মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় (রচনা ১৯৭২-৭২। প্রকাশ ১৯৭৪)
নির্বাসন
আমার সামনে দিয়ে যারা যায়, আমার পাশ দিয়ে যারা যায়
সবাইকে বলি : মনে রেখো
মনে রেখো একজন শারীরিক খঞ্জ হয়ে
ফিরে গিয়েছিল এই পথে
বালকের মতো তার ঘর ছিল বিষণ্নের
দুপুর আকাশে ছন্নছাড়া
চোখে তার জল নয়, বুকের পিছনে দিঘি
ভাঙা বাড়ি প্রাচীর আড়াল
শতাব্দীর বুরিনামা গাছের নিবিড়ে ওই
ব্যবহারহীন জল থেকে,
একজন দেখে- দূরে- কখনো দেখেনি আগে
এমন আনন্দমুগ্ধ দেশ
এমন আপনমুগ্ধ ঢল নামে, তার পাশে
এমন শরীরসঙ্গহারা
হয়তো-বা একজন ধর্মহীন বর্মহীন
নির্বাসনে যায়, মনে রেখো।
*
শরীর
শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটছে, ডাক্তার
ঠিক জানি না
কীভাবে বলতে হয় তার নাম
আয়নার সামনে বসলে ভারী হয়ে নামে চোখ
পেশির মধ্যে ব্যথা
ভিতর থেকে ফুটে বেরোয় হলুদ রঙের আলো
কিন্তু সে তো গোধূলির আভা। রক্তে কি
গোধূলি দেখা যায়?
রক্তে কি গোধুলি দেখা যায় যাওয়া ভালো?
শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে, ডাক্তার
জানি না তার নাম।
*
খরা
সব নদী নালা পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে
জল ভরতে এসেছিল যারা
তারা
পাতাহারা গাছ
সামনে ঝলমল করছে বালি।
এইখানে শেষ নয়, এই সবে শুরু।
তারপর বালি তুলে বালি তুলে বালি তুলে বালি
বালি তুলে বালি
বিশ্বসংসার এ-রকম খালি
আর কখনো মনে হয়নি আগে।
*
না
এর কোনো মানে নেই একদিনের পর দু-দিন, দু-দিনের পর তিনদিন
কিন্তু তারপর কী?
একজনের পর দু-জন, সুজনের পর দুর্জন
কিন্তু তারপর কী?
এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান।
তুমি বলেছিলে ঘর হবে, ঘর হলো
তারপর কী?
তুমি বলেছিলে স্নেহ হবে, স্নেহ হলো
তারপর?
কতদূরে নিতে পারে মেহ? অন্ধকারও আমাকে সন্দেহ
করেনি কখনো
বুকে বসে আছে তার এত বড় প্রতিস্পর্ধী কোনো!
না-এর পর না, না-এর পর না, না-এর পর না
তারপর কী?
পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা
তারপর?
*
বর্ম
‘ও যখন প্রতিরাত্রে মুখে নিয়ে এক লক্ষ ক্ষত
আমার ঘরের দরজা খোলা পেয়ে ফিরে আসে ঘরে
দাঁড়ায় দুয়ারপ্রান্তে সমস্ত বিশ্বের স্তব্ধতায়
শরীর বাঁকিয়ে ধরে দিগন্তের থেকে শীর্ষাকাশ
আর মুখে জ্বলে থাকে লক্ষ লক্ষ তারার দাহন
অবলম্বহীন ওই গরিমার থেকে ঝুঁকে প’ড়ে
মনে হয় এই বুঝি ধর্মাধর্মজ্ঞানহীন দেহ
মুহূর্তে মূৰ্ছিত হলো আমার পায়ের তীর্থতলে–
শূন্য থেকে শূন্যতায় নিরাকার অস্ফুট নিশ্বাস
মধ্যযামিনীর স্পন্দে শব্দহীন হলো, তখনও সে
দূর দেশে দুর কালে দূর পৃথিবীকে ডেকে বলে :
এত যদি ব্যুহ চক্ৰ তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে?
*
স্পর্ধা
তার কোনো খ্যাতি নেই তার জন্মপরিচয় নেই
তার কোনো মুক্তি নেই লোকে যাকে মুক্তি বলে থাকে
যতদূর দেখা যায় সারি সারি কম্বল, পশম
আর কোনো ঢেউ নেই ঢেউয়ের সংঘর্ষে দ্যুতি নেই।
জীবন এত যে ভাল, সে-জীবনে অধিকার নেই
লজ্জাহীন সুন্দরের মুখে কোনো ম্লান আভা নেই
সারি সারি উট আর উটের চোখের নীচে জল
দু-হাত বাড়িয়ে দেখে আর কোনো জলচিহ্ন নেই–
তবু সে এমনভাবে কোন্ স্পর্ধা করে বলে যায়
‘আমার দুঃখের কাছে তোমাদের নত হতে হবে!’
*
সন্ততি
আবার ফিরে আসে এ-রকম নিজের মধ্যে ভরে-ওঠা দুপুর
যখন মাথার উপর নিকষকালো মেঘ
আর অগাধ পাটখেতের কিনার ঘিরে আমাদের নিঃশব্দ চলা
ছমছমে প্রান্তর জুড়ে খেলনা দুই মানুষ
ভেসে ওঠে সুখে-দুঃখে অস্পষ্ট অতীত দিন নিয়ে
ভয়ে ভয়ে সরে আসে শস্যের পাশাপাশি খুব
কেননা এই সুখ এই দুঃখ এই আকাশ
আমাদের ছিঁড়ে নেয় ভিন্ন ভিন্ন ব্যথাময়
গ্রামান্তের দিকে
শুধু ধরা থাকে হাত
হাতে হাতে কথা নেই কোনো
চোখে চোখ রাখি তবু কেউ কাউকে দেখতে পাই না আর
এ কি মৃত্যু? এ কি বিচ্ছেদ? না কি মিলনেরই অপার বিস্তার?
এ কি মুহূর্ত? এ কি অনন্ত? না কি এরই নাম সন্তত জীবন?
আমাদের মাঝখানে প্রথম বৃষ্টির বিন্দু নীল
আর তুমি নিচু হয়ে তুলে নাও একমুঠো মাটি
শূন্যে ছড়াও, আর চোখে চোখে না তাকিয়ে বলো :
ভেবো না ভেবো না কিছু! দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
*
প্রতিভা
ক্রমে এনে দেব তোকে স্ফীত মুণ্ড, স্নায়ুহীন ধড়
থাবায় লুকোনো বহু বাঘনখ, লোমশ কাকুতি
চোখের প্রতিটি পক্ষ্মে এনে দেব ধূর্ত শলাকা-র
ক্ষিপ্র চলাচল, আর, জল নয়, লালা দুই চোখে।
হৃৎপিণ্ডে বেঁধে দেব কারুকার্যে পাথরের ঢাল
মেরুদণ্ডে গলে-যাওয়া সরীসৃপ-আভা, আর স্বরে
সহজে বাজিয়ে দেব নবমীর ন-হাজার ঢাক–
তারপরে বলে দেব- আ, এই প্রতিভা আমার,
যা, শহরের পথে অকাতরে ঘোর এইবার!
*
শাদাকালো
পথের ওই খুনখুনে বুড়ো
যখন এগিয়ে এসে বলে ‘আমি চাই।
দেবেন না? না দিয়ে
কাকে ঠকাচ্ছেন মশাই?’
আর চারদিক থেকে ভদ্রলোকেরা :
‘সাবধান, সরে যান
লোকটা নির্ঘাৎ টেনে এসেছে
কয়েক পাঁইট’
তখন আমার সামনে কেঁপে দাঁড়ায়
ওয়াশিংটনের আরেক মস্ত বুড়ো
থুত্থুরে
ছেঁড়া বুকে ঢিল খেতে খেতে
তবু যে আঙুল তুলে বলেছিল ‘শোনো
আই অ্যাম ব্ল্যাক
ও ইয়েস, আই অ্যাম ব্ল্যাক
বাট মাই ওয়াইফ ইজ হোয়াইট!’
*
হাসপাতাল
নার্স ১
ঘুমোতে পারি না, প্রতি হাড়ের ভিতরে জমে ঘুণ
পা থেকে মাথায় ওঠে অশালীন বীজাণুবিস্তার
ঘূর্ণমান ডাক দিই : কে কোথায়, সিস্টার সিস্টার–
‘হয়েছে কী? চুপ করে নিরিবিলি ঘুমিয়ে থাকুন।
তাছাড়া নিয়মমতো খেয়ে যান ফলের নির্যাস—’
শাদাঝুটি লাল বেন্ট খুট খুট ফিরে যায় নার্স।
.
নার্স ২
রাত দুটো। চুপিচুপি দুটি মেয়ে ঢুকে দেখে পাশের কেবিনে
ম্রিয়মাণ যুবাটির আরো কিছু মরা হলো কি না।
‘এখনও ততটা নয়’ ঠোঁট টিপে এ ওকে জানায়।
‘তবে কি ঘুমোচ্ছে? না কি জ্ঞানহীন? ডাক্তার দরকার?’
‘থাক বাপু’- ফিনফিনে ফিঙে দুটি ফিরে চলে যায়
‘আমরা কী করতে পারি! যার যার ঈশ্বর সহায়!’
.
নার্স ৩
দু-জন আছেন ওই অ্যাপ্রনসুন্দরী
অ্যাপনের নীচে রেখে হাসি
মুখে মরুভূমি নিয়ে নিয়মিত ভোরে
বিছানা সাজান বারো মাসই
যদি বলি ‘চাদরের আমিও কোণ ধরি’
আমাকে দেবেন ঠিক ফাঁসি!
.
নার্স ৪
হাসিও ছিল বারণ
মুখে তাকাই না, কারণ
তাকালে মুখে রোগীর বুকে
রক্ত-সমুৎসারণ।
ধরেছি বটে নাড়ি,
কপাল ছুঁতে কি পারি?
এক ঝাপট-এ মাথায় ওঠে
ছেলে থেকে বুড়ো ধাড়ি।
*
পায়ের নীচে একটুকরো খাবার
পায়ের তলায় কুড়িয়ে নেয় দানা।
ঠোঁটের থেকে পড়ছে ঝরে ঝরে
অন্য ধারে গিয়ে খাবার খা না!
পায়ের তলায় কুড়িয়ে নেয় দানা।
খুব বিরক্ত করছিল কি তোকে?
বড়োই বেশি করছিল বাহানা?
পায়ের তলায় কুড়িয়ে নেয় দানা।
দিস নি, ভালো, দিলেই হতো ভুল
লোভ বাড়াতে শাস্ত্রে আছে মানা।
পায়ের তলায় কুড়িয়ে নেয় দানা।
তোর দয়াতে হয়তো পেত ভয়
চেঁচিয়ে উঠে বলত ‘না-না, না-না’
বিস্ফোরণে ফাটত হঠাৎ দানা
থেকে কিউবা থেকে ঘানা।
*
বাবুমশাই
আশা করি সকলেই বুঝবেন যে এই ধরণের
রচনা পড়বার বিশেষ একটা সুর আছে।
‘সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা!
বেঁচে ছিলাম বলেই সবার কিনেছিলাম মাথা
আর তাছাড়া ভাই
আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে
নতুন সমাজ, চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে
যাবে খোল-নলিচা
যাবে খোল-নলিচা পালটে, বিচার করবে নিচু জনে’
-কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে
মিত্র বাবুমশয়
মিত্র বাবুমশয় বিষয়-আশয় বাড়িয়ে যান তাই,
মাঝেমধ্যে ভাবেন তাদের নুন আনতে পান্তাই
নিত্য ফুরোয় যাদের
‘নিত্য ফুরোয় যাদের সাধ-আহ্লাদের শেষ তলানিটুকু
চিরটা কাল রাখবে তাদের পায়ের তলার কুকুর
সেটা হয় না বাবা
সেটা হয় না বাবা’ বলেই থাবা বাড়ান যতেক বাবু
কার ভাগে কী কম পড়ে যায় ভাবতে থাকেন ভাবুক
অমনি দু-চোখ বেয়ে
অমনি দু-চোখ বেয়ে অলপ্পেয়ে ঝরে জলের ধারা
বলেন বাবু ‘হা, বিপ্লবের সব মাটি সাহারা’
কুমির কাঁদতে থাকে
কাঁদতে থাকে ‘আয় আমাকে নামা নামা’ বলে
কিন্তু বাপু আর যাব না চরাতে-জঙ্গলে
আমরা ঢের বুঝেছি
আমরা ঢের বুঝেছি খেদিপেঁচি নামের এসব আদর
সামনে গেলেই ভরবে মুখে, প্রাণ ভরে তাই সাধো
তুমি সে-বন্ধু না
তুমি সে-বন্ধু না, যে-ধূপধুনা জ্বলে হাজার চোখে
দেখতে পাবে তাকে, সে কি যেমনতেমন লোক
তাই সব অমাত্য
তাই সব অমাত্য পাত্রমিত্র এই বিলাপে খুশি
‘শুঁড়িখানাই কেবল সত্য, আর তো সবই ভূষি
ছি ছি হায় বেচারা!
ছি ছি হায় বেচারা? শুনুন যাঁরা মস্ত পরিত্রাতা
এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা
হেঁটে দেখতে শিখুন
হেঁটে দেখতে শিখুন ঝরছে কী খুন দিনের রাতের মাথায়
আরেকটা কলকাতায় সাহেব আরেকটা কলকাতায়
সাহেব বাবুমশায়!
*
পাগল হবার আগে
ফুলবেলপাতা ড্যাডাং ড্যাং
ঘনকাসুন্দি ড্যাডাং ড্যাং
দিন যদি তা র চোখ শুষে নেয়
রাত্রিবেলার মাথায় ব্যাং।
ছাপোষা ছাপ্পা ধে দে রে খাপ্পা
বুঝে গিয়েছি হে বেবাক ধাপ্পা
মাথার ভিতরে উলটে গিয়েছে
তিনচারজোড়া গোরুর ঠ্যাং
কাটা-কাট-কাট আরে আকাট
এই ডান-কাৎ এই বাঁ-কাৎ
দিনদুপুরে-যে সবই ডাকাত
জবর গ্যাং!
ফুলবেলপাতা ড্যাডাং ড্যাং
ঘনকাসুন্দি ড্যাডাং ড্যাং
ছড়িয়ে গিয়েছে আসল গ্যাং
অহো রে শহরে গ্যাঙরগ্যাঙ।
*
এই শহরের রাখাল
গোরর পিঠে উঠবে বলে দৌড়েছিল যুবা
খোলা পথের উপর
লোকে বলল পাগল, লোকে বুঝেও নিল মাতাল
তা বলে…ভরদুপুর…?
দুপুরবেলাই? বাঁধো ওকে! মাথায় ঢালো জল
হতে পরাও বেড়ি!
‘বেড়ি? না কি রুপোর মালা?’ ব’লে যুবক সবার
ঠিক করে দেয় টেরি।
ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল সবাই ‘এইরকমই হবে,
আকাল, মশাই, আকাল।’
গোরুর পিঠে দাঁড়িয়ে যুবা বলে ‘এবার আমিই
এই শহরের রাখাল।’
*
ঘরে ফেরার রাত
দেখেছি পথে যেতে, চলেছে হামা দিয়ে
বৈধাবৈধের লক্ষ চুম্বন
মিলেছে শহরের মুক্ত নাভিতটে
লুব্ধ পাঁচ মাথা : নষ্ট চুম্বন
মানুষ নামে ওঠে মানুষ মাঝখানে
দশটা পাঁচটার ত্রস্ত চুম্বন
কেবিনে পর্দায় গভীর ময়দানে
মুখ না মুখোশের শুষ্ক চুম্বন
এখানে কফি হাতে ওখানে জটলায়
বামন চায় চাঁদে খুচরো চুম্বন
এ-ওকে ধ্বংসের ভিতরে উত্থান
কর্তৃপদে তাই তুখোড় চুম্বন
হঠাৎ-পতনের শায়িত খোলা বুকে
জনতা তোলে খর নখর, চুম্বন
‘থামাও, বাঁধো, ধাও’ ধ্বনির গহ্বরে
লরি ও ট্যাক্সির প্রখর চুম্বন
শরীর ফেরে তবু, যদিও কৃকলাশ,
চোখের পাতা চায় চোখের চুম্বন
*
তিমির বিষয়ে দু-টুকরো
আন্দোলন
ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।
.
নিহত ছেলের মা
আকাশ ভরে যায় ভস্মে
দেবতাদের অভিমান এইরকম
আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান
এ ছাড়া
আর কোনো শান্তি নেই কোনো অশান্তিও না।
*
বড়ো বেশি দেখা হলো
বড়ো বেশি দেখা হলো যা-দেখার পাপে শরীরের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে যায় ত্রাণহীন নীরন্ধ্র কালিমা।
যদিই বাঁচাতে চাও দুই চোখে ঘষে দাও তুঁতে
চোখের তারায় দাও তরবারি উদ্দাম লবণ
জ্বালাও গন্ধক ধূম হলাহল ধ্বংস করে দাও
চেতনা চৈতন্য বোধ লুপ্ত করো অনুভব স্বাদ
শিরায় ছড়াও আর্দ্র ধারাময় সরীসৃপ দাহ
কটাহে ঘোরাও দণ্ড অক্ষিপট ঝিল্লি কনীনিকা
ছিন্ন করে নাও ছিন্ন অন্ধ করে দাও দুই চোখ
বড়ো বেশি দেখা হলো ধর্মত যা দেখা অপরাধ!
*
তুমি
আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই
আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই
কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই
তুমি আছো তুমি।
*
গঙ্গাযমুনা
আর সবই মৃত্যুর কবিতা, কেবল এইটে জীবনের
আর সবই আমার কবিতা, কেবল এইটে তোমার
আর সবই থামা থেমে-যাওয়া চোয়ালে-চোয়াল-জাগা উচ্চাশার ঝুল লাগা
নেমে যাওয়া ভাঙা বর্ষার প্লাবনশেষে ম্যানহোল থেকে তোলা অন্ত্রময়
ভয় আর ধ্বস্তদেহ ফেলে রেখে ছুটে যাওয়া টায়ার টায়ার
ব্রিজ ধ্বস্
আর সবই শহরের কবিতা, কেবল এইটে প্রান্তরের।
আর সবই মৃত্যুর কবিতা, কেবল এইটে জীবনের
আর সবই আমার কবিতা, কেবল এইটে তোমার
এইটে উপচেপড়া পূর্ণ টান সমুদ্রের কী কী যেন বাকি ছিল ব্যথা দেওয়া হলো
কাকে অকারণে একদিন হাঁটুজল ভেঙে চলে যাওয়া বসন্তের উড়ো চুল
হাসাহাসি করে লোকে নিচু হয়ে বুকে নেওয়া সমস্ত পথের ধুলো
হাজার হাজার পাতা উড়ে যাওয়া আসন্ন ঈশান
আর সবই গঙ্গার কবিতা, কেবল এইটে যমুনার।
*
মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়
ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?
চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?
মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে
বসে থাকি?
মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই
মানবশরীর একবার?
দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার
ভেসে-ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো?
যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা, যাও
কী-বা আসে যায়
লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়।
*
হওয়া
হলে হলো, না হলে নেই।
এইভাবেই
জীবনটাকে রেখো
তাছাড়া, কিছু শেখো
পথেবসানো ওই
উলঙ্গিনী ভিখারিনীর
দু-চোখে ধীর
প্রতিবাদের কাছে
আছে, এসবও আছে।
*
বাজি
সন্ন্যাসী হয়েছ সবটুকু?
সবটুকু।
ছেড়ে দিতে পারো সব? রাজি?
রাজি।
উপেক্ষা কি উপেক্ষা দিয়েই
সহজে ফেরাতে পারো মূলে?
খুলে
দিয়েছ সমস্ত দ্বার? আর
নিহিত শীতের রাত্রে তালবীথি দেখেছে আগুন
ওই স্বচ্ছ জলে?
তবে এসো, এইবার, সবটুকু ধরো, দাও টান
মনে রেখো কিছুতেই কোথাও তোমার কোনো ত্রাণ
নেই
জিতে গেছ বাজি।
*
ধর্ম
শুয়ে আছি শ্মশানে। ওদের বলো
চিতা সাজাবার সময়ে
এত বেশি হল্লা ভালো নয়।
মাথার উপরে পায়ের নীচে হাতের পাশে ওরা
সবাই তোমার বান্দা
ওদের বলো
বলো যে এই শূন্য আমার বুকের উপর দাঁড়াক
খুলুক তার গুলফ-ছোঁয়া চুল
মুকুটভরা জ্বলে উঠুক তারা। ওরা পালাক
আর, নাম-না-জানা মুণ্ডমালা থেকে
ঝরে পড়ুক, ধর্ম ঝরে পড়ুক
ঠান্ডা মুখে, আমার ঠান্ডা বুকে, ঠান্ডা!
*
সঙ্গিনী
হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।
পায়ের ভিতর মাতাল, আমার পায়ের নীচে
মাতাল, এই মদের কাছে সবাই ঋণী
ঝলমলে ঘোর দুপুরবেলাও সঙ্গে থাকে
হাঁ-করা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনী।
সেই সনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনা
তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না?
তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়
তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়।
*
মানে
কোনো-যে মানে নেই, এটাই মানে।
বন্য শূকরী কি নিজেকে জানে?
বাঁচার চেয়ে বেশি বাঁচে না প্রাণে।
শকুন, এসেছিস কী-সন্ধানে?
এই নে বুক মুখ, হাত নে পা নে—
ভাবিস পাবি তবু আমার মানে?
অন্ধ চোখ থেকে বধির কানে
ছোটে যে বিদ্যুৎ, সেটাই মানে।
থাকার চেয়ে বেশি থাকে না প্রাণে।
ছুটেছে উন্মাদ, এখনও ত্রাণে
রেখেছে নির্ভয়, সহজযানে
ভাবে সে পেয়ে যাবে জীবনে মানে!
বিভোর মাথা কেউ খুঁড়েছে শানে
কিছু-বা ভীরু হাত আফিম আনে–
জানে না বাঁচে কোন্ বীজাণুপানে
কোনো-যে মানে নেই সেটাই মানে।
কোনো-যে মানে নেই সেটাই মানে।