জ্যাঠাইমা সঙ্গে সঙ্গে বললেন—মাতাল দেখে দেখে ঠাকুরঝির ভয় হয়ে গেছে। প্রভাতকাকা গান গেয়ে উঠলেন—পিলে, পিলে হরি নামকা পেয়ালা। একবার করে পিলে বলছেন, একধাপ সিঁড়ি নামছেন, বাঁকের মুখে চওড়া সিঁড়িতে নেমে দু—হাত তুলে বললেন—হরি নামকা পেয়ালা। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন—তুলে রাখুন, গোলাপ ফুল মার্কা সুটকেসে—মানি মানি মানি, সুইটার দ্যান হানি। মানি মানি মানি, সুইটার দ্যান হানি।
বেলা পড়ে আসছে ধীরে ধীরে। উত্তরদিকের বাগানে নিমগাছের ঝিরি ঝিরি পাতায় হালকা হলুদ রঙের মরা—মরা রোদ দিনের শেষ খেলায় মাতামাতি করছে। দুটো শালিক কর্কশ গলায় সারাদিনের হিসেব—নিকেশ নিচ্ছে। একটু একটু উত্তরের হাওয়া দেখা দিয়েছে। পুজো আসছে, পুজো আসছে।
উত্তরদিকের শেষ ঘরটা আমাদের খাবার ঘর, বাইরেটায় রান্নার ব্যবস্থা। দেওয়ালের গায়ে দুটো বড়ো বড়ো উনুন পাতা। একসময় সুখের দিনে দুটো উনুনেই গনগন করত আগুন। সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে একটায় আমার মা, জ্যাঠামশাই আদর করে বলতেন তুলসী মায়া, আর একটায় আমার রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমা, জ্যাঠামশাই আদর করে বলতেন চপলা দেবী। উনুনের পেছনের দেওয়ালে বহু বছরের ধোঁয়ার কালো কালি লেপটে আছে। কালির দাগ আর স্মৃতি যেন এক জিনিস। এখন একটা উনুনেই যথেষ্ট। আর একটায় যত খালি ঠোঙা, শালপাতা, ঘুঁটের টুকরো ঢোকানো। উনুনের ডানদিকে কালো কুচকুচে বার্মা কাঠের দরজা। দরজায় শিকল তোলা। দরজা খুললেই মাঝারি মাপের একটা ঘর।
সারাঘরের দেওয়ালে নোনা লেগে পলেস্তারা ঝরে নানা দেশের ম্যাপ তৈরি হয়েছে। দক্ষিণের দেওয়ালে গভীর একটা কুলুঙ্গি। এত গভীর, সময় সময় মনে হয়, ওর পেছনে কোথাও কোনো গুপ্ত ঘরে যাবার গোপন সিঁড়ি আছে।
দুপুরের খাওয়া শেষ হলেই দক্ষিণের ঘরটা যেন রেলের প্ল্যাটফর্ম। উত্তরদিকের দরজা দুটো হাঁ—হাঁ করছে খোলা। দক্ষিণের দরজা দিয়ে হু—হু করে হাওয়া আসছে। যে যেখানে পেরেছে চিত হয়ে কাত হয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছে। পুবের দেওয়ালে ছবিতে জেগে আছেন রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমা, সিংহাসনের মতো চেয়ারে সাদা বেনারসি পরে মাথায় অল্প একটু ঘোমটা। পায়ে সাদা ডোরাকাটা পাম্পশু। পেছনে শ্বেতপাথরের থামওলা বারান্দা। বাইরে দুটো ঝাপসা গাছ। সাঁকোর তলা দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা নদী, সুদূর সিপিয়া রঙের আকাশে। জ্যাঠাইমা যেন রাজরানি। এই ঘরের সবচেয়ে বড়ো ছবি জ্যাঠাইমার। ছবিটা এত জীবন্ত, মনে হয় এখুনি উঠে দাঁড়িয়ে, ভরতি এক গেলাস দুধ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলবেন—বিল্টু লক্ষ্মী ছেলে, খেয়ে নাও তো বাবা। দুধ না—খেলে গায়ে শক্তি হবে কী করে। ফুটবলে এমন একটা শট মারবে, বলটা সোজা আকাশে উঠে গিয়ে সকলের মাথার উপর দিয়ে সিধে গোলে। এক এক শটে এক এক গোল! আমি কী চাই রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমা ঠিক বুঝতেন—এক এক শটে একটা করে গোল, এক মারে ওভার বাউন্ডারি। জ্যাঠামশাই কিনে দিয়েছিলেন এয়ারগান। জ্যাঠাইমা জানতেন এয়ারগান নয়, আমি চাই ছোকনদার মতো বড়ো বন্দুক। ডিসেম্বর মাসের সকাল থেকেই আমাদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে পশ্চিমে থানার দিকে বন্দুকধারীদের মিছিল চলত, একদিন, দু—দিন, তিনদিন। একনলা, দো—নলা বন্দুক, কোনোটা চামড়ার খাপে ভরা, কোনোটা খোলা। ওই সময়টা দক্ষিণের জানলার ধারের বেঞ্চি থেকে একমুহূর্তের জন্যে সরে যেতে পারতুম না। যেন উৎসবের কল! জ্যাঠাইমা বলতেন—দুধ খাও, ইয়া গাঁট্টাগোট্টা শরীর কর, আমি তোমাকে বড়ো বন্দুক কিনে দেব। কাঁধে স্ট্র্যাপ বাঁধা বন্দুক, পিঠে হ্যাভারস্যাক, মাথায় শোলার হ্যাট, পায়ে হান্টারবুট, আরাকানের জঙ্গলে যাবে বাঘ শিকারে।
—জানি, জানি, তুমি কি কম চালাক ছিলে! জীবনের সব বড়ো বড়ো দিকের লোভ দেখিয়ে কখন খেলোয়াড়, কখন ঘোড়সওয়ার, কখন শিকারি, কখন বৈমানিক, কখন শিল্পী করার স্বপ্ন দেখিয়ে তুমি আমাকে দুধ খাওয়াতে, সহবত শেখাতে, নিয়মমতো সন্ধ্যায় উপাসনা করাতে, গলা সাধাতে, হাতের লেখা করাতে, অঙ্ক কষাতে। এক জগতের স্বপ্ন দেখিয়ে, আর জগতে ফেলে রেখে, তুমি অন্য জগতে চলে গেলে। তুলসী মা কার ভরসায় আমাকে রেখে গিয়েছিল। এই পপাত ধরণীতলে এখনকার জ্যাঠাইমার ভরসায় নয় নিশ্চয়।
রান্নাঘরে পুবের জানালার পইঠেতে বেশ কিছুক্ষণ পা তুলে বসে রইলুম। পাশের মাঠের খোঁটায় বাঁধা একটা কালো গোরু আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে খাস বাগানের দিকে। ইংরেজ আমলে গঙ্গা থেকে একটা খাল কেটে পূর্ব বাংলায় নিয়ে যাবার কথা ছিল। সেই সময় সরকার সমস্ত জমি খাস করে নিয়েছিলেন। খাল আর হল না। হলে কেমন মজা হত। ওই মাঠটা তখন চলে যেত খালের ধারে।
সারাটা দুপুর কেমন একটা খাই—খাই ভাব। স্কুলে থাকলে অতটা বোঝা যায় না। গোরুটা ঘাস ছিঁড়ছে। এখানে বসে বসেই শব্দটা শুনতে পাচ্ছি। বেশ খাদ্য—খাদ্য ভাব। নিজের পেটটাই যেন কেমন ভরে উঠেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ‘দুর্গার ঘুড়িটা’ তারে জড়িয়ে আছে। কালও গোটা ছিল। আজ একদম ফর্দাফাঁই। হাওয়ায় ওলটপালট খাচ্ছে। ঘুড়ির ছায়াটা ভূতের মতো হাত—পা নাড়ছে উলটোদিকের হলদে বাড়িটার দেওয়ালে। দুটো চড়াই পাখি বাগানে ধুলোয় গববু করে খুব চান করছে। কড়িকাঠের ফাঁকে একটা চড়াইয়ের বাচ্চা অনেকক্ষণ ধরে সিঁসিঁ করছে। লম্বা টেবিলের ওপর শালপাতায় মোড়া একটু তেঁতুল রয়েছে। একটা বিচি ছিঁড়ে নিয়ে নুন মাখিয়ে মুখে দিলুম।
এবার একবার দক্ষিণের বারান্দায় যাই। এদিকটা গ্রাম ওদিকটা শহর। বড়ো রাস্তা ওদিকেই। এবার ওদিকের বেঞ্চিতে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে আর কিছুক্ষণ বসি। এই সময় ভীষণ খিদে পায়। গদাইদা সেই কখন গেছে কেরোসিনের জন্যে লাইন দিতে। প্রায় মাইলখানেক দূরে শ্মশানের কাছে কন্ট্রোলে তেল দেবার দোকান; মালাদি পাশ ফিরে খুব ঘুমোচ্ছে। মালাদির মাথায় বিনা পয়সায় অনেক খাবারের প্ল্যান আসে। জ্যাঠাইমারও আসে। তবে জ্যাঠাইমাকে হুকুম করা চলবে না। ইচ্ছে হলে, তবেই হবে।
রাজেনবাবুর দোকান খুলেছে। বালতি থেকে জল নিয়ে মগে করে রাস্তায় ছিটোচ্ছেন। সন্তোষদার দোকানে মামা নামের ছেলেটা দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছে। সেই বিশ্রী মোটামতো বিধবা মেয়েছেলেটি খাটো করে কাপড় পরে হাতে একটা পেতলের ঘটি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মামা এনামেলের একটা গেলাস বাড়িয়ে ধরেছেন। মেয়েছেলেটি চা ঢেলে দিচ্ছে। সবাই এই মেয়েছেলেটিকে মামার মেম বলে।
ফর্সামতো একটি ছেলে রাজেনবাবুকে মামলেটের অর্ডার দিয়েছে। সামনের বেঞ্চিতে বসে ঘুগনি খাচ্ছে। প্যানে মামলেটটা হলদে হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝখানটায় পেঁয়াজ ও লঙ্কার ডুমো। একটু কাঁচা থাকতেই এপাশ ওপাশ থেকে ভাঁজ করে ডিশে তুলে ফেললেন। চায়ের বড়ো কেটলিটা উনুনে বসে গেল।
বাড়ির পশ্চিমে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। সূর্য যত গঙ্গার দিকে হেলতে থাকে, ল্যাম্পপোস্টের ছায়াটা ততই এগিয়ে আসতে থাকে আমাদের বাড়ির দিকে। তারপর হঠাৎ উঠে চলে যায়। এইটাই আমাদের সূর্য—ঘড়ি। এই ছায়া দেখে সময় বুঝতে পারি। দিন চলে গেলে, দুঃখ নামে। আবার একটা আশাও হয়। খাবার সময়টা এগিয়ে আসছে। রুটি, কম তেলের কুমড়োর ঘ্যাঁট। সাড়ে ন—টা কি দশটার মধ্যে বাবা ফিরবেন। অফিসের পর বেলগাছিয়ায় ছেলে পড়ানো নিয়েছেন। বাবার ফেরার সময়টাও জানা আছে। গবার তেলেভাজার দোকানের সামনে বসে হামাদিস্তেতে গরমমশলা পিটতে থাকলেই আমার সাবধান হবার সময়। এইবার বাবা আসবেন। গোড়ালির শব্দটা শোনা যাবে কলতলার কাছে এলেই। জুতোর শব্দ অনেকেরই হয় কিন্তু বাবার জুতোর শব্দটা এতই পৃথক, চিনতে কখনো ভুল হয় না। আমার কানে বোধহয় কুকুর আছে। আমাদের সেই সাদা কুকুর জিমের প্রেতাত্মা। হাউন্ড। কোনো এক সাহেব জ্যাঠামশাইকে দিয়েছিলেন। জ্যাঠামশাইয়ের অসুখ যখন খুব বাড়াবাড়ি সেই সময় কুকুরটার বড়ো অযত্ন হল। নীচের স্যাঁৎসেঁতে অন্ধকার গলিতে দিনরাত বাঁধা থাকত। ঠিক সময় খাবার পেত না। না—পেলে ডাকত না। কত লোক ওপর—নীচ করছে, ডাক্তার—বদ্যি, আত্মীয়স্বজন, পাড়ার প্রতিবেশী। জিম বুঝতে পারত বাড়িতে বিপদ চলছে। উৎসুক মুখে সকলের মুখের দিকে তাকাত, যেন খবর নিতে চায়—কী দেখলে, কী বুঝলে। জ্যাঠামশাইয়ের খাটটা যখন বাড়ি থেকে সকলের কাঁধে চেপে বেরিয়ে গেল জিম উঠে দাঁড়াল, পা কাঁপছে। ন্যাজটা শেষবারের মতো প্রভুকে বিদায় জানাবার জন্যে বারকতক অতিকষ্টে নাড়ল। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্ধকার জানালার দিকে মুখ করে সেই যে শুল আর উঠল না। বাবা ডাকতেন জিম। চোখ তুলে তাকাত। দু—চোখে অনবরত জলের ধারা। বামুনদি খাবার দিয়ে আসত, স্পর্শ করত না। তিনদিন পরে ভোরবেলা এসে খবর দিল, জিম কখন মারা গেছে।
দূরে গদাইদা আসছে। বটতলা বরাবর এসেছে। হাতে তেলের টিন। মুখটা রোদে পুড়ে আরও কালো হয়ে গেছে। গায়ে প্রভাতকাকার কিনে দেওয়া নীল রঙের একটা জামা, পায়ে ডোঙামতো টায়ারের চটি। গদাইদার সামনে বুক ফুলিয়ে আসছে কালোমতো সেই মেয়েটি। বাড়ি বাড়ি কাজ করে। প্রভাতকাকা নাম রেখেছেন ভীমা। ও নাকি কুস্তির পালোয়ান। মুনশিদের বাড়ি দারোয়ান নাগেশ্বরকেও প্যাঁচ মেরে পটকে দিতে পারে।
ল্যাম্পপোস্টের ছায়াটা গদাইদাকে ধরার জন্যে যেন আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে। তিনটে অনেকক্ষণ বেজে গেছে। ছায়া দেখে মনে হচ্ছে চারটেও বেজে গেছে। কলে জল এসেছে। তেলের টিনটা কলের সামনে সুবোধের বাতাসার দোকানের রকে রেখে গদাইদা হাঁ করে কিছুক্ষণ দোকানটার দিকে তাকিয়ে রইল। সামনেই সুবোধের বড়ো রামছাগলটা চোখ বুজিয়ে লম্বা দাড়ি নেড়ে নেড়ে জাবর কাটছে। দু—জন কারিগর চ্যাটাইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে টপাটপ বাতাসা পেড়ে যাচ্ছে। আমি জানি গদাইদা কী দেখছে। সামনেই কাচের জানলাঅলা চৌকো চৌকো কৌটোয় সাদা সাদা নকুলদানা আছে, সাদা বাতাসা আছে, আর আছে এত বড়ো বড়ো ফুল বাতাসা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়। গদাইদা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কলে মুখ দিয়ে চোঁ—চোঁ করে জল খেল। জামাটা তুলে মুখ মুছল। তারপর টিনটা তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে আসতে লাগল। আর ঠিক সেই সময় কিশোরী গঙ্গার দিক থেকে তার বিশাল পাটনাই গোরুটাকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি দুধ দিতে বেরিয়েছে। সঙ্গে কিশোরীর ফুলো ফুলো গাল বাচ্চা ছেলেটা যেন নেচে নেচে চলেছে। তার বগলে একটা খড়ের গোরু। কিশোরীর হাতে দড়ি আর বালতি। হনহন করে পশ্চিমদিকে হেঁটে চলেছে ডাকপিয়োন। গদাইদা ডেকে জিজ্ঞেস করল—চিঠি আছে বটেক? লোকটি চলতে চলতেই বললেন—নম্বর কত? —সাতান্ন বটেক? পিয়োন ঘাড় নেড়ে চলতে শুরু করল। বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় সন্তোষদার দোকানে একটা খাম ছুড়ে দিল। খামটা মামার মুখে লেগে কোলের কুলোটার ওপর পড়ল।
তেলের টিন হাতে ক্লান্ত, শ্রান্ত গদাইদা সদরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। ঢ্যাং করে টিনটা একপাশে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল যেন বিশ্ব বিজয় করে ফিরেছে। আমি এক নবাব ঠ্যাং ছড়িয়ে আরাম করে বিশ্ব দর্শন করছি। সংসারের জন্য কিছু করার নেই। ছাদের টবে, বাবার সবচেয়ে দামি চন্দ্রমল্লিকার মতো, সার নিয়ে, পরিচর্যা নিয়ে বেড়ে উঠে সবচেয়ে বড়ো একটি চন্দ্রমল্লিকা ফোটাতে হবে। কড়া নির্দেশ—মা—মরা ছেলে, দোকান নয়, বাজার নয়, রেশনের লাইনে নয়, কোথাও নয়, তুমি শুধু থাকবে পড়ার টেবিলে বই মুখে। তুমি ওরই মধ্যে ভাগ্যবান, তোমার পিতা এখনও জীবিত। আশ্রিতের সংখ্যাও অনেক। তোমার পিতা জোগাবেন অর্থ, ওরা দেবে শ্রম। তুমি শুধু বাঁচবার চেষ্টা করো, বড়ো হবার চেষ্টা করো।
গদাইদা বেঞ্চির আর এক মাথায় রাস্তার দিকে মুখ করে বসল। আগের চেয়ে অনেক চটপটে হয়েছে। রাস্তাঘাট চিনেছে। বুঝতে পেরেছে। কোন জমিতে দাঁড়িয়ে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। আগের মতো কথায় কথায় রেগে যায় না, বোনের সঙ্গে ঝগড়া করে না। মা—র ওপর অভিমান করে না।
নিজে কিছু না—করার লজ্জা চাপা দেবার জন্যে জিজ্ঞেস করলুম—তোমার বুঝি চিঠি আসার কথা? গদাইদা বললে—হুটোদা বলেছিল হেডমাস্টার মশাইকে বলে ট্রান্সফার সার্টিফিকেটটা পাঠিয়ে দেবে। তা মাইনে বাকি আছে বটেক।
—তুমি স্কুলে ভরতি হবে গদাইদা? আমাদের স্কুলে ভরতি হয়ে যাও না।
গদাইয়ের মুখটা হঠাৎ করুণ হয়ে গেল। প্রবীণ মানুষের মতো উত্তর দিল—তোমাদের স্কুলে মাইনে লাগবে যে? ছোটোমামা বলেছেন দু—বেলা দুটো খাওয়া জুটছে, এই না কত! এর ওপর পড়ার খরচ? একটা ফ্রি স্কুল জোগাড় করতে হবে।
—কোথায় পাবে?
—আছে বটেক। সেই তিন মাইল দূরে গোপেশ্বর স্কুল। মা বলেছে অধীরবাবুকে ধরবে।
দু—জনেই জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলুম। একটা ছাগল ইয়া বড়ো পেট নিয়ে আপন মনে চলেছে। দূরে ঘুঙুর বাজিয়ে সঙের মতো পোশাক পরে হরিদাসের বুলবুল ভাজা আসছে। যত খাবে ততই মজা। গদাইদা পকেট হাতড়ে একটা আনি বের করল। পয়সাটা হাতের তালুর ওপরে রেখে আমাকে দেখিয়ে বললে—তেলের পয়সা থেকে এইটা ফিরেছে। আমরা দুজনেই আনিটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। বুলবুল ভাজা নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল। কারুরই সাহস হল না তাকে ডাকি। গদাইদা আঙুল দিয়ে পয়সাটা নাড়াতে নাড়াতে বললে—গরম গরম বাতাসা তৈরি হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—ভুজাওলার দোকানে ছোলাসেদ্ধ হয়েছে। লাল লাল কাঁচালংকা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। বহুরকমের খাবার চোখের সামনে ভাসছে। এই তো এখান থেকেই তিন রকম দেখতে পাচ্ছি। সন্তোষদার দোকানের সামনে জারে সাজানো—গোল গোল নানখাতাই, তিনকোনা লেড়ো, কিশমিশ আর কুমড়োর বরফি গোঁজা নরম নরম কেক। উপায় নেই, হিসেবের কড়ি। বাঘেও ছোঁবে না।
একসময় ছিল যখন এই জানলা থেকে একটা আঙুল তুললেই সন্তোষদার দোকান থেকে লজেন্স আর বিস্কুট ওপরে চলে আসত, হাতের মুঠোয়। সেসব সুখের দিন জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। ধারে কিছু চলবে না। সব নগদের কারবার। তিনবছর আগেও বিকেলের জলখাবার ছিল ভাদুয়া ঘিয়ের ফুলকো লুচি, মুচমুচে আলু ভাজা। শুকনো লংকার ভাজা দানা, কী সুন্দর লাগত দাঁতে কাটতে।
মালাদি ঘুম থেকে উঠে এসেছে। মুখটা ফুলো—ফুলো লাগছে। রাস্তাটা একবার দেখে নিয়ে বললে—দেখেছিস? দুজনেই অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকালুম—কী গো মালাদি!
—আবার কচি কচি পেয়ারা হয়েছে?
বাগানের পাঁচিলের গায়ে দো—ফলা পেয়ারা হয়েছে, শীতের পেয়ারা সবে ফুলকুচি হয়েছে সে তো পাকবে অনেক পরে। এখন ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই। এখন একেবারে কষা—বিস্বাদ।
—পেয়ারার আচার খাবি বিল্টু? বেশ ঝাল ঝাল নুন নুন।
—কী করে করবে?
—দেখ না ঠিক করব। চল, ওদিকে চল, হাতে হাতে কয়েকটা পাড়ি চল।
যত বিকেল হতে থাকে উত্তরদিকটা তত বিষণ্ণ থেকে বিষণ্ণতর হয়ে আসে। ছোট্ট একফালি জায়গায় যত রকমের গাছ। পেয়ারা গাছটা এতই বেয়াদব, বেশিরভাগ ডালাপালা পুবের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাঁচিলের ওপাশেই একটা টিনের ঘর। বস্তিবাড়ি মতো। সমস্ত ভালো ভালো পেয়ারাঅলা ডালের গতি সেইদিকে। দু—একটা ডাল আমাদের বারান্দার টিনের চালে এসে ঠেকেছে। হাত বাড়িয়ে টানাটানি করলে গাছের পুবের অংশের কিছুটা নাগালের মধ্যে আসে।
মালাদি একটা ডাল ধরে বললে—টান বিল্টু! দুজনে টানতেই ওপাশের কিছু ডালপালা আমাদের দিকে এগিয়ে এল। মালাদি বললে—গদা, তুই আর বিল্টু এইবার এইটা টেনে ধর। আমি আরও কিছু ওপাশ থেকে ধরে আনি। বারান্দার কাঠের রেলিংয়ের ওপর উঠে হাত বাড়িয়ে মালাদি আরও দূরের ডাল ধরে আনার জন্যে শরীরের ওপরের অংশটাকে শূন্যের দিকে তুলে রয়েছে। মুখে চোখে সর্বত্র পেয়ারা পাতা আর ডাল। মালাদি কেবলই সাবধান করছে। দেখিস ভাই, ছাড়িস না ভাই।
মনের মতো পেয়ালাওলা ডালটা অনেক কষ্টে নাগালে এল। সেই ডালটা অনেক দূরের ডাল, তবু আমরা ধরে ফেলেছি। বাকি ডালগুলো ছেড়ে দিতেই টিনের চালে বিকট একটা শব্দ করে নিজেদের জায়গায় ফিরে গেল। যাবার আগে দারুণ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মুখে—চোখে মাথায় ডাল পাতার ঘষা দিয়ে গেল। পেয়ারা পাতার গন্ধ ভারি সুন্দর। মনে হল সন্ধে আসছে, আকাশে বাদুড় উড়ছে, ঝোপে ঝোপে, লাল সাদা, ছিটছিট কেষ্ট কলি ফুল আসছে।
মালাদি তাড়া লাগাল—তোরা কোনো কম্মের নোস, ঠিক করে ধর। চটপট ছিঁড়ে নিই।
ডালটা ভীষণ টানাটানি করছে যে মালাদি।
ধরে থাক। ও তো পালাবার তালেই আছে। ধর টেনে।
বেশ কিছু ফুলকচি পেয়ারা আমরা শিকার করেছি। মালাদি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে বলল—নে ছেড়ে দে। যেই না ডালটা ছেড়েছি সেটা বিদ্যুৎবেগে প্রচণ্ড একটা শব্দ করে টিনের চালের ভেতর দিকে লেগে তার সমস্ত সঙ্গী—সাথি নিয়ে যথাস্থানে ফিরে গেল। আমরা শব্দ শুনে ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেলেছিলুম। ভেবেছিলুম চালটাই বোধহয় উড়ে গেছে। না সে—রকম কিছু হয়নি। তবে সেই প্রকাণ্ড হনুমান লাফিয়ে পড়ার মতো শব্দ শুনে জ্যাঠাইমা দৌড়ে এলেন।
—একী অত্যাচার অ্যাঁ, এই কচি কচি পেয়ারাগুলো তোরা পাড়লি কেন? দাঁড়া ঠাকুরপো আসুক, সব বলে দোব। গদাই একবার তুই দোতলা থেকে পড়ে মাথাটা তাল তোবড়া করেছিস, এখনও শিক্ষা হল না!
জ্যাঠাইমার তিরস্কার শেষ হতে—না—হতেই, বস্তিবাড়ির সেই মোটামতো মহিলাটি খোলা দাওয়ায় বেরিয়ে চিৎকার করে উঠল—কোন মুখপোড়া রে, টিনের চালটা ভাঙছে? মহিলা ভেবেছে শব্দটা তার চালে হয়েছে। জ্যাঠাইমা সঙ্গে সঙ্গে কাঠের রেলিং দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললেন—বাঁজা মেয়েছেলের মুখ দেখ! টিনের চাল কি এ—তল্লাটে তোমার একলার আছে? আমাদেরও আছে। সারাবছর পেয়ারা পেড়ে পেড়ে ফাঁক করে দিলে, তেড়ে এসেছে ঝগড়া করতে।
বাঁজা শব্দটার মানে জানি না, কিন্তু জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো কাজ হল। মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেল। এই মহিলা সেদিন দুপুরে বিনা কারণে আমাকে ভীষণ লজ্জা দিয়েছিল। খোলা দাওয়ায় বসেছিল হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে আর ওর স্বামী একটা দিকের কাপড় একেবারে সরিয়ে দিয়ে উরুতের ঘামাচি মেরে দিচ্ছিল আধশোয়া হয়ে। আমি ওসব দেখিওনি, দেখতেও যাইনি। ডুমুর গাছে পেছন ফুটো একটা কলসি বেঁধে রেখেছিলাম পাখি বাসা করবে বলে, দোয়েলের আনাগোনা শুরু হয়েছে। খুব শিস দিচ্ছিল। দেখতে গিয়েছিলাম বাচ্চা হয়েছে কি না। মহিলা বেশ শোনা যায় এমন গলায় বলল—ছোঁড়াটার এই বয়েসেই পিপুল পেকেছে। চট করে সরে এসেছিলুম। কথাটা বড়োদের কাউকে বলিনি।
মহিলাকে ঠান্ডা করে জ্যাঠাইমার মেজাজটাও যেন একটু সদয় হল। আমাদের বললেন—বেশ করছিস। সবক—টা পেড়ে নিলেই পারতিস। ওই মাগিটার জন্যে একটাও পাকা পেয়ারা খাবার উপায় নেই।
মালাদি বললে—খাবে মাইমা?
—ধুর ওই কোষো পেয়ারা মানুষে খায়? এখনও অতটা দুর্ভিক্ষ হয়নি রে!
—না—না আচার করব তো!
—এর আবার আচার কী রে, বাঁকুড়ার পেতনি!
—দেখই না, একদিন খেয়ে। কীরকম ঝাল খাবি বিল্টু?
—তুমি যেরকম দেবে।
—তাহলে একটু ঝাল—ঝালই করি।
বারান্দায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে শেষ বেলায় পেয়ারার আচার দারুণ জমল। গদাইদা খেতে খেতে বললে—তুই এটা বেশ ভালোই করিস বটেক।
জিভটা যেন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। পাতাগুলো বাগানে ফেলে দেওয়া হল। উড়ে উড়ে লাট খেতে খেতে এক—একটা জায়গায় পড়ল। মালাদি বললে, আয় এবার জিভ বের করে বারান্দা দিয়ে বাগানের দিকে মুখ নীচু করে দাঁড়াই, যত নাল পড়বে তত ঝাল কেটে যাবে।
ওদিকে সূর্য ডুবেছে, ঘরে ঘরে শাঁখ বাজছে, এদিকে আমরা তিনজন কুকুরের মতো জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ, নাক, জিভ সব দিক দিয়ে টপটপ করে জল বেরুচ্ছে। একসময় মালাদি বললে—নে, সব জিভ তুলে নে। আমরা যেন জিভের কাপড় জল ঝরার জন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিলুম। যার যার জিভ তার তার মুখে পুরে নিয়ে শুরু হল রাত্রির প্রস্তুতি।
মালাদি বললে—সবই হল, একটুর জন্যে জিনিসটা তেমন হল না।
গদাইদা বললে—কী রে দিদি?
—একটু কলাপাতা। কচি কলাপাতায় রেখে এসব জিনিস খেতে হয়। ঠিক আছে। আর একদিন আমরা কলাপাতায় খাব।
মেয়েরা সব মেয়েমহলে চলে গেল। উনুনে আগুন পড়েছে। ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছ থেকে রান্নাঘর, এই হল মেয়েমহলের সীমানা। বাবা বাড়ি ফিরলে সীমানা আরও ছোটো হয়ে, শুধু রান্নাঘরটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
অন্ধকার ক্রমশই গ্রাস করতে আসছে। নীচটা একেবারেই অচেনা লাগছে। কুয়োতলা, শ্যাওলা—ধরা উঠোন। উঠানমুখো সিঁড়িঘর। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত স্যাঁৎসেঁতে অন্ধকার গলিপথ। দু—পাশে সারি সারি বন্ধ ঘর। ভাঙাচোরা মালপত্রে ঠাসা। আরশোলা, ইঁদুর, ছুঁচো, বড়ো বড়ো বিছে, সাপও আছে। মাঝে মাঝে ওপরে বেড়াতে আসে। রাতের বেলায় রান্নাঘরের একপাশের দেওয়ালটা তো আরশোলায় লাল হয়ে থাকে। আর আছে অশরীরী প্রেতাত্মা। বামুনদি তো প্রায়ই দেখতে পেত। এই দক্ষিণের ঘরেই সে বহুবার জ্যাঠামশাইকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখেছে। মাকে দেখেছে, ছাদের আলসের ধারে চুল এলো করে দাঁড়িয়ে থাকতে। রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমাকে দেখেছে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে।
সন্ধে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বাড়িটা যেন কেমন। ভয় ভয় অন্ধকার অন্ধকার। একটা আলো জ্বলছে ওই মাথায় উত্তর মহলের মেয়ে পাড়ার রান্নাঘরে। আর একটা জ্বলছে দক্ষিণের ঘরে, ছাত্রমহলে। মেঝেতে মাদুর পেতে আমি আর গদাইদা মুখোমুখি বসেছি। মাঝখানে হ্যারিকেনটা জ্বলছে। কন্ট্রোলে লাল তেল দিয়েছে। শিখাটা ময়লা। গদাইদাকে কায়দা করে উত্তরদিকটায় বসিয়েছি। পেছনেই খোলা জানালা, বারান্দা, বাগান, ঝুপসি গাছপালা। কোনো বাধা নেই। বসলেই পিঠের দিকটা কেমন সুড়সুড় করে। আমার পেছনদিকে দেওয়াল। একটা বই ঠাসা বহুকালের আলমারি। পাশেই বড়ো জানালা। জানালার ওপাশ দিয়ে সদরের অন্ধকার সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে, জনমানবশূন্য একতলায়। এই সিঁড়িটাও ভয়ের। যে—কেউ চুপি চুপি উঠে এসে জানলায় চোখ রেখে দাঁড়াতে পারে। ভূত হলে লম্বা হাত বের করে আলোর পলতেটা কমিয়ে দিতে পারে।
গদাইদার সঙ্গে চুক্তিই হয়েছে। পড়তে পড়তে সে নজর রাখবে আমার পেছনদিকটায়, আমি নজর রাখব ওর পেছনদিকটায়। গদাইদা আমার ট্রানস্লেশন বইটা নিয়ে দুলে দুলে মুখস্থ করছে। আমি করছি গ্রামার। রাত দশটার সময় বাবাকে পড়া দিতে হবে। ডিমিনিউটিভস, বড়ো বড়ো নাউনকে ছোটো করার কায়দা। মিত্তিরদের বাড়ির বিশাল দুলালকাকাকে ছোটো করতে হলে একটি এট লাগাও। আইলেট, দুলালেট ডিমিনিউটিভস আর ফর্মড টু এক্সপ্রেস দি আইডিয়া অফ এনডিয়ারমেন্ট অর কন্টেম্পট দে আর অলসো অ্যাপ্লায়েড টু দি ইয়ং অফ লিভিং বিইংস অ্যান্ড টু থিংস বিলো দি অ্যাভারেজ সাইজ। এবার বাবার তৈরি করে দেওয়া সেই শ্লোকটায় কী কী লাগিয়ে করতে হবে; এই, ইকিন কিন ওয়াই, ইয়ে ইস্ক, এট, লেট, ইউলি, ক্লি, কিউল, লিং, অর্ক।
যা হয়, বই খুললেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। মাথাটা প্রথমে সামনের দিকে ঝুলে যায়। লেখা ঝাপসা হতে থাকে একই বাক্য বারেবারে বলতে বলতে যেটা হতে থাকে ক্রমশ, শেষে একটা শব্দই ঘুম জড়ানো জিভে জপের মন্ত্র হয়ে ওঠে—লেট ইউল ক্লি, কিউল, ইউল, কিউল কিউল ঢুলে বাঁদিকে পড়ে যাবার মতো হল। আবার গোড়া থেকে এন ইকিন কিন। সামনে মাথা নামছে বেশ বুঝতে পারছি, নিজেকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। ক্লি কিউল ইউল কিউল ডানদিকে পড়ে যাবার মতো হল। আবার সোজা হয়ে এল ইকিন কিন…
উলটোদিকে গদাইদা গুম হয়ে বসে আছে। একটু আগেই বারেবারে পড়ছিল—ইজ অ্যাম আর—এর পর ভার্বে আই এন জি। ঘুম জড়ানো লাল চোখে একবার তাকিয়ে দেখলুম। আলোর ছায়ায় গুম গম্ভীর মুখ। চোখ দুটো বোজানো। কিছু ভাবছে বোধহয়। মনোযোগী পড়ুয়া, পড়ছে আর ভাবছে। কালকেই বাবা গদাইদার খুব প্রশংসা করেছেন। চৌবাচ্ছার যে—অঙ্কটা আমি কিছুতেই পারছিলুম না, গদাইদা খাতা ধরেই করে দিয়েছিল। একটা নল দিয়ে জল ঢুকে ছ—ঘণ্টায় পূর্ণ করে, আর একটি নল দিয়ে জল বেরিয়ে সাত ঘণ্টায় খালি করে। দুটো নলই একসঙ্গে খোলা থাকলে কখন পূর্ণ হবে? এরকম বেয়াড়া চৌবাচ্চা অঙ্ক বইয়েতেই থাকে। আমাদের নীচের চৌবাচ্চাটার একটাই নল। জল বেরিয়ে যাবার ছোট্ট একটা ছ্যাঁদা আছে। সেটা বন্ধই থাকে। বাবা বলেছিলেন, পড়াতে হলে এইসব ছেলেদেরই পড়ানো উচিত। তোমার পেছনে শুধু ভস্মে ঘি ঢালা। সেই থেকে গদাইদার ডাঁটটা একটু যেন বেড়ে গেছে। আজ রাতে সেই হতচ্ছাড়া শামুকটা আসবে যার কাজই হল একটা বাঁশ বেয়ে রাতের বেলা ওপর দিকে ওঠা আর দিনের বেলায় নীচে নামা। সেই ওঠানামার খেলা দেখে হিসেব করে বল, তিনি কখন টঙে চড়ে বসবেন। আর আছে সেই মারাত্মক ঘড়ি যার একটা কাঁটা খুলে পড়ে যাবে আর একটিমাত্র কাঁটা ঘুরতে থাকবে, সেই দেখে বল ক—টা বাজল?
লেট ইউল ক্লি কিউল। বাকিটা আর বলতে হল না। গুম। গদাইদা সটান পেছনদিকে উলটে পড়ল। পা দুটো ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে হ্যারিকেনটাকে মাদুরের ওপর চিৎপাত করে দিল। ভাগ্যিস মুখটা ডানদিকে সরানো ছিল! আলোটা বাঁদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুলে বসাতে বসাতেই তিন—চারবার দপদপ করে আয়ু শেষ। আমার গ্রামার বইটা ছিটকে চলে গেছে। ঘোর অন্ধকার। গদাই ঘুমোচ্ছিল, না ভূতে উলটে ফেলে দিল বুঝতে না—পেরে, উঠে পালাতেও না—পেরে, রামনাম জপতে লাগলুম। জবরদস্ত শব্দ হয়েছে।
কী হল রে, কী হল রে বলে প্রথমে ছুটে এলেন পিসিমা, পেছনে নাক ফোঁস ফোঁস করতে করতে জ্যাঠাইমা। বারো মাস সর্দি যেন লেগেই আছে। কিছু ভেবে না—পেয়ে আমি বললুম গদাইদার ভর হয়েছে।
—সে কী! মালা আলো নিয়ে আয়, আলোটা নিয়ে আয়, এই ছেলেটাই আমাকে মারবে রে! পিসিমার আর্তনাদ, মালাদি আলোটা এনেই চিত—হয়ে—থাকা ভাইকে দেখে বললে—এ কাকাবাবুর কাজ বটেক। বাণ মেরে দিয়েছে।
জ্যাঠাইমা ধমকে উঠলেন—তোর ছাগলীর বুদ্ধি। তোর কাকাবাবু রইল বাঁকুড়ায়, সেখান থেকে বাণ মেরে দিল এত লোক থাকতে তোর ভাইকে, হাসব না কাঁদব?
—তুমি জানো না মাইমা, ওই মড়াটা সব পারে বটেক। আসার সময় বলেছিল, শত্তুরের শেষ রাখতে নাই, ছেলেকে দিয়ে বিষয়ের ভাগ নেবে।
—রাখ তো তোর কাকাবাবু। দাঁড়া ডেকে দেখি, গদাই, ও গদাই।
গদাইদা সাড়া দেবার আগেই প্রভাতকাকার গলা পাওয়া গেল সিঁড়িতে। কলকাতা থেকে ফিরছেন। মুখে গান—অন্ধকারে অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে। দু—হাতে দুটো প্যাকেট। ঘরে ঢুকে বললেন—কী হয়েছে ছোড়দি?
—সর্বনাশ হয়ে গেছে প্রভাত। গদাইকে বাণ মেরেছে।
—কে মেরেছে? বাণটা কই বটেক।
—এ—বাণ, সে—বাণ নয়, মন্তরের বাণ।
—তাই নাকি? কই দেখি? তাহলে তো আমাকে বাণ ঝাড়তে হবে।
প্রভাতকাকার হাতে একটা বড়ো টর্চও ছিল। গদাইদার মুখে জোর আলো ফেললেন। ও, এ তো দেখছি নেশা করেছে!
—কী নেশা প্রভাত?
—চণ্ডু, চরস, গাঁজা, বিড়ি, সিগারেট। দেখছেন না মুখটা কীরকম কালো হয়ে আছে।
জ্যাঠাইমা সঙ্গে সঙ্গে বললেন—কী যে বলো প্রভাত ঠাকুরপো, বংশটাই তো কালোর বংশ। রং ছিল আমাদের বংশে। পিসিমা খেপে গিয়ে বললেন—নেশা! আমি ওকে ঝাঁটা পেটা করব। পিসিমার কথা শেষ হতে—না—হতেই, গদাইদা যেভাবে সোজা উলটে পড়েছিল, ঠিক সেইভাবে সোজা উঠে বসে দুলে দুলে বলতে লাগল—জিরান্ড, জিরান্ড। ভার্বে আই এন জি যোগ করিয়া পার্টিসিপ্যাল ও জিরান্ড হয়, জিরান্ড হয়।
প্রভাতকাকা বললেন—সকলে সরে যান, সরে যান। ওর ওপর নেসফিল্ড সাহেব ভর করেছেন। কোনো ভয় নেই।
—সে কী প্রভাত! পিসিমা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
—সে এক পণ্ডিত সাহেব। যিনি ভর করলে অনিদ্রার রোগীরও নিদ্রা আসে।
ওদিকে অন্ধকার রান্নাঘরে বাবু চিৎকার করছে—ও মা, আলো আন, আরশোলা উড়ছে।
ছেলের গলা শুনে জ্যাঠাইমা হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন—ওঃ, ঘুমের ছিরি দেখ। সবই কী অদ্ভুত! আমাদের পড়ার আলোটা তখনও নিভে আছে। ঘোর ঘন অন্ধকার। প্রভাতকাকা ডাকলেন—গদাই, ওরে গদাই।
—আজ্ঞে প্রভাতমামা।
—উঠে দাঁড়াতে পারবি? গদাইদা উঠে দাঁড়াল। —যা আলোটা রান্নাঘর থেকে জ্বেলে আন। আলো এল। প্রভাতকাকা প্যাকেট খুলে একটা গেঞ্জি বের করলেন, ঘি—রঙের গোল গলা হাফহাতা। নে তোর গেঞ্জি। পরে দেখ। গদাইদার শরীরটা অনেকটা কঙ্কালের মতো। প্রভাতকাকা বললেন—হাড়ের এগজিবিশন হলে তুই ফার্স্ট প্রাইজ পাবি গদাই। তোর পাঁজরায় সা—রে—গা—মা—পা—ধা—নি—সা খেলছে রে। গদাইদা লজ্জায় তাড়াতাড়ি গেঞ্জিটা পরে ফেলল। বুকের দিকে যেমন চওড়া, ঝুলের দিকে তেমনই ছোটো। দু—পাশের দুটো পুট কনুইয়ের ওপরে এসে থেমেছে। হাত দুটো লট পট করছে।
প্রভাতকাকা বললেন—বাঃ, বেশ হয়েছে। গদাইদা খুব খুশি—হ্যাঁ মামা, বেশ হয়েছে বটেক।
মালাদি বললে—ধুর, এটা প্রভাতমামার গেঞ্জি। দেখছিস না, বুকটা কত বড়ো? প্রভাতকাকা বললেন—এটা হল ফ্যামিলির গেঞ্জি। বাবুর হবে, ছোড়দার হবে, ছোড়দির হবে, তোর হবে, আমার হবে, সকলের হবে। সেই কায়দায় কেনা। দেখছিস না ঝুলটা ছোটো, বুকটা বড়ো। একে বলে ফ্যামিলি সাইজ। ছোড়দি একবার পরে দেখুন তো?
—না প্রভাত, মেয়েছেলে কি গেঞ্জি পরে?
—খুব পরে। ব্লাউজের বদলে পরবেন।
পিসিমা পালাচ্ছিলেন। প্রভাতকাকা ধর—ধর করে টেনে নিয়ে এলেন। পরতেই হবে। পালাচ্ছেন কোথায়?
গেঞ্জি—পরা পিসিমা আর দেখা হল না। সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। গবার হামানদিস্তের ঠকঠক শব্দ শুরু হবার আগেই বাবা আজ এসে পড়েছেন। কদাচিৎ এইরকম হয়ে থাকে। হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে প্রায় একলাফে সিঁড়ির কাছে। হাত বাড়িয়ে ঝোলা ব্যাগ আর ছাতাটা নিতে নিতে আমাদের রোজকার কুশল বিনিময়—বাবা কেমন আছেন? ভালো আছি। তুই কেমন? ভালো। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। ঝড়ের পূর্বাভাস। পা থেকে ফিনফিনে একপর্দা ধুলো মাখা, কালো ঝকঝকে নিউকাট খুলে ডান পায়ের দুটো আঙুল দিয়ে একসঙ্গে দুটো পাটিকে ধরে সশব্দে র্যাকে রাখলেন। পাশ থেকে একপাটি চটি কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। গ্রাহ্য করলেন না। ঘরে ঢুকবেন। দরজার সামনেই প্রভাতকাকা। তখনও সাজপোশাক ছাড়েননি। বাবা বললেন, প্রভাত যে। তুমিও ফিরলে? প্রভাতকাকা বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। বাবা অন্ধকার ঘরের চৌকাঠ ডিঙোতে ডিঙোতে বললেন—আজও ভুলেছ? আজ্ঞে না। সব পেয়েছ? আজ্ঞে হ্যাঁ। কাঁচি? পেয়েছি। মুখটা সরু? সরু। অ্যালুমিনিয়ামের চিরুনি? পেয়েছি। লোহার তেপায়া? পেয়েছি। চামড়া? পেয়েছি। কাঁচা না পাকা? পাকা। গুড, নাও জামাকাপড় ছাড়ো, না বেরোবে আবার? প্রভাতকাকা উত্তরে ফরর করে কাপড়ের কোঁচাটা খুলে বুঝিয়ে দিলেন, বেরোবেন না।
বাবার সেই এক বেশ। লাল গামছা ও গেঞ্জি। পইতেটা অল্প একটু বেরিয়ে আছে। চওড়া বুকে কোঁচকানো কোঁচকানো চুল। চোখে রোল্ডগোল্ড চশমা। দক্ষিণের বারান্দার ফরাসি কায়দায় জানলা—ঘেঁষা টেবিলে, দক্ষিণমুখো চেয়ারে বাবা। সামনে চায়ের কাপ। ধোঁয়া উঠছে। হাতে নীল মলাটের সেই ইংরেজি বইটা। ঝোলায় ঘুরছে গত কয়েকদিন। পিরানদিল্লোর গল্প সংকলন। যেতে আসতে ট্রামে পড়েন। বাড়িতে এসে চা খেতে খেতে একটু পড়েন। শেষ চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে বই মুড়ে আসে। পাশ থেকে বেরিয়ে থাকে ট্রামের টিকিট। মার্কা। পড়তে পড়তে নিজের মনেই বলে উঠলেন, বাঃ বাঃ। কী সুন্দর, কী সুন্দর।
বাঁ—পাশের চেয়ারে সারাদিনের হোমটাস্ক নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে বসে আছি। রাত এগারোটার সময় বাবা রায় দিলেন—লেখাপড়া আমার জন্যে নয়। আমার কিছুই নেই, কমনসেন্স নেই, ইন্টেলিজেন্স নেই, অমনোযোগী, ফাঁকিবাজ। থাকার মধ্যে আছে ওপরচালাকি। যাও এখন শরীরটা ঠিক করে, খাওদাও, ফুর্তি করো। তবু পরে মোট বইতে, কী রিকশা চালাতে পারবে। মন খারাপ কোরো না। যা হবার নয় তা হবে কী করে। যাও ঝোলায় আম আছে। পিসিমাকে ভিজিয়ে দিতে বলো। খেয়েদেয়ে মজাদার করে ঘুম লাগাও বাবা, যা বুঝি সেইটাই হবে কাজের কাজ।
দক্ষিণের বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া পুব ঘেঁষা বাথরুম। বাবা স্নান করছেন। স্নানের সময় বিশেষ একটি সাবান ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করেন না। জুঁইফুলের মতো গন্ধ। স্নান করতে করতে ঠাকুরদের নাম হচ্ছে তারস্বরে প্রভু, প্রভু রাম রাঘব, রাম রাঘব, রক্ষ মাং কৃষ্ণ কেশব, কৃষ্ণ কেশব, পাহিমাং। প্রভু, প্রভু। যেই প্রভু বলে চিৎকার করছেন রাজেনবাবুর প্রায় বন্ধ দোকানের সামনে উচ্ছিষ্টের লোভে বসে—থাকা সাত—আটটা কুকুর বাড়ির দিকে মুখ তুলে কোরাসে ঘেঁউউ করে উঠেছে।
রোজই ভাবি, এটা এক ধরনের অপমান। কুকুরগুলো বাবাকে অপমান করছে। কুকুরদের তো আর শিক্ষিত করা যাবে না। তবে বাবা ঠাকুরদের নাম এমনভাবে করতে পারেন যাতে ওদের কানে না—ঢোকে। সে—কথা তো বাবাকে বলা যাবে না। বললেই ওনার স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় হয়তো বলবেন, মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না। একপাল কুকুরকে জগাই—মাধাই ভেবে বসবেন।
খাওয়া—দাওয়া শেষ করে বাবা আর প্রভাতকাকা দক্ষিণের টেবিলে বসেছেন। থানার পেটাঘড়িতে বারোটা বাজল। এ—বাড়িতে বারোটা রাত কিছুই না। চাঁদের আলোয় চারদিক ধুয়ে যাচ্ছে। কিছু দূরেই গঙ্গায় একটা স্টিমার ভিজে গলায় ভোঁ করে উঠল। ঘরে ঘরে বিছানা পড়েছে। কেলে কেলে মশারি। একটু চাঁদের আলো মেঝেতে লুটিয়ে আছে। প্রভাতকাকা ভুঁড়ির ওপর দুটো হাত ভাঁজ করে পেছনে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বাবা বসে আছেন সোজা। কারুর মুখে কোনো কথা নেই। বিশ্রামের আগের মুহূর্ত।
পিসিমা সিঁড়ি দিয়ে হ্যারিকেন হাতে নামছেন। বাবা একটু নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় চললি! —যাই ছোড়দা, দরজাটা দিয়ে আসি। —ও এখন সদর খোলা! এইবার একদিন সব যাবে। প্রভাতকাকা বললেন—কী আর নেবে! ঘরের অবস্থা দেখেছেন! চোর ঢুকলে বেরোতেও পারবে না। মশারির দড়িতে আটকে—মাটকে বসে থাকবে! বাবা কথাটা খুব পছন্দ করলেন—তা যা বলেছ। তবু সাবধানের মার নেই।
পিসিমা নীচে নেবে গেছেন। যেমন বাড়ি তেমনি তার সদর। বিশাল দরজা। বাঁদিকের ছোটো পাল্লা। ডানদিকেরটা বড়ো দু—ভাঁজ। দুটো পাল্লায় তেমন বনিবনা নেই। বন্ধ করলে বড়োটা ছোটোটার ওপর উঠে থাকে। খিলটা খোলা। দরজার মাপেই তার ওজন ও আয়তন। খিল লাগানোটাই আসল কেরামতি। যেকোনো একপাশের হুকের খিলের একটা মাথা একটু ঢুকিয়ে দু—হাতে আপ্রাণ শক্তিতে চেপে ধরে, অসম অংশটার বুকের ওপর দ্বিতীয় হুকের ওপর মাথাটা এমন কায়দায় গুঁজতে হবে, যাতে এ—মাথাটা ঝড়াস করে ঢেঁকি কলের মতো উঠে না—পড়ে। মুখ, বুক আর পা তিনটেকে বাঁচিয়ে দরজা বন্ধ করা। ঘুসি মেরে মেরে খিল নামাতে হবে। সে—শব্দও সাংঘাতিক। এই কারণে সিংহদরজা দিনে একবারই খোলা হয়, বন্ধ হয় মাঝরাতে।
হড়াস করে দরজা লাগাবার শব্দটা পাওয়া গেল। গুম গুম দু—চারটে ঘুসির শব্দও শোনা গেল। তারপরই খিল এবং পিসিমা একসঙ্গে দুজনের পতনের শব্দ। মাঝেমধ্যে খিলটা ছিটকে ওঠে বটে, আজকে খিলটা বোধহয় বাগে পেয়ে পিসিমাকে নকআউট করে দিয়েছে। অনেকদিনের চেষ্টা সফল।
বাবা চিৎকার করলেন—কীরে মরেছিস! কোনো উত্তর নেই। প্রভাতকাকার দিকে তাকিয়ে বললেন—শেষ। অপঘাতে মৃত্যু লেখা আছে বরাতে, কে ঠেকাবে। পালিয়ে এল দেওরের খাঁড়ার ভয়ে, মরল শেষে খিলের ঘায়ে। যাক মরে বেঁচেছে। চল সৎকারের ব্যবস্থা করি।
অন্ধকারে কেউ বুঝতে পারেনি। রঙে রং মিলিয়ে পিসিমা নিঃশব্দে উঠে এসেছেন। প্রভাতকাকা বললেন, ওমা এ কী, মরেননি? তা মরেননি যখন উত্তর দেননি কেন? রসিকতা হচ্ছে। হতভম্ব পিসিমার মুখে কোনো কথা নেই। সারাশরীর কাঁপছে। —কী হয়েছে ছোড়দি। কী হয়েছে বলবেন তো? লেগেছে? পিসিমা অতিকষ্টে কাঁপা—কাঁপা গলায় বললেন—ভূ ভূ ভূ ভূত। বাবা বললেন, কী বলছে! প্রভাতকাকা বললেন—খুব ধীরে ধীরে ভূ ভূ করছে। মনে হয় গায়ত্রী মন্ত্রটা নাভির কাছ থেকে অটোমেটিক ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। বলুন, বলুন আর একটু চেষ্টা করুন—ওঁ ভূ—ভূবঃ স্বঃ। বাবা বললেন—না না, মেয়েছেলের ওঁ হবে না প্রভাত, নমঃ হবে নমোহ। প্রভাতকাকা প্রতিবাদ করলেন গায়ত্রীর ওঁ বাদ গেলে রইল কী ছোড়দা!
বাবা কিছুক্ষণ ভাবলেন, শুনলেন পিসিমা কী বলতে চাইছেন তারপর হঠাৎ একটা হালছাড়া হাসি হেসে বললেন—আরে ধ্যার, তুমিও যেমন ও গায়ত্রীর ভূ বলছে না হে, ভূতের ভূ বলার চেষ্টা করছে। প্রভাতকাকা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ভূত দেখেছেন? ও ছোড়দি, ভূত? পিসিমা অতিকষ্টে মাথা নাড়লেন—কোথায় দেখেছেন? —নীচের ঘরে প্রভাত। —কী ভূত ছোড়দি! কিন্তু সন্ন্যাসী ভূত হতে যাবে কোন দুঃখে। নিশ্চয় ব্রহ্মদত্যি। কিন্তু ব্রহ্মদত্যি বেলগাছ ছেড়ে এখানে কেন? বাবা বললেন—ওসব ভূত—টুত নয় প্রভাত, চোর ঢুকে বসে আছে। একটু আগেই তোমাকে বলছিলুম না। সারাদিনই তো খোলা হাওদাখানা। চলো দেখি আসি। বড়ো শাবলটা নাও। হ্যারিকেনটা তো নীচেই। তবে চোর হলে এতক্ষণে পালিয়েছে।
শাবল হাতে প্রভাতকাকা নামছেন আগে আগে, পেছনে বাবা, তাঁর পেছনে আমি, আমার পেছনে গদাইদা, গদাইদার পেছনে মালাদি। যত নীচে মানছি ততই একটা ভ্যাপসা ঠান্ডা মনে হচ্ছে ওপরের দিকে উঠে আসছে। বাবা বললেন—নীচেটা এরা কী করে রেখেছে দেখেছ? এতগুলো লোক, কারুর মনেও হয় না পরিষ্কার করি।
নীচের গলিতে নেমে শাবল হাতে প্রভাতকাকা পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছেন উত্তরের শেষ গুদামঘরটার দিকে। আগেকার দিনে জমিদার হাত—পা বেঁধে প্রজাদের ফেলে রাখত। দস্যু সর্দার এইরকম ঘরেই শংকরকে আটকে রেখেছিল। বাবা হ্যারিকেনটা প্রভাতকাকার হাতে তুলে দিলেন। পিসিমা সিঁড়ির শেষ ধাপে রেখেছিলেন।
আমরা অন্ধকার সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপে রুদ্ধ নিশ্বাসে ভয়ে ভয়ে প্রাণ হাতে করে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। ঘুম পালিয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম ভূত কিংবা চোর দেখব। ঘরটার দরজার একটা পাল্লা ভেঙে কাত হয়ে পড়েছে। আর একটা খোলা। কোনো জানালা নেই। জীবনে ঝাঁট পড়ে না। পাতকো—তলা থেকে নর্দমা বয়ে গেছে এই ঘরের গা দিয়ে সোজা সদর রাস্তায়। মালকোঁচা মারা প্রভাতকাকা লাফিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
বাবা থমকে দাঁড়ালেন দরজার সামনে। শাবলের খোঁচা খেয়ে চোর বেরোলেই বাবার সঙ্গে কোলাকুলি। ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেলেছি। কই তেমন কোনো উত্তেজনাপূর্ণ কিছু ঘটছে না কেন? হলেই লাফিয়ে পড়বেন। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো পা, হাই—হিল জুতো পরে নাচলে যেরকম শব্দ হয় সেইরকম শব্দ হল, তারপরই হুড়মুড় করে কিছু পড়ার শব্দ হল। চোর যদি হয় একটা নয়, পুরো একটা ব্যাটেলিয়ান ঢুকে বসে আছে।
বাবা আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না। চাপা—গলায় জিজ্ঞেস করলেন—কী হল প্রভাত? যাব? প্রভাতকাকা ভেতর থেকে বিব্রত হয়ে বললেন—আসতে হবে না ছোড়দা। ব্যাটা কোণ নিয়েছে, ঠিক কায়দা করতে পারছি না। বাবা বললেন—শাবলটা দিয়ে লাগাও না এক ঘা। তবে দেখো, বেশি জোরে মেরো না। জাস্ট অজ্ঞান করে দাও। মরে গেলে থানা—পুলিশ হয়ে জেলে যেতে হবে। খুব সাবধানে, ওর কাছেও আর্মস থাকতে পারে। আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমরাও সব রেডি থাকো। যা পাবে তাই দিয়ে মারবে। তারপর গলাটাকে খুব চড়িয়ে বললেন—আয় বেটাচ্ছেলে। প্রভাতকাকা ভেতর থেকে আরও অসহায় গলায় বললেন—মারব কী, গুঁতোতে আসছে।
বাবা বললেন—খবরদার? সারেন্ডার। হঠাৎ হুড়মুড় করে প্রভাতকাকা আর সেই অদৃশ্য জিনিসটা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে একবারে দরজার বাইরে, আলো—টালো, শাবল—টাবল সবসুদ্ধু নিয়ে। আলোটা উলটে নিভে গেল। বাবা, বাপস বলে পাশে সরে গেলেন। আমরাও ‘বাবা রে’ বলে চিৎকার করে সকলে একসঙ্গে ওপরে উঠতে গিয়ে কেউই আর উঠতে পারলুম না, একেবারে সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে এলুম। গদাইদা আমার ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে দুম করে আরও বিপজ্জনক এলাকা—গলিপথের ওপর পড়েই বললে—মরে গেছি বটেক। এদিকে ঝড়ের বেগে খটাখট, খটাখট করে কী—একটা দৌড়ে আসছে। মালাদি আর আমি তালগোল পাকিয়ে গেছি। কে কোথায় আছি বুঝতে পারছি না, সেই অবস্থাতেই মালাদি বললে—টাট্টুঘোড়া বটেক। গদাইদা যেখানে আছে সেইখান থেকেই বললে—লাথি মেরেছে বটেক। বাবা অন্ধকার কোণ থেকে বললেন—প্রভাত এটা কী? ঘোড়সওয়ার বলে মনে হচ্ছে।
ইতিমধ্যে জিনিসটা সদর দরজায় প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা মারতেই দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল, সেই ফাঁক দিয়ে হাঁচড়—পাঁচড় করে বেরিয়ে গেল। বেরোবার সময় তার ব্যঙ্গের গলা শোনা গেল—হুঁ—হুঁ—হুঁ—হুঁ। প্রভাতকাকা ঝেড়েঝুড়ে উঠতে উঠতে বললেন—রামছাগল ছোড়দা! ভীষণ গুঁতোনে স্বভাব। আমার তলপেটে মোক্ষম ঝেড়েছে। বাবা উদবিগ্ন গলায় বললেন—চোরটা কোথায়? —আজ্ঞে ওইটাই চোর, ওইটাই ভূত। —ওটার পেছনে লাগতে গেলে কেন, শুধু শুধু? ভেবেছিলুম শিং ধরে কি দাড়ি ধরে ছোড়দির কাছে টেনে নিয়ে যাব। কার ছাগল, এল কোত্থেকে? গদাই উঠে দাঁড়িয়েছে, বললে, সুবোধের ছাগল।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বাবা বললেন, তোমাকে আমি বলে রাখছি প্রভাত, ওই ঘরে একদিন দেখবে খুন করে ডেডবডি ফেলে দিয়ে গেছে। তোরা একটু সাবধান হ শশী। ভূত—ভূত না—করে, মাঝেমধ্যে একটু—আধটু পরিষ্কার করার ব্যবস্থা কর। এই সেদিন সিঁড়ির তলা থেকে সাপ বেরোল। আমি বলে ফেলেছি ভূত আর দেখা হল না? বাবা বললেন—ভূত? ভূত আর ভগবান দেখার বরাত চাই, বুঝেছ। তার জন্যে সাধনা চাই। মহাসাধক হওয়া চাই। সে দেখেছিলেন আমার বাবা। শেষের দিকে বাবার গলাটা কীরকম ধরে এল। পুরোনো দিন আর ঠাকুরদার কথা হলেই বাবার গলার স্বর পালটে যায়। ছাত্রজীবনে ঠাকুরদা গান গাইতে গাইতে ফাঁকা মাঠে বেলগাছের তলা দিয়ে আসছিলেন, গাছ থেকে ব্রহ্মদৈত্য তারিফ করে বলেছিলেন—বাঃ বাবা, বাঃ, বেশ সুন্দর হচ্ছে! তবে বাবা যাই বলুন না কেন, ভূত আছে, এই বাড়িতেই আছে। আজ না হোক, আর একদিন দেখা যাবেই।
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই মনে হল আবহাওয়াটা পালটে গেছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। সিঁড়ির মুখেই জুতোর র্যাকের কাছে জ্যাঠাইমা। হাতে একটা এনামেলের গামলাতে খানকতক লাল রুটি, আর তার ওপর একচাকলা আম। পিসিমার মুখের সামনে পাত্রটা নেড়ে জ্যাঠাইমা কর্কশগলায় বললেন—এই আমার ব্যবস্থা? তরকারি কোথায়? শেষ সিঁড়ির ধাপটা পেরিয়ে পিসিমা এগিয়ে না—গেলে আমরা এগোতে পারছি না। সারি সারি গাড়ি আটকে গেছে। প্রভাতকাকা সব শেষে। হাতের শাবলটা অসাবধানে সিঁড়ির ধাপে লেগে সুন্দর একটা শব্দ হল—ঠ্যাং।
জ্যাঠাইমার মারমুখী ভঙ্গি দেখে পিসিমা থতোমতো। ভয়ে ভয়ে বললেন—তরকারি তো সব ফুরিয়ে গেছে মেজোবউদি, তোমার আর আমার দুজনেরই নেই। জ্যাঠাইমা বললেন—তোমার কী আছে, কী নেই আমি জানতে চাই না, আমি জানতে চাই অতটা তরকারি কী হল? বাবুর পেট খারাপ, বাবু খায়নি। তার ভাগেরটাই—বা গেল কোথায়? পিসিমা আস্তে আস্তে বললেন—ফুরিয়ে গেল যে। কী করব বলো—ফুরিয়ে গেল যে, কী করব। জ্যাঠাইমা ভেংচি কাটলেন। বাবা বললেন, সর, সর আমাদের উঠতে দে। জ্যাঠাইমা এগোলেন, আমাদের মিছিল সচল হল।
জ্যাঠাইমা বললেন—একচাকলা আম কেন? আমাদের ভাগে ওই পড়েছে যে। ভাগে ওই পড়েছে তাই না ঠাকুরঝি। তক্তাপোশের ভেতর দিকে ইটের পাশে অতগুলো চাকলা কার জন্যে লুকিয়ে রেখেছ শুনি। সকালে মাকালীর পুজো দেবে তাই না? পিসিমার মুখে কোনো কথা নেই। কোনো কথা নেই দেখে জ্যাঠাইমা আরও চেপে ধরলেন, এবার তরকারিটা কোথায় সরিয়েছ বলো। পিসিমা লাফিয়ে উঠলেন—তোমার দিব্যি মেজোবউদি, তরকারি ফুরিয়ে গেছে। —তুলে তুলে ক—বার খেয়েছ মা মেয়ে মিলে। ওটা একবারেই পেটে সরিয়েছ। ঘুরছ—ফিরছ আর মুখ চলেছে? বিধবার অত নোলা কেন?
পিসিমা কেঁদে ফেললেন, কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললেন—দেখছ ছোড়দা তোমাদের আশ্রয়ে এসে পড়েছি বলে, যা মুখে আসছে তাই বলছে। মাইরি বলছি মেজোবউদি তরকারি আমি খাইনি, আমার ছোটোমেয়েটা হাত দিয়ে একটু তুলেছিল তাও সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নিয়েছি। মিথ্যে কথা বলব না, আমি গ্রামের মানুষ, খিদেটা বেশি, তাই মাঝে মাঝে দু—চারটে আলো চালের দানা মুখে ফেলি। কথা শেষ করেই পিসিমা হু—হু করে কেঁদে উঠলেন আবার। পিসিমার কান্না দেখে মালাদিও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। জ্যাঠাইমা ব্যঙ্গের গলায় বললেন—কত ন্যাকামোই জানো ঠাকুরঝি।
বাবা ভীষণ গলায় বললেন—স্টপ, স্টপ, দ্যাট ননসেন্স? এটা বস্তিবাড়ি নয়। সশব্দে চেয়ারটাকে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। প্রভাতকাকা জ্যাঠাইমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—বউদি, ছি ছি, সামান্য খাওয়া নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করবেন না। অনেক রাত হয়েছে। জ্যাঠাইমা বললেন—থামো, তুমি হলে দু—মুখো সাপ। তুমি আর মুখ নেড়ো না। বাবা গুম গুম করে ঢুকতে ঢুকতে বললেন—ওদের সঙ্গে একটা কথা বলবে না। আমি ব্যবস্থা করছি। আমার জুতোয় পেরেক তুমি কী করবে প্রভাত। আমাকেই ঠুকতে হবে। যতটা বেগে বাবা ঘরে ঢুকতে চেয়েছিলেন, ততটা বেগে ঢোকা সম্ভব হল না। মশারির দড়িটা মুখে লাগল। এক টান মেরে দড়িটা ছিঁড়ে ফেললেন। মশারির একটা দিক ঝুলে পড়ল। জ্যাঠাইমা চিপটেন কাটা গলায় বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার ব্যবস্থা আমার জানা আছে। থাকার মধ্যে তিনটে জিনিস আছে, হোমিয়োপ্যাথিক বাক্স, নিজের ক্যাশবাক্স আর নিজের ছেলে। এখুনি এক ডোজ ব্রায়োনিয়া থার্টি ঝেড়ে দিয়ে বলবে, ওই তো মিষ্টি দিয়েছি, বউদি খেয়ে নাও। নিজের ভোগের শেষ নেই, যত ত্যাগের পরামর্শ আমাদের জন্যে।
বাবা পটাপট মশারির দড়ি ছিঁড়ছেন একের পর এক। যেতে চাইছেন উত্তরে। বোধহয় রান্নাঘরে। ওপাশের বারান্দায় পা রেখে হাঁকলেন—শশী আলো নিয়ে আয়। পিসিমা চোখ মুছতে মুছতে আলোটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। জ্যাঠাইমা বললেন—ওসব রাগ আমি বিয়ে হওয়া তক দেখছি? এ তোমার মেজদা পাওনি যে ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকবে? আমি মুকুজ্যে বাড়ির মেয়ে। এই রইল তোমাদের কুকুরখানা। সবই যখন খেয়েছ এটাও খেতে পারবে। থালাটা ঠকাস করে টেবিলে নামিয়ে দিয়ে, নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিলেন।
মরেছে। উত্তরের ওই দরজা দিয়েই দক্ষিণের একটু বাতাস অন্ধকার ঘরে আসে। পিসিমারা অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকেন। দরজাটা বন্ধ করে জ্যাঠাইমা সামান্য হাওয়াটাও কেড়ে নিলেন। বাবা এসে গেছেন। হাতে তক্তাপোশের তলায় লুকিয়ে রাখা সেই আমের থালা। কোথায় গেলেন তিনি? প্রভাতকাকা বললেন—ঘরে ঢুকে খিল দিয়েছেন। বাবাকে একটু শান্ত করার জন্যে যোগ করলেন—ছোড়দা ছেড়ে দিন। ওসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আপনি নাই—বা মাথা ঘামালেন? বাবা অন্ধকার ঘরের চৌকাঠ ডিঙোতে ডিঙোতে বললেন—আমরা নিউটন নই, শেকসপিয়রও নই, বশিষ্ঠও নই, বরাহও নই। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারই আমাদের জীবন।
পিসিমাদের জন্যে এখনও বিছানা করা হয়নি। লাল ঠান্ডা মেঝেতে কয়েকটা তেলের দাগ ধরা বালিশ। সবচেয়ে ছোটো বালিশটা বাবার শটে ফুটবল হয়ে গেল। জ্যাঠাইমার বন্ধ ঘর থেকে মিহি সুরে গান ভেসে আসছে—পার করো হে, গৌর হরি। দুম দুম করে বাবা দরজায় কিল মারলেন। দরজার পাশ থেকে খড়খড় করে কী—একটা সরে গেল। গান বন্ধ হল না। আবার কিল, এবার জোরে জোরে। ভেতর থেকে মন্থর গলায় জ্যাঠাইমা বললেন—কী হয়েচে? বাবা গলা বিকৃত করে বললেন—এই যে তোমার আম। ব্রায়োনিয়া নয়, আম। মালদার ফজলি। রাতটা এই দিয়েই চালাও। কাল সকাল থেকে রাজভোগের ব্যবস্থা হবে। বাপ—বেটা আর সোহাগের বোনকে নিয়ে বসে বসে খাও। আমার জন্যে ভাবতে হবে না। আমার গৌর আছেন।
বাবা একটু থমকে গেলেন। এতকাল বিনীত সব মানুষদের চালিয়ে এসেছেন। বিদ্রোহ দমন করতে হয়নি কখনো। বাবার ভেতর থেকে ডায়ার বেরোবে কী ওয়াটসন বেরোবে। গোলমালে বাবু উঠে পড়েছে। গত তিন দিন ছেলেটা পেটের অসুখে খুব ভুগছে—গবার ডালবড়া, প্রভাতকাকার ফুলুরি, জ্যাঠাইমার আবিষ্কার—ভুসির বড়া আর তেলাকুচো শাকের ঘ্যাঁট সব একসঙ্গে বেরোচ্ছে। বাবার হোমিয়োপ্যাথিই চলছে। বাবু ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল—কী হয়েছে মা। কাকাবাবু ডাকছেন কেন মা? দরজাটা খুলে দাও না।
ছেলের কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দিলেন না। বরং গানের সুরটাকে আরও তীক্ষ্ন করলেন—গৌর আমার প্রাণ রে। বাবা প্রায়—অন্ধকার ঘর থেকে চিৎকার করে উঠলেন—প্রভাত শাবলটা নিয়ে এসো তো। দরজা ভেঙে ফেলব। কথায়—কথায় দরজা বন্ধ। কথায়—কথায় রাগ। এটা যেন গোঁসা—ঘর হয়েছে। কতবড়ো জমিদারের মেয়ে আমি দেখতে চাই।
ভেতরে গানের সুর আরও উদাত্ত—ওরে নিমাই আমার মাতা হাতি।
বাবা দরজাটায় গোটা দুই লাথি মেরে বললেন, খুলবে না ভাঙব? জ্যাঠাইমা উত্তরে বললেন—ওরে নিতাই আমার খেপা হাতি, মাতা হাতি, মাতা হাতি, খেপা হাতি। এতক্ষণ শুধু গান ছিল এখন শুরু হয়েছে চুটুস—চুটুস হাততালি। প্রভাত ভাঙো, দরজা ভেঙে ফ্যালো।
এগিয়ে গিয়ে বাবার হাত ধরলুম। সেই প্রথম আবিষ্কার—মানুষের রাগত চোখও অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। অন্ধকারে একটা আকৃতির অনুভূতি, গরম নিশ্বাস। মুখের একটা অংশ, খাড়া নাকের মাথাটা দেখতে পাচ্ছি। বাবার হাত কাঁপছে। ভীষণ রাগে ছটফট করছেন। পড়াতে পড়াতে রেগে যান, সে একরকম। তখন মনে হয় না, বাবা ছোটো হয়ে গেছেন। মনে হয় না কোনো অন্যায় করছেন। কিন্তু এইধরনের একটা নিতান্ত ছোটো ব্যাপারে মেয়েদের সঙ্গে মাঝরাতে হইহই বাবাকে যেন বাবার আসন থেকে নীচে ফেলে দিচ্ছে। কই তারকবাবু কি শশাঙ্কবাবু কি হরেনবাবুর বাড়িতে তো এইরকম ঘটনা ঘটে না।
বাবার হাতটা যেন মোটা শাবলের মতোই শক্ত। বড়ো বড়ো লোম খসখসে। হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। আমার ভয়টা হঠাৎ কেটে গেল। মনে হল, আমি যেন মুহূর্তে সমবয়সি হয়ে উঠেছি। আস্তে আস্তে কিন্তু কেটে কেটে বললুম—চলুন, বারান্দায় চলুন। অনেক রাত হয়েছে। ছেড়ে দিন ওঁকে। —ছেড়ে দেব? বলিস কী? আমাকে অপমান করেছে। —করুক অপমান। তবু আপনি চলুন। —বলছিস? —হ্যাঁ বলছি। ঠিক আছে, চল।