মুসনাদ প্রণয়ন

মুসনাদ প্রণয়ন

তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথম ভাগেই মুসনাদ নামে হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ‘মুসনাদ’ বলা হয় কোন ধরনের গ্রন্হকে?

******************************************************

মুহাদ্দিস এক একজন সাহাবীর প্রসঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে সমস্ত হাদীসকে এক সঙ্গে উল্লেখ করেন, তাহা সহীহ কি সহীহ নয় তাহার কোন পার্থক্য করেন না এবং হাদীসসমূহের বিষয়বস্তুও হয় সম্পূর্ণ বিভিন্ন। এই ধরনের গ্রন্হেই মুসনাদ বলা হয়।

[********************]

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মুহাদ্দিস হযরত আবূ বকর (রা)-এর নাম উল্লেখ করেন। অতঃপর তাঁহার নিকট হইতে বিভিন্ন বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হইয়াছে ও বিভিন্ন সনদের সূত্রে এই মুহাদ্দিস পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তাহার সমস্ত হাদীসই এক স্থানে লিপিবদ্ধ করা হয়। ইহার পর হযরত উমর (রা)-এর নাম আসিল এবং তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত যাবতীয় হাদীসকে এক স্থানে ও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেক করা হইল। এইভাবে সকল সাহাবীর নামের পরে তাঁহার বর্ণিত ও বিভিন্ন সনদের সূত্রে গ্রন্হাকারে প্রাপ্ত সমস্ত হাদীসই একস্থানে সংকলিত করা হইল।

[********************] তৃতীয় শতকের শুরুতে এই ধরনের হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত মুসনাদ গ্রন্হসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ (১) মুসনাদে উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসা (মৃঃ ২১৩ হিঃ), (২)মুসনাদুল হুমাইদী (মৃঃ ২১৯ হিঃ), (৩) মুসনাদে মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ (মৃঃ ২২৮ হিঃ), (৪) মুসনাদ ইসহাক ইবনে রাওয়াই (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), (৫) মুসনাদ উসমান ইবনে আবূ শায়বাহ (মৃঃ ২৩৯ হিঃ), (৬) মুসনাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৩১ হিঃ), (৭) মুসনাদ ইবনে হুমাইদ (মৃঃ ২৪৯ হিঃ), (৮) আল-মুসনাদুল কবীর- ইয়াকুব ইবনে শায়বাহ (মৃঃ ২৬২ হিঃ), (৯) মুসনাদ মুহাম্মদ ইবনে মাহদী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ), (১০) আল-মুসনাদুল কবীর- বাকী ইবনে মাখলাদুল কুরতাবী (মৃঃ ২৭২ হিঃ), (১১) মুসনাদ আবূ দায়ূদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)।

কিন্তু হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এই পদ্ধতি দোষমুক্ত নয়। ইহাতে হাদীসের সত্যতা, সনদের বিশ্বস্ততা ও উহার মর্যাদা সস্পষ্ট ধারণা করা কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এইরূপ হাদীস হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু মঙ্গল নিহিত আছে তাহা অস্বীকার করা যায় না। ইহার ফলে প্রথমতঃ রাসূলে করীম (ﷺ)- এর হাদীসসমূহ অন্যান্য বর্ণনা হইতে আলাদাভাবে পাঠ করার সুযোগ হয়। দ্বিতীয়ত একজন সাহাবীর নিকট হইতে কতজন লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা স্পষ্টভাবে জানা যায়। এমনও হইতে পারে যে, একটি হাদীসের বিশেষ কোন সনদ সূত্র হয়তো দুর্বল; কিন্তু উহারই অপর এক বর্ণনা সূত্র হয়তো নির্দোষ ও গ্রহণযোগ্য। পরিণামে এই দূর্বল সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিও নির্ভরযোগ্য সূত্রে সমর্থনে সহীহরূপে বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্য হইতে পারে।

[********************]

তবে একথাও মনে করা যায় না যে, মুসনাদ-প্রণেতা মুহাদ্দিসগণ হাদীস নামে যাহাই পাইয়াছেন, নিতান্ত অন্ধের ন্যায় কিংবা ‘অন্ধকারে কাষ্ঠ সংগ্রহকারীর’ মত তাহাই সাহাবীর নামের সঙ্গে যুক্ত করিয়া দিয়াছেন। বস্তুত এইরূপ ধারণা করাই ভিত্তিহীন এবং অনুচিত। কেননা তারা প্রত্যেকটি হাদীসের যথার্থতা প্রাণপণে যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। সেইজন্য গভীর সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যে তারা দেশের পর দেশ সফর করিয়াছেন এবং তাঁহাদের সমগ্র জীবন উহার সংগ্রহ যাঁচাই-পরীক্ষা ও ছাটাই-বাছাই করার কঠিন ও কঠোরতম কাজের মধ্যে দিয়াই অতিবাহিত করিয়াছেন। মুসনাদ গ্রন্হের এমন অনেক প্রণেতাই আছেন, যাঁহারা মূল হাদীসের ও উহার সনদের যথাযথ যাচাই না করিয়া একটি হাদীসও গ্রহণ করেন নাই। অনেক মুসনাদ গ্রন্হে আবার ফিকাহ প্রণয়ন রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক সাহাবীর হাদীসসমূহকে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে বাকী ইবনে মাখলাদ প্রণীত আল মুসনাদুল কবীর-এর নাম উল্লেখ্য। আবার কেহ কেহ প্রত্যেকটি হাদীসকে বিভিন্ন বর্ণনা সূত্র ও বিভিন্ন বর্ণনাকারীর উল্লেখসহ সজ্জিত করিয়াছেন।

[********************]

এই পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

শেষ পর্যন্ত হাদীসের কোন কোন ইমামের ইচ্ছা হইল কেবলমাত্র নবী করীম (ﷺ) সম্পর্কিত হাদীসসমূহ স্বতন্ত্র করিয়া গ্রন্হবদ্ধ করার । এই সময় উবাইদুল্লাহই বনে মুসা আবসী কূফী, মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ বরসীফ, আসাদ ইবনে মুসা উমাভী ও মিসরে অবস্থানকারী নয়ীম ইবনে হাম্মাদ খাজায় এক-একখানি করিয়া মুসনাদ প্রণয়ন করেন। তাঁহাদের পরবর্তীকালীন হাদীসের ইমামগণও তাঁহাদেরই পদাংক অনুসরণ করিয়া চলিলেন। হাদীসের হাফেজগণের একজন ইমামও এমন পাওয়া যাইবে না যিনি তাঁহার সংগৃহীত হাদীসসমূহকে ‘মুসনাদ’ গ্রন্হ প্রণয়ন রীতিতে গ্রন্হাবদ্ধ করেন নাই। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, উসমান ইবনে আবূ শায়াবাহ এবং তাঁহাদের ন্যায় অন্যান্য বড় মুহাদ্দিসগণও এই রীতি অবলম্বন করিয়াছেন। এবং কোন কোন হাদীস সংকলক অধ্যায়-সংযোজন এব‌ং মুসনাদ-নীতি উভয়কেই অনুসরণ করিয়া হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন- যেমন আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বাহ।

[********************]

পূর্বে যেমন বলা হইয়াছে, অধ্যায় হিসাবে গ্রন্হ প্রণয়ন এবং মুসনাদ রীতি অনুযায়ী হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রহিয়াছে। অধ্যায় হিসাবে গ্রন্হ প্রণয়ন হয় বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীস সজ্জায়ন, এক এক বিষয়ের হাদীস এক একটি অধ্যায়ে সজ্জিত করা। যেমন নামায সম্পর্কিত হাদীস এক অধ্যায়ে, রোযা সম্পর্কিত হাদীস রোযার অ্ধ্যায়ে, তাকওয়া পরহিযগারী সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসূমহ স্বতন্ত্র এক অধ্যায়ে সংযোজিত করা। পক্ষান্তরে মুসনাদ প্রণয়ন রীতি এই হয় যে, প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত সমস্ত হাদীস বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রিত করা- তাহা নামায সম্পর্কে হউক, রোযা সম্পর্কে হউক, কি তাকওয়া পরহেযগারী সম্পর্কিত হাদীসই হউক না কেন। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হইতে যত হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে, তাহা যে কোন বিষয় সম্পর্কেই হউক না কেন একত্রিক করিয়া ‘মুসনাদে আবূ বকর সিদ্দীকি’ শিরোনামের অধীন লিপিবদ্ধ করা মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়নের রীতি। এই উভয় রীতির মধ্যে পার্থক্য কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রামাণ্যতার দৃষ্টিতে বিচার করিলেও এই উভয় রীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হইবে। অধ্যায় রীতিতে সংকলিত হাদীস-গ্রন্হের প্রথমে থাকে সেইসব বর্ণনা যাহা আকীদা বা আমলের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য তারা সাধারণ প্রমাণ ও দলীল হিসাবে উল্লেখযোগ্য হাদীসসমূহই সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে একত্রিত করেন, ইহার বর্ণনাকারী যে সাহাবীই হউন না কেন। কিন্তু মুসনাদ প্রণেতাদের একমাত্র কাজ হইতেছে সকল প্রকার হাদীসসমূহ সংগ্রহ, সন্নিবিষ্ট ও একত্রিত করিয়া দেওয়া। এই কারণে মূল হাদীস সহীহ কি অসহীহ তাহার বিচার না করিয়াই তারা হাদীসসমূহ একত্র করিয়া দেন।

অধ্যায় ও মুসনাদ রীতির মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী উভয় রীতিতে হাদীস সংযোজিত করা ও উহার শিরোনাম নির্ধারণের কায়দা দেখাইয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেনঃ ‘মুসনাদ’ রীতিতে হাদীস সংগ্রহ করা হইলে শিরোনাম এইরূপ হইবেঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক কর্তৃক নবী করীম (ﷺ) হইতে বর্ণিত সমস্ত হাদীস বর্ণনা বা উল্লেখ।

এবং ইহার অধীন হযরত আবূ বকর কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীসই উদ্ধৃত হইবে।

ইহার পর দ্বিতীয় শিরোনাম হইবেঃ

******************************************************

কায়স ইবনে আবূ হাযেম হযরত আবূ বকর (রা) হইতে যেসব হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন তাহার উল্লেখ।

এইখানে গ্রন্হকারকে এমন সমস্ত হাদীসই উল্লেখ করিতে হয়, যাহা কায়সের সূত্রে হযরত আবূ বকর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তাহা সহীহ কি অসহীহ সে বিচার করার প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু অধ্যায় হিসাবে হাদীসগ্রন্হ সংকলন করা হইলে প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন তখন শিরোনাম হইবেঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (ﷺ) হইবে তাহারাত নামায কিংবা ইবাদতের অপর কোন বিষয়ে যাহা সহীহরূপে প্রমাণিত ও বর্ণিত হইয়াছে, তাহার উল্লেখ।

[********************]

এই পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে ইবনে হাজার আসকালানী অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অধ্যায় হিসাবে, হাদীস- গ্রন্হ প্রণয়নের রীতি এই যে, তাহাতে কেবল সেই সব বর্ণনার উল্লেখ করা হইবে, যাহা প্রমাণ বা দলীল হইবার যোগ্য। পক্ষান্তরে যাঁহারা মুসনাদ প্রণয়ন করেন, তাঁহাদের পদ্ধতি আলাদা হয়। কেননা তাঁহাদের আসল উদ্দেশ্যই হয় কেবলমাত্র হাদীসের বর্ণনাসমূহ সন্নিবেশিত করিয়া দেওয়া।

[********************]

মুসনাদ গ্রন্হসমূহ মূলতঃ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহের এক বিরাট স্তুপ। তাহা হইতে হাদসের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা করা খুব সহজ হয়। এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের উদ্দেশ্যই হয় এক এক সূত্রে বর্ণিত সমস্ত হাদীস একত্রিত করা, যেন বর্ণিত কোন হাদীসই অসংকলিত থাকিয়া না যায়। সহীহ গায়ের-সহীহ নির্বিশেষে সমস্ত বর্ণিত হাদীস যখন একত্রিত ও এক স্থানে সংকলিত পাওয়া যায় তখন প্রত্যেকটি হাদীস বিজ্ঞানে পারদর্শী ও সূক্ষ্ম বিচারক সমালোচক সমালোচনার কষ্টিপাথরে প্রত্যেকটি বর্ণনাকে যাঁচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন এবং কোন হাদীসটি সহীহস কোনটি নয়, কোন সূত্রটি নির্দোষ, কোনটি দোষমুক্ত, তাহা বিচার করিতে পারেন। এমনকি এক একটি হাদীস কতবার এবং কোন কোন সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে তাহার মধ্যে কোন কোন সূত্রে কি কি শব্দে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে, আর কোন সূত্রের কি অবস্থা, এই সব কিছু নির্ধারণ করা এই ‘মুসনাদ’ গ্রন্হের ভিত্তিতেই সম্ভব এবং সহজ।

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী লিখিয়াছেনঃ

ইসলামে এই মুসনাদ গ্রন্হসমূহে যাহা গ্রন্হাবন্ধ হইয়াছে, তাহাতে সাহাবাদের বর্ণিত হাদীসসমূহই সংযোজিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে বর্ণনা সূত্রসমূহ নির্ভরযোগ্য আছে, আর দোষমুক্তও রহিয়াছে। যেমন, উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসার মুসনাদ এবং আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে দাউদ তায়ালিসীর মুসনাদ। বস্তুত ইসলামে এই দুইজন মুহাদ্দিসই সর্বপ্রথম বর্ণনাকারী ব্যক্তির ভিত্তিতে মুসনাদ প্রণয়ন শুরু করেন।

[কাহারো মতে সর্বপ্রথম মুসনাদ রচনা করেন দাউদ তায়ালিসী

[********************] এই দুইজনের পরে আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে ইবরাহীম হানযালী, আবূ খায়সামা, জুহাইর ইবনে হারব ও উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর কাওয়ারীরী মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। অতঃপর ব্যক্তির ভিত্তিতে মুসনাদ প্রণয়নের কাজ বহু হইয়াছে। আর এইভাবে হাদীস সংযোজনে দোষযুক্ত ও নির্দোষ হাদীস-সূত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নাই।

[********************]

হাকেম মুসনাদ গ্রন্হ সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগা করিয়াছেন। সব কয়খানি মুসনাদ গ্রন্হ সম্পর্কে তিনি এইরূপ ধারণা প্রকাশ করিয়াছেন, অবশ্য অধিকংশ গ্রন্হই যে এই পর্যায়ের, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু সব কয়টি মুসনাদ গ্রন্হ এই দোষে দোষী নহে। কোন কোন মুসনাদ-প্রণেতা হাদীস চয়নে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া স্বীয় গ্রন্হে সংযোজিত করিয়াছেন, তাহা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যেমন আল্লামা সুয়ুতী ইসহাক ইবনে রাহওয়াই সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ জুরয়া আর-রাযী যেমন উল্লেখ করিয়াছেন, ইসহাক যে সাহাবীর বর্ণিত যে হাদীস উত্তম ও গ্রহনযোগ্য কেবল তাহাই সেই সাহাবীর নামে উল্লেখ করিয়াছেন।

[********************]

মুসান্নাফ আবূ বকর ইবনে শায়বাহ

এই পর্যায়ে ইমাম আবূ বকর ইবনে শায়বার হাদীস গ্রন্হাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার সংকলিত ‘মুসনাদ’ ও মুসন্নাফ’ তৃতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্হ। ‘মুসান্নাফ’ এক অতুলনীয় গ্রন্হ বলিয়া মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা তাঁহাদের দৃষ্টিতে এক গৌরবের বস্তুও বটে। হাফেজ ইবনে কাসীর এতদূর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসান্নাফ’ এমনই একখানি গ্রন্হ যে, এইরূপ একখানি গ্রন্হ কেহ কখনো সংকলন করেন নাই, না ইহার পূর্বৈ না ইহার পরে।

[********************]

হাফেজ ইবনে হাজম আন্দালূসী ইহাকে ‘মূয়াত্তা ইমাম মালিক’ হইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন গ্রন্হ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।

[********************] বস্তুত সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ- সিহাহ সিত্তার এই প্রখ্যাত গ্রন্হত্রয়ে ‘মুয়াত্তা’ অপেক্ষা বেশী হাদীস আবূ বকর ইবনে শায়বার এই ‘মুসান্নাফ’ হইতে গ্রহণ করা হইয়াছে।

এই গ্রন্হ কেবলমাত্র ‘আহকাম’ সম্পর্কিত হাদীস গৃহীত হইয়াছে- যাহা হইতে ফিকাহর কোন না কোন মাসায়ালা প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাহাতে যেমন বিশেষ কোন ফিকাহকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় নাই, তেমনি কোনটির প্রতি অধিক গুরুত্বও আরোপ করা হয় নাই। বরং হিজায ও ইরাক অঞ্চলের হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট যত হাদীসই পাওযা গিয়াছে তাহা সবই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নীতিতে এই গ্রন্হে গ্রহণ করা হইয়াছে। ফলে এই গ্রন্হ হইতে প্রত্যেক ফিকাহবিদই নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে নিজের মত গ্রহণ ও উহার অনুকূলে হাদীসের ভিত্তি বা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারেন।

এই গ্রন্হের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে প্রত্যেকটি ‘হাদীস নববী’র সঙ্গে সঙ্গে সাহাবা ও তাবেয়ীনের কথা ও ফতোয়াও উদ্ধৃত হইয়াছে। ফলে প্রত্যেকটি হাদীস সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীদের কি মত ছিল, তাহা সহজেই জানা যাইতে পারে। ‘কাশফুজ্জুনুন’ প্রণেতা এই গ্রন্হ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহা এক বিরাট গ্রন্হ। ইহাতে তাবেয়ীদের ফতোয়া, সাহাবীদের বানী ও রাসূল (ﷺ)- এর হাদীসসমূহ মুহাদ্দিসদের রীতি অনুযায়ী সনদ সহকারে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে এবং ফিকাহর কিতাব সংকলনের ধারা অনুযায়ী ইহার অধ্যায় ও পরিচ্ছেদসমূহ সজ্জিত করা হইয়াছে।

[********************]

ইবনে আবূ শায়বার বিশিষ্টি ছাত্র শায়খুল ইসলাম বাকী ইবনে মাখলাদ যখন এই গ্রন্হখানা লইয়া আন্দালুসিয়া গমন করেন, তখন কোন মহলে ইহার বিরোধিতা করিলেও তথাকার শাসনকর্তা মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইহার আদ্যোপান্ত শ্রবণ করেন এবং রাজকীয় গ্রন্হালয়ের ভারপ্রাপ্তকে এই বলিয়া নির্দেশ দিলেনঃ

******************************************************

ইহা, এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্হ যে, আমাদের গ্রন্হালয়ে ইহার বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। অতএব উহার অনুলিপি গ্রহণের ব্যবস্থা কর।

[********************]

মুসনাদ ইমাম আহমদ

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সংকলিত হাদীস গ্রন্হ- মুসনাদ আহমদ- এই শতকের এক বিরাট ও অপূর্ব অতুলনীয় গ্রন্হ। ইহাকে হাদীস শাস্ত্রের বিশ্বকোষ বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। পূর্ববতী ও পরবর্তীকালের সকল পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ ইহার অসাধারণ মূল্য ও গুরুত্ব উদাত্ত কণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। তারা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসনাদ আহমদ বুখারী-মুসলিম-এর পরে হাদীসরে সর্বাধিক সমন্বাকারী ও বিশুদ্বতমগ্রন্হ। মুসলমানের ব্যবহারিক জীবনের দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সমস্ত হাদীস এই বিরাট গ্রন্হে সংকলিত ও লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে।

[********************]

ইমাম আহমদ (র) দীর্ঘদিনের অপরিসীম ও অবিশ্রান্ত সাধনা ও অভিনিবেশের ফলে এই গ্রন্হখানি প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি হাদীস অধ্যায়নকাল হইতেই হাদীস মুখস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে উহা লিখিয়া লইতে শুরু করেন। বয়সের হিসাবে তাঁহার এই কাজ শুরু হয় তখন, যখন তাঁহার বয়স মাত্র ১৬ বৎসর।

[********************] অতঃপর সমস্ত জীবন ভরিয়া তিনি কেবলমাত্র এই কাজই করিয়াছেন। তাহার জীবনের লক্ষ্য এই হাদীস গ্রন্হখানিকে সর্বতোভাবে ব্যাপক ও সমস্ত প্রয়োজনীয় হাদীসের আকর করিয়া তোলার দিকে। হাদীসসমূহ তিনি আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় লিখিয়া রাখিতেন। শেষ পর্যন্ত উহা এক বিরাট গ্রন্হের পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হয়।

কিন্তু ইমাম আহমদের চরম বাসনা ও সাধনা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাহাঁর আয়ূষ্কাল খতম হইয়া যায়। তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শ্রবণ করিয়াই সর্বপ্রথম যে কাজ করিলেন তাহা এই যে, তাঁহার সন্তান ও পরিবারের লোকজনকে একত্রিত করিয়া হাদীসের এই বিরাট সংকলনটি আদ্যোপান্ত পাছ করিয়া শুনাইয়া দিলেন এবং উহাকে স্বতন্ত্র ও পরিচ্ছন্নভাবে লিখিয়া দেন। কিন্তু ইমাম আহমদ (র) তাঁহার সারা জীবনের সাধনার ফলে সংকলিত হাদীসসমূহকে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া গ্রন্হাকারে সজ্জিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া যাইতে পারেন নাই।

[********************]

শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসনাদ আহমদ যদিও এই মহান সম্মানিত ইমামের সংকলিত হাদীসগ্রন্হ, কিন্তু উহাতে দুইজন লোক পরে আরও অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। একজন তাঁহার পুত্র আবদুল্লাহ এবং অপরজন আবদুল্লাহ হইতে এই গ্রন্হের বর্ণনাকারী আবূ বকর আল-কাতিয়ী।

[********************]

এই গ্রন্হে মোট কত হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, এ সম্পর্কে মুহাদ্দিস ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসনাদে আহমদ’ গ্রন্হে মূলত ত্রিশ হাজার হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। আর তাঁহার পুত্রের সংযোজনের ফলে শেয় পর্যন্ত উহার সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে চল্লিশ হাজার হাদীস।

[********************]

কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহার মোট হাদীসের সংখ্যা হইতেছে চল্লিশ হাজার, কিন্তু পুনারবৃত্তি বাদ দিলে ইহার সংখ্যা দাঁড়ায় ত্রিশ হাজার।

[********************]

ইমাম আহমদ এই গ্রন্হখানিকে ঠিক মুসনাদ রীতিতে সংকলিত করিয়াছেন। তিনি এক-একজন সাহাবী (রা)-এর নাম উল্লেখ করিয়াছেন। তাহার পর সেই সাহাবী কর্তৃক নবী করীম (ﷺ)-এর যত হাদীস বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পর পর উল্লেখ করিয়াছেন। এই হাদীসসমূহের উল্লেখ শেষ হইয়া গেলে তিনি অপর এক সাহাবী এবং তাঁহার বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি ইহাকে বিষয়বস্তু দৃষ্টিতে সজ্জিত করেন নাই। ফলে ইহাতে হদ সম্পর্কে উদ্ধৃত একটি হাদীসের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যাইবে ইবাদত ও পরকালের ভয় সম্পর্কিত হাদীস।

[********************]

এই গ্রন্হে মাত্র আঠারখানি মুসনাদ উল্লেক করা হইয়াছে। প্রথমে জান্নাতের সসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মুসনাদ উল্লেখ করা হইয়াছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আহলে বায়ত-এর মুসনাদ, তৃতীয় পর্যায়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, চতুর্থ আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের মুসনাদ, পঞ্চম আবদুল্লাহই ইবনে আমর ও আবূ মারমাসা, ষষ্ঠ হযরত আব্বাস, সপ্তম আবূ হুরায়রার মুসনাদ, অষ্টম আনাস ইবনে মালিক, নবম আবূ সাঈদ খুদরীর মুসনাদ, দশম জবির ইবনে আবদুল্লাহর মুসনাদ, একাদশ মক্কী সাহাবীদের মুসনাদ, দ্বাদশ মাদানী সাহাবীদের মুসনাদ, ত্রয়োদশ সুফফার অধিবাসী সাহাবী চতুর্দশ বসরার অধিবাসী সাহাবী, পঞ্চাদশ সিরিয়ার অধিবাসী সাহাবী, ষোড়শ আনাসর ও সপ্তাদশ হযরত আয়েশার মুসনাদ- মোটামুটি মুসনাদ গ্রন্হখানি একশত বাহাত্তর অংশে বিভক্ত।

[********************]

ইমাম আহমদ এই গ্রন্হখানিকে সহীহ হাদীসসমূহের এক অতুলনীয় আকররূপে সজ্জিত করিতে চাহিয়াছিলেন। হাদীস চর্চকারীদের মধ্যে কোন হাদীস সম্পর্কে মতবিরোধের সৃষ্টি হইলে এই গ্রন্হই যেন উহার চূড়ান্ত মীমাংসাকারী হইতে পারে; হাদীসসমূহের সনদ সম্পর্কে ইহা এক নির্ভরযোগ্য দস্তাবেজ হইতে পারে, ইহাই ছিল তাঁহার ঐকান্তিক কামনা।

ইমাম আহমদের পুত্র আবদুল্লাহ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি গ্রন্হ প্রণয়ন অপছন্দ করেন কেন? অথচ আপনি নিজেই মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন?

ইহার জওয়াবে ইমাম আহমদ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হখানিকে ‘ইমাম’ স্বরূপ প্রণয়ন করিয়াছি। লোকদের মধ্যে যখন রাসূলে করীম (ﷺ)-এর কোন সুন্নাত বা হাদীস সম্পর্কে মতভেদ হইবে তখন যেন তাহারা ইহার নিকট হইতে চূড়ান্ত মীমাংসা লাভ করিতে পার।

[********************]

ইমাম আহমদের ভ্রাতুস্পুত্র হাম্বল ইবনে ইসহাক বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার সম্মানিত চাচা ইমাম আহমদ (র) আমাকে ও তাঁহার দুই পুত্র সালেহ ও আবদুল্লাহকে একত্রিত করিয়া আমাদের সম্মুখে এই মুসনাদ গ্রন্হখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া শুনাইয়াছেন। আমাদের ব্যতীত অপর কেহ গ্রন্হখানি তাঁহার মুখে সম্পর্ণ শ্রবণ করিতে পারে নাই। তিনি আমাদিগকে বলিয়াছেন, ‘এই গ্রন্হখানিকে আমি সাড়ে সাত লক্ষেরও অধিক সংখ্যক হাদীসের বর্ণনা হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া সংকলিত ও প্রণয়ন করিয়াছি। রাসূলে করীম (ﷺ)-এর যে হাদীস সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ হইবে, সেই হাদীস পাওয়ার জন্যই তোমরা এই কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর (অর্থাৎ সেই হাদীসটি এই কিতাবে তালাশ ও সন্ধান কর)। ইহাতে যদি তাহা পাওয়া যায়, তবে তো ভালই, আর পাওয়া না গেলে উহাকে প্রামাণ্য বা প্রতিষ্ঠিত হাদীস মনে করা যাইবে না।

[********************]

উপরিউক্ত দীর্ঘ উদ্ধৃতির শেষাংশে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উক্তিটি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। ইমাম যাহবী ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদের এই কথাটি সাধারণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণীয়। অন্যথায় মুসলিম, বুখারী, সুনান গ্রনহাবলী ও অন্যান্য জুজ গ্রন্হে আমরা এমন সব সহীহ হাদীস পাই, যাহা মুসনাদ গ্রন্হে নাই।

[********************]

হাফেজ শামসুদ্দিন জজরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ (র) তাঁহার এই কথা দ্বারা হাদীসসমূহের মূলের দিকেই ইশারা করিতে চাহিয়াছেন। আর ইহা সত্য কথা। কেননা সম্ভবত এমন কোন হাদীসই নাই, যাহার ‘মূল’এই মুসনাদ গ্রন্হে উল্লিখিত হয় নাই।

[********************]

ইমাম আহমদ সংকলিত হাদীস গ্রন্হখানি এই উচ্চ মর্যাদাই লাভ করিতে পারিত; কিন্তু তিনি নিজে ইহার সংকলন কার্য সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই বলিয়া বহু সহীহ হাদীস এবং বহু সংখ্যক সাহাবীর বর্ণনা ইহার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে নাই। হাফেজ ইবনে কাসীর এই সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ (র) সংকলিত এই মুসনাদ গ্রন্হখানি হাদীস বর্ণনা সূত্রের বিপুলতাও রচনাসৌকর্যে অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও ইহা হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস সম্পূর্ণ বাদ পড়িয়া গিয়াছে। বরং বলা হয় যে, প্রায় দুইশত সাহাবীর বর্ণিত কোন হাদীসই ইহাতে উদ্ধৃত হয় নাই, অথচ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হে তাঁহাদের বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।

[********************]

কিন্তু এইসব সত্ত্বেও মুসনাদে আহমদের বৈশিষ্ট্য কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। উহাতে যে স্বকপোলকল্পিত নিজস্ব রচিত ও অমুলক একটি হাদীসও নাই, তাহা সর্বসম্মত সত্য। ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখিয়াছেন, এই ধরনের একটি হাদীসও মুসনাদ গ্রন্হে নাই।

[********************] পরন্তু সহীহ হাদীসসমূহের এতবড় সমষি।ট দ্বিতীয়টি নাই। হাফেজ নূরুদ্দীন হায়সামী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সহহি হাদীস হিসাবে মুসনাদে আহমদ অপর হাদীস গ্রন্হসমূহের তুলনায় অধিকতর সহীহ।

[********************]

ইমাম আহমদ তাঁহার নিজের মানদণ্ডে ওযন করিয়া হাদীসসূহ সংকলন করিয়াছেন। মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ তাঁহার গ্রন্হে স্বীয় শর্তানুযায়ী বিশেষ সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করিবেন না বলিয়া সিদ্ধা্ন্ত করিয়াছিলেন।

[********************]

পূর্বেই বলিয়াছি, ইমাম আহমদ নিজের জীবনে এই গ্রন্হখানিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। এই কারণে ইহাতে ইমামপূ্রত আবদুল্লাহ এবং হাফেজ আবূ বকর আল-কাতীয়ী কর্তৃক সংযোজিত বহু হাদীস পরিদৃষ্ট হইতেছে।

আল্লামা আহমাদুল বান্না এই বিরাট গ্রন্হখানির পূর্ণ সম্পাদনা এবং অধ্যায় ও বিষয়বস্তু দৃষ্টিতে পূনর্বিন্যাস করিয়াছেন। সম্প্রতি উহার বৃহদায়তন ২১ খণ্ডগ্রন্হ মিসর হইতে ‘ফতহুল রব্বানী’ নামে প্রকাশিত হইয়াছে এবং উহার সহিত তাঁহারই কৃত বিশদ ‘শারহ’ বুলুগুল আমানী’ নামে শামিল রহিয়াছে। আমাদের মতে বর্তমানে ইহা এক বিরাট তুলনাহীন হাদীস সম্পদ।

আহমদুল বান্না মুসনাদের হাদীসসমূহ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

‘মুসনাদ’ গ্রন্হের হাদীস সমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া আমি দেখিলাম যে, ইহাতে মোট ছয় প্রকারের হাদীস রহিয়াছে। প্রথম আবূ আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ বর্ণিত হাদীস, যাহা তিনি স্বয়ং ইমামের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন। মূলত ইহাই মুসনাদে আহমদ এবং ইহা বর্তমান গ্রন্হের চার ভাগের তিন ভাগ।

দ্বিতীয়, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন। ইহার সংখ্যা অত্যন্ত কম।

তৃতীয়, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ তাঁহার পিতা ছাড়া অপরাপর মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন, তাহা যাওয়ায়িদে আবদুল্লাহ’ বা ‘আদুল্লাহ সংযোজন’ নামে পিরিচিত। এই হাদীসের সংখ্যা বিপুল।

চতৃর্থ, যেসব হাদীষ আবদুল্লাহ নিজে তাঁহার পিতার সম্মুখে পাঠ করিয়াছেন ও তাঁহাকে শুনাইয়াছেন; কিন্তু তিনি তাঁহার পিতার নিকট হইতে শুনেন নাই- ইহার সংখ্যাও কম।

পঞ্চম, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ তাঁহার পিতার নিকট পাঠ করেন নাই, তাঁহা নিকট হইতে শুনিতেও পান নাই, বরং যাহা তিনি তাঁহার পিতার গ্রন্হে তাঁহার পিতার স্বতস্ত লিখিত অবস্থায় পাইয়াছেন- ইহার সংখ্যাও কম।

ষষ্ঠ, যেসব হাদীস প্রখ্যাত ও সর্ব জনমান্য মুহাদ্দিস হাফেজ আবূ বকর আল কাতায়ী কর্তৃক আবদুল্লাহ এবং তাঁহার পিতা ইমাম আহমদ ব্যতীত অপরাপর মুহাদ্দিসের নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন-ইহার সংখ্যা সর্বাপেক্ষা কম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *