মুহূর্ত
তাহাদের ঘরে ঢুকিয়া হঠাৎ দরজা দিতে দেখিয়া পদ্মা কাতর স্বরে বলিল, আমাকে একটু আসতে দে ভাই, আমি কিছু বলব না, কেবল চুপ করে বসে বসে শুনব, কিছু বলব না–
দরজা আগলাইয়া সুমতি বলিল, না না, তোমাকে আসতে দেওয়া হবে না।
পদ্মা তবু তাহার মুখটি আরও কাতর করিয়া বলিল,
—তোদের পায়ে পড়ি ভাই, আমায় একটু আসতে দে, বলছি তো একটি কথাও বলব না
তাহারা একবার পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করিল, শোভা মুখ টিপিয়া হাসিল, তারপর রাণু গম্ভীরভাবে বলিল, একটি কথাও বলতে পারবে না, ঠিক তো?
—ঠিক বলছি, এই চোখ ছুঁয়ে বলছি। পদ্মা সত্যিই তাহার দুই চোখ ছুঁইয়া বলিল।
সুমতি এবার পথ ছাড়িয়া দিল, পদ্মাকে ঢুকিতে দিয়া তারপর দরজা বন্ধ করিয়া বিছানার উপর বসিয়া সকলে মিলিয়া গল্প করিতে আরম্ভ করিল। শোভা পাশের বাসায় থাকে, বয়স নিতান্ত অল্প—এখনও পনেরো পার হয় নাই, কিন্তু খুবই আশ্চর্যের কথা এই যে, এখুনি বিবাহের কথাবার্তা ঠিক হইয়া গিয়াছে। সুতরাং, গল্পটা হয় তাহাকে উপলক্ষ করিয়াই।
সুমতিদের উচ্ছাসটা শোভার চাইতেও বেশি, শোভা কেবল মাঝে মাঝে লাল হইয়া ওঠে, অথবা স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে বাইরের দিকে তাকায়। তাহারা তিনজনে মিলিয়া একটার পর একটা গল্প করিয়া চলিল, এক সময় শোভা তাহার বিবাহের জন্য নির্মিত নতুন চুড়ি দেখাইল, আর একসময় সুমতি তাহার কানে ফিস ফিস করিয়া কিছু বলিল। পদ্মা একবার কান পাতিয়া শোনার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু সুমতি অমনি ঝংকার তুলিয়া বলিল, কী অসভ্য, আবার আড়ি পেতে শশানে!
কিছুক্ষণ পরে এদি-ওদিক চাহিয়া শোভা হঠাৎ চীৎকার করিয়া বলিল, আমার আর একটা চুড়ি কোথায়?
–চুড়ি! বিস্ময়ে সকলের চোখ বড়ো হইয়া গেল,–চুড়ি আবার কোথায়? এই না কোথায় রাখলি? ভোজবাজী নাকি যে চোখের সামনে জিনিস উড়ে যাবে?
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি হইল। রাণু হঠাৎ মুখ তুলিয়া বলিল, আমার মনে হয় কী জানিস?
সকলের চোখে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিয় হইয়া গেল। সুমতি গম্ভীরভাবে পদ্মার দিকে আগাইয়া আসিল, তাহার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া বলিল, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল?
পদ্মা তো অবাক! এমনটা যে হইবে সে কল্পনাও করিতে পারে না। সবটাতেই কী তাহার দোষ! সে কাতরস্বরে বলিল, আমি তো নিইনি…
—আমি তো নিইনি। আহা, ন্যাকা আর কী। তোমাকে বাপু আমরা চিনি, এই সেদিন সুলতার ছোটো ভাইয়ের হাতের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলে; চুড়ি শীগগির বার করে দে বলছি?
পদ্মার চোখ দুটি ছোটো হইয়া আসিল, সে আরও করুণ হইয়া বলিল, বিশ্বেস কর ভাই, আমি চুড়ি নিইনি…
—তবে রে! তবু মিথ্যা বলা হচ্ছে! রাণু আরও কাছে আসিয়া বসিল, তাহলে দাঁড়াও, তোমার সমস্ত শরীর আমরা খুঁজে দেখব।
কিন্তু তাহার কাপড়-চোপড় খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
সুমতি হঠাৎ তাহার বুকের উপর ঝুঁকিয়া বলিল,
দেখি তোর—এই বলিয়া তাহার বুকের উপর সেমিজটা সরাইয়া দেখিল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।
পদ্মা ভাবিল, সে কী এতই বোকা যে চুরি করিয়াও এতক্ষণ এখানে বসিয়া থাকিবে, বা বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিবে? কিন্তু সকল সময়েই কী তাহার দোষ? যে কেউ চুরি করলেও তাহার নাম বলিবে? এই তো আজ-আজ তো সে চুরি করে নাই, তবুও তো সকলেই তাহাকে কেমন যা-তা বলিতে ছাড়িল না!
পদ্মা ধীরে ধীরে সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল, দীর্ঘ বারান্দা ধরিয়া ধীরে ধীরে হাঁটিতে লাগিল। বারান্দায় প্রায় সবটাই দিনের বেশিরভাগ সময় জলে চ্যাক চ্যাক করে, দারুণ পিছল হইয়া থাকে, এখন দুপুর বলিয়া খানিকটা শুকনো। প্রদিনি ভোর হইতে না হইতেই পাশের ঘরগুলি হইতে ছোটো বড়ো নানা ধরনের ছেলেমেয়েদের দল পিঁপড়ার মতো বাহির হইয়া আসে। বারান্দার বাহির হইয়া আসিতে পারিলেই যেন তাহারা বাঁচে, তারপর সেখানে পড়িয়া হাত পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে থাকে—যতোক্ষণ না খাবার দেওয়া হয়। বেলা দশটা বাজিতেই, অর্থাৎ রৌদ্রের তেজ বাড়িলে বৃদ্ধ হরিমোহন গায়ের সমস্ত কাপড়-চোপড় ফেলিয়া বারান্দায় একপাশে তেল মালিশ করিতে বসিয়া যায়, তাহার কোমরে নাকি বাত—গায়ে একখানা যেমন তেমন ছেড়া গামছা থাকিলেই যথেষ্ট। দুপুরবেলায় খানিকটা সময়ের জন্য কিছুটা ফাঁকা যায় বটে, কিন্তু তখন ছোটো ছেলেময়ে এবং বড়োদের বিস্তর কাঁথা আর তালি দেওয়া বিছানা রৌদ্রে শুকাইতে দেওয়া হয়। এখনও স্তূপ পড়িয়া আছে। তাই চারিদিকে কেমন একটা ছাগলের গায়ের গন্ধের মতো। মাছিও ভনভন করিতেছে। পদ্মা খুব সাবধানে পা ফেলিয়া সিঁড়ির কাছে গেল—নইলে ওই রঙ বেরঙ বিছানাগুলি একটু মাড়ালেই হয়তো পাশের ঘর হইতে শশধরের কাঠির মতো সরু বউটা চীৎকার করিয়া সারা বাড়ির লোককে আনিয়া জড়ো করিবে।
বাড়িটা অত্যন্ত পুরোনো, এত যে একটু জোরে হাঁটিলেই যেন থর থর করিয়া কাঁপিয়া ওঠে।
দেওয়ালে দেওয়ালে অজস্র ফাটল, অনেক ঘরের ছাদও ভাঙা বর্ষায় রীতিমত জল পড়ে, তাই প্রায় সবগুলি ঘরের দেওয়ালেই কালো কালো স্যাঁতসেঁতে দাগ ধরিয়া আছে। পদ্মা সিঁড়ি দিয়া নামিতে গিয়া দেখিল কাঁপে কি না। হুঁ, কাঁপে, তবে সিঁড়ির মতো নয়। আচ্ছা, বাড়িটা যদি হঠাৎ একদিন ভাঙিয়া পড়ে? তাহা হইলে কিন্তু উপরের ঘরের কেউ বাঁচিতে পারিবে না। তাহারা কেমন করিয়া পালাইবে? পালাইবার সময়ই বা পাইবে কোথায়?
সিঁড়িটা ভয়ানক খরখরে, কোনো কাঁকর বিছানো পথের চাইতেও অনেক কর্কশ। আর সরু, এত সরু যে আর একজন কেউ নীচ হইতে আসিলে একেবারে দেয়াল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতে হয়। একদিন যা হইয়াছিল…সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে পদ্মা উপরের ঘরে সুমতিদের হাসির রোল শুনিতে পাইল। চুড়িটা পাওয়া গিয়াছে তাহা হইলে? হয়তো কোথাও চাপা পড়েছিল, এতক্ষণে তা পাওয়া গেল। তবুও তো না জানিয়া শুনিয়াই সুমতিরা তাহাকে যা-তা বলিতে ছাড়ে নাই! সে চুরি করে বলিয়াই কী যখন-তখন যে-কোনো জিনিস চুরি গেলেই তাহার নাম পড়িবে।? সে কী এতই বোকা চুরি করিয়াও সেখানে বসিয়া থাকিবে? পদ্ম মনে মনে একটু হাসিল। কিন্তু পরক্ষণেই শোভা এবং তাহার সঙ্গিনীদের ব্যবহারের কথা মনে করিয়া একটু দমিয়া গেল। মন তাহার সহজে বড়ো খারাপ হয় না। আজ একটু খারাপ হইয়া গেল।
পদ্মার মা-র আজ দুপুরবেলা ঘুম হয় নাই। মেয়ের চেহারাখানা দেখিতে না দেখিতেই সে খনখন করিয়া বাজিয়া উঠিল, এই যে রানি এসেছেন দেখছি। এতক্ষণ হৈ-রৈ করে কোথায় বেরোনো হয়েছিল শুনি? পাড়া বেড়িয়ে এলেন বুঝি? এ ছাড়া আর কী কাজ? কাজের ঠেলায় খাওয়া-দাওয়া সারবার সময়ই বা কোথায়? মা হঠাৎ ঝাঁটার দিকে হাত বাড়াইয়া সামনের দিকে অগ্রসর হইল, নিজের কুঞ্চিত মুখখানা কংকালের মুখের মতো বিকৃত করিয়া বলিল, যা এখান থেকে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা বলছি।
ঘরের একপাশে আলোর কাছে বসিয়া শিবনাথ পুরোনো একজোড়া জুতায় লোহা মারিতেছিল। একবার পেছন ফিরিয়া চাহিয়াই সে বলিতে আরম্ভ করিল, আমি কিন্তু তোমাদের ওসব ইসটাইল-ফাইল ভালো বুঝিনে। এই যে যার তার সঙ্গে কথা কওয়া, যেখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়া—এ যেন এক ইসটাইল হয়েছে আজকাল! যতো সব…। খবরের কাগজে রোজই তো পড়ি, পড়তে পড়তে কান ঝালা পালা হয়ে গেল। এই তো সেদিনও শুনলাম অমূল্য চৌধুরীর বড়ো মেয়েটা বাড়ির সামান্য একটা তাই নিয়ে কত কেলেঙ্কারি! শিবনাথ নিজের মনে বিড় বিড় করিয়া আরও অনেক কিছু বলিল, তারপর এই বলিয়া উপসংহার করিল
—আমার কথা হল মেয়ে মোলোয় পড়ল তো অমনি বিয়ে দাও, বাস! লেখাপড়া দিয়ে কী হবে? বিয়ের ঘরে কোথায় থাকে লেখাপড়া, আর কোথায় থাকে গান। এই গান হয়েছে আর এক ইসটাইল দেশে। আমাদের নির্মলের বউ সেদিনও বলছিল— শিবনাথ দুরাত্মীয় ধনী ভাগ্নে নির্মল এবং তাহার স্ত্রীর কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিল।
মা তাহার মেয়ের দিক এতক্ষণ কটমট করিয়া—চাহিয়াই ছিল, এবার ঠিক তাহার সামনে গিয়া থপ করিয়া এমনভাবে খানিকটা থুথু ফেলিল যে মনে হয় যেন। তাহার গায়ের উপরেই ফেলিতেছে, তারপর চেঁচাইয়া বলিয়া উঠিল, বাঃ দাঁড়িয়ে রয়েছে কেমন করে দ্যাখো, যেন হুকুম আলী সরদার! দুনিয়ার কাউকে পরোয়া নেই! যা এখান থেকে, আমার সুমুখ থেকে চলে যা বলছি?
ব্যাপার দেখিয়া পদ্মার মুখের চেহারা এমন হইয়া গেল যে, মনে হয় যেন সে ভাবিতেছে, ইস, আজ তোমরা সবাই মিলে আমাকে এমন করে বকছো কেন?
ব্যাপারটা সে সহজেই বুঝিতে পারিল। হাতে পয়সা না থাকিলেই কী। তাহাকে সবাই মিলিয়া এমন বকাবকি করিবে? হাতে পয়সা না থাকাটাই যেন তাহার দোষ! সর্বদাই কী আর চুরি করা যায়? সেকালেই তো আর যাহাদের চুরি যায় তাহাদের মতো এমন বোকা নয় যে প্রায় চোখের উপর দেখিয়াও ধরিতে পারিবে না। তবুও চুরি করিতে হইবে। আর না করিলে মাঝে মাঝেই বলা-নাই কওয়া-নাই এমনি বকাবকি শুনিতে হইবে। পদ্মার মনটা আজ সত্যই একটু খারাপ হইয়া গেল। আর কোনোদিন এরকম হয় না। সে নিঃশব্দে সেখান হইতে সরিয়া। পড়িল।
বাড়িটা এখন একটু নির্জন। ছেলেমেয়েগুলি একেবারে সারাদিনের মতো রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িয়াছে কখন। সর্বাঙ্গে এক গাদা ধুলাবালি লইয়া সেই সন্ধ্যার সময় ফিরিবে, তারপর যে যার মতো বসিয়া খাইয়া দাইয়া বিছানায় পড়িয়া যাইবে। দুপুরবেলায় তাই বাড়িটা অস্বাভাবিক রকম নির্জন বোধ হয়। ভাঙা বারান্দায় এখানে-সেখানে জল জমিয়া রহিয়াছে, এখনও শুকায় নাই, এমন স্যাঁতসোঁতে যে আর শুকাইবে না।
পাশ দিয়া একজন প্রৌঢ়া বিধবা ত্রস্ত পায়ে হাঁটিয়া যাইতেছিল। তাহার হাঁটিবার ভঙ্গিই এ রকম। তাহাকে দেখিয়া পদ্মা ডাকিল,-মাসিমা? মাসিমা যেন তাহার ডাকের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তার দিকে না চাহিয়া ফরফর করিয়া বলিল,–এতক্ষণে ছেলে আমার এসেছেন। তার যাওয়ার আয়োজন করতে হবে তো! —ছেলে? মাসিমার ছেলের নাম শৈলেন। সে অমনি প্রায়ই ভোর না হইতেই কোথায় বাহির হইয়া যায়, তারপর বেলা দুইটায় তিনটায় আসে। তারপর আবার সেই বিকাল না হইতেই বাহির হইয়া যায়, আর কখন যে ফিরে তা একমাত্র তাহার মা ছাড়া আর কেউ জানে না। চুলগুলিতে তেল আর চিরুনি পড়িয়াছে বলিয়া কোনোদিন কেউ দেখে নাই, পড়িলেই বরং অস্বাভাবিক দেখায়। এই শৈলেন কথাবার্তায় চমৎকার—পদ্মার দাদা বাঁচিয়া থাকিলে আজ তাহারই সমান হইত বটে কিন্তু একসময় এমন গম্ভীর যে কথা বলিতেই ভয় হয়। যেন সারা পৃথিবীর ভাবনা তাহার মাথায় আসিয়া ঢুকিয়াছে। সে সময় সে দাঁত দিয়া ভয়ানক নখ কাটে।
এইমাত্র কাপড় কাঁধে করিয়া শৈলেন স্নান করিতে চলিয়া গেল। সমস্ত বাড়িটা যেন তাহার পদক্ষেপে কাঁপিতেছে।
এই শৈলেন একদিন তাহাকে বলিয়াছিল, পদ্মা, তোমার চোখদুটো ভারী সুন্দর। — সে কথা মনে করিয়া এই মুহূর্তেও পদ্মার মনের ভিতর যা ভালো লাগিল, তা মুখে বলিবার নয়, বুকের ভিতর কেমন করিয়া উঠিল, খানিকটা সময়ের জন্য অন্তত সে গর্বে উন্নত হইয়া চোখদুটি টান এবং আরও বড়ো করিয়া অত্যন্ত করুণায় চারিদিকে তাকাইতে লাগিল।
মাসিমার ঘরে পদ্মার সর্বদাই আসা-যাওয়া আছে। মাসিমা খুবই ভালো মানুষ, আর শৈলেনদা আরও ভালো মানুষ। পদ্মা আস্তে আস্তে সেই ঘরে ঢুকিয়া অনির্দিষ্টভাবে চারিদিকে তাকাইয়া দেখিতে লাগিল। শৈলেন যে এইমাত্র আসিয়া গিয়াছে, তা ঘরের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিলেই বোঝা যায়। স্যান্ডেল জোড়া বিক্ষিপ্ত হইয়া এখানে একটা ওখানে একটা হইয়া পড়িয়া আছে।
তক্তপোষের উপর একটা বই, আর ভাঁজ-করা একটা ইংরেজি পত্রিকা। আর ভাঙা চেয়ারের উপর গায়ের জামাটা।
শৈলেনের জামা? পদ্মা হাত দিয়া আস্তে একটু ধরিল, ধরিয়া দেখিল, কলারের নীচে বেশ ময়লা পড়িয়াছে, আর ঘামের গন্ধ। শৈলেন—দার জামা! নীচের পকেটে কতো কাগজপত্র, এত কাগজপত্র যে কীসের, তা কে জানে! বুক পকেটে একটা নোটবই, আর একটা ময়লা রুমাল, রুমালের মধ্যে একটা কিছু বাঁধা। পদ্মার বুকের ভিতর টিপটিপ করিতে লাগিল, কোনো রুমাল দেখিলেই তাহার বুকের ভিতর এমনি টিপটিপ করিতে থাকে, শরীরের মধ্যে রক্তের স্রোত দ্রুত বহিতে থাকে।
রুমালটার ভিতর কী আছে কে বলিতে পারে? পদ্মা বাহিরের দিকে একবার তাকাইয়া দেখিল। শৈলেন এখনো জল ঢালিতে আরম্ভ করে নাই, মাসিমার বাসন কোসন নাড়ার শব্দ শোনা যায়। রুমালটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিল পদ্মা, হাতটা কাঁপিতেছে! এ কী, নোট? পাঁচ টাকার নোট? পদ্মার বুকের ভিতর টিপ-টিপ আরও বাড়িয়া গেল, রক্তের চলাচল আরও দ্রুত হইল। মাসিমারা চমৎকার মানুষ, এমন ভালো মানুষ খুব কমই চোখে পড়ে। সমস্ত বাড়ির মধ্যে তাহারাই তাহাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।…কিন্তু পাঁচ টাকার নোট! পাঁচ পাঁচটা টাকা! এখন লইয়া গেলে কেই বা জানিতে পারিবে? সোজা কথা সে এখানে আসে নাই। তবু যদি সন্দেহ করে—তবে খুঁজে বার করো। খুঁজিয়া পাইলে তো চোর বলিবে? হাতে-হাতে ধরা না পড়িলে কেউ কখনো চোর হয় নাকি।… মাসিমা..সেদিনও গদাধরের বউর কাছে মাসিমাকে চাল ধার লইতে দেখিয়াছে সে, হয়তো এই পাঁচটি টাকাই প্রায় মাসখানেকের সম্বল। পদ্মার হাত কাঁপিতে লাগিল, সারা শরীরের ভিতর কেমন একটা ভ্যাপসা গরম লাগিতেছে। ইস, পাঁচ পাঁচটা টাকা এখুনি দিব্যি হাতের ভিতর গুজিয়া বা বুকে ফেলিয়া সোজা উপরে চলিয়া গেলে কে জানিতে পারে। কিন্তু শৈলেন…শৈলেনদা একদিন মাসিমাকে লক্ষ করিয়া বলিয়াছিল, সত্যি,পদ্মার চোখের মতো এমন দুটি চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি, মা? সেকথা মনে করিয়া একাট মধুর অস্থিরতায় পদ্মার সারা মুখ লাল হইয়া গেল, টানা চোখদুটি আরও টান হইয়া আসিল। নোটটা কোনো রকমে রুমালের ভিতর জড়াইয়া সেটা পকেটে পুঁজিয়া রাখিয়া পদ্মা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল, বারান্দা পার হইয়া নিজেদের ঘরে আসিয়া ধপাস করিয়া খালি তক্তপোষের উপর শুইয়া পড়িল।
তাহাকে এমনি শুইতে দেখিয়া তাহার মা অমনি খন খন করিয়া বাজিয়া উঠিল : দ্যাখো, হাত পা ছড়িয়ে দস্যির মতো কেমন শুয়ে পড়ল। বাঃ বাঃ লাজ বলে কোনো জিনিস যদি থাকে। কাজের মধ্যে তো কেবল শুয়ে থাকা আর সময় মতো এসে দুটি খাওয়া।
শিবনাথের জুতায় লোহা লাগানো তখনো শেষ হয় নাই, সে ঘাড় ফিরাইয়া একবার মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ওই তো এক ইসটাইল হয়েছে দেশে, ঘরের কাজ না শেখা, যেন ওসব কিছুই নয়! আরে বাপু দুদিন পরে যে এই ঘরের কাজই তোমায় করতে হবে।…
কিন্তু চুরি কী সর্বদাই করা যায়? পদ্মা শুইয়া শুইয়া পিট পিট করিয়া চাহিয়া দেখিল, শৈলেন এখনও স্নান করিতেছে। তাহার মুখের রঙের অনুপাতে গায়ের রঙ অনেক ফর্সা। সেই শরীরের খানিকটা এখান হইতেই দেখা যায়—চমৎকার পেশিবহুল, আর ফর্সা, চক চক করে, চুলগুলি জলে ভিজিয়া একেবারে মুখের উপর আসিয়া পড়িয়াছে, ফর্সা বলিষ্ঠ হাত দুটি যেন দুটি সাদা পাখির মতো অল্প একটু জায়গার মধ্যে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু চুরি কী আর, বলা নাই— কওয়া-নাই সকল সময়েই করা যায়? আর লোকেও কী যাহাদের চুরি যায় তাহাদের মতো এত বোকা যে প্রায় চোখের উপর দেখিয়াও চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবে? হাতে পয়সা না থাকাটাই যেন তাহাদের দোষ! আর থাকিলেও সেটা যদি দু-একদিনের মধ্যেই ফুরাইয়া যায়, তাহা হইলেও তাহার দোষ! পদ্মার মনটা আজ সত্যই খারাপ হইয়া গেল। অন্য কোনোদিন এরকম হয় না। মন যদি সত্যই খারাপ হইয়া থাকে, তখন তাহার ইচ্ছা হইল একটু কাঁদে। আর কাঁদিলে মনটা খুব খারাপ কি না, তা ঠিক বোঝা যাইত। কিন্তু কান্না তাহার কখনো পায় না, আজও চোখ দিয়া এক ফোঁটা জলও বাহির হইল না। স্তূপীকৃত ছেঁড়া বিছানায় মুখ গুঁজিয়া সে পড়িয়া রহিল।