মৃণালকান্তির আত্মচরিত
ভূমিকা
মৃণালকান্তি আমাকে অনেক গলিখুঁজি, চোরাপথ, ভাঁটিখানা, বেশ্যাদের আস্তানা, হিজড়েদের আড্ডা চিনিয়েছিল। এইভাবে চেনা রাস্তা ভুলিয়ে অচেনা রাস্তায় সে বহুবার আমাকে নিয়ে গেছে। মনে আছে অনেকদিন মৃণালকান্তির সঙ্গে শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের রিফিউজিদের বিবাহ, সঙ্গম, জন্ম এবং মৃত্যু দেখব বলে দাঁড়িয়ে থেকেছি। উপকরণের খোঁজে এইভাবে সে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত। যতদূর জানা যায় মৃণালকান্তি তখন তার আত্মজীবনী রচনায় ব্যস্ত ছিল। তার সেই আত্মজীবনীর কিছু কিছু পৃষ্ঠা আমি পড়ে দেখেছি। সদ্যলব্ধ অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও স্বপ্ন এই ছিল তার আত্মজীবনীর উপকরণ এবং এইসব নিয়ে সে এত বেশি উত্তেজিত থাকত যে, কখনও রাস্তায় ঘাটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সে তার মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে কপাল টিপে রেখে এমনভাবে তাকাত যেন চিনতে পারছে না। তার রুক্ষ চোয়াল, গাল–ভাঙা মুখের ওপর নীল শিরাগুলি দেখা যেত। কখনও আমি তাকে বলতাম, ‘তোমাকে মাঝে-মাঝে ভীষণ অচেনা মনে হয় হে মৃণালকান্তি, বাস্তবিক!’ পকেট থেকে জাদুকরের মতো নিমেষে একটা রুমাল বের করে মৃণালকান্তি তার মুখের বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি চাপা দিয়ে বলত, ‘কোথায় যাচ্ছ!’ কিংবা ‘খুব ব্যস্ত কি?’ আমি ‘না’ জানালে সে বলত ‘তবে এসো, একটু চা খাওয়া যাক।’ নির্জন অচেনা নিঃশব্দ কোনও রেস্তরাঁয় আমরা মুখোমুখি বসতাম আর তখন মৃণালকান্তি কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে সদ্যলেখা তার আত্মজীবনীর পৃষ্ঠাগুলি বের করে আমাকে পড়তে দিত।
আমার মনে হয় আত্মজীবনী বলতে যা বোঝায় মৃণালকান্তি ঠিক তা লেখেনি। এইরকম জনশ্রুতি আছে যে, মৃণালকান্তি প্রায়ই স্মৃতি ও স্বপ্নের দ্বারা আক্রান্ত হত। এই সম্বন্ধে সে নিজে লিখে গেছে, ‘আমার মনে হয় স্মৃতি এবং স্বপ্ন–এই দুইটি শব্দ আমাদের সচেতন করিবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। পাপ–পুণ্যময় এ জগতে স্মৃতি এবং স্বপ্ন সকলেরই স্বাভাবিক অবলম্বন। বাস্তবিক ঠিকমতো অনুসন্ধান করিলে জানা যাইবে, যে, আমাদের অধিকাংশ প্রেমের কবিতা, দার্শনিক
প্রবন্ধ, ইস্পাতের কারখানা এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্র স্মৃতি ও স্বপ্নের দ্বারা রচিত।’ মনে হয় এইখানে মৃণালকান্তি স্মৃতি অর্থে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এবং স্বপ্ন অর্থে কল্পনা বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু আমার অনুমান এইমাত্র যে, মৃণালকান্তির স্মৃতি ও স্বপ্ন খুব স্বাভাবিক স্তরে ছিল না, কেন না সে নিজেই অন্যত্র লিখেছেঃ ‘…কিন্তু আমার আত্মজীবনী বাস্তবিক ইস্পাতের কারখানা, প্রেমের কবিতা কিংবা দার্শনিক প্রবন্ধ নয়। ইহার ভিতরে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দু-একটা লক্ষণ বর্তমান থাকিলেও বাস্তবিক ইহাকে ষোলো আনা দূরবীক্ষণ যন্ত্রও বলিতে পারা যায় না। যাহাদের স্মৃতি এবং স্বপ্ন স্বাভাবিক স্তরে আছে তাহারা প্রেমের কবিতা এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিস্কারের চেষ্টা করে বটে, কিন্তু আত্মজীবনী রচনার চেষ্টা কদাচ করে না। আমার মতো মানুষের আত্মজীবনীর মূল্য কি তা যাহাদের স্মৃতি এবং স্বপ্ন স্বাভাবিক স্তরে আছে–তাহাদের কাছে বোধগম্য নয়। কেন না যে স্মৃতি এবং স্বপ্ন অতীতে একদা আমাদের ইস্পাতের কারখানা ও দার্শনিক প্রবন্ধ রচনা করিতে সাহায্য করিয়াছে তাহা আমার ভিতরে উপস্থিত থাকিলে আমার যাবতীয় পণ্ডশ্রম একটি মাত্র আত্মজীবনী রচনাতেই কেন্দ্রীভূত হইল কেন! তাও স্থির প্রত্যয়জাত অঙ্কের মতো নির্ভুল কোনওকিছু এই রচনাতে নাই–বরং এর সর্বত্র রচয়িতার তীব্র সন্দেহ মাত্র উপস্থিত আছে। কোনও ঘটনায় মাথার ভিতরে চকিতে বিস্ফোরণ ঘটিলে তাহার আলোতে যতদূর দেখা যায় ততদূর হইতে আমার স্মৃতি ও স্বপ্নগুলি আহরণ করিতেছি। মাঝে-মাঝে ভ্রম হয় আমি কতদূর অর্থহীন তাহা জানিবার আগ্রহেই আমি এই আত্মজীবনী রচনা করিতেছি।’
আখ্যান
ছায়া ছিল খুব হিসেবি মেয়ে। যাদবপুরের কোনও রিফিউজি কলোনি থেকে ছায়া কলকাতায় মাস্টারি করতে আসত। মৃণালকান্তি পরিচয় করিয়ে দিলে আমি ছায়াকে প্রথম দেখে বড় হতাশ হই। টলটলে চোখ ছিল না ছায়ার–শীতকালে শুকনো ঠোঁটের ওপর মামড়ি দেখা যেত। শরীরে মেয়েদের যে সব আকর্ষণ থাকে তার কোনওটাই ছিল না। খুব ঘন ঘন সিনেমা দেখত ছায়া–সব বাঙলা ছবিই তার মোটামুটি ভালো লাগত। কখনও কোনও কবিতার লাইন ছায়া বলেছিল কি! আমার মনে পড়ে না। প্রথমবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় মৃণালকান্তি ‘এই ছায়া। আমার–’বলে কথা শেষ করবার আগেই মনে পড়ে ছায়া বলল , ‘থাক আর বলতে হবে না, উনি বুঝতে পারছেন।’ মৃণালকান্তির সামনে প্রথমদিনই ছায়া আমার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, ‘আমি খুব বেশি খাই না’, বলেছিল, ‘আমার ছোট বোন গান জানে, আপনার সঙ্গে বেশ মানায়। প্রতি বৃহস্পতিবার আর শনিবার সন্ধে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সে মৃণালকান্তির সঙ্গে থাকত। ওই দুদিন তার টিউশনি ছিল না। সাতটা পঁয়তাল্লিশের ট্রেন ধরে ছায়া বাড়ি ফিরত–যদিও ছায়ার হাতে কখনও ঘড়ি দেখিনি। যেমন টনটনে ছিল তার সময়জ্ঞান তেমনি বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল ছায়ার। মৃণালকান্তি ডায়েরি লিখছে জেনে সে মধ্যে–মধ্যে তার ডায়েরি পড়তে চাইত। মৃণালকান্তির আত্মজীবনীর সবটুকু আমি পড়িনি। ছায়াকে কোথা থেকে কেন জোগাড় করেছিল–সে আমি জানি না। মনে পড়ে তার আত্মজীবনীর কোথাও ছায়ার সঙ্গে তার পরিচয় হওয়ার আগে সে লিখেছিল, ‘..কোনওদিন কোনও যুবতী মহিলার সঙ্গে রাস্তায় হাঁটিয়া যাই নাই–যাহাতে মনে হয় চতুস্পার্শ্বস্থ সবকিছু আমাদের কেন্দ্র করিয়াই আবর্তিত হইতেছে। আমি কখনও মায়ের সঙ্গে, আত্মীয় মহিলার সঙ্গে রাস্তায় হাঁটিয়াছিলাম। সমান বুদ্ধিমতী সমান বয়স্কা কোনও মহিলার সঙ্গে হাঁটিয়া গেলে এমন মনে হইবে কি যে, এই মুহূর্তগুলি আমার সব চেয়ে প্রিয়; যেন আমরা সব কিছুর কেন্দ্রস্থলে আছি! মনে হইবে কি যে আমি কখনও মৃত্যুশোক অনুভব করি নাই! নিজেকে ক্ষুদ্রজীবী শিশুর মতো মনে হইবে কি যে, তাহার প্রিয়জনের দেহে ক্ষুদ্র হস্ত পদের দ্বারা প্রবল আঘাত করিয়া জানাইতে চাহে–আমি আছি!..’
মনে হয় ছায়া ক্রমশ মৃণালকান্তি সম্পর্কে হতাশ হচ্ছিল। মৃণালকান্তি ছিল প্রায় বেকার। কোনও এক ছোট্ট প্রকাশকের দোকানে সে কিছুদিন কাজ করেছিল। মাঝে-মাঝে বইয়ের প্যাকেট বয়ে নিয়ে তাকে এখানে ওখানে পৌঁছে দিতে হত। কিন্তু খুব গরিব সে ছিল না। তার বাবার জমানো কিছু টাকা সে পেয়েছিল, ভাই-বোন না থাকাতে পাকিস্তানের জমিজমা বিক্রি করে কিছু টাকার নিরঙ্কুশ মালিকানা সে পেয়েছিল। এইসব বন্দোবস্ত তার মা মৃত্যুর আগেই তার জন্য করে যান। নইলে ষাট টাকা মাইনে পেয়ে বেনেটোলা লেন-এর যে ঘরটা ভাড়া করে সে থাকত তার ত্রিশ টাকা ভাড়া দিয়ে দিলে পাইস হোটেল, সিগারেট এবং প্রতিদিনের পয়সা তার থাকত না। মৃণালকান্তি বেহিসেবি ছিল না, কিন্তু সম্ভবত ছায়া চাইত বিয়ের পর মৃণালকান্তি তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলুক, এবং দোকানের শো-কেসে সাজানো কিছু কিছু জিনিসপত্র মৃণালকান্তির ঘরে থাক। বিয়ে করার কথা ছায়া এত বেশি ভেবেছিল যে, একদিন শ্রদ্ধানন্দ পার্কে অন্ধকারে মুখ রেখে বলে, ‘আমি চাই তুমি এমন কোনও কাজ করো যাতে আমাকে ছেড়ে তোমাকে অনেকদিনের জন্যে দূরে চলে যেতে হয়। আমি বেশ তোমার অপেক্ষায় থাকব।’ অন্যদিন শিয়ালদায় ট্রেন লেট আছে জেনে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে বলেছিল, ‘অফিস থেকে ফিরে এলে পিছুপিছু অফিসের পিওন ফাইল নিয়ে আসে-দেখতে আমার বেশ লাগে।’
মৃণালকান্তি ছায়াকে কখনও খুব দূরে নিয়ে যেতে চেয়েছে, ছায়া রাজি হয়নি। মনে হয় নানা পরিবেশে সে ছায়াকে দেখতে চাইত। কি দেখতে চাইত মৃণালকান্তি! ঠিক কি চাইত তা আমি জানি না, তবে তার আত্মজীবনীর কোনও এক জায়গায় আমি পড়েছিলাম, একদিন লিন্ডসে স্ট্রিটের এক দোকানের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে কাঁচের শো-কেসে একটা মেয়ের ‘ডামি’ দেখে মুখটা খুব পরিচিত মনে হওয়ায় সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সে লিখেছে ‘ইহাকে আমি কোথায় দেখিয়াছি! এইরূপ প্রাণহীন প্রস্তরবৎ মূর্তি নয়, আমি অবশ্যই ইহার কণ্ঠস্বর শুনিয়াছি, ইহাকে হাসিতে ও কথা বলিতে দেখিয়াছি। ইহাকে আমি বিষাদগ্রস্ত ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় দেখিয়াছি। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না। এমন মাঝে-মাঝে হয় গতকালের কথা কতবার ভুলিয়া গিয়াছি। স্টেটবাসে কে আমার পাশে বসিয়াছিল–তার মুখ দেখি নাই, কন্ডাকটরের হাতে পয়সা গুনিয়া দিয়া টিকিট লইয়াছিল–কই কোনও কন্ডাকটরের মুখ তো মনে পড়ে না! মনে হয় কতকাল মানুষের সহিত আমি কিছুই বিনিময় করি নাই।’ তারপর মৃণালকান্তি লিখছে, ‘মনে হয় এই মুখে কোথাও বিষণ্ণতা ছিল। দীর্ঘকাল কাঁচের আবরণে ঢাকা থাকিতে–থাকিতে সেই আবরণ ভাঙিয়া বাহিরে আসিবার ইচ্ছা জন্মায় নাই বলিয়া কি এই বিষাদ! মনে পড়ে যাহাদের মুখে বিষণ্ণতা ছিল তাহাদের সহিত কখনও আমার বন্ধুত্ব হয় নাই। বোধকরি সেইজন্যই সুবলের মুখ আমি ভুলিয়া যাই নাই।’ এরপর মৃণালকান্তি সুবলের কথা অনেকটা লিখেছে। সুবল চমৎকার গল্প বলতে পারত। স্কুলে অনেকে সুবলকে ঘিরে বসে গল্প শুনত। বলতে-বলতে সে ইচ্ছামতো গল্পটাকে বড় কিংবা ছোট করতে পারত, বদলে দিতে পারত, গল্পটা যেদিকে যাচ্ছিল ঠিক তার উলটোদিকে নিয়ে যেতে পারত। তার গল্প শুনে সবচেয়ে যে বেশি মুগ্ধ হয়ে যেত সে ছিল। মৃণালকান্তি। সুবলের গায়ে নানা জায়গায় কতগুলি দীর্ঘস্থায়ী ঘা ছিল–যা কখনও শুকোত না; মাঝে-মাঝে ঘা বেয়ে রক্ত পড়ত, প্রায়ই খোস পাঁচড়ায় ভুগত সুবল, এবং কাছ থেকে কথা বললে সুবলের মুখ থেকে বিশ্রী পচা গন্ধ পাওয়া যেত। মৃণালকান্তি তাকে ঘেন্না করত। সেই সুবল একবার তার ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল। মৃণালকান্তি লিখছে, ‘সহসা আমার ভিতরে সে কী সঞ্চার করিয়াছিল! চকিত বিস্ফোরণের আলোয় আমি কী দেখিতে পাইয়াছিলাম! মনে পড়ে না। সুবলকে দেখিতাম–স্কুলের সিঁড়িতে সে একা বসিয়া আছে, গ্রাম্য মেঠো পথ দিয়া একা-একা ফিরিতেছে। আমি আর তাহার কাছে যাই নাই।’ দীর্ঘদিন প্রায় আঠারো–উনিশ বছর পর সুবলকে সে আবার দেখেছিল, কলকাতায় সিনেমা হলের কর্মীরা মিছিল বের করলে সেই মিছিলে সুবলের মুখ চকিতে ভেসে যাচ্ছিল। সুবল কোনও সিনেমা হলে ‘গেট–কিপার’ হয়েছিল। সে লিখছে, ‘একদা ছেলেবেলায় মুখোমুখি হইয়া সহসা শূন্য বোধ করিলে যাহা আমরা করিয়াছিলাম তাহার স্মৃতি আমাকে গভীর আহত করিল। আজ আবার দেখা হইলে আমরা পরস্পর কি বিনিময় করিব! কিন্তু এতদিন পর সুবলকে আমি পুনরায় হাজার লোকের মিছিলে হয়তো চিনিয়া বাহির করিয়াছি। আমি কী দেখিয়াছিলাম! মনে হয় সুবলের মুখের সেই বিষাদ কখনও পালটায় নাই, মনে হয় একাকী, কিংবা বহুজনের সঙ্গে মিলিয়া বরাবরই সুবলের কী একটা কথা বলিবার ছিল –ছেলেবেলায় তাহার গল্পের ভিতর দিয়া, চুম্বনের ভিতর দিয়া, শেষ যৌবনে আর্ত স্লোগান ও উৎক্ষিপ্ত বাহুর ভিতর দিয়া সে সেই কথাই বলিয়া চলিয়াছে। আমি তাহাকে ঠিক চিনিয়াছিলাম। দেখা হইলে আজ আমরা পুনরায় চুম্বন না বিষণ্ণতা বিনিময় করিব! ভিড়ের ভিতরে আত্মগোপন করিতে–করিতে আমার মনে হইল আজ আমি পুনরায় সুবলকে ভালোবাসিতে পারিতেছি।’
তেমন করে মৃণালকান্তিকে ছায়ার কিছু বলবার ছিল কি? যতদূর জানি বিষণ্ণতা ছায়ার ভিতর কোথাও ছিল না। বিভিন্ন চুম্বনের আলাদা আস্বাদ মৃণালকান্তি টের পেত কিনা আমি জানি না। সুবলের কথা শেষ করে মৃণালকান্তি লিখছে, ‘কিন্তু বাস্তবিক ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলাম–এই ডামির মুখে আনন্দ বা বিষাদ কিছুই নাই। প্রাণহীনতা আছে মাত্র। এই প্রতিমার মতো মুখের সহিত অলৌকিক চিত্ত–বিনিময় সম্ভব নহে। দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের বাজনায় কেবল ইহার তাৎক্ষণিক বিষণ্ণতা ধ্বনিত হয়।’
মনে হয় ছায়ার ভিতর তবু কিছু খুঁজে পেয়েছিল মৃণালকান্তি যা তার ডামির মুখের বিষণ্ণতার মতো তাৎক্ষণিক। মৃণালকান্তি আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি কোনও শনিবার ময়দান থেকে বেরিয়ে ফিরবার পথে বৃষ্টি নামলে ছায়া ওর আগে–আগে দ্রুত হাঁটছিল। ছায়া কোনও ‘শেড’ খুঁজছিল–মৃণালকান্তি ওকে দাঁড়াতে দিল না। ওরা সাবধানে হাঁটছিল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজছিল। ছায়ার শাড়ির কলপ ভিজে গিয়ে শাড়িটা ওরা রোগা শরীরের সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছিল। পিছন থেকে ওকে দেখাচ্ছিল হঠাৎ চোপসানো, ভেজা একটা চড়াই পাখির মতো। ময়ূর তার পেখম গুটিয়ে নিলে হঠাৎ তার পিছনে যে শূন্যতা দেখা দেয়–মৃণালকান্তি লিখছে, ‘ছায়ার সমুখে সেইরূপ শূন্যতার ভিতর দিয়া দেখা গেল একজন ট্রাফিক পুলিশ একটা কানা ভিখিরির ছেলেকে হাত ধরিয়া রাস্তা পার করিয়া দিতেছে। ছায়া এইসব কিছুই দেখিল না। দেখিল না তাহার সমুখে ক্ষণস্থায়ী সেই কম্পমান দৃশ্যের পশ্চাদভূমিতে তাহার ঘাড়ের তিনটা হাড় উঁচু হইয়া আছে, চূর্ণ চুলের ওপর জলের ফোঁটায় সহসা প্রলয় প্রতিভাত হইতেছে। আমি মনে-মনে তাহার নিকট প্রার্থনা করিতেছিলাম–এখন তোমার চতুর চোখ আমার দিকে ফিরাইও না, সোজা হাঁটিয়া যাও-আমি তোমার পিছনে এইরূপে শাশ্বতকাল হাঁটিতে থাকিব। কিন্তু কোথায় যেন বিসর্জনের বাজনা বাজিতে ছিল। ছায়া মুখ ফিরাইয়া আমাকে কি বলিতেছিল–আমি শুনি নাই। শুধু চূর্ণ দৃশ্যের উপর, জলে প্রতিভাত বিম্বের উপর হইতে ডামির মুখের ক্ষণস্থায়ী বিষণ্ণতা ভাঁটার টানে নামিয়া যাইতেছিল।’
সেই রাতে ফিরে এসে মৃণালকান্তি লিখেছিল, ‘আমার বাবা সুধাকর হালদার ছিলেন দারোগা। তাঁহার মফসসল ভ্রমণের জন্য একটা প্রকাণ্ড কালো ঘোড়া ছিল। আমি একটু বড় হইলে আমার রোগা রোগা হাত পায়ের দিকে চাহিয়া তাঁহার সন্দেহ হইয়াছিল খুব শক্ত সমর্থ হইয়া গড়িয়া না উঠিলে তাঁহার পুত্র মৃণালকান্তি জীবনে এমন কি দারোগাও হইতে পারিবে না। তাই আমার ভিতরে প্রাণসঞ্চার করিবার জন্য আমাকে একদিন সেই ঘোড়ায় সওয়ার করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া। হইল। মনে পড়ে আমি ভয়ে অনেক চিৎকার ও কান্নাকাটি করিয়াছিলাম। অবশেষে ঘোড়াটা আমাকে এক মাঠের ভিতরে আনিয়া পিঠ হইতে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছিল। অনেক বড় হওয়ার পরও সেই দুঃস্বপ্নকে আমি ভুলিয়া যাই না। অনেকবার ঘোড়ার পিঠ হইতে পড়িয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া আমার ঘুম ভাঙিয়াছে। মনে হয় জাগরণেও সেই পতনের অনুভূতি আমাকে কখনও ঝাঁকি দিয়া যায়। সংশয় হয় আমি শাশ্বতকাল একটিমাত্র ঘোড়ার পুষ্ঠে সওয়ার হইয়া থাকিবার চেষ্টা করিতেছি না তো!’ তারপর সুধাকর হালদারের কথা লিখতে গিয়ে মৃণালকান্তি দীর্ঘ বর্ণনা করেছিল। শেষে সে লিখেছে ‘…তখনও আমি ছোটো, মফসসল হইতে ঘোড়ার পিঠে একা ফিরিবার পথে কাহার মাছের জাল ছুঁড়িয়া তাঁহাকে ঘোড়া হইতে ফেলিয়া এবং সেইখানেই লাঠিপেটা করিয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলে। বনতলীর নির্জন মাঠের ভিতর সেই গ্রাম্য দারোগা–হত্যার ঘটনাতেই সম্ভবত সুধাকর হালদার তাঁহার পুত্র মৃণালকান্তির অনুভূতিগুলি প্রথম ও শেষবারের মতো প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃতদেহ লইয়া বিরাট শোভাযাত্রা বাহির হইয়াছিল। মনে পড়ে মায়ের মৃত্যুতে তেমন ঘনঘটা কিছুই ছিল না। কলিকাতার এক ভাড়াটে বাড়িতে তাঁর চেষ্টাহীন নিঃশব্দ মৃত্যু ঘটিয়াছিল। বাড়িওয়ালাই কিছু লোকজন ডাকিয়া আনিয়াছিল। শোক না, বৈরাগ্যও না-বিরাট এক মিশ্র জনতার ভিতর দিয়া খোলা রাস্তায় উজ্জ্বল রৌদ্রে আমার রোগা ছোট্ট মায়ের মৃতদেহের অনুগমন করিয়া যাইতে আমার লজ্জা করিতেছিল। আমি কাহার জন্য শোক করিব, কাহাকে ভালোবাসিব! পৃথিবীর যে প্রকাণ্ড মিশ্র জনতার ভিতর আমি রহিয়াছি তাহাদের কয়জন জানে যে, একজন মৃণালকান্তির একজন মা ছিল এবং মৃণালকান্তির সেই রোগা, ছোট্ট দুর্বল মা আর নাই!’ মৃণালকান্তি লিখেছিল ‘নিজেকে এমন উদ্বাস্তু মনে হয় কেন! কখনও নিশ্চিতভাবে বলিতে পারি না-আমি ভালোবাসি! ভালোবাসি না-এ কথাও সংশয়ে কতবার বলা হয় নাই!’
গড়িয়াহাটার দিকে কোথায় যেন মৃণালকান্তির সোনাকাকা গেঞ্জি ফিরি করে বেড়াত। তার এইরকম কিছু-কিছু আত্মীয়স্বজন নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিল। বিধবা ‘রাঙামাসি’, বাবার খুড়তুতো ভাই সোনাকাকা, বড়পিসি, গ্রামসম্পর্কে জ্যাঠামশাই ইত্যাদি এবং যাদবপুর, টালিগঞ্জ, কসবা, মধ্যমগ্রাম কিংবা আরও দূরে তার আরও আত্মীয়রা ছিল। কখনও কারও সঙ্গে দেখা হলে আর কাউকে মনে পড়ত–তখন খেয়াল করে খোঁজ নিত, একদিন গিয়ে সকলের সঙ্গে দেখা করে আসবে বলে কথা দিত। প্রায়ই যাওয়া হয়নি। কখনও কারও অভাব শুনলে দু-পাঁচ টাকা সাহায্য পাঠিয়েছে, কখনও পাঠানো হয়নি। কলেজ স্ট্রিটে ছায়ার সঙ্গে একদিন রাস্তা পার হতে গেলে কাঁধে গেঞ্জির বোঝা নিয়ে সোনাকাকা পথ আটকাল–দুজনকে একসঙ্গে দেখেও। আর্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল সোনাকাকা, ‘বিয়া করস নাই!’ মৃণালকান্তি লিখছে, ‘সোনাকাকাকে কষ্টে চিনিতে পারিয়া আমি সিগারেট ফেলিয়া দিলাম। তবে কি আমি আস্তে-আস্তে প্রিয়জনদের মুখগুলি ভুলিয়া যাইতেছি! মনে পড়ে হাওড়া স্টেশনে একজন তাহার বিড়ি ধরাইতে আমার সিগারেটটা চাহিয়া লইয়াছিল। কেমন সন্দেহ হওয়ায় আমি আর সিগারেটটা ফেরত না লইয়া তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিলাম। মনে হইল, ইহাকে আমি কখনও জ্যাঠা বলিয়া ডাকিতাম কি! আত্মীয়দের মুখ ক্রমশ ভুলিতেছি। রাঙামাসির মুখ মনে পড়ে না। কবে যেন বড়পিসি আমাকে বলিয়াছিল, ‘মনু, বাইরে চলাফিরা করো, একখান পঞ্জিকা রাখছ তো!’ ছায়া কি ভাবিল জানি না। সে আমাকে কিছু বলে নাই। আমি পকেটে হাত দিতে গেলে সোনাকাকা আমার হাত আটকাইল ‘মনু, তরেই তো আমার দ্যাওনের কথা।’ তাহার পর ছায়ার সঙ্গে নিঃশব্দে ঘঁটিয়া গেলাম। মনে পড়ে না কোনওদিন আমার মানুষকে ভালোবাসিবার সর্বব্যাপী সাধ হইয়াছিল কিনা।’
অন্য একদিনের কথা মৃণালকান্তি লিখেছিল। দুপুর বেলায় এসপ্ল্যানেডে একটা ফাঁকা রেস্তোরাঁয় সে বসে ছিল। সেটা একটা মাদ্রাজি রেস্তোরাঁ। কিছুক্ষণ আগে সে দ্বিতীয়বার স্টেনলেস স্টিলের কাপ থেকে গরম চা খেয়েছে। তার ঠোঁট জ্বলছিল। বাইরে সব কিছুই খুব আলোকিত, উত্তপ্ত এবং ছায়াহীন। রেস্তোরাঁর ভিতরটা অনেক ঠান্ডা এবং নির্জন। সে লিখছে, ‘যেখানে বসিয়া আমি আমার নোট লিখিতেছি সেখান হইতে রাস্তা, ময়দান, মনুমেন্ট সবই দেখা যায়। স্টেটবাসগুলি রাস্তা গিলিতে–গিলিতে যাইতেছে। আমি রাস্তায় পায়ের শব্দ এবং কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইতেছি। জুন মাসের দুপুর বলিয়া রাস্তায় লোকজন কম। হঠাৎ তাকাইলে–আমি সব কিছুর কেন্দ্রস্থলে আছি–এমন মনে হয়। এমন মুহূর্তগুলি আমার এত প্রিয় যেন সবকিছুই আমাকে স্পর্শ করিয়া আছে। এমন সব মুহূর্ত হইতেই আমরা নূতন করিয়া যাত্রা আরম্ভ করি। পাশের টেবিল হইতে দুজন ব্যবসায়ী উঠিয়া গেলে চর্বির পাহাড় গলায় থাক–থাক গলকম্বলওয়ালা এক পাঞ্জাবি আসিয়া বসিল। আধ খোলা ঘুমচোখে সে আমাকে লিখিতে দেখিতেছে। কী লিখিতেছি আমি! এই মুহূর্তেই যেন মনে হইতেছে কাহারা আমার হাত ছাড়িয়া দিয়া চিরতরে চলিয়া গিয়াছে।’
‘একশত বৎসর একটানা ঘুমাইবার পর সহসা জাগিয়া উঠিয়া আমি পরিচিত লোকজন কাহাকেও দেখিতে পাইতেছিনা। কি বলিয়া আত্মপরিচয় দিব। আমি কাহার সন্তান! আমি বিশেষ কাহারও কি! ওই পর্বতকার পাঞ্জাবিটার সন্তান আমি হইলাম না কেন? আমি গাছ হই নাই কেন; আমি মাছ হইয়া জন্ম গ্রহণ করিলেই বা কাহার কি ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল! পরিচিত বৃত্তের বাহিরে নিজেকে আত্মপরিচয়হীন, নামগোত্রহীন বোধ হইলে ভাবিয়া দেখি আমার মুখ কাহারও মনে আছে কি! একশত বৎসর পূর্বে কবে দেখিয়াছিলাম সোনাকাকা গড়িয়াহাটার মোড় হইতে গেঞ্জি হাঁকিতে–হাঁকিতে ভিড়ের ভিতর পথ চিনিয়া চলিয়াছে। ছায়াকে মনে পড়ে না! সহসা সুবলের মুখ একশত বৎসর পার হইতে বিস্ফোরিত হয়। মনে হয় অনেক মৃত মানুষ আমাদের জীবিত মানুষদের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়া বে-আইনিভাবে বসবাস করিতেছে।’
মৃণালকান্তি একদিন ছায়াকে ট্রেনে তুলে দিলে ট্রেন প্ল্যাটফর্মের আলো থেকে বাইরের অন্ধকারের দিকে সরে যাচ্ছিল। জানলায় মুখ রেখে হাত বাড়িয়ে ছায়া রুমাল নাড়তে-সেই ছোট্ট সাদা দোমড়ানো রুমাল অন্ধকার থেকে ফুলের মতো ছিটকে ছিটকে আসছিল। মৃণালকান্তি লিখছে, ‘মনে হয় আমাকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ছায়া তাহার শাড়ি, তাহার মুখ তাহার অবয়ব ট্রেনের জানলায় একটি ব্রাকেটে টাঙাইয়া রাখিয়া নিজে কামরায় ভিতরে কোথাও সরিয়া গিয়া বসিয়াছে। ট্রেন তাহার আলো ও ছায়া পর্যায়ক্রমে আমার শরীরের উপর হইতে তুলিয়া লইলে, সহসা শূন্য দিগন্তপ্রসারী রেলদ্বয়ের দিকে চাহিয়া সন্দেহ হয় আমাকে কি কোনওদিনই কিছু স্পর্শ করে নাই! খুব তীব্র ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কিংবা কোনও বোধ আমি অনুভব করি নাই! আমি কখনও খুব আনন্দিত বা ক্রুদ্ধ হই নাই কেন! আমি আমার হস্তপদগুলি বিপথগামী করিয়া সহসা নৃত্যে উদ্বাহু হই নাই।’
মৃণালকান্তির আত্মজীবনী আমি যতটুকু পড়েছি তা লক্ষ করলে দেখা যায় সে খুব স্বাভাবিক মানুষ ছিল না। মনে আছে সে একদিন গড়ের মাঠে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে চোখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘জানো, রোগা লোকেরা নিজেকে বড্ড বেশি টের পায়! দেখো, খুব শিগগিরই আমার অসুখ হবে।’ তার বেনেটোলা লেন-এর ঘরে আমি মাঝে-মাঝে যেতাম। কখনও দেখেছি। মৃণালকান্তি ইঁদুর আরশোলা কিংবা পিঁপড়েদের চলফেরা লক্ষ করছে। কখনও তাকে আমার খুব অচেনা মনে হত, কখনও মনে হত সে নিজেকে বড় বেশি টের পাচ্ছে। তার আত্মজীবনীর সর্বশেষ যে ঘটনাটি আমি পড়েছিলাম তাতে মৃণালকান্তি লিখেছে…’কত তুচ্ছ মনে হয় যখন ভাবি। ঘটনাটা ঘটিয়াছিল একটি আরশোলাকে লইয়া। সিঁড়ির উপর চিৎ হইয়া শুইয়া থাকিয়া আরশোলাটা মরিতেছিল। তাহার প্রবীণ দেহের চারিপাশে তুলনায় বিশাল বিস্তৃত সেই সিঁড়ির উপর তাহার দেহলগ্ন ছায়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’ আরশোলার কথা মৃণালকান্তি অনেকটা লিখেছিল। লিখেছিল, ‘মৃত্যু মাত্রই আত্মীয়হীন, স্বজনহীন। মৃত্যুতে কোনও সহগামী নাই। তাহার সেই অর্বাচীন শরীরকে ঘিরিয়া মুহূর্তের জন্য আমার চোখের সামনে ছায়াপথ ও নীহারিকাপুঞ্জের আর্চ-এর মতো অর্ধবৃত্তাকার ছড়ানো তারাগুলি দুলিয়া গেল কি! মনে হয় তাহার তুচ্ছ মৃত্যুর। নিকট আমাদের সম্মিলিত বাঁচিয়া থাকা নগণ্য মাত্র। ভালোবাসার, ইচ্ছার, ললাভের মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়া অকস্মাৎ বৈজ্ঞানিক মহৎ শূন্যতার ভিতরে সে অগ্রসর হইতেছিল।’ মৃণালকান্তির পাশে রেস্তোরাঁর সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছায়া কথা বলছিল। মৃণালকান্তি লিখছে যে, ছায়া তখনও বলছিল, ‘কাল ছাত্রীর মা আমাকে একটা খাম দিল। বাড়িতে গিয়ে খুলে দেখি পঞ্চাশ। আমার কিন্তু চল্লিশ পাওয়ার কথা। ভাবছিলাম…’ মৃণালকান্তি লিখছে, ‘দেখিতেছিলাম ছায়ার স্যান্ডেল পরা পা গোঁড়ালির উপর ভর করিয়া দুলিতেছে। ছায়া কথা বলিতেছে–আমি কি তাহাকে চুপ করিতে বলিব! আমি কি সকলকেই চুপ করিতে বলিব! জানি কথা শেষ করিয়া হাসির বেগে যখন সে ঝুঁকিবে তখন ছায়ার পা আরশোলাটার উপর নামিয়া আসিবে। বলিব কী পা সরাইয়া লও। ভাবিতেছি–আমার কী হইয়াছিল! এত তুচ্ছ কথা বলার অর্থ নাই। বলিলেও ছায়া আমাকে পাগল ভাবিবে। কিন্তু আরশোলাটা অপেক্ষা করিতেছে। কোটি–কোটি আলোকবর্ষ দূর হইতে কোনও-কোনও নক্ষত্রের আলো পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করিয়াছিল–এখনও আসিয়া পৌঁছে নাই–সে সেই দিকে চাহিয়া আছে।’ তারপর ছায়া বলছিল, ‘বুঝলাম ছাত্রী থার্ড হয়েছে বলে এটি আমার ইনক্রিমেন্ট…’ ছায়া হাসতে যাচ্ছিল–সেই হাসির আভাস হাসি আসবার আগেই তার মুখে চোখে খেলে যেত চকিতে–মৃণালকান্তি লিখছে…’আমি আমার সর্বস্ব দিয়া বলিতে চাহিলাম–না। সরিয়া দাঁড়াও। আমি দুই হাত বাড়াইয়া সহসা শূন্য বোধ করিয়াছিলাম। সহসা আয়নায় চিড় ধরিবার শব্দ হইল। আমার প্রসারিত হাতে কেন্দ্রবিচ্যুত ছায়া বৃষ্টিতে ভেজা সিঁড়ির ফুটপাথে গড়াইয়া গেল। আমি কি ছায়াকে ধাক্কা দিয়াছিলাম! জানি না।’ ভিড় জমে যাওয়ার আগেই আস্তে-আস্তে ছায়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। কোনও কথাই বলেনি ছায়া, আঙুল তুলে মৃণালকান্তির দিকে স্থাপনও করেনি। সে চলে গিয়েছিল। আর আসেনি। মৃণালকান্তি লিখছে, ‘সে আর আসিবে না জানিয়া তাহাকে আমার সেই মুহূর্তে বড় প্রিয় বোধ হইল। আমি তাহাকে চলিয়া যাইতে দেখিলাম।’