মুসলিম সাহিত্য-সমাজের দশম বার্ষিক অধিবেশনে আমাকে আপনারা সভাপতি নির্বাচন করেছেন।ছেন মুসলিম সাহিত্য-সমাজ, তথাপি এই নির্বাচনের মধ্যে একটি পরম ঔদার্য আছে। আমি হিন্দু অথবা মুসলমান সমাজের অন্তর্গত ,আমি বহুদেবতাবাদী অথবা একেশ্বরবাদী এ প্রশ্ন আপনারা করেন নি। শুধু ভেবেছেন—আমি বাঙ্গালী, বঙ্গ-সাহিত্যের সেবায় প্রাচীন হয়েছি। অতএব, সাহিত্যিক দরবারে আমারও একটি স্থান আছে। সেই স্থানটি অকুণ্ঠচিত্তে আমাকে দিয়েছেন। আমিও আনন্দে সকৃতজ্ঞ মনে সেই দান গ্রহণ করেছি। ভাবি, সকল বিষয়েই আজ যদি এমনি হতে পারত! যে গুণী, যে মহৎ, যে বড়—সে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, কৃশ্চান হোক, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য যা-ই হোক, স্বচ্ছন্দে সবিনয়ে তাঁর যোগ্য আসন তাঁকে দিতে পারতাম। সংশয়-দ্বিধা কোথাও কণ্টক রোপণ করতে পারতো না। কিন্তু যাক সে কথা। আমি পূর্বে একটি পত্রে বলেছিলাম, সাহিত্যের তত্ত্ব-বিচার অনেক হয়ে গেছে। অনেক মনীষী, অনেক রসিক, অনেক অধিকারী বহুবার এর সীমানা এবং স্বরূপ নির্দেশ করে দিয়েছেন, সে আলোচনা আর প্রবর্তন করার আমার রুচি নেই। আমি বলি সাহিত্য-সম্মিলন প্রবন্ধপাঠের জন্য নয়, সুতীক্ষ্ণ সমালোচনায় কাউকে ধরাশায়ী করার জন্য নয়, কে কত অক্ষম উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করার জন্য নয়, যে যা লিখেছে তার চেয়ে ভাল কেন লেখেনি, এ কৈফিয়ত আদায়ের জন্য নয়, এ শুধু সাহিত্যিকে সাহিত্যিকে মিলনক্ষেত্র। এর আয়োজন একের সঙ্গে অপরের ভাব-বিনিময় ও সম্যক পরিচয়ের জন্য। আমার মনে পড়ে, বয়স যখন অল্প ছিল, এ ব্রতে যখন নূতন ব্রতী, তখন আমন্ত্রণ পেয়েও কত সাহিত্য-সভায় দ্বিধায় সঙ্কোচে উপস্থিত হতে পারিনি, নিশ্চিত জানতাম সভাপতির সুদীর্ঘ অভিভাষণের একটা অংশ আমার জন্য নির্দিষ্ট আছেই। কখনও নাম দিয়ে, কখনও না দিয়ে। বক্তব্য অতি সরল। আমার লেখায় দেশ দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ হয়ে এলো এবং সনাতন হিন্দুসমাজ জাহান্নামে গেল বলে। যাবার আশঙ্কা ছিল, অসহিষ্ণু হয়ে যদি নজির দিয়ে আমি তার জবাব দিতাম। কিন্তু সে অপকর্ম কোনদিন করিনি—ভাবতাম, আমার সাহিত্য-রচনা যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, একদিন না একদিন লোকে বুঝবেই। যাই হোক, যে দুঃখ নিজে ভোগ করেছি, সে আর পরকে দিতে চাইনে। তবে অকপটে বলতে পারি, আমার অভিভাষণ শুনে সাহিত্যিক বিজ্ঞতা আপনাদের এক তিলও বাড়বে না, এবং বাড়বেই না যখন জানি, তখন কতকগুলো বাহুল্য কথার অবতারণা করি কেন? এইখানেই শেষ করলেই ত হত। হত না তা নয়, তবে নিজেই নাকি কথাটা একদিন তুলেছিলাম, তাই তারই সূত্র ধরে এই সম্মিলনে আরও গোটা-কয়েক কথা বলবার লোভ হয়।
একদিন আমার কলকাতার বাড়িতে কাজী মোতাহার সাহেব এসে উপস্থিত। সাহিত্য-আলোচনা করতে তিনি যাননি, গিয়েছিলেন দাবা খেলতে,—এ দোষ আমাদের উভয়েরই আছে—অসুস্থ ছিলাম, খেলা হল না, হল বর্তমান সাহিত্য প্রসঙ্গে দুটো আলোচনা। তারই মোটামুটি ভাবটা আমি কল্যাণীয়া জাহান্-আরার বার্ষিক পত্র ‘বর্ষবাণী’তে চিঠির আকারে লিখে পাঠাই। এবং সেইটি ‘অবাঞ্ছিত ব্যবধান’ শিরোনামায় ‘বুলবুল’ মাসিকপত্রের সম্পাদক শ্রদ্ধাস্পদ মুহম্মদ হবিবুল্লাহ সাহেব উদ্ধৃত করেছেন তাঁর আষাঢ়ের কাগজে। দেখলাম, তার একটা জবাব দিয়েছেন শ্রীযুক্ত লীলাময় রায়, আর একটা দিয়েছেন ওয়াজেদ আলী সাহেব।
লীলাময়ের লেখার মধ্যে ক্ষোভ আছে, ক্রোধ আছে, নৈরাশ্য আছে। আমি বলেছিলাম, সাহিত্য-সাধনা যদি সত্য হয়, সেই সত্যের মধ্য দিয়েই ঐক্য একদিন আসবেই। কারণ, সাহিত্য-সেবকেরা পরস্পরের পরমাত্মীয়। হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, কৃশ্চান হোক, তবু পর নয়—আপনার জন। লীলাময় বললেন, “প্রতিকার যদি থাকে, তবে তা সাহিত্যে নয়—তা স্বাজাত্যে”। স্বাজাত্য শব্দটায় তিনি কি বলতে চেয়েছেন, বুঝলাম না। বলেছেন, “ঐক্য জিনিসটা organic; হাড়ের সঙ্গে মাংস জুড়লে যেমন মানুষ হয় না, তেমনি হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান জুড়লে বাঙ্গালী হয় না, ভারতীয় হয় না।” পরে বলেছেন, “হিন্দু-মুসলমানে আপস ছাড়া আর কিছু করবার নেই। সুতরাং ব্যবধান থেকে যাবে, জাতীয়তাও হবে না, আত্মীয়তাও না।” এ-সব উক্তি ক্ষোভের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বলি, এঁদের মতো শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক পণ্ডিত ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরাও আজ যদি এই কথা বলতে থাকেন ত নৈরাশ্যে যে সমস্ত দিক কালো হয়ে উঠবে। এ কি এঁরা ভাবেন না? মনের তিক্ততা দিয়ে কোন মীমাংসাও হয় না, মিলনও ঘটে না। আবার এমনি হতাশা প্রকাশ পেয়েছে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, “আজ যাঁরা নূতন করে আমাদের দুই প্রতিবেশী সমাজের সম্বন্ধে বিচার করবেন, এ নিয়ে যে আশ্চর্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার বন্ধন কেটে কল্যাণের অভিসারী হবেন, দীর্ঘ তাঁদের পথ, কঠিন তাঁদের সাধনা।” আমি এই কথাটাই মানতে চাইনে। জোর করে প্রশ্ন করতে চাই, কেন তাঁদের পথ দীর্ঘ হবে? কিসের জন্য সাধনা তাঁদের সুকঠিন হয়ে উঠবে? কেন একটি সহজ সুন্দর পথে এই সমস্যার সমাধান আমরা খুঁজে পাব না? ওয়াজেদ আলী সাহেব পরে বলেছেন, “যাদের মনে রইলো প্রবল বিরুদ্ধতা, অন্তরে রইলো গভীর অপ্রেম, চিত্তে রইলো দীর্ঘ ব্যবধান, তাদেরকে টেনে পাশাপাশি দাঁড় করানো হল।
তাতে শিষ্টাচারের তাগিদে হাতের সাথে হাত মিললো, তাদের দৃষ্টি-বিনিময় হল না; একজনের অন্তর রইলো আর একজনের অন্তর থেকে শত যোজন দূরে।” এর হেতু দেখাতে গিয়ে বলেছেন, “অচেনা মুসলিম এলো বিজয়ীর বেশে, অধিকার করলো রাজার আসন। আনুগত্য, রাজসম্মান সে পায়নি এমন নয়; কিন্তু ভারতবর্ষকে স্বদেশ স্বীকার করেও দেশ-মনের মিতালি তার ভাগ্যে হয়নি, এদের অপরিচয়ের যে ব্যবধান সেটি অবাঞ্ছিত হলেও কোনদিন ঘোচেনি।” কিন্তু এই কি সমস্ত সত্য? সত্য হলে, এই অবাঞ্ছিত ব্যবধান ঘুচিয়ে মিতালি করতে ক’টা দিন লাগে? মনে হয় লীলাময় অনেক ব্যথার মধ্যে দিয়েই লিখেছেন, “যাঁরা বিদেশ থেকে এসেছেন ও আজও তা মনে রেখেছেন, যাঁরা জলের উপর তেলের মত থাকবেন বলে স্থির করেছেন আবহমান কাল, দেশের অতীত সম্বন্ধে যাঁদের অনুসন্ধিৎসা ও বর্তমান সম্বন্ধে যাঁদের বেদনা-বোধ নেই, রাষ্ট্রের ভিতরে আর একটা রাষ্ট্র-রচনাই যাঁদের স্বপ্ন, আমরা তাঁদের কে, যে গায়ে পড়ে তাঁদের অপ্রিয় সত্য শোনাতে যাবো?”
এ কথার এ অর্থ নয় যে, ব্যবধান আমরা ভালবাসি, মিতালি চাইনে, পরস্পরের আলোচনা-সমালোচনা পরিহার করাই আমাদের বিধেয়। এ উক্তির তাৎপর্য যে কি, সমস্ত সাহিত্য-রসিক বিদগ্ধ মুসলিম সমাজকেই আমি দিতে বলি। কলহ-বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক, বাদ-বিতণ্ডা করে নয়। কোথায় ভ্রম, কোথায় অন্যায়, কোন্খানে অবিচার লুকিয়ে আছে, সেই অকল্যাণকে সুস্থ সবল চিত্ত দিয়ে আবিস্কার করে দিতে বলি, এবং বলি উভয় পক্ষকেই সবিনয়ে সশ্রদ্ধায় তাকে স্বীকার করে নিতে। তখন পরস্পরের স্নেহ, প্রেম, ক্ষমা আমরা পাবোই পাবো।
ওয়াজেদ আলী সাহেব একটি চমৎকার ভরসার কথা বলেছেন, সেটি হিন্দু-মুসলমান সকলেরই মনে রাখা উচিত। বলেছেন, “মুসলিম সাহিত্য-সেবক আরবী-ফারসী শব্দ বাংলা ভাষার অঙ্গে জুড়তে চাইছেন, এতে আপত্তি-অনাপত্তি অতি তুচ্ছ কথা, কেননা শুধু কলম চালিয়ে ওটি হতে পারে না; তার জন্যে চাই প্রচুর সাহিত্যিক শক্তি, চাই সৃষ্টিশীল প্রতিভা। ও দুটি যেখানে নেই, সেখানে ভাষা ভূষণ পরতে গিয়ে অতি সহজেই সং সাজতে পারে।”
পারেই ত। কিন্তু এ জ্ঞান আছে কার? যিনি যথার্থ সাহিত্য-রসিক, তাঁর। ভাষাকে যিনি ভালবাসেন, অকপটে সাহিত্যের সেবা করেন, তাঁর। তাঁকে ত আমার ভয় নেই। আমার ভয় শুধু তাঁদের যাঁরা সাহিত্য-সেবা না করেও সাহিত্যের মুরুব্বি হয়ে বসেছেন। প্রিয় না হলেও একটা দৃষ্টান্ত দিই। ‘মহেশ’ নামে আমার লেখা একটি ছোট গল্প আছে, সেটি সাহিত্যপ্রিয় বহু লোকেরই প্রশংসা পেয়েছিল। একদিন শুনতে পেলাম গল্পটি Matric-এর পাঠ্য-পুস্তকে স্থান পেয়েছে। আবার একদিন কানে এলো সেটি নাকি স্থানভ্রষ্ট হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজের কোন যোগ নেই, ভাবলাম এমনিই হয়ত নিয়ম। কিছুদিন থাকে, আবার যায়। কিন্তু বহুদিন পরে এক সাহিত্যিক বন্ধুর মুখে কথায় কথায় তার আসল কারণ শুনতে পেলাম। আমার গল্পটিতে নাকি গো-হত্যা আছে। আহা! হিন্দু বালকের বুকে যে শূল বিদ্ধ হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বহু টাকা মাইনের কর্তা-মশায় এ অনাচার সইবেন কি করে? তাই ‘মহেশ’, এর স্থানে শুভাগমন করেছেন তাঁর স্বরচিত গল্প ‘প্রেমের ঠাকুর’। আমার ‘মহেশ’ গল্পটা হয়ত কেউ কেউ পড়ে থাকবেন, আবার অনেকেই হয়ত পড়েন নি। তাই শুধু বিষয়-বস্তুটা সংক্ষেপে বলি। একটি হিন্দুপ্রধান হিন্দু জমিদার-পালিত ক্ষুদ্র গ্রামে গরীব চাষা গফুরের বাড়ি। বেচারার থাকার মধ্যে বহুজীর্ণ, বহুছিদ্রযুক্ত একখানি খড়ের ঘর, বছর-দশেকের মেয়ে আমিনা, আর একটি ষাঁড়। গফুর ভালবেসে তার নাম দিয়েছিল মহেশ। বাকি খাজনার দায়ে ছোট গাঁয়ের ততোধিক ছোট জমিদার যখন তার ক্ষেতের ধান-খড় আটক করলে, তখন সে কেঁদে বললে, হুজুর! আমার ধান তুমি নাও, বাপ-বেটীতে ভিক্ষে করে খাবো, কিন্তু খড় ক’টি দাও,—নইলে এ-দুর্দিনে মহেশকে আমার বাঁচাবো কি করে? কিন্তু রোদন তার অরণ্যে রোদন হল—কেউ দয়া করলে না। তার পরে শুরু হল তার কত রকমের দুঃখ, কত রকমের উৎপীড়ন। মেয়ে জলের জন্যে বাইরে গেলে সেই জীর্ণ কুটীরের খড় ছিঁড়ে নিয়ে লুকিয়ে মহেশকে খাওয়াতো, মিছে করে বলতো, মা আমিনা, আজ আমার জ্বর হয়েছে, আমার ভাত ক’টি তুই মহেশকে দে। সারাদিন নিজে অভুক্ত থাকতো। ক্ষুধার জ্বালায় মহেশ অত্যাচার করলে এই দশ বছরের মেয়েটার কাছেও তার ভয় ও কুণ্ঠার অবধি থাকতো না। লোকে বলতো, গরুটাকে তুই খাওয়াতে পারিস নে গফুর, ওকে বেচে দে। গফুর চোখের জল ফেলে আস্তে আস্তে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, মহেশ, তুই আমার ব্যাটা,—আমাকে তুই সাত সন প্রতিপালন করেছিস। খেতে না পেয়ে তুই কত রোগা হয়ে গেছিস,—তোকে কি আজ আমি পরের হাতে দিতে পারি, বাবা! এমনি করে দিন যখন আর কাটতে চায় না তখন একদিন অকস্মাৎ এক বিষম কাণ্ড ঘটলো। সে গ্রামে জলও সুলভ নয়। শুকনো পুকুরের নীচে গর্ত কেটে সামান্য একটুখানি পানীয় জল বহু দুঃখে মেলে। আমিনা দরিদ্র মুসলমানের মেয়ে, ছোঁয়া-ছুঁইর ভয়ে পুকুরের পাড়ে, দূরে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী মেয়েদের কাছে চেয়ে-চিন্তে অনেক দুঃখে বিলম্বে তার কলসীটি পূর্ণ করে বাড়ি ফিরে এলো। এখন ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মহেশ তাকে ফেলে দিয়ে কলসী ভেঙ্গে ফেলে এক নিশ্বাসে মাটি থেকে জল শুষে খেতে লাগলো।
মেয়ে কেঁদে উঠলো। জ্বরগ্রস্ত, পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ গফুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো—এ দৃশ্য তার সইলো না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যা সুমুখে পেলে—একখণ্ড কাঠ দিয়ে সবলে মহেশের মাথায় মেরে বসলো। অনশনে মৃতকল্প গরুটা বার-দুই হাত-পা ছুঁড়ে প্রাণত্যাগ করলে।
প্রতিবাসীরা এসে বললে, হিন্দুর গাঁয়ে গোহত্যা! জমিদার পাঠিয়েছেন তর্করত্নের কাছে প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা নিতে। এবার তোর ঘরদোর না বেচতে হয়। গফুর দুই হাঁটুর ওপর মুখ রেখে নিঃশব্দে বসে রইলো। মহেশের শোকে, অনুশোচনায় তার বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিলো। অনেক রাতে গফুর মেয়েকে তুলে বললে, চল্ আমরা যাই।
মেয়ে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, চোখ মুছে বললে, কোথায় বাবা? গফুর বললে, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে।
আমিনা আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলো। ইতিপূর্বে অনেক দুঃখেও তার বাবা চটকলে কাজ করতে রাজী হয়নি। বাবা বলতো, ওখানে ধর্ম থাকে না, মেয়েদের আব্রু-ইজ্জত থাকে না—ওখানে কখন নয়। কিন্তু হঠাৎ এ কি কথা?
গফুর বললে, দেরি করিস নে মা, চল্। অনেক পথ হাঁটতে হবে। আমিনা জল খাবার পাত্র এবং বাবার ভাত খাবার পিতলের বাসনটি সঙ্গে নিতেছিল, কিন্তু বাবা বারণ করে বললে, ও-সব থাক্ মা, ওতে আমার মহেশের প্রাচিত্তির হবে।
তার পরে গল্পের উপসংহারে বইয়ে এইরূপ আছে—“অন্ধকার গভীর নিশীথে সে মেয়ের হাত ধরিয়া বাহির হইল। এ গ্রামে আত্মীয় কেহ তাহার ছিল না, কাহাকেও বলিবার কিছু নাই। আঙ্গিনা পার হইয়া পথের ধারে সেই বাবলা-তলায় আসিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লাহ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি কখনো যেন মাফ্ করো না।”
এই হল গোহত্যা! এই পড়ে হিন্দুর ছেলের বুকে শেল বিঁধবে। তার চেয়ে পড়ুক ‘প্রেমের ঠাকুর’! তাতে ইহলোক না হোক তাদের পরলোকে সদ্গতি হবে! এই কান্তিমান সুপরিপুষ্ট প্রেমের ঠাকুরটিকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, মুসলমান-সম্পাদিত কাগজে এই গল্পটির যে কড়া আলোচনা বেরিয়েছিল তার কি কোন হেতু নেই? একেবারে মিথ্যা অমূলক?
তাই আমার চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটিকে সসম্মানে নিবেদন করে রাখি যে, খুব বড় হলেও মনের মধ্যে একটুখানি বিনয় থাকা ভাল। ভাবা উচিত, তাঁর রচিত গল্পের সঙ্গে বাঙলার ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় না ঘটলেও বিশেষ কোন লোকসান ছিল না। Text Book থেকে পয়সা পাইনে—ও ব্যবসা আমার নয়—সুতরাং ক্ষতিবৃদ্ধিও নেই—তবু ক্লেশবোধ হয়। নিজের জন্য নয়,—অন্য কারণে। শুধু সান্ত্বনা এই যে, অযোগ্যের হাতে ভার পড়লে এমনি দুর্দশাই ঘটে। যে ব্যক্তি কোনদিন সাহিত্য সাধনা করেনি সে কি করে বুঝবে কার মানে কি! শুনেছি নাকি আমার ‘রামের সুমতি’ গল্পের খানিকটা দিয়েছেন। অত্যন্ত দয়া,—বোধ করি আশা এর থেকে রামেদের সুমতি হবে। কিন্তু মুশকিল এই যে, দেশে রহিমরাও আছে।
আর শুধু বিদ্যালয়ই নয়, মহেশের ভাগ্যে অন্য দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাইনে, কিন্তু নিঃসংশয়ে জানি এক হিন্দু জমিদার রক্তচক্ষু হয়ে শাসিয়ে বলেছিলেন, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সাহায্যে ছাপা মাসিক বা সাপ্তাহিকে এ ধরনের গল্প যেন আর ছাপা না হয়। এতে জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজা ক্ষেপিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ দেশের সর্বনাশ হয়।
যাক নিজের কথা।
উপরি-উক্ত হিন্দু মুরব্বীর মত আবার মুসলমান মুরব্বীও আছেন। শুনেছি তাঁরা নাকি আদেশ করেন ইতিহাস ফরমায়েশ মত লিখতে। ইসলাম-ধর্মী কোন ব্যক্তি কোথাও অন্যায়-অবিচার করেছেন এর লেশমাত্রও যেন কোন পড়ার বইয়ে না থাকে। এখানেও সান্ত্বনা এই যে, এঁদের কেউ কখনো কোনকালে সাহিত্য-সেবা করেন নি। করলে এমন কথা মুখে আনতে পারতেন না। সত্যিকার সাহিত্যিকদের হাতে যদি এই ভার পড়ে, আমার বিশ্বাস, না-হিন্দু, না-মুসলিম কোন পক্ষ থেকেই বিন্দুমাত্র অভিযোগ শোনা যাবে না। ভাষার প্রতি, সাহিত্যের প্রতি সত্যিকার দরদ তাঁদের সত্য পথেই পরিচালিত করবে।
ওয়াজেদ আলী সাহেব এক স্থানে বলেছেন, “মুসলিমের এই নবস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ, ইসলামী কৃষ্টির এই বলিষ্ঠ জাগরণ, সাহিত্যক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের মত শক্তিমান প্রতিভার মনোযোগ আকর্ষণ করলো, হয়ত দেশের অনাগত কল্যাণের এ এক শুভ ইঙ্গিত। কিন্তু তবু কেন মন সন্দেহ-অবিশ্বাসে দ্বিধা-জিজ্ঞাসায় দুলে ওঠে? ‘বুলবুলে’ প্রকাশিত তাঁর পত্রখানিতে যেন চোখে পড়ে, মুসলিমের প্রতি তাঁর সহানুভূতির অভাব, ভালবাসার অভাব এবং মোটামুটি একটা অন্তর্দৃষ্টির অভাব।”
আমার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, মুসলিমের এই ‘নবস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ,’ ইসলামী কৃষ্টির এই ‘বলিষ্ঠ জাগরণ’, যাঁরা নবীন, উদার বাংলা ভাষাকে যাঁরা অকুণ্ঠিত মনে মাতৃভাষা বলে স্বীকার করেন, তাঁদের—না যাঁরা পুরাতনপন্থী, তাঁদের? আমার অভিমত এই যে, যাঁরা প্রাচীনপন্থী, যাঁরা পিছনে ছাড়া সুমুখে চাইতে জানেন না, তাঁদের জাগরণ, কি মুসলিম কি হিন্দু, সকল সমাজেরই বিঘ্নস্বরূপ। হিন্দুদের সম্বন্ধে এ কথা আমি বহুবার বহুস্থানে লিখেছি, মুসলিম-সমাজের সম্বন্ধেও অসংশয়ে বলতে পারি, এ জাগরণ হয় যদি নবীনের—আসুক সে শ্রাবণের পূর্ণিমা জোয়ারের মত সমস্ত ভাসিয়ে দিয়ে, তবু তাকে আমি দু-হাত তুলে সংবর্ধনা করে নেবো। জানবো, এদের হাতে সমস্তই হবে শুভ এবং সুন্দর—এদের হাতে হিন্দু-মুসলিম কারও ভয় নেই—এদের হাতে আমরা দুজনেই হবো নিরাপদ। আমার আশঙ্কা শুধু প্রাচীনপন্থীদের সম্বন্ধে।
তিনি পরে বলেছেন, “ শরৎচন্দ্রের মত সাহিত্যিকদের সম্প্রদায়, জাতি, এক ছাড়া দুই নয়। এ কথা সহজেই আমাদের স্বীকৃতি দাবী করতে পারে। কিন্তু আরও একটি সহজ কথার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সেটি এই যে সাহিত্য মানুষের মনের সৃষ্টি, এবং মানুষের মনকে তৈরী করে তার ধর্ম, তার সমাজ, তার পরিবেশ, তার কৃষ্টি। এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা কি সামান্য ব্যাপার? এবং সাধারণতঃ সেটি কি সম্পূর্ণরূপে সম্ভব?”
এই কথাগুলি শুধু আংশিক সত্য—সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ, এটুকু মোটামুটি জেনে রাখা দরকার যে মানুষ যখন সাহিত্যরচনায় নিবিষ্ট-চিত্ত তখন সে ঠিক হিন্দুও নয়, মুসলিমও নয়। তখন সে তার সর্বজনপরিচিত, ‘আমি’টাকে বহু দূরে অতিক্রম করে যায়, নইলে তার সাহিত্যসাধনা ব্যর্থ হয়। এই জন্যেই যেখানে কিছুই এক নয়, বাহ্যতঃ কিছুই মেলে না, সেখানেও ম্যাক্সিম গর্কির মত সাহিত্য-সেবকেরা আমাদের বুকের মধ্যে অনেকখানি আত্মীয়ের আসন-জুড়ে বসে থাকেন। এই কথাটি আমি সকল সাহিত্যিককেই মনে রাখতে বলি। কে কোথায় তার অসতর্ক মুহূর্তে কি কথা বলেছে, সেইটিই তার জীবনের পরম সত্য নয়। কেবল তাই দিয়েই বিচার করা চলে না। এবং এই জন্যই ওয়াজেদ আলী সাহেব তাঁর প্রবন্ধে আমার সম্বন্ধে যে-সব কঠিন উক্তি করেছেন আমি তার জবাব দিতে বসবো না। রাগ যখন পড়বে, তখন আপনিই মনে হবে আমি সত্যি কথাই বলেছিলাম। ওয়াজেদ আলী সাহেব সবচেয়ে মর্মান্তিক কথা বলেছেন এইখানে, “বস্তুতঃ, দুইটি বিষম অনাত্মীয় কৃষ্টির সংঘর্ষের ফলে এই বিক্ষোভ। এর জন্য আক্ষেপ বৃথা। হিন্দু মুসলিমকে বোঝে না, এজন্যে দুঃখের বিলাপ আজ চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে।
কিন্তু এমনও হতে পারে যে তার ভারতীয় ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি তার মনকে-করেছে অপরিসর, দৃষ্টিকে করেছে আচ্ছন্ন।আপনার পরিধিকে অতিক্রম করে গতি তার নিশ্চল; আপনার আভিজাত্যের গর্বে যে চিরবিলীন, পরাজয়ের প্রাচীন অভিমান যার আজও দুর্জয়, বিনাযুদ্ধে সুচ্যগ্র-পরিমিত স্থান দান করতেও যার আপত্তি অন্তহীন, তার বুদ্ধিকে মুক্ত বলা কঠিন। অথচ, মুক্তি যার নেই সে চলে না, চলতে পারে না, সে জড়। এই আত্মকেন্দ্রী পরবিমুখ জড়বুদ্ধির পরিবেশ এ দেশের মুসলিমকে ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ করে রেখেছে, ভারতের মাটির রসে রসায়িত হয়েও তার মন যেন ভিজছে না।”
এই যে বলেছেন দুইটি বিষম অনাত্মীয় কৃষ্টির ফলে এই বিক্ষোভ, এর জন্য আক্ষেপ বৃথা। আমরা উভয়ে উভয়ের প্রতিবেশী, আমাদের আকাশ বাতাস মাটি জল এক। মাতৃভাষা এক বলেই স্বীকার করি। তবু সংঘর্ষ এত বড় কঠোর যে, তার জন্যে আক্ষেপ পর্যন্ত করা বৃথা—এই মনোভাবই যদি সমস্ত হিন্দু-মুসলমানের সত্য হয় ত এই কথাই বলবো যে, এর চেয়ে বড় দুর্গতি মানুষের আর ঘটতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধিও কি জড়বুদ্ধি? মন তাঁর মুক্ত হয়নি? এ যদি সত্য তবে ওয়াজেদ আলী সাহেবের এ ভাষা এল কোথা থেকে? সহজ, সুন্দর ও অবলীলায় আপন মনোভাব প্রকাশ করার শক্তি তাঁকে কে দিলে? এ যুগে এমন লেখক, এমন সাহিত্য-সেবক কে আছে যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী নয়? সাহিত্য ধর্ম-পুস্তকও নয়, নীতিশিক্ষার বইও নয়, অথচ, আপন বিশাল পরিধির মধ্যে আপন মাধুর্যে সে সব-কিছুকেই আপন করে রেখেছে। তাই সাহিত্য কি, রসবস্তু কি, আজও কেউ তার সত্য নির্দেশ পেলে না। কত তর্ক, কত মতভেদ। এই অবাঞ্ছিত ব্যবধান সম্বন্ধে মীজানুর রহমান সাহেব জ্যৈষ্ঠের ‘বুলবুল’ মাসিক পত্রে তাঁর প্রবন্ধের এক স্থানে অকরুণ হয়ে বলেছেন, “শরৎবাবু তাঁর রাশিকৃত উপন্যাসের ভিতর স্থানে স্থানে মুসলমান-সমাজের যে-সব ছবি এঁকেছেন তা মুসলমান-সমাজের খুব উঁচুদরের লোকের নয়।” কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, উঁচু-নিচু স্তরের পাত্র-পাত্রীর উপরেই কি উপন্যাসের উচ্চতা-নীচতা, ভাল-মন্দ নির্ভর করে? এ যদি তাঁর অভিমত হয়, তবে আমার সঙ্গে তাঁর মতের ঐক্য হবে না। না হোক, কিন্তু উপসংহারে যে বলেছেন, “হিন্দু-সমাজের বিবিধ গলদ ও সমস্যা নিয়ে শরৎচন্দ্র যে-সকল গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন এবং প্রতিকারের উদ্দেশ্যে তাঁহার সমাজকে যে চাবুক কশেছেন, সদিচ্ছাপ্রণোদিত এমনধারা নির্মম কশাঘাতও মুসলিম-সমাজ অম্লানবদনে গ্রহণ করবে তা জোর করে বলতে পারি। বাঙ্গালার কথাসাহিত্য-সম্রাটকে একবার পরীক্ষা করে দেখতে অনুরোধ করি।”
সেদিন জগন্নাথ হলে আমার অভিনন্দনের প্রতিভাষণে এ কথার উত্তর দিয়েছি। অন্তরের শুভ-কামনাকে এঁরা কেমন করে গ্রহণ করেন, এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার পূর্বে আমি দেখে যাবো। সে যাই হোক, মানুষে শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করতেই পারে, কিন্তু তার পরিপূর্ণতার ভার থাকে আর একজনের ’পরে, যিনি বাক্য ও মনের অগোচর।
সেদিন খেতে বসে His Excellency আমাকে এই প্রশ্নই করেছিলেন। আমি উত্তর দিয়াছিলাম, আমার সঙ্কল্প কাজে পরিণত করতে—চাই উভয় সমাজের আশীর্বাদ। ঠিক সমাজ নয়,— চাই উভয় সমাজের সাহিত্য-সেবকদের আশীর্বাদ। যে ভাষার যে সাহিত্যের এতকাল সেবা করেছি, তার ’পরে অকারণ অনাচার আমার সয় না। আমার একান্ত মনের বিশ্বাস, আমার মত সাহিত্যের যথার্থ সাধনা যাঁরা করেছেন, তাঁরা হিন্দু-মুসলিম যা-ই হোন, কারোও এ অনাচার সইবে না। সৌন্দর্য ও মাধুর্যের জন্য পরিবর্তন যদি কিছু কিছু প্রয়োজন হয়—এমন ত কতবার হয়েছে—সে কাজ ধীরে ধীরে এঁরাই করবেন। আর কেউ নয়। সে হিন্দুয়ানির কল্যাণেও নয়, মুসলমানির কল্যাণেও নয়—শুধু মাতৃভাষা ও সাহিত্যের কল্যাণে। এই আমার ছোট আবেদন।
কোথায় কোন্ লেখায় মুসলিম-সমাজের প্রতি অবিচার করেছি,— করিনি বলেই আমার ধারণা—তার চুলচেরা বাদ-প্রতিবাদ প্রতিকারের পথ নয়, সে কলহ-বিবাদের নতুন রাস্তা তৈরি করা।
‘বুলবুল’ কাগজখানির নানা স্থান থেকে আমি উদ্ধৃত করেছি—প্রয়োজনবোধে। এই পত্রিকার অবিচ্ছিন্ন উন্নতি কামনা করি, কারণ যতটুকু পড়েছি তাতে সাহিত্যের উন্নতিই এঁদের কাম্য, আমারও তাই। হয়ত কোথাও একটু কটূক্তি করে থাকবেন কিন্তু সে মনে করে রাখবার বস্তু নয়, ভুলে যাবার জিনিস।
কিন্তু আর নয়। বলবার বিষয় এখনও অনেক ছিল, কিন্তু আপনাদের ধৈর্যের প্রতি সত্যিই অত্যাচার করেছি। সেজন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি। এ অভিভাষণে পাণ্ডিত্য নেই, কারুকার্য নেই, বলার কথাগুলো কেবল সোজা করে বলে গেছি, যেন তাৎপর্য বুঝতে কারও ক্লেশবোধ না হয়। শোনার পরে কেউ না বলেন—যেমন অতুলনীয় শব্দসম্পদ, তেমনি কারুকার্য—কিন্তু ঠিক কি যে বলা হল ভাল বোঝা গেল না।
বাংলা-সাহিত্যের সেবা করে মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা আমার অপরিসীম, তবু তাঁদের নামোল্লেখ করতে আমি বিরত রইলাম।
পরিশেষে কৃতজ্ঞতা নিবেদনের একটা রীতি আছে। যেমন আছে আরম্ভ করার সময় বিনয় প্রকাশের প্রথা। প্রথমটা করিনি। কারণ, সাহিত্য-সভায় সভাপতির কাজ এত বেশি করতে হয়েছে যে, এই ষাট বছর বয়সে নিজেকে অনুপযুক্ত, বেকুফ ইত্যাদি যত প্রকারের বিনয়সূচক বিশেষণ আছে নিজের নামের সঙ্গে সংযোগ করে দিলে ঠিক শোভন হবে মনে হল না। কিন্তু কৃতজ্ঞতা-প্রকাশের বেলায় তা নয়। সমস্ত বিদগ্ধ মুসলিম-সমাজের কাছে আজ আমি অকপটে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি। আপনারা আমার সালাম গ্রহণ করুন। বলার দোষে যদি কাউকে বেদনা দিয়ে থাকি সে আমার ভাষার ত্রুটি, আমার অন্তরের অপরাধ নয়।
ইতি—ঢাকা, ১৫ই শ্রাবণ, ১৩৪৩।