মুসলিম সংস্কৃতি

মুসলিম সংস্কৃতি

শ্রেণীবিভাগকালে প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিভক্তিকরণের একটা নির্দিষ্ট ভিত্তি থাকে। অন্যথায় কোন্ জিনিস কোন্ শ্রেণীভুক্ত সেটা নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। কাজেই বিভক্তিকরণের ভিত্তি পরিবর্তন করলে সেই অনুসারে একই জিনিসকে নানান শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা চলে। এ হলো ন্যায়শাস্ত্রের কথা। এবং মানুষ থেকে শুরু করে গরু- ছাগল গাছ-পালা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, ধর্ম-রাজনীতি সবকিছুর ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। শিক্ষা, জীবিকা, হৃদয়বৃত্তি, দেশ ও ভাষা, ধর্ম, কলাজ্ঞান ইত্যাদিকে যদি একে একে বিভক্তিকরণের ভিত্তি হিসাবে গণ্য করা হয় তাহলে একজন মানুষকে শিক্ষিত, চাকরীজীবী, উদারহৃদয়, বাঙালী, মুসলমান, সংগীতজ্ঞ এই সকল শ্রেণীভুক্ত করা সম্ভব। অনুরূপভাবে অন্যসব জিনিসকেও বিভিন্ন ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীভুক্ত করা চলে। কারণ মানুষের মতো অন্যান্য সব কিছুর মধ্যেই নানা প্রকার গুণগত ও জাতিগত প্রভেদ আছে এবং এই ভেদাভেদের জন্যেই জিনিসের শ্রেণীবিচার সম্ভবপর হয়।

কিন্তু এই সমস্ত শ্রেণীবিভাগের দ্বারা কোন জিনিসের কতকগুলি দিকের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্যপাত সম্ভব হলেও তার কোন একটির মাধ্যমে জিনিসটির সামগ্রিক পরিচয় মেলে না। এ পরিচয়প্রদান ততখানি সন্তোষজনক হবে যত বিবিধভাবে জিনিষটির চরিত্রের বিভিন্ন দিকের বর্ণনা দেওয়া যাবে। এগুলির মধ্যে কোনটি হয়তো কম এবং কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের প্রত্যেকটিই সেই জিনিসের সামগ্রিক পরিচয় দানের পক্ষে বিশেষ সহায়ক এবং প্রয়োজনীয়।

এই সহজবোধ্য কথাগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা বিস্মৃত হই। এই বিস্মৃতির ফলে কোন জিনিসের একটি বিশেষ পরিচয়ের দ্বারা তার সামগ্রিক পরিচয়দানের প্রবণতা আমাদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠে। এবং ফলে অনেক নির্বোধ আলোচনা পরিণতি লাভ করে তিক্ততা এবং উন্মত্ততায়।

এই অবস্থা সৃষ্টি একটি বিশেষ কারণে। শ্রেণীবিচারের সময় যে জিনিসটিকে আমরা শ্রেণীবদ্ধ করি অনেক সময় তার সাথে সেই জিনিষটির অংশবিশেষকে এক করে দেখি অথবা উল্টোভাবে সম্পূর্ণ জিনিসটিকে তারই অংশবিশেষের অন্তর্গত বলে হিসাব করি। এটা একটা গুরুতর ভুল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে পাকিস্তান একটি দেশ এবং সেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নাম পূর্ববঙ্গ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ইত্যাদি। অন্ততঃ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে এবং তারপরও অনেকদিন পর্যন্ত এই নামেই এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলি পরিচিত ছিল। কাজেই পাকিস্তান একটি দেশ এবং পাঞ্জাব পূর্ববঙ্গ ইত্যাদি তার অংশবিশেষ। কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ যদি বলে যে পাঞ্জাব এবং পাকিস্তান সমার্থক অথবা পাঞ্জাবও যা পাকিস্তানও তাই তাহলে সে প্রথম জাতীয় ভুলটি করে বসবে অর্থাৎ সম্পূর্ণ জিনিসের সাথে তার অংশবিশেষকে এক করে দেখবে। আবার কেউ যদি বলে যে পাঞ্জাব পাকিস্তানের অংশ নয়, পাকিস্তানই পাঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত তাহলে সে দ্বিতীয় জাতের ভুল করবে অর্থাৎ উল্টোভাবে সম্পূর্ণ জিনিসটিকে তারই অংশবিশেষের অন্তর্গত বলে বিবেচনা করবে। কিন্তু এই উদাহরণ দুটির মধ্যে যে ভ্রান্তিকে আমরা সহজেই প্রত্যক্ষ এবং চিহ্নিত করতে পারি অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা সেটা পেরে উঠি না।

সংস্কৃতিকে ধর্মের সমার্থক মনে করলে অথবা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত মনে করলে ঠিক এই প্রথম এবং দ্বিতীয় জাতের ভুলই করা হয়। কিন্তু চিন্তার আবেগময়তা এবং অপরিচ্ছন্নতার জন্যে সে ভুল অনেকের কাছে সাধারণতঃ ধরা পড়ে না।

দুই

সংস্কৃতির অর্থ কি? এ নিয়ে অনেক সূক্ষ্ম তর্ক সম্ভব হলেও এর স্বরূপ উপলব্ধির সহজ উপায় সংস্কৃতির অভিব্যক্তি বলতে আমরা যা-কিছু বুঝি সেগুলির প্রতি লক্ষ্যপাত করা। যেমন আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত-নৃত্য, সাহিত্য-নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদি। এগুলিকে মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত করা চলে। প্রথমতঃ এগুলি নিত্যকার জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত। দ্বিতীয়তঃ জীবন-উপভোগের ব্যবস্থা এবং উপকরণের সাথে জড়িত কোন জাতির অথবা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলতে এজন্যে তার সামগ্রিক আর্থিক জীবন থেকে শুরু করে ললিতকলা এবং শিষ্টাচার পর্যন্ত সবকিছুই বোঝায়। অর্থাৎ সেই দেশ এবং জাতির অন্তর্গত মানুষদের জীবনযাপন এবং জীবন- উপভোগের যাবতীয় পদ্ধতি এবং আয়োজনই এর অন্তর্গত। কোন একটি লোকের সংস্কৃতি কি, একথা বোঝার জন্য তাই প্রয়োজন তার আর্থিক জীবন, ভাষা, শিক্ষা, রুচি, আচার- আচরণ ইত্যাদি সবকিছুর সাথে ওয়াকিফহাল হওয়া।

সাধারণতঃ দেখা যায় যে একই দেশ, জাতি অথবা ধর্ম-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হলেও মানুষে মানুষে রুচির অনেক প্রভেদ থাকে। এই পার্থক্যের কারণ সন্ধান করলে মোটা-মুটিভাবে দেখা যাবে যে, এই সমস্ত লোকের জীবন যে প্রভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেগুলি এক নয়। এজন্যেই দেখা যায় যে ইংরেজী, ফারসী, রুশীয়, চৈনিক, বাঙালী, পাঞ্জাবী যে সংস্কৃতিই হোক না কেন তাদের প্রত্যেকটির কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকলেও এক একটি বৃহৎ সাংস্কৃতিক গণ্ডীর মধ্যে আবার অনেক ছোট বড় গণ্ডী থাকে।

উদাহরণস্বরূপ বাঙালী সংস্কৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে। বাঙালী সংস্কৃতি বলতে প্রধানতঃ আমরা সেই সমস্ত লোকের সংস্কৃতি বোঝাই যারা বাঙলা ভাষায় কথা বলে, বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে, বাঙলার আর্থিক জীবনে অংশ গ্রহণ করে এবং বাঙলার ঐতিহ্যকে মোটামুটিভাবে নিজেদের ঐতিহ্য বলে স্বীকার করে। বাঙালী সংস্কৃতির এই পরিচয়কে স্বীকার করে নিয়েও দেখা যায় যে প্রতিটি বাঙালীর সংস্কৃতিই সম্পূর্ণ এক এবং অভিন্ন নয়। তার মধ্যে কিছু কিছু তারতম্য আছে। একজন মধ্যবিত্ত হিন্দুর সংস্কৃতি এবং একজন মধ্যবিত্ত মুসলমান অথবা বৌদ্ধের সংস্কৃতির মধ্যে কিছু তফাৎ আছে। এ তফাতের উৎপত্তি মূলতঃ ধর্মীয় কারণে। আচার-অনুষ্ঠান, ক্রিয়া-কর্মাদির প্রভাবে হিন্দু-মুসলমান— বৌদ্ধ বাঙালীর মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। কিছু কিছু শব্দের ব্যবহারের মধ্যেও সে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন হিন্দুদের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনক্ষেত্রে সংস্কৃত-উদ্ভূত শব্দের প্রচলন যতখানি মুসলমানদের ক্ষেত্রে ততখানি নয়। তাদের মধ্যে আরবী, ফারসী, উর্দু শব্দের প্রচলন অপেক্ষাকৃতভাবে বেশী।

ধর্মীয় প্রভাবের মতো আঞ্চলিক প্রভাবও মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকরী। আচার-অনুষ্ঠান, শব্দের বিশিষ্ট ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমেই এই প্রভাবকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আঞ্চলিক পার্থক্য ভৌগোলিক অবস্থার দ্বারাই মূলতঃ নিয়ন্ত্রিত। পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালীকে তার নদীগুলি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কল্পনা করা চলে না। এর সুর, তাল, কথা ইত্যাদি পূর্ববঙ্গের নদীকে বাদ দিয়ে কখনই সম্ভব হতো না। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানের সুর, বিষয়বস্তু ইত্যাদি সে অঞ্চলে ভৌগোলিক পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার সাথে ঘনিষ্ঠসূত্রে জড়িত। পশ্চিমবঙ্গের কীর্তন সম্বন্ধেও সেই একই কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই নয়। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালী সংস্কৃতির সাধারণ গণ্ডীর মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্যের আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া চলে।

এছাড়া দেখা যায় যে একই ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত এবং একই অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে অনেক গুরুতর পার্থক্য বর্তমান থাকে। এ পার্থক্য সৃষ্টি হয় আর্থিক জীবনকে কেন্দ্র করে। উত্তরবঙ্গের একজন দরিদ্র ভূমিহীন আধিয়ার এবং একজন সমৃদ্ধিশালী পরাক্রান্ত জোতদার একই জেলার অধিবাসী এবং মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের সংস্কৃতির মধ্যে থাকে বিপুল ব্যবধান। এ ব্যবধান হিন্দু আধিয়ার এবং জোতদারের মধ্যেও সমানভাবে বিদ্যমান। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে বাঙালী সংস্কৃতির সাধারণ গণ্ডীর মধ্যে ধর্ম, অঞ্চল ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষে মানুষে সংস্কৃতির যে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয় তার থেকে আর্থিক জীবনের ভিত্তিতে গঠিত বিভিন্ন সংস্কৃতির ভেদাভেদ অনেক গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। এক্ষেত্রে মিলের থেকে গরমিল, ঐক্যের থেকে অনৈক্য এত বেশী যে এ দুই শ্রেণীভুক্ত লোকের সংস্কৃতিকে কোন বৃহত্তর সংস্কৃতির গণ্ডীভুক্ত করা রীতিমত দুঃসাধ্য। বস্তুতঃ ভাষার বন্ধন যদি না থাকতো তাহলে সে কাজ কিছুতেই সম্ভব হতো না। তাদের খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষাদীক্ষা, আচাবিচার, চলাফেরা, আদব কায়দা, শিল্পচর্চা এবং দৈনন্দিন জীবনের হাজারো খুটিনাটি জিনিসের তুলনা করলেই একথা ভাল ভাবে বোঝা যাবে।

তিন

সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো আর্থিক জীবন, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ধর্ম। এগুলির প্রত্যেকটির ভিত্তিতেই মানবসভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে তত্ত্বগতভাবে বিশেষ বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। শুধু ভাষার ভিত্তিতে সংস্কৃতিকে ল্যাটিন, আরবী, ফরাসী, ইংরেজী, জার্মান, পাঠান, পাঞ্জাবী, বাঙালী ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া সম্ভব। আর্থিক জীবনের ভিত্তিতে সামন্ততান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক, মধ্যবিত্ত, সমাজতান্ত্রিক ইত্যাদি বলা যায়। ভৌগোলিক এলাকার ভিত্তিতে সংস্কৃতিকে ভারতীয়, ইউরোপীয়, আমেরিকান, এশীয়, মধ্যপ্রাচ্যীয় ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। আবার ধর্ম অথবা জীবনাদর্শের ভিত্তিতে তাকে খৃষ্টীয়, ইসলামী, বৌদ্ধ, হিন্দু, কম্যুনিস্ট ইত্যাদি নামে অভিহিত করা চলে। কিন্তু সংস্কৃতিকে এইভাবে বিভিন্ন ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে তত্ত্বগতভাবে এক একটি নাম দিলেই সেগুলি সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এই বিভাগগুলির মধ্যে গুরুত্বের প্রভেদ থাকে এবং সংস্কৃ তির আলোচনাকালে সে প্রভেদকে বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।

কিন্তু এক্ষেত্রে গুরুত্বের প্রভেদ বলতে কি বোঝায়? এর একটা সহজ উত্তর আছে। এর জন্য দুই বা ততোধিক সংস্কৃতির এক এক জন প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিকে শুধু সেই বিশেষ পার্থক্যের ভিত্তিতে অন্যদের সাথে তুলনা করা প্রয়োজন। এই তুলনার মাধ্যমে লক্ষ্য করা যাবে সংস্কৃতির অপরাপর ভিত্তিগুলিকে বজায় রেখে শুধু একটির পার্থক্যের কথা ধরলে সে পার্থক্য কতখানি গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রথমতঃ, আঞ্চলিক প্রভেদের কথা বিবেচনা করা যাক। এক ভাষা, এক ধর্ম একই আর্থিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও দুই অঞ্চলের লোকের মধ্যে কতটুকু পার্থক্য দেখা যায়? ইংরেজী এবং মার্কিন সংস্কৃতির কথা বিবেচনা করলে এটা পরিচ্ছন্নভাবে বোঝা যাবে। প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম, ইংরেজী ভাষা এবং উন্নত ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থা এ দুই দেশের সংস্কৃতির মধ্যে যে ঐক্য এবং সাদৃশ্য সৃষ্টি করেছে তার তুলনায় আঞ্চলিক প্রভেদঘটিত দূরত্ব বা গরমিলের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য হলেও খুব বেশী নয়। অনুরূপভাবে দেখা যায় যে ক্যাথলিক ধর্ম, স্প্যানিশ ভাষা এবং অনুন্নত ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থা স্পেন এবং ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যে যে সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ সৃষ্টি করেছে সেটা আঞ্চলিক পার্থক্যের দ্বারা মারাত্মকভাবে খর্ব হয় নি। যদিও এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভেদকে অস্বীকার করা চলে না তবু আবার একথা অনস্বীকার্য যে এই প্রভেদকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করাটা অনেকাংশে অবাস্তব।

চার

এবার ধর্মগত পার্থক্যের গুরুত্ব বিবেচনা করা যাক। একই ভাষাভাষী, একই দেশের অধিবাসী এবং একই আর্থিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত লোকদের ধর্ম যদি পৃথক হয় তাহলে সে পার্থক্য কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ? দুইজন মধ্যবিত্ত প্রটেস্ট্যান্ট এবং রোমান ক্যাথলিক ইংরেজের সংস্কৃতির তুলনা করলে দেখা যাবে যে তাদের মধ্যে তফাৎ খুবই নগণ্য। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকলেও বাকি সবকিছুই তাদের এক। চসার-শেক্সপীয়ার, আর্থার-এলিজাবেথ, নিউটন-ডারউইন, লক-হিউম, কনস্টেবল- ব্লেক, হ্যানডেল-বীচাম এ সমস্ত তাদের উভয়েরই সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অন্তর্গত। ধর্মীয় তত্ত্বগত পার্থক্য এদিক দিয়ে কোন উল্লেখযোগ্য গরমিল দুইয়ের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে নি।

ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের সংঘর্ষের যুগে ধর্মীয় আনুগত্য এখনকার তুলনায় অবশ্য অনেক বেশী প্রতাপশালী ছিল, কিন্তু সে প্রতাপের চিহ্ন আজ আর অবশিষ্ট নেই। নোতুনতর শক্তির অভ্যুত্থানে, আর্থিক জীবনের প্রয়োজনের তাগিদে প্রায় সব কিছুই তার নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ফরাসী এবং জার্মানদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। এক কালে এই সমস্ত ইউরোপীয় দেশগুলিতে ক্যাথলিক এবং প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যেকার বিরোধ আমাদের দেশের হিন্দু-মুসলমান বিরোধের থেকে কম তীব্র ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে বরং বেশীই ছিল। ধর্মীয় কারণে সে সময় অসংখ্য মানুষকে চার্চ ও রাষ্ট্রের সমর্থনে প্রকাশ্যে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। পাক্-ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে অসংখ্য মানুষ নিষ্ঠুরভাবে নিহত, আহত এবং উদ্বাস্তু হলেও এত প্রকাশ্যভাবে ধর্ম এবং রাষ্ট্র সমর্থিত বর্বরতার উদাহরণ এখানে তুলনামুলকভাবে অল্পই দেখা গেছে। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও আজ দেখা যাচ্ছে যে, ধর্মের সে গুরুত্ব ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে নেই। ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান যেই হোক না কেন পরস্পরের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে আজ তারা আর রাজী নয়।

শুধু ইংরেজ কেন বাঙালীদের কথাই ধরা যাক। দুইজন মধ্যবিত্ত বাঙালী হিন্দু এবং মুসলমানের সংস্কৃতির মধ্যে তফাৎ কতখানি? হিন্দু-মুসলমান বিরোধ যে সময় সব থেকে তীব্র আকার ধারণ করেছিলো সেই সময়কার অর্থাৎ এই শতকের তিরিশ চল্লিশের অবস্থা এক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। সে সময় মুসলিম ও হিন্দু সংস্কৃতির নামে এই দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীভুক্ত লোকদের পারস্পরিক মিল এবং ঐক্যের থেকে গরমিল এবং অনৈক্যের উপরই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, একই শ্রেণীর অন্তর্গত বাঙালীদের মধ্যে পার্থক্য যেগুলো সে সময়ে ছিল অথবা এখনো আছে সেগুলোর গুরুত্ব আপেক্ষিতভাবে কম। কারণ খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় আচার-বিচারের ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকলেও বাস্তবতঃ তাদের ইতিহাস, সঙ্গীত, সাহিত্য, আর্থিক জীবন, নদীনালা, গাছপালা, নাট্যশালা সবই এক – তখনো ছিল এবং এখনো আছে। এই ঐক্যকে বারবার ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করার প্রচেষ্টা হয়েছে কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত সফল হয় নি। কারণ যাঁরা এ কাজে ব্রতী হয়েছেন তাঁরা গঙ্গা-যমুনার স্থলে ইউফ্রেটিস-টাইগ্রীস, প্রাকৃত- সংস্কৃতের স্থলে আরবী-ফারসী, শ্যামল শস্যক্ষেত্রের স্থলে পীতাভ মরুভূমি, বিন্ধ্য-হিমাচলের পরিবর্তে সিনাই-আবু সিম্বেল, রামায়ণ-মহাভারতের স্থলে শাহনামা-আলিফ লায়লা ইত্যাদির ব্যবহারকে জোরপূর্বক চালু করার যে ব্যবস্থা করেছিলেন বা আজও করে চলেছেন তার সাথে এ দেশের মাটির কোন নাড়ীর যোগ নেই। এ কথার অর্থ এই নয় যে, ইউফ্রেটিস-টাইগ্রীসের কোন উল্লেখই কাব্য-কাহিনীতে করা উচিত নয়, বা আমাদের সাহিত্যে আরবী- ফারসী শব্দ ব্যবহার বন্ধ করা উচিত অথবা শাহনামা-আফিল লায়লা ইত্যাদি বাদ দিয়ে শুধু রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে পড়ে থাকলেই আমাদের চলবে। কথাটা আসলে তা নয়। এর আসল অর্থ হলো যা কিছুর সাথে মাটির যোগাযোগ এবং সংস্পর্শ আছে তাহাকে বাদ দিলে চলবে না। উপরন্তু তারই ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে রস সংগ্রহ করতে হবে পৃথিবীর সকল দেশের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির থেকে। রামায়ণ-মহাভারতের মতোই শাহনামাতে যে সব চরিত্র, কাহিনী এবং কাল্পনিক ঘটনার বর্ণনা আছে তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তা সেই বলে ইরানীরা শাহনামাকে বর্জন করেনি। এর সহজ কারণ শাহানামা ইরানী সংস্কৃতির ফসল। এভাবেই ইসলামপূর্ব এবং ইসলামী সংস্কৃতির ধারাকে ইরানীরা আজ পর্যন্ত রেখেছে নিরবচ্ছিন্ন।

বাঙলা দেশের লোকসাহিত্যিক এবং লোকশিল্পীরা এর গুরুত্বকে উপেক্ষা না করে সমস্যাটিকে যেভাবে সহজ করে এনেছিলেন তা নিঃসংশয়ে উল্লেখযোগ্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও শিক্ষিত সম্প্রদায় যে সাহিত্য সৃষ্টি করতে অগ্রসর হয়েছিলেন তার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেলেও তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রমেরও অভাব ছিল না। এই ব্যতিক্রমের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ মীর মশাররফ হোসেন এবং তাঁর ‘বিষাদসিন্ধু’। এ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাঙলা দেশে বাঙলা সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের দান সম্পর্কে যদি স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা চলে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে স্থান, অন্যদিকে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ প্রণেতা মীর মশাররফ হোসেনের স্থান ঠিক অনুরূপ। এ দেশের মুসলমান সমাজে তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্য শিল্পী এবং এখন পর্যন্ত তিনিই প্রধান সাহিত্যশিল্পী হইয়া আছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘সীতার বনবাস’ বাঙলাদেশের ঘরে ঘরে যেমন এককালে পঠিত হইয়াছিল, ‘বিষাদ-সিন্ধু’ তেমনই আজও পর্যন্ত জাতীয় মহাকাব্যরূপে বাঙ্গালী মুসলমানদের ঘরে ঘরে পঠিত হয়; বাঙলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ হিসাবে সকল সমাজেই এই গদ্য কাব্যখানির সমান আদর। আর একটি কথা আজ তাঁহার সম্পর্কে আমাদের স্মরণীয় – তিনি জীবন এবং সাহিত্যে সকল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন, হিন্দু মুসলমান বঙ্গমাতার এই দুই বিবদমান সন্তানের মিলন-সাধনের জন্য আজীবন চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সাহিত্য-প্রতিভা এমনই উচ্চশ্রেণীর ছিল যে, সুদূর অতীতের কারবালা-প্রান্তরের ট্রাজেডীকে তিনি সমগ্র বাঙলা ভাষাভাষীর ট্রাজেডী করিয়া তুলিতে পারিয়াছেন। দুঃখের বিষয় বাঙলাদেশের এই প্রতিভাবান সাহিত্যিককে আজ আমরা নামে মাত্র চিনি, তাঁহার জীবনীর এবং জীবনের সকল কীর্তির পরিচয় তাঁহার স্ব-সমাজের লোকও রাখেন না। [১]

[১. সাহিত্য সাধক চরিতমালা ২৮-২৯, দ্বিতীয় খণ্ড; পৃ. ৪৪-৪৫]

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে যে কথা বলেছেন নজরুল ইসলাম সম্পর্কে সে একই কথা প্রযোজ্য। মীর সাহেব যেমন বিষাদ-সিন্ধু সমগ্র বাঙলা ভাষা-ভাষীর ট্রাজেডী করে তুলেছিলেন নজরুল ইসলামের সৃষ্ট সাহিত্যও তেমনি সকল সমাজে এখনো সমানভাবে আদৃত। এবং মীর মশাররফ হোসেনের মতো নজরুল ইসলামেরও জীবনীর, জীবনের সকল কীর্তির এবং সমগ্র সাহিত্য সাধনার সাথেও পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের সন্তোষজনক পরিচয় নেই। সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব আজ তাঁদের সাহিত্য-সাধনার সাথে সাধারণ লোকের পরিচয়ের পথে এক মস্ত বাধাস্বরূপ।

মুসলমান আরবেরা তাঁদের পূর্ববর্তী যুগকে তমসার যুগ বলে বর্ণনা করলেও সেই তমসার যুগের আরবী সাহিত্যকে ইসলামের নামে তাঁরা বর্জন করেননি। ইউরোপে খৃষ্টানরাও গ্রীকল্যাটিন সংস্কৃতিকে বাতিল করেননি বাইবেল-বিরোধী বলে। ‘জ্ঞানার্জনের জন্য চীনে যাও’–হজরত মুহম্মদের এই বাণীকে জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে ইসলামী ঔদার্যের প্রমাণ হিসাবে উদ্ধৃত করলেও নিজেদের বাস্তব জীবনক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বাঙালী মুসলমানেরা যে কূপমণ্ডুকতার পরিচয় দেন তার দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, সে বাণীর প্রতিও তাঁদের কোন আন্তরিক শ্রদ্ধা নেই। সবকিছুর সাথে সেটাও তাঁদের শ্রেণীস্বার্থের পদানত। এজন্যই তাঁরা ইসলামের দোহাই দিয়ে প্রচার করেন যে রামায়ণ, মহাভারত বা গীতগোবিন্দ পড়লে অথবা তার থেকে সাহিত্যিক প্রেরণা লাভ করলে মুসলমানদের জাত যায়, তাদের ধর্মনাশ হয়।

পাঁচ

আঞ্চলিক এবং ধর্মীয় পার্থক্যের পর এবার ভাষার কথা বিবেচনা করা চলে। একই দেশের, একই ধর্মাবলম্বী এবং একই আর্থিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত লোকদের মধ্যে ভাষার প্রভেদ থাকলে সেটা তাদের সংস্কৃতিকে কিভাবে গঠন করে সেটা এক্ষেত্রে দেখা দরকার। এজন্য ইংরেজী এবং ফরাসীভাষী দুজন মধ্যবিত্ত ক্যানাডীয়ানের অথবা জার্মান, ফরাসী এবং ইতালিয়ানভাষী তিনজন সুইসের তুলনামূলক বিচার করা যায়। ভাষার পার্থক্যের জন্য স্বভাবতঃই এক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, ফরাসীভাষী ক্যানাডীয়ানের সাথে ফরাসী সংস্কৃতির যোগ এবং ইংরেজীভাষী ক্যানাডীয়ানের সাথে ইংরেজী সংস্কৃতির যোগ এবং আত্মীয়তা তুলনায় অনেক বেশী। এই যোগাযোগ এবং আত্মীয়তা ইংরেজী এবং ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমেই প্ৰধানতঃ সম্ভব হয়েছে। জার্মান, ফরাসী এবং ইতালিয়ানভাষী সুইসদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। কিন্তু এই পার্থক্য সংস্কৃতিক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এমন একটা গুরুতর ব্যাপার নয় যার দ্বারা রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জীবনের ঐক্য বিপজ্জনকভাবে ব্যাহত হতে পারে। সে সম্ভাবনা দেখা দিতো একমাত্র তখনই যখন একে অন্যের ভাষাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা ও স্বীকৃতি না দিয়ে তাকে অবজ্ঞা এবং খর্ব করতে উদ্যত হতো। যে প্রচেষ্টার অভাবে শুধুমাত্র ভাষার স্বাতন্ত্র্য সাংস্কৃতিক চরিত্রকে একটা বৈশিষ্ট্য এবং স্বাতন্ত্র্য দান করলেও মানুষের জীবনে সেটা কোন নিদারুণ সাংস্কৃতিক সংকট অথবা রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ সৃষ্টি করতে কখনই সম্ভব হয় না।

ছয়

সর্বশেষে সংস্কৃতিক্ষেত্রে আর্থিক অবস্থার পার্থক্যের কথা আলোচনা করা যেতে পারে। একই দেশবাসী, একই ধর্মাবলম্বী এবং একই ভাষাভাষী দুইজন মানুষের আর্থিক জীবন স্বতন্ত্র হলে সেই স্বাতন্ত্র্যের দ্বারা তাদের সংস্কৃতি কতখানি ভিন্নভাবে গঠিত হয় এক্ষেত্রে সেটা দেখা দরকার। এই প্রসঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের একজন উচ্চশিক্ষিত সুপ্রতিষ্ঠিত মুসলমান এবং একজন দারিদ্র্যক্লিষ্ট মুসলমান আধিয়ার অথবা বর্গাদারের সংস্কৃতির তুলনামূলক বিচার অনেকখানি সহায়ক হবে। এই বিশ্লেষণের ফলে দেখা যাবে যে, জীবনযাত্রার পদ্ধতি এবং জীবনকে উপভোগ করার সামগ্রী থেকে শুরু করে দৃষ্টিভঙ্গী পর্যন্ত প্রায় সব কিছুর মধ্যেই এদের আকাশ পাতাল গরমিল এবং অনৈক্য সর্বস্তরে বিরাজমান। শুধু তাই নয়। আর্থিক জীবনের ব্যবধান তাদের ধর্ম এবং ভাষার ঐক্যকে অনেকাংশে বিনষ্ট এবং বিলুপ্ত করতে উদ্যত।

পূর্ব পাকিস্তানের একজন মুসলমান বর্গাদার এবং একজন উচ্চ মধ্যবিত্ত মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনের ঐক্য এবং মিল কতখানি? তাদের আহার ভিন্ন। একদল সাধারণ ডালভাত খায় এবং সে খাওয়ার মধ্যে সারা বছরে কোন বৈচিত্র্য থাকে না। কিছু থাকলে সেটা বছরের অনেকগুলি দিনে ডালভাত না জোটার বৈচিত্র্য। অন্যদিকে অবস্থাপন্ন লোকটির খাদ্যাভাব নেই। নানা ব্যঞ্জনময় আহার তার সকাল সন্ধ্যা এবং তার মধ্যে আবার নিত্যনোতুন বৈচিত্র্য। পরিধানের বেলাতেও সেই একই কথা। একজন একবস্ত্রে বছর কাটিয়ে দিচ্ছে কিন্তু অন্যজনের বেশভূষায় বাহারের অন্ত থাকছে না। শুধু তাই নয়। তাদের বেশভূষাও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। একজন লুঙ্গী পরেই ঘরে বাইরে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু লুঙ্গী পরে অন্যজন বাইরে গেলে মানহানির সম্ভাবনা।

জীবন উপভোগের অন্যান্য উপকরণের ক্ষেত্রে তাদের পার্থক্য আরও নগ্ন আকার ধারণ করে। একজনের জীবনে সত্য অর্থে উপভোগ বলে কিছু নেই। হয়তো লোকশিল্পের কল্যাণে সে বিনামূল্যে যাত্রা দেখে অথবা কবিগান শোনে। কিন্তু সে সুযোগও তার জীবনে অতিশয় সীমাবদ্ধ। জীবন তার কাছে মোটামুটি সমস্যাসঙ্কুল, বৈচিত্র্যহীন, বিস্বাদ। কিন্তু অন্যজনের কাছে জীবন বিস্বাদ নয়। পৃথিবী এবং সমাজ থেকে রস শোষণ ও সংগ্রহ করার বিবিধ আয়োজন তার আয়ত্তগত। সেখানেও অন্তহীন বৈচিত্র্য। প্রায় সব কিছুই অর্থের বশবর্তী এবং অর্থের তার অভাব নেই।

এসব কারণেই দেখা যায় যে, শব্দ ব্যবহারের মধ্যেও এ দুই শ্রেণীর লোকের মধ্যে তফাৎ অনেক। এদের একে যে সকল শব্দ অহরহ ব্যবহার করছে অন্যে সে সকল শব্দ কোন দিন শোনেও নি। এই পার্থক্যের মূল কারণ এদের জীবন যাপন ও উপভোগের পদ্ধতি এবং উপকরণসমূহের পার্থক্য। সমৃদ্ধিশালী বাঙালী মুসলমান নিজের বাড়ীতে যে ঘরোয়া কথাগুলি ব্যবহার করছে তার সাথে একজন বাঙালী মুসলমান বর্গাদারের ঘরোয়া কথার পর্যন্ত কোন মিল নেই। একজন প্রতিদিনই রুটি-মাখন, স্যুট-টাই, ফ্রিজ-সোফা, সিনেমা-থিয়েটার ইত্যাদি কত শব্দেরই ব্যবহার করছে, যেগুলো ব্যবহারের কোন প্রশ্ন অন্য জনের ক্ষেত্রে ওঠেই না। কাজেই দেখা যাবে যে, তারা উভয়ে যে সমস্ত আরবী ফারসী উদ্ভূত ‘মুসলমানী’ শব্দগুলো ব্যবহার করছে তাদের সংখ্যা পানি, নামাজ, রোজা, দোয়াদরুদ, মসজিদ, জানাজা, কবর, ফতোয়া ইত্যাদি মাত্র কয়েকটি শব্দের মধ্যেই নিঃসন্দেহে সীমাবদ্ধ। একটু লক্ষ্য করলেই আরও দেখা যাবে যে, এগুলি প্রায় সবই ধর্মীয় আচার – অনুষ্ঠান ক্রিয়াকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দ। এর বাইরে বৃহত্তর জীবনে ধর্মের কোন প্রভাব উভয়ের সংস্কৃতিক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যদি উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালী মুসলমানটি ধর্মের প্রতি নিতান্তই উদাসীন থাকেন তাহলে এই যৎসামান্য ঐক্যটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না। শ্রেণীবৈষম্য দুইজনের সংস্কৃতিকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে করে দ্বিধাবিভক্ত।

সাত

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যে কোন সংস্কৃতি আসলে অবিভাজ্য হলেও বিভিন্ন ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে তাকে অনেকভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা চলে। এবং তার সাথে এ কথাও বোঝার অসুবিধা নেই যে, সব রকম শ্রেণী বিভাগের গুরুত্ব সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমান নয়। জীবনের সাথে যে জিনিসের যোগ যত গভীর ও নিবিড় তার ভিত্তিতে সংস্কৃতিকে বিচার করলে সে বিচারের যতখানি তাৎপর্য অন্য ধরনের বিচারের ঠিক ততখানি নয়। এ কথা বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার। কারণ এ বিষয়ে গাফলতি হলে শুধু যে নিজের বুদ্ধিই বিপথগামী হয় তা নয়, সে বিপথগামী বুদ্ধির দ্বারা সংস্কৃতিই বিপন্ন হয়।

বাঙলাদেশে সংস্কৃতির আলোচনা – প্রসঙ্গে তাকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করার প্রবণতা সব সময়ে এত বেশী প্রবল থেকেছে যে, অন্য কোনভাবে তাকে দেখার প্রশ্ন তেমন ওঠে নি। কোন কোন ক্ষেত্রে সে আলোচনার সূত্রপাত হলেও তার গুরুত্বকে আমলে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ তেমনভাবে দেখা যায় নি। কাজেই বাংলার সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতি এবং মুসলিম সংস্কৃতি এই দুই ভাগে বিভক্ত করে দেওয়াল তোলার প্রচেষ্টা হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে, বিশেষতঃ মুসলমানদের মধ্যে, যথেষ্ট সক্রিয় ছিল এবং এখনো আছে।

এজন্যই দেখা যায় ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙলা সাহিত্যের চর্চা যখন নতুন উৎসাহে শুরু হলো তখন ফোর্ট উইলিয়ামী হিন্দু পণ্ডিতেরা বাঙলা ভাষাকে তার পূর্ববর্তী দেশীয় ভিত্তি থেকে বিচ্যুত করে চেষ্টা করলেন তার মধ্যে কৃত্রিমভাবে বহু সংস্কৃত শব্দ আমদানি করে তাকে সংস্কৃতের খাঁচায় বন্দী করতে। বন্দীদশাপ্রাপ্ত সে যুগের বাঙলা ভাষা নানা অলঙ্কারে সুশোভিত হলেও তার প্রাণ – ঐশ্বর্য অনেকখানি খর্ব হলো। কিন্তু বাঙলা ভাষার এ দুরবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হলো না। “শবপোড়া মড়াদাহের দল” সংস্কৃতের খাঁচা ভেঙে নবজীবন দান করলেন বাঙলা ভাষাকে। যাঁরা তথাকথিত হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্গঠনের চিন্তায় বিভোর ছিলেন তাঁরাও এর গতিকে রোধ করতে সমর্থ হলেন না। উপরন্তু এগিয়ে এলেন বাঙলার বৃহত্তর এবং লৌকিক জীবনের সাথে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের সংযোগ সাধন করতে।

ধর্মচেতনার ফলে মুসলমানরাও এইভাবে বাঙলা ভাষাকে আরবী ফারসীর চোগা চাপকান পরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অনেক পরের কথা। কারণ ঊনিশ শতকে বাঙলা দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত এবং অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা বাঙলাকে নিজেদের ভাষা বলে বিবেচনা করতেই প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা সাধ্যমত উর্দু ফারসীতে কথা বলতেন এবং বাঙলা ভাষার চর্চা থেকে বিরত থাকতেন। এক্ষেত্রে তাঁদের আংশিক মোহমুক্তি ঘটতে সময় লাগলো অনেক এবং তারপর যখন তাঁরা অনেকে বাঙলা লেখাপড়ার প্রতি কিছুটা আগ্রহশীল হলেন তখন কারো কারো চেষ্টা হলো বাঙলা ভাষাকে মুসলমানী চরিত্র দান করার। হিন্দুরা যেমন সংস্কৃতের দিকে ঝুঁকেছিলেন এসকল মুসলমানেরাও তেমনি বাঙলা চর্চাকালে ঝুঁকলেন আরবী ফারসী এবং উর্দুর দিকে। ব্যাকরণের কাঠামোকে কোনরকমে খাড়া রেখে তথাকথিত মুসলমানী অর্থাৎ আরবী ফারসী শব্দের সম্ভারে বাঙলা ভাষাকে অলঙ্কৃত করার জন্য তাঁদের চেষ্টা এবং উদ্বেগের অবধি রইলো না। তাঁদের হাতে বাঙলা ভাষা আবার বন্দী হলো। আরবী ফারসীর নোতুন খাঁচায়। ধর্মীয় এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবসৃষ্ট এই প্রচেষ্টা হিন্দুদের পূর্ব প্রচেষ্টার মত ব্যর্থ হতে শুরু হলেও তার অবসান এখনো ঘটে নি। হিন্দুরা আজ সংস্কৃত – উদ্ভূত অসংখ্য শব্দ ব্যবহার করলেও জোর করে সে প্রচেষ্টা চালু রাখার কোন প্রবণতা তাঁদের মধ্যে আর নেই। বস্তুতঃ বহু দিন পূর্বেই তার শেষ হয়েছে। এখন তাঁদের তৎসম শব্দ ব্যবহারের মধ্যে নৈপুণ্য আছে এবং সৃষ্টিশীলতা তার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় না। শুধু হিন্দুরাই নয়। মীর মশাররফ হোসেন থেকে শুরু করে মৌলানা আকরম খাঁ এবং তাঁদের উত্তরসূরী মুসলমানেরাও অনেকে এ জাতীয় শব্দসমূহের নিপূণ ব্যবহার পূর্বেও করেছেন এবং এখনো করছেন। সমসাময়িক যুগের শিক্ষিত এবং উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের মতো বাঙলা ভাষা চর্চা থেকে বিরত না হয়ে মীর মশাররফ হোসেন বাঙলা সাহিত্যের উন্নতিসাধনে যত্নবান হওয়ায় বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করে ‘বঙ্গদর্শনে’ লেখেন,

তাঁহার রচনার ন্যায়, বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না। ইহার দৃষ্টান্ত আদরণীয়। বাঙ্গালা, হিন্দু মুসলমানের দেশ – একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু মুসলমান এক্ষণে পৃথক – পরস্পরের সহিত সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গালার প্রকৃত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দু মুসলমানে ঐক্য জন্মে। যতদিন উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমত গর্ব থাকিবে যে, তাঁহারা ভিন্নদেশীয়, বাঙ্গালা তাঁহাদের ভাষা নহে, তাহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু ফারসীর চালনা করিবেন, ততদিন সে ঐক্য জন্মিবে না। কেন না, জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা। অতএব মীর মশাররফ হুসেন সাহেবের বাঙ্গালা ভাষানুরাগিতা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় প্রীতিকর। ভরসা করি, অন্যান্য সুশিক্ষিত মুসলমান তাঁহার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইবেন। [২]

[২. সাহিত্য সাধক চরিতমালা ২৮-২৯, দ্বিতীয় খণ্ড; পৃ ৩৫]

মুসলমান সমাজে বাঙলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র বর্ণিত অবস্থা আজ আর নেই। কিন্তু অবস্থার অনেক পরিবর্তন সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী মহলে এবং বেতার ও অন্যান্য সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আজও বাঙলা ভাষাকে আরবী ফারসী উর্দুর খাঁচায় আবদ্ধ রাখার আয়োজন অব্যাহত আছে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য আমাদের দেশে তাই তখনো এই কৃত্রিম কেরামতির দৌরাত্ম্যে আড়ষ্ট, বিবর্ণ এবং মৃতকল্প।

কিন্তু এই দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য তার স্বকীয় মহিমায় পূর্ব বাঙলার আলো, হাওয়া, মাটি এবং জীবনের সাথে নিবিড় যোগসূত্রে গ্রথিত হয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে যে আপন আলোকে উদ্ভাসিত করবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। দীনেশচন্দ্র সেন এ প্রসঙ্গে বলেন,

এক সময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ অতিকায় সংস্কৃত শব্দ বাঙ্গালা সাহিত্যে আমদানি করিয়া এই ভাষার পর্ণকুটীরকে ঐরাবতশালায় পরিণত করিয়া হাস্যাস্পদ হইয়া পড়িয়াছিলেন। সেই ভাবে আরবী ফারসীর পণ্ডিতগণ উক্ত দুই ভাষার অপর্যাপ্ত ও অবৈধ শব্দ প্রয়োগ দ্বারা এখনও মুসলমানী বাঙ্গালা নামক একটা উদ্ভট সামগ্রীর সৃষ্টি করিতেছেন। বস্তুতঃ মুসলমানী বাঙ্গালা ও পণ্ডিতী বাঙ্গালা, ইহাদের কোনটাই বাঙ্গালার স্বরূপ নহে, উহারা আমাদের ভাষার বিদ্রূপ ও একান্ত পরিহার্য। ভাষা জিনিসটা পণ্ডিত বা মোল্লার হাতের মোরব্বা নহে। দেশের জলবায়ু ও আলোকে ইহা পুষ্ট হইয়া থাকে। ইহা স্বীয় জীবন্ত গতির পথে, ইচ্ছাক্রমে বর্জন ও গ্রহণ করিয়া চলিয়া যায়, স্বীয় ললাটলিপিতে কোন শিক্ষকের ছাপ মারিয়া পরিচিত হইতে চায় না।[৩]

[৩. ময়মনসিংহ গীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৮: ভূমিকা দ্রষ্টব্য।]

একটি জিনিস কিন্তু এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সংস্কৃত, আরবী, ফারসী শব্দ নিয়ে বাকবিতণ্ডা এবং কূপমণ্ডুকতা বাঙলা দেশের মধ্যবিত্ত জীবনে যত প্রবল ছিল গ্রাম্যজীবনে ততখানি ছিল না। এজন্য দেখা যায় যে, লোককাহিনী এবং লোকগীতির ক্ষেত্রে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজের অনেক কবিই প্রায় সমান দক্ষতার সাথে হিন্দু – মুসলমান চরিত্র সৃষ্টি করেছেন এবং সমান নৈপুণ্যের সাথে প্রচলিত সংস্কৃত আরবী ফারসী শব্দের ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে এই সমস্ত লোকশিল্পীরা ধর্মগত জীবনযাপন করলেও মধ্যবিত্ত হিন্দু – মুসলমানের মতো তাঁরা ধর্মের দ্বারা আক্রান্ত হন নি। ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে শুরু করে বৈষ্ণবভাবাপন্ন অসংখ্য কবিতাই এই বক্তব্যের সত্যতাকে প্ৰমাণ করে। দীনেশচন্দ্রের ভাষায়,

ময়মনসিংহ-গীতিকায় আমরা বাঙ্গালা ভাষার স্বরূপটি পাইতেছি। বহু শতাব্দীকাল পাশাপাশি বাস করার ফলে হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা। এক্ষেত্রে জাতিভেদ নাই। এই ময়মনসিংহ গীতিকায় উর্দু উপাদান ততটা ঢুকিয়াছে, যতটা প্রকৃতপক্ষে এদেশে আসিয়া বাঙ্গালা হইয়া গিয়াছে। এই গীতিসাহিত্য হিন্দু মুসলমান উভয়ের, এখানে পণ্ডিতগণের রক্তচক্ষে শাসাইবার কিছু নাই। লেখকদের মধ্যে হিন্দুও যতটি, মুসলমানও ততটি। এই সাহিত্য আবার হিন্দু নায়ক, মুসলমান নায়িকা, এবং মুসলমান নায়ক ও হিন্দু নায়িকা পাইতেছি। প্রকৃত ঘটনা কবিরা যাহা শুনিয়াছেন, তাহাই অনেক সময়ে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।[৪]

[৪. ময়মনসিংহ গীতিকা, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।]

লোকসাহিত্যের এই চরিত্রের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবিদের প্রসঙ্গে একজন উল্লেখযোগ্য গবেষক বলেন, গঙ্গা যমুনা ধারার মত এই যুগ্ম ধার একই ব্যক্তির জীবনে ও কাব্যে মিলিত হইয়াছে। দেশভেদ, জাতিভেদ, ধর্মভেদ ও যুগভেদ এই ভেদচতুষ্টয় সত্ত্বেও যে স্থলে একের প্রভাব অন্যের উপর পূর্ণমাত্রায় পতিত হইয়াছে দেখা যাইতেছে, সেস্থানে ভারতীয় মুসলমানদের খানিকটা হিন্দুভাবে ভাবিত হওয়া আশ্চর্যজনক মনে করিব কেমন করিয়া? এক্ষেত্রে দেশভেদ, জাতিভেদ ও যুগভেদের প্রশ্ন উঠে না, ধর্মভেদ মাত্র রহিয়াছে। অনুরূপভাবে হিন্দুরাও মুসলমান সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসিয়া অনেকখানি প্রভাবান্বিত হইয়াছেন সন্দেহ নাই, এবং ইহা খুব স্বাভাবিকও বটে।[৫]

[৫. শ্রী যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, বাঙ্গালার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬২ পৃ. ৫]

কাজেই ধর্মের নামে হিন্দু মুসলমান মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক জীবনে ঊনিশ শতক থেকে যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব কলহ এবং উৎপাতের সূত্রপাত হয়েছে এবং আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে সেগুলি ওহাবী প্রভাব সত্ত্বেও বাঙলা দেশের গ্রাম্য-জীবন ও লোকসাহিত্যকে তেমনভাবে স্পর্শ করে নি। এ সংক্রমণ বিশেষভাবে কার্যকরী হতে শুরু করে বর্তমান শতকের প্রথম থেকে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের সাথে সাথে এবং মধ্যবিত্ত রাজনীতির অপরিহার্য প্রয়োজনে।

মধ্যবিত্ত হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের এবং ভাব বিনিময়ের অভাবঘটিত কারণে শক্তিশালী হিন্দু লেখকরা কোন সার্থক এবং উল্লেখযোগ্য মুসলমান চরিত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হন নি। মুসলমানদের পক্ষেও হিন্দু চরিত্র সৃষ্টি সম্ভব হয় নি। কিন্তু মধ্যবিত্তের পক্ষে যা ছিল অসাধ্য সে কার্যই অনায়াসে সাধন করেছিলেন বাঙলাদেশের লোকশিল্পীরা। কারণ এ কার্যের জন্যে জীবনে জীবন যোগ করার প্রয়োজন অপরিহার্য এবং এ সংযোগ মধ্যবিত্ত জীবনে সম্ভব না হলেও গ্রাম্য-জীবনে অনেকখানি সম্ভব হয়েছিল। সৃষ্টিশীলতা এবং সাহিত্যবিচারের দিক দিয়ে মধ্যবিত্ত-সৃষ্ট সাহিত্য অনেক শ্রেষ্ঠতর হলেও বাঙলা দেশের লোকসাহিত্য এজন্যেই তর্কাতীতভাবে হিন্দু মুসলমানের সাধারণ সৃষ্টি এবং সাধারণ সম্পদ।

আট

মুসলমানেরা যখন ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন তখন থেকে মোগল যুগের সায়াহ্ন পর্যন্ত আমীর, ওমরাহ, উচ্চপদস্থ ফৌজী কর্মচারী এবং উচ্চশ্রেণীর অন্যান্য মুসলমানেরা অধিকাংশই ছিলেন আরবী, ইরানী, তুর্কী এবং মধ্য-প্রাচ্যের অন্য সব এলাকার অধিবাসী অথবা তাঁদের বংশধর। তাঁরা সাথে করে এনেছিলেন তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং সেই সংস্কৃতির চর্চা এবং পরিচর্যা তাঁদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সংস্কৃতি মুসলিম রাজদরবারে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয় লাভ করে অনেকাংশে সমর্থ হয়েছিল নিজের একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে। কিন্তু এই পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও মুসলমান বাদশাহ, সুলতান এবং অন্যান্য রাজপুরুষদের মধ্যে আকবরের মতো কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় কারণে এদেশীয় সংস্কৃতির সাথে বিদেশাগত আমীর ওমরাহদের সংস্কৃতির কিছুটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ছিল নিতান্তই দুর্বল, অক্ষম এবং অস্থায়ী। কাজেই উঁচুতলার আমীর ওমরাহ নবাব-বাদশার সংস্কৃতির সাথে এদেশীয় সংস্কৃতির তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সংযোগ অথবা সমন্বয় সাধিত হয় নি। মোগল রাজদরবারে যে সমস্ত রাজপুত এবং হিন্দুদের প্রতাপ ও আধিপত্য ছিল তাঁরা ফারসী ভাষা এবং দরবারের সংস্কৃতির দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হওয়ার ফলে হিন্দু-মুসলমান রাজপুরুষদের মধ্যে কিছুটা ঐক্য এবং সামঞ্জস্য স্থাপিত হলেও সে ঐক্য এবং সামঞ্জস্য ছিল বাহ্যিক। এর প্রধান কারণ মোগল দরবারের সংস্কৃতি মোটামুটিভাবে ছিল ইরানী প্রভাবের দ্বারা গঠিত যার সাথে রাজপুত এবং হিন্দুদের কোন আন্তরিক আত্মীয়তা স্থাপন কিছুতেই সম্ভব ছিল না। বাঙলাদেশের গৌড়ীয় সুলতানেরা বাঙলা ভাষাচর্চায় উৎসাহ দান ইত্যাদির মাধ্যমে লোকসংস্কৃতির উন্নতিতে কিছু সহায়তা করলেও বাঙলা তাঁদের নিজেদের ভাষা ছিল না এবং তাঁরা সে ভাষাচর্চাও করতেন না। তাঁদের সমস্ত প্রয়াসই এক্ষেত্রে বাহ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

সুতরাং এই সমস্ত উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা যে সংস্কৃতি চর্চা করতেন তার মধ্যে আরবী- ইরানী-তুর্কী প্রভাবই ছিল মুখ্য। এবং এই সংস্কৃতির সাথে বাঙলাদেশের অগণিত সাধারণ মুসলমানের কোন যোগ ছিল না। যোগাযোগের এই অভাবের প্রধান কারণ দু’টি। প্রথমতঃ শ্রেণীবৈষম্য এবং দ্বিতীয়তঃ জাতিবৈষম্য। মুসলিম যুগে এ দুইই ছিল ঘনিষ্ঠ সূত্রে আবদ্ধ।

ভারতবর্ষের বিপুল সংখ্যক মুসলমান, যাঁরা শত শত বছর ধরে এদেশে বসবাস করে আসছেন, তাঁরা অথবা তাঁদের পিতৃপুরুষেরা আরব-ইরান-তুর্কী থেকে আসেন নি। তাঁরা এ দেশের মানুষ। এবং নীচুতলার মানুষ। বর্ণহিন্দু জমিদার এবং শোষকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা ইসলাম ধর্মের সামাজিক ঔদার্য এবং ভ্রাতৃত্বের মধ্যে মুক্তি সন্ধান করেছিলেন। এই ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষ, বিশেষতঃ সিন্ধুপ্রদেশ এবং বঙ্গদেশে, ছিলেন বৌদ্ধ। এই সকল মুসলমানেরা হিন্দু সমাজে ‘নেড়ে’ নামে অভিহিত হতেন। মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধদের থেকেই এই নামকরণের উৎপত্তি। এই সমস্ত বৌদ্ধ এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বর্ণাশ্রমের বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন। কিন্তু ধর্মান্তরের ফলে সে বন্ধন ছিন্ন হলেও আর্থিক জীবনে শ্রেণীর বন্ধন তাঁরা ছিন্ন করতে পারেন নি। কাজেই শেষ পর্যন্ত ধর্মান্তরের ফলে ঈপ্সিত মুক্তিও তাঁদের সন্তোষজনকভাবে আসে নি।

এজন্যে দেখা গেল যে, মোগল রাজদরবারের সাংস্কৃতিক প্রভাব সত্ত্বেও উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সংস্কৃতির সাথে ভারত বর্ষের উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের সংস্কৃতির গরমিল যত বেশী ছিল নিম্নশ্রেণীর হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সেটা ছিল না। তাদের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক অনৈক্য ছিল তুলনায় অনেক গৌণ। সামান্য কিছু ধর্মীয় আচার – অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোন পার্থক্য তাদের ক্ষেত্রে নির্দেশ করা রীতিমতো মুস্কিল। এমন কি ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রেও বিশুদ্ধ ইসলামের তৌহিদবাদ বলতে যা বুঝায় তার চিহ্ন এই সমস্ত নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের ক্ষেত্রে ছিল অনুপস্থিত। বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে সত্য। কারণ লৌকিক ইসলাম হিন্দু ধর্ম এবং বাঙালী সংস্কৃতির প্রভাবে একটা নোতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিলো। এজন্যে দেখা যায় যে, এখানে অনেক ক্ষেত্রে একদিকে যেমন হিন্দুরা মুসলমান পীর-দরবেশের দরগায় দেবতাজ্ঞানে শিন্নী দিচ্ছেন, মানত করছেন; অন্যদিকে তেমনি মুসলমানেরাও কোন কোন ক্ষেত্রে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের সেবা করছেন এবং মনসা ইত্যাদি পূজা করছেন। এর কারণ ধর্মান্তরের পরও পূর্বসংস্কৃতি এবং সংস্কারের সাথে তাঁদের যোগাযোগ নষ্ট হয় নি. নিরবচ্ছিন্ন ছিল।

এইসবের ফলে দেখা যায় যে, বাঙলাদেশে এবং সারা ভারতবর্ষে কোন মুসলমান পরিবার যখনই নিম্ন অবস্থা উত্তীর্ণ হয়ে অর্থ-সামর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন তখনই তাঁদের মধ্যে দেখা দেয় নিজেদেরকে বিদেশাগত আরবী, ইরানী, তুর্কী পূর্ব- পুরুষদের বংশধর বলে প্রচার করার প্রবণতা। এ দেশের উচ্চ-শ্রেণীর মুসলমানরা যে এদেশের মাটির মানুষ নয়, একথা যেন মুসলমানদের অন্তরে ভালভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। কাজেই কোন মুসলমান পরিবার যখনই নিম্ন অবস্থা থেকে আর্থিক এবং সামাজিক উন্নতির শিখরে আরোহন করতে থাকেন তখনই এ দেশের মাটির সাথে নিজেদের পরিচয়কে ছিন্ন করে তাঁরা নিজেদেরকে ঘোষণা করেন আরবী, ইরানী, তুর্কী, বাখী এবং বাদাখ্ শানী পূর্ব-পুরুষদের বংশধর বলে।

এই প্রচেষ্টার দ্বারা আসলে তাঁরা বলতে চান যে, মুসলমান হলেও তাঁরা ‘ছোট’ জাতের অথবা ‘নিম্ন’ শ্রেণীর মুসলমান নন, যাদের পূর্ব-পুরুষেরা নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধ ছিল। তাঁরা হচ্ছেন এমন এক শ্রেণীর মুসলমান যাঁরা জাতিগতভাবে পৃথক। নিম্ন এবং উচ্চশ্রেণীর মধ্যে এই ভেদজ্ঞানই একমাত্র কারণ যার জন্যে অর্থ প্রতিপত্তিশালী পরিবারের লোকেরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করেন এবং নামের শেষে সৈয়দ, খান, পাঠান, আনসারী, বোখারী, ইস্পাহানী, কাশগারী ইত্যাদি সংযোজন করে নিজেদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় মর্যাদা বৃদ্ধির প্রয়াস পান। এটাই একমাত্র কারণ যার জন্যে তাঁরা ভারত অথবা পাকিস্তানকে অন্তর থেকে নিজেদের স্বদেশভূমি বলে মনে করেননা এবং আরবী -ফারসীকে পাকিস্তানের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক ভাষা করার জন্যে সভা সমিতিতে আবেগময় বক্তৃতা দিতে কুণ্ঠা, সঙ্কোচ অথবা লজ্জা বোধ করেন না। মুসলিম সংস্কৃতির এই পতাকাবাহকেরা সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের মোহে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। তাই এ জাতীয় চিন্তার বিকৃতি এবং অসারতা তাঁদের দৃষ্টিগোচর হয় না। এবং হলেও অন্যান্য অনেক পার্থিব কারণে তাঁরা সে চিন্তাকে মুলতুবী রাখেন।

তত্ত্বগত ইসলামের কোন সমর্থন না থাকলেও ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জাতিভেদ নিঃসন্দেহে বর্তমান ছিল এবং এখনও আছে। এই ভেদজ্ঞান যে বহুলাংশে বর্ণাশ্রমের প্রভাবসৃষ্ট সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। আর্থিক শ্রেণীবিভাগের জন্যে মানুষে অনেক তফাৎ দেখা যায়, কিন্তু বর্ণাশ্রম শুধু আর্থিক জীবন ও জীবিকার উপরই সে ভেদজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করে নি। পরবর্তীকালে তাকে ধর্মীয় তত্ত্বের উপর দাঁড় করিয়ে মানুষ দাঁড় করিয়ে মানুষকে জন্মের ভিত্তিতে ছোটবড়, উচ্চনীচ বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামীতত্ত্বে এ জাতীয় ভেদাভেদের কোন কথা নেই। উপরন্তু সেখানে মানুষে মানুষে সাম্যের বাণীই প্রচার করা হয়েছে। উচ্চশ্রেণীর ভারতবর্ষী মুসলমানরা তাই একদিকে শ্রেণীবৈষম্য ও বর্ণাশ্রম এবং অন্যদিকে ইসলামের তত্ত্বগত শাসক এ দুইয়ের মধ্যে পড়ে ধীরে ধীরে এবং অর্ধসচেতনভাবে যে মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করলেন তার দ্বারা তাঁরা উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদেরকে অভারতীয় এবং নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদেরকে ভারতীয় নিম্নজাতিভুক্ত হিন্দুদের উত্তর পুরুষ বলে সিদ্ধান্ত করলেন। এর ফলেই দেখা গেল অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকদের মধ্যে নিজেদেরকে বিদেশী বলে জাহির করার প্রবণতা। এর থেকেই জন্ম নিল বাঙলাভাষার মধ্যে আরবী ফারসী শব্দ কৃত্রিমভাবে আমদানী করে তাকে ধর্মশালায় পরিণত করার তাড়না। শুধু তাই নয়, এর ফলেই দেখা গেল আরবী-ফারসীকে বিশেষতঃ ফারসীকে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ভাষার মর্যাদা দানের পক্ষে আকুল ওকালতী।[৬]

[৬. Dr. S. Sajjad Hussain,: ‘Education and Integration’ Pakistan Observer, April 6, 1967]

নয়

মুসলিম সংস্কৃতি বলতে অলীক বংশগৌরবসম্পন্ন মুসলমানেরা সব সময় নিজেদের শ্রেণীগত সংস্কৃতির কথাই চিন্তা করতেন এবং এখনো করে থাকেন। এ সংস্কৃতির মধ্যে ইসলামী তত্ত্ব অপেক্ষা আরবী-ইরানী-তুর্কী সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণের প্রভাবই ছিল অধিকতর শক্তিশালী। কাজেই ভারতবর্ষীয় মুসলমানদের সংস্কৃতির মধ্যে দুটি বিশেষ ধারা মুসলিম আমল এবং তার পরবর্তী ইংরেজ রাজত্ত্বেও সমানভাবে প্রচলিত ছিল। একটি নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের এ সংস্কৃতি মোটামুটিভাবে ভারতীয় প্রভাবে গঠিত এবং দেশের আলো হাওয়া মাটির সাথে সংযুক্ত। অন্যটি উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সংস্কৃতি, যার মধ্যে ভারতীয় অপেক্ষা অভারতীয় অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যীয় প্রভাবেরই অধিকতর প্রাধান্য। সুতরাং ভারতীয় মুসলমানদের সংস্কৃতি বলতে এমন কোন জিনিষ কোনকালেই ছিলনা যেটা এদেশীয় সকল শ্রেণীর মুসলমানের সাধারণ সংস্কৃতি। কিন্তু এ দুই শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে সুগভীর সংস্কৃতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও ভারতবর্ষের মুসলিম সংস্কৃতির কথা যখনই উত্থাপিত এবং আলোচিত হয়েছে তখনই তার দ্বারা যে সংস্কৃতির কথা বুঝানো হয়েছে সেটা অল্পসংখ্যক উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সংস্কৃতি, অগণিত নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের সংস্কৃতি নয়। এর কারণ খুবই সহজ। নিম্নশ্রেণীর লোকেরা আর্থিক, সামাজিক ইত্যাদি দিক থেকে পঙ্গু এবং অবহেলিত কাজেই তাদের সংস্কৃতির কথা কেউ কখনো গুরুতরভাবে বিবেচনা করেনি। উচ্চশ্রেণীর মুসলমানরা মুসলিম সংস্কৃতি বলতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সংস্কৃতির কথা চিন্তা করতেও প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁদের শ্রেণীগত ‘তাৰ্জীব’ ‘তমদ্দুন’ কেই তাঁরা এক করে দেখেছিলেন সমগ্র ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতির সাথে। এই সমস্ত শিক্ষিত এবং প্রতিপত্তিশালী উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের প্রচারণার দৌলতে সাধারণ আলোচনার ক্ষেত্রে মুসলিম সংস্কৃতি বলতে আরবী, ইরানী, তুর্কীও ভারতীয় সংস্কৃতির একটা উদ্ভট সংমিশ্রণই বোঝালো, যে সংমিশ্রণের মধ্যে বিদেশী প্রভাবই রইলো অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী। এবং এই বিদেশমুখী সংস্কৃতির সাথে এদেশীয় সংস্কৃতির স্বভাবতঃই দেখা গেলো অনেক পার্থক্য, দূরত্ব এবং অস্বাস্থ্যকর গরমিল।

দশ

এই মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণীবিভাগ ইংরেজ রাজত্বকালেও অক্ষুণ্ণ থাকলো। কারণ মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ফলে উচ্চশ্রেণীর আমীর ওমরাহ নবাব নাজিমদের পতন ঘটলেও তাঁরা সকলেই একেবারে নিশ্চিহ্ন হলেন না। তাঁদের অবস্থার অবনতি হলো এবং সবকিছুর মধ্যে একটা ক্ষয়িষ্ণুতা দেখা দিল। কিন্তু এসবের দ্বারা তাঁদের সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হলো না। উপরন্তু এই ক্ষয়িষ্ণুতার যুগে এ স্বাতন্ত্র্যকেই তাঁরা আঁকড়ে ধরলেন বেশী করে। তার মধ্যেই তাঁরা যেন জীবন্ত রাখার চেষ্টা করলেন নিজেদের স্বাজাত্য, নিজেদের অভিমান এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নকে। এই স্বাতন্ত্র্য, বোধের জন্যেই তাঁরা নিজেদেরকে বেশী করে তফাৎ করলেন ভারতীয় এবং নবাগত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির থেকে।

নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে যে উচ্চ শ্রেণীর লোকদের মত এত আপত্তি ছিল না তার অনেক প্রমাণ আছে। কিন্তু ইচ্ছা সত্ত্বেও তাঁরা সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নি প্রধানতঃ আর্থিক কারণে। এজন্যেই দেখা যায় যে, আর্থিক সুযোগ সুবিধা পেলে দরিদ্রশ্রেণীর মুসলমানরা ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণে বিশেষ কুণ্ঠা অথবা ঘৃণা বোধ করেন নি। ইংরেজী শিক্ষার বিরুদ্ধে যে অভিমান সেটা প্রায় সর্বতোভাবে, উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত এবং সেজন্যেই এদেশে সাধারণভাবে মুসলমানদের শিক্ষাগত অনগ্রসরতার দায়িত্ব তাদেরই সর্বাপেক্ষা বেশী।

ইংরেজী শিক্ষা না করার পশ্চাতে বিশুদ্ধ ধর্মীয় কারণ কিছুই ছিল না। কারণ নোতুন ভাষা অথবা নোতুন কোন দেশের সংস্কৃতির সাথে জ্ঞানের মাধ্যমে পরিচিত হওয়ার বিরুদ্ধে ইসলামের কোন তত্ত্বগত অনুশাসন থাকেনি। পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করলে মুসলমানদের ধর্মনাশ হবে অথবা সম্মান বিপন্ন হবে এই মিথ্যার জন্ম সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে। ইংরেজরা এদেশ দখল করার পর উচ্চশ্রেণীর মুসলমানরা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক সুযোগ- সুবিধা থেকে শ্রেণীগতভাবে বঞ্চিত হলো। দফতর আদালতে, বিশেষতঃ ফৌজী ব্যবস্থায় তাদের পূর্ব-কর্তৃত্বের অবসান ঘটলো। তাদের মাথার উপর বসলো ইংরেজ এবং পাশে দাঁড়ালো হিন্দু, শিখ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ভুক্ত ভারতীয়। অবস্থার এই পরিবর্তনকে তারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলো না। এবং স্বভাবতই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন আন্দোলন অথবা অভ্যুত্থানের দ্বারা এ অবস্থার অবসান ঘটাতেও তারা সমর্থ হলো না। সুতরাং তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত হলো সাংস্কৃতিক জীবনক্ষেত্রে। নিজেদের গৌরববোধ, স্বাজাত্য এবং সামন্ততান্ত্রিক অভিমানকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা নিজেদের চারিদিকে সৃষ্টি করলো নানান বাধার দেওয়াল। সৃষ্টি করলো এক সাংস্কৃতিক অচলায়তন, যে অচলায়তনের নাম মুসলিম সংস্কৃতি দিয়ে তারা উদ্যত হলো তার পরিচর্যা এবং স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে। কাজেই ধর্মের ভিত্তিতে সংস্কৃতিকে হিন্দু এবং মুসলমান সংস্কৃতিরূপে বিভক্ত করলেও তথাকথিত মুসলিম সংস্কৃতির সত্যকার পরিচয় নিহিত আছে ইসলামের মধ্যে নয়, সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে। অর্থাৎ মুসলিম সংস্কৃতি নামে পরিচিত সংস্কৃতিটির রূপচরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তার মধ্যে ইসলামের প্রভাব খুবই ক্ষীণ ও দুর্বল এবং মোগল যুগোত্তর ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবেরই জয়জয়কার।

এগারো

পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা প্রচলনের পূর্বে শ্রেণীগতভাবে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না। অর্থাৎ সকল শ্রেণীর মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষভাবে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু মুসলমানেরা যেমনভাবে নিম্নশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তেমনি উচ্চশ্রেণীর মধ্যেও তাঁদের উভয়ের প্রভাব-প্রতিপত্তির অভাব ছিল না। সে অভাব মুসলমানদের ক্ষেত্রে দেখা গেল মুসলমানদের পাশ্চাত্য শিক্ষা বর্জন এবং হিন্দুদের সেই শিক্ষা অর্জনের ফলে। মুসলমানরা থেকে গেলেন সামন্ততান্ত্রিক পর্যায়ে এবং শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য, চাকরীবাকরী ইত্যাদির মারফতে হিন্দুরা অনেকাংশ উত্তীর্ণ হলেন সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব। কাজেই ঊনিশ ও বিশ শতকে এই মুসলিম সংস্কৃতির চরিত্র রইলো অনেকখানি সামন্ততান্ত্রিক ও মধ্য প্রাচ্যীয় প্রভাব নিয়ন্ত্রিত ও পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় প্রভাব দ্বারা গঠিত। এই হিন্দু সংস্কৃতিও বাঙলাদেশের এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সকল শ্রেণীর হিন্দু সংস্কৃতি ছিল না। তারও শ্রেণীচরিত্র এ সংস্কৃতিকে বিশেষ এক গণ্ডীর মধ্যে রেখেছিল সীমাবদ্ধ করে। এ সংস্কৃতির সাথে তাই এ দেশের অগণিত নিম্নশ্রেণীর হিন্দুর কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল না। সুতরাং এই তথাকথিত মুসলিম সংস্কৃতি এবং হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে যে তফাৎ আছে সেটা শুধু ধর্মগত নয়। এ পার্থক্যের শ্রেণী এবং দেশচরিত্র তার ধর্মচরিত্রের থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। উভয় সংস্কৃতির পার্থক্যের এই দিকটিকে আলোচনাকালে সব সময় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয় এবং তার জন্যে এ দুইয়ের সত্যকার চরিত্র ও তাদের ব্যবধানের দূরত্বেরও সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব হয় না।

উভয় সংস্কৃতির এই পার্থক্যই অন্যতম কারণ যার জন্যে ঊনিশ শতকে হিন্দু মধ্যবিত্তের উত্থান শুরু হলেও মুসলমান সম্প্রদায় সেদিক থেকে অনেকখানি পিছিয়ে রইলো। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আদান-প্রদান লেনদেনের অভাবও ঘটলো যতখানি ধর্মগত কারণে তার থেকে অনেক বেশী শ্রেণীগত কারণে। নবোখিত হিন্দু মধ্যবিত্তের পক্ষে সাহিত্য সংস্কৃতি সভাসমিতি এবং জীবনের বিস্তীর্ণ কার্যক্ষেত্রে মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা আর হয়ে উঠলো না। কারণ এক দিকে অশিক্ষা ও সামন্ততান্ত্রিক চিন্তার দ্বারা আড়ষ্ট হয়ে মুসলমানরা নিজেদের চতুর্দিকে একটা ব্যূহ রচনা করলো এবং হিন্দুদেরকে সুবিধাবাদী ইত্যাদি বলে গালাগালি দিয়ে নির্মাণ করলো এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় জীবনদর্শন। অন্যদিকে নোতুন সুযোগ-সুবিধার দুনিয়া নিজেদের সামনে উন্মুক্ত হলে হিন্দুরা তাকে প্রত্যাখ্যান করলো না। অবশ্য নোতুন যুগ সূচনার সাথে পুরাতন যুগের এবং ব্যবস্থার অবসানে তাঁরা কেউই যে বিষাদগ্রস্ত হলেন না তা নয়। কিন্তু সে বিষাদ তাঁদের পক্ষে স্বভাবতঃই হলো ক্ষণস্থায়ী এবং পরিবর্তিত অবস্থার দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে তাঁরা নির্ধারণ করলেন যুগোযযোগী নোতুন কর্মপন্থা। দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্রের উক্তির মধ্যে এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি নিজে ফারসী ভাষা ও সাহিত্যে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন এবং তার প্রতি তাঁর প্রভূত দুর্বলতা ছিল। তাই ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী সরকারী অফিস আদালত ইত্যাদির ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি আত্মজীবনচরিতে লেখেন,

বাঙ্গালীর পক্ষে পারস্য একরূপ অকর্মণ্য হইল, এবং ইহার আদর এককালে উঠিয়া গেল। বহু যত্নের ও শ্রমের ধন অপহৃত হইলে, অথবা উপার্জনক্ষম পুত্র হারাইলে যেরূপ দুঃখ হয়, সেইরূপ দুঃখ এই সংবাদে আমাদের মনে উপস্থিত হইল। অনেক পরিশ্রমপূর্বক যে কিছু শিখিয়াছিলাম তাহা মিথ্যা হইল এবং বিদ্বান বলিয়া যে খ্যাতিলাভের আশা ছিল, তাহা নির্মূল হইয়া গেল। পূর্বে আমার পিসতুত ভ্রাতা শ্রীপ্রসাদকে আমি পারস্য শিখাইতাম, তিনি আমাকে ইংরেজী পড়াইতেন। কিন্তু এ বিদ্যাশিক্ষায় আমার বিশেষ মনোযোগ ছিল না। এক্ষণে পারস্যবিদ্যার আলোচনায় এককালে বিরত হইয়া ইংরেজী বিদ্যা শিক্ষায় মনোনিবেশ করিলাম। [৭]

[৭. দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের আত্মজীবন চরিত, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ, নোতুন সংস্করণ, ১৩৬৩; পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮]

প্রকৃতপক্ষে এখানেই হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের অসমান উন্নতির গোড়াপত্তন। এর দায়িত্ব হিন্দুদের নয়। ইংরেজের যা কিছু দায়িত্ব তার থেকে অনেক বেশী দায়িত্ব মুসলমানদের নিজেদের। কিন্তু সে দায়িত্বকে স্বীকার করার ঔদার্য মুসলমানদের মধ্যে কোন কালেই বিশেষ লক্ষিত হয় নি। উপরন্তু নিজেকে পিছিয়ে থাকার জন্যে তাঁরা দায়ী করতে চেয়েছেন হিন্দুদের এগিয়ে যাওয়াটাকে। এটাও সামন্ততান্ত্রিক বিভ্রান্তির এক অভিনব লীলা! হিন্দু মুসলমানের উন্নতি অসমান না হলে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবকে উত্তীর্ণ হয়ে মুসলমানেরাও ঊনিশ শতকের বাঙালী সংস্কৃতির নির্মাণকার্যে সমানভাবে ব্রতী এবং অগ্রবর্তী হতেন। এবং এই মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের পারস্পরিক দূরত্ব হয়তো কালের যাত্রাপথে ক্রমাগত হ্রাস পাপ্ত হয়ে পরিশেষে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। বৃহত্তর জাতীয় জীবনেও সাম্প্রদায়িকতার মতো কোন জটিলতার সৃষ্টি হতো না। কিন্তু গোড়াতেই পারস্পরিক বিরোধিতার এই মনোবৃত্তি সে সম্ভাবনাকে ধুলিসাৎ করলো।

বারো

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ইংরেজ শাসনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সংস্কৃতির দিক থেকেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই নোতুন শ্রেণী পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন প্রগতিশীল ভাবধারার সংস্পর্শে আসে এবং নিজেদের ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করতে উদ্যত হয় এক নোতুন সংস্কৃতি। হিন্দুরা একাজে ছিলেন অনেক অগ্রবর্তী এবং ঊনিশ শতকে বাঙালী সংস্কৃতির নির্মাণকার্য তাঁদের প্রচেষ্টাকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা চলেনা। মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষা বর্জন করে পশ্চাদবর্তী হওয়ার ফলে এদিক দিয়ে তাঁদের দান অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক কম। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ বাঙলাভাষার প্রতিই তাঁদের অবজ্ঞা এবং উন্নাসিকতা। তাঁরা অনেকে নিজেদেরকে মনে করতেন আরবী-ইরানী-তুর্কী তেজারতকার এবং ঘোড়সওয়ারদের বংশধর, কাজেই বাঙলা ভাষার উন্নতির এবং পরিচর্যার কোন প্রয়োজন অথবা দায়িত্ব তাঁরা বোধ করেন নি। এর ফলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে যে হাজারো নোতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল। তার সাথে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন।

ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙলাদেশে মুসলমানরা যখন বাধ্য হয়ে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণের তোড়জোড় শুরু করলেন তখনো তাঁদের সংস্কৃতি সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবে সমাচ্ছন্ন। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধশতাব্দীর প্রচেষ্টা এবং সাধনায় হিন্দু সম্প্রদায় বাঙালী সংস্কৃতিকে নিজেদের মতো করে গঠন করে তাকে অনেকখানি মুক্ত করেছিলেন সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব থেকে। মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান মুহূর্তে এই পার্থক্য তার চরিত্র গঠন কার্যে যথেষ্ট প্রভাবশীল হলো! পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে যত তাড়াতাড়ি তাঁদের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাভাবনার আওতামুক্ত হওয়ার কথা সেটা হয়ে উঠলো না। এই অক্ষমতার কারণ ঊনিশ শতকে বাঙালী হিন্দুদের প্রচেষ্টায় বাঙলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে নোতুন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমানদের সাথে তার সন্তোষজনক যোগাযোগের অভাব। এর জন্যে শুধু যে মুসলমানরাই দায়ী তাই নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দুদেরও দায়িত্ব যথেষ্ট। তাঁরা বেশ কিছুকাল একচেটিয়াভাবে ইংরেজ সরকারের থেকে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন সে সুবিধা মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থানের ফলে অনেকখানি কমে এলো। সুযোগ-সুবিধা সঙ্কুচিত হওয়ার এই ব্যাপারটিকে তাঁরা মোটেই সুনজরে দেখলেন না। এবং নবোখিত মধ্যবিত্ত মুসলমানদের প্রতি একটা বিরুদ্ধ মনোভাব তাঁদের অন্তরে কঠিনভাবে দানা বাঁধলো। সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও এ প্রভাব বিশেষভাবে হলো চিহ্নিত। মুসলমানরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকার কারণ দেখলেন না। তাঁরাও আরবী ফারসী সংস্কৃতিকে নিজেদের ঐতিহ্য মনে করে ভারতবর্ষ এবং বাঙলাদেশকে বাতিল করে নিমগ্ন হলেন এক সংকর সংস্কৃতি গঠন করতে যে সংস্কৃতির মধ্যে পূর্ববর্তী সামন্ততান্ত্রিক মোগল প্রভাব কৃতকার্য হলো নিজের গৌরবকে অনেকাংশে অক্ষুণ্ণ রাখতে। ঊনিশ ও বিশ শতকের মধ্যবিত্ত মুসলিম সংস্কৃতি এইভাবে বেশ কিছুটা আচ্ছন্ন হলো মোগল যুগের উচ্চশ্রেণীর মুসলিম সংস্কৃতির দ্বারা।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মধ্যবিত্ত এবং সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ও বিকাশের যুগে মুসলমানরা শোরগোল তুলে ইসলামের নামে যে সংস্কৃতির পরিচর্যায় রত হলেন তার সাথেও ইসলামের বিশেষ সম্পর্ক নেই। তার প্রায় সম্পূর্ণটিই সামন্ততান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক প্রভাবে গঠিত। এবং এজন্যেই সে সংস্কৃতির সাথে ভারতবর্ষের এবং বিশেষতঃ বাঙলাদেশের অগণিত দরিদ্র নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের সংস্কৃতির কোন নাড়ীর যোগ কোনদিন ছিল না এবং আজও নেই।

তেরো

ঊনিশ ও বিশ শতকে মুসলিম সংস্কৃতি বলে যে জিনিসটিকে চালু করা হলো তার মধ্যে সত্যকার সংস্কৃতি চেতনার থেকে উদ্দেশ্যমূলক বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা সহজেই লক্ষণীয়। এই সংস্কৃতির নির্মাতাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীই এর জন্মদাতা। এজন্যেই দেখা যায় মুসলিম রাজত্বকালে উচ্চশ্রেণীর হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল সে পার্থক্যকে বজায় রাখার চেষ্টা তো অব্যাহত থাকলোই উপরন্তু হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতিগত প্ৰভেদকে ইচ্ছাকৃতভাবে আরও বাড়িয়ে তোলা চেষ্টার অন্ত রইলো না। হিন্দু এবং বিশেষ করে মুসলমানেরা দেশের সাধারণ জীবনযাত্রায় যা কিছু ঐক্য ছিল তাকে একেবারে উপেক্ষা করে অনৈক্য এবং বিভেদের উপরই তাঁদের সমগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। প্রচলন করতে চেষ্টা করলেন অনেক নোতুন অভ্যাস এবং ব্যবহারের, যার মধ্যে ঐক্যের থেকে অনৈক্য, মিলনের থেকে বিভেদের কথাই প্রচারিত হতে থাকলো উচ্চ থেকে উচ্চতর কণ্ঠে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানের কিছু পার্থক্য অবশ্যই আছে। আকীকা এবং অন্নপ্রাশন, হাতে তখতী এবং হাতে খড়ি, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতি, শেষকৃত্যের ব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্যে যে তফাৎ আছে তার সত্যতা অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয়, তাকে অস্বীকার করার প্রচেষ্টা অপরিসীম মূঢ়তা ব্যতীত আর কিছুই নয়। কিন্তু এগুলিকে স্বীকার করলেই কি বলতে হবে যে, হিন্দু এবং মুসলমানের সংস্কৃতির পার্থক্য এত গভীর ও সুদূরপ্রসারী যে, তার তুলনায় এ দুই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের জীবনের মৌলিক ঐক্য এবং মিলন সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন? উপরে আকীকা, হাতে তখতী, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান, শেষকৃত্যের ব্যবস্থা ইত্যাদি যে উদাহরণগুলি দেওয়া গেল তাতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কিছু তফাৎ আছে। কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের ঐ সমস্ত প্রথা এবং ব্যবহারের সাথে আরবী- ইরানী তুর্কী মুসলমানদের ব্যবহারের যদি তুলনা করা হয় তাহলে বাঙালী হিন্দুর ব্যবহারিক জীবন এবং আরবী-ইরানী-তুর্কী মুসলমানের ব্যবহারিক জীবন কোনটির সাথে তার অধিকতর মিল দেখা যাবে? একটু লক্ষ্য করলেই স্পষ্টতঃ বোঝা যাবে যে, একমাত্র কবর দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাড়া অন্যান্য প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিদেশী মুসলমানের থেকে বাঙালী হিন্দুর সাথে বাঙালী মুসলমানের ঐক্য অনেক বেশী গভীর এবং বাস্তব। এমনকি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী গঠিত মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান, নাচ গান এবং নানান আয়োজনের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের সামাজিক জীবনের এ ঐক্য এবং পারস্পরিক প্রভাব সব থেকে বেশী প্রত্যক্ষ। শুধুমাত্র বিবাহের দোয়া বা মন্ত্রের ধর্মীয় দিকটি ব্যতীত হিন্দু মুসলমানের আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে এমন কোন অনৈক্য নেই যার কথা উল্লেখ করে দেখানো যেতে পারে যে আরব-ইরান-তুর্কীর মুসলমানের সংস্কৃ তির সাথে বাঙালী মুসলমানের সংস্কৃতিগত ঐক্য তুলনায় কোন অংশে বেশী। উপরন্তু এ বিশ্লেষণের পথে অগ্রসর হলে দেখা যাবে যে, মুসলিম সংস্কৃতির নামে যে জিনিসকে প্রচার করা হচ্ছে তার সাথে অন্য কোন দেশের সমকালীন মুসলমানদের কোন যোগাযোগ বা আত্মীয়তা নেই। এই সমস্ত দেশগুলিও ইতিমধ্যে নিজেদের সংস্কৃতি নির্মাণকার্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে কাজেই তাদের পূর্বচরিত্র এবং চেহারা এখন আর বজায় নেই। কিন্তু পাকিস্তানী মুসলমানরা মুসলিম সংস্কৃতির নামে যে জিনিসকে আঁকড়ে ধরে আছেন তার মধ্যে আরবী, ইরানী, তুর্কী প্রভাব যেটুকু সেটা আজকের আরবী-তুর্কী-ইরানী সংস্কৃতি নয়। সেটাও প্ৰায় দু’তিনশো বছরের পুরাতন এবং ক্ষয়িষ্ণু এক সংস্কৃতি। কাজেই মুসলিম সংস্কৃতি আসলে আরবী-ইরানী-তুর্কীও নয়, ভারতীয়, বঙ্গদেশীয় বা পাকিস্তানীও নয়। এবং সর্বোপরি তত্ত্বের ক্ষেত্রে ইসলামের সাথেও তার কোন সম্পর্ক নেই। এ সংস্কৃতি যেন সদাসর্বদাই ভেসে বেড়াচ্ছে কিন্তু না পারছে অন্য কোন দেশের কূলে ভিড়তে, না পারছে নিজের দেশের মাটিতে বিস্তার করতে তার মূল। তবুও নিজের আন্তরিক তাগিদে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত তাড়নায় যখনই দেশের মাটি থেকে বাঁচার উপযোগী রস সংগ্রহ করতে সে চেষ্টা করে তখনই মুসলিম সংস্কৃতির পতাকাবাহীরা সেই শিকড় ছিন্ন করতে উদ্যত হন। আমাদের দেশের মাটির সাথে তাই মুসলিম সংস্কৃতির রসের বন্ধন যেন কিছুতেই স্থায়ী এবং দৃঢ় হতে পারে না। এবং সকল মুসলমানের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করার আওয়াজ তুলে এই তথাকথিত মুসলিম সংস্কৃতি শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারকার্যেই ব্যবহৃত হয়।

চৌদ্দ

ধর্ম সংস্কৃতির একটি উপাদান মাত্র। সুতরাং শুধু তার দ্বারা কোন সংস্কৃতির চরিত্র নির্ণয় করতে গেলে ভুল করা হবে। ভাষা, আর্থিক জীবন ইত্যাদির প্রসঙ্গেও একই কথা বলা চলে। সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হিসাবে আর্থিক জীবন অন্যান্য উপাদানের তুলনায় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলেও একমাত্র তার দ্বারাই কোন সংস্কৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। যে কোন জীবন্ত সংস্কৃতিই অবিভাহ্য এবং তা সমস্ত উপাদানগুলির সমন্বয়েই গঠিত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমরা এক বা ততোধিক উপাদানের ভিত্তিতে তাকে বিচার করতে পারি কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সত্যিকার অর্থে কোন সংস্কৃতিকে ইচ্ছামত বিভক্ত করা চলে।

সংস্কৃতির যে উপাদানগুলির কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন ভাষা, আর্থিক জীবন, ধর্ম, ভৌগোলিক পরিবেশ, সেগুলি যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সংস্কৃতিকে গঠন এবং বৈশিষ্ট্য দান করে। বিভিন্ন উপাদানের ঐক্যের কারণে অনেক সময় দুই বা ততোধিক সংস্কৃতির মধ্যে একটা সাদৃশ্য গঠিত হয়। কিন্তু সেই সাদৃশ্য তাদের বৈশিষ্ট্যকে বিলুপ্ত করে না। এজন্যেই ইংলণ্ড এবং আমেরিকার সংস্কৃতি তাদের মধ্যেকার সাদৃশ্য সত্ত্বেও ভিন্ন। স্পেন এবং ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলির ক্ষেত্রেও তাই।

সংস্কৃতির চরিত্র বিচারে কোন উপাদানের গুরুত্ব কত বেশী সেটা নির্ভর করে উপাদানগুলির কোনটির প্রভাব জীবনে তুলনা কত কমবেশী তার উপর। সেদিক থেকে বিচার করলে আর্থিক জীবন এবং ভাষার গুরুত্ব সর্বাধিক। এই একই কারণে ধর্ম সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেটা নির্ভর করবে সাধারণ জীবনযাত্রার উপর ধর্ম কতখানি প্রভাবশীল তার উপর। এজন্যে দেখা যায় যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে সংস্কৃতির উপর ধর্মের যে প্রভাব ছিল বর্তমান ইউরোপে সে প্রভাব নেই। তেমনি বর্তমান কালে অনুন্নত দেশগুলিতে ধর্মের যে প্রভাব লক্ষিত হয় সেটা উন্নত দেশগুলিতে দেখা যায় না। এর কারণ সামন্ততান্ত্রিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে ধর্মের স্থান যত উঁচুতে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে তত উঁচুতে নয়। আবার সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাবের চিহ্ন বিশেষ আর অবশিষ্ট থাকেনা। এর ফলে সামন্ততান্ত্রিক পর্যায়ে মানুষ ধর্ম নিয়ে যত মাতামাতি করে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এবং বিশেষতঃ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটা আর করে না। শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের সাথে ধর্মের প্রভাব কমে আসে এবং তার ফলে সাধারণভাবে সংস্কৃতিক্ষেত্রে সে প্রভাবও আর পূর্বের মতো চিহ্নিত হয় না। পূর্ব পাকিস্তানে এখনো ধর্মকে দিয়ে সংস্কৃতির চরিত্র নির্ণয়ের প্রচেষ্টা বজায় আছে। এবং তার ফলে হিন্দু সংস্কৃতি, মুসলিম সংস্কৃতি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সংস্কৃতিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়। এর কারণ এদেশে এখনো সামন্ততন্ত্রের পূর্ণ উচ্ছেদ এবং উন্নততর আর্থিক ব্যবস্থার প্রবর্তন সম্ভব হয় নি। সামাজিক উন্নতির একটি বিশেষ পর্যায়ে সাধারণ জীবনক্ষেত্রে ধর্মের একটি বিশেষ গুরুত্ব থাকে কিন্তু সে প্রাধান্য চিরস্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় নয়। যুগ ও অবস্থার পরিবর্তনে ধর্মপ্রভাবের মধ্যে শৈথিল্য আসে এবং সেটা ধনতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের সাথে ক্রমাগত বৃদ্ধিলাভ করে। অর্থাৎ সামাজিক উন্নতি যত নিম্নপর্যায়ে থাকে ধর্মের প্রভাব সমাজের মধ্যে তত বেশী হয় এবং সংস্কৃতিও তার দ্বারা অনুরূপভাবে গঠিত। কাজেই সাধারণ জীবনযাত্রায় ধর্মের প্রভাব যত কমে আসে সংস্কৃতিক্ষেত্রে ধর্ম হয়ে পড়ে ততই গুরুত্বহীন। সে সময় ধর্মের স্থান অধিকার করে কোন বিশেষ জীবনদর্শন অথবা কোন নোতুন প্রত্যয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *