মৃত্যুকূপ
ব্যারামে ধুঁকছিলাম। মরতে বসেছিলাম। যন্ত্রণায় মনের ভেতর পর্যন্ত মোচড় দিচ্ছিল। ওরা যখন আমার বাঁধন খুলে দিয়ে উঠে বসার অনুমতি দিল–মনে হলো, এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবো। প্রাণদন্ডের হুকুমটুকুই কেবল শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর সব শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে বিচারকের ঠোঁটের রঙ দেখতে পেয়েছিলাম। সাদা হয়ে গেছে। নারকীয় নিপীড়নের এই দন্ড তাদের মুখ দিয়ে বের করতে গিয়েই অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। আমার তাহলে কী হবে। জ্ঞান হারালাম তারপরেই।
পুরোপুরি জ্ঞান ফেরার আগে আবছা একটা অনুভূতি মন আর শরীরের ওপর অসহ্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। সব মনেও করতে পারছি না। বড়ো অস্পষ্ট। বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ড যেন ফেটে যাচ্ছিল।
চোখ খুলিনি এতক্ষণ। তবে বুঝতে পারছিলাম, শুয়ে আছি চিৎ হয়ে। বাঁধন নেই। হাত বাড়ালাম। শক্ত আর ভিজে মতো কী যেন হাতে ঠেকল। কী হতে পারে জিনিসটা, এই ভাবনাতেই কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিলাম। চোখ মেলার সাহস হলো না।
এক ঝটকায় দুচোখের পাতা খুলে ফেললাম আর সইতে পারলাম না বলে। নিঃসীম অন্ধকার। পাতাল কারাগার নিশ্চয়। মেঝে তো পাথরের।
তবে কি আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে গেল? নিদারুণ ভয়ে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম। দুহাত সামনে বাড়িয়ে টলেটলে গিয়েছিলাম। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু সমাধি গহ্বরের দেওয়াল তো হাতে ঠেকবে।
ঠেকেছিল হাতে। পাথরের দেওয়াল নিশ্চয়। মসৃণ, হড়হড়ে, ঠান্ডা। হাত বুলিয়ে একপাক ঘুরে এসেছিলাম। প্রতি পদক্ষেপে গা শিরশির করে উঠেছিল। টোলোভো-র এই পাতাল কারাগারের অনেক গা-হিম-করা গল্লামাথায় ভিড় করে আসছিল। তাই পা টিপে টিপে অনেকক্ষণ যাওয়ার পর মনে হলো, গোল হয়েই ঘুরছি দেওয়াল ধারে।
কিন্তু শুরু করেছিলাম কোত্থেকে? পকেট হাতড়ালাম। ছুরিটা নেই। আমার নিজের জামাকাপড় নেই। আলখাল্লার মতো কী একটা পরিয়ে রেখেছে–অজ্ঞান অবস্থায় টের পাইনি। ছুরিটা থাকলে দেওয়ালের খাঁজে খুঁজে রেখে একপাক ঘুরে এসেই বুঝতে পারতাম–শুরু করেছিলাম কোথা থেকে।
আলখাল্লা থেকে একটা লম্বা উল টেনে নিলাম। বিছিয়ে রাখলাম মেঝের ওপর দেওয়াল থেকে একটু লম্ব ভাবে। মেঝেতে পা রগড়ে রগড়ে এক পাক ঘুরে আসতেই পা ঠেকল উলে।
কিন্তু-ক-পা হাঁটলাম? এমন কাহিল বোধ করছি যে মাথাও ঠিক রাখতে পারছি না। স্যাঁতসেঁতে হড়হড়ে মেঝের ওপর দিয়ে আবার পা রগড়ে এগোতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম। পড়েই রইলাম–এত অবসন্ন। ঘুমিয়ে পড়লাম ওই ভাবেই।
ঘুম ভাঙার পর আবার দেওয়াল ধরে টহল দেওয়া শুরু করলাম। মুখ থুবড়ে পড়ার আগে আটচল্লিশবার পা ফেলেছিলাম–এখন বাহান্নবার পা ফেলেই উলের ওপর এসে গেলাম। তার মানে, কারাগারের বেড় একশ পা। অর্থাৎ পঞ্চাশ গজ তো বটেই। তবে আকৃতিটা কীরকম, তা বুঝতে পারলাম না। হাত বুলানোর সময়ে অবশ্য অনেকগুলো কোণে হাত ঠেকেছিল। তা থেকে পাতাল-সমাধির আকার ধারণায় আনা যায়নি।
এই যে এত গবেষণা করে যাচ্ছিলাম, এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল সামান্য–আশা ছিল না একেবারেই। তবে একটা আবছা কৌতূহল আমাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নিরন্ধ্র এই তমিস্রার মধ্যে। প্রথম-প্রথম খুব হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলেছিলাম। কেন না, মেঝে তো শ্যাওলা হড়হড়ে রীতিমতো বিশ্বাসঘাতক। যদিও শক্ত মেঝে, তবুও পা ফেলতে ভয় হয়।
তারপর অবশ্য ভয় কেটে গিয়েছিল। ফটাফট পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম–মতলব সমাধি গহ্বরের ব্যাস কতখানি, তা হেঁটে দেখে নেব। তাই আড়াআড়িভাবে হাঁটছিলাম সীমাহীন আঁধার ভেদ করে। দশ বারো পা এই ভাবে যাওয়ার পরেই, আলখাল্লা থেকে টেনে ছিঁড়ে নেওয়া উলের খানিকটা পায়ে জড়িয়ে যাওয়ায়, হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম কঠিন শিলার ওপর।
ধড়াম করে আচমকা আছাড় খেয়েছিলাম বলেই চমকে দেয়ার মতো পরিস্থিতিটা সেই মুহূর্তে খেয়াল করতে পারিনি। সেকেন্ড কয়েক ওইভাবে মুখ থুবড়ে ধরাশায়ী থাকার পর ব্যাপারটা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
ব্যাপারটা এই। আমার চিবুক কারাগারের পাথুরে মেঝেতে ঠেকে আছে ঠিকই, কিন্তু ঠোঁট আর মুখের ওপর দিকের অংশ কিছুই স্পর্শ করছে না। যদিও মনে হচ্ছে, থুতনি থেকে বেশ উঁচুতেই রয়েছে এরা-অথচ ছুঁয়ে যাচ্ছে না কিছুই। একই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন কপালে এসে লাগছে পাকের। বাষ্প–নাকে ভেসে আসছে পচা ফাঙ্গাসের অদ্ভুত গন্ধ।
দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম সামনে–শিউরে উঠেছিলাম তৎক্ষণাৎ। আমি মুখ থুবড়ে পড়েছি একটা গহ্বরের কিনারায়। সে গহ্বরের তলদেশ কোথায়, তা তো জানিই না–গোলাকার গহ্বরের পরিধি কতটা, তাও বোঝবার উপায় আমার নেই। কিনারার ধার থেকে হাতড়ে হাতড়ে এক টুকরো পাথর খসিয়ে এনে ফেলে দিয়েছিলাম গহ্বরের মধ্যে। গহ্বরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে পাথরের টুকরো বেগে নেমে গিয়েছিল পাতাল-প্রদেশে–ধাক্কার শব্দ আর প্রতিধ্বনির ঢেউ তুলে এনে আছাড় দিয়ে দিয়ে ফেলে গিয়েছিল কানের পাতায়। তারপর পাথর নিজেই চাপা শব্দে গোত খেয়েছিল জলের মধ্যে–প্রবলতর প্রতিধ্বনি গুমগুম শব্দে ধেয়ে এসেছিল ওপর দিকে।
একই সঙ্গে আচমকা একটা শব্দ ভেসে এসেছিল মাথার ওপর দিক থেকে। ঠিক যেন একটা দরজা খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। চকিতের জন্য আলোর রেখা নিরন্ধ্র আঁধারকে চমকিত করে দিয়ে আঁধারেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
কী ধরনের মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছিল আমার জন্য; তা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠেছিলাম। নিজের গলার আওয়াজ শুনেও তখন চমকে উঠেছিলাম। দুধরনের মৃত্যুর ব্যবস্থা আছে শুনেছিলাম এই ভূগর্ভ কারাগারে। প্রথমটা নিষ্ঠুর নির্যাতন সইতে না পেরে যেন তিল তিল করে মরতে হয়। দ্বিতীয়টা আরও ভয়াবহ; আমাকে এই দ্বিতীয় মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল। আমার কপাল ভালো। তাই আর এক পা এগোইনি। মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম বলেই গহ্বরের মধ্যে তলিয়ে যাইনি।
আতঙ্কে আমার প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কেঁপে উঠেছিল নারকীয় গহ্বরের তলিয়ে যাওয়ার পরের অবস্থাটা কল্পনা করতে গিয়ে। নিপীড়নের আরও অঢেল ব্যবস্থা নিশ্চয় মজুদ রয়েছে গহ্বরের তলদেশে–বেঁচে গেছি ভাগ্য সহায় হয়েছিল বলে।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠক ঠক করে কাঁপছিল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। কীভাবে যে হাতড়ে হাতড়ে পাথুরে দেওয়ালের পাশে ফিরে এসেছিলাম, তা শুধু আমি জানি আর ঈশ্বর জানেন।
পণ করেছিলাম, এই দেওয়ালের আশ্রয়েই থাকব এখন থেকে। মরতে হয় এখানেই মরব–নিতল গহ্বরের আতঙ্কঘন তলদেশে আছড়ে পড়ার চেয়েও তা শতগুণে শ্রেয়। যেহেতু গহ্বরের তলায় কী আছে তা জানি না–তাই অজানা বিভীষিকার কল্পনা ডালাপালা মেলে ধরে পঙ্গু করে তুলল আমার মস্তিষ্ককে। না জানি এই কারাগারের নানা দিকেই এই ধরনের আরও কত কুৎসিত আর বীভৎস মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রেখে দিয়েছে অমানুষ জল্লাদরা। আমার মনের অবস্থা তখন যদি অন্য রকম হতো, তাহলে বোধহয় গহ্বরে ঝাঁপ দিয়েই সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে দিতাম। সেটাও যে সহজতর হতো–সে ভাবনাও কুরে কুরে খাচ্ছিল মাথার কোষগুলোকে। কেনো, আমি তো শুনেছি, এই পাতাল-কারাগারের যাদের আনা হয়–নিমেষ মৃত্যু তাদের কপালে লেখা থাকে না, এদের পৈশাচিক প্ল্যানই হলো একটু একটু করে মানরা কয়েদীকে প্রক্রিয়াগুলো শুনলেও নাকি গায়ের রক্ত পানি হয়ে যায়। নিদারুণ উত্তেজনায় জেগেছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর ঘুম নামল চোখে। ঘুম ভাঙার পর হাতের কাছেই পেলাম এক জগ জল আর এক টুকরো রুটি। প্রথমবার যখন ঘুমে বেহুশ হয়েছিলাম, তখনও এই দুটো জিনিস পেয়েছিলাম ঘুম ভাঙার পরেই। এখনও কেউ এসে রেখে গেছে আমাকে ঘুমে অচেতন দেখে–আড়াল থেকে তাহলে দেখছে আমার মৃত্যু যন্ত্রণা! পিশাচ কোথাকার!
ক্ষিদের চোটে কোঁৎ কোঁৎ করে গিলে নিয়েছিলাম রুটি, ঢকঢক করে খেয়েছিলাম পানি। তারপরেই আশ্চর্য ঘুম নামল দুচোখে। নিশ্চয় ঘুমের আরক শিােনো ছিল পানিতে। ঘুমালাম তাই মড়ার মতো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, বলতে পারবো না। তবে ঘুম যখন উড়ে গিয়েছিল চোখের পাতা থেকে–তখন আশপাশের দৃশ্য আর ততটা অদৃশ্য থাকেনি। যেন গন্ধক-দ্যুতির মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল প্রতিটি বস্তু। বিচিত্র এই প্রভাব উৎস কোথায়, প্রথমে তা ঠাহর করতে পারিনি–কেননা আমি তখন আবিষ্ট হয়ে দেখছিলাম কারাগারের চেহারা।
ভুল করেছিলাম কারাগারের সাইজের আন্দাজি হিসেবে। দেওয়ালের পরিধি পঁচিশ গজের বেশি হবে কোনমতে। ছোটো হলেও পরিত্রাণের পথ যখন নেই, তখন খামোখা তা নিয়ে আর ভেবে লাভ কী। তাই ছোটোখাটো ব্যাপারগুলোর দিকে কৌতূহল জাগ্রত করেছিলাম। পরিধির মাপে হিসাব ভুল করেছিলাম কীভাবে, তাও বুঝেছিলাম।
প্রথমবারে প্রায় এক চক্কর ঘুরে এসে হোঁচট খেয়ে পড়েছিলাম উলের কয়েক পা দূরেই। তারপর টেনে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই আবার উলটোদিকে হেঁটেছিলাম। ঘুমের ঘোরে বাঁ দিকে না গিয়ে ডানদিকে হেঁটেছিলাম। তাই দ্বিগুণ মনে হয়েছিল গহ্বরের বেড়।
কারাগারের আকৃতি নিয়েও ভুল ধারণা করেছিলাম। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে (ঘুমের ঘোরে) যেগুলোকে কোণ বলে মনে হয়েছিল–আসলে তা খাঁজ। অজস্র খাঁজকাটা দেওয়াল। দেওয়াল ঢুকে রয়েছে এই সব খাজের মধ্যে। অন্ধকারে তাই মনে হয়েছিল, দেওয়াল বুঝি গোল হয়ে ঘুরে গেছে। এখন আর সে বিভ্রান্তি নেই। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ঘরটা চৌকোনা। দেওয়ালও পাথর দিয়ে তৈরি নয়। লোহা বা অন্য কোনো ধাতু দিয়ে গড়া। অজস্র কিম্ভূত ছবি আঁকা রয়েছে চার দেওয়ালেই। কুসংস্কারে ডুবে থাকা মঠের সন্ন্যাসীদের মগজ থেকেই কেবল এরকম উদ্ভট কল্পনার আকৃতি সম্ভবপর হয়। প্রতিটি মূর্তিই অপার্থিব, অমানুষিক, পৈশাচিক–কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেই মাথার মধ্যে ঘোর লেগে যায়–রক্ত হিম হতে শুরু করে। যদিও পাতালের স্যাঁৎসেঁতেনির জন্যে বিদঘুঁটে আকৃতিদের রঙ ফিকে হয়ে এসেছে–বিকট অবয়বগুলোও আর তেমন স্পষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও যা দেখতে পাচ্ছি ওই অপার্থিব আলো যার মধ্যে দিয়ে–তার প্রতিক্রিয়াতেই তো আমার মাথার চুল খাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
পাথুরে মেঝের ঠিক মাঝখানে রয়েছে পাতাল কূপ। গোটা ঘরে গহ্বর ওই একটাই। গোলাকার।
আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি একটা কাঠের কাঠামোর ওপর। ঘুমে অচেতন থাকার সময়ে আমাকে এই অবস্থায় আনা হয়েছে। মজবুত পাটি দিয়ে এই কাঠামোর সঙ্গে আমাকে পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেরিয়ে আছে শুধু মুন্ডু আর বাঁ হাতের একটুখানি–যাতে কষ্টেসৃষ্টে হাত বাড়িয়ে মাটির থালায় রাখা মাংস টেনে নিয়ে মুখে পুরতে পারি।
পানির জগ উধাও। ভয়ানক ব্যাপার সন্দেহ নেই। কারণ, তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তেষ্টা আরও বাড়বে ওই মাংস খেলে–কারণ ওতে প্রচুর ঝালমশলা চর্বি দেওয়া হয়েছে পিপাসা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। অথচ জল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যন্ত্রণা সৃষ্টির আর এক পরিকল্পনা! কশাই কোথাকার!
এরপর তাকিয়েছিলাম কারাগার-কক্ষের কড়িকাঠের দিকে। প্রায় তিরিশ চল্লিশ ফুট ওপরে দেখতে পাচ্ছি ধাতুর চাদর দিয়ে মোড়া সিলিং–দেওয়াল চারটে যেভাবে তৈরি, প্রায় সেইভাবে। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল একটাই জিনিস। মহাকালের একটা প্রতিকৃতি। তবে গতানুগতিক কাস্তে নেই হাতে। তার বদলে রয়েছে একটা দোলক। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। দোলকটা যেন একটা ক্ষুরধার কাস্তে। ঠায় চেয়েছিলাম বলেই মনে হয়েছিল, শাণিত কাস্তে যেন অল্প অল্প দুলছে। চোখের ভুল ভেবে আরও খুঁটিয়ে চেয়েছিলাম। এবার আর ভুল বলে মনে হয়নি। কাস্তে-দোলক সত্যিই দুলছে। খুব আস্তে। চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকিয়েছিলাম দেওয়ালের অন্যান্য দৃশ্যের দিকে।
খুটখাট খড়মড় আওয়াজ শুনেই চোখ ঠিকরে এসেছিল মেঝের দিকে। ডানদিকের কোনো গর্ত থেকে পালে পালে ধেড়ে ইঁদুর আগুন-রাঙা বুভুক্ষু চোখে ধেয়ে আসছে মাংসখন্ডর দিকে। অতি কষ্টে খাবার বাঁচালাম শয়তানদের ধারালো দাঁতের খপ্পর থেকে। তাড়িয়েও দিলাম কুচুটে করাল প্রাণি বাহিনীকে।
প্রায় আধঘণ্টা পরে (একঘণ্টাও হতে পারে–সময়ের হিসেব রাখার কোনো উপায় তো ছিল না), ওপরে সিলিং-এর দিকে চাইতেই খটকা লেগেছিল। স্পষ্ট দেখলাম, পেন্ডুলাম আরও বেশি দুলছে–প্রায় গজখানেক জায়গা জুড়ে দুলেই চলেছে। হতভম্ব হলাম (ভয়ার্তও হলাম) পেন্ডুলামের চেহারা দেখে। নিচের দোলকটা একটা ভারি ক্ষুরের মতো ধারালো কাস্তে ছাড়া কিছুই নয়। দুপাশের শিংয়ের মতো উঁচু হয়ে থাকা অংশ দুটোর নিচের দিকে মস্ত দোলকটার নিচের অংশ বাঁকানো ফলক-যা বাতাস কেটে আসছে যাচ্ছে–সাঁ সাঁ শব্দে। রক্ত হিম হয়ে গেল আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে। শাণিত এই দোলক বেশ খানিকটা নিচেও নেমে এসেছে!
পিশাচসম ঘাতকরা তাহলে আমাকে দগ্ধে দন্ধে মারার নতুন প্ল্যান এঁটেছিল। এ গহ্বরে যাদের আটক রাখা হয়, তাদেরকে মারা হয় তিল তিল করে–এটা আমি জানি। ওরা তাই কুয়োয় নিজেরাই ছুঁড়ে দেয়নি—আমাকে–ভেবেছিল আমিই হেঁটে গিয়ে ঢুকে যাব নিঃসীম অন্ধকারে আমার সেই পতন-দৃশ্য দেখার জন্যেই ওপরের দরজা ফাঁক করেছিল নিমেষের জন্যে। যখন দেখল, কপাল জোরে বেঁচে গেছি–তখন আয়োজন হয়েছে আর এক মানসিক অত্যাচারের। ধারালো দোলকের দুলে দুলে নেমে আসা! অমানুষ না হলে এমন অভিনব ফন্দী কারও মাথায় আসে!
কত ঘণ্টা, কত দিন যে এই নির্মম মানসিক ধকল সয়ে গিয়েছিলাম, সে হিসাব দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। সভয়ে বিস্ফারিত চোখে শুধু দেখেছিলাম, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, দুলে দুলে, রক্তলোলুপ খড়গ নেমে আসছে নিচের দিকে। নামতে নামতে এসে গিয়েছিল বুকের এত কাছে। যে, ইস্পাতের গন্ধ ভেসে আসছিল নাকে।
দমকে দমকে, এক এক ঝটকান দিয়ে, ধারালো খড়গ আমার নাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে গেছে ইস্পাতের শীতল গন্ধ–মৃত্যুর হাতছানি প্রকট হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে। নির্মিশেষে সেই দুলন্ত মৃত্যুদূতকে ঘণ্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন দেখতে দেখতে সহসা আমি সর্বাঙ্গ এলিয়ে দিয়ে শিথিল হয়ে পড়েছিলাম। আসন্ন ঝকমকে মুত্যুকে দেখে অকস্মাৎ প্রশান্তির ঢল নেমেছিল আমার প্রতিটি রক্তকণায়।
বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আর কোনো খেয়াল ছিল না। মর্মান্তিক যাতনা থেকে মুক্তি পেয়েছি দেখে অন্তরালের পিশাচ ঘাতকরা নিশ্চয় মুষড়ে পড়েছিল। তাই পেন্ডুলামের দুলুনিও বন্ধ করে রেখেছিল। কতখানি বিকট কুটিল মন থাকলে এইভাবে হত্যা করার ইচ্ছেটা হয়, সে ভাবনারও। আর সময় পাইনি; কেননা, খড়গ-দোলক আবার দুলতে শুরু করেছিল। আবার সাঁই সাঁই শব্দে বাতাস কেটে আমার বুকের ঠিক ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল লৌহ-কারাগারের এদিক থেকে সেদিকে–প্রায় তিরিশ ফুট জায়গা জুড়ে অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে দুলুনি…নামছে একটু একটু… লক্ষ্যস্থল আমার বুকের মধ্যপ্রদেশ।
এ অবস্থায় ক্ষিদে তেষ্টা উড়ে যাওয়ার কথা। আমার কিন্তু পেট চুঁইয়ে উঠেছিল। বাঁ হাত বাড়িয়ে মাংসের টুকরো ধরে মুখের কাছে টেনে এনেছিলাম। ইঁদুর শয়তানরা বেশির ভাগই খেয়ে গেছে। খেতে গিয়েও বিদ্যুতের মতোই একটা বুদ্ধি ঝলসে উঠেছিল মাথার মধ্যে। ক্ষীণ আশার প্রদীপ টিমটিম করে উঠেছিল মগজে। স্নায়ুমন্ডলী বুঝি নৃত্য করে উঠেছিল এই আশার স্নান আভায়। কাঠ হয়ে পড়ে থেকে ছলছল করে দেখে গিয়েছিলাম খড়গের আনাগোনা
ডানে বাঁয়ে…ডানে বাঁয়ে…দুলে দুলে বাতাস কেটে কেটে লোলুপ খড়গ নামছে শনৈঃ শনৈঃ…তালে তালে আমি অট্টহাসি হাসছি উন্মাদের মতো–কখনো হুঙ্কার দিচ্ছি বিকৃত উল্লাসে…।
নামছে…নামছে…রক্তপিপাসু খড়গ নামছে তো নামছেই…বিরামহীন ছন্দে নির্ভুল লক্ষ্যে নেমে আসছে আমার বক্ষদেশ লক্ষ্য করে…এসে গেছে ইঞ্চি তিনেক ওপরে…আর একটা নেমে এসে প্রথমেই কাটবে আমার আলখাল্লা…আলখাল্লার ওপর আছে পাটির বাঁধন…একটাই পাটি দিয়ে পেঁচিয়ে বাধা হয়েছে কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে…এক জায়গা কেটে গেলেই বাঁ হাত দিয়ে টেনে সমস্ত বাঁধন খসিয়ে ফেলতে পারব? আশা আমার সেটাই। কিন্তু…পটি বুকের ওপর আছে তো? খড়গের ফলক বুকের যেখানটা আগে স্পর্শ করবে–পাটি কি সেখানে আছে? মাথা উঁচু করে দেখেছিলাম বুক। নেই। পাটি নেই বুকের ঠিক সেই জায়গায়! পাটি আছে আশপাশে-খড়গ যেখানে বুক কাটবে- সেই জায়গায় রাখা হয়নি পটির ফাস।
ইঁদুরের দল তখন আমাকে হেঁকে ধরেছে। কনুই পর্যন্ত বাঁ হাত আলগা করে এতক্ষণ মাটির থালার ওপর হাত নেড়ে নেড়ে ওদের ঠেকিয়ে রাখছিলাম। একটু একটু করে বেপরোয়া হয়ে উঠছিল বুভুক্ষুর দল। রক্তরাঙা চোখে ধারালো দাঁত দেখিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আমার হাতের ওপর। আঙুলে কামড় বসিয়ে টুকরো টুকরো খেয়ে যাচ্ছিল থালার মাংস। মাংস আর নেই এখন। আছে শুধু চর্বি। আচমকা আবার আশার বিজলী চাবুক মেরে চালু করে দিয়েছিল আমার ভয়-নিস্তেজ মগজকে। হাত বাড়িয়ে চর্বি তুলে নিয়ে মাখিয়ে দিয়েছিলাম পটিতে। তারপর হাত রেখেছিলাম বুকের ওপর। শুয়েছিলাম মড়ার মতো নিস্পন্দ দেহে। আকুল প্রতীক্ষায় নিঃশ্বাস ফেলতেও বুঝি ভুলে গিয়েছিলাম।
সহসা আমি নিশ্চল হয়ে যেতে নিশ্চয় ধোঁকায় পড়েছিল মাংসলোভী ইঁদুর বাহিনী। রান্না মাংস ফুরিয়ে যাওয়ার পর আমার কাঁচা মাংস তো রয়েছেই। এরকম কাঁচা নরমাংস এর আগেও ওরা অনেক খেয়েছে। কিন্তু আমি যে এখনো মরিনি, অথচ চুপচাপ শুয়ে রয়েছি–হাতও নাড়ছি না–এই অবস্থাটা বুঝতেই যেটুকু সময় ওরা নিয়েছিল। তারপরেই ডাকাবুকো দু-একটা বেড়ে ইঁদুর গন্ধে গন্ধে উঠে এসে দাঁত বসালো চর্বি মাখা পাটিতে।
দেখাদেখি এল বাকি সবাই। দেখতে দেখতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেয়ে ফেলল আমার সর্বাঙ্গ। হেঁটে গেল আমার গলার ওপর দিয়ে ঠোঁট মেলালো আমার ঠোঁটের সঙ্গে। কী কষ্টে যে নিজেকে ওই পূর্তিগন্ধময় বিবরবাসীদের সান্নিধ্যে রেখেও স্থির হয়েছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না।
সুচতুর শয়তানের দল নখর বসিয়ে বসিয়ে আমার চোখ মুখ, কান, গলা, পা হাত দিয়ে হেঁটে গেলেও বুকের ঠিক যেখানে খড়গের কোপ নেমে আসছে–পা দিল না সেখানে। টের পেলাম পাটির নানান জায়গায় কুট কুট করে দাঁত বসছে…পাটি খসেও পড়ছে নানান জায়গায়–তবুও আমি নড়লাম না…জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম না–অমানষিক প্রচেষ্টায় নিজেকে নিশ্চল রেখে দিলাম।
খড়গ কিন্তু ইতিমধ্যে আরও নেমে এসেছে। আলখাল্লা কেটে কেটে যাচ্ছে। স্নায়ুর মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম চামড়ায় পরশ বুলিয়ে যাওয়ার। বাঁ হাতের এক ঝটকায় ফেলে দিলাম সমস্ত ইঁদুর। খচমচ শব্দে হটে গেল হতচকিত বিবরবাসীরা। অতি সন্তপর্ণে একপাশে সরে গিয়ে খসিয়ে নিলাম একটার পর একটা বাঁধন। তারপর একেবারেই গেলাম কাঠের ফ্রেমের বাইরে। খড়গের কোপ থেকে এখন আমি অনেক দূরে। আমি মুক্ত! সাময়িক হলেও স্বাধীন!
স্বাধীন হলেও খুনিগুলোর খপ্পর থেকে এখনও কিন্তু নিস্কৃতি পাইনি। তা সত্ত্বেও বিপুল উল্লাসে অট্টহাসি হেসে যখন নৃত্য করছি পাষাণ কারাগারে, ঠিক সেই সময়ে স্তব্ধ হলো মারণ-দোলকের দুলুনি–অদৃশ্য এক শক্তি তাকে টেনে তুলে নিল সিলিং-এর কাছে। এই দেখেই চরম শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল আমার। নরকের পিশাচগুলো তাহলে আড়াল থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করছিল আমার প্রতি মুহূর্তের মরণাধিক যন্ত্রণা!
এ স্বাধীনতা তাহলে টিকবে কতক্ষণ? একটার পর একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সরিয়ে দিচ্ছি–পরক্ষণেই ততোধিক যন্ত্রণার যন্ত্র হাজির করছে পিশাচ-হৃদয় বিচারকরা। নিঃসীম আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়ে জুল জুল করে তাকিয়ে ছিলাম চারপাশের চার দেওয়ালের দিকে। প্রথমে যা টের পাইনি–এখন তা শিহরণের ঢেউ তুলে দিয়ে গেল আমার প্রতিটি স্নায়ুর ওপর দিয়ে।
বিচিত্র একটা পরিবর্তন আসছে ঘরের আকৃতিতে। পরিবর্তনটা কী, তা ধরতে পারছি না। কিন্তু তা আঁচ করতে গিয়েই ঠকঠক করে কাঁপছে আমার সর্বাঙ্গ। ভয়ের ঘোরের মধ্যে দিয়ে সেই প্রথম আবিষ্কার করলাম গন্ধক-দ্যুতির উৎস।
এ আলো আসছে আধ ইঞ্চি ফাঁকা থেকে। চারটে দেওয়াল যেখানে মেঝেতে লেগে থাকার কথা সেখানে রয়েছে আধ ইঞ্চি ফাঁকা; অর্থাৎ চারটে ধাতব দেওয়ালই ঝুলছে মেঝে থেকে আধ ইঞ্চি ওপরে; গন্ধক-দ্যুতি তার অনির্বান আভা নিক্ষেপ করে গেছে এতক্ষণ এই ফাঁকার মধ্যে দিয়ে। ভয়ে বুক টিপটিপ করছিল বলে সাহস হলো না ফাঁকা দিয়ে উঁকি মেরে ওদিকের দৃশ্য দেখার। তারপর অবশ্য চেষ্টা করেছিলাম। মাটিতে উপুড় হয়ে উঁকি মারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পাইনি।
উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা দেওয়ালের চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে আবছাভাবে আঁচ করেছিলাম, কোথায় যেন কী পালটে যাচ্ছে। পরিবর্তনের স্বরূপ আন্দাজ করতে গিয়েই অজানা আতঙ্কে প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। এখন স্বচক্ষে দেখলাম সেই পরিবর্তন। আগেই বলেছি, এ ঘরের লোহার দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা কিন্তু উদ্ভট বিদঘুঁটে বীভৎস মূর্তি–তারা কেউই পার্থিব প্রাণি নয়, অদৃশ্য লোকের আততায়ী প্রত্যেকেই তাদের বিকট চেহারা এতক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠেনি রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছিল বলে।
এখন সেই নিষ্প্রভ দানবদল উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। প্রতিটি রঙের রেখা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোটরাগত নারকীয় চোখে দেখা দিয়েছে স্ফুলিঙ্গ।
হ্যাঁ, সত্যিই আগুন লকলকিয়ে উঠছে অবয়ব। দেওয়াল তেতে উঠছে, লাল হয়ে উঠছে, লোহা তেতে লাল হয়ে গেলে ঠিক যা হয়!
জানোয়ার! জানোয়ার! এরা মানুষ না পশু! এভাবেই শেষে নিকেশ করতে চায় আমাকে! দু-দুবার ওদের পাতা মৃত্যুর ফাঁদ টপকে গিয়ে বেঁচে গেছি–তাই এবার চার দেওয়ালের দানবদের লেহিহান করে তুলছে লোহা তাতিয়ে দিয়ে। উৎকট বাষ্পে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। তীব্র আঁচে চামড়া ঝলসে যাবে মনে হচ্ছে।
উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে আগুনের আঁচ। চার দেওয়ালের দানবদল লোল জিহা আর আগুন চোখ মেলে যেন আরও কাছে এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি বিভ্রম নাকি?
আঁতকে উঠলাম পরক্ষণেই ঘরের আর একটা নারকীয় পরিবর্তন দেখে। ঘরটা ছিল চৌকোনা। এখন তা দ্রুত বরফির মতো হয়ে যাচ্ছে বিপরীত দুটো কোণ ছোটো হচ্ছে যে হারে, মুখোমুখী অন্য দুটো কোণ বড়ো হচ্ছে সেই একই হারে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে মেঝের ছোটো হয়ে যাওয়া–সঙ্কীর্ণ হচ্ছে বরফি মেঝে–দুদিক থেকে আগুন রাঙা দেওয়াল আমাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে….
মাঝের ওই নিতল গহ্বরের দিকে!
হা ঈশ্বর! আর তো পরিত্রাণের পথ নেই। ওরা আমাকে এই কারাগারে এনেছিল একটাই উদ্দেশ্যে–পাতাল-কূপে ফেলে দেবে বলে। দু-দুবার ওদের ফাঁকি দিয়েছি। এবার আর রক্ষা নেই। তেতে-লাল লোহার দেওয়াল বারকয়েক ঘঁাকা দিয়ে ফোঁসকা তুলে গেল গায়ে। দম আটকে আসছে উগ্র কটু গন্ধে। পেছনের দুই দেওয়াল ক্রমশ এগিয়ে এসে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অতলান্ত ওই বিভীষিকার দিকে…
কুয়োয়
কি আছে ওই কুয়োয়? কেন ওরা আমাকে ওরা ফেলে দিতে চায় কুয়োর গর্ভে? উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে উঁকি মেরেছিলাম তলদেশে। শিহরণের পর শিহরণ ঘূর্ণিপাকের মতো আর্বত রচনা কবে আমাকে ছিটকে সরিয়ে এনেছিল কুয়োর পাড় থেকে।
যা দেখেছি, তা আর যেন ইহজীবনে দেখতে না হয়। আগুনের লাল আভা সিলিং থেকে ঠিকরে গিয়ে প্রদীপ্ত করে তুলেছিল কুয়োর তলদেশ। সেখানে বিরাজ করছে যে বিভীষিকা, তা কল্পনায় আনার ক্ষমতা আছে শুধু নরকের বাসিন্দাদের সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবার জন্যে প্রস্তুত হয়নি পার্থিব চোখ…করাল ওই বিভীষিকার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আশঙ্কাই তো বিকৃত করে দেওয়াল পক্ষে যথেষ্ট!
আমি তাই ছিটকে সরে এসেছিলাম পেছনে–পরক্ষণেই তপ্তলৌহ দেয়ালের ছ্যাকা খেয়ে কাতরে উঠে আছড়ে পড়েছিলাম সামনে। পেছানোর আর জায়গা নেই। হয় চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে জ্যান্ত ঝলসাতে হবে–নয়তো পাতাল-কূপের মরণাধিক শৈত্যবরণ করতে নিতে হবে!
আমি যখন টলছি…ঠিক সেই সময়ে যেন সহস্র দামামা ধ্বনিত হলো বাইরে কোথায়…সম্মিলিত কণ্ঠের বজ্ররোষ বুঝি বিদীর্ণ করে দিল দূর গগন…পাষাণ মেঝের ওপর লোহা টেনে নিয়ে যাওয়ার কর্কশ নিনাদে ঝালাপালা হয়ে গেল কানের পর্দা…টলে গিয়ে কুয়োর গর্ভে যখন পড়ে যাচ্ছি–শক্ত হাতে কে যেন আমার বাহুমূল খামচে ধরে টেনে নিয়ে এল মৃত্যু গহ্বরের কিনারা থেকে।
এসে গেছেন জেনারেল লাসালে। টোলাডো দখল করেছে ফরাসি সৈন্য। ব্যর্থ হয়েছে চক্রান্ত!