মুসলমানের পরিচয়
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
স্যার সুরেন্দ্রনাথ তাঁর A Nation in Making গ্রন্থে বলতে চেয়েছেন, হিন্দু মুসলমানের বিরোধের সূচনা স্বদেশী আন্দোলন থেকে, তার পূর্বে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক মধুর ছিলো। এ-ধারণা শুধু স্যার সুরেন্দ্রনাথের নয়, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির। এর বিশেষ অর্থের আলোচনা আমরা তৃতীয় বক্তৃতায় করবো। আপাতত বলা যায়, কোনো কোনো অর্থে একথা সত্য, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন– “বিচ্ছিন্ন জিনিস জড়ের মত পড়িয়া থাকিলে তবু টিকিয়া থাকে, কিন্তু কোনো উপায়ে কোনো বায়ুবেগে তাহাকে চালনা করিতে গেলেই সে ছড়াইয়া পড়ে, সে ভাঙিয়া যায়, তার এক অংশ অপর অংশকে আঘাত করিতে থাকে; তাহার অন্তরের সমস্ত দুর্বলতা নানা মূর্তিতে জাগিয়া উঠিয়া তাহাকে বিনাশ করিতে উদ্যত হয়।”[দ্রঃ ‘পথ ও পাথেয়’] স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে যে রাজনৈতিক স্বার্থ-বোধ দেশে জাগলো তার ফলে দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরোধ উত্তরোত্তর প্রবল হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বে এ দেশে হিন্দু ও মুসলমানের সম্বন্ধ মধুর ছিল ঐতিহাসিক সাক্ষ্য তার বিরুদ্ধে। এমন কি, দেশের এই দুই সম্প্রদায়ের সম্বন্ধ শুধু অপরিচয়ের সম্বন্ধ ছিল এও বলা যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ফরিদপুরে ও যশোরে মুসলমান চাষী ও নমঃশূদ্রদের ভিতরে দীর্ঘকালব্যাপী একাধিক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সেই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানদের অনেকে দুই পক্ষে যোগ দিয়েছিল। [ফিরোজাবাদের দাঙ্গার তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতেও এই ধরনের দাঙ্গা সেখানে হয়েছিল।] মোঘল শাসনের শেষভাগে গুজরাটে ও কাশ্মীরে যে দুটি ভীষণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল বিখ্যাত ইতিহাস ‘সিয়ারুল মোতা’ আখেরী’ন- এ তার উল্লেখ আছে এইভাবে :
সম্রাট ফেরোখশিয়ারের সিংহাসনারোহণের বৎসরে আহমদাবাদে এক হিন্দু গৃহস্থ হোলির সময়ে তার বাড়ির উঠানে হোলি জ্বালালে। তখন হোলির সময়ে বিষম মাতামাতি হতো। আঙিনা-সংলগ্ন ও আঙিনার অতি অল্প অংশের অধিকারী মুসলমান গৃহস্থেরা তাতে আপত্তি করলো। হিন্দু গৃহস্থ সে আপত্তি শুনলেন না, বলে প্রত্যেকের তার নিজের বাড়িতে সর্বময় কর্তৃত্ব আছে। পরের দিন পড়লো হজরত মোহাম্মদের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষ্যে মুসলমান গৃহস্থেরা একটি গরু কিনে এনে সেই আঙিনায় জবাই করলে। এতে সেই অঞ্চলের সমস্ত হিন্দু উৎক্ষিপ্ত হয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করলে মুসলমানেরা পালিয়ে যে যার বাড়িতে আশ্রয় নিলে। তখন সেই উৎক্ষিপ্ত হিন্দু জনতা গোহত্যাকারী কশাইয়ের সন্ধান করলে তাকে না পেয়ে তার চৌদ্দ বৎসর বয়সের ছেলেকে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ সেই গোহত্যার স্থানে বলি দিলে। তখন শহরের সমস্ত বিক্ষুব্ধ মুসলমান ও আফগান সৈন্য কাজীর বাড়ি উপস্থিত হলো। কাজী জানতেন শাসনকর্তা দায়ূদ বা পণী এ ব্যাপারে হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছেন, তিনি এদের মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারা উত্তেজিত হয়ে কাজীর বাড়ির সদর দরজা ভাঙলে হয়তো কাজীরই গোপন ইঙ্গিতেও তারপরে আরম্ভ করলে শহরের হিন্দুদোকানে আগুন দিতে। অচিরেই কাপূর চাঁদ নামক একজন রত্ন-বণিক লোজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের বাধা দিলে। কয়েকদিন এভাবে গণ্ডগোল চললো। শেষে শাসনকর্তা মুসলমানদেরই বেশি দোষী সাব্যস্ত করলেন।
কাশ্মীরের দাগটি এর কিছুকাল পরে ঘটে। সেখানকার আব্দুল নবী ওরফে মাহাতাবী ভয়ানক হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এই অরাজকতার কালে একদল ভবঘুরে উচ্ছল মুসলমান জুটিয়ে তাদের নেতা হয়ে সে স্থানীয় শাসনকর্তা ও কাজীর কাছে এই প্রস্তাব করলে যে এর পরে হিন্দুদের আর কোনো সমসূচক যান-বাহন বা বস্ত্রাদি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না; বাগান ও স্নানের ঘাটও তাদের জন্য নিষিদ্ধ হবে। সহকারী-শাসনকর্তা ও কাজী বললেন, মহামান্য বাদশাহের যা হুকুম তাই-ই কাশ্মীরে চলবে। বলা বাহুল্য এতে মাহাতাবী খা সন্তুষ্ট হলো না। এর পর তার কাজ হলো সুবিধা পেলেই হিন্দুদের আক্রমণ করা ও তাদের উপর অত্যাচার করা। একদিন সাহাব রায় নামক জনৈক ভ্রান্ত হিন্দু এক বাগানে উৎসব করছিলেন। সেই নিরপরাধ লোকদের উপর সে তার দলবল নিয়ে হামলা করলে এবং যত পারলে খুন জখম করলে। সাহাব রায় পালিয়ে সহকারী-শাসনকর্তার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। তার বাড়ি এই মাহাতাবী খার দল ইচ্ছামত লুটতরাজ করলে সেই অঞ্চলে কোনো হিন্দুবাড়ি বাদ গেল না। এই সব বাড়িতে আগুন দেওয়াও চললো। যে সমস্ত মুসলমান এই হতভাগ্যদের জন্য দুকথা বলতে এলেন তারাও খুন জখম হলেন। এই মাহাতাবী খার দলের সঙ্গে কাশ্মীরের রাজপুরুষেরা এঁটে উঠতে পারলেন না, তাঁরা পালিয়ে গেলেন। তাদের আশ্রিত হিন্দুদের উপরে তখন হলো অকথ্য অত্যাচার। জয়ী হয়ে মাহাতাবী খা স্থানীয় মসজিদে নিজেকে “দিনদার খা” (ধর্মরক্ষক) বলে ঘোষণা করলে ও শাসনকাজ চালাতে লাগলো। রাজপুরুষদের একজনের চক্রান্তে মাহাতাবী ও তার দুই শিশুপুত্র নিহত হলে তার দল উকট হত্যাকাণ্ড চালালে। প্রায় তিন হাজার লোক তাদের হাতে মারা পড়লো তার অধিকাংশই মোঘল। কয়েক মাস ধরে এই দাঙ্গা চলে।
শেষের এই ঘটনাটি “সয়ারুল মোতা’ আখেরীন” এর লেখক বলেছেন একদল শয়তানের কাজ। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ যারা বুঝতে চান তাঁদের জন্য সেখানের এই দুটি ঘটনাই খুব অর্থপূর্ণ। একালের কলকাতা, ঢাকা, কানপুর, চাটগা প্রভৃতি স্থানের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সঙ্গে এসবের আশ্চর্য মিল রয়েছে।
হিন্দু ও মুসলমানের বিরোধের মূল কারণ সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন– The Muliammadan is a bully and the Hindu is a coward 2 A গুন্ডা আর হিন্দু কাপুরুষ। এই কথাই কেউ কেউ তত্ত্বের ভাষায় বলেছেন মুসলমান রাজসিক, হিন্দু সাত্তিক, তবে দুই-ই কিছু কিছু বিকৃত। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে প্রকৃতির ভেদ আছে; তাও সাত্ত্বিক রাজসিক তামসিক এমন স্পষ্ট ভেদ আছে কি না সন্দেহ। সে-ক্ষেত্রে দুটি বিরাট ধর্ম-সম্প্রদায়কে মানস প্রকৃতির দিক থেকে স্পষ্ট দুইভাগে ভাগ করবার চেষ্টা বিপত্তি ঢের। বাস্তবিক, কি সেকালের দাঙ্গা কি একালের দাঙ্গা কোনোখানেই হিন্দুর শুধু কাপুরুষতার মুসলমানের শুধু জবাইদুরীর পরিচয়ই যে আছে তা নয়। কোনো কোনো শ্রেণীর হিন্দু-মুসলমানের ভিতর কিছু পার্থক্য থাকলেও এই দুই বিরাট সমাজের ভিতরে আশ্চর্য কোনো পার্থক্য যে নেই তার প্রমাণ স্বরূপ এই কটি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে :
প্রথমত, গুভার ভাব দুপক্ষের প্রকৃতিতেই আছে, কেননা নৃশংসতার পরিচয় কোনো পক্ষে কম নেই, দাঙ্গায় আগ্রহী হবার অপরাধ থেকেও কোনো পক্ষ মুক্ত নয়; ভীরুতাও দুই পক্ষেই আছে। ঢাকার দাঙ্গায় দেখেছি হিন্দুরা মুসলমানের ভয়ে পালিয়েছে, মুসলমান-বস্তি সারারাত জেগে কাটিয়েছে এই ভয়ে যে কখন হিন্দুরা এসে ঘর জ্বালিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, যাঁরা বলেন, ভারত বিশেষভাবে অহিংসার ও পরধর্মপ্রীতির দেশ তাদের দৃষ্টি এই ঐতিহাসিক ব্যাপারের দিকে আকৃষ্ট হওয়া উচিত।
(ক) হিন্দু ও বৌদ্ধের বিরোধিতায় বৌদ্ধ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, বৌদ্ধদের উপরে যে অত্যাচার হয়েছিল কোনো কোনো খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের এই মত, [ভারতীয় বিশেষজ্ঞ শ্যাম শাস্ত্রীর মতে ব্রাহ্মণের বৌদ্ধদের কৌশলে পর্যুদস্ত করেছিল বলে নয় “Evolution of Indian Policy” দ্রষ্টব্য] বৌদ্ধদের যে একটি বিরাট সংস্কৃতি ছিল একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মনীষী আলবেরুনী তাঁর ব্রাহ্মণ আচার্যদের কাছ থেকে সে-সম্বন্ধে কোনো নির্দেশ পাননি।
(খ) যদি চাণক্যের অর্থশাস্ত্র ও বৌদ্ধজাতক ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পৰ্কশূন্য মনে করা না হয় তবে বলা যায়, স্বজ-শোণিত রঞ্জিত সিংহাসন শুধু পাঠান ও মোঘল ভারতের বিশেষত্ব নয়, হয়ত ভারতের বিশেষত্ব। তৃতীয়ত, মুসলমানের ইতিহাস হিন্দুর মতন দীর্ঘ না হলেও কম দীর্ঘ নয়, ঘটনাবহুল তো বটেই। দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও নাস্তিক্য, একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ, একান্ত দৈবানুগত্য ও একান্ত পুরুষকার-বাদ, একান্ত শাস্ত্রানুগত্য ও একান্ত মুক্তবুদ্ধিপ্রবণতা, প্রেম ও অহিংসা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টি ও পরধর্ম বিদ্বেষ এর কিছুই হিন্দু ও মুসলমান কারো ইতিহাসে দুর্লভ নয়। আর সব চাইতে বড় কথা এই দুই সম্প্রদায়ই জীবন্ত, কারো অভিব্যক্তি থেমে যায় নি।
হিন্দু ও মুসলমানের বিরোধের কারণ কি সোজাসুজিভাবে এই দুরূহ প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়াই ভাল। তার পরিবর্তে মুখ্যত তাদের বর্তমান চিন্তা-ভাবনার আশা-আকাক্ষার সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে এ-বিরোধ মীমাংসার অন্তত এ বিরোধে অভিভূত না হবার, কিছু শক্তি আমাদের লাভ হবার সম্ভাবনা আছে। মুসলমান কম পরিচিত, সেজন্য তার পরিচয় আগে নেবার দরকার। কিন্তু তার একালের পরিচয় লাভের জন্যও অল্প-বিস্তর পূর্বাভাসের প্রয়োজন।
ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা মোহাম্মদের প্রচারক-জীবন সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করে দেখেন মক্কার জীবন ও মদিনার জীবন। তারা বলেন মক্কার জীবনে তিনি ছিলেন ধর্ম প্রচারক–অন্যান্য ধর্ম প্রচারকের মতো সত্যদ্রষ্টা মানব-প্রেমিক নীতির প্রবর্তক। এ সব বিশেষণ তখন তাঁর জন্য শোভন; কিন্তু মদিনার জীবনে তিনি বিজয়ী বীর ও রাষ্ট্রের অধিনায়ক। অপরপক্ষে মুসলমান চিন্তাশীলেরা তার মদিনার জীবনকেই বেশি মর্যাদা দেন, কেননা মুসলমান-মণ্ডলী তাদের দৈনন্দিন জীবন, যাত্রা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন নির্দেশ তার মদিনার জীবন থেকেই লাভ করে আসছেন। এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে রয়েছে দুই রকমের ভুল। অমুসলমান দলের ভুল তারা ধর্ম বলতে প্রধানত প্রাচীন আচার্যদের জীবনাদর্শ ও মতামতই বোঝেন; কোনো নূতন আদর্শ ও মত হজরত মোহাম্মদের জীবনের ও সাধনায় রূপ লাভ করেছে কিনা সে-কথাটি বুঝে দেখবার মতো ধৈর্যের ও বিনয়ের তাঁদের অভাব। আর মুসলমান দলের ভুল–যাকে তারা ধর্মগুরু অজ্ঞান করেছেন তার সব কাজই তাঁরা মনে করে বিচারের অতীত।।
