মৃতের জঙ্গল

মৃতের জঙ্গল

মূল গল্প  Woods of the Dead (Algernon Henry Blackwood)

যে ঘটনাটার কথা বলছি সেটা আজ থেকে বহুবছর আগের৷ সে সময়ে পেশার প্রয়োজনে ইংল্যান্ডের প্রান্তিক গ্রামগুলোতে হামেশাই ঘুরে বেড়াতে হতো আমাকে৷ তখন রাস্তাঘাটের অবস্থা এত ভালো ছিল না৷ এমন অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হত যেখানে একটা রাত থাকার মতো সামান্য একটা হোটেল জোগাড় করতেই কালঘাম ছুটে যেত আমার৷ মধ্যে-মধ্যে আবার এমন কিছু গ্রামে কাজ পড়ত যেখানে একবার পা ফেললে আর অন্য কোথাও যেতেই ইচ্ছা করত না৷

যে গ্রামের কথা বলছি তার নাম আজ আর এই গল্পে উল্লেখ করতে চাই না৷ মোটকথা কোনও এক গ্রীষ্মের সকালে সেই জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামের দোতলা হোটেলে আমি সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিচ্ছিলাম৷ হোটেলটার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে আমার৷ আর সেই লোকটার কথা… নাহ, প্রথম থেকেই বলা যাক৷

হোটেলের সঙ্গে লাগোয়া রেস্তোরাঁটা খুব একটা বড়সড় নয়৷ বোঝাই যায় এখানে খুব বেশি লোকজন খেতে আসে না—ফলে জায়গাটা বাড়ানোর দরকারও হয়নি৷ আমি যে টেবিলে বসে খাচ্ছি তার ঠিক পাশেই একটা ছোট কাচের জানলা আছে৷ সেই জানলা দিয়ে এখন গ্রীষ্মের ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল আর মানুষের ঘরবাড়ি হাতে-আঁকা ছবির মতো দেখা যাচ্ছে৷ হোটেলের ঠিক বাইরেই একটা ছোট ফুলের বাগিচা করা আছে৷ সেখান থেকে প্রজাপতি উড়ে এসে মাঝে-মাঝে বসছে জানলার উপরে৷ সব মিলিয়ে খেতে-খেতে বাইরে তাকালে গ্রাম্য দৃশ্যের সরলতায় ভারী হালকা হয়ে যাচ্ছে মনটা৷

আচমকা রেস্তোরাঁর দরজার দিক থেকে একটা আওয়াজ পেয়ে আমি ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, বেশ বয়স্ক এক ভদ্রলোক দরজা খুলে ভিতরে আসছেন৷ হাতে একটা ছোট কাগজ, গায়ে খয়েরি রঙের দীর্ঘদিনের না কাচা একটা কোট৷ সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার খাবারে মন দিলাম৷

ভদ্রলোক কিন্তু এগিয়ে এসে আমার সামনের টেবিলেই বসে পড়লেন৷ তারপর হাতের কাগজটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন একটানা৷ কোনও খাবার অর্ডার দেওয়ার খুব একটা তাড়া আছে বলে মনে হল না৷ ঘোলাটে চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেই যেন এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি৷

এর মাঝে হোটেলের মালিকের মেয়েটি একবার কাউন্টার ছেড়ে বাইরে এসে আমার আর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করে গেল৷ খেয়াল করলাম, আমার সামনের বয়স্ক লোকটিকে জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা তার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না মেয়েটা৷

এই ব্যাপারটায় খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না, কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে একটু খটকা লাগল আমার৷ এই টেবিলটায় যেহেতু আমি বসেছি এবং অন্য টেবিল ফাঁকাও আছে তাই লোকটার আমার টেবিলে এসে বসাটা মোটেই সহবত নয়৷ প্রথমে ভেবেছিলাম খেতে-খেতে আমার সঙ্গে খোশগল্প করার ইচ্ছাতেই আমার সামনে এসে বসেছেন তিনি৷ কিন্তু তাও তো নয়, এখনও একইভাবে জানলার দিকে শূন্যচোখে চেয়ে রয়েছেন৷ ভারী অদ্ভুত ব্যাপার তো!

এতক্ষণে তাকে ভালো করে লক্ষ করলাম আমি৷ বয়সের ভারে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন ভদ্রলোক৷ জামাকাপড়েও যেন সময়ের জং পড়েছে, মুখের চামড়া শুকনো আপেলের মতো বলিরেখায় ভরা৷ কোটের ভিতরে রং উঠে যাওয়া স্ট্রাইপড শার্ট দেখা যাচ্ছে, হাতে একটা সরু লাঠি৷ শরীরের মধ্যে একমাত্র শৌখিনতার ছাপ আছে মাথার চুলে৷ যত্ন করে আঁচড়ানো একমাথা রুপোলি চুল৷

মনে-মনে ভাবলাম হয়তো লোকটা এই হোটেলের হর্তাকর্তা গোছের কেউ হবে৷ যখন খুশি যেখানে খুশি এসে বসে পড়তে পারে৷ আমি বাইরে মন দেবার চেষ্টা করলাম৷ একটু দূরে কিছু নাম না-জানা ফুল গ্রীষ্মের খোলা হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে৷ বোঝা যাচ্ছে মৃদু একটা হাওয়া দিচ্ছে বাইরে৷ জানলা থেকে কিছুটা দূরে খাওয়ার পরে ব্যবহার করার জন্যে এক গামলা জল রাখা আছে, তার উপরে সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে জলটা৷ সেদিকে তাকিয়ে লোকটার কথা ভুলেই গেছিলাম আমি, এমন সময় তার গলার আওয়াজ শুনে একটু চমকে উঠলাম৷

‘এদিকে আপনি নতুন, তাই না?’

কোনও সম্বোধনের বালাই নেই, তাও একটা মিহি আন্তরিকতা ছিল তার গলায়, নিজে থেকেই আমার ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি চলে এল, বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি পায়ে হেঁটে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম চষে বেড়াই৷ এদিকটায় আগে আসিনি৷’

‘আমি কিন্তু গোটা জীবনটাই প্রায় এখানে কাটিয়ে দিয়েছি…’ কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ভদ্রলোক, ‘আজ আবার অনেকদিন পর ফিরে এলাম৷’

‘ওহ! মানে এখন আর এখানে থাকেন না?’

‘নাহ, চলে গেছি বহুদিন আগে, কিন্তু…’ লোকটার গলা বিষণ্ণ হয়ে এল, ‘মাঝে-মাঝে ভারি আফশোস হয় জানেন, এত উজ্জল রোদ, এই মিষ্টি ফুলের গন্ধে মাখা বাতাস, এখানকার ঘন সবুজ জঙ্গল, এসব অন্য কোথাও পেলাম না আর৷’

আমি খেতে-খেতে মাথা নাড়ালাম, ‘সে তো বুঝতেই পারছি, জায়গাটাকে ঠিক যেন একটা রূপকথার বই থেকে তুলে এনে এখানে ফেলে দিয়েছে কেউ… এসে থেকেই কেন জানি না খুব, ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে…’

ঠোঁট চেপে একটু হেসে মাথা দোলালেন ভদ্রলোক, ‘সত্যি কথা বলতে কী… এখানে একবার এলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না আমার৷ বারবার ভাবি আসব না, কিন্তু আসতে হয়… কাজটা আসলে এত দরকারি যে…’

‘কী কাজ বলুন তো?’ আমি চামচটা প্লেটের উপরে রেখে জিজ্ঞেস করি৷

‘একজনকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে, সে যাবার জন্য তৈরি নয়, তাও…’ কথাটা না শেষ করেই কাগজটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিলেন ভদ্রলোক, নতুন উদ্যমে বললেন, ‘এক কাজ করুন, আপনি আজকের দিনটা এখানে কাটিয়ে যাবেন তো?’

‘তেমনই তো ইচ্ছা আছে৷’

‘বেশ, তাহলে চলে আসুন না কাল ভোরের দিকে…’ ভদ্রলোকের গলায় আন্তরিকতাটা বেড়ে উঠেছে এবার৷

‘কোথায়?’

‘মৃতের জঙ্গলে৷’

ভদ্রলোক যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছেন৷ হাওয়ার সঙ্গে ভেসে এসেছে কথাটা আমার কানে৷ কিংবা জানলার ঠিক বাইরে যে উঁচু পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে তার চুড়ো থেকে আমার উদ্দেশ্যে কিছু বলেছে কেউ, আমি প্রতিধ্বনিটুকু শুনতে পেয়েছি৷ মনে হল এতক্ষণের উজ্জ্বল রোদ হঠাৎ-ই মরে এসেছে, জানলার উপরে এতক্ষণ একটা হলুদ প্রজাপতি খেলা করছিল, এখন অন্য একটা প্রজাপতি উড়ে এসেছে তার জায়গায়, এর গায়ের রং ঘন কালো৷

আচমকাই দরজা খোলার শব্দে আমার চমক ভাঙল৷ হোটেল মালিকের সেই মেয়েটি আবার এসে ঢুকেছে ঘরে৷ ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটিকে৷ জটিলতাহীন লাবণ্যে ভরা মুখে একটা গ্রাম্য সৌন্দর্য খেলা করছে৷ অথচ এইমুহূর্তে কেন জানি না, ভারি কুৎসিত মনে হল তাকে আমার৷ চোখ দুটো কী নিষ্প্রভ!

তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়েই আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ একটা মৃদু কম্পন আমার শরীর চেপে ধরল৷ পড়ে যেতে-যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিলাম আমি৷ আমার সামনের চেয়ারটা মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে গেছে৷ এখন তার উপরে দুপুরের রোদ এসে পড়েছে৷ খাঁ-খাঁ করছে ফাঁকা চেয়ারটা৷ সেখানে কেউ নেই৷ ঠিক স্বপ্নের চরিত্রের মতো হারিয়ে গেছেন ভদ্রলোক৷

মেয়েটিকে লোকটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে সে বলল আমি নাকি সারাটাক্ষণ একাই বসেছিলাম৷ কোনও বৃদ্ধ লোককে এসে বসতে দেখেনি সে৷ আমার দিকে একবার সন্দেহের দৃষ্টি হেনে আবার ভিতরের দিকে পা বাড়িয়েছিল মেয়েটি৷ আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এখানে মৃতের জঙ্গল কোথায় আছে?’

এক পলকের জন্যে মেয়েটার মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ লাগল৷ ফাঁকা চেয়ারটার দিকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে সে বলল, ‘উনি এসেছিলেন তার মানে!’

‘কে? কে এসেছিলেন?’

‘প্রতিবার গ্রামে কেউ মারা যাবার আগে উনি আসেন৷’ থমথমে গলায় কথাটা বলে হাতের প্লেটটা টেবিলের উপরে রাখে মেয়েটি৷

গ্রামের মানুষ সাধারণত সহজ-সরল৷ তাদের পেট থেকে কথা বের করতে বেশি বেগ পেতে হয় না৷ আমাকেও সেই মেয়েটির থেকে কথাগুলো বের করতে সেদিন খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি৷ সে নিজে থেকেই গোটা ব্যাপারটা খুলে বলে আমায়৷ তার এলোমেলো বক্তব্য শুনে যেটুকু আমি বুঝেছিলাম তার সবটাই এখানে বলে রাখছি৷

যে হোটেলটায় বসে আমি খাওয়া-দাওয়া করছিলাম সেখানে আগে একটি ফার্মহাউস ছিল৷ ইয়োমেনের এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক সেই ফার্ম দেখাশোনা করতেন৷ বছর ষাটেক বয়স অবধি দারিদ্রের সঙ্গেই সংসার চালাচ্ছিলেন তিনি৷ কিছু একটা দুর্ঘটনায় ভদ্রলোকের একটি ছেলে মারা যায়৷ তাতে করে বেশ কিছু টাকা লোকটির হাতে আসে৷

শেষ বয়সে হাতে টাকা এলে মানুষের আর ফুর্তি করার মতো তেমন কিছু থাকে না৷ ফার্মের দেখাশোনা না করলেও সংসার চলে যাবে তার৷ ফলে যা হয়, কাজকর্ম ছেড়ে গ্রামের এদিক-ওদিক ঘুরতে শুরু করলেন তিনি৷ মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে কিছু খ্যাপাটে উদ্ভট কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন ভদ্রলোক৷ অনেকে বলত সারাজীবন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়ায় নাকি তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ তিনি নাকি এমন কিছু দেখতে পেতেন যা স্বাভাবিক লোকে দেখতে পায় না৷ মাঝে-মাঝে অদ্ভুতুড়ে শব্দ আর ফিসফিস শুনতে পেতেন৷ যাই হোক, লোকে তাকে খুব একটা ঘাঁটাত না, সন্ধের পর থেকে তার বাড়ির আশপাশে খুব একটা ঘেঁষত না কেউ৷ মোট কথা, একটা রহস্য আর গুজব জড়িয়ে গেছিল তার নামের সঙ্গে৷

ফার্মের ঠিক পিছন থেকেই পাহাড়ের ঢালে একটা জঙ্গল শুরু হয়৷ উঁচু পাইন গাছের জঙ্গল৷ সেই জঙ্গলের একটা অংশের গাছপালা কিছু একটা কারণে কালো রং ধরে থাকত৷ সবুজ হত না তারা৷ সেই অংশটাকে ভদ্রলোক মৃতের জঙ্গল বলতেন৷ তার একটা কারণও ছিল৷ গ্রামের কেউ মারা যাবার ঠিক আগে তাকে গান গাইতে-গাইতে ওই জঙ্গলের দিকে হেঁটে যেতে দেখতে পেতেন ভদ্রলোক৷ একবার সেই জঙ্গলে ঢুকলে তারা আর বেরিয়ে আসত না৷ যাদের জঙ্গলে ঢুকতে দেখতেন তাদের নাম স্ত্রীয়ের কাছে মাঝে-মধ্যে বলতেন তিনি৷ তাঁর কাছ থেকে গ্রামের বাকিদের মুখেও রটে যেত সেই খবর৷ আশ্চর্যের কথা হল যাদের নাম উনি বলতেন তারা সত্যি কিছুদিনের মধ্যে মারা যেত৷

মাঝে মধ্যে হাতের ছোট লাঠিটা নিয়ে ওই মৃতের জঙ্গলে গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি৷ স্ত্রীকে বলে যেতেন যে তাঁর সমস্ত মৃত বন্ধুকে ওই জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে যেতে দেখেছেন৷ একদিন নিজেও হারিয়ে যাবেন৷ জঙ্গলটা ভারি ভালোবাসতেন ভদ্রলোক৷ একদিন তাঁর স্ত্রী পিছন-পিছন গিয়ে দেখেন জঙ্গলের যে জায়গাটা সব থেকে ঘন সেখানে একটা বড় পাইন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন ভদ্রলোক৷ স্ত্রীকে সেখানে দেখতে পেয়ে খানিক ধমক দেন, বলেন, ‘এভাবে আর কোনওদিন আমাকে বিরক্ত করতে এস না৷ আমি কথা বলি ওদের সঙ্গে, ওরা আমাকে শেখায়, জানায়, মৃত্যুর আগে সবকিছু জানতেই হবে আমাকে৷’

গ্রামের দিকে খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে৷ তারপর থেকেই জঙ্গলটার ‘মৃতের জঙ্গল’ বলে বদনাম রটে যায়৷

যাই হোক, ষাট বছরের জন্মদিনের দিন রাতে ভদ্রলোক স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বলেন, ‘এবার মনে হয় তোমাকে ছেড়ে যেতে হবে আমাকে, মৃতের জঙ্গল আমাকে ডাকছে৷ তবে চিন্তা কোরো না, একদিন তুমিও সে পথে হেঁটেই চলে আসবে আমার কাছে৷’

মহিলা তাঁকে যেতে দিতে চাননি৷ কিন্তু একরকম জোর করেই তাঁর হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে জ্যোৎস্না মাখা পথ দিয়ে হেঁটে শিস দিতে-দিতে সেই জঙ্গলে গিয়ে ঢোকেন ভদ্রলোক৷ সেদিন রাতেই তাঁর স্ত্রী ঘুম ভেঙে দেখেন বিছানায় নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে আছেন তিনি৷ দুটো হাত দু-দিকে ছড়ানো—মৃত৷

এত অবধি গল্প আমি সেই মেয়েটির থেকে উদ্ধার করেছিলাম৷ গল্পটা শেষ করে সে বলেছিল, ‘তবে আপনার আগেও বেশ কয়েকজন ঠিক ওই চেয়ারটাতেই বসে থাকতে দেখেছে ওনাকে৷ উনি এসে বসে বাইরে চেয়ে থাকেন, মাঝে-মাঝে কাঁদতেও দেখেছে কেউ-কেউ৷’

‘ওকে দেখে কেউ ভয় পায় না?’ কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি৷

‘পায়, যে দেখে সেই পায়৷ আপনার সঙ্গে তো কথাও হয়েছে…’

‘হ্যাঁ, উনি বলছিলেন কাউকে নিতে এসেছেন…’

‘নিতে এসেছেন!’ ভয়-ভয় চোখে মুখ তোলে মেয়েটি, ‘কাকে?’

‘সেটা বলেননি, আমি জিজ্ঞেসও করিনি…’

আমার দিকে প্রায় এক মিনিট একইভাবে তাকিয়ে টেবিল থেকে প্লেট তুলে নিয়ে ধীরে-ধীরে সরে পড়ল মেয়েটা৷ মনে হল আরও কিছু যেন আমাকে বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু শেষমুহূর্তে না বলাই ভালো বলে এড়িয়ে গেছে৷

সে হোটেলেই রাতটা কাটাব বলে ঠিক করলাম৷ দুপুরটা একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেল নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বাইরেটা একটু ঘুরে দেখতে৷ জানলা দিয়ে যতটা দেখা গেছিল জায়গাটা তার থেকে ঢের বেশি মনোরম৷ বিস্তৃত মাঠঘাটের উপর দিয়ে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘুরে বেড়ালাম৷ মাথার উপরে গাঢ় নীল আকাশে সাদা মেঘের দল সঙ্গী হল সারা বিকেল৷ বিকেল সন্ধের দিকে গড়িয়ে যেতে একটু-একটু করে মিলিয়ে এল তারা৷ এলাকার কিছু লোকের কাছেও একই গল্প শুনলাম৷ বুঝলাম ব্যাপারটা একটা আরবান লিজেন্ডের রূপ নিয়েছে৷ কৌতূহলটা কয়েকধাপ বেড়ে উঠল আমার৷

ফেরার সময় হোটেলের পিছনের দিকে হাঁটতে গিয়েই জঙ্গলটা চোখে পড়ল৷ মৃতের জঙ্গল৷ সত্যি, দূর থেকে দেখলে মনে হয় জঙ্গলের একটা বিশেষ অংশ যেন পুড়ে গেছিল কোনওকালে৷ সেখানকার গাছগুলোতে স্পষ্ট কালো-কালো ছোপ৷ ঘন কালো সেই রঙের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি আর এগোয় না৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই হোটেলে ঢুকে এলাম৷

সেদিন রাতে দূরে চার্চের ঘণ্টায় বারোটা বাজতেই, হোটেলের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম আমি৷ হোটেলের ঠিক পিছন দিকে একটা ছোট ধানখেত আছে৷ সেই খেত যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে জঙ্গল৷ জঙ্গলের ভিতরে প্রায় আধ কিলোমিটার হাঁটলে মৃতের জঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়৷ যদিও অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ততক্ষণে আমার মাথায় উঠেছে, তাও সেই অন্ধকারে ডুবে থাকা ধানখেত আর গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মনের ভিতরে একটা আশঙ্কা উঁকি দিতে লাগল বারবার৷

ধানখেত বেয়ে ক্রমশ সেই জঙ্গলের দিকে এগোতে লাগলাম আমি৷ চারপাশ আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ হয়ে আছে৷ ঝিঁঝিঁর ডাক আর জঙ্গল থেকে ভেসে আসা মৃদু হাওয়ার শনশন ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না৷ একটা জমাট নৈঃশব্দ্য ক্রমশ গ্রাস করছিল আমাকে৷ যতবার পায়ে পাথর লেগে হোঁচট খেলাম মনে হল সেই পাথরের গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ বুঝি নীচের গোটা গ্রাম জুড়ে শোনা যাচ্ছে৷ উঠতে-উঠতে বারবার সেই বয়স্ক ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল৷ সত্যিই কি কিছু দেখতে পেতেন উনি? নিশ্চয়ই এই জঙ্গলেরই আশপাশে কোথাও এসে দাঁড়াতেন একসময়৷ একদৃষ্টে চেয়ে থাকতেন কোনো একটা গাছের দিকে, কথা বলতেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে৷ সে কি এখনও জঙ্গলের ভিতরেই আছে? কথাগুলো ভেবে বুকের ভিতরটা ছমছম করে উঠতে লাগল আমার৷

আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি৷ এবার জঙ্গল শুরু হতে চলেছে৷ প্রান্তরেখার গাছগুলো একেবারে আমার পায়ের সামনে৷ বিরাট মহীরুহের সার তারা ভরা আকাশের বুক ছুঁতে অগ্রসর হয়েছে৷ তাদের পাতা আর ডালপালার ফাঁকে সরসর করে হাওয়ার আওয়াজ কানে এল৷ যেন ফিসফিস করে কথা বলতে চাইছে কেউ, সারাবছরই জঙ্গলের গাছের পাতায় এমন ফিসফিসানি শোনা যায় হয়তো৷ কেউ খেয়াল করে না…

কিছুক্ষণের জন্যে সেখানে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করলাম আমি৷ গাছের বাকল আর মাটির গন্ধ এসে মোহগ্রস্ত করে ফেলতে লাগল৷ মনে হল ভিতর থেকে হাতছানি দিয়ে কেউ যেন ডেকে চলেছে আমাকে৷ সাতপাঁচ না ভেবে জঙ্গলের ভিতরে পা বাড়ালাম৷

সঙ্গে-সঙ্গে সেই গাঢ় অন্ধকারের ভিতর থেকে কিছু একটা এসে যেন চেপে ধরল আমার হাতটা৷ আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়েও কিছুই দেখতে পেলাম না৷ সামান্য চাঁদের আলোও এসে পৌঁছাচ্ছে না জঙ্গলের ভিতরে৷ সেই হাতের টান আমাকে টেনে নিয়ে চলল জঙ্গলের ভিতরে দিকে৷ আরও গভীরে, আরও ঘন অন্ধকারের দিকে৷ আমাদের দু-পাশে গাছের সার দ্রুত গতিতে সরে যেতে লাগল পিছনের দিকে৷ যেন একটা বিরাট সৈন্যদল সার বেঁধে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে৷

কিছুদুর সেইভাবে চলার পর খানিকটা ফাঁকা জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম আমরা৷ এখানে গাছের সার কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছে৷ বরঞ্চ আমাদের মাথার উপরে যেন ঝুঁকে পড়েছে তারা৷

‘ভোর হয়ে আসছে…’ পাশ থেকে সেই চেনা কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেলাম৷ অনেকটা গাছের পাতার সেই অস্পষ্ট আওয়াজটার মতোই সেটা, ‘মৃতের জঙ্গলের একেবারে মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা৷’

একটা মাঝারি শ্যাওলায় ঢেকে যাওয়া পাথরের উপরে বসে পড়লাম আমি৷ মনে হল পুবের দূর প্রান্ত থেকে একটা হালকা আলোর আভাস একটু-একটু করে ফুটে উঠছে৷ বাতাস জেগে উঠছে ধীরে-ধীরে, প্রথম সূর্যের রেখা, দুটো গাছের কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে একটা আলোর বৃত্ত তৈরি করল৷

‘এবার এসো আমার সঙ্গে,’ আমার সঙ্গীর চেনা গলা আবার শুনতে পেলাম, ‘এখানে সময়ের অস্তিত্ব নেই, চলো, তোমাকে দেখাই কাকে নিতে এসেছি আমি…’

সেই হাতের টানে এগিয়ে চললাম সামনে দিয়ে, মনে হতে লাগল দ্রুত কেটে যাচ্ছে সময়টা৷ সূর্যটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দিগন্তরেখা ছেড়ে জ্বলে উঠল মাথার উপরে, গাছের ছায়া খেলা করতে লাগল আমাদের পায়ের কাছে৷ জঙ্গল আবার ঘন হতে শুরু করেছে৷ শুধু মাঝে-মাঝে মাথার উপর দিয়ে এক বিন্দু রোদ এসে আমাদের মুখে আলপনা এঁকেই মিলিয়ে যাচ্ছে৷

ভালো করে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম৷ সেই ধানখেতটাকে আবার দেখতে পাচ্ছি৷ কিন্তু অন্ধকারে ডুবে নেই আর সেটা, ঝকঝকে সূর্যের আলো এখন খেলা করছে তার উপরে৷ অথচ মাত্র কয়েক মিনিট আগেই তার অন্ধকার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে এসেছি৷ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি৷

হঠাৎ মনে হল মাঠের একপ্রান্ত থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি একদিক থেকে আরেকদিক পার হচ্ছে৷ ক্যারিজের ছাউনির বাইরে একজন বসে চালাচ্ছে গাড়িটা, ভিতরে অন্য কেউ বসে৷ ঘোড়াদুটোর পায়ের তালের সঙ্গে-সঙ্গে নড়ে উঠছে গোটা গাড়িটা৷ চলতে-চলতে মাঠের ঠিক মাঝামাঝি এসে সেটা থেমে গেল৷ গাড়ির চালক নীচে নেমে এসে ক্যারিজের দরজা খুলতে ভিতরে যিনি বসেছিলেন তিনি নেমে এলেন৷ তাঁর সমস্ত শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা৷ মাথা থেকে পা অবধি কিছুই দেখা যায় না৷ আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখতে লাগলাম সেই দৃশ্য৷

চালককে কিছু একটা বলতে চালক মাথা দোলাল৷ তারপর আঙুল তুলে জঙ্গলের অন্যদিকের প্রান্তটা দেখিয়ে দিল৷ কাপড়ে ঢাকা সেই মানুষটা কিন্তু সেদিকে গেল না৷ উল্টে দ্রুত পা চালিয়ে আমরা যে জঙ্গলের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছি সেদিকেই আসতে লাগল সে৷ একেবারে আমাদের সোজাসুজি৷ জঙ্গলের ভিতরের অন্ধকারে আমরা দাঁড়িয়ে আছি বলে আমাদের এখনও দেখতে পাচ্ছে না সে৷

মানুষটাকে উল্টোদিকে হেঁটে আসতে দেখে চালক তাকে একবার বাধা দিল৷ কিন্তু তাতে আমল দিল না কাপড়ে ঢাকা মানুষটা৷ সে আগের মতোই ছন্দোবন্ধ পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে এগিয়ে আসতে লাগল মৃতের জঙ্গলের দিকে৷ একেই তবে নিয়ে যেতে এসেছেন ভদ্রলোক৷ কিন্তু হেঁটে আসা মানুষটার মুখ এখনও দেখতে পাচ্ছি না আমি৷ মুখের সামনেটায় যেন অনেকটা ছায়া ভিড় করেছে তার৷

এখন সে আমাদের থেকে মিটার খানেক দূরে৷ আর কয়েক পা এগোলেই জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করবে সে৷ ঠিক এই সময়ে তার মুখের সামনে থেকে অন্ধকার সরে গেল৷ বিস্ময়ের একটা ধাক্কায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে এলাম আমি৷ এ কাকে দেখছি! তবে কি…

উত্তেজনার মাঝে অনুভব করতে পারলাম আমার কবজির কাছে হাতের টান আর নেই৷ সেটা বুঝতে পেরেই পিছনদিকে দৌড় দিলাম আমি৷ ছুটতে লাগলাম বনবনানির প্রান্ত রেখার দিকে৷ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে লক্ষ করলাম আমার চারদিকের জঙ্গল একটু-একটু করে ঢেকে যাচ্ছে ঘন অন্ধকারে৷ কানের দু-পাশ দিয়ে উন্মাদ হাওয়ার ব্যস্ত ছোটাছুটি আমার বুকের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিল৷ একটু আগে যা দেখেছি সব ভুলে সেই নারকীয় জঙ্গলের বুক চিরে দৌড়াতে লাগলাম আমি৷

সেদিন হোটেলে ফিরে নিজের ঘরে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ সকালে ঘুম ভাঙতে আর সেখানে থাকিনি আমি৷

এর প্রায় একবছর পরে আবার একবার কর্মসূত্রে সেই গ্রামে যেতে হয়েছিল আমাকে৷ খানিকটা অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতেই হয়তো গিয়ে উঠেছিলাম সেই একই হোটেলে৷ তবে এবার আর সেখানে রাত কাটানোর ইচ্ছা ছিল না আমার৷ সকালের জলখাবারটা সেখানে সেরেই বিদায় নেওয়ার প্ল্যান ছিল৷

তবে হোটেল মালিকের সেই মেয়েটিকে কিন্তু আর দেখতে পাইনি সেদিন৷ খেয়েদেয়ে টাকা মেটাতে গিয়ে ম্যানেজারের টেবিলে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘আপনার মেয়েটিকে তো দেখছি না আর… বিয়ে-টিয়ে হয়ে গেছে নাকি?’

টাকা গুনতে-গুনতে মাথা নেড়েছিল লোকটা, ‘না বাবু, বিয়ে হবারই কথা ছিল তার৷ কিন্তু তার আগেই ওই ধানখেতে কাজ করতে-করতে এমন সানস্ট্রোক হল যে… আপনি চলে যাওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই… মেয়ে আমার আর বেঁচে নেই…’

টাকাটা হাতে নিলাম আমি৷ মনে পড়ে গেল জঙ্গলে সেদিন সেই কাপড়ে ঢাকা মূর্তির মুখ থেকে অন্ধকার সরে যেতে সেই মেয়েটির মুখটাই দেখেছিলাম আমি৷ একটা অচেনা শিস দিতে-দিতে এগিয়ে আসছিল সে আমার সঙ্গীর দিকে…

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *