প্লেন যখন ইংলিশ চ্যানেলের উপর দিয়ে যাচ্ছে তখন ছোকরা মুখুজ্যে শুধালে, চাচা, লন্ডনে গিয়ে উঠব কোথায়, চিন্তা করেছেন কি? ছোকরা এই প্রথম বিলেতে যাচ্ছে, প্রশ্নটা অতিশয় স্বাভাবিক। আমি বললুম, বাবাজি, কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না। রসুই বামুন না হলেও তুমি তো ব্রাহ্মণসন্তান বটে। হাটে গিয়ে চাল-ডাল কিনে নিয়ে আসবে; আমি ততক্ষণে বটগাছতলায় হঁটের উনুন জ্বালিয়ে রাখব। শুনেছি লন্ডনের উপর বিস্তর বোমা পড়েছিল, ইঁট পেতে অসুবিধে হবে না।
এ্যারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরও যখন বটগাছ পাওয়া গেল না, তখন বাধ্য হয়ে হোটেলে উঠতে হল।
রসিকতা নয়, একটুখানি সবুর করুন।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায়ই মুখুজ্যের বয়সীই তার এক ইংরেজ বন্ধু এসে উপস্থিত। ছোকরা খাঁটি ইংরেজ, লড়াইয়ের সময় ভারতবর্ষে এসেছিল, এ দেশটাকে এতই ভালোবেসে ফেললে যে শেষ পর্যন্ত দিশি মেম নিয়ে বিলেতে গেল। বললে, এদেশের লোক ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এমনি অগা যে, সেদিন এক গবেট বিবিসিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললে, ভারতবর্ষের এক-তৃতীয়াংশ লোক বাইরে শোয়। আমি ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে বিবিসিতে কড়া চিঠি লিখেছি।
আমি বললুম, এতে চটবার কী আছে? কথাটা তো সত্যি। গরমের দেশের লোক ১১৪ ডিগ্রিতে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে ঘরের ভেতর শোবে নাকি? তোমাদের দেশের লোক মাইনাস দশ ডিগ্রিতে যদি বাইরে শোয় তবে মরে যাবে। আমাদের দেশের লোক গরমে ঘরের ভিতর দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে না বটে, কিন্তু সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে হবে। হিট হার্টস, কোল্ড কিলস।
এই কোল্ড কিলস নিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্য সভ্যতার পার্থক্য, বটগাছতলা আর হোটেলের পার্থক্য।
গরমের দেশে জীবন ধারণের জন্য অত্যধিক সাজ-সরঞ্জাম আসবাবপত্রের প্রয়োজন হয় না; পক্ষান্তরে শীতের দেশে পাকাঁপোক্ত ঘরবাড়ি চাই, মেঝেতে শোয়া যায় না; লেপ-কম্বল গদি-বালিশ চাই। শীতের ছ মাস শাক-সবজি ফলমূল কিছুই ফলে না, ছ মাসের তরে মাংসের শুঁটকি জমিয়ে রাখতে হয়; আমরা দিন আনি দিন খাই, ছ মাসের খাবার-দাবার জমিয়ে রাখার কথা শুনলে নাভিশ্বাস ওঠে। ছ মাসের খাবার কিনতে গেলে বেশকিছু রেস্তোর প্রয়োজন।
তাই বোধহয় ইয়োরোপীয়রা একদিন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ডাকাতি করতে প্রাচ্য দেশে এসেছিল। আজ ডেনমার্ক, জর্মনি, নরওয়ে, সুইডেনের খাবার-দাবার ব্যবসা-বাণিজ্য করেই চলে। ডাকাতিতে জিতেছিল ইংরেজ। আজ সে সব লুণ্ঠনভূমি কজা থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে। চার্চিল ব্রিটিশ রাজত্বের লিকুইডেটর হতে চাননি; আজকের শাসনকর্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হতে হচ্ছে। ওদিকে খাওয়া-দাওয়া থাকা-পরার মান অনেকখানি উঁচু হয়ে গিয়েছে সেটাকে বজায় রাখা যায় কী প্রকারে? আজ না হয় রইল, ভবিষ্যতে হবে কী? সেকুরিটি কোথায়?
এই সেকুরিটি নিয়েই যত শিরঃপীড়া।
সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অল্প। তবে সমঝদারদের মুখে শুনেছি, সেখানেও নাকি গুণীজ্ঞানীরা প্রাণপণ সেকুরিটি খুঁজছেন। ধর্মে বিশ্বাস নেই, আদর্শবাদ গেছে, চরমমূল্য পরমসম্পদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আদৌ আছে কি না তাই নিয়ে গভীর সন্দেহ–সেই প্রাচীন ওয়েস্টল্যান্ড নাকি আরও বিস্তীর্ণ হয়ে সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে।
তবে কি কার্ল মার্কসের নীতিই ঠিক? দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অভাব-অনটন উপস্থিত হলে সাহিত্যে সেটা প্রতিবিম্বিত হবেই হবে?
তা সে যা হোক, কিন্তু এই সেকুরিটির ব্যাপার আরেক সূত্রে উঠল।
বিদ্যাসাগরকে যে ইংরেজ মহিলা স্ত্রী-শিক্ষার প্রচার-প্রসারে প্রচুর সাহায্য করেন, তাঁরই এক নিকট-আত্মীয়ের সঙ্গে আমাদের আবার দেখা হল লন্ডনে। নাম কার্পেন্টার। ইনি জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে। আমি তাঁকে যখন একবার কলকাতাতে শুধাই তিনি কি মিস কার্পেন্টারের কোনও আত্মীয় হন, তখন উত্তরে তিনি বলেন, আমার ঠাকুরদার বোন। তার পর হেসে বলেছিলেন, আমি কিন্তু তাঁর মতো টাকা ছড়াতে আসিনি; তারই কিছুটা কুড়িয়ে নিতে এসেছি।
তিনি নিমন্ত্রণ করে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় মূর পদ্ধতিতে তৈরি বিরিয়ানি (সে কথা পরে হবে) খাওয়াচ্ছিলেন। কথায় কথায় তাকে শুধালাম, এই যে সাদায়-কালোয় দ্বন্দ্ব লেগেছে এদেশে, তার মূল কারণ কী?
তিনি এক কথায় বললেন, গার্লস।
আমি অন্যত্র শুনেছিলুম চিপ লেবার অর্থাৎ কালারা কম মজুরিতে কাজ করতে তৈরি। ম্যানেজাররা তাই তাদের চায়। ইংরেজ মজুর তাই চটে গেছে।
তা হলে গার্লস এল কোত্থেকে?
আসলে দুটোই এক জিনিস।
নিগ্রোদের কথা বলতে পারব না– সিলেট-নোয়াখালির খালাসিদের কথা জানি। তাদের অনেকেই লন্ডনে এসে অন্য খালাসিদের জন্য রাইস-কারির দোকান খোলে। বাঙালি ছাত্রেরাও সেখানে মাঝে মাঝে গোয়ালন্দ চাঁদপুরি জাহাজের রাইস-কারি খাবার জন্য যায়।
গিয়ে দেখবেন মিশকালো খালাসির ইংরেজ বউ! দু জনাই খদ্দেরকে খাবার দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সেই সিলেটি আছমৎ উল্লা বউকে ডেকে খাস সিলটিতে বলছে, ওগো ডুরা (ডোরা), সাবরে আরক কট্টা মুরগির সালন দে (সায়েবকে আরেক কটোরা-বাটি মুরগির ঝোল দে)!
মেমসাহেব সিলেটি শিখে নিয়েছে! কারণ আছমৎ ইংরেজিটা রপ্ত করতে পারেননি।
এখানে প্রশ্ন, এই মেমটি আছমৎ উল্লাকে বিয়ে করল কেন?
সেকুরিটি।
আছমৎ উল্লা মদ খায় না। তাই মাতাল হয়ে বউকে মারপিট করে না এবং তার চেয়েও বড় কথা মদ খেয়ে টাকা ওড়ায় না। রেসে যায় না, তিন পাত্তি তাস খেলেও সর্বস্বান্ত হয় না। সন্ধ্যার পর বাড়িতেই থাকে। এই হল এক নম্বর।
দুই নম্বর বিয়ের পর (আগেও ভোরা ছাড়া) অন্য রমণীর দিকে প্রেমের বাণ হানে না।
এই দুটি সেকুরিটি রমণী মাত্রই খোঁজে। অন্যান্য ছোটখাটো কারণের উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই– বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে, কান্নাকাটি করলে বউকে ধমক দিয়ে ড্রইংরুমে লেপকম্বল নিয়ে শুতে চলে যায় না। আছমৎ উল্লার দেশের কুঁড়েঘরে তারা দশজন শুতো, তার দাদার কাচ্চা-বাচ্চা সে সামলেছে, পরিবার বেসামাল বড় ছিল বলেই তো দু মুঠো ভাতের জন্য সে এদেশে এসেছে।
যদি বলেন, কালচারল লেভেল কি এক? নিশ্চয়ই। ডোরা খানদানি ডিউকের মেয়ে নয়, সে এগজিসটেনশিয়ালিজম নিয়ে মাথা ঘামায় না, আর আমাদের আছমৎ উল্লাও জমিদারবাড়ির ছেলে নয়, সে যোগাযোগ পড়েনি।
যদি বলেন, সাদা মেয়ে কি কালোকে পছন্দ করে? উত্তরে বলি, আমাদের ভিতরে যে যত কালা সে-ই তো তত ফর্সা বউ খোঁজে। (এই সাদার তরে পাগলামি এদেশে খুব বেশিদিন হল আসেনি। দুশো বছর আগেকার লেখা বইয়ে ইয়োরোপীয় পর্যটকরাও লিখেছেন, ভারতীয়রা আমাদের ফর্সা রঙ দেখে বেদনাভরা কণ্ঠে শুধায় হায়, ভগবান এদের সবাইকে ধবলকুষ্ঠ দিয়েছেন কেন? কথাটা ঠিক। এদেশের দুই মহাপুরুষ কৃষ্ণ এবং রামের একজন কালো, অন্যজন নবজলধরশ্যাম।)।
এই সেকুরিটির অভাবই মদ্যপানের অন্যতম কারণ।
ইংলন্ডে যে মদ্যপান বেড়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কোনও দেশের গুণীজ্ঞানীরা কী ভাবেন, কী চিন্তা করেন, সে কথা জানবার জন্য সে দেশে যাবার কোনও প্রয়োজন আমি বড় একটা দেখিনে। আপন দেশে বসে বসে সে দেশের উত্তম অধম পুস্তক, মাসিক, খবরের কাগজ পড়লেই সে সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা জন্মে! কিন্তু সে দেশের টাঙ্গাওলা-বিড়িওলা ড্রাইভার-কারখানার মজুর কী ভাবে, কী চিন্তা করে সেটা জানতে হলে সে দেশে না গিয়ে উপায় নেই। কারণ তারা বই লেখে না, খবরের সম্পাদককে চিঠি লিখে নালিশ-ফরিয়াদ জানায় না। তাদের কান্নাকাটি গালমন্দ যা কিছু করার সবকিছুই তারা করে এদেশের চায়ের দোকানে, ওদেশে পাবে অর্থাৎ শরাবখানায়। আর শরাবখানায় মস্ত বড় একটা সুবিধা– আমাদের চায়ের দোকানেও তাই কারও সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে চাইলে সে খেঁকিয়ে ওঠে না; গুণীজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করতে হলে বিস্তর বয়নাক্কা, আত্মাবমাননাও তাতে কিঞ্চিৎ আছে কিংবা এ চিন্তা মনে উদয় হওয়া অসম্ভব নয়, আমি কে যে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে যাব?
কেনসিংটন গির্জার পাশে ছোট্ট একটি শরাবখানাতে এক কোণে বসেছি। প্রচণ্ড ভিড়। এমন সময় একটি বুড়ি বার থেকে এক গেলাস জিন কিনে এনে আমার পাশে বসতে গেলে তার হ্যান্ডব্যাগটি মাটিতে পড়ে গেল। সেটি কুড়িয়ে টেবিলের উপর রাখলুম। বুড়ি গলে গিয়ে থ্যাঙ্কয়ু থ্যাঙ্কয়ু বলে চেয়ারে বসে খানিকটে আমাকে শুনিয়ে খানিকটে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, আজকালকার ছোঁড়াদের ভদ্রতা বলে কোনও জিনিস নেই, তবু বাকিটা তিনি আর শেষ করলেন না। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না তিনি কী বলতে চান। ছোঁড়াদের ভদ্রতা নেই কিন্তু আমার আছে, এ কী করে হয়, কারণ আমি ছোঁড়া নই। তবে বোধহয় বলতে চান ছোঁড়াদের নেই, কিন্তু এ বুড়োর (অর্থাৎ আমার) আছে। সেটা অনুমান করেও উল্লাস বোধ করি কী প্রকারে? আমি বুড়ো বটে কিন্তু থুথুরে বুড়ির কাছ থেকে সে তত্ত্ব শুনে তো আনন্দিত হওয়ার কথা নয়।
তা সে যাকগে। আমি তখন অবাক হয়ে বারের দিকে তাকিয়ে বার বার তাজ্জব মানছি। হরেক রকম চিড়িয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝপাঝপ বিয়ার, এল, জিন খাচ্ছে– এ কিছু নয়া তসবির নয়, কিন্তু আশ্চর্য, চব্বিশ-ছাব্বিশ বছরের মেয়েরা পর্যন্ত বারে কটাশ করে শিলিঙ রেখে অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে ঢাকাঢ়ক বিয়ার খেয়ে হুট করে বেরিয়ে যায়। যৌবনে যখন লন্ডন গিয়েছি, তখন দুপুরবেলা বারে একা একা খাওয়া মাথায় থাকুন, রাত্রে ডিনারের সময়ও কোনও ভদ্ৰমেয়ে তার বন্ধু বা আত্মীয়ের সঙ্গেও এসব জায়গায় আসতে ইতস্তত করত। নিতান্ত যেতে হলে যেত রেস্তোরাঁয় অর্থাৎ খাবারের জায়গায় যেখানে মদ্যপান করা হয় খাদ্যের অত্যাবশ্যক অঙ্গরূপে আমাদের গ্রামাঞ্চলে যে রকম শুধু জল খেতে দেয় না, সঙ্গে দুটি বাতাসা দেয়।
বুড়ো-বুড়িদের দৃষ্টিশক্তি কমে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটাও সত্য যে, যা দেখে তার থেকে অর্থ বের করতে পারে সেই অনুপাতে অনেক বেশি। তাই সেই বুড়ি এক ঢোক জিন খেয়ে আমাকে শুধালে– (এ সব জায়গায় ইংরেজ লৌকিকতার বজ্ৰবাধন কিঞ্চিৎ ঢিলে হয়ে যায়) বাবাজি কি এদেশে এই প্রথম এলে?
বুঝলুম, বাঙালের হাইকোর্ট-দর্শন করে ঘটি যে রকম পত্রপাঠ ঠাহর করে নেয়, লোকটা বাঙাল; আর আমি তো আসলে বাঙাল; কলকাতায় যে রকম প্রথম হাইকোর্ট দেখেছিলুম এখানেও ঠিক তেমনি ক্যাবলাকান্তের মতো সবকিছু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছি। যতই পলস্তরা লাগাই-না কেন, সে বাঙালত্ব যাবে কোথায়? প্রতিজ্ঞা করলুম সাবধান হতে হবে। শহুরেদের মতো সবকিছু দেখব আড়নয়নে ব্রিামদার মতো বাঁকা চোখে।
অপরাধীর সুরে বললুম, তা ম্যাডাম, প্রায় তাই। ত্রিশ বছর পূর্বে এসেছিলুম, আর এই। লন্ডন ইতোমধ্যে পুনর্জন্ম না হোক, অধজন্ম তো লাভ করেছে।
বুড়ি মহা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলে কী? ত্রিশ বছর পরে। তা হলে তো এর কাছ থেকে অনেককিছু শোনা যাবে। অবশ্য উত্তেজনার কারণ জিনও হতে পারে।
.
সবে দাড়ি-গোঁফ কামাতে শিখেছে এক স্কচ ছোকরা বাড়ি থেকে পালিয়ে মার্কিন মুলুকে উধাও হয়। বহু পয়সা কামিয়ে ত্রিশ বছর পরে সে ফিরছে দেশে। বাড়ি ফেরার সময় এত দিন বাদে এই সে প্রথম চিঠি লিখেছে। স্টেশনে বাপ-চাচা-দাদা সবাই উপস্থিত, সবাই খুশি, প্রচুর পয়সা কামিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসছে।
চুমোচুমি আলিঙ্গনের পর ছোকরা শুধালে, তোমরা সবাই এ রকম লম্বা লম্বা দাড়ি রেখেছ কেন? এই বুঝি ফ্যাশান!
জ্যাঠা বিড়বিড় করে বললেন, ফ্যাশান না কচু। তুই যে পালাবার সময় ব্লেডখানা সঙ্গে নিয়ে গেলি!
বুড়ি আরেক ঢোক জিন্ খেয়ে হেসে বললেন, আমার পিতৃভূমি স্কটল্যান্ডে; কাজেই আমার অজানা নয় যে সেখানে কুল্লে পরিবার এক ব্লেডে দাড়ি কামায়। কিন্তু ত্রিশ বছর–?
আমি বললুম, ঠিক বলেছেন, ম্যাডাম। আমি ত্রিশ বছর পূর্বে লন্ডন ছাড়ার সময় আমার ব্লেডখানা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম কিন্তু তাই বলে লন্ডনের লোক দাড়ি কামানো বন্ধ করে দেয়নি। ইস্তেক গোঁফ পর্যন্ত কামিয়ে ফেলেছে।
মানে?
মানে মেয়েদের রাজত্ব। আমার ভাইপো এই প্রথম লন্ডনে এসেছে। তার কাছে সবকিছুই নতুন ঠেকছে। সে আজ সকালে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর বললে, ফোর টু ওয়ান অর্থাৎ রাস্তা দিয়ে যদি চারটে মেয়ে চলে যায়, তবে একটা ছেলে। আমি অবশ্য বললুম, এখন আপিস, আদালত, দোকান-পাট খোলা, সেখানে পুরুষরা কাজ করছে। অন্য সময় শুনলে হয়তো অন্য রেশিয়ে বেরোবে। সে বললে, ওসব জায়গায় তো মেয়েরাই বেশি। নিতান্ত বাস আর ট্যাক্সি মেয়েরা চালাচ্ছে না। (পরে অবশ্য ফ্রান্স না জর্মনি কোথায় যেন তা-ও দেখেছি)।।
তার পর বললুম, এক-একটা লড়াই লাগে আর মেয়েদের পায়ের শিকলি খোলার সঙ্গে সঙ্গে মনের শিকলিও খুলে যায়।
মানে?
আমি বললুম, বেশি দূরে যাওয়ার কী প্রয়োজন? ওই বারের দিকে তাকিয়ে দেখুন না। ত্রিশ বছর আগে উড়ুক্কু বয়সের মেয়েদের দুপুরবেলা বারে মাল গিলতে দেখেছেন?
বুড়ি একটু লজ্জিত নয়নে আমার দিকে তাকালেন।
আমি তাতে পেলুম আরও লজ্জা। আবার বাঙাল-পনা করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি বললুম, না, না, এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তার পর অস্বস্তির কুয়াশা কাটাবার জন্য হাসির রোদ ফুটিয়ে বললুম, সবাই কি ত্রিশ বছরের দাড়ি নিয়ে বসে থাকবে? সময়ের সঙ্গে কদম কদম এগিয়ে যেতে হয়।
বুড়ি যেন আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, এ জন্য আমরাই দায়ী। তবে শুনুন।
এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে লন্ডনের উপর কী রকম বোমা পড়েছে তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। কয়েক বছর আগে এলেও দেখতে পেতেন লন্ডনের সর্বাঙ্গে তার জখমের দাগ। এখনও কোনও কোনও জায়গায় আছে নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু ওসব বাইরের জিনিস। আজ যদি ভূমিকম্পে লন্ডনের আধখানা তলিয়ে যায় তবে তাই নিয়ে বাকি জীবন মাথা থাবড়াব নাকি?
কিন্তু মাটির তলার ঘর সেলারে বসে প্রতি বোমা পড়ার সময় ভয়ে-আতঙ্কে যে রকম কেঁপেছি সেটা হাড়গুলোকে নরম করে দিয়ে গিয়েছে, সে আর সারবার নয়। বম্বিং-এর পর রাস্তায় বেরিয়ে মড়া দেখেছি, জখমিদের কাতর আর্তনাদ শুনেছি— বুকের ওপর তার দাগ সে-ও কখনও মুছে যাবে না। আমার ফ্ল্যাটটা বহুদিন টিকেছিল– অনেককে তাতে আশ্রয় দেবার সুযোগ পেয়েছি, দু চার দিন থেকে তারা অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে, কেউ-বা বেশি দিন থেকেছে। একদিন এক মর-মর বুড়োকে আশ্রয় দিলুম। তাকে নিয়ে কী করব সেই কথা ভাবতে ভাবতে যখন কুড়ি ফিরছি তখন জর্মন বারের বাঁশি বাজল। ঘণ্টাখানেক মাটির নিচের আশ্রয়ে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন দেখি স্বয়ং ভগবান আমার সমস্যাটির শেষ সমাধান করে দিয়েছেন। বাড়িটি নেই। সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও গেছে। একটুখানি থেমে বললেন, পরে অবশ্য লাশটা পাওয়া গিয়েছিল।
বুড়ির জিন ততক্ষণে ফুরিয়ে গিয়েছে। কাপড়-চোপড় দেখে মনে হল অবস্থাও খুব ভালো নয়। ফ্রকে হাঁটুর কাছটায় আনাড়ি কিংবা বুড়ো হাতের একটুখানি রিপুও দেখতে পেলুম। এবার কিন্তু বাঁকাচোখে।
এখখুনি আসছি বলে বারে গিয়ে একটা জিন নিয়ে এলুম।
মনে মনে বললুম, সদাশয় ভারত সরকারের যে কটি পাউন্ড ভারতীয় মুদ্রা মারফত কিনতে দিয়েছেন তা দিয়ে এ রকম করলে আর কদিন চলবে? কিন্তু তাই বলে তো আর ছোটলোকামি করা যায় না। আমার ক্যাশিয়ার মুখুজ্যেও পই পই করে বলেছে, কিপ্টেমি করা চলবে না; পাউন্ড যদি ফুরিয়ে যায় তবে তদণ্ডেই দেশে ফিরে যাবে– ফিরতি টিকিট তো কাটাই আছে।
বুড়ি বললেন, না, না। আপনি আবার কেন– আমি এমনিতেই অনেকগুলি খাই।
আমি হেসে বললুম, ত্রিশ বছর পরে এসেছি; একটুখানি পরখ করব না। যদিও স্কচ ছোঁয়ার মতো মিলিয়ন নিয়ে আসিনি।
বুড়ি বললেন, তখনই আমার নার্ভস যায়। অনেকেরই যায়। তার পর ফিসফিস করে বললেন, চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন না, আমার বয়সী ক গণ্ডা বুড়ি মদ গিলছে।
খাবার জোটে না, অহরহ বোমা পড়ছে, কানের পর্দা শব্দের হাতুড়ি পেটা খেয়ে খেয়ে যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে– লক্ষ করেননি, অনেকেরই কান খারাপ হয়ে গিয়েছে, সবাই একটুখানি চেঁচিয়ে কথা কয় (আমি অবশ্য করিনি– তবে কথাটা সম্পূর্ণ ভুল না-ও হতে পারে)- দিনরাত কেটে যাচ্ছে, চোখের পাতায় ঘুম নেই, এমন সময় পাশের বাড়ি উড়ে যাওয়ার পর তাদের সেলার থেকে বেরুল এক গুদোম মদ।
আগের থেকেই নার্ভস ঠাণ্ডা করার জন্য ধরেছিলুম সিগারেট, এখন পেলুম ফ্রি মদ। মদ খেলে আরেকটা সুবিধে। ক্ষিদেটা ভুলে থাকা যায়, আর, নেশাটা ভালো করে চড়লে দিব্য ঘুমানোও যায় বোমা ফাটার শব্দ সত্ত্বেও।
খাবার নষ্ট হয়ে যায় সহজেই, কিন্তু মদ একবার বোতলে পুরলেই হল। তাই খাবারের চেয়ে মদ জুটত সহজে অন্তত আমার বেলা তাই হয়েছে। সেই যে অভ্যেসটা হয়ে গেল সেটা আর গেল না। এই দেখুন হাত কাঁপছে। গণ্ডাখানেক খাওয়ার পর হাত দড়ো হবে। আর নাই-বা হল দড়ো। কদিনই-বা বাঁচার আর বাকি আছে!
কিন্তু যে কথা বলছিলুম, আমাদের মতো বুড়িদের দেখে দেখে ছুঁড়িরাও মদ খেতে শিখেছে। দোষটা তো আমাদেরই।
বুড়ি থামলেন। খোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়ল বৃষ্টি নেমেছে। দেশের মতো গামলা-ঢালা বর্ষণ নয়– সে বস্তু এদেশে কখনও দেখিনি। ঝিরঝিরে ফিনফিনে। তারই ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আরও যেন ঠাণ্ডা হয়ে পাবে ঢুকে আমার হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। ওদের অভ্যাস আছে, বুড়ি পর্যন্ত বিচলিত হল না, কেউ দরজা বন্ধ করে দেবার কথা চিন্তাও করলে না।
পূর্বেই বলেছি বুড়িরা দেখে কম, বোঝে বেশি। বললেন, বাবাজি এদেশে এলেন অক্টোবর মাসে, যেটা কি না ইংলন্ডের ওয়েটেসট মথ, বৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এ বছর আবহাওয়ার কোনও জমা-খরচ পাওয়া গেল না– তেষট্টি বছরের ভিতর এ রকম ধারা কখনও হতে দেখিনি! যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন ঝা ঝা রোদ্দুর, আর যখন রোদ্দুর হওয়ার কথা, ফসল কাটার সময়, তখন হল বৃষ্টি। এ রকম হলে এদেশ থেকে চাষবাসের যেটুকু আছে তা-ও উঠে যাবে।
আমি বললুম, এই অনিশ্চয়তার জন্যই গত একশো বছর ধরে এদেশে গমের চাষ কমে গিয়েছে– কোথায় যেন পড়েছি।
বুড়ি বললেন, এবারের সঙ্গে কিন্তু আদপেই তার তুলনা হয় না। সবাই বলে এটম বম নিয়ে মাতামাতি করার ফলে। হবেও বা। আপনাদের দেশেও তো শুনেছি এবারে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল,– বিস্তর গর্মি, অল্প বৃষ্টি।
একটু আরাম বোধ করলুম। তা হলে বুড়ি এখনও খবরের কাগজটা অন্তত পড়ে। জীবনে আঁকড়ে ধরার মতো অন্তত কিছু একটা আছে। বললুম, সে কথা আর তুলবেন না, ম্যাডাম। দিনের পর দিন ঝাড়া দুটি মাস ধরে ১১৪ ডিগ্রির ১১৪ ন্যাজওলা ক্যাট অ নাইন টেলসের চাবুক খেয়ে পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন এই ঠাণ্ডায় সে কথা ভাবতে চিত্তে পুলক লাগে, দেহ কদমফুলের মতো—
সে আবার কী ফুল?
খাইছে। এ যেন লন্ডন শহরে মুখুজ্যের বটগাছ সন্ধান করার মতো। বললুম, ম্যাডাম, সে তো বোঝানো অসম্ভব। এদেশের কোনও ফুল তার কাছ ঘেঁষেও যায় না। বোঝাতে গেলে সেই অন্ধের বক খাওয়ার মতো হবে। অন্ধকে শুধালে দুধ খাবে? দুধ কী রকম? সাদা। সাদা কী রকম? বকের মতো। বক কী রকম? লোকটা তার কনুই থেকে বক দেখানোর বাঁকানো হাতের আঙুল পর্যন্ত অন্ধের হাতে বুলিয়ে দিল। অন্ধ ভয় পেয়ে বললে, বাপ! ও আমি খেতে পারব না আমার গলা দিয়ে ঢুকবে না।
তার পর বললুম, কিন্তু ম্যাডাম, আপনি যে বললেন, হুঁড়িরা আপনাদের অনুকরণে মদ খেতে শিখেছে এ কথাটা আমার মনকে নাড়া দিচ্ছে না। আমার মনে হয়, যারা মদ খায় তাদের অধিকাংশই দুরন্ত দৌড়-ঝাঁপটার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই ওই কর্ম করে। চাষাবাদের কাজ টিমেতেতালা; তারা মদ খায় কম। কারখানার কাজ জলদ তেতাল; তারা খায় বেশি। আগে শুধু পুরুষেরা যেসব ধুন্দুমারের কাজ করত এখন মেয়েরাও সে-সব কাজ করছে বলে তাদেরও একটু-আধটু পান করতে হচ্ছে। কিন্তু এটাও বলে রাখছি, এ রেওয়াজ বেশিদিন থাকবে না?
কেন?
আমি বিজ্ঞের ন্যায় বললুম, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পড়িনি, আমি নিজে কোথাও দেখিনি মদ নিয়ে মেয়েদের বাড়াবাড়ি করতে– ও বস্তু যেখানে জলের মতো সস্তা সেখানেও। তার কারণ মেয়েদের বাচ্চা প্রসব করতে হয়। প্রকৃতি চায় না মদের বাড়াবাড়ি করে মেয়েরা স্বাস্থ্য নষ্ট করুক। এবং শেষ কথা পুরুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের আবার ঘরকন্নার দিকে ফিরে যেতে হবে।
বুড়ি বললেন, কী জানি? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাই হয়েছিল বটে, কিন্তু এবার কি তারা যে স্বাধীনতা পেয়েছে সেটা আর ছেড়ে দেবে? সেবারে শুধু তারা পুরুষের কাজ করার অধিকার পেয়েছিল, এবারে তার টাকা ওড়াবার অধিকারও তারা পেয়েছে যে। এই যে তারা পাবে আসে, সেটা কেন? পুরুষের মতো আড্ডা জমাতে তারাও শিখে গিয়েছে।
আমি শুধালুম, বাড়িতে মদ খাওয়া তো অনেক সস্তা!
বুড়ি আনমনে বললেন, অনেক। কিন্তু বাড়িতে আমার আর কে আছে? কর্তা তো আগেই গেছেন। ছেলেটাও ফ্রান্সের আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হল।
তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– গলায় নেশার চিহ্নমাত্র নেই–কিন্তু জানেন, আমি তার আশা এখনও ছাড়তে পারিনি। হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পাব মা। শেষে ঘুম ভাঙতেই শুনি, পাশের বাড়ির লক্ষ্মীছাড়া রেডিয়োটা ধর্মসঙ্গীত গাইছে।
মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর
অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।
কোথায় ব্রাহ্মমুহূর্তে প্রসন্নমনে জানালা দিয়ে সবুজ গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সবুজ প্রাণশক্তি আহরণ করব, তা না, তখন স্মরণ করিয়ে দিলে শেষের দিনের কথা। ঘুম তো এক রকমের মৃত্যু, সেই মৃত্যুর থেকে উঠে শুনতে হয় বিভীষিকাময় আরেক মৃত্যুর কথা– তা-ও বিটকেল গানে গানে!
এখানে সকালবেলা খাটের পাশে রেডিয়োটা চালিয়ে দিই আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী শোনার জন্য। এ-দেশে সেটা জানার বড়ই প্রয়োজন। বৃষ্টি হলেই গেছি–বুড়ো হাড় নিয়ে রাস্তাঘাটে ফু, নিউমোনিয়া কুড়োতে ভয় করে। রোদের সামান্যতম আশা পেলে মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এ দেশের আলিপুর কতখানি নির্ভরযোগ্য! দেশে থাকতে আবহাওয়ার বিলিতি এক ওঝার এক বিবৃতি পড়েছিলুম। তিনি কলকাতায় এসে বেশ মুরুব্বিয়ানার সুরে বললেন, তোমাদের দেশে এখনও আবহাওয়া যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করার মতো ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে দফতর নেই বলে প্রায়ই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পার না। আমরা কিন্তু বিলেতে মোটামুটি পারি।
এর পরীক্ষা হাতেনাতে হয়ে গেল।
একদিন ঘুম দেরিতে ভাঙায় বেতার-রিপোর্টটা শুনতে পাইনি। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় বাড়ির বুড়ি ঝিয়ের সঙ্গে দেখা- তার এক হাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অন্য হাতে বালতি। শুধালাম, বেতারে আবহাওয়ার বাণী কিছু শুনেছ?
একগাল হেসে বললে, এবারে যা আবহাওয়া বলে সেই পাবের বুড়ির মতো অনেক কথাই বললে– ইস্তেক এটম বম্ যে এসব গড়বড়ের প্রধান কারণ সেটা বলতেও ভুলল না।
সর্বশেষে বললে, যেন সবকিছু যথেষ্ট বরবাদ হয়নি বলে শেষমেশ এলেন ঝড়, গে। ওহ, তার কী দাপট!
আমি শুধালাম, আবহাওয়া দফতর সতর্ক করে না, ওয়ার্নিং দেয়নি?
গম্ভীরভাবে বললে, ইয়েস স্যর, আফটারওয়ার্ডস, ঝড়ের পরে দিয়েছিল।
রসবোধ আছে বৈকি।
কিন্তু মোদ্দা কথায় ফিরে যাই। আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার পূর্বে বেতারে হয় ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা উপাসনা। সাতসকালে ওটাও সেই অন্যলোকে কবে কথা তুমি রবে নিরুত্তর গোছের। কিন্তু পাছে আবহাওয়া মিস্ করি তাই সেটা শুনতে হত।
সর্বপ্রথম যেটা কানে ঠেকে সেটা পাদরি সায়েবের ভাষা।
একদা ধর্ম প্রভাব করত সাহিত্য, কলা, সঙ্গীত তাবৎ রসপ্রকাশ প্রচেষ্টাকে– এখনও করে। একথা ফলাও করে বোঝাবার কিছুমাত্র দরকার নেই কারণ বহু শতাব্দী ধরে রিলিজিয়াস আর্টের সাধনা করার পর মানুষ এই সবে সেকুলার আর্ট আরম্ভ করেছে।
এখন আরম্ভ হয়েছে উল্টো টান। এখন ধর্মযাজকরা আপন-আপন ভাষা সরল, প্রাঞ্জল, ওজস্বিনী, মর্মস্পর্শী করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য থেকে বচনভঙ্গী ধার নিচ্ছেন। আজকের দিনের জীবন যে চরম মূল্যে বিশ্বাস হারিয়ে দেউলে হয়ে গিয়েছে তারই বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পাদরি সায়েব যখন ভোরবেলা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আমার কেমন যেন আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল, কোথায় যেন এটা পড়েছি। তারই সন্ধানে যখন আমার মন আর স্মৃতিশক্তি লুকোচুরি খেলছে তখন, ও হরি, পাদরি সায়েবই মাইকের উপর হাঁড়ি ফাটালেন। বললেন, আজকের দিনের দুনিয়া দেউলে; সর্বভুবন এখন এক বিরাট ওয়েস্টল্যান্ড।
কবিতাটি আমি মাত্র একবার পড়েছি, তা-ও বহু বৎসর পূর্বে এবং সে-ও খামচে খামচে, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে স্কিপ করে করে, কারণ ও কবিতায় একাধিক ভাষায় যে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ভাষা শেখাতে অগা এক-ভাষা-নিষ্ঠ (মনোগ্নট) ইংরেজকে তাক লাগাবার কিশোরসুলভ প্রচেষ্টা আছে, তা দেখে আমি বে-এক্তেয়ার হব কেন আমি তো এ সব-কটা ভাষা এলিয়টের মতোই বিলক্ষণ মিসান্ডারস্টেন্ড করতে পারি। কাজেই কবিতাটি স্মরণ করতে যদি সময় লেগে থাকে তা হলে আশা করি, যাদের কাছে ওই কবিতা রামায়ণ মহাভারতের চেয়েও প্রণম্য তারা অপরাধ নেবেন না।
ইংলন্ডের প্রার্থনার কথা ওঠাতে যদি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এস্থলে কিঞ্চিৎ বাক্যবিন্যাস করি তবে, বিবেচনা করি, সেটা নিতান্ত বেখাপ্পা শোনাবে না, এবং সে-বাসনা যে আমার কিঞ্চিৎ আছেও; সেটা অস্বীকার করব না, কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্য থেকে অনেকখানি দূরে চলে যাব বলে পাঠক হয়তো ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠবেন। তাই শুধু এই প্রশ্নই শুধাই, ভোরবেলার পাদরি সায়েব বেছে বেছে আমাদের এলিয়ট সাহেবকেই স্মরণ করলেন কেন?
মার্কিন মুলুকের লেখককে ইংরেজ সহজে কল্কে দেয় না, কাজেই এই কল্কে পাওয়ার জন্য এলিয়টকে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বহু জায়গায় বিস্তর কল্কে পাওয়ার পর ইংলন্ডের কনসারভেটিভ পার্টিতেও তো জাতে উঠবার জন্য তিনি লিখলেন দি লিটারেচার অব পলিটিক্স–টি এস এলিয়ট ও এম কর্তৃক লিখিত; রাইট অনরেবল স্যর এন্টনি ইডন, কে জি; এম সি; এম পি কর্তৃক ভূমিকা সম্বলিত। এরকম ব্যাপার যে ইংলন্ডে হতে পারে আমি জানতুম না। আজ যদি শ্রদ্ধেয় পরশুরাম শ্রীরাজশেখর বসু রায়সাহেব কর্তৃক লিখিত এবং শ্রীযুক্ত ভূতনাথ ভড় রায়বাহাদুর, বিধানসভার সদস্য, কাইসার-ই হিন্দ দ্বিতীয় শ্রেণি মেডলপ্রাপ্ত কর্তৃক ভূমিকা সম্বলিত পুস্তক প্রকাশ করেন তবে যে রকম বিস্মিত এবং বিরক্ত হব। সাহিত্যজগতে (এলিয়ট যে পলিটিশিয়ান নন, সে সবাই জানে) তিনি তার ও. এম উপাধিটি উল্লেখ করতে ভুললেন না, আর ইডন তো সালঙ্কার থাকবেনই। মুসলমান বলে আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে অনুমান করি চাঁড়াল যদি পৈতে পেয়ে যায়, (স্বগুণেই বলছি) তবে বোধহয় সে সেটা সর্বক্ষণ মাথায় জড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়! আশা করি, এর পর যখন বাংলার সাহিত্যিকরা রাজনীতিকদের দাওয়াত করে, সভাপতি বানিয়ে, তাদের দিয়ে সাহিত্য অথবা সাহিত্যিকদের চরিত্রের আনাড়ি সমালোচনা করাবেন, তখন শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ অনাদৃত খাঁটি সাহিত্যিকরা অহেতুক উষ্ণ গোসূসা প্রদর্শন করবেন না। এদের গুরুঠাকুর মহামান্যবর এলিয়ট সাহেব– এঁরা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন মাত্র।
সাহিত্যজগতে কন্ধে পেয়েই এলিয়ট সন্তুষ্ট নন। তিনি আরও বহু কল্কে বহু জায়গায় পেয়েছেন। কিন্তু ইংলন্ডের সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ কল্কে ধর্মচক্রে কে না জানে সে দেশের রাজা বা রানির অন্যতম উঁদরেল উপাধি ডিফেন্ডার অব ফেৎ? স্বয়ং পোপ ইটি অষ্টম হেনরিকে দিয়েছিলেন। সেখানে কল্কে পাওয়া চাই-ই চাই।
এলিয়ট তার ধর্মবিশ্বাস পরিষ্কার ভাষাতেই প্রকাশ করেছেন সেটা তার কবিতার মতো তেষট্টি রকমের বোঝা এবং বোঝানো যায় না, এই রক্ষে। পাসকাল সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ধর্মগুলোর ভিতর খ্রিস্টধর্ম, এবং তার ভিতরে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মই জগৎ এবং বিশেষ করে আধ্যাত্মজগতের সমস্যা এবং কার্যকারণ সর্বোত্তমভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে (টু অ্যাকাউন্ট, মোস্ট সেটিসফেকটরিলি ফর দি ওয়ার্লড অ্যান্ড স্পেশালি দি মরাল ওয়ার্ল্ড উইদিন)। যিশুখ্রিস্ট যে জলকে মদ্যরূপে পরিবর্তিত করেছিলেন, মৃতজনে প্রাণ দিয়েছিলেন এসব অলৌকিক কার্যকলাপে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি অ্যাংলো ক্যাথলিক গির্জায় (বিলাতের সরকারি, রাজরানির প্রতিষ্ঠান) গিয়ে পুজোপাঠ করেন, মন্ত্রপূত রুটি এবং মদের মাধ্যমে খ্রিস্টের সঙ্গে অশরীরীভাবে হরিহরাত্ম হন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার নয়। আমাদের মডার্ন কবিরাও হয়তো ইতু ঘেঁটুর পুজো করেন, নজরুল ইসলাম আজ যদি মোল্লার কাছ থেকে পানি-পড়া তাবিজ-কবজ নিয়ে ব্যামো সারাতে চান তবে আমরা উল্লাসই অনুভব করব– ডাক্তার-কবরেজ তো হার মেনেছেন কিন্তু এ বাবদে একটা প্রশ্ন স্বভাবতই উদয় হয়।
গোঁড়া ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন, অ-খ্রিস্টানরা অনন্ত নরকের আগুনে জ্বলবে। গোড়া মুসলমানরা অতখানি ঠিক করেন না তাদের মতে কোনও অনৈসলামিক ধর্মের মূলতত্ত্ব (ফান্ডামেন্টালস্) যদি ইসলামের সঙ্গে মেলে তবে সে ধর্মের লোক স্বর্গে না গেলেও অনন্ত নরকে জ্বলবে না। এখন প্রশ্ন এলিয়ট কি বিশ্বাস করেন, তাঁর বাঙালি হিন্দু-মুসলমান চেলারা অনন্ত নরকের আগুনে রোস্ট মটন কিংবা তন্দুরি মুরগি ভাজা হবে, যারা তাঁর সঙ্গরস পেয়েছেন তারা যদি বাৎলে দেন, তবে উপকৃত হব।
কিন্তু ইহুদিদের সম্বন্ধে এলিয়ট তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। পাঠক স্মরণ রাখবেন, ইহুদির ধর্মগ্রন্থ প্রাচীন নিয়ম (ওল্ড টেসটামেন্ট) খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থও বটে এবং খ্রিস্টানদের একেশ্বরবাদ, প্রতিমাবর্জন, স্বৰ্গনরক, শেষ বিচার, গির্জার প্রার্থনা-পদ্ধতি ইহুদিদের কাছ থেকে নেওয়া, এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট ইহুদিসন্তান– মথিলিখিত সুসমাচারের আরম্ভই যিশুর কুলজি নিয়ে; তিনি ইহুদিদের বংশপিতা আব্রাহামের (ইব্রাহিমের) বংশধর।
এলিয়ট আদর্শ সমাজব্যবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, যে সে আদর্শ সমাজে রক্ত ও ধর্ম এই দুয়ে মিলে মুক্তচিন্তাশীল ইহুদিদের (আদর্শ সমাজে) বেশি সংখ্যায় থাকা অবাঞ্ছনীয়।
(Reasons of race and religion combine to make any large number of free-thinking Jews undesirable)
সোজা বাংলায় প্রকাশ করতে গেলে দাঁড়ায় :- যেমন মনে করুন রবীন্দ্রনাথ যদি বলে যেতেন, পারসিদের ধর্ম এবং রক্ত আলাদা (এবং এটাও লক্ষণীয় যে, ইহুদি ও পারসি উভয় সম্প্রদায়ই বিত্তশালী); এ দুয়ে মিলে গিয়ে এমনই এক বিপর্যয় ঘটেছে যে এদের থেকে বেশি লোক ভারতীয় সমাজে থাকুক এটা বাঞ্ছনীয় নয়!!!
অ্যান্টনি ইডনের ভূমিকাসম্বলিত এলিয়টের যে লিটারেচার অব পলিটিকস্ বইয়ের পূর্বে উল্লেখ করেছি তাতে এলিয়ট চারজন কন্সারভেটিভ সাহিত্যিকের উল্লেখ করেন; বলিং, বার্ক, কোলরিজ এবং ডিজ্বরেলি। ডিজরেলির কথা বলতে গিয়ে এলিয়ট বলেছেন, হ্যাঁ, ইনি (এখানে বোধহয় এলিয়ট একটু থেমে গিয়ে মৃদু গলাখাকারি দিয়েছিলেন) একটা সাদামাটা পাস পেতে পারেন মাত্র; আমি অবশ্য গির্জার সদস্য গ্ল্যাডস্টনকেই পছন্দ করি বেশি।
সমালোচক উইলসন কাষ্ঠহাসি হেসে এ স্থলে বলেছেন, হ্যাঁ, একজন মুক্তচিন্তাশীল ইহুদি চললেও চলতে পারে, অবশ্য তিনি যদি কনসারভেটিভের স্বার্থে কাজ করেন।
অনেকটা রবিঠাকুর যেন বলেছেন, নৌরজী চললেও চলতে পারেন; আমি কিন্তু গোড়া টিলককেই পছন্দ করি।
এ-আলোচনা উঠেছিল যখন বিবিসি দর্শনে যাই-হাজার হোক এ-জীবনের চারটি বছর দিশি বেতারে নষ্ট করেছি তো!
.
পারস্যে প্রখ্যাত কবি মুশাররফ উদ্দীন বিন্ মুসলিহ উদ্দীন শেখ সাদীকে একদিন দেখা গেল ভর সন্ধেবেলা গোরস্তানের দেউড়ির সামনে। এ সময়টা মৃতের সদ্গতি-প্রত্যাশাকামী উপাসনার জন্য প্রশস্ত নয়; তাই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কবির এক বন্ধু তাকে দেখতে পেয়ে শুধালেন, অবেলায় এখানে কী করছেন, শেখ সায়েব? দীর্ঘ দাড়ি দুলিয়ে, দীর্ঘতর নিশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ বললেন, আর বলল না ভাই, গেরো, গেরো। জানো তো অমুককে। আমার কাছ থেকে একশো তুমান ধার নিয়েছিল বছরটাক হয়ে গেল। ফেরত পাইনে। পাড়ায় পাড়ায় খেদিয়ে বেরিয়েও তাকে ধরতে পাইনে। তখন আমার গুরুভাই আমাকে পরামর্শ দিয়েছে এখানে এসে অপেক্ষা করতে। গোরস্তানে নাকি সবাইকে একদিন আসতে হয়।
বিবিসি লন্ডন তথা ইংলন্ড, এমনকি লন্ডনাগত বিদেশি গুণী-জ্ঞানীর জ্যান্ত গোরস্তান। গাইয়ে, বাজিয়ে, নাট্যকার, বক্তৃতাবাজ, পাহাড়-চড়নে-ওলা, চোরের সেরা, ডাকাতের-বাড়া (এরাও ইন্টারভু দেয়) হেন প্রাণী নেই যে এখানে একদিন না একদিন না-আসে।
আমার জন্মভূমি সোনার দেশ ভারতবর্ষে অবশ্য ভিন্ন ব্যবস্থা। তার সম্বন্ধে অন্য গল্প আছে। সেটা কিন্তু বাজারে চালু হয়নি। আকাশবাণীতে সামান্য যেটুকু প্রোগ্রাম পায় তা-ও কাটা যাবার ভয়ে সে গল্পটি কেউ বলতে চায় না, শুনলেও ভুলে যেতে চায়।
এটম বম পড়লে কী কী কাণ্ড হতে পারে তারই রগরগে বর্ণনা শুনে এক নিরীহ বঙ্গসন্তান তার বৈজ্ঞানিক বন্ধুকে শুধালে, এসব কি সত্যি?
এক দম! বরঞ্চ কমিয়ে সুমিয়ে বলেছে।
তা হলে উপায়? দূর-দূরান্তে, লড়াইয়ের আওতার বাইরে কোনও নির্জন দ্বীপে চলে গেলে হয় না?
হয়। কিন্তু এদেশের সরকার এটম বমের বিরুদ্ধে উত্তম ব্যবস্থা করেছেন। বম ফাটার সম্ভাবনা দেখলেই, আকাশবাণীর কোনও স্টুডিয়োতে ঢুকে পড়ো। সেখানে কোনও রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি নেই।
আমি অবশ্য মৌলানা সাদীর মতো দেনাদারকে পাকড়াবার জন্য বিবিসিতে যাইনি। আমি গিয়েছিলুম আপন ঋণ শোধ করতে। পূর্বেই বলেছি, একদা আমি বেতারে বাঁধা ছিলুম। সে সুবাদে দু একজন কর্মীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এমনকি দহরম-মহরম হয়। দেশে নিষ্কর্মা বিবেচিত হওয়ার পর বিবিসি এদের লুফে নিয়েছে পাড়ার মেধো ওপাড়ার মধুসূদন তুচ্ছার্থে বলা হয়, এখানে কিন্তু সত্যই।
জর্মনির জন্য বিবিসি যে জর্মন প্রোগ্রাম করে তারই বড় কর্তা আসলে ভিয়েনাবাসী জর্মনভাষী ড, ভলফের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে আমাদের সিনহা (আসলে সাদামাটা কায়েতের পো সিঙ্গি, নিতান্ত সম্মানার্থে সিংহ, কিন্তু ছোকরা হামেশাই একটু সায়েবি ঘেঁষা ছিল বলে আমরা বাংলাতে কথা কইবার সময়ও সিনহা বলতুম)। লোকটি অসাধারণ পণ্ডিত এবং সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর দৈনন্দিন সর্ব সমস্যা সম্বন্ধে অহরহ সচেতন। এ সমন্বয় সচরাচর চোখে পড়ে না।
আশকথা পাশকথার পর আমিই বললুম, বিবিসির জর্মন কর্মচারীদের উচ্চারণ জর্মনি থেকে সম্প্রসারিত খাস জর্মন বেতারবাণীর চেয়ে ভালো। প্রিয় অসত্য আমি যে একেবারেই বলিনে তা নয়, কিন্তু প্রিয় সত্য বলবার সুযোগ পেলে আত্মপ্রসাদ হয় ঢের ঢের বেশি।
হিটলার বরিশালের লোক। অর্থাৎ বরিশালের লোক কলকাতার ভাষা বলতে গেলে যে রকম তার কথায় আড় থেকে যায়, হিটলারের পোশাকি জৰ্মনে তেমনি শুধু আড় নয়, তার জন্মভূমি অস্ত্রীয় উপভাষার বোটকা গন্ধ পাওয়া যেত। হিটলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও যাননি, শিক্ষিত আচার্য পণ্ডিতদের তিনি দু চোখে দেখতে পারতেন না, তদুপরি নতুন ভাষা বাবদে তিনি ছিলেন মোল আনা অগা। (মুসসোলিনি চমৎকার জর্মন বলতে পারতেন এবং একমাত্র তার সঙ্গেই কথা কইতে তাঁর দোভাষীর প্রয়োজন হত না। ওদিকে আবার স্তালিনের রুশ উচ্চারণে ককেশাসের শুরুভার ছিল বলে তিনি লেকচরবাজি করতে ভালোবাসতেন না কিন্তু এৎস্কি ছিলেন বহু ভাষায় অসাধারণ পণ্ডিত। কাজেই এসব উল্টোপাল্টা নমুনা থেকে আমি কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে পারিনি। হিটলার যখন রাজ-রাজেশ্বর হয়ে গেলেন তখন যে তার চেলাচামুণ্ডারা শুধু তার উচ্চারণ নকল করতে আরম্ভ করলেন তাই নয়, তারই মতো কর্কশ গলায় (হিটলার টনৃসিলে ভুগতেন) দাবড়ে দাবড়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন– এক গ্যোবেলস্ ছাড়া। জর্মনির খানদানি শিক্ষিত পরিবারে যে ঋজু, স্বচ্ছ, চাঁচাছোলা উচ্চারণ প্রচলিত ছিল, অধ্যাপকরা যে ভাষায় কথা বলতেন, থিয়েটার-অপেরাতে যে উচ্চারণ আদর্শ বলে ধরা হত, সেটা লোপ পাবার উপক্রম করল। যুদ্ধ লাগার পূর্বে এবং পরে যারা লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে বিবিসির জর্মন সেকশনের ভার নিল তারা প্রধানত ওইসব শ্রেণির বুদ্ধিজীবী। আজকের দিনে যারা হিটলারি রাজত্বের বারো বৎসরের দুঃস্বপ্ন যত তাড়াতাড়ি পারে ভুলে যেতে চায় তবু পুরনো দিনের অভ্যেস অত সহজে যাবে কেন?
তাই বিবিসি-র জর্মন উচ্চারণ এখন খাস জর্মনির চেয়ে খানদানি।
অভ্যাস যে সহজে যেতে চায় না তার উদাহরণ যত্রতত্র সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। বাঙলা দেশ থেকেই তার একটা অতি সাধারণ উদাহরণ দিয়ে আরম্ভ করি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এদেশে কাপড়ের কী অনটন পড়েছিল সে কথা আমরা ভুলিনি। তারই ফলে পাঞ্জাবির ঝুল কমে কমে প্রায় গেঞ্জির মতো কোমরে উঠে গিয়েছিল। তার পর লড়াই শেষ হওয়ার পর যখন বাজারে আর আদ্দির অভাব রইল না, তখনও কিন্তু স্কুল আর নামে না। ইতোমধ্যে ওইটেই হয়ে গিয়েছে ফ্যাশান!
ইংলন্ডেও তাই। সেই যে যুদ্ধের সময় কাপড়ের অভাবে মেয়েরা অল্প ঘেরের স্কার্ট বানাতে বাধ্য হয়েছিল আজ সেটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং তার ঘের এতই মারাত্মক রকমের অল্প যে বাসের পাদানিতে পা ভোলা যায় না। বাসের হ্যাঁন্ডিল ধরে মেম সায়েবদের লাফ দিয়ে একসঙ্গে দু পা তুলে বাসে উঠতে হয়। আমারই চোখের সামনে একদিন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। একটু ফুল সিম্ (আজকাল মোটা বলা অসভ্যতা– সেটা সংস্কৃত পদ্ধতিতে ফুল স্লিম বলাটা যে আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন তাঁকে বার বার নমস্কার!) মহিলা বাসে উঠতে গিয়ে লাফ না দিয়ে পুরুষদের মতো পা তুলতেই চড়চড় করে স্কার্টটি প্রায় ই-পার উস্-পার!
যাদের কম ঘেরের লুঙ্গি পরার অভ্যাস আছে তাদের নিশ্চয়ই এ অভিজ্ঞতাটি একাধিকবার হয়েছে প্রধানত লুঙ্গির বার্ধক্যে।
ঘটনাটা নিত্যি নিত্যি এ দেশে হয় কি না বলতে পারব না, কারণ যে কটি লোক কাণ্ডটা দেখলে তারা মৃদু হাস্য করা দূরে থাক, তাদের নয়নের উদাস দৃষ্টি যেন সঙ্গে সঙ্গে উদাসতর হয়ে গেল। আমিও ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ শহুরে হয়ে গিয়েছি। মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজে বরিলের বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই সই পড়তে লাগলুম।
ঘটনাটি প্রচুর ধ্বনি ও ব্যঞ্জনা সহকারে এক ইংরেজ বন্ধুকে যখন বাখানিয়া বললুম, তখন তিনি বললেন, কেন, এ ব্যাপার তো এখন ক্লাসিসের পর্যায়ে উঠে গেছে। শোনো এক কনি আর এক কনিকে উপদেশ দিচ্ছে, মিলের শেয়ার না কিনতে। কী হবে কিনে? কাপড়ের এখন আর কতখানি প্রয়োজন? এই দেখ না, আমি আমার স্ত্রীর গেল বছরের স্কার্ট দিয়ে নেকটাই বানিয়েছি, আর তিনি আমার গেল বছরের টাই দিয়ে এ বছরের স্কার্ট বানিয়েছেন।
কিন্তু এহ বাহ্য। এসব জিনিস দিয়ে ইংরেজ চরিত্রের অদল-বদল হয়েছে কি না সে কথা বলা অসম্ভব না হলেও কঠিন। এক মার্কিন সেপাই যুদ্ধের সময় বাঙলা দেশের ভিতর দিয়ে যাবার সময় দেখে, যেখানেই পুকুর কাটা হয়েছে সেখানেই পুকুরের মাঝখানে মাটির কোনিকাল থাম রাখা হয়েছে। আসলে এটা কতখানি মাটি কাটা হয়েছে তার মাপ রাখবার জন্য এবং মাটি-কাটাদের মজুরি চুকিয়ে দেবার পর এ থামগুলোও কেটে ফেলা হয় কিন্তু মার্কিন তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখলে, বাঙলা দেশের লোকই সবচেয়ে বেশি শিবলিঙ্গ পুজো করে। এন্তের পয়সা খরচ করে বিরাট বিরাট পুকুর খুঁড়ে মাঝখানে শিবলিঙ্গ স্থাপনা করে।
এটা শুনে আমার মনে শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। না হলে ক্লিয়াপাত্রার নিডল (অবিলিস্ক) ইয়োরোপে যে সম্মানের সঙ্গে রাখা হয়েছে তার থেকে মীমাংসা করে আমিও বলে দিতাম, ইয়োরোপেও লিঙ্গপূজা হয়।
যতই খবরের কাগজ পড়ি, রেডিয়ো শুনি, টেলিভিশন দেখি, পাবে কথাবার্তা কই, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লাঞ্চ-ডিনার খাই, মোটরে করে গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যাই, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে অবরে সবরে রসালাপ করি (তার সুযোগ বিস্তর, কারণ ট্রাফিক জ্যামের ঠেলায় ঘাটে ঘাটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়) বাকা নয়নে সবকিছু দেখি, খাড়া কানে অধর্মাচরণে অন্য লোকের কথাবার্তা শুনি ততই মনে হয়, সেই পুরনো ফরাসি প্রবাদ, প্ল্যু সা শাঁজ প্ল্যু সে লা মেম শোজ (দি মোর ইট চেঞ্জেস, দি মোর ইট ইজ দি সে থিং), খোল-নলচে বদলেও সেই পুরনো হুঁকো।
এই যে জর্মনির হাতে ইংরেজ বেধড়ক বম্ খেল, কই, কথায় কথায় তো জর্মনিকে কটুবাক্য করে না; দু এক জায়গায় যে কালোয়-ধলায় মারামারি হচ্ছে, কই সাধারণ ইংরেজ তো সাদার পিছনে দাঁড়ায়নি; উল্টো প্রতিবাদ জানাচ্ছে, এমনকি শুনতে পেলুম পার্লিমেন্টে নাকি কে যেন বিল আনবেন, যেসব হোটেল-ওলা কালো-ধলায় ফারাক করে তাদের সায়েস্তা করবার জন্য; নানা প্রকার আমদানি-রপ্তানির ওপর যদিও বাধ্য হয়ে কিছু কিছু আইন জারি করতে হচ্ছে তবু তো ইংরেজ আরও কয়েকটা জাত নিয়ে একটা খোলা বাজার তৈরি করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে। ত্রিশ বছর আগেও মনে হয়েছে, এখনও মনে হল, ইংলন্ডে কনসারভেটিভও লিবরেল, লেবারও লিবরেল হয়ে গিয়েছে। তাই বোধহয় খাস লিবারেল দলের জেল্লাই সেখানে কমে গিয়েছে। যে দেশের সবাই ভাত খায় সেখানে তো আর ভাতখেকোদের আলাদা হোটেল হয় না।
তাই তাজ্জব মানি, এলিয়ট এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন কী করে।
সিনহা না ভলফ শুধিয়েছিলেন সে কথাটা মনে নেই।
আজ যখন অ্যারোপ্লেনে করে অষ্টপ্রহরে কলকাতা থেকে লন্ডনে যেতে পারি, প্যারিসের লোক আর কয়েকদিনের ভিতরেই দেশে খাবে ব্রেকফাস্টনিউইয়র্কে খাবে লাঞ্চ, সর্বদেশের ভৌগোলিক গণ্ডি যায় যায়, শঙ্কর দর্শন আলোচনা করতে হলে প্লাতোর উল্লেখ না করলে সমালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ক্রোচের সমালোচনায় অভিনব গুপ্তের নামোল্লেখ অভিনব বলে মনে হয় না, লন্ডন পাউন্ডের দাম কমালে আর পাঁচটা দেশ পড়িমরি হয়ে সেই কর্ম করে, জর্মনিতে নতুন দাওয়াই বেরোলে সেটা কলকাতার কালোবাজারে ঢোকে সাত দিনের ভিতর, বিলিতি ফিরে মরমিয়া কেঁই কেঁই সুরের দিশি ভেজাল হন্টরওয়ালিতে শোনা যায় পক্ষাধিক কালে, তখন শুনতে হবে খ্রিস্টধর্মের, একমাত্র খ্রিস্টধর্মের তা-ও চার্চ অব ইংলন্ডের খ্রিস্টধর্মের জয়গান? সেইটে বারণ না করলে পৃথিবীর আদর্শ সমাজে আমাদের স্থান নেই?
কারণ এলিয়ট অতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আমাকে যদি ধর্মান্ধ বলা হয় তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। যদি খ্রিস্টীয় সমাজই চাও তবে তাতে মেলা স্বাধীন পন্থা, স্বাধীন মতবাদের ঝামেলা লাগালে চলবে না (ইউ ক্যানোট এলাও কনজেরিজ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট সেকটস)। ইংলন্ডের নৈতিক পন্থা, এবং বৈদেশিক নীতি ঠিক করে দেবে চার্চই। আর তার আদর্শ রাষ্ট্রে ইহুদিদের সংখ্যা যে অতিশয় সীমাবদ্ধ থাকবে সে কথা তো পূর্বেই নিবেদন করেছি। (এখানে বলে দেওয়া ভালো আমি পাপী; সে আদর্শ সমাজে স্থান চাইনে; আমি শুধু তার বাঙালি শিষ্যদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলুম।)
আমি তো আশা করেছিলুম, ভৌগোলিক গণ্ডি যখন জেরিকের দেয়ালের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তখন শিক্ষিত মানুষ সেই ধর্মেরই অনুসন্ধান করবে যে ধর্ম তার বিরাট বাহু মেলে সবাইকে আলিঙ্গন করতে চায়। আমার তো মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ যখন ইংলন্ডে মানবধর্মের জয়গান গেয়েছিলেন তখন তিনি বলদের সামনে বেদপাঠ কিংবা মোষের সামনে বীণা বাজাননি।
.
ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি–অর্থাৎ ইংরেজ বাড়িঘর ছিমছাম রাখে, হিন্দু মেয়েরা জামা-কাপড় (বিশেষ করে গয়না-গাটি) পরে ভালো, আর মুসলমানের কুলে পয়সা যায় তার হাঁড়িতে, উত্তম আহারাদি করে তার দিন কাটে। তাই ব্রিামদা একদিন আপন মনে প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, মুসলমানদের ভিতর এত শিক্ষাভাব কেন? তার পর আপন মনেই উত্তর দিয়েছেন, যেখানে শিককাবাব বেশি সেখানে শিক্ষাভাব তো হবেই।
বিবিসির অন্যতম বাঙালি মুসলমান কর্মী আমাকে বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন সম্বন্ধে প্রশ্ন শোধাননি, জর্মন প্রেসিডেন্ট হয়েসের আসন্ন লন্ডনাগমনের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আমার সুপক্ক মতামত জানতে চাননি, এমনকি ইংরেজ নারীর নমনীয়তা কমনীয়তা সম্বন্ধেও তিনি উদাসীন। আমাকে শুধালেন, আহারাদি?
আমি বললুম, ইংরেজের তো বাড়ি; দুনিয়ার হাঁড়ির খবর রেখেও তার হাঁড়ি শূন্যই থেকে গেছে।
তার পর বিজ্ঞভাবে মাথা নেড়ে জর্মন অধ্যাপকদের বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে আরম্ভ করলুম, নরমানরা আলবিয়ন ভূমি জয় করার ফলে ধর্ম, রাজনীতি তথা সাহিত্যজগতে যেসব বহুবিধ ঘূর্ণিবাত্য, ভূমিকম্প, প্লাবনান্দোলন আরম্ভ হয়েছিল তদ্বিষয়ে বহুতর পুস্তক, সংখ্যাতীত প্রবন্ধ এবং ভূরি ভূরি গবেষণামূলক কোষ লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ওহহা হতোস্মি, ইহলোক-লোক উভয় লোকের সঙ্গমভূমি এই যে উদর (পিতৃলোকের একমাত্র কাম্য পিণ্ড, এ তথ্য কুলাঙ্গারও স্মরণ রাখে।) তদ্বিষয়ে অতিশয় যৎসামান্য স্মৃতিশ্রুতি বর্তমান। পরম মনস্তাপের বিষয় অদ্যাবধি আলবিয়ন ভূমির শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় এই সর্বোত্তম সনাতন মার্গ সম্বন্ধে সম্যক সংবিদিত হয়নি।
কর্মী বললেন, বাংলা অভিধান হাতের কাছে নেই।
ত্রিতাল থেকে একতালে যাওয়া অশাস্ত্রীয়। কিন্তু শাস্ত্র মেনে কী হবে? পূর্বেই নিবেদন করেছি, রবীন্দ্রনাথের সর্বশাস্ত্রসম্মত মানবধর্ম শ্বেতভূমিতে অনাদৃত।
আমি বললুম, নরমানরা আসার পূর্বে এদেশের লোক বোধহয় কাঁচা মাংস খেত। এই দেখুন জ্যান্ত ভেড়ার নাম ইংরেজিতে শিপ, তার মাংস রান্না করে খেতে হলে সেটা হয়ে যায় মটন। শিপ শব্দ খাস ইংরেজি, মটন শব্দ ফরাসি, নরমান যা খুশি বলতে পারেন; কাউ ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে (তোবা, তোবা)! ফরাসি শব্দ বি; কাফ ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে ফরাসি শব্দ ভিল; ঠিক সেইরকম সুয়াইন ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে (রাম রাম)! ফরাসি শব্দ পোর্ক; ইংরেজি ডিয়ার ফরাসি ভেনজন ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি যেসব রসবস্তু দিয়ে এগুলোকে সুস্বাদু করা হয়, যথা সস, সেভারি, ভিনিগার, মায়োনেজ, সেগুলোও ফরাসি শব্দ। খাবার মেনু ফরাসি; তার প্রধান ভাগ অরদ্যভ্র (অবতরণিকা), কসমে-পতাজ (শুরুয়া বিভাগ), আঁত্রে (প্রবেশ), পিয়েস দ্য রেজিসাস (পিস্ অব রেজিসটেনস্ অর্থাৎ প্রধান খাদ্য যা দিয়ে পেট ভরাবে), স্যালাড, ডেসের (ফলমূল, মিষ্টি), সেভরি (শেষ চাট) সবই ফরাসি। আর পদগুলোর নাম, কসমে জ্বলেয়্যন, পটাজ ও ফেরমিয়ে (চাষাদের(!) সুপ), অমলেট ওর্জেব (পেঁয়াজ পুদিনার অমলেট) এখানেও দেখুন এগ ইংরেজি শব্দ কিন্তু অমলেট ফরাসি। এসব আরম্ভ করলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। আশু ইংলগামী এর কটিঙটা রাখলে উপকৃত হবেন; আমাকে নিমন্ত্রণ করে সঙ্গে নিয়ে গেলে আরও বেশি উপকৃত হবেন; কারণ যেগুলোর নাম করলুম এগুলো ভোজনতীর্থের বিখ্যাত কাশী বৃন্দাবন হিংলাজ গোটাটি করে নিয়ে যেতে হয় হাতে ধরে)।
এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। মহানগরী কলকাতার হিন্দুসন্তান যখন পোশাকি মাংস খায় তখন সে ভাত খায় না, সে তখন বেরোয় খানা খেতে এবং যবনের হাতে কিন্তু স্বেচ্ছায়। কোর্মা, কালিয়া, বিরিয়ানি, কাবাব, দোলমা এবং সবকটি শব্দই বিদেশি; বাংলা প্রতিশব্দ নেই। চপ, কাটলেট, অমলেটও বিদেশি শব্দ। তফাৎ এই যে ইংরেজিগুলো হিন্দু হেঁশেলে ঢুকেছে, মুসলমানিগুলো ঢুকতে পারেনি। তার কারণ, মুসলমানিগুলো রান্না একটু বেশি শক্ত।
শেষোক্তগুলো কলকাতার মুসলমানরাও খেতে শিখেছেন।
এক মুসলমান গেছেন হোটেলে। বয় এক কাটলেস লে আও।
হুজুর আজ মিট-লেস।
সায়েব বললেন, কুছ পরোয়া নাহি; সো হি লাও।
সায়েব ভেবেছেন মিট লেস (দিন) বুঝি কাটলেসের এক নবীন সংস্করণ।
মূল কথায় ফিরে যাই।
নরমান জয়ের পর ক্রমে ক্রমে যেসব বিদেশি খাদ্যরাজি বিলাতে প্রবর্তিত হল, তার ইতিহাস এখনও আমার চোখে পড়েনি– পক্ষান্তরে ফরাসি খাদ্যের সর্বাঙ্গসুন্দর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে উত্তম উত্তম পুস্তক দেখেছি। শুনেছি, মহামান্যবর স্বর্গীয় আগা খান এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভোজনরসিক ছিলেন। তাঁর নাকি একখানি বিশাল বিরাট এটলাস ছিল। তাতে পৃথিবীর কোন জায়গায় কোন সময় কোন খাদ্য উত্তমরূপে প্রস্তুত হয় সেগুলো চিহ্নিত ছিল। এ পৃথিবীর সব খাদ্যই যখন তিনি একাধিকবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন তখন নতুন রসের সন্ধানে অন্যলোকে চলে গেলেন। আমার হাজার আপমোস তাঁর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি বলে।
তা সে যাই হোক, একথা, মোটামুটি বলা যেতে পারে বর্বর ইংরেজি রান্নার প্রতীক ছিল ক্রুয়েট স্ট্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি। এতে থাকত সিরকা, অলিভ তেল, উস্টার সস আর সরষে। নুন গোলমরিচ তো আছেই। বস্তুত এর কোনও একটা কিংবা একাধিক বস্তু না মিশিয়ে অধিকাংশই খাওয়া যেত না। নিতান্ত খরগোশ গোত্রজাতরাই ইংরেজের স্যালাড কচর কচর করে চিবুতে পারত। পার্ক সার্কাসের রদ্দিতম ধনে কিংবা পুদিনা স্যালাড এর তুলনায় অমৃতগন্ধী মধুমঞ্জরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেপাইরা ট্রেঞ্চে শুয়ে শুয়ে অখাদ্য খেয়ে খেয়ে স্বপ্ন দেখত, ছুটিতে প্যারিসে ছিমছাম রেস্তোরাঁয় করকরে টেবিলক্লথগুলো ছোট্ট টেবিলের উপর মেডফুড–অর্থাৎ তৈরি খাবারের; ইংরেজি ধরনে নুন লঙ্কা তেল সস মিশিয়ে খেতে হয় না, ফরাসি শে এসব বস্তু রান্নাঘরেই পরিপাটিরূপে তৈরি করে দিয়েছে আমাদের মা-মাসিরা যেরকম মাছের ঝোল কিংবা চালতের অম্বল করে দেন। তারই ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজি রান্নার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন হয়। সেইটে আমি চোখে দেখি ১৯৩০ সালে। অখাদ্য লেগেছিল কারণ, সদ্য গিয়েছি লন্ডনে– প্যারিস থেকে।
ইনভেশনের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বসংসারের জাত-বেজাত জড়ো করা হল ইংলন্ডে–আলেকজান্ডারের সময় মেসিডোনিয়ায় কিংবা রোমের মধ্যাহ্ন দীপ্তির সময়ও এ শহরে বোধহয় এরকম সাড়ে বত্রিশ ভাজা কখনও হয়নি। ফলে লন্ডনের রান্না আপাদমস্তক বদলে গিয়েছে।
সেইটে চাখলুম ৫৮-এ।
সবকিছু বেবাক বদলে গিয়েছে। ইস্তেক ক্রুয়েট তার মালমসলাসুদ্ধ গায়েব। যেদিন নুন লঙ্কার শিশিও যাবে, সেদিনই ইংরেজি রান্না তার চরম মোক্ষে পৌঁছবে। কে না জানে, ভালো রাঁধুনি কাউকে ফালতু নুন নিতে দেখলে বেদনা পায়। প্যারিসে শোনা যায়, ভোজরাজ সম্রাট আগা খান এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় মনের ভুলে একটু ফালতু নুন নিয়েছিল বলে রেস্তোরাঁর রাঁধুনি দুঃখে আত্মহত্যা করে। ইংলন্ডে এখন পাঁচকই রান্নাঘরে আহারাদি তৈরি করে। গাহককে ডাইনিং হলে টেবিলের উপর পি সি সরকারের মতো নিপুণ যাদুকরি হস্তে সিরকা সস ঢেলে কাঁচাসে মালকে সুস্বাদু করতে হয় না। পৃথিবীর আর পাঁচটা জাত– মায় বান্টু হটেনটট– এতকাল যা করে আসছে।
এবং জাত-বেজাতের নতুন নতুন পদও তার রান্নাঘরে ঢুকতে দিয়েছে।
ত্রিশ বছর আগে রাইস-কারি খেতে হলে আপনাকে লিভিংস্টোনের মতো ছ মাসের চালচিড়ে পুরনো ধুতিতে বেঁধে বেরোতে হত তারই আবিষ্কারে। বহু বাজে লোক কর্তৃক বেপথে চালিত হয়ে, বহু পুলিশমেনের সক্রিয় সহযোগিতার ফলে, অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জিয়া আপনি যখন মোকামে পৌঁছতেন তখন রাইস-কারি খতম! সেই লক্ষ্মীছাড়া বিফস্টেক খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। মনে পড়ত সেই গরিব মোল্লার কাহিনী। চেয়ে-চিন্তে অতি কষ্টে খেয়ার একটি পয়সা যোগাড় করে সে যখন ওপারে ফাতেহার (শ্রাদ্ধের) ভোজে পৌঁছল তখন সবকিছু ফুরিয়ে গিয়েছে। মেহমানকে তো আর অভুক্ত ফেরানো যায় না– তাড়াতাড়ি ভাত আর মসুর ডাল সেদ্ধ করে তাকে খাওয়ানো হল। মনের দুঃখে সে বললে, ওরে ডাল, আমি না হয় খেয়ার পয়সা ধার করে যোগাড় করলুম; তুই পেলি কোথায়? আপনিও স্টেককে শুধাবেন, এ পথ তুই পেলি কোন পুলিশকে শুধিয়ে?
একদম পয়লা নম্বরি হোটেলে অর্থাৎ যেখানে গ্রস্টারের ডুক, কেন্টের ডাচেস খেতে যান– আমি যাইনি। তার অধিকাংশই দামের ঠেলায় ফাঁকা। বিরাট হলের এখানে দু জন ওখানে চারজন লোক খাচ্ছে, আর বেকার ওয়েটারগুলো ইভনিং ড্রেস পরে হেথা-হোথা জটলা পাকাচ্ছে, বাড়িটা যেন খা খা করছে–এমন জায়গায় খেয়ে সুখ নেই। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল চ্যারিটি ম্যাচে যদি গিয়ে দেখেন মাত্র আপনি আর ওপাড়ার গোবর্ধন উপস্থিত, আর কেউ নেই, তখন কি খেলা দেখাটা জমে? অবশ্য যেখানে এমন ভিড় যে পলায়মান বয়ের কাছাতে হ্যাঁচকা টান না দেওয়া পর্যন্ত একটা হাফ-সিঙ্গিল চা জোটে না সেখানেও গব্বযন্ত্রণা। বাচ্চা এবং চা আসি আসি করে না এলে কী পীড়া তা শুধু পোয়াতি আর গাহকরাই জানে।
অতএব যেতে হয় দুই নম্বরি হোটেলে। এবং সেখানেও হরবকৎ রাইস-কারি পাবেন– পয়লা নম্বরিতে পান আর না-ই পান। আর কোনও কোনও রেস্তোরাঁয় লেখা আছে পাটনা রাইস! পাটনা রাইসের প্রতি এ দুর্বলতা কেন? রাষ্ট্রপতির শহর বলে?
আর যারা খাচ্ছে তারা বাঙালি নয়, ভারতীয় নয়–দুনিয়ার চিড়িয়া।
এইসব খাস বিলিতি রেস্তোরাঁতেই যদি রাইস-কারি জামাইয়ের কদর পাচ্ছে তবে তার আপন বাড়িতে অবস্থাটা কী রকম?
সে এক অভিজ্ঞতা।
লন্ডনের বুকের উপর তবে ঠিক বড় রাস্তায় নয়। ভালোই, হট্টগোল কম। এই আমাদের বড়বাজারে যতখানি। তবে বড় রাস্তায় গোলমাল কত? মুখুজ্যেকে শোধাবেন। সে বেচারি ঘুমুতে পারত না!
ইয়া লম্বা, উর্দি পরা মাথায় পাঠানি পাগড়ি, ছ ফুটি দারোয়ান। যেখানে হ্যাট রেনকোট ছাড়তে হয় সেখানেও তদ্বৎ। ঢুকেই লাউঞ্জ ককটেলটা-আসটা খাবার জন্য; ভাগ্যিস ওটা মুরারজি ভাই চালান না। সাজসজ্জা পুরা ভারতীয়। হেথায় নটরাজের ব্রোঞ্জ, হোথায় পেতলের ভারতীয় অ্যাসট্রে, আরও এটা সেটা, ধূপকাঠিও জ্বলছে।
এগিয়ে এলেন খাপসুরৎ শ্যামাঙ্গী, পরনে মুর্শিদাবাদি, চুলে তেল পড়েছে মেমেদের শনপাটের মতো স্নেহহীন নন– খোঁপাটিও নসিকে বাঙালোরি, ব্লাউজ ব্লাউজেরই কাজ করছে চোলির প্রক্সি দিচ্ছে না– চোখেমুখে খুশি, ভারি চটপটে। একটা নমস্তে ভি পেশ করলে।
বাহ্! এ তো বেড়ে ব্যবস্থা।
গাছে না উঠতেই এক কাঁদি।
তা হলে উত্তম আহারাদি হবে।
ফরাসি গুণী রশফুকোল বলেছেন, আহার প্রয়োজনীয় বটে; কিন্তু রসিকজনের মতো আহার করা আর্ট। ভোভানার্গ বলেছেন, মহৎ চিন্তা পেটের ভিতর থেকে আসে। গ্রিক দার্শনিক এপিকুর বলেছেন, প্রকৃতিদত্ত বুদ্ধিবৃত্তি উত্তম কর্মে নিযুক্ত করবে এবং সুবুদ্ধিমানের মতো পরিপাটি আহার করবে। এবং ইলেসিয়াসের মাধ্যমে নমস্য বাইবেল গ্রন্থ অনুশাসন দিয়েছেন, পান, আহার ও আনন্দ করার (ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড বি মেরি) চেয়ে মহত্তর কর্ম ত্রিভুবনে নেই।
আর মলিয়ের যখন বলেন, আমরা বাঁচার জন্য খাই; খাওয়ার জন্য বাঁচিনে, তখন তিনি বর্বর জনসুলভ প্রলাপবাক্য ব্যবহার করেছেন। আমরা খাওয়ার জন্য বাঁচি, বাঁচার জন্য খাই না! ভোজনাদি সম্বন্ধে আমি আলোচনা আরম্ভ করলেই কোনও কোনও উন্নাসিক পাঠক বিরক্ত হন, আবার কেউ কেউ বলেন, এসব কথা তো আগেও যেন শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। উত্তরে নিবেদন, সব কথা শোনেননি; আর শুনে থাকলেই-বা কী? পুরনো জিনিসের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে নিটশে একদা লিখেছেন, এ কথা আমি পূর্বেই বলেছি, কিন্তু মানুষ শোনা কথাই শুনতে চায়, জানা কথাই বিশ্বাস করে।
একদম খাঁটি কথা। আমাদের মোহর বিবি, কণিকা ব্যানার্জিকে যখন শুধাই, সেই রেকর্ডে দেওয়া তোমার গান ওগো তুমি পঞ্চদশী ফের বেতারে গাইলে কেন? ওটা তো ইচ্ছে করলেই রেকর্ড বাজিয়ে আবার শোনা যায়, তখন সে বলে, কী করব, সৈয়দা লোকে যে পুরনো গানই শুনতে চায়। বুঝলুম, বাচ্চাদের কাছে নতুন গল্প বলতে চাইলে তারা যে রকম চেঁচিয়ে ওঠে, না, মামা কালকের সেই বাঘের গল্পটা বল।
দ্বিতীয়ত, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার রচনা বাঙলা দেশে অজরামর হয়ে থাকবে না, আমার রসনির্মাণপ্রচেষ্টা বাণী-সরস্বতীর অঙ্গদে কুন্তলে মাল্যরূপে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে না, কিন্তু এ কথা স্থির-নিশ্চয় জানি, এই বঙ্গসন্তানদের যেদিন কাণ্ডজ্ঞান সম্যক প্রস্ফুরিত হবে, যেদিন তারা ভারতনাট্যম, পিকাসো, সিংহেন্দ্র মাধ্যম কিংবা ভালুকপঞ্চমীর পশ্চাদ্ধাবন কর্ম বর্বরস্য শক্তিক্ষয় বলে সুষ্ঠুরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে সেদিন সে উদমার্গের সন্ধানে নব নব অভিযানের পথে নিষ্ক্রান্ত হবেই হবে। আজ যে রকম চিৎ-জাগরিত বিহঙ্গকাকলির ন্যায় কোনও কোনও বিদ্বজ্জন চৈতন্যচরিতামৃতের ভোজনামৃত খাদ্য-নিঘণ্ট অধ্যয়ন করতে করতে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন উত্থাপন করেন কিমাশ্চর্য! ছানার সন্দেশের উল্লেখ তো কুত্রাপি নেই?–ঠিক সেইরূপ অম্মদ্দেশে যেদিন রাজত্মে রাজবর্ষে চিৎকার প্রতিধ্বনিত হবে, আমাদের দাবি মানতে হবে। ভোজনা মার্গের-গীতা রচনা কর! ইনকিলাব-জিন্দাবাদ! পেট-কিলাব-ঝাণ্ডা তোল! সেদিন, বলতে লজ্জা করছে, বিনয়ে বাধছে, সেদিন এই অধমের, হ্যাঁ, এই অধমের বইয়ের সন্ধানেই বেরুতে হবে বঙ্গের মামলার মমজেনকে। আফগানিস্তানের সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস নির্মাণে মল্লিখিত দেশে-বিদেশে ব্যবহৃত হবে কি না জানি না, কিন্তু এ বিষয়ে সূচ্যগ্রন সূতিক্ষেণ সন্দেহ নেই যে আজ আমরা যে রকম আমাদের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনার সময় নিরপেক্ষ পর্যটক পরিদর্শক হিউয়েন সাঙের শরণাপন্ন হব, ঠিক সেই রকম ইংলন্ড-সন্তান যেদিন সভ্য হয়ে তার দেশের ভোজনেতিহাস লিপিবদ্ধ করবে সেদিন তাকে বেরোতে হবে– পুনরায় ব্রীড়িত হচ্ছি– এই আমারই বইয়ের সন্ধানে, রাখাল বাঁড়য্যেকে যে রকম মোন-জো-দড়ো সন্ধানে একদা বেরুতে হয়েছিল; আপনাদের রবিঠাকুরের চাঁদ উঠেছিল গগনের সন্ধানে দেশে কেউ আসবে না। রায়গুণাকর অন্নদাশঙ্করের রত্ন ও শ্রীমতীর জন্য তাঁর প্রকাশক মাত্র ইয়োরোপকে চ্যালেঞ্জ করেছে, আমার প্রকাশক বিশ্বভুবনকে ক্রৌঞ্চমুদ্রা প্রদর্শন করবে, কাজী সায়েবের ভাষায় (আল্লা তাঁর বিমারি বরবাদ করে জিন্দেগি দরাজ করুন।) ত্রিভুবনেশ্বরের সিংহাসন নিয়ে আকর্ষণ-বিপ্রকর্ষণ আরম্ভ করবে।
.
সেই রত্নসমা শ্রীমতী তো ফরাসিস পানীয়ের কথা ওঠাতে আরেকবার বিলক্ষণ বলে অন্তর্ধান করলেন; আমি ভাবলুম, ওই য যা। ব্যাকরণে বুঝি গলতি হয়ে গেল। এ যে সম্ভ্রান্ত ভারতীয় ভোজনালয়! এ সব বিদগ্ধ পানীয় বোধহয় এখানে নিষিদ্ধ। আবার বাঙাল বনে গেলুম নাকি?
নাহ! কোনও ভয় নেই। ভাতিজা, চ্যাংড়া মুখুজ্যে ঘটিস্য ঘটি। সে দেখি দিব্য তার টুথব্রাশ গোঁফে আঙুল বুলোতে বুলোতে নিশ্চিন্ত মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে– চোখদুটো যেন ব্লটিং পেপার– সবকিছু শুষে নিচ্ছে। পুরীর সমুদ্রপাড়ে ঢেউ দেখে অবনঠাকুর ভীত হয়ে পালাবার পথ খুঁজছিলেন, তখন তাঁর এক স্যানা বন্ধু তাঁকে বলেন, ভয় কিসের? সায়েব-সুবোরা তো চতুর্দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ তেমন কিছু বিপজ্জনক পরিস্থিতি হলে পুলিশ আগেই তাদের খবর দিতেন, তারাও কাটতেন।
যাক। এদেশে আনকোরা আগত মুখুজ্যে যখন নিশ্চিন্ত তবে আর আমার ভয় কী? তখন কি আর ছাই জানতুম, সে আমারই ভরসায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে।
কিন্তু, সায়েব-সুবোরা তো রয়েছেনই। তেনারা তো পানীয় বেগর ভোজন করতে পারেন না।
এবং সাতিশয় উল্লাসের সঙ্গে লক্ষ করলুম, কোনও ভারতীয় লাউঞ্জে নেই। তারা নিশ্চয়ই মনুনিষিদ্ধ এই পানে লিপ্ত পাপবিদ্ধ হয় না। সোজা ডাইনিংরুমে ভোজন করতে গিয়েছে। তাদের চরিত্রবল দেখে উল্লাস বোধ করলুম।
ওদিকে দেখি শ্রীমতী অন্য খদ্দেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। ভারি বিরক্তিবোধ হল। এ যে দেখি হুবহু বাঙালি দোকানের মতো। আপনাকে জিনিস দেখাতে দেখাতে হঠাৎ অন্য খদ্দের ঢুকছে দেখে দিল ছুট তার দিকে আপনাকে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলিয়ে রেখে, কিংবা যে রকম নির্মল সিদ্ধান্ত জানান যে আপনার পরীক্ষার ফল পরে বেরুবে!
নাহ্। আমারই ভুল। দেখি হেলে-দুলে একটি মোটাসোটা ভারিক্কি ধরনের লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এর গলায় গলাবন্ধ কোটের উপর ঝোলানো মসীকৃষ্ণ উপবীত ও তৎসংলগ্ন কুঞ্চিকা দেখে এর জাতগোত্র বুঝতে আমার কণামাত্র সময় লাগল না। যারা সংস্কৃতে লেখা প্রতিমালক্ষণ সংক্রান্ত অত্যুকৃষ্ট গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন করেছেন তারাই জানেন, প্রতিমা দেখে কোনটা কোন দেব না দেবীর জানতে হলে স্মরণ রাখতে হয়, কোন দেবীর দক্ষিণ হস্তে কুবলয় বলয়, কার বাম হস্তে চক্র, কার মস্তকে উষ্ণীষ, কার পদে নূপুর।
কুঞ্চিকাসমন্বিত কৃষ্ণোপবীত ওয়াইন মাস্টারের লক্ষণ।
আপনি যদি চাষাড়ে হুইস্কি বিয়ার রাম জিন্ না খেয়ে উত্তম বিদগ্ধ ফরাসি কিংবা জর্মন অথবা ইতালীয় ওয়াইন খেতে চান তবে এই ভদ্রসন্তান আপনাকে পরম বান্ধবের ন্যায় তাবৎ সন্ধিসুড়ক বাতলে দেবেন। চাণক্য বলেছেন, ব্যসনে (এবং মদ্যপান ব্যসন-বিশেষ) যে সঙ্গে থাকে সে বান্ধব। ইনি তাই করে থাকেন। তবে চাণক্যের বান্ধব আপনাকে কোনওগতিকে ঠেকিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবার চেষ্টা করে; ইনি মোকা পেলে ওস্কাবার চেষ্টা করেন– এই যা তফাৎ।
মৃত্যুঞ্জয় যে রকম কৈলাসে বিহার করেন, রাশান ডিকটেটর যে রকম ক্রেমলিনে বাস করেন, ভেজাল যে রকম খাদ্যে বিরাজ করেন, ওই ওয়াইন মাস্টারটি ঠিক তেমনি বিচরণ করেন অতিশয় পয়লানম্বরি খানদানি ভয়াঙ্কুর রেস্তোরাঁতে। ভয়াঙ্কুর বললুম ইচ্ছে করেই। এখানে অঙ্কুর পর্যন্ত বিনষ্ট হয়। ইনি আপনার সব অপহরণ করেন। পাতলুন বন্ধক দিয়ে বিল্ শোধ করতে হয়।
ভীতকণ্ঠে ভাতিজাকে শুধালুম, ওরে রেস্ত আছে তো?
ভিতরের বুক-পকেটের উপর থাবড়া মারার মুদ্রা দেখিয়ে বললে, কুছ পরোয়া নেই; আপনি চালান।
সোনার চাঁদ ছেলে। একেই বলে বান্ধব। ব্যসনে সঙ্গে থাকে।
এ জীবনে আর যদি কখনও চাকরি নিই তবে উমেদার হব এই ওয়াইন মাস্টারের চাকরির জন্য বেতারের কাজ হয়ে গিয়েছে, সেখানে শুধু খাপসুরৎ কলাবতীর ঝামেলা; তারা আমাকে যথেষ্ট কলচর বলে বিবেচনা করেন না।
খানদানি রেস্তোরাঁর চার ইঞ্চি পুরু মহামূল্যবান ইরানি গালচের উপর মৃদু পদসঞ্চরণ করে কাটবে আপনার জীবন– ভ্রমর যে রকম তঙ্গীর বিশ্বধরে পদক্ষেপ করে ঠিক সেই রকম (বিশ্বাস না হলে কালিদাস পশ্য) একজোড়া চার আউন্স ওজনের ইভনিং শুতে কেটে যাবে ঝাড়া দশটি বছর হাপসোল পর্যন্ত বদলাতে হবে না। এ টেবিলে গিয়ে কাউকে বলবেন, তিপানের নিরেনস্টাইনার- সে একটি স্বপ্ন! ১৯৫৩-এ সেখানকার আঙুর মোলায়েম রৌদ্রে যা রসে টইটম্বুর হয়েছিল, সে রকম ধারা আর কখনও হয়নি। তাই দিয়ে এ সুধা নির্মিত হয়েছে। কখনও-বা অন্য টেবিলে গিয়ে ফিসফিস করবেন, মাদাম, দেখুন, দেখুন এই শ্যাম্পেনের বুদ্বুদ কী রকম লক্ষ লক্ষ পরীর মতো সলোমনের বোতল-বদ্ধ জিনের ন্যায় নিষ্কৃতি পেয়ে লক্ষ লক্ষ হাওয়ার ডানা মেলে উর্ধপানে উড়ে যাচ্ছে। এ বস্তু গলা দিয়ে নাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও ইহলোকের সর্ববন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে নীলাম্বরের মর্মমাঝে উধাও হয়ে যাবেন। তার পর একটু মৃদু হাসি হেসে বলবেন, তাই, মাদাম, এ শ্যাম্পেন যিনি অর্ডার দেন তাঁর কাছ থেকে আমরা আগেভাগেই বিলটা আদায় করে নিই, অবশ্য; আপনাদের বেলা সে কথাই উঠছে না।
এ তো হল। তার পর আপনি ঘড়ি ঘড়ি বারে সেলারে গিয়ে তদারক করবেন, সর্ববস্তু রাজসিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত রয়েছে কি না। রাঁধুনিকে যে রকম সে-সব জিনিস মাঝে মাঝে চেখে দেখতে হয় আপনাকেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে, অতিশয় অনিচ্ছায়–আমাদের বরকর্তারা যে রকম পণ নেন– অল্প-স্বল্প মাঝে-মধ্যে চেখে দেখতে হবে বইকি!
তা-ও হল। ওদিকে আপনাকে প্রতি শরতে ফ্রান্স যেতে হবে, সেখান থেকে নিলামে পানীয় কিনে সেলার পূর্ণ করার জন্য। আপনার কমিশনটা-আসটা ঠেকায় কে? আপনার ভারী ভারী গাহক খদ্দেরের বাড়ির জন্য তাদের প্রাইভেট অর্ডারও সাপ্লাই করবেন। তাতেই-বা কম কী? ওনরা হাত উপুড় করলেই আমাদের পর্বত-প্রমাণ।
আমাদের ওয়াইন মাস্টারটি এসে নমস্তে জানালেন। চমৎকার চেহারা। নেয়াপাতি ভুড়ি, চোখ দুটি জবাকুসুমশঙ্কাসং, যা হওয়ার কথা।
আমি সবিনয়ে বললুম, ত্রিশ বছর পরে এসেছি। ইতোমধ্যে একটা লড়াই হয়ে গিয়েছে। জর্মনরা ফ্রান্স ছাড়ার সময় প্যারিসের নত্র দাম গির্জে সঙ্গে নিয়ে যায়নি বটে, কিন্তু ফ্রান্সের সেলারে সেলারে ঢুকে তার উত্তম-অধম সর্বপানীয় খতম করে যায়। এখন যা ফ্রান্স-ইংলন্ডে পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আপনি পথপ্রদর্শন করুন। তবে এইটুকু বলতে পারি, বর্দো এবং শান্ত।
শান্ত মানে যে বস্তু সোডার মতো বুজবুজ করে না, তেলের মতো শুয়ে থাকে।
চাকুরে যে রকম পেনশনধারীকে খাতির করে, মাস্টার আমাকে সেই রকম কদর করল। আহা, এককালে লোকটা সবকিছু জানত। এখন না হয় আউট অব ডেট! ম্যাক্সমুলার নাকি আমাদের সংস্কৃত শিখে ভশচাযদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, হরিনাথ দে নাকি গ্রিক শিখে গ্রিকদের চিত্তহরণ করেন– এসব শোনা যায়, কিন্তু আমাদের এই পানের প্রভু দেখলুম সত্যিই পেটে এলেম ধরে। দেখলুম হেন পানীয় নেই, যার ঠিকুজিবুলজি তার বিদ্যাচৌহদ্দির বাইরে পড়ে। কবে কোন বৎসরে কোন গায়ের আঙুরে এ জিনিস তৈরি, সে বৎসর আঙুর পাকার সময় সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল না মেঘ ও রৌদ্র, না মোলায়েম মিঠে রোদ্দুরে ছিল, কার চাপযন্ত্রে তার রস বের করা হয়, তাই দিয়ে সবশুদ্ধ ক বোতল তৈরি হয়েছিল, তার কটা গেল মার্কিন মুলুকে কটা এল এ দেশে, এর বডি কী রকম, বুকে (bouquet)-টাই বা রমণীয় কি না– সব-কিছু জিহ্বাগ্রদর্পণে, এবং উভয়ার্থে।
নগণ্য ভারতীয় যে এই বিলিতি বিদ্যে এতখানি হাসিল করেছে তার কাছে মাসমুলারের সংস্কৃতজ্ঞান শিশু।
শুধালুম, ভদ্রে, এ কর্মে কতদিন ধরে আছেন?
সবিনয়ে বললে, আজ্ঞে পঞ্চাশ বছর পূর্বে যখন এ রেস্তোরাঁ খোলা হয় তখন থেকে। সে আমলের আর কেউ নেই।
তবে কি এসব জিনিস খেলে মানুষ দীর্ঘজীবী হয়? অর্থাৎ ওয়াইন– যে বস্তু আঙুরের রস দিয়ে তৈরি হয়েছে; হুইস্কি বিয়ারের কথা উঠছে না।
জানি রসভঙ্গ হবে, তবু হুইস্কি-ওয়াইন কোনও জিনিসই ভালো নয়। অতিশয় শীতের দেশে, কিংবা ডাক্তারের হুকুমে খাওয়া উচিত কি না, সে কথা আমি বলতে পারব না। অতখানি শীতের দেশে আমি কখনও যাইনি বিলেতে গরম দুধ, চা, কফি খেলেই চলে– আর অতখানি অসুস্থও আমি জীবনে কখনও হইনি। মদ্যপান করলে ভালো লেখা বেরোয় এ কথা আমি বিশ্বাস করিনে। মেঘনাদ কাব্য রচনার সময় মাইকেল ক্লান্তি দূর করার জন্য অল্প খেতেন, শেষের দিকে যখন মাত্রা বেড়ে গেল, তখন দু চার পাতা লেখার পরেই বেএক্তেয়ার হয়ে ঢলে পড়তেন– তাঁর গ্রন্থাবলি সে সব অসমাপ্ত লেখায় ভর্তি। এবং তার চেয়েও বড় কথা, আপনি-আমি মাইকেল নই। একখানা মেঘনাদ লিখুন; তার পর না হয় মদ খেয়ে লিভার পচান- কেউ আপত্তি করবে না।
এবং সবচেয়ে মারাত্মক তত্ত্ব শুনেছি কোনও কোনও কলেজের ছোকরার কাছে। বিয়ার নাকি মদ নয়, ওতে নাকি নেশা হয় না, ও বস্তু খেলে নাকি পরীক্ষার পড়া করার সুবিধে!
বটে! বিয়ারে নেশা হয় না? লন্ডন-প্যারিসে রাস্তায় যারা মাতলামো করে তারা কী খায়? কোকা কোলা? অগা আর কারে কয়! ওদের পনেরো আনা বিয়ার খেয়েই মাতাল হয়। আমাকে ওসব বল না; ঠাকুরমাকে ডিম চোষা শেখাতে হবে না।
মূল ফার্সিতে আছে,
গর দস্ত দহজমগজ-ই-গদুম্
নানি,
ওয়াজ ময় দো মনি জু গোসফন্দি
রানি,
ওয়ানগাহ মন্ ওয়া তো নিশতে
দর ওয়েরানি
আয়েশি বোদ আন্ ন্ হ হ।
সুলতানি
এর ইংরেজি–
Here with a loaf of bread
beneath the bough,
A flask of wine, a book of
verse and Thou
Beside me singing in the
Wilderness
And Wilderness is Paradise
enow.
(ফিটসজেরাল্ড)
তার বাংলা—
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে
শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে
দিনটা যায়।
মৌন ভাঙি তার পাশেতে গুঞ্জে
তব মঞ্জু সুর–
সেই তো, সখী, স্বপ্ন আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর।– (কান্তি ঘোষ)
কিংবা
বনচ্ছায়ায় কবিতার পুঁথি
পাই যদি একখানি
পাই যদি এক পাত্র মদিরা আর।
যদি তুমি রানি
সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া
গাহো গো মধুর গান
বিজন হইবে স্বর্গে আমার
তৃপ্তি লভিবে প্রাণ। (সত্যেন দত্ত)
যার প্রাণে যা চায় তিনি সেইভাবে অনুবাদ করেছেন। খৈয়ামের খড়বাঁশের কাঠামোর উপর যে যার আপন মানসমূর্তি স্বপ্নপ্রতিমা গড়েছেন; আসলে কিন্তু আছে,
উত্তম ময়দার তৈরি রুটি যদি
হাতে থাকে,
আর যদি থাকে দু মণ মদ এবং
বাচ্চা ভেড়ার আস্ত একখানা ঠ্যাং (রান),
ঘুঘু-চরা পোড়া বাড়িতে কাছাকাছি বসে
তুমি আমি দু জনা।
সে আনন্দ বহু সুলতানেরও ভাগ্যে।
জোটে না।
খৈয়াম এ কবিতায় কবিত্ব করেননি। তিনি সাদামাটা ভাষায় বলেছেন, তার কী কী চাই। মোলায়েম কবিতায় বিলকুল অচল হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভেড়ার একখানা আস্ত ঠ্যাং (রান্ কথাটা আসলে ফারসি এবং তিনি ইটি এ স্থলে নির্ভয়ে ব্যবহার করেছেন) অর্ডার দিয়েছেন এবং পাছে নেশা জমবার আগে মদ ফুরিয়ে যায় তাই পাক্কা দু মণ খাঁটি চেয়েছেন। এবং লক্ষ করার বিষয় তিনি কবিতার বই আদপেই চাননি। যে জিনিস যে পারে সেটা সে চায় না। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে যে দড়ির উপর নাচতে পারে সে প্রিয়াকে নিয়ে বোটানিক্সে পিকনিক করতে যাওয়ার সময় ডাণ্ডা-দড়ি বগলে করে নিয়ে যায় না। এবং আসল কথাটা দুই বাঙালি অনুবাদকই ঘুলিয়ে ফেলেছেন। খৈয়াম বলেছেন, যা সব চাইলুম তা পেলে আমি জাহান্নামেও যেতে রাজি আছি; ওরকম জাহান্নাম রাজা-বাদশার কপালেও জোটে না।
যে ইরান-সন্তান চতুষ্পদীটির ফরাসি অনুবাদ করেছেন তিনি মূলতত্ত্বটি ধরতে পেরেছেন বলে খৈয়ামের প্রতি অবিচার করেননি।
Pour celui qui possede un
morceau de bon pain.
Un gigot de mouton, un grand
flacon de vin,
Vivre avec une belle au milieu
des ruines,
Vaut mieux que dun Empire
etre le souverain. —(এতেসসাম-জাদে)
কিন্তু আমার মূল বক্তব্য এখানে তা নয়।
আমি বলতে চাই, কবিতা বা অন্য কোনও বস্তু অনুবাদ করার সময় এ শুচিবাই কেন? কেন লোকে ধরে নেয় যে কাব্যে ভেড়ার ঠ্যাং চলতে পারে না। ইংরেজ এ শুচিবাই শিখেছে গ্রিকদের কাছে। তাদের ভিনাস মূর্তি দেখে এক সরলা নিগ্রো রমণী শুধিয়েছিল, শরীরের নিচের আধা সম্বন্ধে মেয়েটার অত লজ্জা কেন? ওটা ছালা দিয়ে ঢেকেছে কেন?
যুগে যুগে রুচি বদলায়। অনুবাদ করার সময় যদি আপন যুগের রুচি দিয়ে পূর্ববর্তী যুগের রুচির ওপর সেন্সর চালাই তবে কবির প্রতি তো অবিচার করা হয়ই, পরবর্তী যুগের রসিকজনের প্রতিও অমর্যাদা দেখানো হয়। কোনারকের মন্দির বহু সায়েসুবোর রুচিতে বাধে। তাই বলে আমরা তো আর মূর্তিগুলোর মুণ্ডু বাইরে রেখে বাকি ধড় কম্বল-চাপা দিয়ে রাখিনে।
ওমরের স্মরণে আমি একখানা পুরো রানই অর্ডার করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পরশু রাতের শিক্ষা।
তখন সন্ধে আটটা। দেশের হিসাবে রাত দেড়টা। সবে এদেশে এসেছি; শরীরটা এদেশের টাইমে ধাতস্থ হয়নি। ভাতিজাকে বললুম, বাবাজি, আমি আর বেরুচ্ছিনে। তুমি আলুসেদ্ধ ফেদ্দ কিছু একটা নিয়ে এস–রুটি-মাখন ঘরেই আছে। তাই দিয়ে দিব্য চলে যাবে।
মুখুজ্যে মশাই যখন ফিরে এলেন তখন দেখি তার হাতে এক ঢাউস খলতে বাঙাল দেশে বলে ঢোঙ্কা।
মিনির মতো সরল চিত্তে শুধালুম, এর ভিতর কী, হাতি?
বললে, সব্বনাশ হয়েছে, স্যার।
এস্থলে বলে রাখা ভালো, মুখুজ্যের সব্বনাশটা খাস কলকাত্তাই। মোকামে পৌঁছে যখন দেখলে তার বহু পয়সার মাল শান্তিনিকেতনের একটা ডকুমেন্টরি ফিলম বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে, তখন টুথব্রাশমুস্টাসে হাত বুলিয়ে বলে, যাকগে, আবার যখন পাতলুনের পকেট খুঁজে পায় না তখন বলে, সব্বনাশ হয়েছে।
আমি তার সব্বনাশে বিলক্ষণ অভ্যস্ত বলে হাই তুলতে তুলতে নিশ্চিন্ত মনে শুধালুম, কী সব্বনাশ হয়েছে। দেশলাই খুঁজে পাচ্ছ না?
কী করে জানব বলুন এদেশে মুরগির সাইজ হয় দেশের খাসির? আপনি তো আলুসেদ্ধ চেয়েছিলেন রেস্তোরাঁওলা বললে, কাবার। আমি বললুম, আলুসেদ্ধ নেই তো নেই চিকেনসেদ্ধ দাও। ভাগ্যিস হাফ-এ-চিকেন বলেছিলুম, তাই রক্ষে। দেখুন।
সেই চিকেন আমরা দুই পুরুষ্ট পাঠায় দেড় বেলায় শেষ করি!
তারই স্মরণে অতখানি অর্ডার না করে যৎসামান্যের হুকুম দিলুম।
চতুর্দিক তাকিয়ে দেখি, সবাই গোরার পাল। একটিমাত্র ভারতীয়ও নেই। মেনুর দিকে নজর যেতেই কারণটা বুঝতে পারলুম। এক-একটি পদের যা দাম তাই দিয়ে যে কোনও লন্ডনবাসী ভারতীয় ছাত্রের আড়াইখানা পুরো লাঞ্চ হয়! মুদ্রার মতো পিসটন না থাকলে এরা এখানে আসতে পারে না।
বিলেতফের্তা বাঙালিদের নিয়ে দেশে বহু আলোচনা হয়ে গিয়েছে। এককালে এদের অনেকেই আর দিশি ডালভাত ধুতি-চাদরে ফিরতেন না। তার পর বিশেষ করে চিত্তরঞ্জন দাস যে ভেল্কিবাজি দেখালেন তা দেখে আর বিলিতিয়ানা করার সাহস অল্প সায়েবেরই রইল। কিন্তু যেসব ইংরেজ এদেশে বহু বছর কাটিয়ে বিলেত ফিরে যায় তাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে শুনেছি, ড্রাইভার রাখার মতো পয়সা ছিল না বলে লর্ড রোনালড়শেকে ট্রামে-বাসে দেখা যেত। এদের সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো লিখেছেন উডহাইস। তার ধারণা এদের মাথায় ছিট ধরে। কেউ কেউ নাকি ডিনার আরম্ভ করে পুডিং দিয়ে ও শেষ করে সুপ দিয়ে!
তবে একথা বিলক্ষণ জানি এদেশ থেকে তারা দুটো অভ্যাস নিয়ে যায়। স্নান করা ও মশলাদার খাদ্য খাওয়া। এই যে আজ ইংল্যান্ড-জর্মানিতে বাথরুমের ছড়াছড়ি না হোক, ব্যবস্থাটা অন্তত আছে (জর্মনিতে মনিসিপালিটির আইন হয়েছে, কটা শোবার ঘর হলে কটা বাথরুম অবশ্য তৈরি করতে হবে) তার প্রধান বাহক চা-বাগানের ইংরেজ। আমার এক বন্ধুর কাছে শোনা, তার সময়ে অর্থাৎ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত অক্সফোর্ডে নাকি মাত্র দুটি বাথরুম ছিল। তাই নিয়ে এক বাগিচার সায়েবের ছেলে কর্তৃপক্ষকে ফরিয়াদ জানালে তাঁদের একজন বলেন, তোমরা তো এখানে একনাগাড়ে থাক ছ হপ্তা (তখন বোধহয় এক টার্ম বলতে ওই সময়ই বোঝাত); ছুটিতে বাড়ি ফিরে চান করলেই পার।
অর্থাৎ ছ সপ্তাহে একটা স্নানই ইংরেজ বাচ্চার জন্য যথেষ্ট। ধেড়েদের জন্য বোধহয় ছ বছরে একটা! ফরাসিরা তো শুনেছি চান করে নদীতে আত্মহত্যা করার সময়।
কেন? তারা তাদের কলোনি ইন্দোচীনে চান করতে শিখল না কেন?– এখনও তো ফ্রান্সের চৌদ্দ আনা বাড়িতে চানের ঘর নেই। বলতে পারব না। তবে শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের কাছে শুনেছি, তিনি চীন দেশের বিরাট নদী দিয়ে জাহাজে করে গিয়েছেন কিন্তু কোনও চীনাকে নদীর জলে স্নান করতে দেখেননি।
আর এদেশের মশলামাখা রান্না খেয়ে ইংরেজের স্বভাব এমন বিগড়ে যায় যে, দেশে ফিরে তাকে যেতে হয় ভারতীয় রেস্তোরাঁতে। এদের পয়সাও প্রচুর; তাই বোধহয় খাস করে এদেরই জন্য এই তালু-পোড়া দামের রেস্তোরাঁ!
ইংরেজের যে কটি প্যারা স–যথা উস্টার, এইচ বি– এগুলো নাকি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষেই তৈরি হয়েছিল। এগুলো বানাতে যেসব মশলার প্রয়োজন হয়, সেগুলো যে ইয়োরোপে গজায়
সেকথা ভালো করেই জানি। এমনকি আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে যেসব তরকারি গজায় সেগুলো আপন দেশে গজাতে পারে না বলে সাউথ অ্যামেরিকা থেকে আনিয়ে খায়। ঠিক বলতে পারব না, তবে বেগুন খেতে শিখেছে বোধহয় মাত্র ত্রিশ বৎসর।
আবার বলছি, সব তত্ত্বের মাহাত্ম আমার বহু পাঠক দেবেন না। কিন্তু আমি সাধারণ জিনিসের খেই ধরে তত্ত্বচিন্তা করতে ভালোবাসি। যেমন ইংরেজ বেগুন খেতে শিখেছে বটে, কিন্তু সেটা খায় সেদ্ধ করে যতদূর সম্ভব বিস্বাদ বানিয়ে। বেগুন-পোড়া যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিণতি, সে তত্ত্ব এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। ঠিক তেমনি মার্কিন জাত রেড ইন্ডিয়ানের কাছ থেকে মুড়ি খেতে শিখেছে বটে, কিন্তু তেল পেঁয়াজকুচি (পাপরভাজা বাদ দিন) দিয়ে খেতে শেখেনি।
আমি শুধু ভাবি ওসব সামান্য জিনিস আবিষ্কার করতে মানুষের কত শত বৎসর লাগে।
ফার্পোতে যখন কেউ বাঁ হাতে ছুরি নেয় তখন তার কামেল বন্ধুরা ফিসফিস্ করে ভুল বাৎলে দেয়। এখানে দেখি উল্ট-পুরাণ। পোলাও খেয়ে যাচ্ছে তো খেয়েই যাচ্ছে। মাংসের কারিটা পাশে পড়ে আছে। মেশাবার কথা মাথায় আসেনি। কাবাব খাচ্ছে তো খাচ্ছেই– পাশে চাপাতি পড়ে পড়ে জুড়িয়ে হিম হয়ে গেল। ওকিব-হালরা তখন ফিসফিস করে অ্যামেচারদের তালিম দিয়ে দুরস্ত করার চেষ্টা করছেন।
এইবারে রসভঙ্গ করতে হল। আর চেপে রাখতে পারলুম না।
রান্না পছন্দ হল না।
মাদ্রাজি মশলা দিয়ে মোগলাই খানা এই আমি প্রথম খেলুম। এ যে সিমেন্ট দিয়ে তাজমহল বানানো, কিংবা মাইকেলি অমিত্রাক্ষরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া, অথবা মাদ্রাজি মোগলাই মালমশলাই থাক– দক্ষিণের রাজগোপাল-আচারীকে উত্তরের চোগা চাকি না পরানো।
কিন্তু তবু খেতে খুব মন্দ না। এত হাড্ডিসার মুরগি ভেজাল দালা দিয়ে রান্না নয়। মুরগিটা যেন চর্বিওলা খাসি আর যে মাখন দিয়ে রান্না করা হয়েছে সেটা এদেশে সত্যযুগে পাওয়া যেত। দেশে থাকতে আমি তো একবার প্রস্তাব করেছিলুম, কোনওগতিকে একটুখানি খাঁটি গাওয়া ঘি যোগাড় করে মিউজিয়ামে রাখার জন্য যাতে করে ভবিষ্যদ্বংশীয়রা জানতে পারে এককালে বাঙলা দেশের লোক কী খেত।
তখন প্রায় রাত দুপুর। রাস্তায় বেরিয়ে পিকাডেলি। সচরাচর যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ব্যবসা বলা হয়, তার সঙ্গে সেখানে মুখোমুখি মোলাকাত।
এ ব্যবসা সম্বন্ধে লিখব কি না মন স্থির করতে পারছিনে।
.
শ্যামবাজারের মামা নাকি হেদো না পেরিয়ে দু বছরে তিন লাখ টাকা খুঁকে দেওয়ার পর বিলেতগামী ভাগনেকে সদুপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, কোথায় যাবি বাবা, সেই জল, সেই ঘাস, সেই গাছ। ওগুলো দেখবার জন্য আবার বিদেশ যাবি কেন?
আমাদের গ্রামের ভিতর যখন প্রথম ইঞ্জিন এসে রাতের বাসা বাঁধল, তখন ছেলেবুড়ো সবাই হদ্দমুদ্দ হয়ে সেই কলের গাড়ি দেখতে গেল। ফিরে এসে সবাই যখন ইঞ্জিনের প্রশংসায় অষ্টপ্রহর পঞ্চমুখ তখন মুরুব্বি কলিমুল্লা বলেছিলেন, যা বল যা কও, উই আমাদের আগুন উই আমাদের জল ছাড়া বাবুদের চলে না। আকাষ্টা পবনের নৌকোই বানাও, আর চিল্লীমারা ইঞ্জিলই বানাও সেই আগুন, সেই জল।
এ তো সাধারণ লোকের কথা। স্বয়ং বাইবেল বলেছেন, সেই ঋষির মুখ দিয়েই, যিনি ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড বি মেরি হতে সদুপদেশ দিয়েছেন, যা ছিল তাই হবে, যা করা হয়ে গিয়েছে তা আবার করা হবে; এ সংসারে নতুন কিছু নেই।
বেশিরভাগ লোক দেশভ্রমণে যায় নতুন কিছু দেখবার জন্য। এবং গিয়ে দেখে সেই জল, সেই ঘাস। আবার অন্য অনেক লোক বিদেশে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেশের সন্ধানে লেগে যায়। প্যারিস গিয়ে খবর নেয়, সেখানে আপন দেশের কেউ আছে কি না। তাকে খুঁজে বের করে শুধায়, রাইস-কারি কোথায় পাওয়া যায়? সেই খেয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরুতে বেরুতে বলে, চলো, দাদা, চট করে মোড়ের যদুর দোকান হয়ে যাই।– পাড়ার যদুর পান বিখ্যাত।
আমি দেশভ্রমণে উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই দেখতে পাই বেশি। সে বিষয়ে অন্যত্র সবিস্তর আলোচনা করেছি। তবে এ বাবদে বলতে পারি, ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সবকিছু পুরনো হলেও নতুন। বিলেতের ঘাস ঘাস, কিন্তু সে ঘাস আমাদের ঘাসের মতো ঘন সবুজ নয়, একটুখানি ফিকে, কেমন যেন হলদে ভাগটা বেশি। গাছপালার তো কথাই নেই। জলের স্বাদও অন্যরকম। একমাত্র আগুনে আগুনে কোনও পার্থক্য দেখিনি। তাই বোধহয় পৃথিবীতে অগ্নি-উপাসকের সংখ্যা এখনও প্রচুর।
সেটা অবশ্য প্রথম যৌবনের প্রথম সফরে লক্ষ করিনি।
প্রথমবারের কথা বলছি।
একটানা জর্মনিতে থাকার পর অচেনা জিনিস দেখে দেখে যখন মন ক্লান্ত তখন গিয়েছি নেপলসে– জাহাজে করে দেশে ফিরব বলে। জাহাজ লেট। দু দিনের তরে সেই নির্বান্ধব বন্দরে আটকা পড়ে গেলুম। নিতান্ত কোনও কিছু করবার ছিল না বলে গেলুম পম্পেই দেখতে (এ স্থলে কিঞ্চিৎ অবান্তর এবং নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও বলি, আমি স্বেচ্ছায় কেবলমাত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কখনও বাড়ি থেকে বেরুইনি– বেরিয়েছি প্রয়োজনের তাগিদে। মাত্র একবার আমি কাইরো থেকে স্বেচ্ছায় পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন দেখতে গিয়েছিলুম। সেখানে ইহুদি খ্রিস্টান ও মুসলমানের সঙ্গম। ধর্মচর্চাতে আচরণে নয় আমার চিরকালের শখ)।
পম্পেই মধ্য কিংবা দক্ষিণ ইতালিতেও বলতে পারেন। আবহাওয়া একটুখানি গরম।
পম্পেই টিলার নিচে বাস থামতে হঠাৎ দেখি সামনে একবন করবী গাছ।
ওহ্! সে কী আনন্দ হয়েছিল! এ-জীবনে প্রথম যে গাছ চিনতে শিখি সেটি করবী। আমাদের দেশে বলে ঘণ্টাফুল। মা আমায় চিনিয়ে দিয়েছিল। তার পর যখন তিনখানা বই পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন চাচা বললেন, করবী আর কবরীতে যেন গোবলেট না পাকাই। তার পর নিজের থেকেই শিখলুম, করবী পাঁচ রকমের হয়;– শ্বেত, পীত, রক্ত, কৃষ্ণ এবং পাটল– কৃষ্ণকরবী এখনও দেখিনি। সর্বশেষে শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মুখে শুনলাম যক্ষপুরী। পরে তার নাম হল রক্তকরবী। এখন শিখলুম, ইতালির ভাষাতে ওলে-আন্দ্রো।
এ ফুলটি তাই কত স্মৃতি-বিস্মৃতিতে বিজড়িত। বিস্মৃতি বলার কারণ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলুম, ছেলেবেলায় নানুরে চণ্ডীদাসের ভিটে দেখতে গিয়ে পেলুম ডাকবাংলোর একপাশে অজস্র করবীগাছ– এই শুকনো খোয়াই-ডাঙার দেশ বীরভূমে।
কিন্তু করবীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের দীর্ঘ ফিরিস্তিতে কার কোন কৌতূহল? কৌতূহল তখনই হয় যখন কেউ সেই পম্পেইতে হঠাৎ দেখা করবীকে নৈর্ব্যক্তিক স্তরে তুলে রস স্বরূপে প্রকাশ করতে পারে। যেমন রবীন্দ্রনাথ দেশে বসেই গাইলেন,
আবেশ লাগে বনে
শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে–
সঙ্গে সঙ্গে রসের মাধ্যমে করবী এসে আমাদের হৃদয় দখল করে বসে। সার্থক ভ্রমণকাহিনী-লেখক তাই নতুন পুরাতন উভয় অভিজ্ঞতাকে সমাহিত চিত্তে স্মরণ করে রসম্বরূপ প্রকাশ করেন। ভ্রমণ উপলক্ষ মাত্র।
কিংবা হয়তো তথ্য পরিবেশন করেন। সেটা যদি রসরূপে প্রকাশিত হয়, তবে আরও ভালো। কিন্তু রস নেই, এবং তদুপরি যদি সে তথ্য কারও কোনও কাজে না লাগে তবে সেটা বলে কী লাভ আমি ঠিক বুঝতে পারিনে। কাবুলের অনৈসর্গিক যৌন সম্পর্কের কাহিনী এদেশে কেউ কেউ শুনেছেন, সেখানে অল্পবিস্তর গণিকাবৃত্তিও আছে, কিন্তু সেসব তথ্য কারও কোনও কাজে লাগবে বলে আমার মনে হয়নি। এই নিয়ে আমার চারবার ইউরোপ যাওয়া হয়। গণিকাবৃত্তি চোখে পড়ার কথা। এ নিয়ে সে দেশের ছাত্রসমাজে নানা আলোচনাও হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা আইন ও ডাক্তারি পড়ে। সেগুলো অনেক সময় শুনতে হয়। সতীর্থরা হয়তো-বা জিগ্যেস করে বসে, তোমাদের দেশে কী রকম?
তবু এ সম্বন্ধে আমি কোনও কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যার পর হয়তো অল্পকিছু বলার সময় এসেছে।
গত বৎসর হঠাৎ খবর এল সরকার সোনাগাছির (কথাটা আসলে সোনাগাজী হুতোমে আছে) গণিকাদের প্রতি আদেশ করেছেন, তারা যেন ওপাড়া ছেড়ে চলে যায়।
তা হলে প্রথম প্রশ্ন, তারা যাবে কোথায়? তারা যদি দ্রপাড়াতে একজন কিংবা দু জনে মিলে ঘর ভাড়া নেয়, তবে সরকার কোন আইনে তাদের ধরবেন, কিংবা যে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকার কোনও মোকদ্দমা আনবেন কি না, এসব কথা খবরের কাগজে ভালো করে বেরোয়নি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এরা উদ্বাস্তু হয়ে বেশি ভাড়া দিতে রাজি হবে, এবং কলকাতাতেও লোভী বাড়িওলার অভাব নেই। প্রায় ঠিক এই ধরনের একটা ব্যাপার ঘটে কিছুদিন পূর্বে দিল্লি শহরে। সরকার আইন করে রেস্তোরাঁ এবং মদের দোকানে মদ, অর্থাৎ প্রকাশ্যে মদ্যপান বারণ করে দিলেন, কিন্তু দোকানে মদ কিনে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া নিষিদ্ধ করলেন না। ফলে যে পাপকর্ম সে বাইরে করত, পুত্রকন্যা জানতে পারত না, সেইটে অনেক বাড়ির ভিতরে আরম্ভ হয়ে গেল। ফলে পুত্র এবং কোনও কোনও স্থলে কন্যা যদি মদ খেতে শেখে, তবে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। আমি সমাজসংস্কারক নই তবু তখন কাগজে লিখেছিলুম, মদ্যপান এদেশে এখনও এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি যার জন্য জুজুর ভয় দেখাতে হবে। আসল প্রয়োজন, যেন নতুন কনভার্ট না হয়, অর্থাৎ আজকের ছেলে-ছোকরারা যেন মদ খেতে না শেখে। যে রকম আফিঙের বেলায় নতুন পারমিট না দেওয়ার ফলে আসাম থেকে আফিঙ খাওয়া উঠে যাচ্ছে। দোকানে মদ না খেতে পেয়ে কর্তা যদি বাড়িতে মদ খেতে আরম্ভ করেন, তবে তো কনভার্টের সংখ্যা বাড়বে! এ বাবদে বিধানবাবু সাউথ ক্লাব থেকে মদ তুলে দিয়ে অতি উত্তম কর্ম করেছেন। ছেলে-ছোকরারা সেখানে যেত টেনিস খেলতে। বারে যেত শরবৎ খেতে। শরবৎ থেকে শরাব প্রয়াণ কঠিন কর্ম নয়– দুটো শব্দই আরবি শারাবা = পান করা থেকে এসেছে।
এসব অবান্তর নয়। সরকার যদি মনে করে থাকেন যে, সোনাগাছি-বাসিন্দাদের ভিটেছাড়া করতে পারলেই সর্ব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তবে তাঁরা মারাত্মক ভুল করছেন। ভদ্র গৃহস্থ উদ্বাস্তুদের নিয়েই আমরা কী রকম হিমসিম খাচ্ছি সেটা শেয়ালদাতে নেমেও স্পষ্ট বোঝা যায়। এত সহজে এ সমস্যার সমাধান হয় না। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, দীর্ঘতম পন্থা অনুসরণ করলেই স্বল্পতম সময়ে পৌঁছান যায়। এটা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না বলা কঠিন, কারণ গোল্ডেন রুল ইজ দ্যাট দেয়ার ইজ নো গোল্ডেন রুল, কিন্তু সচরাচর যে ব্যবসাকে সংসারের প্রাচীনতম ব্যবসা বলে বহু পণ্ডিত স্বীকার করে নিয়েছেন তার ওষুধ একটি বাড়িতেই হয়ে যাবে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।
আসলে আমরা বিলেতের অনুকরণ করছি। বিলেত ব্রথেল বা গণিকালয় তুলে দিয়েছে, আমরাও দিয়েছি। ফলে লন্ডনের গণিকারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ছড়ায়নি। বোঝা গেল, ওষুধ না ধরাতেই আমরা উপকৃত হয়েছি বেশি।
এ স্থলে একটি কথা না বললে কলকাতার প্রতি অবিচার করা হবে।
কলকাতার আপনজন না হয়েও আমি তার শত দোষ স্বীকার করি। কলকাতার শিশুরা সস্তায় খাঁটি দুধ পায় না, রোগীরা হাসপাতালে স্থান পায় না, ওষুধ কালোবাজারে ঢুকেছে, ভেজালের অন্ত নেই, এরকম অবর্ণনীয় নোংরা শহর ত্রিভুবনে নেই, ট্রাম-বাসে পায়লোয়ানরাই শুধু উঠতে পারে, শেয়ালদা-হাওড়াতে ট্রেন যা লেট হয়, তা-ও পানচুয়ালি হয় না– অবস্থা অবর্ণনীয়।
কিন্তু এই যে কলকাতা শহরে স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত– এত বেশি পুরুষ এবং এত কম মেয়ে– অনুপাত পৃথিবীর কোনও বড় শহরই দেখাতে পারবে না। এটা কিছু গর্বের বিষয় নয়, কিন্তু আমি বিদেশ থেকে ফিরে বার বার গর্ব অনুভব করেছি যে, এ শহরের লোক যৌনক্ষুধা সম্বন্ধে কতখানি অচেতন, কিংবা তারা সুযোগ পায়নি, সেটা কেন তৈরি করেনি, তা জানিনে।
ইয়োরোপে যখনই যুদ্ধের ফলে বা কোনও কারণে স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় এবং বিদেশি সৈন্যের মিত্র বা শত্রুভাবে আগমন হয়, সঙ্গে সঙ্গে জারজ সন্তানের সংখ্যা যে কী অসম্ভব রকম বেড়ে যায়, তা দেখে সমাজসেবীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এবারে সে সংখ্যা এমনই হিসাবের বাইরে চলে গেল যে শেষটায় পাদ্রিসায়েবরাই প্রস্তাব করলেন জারজ শিশুদের যেন সমাজ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠান আইনত ন্যায্য বলে স্বীকার করে নেয়।
শান্তির সময়েও এরকম ধারা হয়। উত্তর ইয়োরোপের কোনও একটি দেশে অনুপাত অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় দেখা গেল বহু পুরুষ একটি স্ত্রী এবং একটি করে রক্ষিতা পুষছে। রক্ষিতা বলা ভুল, কারণ এ রমণী ভদ্রঘরের মেয়ে, বেশ্যাবৃত্তি কখনও করেনি, তার প্রতিপালকের সঙ্গে তার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, তার পুত্রকন্যা আছে, সমাজে সে অপমানিতা নয়। অনেক স্থলে তার আসল স্ত্রী এ রমণীর খবর জানেন, এবং কোনও কোনও স্থলে পালা-পরবে দুই পরিবার একত্র হয়ে আনন্দোল্লাস করেন। বস্তুত আমাদের দেশে কোনও পুরুষের যদি দুই স্ত্রী থাকে এবং তারা যদি ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে থাকে তা হলে সচরাচর হয়ে থাকে।
কোনও কোনও বুদ্ধিমান সমাজসেবী তাই প্রস্তাব করেছেন, এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার চেয়ে ঢের ভালো নয়, এইসব লোকদের আইনত দুটি বিয়ে করার অধিকার দেওয়া। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে এক স্ত্রীর জীবিতাবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ বেআইনি– তাকে তালাক না দিয়ে। ক্যাথলিক ধর্মে আবার ঠিক তালাকের ব্যবস্থাও নেই সেখানে প্রমাণ করতে হয়, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি থাকায় বিয়েটা আদপেই হয়নি। ধর্মের অনুশাসন এড়াবার জন্যে কেউ কেউ তার সুবিধে নিয়ে থাকেন।
অথচ ইয়োরোপে আমাদের বদনামের অন্ত নেই– আমরা বহুবিবাহে বিশ্বাস করি, আমরা হারেম পুষি।
দুশমন সকলেরই থাকে। খ্রিস্টের ছিল, সাতেসের ছিল। আমাদেরও আছে। ইয়োরোপেও আছে।
তাদেরই কেউ কেউ আপনাকে অপ্রস্তুত করার জন্যে পাঁচজনের সামনে শুধাবে, আপনাদের দেশে বহুবিবাহ প্রচলিত আছে– না?
আমি কোথায় না লজ্জা পাব, উল্টো একগাল হাসি। যেন বঙ্গ দু কান কাটা। বলি, বিলক্ষণ! একটা, দুটো, চারটে মুসলমান হলে– যত খুশি। আর হিন্দু হলে তো কথাই নেই। এক মুখুয্যের ছিল আটশো বাড়য্যের ছ শো, চাটুয্যের চারশো, বেচারি গাঙ্গুলির মাত্র আশি– ঘোষালের ফর্দটা জানা নেই। কায়েতরা অতখানি না, তবে তাঁরাও ছেড়ে কথা কননি। বার্নার্ড শ এ-ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
তার পর হঠাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলি, এ ব্যবস্থা অতি অল্পকাল স্থায়ী ছিল। আসলে ভারতের শতকরা নিরানব্বইজন লোক একটিমাত্র স্ত্রীলোকের সংস্পর্শে আসে। যদিও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অধিকার আইনত তার ষোল আনা আছে।
তার পর ধীরে ধীরে রসকষহীন অতি শুকনো গলায় বলি, এবারে আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনাদের দেশে কজন লোক একদারনিষ্ঠ হয়ে, অর্থাৎ বিবাহের পূর্বে বা পরে অন্য কোনও কুমারী বা বিবাহিতার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না এসে জীবন কাটায়? যদিও একাধিক স্ত্রীগমনের অধিকার আইনত আপনাদের নেই।
.
যেন ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজের নিচে দিয়ে যাচ্ছি। এই বিশাল উন্নতশির দেউড়ি যেন স্থপতি ইচ্ছে করেই এমনভাবে বানিয়েছেন যে, নিচে দিয়ে যাবার সময় মানুষ বুঝতে পারে সে কত নগণ্য।
কেনসিংটন গার্ডেনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। গাছগুলো এমনি বিরাট, এমনি উঁচু যে, যেতে যেতে আমার মনে পড়ল বুলন্দ দরওয়াজার কথা। সেখানেও শীতের প্রভাতে কাঁপতে কাঁপতে ঢুকেছিলাম; এখানেও হেমন্তের শীতে জবুথবু হয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি।
আকাশে একরত্তি মেঘ নেই, বাতাসে এক ফোঁটা হিম নেই–সূর্যদেব তাঁর ভাণ্ডার উজাড় করে স্বর্ণরৌদ্র ঢেলে দিয়েছেন কিন্তু শীতের দাপট কমাতে পারেননি। পার্ক থেকেই দেখতে পাচ্ছি, বয়স্করা ওভারকোট পরেছে। কাল বৃষ্টি নেমেছিল– তখন জওয়ানরা পর্যন্ত কাঁধ কুঁচিয়ে, মাথা নিচু করে, হ্যাট সামনের দিকে নামিয়ে দিয়ে হনহন করে চলেছিল গায়ের গরম বাড়াবার জন্য। মেয়েরা কী করে হাঁটু পর্যন্ত ওইটুকু সিল্কের মোজা পরে শীত ভাঙায় সে এক সমস্যা। প্যারিসে দেখেছি, পেভমেন্টে যারা পুরনো বই বিক্রি করে তাদের কোনওপ্রকারের আশ্রয় নেই বলে দোকানের সামনে ঘন ঘন পায়চারি করে, আর দুই বাহু প্রসারিত, ডান হাত শরীরের বাঁ দিকে আর বাঁ হাত ডান দিকে থাবড়ায়। মাঝে মাঝে হাতের তেলো গরম করার জন্য দু হাত আঁজলা করে মুখ দিয়ে জোর ফুঁ দেয়।
কাল রাতের বৃষ্টি না আজ ভোরের হিমে গাছের পাতা সব ভেজা। সেগুনকাঠের পাতার মতো তারা ওজনে ভারী– সারা গ্রীষ্মকাল রোদ আর জল খেয়ে খেয়ে তারা যেন পেটের অসুখ করে কেউ হলদে, কেউ ফিকে, কেউ-বা কালো হয়ে গিয়েছে। আর কেউ টকটকে লাল শুনেছি, ঠিক মরার সময় কোনও কোনও মানুষের সব রক্ত এসে মুখে জড়ো হয়। টুপ করে কখনও এক ফোঁটা জল এসে নাকের উপর পড়ে, কখনও-বা হাতের উপর। কী ঠাণ্ডা। সঙ্গে সঙ্গে অতি নিঃশব্দে দুটি লাল পাতা।
দু দিকে সবুজ ঘাসের লন। ঠিক সবুজ বলা চলে না। নীলের ভাগটা কম, হলদেটাই বেশি। এখন না হয় হেমন্তের প্রথম শীতে তারা ফিকে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ভরগ্রীষ্মকালেও আমি ইউরোপে কখনও দেশের কালো-সবুজ দেখিনি। আর ঘাসগুলোই-বা কী অভদ্র রকমের লম্বা আর মোটা! একে তো তাদের যত্ন নেওয়া হয় প্রচুর তার ওপর বোধহয় এদের মাড়িয়ে পায়চারি করা বারণ বলে কী রকম উদ্ধতভাবে মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। এরাও ভেজা। গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে না। দেশে শীতের সকালে নৌকো দিয়ে যাবার সময় যে রকম ভিজে শাপলাপাতায় হাত দিতে গা কিরকির করে।
দু দিকে সবুজ লনের মাঝখানে কালো পিচের রাস্তা। ছোট্ট, এক ফালি। এঁকেবেঁকে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে চলে গিয়েছে বিরাট হাইড-পার্কে, বাঁ দিকে গিয়েছে এ বাগানেরই গোলদিঘির দিকে। সেই ফালি রাস্তাটুকু আবার নিয়েছে নানা রঙের মোজায়িক, কেটেছে ঝরা পাতার আলপনা। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য আলপনা এরকমের থাকে না। মুখে পাইপ, হলদে গোঁফওলা বুড়ো মালী এসে ঝাঁট দিয়ে সাফ করে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাসে আরেক প্রস্থ রঙিন পাতা ঝরে পড়ে আবার নতুন আলপনা আঁকা হয়।
বেলা এগারোটা। সমস্ত পার্কে মেরে কেটে দশ-বারো জন লোক হয় কি না হয়। শুনেছি আরও সকালে, ছুটির দিনে এবং গ্রীষ্মকালে বেশি ভিড় হয়। লন্ডন শহরের লোক যে কাজ করে, ছুটির দিন ছাড়া আলসেমি করে না, এ তত্ত্বটা এদের ফাঁকা পার্ক দেখলেই বোঝা যায়। ইতালিতে অন্য ব্যবস্থা। তাদের পার্ক সবসময়েই ভর্তি– অবশ্য সে দেশে টুরিস্টও যায় বেশি এবং তাদের পাবও সবসময়েই গুলজার। সকাল দশটাই হোক আর বিকেল চারটাই হোক– জোয়ান মদ্দেরা কাজকর্ম ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সস্তা লাল মদ খায় আর ব্যাক্-গ্যাম খেলে। এ খেলাটা আমি দেশে কখনও দেখিনি, অথচ ভূমধ্যসাগরের পাড়ে পাড়ে, ইতালি গ্রিস তুর্কি লেবানন প্যালেস্টাইন মিশর সর্বত্র প্রচলিত। তাই বোধহয় এরা কেউ দাবা খেলাতে নাম কিনতে পারেনি।
ব্যাক-গ্যামনের সুবাদে একটা কথা বলে নিই। মিশরে ওই খেলাতে পয়েন্ট গোনা হয় ফারসিতে– আরবিতে নয়। আমরা যে রকম টেনিস খেলার সময় থার্টি ফর্টি, লাভ ফিফটিন, থার্টি অল বলি– ত্রিশ-চল্লিশ,, ভালোবাসার পনেরো বা ত্রিশ সমস্ত বলিনে। ফারসিতে নম্বর গোনা থেকে বোঝা যায় খেলাটা আসলে ইরান থেকে মিশরে গিয়েছে। ঠিক তেমনি বাঙলা দেশের একাধিক গ্রাম্য খেলাতে দেখেছি, নম্বর গোনা হয় কিছু জানা-কিছু অজানা ভাষায় পুরোপুরি বাংলায় নয়। এগুলো তবে কোন ভাষা থেকে এসেছে। আমার বিশ্বাস, সত্যকার রিসার্চ করলে তার থেকে বেরুবে আর্যরা বাঙলা দেশে এসে কোন জাতি-উপজাতির সংস্পর্শে এসেছিল। অনেক পণ্ডিত বলেন, সিঁথির সিঁদুর আমরা সাঁওতালদের কাছ থেকে নিয়েছি। আমার বিশ্বাস, খেলার নম্বরের অনুসন্ধান করলে আরও বেশি তথ্য এবং তত্ত্ব বেরুবে। মমগ্রজ গ্রামের অবাংলা নাম নিয়ে বহু বত্সর খেটে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন আর্যভাষীরা কোন কোন উপজাতির সংস্রবে এসেছিল। তার ওসব লেখা কেউ পড়ে না। গবেষণা বলতে বাঙলা দেশে বোঝায়, তিনখানা বই পড়ে চতুর্থ বই লেখা। অর্থাৎ একখানা বই থেকে গা-মারা চুরি; তিনখানা বই থেকে চুরি-করা গবেষণা।
বেশি হাঁটাহাঁটি করলে পাছে ভগবান আসছে জন্মে ডাকহরকরা বানিয়ে দেয় তাই গোলদিঘির কাছে এসে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লুম। পুকুরের জল স্বচ্ছ কালো। চতুর্দিকে অনেকখানি ভোলা বলে জোর বাতাস শুকনো পাতা পুকুরের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে নিজেই ঢেউয়ে ঢেউয়ে এক পাড়ে জড়ো করছে। মালী সেখানে দাঁড়িয়ে লম্বা আঁকশি দিয়ে টেনে এনে পুকুর সাফ রাখছে। একপাল পাতিহাঁস ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছে। বাতাস হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে, স্বচ্ছ কালো জলের দিকে তাকিয়ে সে শীত যেন তার চরমে পৌঁছচ্ছে আর আহাম্মুকের মতো ভাবছি, হাঁসগুলো ওই হিমে থাকে কী করে? উত্তর সরল; হিমালয়ের সরোবরে যখন থাকতে পারে তখন এখানেই-বা থাকতে পারবে না কেন? কিন্তু চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না।
হঠাৎ একটা ধেড়ে রাজহাঁস বিরাট দুটো পাখা এলোপাতাড়ি থাবড়াথাবড়ি করে পড়ি পড়ি হয়ে হয়ে ধপ করে নামল পাতিগুলোর মাঝখানে। তারা ভয় পেয়ে প্যাক প্যাক। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। কী দরকার ছিল এদের এই শান্তিভঙ্গ করার? রাজহাঁসটা ভেবেছে, পাতিগুলি এতক্ষণ ধরে ওই কোণে যখন জটলা পাকাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই ভালো খাবারের সন্ধান পেয়েছে।
তাই হবে। নিশ্চয়ই তাই। ইয়োরোপের পাতিজাতগুলো যখন এশিয়া-আফ্রিকায় খাবার পেয়ে জটলা পাকাল তখন ধেড়ে ইংরেজ তাদের তাড়িয়ে দিয়ে রাজ্য বিস্তার করল। সাধে কি আর বিষ্ণুশর্মা এসপ বলেছেন, পশুপক্ষীর কাছ থেকে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়। কিন্তু তাই করে কতকগুলো জাত যে পশুর মতো আচরণ করলে, এবং এখনও করছে, তার কী?
আচ্ছা, যদি খুব শীত পড়ে আর পুকুরের জল জমে যায়। আমি স্বচক্ষে রাইনের মতো নদী পর্যন্ত জমে যেতে দেখেছি তা হলে এ হাঁসগুলো যায় কোথায়? কোথায় যেন পড়েছি, কবি দুঃখ করে বলছেন, আমি মানস সরোবরে যেন ডানা ভাঙা রাজহাঁস। চতুর্দিকের জল জমে গিয়ে বরফ হয়ে হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, শেষটায় আমাকে পিষে মারবে। আমার সঙ্গী-সাথিরা অনেকদিন হল দক্ষিণে চলে গিয়েছে। আমার যাবার উপায় নেই। হায়, আমাদের সক্কলেরই তাই। কারও পা খোঁড়া, কারও ডানা ভাঙা, কারও প্রিয়া পালিয়ে গিয়েছে, কাউকে-বা সরকার জেলে পুরে দিয়েছে– সবাই যেন বলছে, পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে!
এদের জন্য নিশ্চয়ই কোনও ব্যবস্থা আছে। লন্ডন তো আর দেদ্দেড়ে গ্রাম নয় যে, হাঁসগুলো গোলাবাড়ির খামারঘরে গিয়ে আশ্রয় নেবে। পশুপ্রীতি ইংরেজের যথেষ্ট আছে। মিশর পরাধীন থাকাকালীন এক ইংরেজ হাকিম যখন এক মিশরি খচ্চরওলাকে জরিমানা করে জন্তুটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দেওয়ার জন্য–তখন সে মনের দুঃখে বলেছিল, আমি তো জানতুম না রে খচ্চর, আদালতে তোর এক দরদী ভাই রয়েছে।
সামনে দিয়ে একটি মেমসায়েব চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে দেশের মা-মাসিরা দেখতে পেলে বলতেন, হুনোমুখো। না, পরনে সে স্কার্ট নয়, যা পরে বাসে উঠতে গেলে ছিঁড়ে যায়। এর প্রনে হুবহু চীনা পাতলুন। ক্লাইভ স্ট্রিটে বিস্তর দেখেছি। তবে চামড়ার সঙ্গে সেঁটে টাইট, মে-র-কেটে পায়ের ডিম ছাড়ায় কি না-ছাড়ায়, আর লাল সবুজের মারাত্মক চেক। শিলওয়ার বুঝি, বড়ি মোরি–অর্থাৎ ঢিলে পাজামা বুঝি, চীনে পাজামা বোঝাও অসম্ভব নয়, কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া পাজামা পরলে রমণীদেহের কোন সৌন্দর্যের কী যে খোলতাই হয় সেটা আদপেই বুঝতে পারলুম না। আর শরীরটাই-না কী বাহারে! বার তিনেক না ঘোরালে বোঝা যায় না কোনটা সামনের দিক, কোনটা পিছন। যেন মডার্ন পেন্টিং। গ্যালারিতে দেখে আমাদের মতো বেকুবদের মনে সন্দেহ জাগে উল্টো টাঙায়নি তো?
যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। যুবতী কখনও কুৎসিত হয় না। তবে যার যেটা মানায় তাকে সেটা পরতে হয়। আজকাল তো আরও কত সব কল বেরিয়েছে, শুনতে পাই। তা না হয় নাই-বা হল। একটু ফোলা ফাপার জামা-কাপড়ও তো আছে। সাড়ে বাইশ-গজি শিলওয়ার নাই-বা হল।
পিছনে আবার একটা কুকুর। মনিবের সেই মেলগাড়ির তেজে চলার সঙ্গে পাল্লা রাখতে গিয়ে এই শীতে হাঁপিয়ে উঠেছে। অতিশয় অপ্রিয়দর্শন। ডাহুন্ট না কী যেন নাম। পিপের মতো দেহ। মনে হয় যেন দুটো কুকুর জুড়ে একটা বানানো হয়েছে। অথচ আস্তে আস্তে চললে একেও হয়তো মন্দ দেখাত না।
সবশুদ্ধ জড়িয়ে মুড়িয়ে যাকে বলে কাল্ট অব দি আগলি অর্থাৎ কুৎসিত ধর্ম। মডার্ন কবিতা। যার বিষয়বস্তু, ডাস্টবিন, পচা ইঁদুর, মরা ব্যাঙ।
বিরক্তি হয়নি, দুঃখ হয়েছিল। আসলে এরা তো কুৎসিত নয়। এসব গায়ে পড়ে করা। দেশকালপাত্র।
বাঁচালে। হাওয়াটা বন্ধ হয়েছে। ওই হাওয়াটাই যত অনর্থের মূল। উনি বন্ধ হলে বেশ ওম ওম ভাবটা জমে আসে। বেঞ্চির হেলানে মাথাটা চিত করে আকাশমুখো করলুম। ধুপ করে হ্যাটটা পড়ে গেল। তা পড়ক। বন্ধ চোখে লাগল রোদের কুসুম কুসুম পরশ। দেশে গরমের দিনে চোখে ঠাণ্ডা জল দিলে যে রকম আরাম বোধ হয়। হাওয়া বন্ধ হয়েছে বলে পোড়া ট্রেলের গন্ধও নাকে আসছে না। এদেশের লোকের বোধহয় অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। আমি তো সর্বক্ষণ হাতে-গোঁফে চামেলি ঘষি। ভাগ্যিস খানিকটে আতর সুটকেসের পকেটে করে অজানতে চলে এসেছে। এদেশের ও দ্য কলোন লেভেন্ডার ছিটোলে শীতটা যেন আরও ছমছম করে ওঠে।
এবার হেমন্তটা এই পোড়া লন্ডনেও হেমন্ত বলেই ঠেকছে। কাল গিয়েছিলুম মোটরে করে লন্ডনের উত্তরে, গ্রামাঞ্চলে মাইল বিশেক দূরে। তখন চোখে পড়েছিল সত্যকার হেমন্ত।
হেমন্ত নিয়ে এ সংসারের সব কবিই বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বোধহয় শ দেড়েক গান রচেছেন বর্ষা নিয়ে। হেমন্ত নিয়ে পাঁচটি হয় কি না হয়। কবিগুরু কালিদাস পর্যন্ত ঋতুসংহারে হেমন্তের বন্দনা করতে গিয়ে যা রচেছেন তার তুলনায় তার বর্ষা বর্ণন শতগুণে শ্রেয়। তবু তার কলম জোরদার। হেমন্ত ঋতুতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন তিনি মানসযাত্রী হংস ক্রৌঞ্চমিথুন আর মাটির দিকে দেখেছেন পরিকু শস্যে গ্রামের প্রত্যন্ত প্রদেশ পরিপূর্ণ। হেমন্তের সেই সফল শান্তির পূর্ণতা দেখে প্রার্থনা করেছেন;
বহুগুণরমণীয়ো যোষিতাং চিত্তহারী
পরিণতবহুশালিব্যাকুলগ্রামসীমা।
সততমতিমনোজ্ঞঃ ক্রৌঞ্চমালাপরীতঃ।
প্রদিশতু হিমযুক্তঃ কাল এষ সুখং বঃ ॥
হঠাৎ শুনি ধমকের শব্দ। রমণীকণ্ঠে।
শিক্ষিত ভদ্রলোকের ইংরেজিই ভালো করে বুঝিনে, ককনি বোঝা আমার কর্ম নয়। তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে ডান দিকে একটি পেরেম্বুলেটর। তার পিছনে একটি ছোট্ট বাচ্চা। চলি চলি পা-পা করে গোলদিঘিতে ক্ষুদে একটি রবারের নৌকা ভাসাবার চেষ্টা করছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় সেটা বার বার কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে তার আয়া অসহিষ্ণু হয়ে লাগিয়েছে তাকে এক বিকট ধমক। সে ধমকের ধাক্কায় রাজ-পাতি সব হাঁস প্যাক প্যাক করে পালাচ্ছে, নৌকোটা পর্যন্ত ডুবুডুবু!
শুনেছিলুম, এ দেশে বাচ্চাদের ধমক দেওয়া হয় না। দেশের এক অতি আধুনিক পরিবার। সেখানে অতিথি এলে এক ছেলে পিঠে পিন ফুটাত, অন্য ছেলে কাঁচ কাঁচ করে কাঁচি দিয়ে তার টাইটি কাটতে আরম্ভ করত। ধমক দিতে গেলে বাপ-মা অতিথিকে বিলেতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।
ফের ঘাড় ঝুলিয়ে দিলুম বেঞ্চির হেলানে, মুখ তুলে দিলুম আকাশের দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বললুম, হায় পেস্তালৎসি, হায় রে ফ্র্যোবেল, কোথায় তুমি ফ্রয়েট! এই ককনি রমণীকে পর্যন্ত তালিম দিয়ে শাবুদ করতে পারনি!
এবারে শুনি বাঁ দিক থেকে, বেগি পান্। মানে? ওহ্বেগ ইয়োর পার্ডন! হকচকিয়ে চোখ খুলে দেখি, আমার অজানতে এক ভদ্রলোক বেঞ্চির অন্য প্রান্তে আসন নিয়েছেন।
সুন্দর চেহারা। ঢেউ খেলানো সোনালি ব্লন্ড চুল হাওয়াতে অল্প উস্কোখুস্কো। নাকটি খাঁটি রোমান, ব্রিজের চিহ্নমাত্র নেই। মুখের রঙ পুরনো হাতির দাঁতের মতো। শুধু গাল দুটিতে অতি অল্প গোলাপির ছোঁয়া লেগেছে। একটুখানি গোঁফ মাথার চুলের চেয়ে এক পোঁচ বেশি সোনালি।
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, আজ্ঞে না। আমি কিছু বলিনি। তার পর আমতা আমতা করে বললুম, আমি শুধু পেস্তালৎসির কথা স্মরণ করছিলুম।
হাত দু খানি জানুর উপর ভারি শান্তভাবে রাখা, যেন রেমব্রান্টের ছবিতে আঁকা। সরু লম্বা লম্বা। নখে লালের আভাস। চমৎকার মেনিকোর করা। বয়স ৩০/৩৫। ঠিক বলতে পারব না। সায়েব-সুবোদের বয়েস আমি অনুমান করতে পারিনে।
এবারে আমার পালা। সায়েব কী যেন বললে। বুঝতে না পেরে বললুম, বেগি পান। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বুঝে গেলুম বলেছে, থ্যাঙ্ক গড় ধরনের কিছু একটা। কিন্তু তখন তো আর বেগ ইয়োর পার্ডনটা ফের বেগ করে ফেরত নেওয়া যায় না।
পাশে বেঞ্চির উপর অত্যুকৃষ্ট শোলার হ্যাট, তার ভিতরে দু খানা দস্তানা। পরনে হেরিং মাছের কাঁটার নকশা কাটা নতুন স্যুট। শক্ত কলার, ডোরাকাটা টাই– কোনও পাবলিক স্কুলের নিশানমারা হতেও পারে কফের বোম ঝিনুকের, মাঝখানে কী একটা ঝকঝকরছে। পায়ে ছুঁচলো কালো জুতো। এবং বিশ্বাস করবেন না, তার উপর স্প্যাট!
ত্রিশ বৎসর পূর্বে এ রকম বেশভূষা মাঝে-মধ্যে দেখেছি। বইয়ে বর্ণনা পড়েছি। এ কি বিংশ শতাব্দীর রিপ ভান উইনল?
তখন মনে পড়ল কেনসিংটন গার্ডেনের আশেপাশে থাকেন এদেশের খান্দানিরা। কাশ্মীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিন্দি কবি গেয়েছেন,
য়হি স্বর্গ সুরলোক
মহি সুরকানন সুন্দর।
মহা অমরোকা ওক,
মহা কহি বসত পুরন্দর ॥
এইটেই স্বর্গসুরলোক, এইখানেই কোথাও পুরন্দর বাস করেন।
শুনেছি, এরই আশপাশে চার্চিল থাকেন, এপস্টাইন বাস করেন।
তবে ইনি খান্দানি লোক। কাজকর্ম নেই। অবেলায় পার্কে রোদ মারতে বেরিয়েছেন।
ছিঃ। তখন দেখি তার বাঁ দিকে একটা ক্রাচ– খোঁড়ারা যার উপর ভর দিয়ে হাঁটে। নিজের মনকে কষে কান মলে দিলুম- উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ না করে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য।
বললেন, পেস্তালৎসি কিন্তু শেষ বয়সে আপন মত অনেকখানি পরিবর্তন করেছিলেন। বলতেন, বাচ্চাদের বড় বেশি যা-তা করতে দিতে নেই।
আমি অবাক। আমি তো শুনেছি ইংরেজ অচেনার সঙ্গে কথা কয় না। ইনি আবার খান্দানি।
ভদ্রলোক কিন্তু পাঁচ সিকে সপ্রতিভ। কঞ্জুস যে রকম চুনের কৌটো থেকে খুঁটে খুঁটে শেষ রত্তি বের করে, ইনি ঠিক তেমনি দুটি নীল চোখ দিয়ে আমার চোখ দুটি খুঁটে খুঁটে শেষ চিন্তা বের করে নিচ্ছেন।
বললেন, সে আমি বেশ জানি, প্রাচ্যদেশীয়দের সঙ্গে বিনা পরিচয়েই কথা আরম্ভ করা যায়। মুখে অল্প অল্প হাসি-খুশির ভাব।
আমি শুধালুম, আপনি কি অনেক প্রাচ্যদেশীয়দের চেনেন?
বললেন, আদপেই না। আপনিই প্রথম।
আমি বললুম, সে কী? এখন তো লন্ডনে বিদেশিই বেশি বলে মনে হয়। আমি তো ভেবেছিলুম পাছে এদের ঠেলায় খাস লন্ডনবাসীরা শহরছাড়া হয় তাই ম্যাকমিলানকে প্রস্তাব করে পাঠাব কাঁটার তার দিয়ে দিয়ে লন্ডনের আদিবাসীদের জন্য (আমি এবরোজিনালস শব্দটি প্রয়োগ করেছিলুম) আলাদা মহল্লা করে দেবার জন্য। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, প্রাণীদের খাবার দেওয়া বারণ। হুকুম অমান্য করলে এক পৌন্ড জরিমানা। কী বলেন?
বললেন, খাঁটি কথা। আমাদের পাড়া তো যায়-যায়।
ইচ্ছে হচ্ছিল শুধাই কোন পাড়া। কিন্তু ইনি যখন প্রাচ্য কায়দায় বিনা পরিচয়ে আলাপ আরম্ভ করেছেন, তখন আমার উচিত প্রতীচ্য কায়দা অনুসরণ করা।
বললুম, কলকাতায় তো তাই হয়েছে। আমরা কলকাতার আদিবাসীদের কোণঠাসা করে এনেছি।
তিনি শুধালেন, আমরা মানে কারা?
এ তো তোফা ব্যবস্থা। উনি প্রাচ্য পদ্ধতিতে দিব্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে যাচ্ছেন, আর আমি নেটিভ ছুরি-কাটা নিয়ে আনাড়ির মতো কিছুই মুখে তুলতে পারছিনে। ঠিকই তো। সেই কথামালার গল্প। বক তার লম্বা ঠোঁট চালিয়ে কুঁজো থেকে টপাটপ খাবার তুলে নিচ্ছে। আর আমি খেঁকশেয়ালটার মতো শুধু কুঁজোটার গা চাটছি। আর ব্যবস্থাটা করেছে বই।
কিন্তু হলে কী হয়? ইংরেজের বাচ্চা। বেশিক্ষণ প্রশ্ন শুধোবে কী করে? অনভ্যাসের ফোঁটা নয়, অনভ্যাসের লাল লঙ্কা। খাবে কতক্ষণ!
আমি বললাম, আমি শিক্ষাবিদ নই, তবু জানতে ইচ্ছা করে এ দেশের শিক্ষিত পরিবারে বাচ্চারা কতটুকু যাচ্ছেতাই করার সুযোগ পেয়েছে!
এবারে ইংরেজের ইংরেজিপনা আরম্ভ হল। অনেকগুলি সবৃজনকটিভ মুড ব্যবহার করতে পেরে ভদ্রলোক যেন বেঁচে গেলেন। ওই মুডটাই ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, কারণ এতে প্রকাশ পায় অনিশ্চয়তা। শুড উডের ছড়াছড়ি– আই শুড সে, ইট উড় অ্যাপিয়ার, ওয়ান মাইট থিন থাকলেই বুঝতে হবে ইংরেজ পাকাপাকি কিছু বলতে চায় না, কিংবা ভদ্রতা প্রকাশ করতে চায়– ফাউলার যা বলুন, বলুন। আমরা এ জিনিসটেই প্রকাশ করি অতীতকাল দিয়ে। শ্বশুরমশাই যখন জিগ্যেস করেন, তা হলে বাবাজি আসছ কবে? আমরা ঘাড় নিচু করে বলি, আজ্ঞে আমি তো ভেবেছিলুম ভাদ্র মাসে এলেই ভালো হয়। আসলে কিন্তু বলতে চাই, আমি ভাবছি…। তা বলিনে; অতীতে ফেললে বিনয় প্রকাশ হয় অনিশ্চয়তাও বোঝানো হয়, অর্থাৎ শ্বশুরমশাই ইচ্ছে করলেই আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাকচ করে দিতে পারেন।
ইংরেজ বললেন, অন্য লোকে যে আমাদের দ্বীপবাসী বলে সেটা কিছু মিথ্যে নয়! ওই পেস্তালৎসি, ফ্ল্যোবেলের কথা বলছিলেন না? এদের তত্ত্বকথা সর্বজনমান্য হয়ে গেলেও আমরা সেগুলো গ্রহণ করি সকলের পরে। চ্যানেলের ওপার থেকে যা কিছু আসে তাই যেন আমরা একটু সন্দেহের চোখে দেখি। আর গ্রহণ করলেও সমাজের সব শ্রেণি একই সময়ে নেয় না। আমাদের বাড়িতে কিছু মনে করবেন না, একটু ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে–
আমি বললুম, প্রাচ্য পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত হওয়াটাই রেওয়াজ।
ধন্যবাদ। আমাদের বাড়িতে এখনও প্রাচীন পন্থা চালু। দুনিয়ার আর সর্বত্র সেন্ট্রাল হিটিঙ কিংবা ইলেকট্রিক দিয়ে ঘর গরম করা হয়, আমাদের বাড়িতে এখনও লগ ফাইয়ার –কাঠের আগুন। ওহ্! একটা ঘটনা মনে পড়ল। আপনি জাওয়ার ডাক্তারের কথা শুনেছেন?
যদিও লোকটি অতিশয় ভদ্র, মাত্রাধিক দ্ৰ বললেও ভুল বলা হবে না, তবু একটু বিরক্ত হলুম। এই ইংরেজরা কি আমাদের এতই অগা মনে করে বললুম, সেই যিনি সর্বপ্রথম ফুসফুসের অপারেশন আরম্ভ করেন?
ইংরেজের তারিফ করতে হয় মানুষের গলা থেকে মনের ভাব চট করে বুঝে নেয়। ভদ্রলোক বার বার মাফ চাইতে আরম্ভ করলেন। আমিও একটু লজ্জা পেলুম।
বললেন, হাজারটা ইংরেজের একটা ইংরেজও ওঁর নাম জানে না। তাই আপনাকে জিগ্যেস করেছিলুম।
আমিও ভদ্রতা করে বললুম, আমিও জানতুম না যদি না এক জর্মন ডাক্তারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হত। তার পর কী বলছিলেন, বলুন।
১৯২৮-এ যখন পঞ্চম জর্জের শক্ত ব্যামো হয়, তখন তাঁর কাছে ইংরেজ ডাক্তাররা পাঠালে রাজার এক্স-রে ছবি। ওঁর মতামত জানতে চাইলে–বুকে অপারেশন করা হবে, না শুধু ফুটো করলেই হবে, না ড্রেন করতে হবে, না কী? এবং এ কথাও জাওয়ার বুঝে গেলেন যে, আর যা হয় হোক, কোনও বিদেশি সার্জনকে দিয়ে রাজার অপারেশন করা চলবে না। ইংরেজ ডাক্তারগোষ্ঠী তা হলে আপন দেশে মুখ দেখাতে পারবে না।
আমি বললুম, আশ্চর্য! আমাদের গান্ধীকে তো ইংরেজ ডাক্তারই অপারেশন করেছিল।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, গল্পটা এখানেই শেষ নয়। কয়েক দিন পর ডাচেস অব কনোট না কেন্ট, কার জানি শক্ত ব্যামো হয়েছে। জাওয়ারব্রুখকে প্লেনে করে এখন তো প্লেন ডাল-ভাত– লন্ডন আনানো হল। অর্থাৎ ডাচেসের বেলা জর্মন ডাক্তার চললে চলতেও পারে, রাজার বেলা নয়!
আমি বললুম, বা রে!
বললেন, এখানেও শেষ নয়। জাওয়াব্রুখ তো রুগীর ঘরে ঢুকে রেগে কাই। এ রুগী তো ভয়ে কাঁপছে না, কাঁপছে শীতে। রুগীর লেপ তো লেপ নয়, ভিজে কাঁথা। বললেন, এ ঘরে রুগীর চিকিৎসা চলবে না। বেশ চড়া গলাতেই নাকি বলেছিলেন, মানুষ থাকার উপযোগী এবং ভদ্র (রিজনেবল) ঘরে ওঁকে নাকি নিয়ে যেতে হবে। একে জর্মন, তায় ডাক্তার– চড়া গলাতে বলবেই তো। তখন আরম্ভ হল তুলকালাম কাণ্ড। বহু হট্টগোলের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হল অন্য ঘরে সেখানে একটি ইলেকট্রিক হিটার কোনও গতিকে লাগানো হল।
ডাক্তার কী বললেন, জানেন? বললেন, কিছু হয়নি; কালই সেরে যাবেন। এবং সেরে গেলেন।
আমি বললুম আশ্চর্য।
তিনি বললেন, এ-ও শেষ নয়। পরদিন ডুক দিলেন ডাক্তারকে বিরাট ভোজ। তার পরিচিত লাট-বেলাট সবাইকে নেমন্তন্ন করা হল। স্বয়ং ডাচেস সেরে উঠে ব্যানকুয়েটে বসলেন। চার্চিলও ছিলেন। তার পর কী কাণ্ড হল জানেন?
ভোজ খেয়ে হোটেলে ফিরে এসে জাওয়ার দেখেন সেখানে আরেক কাণ্ড। চেনা আধা-চেনা যে তাঁকে দেখে সেই মাথা নিচু করে বাও করে। ওয়েটার, ম্যানেজার সবাই তাঁর পিছনে পিছনে ছুটছে। হুজুরের কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো, হুজুরের কী চাই? ডাক্তার তো অবাক। ডাচেসের জন্য গরম ঘরের ব্যবস্থা করেই এতখানি?
আসলে তা নয়। শোবার ঘরে গিয়ে ডাক্তার দেখেন, তার টেবিলের উপর সন্ধ্যাবেলাকার কাগজ। তাতে মোটা মোটা হরফে লেখা জর্মনির ডাক্তার জাওয়ারব্রুখ রাজাকে আজ সন্ধ্যায় অপারেশন করলেন! খবরের কাগজ সবকিছু জানে কি না! জাওয়ারব্রু লন্ডনে, ওই সময়ে, টায়টায়।
আমি আবার বললুম, আশ্চর্য! জাওয়ার প্রতিবাদ করলেন না?
তিনি বললেন, পরের দিন ভোরেই তাকে প্লেনে তুলে দেওয়া হল– এ্যারপোর্টে ডুক ডাচেস সবাই উপস্থিত। হৈহৈ-রৈরৈ। দেশে গিয়ে দেখেন, ইতোমধ্যে মার্কিন কাগজগুলো বলতে আরম্ভ করেছে, জাওয়ার অস্তর করার জন্য এক মিলিয়ন পৌন্ড পেয়েছেন! জর্মন কাগজরা আত্মম্ভরিতায় ফেটে যাবার উপক্রম। জাওয়ারব্রুখ একে ওঁকে জিগ্যেস করলেন, কী করা উচিত। সবাই বলে এই ডামাডোলের বাজারে কেউ তোমার প্রতিবাদ (দেমাতি) শুনবে না। চেপে যাও।
তার পর! ঠিক সেই সময়ে এক তাগড়া লম্বাচৌড়া নার্স এসে উপস্থিত। তাকে তুলে ধরল। তিনি ক্রাচ তুলে নিয়ে একদিকে ধরলেন, অন্যদিকে ভর করলেন নার্স। সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বারোটার ঘন্টা। বললেন, ও রেভোয়া–অর্থাৎ আবার দেখা হবে। গুড বাই নয়। তার অর্থ অন্য।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগল, জাওয়ার কি জানতেন তাঁকে ডাচেসের বাড়িতে আনা হয়েছিল তার অসুখের ভান করে। ওই সময়ে তিনি যেন লন্ডনে হাতের কাছে থাকেন। অপারেশনে যদি গণ্ডগোল হয়, তাকে তখখুনি ডেকে পাঠাবার জন্য।
যাকগে। কালই তো জর্মনি যাচ্ছি। আমার বন্ধু পাউলকে শুধাব! সে গুণী, সব জানে।
.
বহু চেষ্টা করেও লন্ডনের সঙ্গে দোস্তি জমাতে পারলুম না। পূর্বেও পারিনি। কারণ অনুসন্ধান করে আশ্চর্য বোধ হয়েছে, যে শহরকে দশ-এগারো বছর বয়স থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মারফতে চিনতে শিখেছি তার সঙ্গে হৃদ্যতা হয় না কেন? বোধহয় ইংরেজ এদেশে রাজত্ব করেছে বলে। বোধহয় বহুকাল ইংরেজের গোলামি করেছি তার প্রতি রাগটা যেন যেতে চায় না। তার সদগুণ দেখলে রাগটা আরও যেন বেড়ে যায়। তখন মনে হয়, এর সঙ্গে দোস্তিটা জমাতে পারলে জীবনটা আরও মধুময় হতে পারত।
কিন্তু আমি তো এ ফরিয়াদে একা নই। ফরাসিরা তো ইংরেজকে সোজাসুজি অনেক কথা বলে। মাদাম টাবউই বই লিখেছিলেন– পারফিডিয়াস এলবিয়ন অর আঁতাৎকর্দিয়াল। জর্মন, হাঙ্গেরিয়ান এবং অন্যান্য জাত অত কড়াভাবে কথাটা বলেনি বটে, কিন্তু ইংরেজের প্রকৃতি যে আর পাঁচটা জাতের মতো নয় সে কথা সবাই স্বীকার করে নেয়। কেউ ব্যঙ্গ করেছে, কেউ সহিষ্ণুতার সদয় হাসি হেসেছে। এ শুধু টুরিস্টদের সাধারণ অভিজ্ঞতা নয়, হাইনে, ভলতেয়ার, জোলার মতো বিচক্ষণ মহাজনরা যা বলে গেছেন সে তো কিছু ঝেড়ে ফেলে দেবার মতো নয়।
কিন্তু একটি কথা সবাই স্বীকার করেছেন। শেকসপিয়ারের মতো কৰি হয় না, ইসকিলাস, দান্তে, গ্যোটে এঁদের কারও চেয়ে ইনি কম নন। আর এর মহত্ত্ব এমনই বিরাট যে, তাঁকে নকল পর্যন্ত করার সাহস কারও হয় না।
কিন্তু এ তত্ত্ব নিয়ে অত্যধিক বাক্যব্যয় আমি করতে যাব কেন?
আমাকে যে জিনিস সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে সেইটে বলে প্লেনে উঠি।
.
ব্রিটিশ মিউজিয়মের পাঠাগার। অনেক দেশে বিস্তর পুস্তকাগারে ঢুকেছি। থানাতেও দু-একবার গিয়েছি। দুটোতে কোনও পার্থক্য লক্ষ করতে পারিনি। আমি যেন চোর। বই সরাবার মতলব ভিন্ন আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে এটা কেউই যেন বিশ্বাস করতে চায় না। কার্ড দেখানো থেকে আরম্ভ করে বই ফেরত দিয়ে বেরোবার পরও মনে হয় পিঠের উপর ওদের চোখগুলো যেন সার্জেনের তুরপুনের মতো কুরে কুরে ঢুকছে।
এর জন্য কে দায়ী বলা কঠিন। কিন্তু যেই হোক, কিংবা যারাই হোন, এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, চোর-পুলিশের বাতাবরণে আর যা হয় হোক, জ্ঞানসঞ্চয় বিদ্যার্জন হয় না। তবে এর ব্যত্যয়ও আছে। এবং আমার বিশ্বাস, আমরা উন্নতির দিকেই চলেছি।
ব্রিটিশ মিউজিয়মে কাউকে যে সন্দেহের চোখে দেখা হয় না তার প্রধান কারণ প্রায় সবাই বয়স্ক, অনেকেই পণ্ডিতরূপে বিশ্ববরেণ্য। এখানে কাজ করতে হলে সহজে অনুমতি পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ মিউজিয়মের কর্তারা যে ডগ অ্যান্ড দি ম্যানেজার, অর্থাৎ আমি খাব না, তোকেও খেতে দেব না নীতি অবলম্বন করেন তা নয়। তাঁদের বক্তব্য, সাধারণ রিসার্চ, যেমন মনে করুন ডক্টরেটের কাজ করার জন্য লন্ডনে আরও বিস্তর লাইব্রেরি রয়েছে। সেখানে ভিড় কম, ও রিসার্চ একটি বিশেষ বিষয়বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে আপনি আপনার বই পেয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি। যেমন মনে করুন, আপনি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই আপনি আপনার প্রয়োজনীয় বই পেয়ে যাবেন। কিন্তু যেখানে গবেষণা একাধিক বিষয়বস্তু ছাড়িয়ে যায় সেখানে স্পেশেলাইজড লাইব্রেরি কুলিয়ে উঠতে পারে না– তখন ব্রিটিশ মিউজিয়ম আপনাকে স্বাগতম জানায়।
এবং সবচেয়ে বড় কথা– পৃথিবীর সর্ব জায়গা থেকে এত সব নামকরা পণ্ডিত এখানে আসেন যে, মিউজিয়ম তাঁদের নিরাশ করে অপেক্ষাকৃত, কিংবা সম্পূর্ণ অজানা গবেষককে স্থান দিতে চায় না– কারণ পাঠাগারের সাইজ দশ ডবল করে দিলেও সে তার মোহাকৃষ্ট গবেষকদের স্থান কুলান করতে পারবে না।
মিউজিয়মের চায়ের স্টলে একজন পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ হয়।
তিনি বললেন, রিডিং রুমে ঢুকেই একজন নিগ্রো ভদ্রলোককে লক্ষ করেছেন কি? আবলুসের মতো রঙ আর বরফের মতো সাদা চুল? নাগাড়ে বিশ বছর ধরে ওই আসনে বসে কাজ করে যাচ্ছেন।
আমি বললুম, আপনি ক বছর ধরে?
তিনি যেন একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, সামান্য। পনেরো হবে। আমার চেয়ে যারা ঢের প্রবীণ তাঁদের কাছে শোনা।
আমি শুধালুম, ইনি কী কাজ করছেন?
হাবশি মুল্লুকে খ্রিস্টধর্মের অভ্যুদয় কিংবা ওরই কাছাকাছি কিছু একটা। হিব্রু, আরাহময়িক, আহমরিক, সিরিয়াক এসব তাবৎ ভাষায় লেখা বই ঘাঁটতে হলে এখানে না এসে তো উপায় নেই।
আমি সামান্য যে ক দিন কাজ করেছিলুম সে কদিন নিগ্রো ভদ্রলোকের নিষ্ঠা দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। নটার সময় কাটায় কাটায় তাকে আসন নিতে দেখেছি এবং উঠতেন ছটার সময়। এর ভিতরে আসন ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকলে আমার অজানতে। আর দেড়টা থেকে দুটো অবধি চেয়ারের হেলানে মাথা দিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে নিতেন।
লিখতেন অল্পই। পড়তেন বেশি। চিন্তা করতেন তারও বেশি। দু একবার চোখাচোখি হয়েছে। তিনি যেন আমাকে দেখতেই পাননি। চোখ দুটি কোন অসীম ভাবনার গভীর অতলে ডুবে আছে আমি জানব কী করে? কিংবা তিনি হয়তো ছবি দেখছেন, সেই আদিম আবিসিনিয়ান সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন খ্রিস্টের দূত, শান্তির বাণী বহন করে। তখন তাঁদের সভ্যতা সংস্কৃতি কোন স্তরে ছিল, খ্রিস্টের বাণী তারা কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন– তারই ছবি দেখছেন। যেখানে ছবি অসম্পূর্ণ কিংবা ঝাপসা সেটাকে সম্পূর্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য এই সাধনা।
তাঁর বই লেখা শেষ হয়েছিল কি না, প্রকাশিত হলে কজন লোক সেটি পড়েছিল, বুঝবার মতো শক্তি কজন পাঠকের ছিল তা-ও জানিনে। কারণ এরকম নিষ্ঠাবান সাধক পাঠাগারের অনেকেই।
এ স্থলে পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমি সেখানে ঠাই পেলুম কী করে? কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, আমি পণ্ডিত নই।
জর্মনিতে পড়াশোনা করার সময় আমার কয়েকখানা বইয়ের প্রয়োজন হয়। সেদেশে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছিল না বলে অধ্যাপক বললেন, ব্রিটিশ মিউজিয়মে যাও; সেই সুযোগে লন্ডনও দেখা হয়ে যায়।
তিনি নিজে প্রায়ই লন্ডনে এসে কাজ করে যেতেন। মিউজিয়মের কর্তারা ভালো করেই জানতেন, পণ্ডিতসমাজে তার স্থান কতখানি উঁচুতে। তিনি যখন পরিচয়পত্র দিয়ে পাঠালেন তখন এঁরা আর কোনও প্রশ্ন শুধালেন না।
কিন্তু বার বার লজ্জা অনুভব করেছি।
প্রথম মুশকিল আসন নিয়ে। কোনও আসনে কেউ বসছেন বিশ বছর ধরে, কেউ ত্রিশ বছর ধরে। ঠিক সেদিনটাই হয়তো তিনি তখনও আসেননি। আপনি না জেনে বসে গেলেন তারই আসনে– কারণ কোনও চেয়ার কারও জন্য রিজার্ভ করা হয় না। তিনি খানিকক্ষণ পরে এসে আপনাকে ওই চেয়ারে দেখে চলে গেলেন কিছু না বলে। অন্য জায়গায় বসে তিনি ঠিক আরাম পেলেন না। আপনি কিন্তু জানতেই পেলেন না।
পরের দিন গিয়ে দেখলেন, অন্য কে একজন– তিনিই হবেন– ওই আসনে বসে আছেন। আপনি নতুন আসনের সন্ধানে বেরোলেন।
এসব বুঝতে বুঝতে কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। যখন বুঝলুম, তখন শরণাপন্ন হলুম এক কর্মচারীর। তিনি অনেক ঘাড় চুলকে আমাকে একটি আসন দেখিয়ে বললেন, এ চেয়ারটায় এক ভদ্রলোক বসছেন দশ বৎসর ধরে।
আমি বললুম, থাক্ থাক্।
তিনি বললেন, তবে মাসখানেক ধরে তিনি আসছেন না।
আমি বললুম, তা হলে উপস্থিত এখানেই বসি। কিন্তু তিনি এলে আমায় বলে দেবেন কি?
বিরাট গোল ঘর! মাঝখানে চক্রাকারে সাজানো ক্যাটালগ। আর একেবারে কেন্দ্রে বসে কয়েকজন কর্মচারী। এঁদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বড় একটা হয় না। বই আসে-যায় কলের মতো।
কেন্দ্র থেকে সারি সারি হয়ে দেয়াল অবধি বেরিয়েছে পাঠকদের আসনপঙক্তি। উপরের কাঁচ দিয়ে যে আলো আসছে সেটুকু যথেষ্ট নয় বলে টেবিলে টেবিলে ল্যাম্প। পাঠকদের অনেকেই পরেছেন কপালের উপরে রবারে বাধা শেড়–টেনিস খেলোয়াড়দের মতো। সামান্য পাতা উল্টোনোর শব্দ, পাশের ভদ্রলোকের কলমের অতি অল্প খসখস। আর কোনও শব্দ কোনও দিক দিয়ে আসছে না। অখণ্ড মনোযোগের পরিপূর্ণ অবকাশ।
এ জায়গা মানুষকে কাজ করতে শেখায়। আপনি হয়তো এলেন নটা পনেরো মিনিটে। এসে দেখেন আপনার পাশের ভদ্রলোক যেভাবে কাজ করছেন তার থেকে মনে হয়, তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। তার পর দশটা এগারোটা বারোটা একটা অবধি তিনি আর ঘাড় তোলেন না। আপনার ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছে। তার পায়নি। আপনারও রোখ চেপে গেল। উনি না উঠলে আপনিও উঠবেন না। ইতোমধ্যে বাইরে গিয়ে বার বার সিগারেট খাবার ইচ্ছে হয়েছে সেটাও চেপে গিয়েছেন। দুটোর সময় উনি উঠলেন। আপনি যখন সাত তাড়াতাড়িতে চা-রুটি খেয়ে ফিরলেন, তিনি তখন ঘাড় গুঁজে ফের কাজে ডুব মেরেছেন। বোঝা গেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি সঙ্গে আনা দু খানা স্যান্ডউইচ খেয়েই কাজ সেরেছেন। তার পর তিনি উঠলেন পাঠাগার বন্ধ হওয়ার সময়।
এরকম যদি একটা লোক পাশে বসে কাজ করে তবে কার না মাথায় খুন চাপে। কিছুদিনের ভিতর দেখতে পাবেন, আপনিও দিব্য নটা ছটা করে যাচ্ছেন। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, কোনও ক্লান্তি আসছে না।
একেবারে কেন্দ্রে বসতেন একটি অতিশয় ছোটখাটো বৃদ্ধ। পরনে মর্নিং স্যুট। লম্বা দাড়ি। আবার মাথায় টপ হ্যাট! ঘরের ভিতরে ইংরাজ হ্যাট পরে না। এঁকে কিন্তু কখনও হ্যাটটি নামাতে দেখি না। বোধহয় হ্যাঁটের সামনের দিকটা দিয়ে তিনি শেডের কাজ চালিয়ে নিতেন।
সিন্ধি-গুজরাতিতে মেশানো কয়েকখানি ধর্মগ্রন্থের সন্ধান না পেয়ে তার কাছে গেলুম। তিন মিনিটের ভিতর তিনি ক্যাটালগের ঠিক জায়গা বের করে দিলেন, এবং এটাও বললেন, বোধহয় ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে এ সম্বন্ধে আরও বই আছে।
পরে এক ভারতীয়ের মুখে শুনলুম, হেন বই লাইব্রেরিতে নেই যার হদিশ তার অজানা। মিউজিয়মের চায়ের ঘরে কথা হচ্ছিল। লাইব্রেরির দেশবিদেশের পাকা গাহক কয়েকজন ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলেন।
.
এই অশ্রান্ত অজস্র পরিশ্রম আর নিষ্ঠার শেষ কোথায়, ফল কী? এদের সকলের বই কি জনসমাজে সম্মান পায়? বহু পরিশ্রমের পর যখন বই সম্মান পায় না তখন লেখকের মনে কী চিন্তার উদয় হয়? তিনি কি আবার নতুন করে কাজ আরম্ভ করেন, না ভগ্নহৃদয়ে শয্যাগ্রহণ করেন।
এর উত্তর দেবে কে?
শুধু এইটুকু জানি, মিউজিয়ম এ নিয়ে মাথা ঘামাক আর না-ই ঘামাক, সে সাদরে বংশপরম্পরাকে জ্ঞানের সন্ধানে সাহায্য করছে, আর পাঠাগারের কেন্দ্রটি বিশ্বের সর্বজ্ঞানের কেন্দ্র না থোক, অন্যতম কেন্দ্র।
ইংরেজকে এখানে নমস্কার।
বিশ্বজনের কাছে ভারতবর্ষ অপরিচিত দেশ নয়। প্রাচীন যুগে সে অপরিচিত ছিল না, এ যুগেও নয়। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য অল্পসংখ্যক স্বার্থান্বেষী সাম্রাজ্যবাদী ভারতবর্ষের সম্বন্ধে প্রচার করেন যে, যদিও এদেশ একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল আজ তার সর্বলোপ পেয়েছে এবং বৈদেশিক শাসন ভিন্ন এর পুনর্জীবন লাভের অন্য কোনও পন্থা নেই। এ কুৎসা প্রচারের ফলে প্রাচ্য-প্রতীচ্য উভয় মহাদেশেই বিস্তর কুফল ফলেছিল, এখনও কিছু কিছু ফলছে। এর জন্য সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই স্বল্পসংখ্যক সাম্রাজ্যবাদীদের দেশই। কিন্তু এ স্থলে স্মরণ রাখা কর্তব্য, সে দেশের মনীষীগণও তাই নিয়ে প্রচুর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
মাত্র একটি দেশ ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কখনও তার ভক্তিশ্রদ্ধা হারায়নি। সে দেশ জর্মনি। এদেশের গুণীজ্ঞানীরা সে তত্ত্ব অবগত আছেন। আমাদের কবি মধুসূদন একশো বছর পূর্বে লন্ডনে থাকাকালীন জর্মন পণ্ডিত গল্টকারের সঙ্গে দেখা করতে যান; এমনকি যে স্বল্পসংখ্যক জর্মন পণ্ডিতের মতবাদ আমাদের সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ভ্রমাত্মক বলে মনে করেছেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি আপন যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছেন। পরবর্তী যুগে আমাদের শিক্ষাচার্য রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় শাস্ত্র গবেষণার জন্য জর্মন পণ্ডিত ইউনটার-নিসকে নিমন্ত্রণ করে বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসেন; তখনই অপরিচিতা শ্রীমতী ক্ৰামরিশ তাঁরই সৌজন্যে বিশ্বভারতীতে ভারতীয় কলাচর্চার সুযোগ পান।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এদেশের জনসাধারণ জর্মনির খবর পেল দুই অশুভ যোগাযোগের ফলে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবাসী জর্মনি সম্বন্ধে নানা অতিরঞ্জিত কাহিনী শুনে ঈষৎ পথভ্রান্ত হয়েছে সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। এদেশের পণ্ডিতসমাজেও জর্মন ভাষা সুপ্রচলিত নয় বলে ভারতবর্ষীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা জর্মনিতে কীভাবে হয়, তার কতখানি উন্নতি হয়েছে, সে বিষয় বাংলায় অনূদিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। যেসব বাঙালি বিপ্লবী জর্মনিতে আশ্রয় পেয়েছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা সুস্পষ্ট কারণবশত এদেশে প্রসার লাভ করতে পারেনি।
ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান কলা-দর্শন সভ্যতা-সংস্কৃতি চর্চার জন্য ইয়োরোপে যে শব্দটি প্রচলিত তার নাম ইভলজি– জর্মন উচ্চারণ ইন্ডলগি। শব্দটি অর্বাচীন ও গ্রিক গোত্রীয় (অবশ্য এর প্রথমাংশ ইন্দস শব্দটি মূলে ভারতীয়) এবং জর্মনির শিক্ষিতজন মাত্রই এটির বহুল প্রয়োগ করে থাকেন; ইংলন্ডের পণ্ডিতসমাজে এটি কখনও কখনও ব্যবহৃত হয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় শব্দটি নেই, জর্মন সাইক্লোপিডিয়ায় নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ আছে।
জর্মনিতে ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদির চর্চা অর্থাৎ ইন্ডলজি কতখানি প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা বাংলাতে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণকাহিনী তার জন্য প্রশস্ত স্থান নয়, কিন্তু এ সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান না থাকলে জর্মন দেশবৃত্তান্তের একটা বিরাট মহৎ দিক অবহেলিত হয়, এবং দ্বিতীয়ত আমার ছাত্রজীবনের প্রায় চার বৎসর সেখানে কাটিয়েছি বলে একাধিক জর্মন সংস্কৃতজ্ঞের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয় এবং ভ্রমণকাহিনীতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় প্রকাশিত হবে বলে এসব পণ্ডিত এবং তাঁদের সাধনা সম্বন্ধে এই সুযোগে যা না বললে নিতান্তই চলে না সেইটুকু বলে রাখি। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি, ভবিষ্যতে আমি এ প্রলোভন সম্বরণ করব।
ইভলজি আরম্ভ করেন ইংরেজরাই অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। জোনস, কোব্রুক, উইলসন এর প্রতিষ্ঠাতা। এর পরই ফ্রান্সে সিলভেসূত্র দ্য সাসি এ চর্চা আরম্ভ করেন। সঙ্গে সঙ্গে জর্মনিতে সেটা ব্যাপকতরভাবে আরম্ভ হয়। জর্মন পণ্ডিত শ্লেগেলই সর্বপ্রথম এ চর্চার ব্যাপকতা এবং কীভাবে একে অগ্রসর হতে হবে তার কর্মসূচি তার পুস্তক ঝুবার ডি স্পাখে উনট ভাইজহাইটডের ইভার (ভারতীয় ভাষা ও মনীষা:) ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। এর কয়েক বৎসর পরেই জর্মন পণ্ডিত বপু সংস্কৃত ধাতুরূপের সঙ্গে গ্রিক, লাতিন এবং প্রাচীন জর্মন ধাতুর তুলনা করে সপ্রমাণ করেন যে, ভবিষ্যতে আর্যগোষ্ঠীর যে কোনও ভাষার মূলে পৌঁছতে হলে সংস্কৃত ভাষা অপরিহার্য। বস্তুত তিনিই প্রথম তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের কেন্দ্রভূমিতে যে সংস্কৃতকে স্থাপনা করলেন এখনও সে সেখানেই আছে। তারই দু বৎসর পরে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জর্মনির বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংস্কৃত অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয় এবং ওই কর্মে নিয়োজিত হন পূর্বোল্লিখিত ফ্রিডরিষ শ্লেগেলের ভ্রাতা ভিলহেলম শ্লেগেল। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে বপু বার্লিনে নিযুক্ত হলেন।
ভারতবর্ষে তখন সংস্কৃত চর্চার কী দুর্দিন!
শ্লেগেল ভ্রাতৃদ্বয়, বপ যে শুধু ভারতীয় ব্যাকরণ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন তাই নয়, তারা তখন সংস্কৃত সাহিত্যের রসের দিক অনুবাদের মাধ্যমে জর্মনিতে পরিবেশন করতে আরম্ভ করেছেন। ফলে তার প্রভাব গিয়ে পড়ল জর্মন সাহিত্যে। কবিগুরু গ্যোটে শকুন্তলার অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ। তিনি তখন যা বলেছিলেন তাই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন প্রায় একশো বছর পরে। তিনি লিখলেন :
য়ুরোপের কবিগুরু গ্যোটে একটিমাত্র শ্লোকে শকুন্তলার সমালোচনা লিখিয়াছেন, তিনি কাব্যকে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন করেন নাই। তাহার শ্লোকটি একটি দীপবর্তিকার শিখার ন্যায় ক্ষুদ্র, কিন্তু তাহা দীপশিখার মতোই সমগ্র শকুন্তলাকে এক মুহূর্তে উদ্ভাসিত করিয়া দেখাইবার উপায়। তিনি এক কথায় বলিয়াছিলেন, কেহ যদি তরুণ বৎসরের ফুল, কেহ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখিতে চায়, তবে শকুন্তলায় তাহা পাইবে।
এবং প্রবন্ধ শেষ করতে গিয়ে লিখলেন :
গ্যোটের সমালোচনার অনুসরণ করিয়া পুনর্বার বলি, শকুন্তলায় আরম্ভের তরুণ সৌন্দর্য মঙ্গলময় পরম পরিণতিতে সফলতা লাভ করিয়া মর্তকে স্বর্গের সহিত সম্মিলিত করিয়া দিয়াছে।
গ্যোটের মতো কবি যখন সংস্কৃত নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত তখন অন্য কবিরা যে উৎসাহিত হবেন সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। গীতিকাব্যের রাজা হাইনে তখন দুঃখ-বেদনায় কাতর হলেই স্বপ্ন দেখতে লাগতেন সেই আনন্দনিকেতন, সেই স্বপ্নের ভুবন ভারতবর্ষ শেলি কিটস বায়রন যে অবস্থায় স্বপ্ন দেখতেন গ্রিসের।
গঙ্গার পার- মধুর গন্ধ ত্রিভুবন আলো ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে।
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতিধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
আম্ গাঙেস ডুফটেট লয়েস্টটস
উনটু রিজেনবয়মে ব্ল্যুয়েন,
উনট শ্যোনে স্টিলে মেনশেন্।
ফর লটসব্লুমেন ক্লিয়েন।
গঙ্গানদীতে আমি পদ্মফুল ফুটতে দেখিনি। কিন্তু এ তো স্বপ্নরাজ্য। এর কিছুটা সত্য কিছুটা কল্পনা। তাই পূর্ব-বাংলার কবিও মধ্য আরবের মরুভূমির ভিতর দিয়ে তার নায়িকা লায়লাকে যখন মজনুর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন তখন তিনি যাচ্ছেন নৌকোয় চড়ে! এবং শুধু কি তাই? তিনি বিলের জল থেকে সেই আরবদেশে–কুমুদকহার তুলে তুলে খোঁপায় খুঁজছেন!
হাইনে জাত-ধর্মে ইহুদি। তার ধমনিতে আর্যরক্ত নেই। কিন্তু আর্যজর্মানিতে তখন ভারতীয় আর্যের প্রতি যে সমবেদনা, গৌরবানুভূতির প্লাবন আরম্ভ হয়েছে তাতে তিনিও নিজকে ভাসিয়ে দিলেন। তাঁর বহু কবিতায় কখনও প্রচ্ছন্ন, কভু-বা প্রকাশ্যে ভারতের প্রতি আকুল ব্যাকুল হৃদয়াবেগ (জর্মন ভাষায় এই হৃদয়াবেগের নাম শুয়ের্মেরাই)।
ওই সময়ে ভারতের প্রতি জর্মনির কতখানি শুয়ের্মেরাই (ইংরেজিতেও এর প্রতিশব্দ নেই- ফেনাটিক এনথুসিয়েজম-এর অনেকটা কাছাকাছি) তার কয়েকটি উদাহরণ দিই।
ভারতবর্ষে যখন কেউ জর্মন ভাষা শিখতে আরম্ভ করে তখন সাধারণত তাকে যে প্রথম ক্ষুদ্র উপন্যাস পড়তে দেওয়া হয় তার নাম ইমেজে। আমিও এই বই পূৰ্বোল্লিখিতা শ্রীযুক্তা ক্ৰামরিষের কাছে পড়ি। তাতে জর্মন বাচ্চাদের খেলাধুলোর একটি বর্ণনা আছে। তারা সবাই মিলে একটা ঠেলাগাড়ি তৈরি করে তার উপর কেউ-বা চাপছে, কেউ-বা দিচ্ছে ঠেলা। আর সবাই মিলে একসঙ্গে প্রাণপণ চেঁচাচ্ছে :
নাখ ইন্ডিয়েন, নাখ ইন্ডিয়েন্!
ভারত চলো, ভারত চলো!
ঠেলাগাড়ি চড়ে চড়েই তারা ভারতবর্ষে পৌঁছবে!
কবিরা শিশুপ্রকৃতি ধরেন, এবং শিশুরাও কবিপ্রকৃতি ধরে। দু জনারই বাস কল্পনারাজ্যে।
কিন্তু প্রশ্ন, তারা নাখ ইন্ডিয়েন, নাখ ইন্ডিয়েনই করছে কেন, না আমেরিকা কিংবা নাখ চীনা চেঁচাচ্ছে না কেন? জর্মনির কাচ্চাবাচ্চাদের ভিতরও তখন এই শুয়ের্মেরাই ছড়িয়ে পড়েছে। এ বইয়ের প্রকাশ ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে।
ওই সময়ে ইয়োরোপে যেসব পণ্ডিত বেদ চর্চায় মত্ত তাদের তিনজনই জর্মন : বেনাই, ম্যাকমুলার এবং ভেবার। ম্যাকমুলারকে সবাই চেনেন, ভেবারের লেখার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র সুপরিচিত ছিলেন, কিন্তু কেনফাই সামবেদের অনুবাদ করেছিলেন বলেই বোধহয় অতখানি খ্যাতি পাননি। তবে জর্মনির শিশুসাহিত্যে তিনি সম্রাট। তার পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ প্রাতঃস্মরণীয়।
কাজ তখন এত এগিয়ে গিয়েছে যে একখানা সর্বাঙ্গসুন্দর সংস্কৃত-জর্মন অভিধান না হলে আর চলে না। দুই জন পণ্ডিত ব্যোটলি ও রোট তখন যে অভিধান প্রস্তুত করলেন সেটি প্রকাশিত হল রুশ সম্রাটের অর্থসাহায্যে সাত ভলুমে, ১৮৫২-৭৫ খ্রিস্টাব্দে।
এ অভিধান অতুলনীয়। কিয়দ্দিন পূর্বে পরলোকগত পণ্ডিতবর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ই আমার জানামতে একমাত্র বাংলা আভিধানিক যিনি তার বঙ্গীয় শব্দকোষ রচনাকালে এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।
ওই শুন দিশে দিশে তোমা লাগি
কাঁদিছে ক্রন্দসী।
এ স্থলে ক্রন্দসী শব্দের অর্থ কী? ভাসা ভাসাভাবে অনেকেই ভাবেন, ওই চতুর্দিকে কান্নাকাটি হচ্ছে, আর কি। অন্যায়টাই-বা কী? স্বয়ং নজরুল ইসলাম লিখেছেন, কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের কোষ অনবদ্য। তাতেও দেখবেন, সংস্কৃত অভিধানে পাই নাই, কিন্তু রোদসী পাইয়াছি। তার অনুকরণে অনুপ্রাসানুরোধে (!) ক্রন্দসী। কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক উদ্ভাবিত (!) এবং বাংলায় প্রথম ব্যবহৃত। কিন্তু এতখানি বলার পর জ্ঞানেন্দ্রমোহন প্রকৃত কোষকারের ন্যায় অর্থটি দিয়েছেন ঠিক। আকাশ ও পৃথিবী; স্বর্গমর্ত।
ব্যোটলিঙ্ক-রোটের সংস্কৃত-জর্মন অভিধানখানার প্রসঙ্গ উঠেছে বলেই এ উদাহরণটির প্রয়োজন হল। এ অভিধান জর্মন দেশ ও বাংলার যোগসেতু।
একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেলে পাঠক অপরাধ নেবেন না।
ছেলেবেলায় আমার মনে ধোকা লাগে ক্রন্দসী শব্দ নিয়ে। সবে শান্তিনিকেতনে এসেছি। দূর থেকে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি। শুনে ভয় পেয়েছি, তিনি নাকি বিশ বছর ধরে একখানা বাংলা অভিধান লিখছেন। বিশ বছর ধরে বাংলা-সংস্কৃত নয়, গ্রিক নয়, বাংলা অভিধান- বি…শ বছর ধরে! তখনও জানতুম না তার পরও তিনি আরও প্রায় বিশ বছর খাটবেন।
তাঁকে গিয়ে শুধাতে তিনি বড় আনন্দিত হলেন– আমি ভয় পেয়েছিলুম, তিনি বিরক্ত হতে পারেন। একাধিক বাংলা অভিধান দেখালেন যাতে শব্দটা নেই। তার পর ব্যোটলিঙ্ক রোট পড়তে পড়তে বললেন, এইবারে দেখ, জর্মনরা কী বলে। তাতে দেখি, ডি টোবেন্ডেন শ্লাখটরাইয়েন, অর্থাৎ যে দুই সৈন্যবাহিনী হুঙ্কার করছে। হরিবাবু বললেন, ঠিক, অর্থাৎ দুই পক্ষ- তার মানে উর্বশীর জন্য দু পক্ষই কাঁদছে। কিন্তু তার পরেও এগোতে হয়। ঋগ্বেদের এই ২, ১২, ৮–এর টীকা দিতে গিয়ে সায়ণাচার্য ক্রন্দসী শব্দের অর্থ করেছেন স্বর্গমর্ত।
উর্বশী কবিতায় রবীন্দ্রনাথও ক্রন্দসী শব্দ স্বর্গ ও মর্ত্য এই মর্মে ব্যবহার করেছেন। কারণ স্বর্গে দেবতা এবং মর্তের মানব দুই-ই যে তার প্রেমাকাভী, তার বর্ণনা তিনি এ কবিতায় দিয়েছেন।
এ স্থলে আর এগোবার দরকার নেই। জর্মনিতে ফিরে যাবার পূর্বে উল্লেখ করি হরিচরণ তার সফল শব্দকোষ ব্যোটলিঙ্ক-রোটকৃত অভিধানের প্যাটার্নে নির্মাণ করেছেন।
এ অভিধান জর্মনিতে প্রসার লাভ করার ফলে সে দেশে ভারতীয় জ্ঞান-চর্চা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল এবং তারই ফলে তার পরিমাণ এমনই বিরাট রূপ এগিয়ে ধরল যে, ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিতদের হাতে সমর্পণ করতে হল। জর্মন পণ্ডিত ব্যুলার তখন এক বিরাট পুস্তকের পরিকল্পনা করলেন। আর্য-প্রাচ্যতত্ত্বের পরিকল্পনা–এন্টরিশ ডের ইন্ডো-আরিশেন ফিললগি উন্ট আলটের টুমসকুন্ডে নামে এ বই পরিচিত। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এর প্রথম ভলুম বেরোয়; এ যাবৎ কুড়ি ভলুম বেরিয়েছে। প্রধানত কিলহন, ডার্স, ভাকেরনাগেল এবং আরও অসংখ্য পণ্ডিত এতে সাহায্য করেন।
এর পর আর হিসাব রাখা যায় না।
কারণ এতদিন ছিল ব্যাকরণ, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন নিয়ে চর্চা; তার পর আরম্ভ হল ভাস্কর্য, স্থাপত্য, চিত্র, নাট্য, নৃত্য, হস্তশিল্প, সঙ্গীত- আরও কত কী নিয়ে আলোচনা। শিট সায়েব তো একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন কামসূত্র নিয়ে। ব্যোটলিঙ্কের অভিধানে কামসূত্রের টেকনিকাল শব্দ বাদ পড়ে গিয়েছিল– শিট সে অভিধানের প্রয়োজন খণ্ড প্রণয়নকালে এত বেশি কামসূত্রীয় শব্দ প্রবেশ করিয়ে দিলেন যে, তাই নিয়ে পণ্ডিতমহলে নানা রকমের শ্রুতিমধুর মন্তব্য শোনা গেল। কৌটিল্য নিয়ে কী মাতামাতি! আর, আমি দেখেছি আমারই চোখের সামনে এক জর্মন মহিলা সপ্তাহে তিন দিন করে তিনটি বচ্ছর এলেন অধ্যাপক কিফেলের কাছে অষ্টাঙ্গের জর্মন অনুবাদে সাহায্যের জন্যে। তার পূর্বে তিনি মেডিকেল কলেজ পাস করে ওই বিষয়ে বোধহয় ডক্টরেটও নিয়েছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত ক বছর খেটেছিলেন বলতে পারব না। যে ডক্টর জাওয়ারব্রুখের কাহিনী পঞ্চম জর্জের অপারেশন প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি, তিনি পর্যন্ত ক্যানসারের গবেষণা আরম্ভ করার পূর্বে জর্মন ইন্ডলজিস্টের কাছ থেকে শুনে নিয়েছিলেন, ভারতীয় বৈদ্যরাজগণ এই মারাত্মক ব্যাধি সম্বন্ধে কোন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, কোন চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।
ভারতীয় সঙ্গীত ও জর্মনি সঙ্গীত ভিন্ন ভিন্ন মার্গে চলে। তৎসত্ত্বেও ভারতীয় বিষয়বস্তু একাধিক সঙ্গীতকারকে ভারতীয় লাইট-মোতিফ জুটিয়েছে, তুলনাত্মক আলোচনা প্রচুর হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জনৈক মজুমদার এ সম্বন্ধে একখানি উচ্চাঙ্গের পুস্তক লিখে ডক্টরেট পান। পরম পরিতাপের বিষয় ওই যুদ্ধে তিনি তরুণ বয়সে প্রাণ হারান। বইখানির পাণ্ডুলিপি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এ যাবৎ সে বই কেন যে কোনও ভারতীয় বা ইংরেজি ভাষাতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি সে এক বিস্ময়।
মৃচ্ছকটিকা জর্মনদের প্রিয় নাট্য। তার একাধিক প্রাঞ্জল এবং মধুর জর্মন অনুবাদ আমি দেখেছি। এ নাট্যের ঘটনাপরম্পরার বিচিত্র ঘাতপ্রতিঘাত যে রকম জর্মন মনকে চলিত করে, ঠিক তেমনি তার গীতিরস–বিশেষ করে অকাল বর্ষায় বসন্তসেনার অভিসার ও দয়িত দরিদ্রচারুদত্তের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর উভয়ের সে বর্ষণবর্ণন জর্মন হৃদয়কে নাট্যগৃহে বহুবার উল্লসিত উদ্বেলিত করেছে। জর্মন ভাষা ইংরিজির তুলনায় অনেক বেশি গম্ভীর ও প্রাচীনত্ব (আরকাইক) ধরে বলে সে ভাষায় মূল সংস্কৃতের অনেকখানি স্বাদগন্ধ রক্ষা পায় এবং কাব্যরসাশ্রিত নাট্যরস সহজেই সে ভাষায় সঞ্চারিত হয়।
জর্মন সাহিত্যদর্শন তথা জাতীয় জীবন– এ দুয়ের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের প্রভাব কতখানি হয়েছে তার সিংহাবলোকন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ জর্মনিতে যান। জর্মনি তখন মিত্রশক্তির পদদলিত, শব্দার্থে মর্মাহত। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, পরাজিতের সঙ্গীত। তখন জর্মনিতে যেরূপ হার্দিক অভিনন্দন পেয়েছিলেন সে রকম অন্যত্র কোথাও পাননি। সে কথার উল্লেখ তিনি নিজেই করে গিয়েছেন। আমি অন্যত্র একাধিকবার তার প্রতি জর্মন প্রীতির নিদর্শন বর্ণন করার চেষ্টা করেছি। এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
এতদিন জর্মনদের বিশ্বাস ছিল, ভারতবর্ষ একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির উচ্চ শিখরে উঠেছিল বটে, কিন্তু বর্তমান যুগে সে দেশে শুধু ম্যালেরিয়া, গোখরো এবং ইংরেজ। (যদিও অবান্তর তবু বলে ফেলি; শেষের দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি বেইমান সেটা পশুবিদরা এযাবৎ স্থির করে উঠতে পারেননি) রবীন্দ্রনাথের আগমনে এবং দু তিন মাসের ভিতর তার লক্ষাধিক পুস্তক জনসমাজে প্রচারিত হওয়ার ফলে তথা ডাকঘর নাট্যরূপে দেখে তাদের ভুল ভাঙল। নবীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাদের মনে কৌতূহল জাগল। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা হল। প্রথম অধ্যাপক ভাগনার অবশ্য বাংলা শিখেছিলেন নিজের চেষ্টাতেই। জর্মনিতে অনূদিত তার বাংলা-গল্প চয়নিকা বেঙ্গালিষে এরসেলুনে সম্বন্ধে আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা এবং প্রগাঢ় প্রীতি সম্বন্ধে বার্লিনে প্রবাসী বাঙালি মাত্রই সচেতন ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর দরদটি কেমন যেন ভীতি-ভরা বলে আমার মনে হত। আমার মনে হত, বিশ্বসাহিত্যের অপরিচিত এই সাহিত্যের প্রতি তাঁর মাত্রাতিরিক্ত প্রীতি (প্রায় শুয়ের্মেরাই বলা চলে) পাছে লোকে ভুল বোঝে, সেই ছলে পাছে লোকে সেটিকেও অনাদর করে ফেলে– এই ছিল তার ভয়। দুঃখিনী মা লাজুক ছেলেকে যে রকম পরবের বাড়িতে নিয়ে যেতে ভয় পায়। শোকের বিষয় এই বিষয় নিরীহ ভাবুকটিও মজুমদারের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তার পরও জর্মনি অনেক ভারতীয় রাজদ্রোহীকে আশ্রয় দিয়েছে। এ সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানিনে। তার কারণ এর সবকিছুটাই ঘটত লোকচক্ষুর অগোচরে। তবে শুনেছি ইংরেজ যখন জর্মনির ওপর চাপ আনত, কোনও ভারতীয় বিদ্রোহীকে সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য, তখন জর্মন পুলিশ তাকে কাতর কণ্ঠে বলত, কেন বাপু একই ঠিকানায় বেশি দিন ধরে থাক? ইংরেজ খবর জেনে আমাদের ওপর চোটপাট করে তোমাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য। আজই বাড়ি বদলাও। আমরা বলব, তোমার ঠিকানা জানিনে এ কথাটি আমি শুনেছি, নেতা লালা হরকিষণ লালের ছেলে মনোমোহনলাল গাওবার কাছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিংবা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে আমার চেনার মধ্যে জর্মনিতে ছিলেন শ্রীযুক্ত সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও বীরেন সেন (এঁর পুরো নাম ও পদবি আমার ঠিক মনে নেই); এ সম্বন্ধে এঁরা সবিস্তর বলতে পারবেন এবং কিছু কিছু বলেছেনও। আর ছিলেন পরলোকগত মানবেন্দ্র রায়।
ভারতের প্রতি হিটলারের শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। তদুপরি জাপানকে হাতে আনবার জন্য তিনি চীন ভারত তাকে (প্রভাবভূমি বা স্ফিয়ার অব্ ইনফ্লুয়েন্স রূপে) দান করে বসেছিলেন বলে সুভাষচন্দ্রকে বাইরে আদর দেখিয়েও ঠিকমতো সাহায্য করেননি। সুভাষচন্দ্র যে অতিশয় তেজস্বী মহাবীর এবং সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বিচক্ষণ কূটনীতিক ছিলেন সে কথা আমার মতো সামান্য প্রাণীর প্রশস্তি গেয়ে বলার প্রয়োজন নেই। তিনি হিটলারের মনোভাব বুঝতে পেরে জাপান চলে যান। জাপানই যখন শেষমেশ ভারত আক্রমণ করবে, তখন জর্মনিতে বসে না থেকে জাপানে চলে যাওয়াই তো বিচক্ষণের কর্ম। এ সম্বন্ধে বাকি কথা প্রসঙ্গ এলে হবে।
জর্মন সাহিত্যদর্শন তথা তার জাতীয় জীবন–এ দুয়ের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের প্রভাব কতখানি হয়েছে, এ সম্বন্ধে আলোচনা করার অধিকার আমার নেই। আশা করি শাস্ত্ৰাধিকারী ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রামাণিক পুস্তক লিখবেন। উপস্থিত আমি মাত্র একটি উদাহরণ দিয়ে এ স্থলে ক্ষান্ত হই।
ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়ায় টেগোর শব্দ খুললে পাবেন, মাত্র রবীন্দ্রনাথের একটি অতি ক্ষুদ্র জীবনী। এবং তার জীবনীকার হিসেবে একমাত্র টমসনের নাম।
জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া সাইজে তার ইংরেজি অগ্রজের অর্ধেক মাত্র। তবু তার প্রথমেই পাবেন, টেগোর শব্দের অর্থ। অনুবাদ দিচ্ছি–
টিগোরে, আসলে ঠাকুর (Thakur) (সংস্কৃত ঠাকুর, প্রভু, সম্মতির প্রভু), পদবি (অষ্টাদশ শতাব্দীর আরম্ভ থেকে), বর্তমানে পারিবারিক নাম। এ পরিবার দ্বাদশ শতাব্দীতে অযোধ্যা হতে বঙ্গে আগত ব্রাহ্মণদের বাঁড়ুয্যে পদবিধারী। পূর্বপুরুষ সংস্কৃত নাট্যকার ভট্টনারায়ণ (অষ্টম শতাব্দী)।
এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনার জন্য তার পর একখানি পুস্তকের উল্লেখ আছে। নাম আর্ষিত ফুর রাসেন উনটু গেজেলশাফটস্-বিয়োলগি অর্থাৎ আর্কাইভ ফর রেস অ্যান্ড বায়োলজি অব সোসাইটি- জাতি এবং সামাজিক জীববিদ্যার দলিল-দস্তাবেজ।
এর পর আছে, অবনীন্দ্রনাথের জীবনী, তার পর দেবেন্দ্রনাথের এবং বিস্তৃত বিবরণের জন্য তাঁর আত্মজীবনীর উল্লেখ আছে।
বর্ণানুক্রমে সাজানো বলে সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথের জীবনী। অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করে লেখক বলছেন, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তাকে যে স্যার উপাধি দেওয়া হয়, সেটা তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরে রক্তগঙ্গা (জর্মনে বুট-বাট= ব্ল-বাথ) প্রবাহিত হওয়ার পর বর্জন করেন।১ এবং সর্বশেষে যে জীবনীগুলোর উল্লেখ আছে সেটি লক্ষণীয়।
(i) H. Meyer-Benfey : Rabindranath Tagore (1921); (2) P. Notorp : Studen mit Rabindranath Tagore (1921); (3) W. Graefe : Die Weltanschauung Rabindranath Tagores (1930); (4) R. Otto : Rabindranath Tagores Bekenntnis (1931); (5) M. Winternitz : Rabindranath Tagore Religion und Weltanschauung des Dichters (Prag 1936) অতি উৎকৃষ্ট; এর বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত (লেখক) (6) Marjorle Sykes : Rabindranath Tagore (1943); (7) E. J. Thompson : Rabindranath Tagore, Poet and dramatist (1948); (8) J. C. Ghosh : Bengali Literature (1948).
পাঠশালে গুরুমশায়ের কাছে প্রথম যে চড় খেয়েছিলুম সেটা আজও ভুলিনি। স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসছে সে দৃশ্যটা কিন্তু তার কথা এখন ভাবতে গেলে কেমন যেন সদয় হাসি পায়। অথচ বার্লিনে নেমে যে চড় খেয়েছিলুম সেটা তো ভুলিনি বটেই, তদুপরি এখনও সেটা স্বপ্নে দেখি এবং এক গা ঘেমে জেগে উঠি। প্রত্যেকটি ঘটনা ঠাস ঠাস করে টাইপ রাইটারের মতো গালে চড় মেরে যায় এবং তার প্রত্যেকটি যেন মনের সাদা কাগজের উপর লাল রিবনের কালিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে।
প্রথমবারের অভিজ্ঞতা। কাবুল থেকে দেশ হয়ে বার্লিন পৌঁছেছি। কাবুলে অনেক মার খেয়ে অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু সেগুলো তো এখানে কোনও কাজে লাগবে না। বার্লিন মারাত্মক মডার্ন শহর। এখানে চলাফেরার কায়দা-কেতা একদম অজানা।
প্লাটফর্মে অসহায় আমি দাঁড়িয়ে। রবিনসন ক্রুশো নিশ্চয়ই এতখানি অসহায় অনুভব করেননি। তিনি যে ভুলই করুন না কেন, তার জন্য তাঁকে কারও কাছ থেকে চড় খেতে হবে না, জেলে যেতে হবে না। তিনি উদোম হয়ে ঘুরে বেড়ালেও কেউ কিছু বলবে না। মার্সেলেস বন্দরে রাস্তার বাঁ দিকে চলতে গিয়ে প্রথম ধমক খেয়েছি। ফরাসি মাস্টার বলে দিয়েছিলেন বটে, কন্টিনেন্টে কিপ টু দি রাইট–আমাদের দেশে খাল-বিলেও মাঝিরা চিৎকার করে একে অন্যকে তম্বি করে আপন ডা-ই-ন! কিন্তু বন্দরের ধুন্ধুমারের ভিতর কি অতশত মনে থাকে?
স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যাঁকে মার্সেলেস থেকে তার করেছিলুম, তিনি সে তার পাননি কিংবা সেগুলো আর বলে দরকার নেই। ভুক্তভোগীই জানেন, তখন সম্ভব অসম্ভব কত কারণই মনে আসে। আমি আসছি জেনে সে আত্মহত্যা করেনি তো ইস্তেক।
পোর্টারটি কিন্তু দেখলুম আমাদের কুলির মতো ঘড়ি ঘড়ি তাড়া লাগালে না। আমার সেই বিরাট মাল-বহর– পরে দেখলুম বার্লিনে তার পনেরো আনাই কাজে লাগে না ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে নির্বিকার চিত্তে পাইপ টানছে।
জর্মন ভাষা যে একেবারে জানিনে তা নয়। ঝাড়া পাঁচটি বচ্ছর উত্তম উত্তম গুরুর কাছে শান্তিনিকেতনে সে ভাষার ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করেছি। কিন্তু বার্লিনের এই জীর্ণ শীতের সঝে কোন জর্মন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিদেশির মুখে তারই মাতৃভাষার শব্দরূপ– তা-ও ভুল উচ্চারণে– শুনতে যাবে? হাওড়া স্টেশনে যদি কাবুলিওলা কোন বঙ্গসন্তানকে দাঁড় করিয়ে তার খাস কাবুলি উরুশ্চারণ সহযোগে লিটু, লঙ, আশিলিঙ শোনাতে চায় তবে অবস্থাটা হয় কী রকম?
বুদ্ধি করে ট্রেনে একটি ফরাসি-জাননেওলি মহিলাকে শুধিয়ে নিয়েছিলুম, স্টেশনে মালপত্র রাখার জায়গাটাকে জৰ্মনে কী বলে? তিনি বলেছিলেন,
Gepaeckaufbewahrungsstelle
!!!
প্রথম ভেবেছিলুম তিনি মস্করা করছেন। তাই আমি সেটা টুকে নিয়েছিলুম। মাসখানেক পরে বার্লিনে গোছগাছ করে বসার পরে শব্দটিকে হামানদিস্তে দিয়ে টুকরো টুকরো করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তার অর্থ বের করেছিলুম। উপস্থিত সেই চিরকুট টুকুন পোর্টারের হাতে দিলুম। সে একটা হুম শব্দ করে গুম গুম করে ঠেলাগাড়ি চালিয়ে এগোল। আমি মেরির লিটল ল্যামের মতো পিছনে পিছনে চললুম।
মাল সঁপে দিয়ে রাস্তায় নামলুম।
দেখিনি, কিছুই দেখিনি। রাস্তা, বাড়ি, দোকান, গাড়ি, কিছুই দেখিনি। আমি ভাবছি, যাই কোথায়?
হুদো হুদো কড়ি থাকলে কিছুটি ভাবনা নেই। ট্যাক্সি এবং হোটেল এ দুটি শব্দের প্রসাদাৎ শুটনিক সহযোগে চন্দ্রলোকে নেমে আশ্রয় মেলে। কিন্তু আমার বটুয়াতে তখন ছুঁচোর কেত্তন। স্কলারশিপের প্রথম কিস্তি না পাওয়া পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। তখনও অবশ্য জানতুম না, মাটি পেতে হলে পাথর ঢাকা বার্লিন থেকে অন্তত বারো মাইল দূরে যেতে হয়।
হঠাৎ শুনি, শুট আবেন্ট! তার পর গুড় ইভনিং, তার পর ব সোয়ার। তাকিয়ে দেখি, আমার চেয়ে দু মাথা উঁচু এক পুলিশম্যান কিংবা সেপাইও হতে পারে।
পরিষ্কার ইংরিজিতে শুধালে, আপনার কি কোনও সাহায্যের প্রয়োজন।
ম্যাট্রিক ফেল বঙ্গসন্তান দু শো টাকার চাকরি পেলেও বোধহয় অতখানি খুশি হয় না।
আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, হোটেল।
লোকটা আমুদে। চলতে চলতে বললে, এ শব্দটা তো ইন্টারন্যাশনাল। আপনি অত অসহায় বোধ করছিলেন কেন?
সত্যি কথা বলে দেব? প্রথম পরিচয়ের প্রথম জর্মনকে? বলেই ফেলি।
লোকটি দরদীও বটে। দাঁড়িয়ে বললে, সে তো অত্যন্ত স্বাভাবিক। স্টুডেন্ট মানুষ। পয়সা থাকার তো কথা নয়। তা হলে হসপিৎসে চলুন।
আমি শুধালুম, সে আবার কী?
ও! হসপিস! ওটা তো ইংরেজিতেও চলে।
হায় রে কপাল। শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ, অ্যান্ড্রজ, কলিনসের কাছ থেকে পাঁচ বছর ইংরেজি শিখেও যা জানিনে, জর্মন পুলিশ সেটাও জানে। কলকাতার ভোজপুরি পুলিশ তা হলে একদিন আমাকে আরবি শেখাবে।
হোটেলেরই মতো। তবে বার, ব্যুফে, ডান্স হল, কাবারে নেই। খাবারদাবার সাদাসিধে, ঘন্টি বাজালেই ওয়েটার আসে না। তাই সস্তা পড়ে।
অর্থাৎ হোটেল জিনিসটি দ্য লুক্স–হসপিস তারই গার্হস্থ্য সংস্করণ। ডাকবাংলো আর চট্টিতে যে তফাৎ তাই।
এতদিন পরও আমার স্পষ্ট মনে আছে লোকটি সঙ্গে যেতে যেতে তার মনের দুঃখ আমাকে বলেছিল। তার ছেলেটি ম্যাট্রিক পাস করেছে, কিন্তু পয়সার অভাব বলে কলেজে ঢুকতে পারেনি।
আমি তো অবাক। তিন-তিনটে ভাষা জানে। শিক্ষিত লোক বলেই মনে হচ্ছে। ফিটফাট ইউনিফর্ম না হয় সরকারই দিয়েছে, কিন্তু তেমন কিছু গরিব বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে কি এদেশেও গরিব লোক আছে।
বাকি কথা পরে হয়েছিল। হসপি কাছেই। পৌঁছে গিয়েছি।
পুলিশ মোকামে পৌঁছে দিল এই তো বিস্তর। কিন্তু এ লোকটি শক্ৰমিত্রে তফাৎ করে না। শত্রুর শেষ করতে হয়– শাস্ত্রে বলে– এ লোকটি মিত্রেরও শেষ ব্যবস্থা দেখে যেতে চায়। হোটেলওলার সঙ্গে আলাপচারী করে সুব্যবস্থা করে দিল। আমি ভাবলুম, এবারে বোধহয় আমার খাটের পাশে বসে ঘুমপাড়ানিয়া গান গাইবে।
যাবার সময় আমি বললুম, আপনার নাম কী?
একখানা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলে।
পুলিশম্যানেরও ভিজিটিং কার্ড!
আমি শুধালুম, এদেশের সব পুলিশই কি ইংরেজি-ফরাসি বলতে পারে?
বললে, আদপেই না। তার পর একটা ব্যাজ দেখিয়ে বললে, যাদের গায়ে এই ব্যাজ থাকে তারা একাধিক ভাষা বলতে পারে। যার ব্যাজে যতটা ফুটকি, সে ততটা ভাষা জানে। আমার ব্যাজে তিনটে।
ধন্যবাদ দেবার মতো ভাষা খুঁজে পাইনি।
পরে জানলুম, একাধিক ভাষা জাননেওলা পুলিশ বিরল– আমার কপাল ভালো যে প্রথম ধাক্কাতেই তারই একজন জুটে গিয়েছিল।
.
চাটুয্যে অতিশয় সুদর্শন পুরুষ। সুন্দর ঢেউখেলানো চুল। বর্ণটি উজ্জ্বল শ্যাম। চোখ দুটি স্বপ্নালু ঘন আঁখিপল্লব যেন অরণ্যানীর স্নিগ্ধচ্ছায়া নির্মাণ করেছে। সাধারণ বাঙালির চেয়ে কাঁধ অনেক বেশি চওড়া বুকের পাটা রীতিমতো জোরদার। কোমরটি সরু– প্রায় মেয়েদের মতো। সেই চওড়া বুক নিয়ে পাখির চলনের মধ্যে যে একটা দ্বন্দ্ব থাকত তাকে দ্বন্দ্বমধুর বলা যেতে পারে।
কিন্তু বার্লিনের ভারতীয় মহল এবং তার রায়ত-প্রজাদের ভিতর সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল তার আহনুলম্বিত দুটি মোলায়েম আকুঞ্চিত জুলপি খ্যাতিতে হিন্ডেনবুর্গের গোপের সঙ্গে এরা তাবৎ বার্লিনে পাল্লা দিত। জর্মন ভাষায় জুলপিকে বলে কাটলেট। হিন্দুস্তান হৌস রেস্তোরাঁয় চাটুয্যে খাবার কাটলেটের অর্ডার দিলে আমাদের ঠিকে বামনী রঙ করে বলত, দুটো কাটলেটের জন্য একটা কাটলেট, প্লিজ! সেই বামনী থেকে আরম্ভ করে বার্লিন সমাজের মশাইমোড়ল সবাই তাঁর নামে অজ্ঞান। চেহারা ছাড়া তার আরও দুটো কারণ ছিল। অতিশয় নম এবং স্বল্পভাষী। হাঙ্গামহুজ্জত অপচ্ছন্দ করতেন বলে দিন-যামিনীর অধিকাংশ তার কাটত হিন্দুস্তান হৌসের সুদূরতম কোণের বৃহত্তম সোফার নিবিড়তম আশ্রয়ে। ব্যসনের মধ্যে ছিল অবরে-সবরে বিপ্লবী নলিনী গুপ্তের সঙ্গে এক গেলাস অতি পানসে বিয়ার পান। এ স্থলে বলে রাখা ভালো যে, বিয়ার পান বার্লিনে ব্যসন নয়। খাঁটি খানদানি বার্লিনবাসী ভিরমি গেলেও তার গলা দিয়ে জল গলানো যায় না, এবং মৃতজনের মুখে বিয়ার পাত্র ধরলে সে চুকুস চুকুস করে দিব্য চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আর চাটুয্যে ছিলেন মি, বার্লিন নম্বর ওয়ান।
খুব যে শক্তিশালী ছিলেন তা নয়, কিন্তু পরনে সবসময়ই সুরুচিসম্মত সুট-টাই। ফরাসি মহিলাদের সঙ্গে সেদিক দিয়ে তাঁর মিল ছিল। শুনেছি, ইংরেজ রমণীর নাকি ক্ষোভ, ফরাসিনী কী করে এত অল্প খরচে এত সুন্দর জামাকাপড় পরে। কাঁচা বউ যে রকম পাকা শাশুড়ির কম তেল-ঘিয়ে রান্না করা দেখে অবাক হয়।
তিনি ছিলেন ভারতীয় সমাজের বেসরকারি অনারারি পাবলিক রিলেশন অফিসার। তার অতিশয় অনিচ্ছাতে এ কর্ম স্কন্ধে এসে পড়েছিল বলে হিন্দুস্তান হৌসের টেলিফোন বাজলে তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাত নেড়ে যে ফোনের কাছে বসে আছে তাকে বোঝাতেন যে তিনি অনুপস্থিত। অবশ্য বামাকণ্ঠ হলে শিভালরির খাতিরে মাঝে-মধ্যে ব্যত্যয় করা হত।
সোফার হাতায় ডান হাত ঠেস দিয়ে তারই উপর গাল রেখে দিনরাত চিন্তা করতেন। কী চিন্তা করতেন জানিনে– খোঁচাখুঁচি করেও বের করতে পারিনি।
হোটেলে বায়স-নিদ্রায় যামিনীযাপন করে পরদিন বেরোলুম বন্ধুর সন্ধানে। সে ঠিকানায় তিনি নেই। তার পর কলকাতার হিসেবে বলতে গেলে কখনও শেয়ালদা, কখনও আলিপুর, কখনও হাতিবাগান, কখনও টালিগঞ্জ করে করে বুঝলুম, বন্ধুর যে ঠিকানা আমার কাছে ছিল, সেটা অন্তত এক বছরের পুরনো এবং ইতোমধ্যে তিনি প্রায় প্রতি মাসে বাড়ি বদল করেছেন। পাওনাদারের ভীতি তাঁর নেই, তবে যে কেন তিনি এই বার্লিন প্রদেশটার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি চষেছেন পরে তাকে জিগ্যেস করেও জানতে পাইনি। ইতোমধ্যে আমি ভুল বাসে উঠে, ভুল জায়গায় নেমে, ট্রামের নম্বরের সঙ্গে বাসের নম্বর ঘুলিয়ে ফেলে, বিরাট বিরাট বাড়ির আগাপাশতলা ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে শীতে জবুথবু হয়ে কঁকাতে কঁকাতে যখন নিতান্তই একটা বাড়ির সিঁড়িতে ভেঙে পড়লুম, তখন সন্ধান পেলুম সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মশায়ের। তিনি নিয়ে গেলেন চাটুয্যের কাছে।
সেই শীতে আমি যেন মাঘের পানাপুকুরে চুবুনি খেয়ে দেখি সমুখের আঙিনায় খড়ের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এক লহমায় সর্বাঙ্গ ওমে এলিয়ে পড়ল। দু লহমায় কুল্লে সমস্যার সমাধান হল। সাধে কি রাঢ়ভূমি বলে, মুখুয্যে কুটিল অতি, বন্দ্যো বটে সাদা, তার মাঝে বসে আছে চট্টেী মহারাজা!
পাঠান্তর প্রক্ষিপ্ত।*[* তুলনার জন্য সুশীল দের বাংলা প্রবাদ নং ২৮৬০ ও ৬৮২৩ দ্রষ্টব্য।]
আমাদের বটতলাতে বই বিক্রি হয়, কলকাতা-মাদ্রাসা অঞ্চলের নাম তালতলা। সেখানে আরবি, ফারসি, উর্দু বই বিক্রি হয়। এখানে লিভেনতলাতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়। লিভেন মানে ইংরিজিতে লাইম, কিন্তু সে লাইম আমাদের নেবু নয়, তাহলে ওটাকে স্বচ্ছন্দে নেবুতলা বলা যেত। বাঙালিরা তৎসত্ত্বেও বলত।
আমাদের দেশ গরম। সেখানে না হয় পণ্ডিতমশাই অক্লেশে ক্লাস বসান। তারও বহু পূর্বে আরণ্যক হয়ে গিয়েছে। অরণ্যে পাঠ্য ব্রাহ্মণের অংশবিশেষ। কিন্তু শীতের দেশে গাছতলাতে ক্লাস বসবে কী করে? নেবুতলা নাম তা হলে নিতান্তই কাকতালীয়। যেমন বেনেরা বটগাছতলায় বসত বলে ফিরিঙ্গিরা বটগাছের নাম দিল বানয়ান ট্রি।
হিটলার যখন তার হাজার বছরের জন্য রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে তার রাজধানী বার্লিন শহরের সংস্কার আরম্ভ করলেন, তখন প্রথমেই হুকুম দিলেন লিন্ডেন বা লাইমগাছগুলো কেটে ফেলতে। শত্রুপক্ষ রটালে, ইনি আবার আর্টিস্ট! আসলে কিন্তু তার দোষ নেই; গাছগুলো তখন অত্যন্ত বৃদ্ধ জরাজীর্ণ। সেগুলো কাটার ফলে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো বড্ড ক্যাটক্যাট করে চোখে পড়ল শত্রু-মিত্র-নিরপেক্ষ সবাই মিলে রাস্তাটার নতুন নামকরণ করলে উনটার ডেন লাটের্নে অর্থাৎ লণ্ঠনতলা! পরে অবশ্য হিটলার তামাম জর্মনি খুঁজে সবচেয়ে সেরা লিন্ডেন চারা সেখানে পুঁতেছিলেন।
.
দুশো বছরের পুরনো খানদানি রাজপথ। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় এক মাইল অবধি গিয়ে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট। বিরাট সুউচ্চ সেই তোরণের উপর রথাসহ বিজয়িনী বা ভিক্টোরিয়ার (ইংলন্ডের রানি না) ব্রোঞ্জ প্রতিমূর্তি। হিটলার এ রাস্তা বাড়িয়ে দিয়ে শার্লটেনবুর্গ পেরিয়ে বহুদূর অবধি টেনে নিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন ইস্ট-ওয়েস্ট একসিস! তাঁর আত্মহত্যা করার কয়েক দিন পূর্বে এ রাস্তায় যান চলাচল যখন প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ তখন তাকে সাহায্য করার জন্য এখানে উড়োজাহাজ পর্যন্ত একাধিকবার ওঠা-নামা করেছিল। এ্যারপোর্টগুলো তখন মিত্রশক্তির কজাতে চলে গিয়েছে বলে যারা বিশ্বাস করেন। হিটলারের পালাবার কোনও উপায় ছিল না, তাঁদের বিরুদ্ধে অন্যপক্ষ এই ইস্ট-ওয়েস্ট একসিস দেখিয়ে দেন। আজ অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে এ রাস্তার পূর্বার্ধ রাশার হাতে, পশ্চিমার্ধ মিত্রশক্তির। কিন্তু সে সব অনেক পরের কথা।
এ রাস্তায় দ্রুত জীবনের চরম গতিবেগের সঙ্গে শান্ত গ্রাম্য জীবনের সুষুপ্তির অদ্ভুত সমন্বয়। দু দিকে যান চলাচলের রাস্তা; মাঝখানে লাইমগাছের বিস্তীর্ণ এভিন চলেছে তো চলেছে, তার যেন শেষ নেই। এদিকে পেভমেন্টের উপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে একাধিক লোক, বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, স্টপেজে ওটাতে চাপবে বলে, আর এদিকে এভিন্যুর উপর দিয়ে মা চলেছেন পেরাম্বুলেটর ঠেলে ঠেলে সপ্তপদী চলার গতিতে। দশ কদম যেতে না যেতে বসে পড়ছেন হেলানদার বেঞ্চিতে। সেখানে পেনশনার চোখ বন্ধ করে পাইপ টানছেন, যুদ্ধে বিকলাঙ্গ বেঞ্চির গায়ে ক্রাচ খাড়া করে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে, এ-বাড়ির আয়া ও-পাড়ার রুটিওলার সঙ্গে রসালাপ করছে, আর বেঞ্চির হেলানে মাথা দিয়ে হেথাহোথা সর্বত্র ঘুমুচ্ছে অনেক লোক। এক বেঞ্চিতে দুটি কলেজের ছোকরা মৃদুকণ্ঠে আলোচনা করছে। আরেক বেঞ্চে একজন আরেকজনের পড়া নিচ্ছে।
দুই সারি বেঞ্চির মাঝখান দিয়ে স্কিপ করতে করতে চলে যাচ্ছে একটি মেয়ে। পিছনে ঠাকুরদা চলেছেন ভ্যামটার চেয়েও মন্দ গতিতে। মেয়েটি উই– ওখানে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কিপ করছে; ঠাকুরদা গতিবেগ বাড়াবার প্রয়োজন বোধ করছেন না।
এরই এক পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়।
বেশি পুরনো দিনের নয়। একশো বছরের একটু বেশি। এর চেয়ে ঢের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় জর্মনিতে আছে। আসলে বার্লিন খুব সম্ভ্রান্ত শহর নয়। সে বাবদে রোম, প্যারিস, ভিয়েনা এমনকি প্রাগ;– যারা দেখেছেন তারা ইস্তাম্বুলেরও নাম করেন। বার্লিন অনেকটা লন্ডনের মতো; বেশিরভাগ জিনিসই নকল। তবে কি না বিজ্ঞান এ যুগের কামনার ধন। সেখানে বার্লিনের নাম আছে, আর আছে জর্মনির রাজধানীরূপে। তারই প্রায় কেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত বলে ব্যবসা-বাণিজ্য এখানে প্রচুর। টোকিও না ওঠা পর্যন্ত বার্লিন পৃথিবীর তৃতীয় নগরী ছিল।
য়ুনিভার্সিটির সামনেই প্রতিষ্ঠাতা ভিলহেলম ফন হুমবল্টের প্রতিমূর্তি। গ্যোটের বিশিষ্ট বন্ধু।
হায়, সে সত্যযুগ গিয়েছে।
ভারতবর্ষ, গ্রিস, আরব ভূখণ্ডে একদা জ্ঞানী বললে বোঝাত সর্বজ্ঞানে জ্ঞানী। সর্ববিষয়ে সমান জ্ঞান থাকবে এমন কোনও কথা ছিল না, কিন্তু সর্ব জ্ঞানভাণ্ডার থেকে অল্পবিস্তর সঞ্চয় করে যিনি অখণ্ড সর্বাঙ্গসুন্দর বিশ্বদর্শনে উপনীত হতে পারতেন তাকেই বলা হত পণ্ডিত। এ তিন ভূখণ্ডে পাঠ্যনির্ঘণ্ট দেখলেই বোঝা যায়, আদর্শ ছিল মানবজীবনে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য পরিপূর্ণ জ্ঞানের সন্ধান। একদিকে আয়ুর্বেদ অন্যদিকে যোগশাস্ত্র, একদিকে ব্যাকরণ অন্যদিকে অলঙ্কার, একদিকে রসায়ন অন্য দিকে দর্শন, সঙ্গে সঙ্গে কাব্যের প্রতি স্পর্শকাতরতা, নাট্যে প্রীতি, কৌটিল্যের কুটিলতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়, বসন্তসেনার নৃত্যগীতসঙ্গীতের সম্মুখে সহৃদয় বিস্ময়।
বস্তুত, এ সবই বাহ্য। কিন্তু এদের সন্নিবেশের মাধ্যমে কোনও গুণী হঠাৎ পেয়ে যান অনির্বচনীয়ের সন্ধান। সে সন্ধান ভূয়োদর্শনের, ভূমানন্দের।
সবাই পেত তা নয়, কিন্তু না পেলেও তারা সাধকসমাজে সম্মানিত হতেন। সর্ববিষয়ে তাঁদের সহানুভূতি থাকত বলে তারা প্রাজ্ঞসমাজের পৃষ্ঠপোষক বলে খ্যাত হতেন। জর্মনিতে এ স্বর্ণযুগ আসে অষ্টাদশ শতকের শেষে ও ঊনবিংশ শতকের প্রারম্ভে। তার অন্যতম প্রতীক ভিলহেলম ফন হুমবন্ট।
আসলে ইনি কবি এবং আলঙ্কারিক রসশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রামাণিক পুস্তক এবং গ্যোটের কাব্যালোচনা নিয়ে তিনি নামলেন আসরে। কিন্তু অল্পকাল যেতে-না-যেতেই তাঁর রাজনৈতিক প্রাখর্য ধরা পড়তেই তাঁকে ডাকা হল রাজসভায়। ওদিকে তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করতেন–সর্বোচ্চ আদর্শ বলে ধরে তুলেছিলেন মানবচরিত্রের স্বাধীন এবং সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সেই আদর্শ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তাই তিনি আজ ভিয়েনা কাল লন্ডনের রাজদরবারে যেতেন, কিংবা পরশু বার্লিনের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে কাজ করে গেলেন। ওই সময়েই তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে স্পেনের বাসদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করে দেখিয়ে দিলেন যে ভাষার মূলে ব্যাকরণ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ভাষার কাঠামো ভালো করে পরীক্ষা করলে পাওয়া যায় সে ভাষা-ভাষীর পরিপূর্ণ ইতিহাস। যে কোনও সমাজের সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস লুকনো থাকে তার ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের মাঝখানে। তাই এক সমাজ যেমন অন্য সমাজ থেকে ভিন্ন ঠিক তেমনি এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে। মূলে এক সমাজ হলেও তারা যদি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, তবে তাদের ভিন্ন ভিন্ন বিবর্তন তাদের আপন আপন ভাষাতে প্রতিবিম্বিত হয়।
সেই সূত্রে তিনি উপনীত হলেন চরম মীমাংসায় মানুষের মননবৃত্তির শ্রেষ্ঠতম বিকাশ হয়েছে আর্য ভাষায়। মানব দেবতাত্মার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় তার বাঙময় ভুবনে।
ভিলহেলম্ ফন হুমবল্ট ভাষাতত্ত্বের সর্বপ্রথম দার্শনিক।
তাঁর অনুজ আলেক্সান্ডার ফন হুমবল্টের পরিচয় দেওয়া আরও কঠিন। সে যুগের গুণীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, নেপোলিয়ানের পরেই খ্যাতিতে এর স্থান। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন শাখা-প্রশাখা ছিল না যাতে তিনি বিচরণ করেননি। এদিকে ভূতত্ত্ব-উদ্ভিদতত্ত্ব, ওদিকে উত্তর মেরু থেকে আরম্ভ করে বিষুবরেখা অবধি চুম্বকের আকর্ষণশক্তি-বিবর্তন, মহাকাশে উল্কাপিণ্ডে বিশেষ দিনে প্রবলতর বর্ষণ–বিজ্ঞানের একাধিক নবীন ক্ষেত্র তিনি আবিষ্কার করলেন। মহাপুরুষ মুহম্মদ বলেছিলেন, জ্ঞানের সন্ধানে যদি বেরুতে হয় তবে চীনেও যেয়ো। আরবদের কাছে চীনই সবচেয়ে দূরের দেশ। এ মনীষী জর্মনি থেকে চীন, ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিছুই বাদ দেননি। ষাট বছর বয়সে মানুষ যখন খ্যাতির মুকুট পরে সহাস্যবদনে জনগণের করতালিধ্বনি.শোনে, তখন হঠাৎ অর্থানুকূল্য পেয়ে বেরুলেন রাশিয়া ভ্রমণে আবিষ্কার করলেন উরালে হীরকচিহ্ন। অথচ প্রথম যৌবনে প্রকাশিত তাঁর দার্শনিক রহস্যতত্ত্ব ও মাংসপেশির স্নায়ু সম্বন্ধে রচনা তখনই পণ্ডিতমণ্ডলীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল।
তার কসমস বা সৃষ্টি এখনও আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে পড়া যায়। এ ধরনের বই আজকাল আর লেখা হয় না। প্রাচীন দার্শনিক জ্ঞান ও সনাতন রসতত্ত্ব তিনি মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সে যুগের নববিকশিত বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এমন এক সংমিশ্রণে যাতে করে বিজ্ঞানের ক্ষুদ্রতম বিচ্ছিন্ন জ্ঞানবিন্দু ভূয়োদর্শনের অসীম সিন্ধুতে স্থান পায়। পক্ষান্তরে দার্শনিকের কল্পনাবিলাসের ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা যেন বাস্তবের ধূলিকণাকে অবহেলা না করে।
তাই বোধহয় নগণ্যজনের দৈন্য-দুর্দশা সম্বন্ধে তিনি যৌবনপ্রারম্ভেই সচেতন হন। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি দেখে উদ্ধত তার প্রতিবাদ জানিয়ে যে সংস্কারকর্ম আরম্ভ করলেন সে কথা আজও জর্মনি ভোলেনি। পরবর্তীকালে দাসপ্রথার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়। তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন এই যুগধর্মসম্মত প্রথার বিরুদ্ধে। এবং আজীবন তাঁর সাধনার মার্গ বর্জন না করে।
তাই যখন কৃতজ্ঞ জর্মনগণ বিত্তহীন জ্ঞানার্থীর জন্য ব্রহ্মোত্তর বা ওয়াফ অর্থাৎ ট্রাস নির্মাণ করল তখন সেটিকে উৎসর্গ করা হল তাঁরই নামে আলেকজান্ডার ফন হবল্ট স্টিফটুঙ। দেশে-বিদেশে এটি সুপরিচিত।
এদেশে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে এই ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ইনি এঁদের জীবনী ও কার্যকলাপের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন।
সে সত্যযুগ গেছে। মহাকবি গ্যোটেকে গুরুত্বে বরণ করে তাঁর চতুর্দিকে যে কেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর কোথাও হয়নি। শ্লেগেল, ফিষটে, শিলার, হুমবল্ট ভ্রাতৃদ্বয়, একেরমান ইত্যাদি ইত্যাদি বহু পণ্ডিত, গবেষক, কবি তাঁদের জীবন-বাতায়ন উন্মুক্ত করে পূর্ব-পশ্চিমের জ্ঞান-দর্শন, ঊর্ধ্ব-অধেঃর বিজ্ঞান-বিশ্লেষণকে যে আবাহন করেছিলেন, তারই ফলে জর্মনির যে সর্বমুখী বিকাশ হল আজও সে বিশ্বজনের বিস্ময়।
লোকে শুধায়, যে জর্মনি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পদদলিত, নিঃস্ব, আজ সে বিশ্বের উত্তমর্ণ হল কী প্রকারে?
এর বুনিয়াদ বড় দড়।
.
জীবনে সেই তিনটি সপ্তাহ কী করে কেটেছে তার বর্ণনা দেবার শক্তি আমার নেই। যেন পাহাড়ের চূড়ায় হঠাৎ কুয়াশা নামল। হাতড়ে হাতড়ে আমি এদিক যাচ্ছি ওদিক যাচ্ছি আর দুঃস্বপ্নের বিভীষিকা দেখছি; হঠাৎ পায়ের তলায় শক্ত জমি খসে পড়েছে আর আমি সর্বনাশের অতল গভীরে বিলীন হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছি। এবারে ভাষা-পরীক্ষার শক্ত জমিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব কটা হাড়হাড়ি গুঁড়িয়ে যাবে।
ভাষা-পরীক্ষাটা কী?
চাটুয্যে নিয়ে গেছেন ড. গ্যোপেলের কাছে। বলে রাখা ভালো, ইনি হিটলারের প্রোপাগান্ডা-মাস্টার ড. গ্যোবেলস্ নন। হুমবল্ট ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি। অতিশয় নিরীহ লোক। ততোধিক সাদাসিধে জামাকাপড় যতদূর সস্তা হতে পারে। মোটাসোটা মানুষ এবং হাসি হাসি মুখ। মিষ্টি সুরে এত নিচু গলায় কথা কন যে, টেবিলের এপারে এসে পৌঁছয় না। দেশে থাকতে এর সঙ্গেই পত্রালাপ ছিল। ইনিই প্রাঞ্জল জর্মনে জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিট তৈরি; আমি এলেই হল। এখন বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ সেই মিষ্টি গলাতেই বললেন, অবশ্য একটা অত্যন্ত সরল মামুলি পরীক্ষা দিতে হবে যে, কলেজের লেকচার বোঝার মতো জর্মন ভাষায় ক খ গ ঘ আপনি জানেন।
বলে কী! পরীক্ষা দেব কী করে? ফেল মারব নিশ্চিত। পড়তে পারি– খানিকটা। কিন্তু কেউ কথা বললে সেটা বুঝতে তো পারিনে। না হলে চাটুয্যেকে দোভাষী বানিয়ে আনব কেন।
আর এত বড় বিদকুটে ব্যবস্থা! পড়াশুনোর পর পরীক্ষা দিতে রাজি আছি, কিন্তু এখানে বুঝি আগে পরীক্ষা, তার পর লেখাপড়ি আগে ফাঁসি তার পর বিচার। হটেনটটের রাজত্বেও তো এ রকম ধারা হয় না। হ্যাঁ, দার্শনিক শোপেনহাওয়ার নামকরা জর্মন লেখকদের ভাষাতে ব্যাকরণের ভুল দেখে একবার বলেছিলেন, শুধু জর্মন আর হটেনটটরাই আপন মাতৃভাষা নিয়ে এরকম ছিনিমিনি খেলে।
আমাদের রঙ কালো বলে মুখের ভাব পরিবর্তন ইয়োরোপীয়রা চট করে ধরতে পারে না। তাই তারা বলে, আমরা দুয়ে, অবোধ্য। আমার চেহারা কিন্তু তখন এমনি ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছে, শুকনো গলাতালু থেকে এমনি চেরা বাঁশের শব্দে আওয়াজ বেরুচ্ছে যে, ভালো মানুষ ড. গ্যোপেল পর্যন্ত সেটা লক্ষ করে আমাকে দিলাশা-সান্ত্বনা দিতে আরম্ভ করেছেন। পরীক্ষাটা নাকি একেবারে কিসসুটি নয়, ছেলেখেলা, এলিমেন্টারি, ছ মাসের কোর্স, এখনও তিন সপ্তাহ রয়েছে, এন্তের সময় পড়ে আছে।
মানে?
অর্থাৎ বিদেশিদের জন্য জর্মন ভাষার ক্লাস হয়। ছ মাসের কোর্স। আর তিন সপ্তাহ বাদে পরীক্ষা। আপনি কাল থেকে ঢুকে যান– সব ঠিক হয়ে যাবে।
অর্থাৎ ছ মাসের কোর্স আমাকে তিন হপ্তায় শেষ করতে হবে। ওহ! কী সুখবর।
কিন্তু আমি আপত্তি জানাই কী করে? বৃত্তির জন্য দরখাস্ত পেশ করার সময় কবুল জানিয়েছি যে, আমি জর্মন জানি, প্রোফেসারের সার্টিফিকেটও সঙ্গে ছিল। এখন সেগুলো রদবদল করি কী প্রকারে?
গ্যোপেল মিষ্টি গলায় হাসিমুখে আমাকে আরও অনেক সান্ত্বনা দিলেন তার অল্প অল্প বুঝলুম। বাকিটা চাটুয্যে অনুবাদ করে দিলেন।
তার প্রত্যেকটি সান্ত্বনা-বচন আমার সর্বাঙ্গ কণ্টকিত করল। এ যেন ফাঁসির আসামিকে বলা হচ্ছে, দড়িটাকে মাখন মাখিয়ে মোলায়েম করা হয়েছে, যে টুলে দাঁড়াবে সেটা মখমলে মোড়া!
সায়েবের কথার ফাঁকে এটাও বেরিয়ে গেল যে, পরীক্ষায় ফেল মারলে ভর্তি হতে পারব না। আবার ভর্তি হওয়ার পালা ছ মাস পরে অর্থাৎ আমার জর্মন-বাসের শেষের ছ মাস কাটবে বিনা বৃত্তিতে অনাহারী। সায়েব সেটা অবশ্য বলেননি তিনি পইপই করে বোঝাচ্ছিলেন, ও পরীক্ষাতে ফেল মারে শতকরা একজন। কিন্তু সে একজন যে আমি হব না, তিনি জানেন কী করে? লটারিতে হই না, সে আমি জানি।
আরবি ভাষায় বলে, আকাশে দু খানা চাপাতি। একটি ঠাণ্ডা, আরেকটি গরম। চন্দ্র আর সূর্য।
রাস্তায় যখন বেরোলুম তখন দুপুর। সূর্যটিও তখন আমার কাছে ঠাণ্ডা চাপাতি বলে মনে হল।
তাই বলছিলুম, ভাষা-পরীক্ষার শক্ত জমিতে পড়ে হাড়-হাড্ডি চুরমার না হওয়া পর্যন্ত এখন শুধু হুশহুশ করে নিচের দিকে পতন।
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে ক্রসিঙে ক্রসিঙে ট্রাফিক পুলিশম্যান রাখা উচিত। আমি ঢুকেছিলুম দু পিরিয়ডের মাঝখানে ক্লাস বদলাবদলির সময়। করিডরে করিডরে আপন ডাইন রেখে তরুণ-তরুণীর জনস্রোত উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম পানে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রসিঙে এসে লেগে যাচ্ছে ধুন্ধুমার। ঠিক ওই সময়ই হয়তো খুলে গেল তারই পাশের বিরাট হলের দরজা। তার থেকে বেরুবার চেষ্টা করছে আরও শ-দুই ছাত্রছাত্রী। তখন লেগে যায় সত্যিকার হরিনট। সবই আবার চলতে চলতে ধাক্কা খেয়ে এদিক-ওদিক ঠিকরে পড়ে তর্ক চালাচ্ছে নিজেদের মধ্যে এখখুনি ক্লাসে অধ্যাপক যা পড়িয়েছেন তারই বিষয়বস্তু।
কিন্তু এত তাড়া কিসের। পরে শুনলুম এবং দেখলুমও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা এবং তার অনুপাতেরও বেশি ছাত্রীসংখ্যা এত মারাত্মক রকমের বেড়ে গিয়েছে যে, এখন আর ক্লাসে জায়গা হয় না। আগে না গেলে রক্ষে নেই।
রোল কল এদেশে নেই। শুনে বঙ্গসন্তান আমি বড়ই উল্লাস বোধ করেছিলুম। গাইড বুক নিশ্চয়ই আছে। তাই মুখস্থ করে ঠিক পরীক্ষা পাস করে যাব– অবশ্য ভাষা-পরীক্ষা নয়, ফাইনালটার কথা হচ্ছে। তখন শুনলুম, গাইড বুক নেই, অধ্যাপকরা বই লেখেন, সেগুলো পড়তে হয়। তা হলে ক্লাসে যাবার কী প্রয়োজন? বিস্তর বই প্রকাশিত হওয়ার পরও অধ্যাপকরা যেসব গবেষণা করেছেন সেগুলো বলেন ক্লাস লেকচারে। পরীক্ষার সময় প্রশ্ন করেন তার থেকে। তার উত্তর না দিতে পারলে ভালো নম্বর পাওয়া যায় না শুধুমাত্র বইয়ের জোরে মেরে-কেটে পাসনম্বর পাওয়া যায় মাত্র।
এসব পরের কথা।
এ জলতরঙ্গ ভেদ করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্পূর্ণ অসম্ভব বুঝতে পেরে আমি মোকা পেয়ে একটা ফাঁকা ক্লাসে ঢুকে পড়লুম। খানিকক্ষণ পরে ঘণ্টা পড়ল, নেক্সট পিরিয়ডের। করিডরগুলো মরুভূমির মতো খা খা করতে লাগল।
দেশে থাকতে কত রকম কথাই না শুনেছিলুম– জর্মনি পণ্ডিতের দেশ, সেখানকার সবাই ইংরেজি জানে। রাস্তা সোনা-মোড়া। গাঁয়ের লোক যে রকম ভাবে, শ্যালদায় পৌঁছলেই তার জন্যে হুদো হুদো চাকরি অপিক্ষে করে বসে আছে।
অনেক কষ্টে বিদেশিদের প্রতিষ্ঠানটি আবিষ্কার করলুম। আশা করেছিলুম, বিদেশিদের নিয়ে এদের যখন কারবার তখন অন্তত এরা ইংরেজি বলতে পারবে। পারে, তবে আমি যতখানি জর্মন পারি তার চেয়েও কম।
বুঝলুম, বিদেশি রাজত্ব না হওয়া পর্যন্ত কোনও দেশের লোক ব্যাপকভাবে বিদেশি ভাষা শেখে না। আমরা এককালে ফারসি শিখেছিলুম; তার পর ইংরেজি শিখলুম।
মনকে সান্ত্বনা দিলুম, এরা সবাই ইংরেজি বলতে পারলে আমার আর জর্মন শেখা হত না।
ইতোমধ্যে এক সুপুরুষ কাউন্টারে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। ওঁকে দেখেই যে মহিলাটি আমার তদারক করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি খুশিভরা মুখে অনর্গল জর্মন বলে যেতে লাগলেন। বার বার প্রফেসর কথাটা আসছিল বলে অনুমান করলুম, ইনি আমাকে জর্মন শেখাবেন। আমিও খুশিমনে ভাবলুম, এবারে আমার ভাঙা নৌকা কূল পেল। একে। আমার হৃদয়বেদনা সমুচিত ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারব।
ইয়াল্লা। ইনিও তদ্বৎ। পরে জানলুম, পাছে তার ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই আপন আপন মাতৃভাষায় তার সঙ্গে কথা বলে বলে জর্মন অবহেলা করে তাই তিনি একাধিক ভাষা জানা সত্ত্বেও জর্মন ভিন্ন অন্য ভাষা বলেন না।
নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ভাঙা নৌকাটা দ-য়ের দিকে ঠেলে দিয়ে অতল জলে ডুব দিলুম। মা গঙ্গাই জানেন, বস্ত্র নেই– গামছাখানা পর্যন্ত গেছে। মনকে ধমক দিয়ে বললুম, ইংরেজির প্রতি তোমার এত দরদ কেন? ওটা কি তোমার বোনপোর ভাষা? জর্মন কি সতীনের ভাষা? ব্যস, হয়েছে, আর মুক্তোবনে বেনা বোনবার প্রয়োজন নেই।
প্রফেসর আদর করে প্রায় হাতে ধরে ক্লাসের দিকে নিয়ে চললেন। আবার চতুর্দিকে জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ। এবারে কিন্তু ভয় নেই। প্রফেসর কাণ্ডারী। ইনি যদি এ দরিয়ায় আমাকে না বাঁচাতে পারেন তবে ব্যাকরণ পারাবারের কুমির-হাঙ্গর কৃৎ-তুদ্ধিতের পুচ্ছ-দন্ত থেকে পরিত্রাণ করে ভাষা-পরীক্ষার ওপারে নিয়ে যাবেন কী করে? সেই পাদ্রি সায়েবের গল্প মনে পড়ল। বদলি হয়ে এসে অচেনা গ্রামে নেমেছেন। রাস্তায় দুটি ছেলেকে জিগ্যেস করলেন গাঁয়ের গির্জের পথ।
তারা বাতলে দিলে তিনি খুশি হয়ে বললেন, আজ তোমরা আমাকে গাঁয়ের পথ বাতলে দিলে; আসছে রবিবারে যদি গির্জেয় আস তবে স্বর্গে যাওয়ার পথ আমি তোমাকে বাতলে দেব!
তখন একটা ছেলে অন্য ছেলেটার পাজরে খোঁচা মেরে বললে, শুনলি? গাঁয়ের পথ জানে না- সে বাতলে দেবে স্বর্গে যাবার পথ।
উপস্থিত দেখলুম, জর্মনি দেশের আমার প্রথম গুরু অন্তত গাঁয়ের পথটা জানেন।
সে কী ক্লাস! চীনেম্যান থেকে আরম্ভ করে নিগ্রো পর্যন্ত। ঢের ঢের চিড়িয়াখানা দেখছি, কিন্তু এ রকম তাজ্জব চিড়িয়াখানা পূর্বে দেখিনি, পরেও দেখিনি। এরা যদি কোট-পাতলুন না পরে আপন আপন দেশের পোশাক পরত তা হলে অনায়াসে পৃথিবীর যে কোনও ফ্যানসি ড্রেস, কম বলকে হারাতে পারত। দুনিয়ার চিড়িয়া জড়ো হয়েছে জর্মন বুলি শিখে, এদেশের এলেম রপ্ত করে দেশে ফিরে নয়ি তালিমের ছয়লাপ বইয়ে দেবার জন্য। আর বয়েসেরই-বা কত রকমফের! আঠার থেকে চল্লিশ অবধি ছেলেবুড়ো, মেয়ে-মন্দ।
আমরা যখন ক্লাসে ঢুকলুম তখন একটি আঠার-উনিশের খাপসুরৎ চিংড়ি প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশের রগে-পাক-ধরা চুলের চীনা ভদ্রলোককে ব্লাকবোর্ডের উপর কী একটা ধাঁধা বোঝাতে গিয়ে খিলখিল করে হাসছে, আর চীনা প্রৌঢ়টি গাম্ভীর্যের স্মিতহাস্যের সঙ্গে বোকা বনে যাওয়ার ভাবটা মিশিয়ে ঘন ঘন সামনে পিছনে দুলে দুলে দু ভাঁজ হচ্ছেন– ভদ্রতা আর ধন্যবাদ জানাতে হলে চীনারা যে রকম কাওটাও করে।
প্রফেসর হেসে বললেন, চলুক। আমি বাধা দিতে চাইনে। ধাঁধাটা কী?
চিংড়ি আড়াই লফে ডেসকে পৌঁছে তারই উপর মোলায়েমসে বা হাত রেখে অর্ধ লক্ষের আধা চক্কর খেয়ে ডেসক টপকে গুপুস করে বসে পড়ল আপন সিটে। আমি শুধু দেখতে পেলুম, একগাদা বাদামি-সোনালি মেশা ঢেউখেলানো চুল আর বেগুনি হলদেতে ডোরাকাটা ঘাগরার ঘূর্ণি।
ক্লাসের লটবর– পরে জানলুম গ্রিক বললে শাবাশ!
.