মৃতদেহ
ভূতের ভয় আমাদের মজ্জাগত। এই ভয় নিয়ে শিশু হয় বুড়ো, তারপর মারা পড়ে স্বচক্ষে কখনো ভূত না দেখেই।
স্বচক্ষে দেখিনি বলেই যে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই, এমন কথা বলা যায় না— এই হল নরেশের যুক্তি।
‘নিশ্চয়! স্বচক্ষে দেখাটাই হচ্ছে আসল কথা!’ আমি বললুম।
‘তুমি কামচাটকা দেখেছ?’ নরেশ জিজ্ঞাসা করলে।
মাথা নেড়ে জানালুম, ‘না।’
‘তবু তো কামচাটকার অস্তিত্ব স্বীকার করো?’
‘করি।’
‘কেন করো?’
‘কেন করব না? আমি জানি, জাহাজের টিকিট কিনলেই যেদিন খুশি ”কামচাটকায়” বেড়িয়ে আসতে পারি!’
‘প্রেতলোকের পথও দুর্গম নয়।’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে, ইচ্ছে করলে এখনি তুমি টিকিট না কিনেই সোজা প্রেতলোকে গিয়ে হাজির হতে পারো।’
‘পারি নাকি?’
‘আলবাত! খানিকটা আফিম খাও, অথবা গলায় দড়ি দাও, অথবা—’
‘ধন্যবাদ! তোমাকে আর কোনো উপায় বাতলাতে হবে না। নরেশ, তোমার যুক্তি শুনে আমার দেহ রোমাঞ্চিত হচ্ছে, অতএব এ প্রসঙ্গ ছেড়ে দাও।’
নরেশের সঙ্গে আমার প্রায়ই এমনি তর্ক হত। আমি ভূত মানি না, সে মানে। ছলে-বলে-কৌশলে সে আমাকে নিজের দলে টানবার চেষ্টা করত; অথচ আমি ভূত মানলে তার বা ভূতের কী লাভ হবে এটুকু ছিল আমার বুদ্ধির অগম্য।
* * *
সেদিন আকাশে চাঁদ উঠেছিল। পূর্ণিমার পরিপূর্ণ চাঁদ। ‘ব্ল্যাক আউটে’র ব্যবস্থা করে কলকাতাকে যারা নিষ্প্রদীপ করেছে, আজকের সমুজ্জ্বল চন্দ্র যেন তাদের অক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করতে চায়। হঠাৎ নরেশ এসে হাজির, এসে বললে, ‘চলো’।
নরেশ হচ্ছে সেই জাতীয় মানুষ, লোকে যাদের বলে ‘চন্দ্রাহত’। সে লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্য লেখে কিনা জানি না, কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ উঠলেই আর ঘরের ভিতরে বসে থাকতে পারে না; পথে বেরিয়ে পড়ে এবং কোনোদিন যায় গড়ের মাঠে, কোনোদিন ঢাকুরিয়া লেকের দিকে, কোনোদিন বা অন্য কোথাও। তার এই নৈশভ্রমণের একমাত্র সঙ্গী হচ্ছি আমি। যদিও এতটা কবিত্ব বা বাড়াবাড়ি আমি পছন্দ করি না, তবু প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কারণ আমি প্রতিবাদ করলেই সে তর্ক করবে। তার তর্ককে আমি ভয় করি ভূতের চেয়েও।
ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলুম, রাত সাড়ে এগারোটা। নাচারভাবে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আজ কোন দিকে?’
‘গঙ্গার ধারে।’
‘গঙ্গার ধারে গিয়ে পৌঁছাব রাত বারোটায়। তারপর?’
‘তারপর কী?’
‘সেখানে কতক্ষণ থাকবে?’
‘যতক্ষণ ভালো লাগে। নাও, নাও— আর দেরি কোরো না!’
মনে মনে পূর্ণিমার চাঁদের মুণ্ডপাত করতে করতে জামা পরে নরেশের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম।
সারা কলকাতা তখন ঘুমোবার চেষ্টা করছে— ‘রেডিও’ দানবের বেসুরো কোলাহল পর্যন্ত বন্ধ।
* * *
গঙ্গার ধারে গিয়ে দেখলুম, সেখানে আর কোনো চাঁদের ভক্ত হাজির নেই। এ যেন মনুষ্যহীন পৃথিবী।
কেবল একজন পাহারাওয়ালা একটা আলোকহীন গ্যাসস্তম্ভের পাশে লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেও যেন মানুষ নয়, পাথরের প্রতিমূর্তি। তাকে দেখেও সন্দেহ হয় না যে, সে পূর্ণিমার চাঁদকে উপভোগ করছে।
নিদ্রিত দীর্ঘ পথ, নিস্তব্ধ রাত্রির কণ্ঠ, নির্জনতায় চারিদিক করছে যেন খাঁ খাঁ।
হঠাৎ কারা ভীষণ স্বরে গর্জন করে উঠল, ‘বলো হরি, হরি বোল!’
কাঁধে খাট নিয়ে দেখা দিলে একদল শবযাত্রী। কোন হতভাগ্য ঘণ্টা খানেক আগেও ছিল এই পৃথিবীর জীব, কিন্তু এখন তার প্রাণহীন দেহের আর কোনো মূল্যই নেই, খানিকক্ষণ পরে তার অস্থায়ী স্মৃতির মতন পড়ে থাকবে খালি কয় মুঠা ছাই!
আবার সেই ভয়াবহ চীৎকার— ‘বলো হরি, হরি বোল!’
এই কর্কশ চীৎকারে শ্রীহরির বা সদ্যমৃতের প্রতি কিছুমাত্র শ্রদ্ধার ভাব নেই। নিস্তব্ধ রাত্রে এই চীৎকার শুনলে কেন জানি না, আমার বুক ওঠে কেঁপে— এ যেন জীবনের প্রতি মৃত্যুর অভিশাপ!
খিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান বা আর কোনো ধর্মাবলম্বীরা শবযাত্রার সময়ে এমন অশোভন ও বীভৎস গোলমাল করে না।
বললুম, ‘নরেশ, তুমি তো ভূত মানো। কিন্তু স্তব্ধ রাত্রে এমন নির্জন জায়গায় এরকম চীৎকার শুনলে তোমার কি ভয় হয় না যে, এখনি ওই মড়াটা জেগে ধড়মড় করে খাটের ওপরে উঠে বসবে?’
নরেশ বললে, ‘না! অমন অসম্ভব কথা মনে হবে কেন? ভূত হচ্ছে দেহহীন আত্মা। পঞ্চভূতে গড়া মৃতদেহের সঙ্গে তার কোনোই সম্পর্ক নেই। ভূত হচ্ছে অশরীরী।’
‘তাহলে লোকে যখন ভূত দেখেছি বলে তখন কি মিথ্যা কথা কয়?’
‘তাও না। লোকে দেখে আত্মার সূক্ষ্মদেহ। সে কেবল ছায়া। তাকে ধরাও যায় না, ছোঁওয়াও যায় না; সেই ছায়াও মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না।’
‘তাহলে লোকে ভূতকে ভয় করে কেন?’
‘অকারণে।’
* * *
একটি স্নানঘাটের চাতালে গিয়ে বসলুম।
তখন পূর্ণ জোয়ার। পৃথিবী নীরব হয়েছে বলে জেগে উঠেছে গঙ্গার কলরব। চল-চল-ছল-ছল ছলাৎ-ছলাৎ— বিচিত্র ধ্বনি তুলে তটের উপরে এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পরে ঢেউ। জ্যোৎস্নায় চারিদিক করছে জ্বল জ্বল— তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে যেন চকচকে হীরকচূর্ণ!
নরেশের প্রাণে কবিত্ব জেগে উঠল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘ভায়া, একটা গান গাইবে?’
আমি বললুম, ‘দু-একবার গান গাইবার চেষ্টা করেছিলুম। কিন্তু আমি গান গাইলেই আমার কুকুরটা উপরদিকে মুখ তুলে শেয়ালের মতন কেঁদে ওঠে, তাই ও-চেষ্টা ত্যাগ করেছি। তার চেয়ে তুমি গাও, আমি শুনি।’
নরেশ মাথা নেড়ে বললে, ‘আমারও অবস্থা আশাপ্রদ নয়। আমি গান গাইলেই পাড়ার লোকেরা বলে, শান্তিভঙ্গের অপরাধে তারা আমার নামে নালিশ করবে। আজকাল তাই মনে মনে গান গাই।’
অতএব কারুর গান গাওয়া হল না।
একটু চুপ করে থেকে নরেশ আবার বললে, ‘গঙ্গার পাশে বসে মানুষের গান গাওয়া ধৃষ্টতা। এমন কলসংগীত মানুষের কণ্ঠে ফোটে না।’
গঙ্গার ধ্বনিকে আমার কিন্তু সংগীত বলে মনে হল না। থমথমে নিঝুম রাত, চারিদিকে ছমছমে ভাব— এ যেন আর মানুষের পৃথিবী নয়। এই নিরালায় গঙ্গার বক্ষভেদ করে নির্গত হচ্ছে যেন কোনো অতিকায়, পাতালবাসীর মহা আর্তনাদ! যেন সে আর জলশৃঙ্খলে বন্দি হয়ে থাকতে রাজি নয়, তাই বিপুল কণ্ঠে কেঁদে কেঁদে ছটফট করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে আলোড়িত হয়ে উঠছে সারা গঙ্গার জলরাশি!
হঠাৎ আমার দৃষ্টি একদিকে আকৃষ্ট হল। ঘাটের সিঁড়ির শেষ ধাপটা যেখানে জলের উপরে জেগে রয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে কী-একটা সন্দেহজনক বস্তু!
‘ওটা কী নরেশ?’
নরেশ দেখেই উঠে দাঁড়াল। সচকিত কণ্ঠে বললে, ‘ওটা মানুষের দেহ বলে মনে হচ্ছে না?’
‘তাইতো বোধ হচ্ছে। জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে ঠেকেছে।’
দুজনে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির নীচে নেমে গেলুম। হয়তো ও-দেহে এখনও জীবন আছে।
না, জীবন্ত নয়, মৃতদেহ। স্ত্রীলোকের মৃতদেহ— পচে ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে! কালাপেড়ে কাপড়ের খানিকটা দেহের সঙ্গে জড়ানো, খানিকটা জলের উপরে ভাসছে। সেইসঙ্গে ভাসছে তার একরাশ এলানো চুল। দৃষ্টিহীন চোখদুটো আড়ষ্ট। ঢেউয়ের তাল তালে দেহটা অস্বাভাবিক ভাবে হেলছে, দুলছে, ঘাটের ধাপে এসে লাগছে— যেন তা জ্যান্ত, যেন তা আবার শুকনো পৃথিবীর উপরে উঠতে চায়!
মানুষের এই শোচনীয় পরিণাম দেখে বুকের ভিতরটা কেমন করতে লাগল! নরেশের হাত ধরে দ্রুতপদে সিঁড়ির উপরে এসে দাঁড়ালুম।
গ্যাসপোস্টের পাশে পাহারাওয়ালাটা ঠিক সেইভাবেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নরেশ উত্তেজিতের মতন তার কাছে দৌড়ে গিয়ে নিজের অদ্ভুত হিন্দি ভাষায় ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল।
পাহারাওয়ালা হেসে বললে, ‘বাবুজি, বাংলায় কথা বলুন। আমি বাংলা জানি… কী হয়েছে? ঘাটে একটা লাশ ভেসে এসেছে?’
‘হ্যাঁ। স্ত্রীলোকের লাশ।’
‘স্ত্রীলোকের লাশ? আবার স্ত্রীলোকের লাশ! বড়োই আজব কথা বাবুজি, বড়োই আজব কথা!’
‘কেন পাহারাওয়ালাজি?’
‘গেল দুই মাসের মধ্যে এই ঘাটেই রাতদুপুরে আরও দু-বার দুটো স্ত্রীলোকের লাশ ভেসে এসেছিল।’
‘এই ঘাটেই… তারপর?’
‘দু-বারই আমি স্বচক্ষে লাশ দেখেছি। তারপর উপরে উঠে থানায় খবর দিয়ে নিজেই বোকা বনে গিয়েছি।’
‘কেন?’
‘লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
‘নিশ্চয় স্রোতে ভেসে গিয়েছিল।’
‘তা ছাড়া আর কী বলব বলুন?… আচ্ছা, চলুন দেখি লাশটা একবার দেখে আসি।’
পাহারাওয়ালাকে নিয়ে আবার ঘাটের দিকে চললুম। দুই মাসের মধ্যে রাতদুপুরে একই ঘাটে তিন বার তিনটে স্ত্রীলোকের লাশ ভেসে আসা খুব আশ্চর্য ব্যাপার বটে!
মৃতদেহটা তখনও সেইখানেই তেমনিভাবে ঘাটের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে।
পাহারাওয়ালা হেঁট হয়ে পড়ে খানিকক্ষণ নীরবে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফিরে বললে, ‘বড়োই আজব কথা বাবুজি, বড়োই আজব কথা! আরও দু-বার ঠিক যেন এই লাশটাকেই দেখেছি— এমনি এলানো চুল, এমনি কালাপাড় কাপড়—’
‘কী পাগলের মতন বকছ পাহারাওয়ালাজি!’
হঠাৎ পাহারাওয়ালা চীৎকার করে টলে জলের ভিতরে পড়ে যায় আর কী! আমি তাড়াতাড়ি তার একখানা হাত চেপে ধরলুম, সে নিজেকে সামলে নিলে!
‘আমার লাঠি, আমার লাঠি!’
‘তোমার লাঠি?’
‘হ্যাঁ বাবুজি, জলের ভিতর থেকে কে টান মেরে আমার লাঠি কেড়ে নিলে— ওই দেখুন!’
ঘাট থেকে হাত চার-পাঁচ তফাত দিয়ে একগাছা লম্বা লাঠি ভেসে যাচ্ছে স্রোতের সঙ্গে!
পাহারাওয়ালা একটা ভয়ার্ত চীৎকার করে সিঁড়ি বেয়ে বেগে উপরে উঠতে লাগল এবং ভয় এমন সংক্রামক যে, আমরাও তার পিছনে পিছনে উপরে না উঠে পারলুম না!
কিন্তু উপরে এসেই নরেশ বলে উঠল, ‘ধেৎ, আমরাও কী পাগল? পাহারাওয়ালার হাত ফসকে লাঠিটা জলে পড়ে গেছে বলে আমরাও কিনা ভয়ে পালিয়ে এলুম!’
নিজের কাপুরুষতায় অপ্রতিভ হয়ে আমিও কথা কইতে পারলুম না। বাস্তবিক ভয় পাবার তো কিছুই হয়নি! পাহারাওয়ালা লাঠির উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, পিচ্ছল ঘাটে হড়কে লাঠিটা জলে পড়ে গিয়েছে, এ তো খুবই সহজ কথা!
হঠাৎ পাহারাওয়ালা সভয়ে বলে উঠল, ‘দেখুন বাবুজি, দেখুন!’
ফিরে দেখলুম, মৃতদেহটা আর ঘাটের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে নেই, ঠিক যেন চিৎসাঁতার কেটে জোয়ারের মুখে ভেসে চলেছে উত্তরদিকে। কিন্তু খানিকটা গিয়েই দেহটা আবার ডুবে গেল। অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম, কিন্তু আর তা ভেসে উঠল না!
ফিরে দেখি, পাহারাওয়ালা সেখানে নেই।
নরেশ নীরস কণ্ঠে বললে, ‘খুব পূর্ণিমার চাঁদ দেখা হল, এখন বাড়ি চলো।’