মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শিশুকাল

মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শিশুকাল

সাধারণত বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। এ সময়টাতে তাদের যথেষ্ট ভালোবাসা আর মনোযোগ প্রয়োজন। ‘কোয়ালিটি টাইম’ বা মানসম্পন্ন সময় বলে আমরা একটা বিষয় জানি। আমাদের ব্যস্ত জীবন আর ক্রমাগত সব মনোযোগ বিঘ্ন করা বিষয়ের মাঝে শিশুদেরকে আরও বেশি সময় দিতে হবে। যত্ন নিতে হবে। বিধবা মা আমিনার আলিঙ্গন, চুমু আর মায়াভরা হাসির মধ্য দিয়ে শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবেগি প্রয়োজনগুলো পূরণ হয়েছে।

শিশুদের জন্য এমন আনন্দ-উত্তেজনাময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা জীবনের জরুরি দক্ষতা অর্জন করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ক্ষেত্রে সেটা ছিল মরুপ্রান্তর। আমাদের জন্য তা হতে পারে স্কুল, দিবা সেবাকেন্দ্র, রিডিং ক্লাব, আত্মীয়স্বজনের বাসা বা শিশুকেন্দ্রিক ফিটনেস সেন্টার।

মানসিক বিকাশ

ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিবের সাথে থাকেন। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে ধরনের আদর, ভালোবাসা ও যত্ন দরকার ছিল, তার সবই তিনি তাঁদের কাছে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে মরুভূমির কঠিন পরিবেশ তাঁকে দিয়েছে জীবনমুখী নানা দক্ষতা অর্জনের উৎসাহ।

শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। প্রথম বছরে শিশুর মধ্যে অনুভূতি জন্মলাভ করে। দ্বিতীয় বছর থেকে তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। তৃতীয় বছরে বাচ্চারা অন্যের সাথে ভাববিনিময় করতে শেখে। চতুর্থ বছর থেকে ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরশীল। পঞ্চম আর ষষ্ঠ বছরে তারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াগুলো তুলে ধরতে শেখে। এসময় নিজেদের আবেগ- অনুভূতিগুলো আরও ভালোভাবে প্রকাশ করতে শেখে। শিশুদের এই ছয় বছরের ব্যাপারগুলো একটি চার্টে আমরা দেখব।

প্রথম বছরঅনুভূতি জন্মলাভ করে।
দ্বিতীয় বছরশব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে।
তৃতীয় বছরঅন্যের সাথে ভাববিনিময় করতে শেখে।
চতুর্থ বছরআত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করে।
পঞ্চম বছরচাওয়া-পাওয়া তুলে ধরতে শেখে।
ষষ্ঠ বছরচাওয়া-পাওয়া তুলে ধরতে শেখে।

এই অধ্যায়ে আমরা ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাল্যকালকে দেখব। তাঁকে বড় করতে যেয়ে তাঁর মা ও দুধ-মা কী বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন, তা দেখব। এরপর দেখব, তাঁর শিশুকালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কীভাবে শিশুদের বড় করতে পারি।

ছয় বছরের নিচে বাচ্চারা

পরিবেশ আর ব্যক্তিত্ব ভেদে শিশুদের বেড়ে ওঠার গতি কমবেশি হয়ে থাকে। সে হিসেবে বলতে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বড় ছিলেন। তাঁর বয়স যখন দু’বছরের নিচে, তখন তাঁর এনার্জি দেখে অনেকেই অবাক হতেন। তারপরও শিশুদের মাঝে এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা মোটামুটি সবার জন্য এক। ছয় বছর পর্যন্ত একজন শিশুর বেড়ে উঠার ব্যাপারগুলো আমরা আরেকটি চার্টে দেখব।

ছয় মাসশিশু তার মায়ের কণ্ঠ চিনতে পারে। পরিচিত চেহারা দেখে হেসে ওঠে।
নয় মাসতাদের মধ্যে প্রথম কৌতূহলের ছাপ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে উদ্বেগও দেখা যায়।
এক বছরচারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছে জাগে। সাধারণ নির্দেশনাগুলো বুঝতে শেখে।
দুই বছরপ্রায় দু’শ শব্দের মতো শব্দভাণ্ডার জমা হয়।
তিন বছরএটা কেন, ওটা কেন- এমন প্রশ্ন করতেই থাকে। অন্যদের সাথে খেলাধুলা ও সাহায্যের মনোভাব গড়ে ওঠে। অন্যকে খুশি করতে চায়।
চার বছরকিছুটা আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। মজা করে। এক থেকে বিশ গুণতে শেখে।
পাঁচ বছরশব্দভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়। সময়ের ব্যাপারে সজাগ হয়।
ষষ্ঠ বছরকথাবার্তা বলায় আস্থাশীল হয় এবং কৌতূহল আরও বৃদ্ধি পায়।

শিশুরা সাধারণত প্রথম পর্যায়গুলো মায়ের সাথে বেশি কাটায়। অনুভূতি সংক্রান্ত চাহিদাগুলো তিনিই পূরণ করেন। আর পরবর্তী পর্যায়গুলো সামাজিক আর ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে কেটে যায়। আমরা দেখি যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর জীবনেও এমনটা হয়েছে। অন্য আর দশটা শিশুর মতো তাঁর ঐ সময়টাও কেটেছে একান্তে মায়ের সাথে।

ভালোবাসার চাহিদা পূরণ

বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের আর্থিক দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। সংসার খরচের চিন্তা না-থাকায় মা আমিনা তার পুরো সময়টা ছেলের পেছনে দিতে পেরেছিলেন। মা হিসেবে বাবা না থাকার কষ্ট কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কখনো আদরঘন আলিঙ্গন, কখনো মমতামাখা চুমু, কখনো-বা শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার হাসি, এভাবেই তাঁকে আগলে রেখেছিলেন মা আমিনা। শিশুকালে রাসূল (সাঃ) তাঁর মায়ের সঙ্গে খুব বেশি একটা সময় কাটাতে পারেননি। অনেক শিশু এ বয়সে মায়ের সাথে অনেক সময় কাটায়। কিন্তু তারপরও শিশু মুহাম্মাদ যে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন, সেটা আজকাল অনেক শিশুর ভাগ্যেই জোটে না।

আজকালকার মা’রা অনেক বেশি ব্যস্ত। অনেক দায়িত্ব ঘর সামলানো, চাকরি, স্বামীসেবা, অন্যান্য বাচ্চাদের দেখভাল ইত্যাদি। মা আমিনার কাঁধে এত বোঝা ছিল না। সংসার খরচের দায়ভার নিয়েছিলেন দাদা। কুঁড়ি বছর বয়সেই বিধবা আমিনাকে এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। মুহাম্মাদ (সাঃ) যে তাঁর একমাত্র সন্তান ছিল, এটাও বেশ কাজে এসেছে।

তখনকার সমাজে সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবারাই মূল ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি মেনে মা আমিনা আঁর মাতৃসুলভ ভালোবাসা আর আদরের পুরোটাই একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ওপর ঢেলে দিয়েছিলেন।

সন্তানের ওপর ভালোবাসার প্রভাব

শিশুর মানসিক বিকাশে ভালোবাসা আর আদরের প্রভাব অনেক। এতে তার নিজের ব্যাপারে আস্থা জাগে, আত্মবিশ্বাস জন্মে। আবেগ-অনুভূতি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এতে করে শিশুরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে। আপনিও আপনার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরুন। ঘুম থেকে ওঠার পর কিংবা বাইরে থেকে বাসায় এসে তাকে সালাম দিন। চুমু দিন। তার সাথে খেলুন। এগুলো ওর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখবে। আত্মমর্যাদা বাড়াবে।

আপনার অবস্থা হয়ত এমন না যে, আপনি পারফেক্ট বাবা-মা হবেন। কিন্তু যতটুকু পারুন ওকে সময় দিন, আদর করুন। মনোযোগ দিন। মাঝেমধ্যে বা কেবল বিশেষ কোনো ঘটনায় ওর প্রতি আদর না-দেখিয়ে নিয়মিত দেখান।

কীভাবে শিশুর মানসিক চাহিদা পূরণ করবেন?

  • প্রতিদিন চুমু দিন, জড়িয়ে ধরুন।
  • ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। বাধা দেবেন না।
  • বাসার বাইরে থাকলে ফোন দিয়ে কথা বলুন।
  • ওর সাথে খেলুন। নিজের পোশাক ময়লা হওয়া নিয়ে চিন্তার দরকার নেই।
  • ভালোবাসা দিয়ে দিন শুরু করুন। আর অখুশি হয়ে কখনো দিন শেষ করবেন না।

সন্তানের জন্য বাঁচা

মা আমিনার স্বামী মারা যান ৫৭১ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ। তারপরও তিনি কিন্তু আর বিয়ে করেননি। তখনকার সমাজ অবশ্য বিধবাদের খাটো চোখে দেখত না। যাদের বংশ ভালো ছিল, তাদেরকে উচু নজরে দেখত। আমিনার রূপ আর কবিতা আবৃত্তির গুণে চাইলেই তিনি আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে পারতেন। সমাজ যে তাঁকে এ ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করেনি, তা কী করে বলি?

কিন্তু তিনি বিধবাই থেকে গেলেন। সেই সমাজে বড় পরিবারের আলাদা মর্যাদা ছিল। আমিনার মনেও হয়ত অমন বড় পরিবারের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর ছেলে মুহাম্মাদের জন্য নিজেকে কোরবান করেছিলেন। শিশু মুহাম্মাদের জীবনকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করতে নিজের জীবনের সাথে আপোষ করেছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। ছিল প্রথাবিরোধী। বিশ বছর বয়সী এক বিধবা তরুণির জন্য এই সিদ্ধান্ত যে অনেক কষ্টের ছিল, তা বলাই বাহুল্য।

কীভাবে নিজের সন্তানকে অগ্রাধিকার দেবেন?

শিক্ষাবিদরা শিশুদের জন্য আলাদা সময় রাখার গুরুত্বের কথা বলেন। যেন মনে হয়, শিশুদের সাথে সময় কাটানো একটা বোঝা। আনন্দের কিছু না। চাকরিজীবী মায়েরা তাদের সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। এতে অনেক মা-ই মনে মনে এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগেন। তাদের এই অপরাধবোধে প্রলেপ দেওয়ার জন্য আলাদা সময় ধারণার জন্ম হয়। অথচ আলাদা সময়ের বদলে আমাদের তো শিশুদের সাথে এমনিতেই সময় কাটানোর কথা।

আর সেটাও স্বতস্ফূর্তভাবে। ঘড়ি ধরে কেন? কত সুন্দরভাবে সময় কাটাচ্ছি বিবেচনার সাথে সাথে কতক্ষণ সময় কাটাচ্ছি, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। বাবা-মারা সন্তানদের সাথে যত বেশি সময় কাটাবে (এখানে বেশি বলতে পরিমাণের কথা বলছি) তাদের সামাজিক, মানসিক ও অ্যাকাডেমিক সমস্যা তত কম হবে। মাদকে জড়ানোর আশঙ্কা কমবে। বখাটেগিরি বা এ ধরনের কোনো অপরাধমূলক কাজ অথবা বিয়ের আগে বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে হারাম সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা কমবে। লরা রামিরেজের কথায় এমনটাই পাওয়া যায়

বাচ্চাদের পার্কে নিয়ে যান। এটা ভালো। কিন্তু এটা কোনোভাবেই ভালো প্যারেন্টিঙের বিকল্প না। বাবা-মাকে তাদের বাচ্চার ছায়া হয়ে থাকতে হবে। এর মানে তাদের সাথে ভালো সময় কাটাতে হবে। ওদের সময়টা যখন ভালো যাবে না, তখন ওদের পাশে থাকতে হবে। ওদের প্রতিটা সমস্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

বাচ্চার সাথে সময় কাটানোর মানে কী?

  • সময় কাটানো মানে এই না যে, সবসময় কিছু না কিছু করতেই হবে। ওদের সাথে থেকে ওরা কী করছে, না করছে তার ওপরনজর রাখাই যথেষ্ট।
  • ওকে সময় দেওয়া সংসারের দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজের অংশ নয়। কাজেই ওকে এমনভাবে সময় দেবেন না, যাতে ওর মনে এই ধারণা উকি দেয়।
  • যেকোনো সময় আপনার কাছে ঘেঁষতে ওর মনে যেন কোনো ধরনের সংকোচ কাজ না করে।

মরু শিক্ষা

রাসূল (সাঃ) ছোটবেলায় শুধু মা’র কাছ থেকেই শেখেননি। তাঁর দুধ-মা হালিমা এবং তাঁর পরিবার থেকেও মানসিক বিকাশের শিক্ষা নিয়েছেন। হালিমার আরও তিন সন্তান ছিল- আবদুল্লাহ, আনিসা, শায়মা। সাথে ছিল তার স্বামী আল হারিস। মক্কা থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল ১৫০ কিলোমিটার। মাঝে মাঝেই এখান থেকে মক্কায় যাওয়া হতো তাঁর। প্রায় চার বছর তিনি এখানে কাটিয়েছেন। অনেক কিছু শিখেছেন এখান থেকে।

সে সময়কার আরব উপদ্বীপের মরুভূমি অঞ্চল সম্পর্কে জানলে সহজে বুঝতে পারব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাল্যকালে মরুভূমির ভূমিকা কেমন ছিল। কী কী মূল্যবোধ তিনি এখান থেকে শিখেছেন। তখন স্কুল-কলেজ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। মরুভূমির এক একটা পরিবারই ছিল এক ধরনের ফুল। শহরের বাবা-মা’রা বাচ্চাদের চারিত্রিক বিকাশের জন্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যই মরুর এসব পরিবারে পাঠাতেন।

মূলত, গ্রামাঞ্চল ও মরুভূমির চেয়ে শহর অঞ্চলে অসুখ-বিসুখের মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজার। ইসলামের বার্তা পুনরায় চালু হওয়ার আগে থেকেই সেখানে হজ্জের রীতি বহাল ছিল। হজ্জের সময়ে স্বাভাবিক কারণে লোকজনের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত। যার কারণে নানারকম রোগ বালাই এর আশঙ্কাও বৃদ্ধি পেত। এসব কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সেসময় অধিকাংশ শহুরে পরিবারের বাচ্চাদের মরু অঞ্চলে পাঠানো হতো। তাছাড়াও মরু অঞ্চলের কথ্য আরবি যেকোনো ধরনের বিকৃতি থেকে মুক্ত ছিল। মরুভূমির বেশিরভাগ নারীই পেশা হিসেবে বা পারিবারিক বন্ধন গড়ার খাতিরে শহরের বাচ্চাদের লালনপালনের জন্য নিয়ে যেতো। নতুন আর অজানাকে জানার, আবিষ্কারের পসরায় সজ্জিত ছিল। মরুভূমির উন্মুক্ত বালুচর। শহরের দালানঘরে সেই সুযোগ কোথায়?

মরুভূমিতে থেকে থেকে শিশু মুহাম্মাদের সামাজিক আর যোগাযোগের দক্ষতা বেড়েছে। শারীরিক সামর্থ্য বেড়েছে। ভাষা শাণিত হয়েছে। সে সময়ের মরুঅঞ্চল, বাচ্চাদের এসব দিকগুলো বিকাশের জন্য দারুন সহায়ক ছিল। তবে আজকের জমানায় এসে আমি আপনার শিশুকে মরুভূমিতে পাঠাতে বলব না। কিন্তু যেসব পরিবেশ শিশুদেরকে উদ্দীপ্ত করবে, সেগুলোকে কখনোই উপেক্ষা করবেন না। এগুলো হতে পারে স্কুল, দিবাসেবা, আত্মীয়ের বাসা কিংবা এধরনের অন্য কিছু। খেয়াল রাখতে হবে, এই জায়গাগুলো যেন নিরাপদ হয় এবং শিশুর প্রতিভা বিকাশ ও আবিষ্কারে সহায়ক হয়।

মরুজীবন

মরুজীবনের বাস্তবতা বুঝার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। যথা

  • মুহাম্মাদ -এর জীবনে মরু জীবন কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
  • তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কী শিখতে পারি।

মরুবাসীদের জীবন ছিল যেনতেন উপায়ে বেঁচে থাকা। টিকে থাকাটাই মুখ্য। বিলাসিতার কোনো জায়গা নেই সেখানে। শুষ্ক এই আবহাওয়ার তীব্র দাবদাহে সূর্যের নিচে ডিম ভাজি হয়ে যেত। পানি আর ছায়া দুটোরই অভাব ছিল। আজকাল আমরা পিপাসা মেটানোর জন্য যে পরিমাণ পানি খাই, তখন তারা এত খাওয়ার সুযোগ পেত না। সামান্য পানি খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য শুধু গলা ভেজাতেন। যেহেতু পানি কম ছিল, খাবারের উৎসও কম ছিল। মরুদ্যান, কুয়ো বা ঝরনার আশপাশ ছাড়া ফসলের ক্ষেত খুব একটা হতো না।

খাওয়ার কষ্ট, পানির কষ্ট নিয়েই বেদুইনরা বাঁচতে শিখেছে। আরও খাবো, আরও খাবো’! এ রকমটা বলে অভিযোগ করতেন না। খাওয়াদাওয়া বা ভোগ করা তখন আনন্দের জন্য ছিল না। ছিল টিকে থাকার জন্য। জীবনের এই কঠিনতা তাদেরকে জীবনের দুঃখকষ্টগুলোকে বিনা অভিযোগে বরণ করতে শিখিয়েছিল।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর ওপর এই পরিবেশের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তিনি কখনো পেট পুরে খাননি। ক্ষুধার যন্ত্রণা দমন করার জন্য পেটে চ্যাপ্টা পাথর বাঁধতেন। এমন কত দিন গেছে তাঁর ঘরে চুলা জ্বলেনি। খুব কম সময়েই তিনি মাংস খেয়েছেন; বরং বেশিরভাগ সময়েই খসখসে রুটি খেতে হয়েছে। খাবার না থাকলে সিয়াম পালন করতেন। তালগাছের পাতা দিয়ে বানানো মাদুরে ঘুমোতেন।

বর্তমান দুনিয়ার চোখে দেখলে তাঁর জীবনযাপন পদ্ধতি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তিনি বাচ্চা বয়সেই এমনটা শিখেছেন। সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ধরে রেখেছেন। এমনকি মক্কায় আসার পরও। মরুভূমিতে তিনি যেসব দামি মূল্যবোধ অর্জন করেছিলেন, তাঁর নিজ পরিবেশ সেগুলোকে আরও জোরদার করেছে।

মরুভূমি থেকে নিয়ে আসা মূল্যবোধ

রাসূল মরুজীবন থেকে যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর মা সেটার মূল্য বুঝেছিলেন। স্কুলে যদি ভালো কিছু শেখায়, তাহলে বাবা-মাদের এর বিরোধী কিছু শেখানো ঠিক হবে না। শিশুকে বরং এমন পরিবেশ দিতে হবে, যেটা তার স্কুলের শিক্ষাকে আরও পোক্ত করবে। মরুকূলে রাসূল সহ্য করার ক্ষমতা আর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের যে শিক্ষা নিয়েছিলেন, মা আমিনা তার ঘরে সেই একই শিক্ষা জারি রেখেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মরু শিক্ষার বাস্তবতা পরিবারে এসেও পেয়েছিলেন। পারিবারিকভাবেই তাঁর জীবন ছিল সাদাসিধা, অনাড়ম্বর। তাঁর মা শুকনো মাংস খেতেন। দাদা দানের টাকা জোগাড় করে হজ্জ পালনকারীদের পানির ব্যবস্থা করতেন। চাচা যৌথ পরিবারের খরচ জোগাতেন। ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ পরিবারেই পেয়েছিলেন। বাচ্চাকাচ্চারা স্কুলে যা শেখে, ঘরে এবং সাধারণভাবে সমাজে যদি সেই একই শিক্ষা জোরদার করে, তাহলে বাচ্চারা নিজেদের নিরাপদ ভাবে। আত্মবিশ্বাসী হয়।

আত্মশৃঙ্খলার মূল্য

শৃঙ্খলার মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। তাদের আচারআচরণ সন্তোষজনক হয়। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। তবে এজন্য বাবা-মার তরফ থেকে এনার্জি ও কমিটমেন্টের দরকার হয়। বাবা-মা কতটা শক্তি ঢালবেন আর কতটা লেগে থাকবে তা নির্ভর করে বাচ্চার ব্যক্তিত্ব এবং কী রকম পরিবেশে সে বেড়ে উঠছে তার ওপর।

রাসূল (সাঃ) মরুভূমিতে শৃঙ্খলার পাঠ নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ে তাঁকে ঘুমোতে যেতে হয়েছে। উঠতে হয়েছে। বিভিন্ন কাজেকর্মে সহযোগিতা করতে হয়েছে। গবাদিপশুর দেখভাল করতে হয়েছে। একটু অন্যরকমভাবে মক্কায় নিজের বাড়িতে সেই একই শৃঙ্খলা জোরদার করা হয়েছে। বাচ্চার চারপাশ আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খায় এমন শৃঙ্খলার মধ্যে বাচ্চাকে বেড়ে তোলা আজকের দিনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। মন যা-ই চাক, বাচ্চাকে দায়িত্ববানের মতো কাজ করতে হবে এটাই শৃঙ্খলা। কচি বয়সেই এটা গড়ে তুলতে হবে।

ষাটের দশকের শেষের দিকে বাচ্চাদের শৃঙ্খলা নিয়ে এক বিখ্যাত গবেষণা হয়। সেখান থেকে দেখা যায়, বাচ্চা বয়সে শেখা শৃঙ্খলা পরবর্তী বয়সে টেকসই হয়। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়াল্টার মিসচেল চার বছর বয়সী একদল বাচ্চাকে একটা করে মার্শম্যালো দেন। তাদেরকে দুটো অপশন দেন: হয় এখন খাও, নয় পরে খাও। তবে পরে খেলে আরেকটা মার্শম্যালো পাবে’। তো এই গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশুরা তাদের খাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পেরেছিল, পরিণত বয়সে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার ছাপ বেশি পাওয়া গিয়েছিল। জীবনে তাদের অর্জনও বেশি।

বাচ্চাকাচ্চাদের শৃঙ্খলা শেখাবেন কীভাবে?

মারধোর, গালি-বকা দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো যায় না। সদয় আচরণ আর সুন্দর লালনপালনের মাধ্যমে এটা সম্ভব। নিচে আমরা কিছু উপায় দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখুন –

  • ভালো কাজের প্রশংসা করুন। এটা তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। আর আপনাকে খুশি করার জন্য এমন কাজ বার বার করতে চাইবে।
  • এমনভাবে বলুন যেন সে বুঝে।
  • করো না’ কথাটা অতিরিক্ত ব্যবহার করবেন না। গলার আওয়াজ উঁচু করো না। এমনটা না বলে বলুন, ‘একটু আস্তে কথা বলো’।
  • বকাঝকার মধ্যে না রেখে মজাদার বিকল্পের ব্যবস্থা করুন।
  • ওদের সাথে কোনো কিছু নিয়ে আলাপ করতে গেলে এমন সময় করবেন না, যখন আপনি রেগে আছেন। ওর মন খারাপের সময়ও আলাপ করবেন না।

সামাজিক দক্ষতা শেখা

মরুভূমিতে থাকা অবস্থায় শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) বেশকিছু কাজ করতেন বলে ধারণা করতে পারি। এই যেমন- পানি আনা-নেওয়া, গবাদিপশুর দেখভাল, তাঁবু টাঙানো, খুলে ফেলা, বড়দের ও মেহমানদের সাহায্য করা। এগুলো তাঁর মধ্যে সহযোগিতা, ভাগাভাগি আর অন্যের দেখভালের মতো গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাসগুলো গড়ে দিয়েছে।

শারীরিক সক্রিয়তার সাথে দক্ষ হওয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেসব শিশুরা শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয়, তারা কম সক্রিয় শিশুদের তুলনায় সামাজিক দায়িত্ব ও নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালনে বেশি অগ্রণী হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে শিশুকে এজন্য যেন চাপাচাপি করা না-হয়। আর সক্রিয় হওয়ার জন্য ওর পরিবেশ নিরাপদ ও আরামদায়ক রাখতে হবে।

মরুভূমিতে দৌড়াদৌড়ি ও খেলাধুলা করার জন্য শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সামনে ছিল প্রশস্ত মরুপ্রান্তর। শিশুসুলভ বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্য দিয়েই তিনি একে অন্যকে সহযোগিতা করতে শিখেছেন। অন্যের সাথে ভাগাভাগি ও দেখভাল করতে শিখেছেন।

শিশুরা যখন খুশিতে থাকে, আনন্দে থাকে, তখন তারা ভালো শেখে। মজাদার সময়গুলো শিশুদের বেড়ে ওঠার সেরা সময়। কারণ, তারা খেলতে পছন্দ করে। চমক পছন্দ করে। কোনো কোনো বাবা-মা মনে করেন শিশুদের খেলাধুলা মানে সময় নষ্ট। এমন ধারণা মোটেই ঠিক না।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ওরা যখন খেলার মধ্যে থাকে, তখনই ওরা সহজে শেখে। গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে। গৎবাধা স্কুলগুলোতে কচি শিশুদের আদেশ-নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করে ফেলা হয়। খালি পড় আর পড়। অন্যদিকে উন্নতমানের স্কুলগুলোতে বিভিন্ন দক্ষতা আর আচরণ শেখানোর জন্য মজাদার কাজকারবার করা হয়।

খেলাধুলার গুরুত্ব

ছোট বয়সে তাদের খেলার সময়সীমা কেটে দিবেন না। এমন ভাবার দরকার নেই যে, তারা বড় হয়ে গেছে, এখন আর বেশি খেলার দরকার নাই। আবার সে কোন ধরনের খেলা খেলবে, সেটাও চাপিয়ে দিতে যাবেন না। ওকে ওর মতো খেলতে দিন। মনের মতো।

শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, তখন বক্ষবিদারণের সেই বিখ্যাত অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কাজেই খেলাধুলার সময়কে অবমূল্যায়ন করবেন না। শিশুদের বেড়ে ওঠা ও শেখার জন্য এটা পার্ফেক্ট অপরচুনিটি।

মরুভূমিতে থাকার সময়ে তিনি দায়িত্ব ও যোগাযোগ রক্ষার ব্যাপারগুলো শিখেছেন। ওখানকার আবহাওয়া অনেক গরম। জীবন ধারণও কঠিন। কিন্তু মক্কার ব্যস্ত গলির চেয়ে মরুরাস্তায় তিনি ছুটে বেড়াতে পেরেছেন। যাযাবরদের জীবন মানে প্রতিদিন নতুন গন্তব্য। তাঁবু গাড়া, গবাদিপশু দেখা, আশপাশ দিয়ে যাওয়া কাফেলাগুলোকে সাময়িক আশ্রয় দেওয়া আর নিরাপদ জায়গা খোজা।

নিঃসন্দেহে শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্য এ ধরনের পরিবেশ ছিল বেশ রোমাঞ্চকর উত্তেজনাময়। এটা তার চরিত্র বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আনন্দের মাঝে শিশুরা শেখে।

ভাষা দক্ষতা

মরুভূমির পরিবেশ তাঁর ভাষা দক্ষতা বাড়াতেও সাহায্য করেছে। স্কুলে ভর্তির আগের সময়টাতে শিশুদের মধ্যে এই দক্ষতা গড়ে ওঠে। মরুভূমির পরিবেশ বিজাতীয় সংস্কৃতি আর ভাষা বিকৃতি থেকে মুক্ত ছিল। যে কারণে রাসূল হয়ে উঠেছিলেন বিশুদ্ধভাষী। অনেক শব্দ শিখেছেন সেখানে।

মক্কায় তাঁর পরিবারের চেয়ে এখানে সদস্য সংখ্যা পাঁচজন বেশি ছিল। তাছাড়া ওখানে কেবল হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন আসত। এখানে প্রায়ই বিভিন্ন কাফেলা যেত। তাদের সংস্পর্শে তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক আরবির সান্নিধ্যে আসেন।

মক্কার লোকেরা তাদের শিশুদের যেসব কারণে মরুভূমিতে পাঠাতো, তার মধ্যে একটি ছিল তাদের আরবির ভিত যাতে মজবুত হয়। কমবেশি চার বছর শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) সেখানে কাটিয়েছেন। আমাদের সময়ে হিসেব করলে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে যে সময়টা বাচ্চাকাচ্চারা বাবা-মার সাথে থেকে অনেক কিছু শেখার সাথে ভাষাটাও শেখে। তো ঐ বয়সে মরুভূমির অনুকূল পরিবেশ ভাষায় তাঁর শক্ত ভিত গড়ে দিয়েছিল।

অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শিতার আগে বাচ্চাদের মধ্যে ভাষাপটুতা আগে তৈরি হয়। অনেক শিশু প্রথম বছরে বিভিন্ন শব্দ শেখে। দুই বছর থেকে চার বছরে শব্দভাণ্ডার সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। চার বছরের মধ্যে গড়পড়তী একটি শিশু হাজার খানেক শব্দ শেখে। এসব শব্দ ব্যবহার করেই তারা তাদের চাহিদা তুলে ধরে। কথা বলে। আত্মবিশ্বাস পায়।

আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, যেসব শিশুরা ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। এতে করে তাদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু আচরণ চোখে পড়ে। যেমন- উগ্র মেজাজ, অযথা চিৎকার-চেঁচামেচি।

শিশুর ভাষাদক্ষতা কীভাবে বাড়াবেন?

  • পনের মিনিট করে ওকে গল্প পড়ে শোনান। বর্ণনামূলক গল্প শিশুর কল্পনাশক্তি ও শব্দভাণ্ডার বাড়ায়।
  • ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। এতে করে ওর কথা বলার নৈপুণ্য বাড়বে।
  • ওর মধ্যেও মন দিয়ে কথা শোনার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ভাষাদক্ষতা বাড়ানোর জন্য অন্যের কথা মন দিয়ে শোনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বড়দের জন্যও এটা খুব কাজের।

মা’র মৃত্যু

এ পর্বে আমরা কথা বলব রাসূল (সাঃ) এর মা’র মৃত্যু নিয়ে। এরপর সেখান থেকে আঁর দাদার বাড়িতে লালনপালন। সেখানে কিন্তু তিনি চমৎকার আদরযত্নে লালিত হয়েছেন। প্রতিটি শিশুর শৈশব এমনই হওয়া উচিত আসলে।

মক্কায় ফিরে শিশু মুহাম্মাদ দুবছর মায়ের সঙ্গে কাটান। মা আমিনা মারা যান ২৬ বছর বয়সে। তখন মুহাম্মাদ -এর বয়স মাত্র ছয়। এত অল্প বয়সে যাদের মা মারা গেছেন, কেবল তারাই হয়ত তাঁর কষ্টটা বুঝতে পারবেন।

রোমান অর্থডক্স যাজক এবং ঔপন্যাসিক কন্সট্যান্টিন ঘিরঘিউ (Constantin Gheorghiu) তার লা ভিয়ে দে মাহোমেত (La Vie De Mahomet) বইতে সেই করুণ দৃশ্যের কল্পনা করেছেন এভাবে-

শিশু তার মায়ের কবরের পাশে বসে আর্তনাদ করছে, ‘মা, তুমি বাসায় আসো না কেন? এই জীবনে তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে?

এই বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য না। তবে এমন করুণ অবস্থার মুখোমুখী যারা হননি, তারা হয়ত এ থেকে তাঁর কষ্টের কিছুটা আঁচ করতে পারবেন। বাবাকে তো তিনি কখনো দেখেনইনি। জন্মের আগেই তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। তিনি মার খুব আপন ছিলেন। তার সাথে জড়িয়ে আছে কত না-ভোলা স্মৃতি।

বাস্তবে বলুন তো কে চায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে? কেউ না। তবে শিশুর কাছের কেউ, আপন কেউ যদি মারা যায়, বা তার সাথে বিচ্ছেদ হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় জানা জরুরি।

কীভাবে মোকাবিলা করবেন?

  • প্রথম দফাতেই তাকে মৃত্যুর খবরটা জানিয়ে দিন। কারণ ঘরের পরিবেশ দেখে এমনিতেই সে বিষয়টা আঁচ করবে। আর তাছাড়া তার জানার অধিকার তো আছেই।
  • বলার সময় বাচ্চার বয়সটাও মাথায় রাখবেন। ২ থেকে ৫ বছরের শিশুরা মৃত্যুকে ঘুমের মতো মনে করে। তারা মনে করে মৃত মানুষ ঘুম থেকে আবার উঠবে। ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী বাচ্চারা মৃত্যুর বিষয়টা বুঝবে। তবে আলাদা হয়ে যাওয়াটাকে তারা ভয় পায়।
  • বাচ্চা যেন তার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে সেজন্য তাকে উৎসাহ দিন। তার প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দিন।
  • তার মধ্যে যেন ভালোবাসা হারানোর ভয় না-ঢোকে। আর যা হয়েছে তার জন্য যে, সে কোনোভাবেই দায়ী না- এ ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করুন। কারণ, অনেক শিশুকে দেখা যায়, আপন কারও মৃত্যুতে সে নিজে নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে। এমনও মনে করে যে, সে-ই এজন্য দায়ী।

মা হারানোর পর

মা’র মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব তার নাতির দায়িত্ব নেন। আবদুল মুত্তালিব কেমন মানুষ ছিলেন সে নিয়ে পরে এক অধ্যায়ে কথা বলব। এখানে আমরা নজর দেব নবির শৈশবে তাঁর দাদুর পরিবারের ওপর।

আচ্ছা কেউ কি বলতে পারেন রাসূল (সাঃ) এর দাদির নাম কী? আমাদের সীরাহ বইগুলোতে দাদার ভূমিকা অনেক বেশি করে বলা থাকে। আসলে ঐ পরিবারের সব আয় উপার্জন তিনিই করতেন। তো সঙ্গত কারণেই তার কথা বেশি এসেছে। কিন্তু রাসূলের কিন্তু একজন দাদিও ছিল। তার নাম ফাতিমা আমর।

বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) কে ঐটুকু বয়সে মমতা দিয়ে তিনিই আগলে রেখেছিলেন। কেন রাখবেন না? তিনি তো শুধু আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মা আমিনার শাশুড়ি। রাসূল (সাঃ) এর বাবা আবদুল্লাহ তো তারই আদরের ছেলে ছিলেন।

ছয় বছর পর্যন্ত শিশু মুহাম্মাদ -এর ছায়া হয়ে ছিলেন তাঁর মা আমিনা। মায়ের মৃত্যুর পর সে অভাব পূরণ করেন দাদি ফাতিমা। রাসূলের ছোট মেয়ের নাম তো সবাই কমবেশি জানি: ফাতিমা। রাসূল (সাঃ) কি তাঁর দাদির সম্মানে মেয়ের নাম ফাতিমা রেখেছিলেন? এটা হলফ করে বলা যায় না। তবে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

অপূর্ব বালক

বালক হিসেবে রাসূল (সাঃ) ছিলেন অসাধারণ। হাদীস থেকে দেখা যায়, তাঁর দাদা ছোটবেলাতেই এটা খেয়াল করেছিলেন। বলেছিলেন এই ছেলে বড় হয়ে বিশেষ কিছু হবে। প্রায় একই রকমের ভবিষ্যদ্বাণী আরও একজন করেছিলেন। ১২ বছর বয়সে কিশোর মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন সিরিয়া সফরে যান, তখন এক সন্ন্যাসী এরকমটা বলেছিলেন।

বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন দাদার ঘরে লালিত হচ্ছেন, তখন দাদার বয়স আশির কোঠায়। খুব ভালোবাসতেন নাতিকে। তবে এই নাতি যে একসময় নবি হবেন এমন কথা তারা হয়ত কল্পনাতেও কোনোদিন ভাবেননি। তাঁর মাও কি কখনো এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন? বড় হয়ে বিশেষ কিছু হবেন এ পর্যন্তই হয়ত।

তাঁকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস তাঁর কানেও পৌঁছাত। বার বার পৌছাত। তাঁকে নিয়ে তাদের ভাবনা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। যে বাচ্চা সবসময় বাবা-মা’র মুখে শোনে সে ভদ্র, স্মার্ট, বড় হয়ে ভালো কিছু হবে- সেই বাচ্চাকে দেখবেন; আর যে-বাচ্চা প্রতিনিয়ত বাবা-মার গালি আর বকা খায়, সে বাচ্চাকে দেখবেন। দুই বাচ্চার বেড়ে ওঠাতে বিস্তর পার্থক্য খুঁজে পাবেন।

বাবা-মা’র কাছ থেকেই কিন্তু শিশুরা নিজেদের ব্যাপারে জানতে শেখে। কারণ বাবা-মা তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনে। কাজেই তাদের কথা সে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। সেখান থেকেই তার মধ্যে আত্মমর্যাদা গড়ে উঠে। তারা যা বলেন, সেগুলোর অনুরণন তার কানে বাজতে থাকে। কাজেই শিশুদের নিয়ে যা-ই বলবেন, ভেবেচিন্তে বলবেন!

বাচ্চাকাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস কীভাবে বাড়াবেন?

  • প্রতিটা শিশুর মধ্যেই প্রতিভা আছে। আপনার নিজের বাচ্চাটাও প্রতিভাবান। আপনি তার প্রতিভা আবিষ্কারে সাহায্য করুন। তার প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করুন। সে যদি দেখে আপনি তার পাশে আছেন, তাকে সাহস যোগাচ্ছেন, তাহলে সে-ও নিজের সামর্থ্য নিয়ে বিশ্বাস করতে শিখবে।
  • বলার সময় কী কী শব্দ ব্যবহার করছেন, তা নিয়ে সতর্ক থাকবেন। বিশেষ করে ও কী করবে না-করবে এ জিনিসগুলো বুঝিয়ে বলার সময় বেশি সতর্ক থাকবেন। আগে এক জায়গায় আমরা বলেছিলাম এটা করো না’- এই কথাটা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করবেন না। গঠনমূলক বা ইতিবাচকভাবে ওদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিন। আপনি কী চাচ্ছেন সেটা বলুন। যেমন- ‘চিৎকার করো না তো’ এভাবে না-বলে বলুন, ‘আস্তে কথা বল বাবা’।
  • বাচ্চার নেতিবাচক অভ্যাস বদলানোর জন্য আঘাত না-করে সহায়ক উপায় অবলম্বনের চেষ্টা করুন। যেমন : এত আলসেমি করো না’ এড়াবে না-বলে সে যেন মজাদার বা প্রোডাক্টিভ উপায়ে সময় কাটাতে পারে সে উপায় তালাশ করুন।

আট বছর বয়স পর্যন্ত বালক মুহাম্মাদ ও তাঁর দাদার সাথে ছিলেন। এরপর চলে যান তাঁর চাচার বাড়িতে। বিয়ে করার আগ পর্যন্ত ওখানেই ছিলেন। নবি মুহাম্মাদ -এর শৈশব-জীবনের শিক্ষাকে আমাদের বর্তমান জীবনে কীভাবে কাজে লাগিয়ে শিশু সন্তান প্রতিপালনে স্মার্ট হতে পারি, তার সংক্ষিপ্তসার তুলে এই অধ্যায় শেষ করছি।

নবি মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শৈশব থেকে পাওয়া শিক্ষা

বিষয়রাসূলের শৈশবআপনার শিশুর
    শৈশবে আবেগ অনুভূতিশিশু মুহাম্মাদ সবার ভালোবাসা পেয়েছিলেন। আদর-যত্ন পেয়েছিলেন। তাঁর ইমোশনাল প্রয়োজন পূরণে তাঁর মা বেশিরভাগ সময় দিয়েছেন।আপনি আপনার সন্তানকে ভালোবাসুন। আদর করুন। যত্ন করুন। চুমু খান। জড়িয়ে ধরুন। তার প্রতি ভালোবাসার জানান দিন। এতে সে আপনার ভালোবাসা আরও গভীরভাবে অনুভব করবে। আর এভাবে তার ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বিকশিত হবে।
    বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতামরুভূমি থেকে শিশু মুহাম্মাদ আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা শিখেছিলেন। সেখানে খেলাধুলা, আনন্দ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। ওখানে যা শিখেছিলেন পরিবারে এসে সেটা আরও জোরদার হয়েছে।হুমকি-ধমকি বা শান্তির ভয় ছাড়া আপনার শিশুর আচার- আচরণের উন্নতি হবে এমন পরিবেশ দিন। খেলাধুলার জন্য। যথেষ্ট সময় দিন। কারণ এভাবেই শিশুরা সবচেয়ে ভালো শেখে।
  ভাষা দক্ষতামরুভূমিতে থাকার কারণে শিশু মুহম্মদ অনেকের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। এতে করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ ও যোগাযোগের দক্ষতা বেড়েছে।বই পড়ার প্রতি আপনার সন্তানের মধ্যে ভালোবাসা জাগাতে সাহায্য করুন। তাকে গল্প বলুন। তার কথা মন দিয়ে শুনুন।
  আত্মবিশ্বাসশিশু মুহাম্মাদ নিজের ব্যাপারে ও নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সবসময় উৎসাহমূলক কথাবার্তা শুনেছেন।  আপনার শিল্প প্রতিভা খুঁজে বের করুন। তার সাথে ভালো ব্যবহার করুন। মাত্রাতিরিক্ত সমালোচনা করবেন না।

.

১. দেখুন- সেভের, হাউ টু বিহেভ সো ইয়োর চিলড্রেন উইল, টু!

২. দেখুন- রামিরেজ, ‘প্যারেন্টিং টিপস: গিভিং ইয়োর চিলড্রেন দ্যা গিফট অফ টাইম।

৩. দেখুন- ব্রুস, লার্নিং থ্র প্লে।

৪. রাসূল (সাঃ) একদিন বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। তাঁর বুক কেটে হৃদপিণ্ড বের করে সেখান থেকে কালো এক রক্তপিণ্ড ফেলে দেন। ফেলে দিতে দিতে বলেন, শয়তানের এই অংশটাই শুধু আপনার মধ্যে ছিল। স্বর্ণের এক পাত্রে ঠাণ্ডা পানিতে তিনি এরপর তার হৃদপিণ্ড ধুয়ে আবার জায়গামতো বসিয়ে দেন। কাটা জায়গাটা সেলাই করে এরপর তিনি চলে যান। (সালাহি, পৃষ্ঠা ২৭)

৫. গর্গিউ, পৃষ্ঠা- ১২

৬. আরও টিপসের জন্য দেখুন- রামসি, ফাইভ হান্ড্রেড ওয়ান ওয়েজ টু বুস্ট ইয়োর চাইল্ড’স সেল্ফ এস্টিম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *