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় –যাকে সে এতক্ষণ ধরে অতিবড়ো কটূক্তি করেছে।

তাদের এ জলের জীবন-যাত্রার কি ডাঙার সুখী মানুষের মতো পরম নিশিন্ত মনে বৎসরের পর বৎসর ধরে এ ওর পানে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকবার উপায় আছে?

এ দুঃখের বোঝা যদি এদের এত বিপুল না হয়ে উঠত, তাহলে এরাও এতদিন ভদ্রলোকের মতো মানুষ জাতির মহাশত্রু হয়ে দাঁড়াত – বড়ো বড়ো যুদ্ধ বাধিয়ে দিত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *