মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কৈশোর
টিনএজ বয়সটা বেশিরভাগের জন্য বিব্রতকর। এ বয়সের ছেলেমেয়েদেরকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেওয়াটা প্রাকৃতিক ব্যাপার হলেও বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এই পদার্পণ মসৃণ হয় না। টিনএজ বয়সীদের সবকিছু নেতিবাচক না। তাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করলে, তাদের ওপর আস্থা রাখলে, তাদের আচারআচরণও ভালো হবে। তারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে। মা’র মৃত্যুর পর রাসূল ২৫ বছর বয়স পর্যন্তু চাচার সাথে ছিলেন। চাচা তাঁকে ভালোবাসতেন। স্নেহ করতেন। এ বয়সে যদি তাদেরকে ঠিকমতো বড় করে তোলা হয়, তাহলে বাবা-মা’র অনুপস্থিতিতেও তারা বিপথে যাবে না। দায়িত্বশীলভাবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে।
আস্থাভাজন হোন
অনেকের কাছে কৈশোরের বয়সটা বিব্রতকর। স্পর্শকাতর। এই অধ্যায়ের শিরোনাম দেখে কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। রাসূল (সাঃ) ও টিনএজ বয়স পার করেছেন? যা হোক, শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই ধাপ পার করেছেন। এটা নিয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই।
টিনএজ বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নানারকম হরমোনজনিত পরিবর্তন দেখা দেয়। এর ফলে তার আচারআচরণ, কথাবার্তায় পরিবর্তন আসে। সব পরিবর্তনই খারাপ না। পরিবর্তনগুলো তাদের আশপাশ ও ব্যক্তিত্ব থেকে উঠে আসে।
চ্যালেঞ্জটা কৈশোরের না। সে কোন পরিবেশে মানুষ হচ্ছে সেটা। স্বাভাবিকভাবে তারা অস্থির না; বরং খুব আবেগী। এজন্য বুদ্ধি করে তাদের সাথে চলতে হবে।
আগের অধ্যায়ে আমরা রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের বাড়তি সদস্যদের ভূমিকা দেখেছি। এখানে দেখব কিশোর বয়সে ঘরে বাইরে তাঁর জীবন প্রণালি কেমন ছিল। আমার লক্ষ্য টিনএজ বয়সীদের আত্মবিশ্বাস মজবুত করা। অন্যান্যরাও যেন বুঝেন যে, যেসব পরিবেশে ভালোবাসা আছে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক আছে, যেখানে কিশোরদের আগ্রহকে খাটো চোখে দেখা হয় না, সেখানে তারাও ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।
টিনএজ
একেক সংস্কৃতিতে কিশোর বয়সের সংজ্ঞা আলাদা। এক দেশে যে বয়সে কাউকে কিশোর ধরা হয়, অন্য দেশে তা হয় না। কোথাও আগে, কোথাও পরে। এই অধ্যায়ে আমরা শুধু রাসূল (সাঃ) এর কিশোর বয়স নিয়ে কথা বলব।
কোনো কোনো মুসলিম পাঠক হয়ত বলবেন, রাসূল (সাঃ) এর-কে তো অল্লিহি নিজে হেফাজত করেছেন। কিশোর বয়সের সমস্যাগুলো তাঁকে আমাদের মতো ফেস করতে হয়নি। রাসূলকে অবশ্যই মহান আল্লাহ সুরক্ষা করেছেন। তবে সেটা তাঁর মানবীয় গুণাবলির মধ্য থেকেই। আর মহান আল্লাহ এমন কিছু উপায়ে তা করেছেন, যা থেকে কিশোর ছেলে মেয়েদের বড় করার বেলায় যেকোনো বাবা-মা উপকৃত হতে পারেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা কাজ করেছেন মানুষদের মাধ্যমে। তারা ভালোবেসে টিনএজ রাসূল (সাঃ) কে পালন করেছে। এমন পরিবেশ দিয়েছেন যেখানে তিনি তাঁর কর্মশক্তির সুব্যবহার করতে পেরেছিলেন। আমরাও এমনটা করতে পারি।
রাসূল (সাঃ) খুব অসাধারণ জীবন কাটিয়েছেন। এমন কথা যেন আমাদের হতোদ্যম না-করে; বরং এটা যেন আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়। নইলে রাসূলের কাহিনি মানুষের মনে শুধু সমীহ জাগাবে। ভক্তি বাড়াবে। কিন্তু নিজেদের উন্নতির জন্য কীভাবে তাঁর জীবনকে আমরা বাস্তব উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, তা উপলব্ধি করতে পারব না।
ঘরে ভালোবাসা ও সম্মান
চাচা আবু তালিবের ঘরে মোট সদস্য সংখ্যা ছিল আটজন। আবু তালিব, তার স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আসাদ। তাদের সন্তান জাফর, জুমানী, ফাখিতা, আকিল, আলী ও তালিব। তাদের ঘরবাড়ির আকার, কতগুলো রুম ছিল, কেমন আসবাবপত্র ছিল- সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। তবে ঐতিহাসিকগণ বলেন, তাদের পরিবারের হাল-হাকিকত খুব একটা ভালো ছিল না। আর্থিক সমস্যার কারণে পরিবারে মাঝে মাঝে বিবাদ হতো। তবে পরিবারের পরিবেশ স্থিতিশীল ছিল। কিশোর বয়সের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো ছিল। একে অপরের কদর করত।
এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা কীভাবে তাঁকে সুরক্ষা করেছেন, সে ব্যাপারে তিনি বলেন,
তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পেয়ে আশ্রয় দেননি? আদ দ্বোহা : ৬
আশ্রয় বলতে এখানে শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের কথা বলা হয়নি; বরং স্থিতিশীল পরিবার এবং যে পরিবার টিনএজদের ভালোবাসা ও সম্মানের প্রয়োজন মেটায় তার কথাও বলা হয়েছে।
অসংখ্য গবেষণায় পাওয়া গেছে, স্থিতিশীল পরিবারে বেড়ে উঠলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হয়। স্কুলে এদের পারফরম্যান্স ভালো হয়। ড্রাগ ব্যবহার বা আত্বহত্যার মতো সমস্যাগুলোতে পড়ার আশঙ্কা কম হয়। স্থিতিশীলতা ও বোঝাপড়ার সাথে ভালোবাসা ও স্নেহও থাকতে হবে। রাসূল (সাঃ) তাঁর কিশোর বয়সে এর সবই পেয়েছিলেন।
আবু তালিব যে কিশোর মুহাম্মদকে কতটা ভালোবাসতেন তার কিছু নমুনা দিই।
- সবাই একসাথে খাওয়ার আগে তার জন্য অপেক্ষা করত।
- তাঁর কাছাকাছি ঘুমাতেন।
- সফরে বা কোথাও গেলে তাঁকে নিয়ে যেতেন।
যে ঘরে সাত সাতটা বাচ্চা থাকে, সে ঘর হয় জান্নাত নয় জাহান্নাম। আবু তালিবের স্ত্রী ফাতিমা এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। চিরায়ত জীবনীগ্রন্থগুলোতে তার ব্যাপারে খুব একটা কথা পাওয়া যায় না। রাসূলের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল তার কমই জানি। মা হিসেবে তিনি কিন্তু চমৎকার ছিলেন। রাসূল (সাঃ) এ ঘরে বড় হয়েছেনই, আলী আর জাফরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি ব্যক্তিত্বরাও। কিন্তু এ ঘরেই মানুষ হয়েছেন। চাচীর ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) একবার বলেছিলেন, চাচার পর চাচীর মতো আর কেউ আমার প্রতি এত দরদি ছিলেন না। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর সাথে বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) এ বাড়িতে ছিলেন। প্রায় সতের বছর। এ বাসা ছেড়ে দেওয়ার পরও চাচীর সাথে তার সম্পর্ক কমেনি; বরং বেড়েছে।
আবু তালিবের মৃত্যুর পর চাচী ফাতিমা বিনতে আসাদ ইসলাম কবুল করেন। এরপর তার ছেলে আলী ও বউমা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমার কাছে চলে আসেন। ছোট থাকতে রাসূলকে চাচী যেভাবে যত্নআত্তি করেছেন, নবিকন্যা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহুও তার শাশুড়িকে সেভাবে যত্নআত্তি করেছেন। দুজন ফাতিমার মধ্যে গুলিয়ে ফেলবেন না। ফাতিমা বিনতে আসাদ রাসূলের চাচী। আর ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ রাসূল (সাঃ) এর কন্যা।
মদিনায় মৃত্যুর আগপর্যন্ত চাচীর কাছাকাছি ছিলেন রাসূল। তার মৃত্যুর পর তিনি নিজ হাতে তার কবর খুঁড়েছেন তার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে। তার জন্য দোয়া করেছেন। আপনিও আপনার টিনএজ ছেলে মেয়েদের সাথে মজবুত সম্পর্ক গড়ুন, যে। সম্পর্ক দিনদিন শুধু বাড়বেই।
কিশোরদের সমর্থন দরকার
কিশোরদের জন্য বয়সটা শঙ্কুল। তাই পরিবারের উচিত সবধরনের সহায়তা করা। আদর-যত্ন ভালোবাসা দেওয়া। এগুলো ম্যাজিকের মতো। কাজ করে, কারণ,
- ওরা মানুষের আকর্ষণ চায়। মূল্যায়ন চায়। আপনি সেটা দিচ্ছেন।
- ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
- আত্মবিশ্বাসের সাথে ওরা দায়িত্ববান হয়।
প্রথমে মা, এরপর দাদি, তারপর চাচী- সবার কাছেই রাসূল (সাঃ) আদর ভালোবাসায় মানুষ হয়েছেন। বিনিময়ে তিনিও তাঁর চাচা-চাচীর ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছেন। চাচাকে সাহায্যের জন্য তিনি রাখাল হিসেবে কাজ করেছেন। চাচার মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সেই একই বছরে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাও মারা যান। সে বছরটা দুঃখের বছর নামে পরিচিত। চাচীর মৃত্যুতেও তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি নিজ হাতে তাঁর কবর খুঁড়েছেন। মহান আল্লাহর কাছে তার মুক্তির জন্য দোয়া করেছেন।
আপনি কিভাবে টিনএজদের ভালবাসবেন
- তার অর্জনগুলো উৎযাপন করুন।
- তাকে বিচার না-করে বা বাধা না-দিয়ে তার কথা মন দিয়ে শুনুন।
- তাকে জানান যে, আপনি তাকে ভালোবাসেন, তার মূল্যায়ন করেন।
সম্মান
ভালোবাসার সাথে সম্মানও দরকার। রাসূল (সাঃ) এর পরিবার তাকে সর্বোচ্চ সম্মান করত। এটা তার বিশুদ্ধ ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করেছে। যে কারণে তিনি ছোট বয়স থেকেই দায়িত্বশীল আচরণ করেছেন। উনি কীভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করেছেন, আর আপনি তা থেকে কী ফায়দা নিতে পারেন চলুন দেখি-
রাসূল (সাঃ) এর ব্যবহার | আপনার আচরণ |
রাসূল (সাঃ) তখন ১২ বছরের বালক। এক সন্ন্যাসী তাঁকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য শর্ত দিলেন লাত আর উয্যার কসম কাটতে। তিনি বললেন, ‘লাত, উয্যার নামে আমাকে কিছু বলতে বলবেন না। আল্লাহর কসম, এদেরকে আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি। এখন আপনি আপনার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। | সংখ্যায় বেশি হলেই কারও মত অনুসরণের যোগ্য হয় না। রাসূল (সাঃ) এর আশেপাশে বেশিরভাগই ছিল মূর্তিপূজারি! কিন্তু তিনি তা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। সুতরাং ভদ্রভাবে এবং অন্যের মতের প্রতি সম্মান রেখে নিজের বিশ্বাস প্রকাশ করুন। |
চাচা-চাচী, চাচাতো ভাইবোনদের সাথে বসে ধীরে-সুস্থে খাবার খেতেন। গোগ্রাসে গিলতেন না। খাওয়া শেষ করেই হুটহাট উঠে যেতেন না। | কোনো কিছু নিয়ে অধৈর্য হবেন না। পীড়াপীড়ি করবেন না। ধৈর্য ধরুন। কিছু চাইতে হলে সুন্দর করে সম্মান রেখে চান। |
ঘুম থেকে উঠে ঘুমকাতুরে চোখ আর উষ্কুখুষ্কু হয়ে তিনি বের হতেন না। অন্যান্যদের সাথে দেখা করার আগে চোখমুখ ধুতেন। চুল আঁচড়াতেন। | ঘরে পরিবারের ভেতরেও নিজের অ্যাপিয়ারেন্সের খেয়াল রাখুন। |
মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার নিয়ে আবু তালিবের সুনাম ছিল। মক্কাবাসী তাকে বেশ শ্রদ্ধা করত। যদিও তার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আর গরিবদেরও সে সমাজে খুব একটা সম্মানের চোখে দেখা হতো না। আদি আরব ঘটনাপঞ্জিতে আছে, আবু তালিব আর উতবা ছাড়া গরিব কুরাইশদের মধ্যে কেউ শক্তিশালী ছিল না। টাকাপয়সা ছাড়াই এরা ক্ষমতাশালী হয়।
আবু তালিবের আবির্ভাব ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম। তার নিষ্কলুষ নৈতিকতার কারণেই এমনটা হয়েছে। তার স্ত্রী, ছয় সন্তান এবং ভাতিজা মুহম্মদ (সাঃ) এর সাথে আচরণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। টিনএজারদের জন্য শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ।
রাসূল (সাঃ) যে এমন একটা পরিবেশ পেয়েছেন, তার কারণ আবু তালিব ব্যক্তি হিসেবে এমনই ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ) কে কখনো মারধোর করেছেন, গালিবকা দিয়েছেন বা কাউকে নিয়ে ঠাট্টা করেছেন- এমনটা কল্পনা করা কঠিন। তার মতো সম্মানিত একজন ব্যক্তির পক্ষে এসব বেমানান।
একবার ভেবে দেখেন, এই চাচার বাসায় বড় না হয়ে তিনি যদি চাচা আবু লাহাবের ঘরে বড় হতেন, তাহলে কি তিনি একই আচরণ পেতেন? টিনএজ ছেলেমেয়ে ঘরে কতটা সম্মান পাবে, সেটা তার নিজের চেয়ে বেশি নির্ভর করে কারা তার দেখাশোনা করছে তার ওপর। চলুন দেখি, আবু তালিব কীভাবে রাসূল (সাঃ) এর এই বয়সটা ব্যবহার করেছেন, আর আপনি তা থেকে কী ফায়দা নিতে পারেন।
কিশোর রাসূল (সাঃ) এর সাথে আবু তালিব
তিনি যখন দেখলেন অন্যান্যদের মতো মুহাম্মাদ এক বসায় সব গোগ্রাসে গেলে না, তখন তিনি নিজে তার জন্য আলাদা করে খাবার রেখে দিতেন। খাবারে বসার সময় তিনি তাঁকে সাথে নিয়ে বসতেন। বলতেন, “তুমি আমাদের জন্য বারকাত। রাসূল (সাঃ) বসা না-পর্যন্ত তিনি ও তার পরিবারকে খাওয়া শুরু না-করতে বলতেন।
আপনার টিনএজের সাথে আপনার ব্যবহার
টিনএজদের পার্থক্যগুলো সম্মান করুন। তার ব্যক্তিত্বের জন্য সঠিক পরিবেশ দিন, কারণ তার নিজস্ব প্রয়োজন থাকতে পারে। এতে করে ছোটখাটো কলহের পরিমাণ কমবে। তাদের বিকাশে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে। আপনার টিনএজ সন্তানের কদর বুঝুন। তাকে বলুন আপনি তার নৈপুণ্য আর দক্ষতায় কত খুশি। এটা তার আত্মবিশ্বাস গড়ে দেবে।
টিনএজ বয়সীদের কীভাবে সম্মান দেখাবেন
- ভুল করলে তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করুন।
- তাদের ব্যক্তিত্ব বিকৃত না-করে আচরণ বদলানোর চেষ্টা করুন।
- মন দিয়ে তাদের কথা শুনুন, কথার মাঝখানে বাগড়া দেবেন না।
- তাদের অপমান করবেন না। অন্যের সামনে গালিগালাজ, বকাবকি করবেন না।
কিশোর-কিশোরীদের প্রতিভা ও সম্ভাবনায় বিশ্বাস রাখা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অন্যতম অংশ। আবু তালিব রাসূল (সাঃ) এর ভবিষ্যতে বিশ্বাস করতেন। তিনি যে একসময় বিশেষ কেউ হয়ে উঠবেন, অনেকের কাছে তা শুনেছেন। একবার এক লোক রাসূল (সাঃ) কে দেখে আবু তালিবকে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম, এই ছেলে একদিন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে। আরেকবার এক সফরে বাহিরা নামে সিরিয়ান এক যাজকের সাথে দেখা হলে আবু তালিবকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার এই ভাতিজার ভবিষ্যৎ ভালো’।
রাসূল (সাঃ) যে বিশেষ কিছু সেটা শিশু বয়সেই তাঁর মা ঠাহর করেছিলেন। মা’র ধারণা কখনো ভুল হয় না। তিনি বলেছিলেন, ‘ও বিশেষ কিছু হবে’। রাসূল (সাঃ) যখন দাদার বাড়িতে থাকতে গিয়েছিলেন তখন দাদাও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন।
আগেই বলেছি, টিনএজদের মধ্যে অনেক প্রাণশক্তি, সম্ভাবনা। কিন্তু সেগুলো বিকশিত হবে না, যদি তারা এমন পরিবেশ না পায় যেখানে তাদের কদর বুঝা হয়, তাদের বিশ্বাস করা হয়। আপনার টিনএজ সন্তান কী করছে, তার বেশিরভাগের সাথে হয়ত আপনি একমত হবেন না। কিন্তু তার মানে এই না যে, সে যে কর্মশক্তি ব্যবহার করছে আপনি তা সম্মান করবেন না, বা তার ভবিষ্যত সম্ভাবনায় বিশ্বাস করবেন না।
বাহিরা সন্ন্যাসী যখন বলেছিলেন যে, তাঁর মধ্যে অমিত সম্ভাবনা আছে। তিনি অবশ্যই নবি হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আপনার সন্তান নবি হবে না; তবে সে যে একদিন নামকরা কেউ হবে না, তা তো না।
ঘরের বাইরে
আমরা দেখেছি রাসূল কী ধরনের পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। দেখেছি কিশোর-কিশোরীদের জন্য এ ধরনের পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেকে মনে করেন কিশোর-কিশোরীদের সমস্যা বাইরে থেকে উদ্ভব হয়। রাস্তাঘাট, ফুল বা বন্ধুবান্ধবদের থেকে। কথাটা পুরোপুরি ঠিক না; তবে কিছু সত্য।
প্রযুক্তি আজ ঘরে-বাইরের সীমারেখা মুছে দিয়েছে। ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের কারণে একসময় যেসব কাজ শুধু বাইরে করা যেত, এখন তা ঘরে বসেই করা যায়।
সপ্তম শতাব্দীতে সন্তান লালনপালনের যে-চ্যালেঞ্জ ছিল, আজ তা ভিন্ন। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, স্কাইপচ্যাটসহ এরকম অসংখ্য উপায় উপকরণের মাধ্যমে বন্ধুরা ঘরবাড়ি বা স্কুলের বাইরে থেকেও আপনার সন্তানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
তবে লালনপালনের মূলনীতিগুলো সবসময় এক। টিনএজ বয়সের ছেলেমেয়েদের কীভাবে সামলাতে হবে তা কিন্তু বদলায়নি। কিশোর- কিশোরীদের চরিত্র ঘরে শিশুকাল থেকেই গড়ে তুলতে হয়। যাতে সে বাইরের উস্কানি থেকে নিজেকে সামলাতে পারে। সেই উস্কানি যত ভিন্ন বা আধুনিক বেশেই আসুক না কেন। বাসাবাড়ির পরিবেশ এবং মা-বাবার সাথে টিনএজ বয়সী ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক সন্তান লালনপালনের ফাউন্ডেশন। তবে আমাদের সময়ে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সেগুলোও মাথায় রাখতে হবে।
আমরা এখন দেখব বন্ধুবান্ধব, কাজেকর্মে, সফরের সময় রাসূল (সাঃ) এর চলাফেরা কেমন ছিল। আমরা দেখব ঘরে-বাইরে সব জায়গায় আল্লাহ কীভাবে তাঁকে হেফাজত করেছেন। এগুলোর পেছনে কিশোর-কিশোরীদের দেখভাল করার কিছু উপায় পাব, যেগুলো থেকে আমরাও লাভবান হবো। যেমন- আমরা যদি তার বিবেক বিশুদ্ধ রাখি, ধার্মিকতার শিক্ষা দিই, তাহলে রাস্তাঘাটেও ঘরের শিক্ষা তাকে গাইড করবে।
পিয়ার প্রেশার
পরিবেশের যে দিকটা কিশোর-কিশোরীদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তা হলো বন্ধুবান্ধব। এমনকি মা-বাবার চেয়েও। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য বন্ধুবান্ধব খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল (সাঃ) এর কিশোর বয়সে অবশ্যই বন্ধুবান্ধব থেকে থাকবে। কিন্তু তারা যেহেতু কজন ছিলেন বা তাদের নাম কী ছিল তা জানি না, তাহলে আমরা তাদের চিনব কীভাবে?
তাঁর বন্ধুবান্ধব কুরাইশ গোত্রের হওয়া স্বাভাবিক। এক প্রতিবেশীদের মধ্যেই কেউ হবেন। কারণ এক গোষ্ঠীর লোকেরা কাছাকাছি থাকত। বালক বয়সে তিনি প্রতিবেশীর ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করেছেন। এসব ক্ষেত্রে বাইরে নানামুখী কঠিন নৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হওয়া খুব স্বাভাবিক। আর সে কারণেই টিনএজ ছেলেমেয়েদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাবা-মা’র এত চিন্তা।
রাসূল (সাঃ) একবার বলেন,
‘আমি একবার কুরাইশ ছেলেদের সাথে ছিলাম। একটা শিকারের জন্য পাথর বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা সবাই নগ্ন ছিলাম। কারণ, সবাই তাদের কটিবস্ত্র ঘাড়ে করে নিয়ে পাথর বহন করছিল। আমিও তাই করছিলাম। এভাবে যখন হাঁটছিলাম, তখন কে যেন আমাকে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মেরে বলল, কটিবস্ত্র পরো। আমি তখন পরে নিলাম। খালি ঘাড়েই পাথর নিয়ে নিলাম। সেই গ্রুপে কেবল আমিই ছিলাম যে কটিবস্ত্র পরেছিল।
এই ঘটনা থেকে টিনএজ বয়সীদের ওপর বন্ধুবান্ধবদের প্রভাব বেশ বুঝা যায়। এই প্রভাব মনস্তাত্ত্বিক, আবেগের।
বিবেক
এই ঘটনাকে মুসলিমগণ মহান আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখে। কিন্তু সাধারণ টিনএজ বয়সীরা কীভাবে নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচাবে? সেই সমাজে বালকেরা যখন কাঁধে ভারী কোনো বুঝা নিত, তখন কটিবস্ত্র কাঁধে নিয়ে, সেখানে রেখে বহন করা একদম স্বাভাবিক ছিল। রাসূল (সাঃ) এর ক্ষেত্রে এখানে পরিবারের ভূমিকা পালন করেছে মহান আল্লাহর হস্তক্ষেপ।
রাসূল (সাঃ) এর ক্ষেত্রে যেভাবে হয়েছে টিনএজ বয়সী সবার ক্ষেত্রে সেভাবে হস্তক্ষেপ হবে না। কাজেই সন্তানদের মধ্যে এই বিবেকবোধ গড়ে তুলতে হবে পরিবারকে। সেই বিবেক তার কানে সুমন্ত্রণা দেবে। নেগেটিভ পিয়ার প্রেশার দমাবে। সিগারেট, মাদক, মেয়ে দেখলে শীষ দেওয়া। এসব থেকে তাকে দূরে রাখবে।
কিশোর-কিশোরীরা যদি একটা ভুল করে বসে, তার বিবেক তখন তাকে প্রচণ্ড ঘুষি মারবে। ভুলকে অভ্যাসে পরিণত হতে দেবে না।
উদাহরণ দিয়ে প্যারেন্টিং
স্যাল সিভিয়ার একটা বই লিখেছেন ‘হাউ টু বিহেভ সো ইয়োর চিলড্রেন উইল টু’ নামে। সেখানে তিনি বলেছেন, কীভাবে প্রাক-স্কুল সময়ে শিশুদের বিবেক শুরু হয় এবং মা-বাবার সাহায্যে তা আরও গড়ে ওঠে। একসময় এটা তাদেরকে ভালো-খারাপ বেছে নিতে সাহায্য করে (সিভিয়ার, ১০৪-১০৫)। ধৈর্য নিয়ে বাচ্চাদের শেখালে, ধারাবাহিকভাবে গাইড করলে বাচ্চা তার মা-বাবার কণ্ঠ নিজের মধ্যে নিয়ে নেয়। সেটা তার নিজের অংশ হয়ে যায়। সে যদি কোনো খারাপ আচরণে প্রলুব্ধ হয়, তাহলে সেই ভয়েস তাকে ভালো কাজে উদ্দীপ্ত করবে। তীক্ষ্ন বিবেচনাবোধ কিশোর-কিশোরীদের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে।
কীভাবে টিনএজদের বিবেক গড়ে তুলবেন
- ভুল করে ফেললে সুন্দরভাবে বুঝান। তার অর্জনে নিজের গৌরব দেখান। কারণ এটা তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবে।
- তার জন্য এমন বন্ধুবান্ধব খুঁজুন যারা ইসলামের আদর্শ বুকে ধারণ করে। তাহলে আপনার অনুপস্থিতিতে তারা তাকে পথ দেখাবে।
- অন্যরা পছন্দ করুক কী না করুক, তাকে তার আদর্শে অবিচল থাকতে শেখান। ‘না’ বলার সামর্থ্য গড়ে তুলুন।
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ
কিশোর-কিশোরীদের মাঝে যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগা স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা দমানো চ্যালেঞ্জ না। কারণ, এটা মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, একে গাইড করা।
নবি (সাঃ) নিজে এ ব্যাপারে বলেন,
ইসলামপূর্ব যুগে মানুষরা যেভাবে নারীদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল, আমি তেমন ছিলাম না। তবে দুরাত বাদে। সেই দুরাতে আল্লাহ আমাকে সুরক্ষা করেছিলেন। এক রাতে আমি মক্কার কিছু ছেলেপুলের সাথে ছিলাম। আমরা পশুর পাল তদারকি করছিলাম।
আমি আমার বন্ধুকে বললাম, ‘আমার ভেড়াগুলোকে দেখো, যাতে আমি মক্কার অন্যান্য ছেলেদের মতো মক্কায় কাটাতে পারি। সে বলল ঠিক আছে। তো আমি গেলাম। আমি যখন মক্কার প্রথম বাসায় পৌছালাম, তখন আমি তাম্বুরিন ও বাঁশিসহ বাজনা শুনতে পেলাম। আমি দেখার জন্য বসলাম। আল্লাহ আমার কানে আঘাত করলেন। আমি শপথ করছি, সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি আমাকে ঘুম থেকে ওঠাননি।
অন্য একরাত। আমি তাকে বললাম, ‘আমার ভেড়াগুলোকে দেখো, যাতে আমি মক্কায় রাত কাটাতে যেতে পারি। যখন মক্কায় এলাম, গতবার যেমন আওয়াজ শুনেছিলাম, এবারও শুনলাম। আমি দেখার জন্য বসলাম। আল্লাহ আমার কানে আঘাত করলেন। আমি শপথ করছি, সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি আমাকে ঘুম থেকে ওঠাননি। ঐ দুই রাতের পর আমি কসম করে বলছি, আর ওসবের ধারে কাছে যাইনি’।
রাসূল (সাঃ) ও দুবার চেষ্টা করেছিলেন পার্টিতে যোগ দিতে। কিন্তু দুবারই আল্লাহ তাকে বাধা দিয়েছেন তাঁকে অজ্ঞান করে দিয়ে। ভবিষ্যৎ নবির জন্য এটা ছিল মহান আল্লাহর বিশেষ সুরক্ষা। এই ঘটনা থেকে আপনার টিনএজ বয়সী ছেলেমেয়েরা কীভাবে ফায়দা নেবে?
রাসূল (সাঃ) কি তার কিশোর বয়সে পার্টিতে যেতে চেয়েছিলেন, এমনকি দুবার চেষ্টা করেছিলেন, এটা এই কাহিনির মজার দিক না; বরং তিনি যে তৃতীয়বার আর চেষ্টা করেননি সেটাই এই ঘটনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। এটা আপনার কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েদের অনুপ্রেরণা দিতে পারে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ সবসময় খারাপ থামাতে চান না। কখনো কখনো একে কঠিন করে তোলেন। খারাপ কাজ করার সময় টিনএজ বয়সী ছেলেমেয়ে প্রায়ই তার প্রথম চেষ্টায় হোঁচট খাবে। খারাপ পথ সোজা এমনটা যেন সে না-ভাবে সেটাই আল্লাহ চান। পথেঘাটে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখেন যা তাকে দু একবার বাধা দেয়।
যেমন, সে হয়ত প্ল্যান করেছে খারাপ কোনো জায়গায় যাবে। খারাপ জায়গা বলতে কনসার্ট, সিনেপ্লেক্স এ ধরনের জায়গাও হতে পারে, যেগুলোকে আজকাল ঠিক ‘খারাপ’ বলা হয় না। তো দেখা গেল যেদিন যাবে বলে ঠিক করেছে সেদিন অসুস্থ হয়ে গেল। ইন্টারনেটে খারাপ কিছু দেখতে চাওয়ার সময় হঠাৎ করে নেটের লাইন চলে গেল। অথবা প্রথমবার সিগারেট খাওয়ার সময় লাগাতার কাশি।
এখন বাধাগুলোকে সে স্বাভাবিকভাবে নেবে, না আল্লাহর তরফ থেকে সতর্কবাণী হিসেবে নেবে, সেটা নির্ভর করে ছোটবেলায় বাবা-মা তাকে কীভাবে বড় করেছেন তার ওপর। তারা ভাবতে পারে এগুলো দৈব কাকতাল, যে কারও বেলাতেই হতে পারে। অথবা তারা এমনও ভাবতে পারে যে, তাদের খারাপ পথ থেকে থামানোর জন্য এগুলো মহান আল্লাহর তরফ থেকে সতর্কবাণী। তো দেখা যাবে দুতিনবার চেষ্টায় বাধা পাওয়ার পর সে নিজেই তার আচরণ বদলে ফেলল।
মা-বাবার দায়িত্ব হলো ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। যাতে করে যদি সে পিছলে পড়ে, তার বিবেক তাকে উঠিয়ে আনবে। এটা যাতে অভ্যাসে পরিণত না-হয় তা থেকে বাধা দেবে। এটাই একজন টিনএজ ছেলেমেয়েকে আস্থাভাজন করে। নির্ভরযোগ্য করে।
আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর কানে আঘাত করে তাকে অচেতন করে দিয়েছিলেন পার্টিতে পৌছানোর আগেই। ভুল পথে যাওয়ার চেষ্টায় আপনি যেসব বাধা পান সেগুলো আসলে আপনার প্রতি মহান আল্লাহর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত। তিনি চান না যে, আপনি অন্ধকারে যোগ দেন। প্রতিবন্ধকতার পেছনের মানে বুঝার চেষ্টা করুন। এগুলো এমন সাধারণ কিছু না, যা যে কারও ক্ষেত্রেই হতে পারে।
কাজ
এই অধ্যায়ের বাকি অংশে রাসূল (সাঃ) এর কাজ ও সফর নিয়ে কথা বলব। বলব কীভাবে টিনএজ বয়সীরা এ থেকে উপকৃত হতে পারে। রাসূল (সাঃ) এর কাজকর্ম শুরু রাখাল হিসেবে। চাচা আবু তালিবকে সাহায্য করার জন্য এ কাজ করতেন। এভাবে তিনি প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। রাসূল (সাঃ) একবার বলেছিলেন, এমন কোনো নবি নেই যে, রাখাল ছিল না।
রাখালের কাজ গবাদিপশুর খাওয়াদাওয়া সংগ্রহের মতো সহজ কিছু না। এ কাজের জন্য বেশকিছু ব্যক্তিগত দক্ষতা ও গুণ লাগে।
- নেতৃত্ব: পশুগুলোকে কোন পথে নিয়ে যেতে হবে। খাওয়ানোর জন্য কোথায় থামতে হবে।
- সততা: ভেড়াগুলোকে সততার সাথে ব্যবস্থাপনা করতে হয়। মালিকের বিশ্বাস ভাঙা যায় না। যেমন অনুমতি ছাড়া ওগুলোর দুধ খাওয়া।
- ফোকাস: মুহুর্তের মনোযোগ হারিয়ে ফেললে পালের ভেড়া হারিয়ে বা চুরি হয়ে যেতে পারে।
- মমতা: পশুপালের সাথে মমতার সম্পর্ক গড়ে তোলা, এমন যে আপনি আপনার প্রতিটা ভেড়াকে একটা একটা করে চেনেন।
- লেগে থাকা:বৈরি, কঠিন আবহাওয়া সহ্য করা ও দীর্ঘ সময় ধরে দেখাশোনা করা।
ভৌগলিকবিদেরা পৃথিবীজুড়ে পাঁচটি অঞ্চলকে শতায়ুদের ‘ব্লু জোন’ বলেছেন। এসব অঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু বেশি। এগুলোর মধ্যে আছে জাপান, গ্রিসের দ্বীপ অঞ্চল ও ইতালির সারাদিনিয়া দ্বীপ।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলছে এই অঞ্চলগুলো একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে। কিন্তু তাদের জীবনযাপনের কিছু ব্যাপার এক। যেমন- পারিবারিক জীবন। এদের মধ্যে ধূমপান নেই। শারীরিক কাজে গুরুত্ব দেয় এরা। ম্যাগাজিনে বলেছে যে, এসব অঞ্চলের বুড়োরা বয়স হলেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না; বরং কম-চাপের কাজে ব্যস্ত থাকে। যেমন গবাদিপশু দেখাশোনা।
গবাদিপশু দেখাশোনা আপনার কিশোর-কিশোরীর জন্য আদর্শ ক্যারিয়ার এটা এখানে প্রমোট করা হচ্ছে না। বলতে চাচ্ছি, যদি কিশোর-কিশোরীরা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করে তাহলে তারা মানসিকভাবেও অনেক শান্তিতে থাকবে। এবার আমরা সফর নিয়ে কথা বলব। দেখব কীভাবে সেটা একজন টিনএজের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে।
সফর
সাধারণভাবে টিনএজরা রুটিন অপছন্দ করে। সফর ও পরিবর্তন পছন্দ করে। ১৩ বছর বয়সে আবু তালিব যখন সিরিয়া সফরে গেলেন, তখন রাসূল (সাঃ) তার সাথে যাওয়ার আগ্রহ দেখালেন। এই বয়সে মক্কা থেকে সিরিয়া সফর খুব কষ্টকর। এর দূরত্ব প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। ২০-৩০ দিনের সফর। পিচঢালা পথে গাড়িতে করে যারা মক্কা থেকে দামাস্কাস গিয়েছেন তাদেরই অনেকে সফরের ক্লান্তি নিয়ে অভিযোগ করেন। তাহলে উটে চড়ে সেখানে যাওয়া কেমন ছিল ভেবে দেখেন।
কিশোর-কিশোরীরা যদিও প্রাণশক্তিতে ভরপুর এবং তারা রোমাঞ্চ পছন্দ করে, কিন্তু রাসূল (সাঃ) এর জন্য এ যাত্রা খুব কঠিন হওয়ার কথা। একে তো এত লম্বা দূরত্ব সফরের অভিজ্ঞতা আগে তাঁর ছিল না। অন্যদিকে বাণিজ্য কাফেলায় তার সমবয়সী আর কেউ না-থাকায় তার মধ্যে বিরক্তি চলে আসাটা স্বাভাবিক ছিল।
আমি জানি না এই সফরে সফরকারীরা কীভাবে সময় কাটিয়েছিলেন। কী কী দর্শনীয় স্থান তারা দেখেছিলেন, তবে নিচের জিনিসগুলো দেখার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে:
- ঐতিহাসিক স্থান: মাদাইন সালিহ। আজকের দিনে উত্তরপশ্চিম সাউদি আরাবিয়া। নাবাতি সভ্যতা পাথরে কেটে এই শহর বানিয়েছিল। আধুনিক জর্দানের পেত্রা শহরের মতো। অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে আছে সোড়োম ও গোমরাহ। রোমানদের তৈরি মসৃণ রাস্তা।
- বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক লীলা ও আবহাওয়া: মক্কার আশেপাশের পাহাড় ও সমভূমি; ওয়াদি সারহানের জলাভূমি, বর্তমানে এটা জর্দান-সাউদির সীমান্তের কাছে; নেফুদ, প্রচুর উপবৃত্তাকার নিচু জায়গা ও মরুভূমি; জর্দানে সাত ঘুমন্ত যুবকের গুহা। উত্তর আরব উপদ্বীপ দিয়ে লোহিত সাগরের পাশ ঘেঁষে কাফেলা দক্ষিণ সিরিয়ায় বসরায় নেফুদ মরুভূমি পার করেছে।
- বিভিন্ন সমাজ ও ধর্ম: হিজাজের মূর্তিপূজারি, মদিনার ইহুদি গোষ্ঠী, লাখমিদ, বানু জুদহাম ও গাসসানিদ গোত্রের খ্রিষ্টান আরব, ও সন্ন্যাসীরা, যার মধ্যে একজন ছিল বাহিরা।
সফর করা আজকাল অনেকের সামর্থের মধ্যে সহজও। তাই টিনএজ বয়সীদের জন্য সফর আসল চ্যালেঞ্জ না; বরং, সেই সফরকে তারা নিজেদের ও নিজেদের ব্যক্তিগত সামর্থ্য বিকাশে কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা চ্যালেঞ্জ। এটা যেকোনো বয়সী মানুষদের জন্যও খাটে।
সিরিয়া সফরের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) নিজে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানগুলো দেখেছেন। তাঁর চাচার সাথে বিভিন্ন বাজারে ঘুরে ঘুরে নানান সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রথার মুখোমুখী হয়েছেন। বাহিরা সন্ন্যাসীর সাথে দেখা হয়েছে।
নিজের থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের সাথে মেশা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিশোর-কিশোরীদের উন্মুখ হয়ে থাকা দরকার। যেগুলো তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে সবসময় সেসব খুঁজা উচিত তাদের। নিচের টেবিল আপনাকে মনে করাবে কীভাবে একজন টিনএজ বয়সী তার টিনএজ বয়সের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে, আর কীভাবে রাসূল (সাঃ) কিশোর বয়সের কঠিন সময় নিরাপদে পার করেছিলেন।
রাসূল (সাঃ) এর কিশোর বয়স থেকে ফায়দা
রাসূল (সাঃ) এর কৈশোর | আপনার কৈশোর |
রাসূল (সাঃ) তাঁর চাচাকে সাহায্য করার জন্য রাখালের দায়িত্ব পালন করেছেন। | আপনার বাবা-মাকে সাহায্য করুন। এমনকি যদি তারা সরাসরি সাহায্য। না-ও চায়। |
রাসূল (সাঃ) তাড়াহুড়ো করে খেতেন না। বিশেষ করে যখন অনেকের সাথে বসে একসঙ্গে খেতেন। | কিছু চাওয়ার সময় ধৈর্য ধরুন,ভদ্র থাকুন। বন্ধুত্বপূর্ণ থাকুন। |
রাসূল (সাঃ) সবসময় চুল আঁচড়ে রাখতেন। ছিমছাম থাকতেন। | আপনার সামগ্রিক বাহ্যরূপের খেয়াল রাখুন, এমনকি যদি বাসায় পরিবারের সাথে থাকেন তবুও। |
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে সুরক্ষা করেছিলেন গায়েবি আওয়াজের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর কটিবস্ত্র পরতে বলে। | আপনার অভ্যন্তরীণ ভয়েস ও বিবেক আপনাকে বলে দিক কোনটা খারাপ। কোনটা ভালো। আস্থাভাজন থাকুন। এমনকি যদি আপনি বাবা-মা বা অন্য জ্ঞানী কারও তত্ত্বাবধান থেকে দূরে থাকেন তবুও। |
খারাপ পথে যাওয়া থেকে আল্লাহ রাসূল (সাঃ) কে নিরাপদ রেখেছিলেন। রাসূল (সাঃ) শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। | আপনার বেলায় আল্লাহ হয়ত এমন প্রকাশ্য হবেন না। কাজেই আপনাকে তাঁর সুরক্ষার নিদর্শন খুঁজে নিতে হবে। |
রাসূল (সাঃ) বাহিরা সন্ন্যাসীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মূর্তিপূজারীদের দেবদেবীর নামে কসম কাটবেন না। | কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই অন্ধের মতো তাদের অনুকরণ করবেন না। নিজের বিশ্বাস ভদ্রোচিতভাবে জানিয়ে দিন। |
রাসূল (সাঃ) সিরিয়ায় সফর করেছিলেন। সেই কাফেলায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে কমবয়স্ক। | নিজেকে নতুন রোমাঞ্চের সামনে উন্মোচিত করুন। যা দেখেন তা দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করুন। |
.
১. আরও টিপসের জন্য দেখুন: বিড্ডালফ, রেইজিং বয়েজ এবং একই লেখকের রেইজিং গার্লস।