মুসলমান আমলের ভারতশিল্প

মুসলমান আমলের ভারতশিল্প

১. স্থাপত্য

পাঠানদের গঠিত যত সমস্ত বাড়ীঘর, বিশেষত পাথরের দেশ উত্তর-ভারতের ইমারতগুলি, কেমন একটা নিরেট বিরাট স্তূপের মতন, তাদের শ্রীছাদে কেমন একটা বিষণ্ণ আচ্ছন্ন ভাব আছে, মুঘল আমলের ইমারতগুলির মতন গঠনের কমনীয় লালিত্য ও অলঙ্কারের ঐশ্বর্য্য ইহাদের মধ্যে নাই। কিন্তু গৌড়ের সুলতানদের গঠিত ইঁটের প্রাসাদ ও মসজিদগুলি সেই সময়কার অন্যত্র গঠিত পাথরের ইমারত হইতে একেবারে স্বতন্ত্র ধরনের; উহাদের গঠনের বিন্যাস ও অলঙ্কার বিশেষ একটু উচ্চস্তরের; উহাদের উপর স্থানীয় স্থপতিদের প্রতিভা ও শিল্পধারার ছাপ অতি সুস্পষ্ট, যেমন সুস্পষ্ট ভারতের অন্য সমস্ত মুসলমানী স্থাপত্যের উপর একটা বিদেশী নূতন প্রভাবের ছাপ।

অনেকে অনুমান করেন যে গোল ধনুকের মতন খিলান মুসলমানেরাই ভারতে প্রবর্তন করেন; হিন্দুদের খিলান ছিল থাকে থাকে পাথর বা ইট তাকের মতো সাজানো, যাকে ভারতীয় স্থপতিরা মঞ্চবন্ধ বলিত। দিল্লীতে কুতুব মসজিদের হাতায় আল্লামাশের আমলের বৃহৎ খিলানটি এইরূপ খিলানের একটি উৎকৃষ্ট নমুনা।

পাঠান স্থাপত্যের প্রথমদিককার গঠনরীতি দেখিতে পাওয়া যায় মজিদ কবর মিনার ও খিলান তোরণে; পরবর্তী রীতির নমুনা হইতেছে জৌনপুরের শাকা ইমারতগুলি, এবং গৌড়ের বাঙ্গালী সুলতানদের সুন্দর ইটের প্রাসাদ ও মসজিদ। তুঘলক আমলের কোন কোন ইমারতের গড়ানে দেয়াল ও ভারী স্তূপাকার মূর্ত্তি প্রাচীন মিশরীর স্থাপত্যপদ্ধতির কথা স্মরণ করাইয়া দেয়, যদিও প্রাচীন মিশরের সঙ্গে ভারতীয় শিল্পপদ্ধতির সম্পর্ক এখনো ইতিহাস প্রমাণ করিতে পারে নাই। পাঠান স্থাপত্যে হিন্দু প্রভাবেরও কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।

মুঘল আমলের, বিশেষ করিয়া আকবরের আমলের, স্থপতিদের উপর হিন্দু স্থাপত্যরীতির প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ইমারতে সরু সরু থাম, দেয়ালের সঙ্গে অর্দ্ধেক পোঁতা চৌকা থাম, দেয়াল হইতে বাহির-করা তাক এবং অন্যান্য প্রসাধন অলঙ্কারে হিন্দু প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু মূল পদ্ধতি ও শ্রী বিশুদ্ধ মুসলমানী। মুঘল স্থাপত্যের বিশেষ লক্ষণ এই—

(১) ঘণ্টার খোলের মতন গম্বুজ।

(২) কোণে কোণে লম্বা সরু সরু খোলা ঘর।

(৩) প্রাসাদের হল-ঘরে কেবলমাত্র থামের উপর ছাদ, মাঝের দৌড়-ঘর ও চারিদিকের বারান্দা একই রকমের খোলা। এ-কে বারো-দুয়ারী পদ্ধতি বলে।

(৪) হিন্দু-সারাসেন পদ্ধতির তোরণ- একটি প্রকাণ্ড অর্দ্ধ-গম্বুজ, অৰ্দ্ধেক দেয়ালে প্রোথিত, ইমারতের শ্রী ও আকারের সঙ্গে সুসঙ্গত ও সুসমঞ্জস এবং গম্বুজের তলায় প্রবেশপথটি চতুষ্ক। ফার্গুসন এই পদ্ধতির তোরণের খুব প্রশংসা করিয়া গ্রীক ও গথিক পদ্ধতি অপেক্ষা শ্ৰী গাম্ভীর্য্য ও সুসঙ্গতি সুসামঞ্জস্যে ইহাকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করিয়াছেন। ফতেপুর সিক্রীর বুলন্দ দরওয়াজা এইরূপ তোরণের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

ফতেপুর সিক্রীর আরী ইমারতের ও আগ্রাদুর্গের জাহাঙ্গিরী মহলের অনেক আলঙ্কারিক থাম হিন্দুমন্দিরের থামের ন্যায় ক্ষীণ ও ক্রমশ সরু; ফতেপুর সিক্রীর শেখ সলিম চিস্তির দরগা ও দেওয়ান-ই-খাস প্রভৃতি ইমারতের দেয়াল হইতে বাহির-করা তাক বা ব্র্যাকেটগুলি হিন্দুমন্দিরের একেবারে নকল- ঠিক ঐরূপ তাক আবু-পর্ব্বতের দিয়ারা মন্দিরে আছে। আহমদাবাদের একটি মুসলমানী কবরে ও উত্তর-ভারতের কোন কোন ইমারতের দেয়ালের গায়ে তোলা, শিকলে-ঝোলানো ঘণ্টার অলঙ্কারবিন্যাসও হিন্দুপদ্ধতির নকল।

মুঘলস্থাপত্যের প্রধান বিশেষত্ব ইমারতের গম্বুজ; এই গম্বুজ বৃত্তার্দ্ধের চেয়ে কিছু বড়, এক ফোঁটা পদ্মপত্রের জলের মতন টলটলে, একটা বুদ্বুদের মতন ঢলঢলে। অনেকে মনে করেন ইহা মধ্য-এশিয়ার তুর্কী যাযাবরদের ঘণ্টাকৃতি তাম্বুর আকারের নকল, যেহেতু পাঠান বা হিন্দু স্থাপত্যে এর অনুরূপ গম্বুজ দেখা যায় না। কিন্তু মধ্যভারতে মুঘল আমলের পূর্ব্বকার একটি হিন্দুমন্দিরে এমনি গম্বুজ নাকি একটি আছে।

আকবরী আমলের ইমারত লাল বেলে পাথরে তৈরি; শাহজাহানের ইমারত শুভ্র মর্ম্মর মার্বেল পাথরে গঠিত। উভয়ের ইমারতেই প্রচুর তক্ষণ অলঙ্কার, তোলা কাজ এবং পাথরের ফারফোর জালি দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু শাজাহানের ইমারতের শিল্পপ্রসাধন অধিকতর সূক্ষ্ম, ইমারতগুলি বৃহত্তর সুন্দরতর ও ব্যয়বহুল। আকবরের রচিত প্রধান ইমারত আগ্রাদুর্গের আকবরী মহল, দুর্গের গড়বন্দী প্রাকার ইত্যাদি, সিকান্দ্রা ও ফতেপুর সিক্রীর প্রাসাদ ও কবর, এবং এটকের দুর্গ। শাজাহান গঠন করাইয়াছিলেন দিল্লীর জামা মজিদ, শাজাহানাবাদ বা নূতন দিল্লীর দুর্গপ্রাসাদগুলি (কেবল দিল্লীদুর্গের অন্তর্গত মোতিমজিদ ছাড়া, এটি ঔরঙ্গজীব নির্ম্মাণ করান), আগ্রার মোতিমজিদ, আগ্রাদুর্গের মর্মরপ্রাসাদ ও মারমসজিদের অধিকাংশ, তাজমহল, ইতিমদ্-উদ্-দৌলার কবর, আজমীরের আনাসাগরের মর্ম্মর চত্বর, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। আওরংজীব কেবলমাত্র দিল্লীদুর্গের অন্তর্গত মোতিমজিদটি এবং আওরঙ্গাবাদে পত্নীর কবর নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজত্বকালে অপর লোকে কতকগুলি চমৎকার মসজিদ নির্ম্মাণ করান, যথা– লাহোরে ওয়াজির খাঁর মসজিদ, দিল্লীতে জিন্নৎ-উন্নিসার মসজিদ ইত্যাদি।

২. চিত্র

আকবরের দরবারের প্ররোচনায় ও উৎসাহে চিত্রশিল্প বিশেষ স্ফূর্তিলাভ করিতে পারিয়াছিল এবং সেই বিকাশ শাজাহানের আমল পর্য্যন্ত চলিয়াছিল। পাছে মানুষ নিজের সৃষ্ট পদার্থেরই উপাসক হইয়া অনন্তকে অবহেলা করে এই ভয়ে কোরানে মুসলমানের জীবন্ত প্রাণীর চিত্রাঙ্কণ নিষেধ করা হইয়াছে; এইজন্য শাস্ত্রবিশ্বাসী মুসলমানেরা ফুলপাতা গাছপালা নকশা ছাড়া আর কিছু আঁকিতে পারিত না। আগ্রার একজন আধুনিক মুসলমান ফেরিওয়ালা শাদা পাথরের উপর রঙিন পাথর বসাইয়া টিয়াপাখি আঁকা পাথর বিক্রী করিতে রাজি হয় নাই দেখিয়াছি। আকবর শাস্ত্রবিশ্বাসী মুসলমান ছিলেন না, এবং তাঁর উৎসাহে বহু চিত্রকর তাঁর দরবারে চিত্রাঙ্কনে নিযুক্ত হইয়াছিল এবং তাদের চিত্র সম্রাটের সমাদরে সম্মানিত হইয়াছিল।

কোরানের নিষেধের জন্য মুসলমান চিত্রচর্চ্চা করিতে না পারিলেও মুসলমানের চিত্তবৃত্তি মনোরঞ্জনের জন্য চিত্রচর্চ্চার দিকে আকৃষ্ট হইত। এই কারণে বহু ধনী মুসলমান, বিশেষত মধ্য এশিয়ার ধনী মুসলমানেরা, চীনা চিত্রকরদের চিত্রাঙ্কনে নিযুক্ত করিত। চীনা চিত্রকরদের শিল্পনৈপুণ্য ও চিত্রের উৎকর্ষ পারসী সাহিত্যে প্রশংসিত হইয়া নক্কাস-ই-চীনী নাম প্ৰসিদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। খোরাশান বোখারা প্রভৃতি স্থানের প্রাচীন ও প্রথম যুগের ছবিতে মানুষের মুখ, পাহাড়, জল, আগুন ও নাগ চিত্রণে চীনা ছাপ সুস্পষ্ট। পাটনার প্রসিদ্ধ খোদাবক্স্ লাইব্রেরীতে যেসব রঞ্জিত পুঁথিতে তারিখ দেওয়া আছে, সেইসব পুঁথির রঞ্জন-চিত্র দেখিয়া ও তারিখ পরম্পরা মিলাইয়া ভারতে সারাসেন শিল্পের ক্রমবিকাশ বেশ ধাপে ধাপে ধরিতে পারা যায়। আলীমৰ্দ্দন খাঁ ১৬৩৯ সালে যে চিত্রভূয়িষ্ঠ সাহনামা পুঁথি শাজাহানকে উপহার দেন, তাহাতে মধ্যএশিয়ার বিশুদ্ধ চীনা চিত্রের নমুনা দেখিতে পাওয়া যায়; এই চীনা চিত্রাঙ্কনরীতি আকবরের আমলে বা তার পূর্ব্বেই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল নিশ্চয়। আমাদের প্রকৃত জাতীয় সম্রাট আকবরের দরবারেই এই চীনা অথবা বহির্ভারতের মুসলমানী চিত্রশিল্পের সহিত বিশুদ্ধ হিন্দু চিত্রশিল্পের মিলন ও মিশ্রণ ঘটিয়াছিল। অজন্তা গুহাগাত্রের চিত্রপদ্ধতি ও বরহুত ইলোরা গুহাগাত্রের তক্ষণপদ্ধতি যে ধারায় হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে আবহমান ছিল, তারই সঙ্গে চীনা মুসলমানী চিত্রশিল্পের মিলন প্রথম রূপান্তর ঘটাইয়াছিল। শতবৎসর পূৰ্ব্বে মুর্শীদাবাদে নির্ম্মিত হাতীর দাঁতের একটি কৃষ্ণমূৰ্ত্তি দেখিয়াছি সেটি যেন বরহুতের তোলা ছবির নকল।

ভারতীয় পদ্ধতির মিশ্রণে চীনা শিল্পের বহিরেখার কঠোরতা কোমল হইয়া আসিয়াছিল, চীনা শিল্পপদ্ধতির নির্দ্দিষ্ট ভঙ্গী পরিত্যক্ত হইয়াছিল। ভারতীয় চিত্রে অঙ্কিত পাহাড় জল আগুনের ছবিতে চীনাপদ্ধতির আভাস থাকিলেও সেই পদ্ধতি যে ক্রমে বদল হইয়া প্রকৃতির অনুরূপ হইয়া আসিতেছে তাহা বেশ বুঝা যায়; লোকের মুখশ্রী ও নিসর্গদৃশ্য স্পষ্ট ভারতীয় হইয়া আসিয়াছিল; এইরূপে পুরাতন নূতনের বেশে ভোল ফিরাইয়া লইতেছিল। খোদাবকস লাইব্রেরীর তারিখ-ই-খান্দান্-ই-তৈমুরিয়াএই পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ইংলরে সাউথ কেন্সিংটন মিউজিয়ামে রক্ষিত মহাভারতের পারসী অনুবাদ রজম্-নামা আকবরের সমসাময়িক চিত্রবিবর্তনের নিদর্শন। সারাসেন-চীনা চিত্রপদ্ধতি এইরূপে ক্রমে ক্রমে ভারতীয় পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হইতে থাকে শাজাহানের আমল পর্য্যন্ত; তখন বিদেশী ভাব ও প্রভাব গুপ্ত বা লুপ্ত হইয়া আসিয়াছে, ভারতের ভাব প্রবল ও প্রকট হইয়াছে; মুখসৌষ্ঠব ও বর্ণবিন্যাস, রচনার সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম খুঁটিনাটি, অলঙ্কারের বিচিত্রতা ও প্রাচুর্য্য এবং প্রকৃতির সাদৃশ্য (আপেক্ষিক পরিপ্রেক্ষিত অথবা ছায়া-সুষমা ছাড়া) পূর্ণতায় বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ খোদাবকস লাইব্রেরীর পাদিশানামা পুঁথিতে আমরা দেখিতে পাই।

এই হিন্দু-সারাসেন চিত্রশিল্প মুঘল সম্রাটদের দরবারেই পরিণতি লাভ করে। চিত্রের বিষয় ছিল লোকের চেহারা, সাধু ফকির দরবেশদের কাল্পনিক মূর্ত্তি, পারসী মহাকাব্যের ঘটনা-শাহনামা, ঐতিহাসিক ব্যাপার, ভূদৃশ্য, প্রসাধনরতা মহিলার কাল্পনিক ছবি, শিকারের দৃশ্য, পারসী প্রণয় কবিতার ব্যাপার, এবং হিন্দু পুরাণের আখ্যান অথবা আকবরের আদেশে রচিত রামায়ণ-মহাভারতের পারসী অনুবাদের চিত্র

শাজাহানের আমলে মানুষের চেহারা আঁকা সম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছিল। যদিও মুখে ভাবের অভিব্যক্তি হইত না, তবু লোকের চেহারা আসল মানুষের অবিকল হইত এবং বর্ণবিন্যাস ও বস্ত্রবিন্যাসে নিপুণ সূক্ষ্মতা প্রকাশিত হইত। এইসব ওস্তাদ শিল্পীদের হাতের রং ফলানোর মধ্যে নীল ও সোনালি রং এমন আশ্চর্য্য গভীর ও পাকা যে তিন শত বৎসরের-অযত্ন ও অসাবধান নাড়াচাড়া সত্ত্বেও এখনো নূতনের মতন উজ্জ্বল ও অটুট আছে। রাত্রির ও আতসবাজির দৃশ্যে রং ফলানো ছিল এইসব ওস্তাদ চিত্রকরদের বিশেষ দক্ষতা; এখন তাঁদের সাকরেদরা সেই নিপুণ রং ফলানোর অনুকরণে ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছেন।

৩. ভারতীয় চিত্রকলার তথাকথিত রাজপুত পদ্ধতি

ডাক্তার কুমারস্বামী যে চিত্র-রচনা-রীতিকে রাজপুতপদ্ধতি বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন, তাহা বাস্তবিক হিন্দুর স্বকীয় পদ্ধতিও নয় এবং তার সঙ্গে রাজপুতানা দেশের বা রাজপুত জাতির কোন বিশেষ সম্পর্কও নাই। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মিত্র ও করদ রাজারা বাদশাহী দরবারের শিক্ষিত চিত্রকরদের নিজেদের দরবারে নিযুক্ত করিয়া হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী, কাব্যকাহিনী ইত্যাদি হিন্দু ভাব ও কল্পনাকে আকার দেওয়াইতেন, কিন্তু চিত্রকরদের অঙ্কনপদ্ধতি ও শিল্পকল্পনা মুঘল দরবারেরই অনুরূপ হইত। চিত্রকরেরা মুঘল ভাবে এমন অনুপ্রাণিত হইয়া থাকিত যে তাদের চিত্র মাঝে মাঝে আধুনিক লোকের নিকট হাস্যজনক বিবেচিত হয়; মথুরার রাজপারিষদেরা মুঘল দরবারী পোশাক পরিয়া পাঁচ হাতিয়ার বাঁধিয়া কৃষ্ণসন্দর্শনে যাইতেছেন, অথবা রামচন্দ্রের কপিসৈন্য ব্যূহবদ্ধ হইয়া পাঁচহাজারী দশহাজারী মনসবদারী ভাগে যুদ্ধযাত্রা করিতেছে, সঙ্গে মুঘলাই অস্ত্র-এমন কি কামান পর্য্যন্ত! সৈন্যদের কোমরবন্দে ছোরার ঝলক। তুলির দু এক পোঁচে সেইসব লোককে মুঘল দরবারী আমির ওমরাহ বা স্বয়ং সম্রাট আকবরের প্রতিমূর্ত্তি করিয়া তোলা যায়। রাধা তো যেন প্রসাধনরতা মুঘল মহিলা, কেবল কয়েকখানা ভূষণ কম। মুঘল দরবারের চিত্রকরদের তুলিতে যে সূক্ষ্ম কারুকার্য্য, কোমল স্পর্শ ও অলঙ্কারের প্রাচুর্য্য ও বৈচিত্র্য প্রকাশ পাইত এবং যাহা শাজাহানের আমলে পূর্ণ পরিণত হইয়া উঠিয়াছিল, রাজপুতপদ্ধতি নামে পরিচিত চিত্রাবলীতে তার অভাব দেখা যায়, এগুলি সুসংস্কৃত নয়, এদের বহিরেখা কঠোর এবং বর্ণবিন্যাস উগ্র এবং পার্শ্বিক দৃশ্যের মধ্যে কেমন একটা দীনতা বা নগ্নতা সুস্পষ্ট। এর কারণ এ নয় যে এইসব চিত্রকর স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে চিত্র অঙ্কন করিত; এরা মুঘল দরবারের চিত্রকরদের মতন ওস্তাদ নিপুণ দক্ষ কারিগর ছিল না, বাদশাহী দরবারে যে মেকদারের কারিগর নিযুক্ত হইত সেইরূপ গুণপনার লোককে অপেক্ষাকৃত অল্পধনী ও অল্প সভ্য অল্প রসজ্ঞ রাজপুত রাজারা নিযুক্ত করিতে পাইতেন না বা পারিতেন না। সুতরাং রাজপুত দরবারের চিত্রকরেরা বাদশাহী দরবারের চিত্রকরদের সাগরেদ শ্রেণীর লোক বলিয়া তাদের রচনা হীনতর ও ভিন্নতর হইত। এই রাজপুতপদ্ধতি আধুনিক কালপর্য্যন্ত জয়পুরে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় রহিয়াছে দেখা যায়। য়ুরোপীয়দের প্রাচীন পদ্ধতির নমুনা সংগ্রহের ঝোঁকে এরা কেবল প্রাচীনের নকলের নকল করিয়া মরিতেছে, প্রাচীন শিল্পরীতিকে অতিক্রম করিয়া আত্মশক্তি বা স্বকীয় বিশেষত্ব বিকাশের অবকাশ তারা পাইতেছে না।

শাজাহানের মৃত্যুর পরে হিন্দু-সারাসেন চিত্রকলা দ্রুত অবনত হইয়া পড়িল। আওরংজীব শুচিবাই প্রবল থাকাতে তাঁর দরবার আড়ম্বরহীন ও ব্যয়সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়ে এবং চিত্রের প্রতি মুসলমানী উপেক্ষাও প্রবল হইয়া উঠে; বাদশাহের নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের জন্য প্রচুর ব্যয় ও অন্যদিকে ব্যয়সংক্ষেপ করিবার কারণ হইয়াছিল। তাঁর পরে মুঘল সম্রাটদের দীনতা ও কদরের আদর করিবার অক্ষমতা চিত্রকরদের উৎসাহ নিরুদ্যমে পরিণত করে এবং দেশের শিল্পপ্রতিভা একেবারে নষ্ট হইয়া যায়। চিত্রকরেরা সাহায্যের অভাবে বাধ্য হইয়া ভিন্ন ভিন্ন উপার্জ্জনের উপায় অবলম্বন করিতে থাকে। এইরূপে চর্চ্চা ও উৎসাহের অভাবে উৎকৃষ্ট চিত্র সৃষ্টি বন্ধ হইয়া গেল, শিল্পীদের জীবন অভাবে দুৰ্ব্বহ হইয়া উঠিল; মাঝে মাঝে এক আধজন রাজা বা নবাবের শিল্পানুরাগ মাত্র সেই মুমূর্ষ শিল্পধারাটিকে প্রবহমান রাখিতে চেষ্টা করিতেছিল। কিন্তু ১৭৩৯ সালে নাদির সাহের আক্রমণ দেশকে ছিন্নভিন্ন করিয়া পশ্চাতে একটা বিপর্য্যয় রাখিয়া চলিয়া গেল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশে অযোধ্যার নবাবদের প্ররোচনায় চিত্রবিদ্যা আর একবার উজ্জীবিত হইয়া উঠে। কিন্তু তখন য়ুরোপীয় শিল্পপদ্ধতি প্রভাব বিস্তার করিয়া হিন্দু-সারাসেন শিল্পকে আচ্ছন্ন অভিভূত করিয়া ফেলিতেছিল; তার ফলে না য়ুরোপীয় না হিন্দু না মুসলমানী এক খিচুরী সঙ্কর শিল্পের উদ্ভব হয়, তাতে না আছে কোন পদ্ধতির কোন গুণপনা, না আছে বিশেষত্ব; তার রুচি কল্পনা ও রচনা সবই কৃত্রিম নিম্নশ্রেণীর, এদের কোনখানার মধ্যে প্রতিভার বিন্দুপরিমাণ স্ফুলিঙ্গের স্পর্শও দেখিতে পাওয়া যায় না।

বর্তমান বিংশ শতাব্দীতে প্রাচীন চিত্রের প্রতি অনেকের অনুরাগ দেখা যাইতেছে; তার কারণ হ্যাঁভেল সাহেব, ডাক্তার কুমারস্বামী ও ভগিনী নিবেদিতার চেষ্টা ও শিল্পপরিচয়। তার পর য়ুরোপীয় ও আমেরিকানদের কৌতুকসামগ্রী সংগ্রহের আগ্রহে পুরাতন ছবির দাম চড়িয়া চলিয়াছে এবং এখন আসল পুরাতন ছবি দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠাতে নকল নূতন ছবিকে কৃত্রিম উপায়ে চেহারায় পুরাতন করিয়া চালানো হইতেছে।

ভারতীয় চিত্রপদ্ধতির নবশাখ সম্প্রদায়ের প্রধান চিত্রগুরু অবনীন্দ্ৰনাথ ঠাকুর ও তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্য নন্দলাল বসু। কিন্তু এঁরা প্রাচীন অজন্তা-রীতিরই অনুকরণ করিতেছেন। মুঘলরীতিরও অনুকারী কয়েকজন আছেন। কিন্তু অনুকরণ সৃষ্টি নয়, তাহা কৃত্রিম, তাহা প্রাণহীন। প্রতিভা জীবন্ত সৃষ্টিতেই আনন্দ ও স্ফূর্ত্তি পাইয়া থাকে; কিন্তু এই নূতন চিত্রকর সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় সক্রিয় সৃজনীশক্তির ঐশী মত্ততার আভাস পাওয়া যায় না।

কাংড়া চিত্রাঙ্কনপদ্ধতি হিন্দু-সারাসেন পদ্ধতির বিশুদ্ধ পরবর্তী বিকাশ, তার উপজীব্য হিন্দু ব্যাপারের ঘটনা। এই পদ্ধতির ওস্তাদ মোলারাম; তিনি গাঢ়োয়াল দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জীবিত ছিলেন। যে অরাজকতার বিপ্লবে মুঘল সাম্রাজ্যের শিল্প বিনষ্ট হইয়াছিল, অথবা য়ুরোপের যে প্রভাবে গঙ্গাতীরের দেশের শিল্প কুশী হইয়াছিল, তাদের কোনটারই প্রভাব পাৰ্ব্বত্য গাঢ়োয়াল দেশে পৌঁছিতে পারে নাই। সুতরাং চিত্রশিল্পের সূতিকাগার দিল্লী-আগ্রায় যখন শিল্পের প্রাণস্পন্দন স্থগিত হইয়া গিয়াছিল, তার পরেও ১৯ শতাব্দী পর্যন্ত কাংড়া পদ্ধতির চিত্রাঙ্কনে নিভাঁজ ভেজালশূন্য সৌন্দর্য্য রক্ষিত হইয়াছিল। মোলারামের রং ফলানো অতি চমৎকার এবং গাছপালা ও জীবজন্তু চিত্রণে স্পষ্ট কৃত্রিম নিৰ্দ্দিষ্ট ভঙ্গী থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রকাশে একটি কোমল পেলবতা ও কমনীয় শ্রী আছে। রাত্রির চিত্রগুলি বিশেষ শ্রীতে মণ্ডিত।

হিন্দু-সারাসেন পদ্ধতিকে মুমূর্ষু অবস্থায় অনুপ্রাণিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন রণজিত সিংহ (১৮২৫-৪০)। কিন্তু সেই চেষ্টার ফল চিত্রগুলির সৌন্দৰ্য্যবহুলতা যেন নির্ব্বাণোন্মুখ দীপশিখার শেষ উজ্জ্বলতা, মরণোন্মুখ ক্লান্ত অশ্বের প্রভুর কশাঘাতে শেষ উত্তেজনা।

মহারাষ্ট্র প্রাধান্যের সময় (১৭৫০-১৮০০) চিত্রশিল্পের কোন বিকাশ দেখা যায় না। কিন্তু দিল্লীতে মহারাষ্ট্র রাজদূত হিঙ্গনে ও অপরাপর মহারাষ্ট্র কর্ম্মচারীরা বহু পুরাতন মুঘল চিত্র ও চিত্রিত সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ করিয়া দাক্ষিণাত্যে সাতারার রাজা ও পুনার পেশোয়াদের পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। নাদির শাহের আক্রমণে মুঘল রাজশক্তি একেবারে নিষ্প্রভ হইয়া পড়াতে সেই সুযোগে মহারাষ্ট্ররা প্রবল হইয়া প্রাচীন বহু শিল্পসম্ভার সংগ্রহ করিয়া দেশে লইয়া গিয়াছিল এবং তার নিদর্শন মহারাষ্ট্র দেশে এখনো দেখিতে পাওয়া যায়।

৪. খোদকারী

খোদাই কাজের মধ্যে হাতীর দাঁতের মূর্তি গড়া নিখুঁত সুন্দর হইয়া উঠিয়াছিল; এবং তার ধারা সাহায্য ও উৎসাহের অভাব সত্ত্বেও আজও অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। মুঘল আমলে কাঠের খোদকারীও চমৎকার নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে করা হইত।

৫. বস্ত্ৰশিল্প

মিহি সূতী কাপড়ের জন্য ভারত বহু প্রাচীন কাল হইতেই প্রসিদ্ধ। দেশের গ্রীষ্মাতিশয্যের জন্য রাজা-রাজড়ারা সূক্ষ্মবস্ত্রের পক্ষপাতী হওয়াতে মিহি কাপড়ের ব্যবসায় খুব উন্নত ও ফলাও হইয়া পড়িয়াছিল। গুটিপোকা পালন ও রেশম উৎপাদন এবং রেশমী কাপড় বয়ন মুসলমানী আমলের আগে হইতেই ভারতে প্রচলিত ছিল। মখমল সার্টিন প্রভৃতি কাপড় এদেশে প্রস্তুত হইত না, বিদেশে (বিশেষত য়ুরোপ) হইতে আমদানী করা হইত, বাদশাহ ও নবাবেরা এইসব কাপড়ের খুব আদর করিতেন। মুঘল আমলে বিদেশীরা, বিশেষ করিয়া য়ুরোপীয়রা, মখমল সাটিনের ব্যবসা করিয়া বেশ দুপয়সা রোজগার করিত।

কিংখাবও জরি-চুম্‌কি-সমার কাজকরা কাপড়ের প্রবর্ত্তক মুসলমানদের দ্বারাই হইয়াছিল কি না ঠিক করিয়া বলা শক্ত হইলেও এ ঠিক যে প্রচলন করিয়াছিল মুসলমানেরা, মুসলমান বাদশাহী ও নবাবী দরবারে বহু কারিগর ওস্তাদ দর্জি নিযুক্ত থাকিয়া নানাবিধ কাপড়ের উপর জরির ও রেশমের রঙিন সূতা দিয়া বিচিত্র সুন্দর নক্সা বুনিত এবং সমা-চুমকির সূক্ষ্ম কাজ করিত। আইন-ই-আকবরী পুস্তকে দেখিতে পাওয়া যায় মুঘল আমলে কত বিচিত্র ও বিভিন্ন রকমের নক্সা তোলা হইত, কত রকমের কাপড়ে কত রকমের সূতায় কাজ হইত।

কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের শালের শিল্প মুসলমানদেরই সৃষ্টি। দরবারী পোশাকের জন্য কিংখাব ও জরির কাপড় আবশ্যক হইত বলিয়া নবাবেরা প্রত্যেক শহরে বহু শিল্পী দর্জি নকাসী পালন করিতেন এবং কোথাও যথার্থ গুণীর সন্ধান পাইলে তাকে যথোচিত সাহায্য ও পুরস্কৃত করিতেন। গুজরাটের আহমদাবাদ, মাদ্রাজ প্রদেশের মসলিপত্তন, বঙ্গের ঢাকা মুর্শীদাবাদ, লক্ষ্ণৌ, কাশী প্রভৃতি বহু শহর বিবিধ বিচিত্র বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ হইয়া আজও সেই খ্যাতি রক্ষা করিতেছে।

কার্পেট গালিচা প্রভৃতির শিল্প মুসলমান বাদশাহ নবাবদের দ্বারাই ভারতে প্রবর্তিত হয়। কার্পেট ও গালিচার কোমলতা নকসা রঙের সুসঙ্গত বাহার প্রভৃতির উৎকর্ষ শাজাহানের সময় চরমে উঠিয়াছিল, এবং এইসব পাতঞ্চে অসম্ভব অধিক মূল্যে বিক্রীত হইত। বাদশাহী দরবারের জন্য চন্দ্রাতপ বা সামিয়ানা বহুব্যয়ে বিচিত্র ভূষণে সজ্জিত করিয়া আহমদাবাদ ও কাশ্মীরে প্রস্তুত হইত। চন্দ্ৰাতপ প্রাচীন হিন্দুরাজাদের সভারও ভূষণ ছিল।

এই সমস্ত জিনিস রাজদরবারই বেশীর ভাগ কিনিত। বাকী বিদেশে রপ্তানী হইত। এইরূপ রাজসাহায্যে দেশের বস্ত্রশিল্প রেশমে পশমে সূতায় জরিতে ঐশ্বর্য্যবান ও অতুলনীয় হইয়া উঠিয়াছিল।

৬. রত্নালঙ্কার

হিন্দু যুগেই রত্নালঙ্কারের শিল্প যথেষ্ট উন্নত হইয়াছিল, মুসলমানী আমলে সেই ধারাই প্রবাহিত হইয়া আসিয়া প্রবল হইয়াছিল। মুসলমান বাদশাহ নবাব আমীর ওমরাহেরা স্বভাবত বিলাসী আড়ম্বরপ্রিয় ছিলেন; তাঁদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য ও অনুগ্রহভাজনদের বা মিত্ররাজাদের সন্তুষ্ট করিবার জন্য শিরোপা ও সম্মান-উপহার দিতে বহু অলঙ্কার রাজদরবারে আবশ্যক হইত। তার ফলে এই ভূষণশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়াছিল।

৭. তৈজস, প্রস্তর ও মৃৎপাত্র

চিত্রিত কারুকার্যখচিত ও বিচিত্র গঠনের তৈজসপত্র প্রস্তরপাত্র ও মৃৎপাত্র মুসলমানী আমলে প্রস্তুত হইত। হিন্দুরা উচ্ছিষ্ট ও অশুচি হয় বলিয়া মৃৎপাত্রের শিল্পের দিকে বেশী মনোযোগ দেয় নাই; মুসলমানী আমলে পোর্সিলেন ও কলাইকরা মাটির বাসন বহু প্রকারের আকৃতির ও অলঙ্কৃত প্রকৃতির প্রস্তুত হইত। হিন্দুদের তৈজসপাত্রও রোজ মাজা দরকার হয়, এজন্য তৈজসপাত্র সাদা করিত; কিন্তু মুসলমানী তৈজসপাত্র বিচিত্র কারুকার্য্যে খোদিত হইত; এক ধাতুর উপর অন্য ধাতুর খণ্ড বসাইয়া নানাবিধ নকসার বিদরী ও মিনার কাজ এবং কোফতগিরি ও তারের কাজ মুসলমানী তৈজসশিল্পের চরম নিপুণতা প্রকাশ করিয়াছে।

[ প্রবাসী, ভাগ ১৯, খণ্ড ২, সংখ্যা ১, কাৰ্ত্তিক, ১৩২৬।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *