চতুর্থ খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : ঊর্ণনাভ
যতক্ষণ মৃণালিনীর সুখের তারা ডুবিতেছিল, ততক্ষণ গৌড়দেশের সৌভাগ্যশশীও সেই পথে যাইতেছিল। যে ব্যক্তি রাখিলে গৌড় রাখিতে পারিত, সে ঊর্ণনাভের ন্যায় বিরলে বসিয়া অভাগা জন্মভূমিকে বদ্ধ করিবার জন্য জাল পাতিতেছিল। নিশীথ নিভৃতে বসিয়া ধর্মাধিকার পশুপতি, নিজ দক্ষিণহস্তস্বরূপ শান্তশীলকে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন, “শান্তশীল! প্রাতে যে সংবাদ দিয়াছ, কেবল তোমার অদক্ষতার পরিচয় মাত্র। তোমার প্রতি আর কোন ভার দিবার ইচ্ছা নাই |”
শান্তশীল কহিল, “যাহা অসাধ্য, তাহা পারি নাই। অন্য কার্যে পরিচয় গ্রহণ করুন |”
প। সৈনিকদিগকে কি উপদেশ দেওয়া হইতেছে?
শা। এই যে, আমাদিগের আজ্ঞা না পাইলে কেহ না সাজে।
প। প্রান্তপাল ও কোষ্ঠপালদিগকে কি উপদেশ দেওয়া হইয়াছে?
শা। এই বলিয়া দিয়াছি যে, অচিরাৎ যবন-সম্রাটের নিকট হইতে কর লইয়া কয় জন যবন দূতস্বরূপ আসিতেছে, তাহাদিগের গতিরোধ না করে।
প। দামোদর শর্মা উপদেশানুযায়ী কার্য করিয়াছেন কি না?
শা। তিনি বড় চতুরের ন্যায় কার্য নির্বাহ করিয়াছেন।
প। সে কি প্রকার?
শা। তিনি একখানি পুরাতন গ্রন্থের একখানি পত্র পরিবর্তন করিয়া তাহাতে আপনার রচিত কবিতাগুলি বসাইয়াছিলেন। তাহা লইয়া অদ্য প্রাহ্নে রাজাকে শ্রবণ করাইয়াছেন এবং মাধবাচার্যের অনেক নিন্দা করিয়াছেন।
প। কবিতায় ভবিষ্যৎ গৌড়বিজেতার রূপবর্ণনা সবিস্তারে লিখিত আছে। সে বিষয়ে মহারাজ কোন অনুসন্ধান করিয়াছিলেন?
শা। করিয়াছিলেন। মদনসেন সম্প্রতি কাশীধাম হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন, এ সংবাদ মহারাজ অবগত আছেন। মহারাজ কবিতায় ভবিষ্যৎ গৌড়জেতার অবয়ব বর্ণনা শুনিয়া তাঁহাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। মদনসেন উপস্থিত হইলে মহারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, তুমি মগধে যবন-রাজ-প্রতিনিধিকে দেখিয়া আসিয়াছ?” সে কহিল, “আসিয়াছি|” মহারাজ তখন আজ্ঞা করিলেন, “সে দেখিতে কি প্রকার, বিবৃত কর |” তখন মদনসেন বখ্িতিয়ার খিলিজির যথার্থ যে রূপ দেখিয়াছেন, তাহাই বিবৃত করিলেন। কবিতাতেও সেইরূপ বর্ণিত ছিল। সুতরাং গৌড়জয় ও তাঁহার রাজ্যনাশ নিশ্চিত বলিয়া বুঝিলেন।
প। তাহার পর?
শা। রাজা তখন রোদন করিতে লাগিলেন। কহিলেন, “আমি এ বৃদ্ধ বয়সে কি করিব? সপরিবারে যবনহস্তে প্রাণে নষ্ট হইব দেখিতেছি!” তখন দামোদর শিক্ষামত কহিলেন, “মহারাজ! ইহার সদুপায় এই যে, অবসর থাকিতে থাকিতে আপনি সপরিবারে তীর্থযাত্রা করুন। ধর্মাধিকারের প্রতি রাজকার্যের ভার দিয়া যাউন। তাহা হইলে আপনার শরীর রক্ষা হইবে। পরে শাস্ত্র মিথ্যা হয়, রাজ্য পুন:প্রাপ্ত হইবেন |” রাজা এ পরামর্শে সন্তুষ্ট হইয়া নৌকাসজ্জা করিতে আদেশ করিয়াছেন। অচিরাৎ সপরিবারে তীর্থযাত্রা করিবেন।
প। দামোদর সাধু। তুমিও সাধু। এখন আমার মনস্কামনা সিদ্ধির সম্ভাবনা দেখিতেছি। নিতান্ত পক্ষে স্বাধীন রাজা না হই, যবন-রাজ-প্রতিনিধি হইব। কার্যসিদ্ধি হইলে, তোমাদিগকে সাধ্যমত পুরস্কৃত করিতে ত্রুটি করিব না, তাহা ত জান। এক্ষণে বিদায় হও। কাল প্রাতেই যেন তীর্থযাত্রার জন্য নৌকা প্রস্তুত থাকে।
শান্তশীল বিদায় হইল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : বিনা সূতার হার
পশুপতি উচ্চ অট্টালিকায় বহু ভৃত্য সমভিব্যাহারে বাস করিতেন বটে, কিন্তু তাঁহার পুরী কানন হইতেও অন্ধকার। গৃহ যাহাতে আলো হয়, স্ত্রী পুত্র পরিবার-এ সকলই তাঁহার গৃহে ছিল না।
অদ্য শান্তশীলের সহিত কথোপকথনের পর, পশুপতির সেই সকল কথা মনে পড়িল। মনে ভাবিলেন, “এত কালের পর বুঝি এ অন্ধকার পুরী আলো হইল-যদি জগদম্বা অনুকূলা হয়েন, তবে মনোরমা এ অন্ধকার ঘুচাইবে|”
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে পশুপতি, শয়নের পূর্বে অষ্টভুজাকে নিয়মিত প্রণাম-বন্দনাদির জন্য দেবীমন্দিরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, তথায় মনোরমা বসিয়া আছে।
পশুপতি কহিলেন, “মনোরমা, কখন আসিলে?”
মনোরমা পূজাবশিষ্ট পুষ্পগুলি লইয়া বিনাসূত্রে মালা গাঁথিতেছিল। কথার কোন উত্তর দিল না। পশুপতি কহিলেন, “আমার সঙ্গে কথা কও। যতক্ষণ থাক, ততক্ষণ সকল যন্ত্রণা বিস্মৃত হই|”
মনোরমা মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল। পশুপতির মুখপ্রতি চাহিয়া রহিল, ক্ষণেক পরে কহিল, “আমি তোমাকে কি বলিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু তাহা আমার মনে হইতেছে না |”
পশুপতি কহিলেন, “তুমি মনে কর। আমি অপেক্ষা করিতেছি |”
পশুপতি বসিয়া রহিলেন, মনোরমা মালা গাঁথিতে লাগিল।
অনেকক্ষণ পরে পশুপতি কহিলেন, “আমারও কিছু বলিবার আছে, মনোযোগ দিয়া শুন। আমি এ বয়স পর্যন্ত কেবল বিদ্যা উপার্জন করিয়াছি-বিষয়ালোচনা করিয়াছি, অর্থোপার্জন করিয়াছি। সংসারধর্ম করি নাই। যাহাতে অনুরাগ, তাহাই করিয়াছি, দারপরিগ্রহে অনুরাগ নাই, এজন্য তাহা করি নাই। কিন্তু যে পর্যন্ত তুমি আমার নয়নপথে আসিয়াছ, সেই পর্যন্ত মনোরমা- লাভ আমার একমাত্র ধ্যান হইয়াছে। সেই লাভের জন্য এই নিদারুণ ব্রতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। যদি জগদীশ্বরী অনুগ্রহ করেন, তবে দুই চারি দিনের মধ্যে রাজ্যলাভ করিব এবং তোমাকে বিবাহ করিব। ইহাতে তুমি বিধবা বলিয়া যে বিঘ্ন, শাস্ত্রীয় প্রমাণের দ্বারা আমি তাহার খণ্ডন করিতে পারিব। কিন্তু তাহাতে দ্বিতীয় বিঘ্ন এই যে, তুমি কুলীনকন্যা, জনার্দন শর্মা কুলীনশ্রেষ্ঠ, আমি শ্রোত্রিয় |”
মনোরমা এ সকল কথায় কর্ণপাত করিতেছিল কি না সন্দেহ। পশুপতি দেখিলেন যে, মনোরমা চিত্ত হারাইয়াছে। পশুপতি, সরলা অবিকৃতা বালিকা মনোরমাকে ভালবাসিতেন-প্রৌঢ়া তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী মনোরমাকে ভয় করিতেন। কিন্তু অদ্য ভাবান্তরে সন্তুষ্ট হইলেন না। তথাপি পুনরুদ্যম করিয়া পশুপতি কহিলেন, “কিন্তু কুলরীতি ত শাস্ত্রমূলক নহে, কুলনাশে ধর্মনাশ বা জাতিভ্রংশ হয় না। তাঁহার অজ্ঞাতে যদি তোমাকে বিবাহ করিতে পারি, তবে ক্ষতিই কি? তুমি সম্মত হইলেই, তাহা পারি। পরে তোমার পিতামহ জানিতে পারিলে বিবাহ ত ফিরিবে না|”
মনোরমা কোন উত্তর করিল না। সে সকল শ্রবণ করিয়াছিল কি না সন্দেহ। একটি কৃষ্ণবর্ণ মার্জার তাহার নিকটে আসিয়া বসিয়াছিল, সে সেই বিনাসূত্রের মালা তাহার গলদেশে পরাইতেছিল। পরাইতে মালা খুলিয়া গেল। মনোরমা তখন আপন মস্তক হইতে কেশগুচ্ছ ছিন্ন করিয়া, তৎসূত্রে আবার মালা গাঁথিতে লাগিল।
পশুপতি উত্তর না পাইয়া নি:শব্দে মালাকুসুমমধ্যে মনোরমার অনুপম অঙ্গুলির গতি মুগ্ধলোচনে দেখিতে লাগিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : বিহঙ্গী পিঞ্জরে
পশুপতি মনোরমার বুদ্ধিপ্রদীপ জ্বালিবার অনেক যত্ন করিতে লাগিলেন, কিন্তু ফলোৎপত্তি কঠিন হইল। পরিশেষে বলিলেন, “মনোরমা, রাত্রি অধিক হইয়াছে। আমি শয়নে যাই |”
মনোরমা অম্লানবদনে কহিলেন, “যাও |”
পশুপতি শয়নে গেলেন না। বসিয়া মালা গাঁথা দেখিতে লাগিলেন। আবার উপায়ান্তর স্বরূপ, ভয়সূচক চিন্তার আবির্ভাবে কার্য সিদ্ধ হইবেক ভাবিয়া, মনোরমাকে ভীতা করিবার জন্য পশুপতি কহিলেন, “মনোরমা, যদি ইতিমধ্যে যবন আইসে, তবে তুমি কোথায় যাইবে?”
মনোরমা মালা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিল, “বাটীতে থাকিব |”
পশুপতি কহিলেন, “বাটীতে তোমাকে কে রক্ষা করিবে?”
মনোরমা পূর্ববৎ অন্য মনে কহিল, “জানি না; নিরুপায় |”
পশুপতি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমাকে কি বলিতে মন্দিরে আসিয়াছ?”
ম। দেবতা প্রণাম করিতে।
পশুপতি বিরক্ত হইলেন। কহিলেন, “তোমাকে মিনতি করিতেছি, মনোরমা, এইবার যাহা বলিতেছি, তাহা মনোযোগ দিয়া শুন-তুমি আজিও বল, আমাকে বিবাহ করিবে কি না?”
মনোরমার মালা গাঁথা সম্পন্ন হইয়াছিল-সে তাহা একটা কৃষ্ণবর্ণ মার্জারের গলায় পরাইতেছিল। পশুপতির কথা কর্ণে গেল না। মার্জার মালা পরিধানে বিশেষ অনিচ্ছা প্রকাশ করিতেছিল-যতবার মনোরমা মালা তাহার গলায় দিতেছিল, ততবার সে মালার ভিতর হইতে মস্তক বাহির করিয়া লইতেছিল-মনোরমা কুন্দনিন্দিত দন্তে অধর দংশন করিয়া ঈষৎ হাসিতেছিল, আর আবার মালা তাহার গলায় দিতেছিল। পশুপতি অধিকতর বিরক্ত হইয়া বিড়ালকে এক চপেটাঘাত করিলেন-বিড়াল ঊর্ধ্বলাঙ্গুল হইয়া দূরে পলায়ন করিল। মনোরমা সেইরূপ দংশিতাধরে হাসিতে হাসিতে করস্থ মালা পশুপতিরই মস্তকে পরাইয়া দিল।
মার্জার-প্রসাদ মস্তকে পাইয়া রাজপ্রসাদভোগী ধর্মাধিকার হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন। অল্প ক্রোধ হইল-কিন্তু দংশিতাধরা হাস্যময়ীর তৎকালীন অনুপম রূপমাধুরী দেখিয়া তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল। তিনি মনোরমাকে আলিঙ্গন করিবার জন্য বাহু প্রসারণ করিলেন-অমনি মনোরমা লম্ফ দিয়া দূরে দাঁড়াইল-পথিমধ্যে উন্নতফণা কালসর্প দেখিয়া পথিক যেন দূরে দাঁড়ায়, সেইরূপ দাঁড়াইল।
পশুপতি অপ্রতিভ হইলেন; ক্ষণেক মনোরমার মুখপ্রতি চাহিতে পারিলেন না-পরে চাহিয়া দেখিলেন-মনোরমা প্রৌঢ়বয়:প্রফুল্লমুখী মহিমাময়ী সুন্দরী।
পশুপতি কহিলেন, “মনোরমা, দোষ ভাবিও না। তুমি আমার পত্নী-আমাকে বিবাহ কর।” মনোরমা পশুপতির মুখপ্রতি তীব্র কটাক্ষ করিয়া কহিল, “পশুপতি! কেশবের কন্যা কোথায়?”
পশুপতি কহিলেন, “কেশবের মেয়ে কোথায় জানি না-জানিতেও চাহি না। তুমি আমার একমাত্র পত্নী |”
ম। আমি জানি কেশবের মেয়ে কোথায়-বলিব?
পশুপতি অবাক হইয়া মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। মনোরমা বলিতে লাগিল, “একজন জ্যোতির্বিদ, গণনা করিয়া বলিয়াছিল যে, কেশবের মেয়ে অল্পবয়সে বিধবা হইয়া স্বামীর অনুমৃতা হইবে। কেশব এই কথায় অল্পকালে মেয়েকে হারাইবার ভয়ে বড়ই দু:খিত হইয়াছিলেন। তিনি ধর্মনাশের ভয়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করিলেন, কিন্তু বিধিলিপি খণ্ডাইবার ভরসায় বিবাহের রাত্রেই মেয়ে লইয়া প্রয়াগে পলায়ন করিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই ছিল যে, তাঁহার মেয়ে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ কস্মিন্কালে না পাইতে পারেন। দৈবাধীন কিছুকাল পরে, প্রয়াগে কেশবের মৃত্যু হইল। তাঁহার মেয়ে পূর্বেই মাতৃহীনা হইয়াছিল-এখন মৃত্যুকালে কেশব হৈমবতীকে আচার্যের হাতে সমর্পণ করিয়া গেলেন। মৃত্যুকালে কেশব আচার্যকে এই কথা বলিয়া গেলেন, ‘এই অনাথা মেয়েটিকে আপনার গৃহে রাখিয়া প্রতিপালন করিবেন। ইহার স্বামী পশুপতি-কিন্তু জ্যোতির্বিদেরা বলিয়া গিয়াছেন যে, ইনি অল্পবয়সে স্বামীর অনুমৃতা হইবেন। অতএব আপনি আমার নিকট স্বীকার করুন যে, এই মেয়েকে কখনও বলিবেন না যে, পশুপতি ইহার স্বামী। অথবা পশুপতিকে কখনও জানাইবেন না যে, ইনি তাঁহার স্ত্রী |”
“আচার্য সেইরূপ অঙ্গীকার করিলেন। সেই পর্যন্ত তিনি তাহাকে পরিবারস্থ করিয়া, প্রতিপালন করিয়া, তোমার সঙ্গে বিবাহের কথা লুকাইয়াছেন |”
প। এখন সে কন্যা কোথায়?
ম। আমিই কেশবের মেয়ে-জনার্দন শর্মা তাঁহার আচার্য।
পশুপতি চিত্ত হারাইলেন; তাঁহার মস্তক ঘুরিতে লাগিল। তিনি বাঙ্ানিষ্পত্তি না করিয়া প্রতিমাসমীপে সাষ্টাঙ্গ প্রাণপাত করিলেন। পরে গাত্রোত্থান করিয়া মনোরমাকে বক্ষে ধারণ করিতে গেলেন। মনোরমা পূর্ববৎ সরিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “এখন নয়-আরও কথা আছে |”
প। মনোরমা-রাক্ষসি! এতদিন কেন আমাকে এ অন্ধকারে রাখিয়াছিলে?
ম। কেন! তুমি কি আমার কথায় বিশ্বাস করিতে?
প। মনোরমা, তোমার কথায় কবে আমি অবিশ্বাস করিয়াছি? আর যদিই আমার অপ্রত্যয় জন্মিত, তবে আমি জনার্দন শর্মাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিতাম।
ম। জনার্দন কি তাহা প্রকাশ করিতেন? তিনি শিষ্যের নিকট সত্যে বদ্ধ আছেন।
প। তবে তোমার কাছে প্রকাশ করিলেন কেন?
ম। তিনি আমার নিকট প্রকাশ করেন নাই। একদিন গোপনে ব্রাহ্মণীর নিকট প্রকাশ করিতেছিলেন। আমি দৈবাৎ গোপনে শুনিয়াছিলাম। আরও আমি বিধবা বলিয়া পরিচিতা। তুমি আমার কথায় প্রত্যয় করিলে লোকে প্রত্যয় করিবে কেন? তুমি লোকের কাছে নিন্দনীয় না হইয়া কি প্রকারে আমাকে গ্রহণ করিতে?
প। আমি সকল লোককে একত্র করিয়া তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিতাম।
ম। ভাল, তাহাই হউক-জ্যোতির্বিদের গণনা?
প। আমি গ্রহশান্তি করাইতাম। ভাল, যাহা হইবার, তাহা হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে যদি আমি রত্ন পাইয়াছি, তবে আর তাহার গলা হইতে নামাইব না। তুমি আর আমার ঘর ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না।
মনোরমা কহিল, “এ ঘর ছাড়িতে হইবে। পশুপতি! আমি যাহা আজি বলিতে আসিয়াছিলাম, তাহা বলি শুন। এ ঘর ছাড়। তোমার রাজ্যলাভের দুরাশা ছাড়। প্রভুর অহিত চেষ্টা ছাড় । এ দেশ ছাড়িয়া চল, আমরা কাশীধামে যাত্রা করি। সেইখানে আমি তোমার চরণসেবা করিয়া জন্ম সার্থক করিব। যে দিন আমাদিগের আয়ু:শেষ হইবে, একত্রে পরমধামে যাত্রা করিব। যদি ইহা স্বীকার কর-আমার ভক্তি অচল থাকিবে। নহিলে___”
প। নহিলে কি?
মনোরমা তখন উন্নতমুখে, সবাষ্পলোচনে, দেবীপ্রতিমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, যুক্তকরে গদ্গদকণ্ঠে কহিল, “নহিলে, দেবীসমক্ষে শপথ করিতেছি, তোমায় আমায় এই সাক্ষাৎ, এ জন্মে আর সাক্ষাৎ হইবে না |”
পশুপতিও দেবীর সমক্ষে বদ্ধাঞ্জলি হইয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “মনোরমা-আমিও শপথ করিতেছি, আমার জীবন থাকিতে তুমি আমার বাড়ী ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না। মনোরমা, আমি যে পথে পদার্পণ করিয়াছি, সে পথ হইতে ফিরিবার থাকিলে আমি ফিরিতাম-তোমাকে লইয়া সর্বত্যাগী হইয়া কাশীযাত্রা করিতাম। কিন্তু অনেকদূর গিয়াছি, আর ফিরিবার উপায় নাই-যে গ্রন্থি বাঁধিয়াছি, তাহা আর খুলিতে পারি না-স্রোতে ভেলা ভাসাইয়া আর ফিরাইতে পারি না। যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে। তাই বলিয়া কি আমার পরমসুখে আমি বঞ্চিত হইব? তুমি আমার স্ত্রী, আমার কপালে যাই থাকুক, আমি তোমাকে গৃহিণী করিব। তুমি ক্ষণেক অপেক্ষা কর-আমি শীঘ্র আসিতেছি।” এই বলিয়া পশুপতি মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। মনোরমার চিত্তে সংশয় জন্মিল। সে চিন্তিতান্ত:করণে কিয়ৎক্ষণ মন্দিরমধ্যে দাঁড়াইয়া রহিল। আর একবার পশুপতর নিকট বিদায় না লইয়া যাইতে পারিল না।
অল্পকাল পরেই পশুপতি ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, “প্রাণাধিকে! আজি আর তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে পারিবে না। আমি সকল দ্বার রুদ্ধ করিয়া আসিয়াছি |”
মনোরমা বিহঙ্গী পিঞ্জরে বদ্ধ হইল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : যবনদূত-যমদূত বা
বেলা প্রহরের সময় নগরবাসীরা বিস্মিতলোচনে দেখিল, কোন অপরিচিতজাতীয় সপ্তদশ অশ্বারোহী পুরুষ রাজপথ অতিবাহিত করিয়া রাজভবনাভিমুখে যাইতেছে। তাহাদিগের আকারেঙ্গিত দেখিয়া নবদ্বীপবাসীরা ধন্যবাদ করিতে লাগিল। তাহাদিগের শরীর আয়ত, দীর্ঘ অথচ পুষ্ট; তাহাদিগের বর্ণ তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ; তাহাদিগের মুখমণ্ডল বিস্তৃত, ঘনকৃষ্ণশ্মশ্রু রাজিবিভূষিত; নয়ন প্রশস্ত, জ্বালাবিশিষ্ট। তাহাদিগের পরিচ্ছদ অনর্থক চাকচিক্যবর্জিত; তাহাদিগের যোদ্ধৃবেশ; সর্বাঙ্গে প্রহরণজালমণ্ডিত, লোচনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আর যে সকল সিন্ধুপার-জাত অশ্বপৃষ্ঠে তাহারা আরোহণ করিয়া যাইতেছিল, তাহারাই বা কি মনোহর! পর্বতশিলাখণ্ডের ন্যায় বৃহদাকার, বিমার্জিতদেহ, বক্রগ্রীব, বল্গা-রোধ-অসহিষ্ণু, তেজোগর্বে নৃত্যশীল! আরোহীরা কিবা তচ্চালন-কৌশলী-অবলীলাক্রমে সেই রুদ্ধবায়ুতুল্য তেজ:প্রখর অশ্ব সকল দমিত করিতেছে। দেখিয়া গৌড়বাসীরা বহুতর প্রশংসা করিল।
সপ্তদশ অশ্বারোহী দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় অধরৌষ্ঠ সংশ্লিষ্ট করিয়া নীরবে রাজপুরাভিমুখে চলিল। কৌতূহলবশত: কোন নগরবাসী কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, সমভিব্যাহারী একজন ভাষাজ্ঞ ব্যক্তি বলিয়া দিতে লাগিল, “ইহারা যবনরাজার দূত |” এই বলিয়া ইহারা প্রান্তপাল ও কোষ্ঠপালদিগের নিকট পরিচয় দিয়াছিল-এবং পশুপতির আজ্ঞাক্রমে সেই পরিচয়ে নির্বিঘ্নে নগরমধ্যে প্রবেশ লাভ করিল।
সপ্তদশ অশ্বারোহী রাজদ্বারে উপনীত হইল। বৃদ্ধ রাজার শৈথিল্যে আর পশুপতির কৌশলে রাজপুরী প্রায় রক্ষকহীন। রাজসভা ভঙ্গ হইয়াছিল-পুরীমধ্যে কেবল পৌরজন ছিল মাত্র-অল্পসংখ্যক দৌবারিক দ্বার রক্ষা করিতেছিল। একজন দৌবারিক জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কি জন্য আসিয়াছ?”
যবনেরা উত্তর করিল, “আমরা যবন-রাজপ্রতিনিধির দূত; গৌড়রাজের সহিত সাক্ষাৎ করিব |”
দৌবারিক কহিল, “মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর এক্ষণে অন্ত:পুরে গমন করিয়াছেন-এখন সাক্ষাৎ হইবে না |”
যবনেরা নিষেধ না শুনিয়া মুক্ত দ্বারপথে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইল। সর্বাগ্রে একজন খর্বকায়, দীর্ঘবাহু, কুরূপ যবন। দুর্ভাগ্যবশত: দৌবারিক তাহার গতিরোধজন্য শূলহস্তে তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল। কহিল, “ফের-নচেৎ এখনই মারিব |”
“আপনিই তবে মর!” এই বলিয়া ক্ষুদ্রাকার যবন দৌবারিককে নিজকরস্থ তরবারে ছিন্ন করিল। দৌবারিক প্রাণত্যাগ করিল। তখন আপন সঙ্গীদিগের মুখাবলোকন করিয়া ক্ষুদ্রকায় যবন কহিল, “এক্ষণে আপন কার্য কর |” অমনি বাক্যহীন ষোড়শ অশ্বারোহীদিগের মধ্য হইতে ভীষণ জয়ধ্বনি সমুত্থিত হইল। তখন সেই ষোড়শ যবনের কটিবদ্ধ হইতে ষোড়শ অসিফলক নিষ্কোষিত হইল এবং অশনিসম্পাতসদৃশ তাহারা দৌবারিকদিগের আক্রমণ করিল। দৌবারিকেরা রণসজ্জায় ছিল না-অকস্মাৎ নিরুদ্যোগে আক্রান্ত হইয়া আত্মরক্ষার কোন চেষ্টা করিতে পারিল না-মুহূর্তমধ্যে সকলেই নিহত হইল।
ক্ষুদ্রকায় যবন কহিল, “যেখানে যাহাকে পাও, বধ কর। পুরী অরক্ষিতা-বৃদ্ধ রাজাকে বধ কর |”
তখন যবনেরা পুরমধ্যে তাড়িতের ন্যায় প্রবেশ করিয়া বালবৃদ্ধবনিতা পৌরজন যেখানে যাহাকে দেখিল, তাহাকে অসি দ্বারা ছিন্নমস্তক, অথবা শূলাগ্রে বিদ্ধ করিল।
পৌরজন তুমুল আর্তনাদ করিয়া ইতস্তত: পলায়ন করিতে লাগিল। সেই ঘোর আর্তনাদ, অন্ত:পুরে যথা বৃদ্ধ রাজা ভোজন করিতেছিলেন, তথা প্রবেশ করিল। তাঁহার মুখ শুকাইল। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ঘটিয়াছে-যবন আসিয়াছে?”
পলায়নতৎপর পৌরজনেরা কহিল, “যবন সকলকে বধ করিয়া আপনাকে বধ করিতে আসিতেছে |”
কবলিত অন্নগ্রাস রাজার মুখ হইতে পড়িয়া গেল। তাঁহার শুষ্কশরীর জলস্রোত:প্রহত বেতসের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল। নিকটে রাজমহিষী ছিলেন-রাজা ভোজনপাত্রের উপর পড়িয়া যান দেখিয়া, মহিষী তাঁহার হস্ত ধরিলেন; কহিলেন, “চিন্তা নাই-আপনি উঠুন।” এই বলিয়া তাঁহার হস্ত ধরিয়া তুলিলেন। রাজা কলের পুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিলেন।
মহিষী কহিলেন, “চিন্তা কি? নৌকায় সকল দ্রব্য গিয়াছে, চলুন, আমরা খিড়কী দ্বার দিয়া সোণারগাঁ যাত্রা করি |”
এই বলিয়া মহিষী রাজার অধৌত হস্ত ধারণ করিয়া খিড়কিদ্বারপথে সুবর্ণগ্রাম যাত্রা করিলেন। সেই রাজকুলকলঙ্ক, অসমর্থ রাজার সঙ্গে গৌড়রাজ্যের রাজলক্ষ্মীও যাত্রা করিলেন।
ষোড়শ সহচর লইয়া মর্কটাকার বখ্ৌতিয়ার খিলিজি গৌড়েশ্বরের রাজপুরী অধিকার করিল।
ষষ্টি বৎসর পরে যবন-ইতিহাসবেত্তা মিন্হাাজ্গউদ্দীন এইরূপ লিখিয়াছিলেন। ইহার কতদূর সত্য, কতদূর মিথ্যা কে জানে? যখন মনুষ্যের লিখিত চিত্রে সিংহ পরাজিত, মনুষ্য সিংহের অপমানকর্তা স্বরূপ চিত্রিত হইয়াছিল, তখন সিংহের হস্তে চিত্রফলক দিলে কিরূপ চিত্র লিখিত হইত? মনুষ্য মূষিকতুল্য প্রতীয়মান হইত সন্দেহ নাই। মন্দভাগিনী বঙ্গভূমি সহজেই দুর্বলা, আবার তাহাতে শত্রুহস্তে চিত্রফলক!
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : জাল ছিঁড়িল
গৌড়েশ্বরপুরে অধিষ্ঠিত হইয়াই বখ্তিয়ার খিলিজি ধর্মাধিকারের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। ধর্মাধিকারের সহিত সাক্ষাতের অভিলাষ জানাইলেন। তাঁহার সহিত যবনের সন্ধিনিবন্ধ হইয়াছিল, তাহার ফলোৎপাদনের সময় উপস্থিত!
পশুপতি ইষ্টদেবীকে প্রণাম করিয়া, কুপিতা মনোরমার নিকট বিদায় লইয়া, কদাচিৎ উল্লসিত-কদাচিৎ শঙ্কিত চিত্তে যবনসমীপে উপস্থিত হইলেন। বখ্য়তিয়ার খিলিজি গাত্রোত্থান করিয়া সাদরে তাঁহার অভিবাদন করিলেন এবং কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। পশুপতি রাজভৃত্যবর্গের রক্তনদীতে চরণ প্রক্ষালন করিয়া আসিয়াছেন, সহসা কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। বখ্দতিয়ার খিলিজি তাঁহার চিত্তের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “পণ্ডিতবর! রাজসিংহাসন আরোহণের পথ কুসুমাবৃত নহে। এ পথে চলিতে গেলে, বন্ধুবর্গের অস্থিমুণ্ড সর্বদা পদে বিদ্ধ হয়|”
পশুপতি কহিলেন, “সত্য! কিন্তু যাহারা বিরোধী, তাহাদিগেরই বধ আবশ্যক। ইহারা নির্বিরোধী।”
বখ্পতিয়ার কহিলেন, “আপনি কি শোণিতপ্রবাহ দেখিয়া, নিজ অঙ্গীকার স্মরণে অসুখী হইতেছেন?”
পশুপতি কহিলেন, “যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা অবশ্য করিব। মহাশয়ও যে তদ্রূপ করিবেন, তাহাতে আমার কোন সংশয় নাই |”
ব। কিছুমাত্র সংশয় নাই। কেবলমাত্র আমাদিগের এক যাচ্ঞা আছে।
প। আজ্ঞা করুন।
ব। কুতব্ উদ্দীন গৌড়-শাসনভার আপনার প্রতি অর্পণ করিলেন। আজ হইতে আপনি বঙ্গে রাজপ্রতিনিধি হইলেন। কিন্তু যবন-সম্রাটের সঙ্কল্প এই যে, ইসলামধর্মাবলম্বী ব্যতীত কেহ তাঁহার রাজকার্যে সংলিপ্ত হইতে পারিবে না। আপনাকে ইসলামধর্ম অবলম্বন করিতে হইবে।
পশুপতির মুখ শুকাইল। তিনি কহিলেন, “সন্ধির সময়ে এরূপ কোন কথা হয় নাই |”
ব। যদি না হইয়া থাকে, তবে সেটা ভ্রান্তিমাত্র। আর এ কথা উত্থাপিত না হইলেও আপনার ন্যায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি দ্বারা অনায়াসেই অনুমিত হইয়া থাকিবে। কেন না, এমন কখনও সম্ভবে না যে, মুসলমানেরা বাঙ্গালা জয় করিয়াই আবার হিন্দুকে রাজ্য দিবে।
প। আমি বুদ্ধিমান বলিয়া আপনার নিকট পরিচিত হইতে পারিলাম না।
ব। না বুঝিয়া থাকেন, এখন বুঝিলেন; আপনি যবনধর্ম অবলম্বনে স্থিরসঙ্কল্প হউন।
প। (সদর্পে) আমি স্থিরসঙ্কল্প হইয়াছি যে, যবন-সম্রাটের সাম্রাজ্যের জন্যও সনাতনধর্ম ছাড়িয়া নরকগামী হইব না।
ব। ইহা আপনার ভ্রম। যাহাকে সনাতন ধর্ম বলিতেছেন, সে ভূতের পূজা মাত্র। কোরাণ- উক্ত ধর্মই সত্য ধর্ম। মহম্মদ ভজিয়া ইহকাল পরকালের মঙ্গলসাধন করুন।
পশুপতি যবনের শঠতা বুঝিলেন। তাহার অভিপ্রায় এই মাত্র এই যে, কার্যসিদ্ধি করিয়া নিবদ্ধ সন্ধি ছলক্রমে ভঙ্গ করিবে। আরও বুঝিলেন, ছলক্রমে না পারিলে, বলক্রমে করিবে। অতএব কপটের সহিত কাপট্য অবলম্বন না করিয়া দর্প করিয়া ভাল করেন নাই। তিনি ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “যে আজ্ঞা। আমি আজ্ঞানুবর্তী হইব|”
বখ্নতিয়ার তাঁহার মনের ভাব বুঝিলেন। বখ্ তিয়ার যদি পশুপতির অপেক্ষা চতুর না হইতেন, তবে এত সহজে গৌড়জয় করিতে পারিতেন না। বঙ্গভূমির অদৃষ্টলিপি এই যে, এ ভূমি যুদ্ধে জিত হইবে না; চাতুর্যেই ইহার জয়। চতুর ক্লাইব সাহেব ইহার দ্বিতীয় পরিচয়স্থান।
বখ্তিয়ার কহিলেন, “ভাল, ভাল। আজ আমাদিগের শুভ দিন। এরূপ কার্যে বিলম্বের প্রয়োজন নাই। আমাদিগের পুরোহিত উপস্থিত, এখনই আপনাকে ইসলামের ধর্মে দীক্ষিত করিবেন |”
পশুপতি দেখিলেন, সর্বনাশ! বলিলেন, “একবার মাত্র অবকাশ দিউন, পরিবারগণকে লইয়া আসি, সপরিবারে একেবারে দীক্ষিত হইব |”
বখ্েতিয়ার কহিলেন, “আমি তাঁহাদিগকে আনিতে লোক পাঠাইতেছি। আপনি এই প্রহরীর সঙ্গে গিয়া বিশ্রাম করুন |”
প্রহরী আসিয়া পশুপতিকে ধরিল। পশুপতি ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “সে কি? আমি কি বন্দী হইলাম?”
বখ্হতিয়ার কহিলেন, “আপাতত: তাহাই বটে!”
পশুপতি রাজপুরীমধ্যে নিরুদ্ধ হইলেন। ঊর্ণনাভের জাল ছিঁড়িল-সে জালে কেবল সে স্বয়ং জড়িত হইল।
আমরা পাঠক মহাশয়ের নিকট পশুপতিকে বুদ্ধিমান বলিয়া পরিচিত করিয়াছি। পাঠক মহাশয় বলিবেন, যে ব্যক্তি শত্রুকে এতদূর বিশ্বাস করিল, সহায়হীন হইয়া তাহাদিগের অধিকৃত পুরীমধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার চতুরতা কোথায়? কিন্তু বিশ্বাস না করিয়া কি করেন। এ বিশ্বাস না করিলে যুদ্ধ করিতে হয়। ঊর্ণনাভ জাল পাতে, যুদ্ধ করে না।
সেই দিন রাত্রিকালে মহাবন হইতে বিংশতি সহস্র যবন আসিয়া নবদ্বীপ প্লাবিত করিল। নবদ্বীপ-জয় সম্পন্ন হইল। যে সূর্য সেই দিন অস্তে গিয়াছে, আর তাহার উদয় হইল না। আর কি উদয় হইবে না? উদয়-অস্ত উভয়ই ত স্বাভাবিক নিয়ম!
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পিঞ্জর ভাঙ্গিল
যতক্ষণ পশুপতি গৃহে ছিলেন, ততক্ষণ তিনি মনোরমাকে নয়নে নয়নে রাখিয়াছিলেন। যখন তিনি যবনদর্শনে গেলেন, তখন তিনি গৃহের সকল দ্বার রুদ্ধ করিয়া শান্তশীলকে গৃহরক্ষায় রাখিয়া গেলেন।
পশুপতি যাইবামাত্র, মনোরমা পলায়নের উদ্যোগ করিতে লাগিল। গৃহের কক্ষে কক্ষে অনুসন্ধান করিতে লাগিল। পলায়নের উপযুক্ত কোন পথ মুক্ত দেখিল না। অতি ঊর্ধ্বে কতকগুলি গবাক্ষ ছিল; কিন্তু তাহা দুরারোহণীয়; তাহার মধ্য দিয়া মনুষ্যশরীর নির্গত হইবার সম্ভাবনা ছিল না; আর তাহা ভূমি হইতে এত উচ্চ যে, তথা হইতে লম্ফ দিয়া ভূমিতে পড়িলে অস্থি চূর্ণ হইবার সম্ভাবনা। মনোরমা উন্মাদিনী; সেই গবাক্ষপথেই নিষ্ক্রান্ত হইবার মানস করিল।
অতএব পশুপতি যাইবার ক্ষণকাল পরেই মনোরমা পশুপতির শয্যাগৃহে পালঙ্কের উপর আরোহণ করিল। পালঙ্ক হইতে গবাক্ষরোহণ সুলভ হইল। পালঙ্ক হইতে গবাক্ষ অবলম্বন করিয়া, মনোরমা গবাক্ষরন্ধ্র দিয়া প্রথমে দুই হস্ত, পশ্চাৎ মস্তক, পরে বক্ষ পর্যন্ত বাহির করিয়া দিল। গবাক্ষনিকটে উদ্যানস্থ একটি আম্রবৃক্ষের ক্ষুদ্র শাখা দেখিল। মনোরমা তাহা ধারণ করিল; এবং তখন পশ্চাদ্ভাগ গবাক্ষ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া, শাখাবলম্বনে ঝুলিতে লাগিল। কোমল শাখা তাহার ভরে নমিত হইল; তখন ভূমি তাহার চরণ হইতে অনতিদূরবর্তী হইল। মনোরমা শাখা ত্যাগ করিয়া অবলীলাক্রমে ভূতলে পড়িল। এবং তিলমাত্র অপেক্ষা না করিয়া জনার্দনের গৃহাভিমুখে চলিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ : যবনবিপ্লব
সেই নিশীথে নবদ্বীপ নগর বিজয়োন্মত্ত যবনসেনার নিষ্পীড়নে বাত্যাসন্তাড়িত তরঙ্গোৎক্ষেপী সাগর সদৃশ চঞ্চল হইয়া উঠিল। রাজপথ, ভূরি ভূরি অশ্বারোহিগণে, ভূরি পদাতিদলে, ভূরি ভূরি খড়্গী, ধানুকী, শূলিসমূহসমারোহে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। সেনাবলহীন রাজধানীর নাগরিকেরা ভীত হইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল; দ্বার রুদ্ধ করিয়া সভয়ে ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিল।
যবনেরা রাজপথে যে দুই একজন হতভাগ্য আশ্রয়হীন ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হইল, তাহাদিগকে শূলবিদ্ধ করিয়া রুদ্ধদ্বার ভবনসকল আক্রমণ করিতে লাগিল। কোথায়ও বা দ্বার ভগ্ন করিয়া, কোথায়ও বা প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া, কোথায়ও শঠতাপূর্বক ভীত গৃহস্থকে জীবনাশা দিয়া গৃহপ্রবেশ করিতে লাগিল। গৃহপ্রবেশ করিয়া, গৃহস্থের সর্বস্বাপহরণ, পশ্চাৎ স্ত্রী-পুরুষ, বৃদ্ধ, বনিতা, বালক সকলেরই শিরশ্ছেদ, ইহাই নিয়মপূর্বক করিতে লাগিল। কেবল যুবতীর পক্ষে দ্বিতীয় নিয়ম।
শোণিতে গৃহস্থের গৃহসকল প্লাবিত হইতে লাগিল। শোণিতে রাজপথ পঙ্কিল হইল। শোণিতে যবনসেনা রক্তচিত্রময় হইল। অপহৃত দ্রব্যজাতের ভারে অশ্বের পৃষ্ঠ এবং মনুষ্যের স্কন্ধ পীড়িত হইতে লাগিল। শূলাগ্রে বিদ্ধ হইয়া ব্রাহ্মণের মুণ্ডসকল ভীষণভাব ব্যক্ত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণের যজ্ঞোপবীত অশ্বের গলদেশে দুলিতে লাগিল। সিংহাসনস্থ শালগ্রামশিলাসকল যবন-পদাঘাতে গড়াইতে লাগিল।
ভয়ানক শব্দে নৈশাকাশ পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। অশ্বের পদধ্বনি, সৈনিকের কোলাহল হস্তীর বৃংহিত, যবনের জয়শব্দ. তদুপরি পীড়িতের আর্তনাদ। মাতার রোদন, শিশুর রোদন; বৃদ্ধের করুণাকাঙ্ক্ষা, যুবতীর কণ্ঠবিদার।
যে বীরপুরুষকে মাধবাচার্য এত যত্নে যবনদমনার্থ নবদ্বীপে লইয়া আসিয়াছিলেন, এ সময়ে তিনি কোথা?
এই ভয়ানক যবনপ্রলয়কালে, হেমচন্দ্র রণোন্মুখ নহেন। একাকী রণোন্মুখ হইয়া কি করিবেন?
হেমচন্দ্র তখন আপন গৃহের শয়নমন্দিরে, শয্যোপরি শয়ন করিয়া ছিলেন। নগরাক্রমণের কোলাহল তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল। তিনি দিগ্বিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের শব্দ?”
দিগ্বিজয় কহিল, “যবনসেনা নগর আক্রমণ করিয়াছে |”
হেমচন্দ্র চমৎকৃত হইলেন। তিনি এ পর্যন্ত বখ্ তিয়ারকর্তৃক রাজপুরাধিকার এবং রাজার পলায়নের বৃত্তান্ত শুনেন নাই। দিগ্বিজয় তদ্বিশেষ হেমচন্দ্রকে শুনাইল।
হেমচন্দ্র কহিলেন, “নাগরিকেরা কি করিতেছে?”
দি। যে পারিতেছে পলায়ন করিতেছে, যে না পারিতেছে সে প্রাণ হারাইতেছে।
হে। আর গৌড়ীয় সেনা?
দি। কাহার জন্য যুদ্ধ করিবে? রাজা ত পলাতক। সুতরাং তাহারা আপন আপন পথ দেখিতেছে।
হে। আমার অশ্বসজ্জা কর।
দিগ্বিজয় বিস্মিত হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবেন?”
হে। নগরে।
দি। একাকী?
হেমচন্দ্র ভ্রূকুটি করিলেন। ভ্রূকুটি দেখিয়া দিগ্বিজয় ভীত হইয়া অশ্বসজ্জা করিতে গেল।
হেমচন্দ্র তখন মহামূল্য রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া সুন্দর অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। এবং ভীষণ শূলহস্তে নির্ঝরিণীপ্রেরিত জলবিম্ববৎ সেই অসীম যবন-সেনা-সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন।
হেমচন্দ্র দেখিলেন, যবনেরা যুদ্ধ করিতেছে না, কেবল অপহরণ করিতেছে। যুদ্ধজন্য কেহই তাহাদিগের সম্মুখীন হয় নাই, সুতরাং যুদ্ধে তাহাদিগেরও মন ছিল না। যাহাদিগের অপহরণ করিতেছিল, তাহাদিগকেই অপহরণকালে বিনা যুদ্ধে মারিতেছিল। সুতরাং যবনেরা দলবদ্ধ হইয়া হেমচন্দ্রকে নষ্ট করিবার কোন উদ্যোগ করিল না। যে কোন যবন তৎকর্তৃক আক্রান্ত হইয়া তাঁহার সহিত একা যুদ্ধোদ্যম করিল, সে তৎক্ষণাৎ মরিল।
হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। তিনি যুদ্ধাকাঙ্ক্ষায় আসিয়াছিলেন, কিন্তু যবনেরা পূর্বেই বিজয়লাভ করিয়াছে, অর্থসংগ্রহ ত্যাগ করিয়া তাঁহার সহিত রীতিমত যুদ্ধ করিল না। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “একটি একটি করিয়া গাছের পাতা ছিঁড়িয়া কে অরণ্যকে নিষ্পত্র করিতে পারে? একটি একটি যবন মারিয়া কি করিব? যবন যুদ্ধ করিতেছে না-যবনবধেই বা কি সুখ? বরং গৃহীদের রক্ষার সাহায্যে মন দেওয়া ভাল |” হেমচন্দ্র তাহাই করিতে লাগিলেন, কিন্তু বিশেষ কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। দুইজন যবন তাঁহার সহিত যুদ্ধ করে, অপর যবনে সেই অবসরে গৃহস্থদিগের সর্বস্বান্ত করিয়া চলিয়া যায়। যাহাই হউক, হেমচন্দ্র যথাসাধ্য পীড়িতের উপকার করিতে লাগিলেন। পথপার্শ্বে এক কুটীরমধ্য হইতে হেমচন্দ্র আর্তনাদ শ্রবণ করিলেন। যবনকর্তৃক আক্রান্ত ব্যক্তির আর্তনাদ বিবেচনা করিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
দেখিলেন গৃহমধ্যে যবন নাই। কিন্তু গৃহমধ্যে যবনদৌরাত্ম্যের চিহ্ন সকল বিদ্যমান রহিয়াছে। দ্রব্যাদি প্রায় কিছুই নাই, যাহা আছে তাহার ভগ্নাবস্থা, আর এক ব্রাহ্মণ আহত অবস্থায় ভূমে পড়িয়া আর্তনাদ করিতেছে। সে এ প্রকার গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে যে, মৃত্যু আসন্ন। হেমচন্দ্রকে দেখিয়া সে যবনভ্রমে কহিতে লাগিল, “আইস-প্রহার কর-শীঘ্র মরিব-মার-আমার মাথা লইয়া সেই রাক্ষসীকে দিও-আ:-প্রাণ যায়-জল! জল! কে জল দিবে!”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার ঘরে জল আছে?”
ব্রাহ্মণ কাতরোক্তিতে কহিতে লাগিল, “জানি না-মনে হয় না-জল! জল! পিশাচী!-সেই পিশাচীর জন্য প্রাণ গেল!”
হেমচন্দ্র কুটীরমধ্যে অন্বেষণ করিয়া দেখিলেন, এক কলসে জল আছে। পাত্রাভাবে পত্রপুটে তাহাকে জলদান করিলেন।
ব্রাহ্মণ কহিল, না! না! জল খাইব না! যবনের জল খাইব না |” হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যবন নহি, আমি হিন্দু, আমার হাতের জল পান করিতে পার। আমার কথায় বুঝিতে পারিতেছ না?”
ব্রাহ্মণ জল পান করিল। হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার আর কি উপকার করিব?”
ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কি করিবে? আর কি? আমি মরি! মরি! যে মরে তাহার কি করিবে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার কেহ আছে? তাহাকে তোমার নিকট রাখিয়া যাইব?”
ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কে-কে আছে? ঢের আছে। তার মধ্যে সেই রাক্ষসী! সেই রাক্ষসী-তাহাকে বলিও-বলিও আমার অপ-অপরাধের প্রতিশোধ হইয়াছে |”
হে। কে সে? কাহাকে বলিব?
ব্রাহ্মণ কহিতে লাগিল, “কে সে পিশাচী! পিশাচী চেন না? পিশাচী মৃণালিনী-মৃণালিনী! মৃণালিনী-পিশাচী |”
ব্রাহ্মণ অধিকতর আর্তনাদ করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নাম শুনিয়া চমকিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃণালিনী তোমার কে হয়?”
ব্রাহ্মণ কহিলেন, “মৃণালিনী কে হয়? কেহ না-আমার যম |”
হে। মৃণালিনী তোমার কি করিয়াছে?
ব্রা। কি করিয়াছে?-কিছু না-আমি-আমি তার দুর্দশা করিয়াছি, তাহার প্রতিশোধ হইল-
হে। কি দুর্দশা করিয়াছ?
ব্রা। আর কথা কহিতে পারি না, জল দাও।
হেমচন্দ্র পুনর্বার তাহাকে জলপান করাইলেন। ব্রাহ্মণ জলপান করিয়া স্থির হইলে হেমচন্দ্র তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?”
ব্রা। ব্যোমকেশ।
হেমচন্দ্রের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। দন্তে অধর দংশন করিলেন। করস্থ শূল দৃঢ়তর মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ধরিলেন। আবার তখনই শান্ত হইয়া কহিলেন, “তোমার নিবাস কোথা?”
ব্রা। গৌড়-গৌড় জান না? মৃণালিনী আমাদের বাড়ীতে থাকিত।
হে। তার পর?
ব্রা। তার পর-তার পর আর কি? তার পর আমার এই দশা-মৃণালিনী পাপিষ্ঠা; বড় নির্দয়-আমার প্রতি ফিরিয়াও চাহিল না। রাগ করিয়া আমার পিতার নিকট আমি তাহার নামে মিছা কলঙ্ক রটাইলাম। পিতা তাহাকে বিনাদোষে তাড়াইয়া দিলেন। রাক্ষসী-রাক্ষসী আমাদের ছেড়ে গেল।
হে। তবে তুমি তাহাকে গালি দিতেছ কেন?
ব্রা। কেন?-কেন? গালি-গালি দিই? মৃণালিনী আমাকে ফিরিয়া দেখিত না-আমি-আমি তাহাকে দেখিয়া জীবন-জীবন ধারণ করিতাম। সে চলিয়া আসিল, সেই-সেই অবধি আমার সর্বস্ব ত্যাগ, তাহার জন্য কোন্ দেশে-কোন্ দেশে না গিয়াছি-কোথায় পিশাচীর সন্ধান না করিয়াছি? গিরিজায়া-ভিখারীর মেয়ে-তার আয়ি বলিয়া দিল-নবদ্বীপে আসিয়াছে-নবদ্বীপে আসিলাম, সন্ধান নাই। যবন-যবন-হস্তে মরিলাম, রাক্ষসীর জন্য মরিলাম-দেখা হইলে বলিও-আমার পাপের ফল ফলিল।
আর ব্যোমকেশের কথা সরিল না। সে পরিশ্রমে একেবারে নির্জীব হইয়া পড়িল। নির্বাণোন্মুখ দীপ নিবিল! ক্ষণপরে বিকট মুখভঙ্গী করিয়া ব্যোমকেশ প্রাণত্যাগ করিল।
হেমচন্দ্র আর দাঁড়াইলেন না। আর যবন বধ করিলেন না-কোন মতে পথ করিয়া গৃহাভিমুখে চলিলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ : মৃণালিনীর সুখ কি?
যেখানে হেমচন্দ্র তাঁহাকে সোপানপ্রস্তরাঘাতে ব্যথিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন-মৃণালিনী এখনও সেইখানে। পৃথিবীতে যাইবার আর স্থান ছিল না-সর্বত্র সমান হইয়াছিল। নিশা প্রভাতা হইল, গিরিজায়া যত কিছু বলিলেন-মৃণালিনী কোন উত্তর দিলেন না, অধোবদনে বসিয়া রহিলেন। স্নানাহারের সময় উপস্থিত হইল-গিরিজায়া তাঁহাকে জলে নামাইয়া স্নান করাইল। স্নান করিয়া মৃণালিনী আর্দ্রবসনে সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন। গিরিজায়া স্বয়ং ক্ষুধাতুরা হইল-কিন্তু গিরিজায়া মৃণালিনীকে উঠাইতে পারিল না-সাহস করিয়া বার বার বলিতেও পারিল না। সুতরাং নিকটস্থ বন হইতে কিঞ্চিৎ ফলমূল সংগ্রহ করিয়া ভোজন জন্য মৃণালিনীকে দিল। মৃণালিনী তাহা স্পর্শ করিলেন মাত্র। প্রসাদ গিরিজায়া ভোজন করিল-ক্ষুধার অনুরোধে মৃণালিনীকে ত্যাগ করিল না।
এইরূপে পূর্বাচলের সূর্য মধ্যাকাশে, মধ্যাকাশের সূর্য পশ্চিমে গেলেন। সন্ধ্যা হইল। গিরিজায়া দেখিলেন যে, তখনও মৃণালিনী গৃহে প্রত্যাগমন করিবার লক্ষণ প্রকাশ করিতেছেন না। গিরিজায়া বিশেষ চঞ্চলা হইলেন। পূর্বরাত্রে জাগরণ গিয়াছে-এ রাত্রেও জাগরণের আকার। গিরিজায়া কিছু বলিল না-বৃক্ষপল্লব সংগ্রহ করিয়া সোপানোপরি আপন শয্যা রচনা করিল। মৃণালিনী তাহার অভিপ্রায় বুঝিয়া কহিলেন, “তুমি ঘরে গিয়া শোও |”
গিরিজায়া মৃণালিনীর কথা শুনিয়া আনন্দিত হইল। বলিল, “একত্রে যাইব |”
মৃণালিনী বলিলেন, “আমি যাইতেছি |”
গি। আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করিব। ভিখারিণী দুই দণ্ড পাতা পাতিয়া শুইলে ক্ষতি কি? কিন্তু সাহস পাই ত বলি-রাজপুত্রের সহিত এ জন্মের মত সম্বন্ধ ঘুচিল-তবে আর কার্তিকের হিমে আমরা কষ্ট পাই কেন?
মৃ। গিরিজায়া-হেমচন্দ্রের সহিত এ জন্মে আমার সম্বন্ধ ঘুচিবে না। আমি কালিও হেমচন্দ্রের দাসী ছিলাম-আজিও তাঁহার দাসী।
গিরিজায়ার বড় রাগ হইল-সে উঠিয়া বসিল। বলিল, “কি ঠাকুরাণি! তুমি এখনও বল-তুমি সেই পাষণ্ডের দাসী! তুমি যদি তাঁহার দাসী-তবে আমি চলিলাম-আমার এখানে আর প্রয়োজন নাই |”
মৃ। গিরিজায়া-যদি হেমচন্দ্র তোমাকে পীড়ন করিয়া থাকেন, তুমি স্থানান্তরে তাঁর নিন্দা করিও। হেমচন্দ্র আমার প্রতি কোন অত্যাচার করেন নাই-আমি কেন তাঁহার নিন্দা সহিব? তিনি রাজপুত্র-আমার স্বামী; তাঁহাকে পাষণ্ড বলিও না।
গিরিজায়া আরও রাগ করিল। বহুযত্নরচিত পর্ণশয্যা ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। কহিল, “পাষণ্ড বলিব না?-একবার বলিব?” (বলিয়াই কতকগুলি শয্যাবিন্যাসের পল্লব সদর্পে জলে ফেলিয়া দিল) “একবার বলিব?-দশবার বলিব” (আবার পল্লব নিক্ষেপ)-“শতবার বলিব” (পল্লব নিক্ষেপ)-“হাজারবার বলিব।” এইরূপে সকল পল্লব জলে গেল। গিরিজায়া বলিতে লাগিল, “পাষণ্ড বলিব না? কি দোষে তোমাকে তিনি এত তিরস্কার করিলেন?”
মৃ। সে আমারই দোষ-আমি গুছাইয়া সকল কথা তাঁহাকে বলিতে পারি নাই-কি বলিতে কি বলিলাম।
গি। ঠাকুরাণি! আপনার কপাল টিপিয়া দেখ।
মৃণালিনী ললাট স্পর্শ করিলেন।
গি। কি দেখিলে?
মৃ। বেদনা।
গি। কেন হইল?
মৃ। মনে নাই।
গি। তুমি হেমচন্দ্রের অঙ্গে মাথা রাখিয়াছিলে-তিনি ফেলিয়া দিয়া গিয়াছেন। পাতরে পড়িয়া তোমার মাথায় লাগিয়াছে।
মৃণালিনী ক্ষণেক চিন্তা করিয়া দেখিলেন-কিছু মনে পড়িল না। বলিলেন, “মনে হয় না; বোধ হয় আমি আপনি পড়িয়া গিয়া থাকিব |”
গিরিজায়া বিস্মিতা হইল। বলিল, “ঠাকুরাণি! এ সংসারে আপনি সুখী |”
মৃ। কেন?
গি। আপনি রাগ করেন না।
মৃ। আমিই সুখী-কিন্তু তাহার জন্য নহে।
গি। তবে কিসে?
মৃ। হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ পাইয়াছি।
নবম পরিচ্ছেদ : স্বপ্ন
গিরিজায়া কহিল, “গৃহে চল।” মৃণালিনী বলিলেন, “নগরে এ কিসের গোলযোগ?” তখন যবনসেনা নগর মন্থন করিতেছিল।
তুমুল কোলাহল শুনিয়া উভয়ের শঙ্কা হইল। গিরিজায়া বলিল, “চল, এই বেলা সতর্ক হইয়া যাই |” কিন্তু দুইজন রাজপথের নিকট পর্যন্ত গিয়া দেখিলেন, গমনের কোন উপায়ই নাই। অগত্যা প্রত্যাগমন করিয়া সরোবর-সোপানে বসিলেন। গিরিজায়া বলিল, “যদি এখানে উহারা আইসে?”
মৃণালিনী নীরবে রহিলেন। গিরিজায়া আপনিই বলিল, “বনের ছায়ামধ্যে এমন লুকাইব-কেহ দেখিতে পাইবে না |”
উভয়ে আসিয়া সোপানোপরি উপবেশন করিয়া রহিলেন।
মৃণালিনী ম্লানবদনে গিরিজায়াকে কহিলেন, “গিরিজায়া, বুঝি আমার যথার্থই সর্বনাশ উপস্থিত হইল |”
গি। সে কি!
মৃ। এই এক অশ্বারোহী গমন করিল; ইনি হেমচন্দ্র। সখি-নগরে ঘোর যুদ্ধ হইতেছে; যদি নি:সহায় প্রভু সে যুদ্ধে গিয়া থাকেন-না জানি কি বিপদে পড়িবেন!
গিরিজায়া কোন উত্তর করিতে পারিল না। তাহার নিদ্রা আসিতেছিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মৃণালিনী দেখিলেন যে, গিরিজায়া ঘুমাইতেছে।
মৃণালিনীও, একে আহারনিদ্রাভাবে দুর্বলা-তাহাতে সমস্ত রাত্রিদিন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলেন, সুতরাং নিদ্রা ব্যতীত আর শরীর বহে না-তাঁহারও তন্দ্রা আসিল। নিদ্রায় তিনি স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন যে, হেমচন্দ্র একাকী সর্বসমরে বিজয়ী হইয়াছেন। মৃণালিনী যেন বিজয়ী বীরকে দেখিতে রাজপথে দাঁড়াইয়াছিলেন। রাজপথে হেমচন্দ্রের অগ্রে, পশ্চাৎ, কত হস্তী, অশ্ব, পদাতি যাইতেছে। মৃণালিনীকে যেন সেই সেনাতরঙ্গ ফেলিয়া দিয়া চরণদলিত করিয়া চলিয়া গেল-তখন হেমচন্দ্র নিজ সৈন্ধবী তুরঙ্গী হইতে অবতরণ করিয়া তাঁহাকে হস্ত ধরিয়া উঠাইলেন। তিনি যেন হেমচন্দ্রকে বলিলেন, “প্রভু! অনেক যন্ত্রণা পাইয়াছি; দাসীকে আর ত্যাগ করিও না |” হেমচন্দ্র যেন বলিলেন, “আর কখন তোমায় ত্যাগ করিব না |” সেই কণ্ঠসবরে যেন-
তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল, “আর কখনও তোমায় ত্যাগ করিব না” জাগ্রতেও এই কথা শুনিলেন। চক্ষু উন্মীলন করিলেন-কি দেখিলেন? যাহা দেখিলেন, তাহা বিশ্বাস হইল না। আবার দেখিলেন সত্য! হেমচন্দ্র সম্মুখে! হেমচন্দ্র বলিতেছেন-“আর একবার ক্ষমা কর-আর কখনও তোমায় ত্যাগ করিব না |”
নিরভিমানিনী, নির্লজ্জা মৃণালিনী আবার তাঁহার কণ্ঠলগ্না হইয়া স্কন্ধে মস্তক রক্ষা করিলেন।
দশম পরিচ্ছেদ : প্রেম-নানা প্রকার
আনন্দাশ্রুপ্লাবিত-বদনা মৃণালিনীকে হেমচন্দ্র হস্তে ধরিয়া উপবন-গৃহাভিমুখে লইয়া চলিলেন। হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে একবার অপমানিতা, তিরস্কৃতা, ব্যথিতা করিয়া ত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন, আবার আপনি আসিয়াই তাঁহাকে হৃদয়ে গ্রহণ করিলেন,-ইহা দেখিয়া গিরিজায়া বিস্মিতা হইল, কিন্তু মৃণালিনী একটি কথাও জিজ্ঞাসা করিলেন না, একটি কথাও কহিলেন না। আনন্দপরিপ্লববিবশা হইয়া বসনে অশ্রুস্রুতি আবৃত করিয়া চলিলেন। গিরিজায়াকে ডাকিতে হইল না-সে স্বয়ং অন্তরে থাকিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
উপবনবাটিকায় মৃণালিনী আসিলে, তখন উভয়ে বহুদিনের হৃদয়ের কথা সকল ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তখন হেমচন্দ্র, যে যে ঘটনায় মৃণালিনীর প্রতি তাঁহার চিত্তের বিরাগ হইয়াছিল আর যে যে কারণে সেই বিরাগের ধ্বংস হইয়াছিল, তাহা বলিলেন। তখন মৃণালিনী যে প্রকারে হৃষীকেশের গৃহ ত্যাগ করিয়াছিলেন, যে প্রকারে নবদ্বীপে আসিয়াছিলেন, সেই সকল বলিলেন। তখন উভয়েই হৃদয়ের পূর্বোদিত কত ভাব পরস্পরের নিকট ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তখন উভয়েই কত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কল্পনা করিতে লাগিলেন; তখন কতই নূতন নূতন প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ হইতে লাগিলেন। তখন উভয়ে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন কত কথাই অতি প্রয়োজনীয় কথার ন্যায় আগ্রহ সহকারে ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তখন কতবার উভয়ে মোক্ষোন্মুখ অশ্রুজল কষ্টে নিবারিত করিলেন। তখন কতবার উভয়ের মুখপ্রতি চাহিয়া অনর্থক মধুর হাসি হাসিলেন; সে হাসির অর্থ “আমি এখন কত সুখী!” পরে যখন প্রভাতোদয়সূচক পক্ষিগণ রব করিয়া উঠিল, তখন কতবার উভয়েই বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন যে, আজি এখনই রাত্রি পোহাইল কেন?-আর সেই নগরমধ্যে যবনবিপ্লবের যে কোলাহল উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের বীচিরববৎ উঠিতেছিল-আজ হৃদয়সাগরের তরঙ্গরবে সে রব ডুবিয়া গেল।
উপবন-গৃহে আর এক স্থানে আর একটা কাণ্ড হইয়াছিল। দিগ্বিজয় প্রভুর আজ্ঞামত রাত্রি জাগরণ করিয়া গৃহরক্ষা করিতেছিল, মৃণালিনীকে লইয়া যখন হেমচন্দ্র আইসেন, তখন সে দেখিয়া চিনিল। মৃণালিনী তাহার নিকট অপিরিচিতা ছিলেন না-যে কারণে পরিচিতা ছিলেন, তাহা ক্রমে প্রকাশ পাইতেছে। মৃণালিনীকে দেখিয়া দিগ্বিজয় কিছু বিস্মিত হইল, কিন্তু জিজ্ঞাসা সম্ভাবনা নাই, কি করে? ক্ষণেক পরে গিরিজায়াও আসিল দেখিয়া দিগ্বিজয় মনে ভাবিল “বুঝিয়াছি-ইহারা দুইজন গৌড় হইতে আমাদিগের দুইজনকে দেখিতে আসিয়াছে। ঠাকুরাণী যুবরাজকে দেখিতে আসিয়াছেন, আর এটা আমাকে দেখিতে আসিয়াছে সন্দেহ নাই |” এই ভাবিয়া দিগ্বিজয় একবার আপনার গোঁপদাড়ি চুমরিয়া লইল, এবং ভাবিল, “না হবে কেন?” আবার ভাবিল, “এটা কিন্তু বড়ই নষ্ট-একদিনের তরে কই আমাকে ভাল কথা বলে নাই-কেবল আমাকে গালিই দেয়-তবে ও আমাকে দেখিতে আসিবে, তাহার সম্ভাবনা কি? যাহা হউক, একটা পরীক্ষা করিয়া দেখা যাউক। রাত্রি ত শেষ হইল-প্রভুও ফিরিয়া আসিয়াছেন; এখন আমি পাশ কাটিয়া একটুকু শুই। দেখি, পিয়ারী আমাকে খুঁজিয়া নেয় কি না?” ইহা ভাবিয়া দিগ্বিজয় এক নিভৃত স্থানে গিয়া শয়ন করিল। গিরিজায়া তাহা দেখিল।
গিরিজায়া তখন মনে মনে বলিতে লাগিল, “আমি ত মৃণালিনীর দাসী-মৃণালিনী এ গৃহের কর্ত্রী হইলেন অথবা হইবেন-তবে ত বাড়ীর গৃহকর্ম করিবার অধিকার আমারই |” এইরূপ মনকে প্রবোধ দিয়া গিরিজায়া একগাছা ঝাঁটা সংগ্রহ করিল এবং যে ঘরে দিগ্বিজয় শয়ন করিয়া আছে, সেই ঘরে প্রবেশ করিল। দিগ্বিজয় চক্ষু বুজিয়া আছে, পদধ্বনিতে বুঝিল যে, গিরিজায়া আসিল-মনে বড় আনন্দ হইল-তবে ত গিরিজায়া তাহাকে ভালবাসে। দেখি, গিরিজায়া কি বলে? এই ভাবিয়া দিগ্বিজয় চক্ষু বুজিয়াই রহিল। অকস্মাৎ তাহার পৃষ্ঠে দুম দাম করিয়া ঝাঁটার ঘা পড়িতে লাগিল। গিরিজায়া গলা ছাড়িয়া বলিতে লাগিল, “আ: মলো, ঘরগুলায় ময়লা জমিয়া রহিয়াছে দেখ-এ কি? এক মিন্সে! চোর না কি? মলো মিন্সে, রাজার ঘরে চুরি!” এই বলিয়া আবার সম্মার্জনীর আঘাত। দিগ্বিজয়ের পিট ফাটিয়া গেল।
“ও গিরিজায়া, আমি! আমি!”
“আমি! আরে তুই বলিয়াই ত খাঙ্গরা দিয়া বিছাইয়া দিতেছি |” এই বলিবার পর আবার বিরাশি সিক্কা ওজনে ঝাঁটা পড়িতে লাগিল।
“দোহাই! দোহাই! গিরিজায়া! আমি দিগ্বিজয়!”
“আবার চুরি করিতে এসে-আমি দিগ্বিজয়! দিগ্বিজয় কে রে মিন্সে!” ঝাঁটার বেগ আর থামে না।
দিগ্বিজয় এবার সকাতরে কহিল, “গিরিজায়া, আমাকে ভুলিয়া গেলে?”
গিরিজায়া বলিল, “তোর আমার সঙ্গে কোন্ পুরুষে আলাপ রে মিন্সে?”
দিগ্বিজয় দেখিল নিস্তার নাই – রণে ভঙ্গ দেওয়াই পরামর্শ। দিগ্বিজয় তখন অনুপায় দেখিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে গৃহ হইতে পলায়ন করিল। গিরিজায়া সম্মার্জনী হস্তে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইল।
একাদশ পরিচ্ছেদ : পূর্ব পরিচয়
প্রভাতে হেমচন্দ্র মাধবাচার্যের অনুসন্ধানে যাত্রা করিলেন। গিরিজায়া আসিয়া মৃণালিনীর নিকট বসিল।
গিরিজায়া মৃণালিনীর দু:খের ভাগিনী হইয়াছিল, সহৃদয় হইয়া দু:খের সময় দু:খের কাহিনী সকল শুনিয়াছিল। আজি সুখের দিনে সে কেন সুখের ভাগিনী না হইবে? আজি সেইরূপ সহৃদয়তার সহিত সুখের কথা কেন না শুনিবে? গিরিজায়া ভিখারিণী, মৃণালিনী মহাধনীর কন্যা-উভয়ে এতদূর সামাজিক প্রভেদ। কিন্তু দু:খের দিনে গিরিজায়া মৃণালিনীর একমাত্র সুহৃৎ, সে সময়ে ভিখারিণী আর রাজপুরবধূতে প্রভেদ থাকে না; আজি সেই বলে গিরিজায়া মৃণালিনীর হৃদয়ের সুখের অংশাধিকারিণী হইল।
যে আলাপ হইতেছিল, তাহাতে গিরিজায়া বিস্মিত ও প্রীত হইতেছিল। সে মৃণালিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তা এতদিন এমন কথা প্রকাশ কর নাই কি জন্য?”
মৃ। এতদিন রাজপুত্রের নিষেধ ছিল, এজন্য প্রকাশ করি নাই। এক্ষণে তিনি প্রকাশের অনুমতি করিয়াছেন, এজন্য প্রকাশ করিতেছি।
গি। ঠাকুরাণি! সকল কথা বল না? আমার শুনিয়া বড় তৃপ্তি হবে।
তখন মৃণালিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন, “আমার পিতা একজন বৌদ্ধমতাবলম্বী শ্রেষ্ঠী। তিনি অত্যন্ত ধনী ও মথুরারাজের প্রিয়পাত্র ছিলেন-মথুরার রাজকন্যার সহিত আমার সখিত্ব ছিল।
আমি একদিন মথুরায় রাজকন্যার সঙ্গে নৌকায় যমুনার জলবিহারে গিয়াছিলাম। তথায় অকস্মাৎ ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ায়, নৌকা জলমধ্যে ডুবিল। রাজকন্যা প্রভৃতি অনেকেই রক্ষক ও নাবিকদের হাতে রক্ষা পাইলেন। আমি ভাসিয়া গেলাম। দৈবযোগে এক রাজপুত্র সেই সময়ে নৌকায় বেড়াইতেছিলেন। তাঁহাকে তখন চিনিতাম না-তিনিই হেমচন্দ্র। তিনিও বাতাসের ভয়ে নৌকা তীরে লইতেছিলেন। জলমধ্যে আমার চুল দেখিতে পাইয়া স্বয়ং জলে পড়িয়া আমাকে উঠাইলেন। আমি তখন অজ্ঞান! হেমচন্দ্র আমার পরিচয় জানিতেন না। তিনি তখন তীর্থদর্শনে মথুরায় আসিয়াছিলেন। তাঁহার বাসায় আমায় লইয়া গিয়া শুশ্রূষা করিলেন। আমি জ্ঞান পাইলে, তিনি আমার পরিচয় লইয়া আমাকে আমার বাপের বাড়ী পাঠাইবার উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু তিন দিবস পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টি থামিল না। এরূপ দুর্দিন হইল যে, কেহ বাড়ীর বাহির হইতে পারে না। সুতরাং তিন দিন আমাদিগের উভয়কে এক বাড়ীতে থাকিতে হইল। উভয়ে উভয়ের পরিচয় পাইলাম। কেবল কুল-পরিচয় নহে – উভয়ের অন্ত:করণের পরিচয় পাইলাম। তখন আমার বয়স পনের বৎসর মাত্র। কিন্তু সেই বয়সেই আমি তাঁহার দাসী হইলাম। সে কোমল বয়সে সকল বুঝিতাম না। হেমচন্দ্রকে দেবতার ন্যায় দেখিতে লাগিলাম। তিনি যাহা বলিতেন, তাহা পুরাণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তিনি বলিলেন, বিবাহ কর |’ সুতরাং আমারও বোধ হইল, ইহা অবশ্য কর্তব্য। চতুর্থ দিবসে, দুর্যোগের উপশম দেখিয়া উপবাস করিলাম; দিগ্বিজয় উদ্যোগ করিয়া দিল। তীর্থপর্যটনে রাজপুত্রের কুলপুরোহিত সঙ্গে ছিলেন, তিনি আমাদিগের বিবাহ দিলেন।”
গি। কন্যা সম্প্রদান করিল কে?
মৃ। অরুন্ধতী নামে আমার এক প্রাচীন কুটুম্ব ছিলেন। তিনি সম্বন্ধে মার ভগিনী হইতেন। আমাকে বালককাল হইতে লালনপালন করিয়াছিলেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন; আমার সকল দৌরাত্ম্য সহ্য করিতেন। আমি তাঁহার নাম করিলাম। দিগ্বিজয় কোন ছলে পুরমধ্যে তাঁহাকে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়া ছলক্রমে হেমচন্দ্রের গৃহে তাঁহাকে ডাকিয়া আনিল। অরুন্ধতী মনে জানিতেন, আমি যমুনায় ডুবিয়া মরিয়াছি। তিনি আমাকে জীবিত দেখিয়া এতই আহ্লাদিত হইলেন যে, আর কোন কথাতেই অসন্তুষ্ট হইলেন না। আমি যাহা বলিলাম, তাহাতেই স্বীকৃত হইলেন। তিনিই কন্যা সম্প্রদান করিলেন। বিবাহের পর মাসী সঙ্গে বাপের বাড়ী গেলাম। সকল সত্য বলিয়া কেবল বিবাহের কথা লুকাইলাম। আমি, হেমচন্দ্র, দিগ্বিজয়, কুলপুরোহিত আর অরুন্ধতী মাসী ভিন্ন এ বিবাহ আর কেহ জানিত না। অদ্য তুমি জানিলে।
গি। মাধবাচার্য জানেন না?
মৃ। না, তিনি জানিলে সর্বনাশ হইত। মগধরাজ তাহা হইলে অবশ্য শুনিতেন। আমার বাপ বৌদ্ধ, মগধরাজ বৌদ্ধের বিষম শত্রু।
গি। ভাল, তোমার বাপ যদি তোমাকে এ পর্যন্ত কুমারী বলিয়া জানিতেন, তবে এত বয়সেও তোমার বিবাহ দেন নাই কেন?
মৃ। বাপের দোষ নাই। তিনি অনেক যত্ন করিয়াছেন, কিন্তু বৌদ্ধ সুপাত্র পাওয়া সুকঠিন; কেন না, বৌদ্ধধর্ম প্রায় লোপ হইয়াছে। পিতা বৌদ্ধ জামাতা চাহেন, অথচ সুপাত্র চাহেন। এরূপ একটি পাওয়া গিয়াছিল, সে আমার বিবাহের পর। বিবাহের দিন স্থির হইয়া সকল উদ্যোগও হইয়াছিল। কিন্তু আমি সেই সময়ে জ্বর করিয়া বসিলাম। পাত্র অন্যত্র বিবাহ করিল।
গি। ইচ্ছাপূর্বক জ্বর করিয়াছিলে?
মৃ। হাঁ, ইচ্ছাপূর্বক। আমাদিগের উদ্যানে একটি কূয়া আছে, তাহার জল কেহ স্পর্শ করে না। তাহার পানে বা স্নানে নিশ্চিত জ্বর। আমি রাত্রিতে গোপনে সেই জলে স্নান করিয়াছিলাম।
গি। আবার সম্বন্ধ হইলে, সেইরূপ করিতে?
মৃ। সন্দেহ কি? নচেৎ হেমচন্দ্রের নিকট পলাইয়া যাইতাম।
গি। মথুরা হইতে মগধ এক মাসের পথ। স্ত্রীলোক হইয়া কাহার সহায়ে পলাইতে?
মৃ। আমার সহিত সাক্ষাতের জন্য হেমচন্দ্র মথুরায় এক দোকান করিয়া আপনি তথায় রত্নদাস বণিক বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। বৎসরে একবার করিয়া তথায় বাণিজ্য করিতে আসিতেন। যখন তিনি তথায় না থাকিতেন, তখন দিগ্বিজয় তথায় তাঁহার দোকান রাখিত। দিগ্বিজয়ের প্রতি আদেশ ছিল যে, যখন আমি যেরূপ আজ্ঞা করিব, সে তখনই সেরূপ করিবে। সুতরাং আমি নি:সহায় ছিলাম না।
কথা সমাপ্ত হইলে গিরিজায়া বলিল, “ঠাকুরাণি! আমি একটি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি। আমাকে মার্জনা করিতে হইবে। আমি তাহার উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করিতে স্বীকৃত আছি |”
মৃ। কি এমন গুরুতর কাজ করিলে?
গি। দিগ্বিজয়টা তোমার হিতকারী, তাহা আমি জানিতাম না, আমি জানিতাম, ওটা অতি অপদার্থ। এজন্য আমি তাহাকে ভালরূপে ঘা কত ঝাঁটা দিয়াছি। তা ভাল করি নাই।
মৃণালিনী হাসিয়া বলিল, “তা কি প্রায়শ্চিত্ত করিবে?”
গি। ভিখারীর মেয়ের কি বিবাহ হয়?
মৃ। (হাসিয়া) করিলেই হয়।
গি। তবে আমি সে অপদার্থটাকে বিবাহ করিব-আর কি করি?
মৃণালিনী আবার হাসিয়া বলিলেন, “তবে আজি তোমার গায়ে হলুদ দিব |”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : পরামর্শ
হেমচন্দ্র মাধবাচার্যের বসতিস্থলে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, আচার্য জপে নিযুক্ত আছেন। হেমচন্দ্র প্রণাম করিয়া কহিলেন, “আমাদিগের সকল যত্ন বিফল হইল। এখন ভৃত্যের প্রতি আর কি আদেশ করেন? যবন গৌড় অধিকার করিয়াছে। বুঝি, এ ভারতভূমির অদৃষ্টে যবনের দাসত্ব বিধিলিপি! নচেৎ বিনা বিবাদে যবনেরা গৌড়জয় করিল কি প্রকারে? যদি, এখন এই দেহ পতন করিলে, একদিনের তরেও জন্মভূমি দস্যুর হাত হইতে মুক্ত হয়, তবে এই ক্ষণে তাহা করিতে আছি। সেই অভিপ্রায়ে রাত্রিতে যুদ্ধের আশায় নগরমধ্যে অগ্রসর হইয়াছিলাম-কিন্তু যুদ্ধ ত দেখিলাম না। কেবল দেখিলাম যে, এক পক্ষ আক্রমণ করিতেছে-অপর পক্ষ পলাইতেছে |”
মাধবাচার্য কহিলেন, “বৎস! দু:খিত হইও না। দৈবনির্দেশ কখনও বিফল হইবার নহে। আমি যখন গণনা করিয়াছি যে, যবন পরাভূত হইবে, তখন নিশ্চয়ই জানিও, তাহারা পরাভূত হইবে। যবনেরা নবদ্বীপ অধিকার করিয়াছে বটে, কিন্তু নবদ্বীপ ত গৌড় নহে। প্রধান রাজা সিংহাসন ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছেন। কিন্তু এই গৌড় রাজ্যে অনেক করপ্রদ রাজা আছেন; তাঁহারা ত এখনও বিজিত হয়েন নাই। কে জানে যে, সকল রাজা একত্র হইয়া প্রাণপণ করিলে, যবন বিজিত না হইবে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাহার অল্পই সম্ভাবনা |”
মাধবাচার্য কহিলেন, “জ্যোতিষী গণনা মিথ্যা হইবার নহে; অবশ্য সফল হইবে। তবে আমার এক ভ্রম হইয়া থাকিবে। পূর্বদেশে যবন পরাভূত হইবে-ইহাতে আমরা নবদ্বীপেই যবন জয় করিবার প্রত্যাশা করিয়াছিলাম। কিন্তু গৌড়রাজ্য ত প্রকৃত পূর্ব নহে-কামরূপই পূর্ব। বোধ হয়, তথায়ই আমাদিগের আশা ফলবতী হইবে |”
হে। কিন্তু এক্ষণে ত যবনের কামরূপ যাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখি না।
মা। এই যবনেরা ক্ষণকাল স্থির নহে। গৌড়ে ইহারা সুস্থির হইলেই কামরূপ আক্রমণ করিবে।
হে। তাহাও মানিলাম। এবং ইহারা যে কামরূপ আক্রমণ করিলে পরাজিত হইবে, তাহাও মানিলাম। কিন্তু তাহা হইলে আমার পিতৃরাজ্য উদ্ধারের কি সদুপায় হইল?
মা। এই যবনেরা এ পর্যন্ত পুন:পুন: জয়লাভ খরিয়া অজেয় বলিয়া রাজগণমধ্যে প্রতিপন্ন হইয়াছে। ভয়ে কেহ তাহাদের বিরোধী হইতে চাহে না। তাহারা একবার মাত্র পরাজিত হইলে, তাহাদিগের সে মহিমা আর থাকিবে না। তখন ভারতবর্ষীয় তাবৎ আর্যবংশীয় রাজারা ধৃতাস্ত্র হইয়া উঠিবেন। সকলে এক হইয়া অস্ত্রধারণ করিলে যবনেরা কত দিন তিষ্ঠিবে?
হে। গুরদেব! আপনি আশামাত্রের আশ্রয় লইতেছেন; আমিও তাহাই করিলাম। এক্ষণে আমি কি করিব-আজ্ঞা করুন।
মা। আমিও তাহাই চিন্তা করিতেছিলাম। এ নগরমধ্যে তোমার আর অবস্থিতি করা অকর্তব্য; কেন না, যবনেরা তোমার মৃত্যুসাধন সঙ্কল্প করিয়াছে। আমার আজ্ঞা-তুমি অদ্যই এ নগর ত্যাগ করিবে।
হে। কোথায় যাইব?
মা। আমার সঙ্গে কামরূপ চল।
হেমচন্দ্র অধোবদন হইয়া, অপ্রতিভ হইয়া, মৃদু মৃদু কহিলেন, “মৃণালিনীকে কোথায় রাখিয়া যাইবেন?”
মাধবাচার্য বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কি! আমি ভাবিতেছিলাম যে, তুমি কালিকার কথায় মৃণালিনীকে চিত্ত হইতে দূর করিয়াছিলে?”
হেমচন্দ্র পূর্বের ন্যায় মৃদুভাবে বলিলেন, “মৃণালিনী অত্যাজ্যা। তিনি আমার পরিণীতা স্ত্রী |”
মাধবাচার্য চমৎকৃত হইলেন। রুষ্ট হইলেন। ক্ষোভ করিয়া কহিলেন, “আমি ইহার কিছু জানিলাম না?”
হেমচন্দ্র তখন আদ্যোপান্ত তাঁহার বিবাহের বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন। শুনিয়া মাধবাচার্য কিছুক্ষণ মৌনী হইয়া রহিলেন। কহিলেন, “যে স্ত্রী অসদাচারিনী, সে তো শাস্ত্রানুসারে ত্যাজ্যা। মৃণালিনীর চরিত্র সম্বন্ধে যে সংশয়, তাহা কালি প্রকাশ করিয়াছি।
তখন হেমচন্দ্র ব্যোমকেশের বৃত্তান্ত সকল প্রকাশ করিয়া বলিলেন। শুনিয়া মাধবাচার্য আনন্দ প্রকাশ করিলেন। বলিলেন, “বৎস! বড় প্রীত হইলাম। তোমার প্রিয়তমা এবঞ্চ গুণবতী ভার্যাকে তোমার নিকট হইতে বিযুক্ত করিয়া তোমাকে অনেক ক্লেশ দিয়াছি। এক্ষণে আশীর্বাদ করিতেছি, তোমরা দীর্ঘজীবী হইয়া বহুকাল একত্র ধর্মাচরণ কর। যদি তুমি এক্ষণে সস্ত্রীক হইয়াছ, তবে তোমাকে আর আমি আমার সঙ্গে কামরূপ যাইতে অনুরোধ করি না। আমি অগ্রে যাইতেছি। যখন সময় বুঝিবেন, তখন তোমার নিকট কামরূপাধিপতি দূত প্রেরণ করিবেন। এক্ষণে তুমি বধূকে লইয়া মথুরায় গিয়া বাস কর-অথবা অন্য অভিপ্রেত স্থানে বাস করিও |”
এইরূপ কথোপকথনের পর, হেমচন্দ্র মাধবাচার্যের নিকট বিদায় হইলেন। মাধবাচার্য আশীর্বাদ, আলিঙ্গন করিয়া সাশ্রুলোচনে তাঁহাকে বিদায় করিলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মহম্মদ আলির প্রায়শ্চিত্ত
যে রাত্রে রাজধানী যবন-সেনা-বিপ্লবে পীড়িতা হইতেছিল, সেই রাত্রে পশুপতি একাকী কারাগারে অবরুদ্ধ ছিলেন। নিশাবশেষে সেনাবিপ্লব সমাপ্ত হইয়া গেল। মহম্মদ আলি তখন তাঁহার সম্ভাষণে আসিলেন। পশুপতি কহিলেন, “যবন!-প্রিয় সম্ভাষণে আর আবশ্যকতা নাই। একবার তোমারই প্রিয়সম্ভাষণে বিশ্বাস করিয়া এই অবস্থাপন্ন হইয়াছি। বিধর্মী যবনকে বিশ্বাস করিবার যে ফল, তাহা প্রাপ্ত হইয়াছি। এখন আমি মৃত্যু শ্রেয় বিবেচনা করিয়া অন্য ভরসা ত্যাগ করিয়াছি। তোমাদিগের কোন প্রিয়সম্ভাষণ শুনিব না |”
মহম্মদ আলি কহিল, “আমি প্রভুর আজ্ঞা প্রতিপালন করি-প্রভুর আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে আসিয়াছি। আপনাকে যবনবেশ পরিধান করিতে হইবে |”
পশুপতি কহিলেন, “সে বিষয়ে চিত্ত স্থির করুন। আমি এক্ষণে মৃত্যু স্থির করিয়াছি। প্রাণত্যাগ করিতে স্বীকৃত আছি-কিন্তু যবনধর্ম অবলম্বন করিব না |”
ম। আপনাকে এক্ষণে যবনধর্ম অবলম্বন করিতে বলিতেছি না। কেবল রাজপ্রতিনিধির তৃপ্তির জন্য যবনের পোষাক পরিধান করিতে বলিতেছি।
প। ব্রাহ্মণ হইয়া কি জন্য ম্লেচ্ছের বেশ পরিব?
ম। আপনি ইচ্ছাপূর্বক না পারিলে, আপনাকে বলপূর্বক পরাইব। অস্বীকারে লাভের ভাগ অপমান।
পশুপতি উত্তর করিলেন না। মহম্মদ আলি স্বহস্তে তাঁহাকে যবনবেশ পরাইলেন। কহিলেন, “আমার সঙ্গে আসুন |”
প। কোথায় যাইব?
ম। আপনি বন্দী-জিজ্ঞাসার প্রয়োজন কি?
মহম্মদ আলি তাঁহাকে সিংহদ্বারে লইয়া চলিলেন। যে ব্যক্তি পশুপতির রক্ষায় নিযুক্ত ছিল, সেও সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
দ্বারে প্রহরিগণের জিজ্ঞাসামতে মহম্মদ আলি আপন পরিচয় দিলেন; এক সঙ্কেত করিলেন। প্রহরিগণ তাঁহাদিগকে যাইতে দিল। সিংহদ্বার হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া তিন জনে কিছু দূর রাজপথ অতিবাহিত করিলেন। তখন যবনসেনা নগরমন্থন সমাপন করিয়া বিশ্রাম করিতেছিল; সুতরাং রাজপথে আর উপদ্রব ছিল না। মহম্মদ আলি কহিলেন, “ধর্মাধিকার! আপনি আমাকে বিনা দোষে তিরস্কার করিয়াছেন। বখ্ তিয়ার খিলিজির এরূপ অভিপ্রায় আমি কিছুই অবগত ছিলাম না। তাহা হইলে আমি কদাচ প্রবঞ্চকের বার্তাবহ হইয়া আপনার নিকট যাইতাম না। যাহা হউক, আপনি আমার কথায় প্রত্যয় করিয়া এরূপ দুর্দশাপন্ন হইয়াছেন, ইহার যথাসাধ্য প্রায়শ্চিত্ত করিলাম। গঙ্গাতীরে নৌকা প্রস্তুত আছে-আপনি যথেচ্ছ স্থানে প্রস্থান করুন। আমি এইখান হইতে বিদায় হই |”
পশুপতি বিস্ময়াপন্ন হইয়া অবাক হইয়া রহিলেন। মহম্মদ আলি পুনরপি কহিতে লাগিলেন, “আপনি এই রাত্রিমধ্যে এ নগরী ত্যাগ করিবেন। নচেৎ কাল প্রাতে যবনের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলে প্রমাদ ঘটিবে। খিলিজির আজ্ঞার বিপরীত আচরণ করিলাম-ইহার সাক্ষী এই প্রহরী। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্য ইহাকেও দেশান্তরিত করিলাম। ইহাকেও আপনার নৌকায় লইয়া যাইবেন |”
এই বলিয়া মহম্মদ আলি বিদায় হইলেন। পশুপতি কিয়ৎকাল বিস্ময়াপন্ন হইয়া থাকিয়া গঙ্গাতীরাভিমুখে চলিলেন।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ধাতুমূর্তির বিসর্জন
মহম্মদ আলির নিকট বিদায় হইয়া, রাজপথ অতিবাহিত করিয়া পশুপতি ধীরে ধীরে চলিলেন। ধীরে ধীরে চলিলেন-যবনের কারাগার হইতে বিমুক্ত হইয়াও দ্রুতপদক্ষেপণে তাঁহার প্রবৃত্তি জন্মিল না। রাজপথে যাহা দেখিলেন, তাহাতে আপনার মনোমধ্যে আপনি মরিলেন। তাঁহার প্রতি পদে মৃত নাগরিকের দেহ চরণে বাজিতে লাগিল; প্রতি পদে শোণিতসিক্ত কর্দমে চরণ আর্দ্র হইতে লাগিল। পথের দুই পার্শ্বে গৃহাবলী জনশূন্য-বহু গৃহ ভস্মীভূত; কোথাও বা তপ্ত অঙ্গার এখনও জ্বলিতেছিল। গৃহান্তরে দ্বার ভগ্ন-গবাক্ষ ভগ্ন-প্রকোষ্ঠ ভগ্ন-তদুপরি মৃতদেহ! এখনও কোন হতভাগ্য মরণ-যন্ত্রণায় অমানুষিক কাতরস্বরে শব্দ করিতেছিল। এ সকলের মূল তিনিই। দারুণ লোভের বশবর্তী হইয়া তিনি এই রাজধানীকে শ্মশানভূমি করিয়াছেন। পশুপতি মনে মনে স্বীকার করিলেন যে, তিনি প্রাণদণ্ডের যোগ্য পাত্র বটে-কেন মহম্মদ আলিকে কলঙ্কিত করিয়া কারাগার হইতে পলায়ন করিলেন? যবন তাঁহাকে ধৃত করুক-অভিপ্রেত শাস্তি প্রদান করুক-মনে করিলেন ফিরিয়া যাইবেন। মনে মনে তখন ইষ্টদেবীকে স্মরণ করিলেন-কিন্তু কি কামনা করিবেন? কামনার বিষয় আর কিছুই নাই। আকাশপ্রতি চাহিলেন। গগনের নক্ষত্র-চন্দ্র-গ্রহমণ্ডলীবিভূষিত সহাস্য পবিত্র শোভা তাঁহার চক্ষে সহিল না-তীব্র জ্যোতি:সম্পীড়িতের ন্যায় চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। সহসা অনৈসর্গিক ভয় আসিয়া তাঁহার হৃদয় আচ্ছন্ন করিল-অকারণ ভয়ে তিনি আর পদক্ষেপ করিতে পারিলেন না। সহসা বিলীন হইলেন। বিশ্রাম করিবার জন্য পথিমধ্যে উপবেশন করিতে গিয়া দেখিলেন-এক শবাসনে উপবেশন করিতেছিলেন। শবনিস্রুত রক্ত তাঁহার বসনে এবং অঙ্গে লাগিল। তিনি কণ্টকিতকলেবরে পুনরুত্থান করিলেন। আর দাঁড়াইলেন না-দ্রুতপদে চলিলেন। সহসা আর এক কথা মনে পড়িল-তাঁহার নিজবাটী? তাহা কি যবনহস্তে রক্ষা পাইয়াছে? আর সে বাটীতে যে কুসুমময়ী প্রাণ-পুত্তলিকে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন, তাহার কি হইয়াছে? মনোরমার কি দশা হইয়াছে? তাঁহার প্রাণাধিকা, তাঁহাকে পাপ পথ হইতে পুন: পুন: নিবারণ করিয়াছিল, সেও বুঝি তাঁহার পাপসাগরের তরঙ্গে ডুবিয়াছে। এ যবনসেনাপ্রবাহ সে কুসুমকলিকা না জানি কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে!
পশুপতি উন্মত্তের ন্যায় আপন ভবাভিমুখে ছুটিলেন। আপনার ভবনসম্মুখে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, যাহা ভাবিয়াছিলেন, তাহাই ঘটিয়াছে-জ্বলন্ত পর্বতের ন্যায় তাঁহার উচ্চচূড় অট্টালিকা অগ্নিময় হইয়া জ্বলিতেছে।
দৃষ্টিমাত্র হতভাগ্য পশুপতির প্রতীতি হইল যে, যবনেরা তাঁহার পৌরজন সহ মনোরমাকে বধ করিয়া গৃহে অগ্নি দিয়া গিয়াছে। মনোরমা যে পলায়ন করিয়াছিল, তাহা তিনি কিছু জানিতে পারেন নাই।
নিকটে কেহই ছিল না যে, তাঁহাকে এ সংবাদ প্রদান করে। আপন বিকল চিত্তের সিদ্ধান্তই তিনি গ্রহণ করিলেন। হলাহল-কলস পরিপূর্ণ হইল-হৃদয়ের শেষ তন্ত্রী ছিঁড়িল। তিনি কিয়ৎক্ষণ বিস্ফারিত নয়নে দহ্যমান অট্টালিকা প্রতি চাহিয়া রহিলেন-মরণোন্মুখ পতঙ্গবৎ অল্পক্ষণ বিকলশরীরে অবস্থিতি করিলেন-শেষে মহাবেগে সেই অনলতরঙ্গমধ্যে ঝাঁপ দিলেন। সঙ্গের প্রহরী চমকিত হইয়া রহিল।
মহাবেগে পশুপতি জ্বলন্ত দ্বারপথে পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। চরণ দগ্ধ হইল- অঙ্গ দগ্ধ হইল-কিন্তু পশুপতি ফিরিলেন না। অগ্নিকুণ্ড অতিক্রম করিয়া আপন শয়কক্ষে গমন করিলেন-কাহাকেও দেখিলেন না। দগ্ধশরীরে কক্ষে কক্ষে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহার অন্তরমধ্যে যে দুরন্ত অগ্নি জ্বলিতেছিল-তাহাতে তিনি বাহ্য দাহযন্ত্রণা অনুভূত করিতে পারিলেন না।
ক্ষণে ক্ষণে গৃহের নূতন নূতন খণ্ডসকল অগ্নিকর্তৃক আক্রান্ত হইতেছিল। আক্রান্ত প্রকোষ্ঠ বিষম শিখা আকাশপথে উত্থাপিত করিয়া ভয়ঙ্কর গর্জন করিতেছিল। ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার দগ্ধ গৃহাংশসকল অশনিসম্পাতশব্দে ভূতলে পড়িয়া যাইতেছিল। ধূমে, ধূলিতে, তৎসঙ্গে লক্ষ লক্ষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আকাশ অদৃশ্য হইতে লাগিল।
দাবানল সংবেষ্টিত আরণ্য গজের ন্যায় পশুপতি অগ্নিমধ্যে ইতস্তত: দাসদাসী স্বজন ও মনোরমার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কাহারও কোন চিহ্ন পাইলেন না-হতাশ হইলেন। তখন দেবীর মন্দির প্রতি তাঁহার দৃষ্টিপাত হইল। দেখিলেন, দেবী অষ্টভুজার মন্দির অগ্নিকর্তৃক আক্রান্ত হইয়া জ্বলিতেছে। পশুপতি পতঙ্গবৎ তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, অনলমণ্ডলমধ্যে অদগ্ধা স্বর্ণপ্রতিমা বিরাজ করিতেছে। পশুপতি উন্মত্তের ন্যায় কহিলেন, “মা! জগদম্বে! আর তোমাকে জগদম্বা বলিব না। আর তোমায় পূজা করিব না। তোমাকে প্রণামও করিব না। আশৈশব আমি কায়মনোবাক্যে তোমার সেবা করিলাম-ঐ পদধ্যান ইহজন্মে সার করিয়াছিলাম-এখন, মা, এক দিনের পাপে সর্বস্ব হারাইলাম। তবে কি জন্য তোমার পূজা করিয়াছিলাম? কেনই বা তুমি আমার পাপমতি অপনীত না করিলে?”
মন্দিরদহন অগ্নি অধিকতর প্রবল হইয়া গর্জিয়া উঠিল। পশুপতি তথাপি প্রতিমা সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঐ দেখ! ধাতুমূর্তি!-তুমি ধাতুমূর্তি মাত্র, দেবী নহ-ঐ দেখ অগ্নি গর্জিতেছে! যে পথে আমার প্রাণাধিকা গিয়াছে-সেই পথে অগ্নি তোমাকেও প্রেরণ করিবে। কিন্তু আমি অগ্নিকে এ কীর্তি রাখিতে দিব না-আমি তোমাকে স্থাপনা করিয়াছিলাম-আমিই তোমাকে বিসর্জন করিব। চল! ইষ্টদেবি! তোমাকে গঙ্গা জলে বিসর্জন করিব |”
এই বলিয়া পশুপতি প্রতিমা উত্তোলন আকাঙ্ক্ষায় উভয় হস্তে তাহা ধারণ করিলেন। সেই সময়ে আবার অগ্নি গর্জিয়া উঠিল। তখনই পর্বতবিদানুরূপ প্রবল শব্দ হইল,-দগ্ধ মন্দির, আকাশপথে ধূলিধূমভস্ম সহিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গরাশি প্রেরণ করিয়া, চূর্ণ হইয়া পড়িয়া গেল। তন্মধ্যে প্রতিমা সহিত পশুপতি সজীবন সমাধি হইল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : অন্তিমকালে
পশুপতি স্বয়ং অষ্টভূজার অর্চনা করিতেন বটে-কিন্তু তথাপি তাঁহার নিত্যসেবার জন্য দুর্গাদাস নামে এক জন ব্রাহ্মণ নিযুক্ত ছিলেন। নগরবিপ্লবের পরদিবস দুর্গাদাস শ্রুত হইলেন যে, পশুপতির গৃহ ভস্মীভূত হইয়া ভূমিসাৎ হইয়াছে। তখন ব্রাহ্মণ অষ্টভূজার মূর্তি ভস্ম হইতে উদ্ধার করিয়া আপন গৃহে স্থাপন করিবার সঙ্কল্প করিলেন। যবনেরা নগর লুঠ করিয়া তৃপ্ত হইলে, বখ্মতিয়ার খিলিজি অনর্থক নগরবাসীদিগের পীড়ন নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। সুতরাং এক্ষণে সাহস করিয়া বাঙ্গালীরা রাজপথে বাহির হইতেছিল। ইহা দেখিয়া দুর্গাদাস অপরাহ্নে অষ্টভূজার উদ্ধারে পশুপতির ভবনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। পশুপতির ভবনে গমন করিয়া, যথায় দেবীর মন্দির ছিল, সেই প্রদেশে গেলেন। দেখিলেন, অনেক ইষ্টকরাশি স্থানান্তরিত না করিলে, দেবীর প্রতিমা বহিষ্কৃত করিতে পারা যায় না। ইহা দেখিয়া দুর্গাদাস আপন পুত্রকে ডাকিয়া আনিলেন। ইষ্টক সকল অর্ধ দ্রবীভূত হইয়া পরস্পর লিপ্ত হইয়াছিল-এবং এখন পর্যন্ত সন্তপ্ত ছিল। পিতাপুত্রে এক দীর্ঘিকা হইতে জল বহন করিয়া তপ্ত ইষ্টকসকল শীতল করিলেন, এবং বহুকষ্টে তন্মধ্য হইতে অষ্টভূজার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। ইষ্টকরাশি স্থানান্তরিত হইলে তন্মধ্য হইতে দেবীর প্রতিমা আবিষ্কৃতা হইল। কিন্তু প্রতিমার পাদমূলে-এ কি? সভয়ে পিতাপুত্র নিরীক্ষণ করিলেন যে, মনুষ্যের মৃতদেহ রহিয়াছে! তখন উভয়ে মৃতদেহ উত্তোলন করিয়া দেখিলেন যে, পশুপতির দেহ।
বিস্ময়সূচক বাক্যের পর দুর্গাদাস কহিলেন, “যে প্রকারেই প্রভুর এ দশা হইয়া থাকুক, ব্রাহ্মণের এবঞ্চ প্রতিপালিতের কার্য আমাদিগের অবশ্য কর্তব্য। গঙ্গাতীরে এই দেহ লইয়া আমরা প্রভুর সৎকার করি চল |”
এই বলিয়া দুইজনে প্রভুর দেহ বহন করিয়া গঙ্গাতীরে লইয়া গেলেন। তথায় পুত্রকে শবরক্ষায় নিযুক্ত করিয়া দুর্গাদাস নগরে কাষ্ঠাদি সৎকারের উপযোগী সামগ্রীর অনুসন্ধানে গমন করিলেন। এবং যথাসাধ্য সুগন্ধি কাষ্ঠ ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করিয়া গঙ্গাতীরে প্রত্যাগমন করিলেন।
তখন দুর্গাদাস পুত্রের আনুকূল্যে যথাশাস্ত্র দাহের পূর্বগামী ক্রিয়াসকল সমাপন করিয়া সুগন্ধি কাষ্ঠে চিতা রচনা করিলেন। এবং তদুপরি পশুপতির মৃতদেহ স্থাপন করিয়া অগ্নিপ্রদান করিতে গেলেন।
কিন্তু অকস্মাৎ শ্মশানভূমিতে এ কাহার আবির্ভাব হইল? ব্রাহ্মণদ্বয় বিস্মিতলোচনে দেখিলেন যে, এক মলিনবসনা, রুক্ষকেশী, আলুলায়িতকুন্তলা, ভস্মধূলিসংসর্গে বিবর্ণা, উন্মাদিনী আসিয়া শ্মশানভূমিতে অবতরণ করিতেছে। রমণী ব্রাহ্মণদিগের নিকটবর্তিনী হইলেন।
দুর্গাদাস সভয়চিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে?”
রমণী কহিলেন, “তোমরা কাহার সৎকার করিতেছ?”
দুর্গাদাস কহিলেন, “মৃত ধর্মাধিকার পশুপতির |”
রমণী কহিলেন, “পশুপতির কি প্রকারে মৃত্যু হইল?”
দুর্গাদাস কহিলেন, “প্রাতে নগরে জনরব শুনিয়াছিলাম যে, তিনি যবনকর্তৃক কারাবদ্ধ হইয়া কোন সুযোগে রাত্রিকালে পলায়ন করিয়াছিলেন। অদ্য তাঁহার অট্টালিকা ভস্মসাৎ হইয়াছে দেখিয়া, ভস্মমধ্য হইতে অষ্টভূজার প্রতিমা উদ্ধার মানসে গিয়াছিলাম। তথায় গিয়া প্রভুর মৃতদেহ পাইলাম |”
রমণী কোন উত্তর করিলেন না। গঙ্গাতীরে, সৈকতের উপর উপবেশন করিলেন। বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কে?” দুর্গাদাস কহিলেন, “আমরা ব্রাহ্মণ; ধর্মাধিকারের অন্নে প্রতিপালিত হইয়াছিলাম। আপনি কে?”
তরুণী কহিলেন, “আমি তাঁহার পত্নী |”
দুর্গাদাস কহিলেন, “তাঁহার পত্নী বহুকাল নিরুদ্দিষ্টা। আপনি কি প্রকারে তাঁহার পত্নী? “
যুবতী কহিলেন, “আমি সেই নিরুদ্দিষ্টা কেশবকন্যা। অনুমরণ ভয়ে পিতা আমাকে এতকাল লুক্কায়িত রাখিয়াছিলেন। আমি আজ কালপূর্ণে বিধিলিপি পূরাইবার জন্য আসিয়াছি |”
শুনিয়া পিতাপুত্রে শিহরিয়া উঠিলেন। তাঁহাদিগকে নিরুত্তর দেখিয়া বিধবা বলিতে লাগিলেন, “এখন স্ত্রীজাতির কর্তব্য কাজ করিব। তোমরা উদ্যোগ কর |”
দুর্গাদাস তরুণীর অভিপ্রায় বুঝিলেন; পুত্রের মুখ চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বল?”
পুত্র কিছু উত্তর করিল না। দুর্গাদাস তখন তরুণীকে কহিলেন, “মা, তুমি বালিকা-এ কঠিন কার্যে কেন প্রস্তুত হইতেছ?”
তরুণী ভ্রূভঙ্গী করিয়া কহিলেন, “ব্রাহ্মণ হইয়া অধর্মে প্রবৃত্তি দিতেছ কেন? – ইহার উদ্যোগ
কর |”
তখন ব্রাহ্মণ আয়োজন জন্য নগরে পুনর্বার চলিলেন। গমনকালে বিধবা দুর্গাদাসকে কহিলেন, “তুমি নগরে যাইতেছ। নগরপ্রান্তে রাজার উপবন বাটিকায় হেমচন্দ্র নামে বিদেশী রাজপুত্র বাস করেন। তাঁহাকে বলিও, মনোরমা চিতারোহণ করিতেছে-তিনি আসিয়া একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যাউন, তাঁহার নিকটে ইহলোকে মনোরমার এই মাত্র ভিক্ষা |”
হেমচন্দ্র যখন ব্রাহ্মণমুখে শুনিলেন যে, মনোরমা পশুপতির আত্মপরিচয়ে তাঁহার অনুমৃতা হইতেছেন, তখন তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। দুর্গাদাসের সমভিব্যাহারে গঙ্গাতীরে আসিলেন। তথায় মনোরমার অতি মলিনা, উন্মাদিনী মূর্তি, তাঁহার স্থিরগম্ভীর, এখনও অনিন্দ্যসুন্দর মুখকান্তি দেখিয়া তাঁহার চক্ষুর জল আপনি বহিতে লাগিল। তিনি বলিলেন, “মনোরমা! ভগিনি! এ কি এ?”
তখন মনোরমা জ্যোতিস্নাপ্রদীপ্ত সরোবরতুল্য স্থির মূর্তিতে মৃদুগম্ভীরস্বরে কহিলেন, “ভাই, যে জন্য আমার জীবন, তাহা আজি চরম সীমা প্রাপ্ত হইয়াছে। আজ আমি আমার স্বামীর সঙ্গে গমন করিব |”
মনোরমা সংক্ষেপে অন্যের শ্রবণাতীত স্বরে হেমচন্দ্রের নিকট পূর্বকথার পরিচয় দিয়া বলিলেন, “আমার স্বামী অপরিমিত ধন সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আমি এক্ষণে সে ধনের অধিকারিণী। আমি তাহা তোমাকে দান করিতেছি। তুমি তাহা গ্রহণ করিও। নচেৎ পাপিষ্ঠ যবনে তাহা ভোগ করিবে। তাহার অল্পভাগ ব্যয় করিয়া জনার্দন শর্মাকে কাশীধামে স্থাপন করিবে। জনার্দনকে অধিক ধন দিও না। তাহা হইলে যবনে কাড়িয়া লইবে। আমার দাহের পর, তুমি আমার স্বামীর গৃহে গিয়া অর্থের সন্ধান করিও। আমি যে স্থান বলিয়া দিতেছি, সেই স্থান খুঁড়িলেই তাহা পাইবে। আমি ভিন্ন সে স্থান আর কেহই জানে না |” এই বলিয়া মনোরমা যথা অর্থ আছে, তাহা বলিয়া দিলেন।
তখন মনোরমা আবার হেমচন্দ্রের নিকট বিদায় হইলেন। জনার্দনকে ও তাঁহার পত্নীকে উদ্দেশে প্রণাম করিয়া হেমচন্দ্রের দ্বারা তাঁহাদিগের নিকট কত স্নেহসূচক কথা বলিয়া পাঠাইলেন।
পরে ব্রাহ্মণেরা মনোরমাকে যথাশাস্ত্র এই ভীষণ ব্রতে ব্রতী করাইলেন। এবং শাস্ত্রীয় আচারান্তে, মনোরমা ব্রাহ্মণের আনীত নূতন বস্ত্র পরিধান করিলেন। নব বস্ত্র পরিধান করিয়া, দিব্য পুষ্পমাল্য কণ্ঠে পরিয়া, পশুপতির প্রজ্বলিত চিতা প্রদক্ষিণপূর্বক, তদুপরি আরোহণ করিলেন। এবং সহাস্য আননে সেই প্রজ্বলিত হুতাশনরাশির মধ্য উপবেশন করিয়া, নিদাঘসন্তপ্ত কুসুমকলিকার ন্যায় অনলতাপে প্রাণত্যাগ করিলেন।
পরিশিষ্ট
হেমচন্দ্র মনোরমার দত্ত ধন উদ্ধার করিয়া তাহার কিয়দংশ জনার্দনকে দিয়া তাঁহাকে কাশী প্রেরণ করিলেন। অবশিষ্ট ধন গ্রহণ করা কর্তব্য কিনা, তাহা মাধবাচার্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন। মাধবাচার্য বলিলেন, “এই ধনের বলে পশুপতির বিনাশকারী বখ্তিয়ার খিলিজিকে প্রতিফল দেওয়া কর্তব্য; এবং তদভিপ্রায়ে ইহা গ্রহণও উচিত। দক্ষিণে, সমুদ্রের উপকূলে অনেক প্রদেশ জনহীন হইয়া পড়িয়া আছে। আমার পরামর্শ যে, তুমি এই ধনের দ্বারা তথায় নূতন রাজ্য সংস্থাপন কর, এবং তথায় যবনদমনোপযোগী সেনা সৃজন কর। তৎসাহায্যে পশুপতির শত্রুর নিপাতসিদ্ধ করিও |”
এই পরামর্শ করিয়া মাধবাচার্য সেই রাত্রিতেই হেমচন্দ্রকে নবদ্বীপ হইতে দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা করাইলেন। পশুপতির ধনরাশি তিনি গোপনে সঙ্গে লইলেন। মৃণালিনী, গিরিজায়া এবং দিগ্বিজয় তাঁহার সঙ্গে গেলেন। মাধবাচার্যও হেমচন্দ্রকে নূতন রাজ্যে স্থাপিত করিবার জন্য তা তাঁহার সঙ্গে গেলেন। রাজ্যসংস্থাপন অতি সহজ কাজ হইয়া উঠিল; কেন না, যবনদিগের ধর্মদ্বেষিতায় পীড়িত এবং তাঁহাদিগের ভয়ে ভীত হইয়া অনেকেই তাঁহাদিগের অধিকৃত রাজ্য ত্যাগ করিয়া হেমচন্দ্রের নবস্থাপিত রাজ্যে বাস করিতে লাগিল।
মাধবাচার্যের পরামর্শেও অনেক প্রধান ধনী ব্যক্তি তথায় আশ্রয় লইল। এই রূপে অতি শীঘ্র ক্ষুদ্র রাজ্যটি সৌষ্ঠবান্বিত হইয়া উঠিল। ক্রমে ক্রমে সেনা সংগ্রহ হইতে লাগিল। অচিরাৎ রমণীয় রাজপুরী নির্মিত হইল। মৃণালিনী তন্মধ্যে মহিষী হইয়া সে পুরী আলো করিলেন। গিরিজায়ার সহিত দিগ্বিজয়ের পরিণয় হইল। গিরিজায়া মৃণালিনীর পরিচর্যায় নিযুক্তা রহিলেন, দিগ্বিজয় হেমচন্দ্রের কার্য পূর্ববৎ করিতে লাগিলেন। কথিত আছে যে, বিবাহ অবধি এমন দিনই ছিল না, যে দিন গিরিজায়া এক আধ ঘা ঝাঁটার আঘাতে দিগ্বিজয়ের শরীর পবিত্র করিয়া না দিত। ইহাতে যে দিগ্বিজয় বড়ই দু:খিত ছিলেন, এমন নহে। বরং একদিন কোন দৈবকারণবশত: গিরিজায়া ঝাঁটা মারিতে ভুলিয়াছিলেন, ইহাতে দিগ্বিজয় বিষণ্ণ বদনে গিরিজায়াকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “গিরি, আজ তুমি আমার উপর রাগ করিয়াছ না কি?” বস্তুত: ইহারা যাবজ্জীবন পরমসুখে কালাতিপাত করিয়াছিল।
হেমচন্দ্রকে নূতন রাজ্যে স্থাপন করিয়া মাধবাচার্য কামরূপে গমন করিলেন। সেই সময়ে হেমচন্দ্র দক্ষিণ হইতে মুসলমানের প্রতিকূলতা করিতে লাগিলেন। বখ্তিয়ার খিলিজি পরাভূত হইয়া কামরূপ হইতে দূরীকৃত হইলেন। এবং প্রত্যাগমনকালে অপমানে ও কষ্টে তাঁহার প্রাণবিয়োগ হইল। কিন্তু সে সকল ঘটনার বর্ণনা করা এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে।
রত্নময়ী এক সম্পন্ন পাটনীকে বিবাহ করিয়া হেমচন্দ্রের নূতন রাজ্যে গিয়া বাস করিল। তথায় মৃণালিনীর অনুগ্রহে তাহার স্বামীর বিশেষ সৌষ্ঠব হইল। গিরিজায়া ও রত্নময়ী চিরকাল “সই” “সই” রহিল।
মৃণালিনী মাধবাচার্যের দ্বারা হৃষীকেশকে অনুরোধ করাইয়া মণিমালিনীকে আপন রাজধানীতে আনাইলেন। মণিমালিনী রাজপুরী মধ্যে মৃণালিনীর সখীর স্বরূপ বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহার স্বামী রাজবাটীর পৌরোহিত্যে নিযুক্ত হইলেন।
শান্তশীল যখন দেখিল যে, হিন্দুর আর রাজ্য পাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন সে আপন চতুরতা ও কর্মদক্ষতা দেখাইয়া যবনদিগের প্রিয়পাত্র হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। হিন্দুদিগের প্রতি অত্যাচার বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা শীঘ্র সে মনস্কাম সিদ্ধ করিয়া অভীষ্ট রাজকার্যে নিযুক্ত হইল।