1 of 2

মূর্তি

মূর্তি

পাহাড়ের ছায়াকে আরও কালো করে রাত্রি ঘনিয়ে এল।

আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে একদল যাত্রী এগিয়ে চলেছে। গরম পোশাকে সকলের আপাদমস্তক মোড়া, কারণ কনকনে ঠান্ডা বাতাস হু-হু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে।

একে ঘন কুয়াশা, তার উপরে আবার রাতের অন্ধকার। তবু তারই ভিতরে কোনোরকমে চোখ চালিয়ে দূরের সরাইখানার মিটমিটে আলো দেখে পথিকদের ক্লান্ত-শীতার্ত মন খুশি হয়ে উঠল।

খানিক পরেই সকলে সরাইখানার দরজার সামনে এসে হাজির হল।

যার সরাই সে বেরিয়ে এল। পথিকদের কথা শুনে বললে, ‘বড়োই মুশকিলের কথা! আমার সরাইয়ের সব ঘরই যে আজ ভরতি হয়ে গেছে!… তবে হ্যাঁ, আপনারা যদি আমার ঢেঁকিশালায় শুয়ে আজকের রাতটা কাটাতে রাজি হন, তাহলে আমি সে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’

পথিকরা পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখলে। হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কোনো উপায় তো নেই! এই রাতে এই শীতে এই আঁধারে, বাইরের জনমানবশূন্য মাঠ বা জঙ্গলের চেয়ে সরাইয়ের ঢেঁকিশালাও ঢের ভালো।

সরাইয়ের কর্তা তাদের সকলকে নিয়ে ঢেঁকিশালায় গিয়ে ঢুকল। মস্ত ঘর— একদিকে একখানা বড়ো পর্দা ঝুলছে।

সকলে মিলে খেয়ে-দেয়ে হাসি আমোদ করে যে যার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

যাত্রীদের ভিতরে একজন ছিল, তার নাম ওয়াংফো।

সঙ্গীদের বিষম নাক-ডাকুনি ও ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুরের হুটোপুটি ওয়াংফোর চোখ থেকে আজ ঘুম কেড়ে নিলে।

নাচার হয়ে শেষটা সে উঠে বসল। লণ্ঠন জ্বেলে একখানা বই বার করে পড়াশোনায় আজকের রাতটা সে কাটিয়ে দেবে বলে স্থির করলে। কিন্তু পড়াতেও তার মন বসল না। নিশুত রাত, বাইরের গাছপালার ভিতরে বাতাসও যেন নিবিড় অন্ধকারে ভয় পেয়ে স্তব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে আছে।

অত বড়ো ঘরে ওয়াংফোর ছোট্ট লণ্ঠনটা টিমটিম করে জ্বলছে। সে যেন তার আলো দিয়ে অন্ধকারকেই আরও ভালো করে দেখাতে চায়!

ক্রমে ওয়াংফোর গা যেন ছমছম করতে লাগল! তার মনে হল, ঘরের ওদিককার অন্ধকারে কী-একটা ভীষণ আকার ধারণ করবার চেষ্টা করছে! অন্ধকার যেন পাক খাচ্ছে! ধড়ফড় করে নড়ছে।

হঠাৎ ওয়াংফোর আবার মনে হল, পর্দার পিছনে যেন কাঠের কী-একটা মড়মড় করে ভেঙে গেল! তারপরেই পর্দাখানা একটু দুলে উঠল! তারপরেই আবার সব নিসাড়!

এসব কী কাণ্ড! ওয়াংফো আর বই পড়বার চেষ্টা করলে না। আড়ষ্ট হয়ে পর্দার পানে চেয়ে রইল, খালি চেয়েই রইল— তার চোখে আর পলক পড়ল না।

পর্দাখানা আস্তে-আস্তে একটু উপরে উঠল এবং তার পাশ থেকে বেরিয়ে এল একখানা রক্তহীন হলদে হাত! তারপর কী যেন ছায়ার মতো একটা কিছু বাইরে এসে দাঁড়াল— সে যেন বাতাস-দিয়ে-গড়া কোনো মূর্তি!

ওয়াংফোর গায়ে তখন কাঁটা দিয়েছে, মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে! সে চ্যাঁচাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু পারলে না। কিন্তু তার হয়ে বাইরে থেকে একটা প্যাঁচা চ্যাঁ-চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে রাতের আঁধারকে চিরে যেন ফ্যালাফ্যালা করে দিলে।

ধীরে ধীরে সেই বাতাস-দিয়ে-গড়া মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল! ওয়াংফো তখন দেখলে, পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা স্ত্রীলোকের মূর্তি!

মূর্তিটা ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে।

যাত্রীরা পাশাপাশি শুয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। কে যে এখন তাদের ক্ষুধিত দৃষ্টি দিয়ে দেখছে, সেটা তারা টেরও পেলে না।

মূর্তি পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। তারপর একজন যাত্রীর মুখের কাছে হেঁট হয়ে পড়ে কী যে করলে, তা কিছুই বোঝা গেল না।

মূর্তি দ্বিতীয় যাত্রীর কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলছে এবং মুখখানা এক ভয়ানক হাসিতে ভরা!

মূর্তি আবার হেঁট হয়ে পড়ল এবং দ্বিতীয় যাত্রীর টুঁটি কামড়ে ধরল।

ওয়াংফো আর পারলে না, বিকট চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল এবং তিরবেগে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।

পথ দিয়ে ওয়াংফো চিৎকারের পর চিৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল। তার সেই কান-ফাটানো চ্যাঁচানির চোটে গাঁয়ের ঘরে ঘরে সকলকার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু এ রাতে বাইরে এসে কেউ যে তাকে সাহায্য করবে, গাঁয়ের ভিতরে এমন সাহসী লোক কেউ ছিল না।

ছুটতে ছুটতে এবং চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ওয়াংফো একেবারে গাঁয়ের শেষে গিয়ে পড়ল। তারপরেই মাঠ আর জঙ্গল।

দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সে একবার পিছন ফিরে চাইলে। দূরের গাঢ় অন্ধকারে ফুঁড়ে দুটো জ্বলজ্বলে আগুনের ভাঁটা বেগে এগিয়ে আসছে, ক্রমেই তার দিকে এগিয়ে আসছে!

ওয়াংফো আর একবার খুব জোরে আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গেল।

চীনদেশে নিয়ম আছে, কেউ মরলে পর ভালো দিনক্ষণ না-দেখে তার দেহকে কবর দেওয়া হয় না।

গাঁয়ের মোড়লের এক মেয়ে মারা পড়েছিল। কিন্তু ভালো দিনক্ষণের অপেক্ষায় তার দেহকে কফিনে পুরে সরাইখানার ঢেঁকিশালে রাখা হয়েছিল। আজ ছ-মাসের ভিতরে ভালো দিন পাওয়া যায়নি।

সরাইখানার কর্তা সকালে উঠে যাত্রীদের খোঁজে ঢেঁকিশালায় গিয়ে দেখে, দু-জন যাত্রী মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। তাদের গলায় এক-একটা গর্ত, তাদের দেহে এক ফোঁটা রক্ত নেই!

পর্দা তুলে সভয়ে সে দেখলে, যে-কফিনে গাঁয়ের মোড়লের মেয়ের মড়া ছিল, তার তালা খোলা, তার ভিতরে মড়া নেই!

তারপর গোলমাল শুনে গাঁয়ের প্রান্তে গিয়ে সে দেখলে, ওয়াংফোর মৃতদেহের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে— মোড়লের মেয়ের মড়া! ওয়াংফোর গলায় একটা গর্ত আর মড়ার মুখে লেগে আছে চাপ চাপ রক্ত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *