১৯৪২ সালে বাবা দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফটফটে চাঁদের আলোয় হাতিবাগানে জাপানি বোমা পড়া দেখলেন। জ্যাঠামশাই আমাদের নিয়ে একতলার শেলটারে নামতে নামতে বললেন, সাহস ভালো, দুঃসাহস ভালো না। মনে রেখ, পুরোনো বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে আছ।
৪৩ সালে জ্যাঠামশাই দুরারোগ্য অসুখে শয্যাশায়ী হলেন। বাবা বললেন, বেহিসেবি যৌবন কাউকে ক্ষমা করে না। ৪৪—এর পুরোটাই জ্যাঠামশাই বিছানায় পড়ে রইলেন। বাবা সংসারের হাল ধরে চতুর্দিকে দেনার বহর দেখে বললেন, ‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’। রোগীর জন্যে সকালে একগাদা মাছ, রাতে একটুকরো মাংস, প্রয়োজনীয় ওষুধ, একটু ফল, ডাক্তারের ফি, বাকি সকলের ভাতে ভাত। বাইরে যুদ্ধের বাজার, ভেতরে অসুখের বাজার।
৪৫ সালে জ্যাঠামশাই আর পারলেন না। বাবার হাত ধরে বললেন, তোর বউদি আর নাবালক ছেলেটা রইল, আমি চললুম রে। যাবার আগে কিছু ব্যাড ডেটসে তোকে জড়িয়ে রেখে গেলুম, ক্ষমা করিস। সোনাদানা যদি কিছু থেকে থাকে, বিক্রি করে শোধ করার ব্যবস্থা করিস। বাবা বললেন, শ্রাদ্ধটা নমোনিত্যং করে সারব, কিছু ভূতভোজন করাবার কোনো মানে হয় না।
৪৬ সালে দুপুরে চিঠি এল বাবার ছোটো ভগিনীপতি হঠাৎ এক্সপায়ার করেছেন। জায়গার নাম বাঁকুড়া। ভগিনীপতির ছোটো ভাই তন্ত্রসাধনা করেন ভৈরবী নিয়ে। মাঝরাতে কারণবারি পান করে কাপালিক হয়ে যান। তখন খাঁড়া হাতে রোজই একবার করে বউদিকে নরবলি দিতে চান। বুড়ো বাবা প্রতিবাদ করায়, পাঁজাকোলা করে পাতকুয়ায় ফেলে দিয়ে এসেছেন। আর তুলে আনেননি। বৃদ্ধের ডোবা—সমাধি হয়ে গেছে। ছেলে তার ওপর পঞ্চমুণ্ডির আসন বসাবে। বুক বাজিয়ে বউদিকে বলেছেন, মায়ের চ্যালা বিশু বিষয়ের জন্যে করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। জগদম্বা আসছে। সঙ্গে এক ছেলে, দুই মেয়ে। বাবা বললেন, বহুত আচ্ছা। বোঝার ওপর শাকের আঁটি। যুদ্ধের বাজারে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। সংসার এমনিই অচল। সবই ভগবানের খেলা। আরও একটু টানতে হবে। জীবনধারণের জন্যে যতটুকু দরকার তার বেশি নয়।
৪৬—এর দাঙ্গায় কাকার সাইকেলের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়ে গেল একডজন সাইকেল আর ঢাউস একটা সাইনবোর্ড। একটা সাইকেলের হাতলে বড়ো বাঁশ বেঁধে, এদিকে ছ—টা ওদিকে ছ—টা সাইকেল জুতে, সাইনবোর্ডটাকে সামনে ট্রের মতো রেখে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘ট্রিকস রাইডার’—কে হার মানিয়ে, প্রভাত কাকা এক দুপুরে সেই রাস্তা জোড়া সাইকেল ফ্রন্ট নিয়ে হাজির হলেন। পেছনে শ—দুয়েক লোক মজা দেখতে দেখতে আসছে। মালকোঁচা মারা কাপড়ের ওপর ফিনফিনে গরদের পাঞ্জাবি। সারা কলকাতায় বারোটা সাইকেল সাইনবোর্ডসহ চড়ার কোনো রেকর্ড নেই, হবেও না। সাইকেল থেকে নেমে বিনা পয়সায় দর্শকদের হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়ে কাকা বাড়িতে ঢুকলেন। বাগানের মাঝখানে সাইনবোর্ডটাকে চিত করে ফেলে, তার ওপর দাঁড়িয়ে নাচতে নাচতে হাঁকলেন, ছোড়দা এসে গেছি। আমরা দোতলার ভেতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানে চিত সাইনবোর্ডটা পড়ে ফেললুম—প্রতারা ভু ভাত জঙ্গপদ সাইকেল ওয়ার্কস।
বাবা বললেন, এক্সপেক্ট করেছিলুম, চলে এসো ওপরে।
কাকা বললেন, দিস ইজ ফর দি থার্ড টাইম। গোমেদটায় কোনো কাজ দিচ্ছে না। গয়া ইজ হোপলেস। এবার একটা নীলা চাপাতে হবে।
বাবা বললেন, কপালে না—থাকলে কিছু হয় না প্রভাত। তবে আর একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো। একলার ইনকাম, এই বাজার, এত লোক, সেকেন্ডারি একটা ইনকাম চাই, আদারওয়াইজ বুঝতেই পারছ!
ঘরের কোণ থেকে লম্বা গলা কুঁজোটা বাঁ—হাতে তুলে নিয়ে হাতখানেক উঁচু থেকে এতখানি একটা হাঁ—মুখে সের দুয়েক জল ঢেলে, ঢেউ করে বিশাল একটা ঢেকুর তুলে, কাকা বললেন—ওরে বাবারে একী গরম রে। তারপর বললেন, কোনো ভয় নেই ছোড়দা। ওই বারোটা সাইকেল আমার ক্যাপিটাল, আবার লাগাচ্ছি দেখুন না। এদিকটাও দেখছি জমে উঠেছে খুব। এখুনি বেরোচ্ছি একটা ঘরের খোঁজে?
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলুম যদি জল খাওয়াটা আর একবার রিপিট করেন। মুখটা যেন গোমুখীর হাঁ। সামনে প্রহরীর মতো দুটো দাঁত। একটা আবার ঢকঢক করে নড়ছে। অবিচ্ছিন্ন ধারায় জল ঢুকছে, যেন উলটো জাহ্নবী। প্রভাতকাকা আর জল খেলেন না। সারাঘরে ডিঙি মেরে মেরে বারকতক ঘুরলেন, মুখে একটা উফ উফ শব্দ, ওরে বাবারে, কী গরম রে বাবা। বাবা আবার অসহিষ্ণুতা পছন্দ করেন না। চশমাটা চোখ থেকে খুলে স্প্রিংয়ের খাপে ভরলেন, খট করে শব্দ হল। ফার্স্ট ওয়ার্নিং। কাকা তখনও নদের নিমাইয়ের মতো ঘুরছেন। পায়ের কাছে কোঁচা লুটোচ্ছে। বাবা বললেন, প্রভাত, গরমকালে একটু গরম হবেই। সহ্য করতে শেখ আর তা না—হলে লাটসাহেবের মতো সিমলায় গিয়ে বসে থাকো। কাকা তখন ঘর—পরিক্রমায় একটা বাঁক নিচ্ছিলেন। ফুস করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন, সোজা নীচের উঠোনে। আমরা সবাই দোতলার ব্যালকনিতে পজিশন নিলুম।
বারোটা সাইকেলের এক একটাকে চ্যাংদোলা করে নীচের মালঘরে পুরে দিলেন। বাইরে রইল নিজের সাইকেলটা। সিটের ওপর দু—বার চাপড় মারলেন। পা দুটো ফাঁক করে পঞ্চাশ ইঞ্চি ধুতির কোঁচাটা পেছনদিকে এক ঝাপটায় ছুড়ে দিয়ে, বাঁ—হাত দিয়ে পেছন থেকে ধরে নিলেন, তারপর সোজা হয়ে, দু—পা কাঁচির মতো করে ডাইনে—বাঁয়ে নেচে নেচে মালকোঁচা মারলেন। সামনের জামাটা দু—হাত দিয়ে সমান করে আমাদের দিকে তাকালেন। সারি সারি উৎসুক মুখ। ওপরের গজদন্ত দুটো দিয়ে তলার ঠোঁটটা চেপে ধরে ভীষণ একটা মুখভঙ্গি করলেন, তারপর স্যাংচু মারি খ্যাং খেলি বলে সাইকেলটাকে প্রায় ঘাড়ে তুলে, পেছল উঠোনের ওপর দিয়ে অবিশ্বাস্য কায়দায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সদ্যআগত প্রায় সমবয়সি পিসতুতো ভাই। সে—মুখটা গোবদা করে বলল—পাগল বটে। পাশে দাঁড়ানো তার দিদি, ভাইকে সংশোধন করে দিল—খ্যাপা বটেক।
জ্যাঠাইমা সেইসময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে মন্তব্য করলেন, ঠাকুরঝি, ছেলে—মেয়েগুলোকে গাঁইয়া করে রেখেছে। কাকে কী বলতে হয় তাও একবারে শেখেনি। অতবড়ো একটা লোককে খ্যাপা বলছে। ঠাকুরঝি তখন বারান্দার এক কোণে বসে ছোটো মেয়ের চুলে, দাঁড়া—ভাঙা চিরুনি লাগিয়ে জট ছাড়াচ্ছিলেন। মেয়ে মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠছিল, লাগে বটেক, লাগে বটেক। সেই অবস্থাতেই জ্যাঠাইমার মন্তব্য তার কানে গেল। মুখটা একটু গম্ভীর হল মাত্র। পালটা জবাব কিছু দিলেন না। সংসারে তাঁর স্থান তখনও ঠিক হয়নি। সবে এসেছেন। ভাসমান অবস্থা। প্রায় এক কাপড়েই চলে এসেছেন। সঙ্গে অ্যাসেট কিছু নেই। সবই লায়বিলিটিজ। বড়ো মেয়ে প্রায় বিবাহযোগ্যা। রূপ নেই, বিদ্যেও নেই। ছেলে সেভেনে পড়তে—পড়তে চলে এসেছে। ছোটোমেয়ের সবে অক্ষর পরিচয় হয়েছে। সম্পত্তির মধ্যে একটা গোলাপ ফুল মার্কা সুটকেস। সুটকেসে কী আছে তখনও অপ্রকাশিত। গোল গোল কালো হাতের একটায়, একটা চিঁড়েচ্যাপটা সোনার বালা। তাতে কতটা সোনা আছে, বাঁধা দিলে বা বেচে দিলে কত টাকা আসবে স্বর্ণকারের কষ্টিপাথরই তা বলতে পারে।
সন্ধের ঘরে তখনও আলো পড়েনি। এ—তল্লাটে একমাত্র আমাদের বাড়িতেই ইলেকট্রিক ছিল না। টাকার অভাব, উৎসাহও তেমন নেই। ভূতের বাড়িতে রাতটা যেন আরও ভূতুড়ে। ছাদে ওঠার সিঁড়ির চাতালে বসে চারটে হ্যারিকেন নিয়ে তখনও বাবার কেরামতি চলছে। সাপ্তাহিক পরিচর্যা। পলতে ট্রিমিং, চিমনি পলিশিং। পলতে নিখুঁত করে কাটা আর গোঁফ ছাঁটা দুটোই সহজ কাজ নয়। একবার করে ছাঁটছেন আর জ্বেলে দেখছেন শিখাটা ঠিক গোল হচ্ছে কি না। প্রতিবারই হয় এপাশে না হয় ওপাশে একটু করে অবাধ্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। জ্যাঠাইমা দক্ষিণের ঘরের মেঝেতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে হাতপাখা নাড়ছেন। একটা দুটো মশা গুনগুন করছে। একসময় পাখা নাড়া বন্ধ করে ফিসফিস করে আমাকে বললেন, একেবারে ছানাপোনা নিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন। বাবুর আর কী! আর একটু টানব আর একটু টানব করে পরনের কাপড়টাই প্রায় বেরিয়ে যেতে বসেছে। একে কন্ট্রোলের বাজার! উনি যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন, মা—মরা ভাইপো আর আমার বউ—মরা ভাইটাকে একটু দেখো। ওঁকে কে দেখবে বাবা! যা মেজাজ। এইবার বোন এসেছে ভালো করে দেখুক। আমি এবার মানে মানে সরে পড়ব বাবা! জ্যাঠাইমার চিরকালের বুক ধড়ফড়ের অসুখ। ক—টা কথা বলেই সেই ভর সন্ধে বেলা পাশ ফিরে শুলেন। বুকটা কেমন করছে। মাথার রগ দুটো ছিঁড়ে যাচ্ছে।
জ্যাঠাইমার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ইদানীং তেমন মধুর যাচ্ছিল না। বাবার ধারণা জ্যাঠামশাই আরও কিছুদিন জীবনটাকে টানতে পারতেন। জ্যাঠামশাইয়ের জীবনের রাশি জ্যাঠাইমা আলগা করে দিয়েছেন। জ্যাঠাইমার আবার ধারণা তিনি ‘চিটেড’ হয়েছেন। জ্যাঠাইমার বাবা কেবল বড়ো বংশটাই দেখেছিলেন। জামাইকে দেখেননি। দোজপক্ষ। কলপ লাগানো চুল উলটে দেখা উচিত ছিল, তাহলেই ধরা পড়ত ভিতরের আসল পাকা চুল। বুকটা বাজালেই ধরা পড়ত ফুসফুসের অবস্থা। পড়তি জমিদার হলেও জমিদার বংশের সুন্দরী মেয়ে। এ তো বিয়ে নয়, হাত—পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া ঝপাং করে! এদিকে জ্যাঠাইমার নাক ডাকতে শুরু করেছে ফুড়ুত ফুড়ুত। যতক্ষণ জেগে থাকেন রাগে ফোঁস ফোঁস করেন। যতক্ষণ ঘুমোন ততক্ষণ ফুড়ুত ফুড়ুত করেন। কার্য এবং কারণ দুটোই ফুড়ুত করে সরে পড়েছে। জ্যাঠাইমার বাবাও আর নেই, জ্যাঠামশাইও নেই। এখন চলেছে তলানির লড়াই। বাবা আর জ্যাঠাইমা মুখোমুখি। অভিযোগ আর পালটা অভিযোগের পর্বটা যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে।
অথচ বাবাই জোর করে জ্যাঠামশাইকে দ্বিতীয়পক্ষ গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। প্রথমে মা মারা গেলেন, তারপর গেলেন প্রথম জ্যাঠাইমা। জেনানা শূন্য পরিবারে রাঁধুনি আর ভৃত্যদের ভূতের নৃত্য। অস্পষ্ট মনে আছে দুই ভাই রোজ রাতে দিনকতক জোর সিটিং চলল। মেজো বললেন, তোমার আগে গেছে তুমি কর। ছোটো বললেন, পাগল হয়েছ? সৎমা এসে আমার একমাত্র ছেলেটাকে পর করে দিক আর কি। স্টেপ মাদার আর জেনারেলি ডেঞ্জারাস মাদার। তুমি নিঃসন্তান তুমি বরং রিস্কটা নিতে পারো। দুটো পারপাসই সার্ভ করবে। হাতও হবে হাতাও হবে।
পাশের ঘরটাই বসার ঘর। বসার ঘরে আলো এল। টেবিলের ওপর ঠক করে হ্যারিকেন রাখার শব্দ হল। ওটা আবার পড়ারও ঘর। দিকে দিকে সন্ধের শাঁখ বাজছে। আকাশের অন্ধকার জমি ক্রমশ ঘন হয়ে উঠেছে। তারার চুমকি সংখ্যায় বাড়ছে। দরজার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো এ—ঘরেও চুরি করে ঢুকেছে। এ—ঘরে স্বতন্ত্র কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। ঘুমের ঘরে থই থই অন্ধকারই ভালো। যে চার বছর জ্যাঠামশাই বেঁচে ছিলেন সেই চার বছরই জ্যাঠাইমা জেগে ছিলেন। তখন ঘরে ঘরে সেজ জ্বলত, আয়নায় আলো চমকাত, ইজিচেয়ারে বসে থাকা জ্যাঠামশাইয়ের আঙুলে সিগারেটের আগুন টিপটিপ করত। খাটের ছত্রিতে জ্যাঠাইমার লাল সিল্কের শাড়ি ভাঁজে ভাঁজে ঝুলত। ফর্সা কপালে কাচপোকার টিপ চিকচিক করত। কখনো কখনো সুরেলা গলায় গান শোনা যেত, নীল আকাশের অসীম ছেয়ে ছড়িয়ে গেছে চাঁদের আলো। কন্ট্রোলের সরু কালোপাড়, মোটা, কোরা, আধময়লা ধুতি পরে জীবন্মৃত জ্যাঠাইমা এখন অন্ধকার ঘরে কুমড়ো গড়াগড়ি।
পাঁচ বছর আগে এই জ্যাঠাইমাকেই পাকা দেখতে গিয়েছিলুম আমি। জ্যাঠামশাই আন্ডার কম্পালশন বিয়ে করছেন, ঠিক বিয়ের জন্যে নয়, আমাকে দেখাশোনা করার জন্যে। সুতরাং পছন্দের দায়িত্ব আমার। আমি আমাদের বৃদ্ধ কুলপুরোহিত আর আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড যাঁকে আমি মাস্টার জ্যাঠামশাই বলতুম, শরতের হুডখোলা গাড়ি চেপে জ্যাঠাইমাকে পাকা করতে চললুম। জ্যাঠামশাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে আমার সে কী খাতির! জ্যাঠাইমার গাঁট্টাগোট্টা ছোটোবোন আমাকে পাঁজাকোলা করে একেবারে বারমহল থেকে অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে, ঠ্যাং ভাঙা আরশোলার মতো ছেড়ে দিলেন—এই দেখ, দিদি তোর দেওরপো। ‘উড বি’ জ্যাঠাইমা তখন আবছা আলোয় সাজগোজ করছিলেন। ভেতরের জামাটা সবে পরা হয়েছে। সেই অবস্থায় একবার ঘুরে দেখলেন। গোলগোল, লম্বা—চওড়া গোলাপি চেহারা। আমাদের বাড়ির পুরুষরা সকলেই কালো কালো। জ্যাঠামশাই আবার একটু শীর্ণ, ইয়ং কোলকুঁজো। মাথার সামনে দু—পাশে টাক। জ্যাঠাইমাকে মনে হল রাজরানি। সেই বয়সে রূপের আর কী বুঝি! যতটুকু বুঝি তাইতেই আমি মুগ্ধ। এরপর জ্যাঠাইমা যখন আমাকে বুকে তুলে নিয়ে একটা হাম খেলেন তখন আমি প্রায় ঠিক করে ফেলেছি জ্যাঠাইমা মাইনাস করে মা—ই বলব। বাড়ি ফিরে এতই উচ্ছ্বাস, জ্যাঠাইমার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে একঘর লোকের সামনে এমন একটা জায়গার বর্ণনা দিলুম বাবা ছিঃ ছিঃ করে লাফিয়ে উঠলেন, যেন কৌরবের সভায় দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করে ছেড়ে দিয়েছি। জ্যাঠামশাই যুধিষ্ঠিরের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। এখন বুঝেছি মা আর জ্যাঠাইমায় কত তফাত! একমাত্র বাবার স্ত্রী—ই মা হতে পারেন। আর কেউ না।
সেই রাজরানি এখন মেথরানি হয়ে মেঝেতে কাত। হাতে ঘেয় তালপাতার পাখা। কোথায় সেই ফিরোজা রঙের সিল্কের শাড়ি! কোথায় সেই চন্দ্রচূড়, ব্রেসলেট, টিকলি। সর্ব অঙ্গ সব সময়েই জ্বলে গেল, জ্বলে গেল। রাগে না পিত্তিতে। বোধ হয় রাগে। রাগটা স্বভাবতই বাবার ওপর। বাবার দলে এতকাল কেউ ছিল না। জ্যাঠাইমা একলাই লাঠি ঘোরাচ্ছিলেন। এখন পিসিমা আসায় বাবার দল ভারী হয়েছে। একে নিঃসহায়, আশ্রিতা তার ওপর মা—র পেটের বোন। জ্যাঠাইমা শুরু থেকেই সংসারে কোণঠাসা। বাবাকে সন্তুষ্ট করা অত সহজ নয়। জ্যাঠামশাই প্রথামতো বিয়েটাই করেছিলেন। কথা ছিল, জ্যাঠাইমা হবেন সংসারের সম্পত্তি। গঙ্গার ঘাট কিংবা টাউন হলের মতো। কারুর একার দখলিস্বত্ব চলবে না। জ্যাঠামশাই কথায় কথায় বলতেন, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, ওকে করো। বাপের বাড়ি যাবে কি না তাও। পুরোনো ডিজাইনের হার ভেঙে নতুন করা হবে কি না, তাও। একদিন ভায়েদের খেতে বলবেন কি না, ও। রাতে চর্বি দিয়ে আলুর দম হবে কি না, ও। এমনকী রাতে শোবার ঘরে খিল পড়বে কি না, ও। জ্যাঠাইমা একদিন চিৎকার করে উঠলেন সবই যখন ও তুমি তাহলে ও না হয়ে ঔ হলে পারতে। আমি ও—ঘরে গিয়ে তোমাদের ‘ও’—র পদসেবা করি, আর তোমাদের শিবরাত্রির সলতে দেবরপোকে কোলে ফেলে সারারাত থাবড়াই, আয় ঘুম, যায় ঘুম। জ্যাঠামশাই হিসহিস করে উঠেছিলেন, আস্তে আস্তে, ছি—ছি নন্দিনী এসব কী কথা, দেওয়ালেরও কান আছে মাই ডিয়ার।
আমাদের বাড়ির চল্লিশ ইঞ্চি পুরু দেওয়ালেরও কান আছে। বাবার ডোমিনিয়ানে স্পাই সিস্টেম বেশি শক্তিশালী ছিল। বাবার চোখও ছিল—কম্পাউন্ড আই। কিছুই দেখছেন না যেন, অথচ সব দেখছেন এমনকী ‘ক্লেয়ারভয়’—ও বলা চলে। ভবিষ্যতেও দৃষ্টি চলত। বামুনদি আড়ি পেতে জ্যাঠাইমার সংলাপ শুনে গেল। রাতে লোহার মতো শক্ত হাতে ছোটোবাবুর সাইটিকার কোমর পাঞ্চ করতে করতে মেজোবউদির মন্তব্য শুনিয়ে দিল। বাবা দেওয়ালে ঝোলানো প্রথম বউদির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তারস্বরে তিনবার তারা, তারা, তারা বললেন, তারপর জিভে ও তালুতে জড়াজড়ি করে একরাশ অব্যয়, সাবানের বুদবুদের মতো হাওয়া ছেড়ে দিলেন, ছ্যাক, ছ্যাক। শেষে একটু সু—সু যোগ করলেন—আহা, কীসব সতী—সাবিত্রীই না ছিলে তোমরা। হায় রাম এ কী করলে, শেষটা এ কী করলে, ছো—ছো, পাশের ঘরে জ্যাঠামশাইয়ের ‘ভার্বাল পথ্য’ ভালোই হল। অম্লমধুর, ত্রিফলা জাতীয় পার্গেটিভ। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে আন্দাজ করে পাছায় চুলকুনির পাউডার ঘষতে গিয়ে এক খামচা সিঁদুর মেখে একপাশে কাত মেরে পড়ে রইলেন। জ্যাঠাইমা সারারাত হাতের তালু দিয়ে নাক ঘষে ঘষে তাঁর সেই ফেমাস আওয়াজ বের করলেন যেটা খুব সর্দিতেও করেন আবার কান্নার সময়েও করে থাকেন।
জ্যাঠাইমা সম্পর্কে বাবার সার্টিফিকেট আর পালটাল না। সাব—স্ট্যান্ডার্ড ছাপ পড়ে গেল। আগমার্কা নয়, অগামার্কা। অগামার্কা জিনিস এই দ্বিতীয় পক্ষটি। আগের দুই বউ ছিলেন হাইক্লাস। দু—জনেই ডিসটিংশন নিয়ে দেহ রেখেছেন। ইনি কিছুই পারেন না, কিছুই জানেন না। ঘন ঘন সর্দি হয়। জোরে জোরে হাঁচেন। আঁচলে নাক ঝাড়েন। আগের দু—জন মাঝে মাঝে হাঁচলেও ফিঁচ করে একটা মিঠে শব্দ হত, সাইলেন্সার লাগানো নাক ছিল। ইনি বাথরুমে ঢুকলে আর বেরোতে চান না এবং ইনভেরিয়েবলি যেকোনো একটা অন্তর্বাস ভেতরে ফেলে রেখে আসবেন। শুধু তাই নয়, ইনি ঘুম—প্রধান, রাগ—প্রধান, তমোগুণী এবং নাক ডাকে।
চরিত্র সংশোধনে জ্যাঠাইমার কোনো উৎসাহই দেখা গেল না। তিনি সার কথাটি জানতেন—স্বভাব না যায় ম’লে। ঠাকুরপোর স্বভাব ছ্যাঁদা খোঁজা। আমার স্বভাব, সে তো জানোই। তবে চলছে চলুক। ঘুমটা প্রকৃতই তাঁর হাত ধরা ছিল। ঘুম, আধকপালে আর বুক ধড়ফড় এই তিনটে জিনিস পালাক্রমে তিনি ব্রহ্মাস্ত্রের মতো ছাড়তে লাগলেন। আধকপালে হলেই ঘুম, ঘুমোলেই আধকপালে, উঠে দাঁড়ালেই বুক ধড়ফড়। শরীরটাকে শুইয়ে রাখাই ভালো। ডগ ট্রেনারের কাজ কী? ট্রেনিং দেওয়া। স্বামীর কাজ কী? স্ত্রী—র পিঠে জিন এঁটে, নাকে ফুটো করে লাগাম পরিয়ে হ্যাট ঘোড়া হ্যাট, ডাইনে চল, বাহিনে চল। তবেই না তুমি স্বামী! বাবা জ্যাঠামশাইকে বললেন, তুমি একটি ‘হেন—পেকড’। জ্যাঠামশাইয়ের শরীর তখন পোড়োবাড়ির মতো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। প্রতিবাদ করার মতোও শক্তি নেই। তিনি হয়তো বুঝতেই পেরেছিলেন হাতের তাস যেভাবেই খেলুন হারতে তাঁকে হবেই। জানতেন যে—গোরু দুধ দেয় তার চাঁট একটু সহ্য করতেই হবে। ছোটোভাইয়ের মেজাজ একটু তিরিক্ষি কিন্তু সে অবশ্যই একজন গুড অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। মুদিখানার দোকানে তাঁর আমলের হাজারখানেক টাকার মতো ধার প্রায় শোধ করে এনেছে। কয়লার দোকানের দেনা শোধ। রোজ সকালে গোয়ালার তাগাদা নেই। কড়া হাতে সংসারের স্টিয়ারিং ধরেছেন। ‘হেন—পেকড’ জ্যাঠামশাই মরে যাওয়া চোখে কিছুক্ষণ ছোটোভায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে গিয়ে দুমড়ে—মুচড়ে বিছানায় পড়লেন।
অন্ধকার ঘরে দেওয়াল আয়নাটাই কেবল চকচক করছে কোথা থেকে আলো চুরি করে। জ্যাঠামশাইয়ের শির—বের—করা কপালে হাত রাখলুম। সেই বয়েসেই এই বোধটা হয়েছিল, বাবার অপরাধ, বাবার দেওয়া দুঃখের দায়ভাগ কিছু অংশ আমারও। কপালটা বেশ গরম। আমার হাতের স্পর্শে জ্যাঠামশাই চমকে উঠেছিলেন। বাপি, তুমি! আঃ, তোমার হাতটা কী সুন্দর ঠান্ডা! ও কতদিন পরে কেউ আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিল। জ্যাঠামশাই কাত হয়ে বসে বললেন, না, তার জন্যে নয়, আমার অসুখ তো, অসুস্থ লোকের কাছে বেশি না—আসাই ভালো।
আমার যখন অসুখ করে তখন আপনি যে কত আমার সেবা করেন। এইবার শোধবোধ হয়ে যাক। জ্যাঠামশাই মৃদু হেসে বললেন—ধুর বেটা, আমি যে তোমার জ্যাঠা! কত বড়ো আমি! তোমার অসুখে আমাকে তো সেবা করতেই হবে, তা না—হলে তুলসী—চপলা আমার উপর রাগ করবে না! রাগ করে কথাই বলবে না। তুলসী আমার মা—র নাম, চপলা আমার প্রথম জ্যাঠাইমা।
—ওঁদের সঙ্গে আপনার দেখা হবে কী করে?
—আমি যখন যাব। তখন ওরা জিজ্ঞেস করবে বাপি কেমন আছে? কত বড়ো হয়েছে? মোটাসোটা হয়েছে কি না?
—আমিও যাব আপনার সঙ্গে। কতদিন দেখিনি।
—দুর বোকা যাব বললেই যাওয়া যায় না। না—ডাকলে যাবে কী করে? না, এসব কথা ভালো নয়।
—তাহলে আসুন, এক গেম ক্যারাম বোর্ড খেলি। আলোটা নিয়ে আসি ও—ঘর থেকে।
—আমি যে বসতে পারছি না বাপি।
—তাহলে একটা মজার গল্প বলবেন, সেই গল্পটা, বোয়াল মাছের।
—ওঃ হো সেইটা, তোমার মনে আছে এখনও। আমার যে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বাপি। আমি ভালো হয়ে উঠি, তোমাকে অনেক গল্প শোনাব।
—তাহলে আমি হাত বুলিয়ে দিই।
হঠাৎ জ্যাঠাইমা এসে এমন কাণ্ড করলেন যার ক্ষত আমি যতদিন বাঁচব ততদিন শুকোবে না। জ্যাঠাইমা একটা ধুনুচি হাতে ধুম্রশ্বরীর মতো ঘরে ঢুকলেন। মুখটা ধোঁয়ায় ঢাকা। মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে। জ্যাঠামশাই বললেন, একী, একী, আমার ঘরে ধুনো কেন, ঠাকুরঘরে দাও। জ্যাঠাইমা ঠক করে ধুনুচিটা এককোণে রাখলেন। সেটা আবার সোজা বসতে পারে না। নিজের ভারে একপাশে কাত হয়ে গেল। জ্বলন্ত একটুকরো ঘুঁটে অল্প একটু ফুলকি ছড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। পাখা হাতে জ্যাঠাইমা উঠে দাঁড়ালেন। ধোঁয়ায় আমাদের চোখ—গলা জ্বালা করছে, জ্যাঠামশাই একটু কেশে উঠলেন। আমি বলতে গেলুম, ধুনোটা সরিয়ে দিন জ্যাঠামশাইয়ের কষ্ট হচ্ছে।
জ্যাঠাইমা পাখা নেড়ে নিজের মুখ থেকে ধোঁয়া পরিষ্কার করছিলেন, ফোঁস করে উঠলেন—তুমি এখানে কেন, এ—ঘরে কী হচ্ছে, যাও ও—ঘরে যাও। বংশে বাতি দাওগে যাও।
মুখটা আমার কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। অভিমানটা চিরকালই আমার বেশি। বাতি দাও গে যাও কথাটা হাত নেড়ে আঙুল উঁচিয়ে এমনভাবে বললেন, অনেকটা সামনের বস্তিবাড়ির গোলাপির মতো করে। জ্যাঠামশাই বললেন, ছি—ছি নন্দিনী, তুমি একী করছ, তুমি ওর মা—র মতো। ওর কী দোষ!
—রাখ রাখ, সারাজীবন তো দরদে উথলে, এর চাকরি, ওর মেয়ের বিয়ে, ভাই, ভাইপো তাতে তোমার কী হল শুনি। তোমার প্রাণের ভাই তো টিবি, টিবি করে লম্ফঝম্ফ শুরু করেছেন। তোমার আলাদা থালা, গেলাস, বাটি। এইমাত্র ব্যবস্থা দিলেন রুগির ঘরে গোরুর গোয়ালের মতো সাঁজাল। শুধু ধুনোতে হবে না, এক পুরিয়া গন্ধকও থাকবে। সেই মানুষের ছেলে তোমার পাশে বসে। নিশ্বাসে রোগ ছড়াবে না? এখুনি বলবেন, ছেলে মারার প্ল্যান হয়েছে। যিনি নিজে চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে শুকনো দরদ দেখান, তাঁর ছেলে চৌকাঠের এদিকে। যাও, যাও, যাও।
জ্যাঠামশাইয়ের খাট থেকে নেমে এলুম। যাও যাও বলে যেন কুকুর তাড়াচ্ছেন। সেই আমি শেষ জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে ঢুকেছিলুম। আর ঢুকিনি। অভিমানে কথা বলিনি। শুধু দেখতুম দিনে দিনে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের এক আত্মীয় ডাক্তার বিনা ভিজিটে চিকিৎসা করতেন। শেষের কয়েকদিন আগে, একজন বড়ো ডাক্তার এসেছিলেন বিশাল গাড়ি চেপে। গাড়ির রং আর জুতোর রং একইরকম। ঝকঝকে বাদামি রঙের ছুঁচ—মুখো জুতো। মিনিট কুড়ি ছিলেন। গম্ভীর মুখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলেছিলেন, শেষ সময়ে বড়ো ডাক্তার ডেকে লাভ কী? আর ক—দিন?
সেইদিন থেকেই জ্যাঠাইমার কান্না শুরু হল। বাবা বললেন, বাঙালি মেয়েরা নার্সিং জানে না। কেঁদে কেঁদেই মৃত্যুটাকে এগিয়ে নিয়ে এল। ইংরেজ মেয়ে হলে দেখিয়ে দিত। একদিন সকালে ফুসফুসে হাওয়া নেবার জন্য জ্যাঠামশাই হাঁ করে বারকতক আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। বালিশ থেকে মাথাটা কয়েকবার উঠে গেল, তারপর ধপাস করে একবার পড়ে ডান পাশে কাত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের কোল বেয়ে একবিন্দু জল গড়িয়ে এল। সেইসময় ঘরে কেউ ছিল না। আমি পাশের ঘর থেকে দেখছিলুম। একটু পরেই জ্যাঠাইমা ঘরে এলেন হাতে ফিডিং কাপে লেবুর রস। এক মিনিটের জন্যে সেই রস আর জ্যাঠামশাইয়ের খাওয়া হল না। তিন মাস আগে। শেষ সেই সন্ধ্যায় বাপি বলে আমাকে ডেকেছিলেন। বিশাল বোয়ালের গল্পটা আমার আর শোনা হল না। ‘জ্যাঠামশাই’ বলে তিন মাসের অভিমান আর সব ব্যবধান ভুলে আমি যখন ঘরে লাফিয়ে পড়লুম সেই ডাকে ‘কী বাপি’ বলে সাড়া দেবার জন্যে তিনি আর নেই।
বাবা বললেন, খাট নয়, খাটিয়া। ফুলের তোড়া নয়, কিছু কুচো ফুল। অগুরুর কোনো প্রয়োজন নেই। এক প্যাকেট ধূপ স্যাংশনড। আসল যাত্রা শুরু হবে চিতা থেকে, তার আগে যেকোনো আড়ম্বরই বাড়াবাড়ি। যে বাজার তাতে বাড়াবাড়ি সাজে না। আসল দায়িত্ব পেছনে পড়ে আছে। মৃত্যুর মধ্যে কোনো গ্ল্যামার নেই। মৃত্যু হল সবচেয়ে বড়ো পরাজয়। ‘হরিবোল’ খুব চাপাস্বরে উচ্চারণ করবে মাঝে মাঝে, সারাটা পথে বার চারেকের বেশি নয়। সব যাত্রীরা প্রায় নিঃশব্দে চলে গেলেন। জ্যাঠাইমার হাতের শাঁখা ভাঙার জন্যে দুই প্রতিবেশী মহিলার মধ্যে কলহ বেধে গেল। মঞ্জুর মা বললেন, আমি সারাজীবনে অন্তত দু—ডজন শাঁখা ভেঙেছি, আমি হলুম গিয়ে ইসপার্ট। রবির মা বললেন, এক্সপার্ট উচ্চারণ করতে পারো না। ইসপার্ট বল, তুমি যে কেমন এক্সপার্ট বোঝাই গেছে, দিদিকে আমি গঙ্গার ধারে সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে যাব, তারপর মাঝারি গোছের একটা পাথর দিয়ে ফুটো করে শাঁখা ভেঙে বিধবা করে দেব। বামুনদি এই ভীষণ সমস্যার সময় আর এক সমস্যা সৃষ্টি করল, কেবলই বলতে লাগল, মেজোবাবু মরে গেছে আমি বিশ্বাসই করি না। মেজোবাবু মরতে পারে না। ডিমের কারি খাব বলেছিল। আহা গো, ডিমের কারি।
একবার এক মহাপুরুষ ঘণ্টাখানেকের জন্যে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। দাদুর গুরু। বাসস্থান হিমালয়। বছরে একবার সংসারের হালচাল দেখার জন্যে সমতলে নেমে আসেন। বড়োবাজারের তুলোপটিতে দিনকতক থেকে আবার হিমালয়ে গিয়ে ওঠেন। বেঁটেখাটো সাত্ত্বিক চেহারা। বসার ঘরে শ্বেতপাথরের টেবিলে এসে বসলেন। পেতে দেওয়া হল কম্বলের আসন। দুটো বিশাল রাজভোগের একটা থেকে একটু খুঁটে তুলে নিলেন। বাকিটা প্রসাদ। কথা খুব কম বলেন, এই আহারে শরীর থাকে কী করে?
সন্ন্যাসী বললেন, শরীরের ক্ষয় রোধ করতে পারলে আহারের কোনো প্রয়োজন হয় না। শরীরের তিনটে দ্বার বন্ধ করে দিতে পারলে, বাস কেল্লা মার দিয়া। মেটেরিয়াল ওয়ার্ল্ডের ওপর মহারাজ হোকে বৈঠ যাও। বেটা! যোগ কর্মসু কৌশলম।
এত বড়ো বড়ো রুদ্রাক্ষের মালা মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করে ন্যাকড়ার জুতো পরে সন্ন্যাসী গটগট করে চলে গেলেন। রাজভোগ দুটো শ—খানেক টুকরো হয়ে প্রায় মৌলিক পদার্থ হয়ে গেল। আমরা সেই পিঁপড়ে ভোগের আস্বাদ পেলাম।
আমার ম্যাথমেটিশিয়ান পিতৃদেব কাগজে—কলমে প্রমাণ করে দেখালেন, তুমি যদি রোজ দু—টাকার মতো খাও এবং যদি হজম করতে না—পার, তাহলে থ্রি—ফোর্থই দাস্ত হয়ে বেরিয়ে যাবে। তার মানে দেড় টাকা টাট্টিখানায় নামিয়ে দিয়ে এলে হুইচ ইজ এ কাস্টলি লস। অথচ ওয়ান—ফোর্থ খেয়ে যদি পুরোটাই হজম করতে পারো তাহলে সকালে দুটি সায়েবি গুটলে বেরোবে, কম খরচে বেশি পুষ্টি। ক্ষয়ের একটা দ্বার বন্ধ হল। দ্বিতীয় দ্বার মুখ। মুখ বন্ধ কর। কম কথা, প্রয়োজনের বেশি একটি কথা নয়। মহাত্মা গান্ধী সপ্তাহে একদিন মৌনী থাকতেন। তুলসীবাদী সম্প্রদায়ের সাধুরা মুখে প্লাস্টার লাগিয়ে ঘোরেন। জীবনস্মৃতি পড়ে দেখ শিশু রবীন্দ্রনাথের পাতে বাড়ির ঠাকুর মাত্র চারখানি লুচি, একটি একটি করে দুলিয়ে দুলিয়ে ফেলে দিতেন, অ্যান্ড নো মোর। ওই দেখ, অলেস্টারপরা রবি ঠাকুরের ছ—ফুট বিশাল চেহারা।
কীসে হয়েছে? মিতাহার, মিতবাক আর কুস্তিতে। ব্যায়াম চাই। গাদাগাদা খাব আর ওই—ঘরের মতো ভোঁস ভোঁস ঘুমোব, এ ‘লাক্সারি’ এখন আর চলবে না। ও—ঘর মানেই জ্যাঠাইমা। তৃতীয় দ্বার বন্ধ করার বয়স এখনও তোমার হয়নি। সে—দ্বার এখন বন্ধ আছে। খুলবে যৌবনে, তখন সাবধান হতে হবে।
সুতরাং ব্যায়াম। জ্যাঠাইমা শুয়েছিলেন রাস্তার দিকের দক্ষিণের ঘরে। পুবের দরজা বন্ধ। খুললেই লাগোয়া বসার ঘর। উত্তরের দরজা খোলা। উত্তরের জানালা শূন্য ঠাকুরঘর। আলো ঢোকে না বলে অন্ধকার ঘর। অন্ধকার ঘরের দিকে জ্যাঠাইমার পা। গুরুজন তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, শোবার ধরনটা বড়ো বিশ্রী। পায়ের পাতার ওপর হাঁটু দুটো দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরের ঠাকুরঘর থেকে পুবের দরজা দিয়ে বেরোলে বড়ো ঘর। ওই ঘর, আমার আর বাবার। পুবে দরজা দিয়ে বাবা দুম করে উত্তরের কাচ নামালেন। উঁচু চৌকাঠ। ডিঙোতে হয় বলে শব্দটা হল। তা ছাড়া বাবা দুমদাম একটু ভালোবাসেন। দুমের সঙ্গে গলা খাঁকারি। বাবা জানতেন, দক্ষিণের ঘরে জ্যাঠাইমা আছেন এবং সেইভাবে আছেন পা উঁচু করে। উত্তরের দরজার একটা পাটি বাবার অদৃশ্য হাতের ঠেলায় বন্ধ হল অপরটা বন্ধের জন্যে লোমশ হাতের একটা অংশ পাশ থেকে বেরিয়ে এল। দ্বিতীয় পাটিটা বন্ধ হতে আদেশটা ঘরের মধ্যে ছুড়ে দিলেন—চলে এসো—হারি আপ!
ঠাকুরঘরের এক কোণে দুটো মুগুর ঘাড় কাত করে দুই দারোয়ানের মতো দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে জড়াজড়ি করে বসে আছে। তাকের ওপরও দুটো করে ডাম্বেল ওজনে হালকা। পরপর কয়েকটা স্টিলের ট্রাঙ্ক একটার ওপর আর একটা। তার পেছনে পাঁউরুটির খালি ঠোঙার ডাঁই। বাবা বলেন, যাকে রাখো সেই রাখে। ফেলো না কিছুই সবই কাজে লাগবে। আর এক কোণে ছেঁড়া—বালিশের তুলো। একদিকের দেওয়ালে বিশাল একটা দাঁড়ানো আলনা। কুলুঙ্গিতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সিঁদুরমাখা ছবি। একটা প্রদীপ কেঁপে কেঁপে জ্বলছে।
ঘরে ঢুকেই বাবা বললেন, ছি ছি। অপরাধীর মতো মুখ করে আলনা থেকে আমার লাল ল্যাঙটটা টেনে নিলুম। বাবা ততক্ষণে দাঁতে লুঙ্গি চেপে ল্যাঙট পরতে শুরু করেছেন। পেছন দিকে চওড়া পটিটা তখন লেজের মতো দুলছে। ওটা ঘুরে সামনে চলে আসবে। লুঙ্গি পরে থাকার সুবিধে কাপড় না—ছেড়েও ল্যাঙটা পরা যায়। আমি পরে আছি প্যান্ট। বাবার দিকে পেছন করে ঠাকুরের দিকে মুখ করে প্যান্ট খুলে ফেললুম। ঈশ্বরের সামনে সহজেই অনাবৃত হওয়া যায়।
নাও, ডাম্বেল দুটো নামাও। ফিগার ওয়ান। ফিগার ওয়ান গত একমাস ধরে কিছুতেই পারফেক্ট হচ্ছে না। একটা ডাম্বেল দু—হাতে ধরে মাথার ওপরে তুলে হাঁটু না—ভেঙে নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সামনে বেন্ড হয়ে পায়ের পাতা ছুঁতে হবে। সামনে ঝুঁকলেই আমার হাঁটু দুটো ভেঙে যাচ্ছে, বোল্ড—হয়ে—যাওয়া উইকেটের মতো। হাঁটুর এই অবাধ্যতা বাবা মনে করেন আমার অবাধ্যতা। মানুষ সন্ধিপদ প্রাণী। চারিদিকেই হাড়ের জোড়। এখানে গাঁট ওখানে গাঁট। গাঁটে গাঁটে শয়তানি থাকতে পারে, কিন্তু স্বাধীন গাঁটকে নিজের ইচ্ছেতে সবসময় চালনা করা যায় না। বাবা মনে করেন অন্যরকম, হোয়্যার দেয়ার ইজ এ উইল দেয়ার ইজ এ ওয়ে। বাবা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ভাঙছে ভাঙছে। এমনভাবে ভাঙছে ভাঙছে বলে উঠলেন যেন একটা বাড়ি কি নদীর ব্রিজ ভেঙে পড়েছে। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে গেলুম। সামনেই অসন্তোষ ছেটানো বাবার দুঃখিত মুখ।
তোমার ইচ্ছেও নেই, একাগ্রতাও নেই। ইচ্ছে থাকলে কান পর্যন্ত নড়ানো যায় আর একমাস হয়ে গেল হাঁটু না—ভেঙে সামনে ঝুঁকতে পারছ না। একেবারে গয়ংগচ্ছ ভাব, ঠিক ওই ওনার মতো। শুয়ে থাকলেই যদি চলে যায় দাঁড়াবার আর দরকার কী?
দক্ষিণের ঘরের দিকে তাকিয়ে বাবা একটা দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করে জলদগম্ভীর গলায় বললেন, হায় প্রভু! আমি তখন আবার গোড়া থেকে শুরু করেছি। এবার যথেষ্ট একাগ্র। মাথার যে জায়গায় ইচ্ছে থাকে সেইখান থেকে ইচ্ছের স্রোত ভাঙা হাঁটুতে পাঠাবার চেষ্টা করছি। বাবা সামনে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন, নাও নাও আর একটু, আর একটু, ঠিক হ্যায় বহুত আচ্ছা বহুত….।
উৎসাহের আধিক্যে যেই একটু বেশি ঝুঁকেছি, হাঁটু ভাঙল না বটে, গোড়ালি দুটো উঠে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্য হারিয়ে টর্পেডোর মতো কিংবা একটা চার্জিং বুলের মতো চোঁ করে বাবার তলপেটে একটা ঢুঁস। বহুত আচ্ছার আচ্ছাটা আর বেরোল না, বহুত কোঁক হয়ে গেল। পেছন দিকে টাল খেয়ে পড়ে যেতে যেতে খুব সামলে নিলেন। আমি তখন আমার ইচ্ছেশক্তির কেরামতিতে বাবার পায়ের তলায় চতুষ্পদ জন্তুবিশেষ, হামা দিয়ে বসে আছি। ইচ্ছে তখন পড়ে যাওয়া ঘড়ির মতো বিকল, চলছে না। উঠে দাঁড়িয়ে বাবার মুখোমুখি হবার সাহস নেই।
বাবা বললেন, অপদার্থ! আর একটু হলেই আমার অ্যাবডোমেনটা ফেটে যেত। কোলনে এসে ডিরেক্ট চার্জ করেছ। নিজেও মরতে আমাকেও মারতে। সবসুদ্ধু ওই জাঙ্ক ইয়ার্ডে পড়লে আমার ডেথ ইয়ার্ড তৈরি হত।
বাবার পেছনেই ছিল সেই স্টিল ট্রাঙ্কের আড়ত। তার পেছনে রুটিন খোলের মজবুত ভাণ্ডার। উঁচিয়ে আছে দুটো প্রমাণ সাইজের শাবল, বাবার গার্ডেনিং টুলস। তার ওপর দেওয়াল—তাকে নানারকম কেমিক্যালস কেমিস্ট বাবার ল্যাবরেটারি। ওর মধ্যে আছে ছ—বোতল নানা ধরনের অ্যাসিড, পিগমেন্ট ডাইস্টাফ, গ্যালিক অ্যাসিড, ট্যানিক অ্যাসিড।
উঠে পড়ো। ফ্রন্ট বেন্ডিং তোমার কম্ম নয়। বুঝে গেছি। হয় ক্রলিং না হয় স্ট্যান্ডিং—এর মাঝে তোমার আর কোনো ইন্টারমিডিয়েট স্টেজ নেই। এসব জিনিস হল সংসারের শালগ্রাম। যার ওঠাও নেই, বসাও নেই।
ডাম্বেল হাতে উঠে দাঁড়াতেই দরজার ওপাশ থেকে কানে এল—পারেক নাই পারেক নাই, ছোটোমামাকে ঢুঁস মেরেছে বটেক? আর একটি কণ্ঠের প্রশ্ন, কী করে বটেক? আর একটি কণ্ঠ, লেগেছে বটেক? বটেকের স্রোত বইছে দরজার ওপাশে দক্ষিণে আমাদের বড়ো ঘরে। তার মানে পুবের দরজার পাশে ঘাপটি মেরে পিসতুতো ভাইবোনেরা দেখছিল। এখন নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা খোলসা করে নিচ্ছে।
বাবার ভুরুর কাছটা একটু ভাঁজ হয়ে গেল। লুঙ্গির তলার দিকের কিছু অংশ ভাঁজ করে কোমরে গোঁজা। পায়ের গোছ দেখা যাচ্ছে। দেহের অন্য অংশের তুলনায় ফর্সা। মার্কিনের লুঙ্গি গেরুয়া রঙে রং করা। আদুর গা। গলার কাছে পইতেটা হারের মতো পরেছেন। দুম দুম করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। পাল্লা দুটো ভেজানো ছিল, একটানে খুলে ফেললেন। বাইরে ঝুলন্ত শিকল তাঁর অসন্তোষকে শব্দময় করে দিল। শরীরটাকে এদিকে রেখে গলাটাকে ওদিকে বাড়িয়ে দিলেন—কী চাই তোমাদের? বটেকরা সব চুপ। কিছু চাই তোমাদের, এনিথিং ইউ ওয়ান্ট? গলাটা টেনে নিলেন—আনডিজায়রেবেল ডিস্টারবেন্স বিগিন।
শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ডিস্টারবেন্স। পিসিমার ছোটোমেয়ে প্যাঁক করে কেঁদে উঠল। চটাস চটাস চড় মারার সঙ্গে সঙ্গে প্যাঁ—টা বেশ খেলে উঠল। আর সেই সময় ঘুম জড়ানো চোখে মাতালের মতো টলতে টলতে জ্যাঠাইমা পাখা হাতে আমাদের আখড়ায় এসে ঢুকলেন। তিনি পুবের দরজার দিকে আমাদের ঘর দিয়ে আপন মনে চলছেন। যেতে যেতে বললেন, ছেলেটাকে মারছ কেন? তোমার তো মারধরের স্বভাব ছিল না। ক—টা বাজল? ক—টা হল?
বুকে হাত মুড়ে বাবা বিবেকানন্দের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। জ্যাঠাইমা পালতোলা নৌকোর মতো ভেসে ভেসে চলে গেলেন। পিসিমার ছোটো কন্যা তখন প্যাঁ ছেড়ে ভ্যাঁ—তে নেমেছে। বাবা কোণ থেকে মুগুর দুটো তুলে নিয়ে জোরে জোরে ভাঁজতে লাগলেন। একটা যখন এক হাতে মাথা উঁচিয়ে স্থির অন্যটা তখন মাথার ওপর দিয়ে একটা ফুলসার্কল করে বুকের কাছে নেমে এসে পাশে দাঁড়িয়ে পড়ছে। মুগুরের পরে পা ফাঁক করে ডন হবে, তারপর হবে লাফা বৈঠক।
দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করল। লুঙ্গির ভাঁজ খুলে স্বাভাবিক হলেন। ছোট্ট ঘরেই গোল হয়ে কয়েকবার উত্তেজিত ভীমের মতো হাঁটলেন। প্রদীপটার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মন্থর পায়ে আলনার পাশে ঝোলানো একটা ছাইরঙের কোটের পাশ পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা মোড়ক বের করলেন। ব্যায়ামের পর বাবার মেজাজটা একটু নরম হয়ে আসে। বোধ হয় জ্যাঠামশায়ের কথা মনে পড়ে। বাবার ব্যায়াম গুরু।
কতবার যে ওই গল্প শুনেছি—তখন কলেজে পড়ি, ভীষণ ডিসপেপসিয়া। জলের মতো স্টুল। দিনে কুড়ি বার পঁচিশ বার। জল পর্যন্ত হজম হচ্ছে না। চেহারাটা একেবারে স্কেলিটন। বড়দা বললেন, চলে আয়। নেমে এলুম নীচের কুস্তির আখড়ায়। পটাপট পটকে দিলেন বারকতক। তিনদিন পড়ে রইলুম বিছানায়। ফোর্থ ডে—তে আবার। শেষকালে আড়াইশো ডন, পাঁচশো বৈঠকে উঠেছিলুম। আর ওই যে সুপুরিগাছের তলায় বিশাল পাথরটা এখন মাটিতে পুঁতে আছে, ওইটা দু—ভায়ে গঙ্গা থেকে তুলে এনেছিলুম। দু—হাতে তুলতুম মাথার ওপর। ডিসপেপসিয়া ফ্লেড অ্যাওয়ে। চড় চড় করে চেহারা বেড়ে গেল। একসময় বুকের ছাতি হয়েছিল আটচল্লিশ, এক্সপ্যান্ডেড ছাপ্পান্ন। তাই তো বলি এক্সারসাইজের কী গুণ। ফলতে বাধ্য। সর্দি নেই, কাশি নেই, জ্বর নেই, শিরঃপীড়া নেই। সবসময় মনে রাখবে প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর। ডাক্তারের পেছনে, উকিলের পেছনে, ঘোড়ার পেছনে টাকা গুঁজে বহু পরিবার ফতুর হয়ে গেছে। আমাদের দশখানা বাড়ি হতে পারত, রোগের পেছনেই সব গেছে। মোড়ক খুলে বাবা বললেন, হাত পাত। হাতের তালুতে গুণে গুণে দশটা কিশমিশ, পাঁচটা কাগজি বাদাম দিলেন। বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে খাও। বাদাম যত চিবোবে তত উপকার। কষের দাঁতকে গ্রাইন্ডিং হুইলের মতো ব্যবহার করবে, অ্যাঁই অ্যাঁই করে। তবেই বাদাম থেকে হাইড্রোসিয়্যানিক অ্যাসিড বেরুবে, এ পোটেনশিয়াল মেডিসিন ফর স্টম্যাক।
ওই কৌটোটা হল বাবার ভাণ্ডার। বুক পকেটে লাউ, কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শ প্রভৃতির বীজ। ভেতরের পকেটে বোতাম, ছুঁচ, সুতো, পেরেক, স্ক্রু, পাশ পকেটে লজেন্স, কিশমিশ বাদাম। দুপুরবেলা কৌটোটার দিকে তাকিয়ে মেঝেতে চুপ করে বসে থাকি। যেন বিড়াল বসে আছে শিকের দিকে তাকিয়ে। মন তখন দুটো হয়ে যেত। একটা মন বলত, চুপ করে বসে কেন, যা হাত ঢোকা একটা লজেন্স মুখে পোর, গোটাকতক কিশমিশ দু—আঙুলে রগড়ে রগড়ে বেশ তুলতুলে করে জিভে ফেলে দে। বেড়ালতপস্বী হয়ে লাভ কী?
আর একটা মন বলত, খবরদার, হাত দিয়েছ কি রাতে মরেছ। হিসাবের কড়ি বাঘে খেলে কী হয় মালুম আছে তো? এক মাস কথা বন্ধ। ভবিষ্যতের পাওনা বন্ধ। ডোন্ট কিল দি গোল্ডেন গুজ। যা পাচ্ছ তাইতে সন্তুষ্ট থাকো। মনে নেই, তোমার শিক্ষা, ছেলেপুলে হবে ট্রেনড ডগের মতো। পাহারা দেবে, থাবা মারবে না। ফোঁস ফোঁস করে একটু শুঁকে দেখতে পারো, মালটা কী? হাতে করে না—দিলে খুলবে না। কুকুর হল ভগবান। কী সেলফ কন্ট্রোল, যেমন ফেথফুল অবজারভ্যান্ট তেমনি তার আন্ডারস্ট্যাডিং। এইটুকু বেচাল পাবে না কখনো। অবশ্য মানুষের পক্ষে কুকুর হওয়া সম্ভব নয়। শয়তানের আপেল খাওয়া মাল, শয়তানিটা যাবে কোথায়? প্রমাণ করে দেখিয়ে দাও, তুমি একটা বাচ্চা ‘গ্রেট ডেন।’ মানুষ হবার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে ট্রেনিং—এর গুণে একটি বিশ্বস্ত বিলিতি ধরনের নেড়ি।
দুটো মনে শেষকালে একটা আপস হত। কী দরকার বাপু, ছেলেটাকে বিপদে ফেলে। লজেন্সও মিষ্টি, হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধও মিষ্টি। অতএব হোমিয়োপ্যাথিক গুলিই খাওয়া যাক। এক একটি শিশিতে অজস্র গুলি। বাবার বাক্সে এ থেকে জেড পর্যন্ত যত ওষুধ আছে তার থেকে চারটে করে গুলি নিলে কেউ ধরতে পারবে না। মিষ্টি মিষ্টি ঝাঁজ ঝাঁজ। ‘অ্যালো’ নাম লেখা শিশিটার ওষুধ গলে জমে গেছে, দেশলাই কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খানিকটা বের করে নিলেই হবে। সারাদুপুর খাই খাই। ঘোরাফেরা অ্যাকোনাইট, ব্রায়োনিয়া, সিনা, চায়না, ইপিকাক, থুজা মিলিয়ে মিশিয়ে খেয়ে যাও। মিল্ক সুগার খেয়ো না, ধরা পড়ে মরবে।
ক—টা বাজল? ক—টা বাজল? করতে করতে জ্যাঠাইমা বোধহয় উত্তরের বারান্দা পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। যখন দেখলেন কেউই কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না, কারণ বাড়িতে কোনো দেওয়াল ঘড়ি নেই, থাকার মধ্যে আছে, জ্যাঠামশায়ের একটা সোনার রিস্টওয়াচ আর বাবার একটা রুপোর পকেট ওয়াচ, দুটোই বাবার হেফাজতে, তখন বোধহয় রাতের আকাশ দেখে, বাতাসের উত্তাপ দেখে, সময় আন্দাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। কাজটা কঠিন। তখন তাঁর মনে হল, আর একটু ঘুমিয়ে নিই। রাত্রি কোন প্রহরে আছে বোঝা না—গেলেও ভোরের সূর্য সময় বলবেই। অতএব সংশয়ের কালটা নিদ্রাকেই উৎসর্গ করে দিই। নিদ্রারূপেণ জ্যাঠাইমা এখন রান্নাঘরের সামনে পুবের বারান্দায় চিৎপাত। অন্ধকারে তাঁর সাদা কাপড় আর ফর্সা মুখের কিছুটা ভূত দেখার মতো দেখা যাচ্ছে। একপাশের দেওয়ালে গোটাকতক আরশোলা রাত্রিকালীন স্ফূর্তি উপভোগ করছে। পাশেই বাগানের ঝাঁকড়া গাছ, মাঝে মাঝে হাওয়ায় দুলে উঠছে। মনে হচ্ছে বেশ শান্তির সংসার—আমার তিন পিসতুতো ভাইবোন খাবার ঘরের জানলায় বসে বটেক বটেক করছে। পিসিমা জল রাখার বিশাল জালাটায় হাত বুলোচ্ছেন আর মাঝে মাঝে শরীরের এখানে—ওখানে চাঁটা মেরে মশা তাড়াচ্ছেন। একটা আলো মিটমিট করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে জগৎ যেন হঠাৎ থেমে গেছে। কিংবা মাঝরাতের খুদে স্টেশন। যাত্রীরা বসে আছে শেষরাতের ট্রেনের জন্যে।
স্লেট মোছা ন্যাকড়া ভেজাবার জন্যে বাড়ির ওই ভূতুড়ে দিকটায় গিয়েছিলুম। ব্যায়াম হয়েছে, নিউট্রিশন হয়েছে, স্তোত্রপাঠে চিত্তশুদ্ধি হয়েছে, এইবার হবে গর্দভ থেকে মনুষ্য হবার পেটাপিটি। রবিবার হলেও পড়ার ছুটি নেই। ন্যাকড়া ভেজানো হয়ে গেছে। নিমগাছে জোনাকির আলো জ্বালানোর কসরত দেখছিলুম। বাবা এলেন সেই ঘুমের স্টেশনে, লন্ঠন দোলাতে দোলাতে, স্টেশন মাস্টারের মতো। প্ল্যাটফর্মের একপাশে এটা কী? আলোটা ফেললেন, ও তুমি? জ্যাঠাইমাকে দেখে নিলেন। খাবারঘরের দিকে আলো ছুড়লেন, জালার পাশে পিসিমা ও বটেকরা সব চুপ। পিসিমার ছোটোমেয়ে হাত—পা ছড়িয়ে চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। প্রহারের পরে ক্রন্দন, ক্রন্দনের পর নিদ্রা। নিয়মের রাস্তাতেই গেছে।
ঠক করে লন্ঠনটা রান্নাঘরে রেখে, দরজার কোণ থেকে বাবা প্রাইমাস স্টোভটা টেনে নিলেন। কখন যে কী করতে হয় সে—ট্রেনিংটা বাবা আমার মধ্যে বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন। যেমন চা খেয়ে খালি কাপ টেবিলে রাখলেই সরিয়ে নিতে হয়। গা থেকে জামা খুললেই হ্যাঙার এগিয়ে দিতে হয়। বর্ষায়, ভিজে ছাতা আনলেই খুলে মেলে দিতে হয়। মেঝেতে ছাতাটা রেখে হাতল ধরে শিকের ওপর দিয়ে ভটঅ, ভটঅ করে ঘুরিয়ে একটু মজা করতে হয় এবং বকুনি খেতে হয়। খোলা বই দেখলে মুড়ে দিতে হয়। স্টোভ টানলেই স্পিরিটের শিশি এগিয়ে দিতে হয়।
স্পিরিটের শিশিটা বাবার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। বার্নারের কার্নিশে একটু স্পিরিট ঢেলে দিলেন। এইবার চাই দেশলাই। নিদ্রিত উনুনের ঝিঁকের ভেতরে দেশলাই থাকা উচিত। সেখানে নেই। পাশে শালপাতা আর ঠোঙার জঙ্গলে নেই। কয়লার গাদায় নেই। স্পিরিটটা সব উড়ে গেল। বাবা বললেন, দিস ইজ বেঙ্গলি। অত সহজ নয়, যেখানকার জিনিস সেখানে রাখব। যখনকার কাজ তখন করব।
এই সময়টা বাবার চা খাবার সময়। চা জ্যাঠাইমার করার কথা। ইদানীং তাঁর কথায় আর কাজে মিল থাকছে না। বাবার পলিসি হল, নো ডিম্যান্ড। নো রিকোয়েস্ট। করলে করলে, না—করবে, না—করবে। সেলফ হেলপ। কিন্তু বাবা প্রথমেই আটকে গেছেন। স্টোভে অগ্নিসংযোগই করা যাচ্ছে না। আসল জায়গাতেই সেলফ হেলপ আটকে গেছে। বেশ বিপর্যস্ত অবস্থা। প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি। জালার পাশ থেকে পিসিমা উঠে এসে বললেন, কী খুঁজছ ছোড়দা?
স্টোভ ধরাবার জন্যে কী খোঁজে লোকে। পিসিমা যেন পরীক্ষার পড়া দিচ্ছেন। চটপট সুর করে বললেন—শলাই।
শলাই নয় শশী, শলাই নয়, দেশলাই।
পিসিমা বীরবিক্রমে ঠোঙার গাদার মধ্যে হাত চালিয়ে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে একটা আরশোলা ফরর করে উড়ে এল। আরশোলার ভয়ে আমি একটু নৃত্য করে ফেললাম। নৃত্যের বৃত্তটা একটু বড়ো হয়ে গিয়েছিল। চপল চরণপাতে স্পিরিটের শিশিটা শুয়ে পড়ল। ভাগ্যিস ছিপি আঁটা ছিল। ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো বাবা লাফিয়ে উঠলেন—মাফ করো রাজা। চায়ের দরকার নেই। ওহে, আরশোলা তোমাকে মারতে পারবে না। পৃথিবীর কাউকে মারেনি। মারবে আগুন। পাশেই হ্যারিকেন। স্পিরিটের শিশিটা ভাঙলেই সবক—টা আজ পুড়ে মরতুম।
দরজার পাশে বড়ো পিসতুতো বোন ভাইকে জিজ্ঞেস করল, কী বটেক?
ভাই বললে—আঁশুললা বটেক।
বাবা বললেন—চুপ বটেক।
বাবা বললেন—ঝ্যাঁটা পেটা করব বটেক।
জ্যাঠাইমা উঠে বসে বিড় বিড় করে বললেন, ভোর তো এখন হয়নি। এত আগে সব উঠল কেন?
আজ মহালয়া নাকি?
পিসিমা বললেন, শলাই কোথায় মেজোবউদি?
জ্যাঠাইমা আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন, ভালোই তো ভালোই তো, ভাইবোনে সলাপরামর্শ কর। আমার কী, আমার কী!
আমার পিসতুতো ভাই হঠাৎ বললে, শলাই বটেক ছোটোমামা?
বাবা বললেন, হ্যাঁরে গদাই।
গদাই অমনি ধাঁ করে ঘরে নিভু নিভু হ্যারিকেনের মাথা থেকে দেশলাইটা এনে মামার হাতে দিল। হাসি হাসি মুখ, কলম্বাস যেন আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে, ফ্যারাডে যেন বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছে। দেশলাইটা হাতে নিয়েই বাবা বললেন, গরম কেন? কোথায় ছিল?
আমি বললুম, ওই হ্যারিকেনটার মাথায়।
হ্যারিকেনের মাথায় দেশলাই। কার এই গোরুর বুদ্ধি! মরার ইচ্ছে হয়েছে।
দিদির বটেক।
বড়ো বোন চ্যাট করে ভায়ের মাথায় চাঁটা মেরে বললে, দুর মাথা ফাটা, মিথ্যেবাদী।
ভাই বললে, হাঁদি।
বাবা স্টোভের কাছে উবু হয়ে বসে বললেন, শশী এদের একটু সিভিলাইজ করতে হবে। কালকেই করে দেব ছোড়দা তা না—হলে ও—উকুন মরবে না। কত ধরব আর মারব বটেক।
স্পিরিটের নীলশিখায় বাবার গম্ভীর মুখ। বার্নারে আগুন ধরেছে। সাঁ—সাঁ আওয়াজ উঠছে।
পিসিমা কেটলি ধুয়ে জল মেপে এনেছেন। বাবা চাপাবার আগে কেটলিটা একবার আপাদমস্তক পরীক্ষা করে নিলেন। খুব সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন বলে মনে হল না। তবু চাপিয়ে দিলেন। কয়েকবার পাম্প করে তেজটা একটু বাড়িয়ে দিলেন।
চায়ের কৌটো আর কনডেন্সড মিল্কের কৌটোটা সহজেই গেল পাওয়া, গেল না চিনির শিশি। বাবা হলেন পারফেকশনের ভক্ত, চায়ের পাতা জলে পাঁচ মিনিট ভিজবে তো পাঁচ মিনিটই ভিজবে। বগলে থার্মোমিটার তিরিশ সেকেন্ড রাখতে হবে তো তিরিশ সেকেন্ডই থাকবে, চা ভিজছে। বাবা পিসিমাকে বললেন, একবার জিজ্ঞেস কর। শেষ হার্ডলে চা—পর্ব বুঝি আটকে যায়। পিসিমা এগিয়ে গেলেন, মেজোবউদি ও মেজোবউদি।
জ্যাঠাইমা ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, দরজাটা খুলে দাও না।
পিসিমা বললেন, দরজা খোলাই আছে, ছোড়দার চা হবে চিনির শিশি কোথায়? চিনির শিশি?
জ্যাঠাইমা ধড়মড় করে উঠে বসেই হাতের তালু দিয়ে নাকটা বারকতক ঘষে বীভৎস একটা আওয়াজ বের করলেন। বাবা বললেন, পালিয়ে আয়, পালিয়ে আয়। চিনি ছাড়াই চা হবে। জ্যাঠাইমা ততক্ষণ স্থান—কাল—পাত্রের জগতে ফিরে এসেছেন। উঠে দাঁড়াতেও পেরেছেন। ইদানীং বেশভূষার দিকে তাঁর নজর থাকে না। গায়ে ব্লাউজ নেই। পরনের কাপড়টাও ময়লা। স্নানও বোধহয় রোজ করেন না। জল সহ্য হয় না।
জ্যাঠাইমা বাবার কাছাকাছি এসে বললেন, সরো সরো খুব হয়েছে।
বাবা সরার পাত্র নন। বাবা বললেন, না না, তুমি বিশ্রাম করো, ঘুমোও। ঘুমিয়ে মোক্ষলাভ করো।
তুমি তো সবসময় আমাকে ঘুমোতেই দেখছ।
আচ্ছা আচ্ছা ঘুমোওনি, ঘুমোওনি।
চা তো ভেজালে তোমার চিনি কোথায়?
জ্যাঠাইমা এইবার চিনির প্যাঁচ মারলেন।
সে—এ—কী! বাবা প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, এর মধ্যে চিনি শেষ।
আধসের চিনি তোমার ক—দিন চলবে? চায়ের যা ধুম।
আমার হিসেবে আছে বউদি। আধ সেরে ক—চামচ হয় আমার মাপ আছে। তোমরা সংসার করছ জানো না, আমি কিন্তু জানি। পার কাপ একচামচ লাগলে কত কাপ চা হয়?
কবে চিনি এসেছে ডেট দিয়ে আমার খাতায় লেখা আছে।
তোমার হিসেব তুমি করো, তোমার চামচে মাপের জীবনে এখন বোন এসে গেছেন। যত পারো হিসেব করো আমি হিসেবের বাইরে । জন্ম পর্যন্ত এইভাবে সংসার করিনি, করতেও পারব না।
বহুত আচ্ছা এই তো চাই, এইটাই শুনতে চেয়েছিলুম স্পষ্টাস্পষ্টি।
ধাঁ করে উঠে দাঁড়ালেন, আমরা সবাই থমকে দাঁড়িয়ে আছি। নেক্সট মুভটা কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। ঠিক সেই সময় প্রভাতকাকা সামনে এসে দাঁড়ালেন, হাতে ঝুলছে দড়িবাঁধা বিশাল একটা হাঁড়ি। মিষ্টির হাঁড়ি। প্রভাতকাকা বললেন, আমি প্রবলেম সলভ করে দিচ্ছি। আমার হাতেই রয়েছে চিনি। ক্ষীরমোহনের রস এক চামচে দিয়ে দিন তো দিদি।
পিসিমা হাঁড়িটা নেবার জন্যে হাত বাড়িয়েছিলেন। বাবা রুদ্রমূর্তিতে বললেন, খবরদার। বোম ফাটলে যেমন বাতাসের ধাক্কা লাগে, আমরা সবক—টা প্রাণী খবরদারের ধাক্কায় স্থাণুর মতো হয়ে গেলাম। পিসিমার হাত ফিরে গেল। প্রভাতকাকার হাঁড়ি হাতেই রইল।
বাবা এইবার খবরদারটাকে অ্যামপ্লিফাই করলেন, তোমার বিলাসী জীবন, তোমার ক্ষীরমোহন চাই, রাবড়ি চাই, ঘি চাই, মাখন চাই, দুধ চাই, দই চাই। আমরা কষ্টের পরীক্ষা দিচ্ছি, আমাদের সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দাও। আমাদের অভ্যেসটাকে আর খারাপ করে দিয়ো না। প্লিজ প্রভাত, প্লিজ। বাবার মুখটা কুঁচকে মুচকে কীরকম বিশ্রী হয়ে গেল।
জ্যাঠাইমা বললেন, প্রভাত ঠাকুরপো অনেক কষ্ট করেছি আর কষ্টমষ্ট করতে পারব না বাপু, হাঁড়িটা আমাকে দাও। কেউ না—খাক, আমি কয়েকটা খেয়ে দেখি।
বাবা পিসিমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, তুই পারবি না শশী আমাদের সঙ্গে কষ্ট করতে, পারবি না বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ করতে, পারবি না, লোভলালসা ত্যাগ করে ভবিষ্যতের জন্যে তৈরি হতে?
খুব পারব ছোড়দা, সেইখানে একবেলা জুটত, এখানে তো তবু দু—বেলা জুটছে।
এই তো চাই, একেই বলে স্পিরিট, একেই বলে স্যাক্রিফাইস, আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
দাও ঠাকুরপো হাঁড়িটা দাও।
জ্যাঠাইমা লোভের হাত বাড়লেন। প্রভাতকাকা কিন্তু হাঁড়িটা দিলেন না। তাঁর মুখ দেখে মনেই হল না—কোনো কথাই গায়ে মেখেছেন। জ্যাঠাইমা প্রায় হাঁড়ি স্পর্শ করে ফেলেছেন। প্রভাতকাকা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন স্যাংচুমারি খ্যাং খেলি, গোয়িং টু পাতাল গুটু।
চোখের পলক ফেলতে—না—ফেলতে প্রভাতকাকা হাত বাড়িয়ে হাঁড়িটা নীচের উঠোনে ফেলে দিলেন। আমি চোখ বুজিয়ে ফেললাম, ভটাস করে একটা শব্দ হলে। আমার পিসতুতো ভাই গদাই, ফেলে দিলে বটেক, বলে, স্টোভ—ফোভ, কেটলি—ফেটলি টপকে দৌড়ে বারান্দার দিকে আসছিল, প্রভাতকাকা একটা পা সামনে একটা পা পেছনে রেখে বুকটা চিতিয়ে বললেন, খবরদার। না—বুঝে, এনেছি মিষ্টি, দিয়েছি ফেলে নীচে, স্যাংচুমারি রে, লক্কা লাখ ফাক্কা ফাঁক, চিচিং ফাঁক।
একটা পায়ের ওপর ভর দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় প্রভাতকাকা ফরর করে ঘুরে গেলেন। লম্বা কোঁচা লটপট করে পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। ভ্রূক্ষেপ নেই। সেই অবস্থাতেই, ওরে বাবা কী গরম, ওরে বাবা, ওরে বাবা বলতে বলতে ডিঙি মেরে বড়ো ঘরের দিকে চলে গেলেন।
জ্যাঠাইমা জিজ্ঞেস করলেন, ক—টাকার ছিল প্রভাত?
বেশি না, দশ টাকার।
তখনকার দিনে দশ টাকার মিষ্টি মানে অনেক মিষ্টি। জ্যাঠাইমা প্রায় আঁতকে উঠলেন, তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছিস কী? আলোটা নিয়ে নীচে দৌড়ো, যে ক—টা পারিস তুলে নিয়ে আয়। ওদের মাথা খারাপ বলে আমরা তো আর পাগল নই, চল আমিও যাচ্ছি।
গদাই বললে, মাইমা মণ্ডা বটেক?
হ্যাঁরে, হলদে হলদে বড়ো বড়ো মণ্ডা।
গদাই প্রায় ছুটছিল। বাবা বললেন, ছি ছি, এটা কি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, নর্দমা থেকে মিষ্টি তুলে খেতে হবে। যে খায় খাক, গদাই তুমি খাবে না, উৎপাতের ধন চিৎপাতে গেছে, বেশ হয়েছে।
গদাই কিছুটা মনমরা হয়ে খাবার ঘরের দরজায় চৌকাঠে থেবড়ে বসে পড়ল। জ্যাঠাইমার দলে কেউ নেই। বাবা সংখ্যাগরিষ্ঠের বলে বলীয়ান। জ্যাঠাইমা তবু হারলেন না। তাঁর তখন রোখ চেপে গেছে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোরা তোদের অন্নদাতার ধামা ধরে থাক, আমি কারুর পরোয়া করি না, আমি একাই যাব, একাই তুলব, একাই খাব।
বাবা বিকৃত গলায় বললেন, যাও না, যাও না কে তোমাকে আটকাচ্ছে। পিশাচসিদ্ধের পক্ষে সবই সম্ভব।
মাসে একদিন চান, যেখানে—সেখানে পড়ে ঘুমোনো। নিগার্ডলি উওম্যান।
বাবা খড় খড় করে চলে যচ্ছিলেন। জ্যাঠাইমা সুর করে বললেন, ও আমি এখন পিশাচ? একসময় একেই তো অপ্সরী বলে তুলে এনেছিলে আধবুড়ো ভায়ের বঁড়শি ফেলে। বাবা ঠিকই বলতেন, মুকুটি কুটিল ভারি, বন্দ্যো কাটি সাদা। সবার মাঝে বসে আছে চট্টো হারামজাদা, ওরে বাব্বা চট্টো হারামজাদা।
শেষের লাইনটা জ্যাঠাইমা গানের মতো সুর করে বারেবারে রিপিট করলেন। বাবার অপমানিত, রাগত, গম্ভীর মুখে কোনো কথা নেই। বাবার অপমান যেন নিজেরও অপমান। জ্যাঠাইমা যে কতটা নিষ্ঠুর তা জানতুম, কতটা অসভ্য সেইদিনই বুঝলুম। পাতলা নাক, পাতলা ঠোঁট, পাতলা চোখের দৃষ্টিতে তাঁর নিষ্ঠুরতা ধরা আছে। নিষ্ঠুরতার দুটো ঘটনা আজও মনে আছে। মনে থাকবে চিরকাল। জ্যাঠামশায়ের অসুখের সময় জিয়োল মাছ এসেছে। ডাক্তার বলেছেন, স্টু করে দিতে। জ্যাঠাইমার কায়দা শুরু হল। মাছটাকে মেঝেতে ফেলে এক খাবলা নুন দিয়ে দিলেন। মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল। মুখ দিয়ে খানিকটা লালা মতো বেরিয়ে গেল। জ্যাঠাইমা তখন বঁটি দিয়ে দাঁড়া বা শুঁড়গুলো কেটে ফেললেন। সেগুলো মাটিতে পড়ে থিরথির করে কাঁপতে লাগল। মাছটার পেট থেকে বুক পর্যন্ত যন্ত্রণার একটা ঢেউ খেলে গেল। মুখ দিয়ে চিঁ চিঁ করে শব্দ উঠল। সেই প্রথম দেখলুম মাছের মৃত্যুর আর্তনাদ। জ্যাঠাইমা নির্বিকার। পেট চিরে পিত্তি—টিত্তি ফেলে দিলেন। মাছটা তখনও সম্পূর্ণ মরেনি। উঁচু বাড়ির ছাদে শেষবেলার রোদ লেগে থাকার মতো তার গায়ে জীবন তখন লেগে ছিল। গরম তেলে আস্ত মাছটাকে যখন ফেললেন সেটা কিলকিল করে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল। মাছটাকে ফের কড়ায় ফেলে খুন্তি চেপে ধরে রইলেন যতক্ষণ না জীবনের শেষ নির্যাসটুকু তেলে মিশে গেল।