যাই হোক, হজরত মোহাম্মদের মদিনার জীবনের প্রভাবেই মুসলমান জগৎ গড়ে উঠেছে। সেই জীবনের ভূমিকা হচ্ছে মুসলমান মণ্ডলীর প্রতি পৌত্তলিক ও ইহুদি আরবদের নির্মম শত্রুতা যার জ• নায়কের একান্ত অনুবর্তিতা, একচিত্ততা বিপক্ষের প্রতি সন্দেহশীলতা, প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের জন্য অবশ্যকাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু যারা বলেন, মদিনার মোহাম্মদ মুখ্যত রাষ্ট্রনেতা, তাঁরা এই বড় ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে ভুলে যান যে তার জীবনের এই কালে তার প্রেরণা-লব্ধ কোরআনে যে-সব নির্দেশ প্রকাশ পেয়েছে আর গুসলমান সমাজে সে-সবের যে রূপ লাভ হয়েছে তা তার শিক্ষার চিরন্তন রূপ না বলে সাময়িক রূপও বলা যেতে পারে। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। মদিনায় অবতীর্ণ একটি “সুরা’র শেষে বলা হয়েছে– “হে বিশ্বাসীগণ, আল্লাহর রোষে যারা পতিত হয়েছে সেই দলের লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না (৬০:১৩)। টীকাকার বলেছেন, এখানে ইহুদিদের কথা বলা হয়েছে। সমসাময়িক মুসলমানেরা হত এই কথাই ভাল করে বুঝেছিলেন এবং তাদের অনুবর্তিতায় পরবর্তী মুসলমানেরা হয়ত বুঝে নিয়েছেন যারা মুসলমান-সম্প্রদায়ভুক্ত নয় তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরআনের অনভিপ্রেত। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় এই বাক্যের সত্যকার মর্যাদা যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। একথা স্বীকার করা যেতে পারে যে সেই দিনে মুসলমান বিশেষভাবে ধর্মপ্রাণ ছিলেন আর তাঁদের ধ্বংসকামী গর্বিত ইহুদি ধর্মপ্রাণ ছিলেন না। কিন্তু ধর্মপ্রাণতা কোনো সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ নয়, তাই কালে কালে এমন অবস্থার উদয় সম্ভবপর যখন মুসলমান সমাজের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের বন্ধু সেই সমাজে দুর্লভ হতে পারে ও সেই সমাজের বাইরে সুলভ হতে পারে। এ সম্ভাবনার কথা মুসলমান অমুসলমান উভয়পক্ষই যে কোরআনের এই ধরনের বাণীর ব্যাখ্যাকালে বিস্তৃত হয়েছেন একে শোচনীয় না বলে উপায় নেই। তবে মুসলমানের ঐতিহাসিক অভিব্যক্তির ধারায় এই স্কুল ব্যাখ্যাই একমাত্র সত্য নয়; যদিও প্রবল সত্য; মুসলমান দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা ও ভক্তরা অনেকখানি স্বতন্ত্রভাবে কোরআন ও হজরত মোহাম্মদের জীবন বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। এর একটি দৃষ্টান্ত বড় অদ্ভুত। যে যুগে সুলতান মাহমুদ ভারতের মন্দির ধ্বংস করে ধনরত্ন আত্মসাৎ করেছিলেন সেই যুগে ইসলামে পরম শ্রদ্ধান্বিত আলবেরুনী অশেষ যত্নে ও শ্রদ্ধায় হিন্দুর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সন্ধান করছিলেন, তার উৎকৰ্ষাবর্ষের বিচার করে জ্ঞানীদের দরবারে উপহার দিচ্ছিলেন।
ইসলামের পরিস্ফুর্তির মূলে এই যে বিশেষ রাজনৈতিক প্রভাব একই সঙ্গে এটি ইসলামের শক্তির ও দুর্বলতার কারণ হয়েছে। শক্তির কারণ এই জন্য যে ধর্মাদর্শের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপলাভ তার সার্থকতার জন্য একান্ত বাঞ্ছিত, নইলে তা রয়ে যায় শুধু সম্ভাব্যতার দেশের ব্যাপার। এর দৃষ্টান্ত ইসলামে সাম্য নীতি। অন্যান্য ধর্মাচার্য ও সাম্য-নীতি প্রচার করেছিলেন, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ এই জন্য যে ধর্মাদশের কোন বিশেষ রূপই তার চরম রূপ নয়: আদশের বিকাশ আছে তার রূপেরও বিকাশ আছে; কিন্তু ধর্মাদশের সাধারণত কঠিন-দেহ, কোনো ধর্মাদর্শ যদি একবার কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপ লাভ করে তবে তারও রূপান্তর সহজ সাধ্য হয় না। এর দৃষ্টান্ত বিপক্ষের সঙ্গে মুসলমানের সম্বন্ধ। সেক্ষেত্রে একবার যে তলোয়ারের সম্বন্ধ বড় হয়েছিল তারপর সে তলোয়ারকে কোষবদ্ধ করা দুঃসাধ্য হচ্ছে; যদিও হজরত মোহাম্মদের বহু কর্মের ও কোরআনে বিপক্ষের সঙ্গ সম্পর্কে প্রতি অগ্রগণ্য হয়েছে, মুসলমান সভ্যতাও মাঝে মাঝে এর প্রকাশ মনোজ্ঞ হয়েছে।
মুসলমানের চিন্তার ইতিহাসে খুব বড় যে ব্যাপারটি চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে বিচার-বুদ্ধি ও শাস্ত্রানুগত্য এই দুইয়ের ভিতরে কঠোর সংগ্রাম, আর সে সংগ্রামে জনসাধারণের প্রাধান্য। ভারতেও বিচার-বুদ্ধি ও বেদানুগত্যের ভিতরে যে সংগ্রাম হয়েছিল তা কঠোর, কিন্তু সে সংগ্রামে জনসাধারণ হয়েছিল অনুবতী, নেতা নয়। এর বড় কারণ হয়ত এই যে ইসলামের বাহন হয়েছিল একটি দুর্ধর্ষ চির-স্বাধীন জাতি। বহু বিরুদ্ধতার পরে একবার তারা হয়ত মোহাম্মদের বিরাট বিরাট ব্যক্তিত্বের কাছে মাথা নত করেছিল; কিন্তু বিকাশোন্মুখ মানুষকে যে নানা মতবাদের কাছে বারবার নত করতে নয়, অবশ্য কৌতূহলে ও অনুরাগে, সে-কথা ভাল করে বুঝবার মতো অনুকূল অবস্থার সৃষ্টির পূর্বেই আর একটি দুর্ধর্ষ জাতি, অর্থাৎ তাতার জাতি এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল ইসলামের পরিচালনার। তাই ইসলামের আবির্ভাব থেকে প্রায় চারশত বৎসরের মধ্যে চিন্তার প্রভূত বৈচিত্র্য মুসলমান জগতে প্রকাশ পেলেও সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য একাল পর্যন্ত বিশেষ শ্রদ্ধার সামগ্রী হয়ে আছে দুটি বিষয় কোরআন ও হজরত মোহাম্মদের বাণী, অথবা, সোজাসুজি ভাবে এই দুইয়ের অনুবর্তিতা। এর বাইরে আর একটি ব্যাপারও দীর্ঘকাল তাদের চিত্ত আকৃষ্ট করেছিল– সুফীর অধ্যাত্মবাদ বা অন্তর্জোতিবাদ, বিরাট ব্যক্তিত্বশালী ইমাম গাজ্জালীর প্রভাবে এই মতবাদের বিস্তার ঘটে। কিন্তু শাস্ত্রানুগত্যের সঙ্গে যেভাবে যুক্ত করে এই তত্ত্ব তিনি জনসাধারণকে দিয়েছিলেন তারই ভিতরে নিহিত হয়েছিল এর ভবিষ্যৎ অসার্থকতার বীজ।
মুসলমানের চিন্তার ইতিহাসে বিচার-বুদ্ধির পরাভব ব্যাপারটি বেশ বুঝে দেখবার মতো। মুসলমান চিন্তাশীলদের তিনটি বড় দলে ভাগ করে দেখা যেতে পারে বিচার পন্থী, মধ্য পন্থী, একান্ত শাস্ত্রানুগত্য পন্থী। বিচার-পন্থীরাও এক হিসাবে শাস্ত্রানুগত্য-পন্থী, তবে শাস্ত্রবাক্যের ব্যাখ্যায় বিচার বুদ্ধির সহায়তা তারা বিশেষভাবে গ্রহণ করতেন। এই দলের এক আদি ব্যক্তি আব্বাসীয় শাসনের প্রারম্ভের ইমাম আবু হানিফা। তাঁর মতানুবর্তী হানাফী দল মুসলমান জগতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে, সংখ্যাগরিষ্ঠ; কিন্তু নামে হানাফী হলেও তাঁর শিষ্যদের প্রভাবে প্রায় প্রথম থেকেই তারা মধ্যপন্থী অর্থাৎ শাস্ত্রানুগত্যই তাদের জন্য বড় কথা, তবে বিচার বুদ্ধির সাহায্য তারা কখনো কখনো নেন। একান্ত শাস্ত্রানুগত্য পন্থীর দল মুসলমানের গৌরব-যুগে, যেমন আব্বাসীয় যুগে, তেমন প্রবল প্রতাপ হননি। কিন্তু এই আব্বাসীয় যুগেই বিচারপন্থীরা এই দলের নেতা ইমাম হাম্বলের উপরে যে কঠোর অত্যাচার করে তার ফলে বিচার পন্থীদের প্রতি মুসলমান জনসাধারণের ঘৃণা ও অবিশ্বাস প্রবল হবার সুযোগ পায়। এর পরে সর্বপ্রকারে যুক্তিবাদের অসারতা ইমাম গাজ্জালী যখন বিশেষ দক্ষতা সহকারে প্রতিপন্ন করলেন এবং শান্ত্রানুগত্য ও অন্তর্জোতিঃ-তত্ত্ব সত্যান্বেষীদের জন্য শ্রেয়ঃ জ্ঞান করলেন তখন বিচার-বাদ স্বভাবতঃই দুর্দশাগ্রস্ত হলো। ইমাম গাজ্জালীর মত খণ্ডন করে বিচার-বাদের ধ্বজা পুনর্বার উত্তোলন করতে চেষ্টা করেন স্পেনীয় দার্শনিক ইবনে রুশদ (Averroes)। কিন্তু তিনিও যুক্তিবাদ জনসাধারণের জন্য কাম্য জ্ঞান করেননি। তাঁর মতের সমাদর হয় ইহুদিদের কাছেও তাঁদের সহায়তায় ইয়োরোপে। ইয়োরোপীয় বুদ্ধির মুক্তির ইতিহাসে (Averoes) এর আসন যে গৌরবের ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা সে-কথা স্বীকার করেন। ইসলামের বিচার-বাদ এইভাবে যে সাগর-পার হয়ে গেছে তারপর তাকে ফিরিয়ে আনবার কিছু সজাগ চেষ্টা করেছেন স্যার সৈয়দ আহমদ ও আমির আলি। তাদের পূর্বে রামমোহনের ভিতরে এই বিচার-বাদের প্রভাব বুঝতে পারা যায়।
আব্বাসীয় যুগের ইমাম হাম্বলের পরে একান্ত শাস্ত্রানুগত্য-বাদের বড় নেতা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের ইমাম ইবনে তায়মিয়া। “আদিম ইসলামে প্রত্যাবর্তন বাদকে তাঁর অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞানের সাহায্যে তিনি পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। কেবল কোরআন ও বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত হজরত মোহাম্মদের বাণী মুসলমানের জন্য নির্ভরযোগ্য নয়, একমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা জানানো যায়, পয়গাম্বর ইমাম সুফী এঁদের কাছে প্রার্থনা জানানো ধর্মবিরুদ্ধ– এই সব মত তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেন। সুফীর অন্তর্জোতিঃ-তত্ত্ব তিনি আদৌ শ্রদ্ধা করতেন কি না বলা শক্ত, তবে কোরআন ও হজরত মোহাম্মদের বাণীর সহজ অর্থের একান্ত আনুগত্য তিনি মুসলমানদের জন্য যে বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন এ সর্বদিসম্মত। তদানীন্তন সমাজের সুফী প্রাধান্যের জন্য তাঁকে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল; কিন্তু জনসাধারণের বিশেষ শ্রদ্ধা তিনি লাভ করেন। তার অষ্টাদশ শতাব্দীর শিষ্য আবদুল ওয়াহ্হাব ও তাঁর অনুবর্তিগণ এই মতবাদের প্রচারে সফলকাম হন, আবদুল ওয়াহহাব নাম অনুসারে এই চিন্তাধারার সাধারণ নাম হয়েছে ওয়াহহাবী মত। সত্য বটে পীর পূজা প্রভৃতি ওহাবী নিন্দিত কর্ম ও মত এখনো মুসলমান সমাজে লোপ পায়নি, কিন্তু এসব শাস্ত্রবিরুদ্ধ অতএব প্রশস্ত নয়, এই বাণী মুসলমান জনসাধারণের কার্ণেও প্রবেশ করেছে।
এই ওহাবী মত বা “আদিম ইসলামে প্রত্যাবর্তন”-বাদ বর্তমান মুসলিম জগতে, বিশেষ করে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে, প্রবলতম মত। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এদেশে এই মতের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পাঞ্জাবে মুসলমানদের উপরে শিখেরা অত্যাচার করে; ওহাবীরা সেখানে জেহাদ ঘোষণা করে। এই সংঘর্ষ ক্রমে ইংরেজও- ওহাবীতে বর্তে। ওহাবীদের দমন করতে ইংরেজ গভর্ণমেন্টকে বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু ওহাবী মত তখন যা ছিল এখন তার কিছু কিছু বদল হয়েছে। ভারতবর্ষ অমুসলমান রাজ্য, মুসলমান ধর্মকর্ম এখানে বাধাগ্রস্ত, এই বিবেচনায় ওহাবীরা একে “দরুল হরব’ বলে ঘোষণা করে’ দারুল হরব’ এ শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজন মত জেহাদ ঘোষণা করা ধর্মকর্ম।৩১ কিন্তু এখন ভারতবর্ষকে সাধারণত “দারুল হরব” বলে গণনা করা হয় না “দারুল ইসলাম বলা হয়, কেননা এখানে মুসলমানদের ধর্মকর্ম বাধাগ্রস্ত নয়। কাজেই ওহাবী মত এখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধং দেহি ভাব পরিত্যাগ করে’ (এর মতে) ভারতের তথাকথিত মুসলমানদের মুসলমানীকরণে মন দিয়েছে। তাই বাংলার সাধু-সংকল্প হিন্দু যখন দুঃখিত হয়ে বলেন মুসলমানদের চাষীরা তো আগে আমাদের পূজা আর্চায় বেশ যোগ দিত, আমাদের বাড়িতে খেতেও তাদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু দিন দিন সব কেমন হয়ে যাচ্ছে তখন তাঁর প্রতিবেশীদের ঘরের খবর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার পরিচয় তিনি দেন।
এই ওহাবী মত ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে এমন প্রভাব বিস্তার করলে কেন সে-কথাটি বুঝে দেখার মতো। কিন্তু বিশাল ভারতের চাইতে এই সমস্যাটি মুখ্যত বাংলাদেশে সংকীর্ণ করে দেখাই নানা কারণে সঙ্গত মনে করি। এই সম্পর্কে বাংলার মুসলমানদের উৎপত্তি-কথার কিঞ্চিত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে আদম শুমারীর রিপোর্টে মিঃ বেভেলি (Mr. H. Beverley) বলেন, বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বাংলার হিন্দু সমাজের নিম্নশ্রেণীর থেকে উদ্ভূত– ইসলামের তলোয়ারের জোরে তারা মুসলমান হয়। রিজলি সাহেব তার Tribes and Castes of Bengal গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সহকারে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে বাংলার মুসলমান, বিশেষ করে মুসলমান চাষী, বাংলার নিম্নশ্রেীর হিন্দুর বংশধর। এই মতের প্রতিবাদ করেন মুর্শিদাবাদের দেওয়ান খোন্দকার ফজলে রাব্বি। তার The Origin of the Mussalmans of Bengal গ্রন্থে (এটি তার পার্শীতে লেখা “হকিকত-ই-মুসলমান-ই-বাঙ্গালা’র ইংরেজি অনুবাদ) তিনি এইভাবে এ মত খণ্ডন করতে চেষ্টা করেন :
(১) তলোয়ারের জোরে এদেশে ইসলাম প্রচার হয়ে থাকলে উত্তর ভারতে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত। সেখানে মুসলমানের তলোয়ারের জোর বাংলার চাইতে কম ছিল না।
(২) বাংলার মুসলমান বাংলার উচ্চ বা নিচ কোনো স্তরের হিন্দুর বংশধর যে মুখ্যত নয় তার ঐতিহাসিক প্রমাণ এই :
(ক) “তারিখ-ই-ফেরেশতা”, আবদুল কাদির দাউনির “মনতাখাত্তাওয়ারিখ” প্রভৃতি ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে বাংলায় মুসলমানের আগমন থেকে আরম্ভ করে নবাব সুজা খার রাজত্ব কাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমান শাসকরা এদেশে মুসলমানদের বসবাসের সুবিধার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা অনেক মুসলমান পরিবারকে জায়গীর প্রভৃতি দান করে বাংলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহু মুসলমান সৈন্যও এদেশে আগমন করেন।
(খ) দিল্লী রাষ্ট্রবিপ্লবের কেন্দ্রস্থল ছিল বলে অনেক মুসলমান সুদূর বাংলায় বসতি স্থাপন নিরাপদ মনে করতেন।
(গ) ম্রাট আকবর অনেক স্বধর্মনিষ্ঠ মুসলমানকে বাংলায় নির্বাসিত করেন।
(ঘ) সমুদ্রপথে অনেক বিদেশী মুসলমান বাংলায় আগমন করে এবং বসতি স্থাপন করে।
(ঙ) বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের ভিতরে ভাষাগত পার্থক্য আছে। দুজনেই বাংলা বলে কিন্তু ঠিক এক বাংলা নয়। মুসলমানের বাংলায় আরবী ফারসী শব্দের সংখ্যা অনেক বেশি।
(চ) রিজলি সাহেবের পদ্ধতি নির্ভুল নয়। কেননা, তিনি সব শ্রেণীর মুসলমানের নাকের মাপ নিয়ে গড় কষেননি, বেছে বেছে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের নাকের মাপ নিয়েছেন।
দেওয়ান সাহেবের গবেষণায় অন্তত এই কথাটি প্রমাণিত হয়েছে যে বাংলায় বাংলার বাইরের মুসলমান কম আসেন নি, অবশ্য দেশের সমগ্র লোকসংখ্যার কত ভাগ তা বলা শক্ত। কিন্তু তাঁর সমস্ত যুক্তির বিরুদ্ধে এই বড় যুক্তিটি দাঁড় করানো যেতে পারে, যুক্তিটি মুসলিম-ইতিহাসবেত্তা ঢাকার হাকিম হবিবুর রহমানের। বিজেতারা সাধারণ বিজিত দেশ থেকেই স্ত্রী গ্রহণ করে থাকেন, ভারতবিজয়ী মুসলমানদের বেলায়ও এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি, হিন্দুস্থানী সৈয়দ, হিন্দুস্থানী শেখ, হিন্দুস্থানী মোগল ও হিন্দুস্থানী পাঠানের উদ্ভব এইভাবে– এই তাঁর মত। এ মত যে গ্রহণযোগ্য তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে দেওয়ানী সাহেব যে বাংলার মুসলমানকে হিন্দু রক্তের সংস্রবশূন্য মনে করেছেন তা আর টেকে না। এদেশের প্রাচীন মুসলমানদের স্ত্রী-গ্রহণ সম্পর্কে একটি কৌতুকাবহ ব্যাপার ইবনে বতুতার ভ্রমণ-কাহিনীতে আছে। মুসলমান রাজত্বের প্রায় সূচনায় তিনি এদেশে আসেন। তিনি লিখেছেন এদেশে স্ত্রীরূপে গ্রহণযোগ্য দাসী অল্প মূল্যে পাওয়া যেত, তার সামনে একটি সুন্দরী যুবতী বিক্রীত হয়েছিল এক স্বর্ণ দিনারে অর্থাৎ দশ টাকায়। তিনিও প্রায় এই মল্যে একটি অতি সুন্দরী দাসী কিনেছিলেন। অবশ্য এই সব দাসী কোন জাতীয় ছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। ৩বে শুধু মুসলমানদের কণ্যাই যে এইভাবে বিক্রীত হতো তা মনে করবার হেতু নেই।
দেওয়ান সাহেব রিজলী সাহেবের মত যেভাবে খণ্ডন করতে চেয়েছেন তাও আপত্তিকর। বাংলার চাষী সম্প্রদায়ের অনেকে হিন্দুর সন্তান এই তার প্রতিপাদ্য। সেক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের তিনি যদি তাঁর গবেষণার বিষয় বলে গণ্য না করে থাকেন তবে তাঁর সেই কাজটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দিক দিয়ে অসঙ্গত হয় না। অবশ্য আজকাল নাকের গঠন দিয়ে জাতি নির্ণীত হয় কি না তা নৃতত্ত্ববিদরাই ভাল জানেন।
দেওয়ান সাহেবের প্রতিপাদ্যের বিরুদ্ধে আর একটি যুক্তি হান্টার সাহেবের গেজেটিয়ারে আছে। তিনি বলেছেন, কিছুদিন পূর্বেও বাংলার অনেক মুসলমান দুর্গা-কালী-লক্ষ্মী প্রভৃতি হিন্দু দেবদেবীর পূজা করতো।
কিন্তু হান্টার সাহেবের এই যুক্তির বিরুদ্ধেও যুক্তি আছে বাংলার কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলমানও দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবীর পূজা করতেন একথা সুপ্রসিদ্ধ। এর বড় কারণ বোধ হয় এই যে ওহাবী প্রভাবের পূর্বে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা প্রতীক চর্চার একান্ত বিরোধী ছিল না। পীরের কবরে বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন, দিনক্ষণ পুরোপুরি মেনে চলা, সমাজে এক শ্রেণীর জাতিভেদ স্বীকার করা, এসব ব্যাপারে মুসলমানের মনোভাব প্রায় হিন্দুর মতোই ছিল। তাছাড়া মুসলমান লিখিত কাব্যে প্রতিমা পূজারির ভক্তি নিবেদনের সৌন্দর্য অনেকদিন থেকে বর্ণিত হয়ে আসছিল; কাব্য-কল্পনায় আর বাস্তব জীবনে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টা অনেক সময় মানুষের সমাজে হয়।
বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের ভাষাগত যে পার্থক্যের কথা দেওয়ান সাহেব এবং একালের কোনো কোনো পদস্থ মুসলমান বলেছেন সে সম্বন্ধে এই কথা বলা যায় যে পূর্বে হিন্দুর ব্যবহৃত বাংলা ভাষায়ও আরবী ফারসী শব্দের সংখ্যা এখনকার চাইতে অনেক বেশি ছিল, টেকচাঁদের সাহিত্য তার এক প্রমাণ। একালে সাহিত্য যেভাবে গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে মুসলমানের চাইতে হিন্দুর যোগ। অনেক বেশি বলে হিন্দুর মুখের ভাষায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
দেওয়ান সাহেব তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি যুক্তি খণ্ডন করতে ভুলে গেছেন। অথবা ইচ্ছা করেই সেটি তোলেন নি। সেটি এই যে অনেক মুসলমান ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে এদেশের অনেক লোক মুসলমান হয়েছিল। শ্রীহট্টের শাহজালালের প্রভাবে সেই অঞ্চলের বহু অধিবাসী যে মুসলমান হয়েছিল ইবনে বতুতার প্রাণ বৃত্তান্তে তার উল্লেখ আছে।
বাংলাদেশের নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের বেশভূষা যে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সঙ্গে তুলনায় স্বতন্ত্র রকমের ছিল, এখনও যেমন আছে– সে কথা সিয়ারুল মোতা আখেরীন এর অনুবাদক প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে উল্লেখ করে গেছেন। তিনি তাদের নামে মাত্র মুসলমান বলেছেন কেননা তারা মুসলমানী রীতিনীতি আচার ব্যবহার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাদের মাথায় যে টুপি ই এটি মুসলমানের পক্ষে তিনি খুব অদ্ভুত বিবেচনা করেছেন।
দেখা যাচ্ছে দেওয়ান সাহেবের মতের বিপক্ষেই যুক্তি প্রবল। বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বাংলার নিম্নশ্রেণীর হিন্দুর সন্তান, কি উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর সন্তান, সে-তর্ক অবশ্য অর্থহীন। ছোট বড় হয়, বড় ছোট হয়। কোনো একশ্রেণীর লোককে সম্ভাবনার দিক দিয়ে বড় ভাবা কুসংস্কার। তাছাড়া বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই বাংলার বিশাল বৌদ্ধ-সমাজ থেকে উদ্ভুত হবার সম্ভাবনা বেশি। [দ্রঃ ‘বাংলার মুসলমানের কথা’]
কিন্তু দেওয়ান সাহেব প্রমুখ মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদীদের যুক্তি অপ্রবল হলেও একথাটি মানতেই হবে যে হিন্দু ও মুসলমান চাষীদের ভিতরে চরিত্রগত পার্থক্য বিদ্যমান। হিন্দু চাষী-শ্রেণীর লোকদের চাইতে মুসলমান চাষী কম শান্ত ও কষ্টসাধ্য কাজে মাথা দিতে বেশি অগ্রসর। এর কারণ কি? হিন্দু ও মুসলমানের এ রকম পার্থক্য শত বৎসর পূর্বে রামমোহনও লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এর কারণ মাংসাহার। কিন্তু পল্লীর মুসলমান মাংস অতি অল্পই খায়। হিন্দু মুসলমানের একালের মারামারির পর থেকে কিন্তু বাস্তবিকই তা নগণ্য। খাদ্যের দিক দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের ভিতরে এতদিন বড় পার্থক্য ছিল পেঁয়াজ আর রসুনের ব্যবহারে। কিন্তু এদুটি যদি এমন মহাশক্তি হবে তবে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা দিন দিন হীনবীর্য হয়ে পড়ছেন কেন?
চিন্তা ও বিশ্বাস-আদির পার্থক্য এই চরিত্রগত পার্থক্যের প্রধান কারণ বলে মনে হয়। এমতের সমর্থন পাওয়া যায় বাংলার হিন্দু সমাজের উচ্চ ও নিম্ন স্তরের লোকদের চরিত্রগত পার্থক্যের কথা ভাবলে। বাস্তবিকই চরিত্রগত পার্থক্য একালের বাংলার হিন্দু সমাজের এই দুই অংশের ভিতরে প্রকট হয়েছে। বহুদোষ সত্ত্বেও সে-সমাজের উচ্চস্তরের লোকদের বলা যায় সাহসী ও চলন্ত-মন-বিশিষ্ট, বহুগুণ সত্ত্বেও তার নিম্ন স্তরের লোকদের বলা যায় সাহসী ও চলন্ত মন বিশিষ্ট। বহুগুণ সত্ত্বেও তার নিম্নস্তারের লোকদের এই সব বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। হিন্দু সমাজের নানা আচার ও সংস্কারের চাপ থেকে সে-সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা কিছু অব্যাহতি পেয়েছে জ্ঞানকৃত চেষ্টায়, আর বাংলার মুসলমান সমাজের নিম্ন অংশের লোকেরা জীবনে কিছু সহজ সরল হতে পেরেছে উচ্চস্তরের লোকদের অবহেলার ফলে। বাংলার মুসলমান সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা বাংলার হিন্দু সমাজের নিম্নস্তরের লোকদের মতো কেন দিন দিন মুখ্যত আচার ধর্মী হয়ে হয়ে পড়ছে তার উত্তর পাওয়া যাবে এই বিবরণের বহুস্থানে।
বাংলার এই মুসলমান-সমাজ, বিশেষ করে এর সুবিশাল নিম্ন অংশ, যে অসার্থক জীবন যাপন করতো না তার পরিচয় রয়েছে সেকালের লোক-সাহিত্যে। ওহাবী প্রভাবের পূর্বে মুসলমান সমাজের উপরে প্রবল ছিল সুফী প্রভাব। মোটের উপর সেটি উদার মানবতার প্রভাব, কিন্তু আচার পরায়ণতা অলৌকিকতাপ্রীতি এসবও ছিল তার সঙ্গে যুক্ত।
এই সমাজ মানস শক্তির দিক দিয়ে তেমন সবল না হলেও ওহাবী- প্রভাবকে বাধা দিতে যে চেষ্টা না করেছে তা নয়। লালন ফকির প্রমুখ উনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান বাউলদের গানে রয়েছে সেই প্রতিবাদের ঝঙ্কার। সে-চেষ্টা সফল হয়নি কেন সে সম্বন্ধে এই কটি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে।
(১) অলৌকিকতার উপরে সুফী ও ওহাবী দুই মতেরই শ্রদ্ধা। কাজেই ওহাবীরা যখন পরম অলৌকিক কোরআন ও হজরত মোহাম্মদের পয়গাম্বরত্বের দোহাই দিলেন মুসলমান হিসাবে তখন অপর পক্ষের প্রায় কোনো উত্তরই রইল না।
(২) অনুবর্তিতা দুইয়েরই ধর্ম। সেক্ষেত্রে পীরের অনুবর্তিতার চাইতে পয়গাম্বরের অনুবর্তিতার মহিমা বেশি মনে হওয়া স্বাভাবিক।
(৩) এই মুসলমান-সমাজে কদাচার যথেষ্ট ছিল। প্রাচীন ইসলামের উন্নততর আচারের সামনে সেসব নতশির না হয়ে পারেনি।
কিন্তু দীর্ঘকালের জীবনধারার প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক মমতা তাকে এই সব যুক্তি জয় করতে পারতো না যদি রাজনৈতিক কারণ এর সহায় রূপে এসে না দাঁড়াত। বস্তুত অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর ওহাবী আন্দোলনকে এক রাজনৈতিক আন্দোলন বলেও গণ্য করা যেতে পারে– ধ্বংসশীল মুসলিম জগতের গা ঝাড়া দেবারও এক চেষ্টা। ভারতে অথবা বাংলায় রাজনৈতিক কারণ যে এর প্রভাবের মূলে তা বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনকালে মুসলমানদের অবস্থার ইতিহাসের কথা ভাবলে। ব্যাপারটি সংক্ষেপে এই :
হিন্দু সমাজের পদস্থ ব্যক্তিদের আনুকূল্যে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনে মুসলমানেরা যে খুব বিচলিত হয় নি তা বোঝা যায় এই দুটি ব্যাপার থেকে–
১. ইংরেজের অধিকৃত বাংলায় প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলিকাতা মাদ্রাসা ইংরেজের আনুকূল্যে মুসলমানদের লাভ হয়;
২. ইংরেজ শাসনের সূচনায় হিন্দু প্রধানত রাজবিভাগ ও মুসলমান প্রধানত বিচার বিভাগে নিযুক্ত থেকে জীবিকা অর্জন করতে থাকে। সেদিনে বাংলার মুসলমান যে বাংলাদেশে উন্নততর সম্প্রদায় ছিল রামমোহন রায় তাঁর বিলাতে সাক্ষ্যদানকালে ও হান্টার সাহেব তার indian Mussalmans গ্রন্থে সে কথা বলেছেন- “When the country passed under our Rule the Muslims were the superior racc.”
মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন আরম্ভ হলো দশসালা বন্দোবস্ত থেকে, আর তাদের সম্ভ্রান্তদের আর্থিক দুর্গতি চরমে পৌঁছলো সনদ দেখাতে না পেরে যখন তাঁদের বহু নিষ্কর জমিজমা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল– ইংরেজিতে এর নাম Resumption Proceedings আর যখন আদালতের ভাষা পাশরি পরিবর্তে ইংরেজি হলো। দশসালা বন্দোবস্তের ফলে মুসলমানদের আর্থিক অবস্থার কেমন পরিবর্তন হলো সে সম্বন্ধে হান্টার সাহেবের উক্তির সারাংশ এই :
Muslim landlords or collectors of revenue did not directly deal with the Muslim peasants, and they employed Hindu bailiffs to collect the revenue direct from the peasantry. So the Hindus in fact formed a Subordinate Revenue Service, and took their share of the profits before passing the collection on to the muslim Superiors. The latter however were responsible to the Emperor and formed a very essential link in the Muslim fiscal system. The series of changes introduced by Lord eornwallis and Sir John Shore ending in the Permanent Settlement in 1793 put an end to this fiscal system of the Muslims.
The Permanent Settlement most seriously damaged the position of Mahomedan houses, for the whole tendency of the settlement was to acknowledge as the landlords the subordinate Hindu Officers who dealt directly with the husbandmen.
It elevated Hindu collectors, who up to that tine had held but unimportant posts to the position of the landlords, gave them a proprietory right in the soil and allowed them to accumula e wealth which would have gone to the Muslims under their own Rule. [১০৪-৫ পৃষ্ঠায় হান্টার সাহেবের মূল বক্তব্য দ্রষ্টব্য]
এসব ব্যবস্থা যে মুসলমানদের শক্তিহীন করবার জন্যই করা হয়েছিল তা মনে হয় না, রাজস্ব যাতে বেশি পাওয়া যায় ও নিশ্চিতরূপে পাওয়া যায় এইই ছিল শাসকদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এর ফল মুসলমানদের জন্য শোচনীয় হলো। এই সময়ে ভারতে আসে ওহাবী আন্দোলন। বাংলার ওহাবী আন্দোলন যে মুখ্যত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তা বোঝা যায় বাংলার ওহাবীনেতা তিতুমিঞার বিদ্রোহ থেকেও :
Titu belonged to the Wahhabi Sect of Muhammadan fanatics, and was excited to rebellion in 1831 by a beard-tax imposed by Hindu landholders. He collected a force of insurgents 3000 strong, and cut to pieces a detachment of Calcutta militia which was sent against him. The magistrate collected reinforcements but they were driven off the field. Eventually the insurgents were defeated by a force of regulars and their stockade was taken by assault. (Imp. Gazt. Vol. XXIV-p. 71.)
ওহাবীরা ইংরেজের হাতে যখন অনেকখানি নিস্তেজ হলো তখন ইংরেজ ও মুসলমান সম্পর্ক দাঁড়াল এই– ইংরেজ সহজেই সকল মুসলমানকে শত্রুপক্ষ ভাবলো এবং তাদের সঙ্গে ব্যবহারের সদয়তা তার পক্ষে সম্ভবপর হলো না; মুসলমানদের সবাই যে ওহাবী মতাবলম্বী হলো তা নয় কিন্তু ইংরেজের প্রতি বিরূপতা তাদের ভিতরে ব্যাপক হলো। পাশীর পরিবর্তে ইংরেজিকে রাজভাষা করা হলে মুসলমানরা প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু প্রতিবাদের ফল না পেয়ে তারা ইংরেজি শিখতে এগোলো না। হান্টার সাহেব বলেছেন– ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক বিবর্জিত শিক্ষা মুসলমানেরা পছন্দ করতে পারলো না। কিন্তু মুসলমানদের খুব বড় অন্যায় এই হলো যে নতুন ব্যবস্থা সম্বন্ধে না-ই তারা বললে, ভাল করে বাঁচতে হলে কোন কোন ব্যাপারে হা-ও বলতে হবে সে চেতনা তাদের ভিতরে দেখা দিল না। অচিরেই তাদের অবস্থা এমন হীন হয়ে পড়লো যে সিপাহী বিদ্রোহের পরে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রধান কর্তব্য জ্ঞান করলেন শাসকদের বিষদৃষ্টির পরিবর্তে প্রসন্ন দৃষ্টি মুসলমানদের জন্য লাভ করা।
মুসলমানদের দুর্গতির সঙ্গে চললো হিন্দুদের উন্নতি-চেষ্টা ও তাদের প্রতি শাসকদের আনুকূল্য। তাই ওহাবীরা যখন শান্ত হয়ে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মুসলমানের ধর্ম ও সমাজের সংস্কারকরূপে এলেন তখন মুখে তাঁদের অনুবর্তিতা তেমন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত না হলেও ধীরে ধীরে এদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমানদের মনে এ ধারণা দৃঢ়মূল হওয়া বিচিত্র নয় যে ধর্মের আদিম ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়া ভিন্ন ইহকাল ও পরকালের জন্য তাদের আর কি করবার থাকতে পারে। হিন্দু-সমাজের সূচিত জাগরণ এ প্রতিক্রিয়া রোধ করতে সমর্থ হলো না কেন দ্বিতীয় বক্তৃতায় তার উত্তর দিতে চেষ্টা করা হবে।
আমরা দেখলাম ওহাবী প্রভাবে এদেশের মুসলমানদের একটি বিশেষ চেতনা লাভ হলো। এ আন্দোলনে তাদের কোনো উপকার যে না হয়েছে তা নয়– এর ফলে ভাববিলাসিতা থেকে কিছু উদ্ধার তারা পেয়েছে, কিছু সঘবদ্ধও তারা হয়েছে। কিন্তু আদর্শ হিসাবে এর দুর্বলতা এইখানে যে এ অতীতের ব্যবস্থার দিকে যাওয়াই সব চাইতে বড় কাজ মনে করে সেই ব্যবস্থাই এর কাছে চিরন্তন ধর্ম। বলা বাহুল্য এ মত সর্বপ্রকার চিন্তার সম্প্রসারণের বিরোধী; সমস্ত রকমের নতুন পরীক্ষা সন্দেহের চোখে দেখা এর প্রকৃতি। এ মত যে উন্নতিকামী জাতীয়তাবাদী আধুনিক মুসলিম জগতে বর্জিত হচ্ছে তা বুঝতে পারা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের মুসলমান একে বর্জন করতে পারছে না তার নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে চেতনা তার এ-মতের বর্জনের পথে বাধা হচ্ছে।
এই দশা থেকে এদেশের মুসলমান কি মুক্তি পাবে না, নানা দিক থেকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এইখানেই তার দৃঢ়স্থিতি হবে! এর সদুত্তর নির্ভর করছে অনেকগুলো ব্যাপারের উপরে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বক্তৃতায় সে-সবের আলোচনার চেষ্টা হবে।
২৬ মার্চ, ১৯৩৫